ডাকিনী ভিলা – ১

ডাকিনী-ভিলায় যাবেন? তাহলে আসুন! খবরদার! না!

ডাকিনী-ভিলায় যাবেন না! যিনি একবার গিয়েছিলেন, অতি কষ্টে ফিরে এসে তিনি তার যে অভিজ্ঞতার কাহিনী বলেছেন, তা যেমনি শিউরে ওঠার মতন তেমনি অবিশ্বাস্য ও ভয়ংকর।

.

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাগও বাড়তে থাকলো। আশ্চর্য লোক বটে এই হরি নারায়ণ! নেমন্তন্ন করে যে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে এ আবার কেমন ধারা নিয়ম! কি দরকার ছিল বাপু আমাকে ‘এই পাণ্ডব বর্জিত দেশে ডেকে আনবার?

হাত ঘড়িতে দেখি দুটো বেজে গেছে। অথচ এখনও হরিবাবুর। পাত্তা নেই। বসে বসে কেবল মাছি তাড়ানো ছাড়া করার কিছু ছিল না। একটা মাছি ক্রমাগত জ্বালাতন করে চলছিল। কখনও নাকে কখনও কানে ঘুরে ফিরে এসে বসছিল। আমি যতবারই তাড়াই ততবারই সে ফিরে আসে।

অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু কোন উপায় ছিল না। আর উপায় ছিল না বলেই বসে বসে হরিনারায়ণের আর তার সঙ্গে সঙ্গে ঐ হতভাগা মাছিটার বাপান্ত করছিলাম। মনের অবস্থা তখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে সেই মুহূর্তে হরিনারায়ণকে হাতের কাছে পেলে খুন করতেও দ্বিধা করতাম না।

বেলা গড়িয়ে তখন বিকেল হয়ে গেছে। মেজাজটাও তখন অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। হঠাৎ মনে হল, আমি ভুল করিনি তো? সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটা খুলে চিঠিটা বার করলাম। না, ভুল হয় নি মোটেই। স্বয়ং হরিনারায়ণের লেখা। বেশ স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে আমাকে রিসিভ করার জন্যে সে ষ্টেশনে হাজির থাকবে।

এ যে কি দুর্ভোগ, একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া অনুমান করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। ষ্টেশনটির নাম ভূঁতুড়িয়া। এখনও পুরোপুরি ষ্টেশনের মর্যাদা পায়নি। সারাদিনে দু’খানি মাত্র গাড়ী যাতায়াত করে। একখানা সকালবেলাই চলে গেছে। আর একখানি মানে শেষ ট্রেনটি সন্ধ্যার সময় আসবে। সুতরাং সারাটা দিন ইচ্ছা না থাকলেও অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না।

ষ্টেশনটিতে ট্রেন থামলেও দুটি কি একটির বেশী যাত্রী ওঠা-নামা করে না। ষ্টেশন মাষ্টার সারাদিনটা কোনক্রমে কাটিয়ে শেষ ট্রেনে চেপে চলে যান। আবার পরের দিন সকালের ট্রেনে এসে হাজির হন ভূঁতুড়িয়াতে।

ষ্টেশনের গায়ে একটা প্রকাণ্ড বট গাছের তলায় ছিলাম বসে। এমন সময় ষ্টেশন মাষ্টারকে আমার দিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালাম।

−কোথায় যাবেন? −ষ্টেশন মাষ্টার বললেন, সেই সকাল থেকেই তো রয়েছেন দেখছি!

আমি বললাম, আমি একটু দুশ্চিন্তায় পড়েছি মাষ্টার মশাই, আমারই এক বন্ধুর আসবার কথা আছে কিন্তু কেন যে এলো না বুঝতে পারছি না।

−আপনি কি আপনার বন্ধুর বাড়ী চেনেন?

