ডাকাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর

ডাকাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর

।। ১।।

গতকালই সুপারিনটেনডেন্ট হিসাবে স্নেহাংশু এই সংশোধনাগারে কাজে যোগ দিয়েছেন। জেলখানাকে আজকাল ডাকা হয় সংশোধনাগার নামে। সুপারিনটেনডেন্ট মানে জেলখানা বা সংশোধনাগারের সর্বময় কর্তা। জেলার সহ অন্য পদাধিকারীরা সুপারের অধীনেই কাজ করেন।

আজ পনেরোই অগাস্ট, স্বাধীনতা দিবস। জেলের ছোটো কম্পাউন্ডের মধ্যে পতাকা উত্তোলনের পর নিজের অফিস ঘরে এসে বসেছিলেন স্নেহাংশু। কারা-দপ্তরের বড়ো কর্তা লাহিড়ী সাহেবের আজ এখানে আসার কথা।

জেলার সাহেব ঘরে ঢুকে বললেন, ‘একটা ব্যাপার আপনাকে জানাবার আছে। আজ একজন বন্দি আমাদের জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছে। না, সাজার মেয়াদ শেষ হবার জন্য নয়। সরকার তাকে সাজা থেকে মুক্তি দিচ্ছেন। লাহিড়ীস্যারও সে জন্যই আসছেন। লোকটাকে নিজে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে জেলের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন বলে।’

স্নেহাংশু গতকাল সবে মাত্র কাজে যোগ দিয়েছেন। এ-জেলের ভিতরের খুঁটিনাটি ব্যাপার এখনও তাঁর জানা হয়ে ওঠেনি। ফাইলপত্রও দেখা হয়নি। এখানে কাজে যোগ দেবার পরই তিনি শুনেছেন যে আজ লাহিড়ীসাহেব এখানে আসছেন। তবে তার আসল কারণটা জানা ছিল না স্নেহাংশুর।

প্রতি বছর এই পনেরোই আগস্টের দিন সরকার বাহাদুর বিভিন্ন জেল থেকে কিছু মানুষকে মুক্তি দেন। দীর্ঘ দিন ধরে সাজা খাটছে এমন লোক, অসুস্থ বা বৃদ্ধ এমন লোকদেরই সাধারণত এ-সব ক্ষেত্রে নির্বাচন করা হয়, এবং এ ধরনের মুক্তির ক্ষেত্রে অন্যতম বিচার্য বিষয় থাকে, জেলে থাকা অবস্থায় সে লোকের আচার ব্যবহার। আসামীর ব্যবহার ভদ্রসভ্য হলে কারা দপ্তর তার মুক্তির জন্য সুপারিশ করে সরকার বাহাদুরের কাছে। এধরনের নানা নামের মধ্যে থেকে নানা দিক খতিয়ে দেখে সরকার কিছু লোকের মুক্তির ব্যবস্থা করে।

জেলার সাহেবের কথা শুনে সুপার সাহেব জানতে চাইলেন, ‘লোকটা কোন মামলাতে সাজা খাটছিল?’

জেলার বললেন, ‘একটা বুড়ো লোক। অবশ্য সাজা খাটতে খাটতে বুড়ো হয়েছে। খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। বহু বড়ো বড়ো জেলে সাজা খাটতে খাটতে অবশেষে আমাদের এই জেলে বছরখানেক আগে আসে। খুব ঠান্ডা প্রকৃতির লোক। বলতে গেলে লাহিড়ীসাহেবই নিজে উদ্যোগী হয়ে লোকটার মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন।’

স্নেহাংশু জানতে চাইলেন, ‘ওর পরিবারের লোকজনেরা কেউ এসেছেন, ওকে আজ নিয়ে যাবার জন্য?’

জেলার বললেন, ‘ওর ব্যাপারে নথিপত্রে তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজনের ঠিকানা পাওয়া যায়নি। লোকটাকে এ-ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় সে বলেছে—তার কেউ কোথাও নেই। আর অদ্ভুত ব্যাপার হল, কারাদপ্তর থেকে সাতদিন আগে তাকে মুক্তি দেবার অর্ডার এল, এবং যখন আমরা সেটা তাকে জানালাম, তখন সে একটুও খুশি হল না কথাটা শুনে। বরং সে বলল, ‘এখানে ছিলাম বরং ভালোই ছিলাম মাথার ওপর ছাদ আর দু-বেলা খাবারের নিশ্চিত ব্যবস্থা অন্তত ছিল। কিন্তু এ-বয়সে আমি জেল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাব?’

স্নেহাংশু কথাটা শুনে আফসোসের স্বরে বললেন, ‘দুর্ভাগ্য লোকটার। তবে কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আছে যারা এ-ধরনের লোকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। হয়তো লাহিড়ীসাহেব তার তেমন কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।’

জেলারসাহেব এরপর বললেন ‘লোকটাকে, তার সম্বন্ধে জেলের নথি আর তার জিনিসপত্র সব আপনার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি, একবার দেখে নিন। তাছাড়া লাহিড়ী সাহেব তো আপনার ঘরেই আসবেন। তবে দীর্ঘ দিন জেলে থাকতে থাকতে লোকটার মাথায় মনে হয় মৃদু গন্ডগোল হয়েছে। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে একটা ছড়া আবৃত্তি করে সে।’

স্নেহাংশু মৃদু বিস্মিত ভাবে জানতে চাইলেন, ‘কী ছড়া?’

জেলারসাহেব হেসে বললেন, ‘ও এলে শুনতে পারবেন। পাঠিয়ে দিচ্ছি লোকটাকে। আমি মেইন গেটের ওখানে থাকছি। লাহিড়ীসাহেব কখন এসে পড়েন কে জানে? তিনি এলে গেট থেকে রিসিভ করে আপনার ঘরে নিয়ে আসব।’ এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন জেলারসাহেব।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দু-জন কারারক্ষী একটা বুড়ো লোককে নিয়ে ঘরে ঢুকে সুপারের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের একজনের হাতে একটা ফাইল আর চটের ছোটো একটা ব্যাগ ছিল। সেগুলো সে টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, ‘স্যার, এই ওর ফাইল আর জিনিসপত্র।’

স্নেহাংশু মুক্তিপ্রাপ্ত লোকটার দিকে ভালো করে তাকালেন। অনেক বয়স হয়েছে লোকটার। মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে। মুখেও বলিরেখা ফুটে উঠেছে। ঠিক নাকের ডগাতে একটা আঁচিল আছে। শরীরের গঠন দেখে মনে হয় এককালে সে বেশ শক্তপোক্ত ছিল। হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।

স্নেহাংশু কারারক্ষীদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা বাইরে অপেক্ষা করুন। দরকার হলে আপনাকে ডেকে নেব।

তারা বাইরে বেরিয়ে যাবার পর স্নেহাংশু লোকটার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনি আজ ছাড়া পাচ্ছেন নিশ্চয়ই জানেন?’

লোকটা বলল, ‘হ্যাঁ, জানি। কিন্তু না ছাড়া পেলেই ভালো ছিল।’

সুপার সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ‘দেখুন, আমরা যেমন কাউকে ইচ্ছা হলেই জেল থেকে ছেড়ে দিতে পারি না। তেমনই সাজার মেয়াদ শেষ হলে বা তার মুক্তির নির্দেশ এলে তাকে এখানে রেখেও দিতে পারি না।’

লোকটা প্রথমে বলল, ‘তা বটে।’ তারপর মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে একটা পরিচিত ছড়া বলতে শুরু করলঃ

‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে?’

ছড়াটা বলে সুপারসাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

স্নেহাংশু হেসে ফেলেও গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর তার টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারটা লোকটাকে দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন। জেল দপ্তরের বড়োকর্তা আসবেন। তারপর আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন।’

একটু ইতস্তত করেই চেয়ারে বসল লোকটা। স্নেহাংশু প্রথমে ফাইলটার ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন বললেন, ‘আপনার নাম তো মণিলাল দত্ত, তাই না?’

সে জবাব দিল, ‘এক সময় তাই ছিল। এখন অবশ্য আমার নাম নেই, নম্বর আছে— সাতশ সাতাত্তর। আপনার মুখে অনেক দিন পর নামটা শুনলাম। পাঁচ-শো বাহান্ন, ষোল-শো দশ, চোদ্দ-শো কুড়ি হতে হতে শেষে আমি এখন সাত-শো সাতাত্তর।’

ফাইলটা দেখার পর সুপারসাহেব চটের ব্যাগটা টেনে নিলেন। জেলের কয়েদিদের বোনা ব্যাগ। জেল থেকে যখন আসামিরা ছাড়া পায় তখন তাদের সঙ্গে আনা জিনিস এই ব্যাগে ফেরত দেওয়া হয়। এতদিন নিশ্চই জেলের মাল-ঘরে ব্যাগের ভিতরের জিনিসগুলো রাখা ছিল।

ব্যাগটা খুললেন স্নেহাংশু। না, তেমন কোন দামি জিনিসপত্র নেই তার মধ্যে। অনেক পুরোনো একটা শার্ট আর প্যান্ট। তবে তার সঙ্গে টিনের তৈরি একটা ছোট্ট জিনিস দেখে সেটা ব্যাগ থেকে বাইরে বের করলেন স্নেহাংশু।

‘ব্যাঙ কটকটি।’ ইঞ্চি তিনেকের লম্বাটে ধরনের টিনের তৈরি একটা খেলনা। দুটো ছোটো টিনের পাত এমন কৌশলে জোড়া থাকে যে তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিলে তীব্র কটকট বা টকটক শব্দ হয়। আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেদের অতি প্রিয় খেলনা ছিল। স্নেহাংশু নিজেও ছেলেবেলাতে এই খেলনা নিয়ে খেলেছেন। নিজের অজান্তেই যেন সুপার সাহেবের আঙুল বার কয়েক টিপে দিল সে জিনিসটাকে। তীব্র কটকট ধাতব শব্দ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। তা শুনে দরজার বাইরে দাঁড়ানো কারারক্ষী দু-জন ঘরের ভিতর উঁকি দিয়ে দেখল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটু বিব্রত বোধ করলেন স্নেহাংশু। একে তিনি সদ্য এ-জেলে কাজে যোগ দিয়েছেন। কী ভাবছেন তার অধস্তন কর্মীরা? নতুন সুপারসাহেব বাচ্চাদের মতো কটকটি বাজাচ্ছেন! কিন্তু লোকটার ব্যাগের ভিতর এ-খেলনাটা পেয়ে বেশ অবাকও হলেন স্নেহাংশু। একজন খুনীর ব্যাগে খেলনা। তাও আবার বাচ্চাদের কটকটি! জিনিসটা সত্যি লোকটার, না কি কোনোভাবে লোকটার ব্যাগে ঢুকে পড়েছে? এ ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করার জন্য তিনি লোকটার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন যে লোকটা বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে আছে তার হাতে ধরা ব্যাঙ কটকটির দিকে! এ-জিনিসটা তার কি না, জিজ্ঞেস করার আগেই লোকটা বলে উঠল, ‘এটা আজও রয়ে গেছে স্যার! পুলিশ যখন আমাকে ধরল তখন এটা আমার পকেটে ছিল। আমাকে একটু কটকটিটা দেবেন স্যার? হাতে নিয়ে দেখব?’

সুপারসাহেব কটকটিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘নিন। এটা তো আপনারই জিনিস।’

লোকটা হাতে নিল কটকটিটা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে যেন পরম মমতায় কটকটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর স্বগতোক্তির স্বরে বলল, ‘এই কটকটিটাই আমাকে জেলের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।’

স্নেহাংশু বললেন, ‘মানে? এই কটকটিটার জন্যই কি আপনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন?’

লোকটা বলল, ‘ঠিক তা নয়। সে গল্প আপনি শুনতে চাইলে আমি বলতে পারি। সে গল্প কয়েদি নম্বর সাত-শো সাতাত্তরের গল্প নয়, মণিলালের গল্প। না না, গল্প নয়, সত্যি ঘটনা!’

লাহিড়ীসাহেব যতক্ষণ না আসছেন ততক্ষণ গল্পটা শুনে সময় কাটানো যেতে পারে। তাই স্নেহাংশু বললেন, ‘বলুন আপনার গল্প।’

মণিলাল বলল, ‘কোর্টে জজসাহেবকে কথাগুলো বলেছিলাম। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণ আমার বিরুদ্ধে ছিল বলে কেউ বিশ্বাস করেনি আমার কথা। আজ এত বছর সাজা খাটার শেষে সে দিনের ঘটনা নিয়ে মিথ্যা বলার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। যা বলব সত্যি বলব।’

এ কথা বলার পর লোকটা কিছুক্ষণ তার হাতে ধরা কটকটির দিকে নিশ্চুপভাবে তাকিয়ে থাকার পর নিজের নাম ধরেই গল্পটা বলতে শুরু করল।

।। ২।।

‘মণিলাল দত্ত ছিল বছর তিরিশের এক যুবক। দক্ষিণ কলকাতাতে কালীঘাট অঞ্চলে থাকত সে। দুঃস্থ পরিবারের সন্তান। বাবা ছিল একটা কাপড়ের দোকানের সামান্য কর্মচারী। লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি মণিলালের। ম্যাট্রিক পাশ করার আগেই মণিলালের বাবা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। কাজ যায় তার। ফলে মণিলালকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে রোজগারের জন্য পথে নামতে হয়। প্রথম কয়েক বছর মুদির দোকানে কাজ, হকারি, এসব কাজ করার পর একটা ছোটো কারখানাতে কাজ পায় সে। টিনের বালতি, সস্তার বাসনপত্র, খেলনা এ-সব বানানো হতো সেই কারখানাতে। মণিলাল বিয়ে-থা করেনি। কারখানার বেতন খুব সামান্য হলেও তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালিয়ে নিচ্ছিল মণিলাল। সংসার বলতে সে, যক্ষ্মা রোগগ্রস্ত বাবা আর রুগ্ন মা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে মিশিয়ে কোনোরকমে দিন কেটে যাচ্ছিল। মণিলালের কোনো চারিত্রিক দোষ ছিল না। নেশা-ভাঙও করত না। সামান্য একটা বিড়িও সে কোনোদিন ছোঁয়নি। বরং শরীরচর্চার দিকে কিছুটা ঝোঁক ছিল—ডন বৈঠক করত। কিন্তু হঠাৎই একদিন বিপদ ঘনিয়ে এল। বছর দশেক কারখানাটা চলার পর কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেল। মণিলাল বেকার হয়ে গেল। সামান্য যে কয়েক-শো টাকা তার কাছে ছিল তা দিয়ে আরও কিছুদিন টেনেটুনে চলল। কাজের খোঁজ চালাতে লাগল মণিলাল। কিন্তু কোথাও কোনো কাজ জুটিয়ে উঠতে পারল না সে। এভাবে আর কতদিন চলে? এক সময় ধারে মাল দিতে দিতে পাড়ার মুদি দোকান চাল-ডাল-তেল দেওয়া বন্ধ করল। বাবার ওষুধ কেনা বন্ধ তো সেই কবেই হয়েছিল, এবার না খাওয়াও শুরু হল। একে তো এই অবস্থা, তার ওপর বেশ কয়েকমাস ভাড়ার টাকা না পেয়ে বাড়িওলা এসে প্রথমে তাগাদা তারপর বাড়ি ছাড়ার জন্য হুমকি দিতে শুরু করল। মণিলালের তখন দিশেহারা অবস্থা। ঠিক এমন সময় একদিন রাস্তায় মণিলালের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল খগেন মন্ডলের। বলতে গেলে এ-কাহিনি আসলে এখান থেকেই শুরু হচ্ছে।

খগেন মন্ডল নামের লোকটা মণিলালের সঙ্গে একই কারখানায় কাজ করত। কারখানা বন্ধ হওয়াতে সে-ও বেকার হয়ে পড়েছিল। বেশ কয়েকমাস বাদে দেখা তাদের দু-জনের মধ্যে। খগেনকে দেখে মণিলালের মনে হল না যে সে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বরং তার চেহারার চাকচিক্য যেন একটু বেড়েছে। খগেন তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘খবর কী মণিলাল?’

সে জবাব দিল, ‘আর বোলো না ভাই, দুর্বিষহ অবস্থা। কাজের ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছি কিন্তু কাজ নেই। বাবা, যা অসুস্থ, ঘরে একদানা চাল নেই। তার ওপর বাড়িওলা ঘর খালি করতে বলছে।’

নিজের কথা ব্যক্ত করে মণিলাল খগেনকে প্রশ্ন করল, ‘তোমার খবর?’

খগেন বলল, ‘আমার খবর বলতে গেলে ভালোই। নতুন একটা কাজ জুটিয়েছি। রোজগারও কারখানার কাজের থেকে বেশি।’

কথাটা শুনেই মণিলাল জানতে চাইল, ‘কী কাজ ভাই? কোথায়?’

একটা খড়কে কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে খগেন বলল, ‘তুমি জনার্দন মল্লিকের নাম শুনেছ? নানা কারবার আছে তার। এরমধ্যে একটা কাজ হল অফিস-কাছারিতে দারোয়ান আর বড়োলোকদের বাড়িতে কাজের লোক সাপ্লাই দেওয়া। আমি অবশ্য দারোয়ান বা চাকরবাকরের কাজ করি না। সরাসরি জনার্দন মল্লিকের কাছেই কাজ করি। নানা কাজের তদারকি করি।’

‘জনার্দন মল্লিক!’ নামটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল মণিলালের। সে প্রথমে বলল, ‘হ্যাঁ, নামটা যেন শুনেছি কোথাও।’ এ-কথা বলে সে খগেনের হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দেখো না ভাই। তোমার জনার্দন মল্লিককে বলে যদি আমার কোনো কাজ জোটাতে পারো? যে কোনো কাজ। দারোয়ান থেকে চাকরবাকর যে কোনো কাজ। আর আমার চরিত্র সম্বন্ধে তো তুমি জানোই। কারখানাতে আমাদের বানানো কয়েকটা ব্যাঙ কটকটি নিয়েছিলাম পাড়ার ছেলেদের দেব বলে। কিন্তু তার জন্য আমি তোমার সামনেই মালিককে পয়সা দিতে গেছিলাম। অথচ ইচ্ছা করলেই আমি সেগুলো পকেটে করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারতাম যেমন অনেকে নিয়ে যেত।’

মণিলালের কথা শুনে খগেন হেসে বলল, ‘জানি, জানি, এ-ব্যাপারে তোমাকে নতুন করে কিছু বলতে হবে না। আমি দেখি তোমার জন্য কিছু করতে পারি কি না?’

মণিলাল বলল, ‘দয়া করে দেখো ভাই, বাঁচাও আমাকে। সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব তোমার কাছে।’

খগেন বলল, ‘আমি চেষ্টা করব ভাই। তোমার বাড়ি তো আমার চেনা আছে। যদি কিছু করা যায় তবে আমি তোমার বাড়ি পৌঁছে যাব।’ এ কথা বলার পর আর দু-চারটে মামুলি কথা বলে খগেন নিজের কাজে চলে গেল।

আর মণিলাল এরপর সারাদিন ধরে কাজের ধান্দায় ঘুরে ব্যর্থ হয়ে, অন্ধকার নামলে পাওনাদারদের চোখ এড়িয়ে বাড়ি ফিরল। তার মা জানতে চাইল, ‘কীরে কিছু হল?’

মণিলাল জবাব দিল, ‘হয়নি। দেখি একজনকে বলেছি যদি কিছু হয়?’ এই বলে জল খেয়ে আলো নিভিয়ে সে শুয়ে পড়ল।

মণিলাল খগেনকে তার কাজের জন্য অনুরোধ করেছিল ঠিকই, আশাও করেছিল যদি খগেন তাকে কোনো কাজ খুঁজে দেয়। কিন্তু পরদিন সকালেই যে খগেন তার বাড়িতে হাজির হবে তা সে ধারণা করেনি। হ্যাঁ, পরদিন সাত সকালেই খগেন এসে হাজির হল তার বাড়িতে। কড়া নাড়ার শব্দ শুনে মণিলাল প্রথমে ভেবেছিল যে কোনো পাওনাদার তার বাড়িতে তাগাদা করতে এসেছে বুঝি। কিন্তু দরজা খুলে সে খগেনকে দেখতে পেল। খগেন তাকে বলল, ‘জামা প্যান্ট পরে তৈরি হয়ে নাও। জনার্দনবাবুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। একটা কাজের খবর আছে। তার সঙ্গে এখন তোমাকে দেখা করাতে নিয়ে যাব। হয়তো কাজটা তোমার হয়ে যাবে।’

খগেনের কাছে এ-সংবাদ পাওয়া মাত্র মণিলাল আর দেরি না করে কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ি ছাড়ল। মণিলাল জানতে চাইল, ‘কোথায় যাব আমরা?’

খগেন বলল, ‘বউবাজার। বাসে চেপে যেতে হবে।’

মণিলাল বলল, ‘কিন্তু আমার কাছে যে বাস ভাড়ার পয়সাটুকুও নেই।’

খগেন হেসে বলল, ‘ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি তো আছি। দুর্দিনে বন্ধুর বিপদে বন্ধু সাহায্য না করলে কে করবে?’

বাসে চেপে আর তারপর পায়ে হেঁটে ঘণ্টাখানেক পরে বউবাজার পৌঁছে গেল তারা দু-জন। সেখানে পৌঁছে মণিলালকে নিয়ে একটা গলিতে ঢুকল খগেন। দু-পাশে বিরাট বিরাট পুরোনো দিনের পলেস্তরা খসা বাড়ি। বাড়ির সামনে রোয়াক। এ-গলি সে-গলি হয়ে অবশেষে মণিলালকে নিয়ে একটা দোতলা বাড়ির সামনে উপস্থিত হল খগেন। এ-বাড়িটাও পুরোনো দিনের। বাড়িটার সামনের রোয়াকে বেশ কয়েকজন ষন্ডামার্কা লোক বসে ছিল। খগেন লোকটাকে চোখের ইশারাতে কী যেন বলতেই সে পথ ছেড়ে দিল। বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল মণিলালরা। বাড়ির ভিতরটা কেমন যেন স্যাঁতস্যাতে অন্ধকার। ভালো করে আলো ঢোকে না পশ্চিমমুখী বাড়িটাতে। একতলায় অনেকটা ছোটো বড়ো ঘর, বারান্দা। তার এক পাশ দিয়ে লোহার রেলিং দেওয়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে ওপর দিকে। সেই সিঁড়ি দিয়ে খগেনের সঙ্গে ওপরে উঠতে উঠতে মণিলাল তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাইরে যাদের দেখলাম তারা কারা?’

খগেন জবাব দিল, ‘ওরা সব বাবুর কাছে কাজ করে।’

দো-তলায় উঠে একটা বারান্দা পেরিয়ে মণিলালকে নিয়ে একটা বেশ বড়ো ঘরে ঢুকল খগেন। আধো-অন্ধকার ঘর। একটা জানলার পাখির ফাঁক দিয়ে সামান্য আলো ঢুকছে ঘরে। এক কোণে একটা ফরাস পাতা। সেখানে বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে মাঝবয়সি একজন লোক। বেশ শক্তসমর্থ চেহারা তার। মোটা গোঁফ। পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি, গলায় মোটা সোনার হার। ঘরে ঢুকে মণিলালকে নিয়ে লোকটার সামনে হাজির হয়ে খগেন বলল, ‘এই হল মণিলাল। ওকে নিয়ে এসেছি।’

খগেনের কথা শুনে মণিলাল বুঝতে পারল, এ লোকটাই জনার্দন মল্লিক। মণিলাল হাত জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার জানালো তাকে।

জনার্দন মল্লিক বেশ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, ‘খগেন তোমার কথা বলেছে। তোমার সত্যি কাজের দরকার? যে কোনো কাজ করতে পারবে? মণিলাল বলল, ‘হ্যাঁ, যে কোনো কাজ করতে পারি। খুব কাজের দরকার।’

জনার্দন মল্লিক বলল, ‘আচ্ছা। একটা কাজ আছে। কেয়ারটেকারের কাজ। সত্যি কথা বলতে হলে আসলে সেটা চাকরের কাজ। সত্তর টাকা মাসিক বেতন। থাকা-খাওয়া ফ্রি। আমি অবশ্য দশ টাকা কমিশন নেই। সেটা অবশ্য তোমাকে দিতে হবে না। খগেন তোমার দুরবস্থার কথা আমাকে বলেছে। কাজটা করবে তো?’

প্রস্তাবটা শুনে মণিলাল বলল, ‘হ্যাঁ করব। নিশ্চই করব। কাজটা পেলে বেঁচে যাব আমি।’

জনার্দন মল্লিক বলল, ‘ঠিক আছে। আজ দুপুরে খগেন তোমাকে সে বাড়িতে নিয়ে যাবে। বাড়িটা শোভাবাজার অঞ্চলে। খগেন লোকটার সাথে গিয়ে কথা বলে এসেছে।’

মণিলাল বলল, ‘আচ্ছা বাবু।’

খগেন মল্লিক এরপর তার বালিশের তলা থেকে এক তাড়া নোট বার করল। সেখান থেকে পাঁচটা দশ টাকার নোট বার করে সেটা মণিলালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা তুমি রাখো। তুমি তো আমার এখানেই এবার থেকে কাজ করবে। ধীরে ধীরে টাকাটা শোধ দিয়ে দেবে।’

টাকাটা হাতে নিয়ে জনার্দনবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে গেল মণিলালের। সে বলল, ‘বাবু আপনি আমাকে বাঁচালেন।’

জনার্দন মল্লিক মৃদু হেসে বললেন, ‘দুটো কথা শুধু তুমি মনে রাখবে। এক, লোকটার বাড়িতে তুমি কাজ করলেও আসলে আমার লোক হিসাবে তুমি সেখানে কাজ করতে যাচ্ছ। আর দুই হল, খগেন দু-দিন পরপর তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করবে। তুমি তোমার আর লোকটার ব্যাপারে তাকে খবর জানাবে। কারণ, আমরা কোথাও লোক পাঠালে সে লোক আর তার মালিকের ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখি।’

মণিলাল বলল, ‘যে আজ্ঞে।’

জনার্দন মল্লিক বলল, ‘ঠিক আছে এবার তোমরা যাও।’

খগেনের সঙ্গে এরপর সে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোল মণিলাল। খগেন বলল, ‘এখন সকাল ন-টা বাজে। তুমি এখানেও থাকতে পার আবার কিছুক্ষণের জন্য বাড়িতে দেখা দিয়ে আসতে পার। বেলা বারোটা নাগাদ আমি তোমাকে নিয়ে সে লোকের বাড়ি যাবার জন্য রওনা হব।’

মণিলাল বলল, ‘আমি বরং বাড়ি থেকেই চট করে ঘুরে আসি। ঠিক বারোটার সময় আমি আবার এখানে পৌঁছে যাব।’

খগেন বলল, ‘আচ্ছা তাই করো।’

সে বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেল মণিলাল। টাকাটা পেয়ে যে তার কত উপকার হয়েছে তা আর বলার নয়। বাড়ি ঢোকার আগে সে চাল-ডাল-নুন-তেল কিনল। বাড়িতে ঢুকে মায়ের হাতে কুড়িটা টাকাও দিল পাওনাদার ঠেকাবার জন্য। তারপর চটপট স্নান সেরে অনেকদিন পর পেট পুরে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ল খগেনের কাছে ফিরে যাবার জন্য।

।। ৩ ।।

বেলা বারোটার মধ্যেই জনার্দনবাবুর বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল মণিলাল। বাড়ির সামনের রোয়াকে কয়েকজন লোকের সঙ্গে বসে ছিল খগেন। মণিলাল সেখানে উপস্থিত হতেই তাকে দেখে একজন লোক খগেনকে বলল, ‘এই তবে আমাদের নয়া চিড়িয়া? চেহারাটা কাজের মনে হচ্ছে।’

খগেন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, তোমাদের মতো এখানেই বাসা বাঁধতে চলেছে।’

এদের কথাবার্তার ঢং যেন কেমন ধরনের! হয়তো এখানে এভাবেই কথা বলার দস্তুর। মণিলাল কিছু বলল না। খগেন, মণিলালকে নিয়ে রওনা হল কর্মস্থলে যাবার জন্য।

বড়ো রাস্তা থেকে বাসে চেপে শোভাবাজার নামল তারা। তারপর গলিতে প্রবেশ করল। দু-পাশে বড়োবড়ো সব বাড়ি। দেখেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত, পয়সাওয়ালা লোকের বাস এখানে। গরমের দুপুর, রোদের তেজও বেশ। রাস্তায় কোনো লোকজন নেই। কেমন যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারপাশ। একটা ছিমছাম দোতলা বাড়ির সামনে সবুজ রঙের একটা মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। খগেন বলল, ‘ওই বাড়িতে যাব।’ সেই দোতলা বাড়ির দরজার সামনে হাজির হল তারা। দরজার ঠিক পাশেই একটা জানলা। তার পাল্লাটা একটু ফাঁক করা। মণিলালরা শুনতে পেল জানলার ফাঁক গলে ঘরের ভিতর থেকে কথার শব্দ আসছে। কে একজন পুরুষ কন্ঠে বলছে:

 ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
 বর্গী এল দেশে
 বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
 খাজনা দেব কীসে?’

খগেন দরজায় কড়া নাড়তেই ভিতরের সেই ছড়ার শব্দ থেমে গেল। তারপর জানলার পাল্লাটা আর একটু ফাঁক হল। ভিতর থেকে উঁকি দিল ফরসা গোলগাল- দাড়ি গোঁফ কামানো মাঝবয়সি একটা লোকের সুন্দর একটা মানুষের মুখ। খগেনকে দেখে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় শব্দ করতে বারণ করে জানলা থেকে সরে গেল লোকটা। খগেন চাপা স্বরে মণিলালকে বলল, এনার নাম হেমচন্দ্র মৈত্র। বড়ো ইঞ্জিনিয়ার। এঁর কাছেই কাজ করতে হবে তোমাকে।’

নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। হেমবাবুই খুললেন। বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল খগেন আর মণিলাল। একটা প্যাসেজের দু-পাশে বেশ কয়েকটা ঘর। হেমবাবু চাপা স্বরে বললেন, ‘একটু আস্তে’ বাবু সবে মাত্র ঘুমোল।’

কয়েক পা এগিয়ে হেমবাবু তাদের নিয়ে একটা ঘরে ঢুকলেন। সে ঘরে ঢোকার সময় উলটো দিকের খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেল সে ঘরের ভিতর বিছানায় শুয়ে বছর পাঁচ-ছয় বয়সি একটি বাচ্চা ছেলে ঘুমোচ্ছে। মণিলালরা ঘরে ঢোকার পর হেমবাবু ঘরের দরজাটা সম্ভবত এ-জন্য বন্ধ করে দিলেন, যাতে কথা-বার্তার শব্দে বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে না যায় সেই জন্য। এটা হেমবাবুর বৈঠকখানা। চেয়ার টেবিল সবই আছে। হেমবাবু দরজা বন্ধ করবার পর একটা চেয়ারে বসে তাকালেন মণিলালের দিকে। মণিলালকে দেখিয়ে খগেন বলল ‘স্যার, এ হল মণিলাল। খুব ভালো ছেলে। আপনার কাছে কাজের জন্য ওকে নিয়ে এলাম।’

মণিলাল হাত জোড় করে নমস্কার করল হেমবাবুকে। তিনি তার সামনে চেয়ারগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘বোসো।’ একটু ইতস্তত করেই মণিলাল চেয়ারে বসল। খগেনও বসল তার পাশের চেয়ারে।’

মণিলালের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হেমবাবু বললেন, ‘আমার এক ছেলে আছে পাঁচ বছর বয়সি। প্রধানত তার দেখাশোনার জন্য। তাকে পাহারা দেবার জন্য আর ঘরের কাজের জন্য একজন লোকের দরকার। রান্নার জন্য একটা বুড়ি আছে। সে দু-বেলা এসে রান্না করে। ছেলেটার দেখাশোনা করতে পারবে তো তুমি?’

মণিলাল জবাব দিল, ‘পারব স্যার।’

হেমবাবু বললেন, ‘ওর একটা সমস্যা আছে। এখনও ভালো করে কথা বলতে পারে না। তবে কথা বুঝতে পারে, হাসতে কাঁদতেও পারে। প্রচণ্ড জেদি ছেলে। ওর মা নেই। আমি ওর মা, আমি ওর বাবা। ও আমার চোখের মণি। আমি মুর্শিদাবাদের লোক। ক্যানিং-এর কাছে একটা নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি করার বরাত পেয়েছে আমাদের কোম্পানি। সে জন্য আমি কলকাতাতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছি। এক তলাতে আমি থাকি আর দোতলায় বাড়িওয়ালি। বাচ্চাটাকে আমি তোমার দায়িত্বে রেখে যাব। তাকে সামলাতে পারবে তো? কোনোরকম মারধোর, বকাঝকা করা চলবে না। জেদ করলে বা খেতে না চাইলে বুঝিয়ে শুনিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে। এর আগে একজন মহিলাকে কাজে রেখে ছিলাম আমি। বাবু খেতে না চাওয়াতে সে বাবুকে চড় মেরেছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছি। এবার বাবুকে দেখার জন্য পুরুষ মানুষ খুঁজছি আরও একটা কারণে—সারা দিন আমি বাড়ি থাকি না। দিনকাল ভালো না। বাবু আর এই বাড়িটাকে একা কোনো মহিলার কাছে ছেড়ে যাওয়া নিরাপদ বোধ করছি না। চোর-ডাকাত হানা দিলে সে যুঝতে পারবে না।’

মণিলাল বলল, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন স্যার। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব বাবুকে ভালো করে দেখভাল করার। আমি বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের খুব ভালোবাসি। আমি আগে একটা কারখানায় চাকরি করতাম। কারখানাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। যে কারখানাতে বাচ্চাদের জন্য টিনের তৈরি ছোটোখাটো খেলনাও বানানো হতো। আমি অনেক সময় সেখান থেকে খেলনা কিনে পাড়ার বাচ্চাদের বিলোতাম। আপনি কোনোদিন আমার পাড়ায় গেলে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বললেই বুঝতে পারবেন।’

হেমবাবু তার কথা শুনে হেসে বললেন, ‘বেশ ভালো কথা। দেখা যাক তুমি বাবুকে সামলাতে পারো কি না? তোমাকে দেখে আর তোমার কথা শুনে তোমাকে আমার মনে ধরেছে। মায়না-পত্তরের ব্যাপারে শুনেছ নিশ্চই? সত্তর টাকা বেতন দেব। মাস পয়লা বেতন দেব। বাবুকে যদি তুমি ঠিকভাবে রাখতে পারো তবে ভবিষ্যতে তোমার বেতন বাড়তেও পারে। একটাই কথা শুধু মনে রাখবে, বাবুই আমার সব কিছু। ওর সামান্য কষ্টও আমি সহ্য করতে পারি না, আর কোনোদিন করবও না। তোমাকে কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা বাবুর দেখাশোনা করতে হবে। যদি কোনোদিন আমি বাড়ি থাকি তখন সময় সুযোগ মতো তুমি বাড়ি যেতে পারবে, রাজী তো?’

মণিলাল বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। তাই হবে।’

হেমবাবু এরপর তার পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বার করে মণিলালের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোমাকে আগাম বখশিস দিলাম। আজ আর তোমাকে আটকাবো না। কাল থেকে কাজে লাগবে তুমি। কাল ভোরবেলা চলে আসবে তুমি। বাবুকে তোমার জিম্মায় রেখে আমি কাজে যাব।’

টাকাটা নিয়ে হেমবাবুকে নমস্কার জানিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মণিলাল আর খগেন। বাইরে বেরিয়ে মণিলাল পকেট থেকে সেই পাঁচটা টাকা বের করে খগেনকে বলল, ‘এই পাঁচটা টাকা তুমি রাখো ভাই। কোনো হোটেল রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভালোমন্দ খেও। তোমার জন্যই তো সবকিছু হলো। তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’

খগেন হেসে বলল, ‘না, ও টাকা তুমি তোমার কাছেই রাখো। এখন তোমার টানাটানি চলছে। তুমি তো এবার থেকে আমাদের কাজই করবে। পরে কোনোদিন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে হোটেলে খাইও। আর কাল ঠিক মতো এ জায়গাতে চলে এসো। দিন তিনেক পর আমি আসব খবরাখবর নিতে। তুমি এবার বাড়ি ফিরে যাও। আমিও আমার কাজে যাব।’

হেমবাবুর বাড়ির গলি ছেড়ে এরপর বড় রাস্তায় বেরিয়ে এল তারা দুজন। মণিলাল আর খগেন দুটো আলাদা আলাদা বাস ধরে যে যার পথে যাত্রা করল।

।। ৪ ।।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙল মণিলালের। হয়তো বা তার নতুন কাজে যোগদানের জন্যই। তবে মা-ও উঠে পড়েছিল। ছেলে যে ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়বে তা তার জানা ছিল। চা করে নিয়ে এল মা। চা খেতে খেতে মণিলালের মনে হল হেমবাবুর ছেলের জন্য কোনোকিছু একটা উপহার নিয়ে যাওয়া যায় না? তাহলে তার সঙ্গে মণিলালের ভাব করতে সুবিধা হবে। কিন্তু কী নিয়ে যাবে সে? এত ভোরে নিশ্চই খেলনা বা চকোলেটের দোকান খুলবে না। হঠাৎ তার একটা জিনিসের কথা মনে পড়ে গেল। টেবিলের ড্রয়ারটা খুলল সে। তার মধ্যে নানা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে রয়েছে দুটো টিনের ব্যাঙ-কটকটি। পাড়ার ছেলেদের জন্য কারখানা থেকে যে ব্যাঙ-কটকটিগুলো সে এনেছিল, সেগুলো বিলাবার পর দুটো এখনও তার কাছে রয়ে গেছে। তার একটা ড্রয়ার থেকে বের করে কাঁধের ঝোলাব্যাগে পুরে নিল সে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মণিলাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে এগোল বাস রাস্তার দিকে। ভোরের প্রথম বাসগুলো এখন সবে চলতে শুরু করেছে। মণিলাল তারই একটাতে চেপে বসল।

শোভাবাজারে পৌঁছে বাস থেকে নেমে মণিলাল যখন হেমবাবুর সদর দরজাতে উপস্থিত হল তখন কাঁটায় কাঁটায় সাতটা বাজে। দরজার পাশের জানলাটা একটু খোলা। ভিতর থেকে একটা বাচ্চার চিৎকার কানে আসছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে হেমবাবুর কন্ঠস্বর—’লক্ষ্মী ছেলে, সোনা ছেলে, এই দুধটুকু খেয়ে নাও বাবু। নইলে তুমি বড়ো হবে কী ভাবে? মানিক আমার খেয়ে নাও, খেয়ে নাও।’

দরজায় কড়া নাড়ল মণিলাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুললেন হেমবাবু। তাঁর এক হাতে ধরা দুধের বাটি। তিনি মণিলালকে বললেন, ‘ছেলেটা ঘুম থেকে ওঠার পর কিছুতেই দুধ খেতে চাচ্ছে না! আমি যে কী করি? ওদিকে আবার আমার আজ সকাল সকাল বেরোনোর কথা। কিন্তু সে না খেলে আমি বাইরে বেরোতে পারব না।’ এ কথা বলে সদর দরজা বন্ধ করে হেমবাবু মণিলালকে নিয়ে ঢুকলেন যে ঘরে বাচ্চাটা আছে সে ঘরে।

খাটের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে বাচ্চাটা। খুব সুন্দর দেখতে। মাথা ভরতি একরাশ কোঁকড়া চুল। টানা টানা চোখ, গোলগাল চেহারা। কিন্তু ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে সে। মণিলালকে দেখিয়ে হেমবাবু বললেন, ‘এ হল মণিলালকাকু। তোমার সাথে খেলা করবে।’ কথাটা শুনে বাচ্চাটা তাকিয়ে রইল মণিলালের দিকে। হেমবাবু তার ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন, কিন্তু দুধের বাটিটা তার মুখের সামনে তুলে ধরতেই সে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগল। সে কান্না আর থামে না। মণিলাল তার উদ্দেশে নরম গলায় বলল, ‘খেয়ে নাও বাবা খেয়ে নাও।’

তাই শুনে ছেলেটা আরও তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল!

মণিলালের তাই দেখে মনে হল, মরেছে। ছেলেটা প্রথম দর্শনেই তাকে অপছন্দ করে ফেলল নাকি? তাহলে তো সমস্যার ব্যাপার। আর এরপরই তার মনে হল ব্যাগে রাখা ব্যাঙ-কটকটিটার কথা। ব্যাগ হাতড়ে সেটা বার করে একটু ইতস্তত করে সেটাতে চাপ দিল মণিলাল। বার কয়েক বাজাতেই কান্না থামিয়ে দিয়ে মণিলালের দিকে তাকাল বাচ্চাটা। কটকটিটা তুলে ধরে আবার বাজাল মণিলাল। বাচ্চাটার চোখে মুখে যেন বিস্ময় মিশ্রিত আবছা হাসি ফুটে উঠল। হেমবাবুও বেশ বিস্মিত ব্যাপারটা দেখে। মণিলাল এরপর খাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে কটকটিটা আবার বাজিয়ে বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা তুমি নেবে?’

বাচ্চাটা হাত বাড়িয়ে সেটা নিল। তারপর সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। খাটে তার পাশে বসল মণিলাল। বাচ্চাটার হাতের আঙুলগুলোর ওপর আঙুল রেখে সে কটকটিতে চাপ দিতেই সেটা আবার বেজে উঠল। এবার আনন্দে হেসে উঠল ছেলেটি। হেমবাবুর হাত থেকে দুধের বাটিটা নিল মণিলাল। সেটা বাচ্চাটার মুখের সামনে ধরতেই বাচ্চাটা ধীরে ধীরে সেটা খেয়ে ফেলল। বাবুর ভাব হয়ে গেল মণিলালের সঙ্গে। হেমবাবু বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘আমি প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করে ওকে এক চুমুকও দুধ খাওয়াতে পারছিলাম না আর তুমি চট করে কাজটা শেষ করলে! তোমার এলেম আছে দেখছি।’

মণিলাল বলল, ‘বাচ্চাদের মনের কথা আমি একটু আধটু বুঝতে পারি স্যার।’

হেমবাবু হাসলেন তার কথা শুনে। তারপর মণিলালকে বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলি। বাইরে, আপিসে, আমার কাজের জায়গাতে সবাই আমাকে ‘স্যার’ বলে ডাকে। এ ডাক আমার শুনতে আর ভালো লাগে না। তুমি আমাকে ‘দাদাবাবু’ বলে ডেকো।’

কথাটা শুনে বেশ ভালো লাগল মণিলালের। ভদ্রলোককে দেখতে সুন্দর, তেমনি তার ব্যবহারটাও মিষ্টি। মণিলাল বলল, ‘আচ্ছা দাদাবাবু।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই যে বৃদ্ধা রান্না করে সে এসে গেল। হেমবাবু তার সঙ্গে মণিলালের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মণিলালের থাকার ঘর দেখিয়ে বাচ্চাটাকে কখন স্নান করাতে হবে, কখন খাওয়াতে হবে ইত্যাদি—সব কাজ ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। এরপর স্নান সেরে ঠাকুর ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ পূজাপাঠ করে, খাওয়া সেরে গাড়ি নিয়ে নিজের কাজে রওনা হয়ে গেলেন তিনি।

সারাটা দিন বাবুকে নিয়ে কোনো সমস্যা হল না মণিলালের। কখনও কটকটি বাজিয়ে, কখনও ঘোড়া হয়ে বাবুকে পিঠে বসিয়ে ঘরের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বাবুর মন জয় করে নিল মণিলাল। আর তার সঙ্গে হেমবাবুর নির্দেশ মতো সব কাজও করল সে।

হেমবাবু ফিরলেন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। মণিলাল তাকে দরজা খুলে দিতেই তিনি প্রথমেই জানতে চাইলেন, ‘বাবু ঠিক আছে তো? কোনো চোট আঘাত লাগেনি তো?’

মণিলাল জবাব দিল, ‘না, সে খুব ভালো আছে।’

হেমবাবু প্রথমে সটান হাজির হলেন তার ছেলের কাছে। খাটে বসে ছিল বাবু। হেমবাবু তার ছেলের পাশে বসে প্রথমে তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ভালো আছ তো সোনা?’

প্রশ্নটা শুনে বাচ্চা ছেলেটা প্রথমে মুখ থেকে ‘বু-বু’ করে শব্দ করল। তারপর হেসে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল ঘরের ভিতর দাঁড়িয়ে থাকা মণিলালকে। হেমবাবু এবার তার ছেলের হাত-পাগুলোতে, কপালে, পিঠে হাত বুলিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। সম্ভবত তার কোথাও চোট-আঘাত লেগেছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি।

রাত ন-টার মধ্যেই সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেল। মণিলাল হেমবাবুকে বলল, ‘বাবুকে কি আমি ঘুম পাড়িয়ে দেব?’

হেমবাবু বললেন, ‘না, তার দরকার নেই। আমিই ঘুম পাড়াচ্ছি। তুমি তো সারাদিন ওকে নিয়ে পরিশ্রম করেছ। এবার শুয়ে পড়ো।’

মণিলাল কথাটা শুনে বলল, ‘আমার কিন্তু কোনো অসুবিধা হবে না।’

হেমবাবু হেসে বললেন, ‘না তুমি যাও। সারাদিন তো ওকে কাছে পেলাম না। ওর ঘুমানোর সময়টুকু অন্তত ওর কাছে থাকি।’ সন্তানের প্রতি একটা স্পষ্ট মমত্ববোধ ঝরে পড়ল হেমবাবুর গলা থেকে।

মণিলাল এরপর নিজের ঘরে গিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশের ঘর থেকে হেমবাবু গলার শব্দ ভেসে আসতে লাগল:

 ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো,
 বর্গী এল দেশে,
 বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
 খাজনা দেব কীসে?’

ছেলেটাকে সত্যিই বড়ো ভালোবাসেন হেমবাবু। সারাদিন পরিশ্রম করে এসেও ছেলেকে নিয়ে ঘুম পাড়াতে বসেছেন। হেমবাবুর সেই ছড়া শুনতে শুনতে ঘুম নেমে এল মণিলালের চোখেও। এ বাড়িতে একটা দিন তার কেটে গেল।

।। ৫।।

পরদিন সকালে বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব মণিলালই নিল। কটকটি বাজিয়ে বাবুকে দুধ খাইয়ে ফেলল সে। হেমবাবু তাই দেখে মণিলালকে বললেন, ‘তোমাকে আগে পেলে বড়ো ভালো হতো। ক-দিন তো ওর জন্য বাইরেই বেরোতে পারিনি। কাজের অনেক ক্ষতি হল।’

মণিলাল বলল, ‘আপনাদের ব্রিজের কাজ কি শুরু হয়ে গেছে দাদাবাবু?’

হেমবাবু বললেন, ‘না হয়নি। তবে খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে। মালপত্র সবে পড়তে শুরু করেছে।’

মণিলালের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার পর স্নানে গেলেন হেমবাবু। তারপর পুজো, খাওয়া ইত্যাদি সেরে দিনের মতোই গাড়ি নিয়ে কাজে বেরিয়ে গেলেন।

আগের দিনের মতো এদিনও বাচ্চাটাকে নিয়ে সারাটা দিন হেসে খেলে কেটে গেল মণিলালের। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরলেন হেমবাবু। দরজা খুলতেই আগের দিনের মতো তিনি জানতে চাইলেন তার ছেলে কেমন আছে তার লাগেনি তো কোথাও। মণিলালের জবাব শুনে তিনি বাবুর ঘরে ঢুকলেন। ছেলের গায়ে সস্নেহে হাত বুলিয়ে পরখ করতে লাগলেন যে তার দেহে কোথাও চোট আঘাত লেগেছে কি না? রাত ন-টায় এদিনও বাড়ির আলো নিভে গেল। ছেলেকে ঘুমপাড়ানি ছড়া শোনাতে লাগলেন হেমবাবু :

 ‘খোকা ঘুমালো
 পাড়া জুড়ালো….।’

সেই ছড়া শুনতে শুনতে মণিলালও ঘুমিয়ে পড়ল।

তৃতীয় দিন সকালে নিয়ম মতো বাড়ি ছাড়লেন হেমবাবু। দু-দিনের মধ্যে মণিলালের সঙ্গে বাচ্চাটার এমন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে যে মণিলাল অন্য ঘরে গেলেও বাবু মুখ দিয়ে শব্দ করে তাকে ডাকে। মণিলালকে কাছছাড়া করতে চায় না সে। হেমবাবু চলে যাবার পর সেদিন বেশ কিছুক্ষণ খেলাধুলো চলল তাদের দুজনের মধ্যে। তারপর বাচ্চাটাকে স্নান করিয়ে খাইয়ে নিজের স্নান খাওয়া সেরে বেলা দুটো নাগাদ বাচ্চাটার ঘরের মেঝেতে মণিলাল যখন একটু শুতে যাচ্ছে ঠিক তখনই বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল সে। দাদাবাবু কি আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন? শব্দটা শুনেই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে মণিলাল দরজা খুলল। না, হেমবাবু নন, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে খগেন।

মণিলাল তাকে দেখে উৎফুল্ল ভাবে বলল, ‘এসো এসো, ভিতরে এসো।’

খগেন বলল, ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যে বাড়িতে নেই তা তার গাড়ি দেখেই বুঝতে পারছি। কিন্তু বাচ্চাটা কই?’ মণিলাল জবাব দিল, ‘সে এখন ঘুমাচ্ছে। ভিতরে এসো।’

খগেন যেন মৃদু ভেবে নিয়ে বলল, ‘না, ভিতরে যাওয়া ঠিক হবে না, হয়তো বাচ্চাটা জেগে যেতে পারে। বরং এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলি। তুমি দু-দিন কেমন কাটালে?’

মণিলাল বলল, ‘খুব ভালো। বাচ্চাটার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে আমার। তাছাড়া ‘দাদাবাবু’ মানে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবও খুব ভালো মানুষ। তার ছেলে অন্ত প্রাণ।’

খগেন প্রশ্ন করল, ‘দাদাবাবু কখন বাড়ি থেকে বেরোন? কখন ফেরেন?’

মণিলাল জানাল, ‘বেরোন এই দশটা নাগাদ আর ফেরেন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ।’

‘বেরোবার সময় হাতে ব্যাগ থাকে?’

সে জবাব দিল, ‘না খালি হাতেই বেরোন।’

খগেন বলল, ‘পুরো বাড়িটাই তো তোমার হাতে তিনি ছেড়ে দিয়ে যান। তা আলমারির চাবিও তোমাকে দিয়ে যান নাকি?’ শেষ প্রশ্নটা হেসেই করল খগেন।

মণিলাল বলল, ‘না, না, আলমারির চাবি-টাবি সব দাদাবাবুর কাছেই থাকে।’

খগেন বলল, ‘এ বাড়িতে অন্য কেউ আসা যাওয়া করে?’

মণিলাল জবাব দিল, ‘এই দু-দিনের মধ্যে তো কাউকে আসতে দেখিনি। রান্নার মাসি সকাল আটটা নাগাদ আসে আর রান্না সেরে দাদাবাবু বাইরে যাবার পরই চলে যায়। দাদাবাবু আসার আগে সন্ধ্যার মুহূর্তে সে আর এক বার আসে। আধ ঘণ্টা থেকে রাতের খাবারের জন্য রুটি বানিয়ে চলে যায়। আর হ্যাঁ, ভোরবেলা দুধওলা আর খবরের কাগজওলা এসে দুধের বোতল আর খবরের কাগজ দরজার সামনে রেখে যায়। তাদের অবশ্য আমি চোখে দেখিনি।’

খগেন বলল, ‘আচ্ছা, লোকটার বাড়িতে কোনো বন্দুক টন্দুক আছে নাকি?’

মণিলাল বলল ‘না, তেমন তো কিছু দেখিনি। কিন্তু কেন বলো তো?’

খগেন হেসে বলল, ‘বড়লোকের বাড়ি তো। ও সব জিনিস অনেক সময় থাকে তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

খগেন এরপর তাকে বলল, ‘খেয়াল রেখো তো তোমার দাদাবাবু ফেরার সময় কোনদিন কোনো ব্যাগ নিয়ে ফেরে কি না?’ এই অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে মণিলাল বলল, ‘খেয়াল রাখব কিন্তু কেন বলো তো?’

খগেন বলল, ‘কারণটা পরে বলব তোমাকে। দু-তিনদিন বাদে আবার আমি আসব। আর আমি যে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম বা দেখা করতে আসব সে ব্যাপারে তোমার মালিককে কিছু বলার দরকার নেই।’ এ কথা বলে মণিলালকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল খগেন। তার শেষ প্রশ্নগুলো বেশ অদ্ভুত লাগল মণিলালের। দরজা বন্ধ করে ঘরে ফিরে এল সে। ঘরে ফিরে মেঝেতে শুয়ে সে ভাবতে লাগল, কেন এ-সব কথা জানতে চাইল খগেন?

 সেদিন সন্ধ্যাতেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। দুপুর বেলা থেকে টানা ঘুম দিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে ঘুম থেকে উঠল বাচ্চাটা। সন্ধ্যা নামার পর তাকে পিঠে বসিয়ে ঘোড়া সেজে মণিলাল ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আর নিজেই বলছিল, ‘এই ঘোড়া, হ্যাট হ্যাট।’ আর তার পিঠে বসে বাচ্চাটা মুখ দিয়ে ‘বু বু’ শব্দ করছিল। সে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। এমন সময় কড়া নাড়ার শব্দ হল। এ সময় আবার কে এল? শব্দটা শুনে মণিলাল তাকে খাটে বসিয়ে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলে সে দেখল দাদাবাবু আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছেন। যথারীতি তিনি মণিলালকে একই প্রশ্ন করলেন ও একই জবাব পেলেন। এরপর তিনি মণিলালকে বললেন, ‘বড্ড মাথা ধরেছে। একটু চা করে আনো।’

তার কথা শুনে মণিলাল এগোল রান্নাঘরের দিকে, আর হেমবাবু তার ছেলের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। মিনিট পাঁচ-সাত সময় পর মণিলাল চা নিয়ে ঢুকল সেই ঘরে। হেমবাবু তখন তার ছেলের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করে দেখছেন যে কোথাও তার চোট আঘাত লেগেছে কি না। মণিলাল দাদাবাবুর হাতে কাপ-প্লেট ধরিয়ে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোতে যাচ্ছিল একটা কাজ করার জন্য। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে খাট থেকে নেমে পড়ল। হেমবাবু চায়ের কাপ মুখে তুলতে যাচ্ছিলেন, আর দরজার বাইরে বেরোতে যাচ্ছিল মণিলাল, ঠিক সেই সময় তাদের দুজনকে চমকে দিয়ে ছেলেটা বলে উঠল ‘ঘো-ও-ও লা, ঘো-ও-লা!’

হেমবাবুর হাতের কাপ থেমে গেল। মণিলালও চমকে উঠে ফিরে দাঁড়াল। যে ভুল শুনল নাকি?’ না, সে ভুল শোনেনি। বাচ্চাটার দিকে মণিলাল ফিরে দাঁড়াতেই সে আবারও বলল ‘ঘো-ও-লা!’ অর্থাৎ ঘোড়া! মণিলালকে ঘোড়া হতে বলছে যে! কথা ফুটছে ছেলেটার মুখে!

চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে হেমবাবু যেন আনন্দে প্রায় পাগল হয়ে মাটি থেকে কোলে উঠিয়ে নিলেন ছেলেটাকে। তারপর চুমু খেতে লাগলেন তার শরীরে। এই আনন্দ দৃশ্য দেখে চোখে জল এসে গেল মণিলালের। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছেলেকে আদর করার পর তাকে মেঝেতে নামালেন হেমবাবু। তারপর পকেট থেকে দশটা দশ টাকার নোট বার করে মণিলালের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা তুমি রাখো। না, এটা বেতন নয়, তোমার বখশিস। তোমার জন্যই তো বাবু আজ প্রথম কথা বলল। তুমি যে আমার কী উপকার করলে তা তুমি নিজেই জান না।’

টাকাটা মণিলালের হাতে ধরিয়ে দিলেন দাদাবাবু। মণিলালের চোখ দিয়ে তখন জল ঝরার উপক্রম। সে বুঝতে পারল এ তিন দিনে বাচ্চাটাকে কম ভালোবেসে ফেলেনি সে নিজেও। তারও প্রচণ্ড আনন্দ হচ্ছে বাচ্চাটার মুখে বোল ফোটাতে। এরপর নিশ্চই ধীরে ধীরে আরও কথা বলতে শুরু করবে সে। বাচ্চাটা আবার বলে উঠল ‘ঘো-ও-ও-লা।’ তার কথা শুনে মণিলাল সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে বসে পড়ে পিঠে তুলে নিল তাকে। তারপর ঘোড়া সেজে হামাগুড়ি দিয়ে সারা ঘরে ঘুরতে লাগল। হেমবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে তার বৈঠকখানায় ঢুকলেন। বাচ্চাটাকে পিঠে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মণিলাল শুনতে পেল দাদাবাবু টেলিফোনে কাকে যেন আনন্দ সংবাদটা দিচ্ছেন, ‘যেটুকু সমস্যা ছিল সেটুকুও কেটে গেছে। ছেলে আজ কথা বলছে!’

একটানা কথাগুলো বলে থামল বৃদ্ধ। সুপার সাহেবকে সে বলল, ‘একটু জল হবে?’

স্নেহাংশু তার দিকে টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলেন। লোকটা জল খেয়ে একটু চুপ করে থেকে এরপর শুরু করল তার জীবন কাহিনির দ্বিতীয় অধ্যায় :

।। ৬।।

পরদিন ভোরবেলা নিয়ম মাফিক বাবুকে খেয়াল রাখার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন হেমবাবু। সারাটা দিন বাচ্চাটাকে নিয়ে খেলে কাটাল মণিলাল। কখনও ঘোড়া সেজে আবার কখনও কটকটি বাজিয়ে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বাড়ির সামনে গাড়ি আসার শব্দ শুনে দরজা খুলল মণিলাল। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি ঢুকলেন হেমবাবু। তাঁর হাতে একটা মোটা চামড়ার ব্যাগ। সেটা দেখেই খগেনের কথা মনে পড়ে গেল মণিলালের। অন্যদিন তিনি ঢোকার পর মণিলালই দরজা বন্ধ করে। কিন্তু হেমবাবু এদিন নিজেই দরজা বন্ধ করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবু ভালো আছে তো? আর কোনো কথা বলতে পারছে?’

মণিলাল জবাব দিল, ‘ভালো আছে। ওই ঘোড়া কথাটা বেশ অনেকবার বলেছে। অন্য শব্দ বলেনি। তবে নিশ্চই আস্তে আস্তে বলবে। সবে তো কাল প্রথম শব্দটা বলল।’

মণিলালের কথা শুনে হাসলেন দাদাবাবু। এদিন এই প্রথম তিনি ছেলের ঘরে ঢুকলেন না। পাশের একটা ঘরে ঢুকলেন। সে ঘরের ভিতরে রাখা লোহার আলমারি খোলার শব্দ শুনতে পেল মণিলাল। ব্যাগটা সে ঘরের আলমারির মধ্যে রেখে তারপর ছেলের ঘরে ঢুকলেন।

যথা নিয়মে সেদিন রাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়ালেন হেমবাবু। সেই একই ছড়া:

 ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো

 বর্গী এল দেশে—

সে ছড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল মণিলালও।

পরদিন সকালবেলা হেমবাবু বললেন, ‘এ তিন দিন আমি আর বাইরে বেরোব না। সোমবার থেকে কাজ শুরু হবে। তখন খুব ভোরে বেরোতে হবে আর ফিরতে অনেক রাত হবে। হয়তো বা কোনো কোনো দিন বাড়িও ফিরতে পারব না। কাজেই এ তিনটে দিন বিশ্রাম নেব। বড়ো কাজে নামার আগে শরীর চাঙ্গা করা প্রয়োজন। তাছাড়া ছেলেটাকে তো এরপর কিছুই সময় দিতে পারব না। ওকে এ তিনদিন একটু সঙ্গ দিই।’

মণিলাল একবার ভাবল যে বাবুর মা কোথায়? তিনি অন্য কোথাও থাকেন? না কি তিনি জীবিত নেই? মাঝে মাঝেই তার এ কথাটা জানার ইচ্ছা হয়। প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সঙ্কোচের কারণে সে জিজ্ঞেস করে উঠতে পারল না কথাটা।

একটু বেলার দিকে মৃদু বিপত্তি সৃষ্টি হল এদিন। কটকটিটা বাবুর বিছানাতেই থাকে। দুপুরের খাবার কিছু আগে বাবু কটকটিটা খুঁজতে শুরু করল। তারপর কান্না আরম্ভ করল সে। কটকটিটা তার চাই। হেমবাবু, মণিলালকে বললেন, কটকটি দোকানে কিনতে পাওয়া যায়?’

মণিলাল বলল, ‘যায় নিশ্চয়ই। কিন্তু কোন দোকান তা আমি জানি না। তবে বড়ো দোকানে এসব বিক্রি হয় না। গরিবের খেলনা। ছোটোখাটো দোকান আর ফিরিওলারা বিক্রি করে এসব। তবে আমার বাড়িতে আরও একটা আছে। বাড়ি যখন যাব তখন নিয়ে আসব।’

এরপর অনেক কষ্টে বাবুকে শান্ত করে ঘুম পাড়ানো হল।

দুপুর কেটে গেল। বিকালবেলা মণিলাল যখন দাদাবাবুকে চা দিতে ঢুকল বাবু তখনও ঘুমোচ্ছে। চায়ের কাপ হাতে নেবার পর হেমবাবু বললেন, ‘সোমবার কাজ শুরু হবার পর তো তোমাকেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বাবুকে দেখতে হবে। একদিনের জন্যও আমি বাড়ি থাকতে পারব না তখন। কাজেই তখন তোমার বাড়ি যাবার জন্য একদম ছুটি মিলবে না। তুমি বরং একটা কাজ করো। এই তিন দিন তো আমি বাড়িতেই আছি। তুমি আজ এখন বাড়ি চলে যাও। রবিবার বিকালে ফিরে এসো। তাছাড়া ওই কটকটিটাও আনা প্রয়োজন। জিনিসটা ও খুব ভালোবাসে।’

দাদাবাবুর প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সে যে বেশ কিছুদিন বাড়ি ফিরতে পারবে না সেটা বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে আসা প্রয়োজন। বাড়ি থেকে নিজের কিছু জামাকাপড়ও আনার দরকার আছে তার। তাছাড়া হেমবাবু তাকে এক-শ টাকা দিয়েছেন। তা দিয়ে ঘর ভাড়া আরও কিছুটা মেটানো যাবে। অনেকদিন হল মণিলাল বাবার জন্য ওষুধ কিনতে পারেনি। সেটাও কেনা সম্ভব হবে।’

মণিলাল তবুও হেমবাবুকে বলল, ‘কিন্তু আমি চলে গেলে তো আপনার খুব অসুবিধা হবে।’

হেমবাবু হেসে বললেন, ‘তা একটু হবে ঠিক। কিন্তু আমি সামলে নেব। আগের মেয়েটা কাজ ছেড়ে চলে যাবার পর তো আমি একাই সামলাতাম ওকে। যাও, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো। বাবুর ঘুম ভাঙলে তখন হয়তো সে তোমাকে যেতে দেবে না। আটকে দেবে।’

মণিলাল বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তবে তাই করছি।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিল মণিলাল। তারপর সে বাড়ি ছেড়ে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে নিজের কালিঘাটের বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেল সে। সন্ধে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি পৌছে গেল সে। তাকে দেখে খুশি হল বাবা-মা।

শনিবারটা নানা ব্যস্ততার মধ্যে কাটল মণিলালের। ঘরদোর পরিষ্কার ছাড়াও বাড়িওয়ালাকে সে আরও তিরিশটা টাকা দিয়ে এল। বাবার ওষুধও কিনল। বিকেলে পাড়ার মাঠে গিয়ে পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে সময়ও কাটাল। আর এ-সবের মধ্যে মাঝে মাঝেই তার মনে পড়ে যেতে লাগল বাবুর কথা। সত্যিই বাচ্চাটাকে এ ক-দিনে খুব ভালোবেসে ফেলেছে সে। রবিবার সকালে বাজারে গেল সে। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে এক-শ টাকার বেশ দাম ছিল। তা দিয়ে মাংস কিনল মণিলাল। বহু দিন পর মাংস রান্না করল মণিলালের মা।

দুপুরে ভাত খেতে বসল মণিলাল আর তার বাবা। ভাত আর মাংস বেড়ে দিচ্ছে মণিলালের মা। সবার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। মাংস দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে মণিলালের বাবা বলল, ‘তোর এই কাজটা কে জোগাড় করে দিল?’

মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে মণিলাল বলল, ‘আমার পরিচিত এক বন্ধু। খগেন তার নাম। আমার মতোই কারখানাতে চাকরি করত। সেখান থেকেই আলাপ তার সঙ্গে। পথে একদিন দেখা হল তার সঙ্গে। সে একজনের কাছে কাজ করছে। আমি তাকে আমার দুরবস্থার কথা বলতে সে তার মালিকের কাছে আমাকে নিয়ে গেল। জনার্দন মল্লিক তার নাম। বৌবাজারে তার বাড়ি। অনেক রকম কারবার তার। এর মধ্যে একটা কারবার হল অফিসে, লোকের বাড়িতে লোক সাপ্লাই দেওয়া। তার মাধ্যমেই আসলে আমি কাজটা পেলাম।’

মণিলালের কথা শুনে মাংসের ঝোলমাখা ভাতের গরসটা মুখে তুলতে গিয়েও হঠাৎ থমকে গেল তার বাবা। মণিলালকে সে বলল, ‘তোকে একবার সেই ডাকাতির গল্পটা বলেছিলাম মনে আছে? আমাদের সেই কাপড়ের দোকানে। মানে, যেখানে আমি এক সময় কাজ করতাম সেখানে একবার ডাকাতি হয়েছিল। ডাকাতি করে পালাবার সময় বাজারের লোকরা ডাকাতদের কয়েকজনকে ধরে ফেলেছিল। তাদের থেকে তাদের পান্ডার নাম পুলিশ জানতে পারে। সে লোকটারও নাম ছিল জনার্দন মল্লিক। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও পরে তাকে প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেয়। এ লোক সে লোক নয় তো?’

বাবার মুখে কথাটা শুনে এবার মণিলালের মনে হল যে সে যখন খগেনের মুখে প্রথম জনার্দন মল্লিকের নাম শোনে, তখন কেন এ নামটা যে কোথায় শুনেছে বলে মনে হয়েছে তার! বাবার মুখেই ডাকাতির গল্পটার সঙ্গে বেশ কয়েকবার এ-নাম শুনেছে সে। মণিলাল বলল, ‘না, না। একই নাম হলেও এ লোক সে লোক নিশ্চই নয়। এ ভারী ভালো লোক। আমাকে ওই ইঞ্জিনিয়ার দাদাবাবুর বাড়ি পাঠাবার জন্য কোনো কমিশন নেবে না বলেছেন। উপরন্তু নিজে থেকে আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিলেন আমার অবস্থা শুনে। বললেন যে আমি তো তার কাজ করবই, পরে ধীরে ধীরে টাকাটা শোধ দিলেই হবে।’

কথাটা শুনে বাবা বলল, ‘আচ্ছা নিশ্চিন্ত হলাম। দিনকাল ভালো নয়। কে কখন নিজের অজান্তে কোন বিপদে জড়িয়ে পড়ে কে জানে!’

মণিলালের মা-ও বলল, ‘তোকে নিয়ে বড্ড চিন্তায় থাকি। কোনোদিন কোনো অন্যায় কাজে জড়াস না। তার চেয়ে আমরা না খেতে পেয়ে মরে যাব তাও ভালো।’

মণিলাল হেসে বলল, ‘এ ব্যাপারে আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো। এতদিন খারাপ গেছে, আমরা না খেয়ে থেকেছি, কিন্তু কোনো দিন বিপথে যাইনি।’

মা বলল, ‘সে ভরসা তোর ওপর আছে। তবু বললাম। কোন মুহূর্তে মানুষ বিপদে পা বাড়ায় তা সে নিজেও জানতে পারে না।’

এরপর নানা গল্প করতে করতে তৃপ্তিতে খাওয়া শেষ করল মণিলাল আর তার বাবা। মণিলাল এরপর তার নিজের ঘরে বিশ্রাম নেবার জন্য ঢুকল। একটু ঘুমিয়ে নিয়ে বিকাল চারটের সময় রওনা হলে সে সন্ধ্যার আগেই শোভাবাজারে দাদাবাবুর বাড়ি পৌঁছে যাবে। তার ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সে ইতিমধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছে। শুধু কটকটিটাই নিতে বাকি। বেরোবার সময় সে সেটা টেবিলের ড্রয়ার থেকে বার করে পকেটে নেবে। সেটা নিতে ভুল হবে না তার। বাচ্চাটা অপেক্ষা করে আছে কটকটিটার জন্য। সেটা নিতে কি সে ভুলতে পারে? বিছানাতে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল মণিলাল। ঠিক সেই সময় মণিলাল শুনতে পেল সদর দরজাতে কে যেন কড়া নাড়ছে!

।। ৭ ।।

দরজা খুলেই মণিলাল দেখতে পেল খগেন এসেছে। সে বলল, ‘আরে তুমি! ভিতরে এসো।’

খগেন বলল, ‘না, ভিতরে ঢুকব না। তুমি কি কাজ ছেড়ে দিয়েছ? কাল তোমাকে খুঁজতে গিয়ে পাইনি। কাল দরজায় কড়া নাড়তে ওই ইঞ্জিনিয়ার দরজা খুলল। বলল, তুমি বাড়ি চলে গেছ। এ কথা বলেই সে দরজা বন্ধ করে দিল!’

মণিলাল হেসে বলল, ‘দাদাবাবু বাড়িতেই আছেন। তাই আমাকে ছুটি দিয়েছেন। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই আবার আমি সেখানে ফিরে যাব।’

খগেন বলল, ‘এবার বুঝলাম ব্যাপারটা। তাই ওই যে ব্যাগের কথা বলেছিলাম দেখেছ নাকি অমন ব্যাগ?’

মণিলাল বলল, ‘হ্যাঁ, দু-দিন আগেই তিনি একটা চামড়ার ব্যাগ সঙ্গে করে নিয়ে ফিরেছেন। কিন্তু ওই ব্যাগের ব্যাপারটা কী? এ ব্যাপারে তোমার এত আগ্রহ কেন?’

খগেন বলল, ‘সব তোমাকে বলছি। তার আগে বলো ব্যাগটা কোথায় রেখেছ লোকটা?’

মণিলাল বলল, ‘দাদাবাবুর ঘরের লোহার আলমারিতে।’

খগেন বলল, ‘ওতে ব্রিজ বানাবার কাজের জন্য এক লাখ টাকা আছে। আমাদের কাছে খবর ছিল যে কিছুদিনের মধ্যেই লোকটার হাতে টাকাটা আসবে।’

এ কথা বলার পর খগেন চাপা স্বরে বলল, ‘এবার যা বলছি তা মন দিয়ে শোন। আজ অমাবস্যা। রাত ঠিক বারোটা নাগাদ ও বাড়ির সদর দরজাতে টোকা পড়বে। তুমি দরজা খুলে দেবে। চার পাঁচজন মুখোশ পরা লোক ঢুকবে বাড়িতে; তাদের হাতে অস্ত্র থাকবে। তুমি তাদের দেখে ভয় পাবার অভিনয় করলেও তুমি ভয় পাবে না। যাতে তোমাকে পরবর্তীকালে পুলিশ সন্দেহ না করে সে জন্য তোমারও মুখ হাত বেঁধে ফেলবে তারা। দু-একটা মৃদু চড়থাপ্পড়ও তারা তোমাকে মারতে পারে ইঞ্জিনিয়ারের সামনে। লোকগুলো এরপর বাচ্চা ছেলেটার মাথায় পিস্তল ধরে তোমার দাদাবাবুর কাছ থেকে টাকার ব্যাগটা নিয়ে আসবে। তোমার দাদাবাবু যদি সে লোকগুলোকে পালটা আক্রমণ না করে তবে তাদের বিপদের কারণ নেই।’

খগেনের কথা শুনে মণিলাল চমকে উঠে বলল, ‘এ কী বলছ তুমি? এ তো ডাকাতি!’

খগেন শান্ত স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ ডাকাতি। যারা ওখানে যাবে তারা সব জনার্দনবাবুর লোক। এ কাজের জন্যই তোমাকে ওখানে পাঠানো হয়েছিল।’

হতভম্ব মণিলাল বলল, ‘কিন্তু কীভাবে এ কাজ করব আমি!’

খগেন বলল, ‘তোমাকে খুন-জখম করতে বলা হচ্ছে না। জানি ওকাজ শিখতে তোমার সময় লাগবে। সামান্য কাজ করতে হবে তোমাকে। টোকা মারার শব্দ শুনলে শুধু দরজাটা খুলে দেবে।’

এরপর সে বলল, ‘শোনো মণিলাল। কাজটা করতে পারলে তুমি দু-হাজার টাকা বখরা পাবে। জনার্দনবাবুর দলে পাকাপাকি ঢুকে পড়তে পারবে। ভবিষ্যতে টাকার অভাব হবে না।’

মণিলালের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘কিন্তু যদি না পারি?’

খগেন জবাব দিল ‘জনার্দনবাবুকে তুমি চেনো না। দু-চারটে খুন জখম তার কাছে কোনো ব্যাপার না। এইতো মাস তিনেক আগের ঘটনা। একটা ব্যাঙ্কে একজন নিরাপত্তা রক্ষী দিয়েছিলাম আমরা। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তার মাধ্যমে খবরাখবর সংগ্রহ করে ব্যাঙ্কের ক্যাশ গাড়ি লুঠ করবার। কিন্তু আমরা তাকে ব্যাপারটা বলতেই সে কথাটা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিল। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষও ব্যাপারটা পুলিশকে জানাল। পুলিশের মধ্যেও জনার্দনবাবুর চর আছে। আমরা জানতে পারলাম যে নির্দিষ্ট দিনে পুলিশ সাদা পোশাকে আমাদের জন্য ওত পেতে থাকবে। আমরা গেলেই আমাদের পাকড়াও করবে। আমাদের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেলেও সে লোকটা কিন্তু জনার্দনবাবুর হাত থেকে ছাড়া পেল না। ওই নিরাপত্তা রক্ষীকে তার সততার জন্য পুরস্কৃত করে ব্যাঙ্ক পাকা চাকরি দিয়েছিল। তবে এক মাসের বেশি সে চাকরি ভোগ করা হল না তার। মাস পয়লা বেতন পেয়ে স্ত্রী-বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য ব্যাগ ভরতি বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরছিল সেই বিশ্বাসঘাতক। তার জন্য বাড়ির গলির মুখে সন্ধ্যার অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন লোক। ব্যাগ হাতে লোকটার আর বাড়ি ফেরা হল না। গলির মুখে ঢুকতেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে গেল। বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করে না জনার্দন মল্লিক।’

গল্পটা শুনে চমকে উঠল মণিলাল। তার গলা শুকিয়ে গেল।

মণিলালের দিকে তাকিয়ে খগেন এরপর বলল ‘ঘাবড়িও না তুমি। ছোটো কাজ। আজ ঠিক রাত বারোটাতে আমাদের লোকেরা টোকা দেবে, আর তুমি দরজা খুলবে। ঠিক রাত বারোটা। এবার আমি যাচ্ছি। ব্যাঙ্কের লোকটার গল্পটা মনে রেখো কিন্তু।’ এই বলে মণিলালকে আর একটাও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল খগেন। সে অদৃশ্য হয়ে গেল মণিলালের চোখের আড়ালে।

খগেন চলে যাবার পরও বেশ স্তম্ভিত ভাবে একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে রইল মণিলাল। সম্বিত ফিরতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল তার। সে এবার বুঝতে পারল যে একটু আগে খেতে বসে বাবা যে ডাকাত সর্দার জনার্দনের কথা বলছিল সে লোক আর এই জনার্দন একই লোক। মণিলালের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে খগেন তাকে জড়িয়ে দিয়েছে জনার্দন মল্লিকের পাপ কর্মের জালে!

কিন্তু কী করবে মণিলাল। একটু ভেবে নিয়ে মণিলাল সিদ্ধান্ত নিল যে সে কিছুতেই করবে না। সে দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছে। কিন্তু কোনো দিন কাউকে এক পয়সাও ঠকায়নি। দাদাবাবু কতো ভালোবাসেন তাকে, বাচ্চাটা তাকে চোখে হারায় না। না, সে কিছুতেই তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না। এ কাজ করলে যে নরকেও স্থান হবে না। তাকে যদি এর জন্য ব্যাঙ্কের সেই দারোয়ানের মতো খুন হতে হয় তবে তাই সই, কিছুতেই সে এ কাজ করবে না। তাছাড়া এ খবরটা যত দ্রুত সম্ভব জানিয়ে দিতে হবে দাদাবাবুকে। মণিলাল দরজা না খুললে হয়তো দরজা ভেঙেই বাড়িতে ঢুকবে ডাকাতদল। আর তারা সাক্ষ্য প্রমাণ লোপাট করার জন্য প্রথমেই হয়তো খুন করবে মণিলালকে। সব চেয়ে বড়ো কথা এই নৃশংস লোকগুলো যদি ওই অবোধ শিশুটার কোনো ক্ষতি করে তখন? এখনই মণিলালকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে দাদাবাবুর বাড়ি। মণিলাল আর ঘুমালো না। ঘুমোবার সময় এটা নয়। পোশাক পালটে, কটকটিটা পকেটে পুরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে মণিলাল কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের বাড়ি থেকে রওনা হয়ে গেল শোভাবাজারে পৌঁছবার জন্য।

বেলা চারটে নাগাদ মণিলাল পৌঁছে গেল দাদাবাবুর বাড়ির সামনে। বাইরে দাদাবাবুর গাড়িটা নেই, অথচ বাড়ির সদর দরজা খুললেন বৃদ্ধ বাড়িওয়ালি। মণিলাল বাড়ির ভিতর পা রাখতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধা বললেন, ‘তোমার দাদাবাবু তো নেই। আজ ভোরেই তিনি ভাড়া মিটিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।’

মণিলাল বিস্মিত ভাবে বলল, ‘কই তিনি যে চলে যাবেন তা তো আমাকে বলেননি!’

বৃদ্ধা বললেন, ‘হ্যাঁ, ইঞ্জিনিয়ারসাহেব বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। তবে তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমার বেতনের সত্তর টাকা তিনি আমাকে দিয়ে গেছেন তোমাকে দেবার জন্য।’ এই বলে বৃদ্ধা আঁচলে বাঁধা টাকার গিট খুলতে লাগলেন।

মণিলাল ভাবার চেষ্টা করল, ‘দাদাবাবু হঠাৎ এ ভাবে চলে গেলেন কেন? কোন জরুরি কাজ? নাকি তিনি কোনোভাবে জানতে পেরেছেন যে এখানে থাকলে তার ওপর বিপদ নেমে আসতে পারে? খগেন তো কাল এখানে এসেছিল। তাকে দেখে কি দাদাবাবুর মনে কোনো সন্দেহ হয়েছিল? তিনি কি জনার্দন মল্লিকের ব্যাপারে কিছু শুনেছেন? কেউ কি এসে তাকে জানিয়ে গেছে ব্যাপারটা?’— দ্রুত এসব ভেবে নিয়ে মণিলাল বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করল, ‘কেউ কি দাদাবাবুর এখানে এসেছিল?’

বৃদ্ধা বলল, ‘আজ বেলার দিকে একদল খ্রিস্টান মিশনারি এসেছিল ইঞ্জিনিয়ারসাহেব আর বাচ্চাটার সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু তার আগেই তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের মুখ থেকেই শুনতে পারলাম যে বাচ্চাটা ওর নিজের ছেলে নয়, মিশনারি থেকে বাচ্চাটাকে দত্তক নিয়েছেন তিনি। কেন যে এভাবে লোকজনকে না জানিয়ে চলে যাওয়া কে জানে? কত করে তাঁকে বললাম সে আজ অমাবস্যা। আজ বাড়ি ছাড়া ঠিক নয় তবু তিনি শুনলেন না। আরও কতজন তার খোঁজে আসবে কে জানে?’ এই বলে মণিলালের হাতে সত্তর টাকা ধরিয়ে দিলেন তিনি।

বাবু যে হেমবাবুর পালিত পুত্র তা জেনে মণিলাল বেশ বিস্মিত হল। কিন্তু তার সঙ্গে এ-কথা শুনে মণিলালের তার দাদাবাবুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধও জেগে উঠল। বাবু দত্তক পুত্র, কিন্তু তাকে নিজের প্রাণের চেয়েও ভালোবেসে কীভাবে মানুষ করছেন দাদাবাবু! যা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। বাচ্চাটা যেন হেমবাবুর হৃৎপিণ্ড!

মণিলাল প্রশ্ন করল, ‘দাদাবাবুরা কোথায় গেছেন জানেন?’

বৃদ্ধা অস্ফুটভাবে বলল, ‘না, জানি না। আমার কথাই যখন তিনি শুনলেন না তখন তাকে আর জিজ্ঞেস করিনি কথাটা। আমাকে আবার এখন নতুন ভাড়াটে খুঁজতে হবে। ভালো ভাড়াটের খোঁজ থাকলে নিয়ে এলে বখশিস দেব। এবার তুমি যাও বাপু।’ এই বলে বৃদ্ধা দরজা বন্ধ করে দিলেন।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে মণিলাল ভাবতে লাগল দাদাবাবু কোথায় যেতে পারেন? হয়তো তিনি মণিলালকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। কিন্তু খোঁজ পাননি বলে নিয়ে যেতে পারেননি। এমনও হতে পারে যে তার বাড়িতে যে ডাকাত পড়তে চলেছে সে খবরটা তিনি জানেনই না। অন্য কোনো জরুরি কাজে তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। ডাকাতরা হয়তো তিনি যেখানে গেছেন সেখানেও তার পিছু ধাওয়া করতে পারে। তাই তার সঙ্গে মণিলালের দেখা করা প্রয়োজন। তাছাড়া বাবু হয়তো খুঁজছে তার ঘো-ও-ওলা’ মণিলালকে, খুঁজছে কটকটিটাকে। কিন্তু মণিলাল কোথায় খুঁজে পাবে তাদের?

এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে মণিলালের মনে হল দাদাবাবু ক্যানিংয়ে কোথাও গিয়ে থাকতে পারেন। যেখানে পরদিন থেকে ব্রিজের কাজ শুরু হবার কথা। আর তিনি সেখানে না থাকলে হয়তো সেখানে অন্য যারা লোক আছে তারা দাদাবাবুর সন্ধান জানাতে পারবে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে মণিলাল সিদ্ধান্ত নিল সে ক্যানিং যাবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শোভাবাজার থেকে বাস চেপে শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে রওনা হল মণিলাল। তারপর ক্যানিংগামী সন্ধ্যার ট্রেনে চেপে বসল সে। টিকির টিকির করে চলতে শুরু করল ট্রেনটা। পথ যেন আর ফুরোয় না। মণিলালের খালি মনে পড়তে লাগল বাচ্চাটার কথাটা। তার সঙ্গে দেখা মিলবে কি? সবশেষে রাত আটটার একটু আগে ট্রেন ক্যানিং পৌঁছাল।’ এ পর্যন্ত বলে আবার থামল সাতশো সাতাত্তর নম্বর কয়েদি। আবার সে জল খেল। জেলার স্নেহাংশুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘আপনি বিরক্তবোধ করছেন না তো? আর সামান্য একটু বাকি।’

স্নেহাংশু বললেন, ‘না, না, বেশ ইন্টারেস্টিং আপনার অতীত জীবন। আপনি বলুন।’

বৃদ্ধ সাতশো সাতাত্তর মৃদু হেসে আবার একবার আবৃত্তি করল তার ছড়াটা —’খোকা ঘুমালো….।’

এরপর বৃদ্ধ বলতে শুরু করল সেই জীবন কাহিনির শেষ অনুচ্ছেদ :

।। ৮।।

‘আমি দীর্ঘদিন এ-জেল ও-জেলের চার দেওয়ালের মধ্যে আছি। আজকের ক্যানিং স্টেশন কেমন আমার জানা নেই। তবে সেদিনের মণিলালের দেখা রেলস্টেশনটা ছোট্ট একটা রেলস্টেশন। রেলগাড়ি এখানে এসেই থেমে যায়। মণিলালের সঙ্গে কিছু লোক এসে ক্যানিং স্টেশনে নামল ঠিকই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা প্ল্যাটফর্ম থেকে অদৃশ্য হল। স্থানীয় মানুষ সব। তারা রওনা হল যে যার বাড়ির পথে। জনশূন্য হয়ে গেল ছোট্ট প্লাটফর্মটা। বাইরে বেরিয়ে আসতেই একটা আঁশটে গন্ধ নাকে লাগল মণিলালের। সামনেই মাছের আড়ত। তবে দরমার বেড়া আর খড়ের ছাউনি দেওয়া মাছের আড়তগুলোর অধিকাংশই ঝাঁপ বন্ধ। দু-একটা দোকানঘরে শুধু লন্ঠন বা তেলের কুপি জ্বলছে।

একটা আড়তের সামনে বসে কয়েকজন লোক গল্প করছিল। মণিলাল তাদের কাছে গিয়ে ব্রিজটা কোথায় হবে জানতে চাইল। লোকগুলো বলল, ‘জায়গাটা একটু আছে। অন্ধকারে একলা যেতে পারবেন না। একটা ভ্যান রিকশা ডেকে দিচ্ছি তাতে চলে যান।’

মণিলাল তাদের প্রস্তাবে সম্মত হলে তারা আড়তে মাছের ঝুড়ি বয়ে আনা একটা ভ্যান রিকশা ডেকে দিল। তাতে চড়ে বসল মণিলাল। আড়ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল রিকসা। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকালয় ত্যাগ করে নদী পাড়ের দিকে এগিয়ে চলল ভ্যান রিকশা। পথে কোনো লোকজন নেই। অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে। মণিলাল বুঝতে পারল তার পক্ষে একলা ও জায়গাতে যাওয়া সম্ভব হত না। যানটা পেয়ে ভালোই হয়েছে। ভ্যান চালককে সে প্রশ্ন করল, ‘ওদিকে কোন লোকজন আছে?’

ভ্যানওলা জবাব দিল ব্রিজের কাজের জন্য কয়েকজন লোক এসেছে। তারা ওখানে একটা ঘর বানিয়েছে। তারা ছাড়া ওদিকে কেউ যাবে না। শুনেছি আর ক-দিনের মধ্যেই ব্রিজের কাজ শুরু হবে। দিনের বেলা লরি করে পাথর-বালি এসব আসা শুরু হয়েছে। তখন নিশ্চয়ই অনেক লোকজন এসে থাকবে ওখানে।’

মিনিট কুড়ি চলার পর বাতাসে মৃদু নোনা গন্ধ এসে লাগল মণিলালের নাকে। আর এর পরই নদীর পাড়ে এসে থামল রিকশা। আশেপাশে কোথাও কোন লোকজন নেই, একটা কুকুর পর্যন্ত নয়। বেশ কিছুটা দূরে নদীর পাড় বরাবর যেন এক বিন্দু আলো জ্বলছে। সে দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে ভ্যানওলা বলল, ‘ওই যে ওদের ঘর। আমি আর ওদিকে যাব না। পাড় বরাবর চলে যান। ওখানে পৌঁছে যাবেন।’

ভ্যানওলার ভাড়া মিটিয়ে দিতেই সে ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেল, আর মণিলাল নদীর পাড় বরাবর এগোল সেই আলোক বিন্দুর দিকে। কাঁচা রাস্তাটার দু-পাশে বড়ো বড়ো ঝোপঝাড়। মাটির রাস্তাটায় ভারবাহী লরির চাকার লম্বাটে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সে পথ হাতড়ে এগোতে লাগল বাড়িটার দিকে। ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল সেই আলোক বিন্দু।

মণিলাল পৌঁছে গেল সে জায়গাতে। বাড়ি নয় সেটা একটা ঘর। ইটের দেওয়ালের মাথায় টিনের ছাউনি। ঘরটার আশেপাশে নানা জায়গাতে ঢিপি করা আছে, পাথর, বালি, ইট, ব্রিজ তৈরির নানা সরঞ্জাম। মণিলাল সে সবের ফাঁক গলে ঘরটার কাছে উপস্থিত হল। সে বুঝতে পারল এটা ঘরের পিছন দিক। একটা জানলা আছে এদিকে। ঘরের ভিতর একটা বাতি জ্বলছে। অমাবস্যার অন্ধকার রাত বলে এ আলোটাই দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। মণিলাল জানলার কাছে পৌঁছতেই ঘরের ভিতর থেকে হেমবাবুর গলার চেনা স্বর শুনতে পেল:

 ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
 বর্গী এল দেশে
 বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
 খাজনা দেব কিসে?’

দাদাবাবুর গলার শব্দ পেয়েই নেচে উঠল মণিলালের মন। জানলা দিয়ে সে উঁকি দিল ঘরের ভিতর। ঘরের ভিতর জানলার কাছেই একটা টেবিলের ওপর হ্যাজাক জ্বলছে। সে আলোতে ঘরের সব কিছু স্পষ্ট দৃশ্যমান। ঘরের এক পাশে একটা লোহার খাটে মাদুরের ওপর শুয়ে আছে বাচ্চাটা। আর তার পাশে বসে বাচ্চাটার পিঠে স্নেহের মৃদু চাপড় মেরে ছড়া বলে তাকে ঘুম পাড়াচ্ছেন হেমবাবু। জানলার ঠিক উলটো দিকেই একটা দরজা আছে। ঘরের ভিতর দাদাবাবুদের দেখার পর মণিলাল জানলা ছেড়ে ঘরটাকে বেড় দিয়ে দরজার দিকে যাবে ভাবছিল, ঠিক সেই সময় মণিলাল দেখল দরজার পাল্লাটা খুলে গেল। একটা মাথা উঁকি দিল ঘরের ভিতর। লোকটা চাপা ফ্যাসফেসে গলায় দাদাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার খোকা কি ঘুমোলো?’

খাট ছেড়ে উঠে দাদাবাবু চাপা স্বরে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ঘুমিয়েছে। তবে ঘুমটা আরও গাঢ় হোক। কাজের সুবিধা হবে তাতে।’

লোকটা বলল, ‘তবে এই ফাঁকে একবার জায়গাটা দেখে আসুন। সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। এক নম্বর পিলারের গর্ত।’ দাদাবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, চলো।’ ছেলেকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন হেমবাবু। ঘরটাকে বেড় দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মণিলাল। ততক্ষণে হেমবাবু লোকটার সঙ্গে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মণিলালের একবার মনে হল একবার সে ঘরের ভিতর ঢোকে। আবার এর পরই তার মনে হল দাদাবাবু যেদিকে যাচ্ছেন সেদিকে সে যায়। ডাকাতদের পরিকল্পনার ব্যাপারটা তাকে জানানোর দরকার। কিন্তু লোকটার সামনে ব্যাপারটা তাকে বলা কি ঠিক হবে? নাকি সে এ জায়গাতে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করবে দাদাবাবুর ফিরে আসার জন্য? এসব ভাবতে ভাবতেই হন হন করে হেঁটে দাদাবাবুরা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলেন। মণিলাল শেষ পর্যন্ত ঠিক করল যে এখনই দাদাবাবুকে আড়ালে ডেকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। দাদাবাবুরা যেদিকে যাচ্ছেন মণিলাল এগোল সে দিকে। হয়তো বা মণিলালের নিয়তিই তাকে টেনে নিয়ে চলল তাদের পিছনে।’ এ পর্যন্ত বলে বৃদ্ধ কিছুক্ষণের জন্য থেমে গিয়ে চোখ বন্ধ করল। হয়তো চোখ বন্ধ করে একবার কল্পনা করল সে দৃশ্য। তারপর আবার চোখ মেলে বলতে শুরু করল:

‘এ দিকটা ঝোপঝাড়ে ভরতি। বড়ো বড়ো বুক সমান ঝোপ। তার মধ্যে দিয়ে একটা শুঁড়িপথ একটু ঢালু হয়ে এগিয়েছে নদীর দিকে। দাদাবাবুরা এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হলেন বিরাট বড়ো একটা ঝোপের আড়ালে। সেখান থেকে একটা আবছা আলোও যেন আসছে। হ্যাঁ, একটা বাতি জ্বলছে সেখানে। মণিলাল ঝোপটার কাছে গিয়ে ওপাশে উঁকি দিল। ওপাশে কিছুটা তফাতে একটা বেশ বড়ো গর্ত ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন দাদাবাবু আর তার সঙ্গী সমেত কয়েকটি লোক। একটা লন্ঠনও জ্বলছে সেখানে। হেমবাবু গর্তটা ভালো করে দেখার পর বললেন ‘হ্যাঁ, প্রথম স্তম্ভটা এখানে হবে।’

তার সঙ্গীদের একজন বলল, ‘তিনফুট বাড়তি খোঁড়া হয়েছে গর্তটা। বালি সিমেন্টের ঢালাই করে দিলে ব্যাপারটা কেউ বুঝতেই পারবে না। তারপর লোহার খাঁচা বসবে,পিলার উঠবে। সব কিছু মাটির নীচে চলে যাবে।’ কথাটা শুনে হেমবাবু বললেন ‘এখন আর কোনো খুঁত নেই।’

আর এরপরই দাদাবাবু আর লোকগুলোর মধ্যে যে কথোপকথন মণিলাল শুনল তাতে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। মণিলাল ঝোপ-জঙ্গল ভেঙে ছুটতে শুরু করল সেই ঘরটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেলেন হেমবাবু আর সঙ্গীরা। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে হেমবাবু আর তার সঙ্গীরা মণিলালকে তাড়া করলেন। এর মধ্যে ঘরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল মণিলাল। খাটে পাতা চাটাইয়ের ওপর অঘোরে ঘুমোচ্ছে বাচ্চাটা। কাজটা এখনই তাকে করতে হবে। তার পিছু ধাওয়া করে আসছে লোকগুলো। কিন্তু কী দিয়ে কাজটা করা যায়। হঠাৎই মণিলাল দেখতে পেল ছেলেটার পাশেই কটকটিটা পড়ে আছে। নিশ্চয়ই মণিলাল হেমবাবুর বাড়ি ছাড়ার পর কটকটিটা খুঁজে পেয়েছিল তারা। মুহূর্তের মধ্যে মণিলাল কটকটিটা তুলে নিয়ে তার পিছনের দিকে অংশটা ব্লেডের মত ধরে চালিয়ে দিল ঘুমন্ত বাচ্চাটার বাহু লক্ষ করে! টিনের পাতের আঘাতে বাচ্চাটার নরম চামড়া চিরে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল! আকস্মিক এই নির্মম আঘাতে আর্তনাদ করে উঠে বসল আতঙ্কিত বাচ্চাটা। আর ঠিক এই মুহূর্তে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন হেমবাবু। তার হাতে একটা পিস্তল। রক্তাক্ত বাচ্চাটাকে দেখে আর মণিলালের হাতে ধরা কটকটিটা দেখে ব্যাপারটা কি ঘটেছে তা বুঝতে অসুবিধা হলনা হেমবাবুর। তিনি প্রচন্ড আক্রোশে মণিলালের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আমার এত বড় ক্ষতি করলি তুই! তোকে আমি খুন করব। এই বলে মণিলালের দিকে তাগ করে পিস্তল উঠিয়ে গুলি চালিয়ে দিলেন তিনি। বাচ্চাটার আতঙ্কিত চিৎকার, গুলির শব্দ এসব মিলিয়ে মিশিয়ে মুহূর্তর মধ্যে এক নারকীয় বীভৎস পরিবেশ সৃষ্টি হল ঘরের মধ্যে। এক চুলের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হল হেমবাবুর প্রথম গুলিটা। কিন্তু সেটা গিয়ে লাগল টেবিলের ওপর রাখা হ্যাজাকটার গায়ে। চুরমার হয়ে সেটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। হেমবাবু তার পিস্তলের দ্বিতীয় গুলিটা মণিলালকে ছুঁড়তে যাচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই ভেঙে যাওয়া হ্যাজাকটা নিভে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল ঘর। বাঁচার জন্য এবার মণিলাল ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে হেমবাবুর ওপর গিয়ে পড়ল। ধস্তাধস্তি শুরু হল দুজনের মধ্যে। আর এরপরই আর একটা গুলির শব্দ হল। অন্ধকারের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর চিৎকার করে মটিতে লুটিয়ে পড়লেন হেমবাবু। নিজের হাতের পিস্তলের গুলিই ফুঁড়ে দিল তার বুক। মণিলাল কিন্তু পালাতে পারল না। হেমবাবুর সঙ্গীরা তাকে ধরে ফেলল। পুলিশে খবর দিল তারাই। ওদিকে কলকাতার বুকে আরও একটা ঘটনা ঘটল সে রাতে। মাঝরাতে শোভাবাজার অঞ্চলে টহলদারি পুলিশের গাড়ি কিছু সন্দেহজনক লোককে ঘুরতে দেখে তাড়া করে ধরে ফেলল। লোকগুলোর কাছে অস্ত্র মেলে। তারা সেই জনার্দন মল্লিকের লোক। হেমবাবুর বাড়িতে ডাকাতি করতে এসেছিল তারা। পুলিশের জেরাতে তাদের মুখ দিয়ে আমার নামও বেরিয়ে পড়ে। আদালতে সরকার পক্ষের উকিল এটাই প্রমাণ করলেন যে ওই ডাকাতি দলের হয়েই আমি ইঞ্জিনিয়ার হেমবাবুর পিছু ধাওয়া করি। এবং ডাকাতি করতে গিয়ে হেমবাবুকে শুধু নৃশংসভাবে হত্যাই করিনি তার শিশুপুত্রকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। সরকারি উকিলের বক্তব্য সমর্থন করেছিল সে রাতে হেমবাবুর তিন সঙ্গী। এই জঘন্যতম হত্যা ও শিশুকে হত্যা করার ঘৃণ্য চেষ্টার অপরাধে আমার আজীবন কারাবাসের সাজা হয়ে গেল।’

 নিজের জীবন কাহিনি শেষ করলেন বৃদ্ধ।

স্নেহাংশু একটানা বৃদ্ধের কথাগুলো শোনার পর বললেন, ‘মানলাম আপনার বক্তব্য হয়তো সত্য। খুনটা ঠিক আপনার হাতে হয়নি। কিন্তু এটা তো সত্যি যে বাচ্চাটাকে আপনি আঘাত করেছিলেন? যার কারণে হেমবাবু আপনাকে গুলি করেছিলেন। ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আপনি হেমবাবুদের এমন কী কথাবার্তা শুনেছিলেন যে তার আক্রোশ গিয়ে পড়ল নিরীহ শিশুর ওপর? আপনি রক্তপাত ঘটালেন তার?’

একটু চুপ করে থেকে বৃদ্ধ জবাব দিল, ‘না, আক্রোশ নয়। এর কারণটা আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি আমার কথা। তাই ও কথা থাক।’

।। ৯।।

বৃদ্ধর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা কন্ঠস্বর বলে উঠল, ‘আমি কিন্তু জানি আপনি সেদিন সত্যি বলেছিলেন।’ সেই ভরাট কন্ঠস্বরটা শুনেই দরজার দিকে তাকিয়েই তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন জেল সুপার স্নেহাংশু।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এই বৃদ্ধর জীবন কথার শেষ অংশটা শুনছিলাম আমি। সেদিন আদালত আপনার কথা বিশ্বাস করেনি। করা সম্ভবও ছিল না। কিন্তু আমি জানি আপনি সেদিন আদালতে সত্যি বলেছিলেন।’

লাহিড়ীসাহেবের কথা শুনে বৃদ্ধ বিস্মিত ভাবে বলে উঠল, ‘আপনি জানেন আমি সত্যি বলেছিলাম? কী ভাবে জানেন?’

লাহিড়ীসাহেব বললেন, কাজের প্রয়োজনে আমাকে নানা জেলে যেতে হয়, বন্দিদের সঙ্গে কথাও বলতে হয়। একবার এক জেলে মৃত্যুপথযাত্রী এক অসুস্থ বন্দির সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। নানা অপরাধের কারণে দীর্ঘ কারাবাস হয়েছিল লোকটার। অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর আগে তার মনে অনুশোচনা জন্মেছিল তার জীবনের নানা অপকর্মের জন্য। লোকটা আমাকে মরার আগে জীবনের নানা ঘটনার কথা বলেছিল। সে রাতে হেমবাবুর তিন সঙ্গীর মধ্যে একজন ছিল ওই লোকটা। তার মুখ থেকে ঘটনাটা শোনার পরই আমি আপনার খোঁজ শুরু করি। নানা পুরোনো কাগজপত্র, মামলার নথি, পুলিশের নথি, জেলের নথি ঘেঁটে অবশেষে এ- জেলে আমি আপনার সন্ধান পাই। তারপর সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আপনার মুক্তির ব্যবস্থা করলাম। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’

কথাটা শুনে বৃদ্ধ হতবাক হয়ে বলল, ‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন? আপনি কে?’

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন লাহিড়ীসাহেব। আবছা হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। তারপর সেই বৃদ্ধ, সুপার আর জেলারকে হতভম্ভ করে দিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ব্যাঙ কটকটি বার করে কটকট শব্দে বেশ কয়েকবার বাজালেন!

বৃদ্ধর মুখে কথা হারিয়ে গেছে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে লাহিড়ীসাহেবের মুখের দিকে। লাহিড়ীসাহেব এরপর তাঁর ডান হাতে শার্টের হাতটা অনেকটা ওপরে তুলে ফেললেন। সেখানে অস্পষ্ট একটা চেরা দাগ যেন এখনও আঁকা আছে। সেটা দেখিয়ে লাহিড়ীসাহেব হেসে বললেন ‘দাগটা এখনও আছে। তবে খুব লেগেছিল কিন্তু।’

থরথর করে কাঁপছেন বৃদ্ধ। লাহিড়ীসাহেব এবার তার হাত দুটো ধরে বললেন, ‘তোমার জন্য নতুন পোশাক এনেছি যাও সেগুলো পরে এসো। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে আমার হাতে কটকটিটা চালিয়ে দিয়েছিলে, তাই বেঁচে গেছিলাম। তারপর আমি আবার এক অনাথ আশ্রমে মানুষ হই। সে সব ঘটনা বাড়ি ফিরে তোমাকে বলব।’

টপটপ করে জল পড়তে শুরু করল বৃদ্ধর চোখ দিয়ে। লাহিড়ীসাহেবের হাতে তার হাত। কিছুক্ষণ এ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর বৃদ্ধ মণিলাল চলে গেল পোশাক পরিবর্তনের জন্য। লাহিড়ীসাহেব জেল সুপার স্নেহাংশুকে বললেন, ‘ওর রিলিজ ফাইলটা দিন। সই সাবুদের কাজগুলো সেরে ফেলি।’ লাহিড়ীসাহেব, সুপার আর জেলার মণিলালের ফাইল খুলে বসলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন পোশাকে সেজে সে ঘরে ফিরে এলেন বৃদ্ধ। লাহিড়ীসাহেবের কাগজপত্রের কাজ এখন শেষ। বৃদ্ধকে নিয়ে এবার জেল ছাড়বেন লাহিড়ীসাহেব। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি। এমন সময় সুপার স্নেহাংশু একটু উসখুস করে বললেন, ‘স্যার যদি কিছু মনে না করেন তা হলে দুটো কথা জানতে খুব কৌতূহল হচ্ছে। মণিবাবু আপনার হাত চিরে আপনাকে বাঁচিয়ে ছিলেন কীভাবে? আর তিনি হেমবাবু আর তার অনুচরদের মধ্যে কী এমন কথাবার্তা শুনেছিলেন যে সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে আঘাত করতে ছুটেছিলেন?’

প্রশ্নটা শুনে লাহিড়ীসাহেব বৃদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলো। এ প্রশ্ন দুটোর জবাব তুমি ভালো দিতে পারবে। বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন হেমবাবু তার সঙ্গীদের বলেছিলেন, ‘ওর শরীরে কোনো খুঁত নেই।’

তার কথা শুনে একজন লোক বলল ‘ভালো করে দেখেছেন তো? কোন কাটাছেঁড়া নেইতো?’

হেমবাবু জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ভালো করে দেখেছি রোজ বাড়ি ফেরার পরও আমি তার শরীরে কোথাও কেউ ছিঁড়েছে কি না দেখতাম। যদিও কথা বলতে না পারাটা দেহের খুঁত নয়, তবুও সে সমস্যাও এখন নেই।’

হেমবাবুর কথা শেষ হলে অপর একজন বলল, ‘তাহলে আর দেরি করে লাভ নেই। বাচ্চাটাকে গিয়ে নিয়ে আসি। গর্তের তিনফুট বাড়তিজায়গার মধ্যে ওর ছোটো দেহটা ধরে যাবে।’ আর এ-কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ছুটেছিলাম বাচ্চাটার দেহে খুঁত করে দেবার জন্য। যাতে বাচ্চাটাকে যে কাজের জন্য আনা হয়েছে সে কাজে না লাগে। দেহে খুঁত বা ক্ষত থাকলে হেমবাবুদের কাজে লাগবে না বাচ্চাটা।’

সুপার স্নেহাংশু বৃদ্ধর কথা শুনে বিস্মিত হয়ে বলে উঠলেন? তার মানে?’

বৃদ্ধ বললেন, ‘মানে হল এ-দেশের প্রাচীন এক কুসংস্কার। ব্রিজ, মন্দির বা বড়ো প্রাসাদ তৈরির সময় যদি কোনো বাচ্চা ছেলেকে স্তম্ভর নীচে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয় তবে তার প্রেতাত্মা নাকি রক্ষা করে সেই ব্রিজ বা অট্টালিকাকে। তা কোনোদিন ভেঙে পড়ে না। আর এই অন্ধ কুসংস্কারের বশবর্তী হয়েই হেমবাবু অনাথ আশ্রম থেকে বাচ্চাটাকে দত্তক নিয়েছিলেন ব্রিজের স্তম্ভর নীচে পুঁতে ফেলার জন্য। শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার হলেও কুসংস্কারগ্রস্ত হেমবাবু আসলে জনার্দন মল্লিকের ডাকাতদলের চেয়ে ভয়ঙ্কর। কী সুন্দর ছড়া আবৃত্তি করে তিনি ঘুম পাড়াতেন বাচ্চাটাকে:

 ‘খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো
 বর্গী এল দেশে।
 বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
 খাজনা দেব কীসে?’

তখনও কী আমি জানতাম তার আসল মতলবের কথা! লোকটা সত্যি ডাকাতের চেয়ে ভয়ঙ্কর।’

কথা শেষ করলেন বৃদ্ধ। লাহিড়ীসাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ মণিলালের হাত ধরলেন তার জীবনদাতাকে জেলের প্রাচীরের বাইরে তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *