মনে পড়ল ষ্টেশন মাষ্টারের মুখের ছবি। যখন আমি তাকে আমার গন্তব্যস্থলের কথা বলেছিলাম, তখন তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তিনি যেন একটু ভীত হয়ে পড়েছিলেন। তাই বারবার অনুরোধ করেছিলেন শেষ ট্রেনটিতেই যেন আমি ফিরে, যাই। কিন্তু হরিনারায়ণ যদি সেই মুহূর্তে এসে হাজির না হতো বা একটু দেরি করতো তাহলে আমি কলকাতায় ফিরে যেতাম।
হরিনারায়ণের যে সাহস আছে এবং সে বর্তমান ঘটনাবলীর সঙ্গে যে অভ্যস্ত, তার আচার আচরণে বুঝতে পারা যায়। নিরুদ্বেগ চিত্তে সে গাড়ী হাঁকিয়ে চলেছে। যে গাড়ীর বাহন দুটি গরু হয়েও যেন গরু নয়। যেন ড্রাগন-গরু। সাধারণ গরুর চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী। চোখগুলো লাল এবং অস্বাভাবিক রকমের বড় বড়।
নিঃশ্বাসে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আগুনের ফুলঝুরি।
গেটের সামনে গাড়ীটা পৌঁছবামাত্রই কড় কড় ক্যাঁচ ক্যাঁচ ঘড় ঘড় শব্দ তুলে গেটটা খুলে গেল। মনে হল, গেটটা বহুদিন যাবৎ খোলা হয়নি অথবা জরা-জীর্ণ গেটটি শেষ অবস্থায় এসে হাজির হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় গেটটিকে কে যে খুলে দিল তা দেখতে পেলাম না। নীলাভ আলোটি তখনও জ্বলছিল কিন্তু সেই আলোয় কোন মানুষকে দেখতে পেলাম না, গেটটি যেন আপনা হতেই খুলে গিয়ে গাড়ীটিকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিল।
গাড়ীটি ফটক পেরিয়ে বাড়ীর সামনে দাঁড়াতেই আবার কানে এল সেই অবরুদ্ধ কান্নার স্বর, এত তীব্র আর এত তীক্ষ্ণ যে কোন মানুষ অমনভাবে কাঁদতে পারে তবু বিশ্বাস হয় না। আমি কেমন যেন উন্মনা হয়ে পড়লাম। হরি সম্ভবতঃ আমার মনের কথা বুঝতে পেরে একলাফে গাড়ী থেকে নেমে বাড়ীর ভিতর ঢুকে গেল।
সেই তীক্ষ্ণ তীব্র কান্নার রেশ আমার কানে বাজছে আর কান্নার সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার হৃৎপিণ্ডটা ধ্বক্ ধ্বক্ করে লাফিয়ে উঠছে বেশ বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার বুক থেকে হৃৎপিণ্ডটাকে টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যেতে চাইছে। আমি দু’হাত দিয়ে কান দুটোকে চেপে ধরলাম। কিন্তু তা সত্বেও কান্নার শব্দকে প্রতিহত করতে পারলাম না।
.
গাড়ীর গরু দুটি ছাড়া আর কোন প্রাণীকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। অথচ আমার মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার চোখ আমার দিকে লোলুপ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে। যাদের আমি দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তারা আমাকে লক্ষ্য রাখছে। আমার প্রতিটি আচার আচরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে শিউরে উঠলাম। হরি বাড়ীর ভিতর চলে যাওয়ার পরই গরু দুটি মাথা ঘুরিয়ে আমাকে একদৃষ্টে নজর করছে। তাদের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে জিংঘাসার লালসা। লকলকে জিভ বেরিয়ে এসেছে ওদের মুখ থেকে। আগুনের ভাঁটার মত চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে হিংস্রতা। ওরা যেন আমাকে গিলে ফেলতে চাইছে ওদের দৃষ্টি দিয়ে। বুঝতে পারছি হয়তো যে কোনও মুহূর্তে গরু দুটো লাফ দিয়ে আমার ঘাড়ে পড়তে পারে। কিন্তু ওদের প্রভুকে হয়ত ওরা ভীষণ ভয় করে সেই জন্যেই ওরা সে সাহস পাচ্ছে না।
এমন সময় সেই কান্না থেমে গেল। হাত দুটো কান থেকে নামিয়ে এনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। উঃ কি দুঃসহ এই অমানুষিক কান্নার শব্দ! ভাবলেও শরীরের রক্ত শুকিয়ে যায়। কান্নার শব্দ থেমে যাওয়া মাত্রই গরু দুটি মুখ ঘুরিয়ে নিল আমার দিক থেকে। আমি আরও কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম।
হরি বেরিয়ে এল বাড়ীর ভিতর থেকে। হাসতে হাসতে বললে, এসো দাদা, ঘরটা ঠিকঠাক করে এলাম। জানোইতো নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে রয়েছি। সব কিছু নিজের হাতেই করতে হয়। তোমাকে উপরে নিয়ে যাওয়ার আগেই একবার ঘরটা দেখে এলাম, ঠিক আছে কি না! নেমে এসো−
আস্বস্ত হলাম হরিকে দেখে। হেসে বললাম, আরে না, না−ঠিক আছে। তোমাকে ব্যস্ত হ’তে হবে না। কথাটা বলতে বলতে আমি গাড়ী থেকে নেমে হরিকে অনুসরণ করলাম।
নিস্তেজ একফালি চাঁদ আকাশের এক কোনকে আলোকিত করার চেষ্টা করছিল বাড়ীটার ঠিক পিছন দিকটার আকাশে। এক লহমার জন্যে মনে হল নরকপুরীর যবনিকা উঠবার পূর্বমুহূর্তে যেন নেহাৎ করুণাবশতঃ ঐ একফালি চাঁদের এক টুকরো আলো ঠিকরে এসে পড়ছিল বাড়ীটার মাথায়। বাড়ীটাকে অতি প্রাচীন পোড়ো বাড়ী বলে আখ্যায়িত করলেই বোধ হয় ঠিক মানানসই হবে। যেন প্রকাণ্ড একটা হাঁ করে সব কিছুকে সে গিলে খেতে চাইছে।
চাঁদের ঐ অস্পষ্ট আলোয় বাড়ীটাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল। কেননা আমি গাড়ী থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই গেটের সেই নীলাভ আলোটি নিভে গিয়েছিল বলে।
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলাম। এই অন্ধকারে বাড়ীর ঐ অন্ধ-কূপের মধ্যে ঢুকতে যেন মনে সায় পেলাম না। একটু আগেই যে কান্নার শব্দ আমাকে ব্যাকুল ও ভীত করে তুলেছিল, সে কথা মনে হতেই হৃদ-স্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠল। মনে হল বাড়ীটার ভিতরে এমন কিছু আছে যা অমঙ্গলজনক। মানুষের পক্ষে শুভ নয়। কিন্তু অমঙ্গলের দোর গড়ায় এসে দাঁড়িয়ে এখন ও সব কথা ভেবে কি লাভ। এখন হাজার ইচ্ছা থাকলেও ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে আমার কাছে। সুতরাং আমাকে এগিয়ে যেতে হবেই। অথচ, অবাক হচ্ছি ভেবে হরি কত সহজ-স্বচ্ছন্দ গতিতে এগিয়ে চলেছে বাড়ীটার দিকে। ভেবে আরও আশ্চর্য হচ্ছি যে, হরি এই বাড়ীতেই থাকে। এবং নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করে নির্ভয়ে!
যাই হোক, মনটাকে শক্ত করে ফেললাম। হরি যদি থাকতে পারে তবে আমিই বা থাকতে পারবো না কেন! কিসের ভয়! জীবন্ত মানুষ আমি। মৃত-মানুষকে মানে অশরীরীকে ভয় করতে যাবো কোন্ দুঃখে!
আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। সতর্ক দৃষ্টি মেলে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে ভাল করে বাড়ীটার পরিস্থিতি সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে চাইলাম। না তেমন কিছু নজরে পড়ছে না। পাড়া গাঁয়ের রূপ যেমন হয় ঠিক তেমনিই পরিবেশ। কয়েকটা নারকেল আর তাল গাছ মাথা উঁচু করে বাড়ীটার এধারে ওধারে দাঁড়িয়ে। আর, এদিকে সেদিকে ভরা রয়েছে ঝোপ-ঝাড়। অন্ধকারের মধ্যে যতদূর চোখের দৃষ্টি চলে তার মধ্যে আর কোন বাড়ী চোখে পড়ল না। বাড়ীর পূব দিকটায় কয়েকটি বড় বড় গাছ। অন্ধকারে দৈত্যের মত রয়েছে দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ একটা কিছু দেখতে পেয়ে চক্কে উঠলাম। যে দিকটায় ঝোপ-ঝাড়ে ভরা, সেই ঝোপের মধ্যে থেকে যেন একজোড়া চোখ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। জন্তু-জানোয়ারের চোখ রাত্রে জ্বলে আমরা জানি। তবে কি কোন হিংস্র জন্ত ওঁৎ পেতে বসে রয়েছে ওখানে?
আমি নিঃসন্দেহ হওয়ার আশায় আর একবার তাকালাম কিন্তু সেই জ্বল-জ্বলে চোখ দুটি ধীরে ধীরে উপর দিকে উঠতে লাগল। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম−একটা প্রকাণ্ড ছায়া-মূর্তি মিলিয়ে গেল সামনের তাল গাছটাকে আশ্রয় করে।
চলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম, সম্বিৎ ফিরে এলো হরির কথায়−কি দেখছো দাদা! ওসব কিছু নয়। চলে এসো।
হয়তো কিছুই নয়। আমার চোখের ভুলও হতে পারে। কোন কথা না বলে পা বাড়ালাম হরিকে অনুসরণ করে। কিন্তু তবু যেন মনকে সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল শত শত অশরীরী দেহধারীরা যেন আমার আশে পাশে চলতে শুরু করেছে। তাদের চলার শব্দ এমনকি তাদের হিম শীতল নিঃশ্বাসের হাওয়া আমার গায়ে এসে লাগছে। বেশ বুঝতে পাচ্ছি গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। শীত শীত অনুভব করছি।
প্রায় মুহ্যমান হয়ে হরির সঙ্গে ঢুকলাম সেই প্রকাণ্ড বাড়ীটার মধ্যে। বাড়ীর মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলে উঠলো আলো। একেবারে অন্ধকারের মধ্যে এই আলো যেন মৃত সঞ্জীবনীর কাজ করল। মনে সাহস এল ফিরে। আমরা দোতলার একটি সুসজ্জিত কক্ষে এসে উপস্থিত হলাম।
হরিনারায়ণ বললে, এই ঘরটাই তোমার জন্যে ঠিক করে রেখেছিলাম দাদা। নিশ্চয়ই তোমার পছন্দ হয়েছে?
খুব পছন্দ হয়েছে হরি, সত্যিই তোমার তারিফ না করে পারছি না,-আমি বেশ খুশী মনেই বললাম, −বাড়ীর বাইরে থেকে দেখে এ ধরনের আধুনিক সাজ-সরঞ্জামে ভরা ঘর কল্পনা করাই কষ্ট সাধ্য।
বিনয়ের হাসি হাসল হরি। বললে, শুনে আনন্দ হল দাদা, আপাততঃ আমি যাচ্ছি, তোমার দরকার হলেই টেবিলে যে “কলিং বেল” টা আছে বাজিও, আমি হাজির হ’ব। এখন তুমি খুবই ক্লান্ত। অনেকটা পথ এসেছো। তোমার এখন ঘুমের প্রয়োজন খুব। আমি চলি তা হলে-বলেই হরি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নিজেকে বড়ই ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল। সুতরাং হরির কথায় কোন প্রতিবাদ করলাম না। সকালবেলাই না হয় কথাবার্তা হবে। ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম বিছানায়।
কিন্তু পরিশ্রান্ত হলেও আমার চোখে ঘুম এলো না। চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করতে গেলেই হাজার রকমের দুঃস্বপ্ন এসে জড়হতে থাকে মনের মধ্যে।
প্রথম থেকে ঘটনার রোমন্থন সুরু করলাম। আর প্রতি মুহূর্তেই শিউরে উঠতে লাগলাম। যে পরিবেশের মধ্যে দিয়ে হরি আমাকে এই অট্টালিকায় নিয়ে এল, সে পরিবেশ তো সাধারণ পরিবেশ নয়, সব কিছুকেই একটা অবাস্তব এবং মানুষের বৃদ্ধি-যুক্তির বাইরে বলে মনে হল। যা কিছু ঘটতে দেখলাম তা এক পৈসাচিক কাণ্ড ছাড়া আর কি হতে পারে?
পরমুহূর্তেই ভাবলাম, তবে কি হরিনারায়ণ পিশাচ-সিদ্ধ? ড্রাগন গরু, অতিকায় রক্ত-চোষা বাদুড়, ভূতুড়ে কান্না, এসব তবে কি? আর এই পরিবেশ সৃষ্টি হলো কেমন করে। এ সবই তাহলে হরির কাজ।
কারণ, ঘটনাগুলি আমার মনে গভীর-ভাবে দাগ কাটলেও হরির মধ্যে তার এক বিন্দুও আভাস পাওয়া যায় নি!
বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। মনের অস্থিরতা বেড়ে চলল। আমি ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করলাম।
হঠাৎ খেয়াল হল, জানালাগুলো সব বন্ধ। আমি এগিয়ে গিয়ে একটা জানালা খুলে দিতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে মুখে আছড়ে পড়ল। বুঝলাম, আকাশে মেঘ করেছে, এখুনি বৃষ্টি নামবে তারই আভাস ভেসে আসছে হাওয়ার সঙ্গে।
জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই দৃষ্টিগোচর হ’লনা। গাঢ় অন্ধকারে ভরে আছে চারিদিক। জানালাটা বন্ধ করে ফিরে এসে বিছানায় বসতে যাবে। হঠাৎ একটা তীব্র হৃদয় বিদারক করুণ আর্তনাদ আমাকে সচকিত করে তুললো। একটা অমানুষিক করুণ আর্তনাদ। জীবনে আমি কোনদিনই এমন ধারা করুণ আর্তনাদের শব্দ শুনিনি। করুণ সুরের আর্তনাদ হলেও সেই আর্তনাদের মধ্যে একটা বীভৎসতার লক্ষণ সুপরিস্ফুট ছিল।
যে বাড়ীতে একমাত্র হরি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি বাস করে না, সেই বাড়ীতে এমন ভাবে কাঁদে কে! বিশেষ করে মেয়েলি সুরের কান্না! তবে কি হরি কোন কিছু গোপন করছে আমার কাছে?
আমি কেমন যেন মরীয়া হয়ে উঠলাম। দরজা খুলে ছুটলাম সেই আর্তনাদ মিশ্রিত কান্নাকে অনুসরণ করে। বারান্দা দিয়ে কিছুটা এগুতেই মনে হল পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে সেই শব্দ। কিন্তু আমি দরজার সামনে দাঁড়াবামাত্রই সবকিছু থেমে গেল। নিমেষে বিরাজ করতে লাগল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। চারিদিক ঘিরে যেন একটা থমথমে ভাব অনুভূত হতে লাগল।
রহস্য জালে যেন আরও গভীরতরভাবে জড়িয়ে পড়লাম। এখন আমার কি করা উচিত। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম। নিজের ঘরে ফিরে যাবো অথবা কান্নার উৎসকে খুঁজে দেখবো?
ভাবতে গিয়ে মনে হল, সকাল থেকে এই গভীর রাত অবধি যখন কোনরূপ বিপদে পড়তে হয়নি; তখন হয়তো কোনরূপ বিপদ আমাকে স্পর্শ করবে না। মনে হওয়া মাত্রই সামনের দরজাটা ঠেলে খুলে ফেললাম।
দরজা খোলা মাত্রই যে দৃশ্য ফুটে উঠলো চোখের সামনে, তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি ভয়াবহ। শিরায় শিরায় বয়ে গেল রক্ত ঠাণ্ডা হিমেল প্রবাহ। স্থানুবৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার সামনে।
ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটি কাঁচের আধারে শুয়ে আছে একটি সুন্দরী রমণী। কফিনের আকারে তৈরী হলেও আধারটি ঠিক কফিন নয়। স্থির দৃষ্টি মেলে সে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে! নিষ্পলক প্রাণহীন চোখ দুটি সতেজ এবং জীবন্ত বলে মনে হতে লাগল। সে দৃষ্টিতে যেন সম্মোহনের মন্ত্র ছিল। আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম
সেই দিকে। চোখ ফেরানো দুষ্কর হয়ে উঠল আমার কাছে।
মেয়েটির সর্বাঙ্গ ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা। কেবল মাত্র মুখমণ্ডলটুকু ছাড়া। প্রচীন মিশরে “মমি” করে যেমন দেহগুলিকে সংরক্ষিত করা হতো, প্রায় ঠিক সেই ভাবেই মেয়েটির দেহটিকে ব্যাণ্ডেজ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
চোখের মণি থেকে যেন একটা ক্ষুধার্ত শাণিত রশ্মি নির্গত হয়ে আমাকে অলক্ষ্যে লেহন করে চলছিল। দেহটুকু বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মুখমণ্ডলটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে মনে হবে, একজন সুন্দরী যুবতী তার শয্যা থেকে নিরক্ষণ করছে আগন্তুক মানুষটিকে, বেশীক্ষণ সেই দৃষ্টির সামনে থাকা যায় না। শির শির করে ওঠে শরীর। অদম্য মনের জোরে চোখ ফিরিয়ে নিলাম অন্য দিকে। মুহূর্তে মনে হল আমি যেন
এক দুরন্ত অদৃশ্য এক শক্তির বাঁধন ছিঁড়ে ‘নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছি। যদি না পারতাম, জানি না তাহলে আমার পরিণতি কি হতো?
সে যাই হোক মেয়েটির মধ্যে বিশেষ করে তার ঐ অন্তর্ভেদী দৃষ্টির মধ্যে ভয়ানক এক সম্মোহনী শক্তি ছিল সে কথা অস্বীকার করতে পারলাম না। কিন্তু, এই হরিনারায়ণ তা হলে মেয়েটিকে এখানে রেখেছে কেন? মিশর দেশের মমি হলে না হয় বুঝতে পারতাম যে হরির একটা “হবি” আছে। এ তো দেখছি আমাদের বাঙালী ঘরের মেয়েদের মতই চেহারা। আর যদি মমি করে মেয়েটিকে রাখা হয়ে থাকে তবে তার মুখমণ্ডল এমনকি তার মাথার চুলগুলি পর্যন্ত খুলে রাখার অর্থ কি হতে পারে?
ভীষণ শব্দে একটা বাজ পড়লো। বৃষ্টি পড়তেও শুরু করেছে। ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া এসে লাগছে আমার গায়ে। বজ্রপাতের শব্দে জরাজীর্ণ বাড়ীটা কেঁপে কেঁপে উঠল। আমি নিজের কামরায় ফিরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আর একবার দৃষ্টিপাত করলাম ঘরের ভেতরটায় আর সেই মুহূর্তে প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠলাম।
জীবনে এতটা চমক বোধ করি কোনদিনই আসেনি। আর সেই চমকের সাথে সাথে একটা ভয়াল-করাল ছায়। যেন আমার মানসিক চিন্তাধারাকে ওলোট-পালোট করে দিতে চাইল।
দু’হাত দিয়ে আমার দুটি চোখকে ভাল করে রগড়ে নিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। আমি কি স্বপ্ন দেখছি অথবা আমার মনের ভ্রম!? কোনটা!! কিন্তু না, যা দেখছি তা সত্য। একটু আগে মেয়েটির যে চক্ষু দুটির বর্ণনা দিয়েছিলাম, সেই চোখ দুটো আর খোলা নেই। তার পরিবর্তে সেই কাঁচের আধারের মধ্যে শায়িত রয়েছে সেই মেয়েটি। চোখ দুটি তার বোঁজা এবং মেয়েটির মুখে ফুটে আছে মৃদু হাসির ঝলক। যে ঠোঁট দুটি বন্ধ ছিল, তাও যেন ঈষৎ ফাঁক হয়ে পড়েছে। টকটকে লাল দুটি ঠোঁটের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে মেয়েটির সারিবদ্ধ সুন্দর দাঁতের বাহার।
সাহসেরও একটা সীমা আছে। সে সীমা আমায় বোধ হয় ছাড়িয়ে গেছে। মনে হল এক ছুটে ফিরে যাই নিজের ঘরে। কিন্তু পা দুটো অচল অনড় হয়ে তাদের অবস্থা জানিয়ে দিল। সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কাঁচের কফিনটার দিকে।
বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুতের ঝলক এসে ঘরের সব কিছুকে মাঝে মাঝে ঝলসে দিয়ে যাচ্ছে। আমি দেখছি, আমাকে যেন দেখতেই হবে। না দেখে আমার উপায় ছিলনা।
কাঁচের সেই কফিনটা মনে হল যেন একটু নড়ে উঠল। পরক্ষণেই উপরের ডালাটা দু’ফাঁক হয়ে খুলে গেল। তারপর! তারপরই সেই শায়িত সুন্দরীর চোখের পাতা দুটো খুলতে লাগল ধীরে ধীরে। তার সেই ভয়ঙ্কর রক্ত-শীতল করা চাউনী দিয়ে আবার যেন সে আমাকে লেহন করে চলল। সর্বাঙ্গ ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা থাকা সত্ত্বেও। মেয়েটি উঠে বসল কফিনের মধ্যে। রক্তবর্ণ জিভ বার করে কয়েকবার ঠোঁট দুটোকে ভিজিয়ে নিয়ে কফিনের ডালার উপর হাত দুটো প্রসারিত করে নিজেকে কফিনের বাইরে নিয়ে এল সে।
বিস্ময়ে বিমূঢ় অবস্থায় আতংকগ্রস্ত হয়ে আমি তাকিয়ে রয়েছি মেয়েটির দিকে। শত চেষ্টা করেও আমি আমার চোখ দু’টোকে অন্যদিকে ঘোরাতে পারলাম না। একটা অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল।
মেয়েটি এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার চোখ দুটো কিসের আনন্দে চক চক করে উঠছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো যখন তার চোখের উপর এসে আছড়ে পড়ছে তখন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার বীভৎস চাউনী। যেন আগুনের ফুলকি ঠিকরে বেরুচ্ছে চোখ দুটো থেকে, আর সেই আগুনের হলকায় আমি যেন দগ্ধ হতে চলেছি।
অনেক, অনেকটা কাছে সে এগিয়ে এসেছে। এতক্ষণ তার ঠোঁট দুটো ছিল বন্ধ। এবার হঠাৎই খুলে গেল তার ঠোঁট। লকলকে লাল জিভ বেরিয়ে এল তার মুখ-গহ্বর থেকে। সেই ভয়ঙ্কর মূর্তির দিকে তখনও আমি চেয়ে আছি নিষ্পলক দৃষ্টি মেলে। নির্বাক, বোধশক্তি-হীন হয়ে। আমার নিজের বলতে করণীয় যেন কিছুই নেই।
মেয়েটি আরও এক-পা এগিয়ে এসেই চীৎকার করে উঠল। মনে হল কেউ যেন করুণ সুরে বিলাপ করে চলেছে। কিন্তু বড়ই তীব্র সে স্বর। কানের মধ্যে প্রবেশ করে মানুষকে দিশেহারা করে তোলে।
মনে পড়ল, এই রকম অমানুষিক বিলাপের সুর শুনতে পেয়েছিলাম এখানে আসার পথে এবং আরও একবার বাড়ীতে প্রবেশ করার প্রাক্কালে।
মেয়েটির ঠোঁট দুটি ধীরে ধীরে কাঁপছে আর সেই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরুচ্ছে এই অপ্রাকৃত শব্দধ্বনি। যে ধ্বনিকে একজন মহিলার ক্রন্দন ধ্বনি বলে মনে হয়।
আমি যেন এতক্ষণ তন্ময় হয়ে ছিলাম। হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজের সত্ত্বাকে। হঠাৎ এই বুক কাঁপানো ধ্বনি আমার সম্বিৎ ফিরিয়ে আনল। আমার মনে হল, আমি যেন এক অদ্ভুত জগৎ থেকে হঠাৎ নিজের জগতে ফিরে এসেছি।
মেয়েটি এগিয়ে আসছে আমার দিকে। নিষ্পলক চোখে ঝরছে তার আগুনের হলকা। যেন এক মূর্তিমতী অভিশাপ। ডাকিনী হয়ে ছুটে আসছে তাজা তাজা রক্ত চুষে খাওয়ার উল্লাসে। আনন্দে।
আরও, আরও কাছে এগিয়ে এলো ঐ ভয়ঙ্করী ডাকিনী। লোভাতুর হিংস্র চোখ দুটি তার আরও বড় হয়ে উঠল। জিভ বার করে একটা টকাশ করে শব্দ করল সে। ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা হাত দুটো প্রসারিত কর’ল−আমার দিকে।
আমি সভয়ে পিছিয়ে এলাম দু’পা। জড়তা আমার আগেই দূরীভূত হয়েছিল, ফিরে এসেছিল মানসিক স্থিরতা। ছুটে যে পালাব সে সময়টুকুও ছিল না। রক্ত-পিপাসু ডাকিনী তখন প্রায় একেবারে সামনা সামনি এসে গেছে। আমি আরও কয়েক পা পেছিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যও অন্য দিকে না ফিরিয়ে পেছন দিকে সরে যেতে থাকলাম। বঝতে পারছি যে কোনও মুহূর্তে সে লাফ দিয়ে পড়বে আমার ঘাড়ে। সুতরাং মনকে দৃঢ় করে প্রস্তুত হলাম! প্রয়োজন হলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও ওর আক্রমণকে প্রতিহত করতে হবে। আর কথাটাও জানি আমার সাহস হারালে চলবে না। মনকে কঠিন করে রাখতে হবে। সাহস হারালে মৃত্যু অবধারিত, বুঝতে পারলাম।
পিছন হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ লোহার রড দেখতে পেলাম। পাশেই রয়েছে পড়ে। চোখের পলক পড়ার থেকেও দ্রুতবেগে কুড়িয়ে নিলাম সেই রডটি। মনটা দ্বিগুণ উৎসাহে ভরে উঠল। রড্ হাতে নিয়ে স্থির দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটি আর এক পা অগ্রসর হলেই ওর মাথাটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবো। তা সে অশরীরী ডাকিনী
অথবা রক্ত-মাংসের মানুষ যেই হোক না কেন!
ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম বারান্দায়। প্রচণ্ড বৃষ্টির সঙ্গে চলছিল ঝড়ের তাণ্ডব। কিন্তু কোনদিকেই তখন আমার হুস্ ছিল না। মেয়েটির একজোড়া অস্বাভাবিক চোখের তারায় তখন আমার মন-প্রাণ নিবদ্ধ। জলের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ছে আমাদের গায়ে। সর্বাঙ্গ ভিজে উঠেছে এরই মধ্যে।
এক ঝলক বিদ্যুতের আলো এসে পড়ল মেয়েটির মুখে। সে একটা অস্বাভাবিক চিৎকার করে লাফিয়ে পড়ল আমার দিকে ক্ষিপ্র-বেগে পিছিয়ে এলাম কয়েক পা। মেয়েটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। একটুর জন্যে ওই দানবীর কবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে সমর্থ হলাম বটে, কিন্তু সে যেন আরও ক্ষিপ্র হয়ে উঠল। তার মুখের চেহারা হ’ল আরও ভয়ংকর। লক্ককে জিভ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে রক্তের নেশায় যেন সে উন্মাদ হয়ে গেছে।
আমি আর মুহূর্ত মাত্র সময় নষ্ট না করে দৃঢ় মুষ্টিতে লোহার রডটি মেয়েটির মাথা লক্ষ্য করে উঁচিয়ে ধরলাম। আর একটি পা অগ্রসর হলেই আমি ওর মাথাটা গুড়িয়ে থেঁতো করে দেবো।
উত্তেজনায় তখন আমার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। হরির বাড়ীতে এসে শেষ অবধি যে এমনি এক মারাত্মক পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, ভাবতেই পারিনি।
মেয়েটি আর এক পা এগিয়ে আসতেই আমি সজোরে লোহার রডটা ওর মাথা লক্ষ্য করে চালিয়ে দিলাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। যেই মুহূর্তে আমি রটা চালিয়ে দিলাম মেয়েটির মাথার দিকে, ঠিক সেই মুহূর্তেই ঝড়ের বেগে হরিনারায়ণ এসে রটা ধরে ফেলল। আর এক সেকেণ্ড দেরী হলে হয়তো মেয়েটির মাথা দু ফাঁক হয়ে যেত রডের আঘাতে।
হরিকে দেখে মেয়েটি যেন কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল। হরি কোন বৃথা না বলে মেয়েটির দিকে ভৎসনার চোখে তাকিয়ে আদেশের সুরে বললে, তোমাকে অনেকবার সাবধান করে দিয়েছি ইলা যে তুমি কখনই আমার বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি অসদাচারণ করবে না। কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত তোমার ব্যবহারে। ছিঃ ছিঃ! যাও নিজের ঘরে ফিরে যাও।
ইলা সুড় সুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। হরি আমার দিকে ফিরে বলল, তুমি দাদা বাইরে বেরিয়েছো। কেন? এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। তোমার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করো আমি এখুনি আসছি। বলেই হরিনারায়ণ ঢুকে গেল ইলার ঘরের মধ্যে।
আমি নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড কৌতূহল মনটাকে উতলা করে তুললো। হরি কি করছে ইলার ঘরে? আমাকে তা দেখতেই হবে। আমি নিজের ঘরের দিকে না গিয়ে ফিরে চললাম ইলার ঘরের দিকে।
চুপিসাড়ে ঘরের বাইরে থেকে ভিতরের দিকে তাকাতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের সামনে। হরির চোখ দিয়ে যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। হাতে একটা প্রকাণ্ড
চাবুক। আর সেই চাবুক দিয়ে ইলাকে সপাসপ মেরে চলেছে। ইলার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে করুণ আর্তনাদ। যে শব্দ আমি এর আগেও কয়েক বার শুনেছি। হরিকে বলতে শুনলাম, শোনো ইলা, আমি চাই না তুমি আমার আদেশকে অমান্য কর। তোমার যা প্রয়োজন আমি সব সময়েই তা যুগিয়ে চলেছি, কিন্তু তা সত্বেও যদি তুমি লোভের মাত্রা বাড়াতে চাও তার ফল ভাল হবে না। যাও তোমার জায়গায় ফিরে যাও।
ইলা কোন কথা না বলে সেই কাঁচের বাক্সের মধ্যে গিয়ে শুয়ে পড়ল। হরি কয়েকটি জীবন্ত মুরগী সেই বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ডালাটা বন্ধ করে দিল।
আমি লঘু পদক্ষেপে দ্রুত ফিরে এলাম নিজের ঘরে। বিছানায় শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, একটু আগে যা দেখলাম তা কি সত্য? বাস্তবের সঙ্গে এই ঘটনার মিল কতটুকু? অথবা আমি একটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে চলেছি?
মেয়েটি কে? আর ঐ মেয়েটিকে ঐ অবস্থায় রাখার মানেই বা কি? ইলা কি জীবিত অথবা সে মৃত? কোনটা ঠিক! সাধারণ মানুষের সঙ্গে ওর মিল কোথায়: হাজার প্রশ্ন মনের মধ্যে ভীড় করে আসছে। কিন্তু সমাধান করার মত কোন সূত্রই আমি পাচ্ছিলাম না। একমাত্র হরিকে পেলে তার কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া আর কোন রাস্তাই দেখতে পেলাম না। জীবন্ত মুরগী গুলোকে কেন ইলার সঙ্গে রাখা হল? এই কথাটা ভেবে খুবই অবাক হয়েছি। কিন্তু কোন সমাধানে পৌঁছতে পারছি না।
মাঝে মাঝে এক আশংকা গুরুগুর্ করে উঠছিল মনের মধ্যে। অনুভব করছি আমার চারিদিকে যেন এক অশুভ ইংগীত একযোগে তাদের ঐক্যতান শুরু করেছে। কিন্তু আমার, ঠিক এই মুহূর্তে, করনীয় বলতে কিছু নাই। হরির আতিথ্য গ্রহণ করেছি। হরিই এখন আমার ভরসা।
অথচ হরি কেমন সহজ-সচ্ছন্দ ভাবে এখানে বাস করছে এ কথা চিন্তা করে বিস্মৃত হলাম। এ সবের মধ্যে হরি নিজেকে কিভাবে যে জড়িয়ে ফেলল; অনুমান করা আমার পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার!
খট করে একটা শব্দ হতেই ফিরে তাকালাম পাশের জানলাটার দিকে। একটা দমকা হাওয়া যেন ছুটে এলো। আমি কিছু একটা দেখবার আগেই দপ করে নিভে গেল ঘরের আলো।
কিন্তু ওটা কি!? ঐ যে!! খোলা জানলার ঠিক বাইরে?! এক জোড়া চোখ জলন্ত অঙ্গারের মত জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। হিংস্র রক্তলোভী পৈশাচিক উল্লাস যেন ঝড়ে পড়ছে ঐ দৃষ্টি থেকে।
অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে দেখতে পাচ্ছি। শুধু একজোড়া অগ্নি-বিন্দু। আর একটু বাদেই যেন সে আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে। যদিও অন্ধকারের মধ্যে শরীরের কোন অংশই দেখতে পাচ্ছিলাম না; তবু যেন মনে হচ্ছিল ওর বিরাট হা আমাকে গ্রাস করবে।
হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠছে আমার। কি করবো অথবা আমার করণীয় কি হতে পারে কিছুই মগজে আসছিল না। আমাকে কেউ যেন পাথরের সঙ্গে বেঁধে রেখে আমার নড়বার-চড়বার ক্ষমতা লুপ্ত করে দিয়েছে।
সেই ভয়ঙ্কর চোখ জোড়া আমার আরও কাছে চলে এসেছে। এক অসহনীয় অবস্থায় অন্ধকারের মধ্যে আমি এক অজানা শত্রুর সামনে দাঁড়িয়ে। এইবার এইবার হয়তো সে ছিঁড়ে খাবে আমাকে তার হিংস্র ধারালো নখ দিয়ে।
সপাং করে একটা শব্দ হল। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, জলন্ত চোখ জোড়া যেন সেই আগেকার দ্যুতি হারিয়ে ফেলেছে। ফুটে উঠেছে একটা ভয়ার্ত ছায়া। ধীরে ধীরে সে সরে যেতে লাগল জানলার দিকে।
সেই মুহূর্তে এক ঝলক বিদ্যুতের আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। এক লহমায় দেখতে পেলাম একটা বিরাটকায় কালো ছাঁয়া সড়াৎ করে জানলার ফাঁক দিয়ে গলে গেল। ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে হরিনারায়ণ। হাতে রয়েছে সেই লম্বা চাবুক।
ভেসে এল হরির কণ্ঠস্বর-অন্ধকারের মধ্যে বসে রয়েছ কেন দাদা? টেবিলের তলায় একটা হ্যারিকেন আছে, জেলে দাও! বৃষ্টির জলে বাড়ীর লাইট ফিউজ হয়ে গেছে।
সম্বিৎ ফিরল হরির কথায়। এতক্ষণ যেন আমি আমার নিজের মধ্যে ছিলাম না। হরির কথার কোন জবাব না দিয়ে দেশলাই বার করে ফস্ করে একটা কাঠি জেলে হ্যারিকেনটা জালিয়ে দিলাম। হরিকে বেশ চঞ্চল আর গম্ভীর মনে হল। সে এগিয়ে এসে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল।
আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই হরি তার কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন, দেখ দাদা! বার বার এক কথা বলা আমার সভাব নয়! তোমাকে ইতিপূর্বেই বলেছি, কোনরকম কৌতূহল দেখাবে না! অথবা ঘর ছেড়ে বাইরে যাবে না। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনছ না। এটা ঠিক নয়।
একটু থেমে একটা বুক সেলফের দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে হরি পুনরায় বলতে শুরু করল-আপাততঃ তুমি এই বইগুলো পড়। আমার মনে হয় তুমি যা জানতে চাও তার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। আর একটা কথা তোমাকে বলে রাখি, তুমি অনেক কিছুই হয়তো দেখবে যা তোমার কল্পনা বা চিন্তার বাইরে। তাই বলে হট করে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যেও না যেন।
হঠাৎ হরির চোখের দৃষ্টি কোমল আর আদ্র হয়ে উঠল, কণ্ঠ হয়ে উঠল বাষ্পরুদ্ধ। সে বললে, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি দাদা। আমি জানি তুমি নিহরঙ্কারী এবং পরোপকারী। আর এটুকুও জানি তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্যে এটুকু উপকার করতে কার্পণ্য করবে না।
−কি যা তা বলছো!? −আমি হরির কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠলাম, −উপকার করার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে হরি? তুমি নেমন্তন্ন করেছ, আমি এসেছি। এখন বলো তোমার জন্যে আমি কি করতে পারি?
স্থির দৃষ্টি মেলে হরি তাকাল আমার দিকে। বললে, তুমি বইগুলো হাতে নিলেই বুঝতে পারবে আমি কি চাই, আর কি উপকার প্রত্যাশা করি তোমার কাছ থেকে। হয়তো তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা সাক্ষাৎ নাও হতে পারে। তুমি শুধু বন্ধুকৃতটুকু করলেই আমরা তোমার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো দাদা। তুমি জাননা আমরা অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছি। নরক যন্ত্রনা যে কি দারুণ যন্ত্রনা তা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। তুমি আমাকে মুক্তি দাও। হ্যাঁ দাদা, একমাত্র তুমিই পারো আমাকে এই নরককুণ্ড থেকে উদ্ধার করতে।
আমি অভিভূত হয়ে শুনছিলাম হরিনারায়ণের কথা। বললাম হরি ব্যাপারটা একটু খুলেই বলনা কেন?
কিন্তু আমার কথা শোনবার অপেক্ষায় হরি ছিল না। চেয়ার শূন্য! আমি হয়তো অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম একটু, সেই সুযোগে হরি কখন যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে টের পাইনি।
বিছানা ছেড়ে এগিয়ে চললাম বুক-সেলফের দিকে। দেখতে হবে, এই সব বইগুলোতে কি এমন লেখা রয়েছে যাতে করে আমার সকল প্রশ্নের জবাব মিলবে।
সপ্ সপ্ সপাং। একটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল এক অমানুষিক আর্তনাদ! কোন মানুষ অমন বীভৎস ভাবে আর্তনাদ করতে পারে বলে মনে হয় না। আমি ছুটে গেলাম জানলার ধারে।
জানলার মধ্য দিয়ে দেখলাম এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বাড়ীর সামনের চাতালটায় হরি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার চাবুক। সেই চাবুক দিয়ে সে নির্দয় ভাবে প্রহার করে চলেছে চার পাঁচটি বিরাটকায় বাদুড় শ্রেণীর জীবকে। জীবগুলির আর্তনাদ সারা অঞ্চলকে কাঁপিয়ে তুলেছে।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে জানালা দিয়ে কাণ্ড লক্ষ্য করে চলেছি। কয়েক ঘা চাবুক খাবার পর বাহড়গুলির দেহের হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে গেল। বাদুড়ের পরিবর্তে দেখা গেল কয়েক জন মানুষকে।
আমার বিস্ময়ের মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়ে চলছিল হরির কাণ্ড দেখে। হরি ভৎর্সনার সুরে ঐ বাদুড়-মানুষগুলোকে তিরস্কার করে বলছে, হতভাগার দল, তোদের মুক্তির জন্যেই আমাকে এত কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে, অথচ প্রত্যেক বারই আমার চেষ্টাকে তোরা বানচাল করে দিচ্ছিস্! ফের যদি অবাধ্য হোস্ তবে এখান থেকে দূর করে দেবো। এখানে তোদের আশ্রয় হবে না। আশা করি কথাগুলো মনে থাকবে।
মানুষের রক্তের পরিবর্তে আজকের মত হাঁসের রক্ত খেয়ে থাকগে যা।
হরি গুটিকয় হাঁস ওদের হাতে দিতেই ওরা মুহূর্ত মাত্র দেরী না করে হাঁসের গলার কাছটায় দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষতে থাকলো, মুখে ফুটে উঠল এক বীভৎস রূপ। ঠোটের কষ বেয়ে গড়াতে লাগল তাজা রক্ত। পিশাচের পৈশাচিক কাণ্ড দেখে ভয়ে শিউরে উঠল আমার বুক। বুঝলাম, একটু আগেই অন্ধকারের মধ্যে এদেরই একজন এসেছিল আমার রক্ত পান করতে। কিন্তু হরির উপস্থিতিতে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেছি।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম খেয়াল ছিল না। চুরির শব্দে চমক ভাঙলো। ফিরে দেখি, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইলা। এক রাশ চুড়ি পরেছে দু’হাতে। কিন্তু আশ্চর্য হলাম দেখে যে একটু আগে যাকে দেখছিলাম ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় এখন তার শরীরের কোন অংশেই কোন ব্যান্ডেজ করা ছিল না। সুন্দর সিল্কের শাড়ী পরে অপরূপ সাজে সে দাঁড়িয়ে।
ইলাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সুন্দরী বললেও বোধ করি ঠিক বলা হয় না। স্বর্গের অপ্সরার যেন আবির্ভাব ঘটেছে মর্তে। চোখ ফেরানো যায় না। চোখ ঝলসে যাচ্ছে তার রূপের জৌলুষে। মুখে তার মনমোহিনী হাসি।
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার ব্যাণ্ডেজ কোথায় গেল?
কল কল খল খল করে হেসে উঠল ইলা। সেই হাসির আমেজ আমার মগজকে যেন অবশ করে দিল। ইচ্ছা হল ছুটে যাই ইলার কাছে। হরি যদি কিছু ভাবে তো ভাবুক, আমার তাতে কিছুই আসে যায় না।
ইলা আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে অনুযোগ ভরা কণ্ঠে বললে, আমাকে জোর করে ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়ে রেখেছে ঐ হতভাগা হরিনারাণটা আর জোর জবরদস্তি করে ঐ কাঁচের বাক্সটায় আমাকে থাকতে বাধ্য করাচ্ছে। বলুন তো এটা কি ওর ঠিক হচ্ছে?
নিশ্চয়ই না! −আমি প্রতিবাদ করে বললাম, খুবই অন্যায় কথা, হরিকে আমি নিশ্চয়ই বলবো। তবে, তার আগে আমাকে জানতে হবে হরির সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কতদূর?
−কোন সম্পর্ক নাই, −ঝাঁঝালো গলায় ইলা বললে, ও আমাকে জোর করে এখানে কয়েদ করে রেখেছে। আমি এখান থেকে পালাতে চাই। কিন্তু…।
−কিন্তু! কিন্তুটা কি? −প্রচণ্ড আগ্রহ প্রকাশ পায় আমার মুখে। আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বলো, তুমি নির্ভয়েই বলো ইলা!
আবদারের সুরে ইলা বললে, বলবো বই কি, নিশ্চয়ই বলবো। সেইজন্যেই তো এলাম। আপনি হ্যারিকেনের আলোটা নিভিয়ে দিন। হরি যদি এসে পড়ে মুস্কিল হবে।
না, না, সেটা ঠিক হবে না ইলা− আমি চিন্তিতভাবে বললাম, হঠাৎ যদি হরি এসে পড়ে তবে বড়ই লজ্জার ব্যাপার হবে। হরি আমাকে অন্য কিছু ভাবুক, তা আমি চাই না।
−বেশ! তবে বাইয়ে আসুন−বারান্দাটা অন্ধকার আছে ওখানে দাঁড়িয়ে শুনবেন−ইল! হাতহানি দিয়ে আমাকে অনুসরণ করতে বলল।
নেহাৎ মন্দ কথা বলেনি ইলা, আমি ইলাকে অনুসরণ করে বারান্দার এলাম। বারান্দাটা তখন গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। বৃষ্টির জোর অনেকটা কমে গেছে। ইলাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কেবল একটা সাদা মূর্তিকে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।
ফিস্ ফিস্ শব্দ ভেসে এল ঐ সাদা মূর্তিটার কাছ থেকে, এদিকে এগিয়ে আসুন! আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম মুর্তিটার কাছে। বললাম, বল ইলা, কি বলতে চাও?
আমাকে জোর করে এখানে আটকে রেখেছে, আপনি আমাকে উদ্ধার করুন, −ইলা আরও সান্নিধ্যে এগিয়ে এসে বললে, দিনের পর দিন ওর অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছি। দেখছেন না সবসময়ই আমাকে ব্যাণ্ডেজ দিয়ে আড়াল করে রাখে। হাতের কাছে খাবার থাকলেও খেতে দেয় না।
−এটা তো খুবই অন্যায় কথা, −আমি সায় দিয়ে বললাম, হরি যে এতটা নীচে নেমে যাবে সেকথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ইলা। আমি নিশ্চয়ই তোমাকে উদ্ধার করবো, এবং…।
কথাটা মাঝপথে আটকে গেল আচম্বিতে ইলা আমাকে জড়িয়ে ধরাতে। ইলার নিঃশ্বাস এসে পড়ছে আমার গালে। উঃ কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সে নিঃশ্বাস! মনে হচ্ছে হিমালয়ের বরফ-ঘেরা গিরি-শিখর থেকে কেউ যেন হিম-শীতল হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে।
আমি অভিভূতের মত নিঃসাড়ে ইলার কবলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলাম। হঠাৎ ইলা মুখটাকে আমার ঘাড়ের কাছে নামিয়ে আনল। আমি অনুভব করলাম ইল। তীক্ষ্ণ-দাঁত বসিয়ে দিয়েছে আমার ঘাড়ে।
বুঝতে অসুবিধা হল না যে হরির কথা না শুনে খুবই অন্যায় করে ফেলেছি। মেয়েটি নিশ্চই পিশাচী। কিন্তু এখন আর সেকথা ভেবে কোন লাভ নাই। নিজের বুদ্ধিকেই তিরস্কার করলাম।
সপাং! একটা চাবুকের শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, আমি মুক্ত। ইলা আমাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।
হরির বিরক্তিসূচক কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, হিঃ হিঃ দাদা! কতবার বারণ করেছি যে ঘরের বাইরে না যেতে কিন্তু কথা না শুনে কতখানি বিপদে পড়েছিলেন বলুন তো? যান শিগগীর নিজের ঘরে ফিরে যান!
অপরাধীর মত সুড় সুড় করে ফিরে গেলাম নিজের ঘরে। দরজাটা আপনা হতেই বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। হরি আর আমার সঙ্গে আমার ঘরে এলো না। যাই হোক, ঘরের মধ্যে ঢুকতেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। মনে হল একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি যেন।
বুক-সেলফের কাছে এগিয়ে গেলাম। তা হতোস্মি, একটিও বই দেখলাম না সেলফে, পরিবর্তে পড়ে আছে একটা কালো, খাতা। মলাটের উপর জমা ধূলো ময়লা দেখে মনেই হবে না যে বেউ ওটা নিয়ে নাড়া চাড়া করেছিল। বহুদিন ধরে অব্যবহৃত ঐ খাতাখানি ছাড়া দ্বিতীয় কোন বই দেখা গেল না। যদিও কিছুক্ষণ আগে হরি যখন সেলফটার কথা উল্লেখ করেছিল তখন প্রচুর বই নজরে পড়েছিল। থাকে থাকে সাজানো ছিল বুক-সেলফের মধ্যে। আশ্চর্য্য হয়ে ভাবছি ব্যাপারটা আসলে কি? আমার চোখের ভুল অথবা, −অথবা না, না, অসম্ভব। যে সেলফ ধূলো-ময়লা ভর্তি কালো খাতা থাকতে পারে, সে সেলফে কখনই সেলফ ঠাসা বই থাকা সম্ভব নয়।
ব্যাপারটা পরে ভেবে দেখবো চিন্তা করে কালো খাতাটা ভুলে নিলাম সেলফ থেকে।
হ্যারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে কালো খাতাটা যেই খুলেছি অমনি এক প্রচণ্ড গর্জনে সারা বাড়িটা গুম্ গুম্ করে উঠল। সভয়ে খাতাটা বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে দিলাম।
গর্জনের চোটে কানে তালা লাগার উপক্রম। মনে হল শত শত ক্ষুধার্ত সিংহ একযোগে গর্জন শুরু করেছে। আর সেই দাপটে ঘর বাড়ী থর থর করে কাঁপছে।
তাড়াতাড়ি জানালার কাছে গিয়ে মুখ বাড়াতেই এক অবর্ণনীয় কল্পনাতীত দৃশ্য চোখে পড়ল। যে গরু দুটো আমাদের গাড়ী টানছিল, অবশ্য আমার তাই মনে হল, তাদের নাক আর মুখ দিয়েই নিঃসৃত হচ্ছিল ওইরূপ বিকট আওয়াজ।
চোখ দুটো ফুটবলের মত বড় বড় হয়ে উঠেছে। নিঃশ্বাসে বেরুচ্ছে লকলকে আগুনের হল্কা। গরু হয়েও সরীসৃপের মত হামাগুড়ি দিচ্ছে। আবার বাঁদরের মত সামনের দু’পা’কে হাত হিসাবে ব্যবহার করছে।