−না মশাই! জীবনে এই প্রথম এখানে আসছি।

−তাহলে তো বেশ দুশ্চিন্তার কথা মশাই, −ষ্টেশন মাষ্টার বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন, দেখুন, এ সব নতুন জায়গা, এখানে রাত্রেকেউ থাকে না। এমন কি এই ষ্টেশনের চার-পাঁচ মাইলের মধ্যেওকোন গ্রাম বা লোক বসতি নেই। সুতরাং শেষ ট্রেনটা এলেই চেপে বসবেন। বুঝলেন?

−সে কথা আর বলতে, −আমি একটু কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম, বন্ধুত্ব করে আচ্ছা বিপদে পড়েছি বাবা, আর নয়!

−আপনার বন্ধুর নামটা কি জানতে পারি?

−নিশ্চয়ই! হরিনারায়ণ মুখুজ্যে। ষ্টেশন থেকে মাইল দুয়েক হবে। বাড়ীখানা নাকি বিরাট এক প্রাসাদের মত।

কথাটা শুনেই ষ্টেশন মাষ্টার কেমন যেন থমকে গেলেন। ভদ্রলোক অবাক দৃষ্টি মেলে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, সেকি! ও বাড়ীতে কেউ থাকে বলে ত শুনিনি!

বিশ্বাস হচ্ছে না! −বলেই আমি ব্যাগ থেকে হরিনারায়ণের চিঠিখানা বার করে ষ্টেশন মাষ্টারের হাতে দিলাম। তিনি চিঠিখানা ভাল করে দেখে শুনে আমার হাতে ফেরৎ দিয়ে বললেন, কি জানি মশাই! আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। যাই হোক, আপনি যদি আমার কথা শোনেন, তবে দয়া করে শেষ ট্রেনটা ছাড়বেন না। আমার মন ভাল বলছে না।

ষ্টেশন মাষ্টার আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে এ্যস্তপদে ষ্টেশনের দিকে রওনা দিলেন। তামি তার ভাব চাঞ্চল্য দেখে একটু ঘাবড়ে গেলাম। মনে হল, এর মধ্যে যেন এক গভীর রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু, সে রহস্যটুকু যেন ইচ্ছা করেই তিনি গোপন করে গেলেন।

ট্রেনটি যথাসময়ে ভুঁতুড়িয়া ষ্টেশনে এসে থামল। একজন যাত্রীকেও নামতে দেখা গেল না। অন্ধকারও তখন বেশ আসর জাঁকিয়ে চারিদিকে পরিব্যপ্ত হয়ে পড়েছে। একটানা ঝি-ঝি পোকার ডাক কানে এসে বাজছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, এখানে আর এক সেকেণ্ড সময়ও থাকতে রাজি নই। এগিয়ে চললাম ট্রেনের দিকে।

ষ্টেশন মাষ্টার ইতি মধ্যেই তার অফিস ঘরে তালা লাগিয়ে গাড়ীতে গিয়ে উঠে পড়েছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন।

গাড়ীতে উঠতে যাবো ঠিক সেই মূহূর্তে কোথা থেকে হরিনারায়ণ এসে হাজির হল, আরে এ কি! তুমি চলে যাচ্ছ?

যাবো না তো কি, তোমার মত একজন কর্তব্যহীন লোকের জন্যে অপেক্ষা করবো? –কথাগুলো খুব জোরের সঙ্গেই বললাম।

আমাকে আর লজ্জা দিও না ভাই। তোমাকে ঠিক সময়ে রিসিভ করতে পারিনি বলে আমি খুবই লজ্জিত। কিন্তু কি করবো বলো –গরুর গাড়ী করে আসছিলাম। হঠাৎ খানায় পড়ে গাড়ীটা উলটে গেল। এইসব ঝামেলা মেটাতে গিয়ে সন্ধ্যে হয়ে এলো।

বরাত ভালো যে ঠিক সময়েই উপস্থিত হতে পেরেছি। না হলে তো আর তোমার দেখা পেতাম না।

হরিনারায়ণের কথায় যেন যাদু ছিল, সব ভুলে গেলাম, সত্যিই তো বেচারী বিপদে না পড়লে ঠিক সময়েই আসতো।

‘ট্রেনের হুইসল’ এর শব্দে চমকে উঠলাম। গাড়ীখানা তখন চলতে শুরু করেছে। ষ্টেশন মাষ্টার তখনও তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে, যতক্ষণ দেখা যায় ট্রেনটির দিকে চোখ মেলে দেখতে লাগলাম।

যেই মুহূর্তে ট্রেনটি দৃষ্টি-সীমানার বাইরে চলে গেল, আমি যেন কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করলাম মনে মনে। নির্জন ভূঁতুড়িয়া ষ্টেশনটিতে তখন আমি আর হরিনারায়ণ ছাড়া অন্য কোন মানুষ ছিল না।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই অন্ধকার এসে গ্রাস করলো সমগ্র অঞ্চলটিকে! এক বিন্দু আলোর চিহ্ন কোনখান থেকে দেখা যাচ্ছিল না। কেবলমাত্র কয়েকটি জোনাকি পোকা সামনের সেই বটগাছটার উপর মাঝে মাঝে তাদের আলো বিকিরণ করে আলোর অস্তিত্বটুকু জানিয়ে দিচ্ছিল।

নিজেকে বড্ড অসহায় বোধ হল। হরিনারায়ণের বাড়ী যে এমন এক অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে এরূপ ধারণা আগে করতে পারিনি। নিশ্চল অবস্থায় ষ্টেশনের উপর দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম বর্তমান পরিস্থিতির কথা।, হরিনারায়ণও কথা না বলে চুপচাপ ছিল দাঁড়িয়ে।

অকস্মাৎ একযোগে কয়েকটি ক্ষুধার্ত শৃগালের ডাক ভেসে এল। আর তারই সঙ্গে মনে হল একটি সদ্যজাত মানব শিশু যেন কেঁদে উঠল তারস্বরে।

একটু চমকে উঠেছিলাম কিন্তু পরক্ষণেই ফিরিয়ে আনলাম নিজের সাহস। দেশ-গ্রামে এমন ঘটনা নতুন নয়। এর ব্যাখ্যা সকলেরই জানা আছে। কিন্তু তবুও মনের কোনে য়েন কিসের একটা ইংগিত ভেসে বেড়াচ্ছিল হয়তো সব কিছুই ঠিক, হয়তো বা কিছুই ঠিক নয়!

মোদ্দাকথা, এ অবস্থায় মোটেই ভাল লাগছিল না আমার। এই নির্জন জন-মানবশূন্য একটা জায়গায় অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ শক্ত ব্যাপার! অথচ এখন এমনি অবস্থা যে ইচ্ছা থাকলেও ফেরবার কোন রাস্তা ছিল না। শেষ ট্রেনটি চোখের সামনে দিয়েই ছেড়ে চলে গেছে। আমি হরিনারায়ণকে শুধালাম, কি হে হরি! আমরা কি এখানে দাঁড়িয়েই থাকবো?

হরি একটু হাসল। অবশ্য হাসলো না কালো অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না। হরির হাসির শব্দ বাতাসে ভর করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অনেকগুলো শেয়ালের চিৎকার আমাকে উন্মনা করে তুলল। একটু ভয় যে পেলাম না, তা নয়। গা-টা শির শির করে উঠল। পা দুটো মনে হল বেশী ভারী হয়ে উঠেছে। আমি হরিকে বললাম, আমরা কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি হরি? সকাল থেকে পেটে বিশেষ কিছু পড়েনি। খিদেয় পেট চুই চুই করছে যে।

আরে না না–হরি বললে, এখুনি গাড়ীটা এসে যাবে, অন্ধকার পথ বলে হয়তো দেরি হচ্ছে!

হরির কথা শেষ হতে না হতেই একটা গরুর গাড়ী আসার শব্দ কানে ভেসে এলো। গাড়ীটা এসে একেবারে আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। ঐ ঘন অন্ধকারের মধ্যেও আমার বুঝতে অসুবিধা হল না যে গরু দুটো বেশ তাগড়াই চেহারার। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছিল গরু দু’টির নাক দিয়ে। মনে হল কামারশালায় যেন হাপর টানছে। এমন কি আমি যেন ওদের নিঃশ্বাসটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম, যেন এক এক ঝলক আগুন বেরিয়ে আসছিল ওদের নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে। ড্রাগনের নিঃশ্বাসে আগুন ঝরে জানতাম কিন্তু আমাদের এই বাংলা মুলুকের গরুর নিঃশ্বাসে আগুন বেরোয় এটা আমার জানা ছিল না। সবই যেন কেমন একটা অদ্ভুত বলে মনে হতে লাগল। অথচ হরি নির্বিকার। তার কোনদিকেই খেয়াল নেই। সে যেন এইসব পরিবেশের সঙ্গে বিশেষ ভাবেই পরিচিত।

হরি এগিয়ে গিয়ে গাড়ীতে উঠে বসল। আমিও হরিকে অনুসরণ করে উঠে বসলাম গাড়ীর মধ্যেখানে ছাউনিঘেরা আবরণীর মধ্যে।

শরীরটা বড়ই ক্লান্ত। খড় বিছানো গদির উপর নিজেকে এলিয়ে দিলাম। হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই তড়াক্ করে উঠে বক্সলাম হরি নিজেই চালকের আসনে বসে গাড়ী চালাচ্ছিল। কথাটা মনে হতেই বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম ষ্টেশনে

যখন গাড়ীটা পৌঁছাল তখন কোন চালককে দেখতে পাইনি বলে। আর হরিও নিশ্চিন্ত মনে চালকের আসনে বসে গরুগুলোকে চালিয়ে নিয়ে চলল। তাহলে, বিনা চালকে গাড়ীখানা ষ্টেশনে গেল কি ভাবে?

গরুর গাড়ী হলেও প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে চলছিল আমাদের গাড়ীটা। গরু দুটো যে কোনও ঘোড়াকে যে হারিয়ে দিতে পারে তা আমি হলপ করে বলতে পারি। তাছাড়া এই ঘনান্ধকার রাতে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের রাস্তায় এত জোরে কি করেই বা চলছে পথ চিনে? ষ্টেশনের নামটি যেমন ভূঁতুড়িয়া, ঠিক সেই নামের সঙ্গে তাল রেখে যেন সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এখানে। আশ্চর্য!

হরিকে আমার মনের কথা বলব বলে ভাবছি, কিন্তু তার আগেই আমার দিকে পেছন ফিরে না তাকিয়েই হরি, বলতে শুরু করল, তোমায় বলতে ভুলে গেছি মান্নাদা, তোমাকে অনেক কিছুই বলবার আছে। তারপর গলার স্বর কমিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বললে, আপাততঃ যা দেখছো সে সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করো না। যথাসময়ে তোমাকে সব কিছুই বলব।

হরির কথায় যেন সম্মোহনের মন্ত্র ছিল, আমি আর কোন প্রশ্ন করা দূরে থাক্ কথা বলতেও যেন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। কেবল চুপচাপ অন্ধকারের বুকে মেলে রাখলাম আমার দৃষ্টি। বুঝতে পারছিলাম না এ যাত্রার শেষ হবে কোথায়?

গাড়ীর চাকায় আওয়াজ উঠছে ক্যাচ ক্যাচ করে। মাঝে মাঝে গাড়ীখানি দুলে উঠছে স-শব্দে, গোরুদুটির নিঃশ্বাসে বেরুচ্ছে আগুনের হল্কা। নিঃশ্বাসের শব্দে জেগে উঠছে গাছের ঘুমন্ত পাখীরা। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে হরির মুখ থেকে গরু চালাবার হ্যাট হুট শব্দ।

সব মিলিয়ে ছাপিয়ে উঠছে একটা অবরুদ্ধ কান্না। অতি ক্ষীণ অথচ খুবই তীক্ষ্ণ সে কান্না। মানুষ কিংবা অশরীরী বোঝবার মত মনের অবস্থা তখন আমার ছিল না। কিন্তু সেই কান্না বেশ আমার মনটাকে নিয়ে চলছিল কোন এক সুদূরলোকে। একটা ভয়াবহ কোন কিছু যেন আমাকে বাঁধতে চাইছে আষ্টেপৃষ্ঠে; অক্টোপাশের মত।

একটা অদ্ভুত কিছু প্রত্যক্ষ করছি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করছি এক অকল্পনীয় পরিবেশ। যে পরিবেশের সঙ্গে জীব জগতের কোন সম্পর্ক নাই। একটা হিমশীতল রক্তজল করা পরিস্থিতি। যা কিছু দেখছি সবই যেন কেমন খাপছাড়া। জীবন্ত জগতের সঙ্গে যেন তার কোন মিল নাই। আমি যেন ছুটে চলেছি এক ভয়ঙ্কর

দুঃস্বপ্নের সাগরের বুকে, একফালি একটা পান্সিতে চেপে।

আকাশের তারাগুলো যেন সেই স্বর্গরাজ্যে এক একটা অভিশাপ। ধূসর আবরণের মধ্যে যেন তাদের দ্যুতি হারিয়ে গেছে। তারা ম্লান মুখে চেয়ে রয়েছে অন্ধকার ধরিত্রির দিকে। মনে হচ্ছে ওরা আমাদের দিকেই তাকিয়ে কিছু বলতে চাইছে। আমি যেন বুঝতে পারছি ওদের কথা। ওরা বলছে, যেওনা যেওনা, কোথায় যাচ্ছ সে কথা কি তুমি জানো? তুমি পিশাচের সহচর হয়ে ছুটে চলেছো জাহান্নামের পথে। যেখানে কোন রক্ত-মাংসের জীবন্ত মানুষ যায় না।  অশরীরীদের রক্ত-পিপাসু জিহ্বা যেখানে লক্ লক্ করে। সেই মৃতের পুরীতে তোমার নিমন্ত্রণ। আশাকরি এই নিমন্ত্রণের অর্থ বুঝতে তুমি পারছো।

চোখ ফিরিয়ে আনলাম নক্ষত্র লোকের দিক থেকে। বেশী সময় আকাশের দিকে চেয়ে থাকলে, হয়ত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে হবে। অবাস্তব কল্পলোকের মোহ কাটিয়ে বাস্তবের দিকে দৃক্‌পাত করতে গিয়েই নজর পড়ল গরু দু’টোর দিকে।

আমি অভিভূতের মত লক্ষ্য করলাম, ঐ দুরন্ত গতিবেগের মধ্যেও গরুগুলো তার প্রভুর দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছিল। অন্ধকারের মধ্যেও ওদের চক্ষুগুলি জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল। সেই ভয়াবহ বড় বড় রক্তবর্ণ চোখগুলি যেন বারে বারে আমার দিকেই কটাক্ষ করছিল। সেই দৃষ্টি যে কত ভয়াবহ স্বচক্ষে না দেখলে বুঝিয়ে বলা’ যায় না। আমার মুখের ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিল। একটা অজানিত আশংকা যেন গ্রাস করে বসছিল প্রতি মুহূর্তে।

আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পূর্বমূহূর্তে দেখতে পেলাম, হরি সপাসপ্ কয়েক ঘা চাবুক বসিয়ে দিল গরু দুটির পিঠে। সঙ্গে সঙ্গে লক্ লক্ করে উঠল গরুগুলোর জিভ। দেখলাম হরি যেন কিছু ছুঁড়ে দিল ওদের মুখের দিকে। গরুগুলো ছুটন্ত অবস্থায় জিভ দিয়ে সড়াৎ করে টেনে নিল নিজেদের মুখে।

অসহ্য মানসিক যন্ত্রনায় আমি ছটফট করে উঠলাম। এসব কি? এ সবের মানে কি? ভাবলাম, হরিকে জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু সেই মুহূর্তেই হরি বলে উঠল, খুব ভুল হয়ে গেছে দাদা, সত্যিই আমি খুব লজ্জা পাচ্ছি কথাটা ভেবে। তোমার সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। তোমার সামনেই খাবার ঢাকা দেওয়া আছে, খেয়ে নাও। আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।

কথাটা কানে আসতেই বুঝতে পারলাম, সত্যিই তো প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে আমার। আমার সামনেই পড়ে রয়েছে আমার খাবার। সব কথা ভুলে গিয়ে তখন সামনের খাবার নিয়ে বসে গেলাম। আশ্চর্য সুস্বাদু খাবার। অমৃত হার মেনে যাবে এর কাছে। অভুক্ত ছিলাম বলে হয়তো অমন সুস্বাদু লেগেছে এ কথাটাও অবশ্য উড়িয়ে দেওয়া

যায় না।

প্রথমদিকে খেয়াল হয় নি। গো-গ্রাসে খাবার গেলবার পর খেয়াল হল। এই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যেও আমার খেতে কোনই অসুবিধা হল না দেখে। একটা নীলাভ আলোয় ভরে ছিল চারিদিক। একটু লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলাম বহু দূরে একটা গাঢ় নীল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে আর তারই আলো এসে পড়েছে আমাদের গাড়ীর ভিতরে।

আশ্চর্য হলাম, এত তীব্র দ্যুতিময় আলো এই অজ পাড়াগাঁয়ে এল কোথা থেকে। এবং এটাও লক্ষ্য করলাম আমাদের গাড়ীটা ছুটে চলেছে সেই আলোটির দিকেই। ঐ নীল আলোর মধ্যে কি ছিল জানি না। কিন্তু আমার, মন একটা অজানা আশংকায় ভরে উঠল! এখানকার সব কিছুই কেমন যেন অস্বাভাবিক বলে মনে হতে লাগল।

খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই আলোটা নিভে গেল। আবার সেই তিমিরাচ্ছন্ন পথ! গরু দুটোর নাসিকা গর্জন, চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ। সর্বোপরি হরিনারায়ণের নিশ্চিন্ত নীরব অবস্থান। আমি হরিকে আমার মনের কথা বলতে উদ্যত হবার আগেই সে আগের মতই বলে উঠল, যা কিছু দেখছো বা শুনছো, দয়া করে কৌতূহল প্রকাশ করো না। এ জায়গাটা খুব সুবিধার নয়। তোমার ভালোর জন্যেই তোমাকে অনুরোধ করছি, আপাততঃ তোমার প্রশ্নগুলোকে চেপে রাখো। বাড়ীতে পৌঁছে তোমাকে সব কিছুই খুলে বলবো।

হরির কথার মধ্যে যেন একটা কঠোর আদেশের সুর ধ্বনিত হল। যে আদেশকে অগ্রাহ্য করার মত ক্ষমতা বা মানসিক ধৈর্য আমার ছিল না। নির্বাক দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করা ছাড়া তখন আমার আর কোন উপায় ছিল না।

হঠাৎ একটা শব্দ কানে আসতেই সচকিত হয়ে উঠলাম। কতকগুলি বিরাটাকার পাখী একসঙ্গে উড়তে থাকলে তাদের ডানায় যে রকম শব্দ হয়, ঠিক সেই রকমের। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করতেই যে দৃশ্য নজরে পড়ল তাতে সারা শরীরের রক্ত যেন জমাট বেঁধে গেল।

অতিকায় কয়েকটি জীব প্রকাণ্ড ডানা মেলে আমাদের গাড়ীর ঠিক উপরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বাদুড় শ্রেণীর হলেও অতবড় বাদুড়ের যে অস্তিত্ব সম্ভব, না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস হবে না। তাদের চোখগুলো আগুনের গোলার মত জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল। মনে হচ্ছিল যেন ওদের ঐ দৃষ্টি দিয়েই ওরা শুষে নেবে শরীরের রক্ত।

ঝপ করে একটা আওয়াজ হতেই ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। গরুর গাড়ীর চালের উপর একটা জীব বা ঐ রক্ত-চোষা বাদুড় লাফিয়ে পড়েছে। গাড়ীটা ভীষণভাবে দুলে উঠল। গরু দুটোও যেন ভয় পেয়ে আরও দ্রুত বেগে ছুটতে সুরু করল।

আমি একটা চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হরি সেই মুহূর্তেই তার হাতের চাবুক দিয়ে সপাং করে ঐ প্রাণীটির গায়ে আঘাত করতেই একটা তীক্ষ্ণ-শীষের মত আওয়াজ তুলে জীবটি সবেগে উধাও হয়ে গেল উদ্ধাকাশের দিকে। গরুর গাড়ীটা দুলে উঠল প্রচণ্ড বেগে। আমি ছিটকে পড়লাম একধারে। হরি কতকগুলি অদ্ভুত ধরণের কথা উচ্চারণ করল যার অর্থ আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। হয়ত সে কিছু সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে থাকবে।

কিন্তু আশ্চর্য ফল পাওয়া গেল তাতে। ডানা ঝাপটানো শব্দ মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল। আবার ফিরে এল সেই পূর্বাবস্থা। একঘেয়ে গরুর গাড়ীর চাকার আওয়াজ আর গরুগুলির নিঃশ্বাসের গুরুগম্ভীর ফসফসানি।

সবকিছু পরিস্থিতির সঙ্গে যেন আমি খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম এরই মধ্যে। সুতরাং যতই কেন না ভয়ঙ্কর অথবা ভীতিজনক হোক, আমার মনোবল বিন্দুমাত্র নষ্ট হবে না। হঠাৎ জানিনা কেন আমার জেদ চেপে গেল। আমি এর শেষ দেখতে চাই। এমনকি জীবনের মূল্যেও যদি দেখতে হয় তবে তাতেও রাজী। কথাটা মনে আসা মাত্রই যেন শরীর ও মনে অনুভব কয়লাম প্রচণ্ড শক্তি। এতক্ষণ কথা বলার স্বাধীনতাটুকু পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল আমার মন থেকে। একটা অদ্ভুত ভীতিকর শিহরণ অনুভব করছিলাম সারাক্ষণ ধরে। কিন্তু এই মুহূর্তে আর সেই দুর্বলতা আমার মন থেকে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল।

আমি হরিকে প্রশ্ন করলাম, হরি! আমাদের আর কতদূর যেতে হবে?

এই যে এসে গেছি দাদা, অত্যন্ত সহজ সরল কণ্ঠ ধ্বনিত হল হরির গলা থেকে, –ঐ যে বাড়ীটা দেখতে পাচ্ছ, ওটাই আমার বাড়ী।

তাইতো! এতক্ষণে যেন খেয়াল হোল। অদূরেই দেখা যাচ্ছিল বাড়ীটাকে। গেটের মুখে জ্বলছে একটা নীলাভ দ্যুতিময় আলো। অন্ধকারকে যেন আরও অন্ধকার করে তুলছিল ঐ আলোর নীলাভ রশ্মি। বাড়ীটাকে প্রকটা দুঃখস্বপ্নের সৌধ বলে মনে হচ্ছিল। কেন হচ্ছিল তা বলতে পারবো না। তবে একটা অশুভ ইংগিত যেন আমার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় দিয়ে আমাকে বলতে চাইছে বাড়ীটা একটা শয়তানের পীঠস্থান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *