ডাইনিবুড়ি

ডাইনিবুড়ি

ভবতারণ চাটুজ্জে ক্লাবঘরে ঢুকেই থমকে গেলেন৷

চাটুজ্জেমশাই এই পাড়ায় এসেছেন বছর দেড়েক হল৷ এই ক্লাবে তাঁর আড্ডা জমে নিত্যই৷ কিন্তু আজকের মতো এত থমথমে আবহাওয়া আগে দেখেননি তিনি৷ যে ক্লাবঘরে আড্ডা জমলে দূর দূর থেকে হইহই শোনা যায়, আজ সেখানে শ্মশানের স্তব্ধতা৷

চাটুজ্জেমশাই তক্তপোশে বসে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার? আজ সবাই এত চুপচাপ যে?’

সবাই একটু সরে সরে চাটুজ্জেমশাইকে জায়গা দিল৷ ভজা মুখ ভেটকে বলল, ‘কী আর করি বলুন, কেউ যদি ক্লাবে আসা ইস্তক গোটা সন্ধে ধরে কাঁদুনি গায়, হইহল্লা করার মেজাজ থাকে, বলুন?’

‘এই রে,’ আঁতকে ওঠার অভিনয় করলেন চাটুজ্জেমশাই, ‘কার জীবনে এত দুঃখ শুনি?’

উত্তর দিল বিশুই৷ ধরা গলায় বলল, ‘চাকরিটা ছেড়ে দেব চাটুজ্জেমশাই৷ আর সহ্য হচ্ছে না৷’

চাটুজ্জেমশাই অবাক স্বরে বললেন, ‘সে কী? এই তো ক-দিন আগেই এই মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভের চাকরিটা পেলে হে৷ মাস চারেকও হয়নি, এখনই ছাড়ার কথা ভাবছ কেন?’

গদাই খিঁচিয়ে উঠে বলল, ‘বাবুর নাকি এত খাটাখাটনি পোষাচ্ছে না৷ রোদ বৃষ্টিতে এত দৌড়দৌড়ি, রেগুলার টার্গেটের প্রেশার, এসব নাকি উনি নিতে পারছেন না৷ তার ওপর বাবুর নাকি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ঢুকলে ডিসইনফেকটেন্টের গন্ধে মনে হচ্ছে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন৷ যত্ত সব ঢং৷’

চাটুজ্জেমশাই মৃদু হাসলেন৷ তারপর বললেন, ‘শোনো বিশু, চাকরিটা অমন বিনা কারণে ঝট করে ছেড়ো না৷ মেডিক্যাল লাইনে কাজ করা কিন্তু মহা পুণ্যের কাজ হে৷ কত লোকের রোগশান্তি নিবারণ করো৷ কত লোকের প্রাণ বাঁচাও৷ কত লোকের আশীর্বাদ কুড়োও৷ এসব কি কম পাওয়া হে?’

বিশু গোঁজ হয়ে বসে রইল৷ সেই দেখে কথা ঘোরানোর জন্য ভজা বলল, ‘আচ্ছা চাটুজ্জেমশাই আপনিও তো শুনি এককালে সেলসে কাজ করেছেন কিছুদিন৷ তা এই মেডিক্যাল লাইনেও ছিলেন নাকি কখনও?’

চাটুজ্জেমশাই বললেন, ‘না হে৷ দু-এক জায়গায় সেলসের চাকরি করে বুঝে গেছিলাম যে ওই লাইন আমার জন্য নয়৷ তারপর তো সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে জঙ্গল দেখভালের চাকরিতে ঢুকে পড়লাম৷ সে চাকরি এত ভালো লেগে গেল যে আর ফিরে তাকাইনি৷ তবে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মেডিক্যাল লাইনে ছিল বটে৷ আর তার সঙ্গে আমার একটা আশ্চর্য গা ছমছমে অভিজ্ঞতা হয়েছিল একবার শুনবে নাকি?’

নেকি অওর পুছপুছ? ভজা ঝট করে চা আর ফুলুরির অর্ডার দিয়ে এল৷ বিশু নিজেই গিয়ে জানালা-টানালা বন্ধ করে একটা কছুয়া মার্কা কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে এল৷ আমরা ঘিরে বসলাম চাটুজ্জেমশাইকে৷ গলা খাঁকারি দিয়ে তাঁর ফেমাস গল্প বলা শুরু করলেন চাটুজ্জেমশাই৷

‘অনেকদিন আগেকার কথা৷ তখনও বিয়ে হয়নি, সবে চাকরি পেয়েছি৷ পোস্টিং বাঁকুড়া বর্ধমান রেঞ্জে৷ অফিস দুর্গাপুরে ৷ অফিসে অবশ্য কমই হাজিরা দিতে হয়, জঙ্গলে জঙ্গলেই কেটে যায় বেশিরভাগ সময়৷ একটা দোতলা বাড়ির একতলাটা ভাড়া নিয়ে থাকি৷ একটা ছোকরা গোছের ছেলে সঙ্গে থাকে, রান্নাবান্না করে, ফাই ফরমাশ খাটে, এটা-ওটা এনে দেয়৷ ঠিকে ঝি এসে দু’বেলা বাসন মেজে দেয় আর ঘর ঝাঁট দিয়ে যায়৷ আমি চাকরি করি, জঙ্গলের সৌন্দর্যে ডুবে যাই, আর শহরে ফিরে এসে আড্ডা মেরে বেড়াই৷

এমন সময় আলাপ হল সংগ্রামের সঙ্গে৷

সংগ্রাম ছিল শ্যামবাজারের বনেদি রায়চৌধুরী বাড়ির ছেলে৷ পড়াশোনা মিত্র ইনস্টিটিউশন আর সিটি কলেজে৷ চাকরি করে একটি নামী ফার্মা কম্পানিতে, অ্যাজমা ডিভিশনের মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ, অর্থাৎ এম আর হিসেবে৷ এরিয়া ছিল বাঁকুড়া, পুরুলিয়া আর বর্ধমান৷ হেড কোয়ার্টার দুর্গাপুর৷ তখন ওর ওই এলাকায় মাস দুয়েক হয়তো হয়েছে৷ বয়সে আমার থেকে পাঁচ-ছ’বছরের ছোট হলে কী হবে, বিলক্ষণ চতুর আর বলিয়ে কইয়ে বলে দু’দিনেই আলাপ জমে গেল৷

আলাপ হওয়ার আরও একটা কারণ অবশ্য দুজনেরই ঘোরাঘুরির নেশা৷ সারা সপ্তাহ দুজনে কাজে কম্মে ব্যস্ত থাকি৷ আর উইক-এন্ড হলেই আশপাশের জায়গা ঘুরে বেড়াই৷ এই করে পুরো জঙ্গলমহল, মায় ঝাড়খণ্ডের আদ্ধেকটা ঘোরা হয়ে গেল৷ তখন অবশ্য ঝাড়খণ্ড হয়নি, জায়গাটা বিহারের অংশ ছিল৷

একবার এরকমই ঘুরতে বেরিয়েছি৷ তখন শীতকাল, ঘুরে বেড়ানোর জন্য আদর্শ সময়৷ আমাদের এবারকার গন্তব্য পাঞ্চেত ড্যাম আর সংলগ্ন বন-জঙ্গল৷

গাড়ি চলছে আশির ওপর৷ জানালার কাচ নামানো৷ জানালা দিয়ে দিব্যি ফুরফুরে হাওয়া আসছে, অথচ সংগ্রামের মুখ দেখি ভার৷ হুঁ হাঁ ছাড়া কথাই বলছে না৷ কপালে চিন্তার ভ্রুকুটি৷ অন্যমনস্ক হয়ে আছে৷ দু-একবার জিজ্ঞেস করলাম কী হল৷ কিন্তু চাপাচাপিই সার, ছেলে দেখি কিছুতেই কিছু বলে না৷

অবশেষে একজায়গায় চা খেতে বসে ছোকরাকে চেপে ধরলুম৷ তবে সে কি আর সহজ ছেলে? অনেক পীড়াপীড়ির পর মুখ খুলল৷ তারপরেই জানতে পারলাম তার দুঃখের কারণ কী৷

কম্পানি নাকি ছোকরার ওপর হঠাৎ করেই বিপুল টার্গেট চাপিয়ে দিয়েছে৷ সে নাকি দুশো পার্সেন্ট গ্রোথ ডেলিভার করার মতো ভয়াবহ ব্যাপার৷ ছোকরা সপ্তাহ ধরে পাগলের মতো ডাক্তার, হাসপাতাল, নার্সিং হোম ভিজিট ইত্যাদি করেও কিছু সুবিধে হচ্ছে না৷ এদিকে মান্থ এন্ড সামনেই৷ টার্গেট না করতে পারলে চোখে সর্ষেফুল দেখা নিশ্চিত৷

ওর অবস্থা দেখে আমিই ওকে একটা পথ বাতলালাম৷

সেই সময় একটা সরকারি স্কিম ছিল৷ সরকার থেকে গ্রামেগঞ্জে ওষুধ সাপ্লাই করার জন্য এলাকাভিত্তিক মেডিসিনের হোলসেলার বানানো হত৷ শুধু তাই নয়, সেই হোলসেলাররা রীতিমতো সাবসিডিও পেত সরকার থেকে৷ তার জন্য একটা আলাদা লাইসেন্স করাতে হত৷ তবে তখন সরকারের সঙ্গে এম আর’দের ইউনিয়নের হেবি দোস্তি৷ ঘাঁতঘোঁত জানা থাকলে অনেক এম আর’রাই ওই চ্যানেল ধরে রুরাল মেডিসিন স্টকিস্ট বানিয়ে টার্গেট করে নিত৷ লাইসেন্স টাইসেন্স কোনও ব্যাপারই না৷ ইউনিয়ন বললেই লাইসেন্স, ইউনিয়ন বললেই ব্যবসা৷

তবে চাপ ছিল একটাই৷ সেক্ষেত্রে এম আর মশাইদের নিজেদের এরিয়ার গ্রামীণ এলাকা একেবারে নখদর্পণে রাখতে হত৷ নইলে অডিট হলে চাকরি নট হতে বেশি সময় লাগত না৷

আমার বাতলানো রাস্তাটা শুনে ঘাড় নাড়ল সংগ্রাম, ‘কথাটা কি আমার মাথায় আসেনি চাটুজ্জেদা? কিন্তু সবে দু’মাস হল এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছি৷ এখনও দুর্গাপুর বর্ধমানই ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারলাম না৷ গ্রামগঞ্জের তো কথাই নেই৷ এই ক’দিনে তিন-তিনখানা জেলার কোথায় কোথায় কোন কোন বনেবাদাড়ে ঘুরব আর স্টকিস্ট অ্যাপয়েন্ট করব বলো তো?’

আমি মৃদু হেসে অভয় দিলাম, ‘আরে ভাই, চিন্তা করছিস কেন? আমি তো আছি না কি?’

ততদিনে কাজের সুবাদে জঙ্গলমহলের অনেক গ্রামগঞ্জই চিনে ফেলেছিলাম৷ ভাবলাম ছেলেটাকে একটু হেল্প করি৷ বেশি কিছু না, চেনাজানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া, আলাপ করিয়ে দেওয়া, এই তো৷

আগেই বলেছি, তখন সবে শীতকাল শুরু হয়েছে৷ তোমরা জানো নিশ্চয়ই, বর্ষার শুরু আর শীতকাল, এইসময়েই শ্বাসকষ্ট বাড়ে৷ বছরের এই দুটো সময়টাই অ্যাজমা পেশেন্টদের জন্য অত্যন্ত প্রাণঘাতী৷ আমি এসব খুব ভালো করে জানি কারণ আমার ঠাকুর্দা ছিলেন ক্রনিক অ্যাজমার পেশেন্ট৷ প্রায়শই শ্বাসকষ্টে ভুগতেন৷ মাঝে মাঝে অবস্থা এমনই গুরুতর হত যে অ্যাস্থালিনের ইনহেলারেও শানাত না, ডেরিফাইলিন ইনজেকশনও দিতে হত৷ তাই অ্যাজমা পেশেন্টদের কষ্টের ব্যাপারটা বুঝি৷

পাঞ্চেত ড্যাম থেকে ফিরে আসার পরের সপ্তাহেই সংগ্রামকে নিয়ে চললাম রুরাল স্টকিস্টের খোঁজে৷ সঙ্গী আমার অনেকদিনের সুখ-দুঃখের ল্যামব্রেটা স্কুটারটা৷ এই বুড়ি স্কুটারটা যে আমাকে কত সার্ভিস দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই৷

এখনও দুর্গাপুর থেকে বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর যাওয়ার সেই রাস্তাটার কথা মনে আছে৷ জঙ্গল ছাওয়া রাস্তা মায়ামেদুর রাস্তা৷ বড়জোড়া থেকে বেলিয়াতোড় হয়ে সোজা রাধানগরে ওঠে৷ সেখান থেকে জয়কৃষ্ণপুর হয়ে সোজা বিষ্ণুপুর৷ রাস্তায় একের পর এক ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় বাংলার গ্রাম৷ তাদের নামগুলিও বড় চমৎকার, কারসানি, হাসিগ্রাম, পাঞ্চাল ইত্যাদি৷

প্রথম থামলাম কারসানিতে৷ একটানা গাড়ি চালিয়ে গলাটা শুকিয়ে গেছিল৷ তাই একটা ঝুপড়ি আর তার সামনে মাটির উনুনে বসানো কেটলি নজরে আসামাত্র স্কুটারটা দাঁড় করালাম৷ দোকানের সামনে একটা নড়বড়ে বেঞ্চ৷ সেখানে কয়েকজন স্থানীয় লোক বসে রাজা উজির মারছিল৷ আমাদের দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন বাবু, বসুন৷’

আমরাও যথেষ্ট শহুরে গাম্ভীর্যের সঙ্গে ভাঙা বেঞ্চিতে অধিষ্ঠান করলাম৷

চা আর লেড়ো বিস্কুট খেতে খেতে এদিক ওদিক তাকিয়ে মন প্রসন্ন হয়ে গেল৷ চারিদিকে উঁচু উঁচু শাল সেগুন গাছের সমারোহ৷ যতদূর চোখ যায় মাটি ছেয়ে আছে শুকনো পাতায়৷ বাতাসে একটা শিরশিরানি ভাব৷ রাস্তা দিয়ে আদিবাসী মেয়েদের দল মাথায় শুকনো কাঠকুটো চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷

চায়ের দাম দিয়ে উঠে আসছি, এমন সময় একটা বুড়ি কাছে এসে দাঁড়াল৷ মাথায় শন পাকানো চুল, সারা গায়ে কুঁকড়ে যাওয়া চামড়া, পরনে নোংরা শতচ্ছিন্ন শাড়ি৷ বুড়ি ফোকলা মুখে একগাল হেসে বলল, ‘ও ছেইলারা, একলাই যে খাঁইয়ে লিলি, বুঢ়িটাকে কিছু দিবি নাই?’

বুড়িকে দেখেই সংগ্রাম নাক কুঁচকোল৷ তার কারণ আছে জানি৷ ও একটু পিটপিটে ছেলে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে৷ অমন শনের দড়ির মতো চুল, নোংরা হাত পা আর পিচুটিভরা চোখ নিয়ে সামনে যদি কেউ এসে দাঁড়ায়, তাহলে এমনিতেই অভক্তি আসতে বাধ্য৷ সংগ্রাম ‘হেই বুড়ি হ্যাট হ্যাট’ করে তাড়িয়ে দিতে চাইল মহিলাকে৷ আমি আবার চাপা গলায় বললাম, ‘এসব কী অসভ্যতা হচ্ছে সংগ্রাম? এইভাবে কেউ কাউকে বলে?’

সংগ্রাম মুখটা বিচ্ছিরিভাবে বেঁকিয়ে বলল, ‘তুমি চুপ করো৷ এইসব ডার্টি ফিলদি ভিখিরি-টিকিরি দেখলেই আমার ঘেন্না করে৷’

আমি আর কিছু বললাম না৷ কারও পছন্দ-অপছন্দ তো আমি বদলাতে পারব না দশটা টাকা দোকানিকে দিয়ে বললাম, ‘বুড়িমাকে কিছু খেতে দিও৷’

সংগ্রাম হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে বলল, ‘দেখো কাকা, টাকাটা আবার মেরে দিও না যেন৷’

দোকানি যেন কথাটা শুনে শিউরে উঠল৷ চাপাগলায় বিড়বিড় করে বলল, ‘বাপ রি বাপ, ওই ডানবুড়ির টাকা মাইরে কি নিজের মরণ ডাইকে আনব ন কি গ?’ তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে চাপাগলায় বলল, ‘আর আপনার বন্ধুটাকে সাবধানে থাইকতে বলবেন বাবু৷ উ বুঢ়ি সিধা লোক লয়৷’

কথাটা তেমন আমল দিলাম না৷ গ্রাম্য লোকেদের অনেক কিছু ফালতু কুসংস্কার থাকে৷ সবকিছুতে কান দিতে নেই৷

স্কুটারে স্টার্ট দিয়েছি কি দিইনি, এমন সময় দেখি বুড়ি একটু দূরে এসে দাঁড়িয়ে রইল৷ আমি কিছু বলার আগেই থুতু ফেলে বলল, ‘তুঁই ভাল ছেইলা বঠিস৷ তবে উ ভাল লয়৷ উয়ার কপালে দুঃখ আছে৷’

* * *

বুড়ির কথাটা যে এত তাড়াতাড়ি ফলে যাবে কে ভেবেছিল? হাসিগ্রাম আসতে আসতে বুঝলাম সত্যিই কপালে দুঃখ আছে৷ অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিলাম যে আকাশের মুখ ভার৷ এবার জঙ্গল ছাড়িয়ে খানিকটা খোলা রাস্তা পেতেই দেখলাম যে শীতের আকাশে অকালে জলভরা মেঘ৷ বৃষ্টি হবে হবে মনে হচ্ছে৷ গাড়ির গতিবেগ বাড়াতেই হল৷ এদিকে সময়টাও ভালো না, সন্ধে নেমে আসছে দ্রুত৷ এই সাইডে মাঝে মাঝেই রাস্তায় হাতিদের দল নেমে আসে, সেটাও একটা বড় চিন্তার কারণ৷

গাড়ি চালাচ্ছি জোরেই৷ একটু এগোলেই জয়কৃষ্ণপুরের জঙ্গল, তারপরেই বিষ্ণুপুর৷ বৃষ্টি, সন্ধে আর হাতি, তিনটের যে কোনও একটা নেমে আসার আগেই বিষ্ণুপুর পৌঁছতে হবে, এই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য৷

কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা হল না৷ ঠিক সন্ধের মুখে নামল প্রবল বৃষ্টি৷ আমরা তখন মাঝরাস্তায়৷ শীতের বৃষ্টি যে কী মারাত্মক সে আর তোমাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না৷ আমরা তড়িঘড়ি করে একটা মস্ত বড় নিমগাছের নীচে দাঁড়ালাম৷

এখনও দিব্যি মনে আছে দৃশ্যটা৷ স্কুটার বন্ধ করে দুই বন্ধু ভূতের মতো ভিজে চুপচুপে হয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ নিমগাছটা মস্ত বড়, অত বড় নিমগাছ এই অঞ্চলে চট করে দেখা যায় না৷ গোড়াটা বেড় দিয়ে কোমরসমান উঁচু করে পাথরে বাঁধানো৷ সেখানে উঠে জবুথবু হয়ে বসলাম৷

অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে দশহাতের দূরের কিছু দেখা যায় না৷ আমার যে খুব অসুবিধা হচ্ছে তা নয়৷ তবে সংগ্রামের অবস্থা ইতিমধ্যেই বেহাল৷ সে কলকাতার ছেলে, জন্মে গ্রামগঞ্জ দেখেনি৷ জঙ্গল দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না৷ তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সাহারায় একলা আটকে পড়েছে, অথচ হাতে কম্পাস নেই৷

শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি আর ভাবছি এখন বুনো হাতি চলে এলেই চিত্তির, এমন সময় কানে এল সাইকেলের বেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ৷

ডাইনে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি সুঁড়িপথ বেয়ে একটা লোক সাইকেল চড়ে এদিকেই আসছে৷ তোমরা অনেকেই হয়তো জান না, তখন সাইকেলের পেছনের চাকার সঙ্গে ছোট্ট একটা ডায়নামো লাগানো থাকত আর সামনে হ্যান্ডেলে লাগানো থাকত একটা ছোট হেডলাইট৷ চাকা ঘুরলে হেডলাইট জ্বলত৷ গ্রামেগঞ্জের অন্ধকার রাস্তায় চলতে খুব কাজের জিনিস৷ এটাতেও দেখি তাই৷ বর্ষার অবিরল বারিধারার মধ্যে একটা ক্ষীণ আলো হেলতে দুলতে আমাদের সামনে এসে থাকল৷ লোকটা বাঁকড়োর উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বাবুরা এখানে আটক হই গেছেন ন কী?’

সংগ্রামকে দেখে মনে হল যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে৷ সে তড়বড় করে পুরো ব্যাপারটাই খুলে বলল৷ এমনকি কীসের খোঁজে এসে আটকে পড়েছে সেটাও জানাল সাতকাহন করে৷

লোকটার চোখদুটো অন্ধকারের মধ্যেই জ্বলজ্বল করে উঠল৷ সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, ‘ওষুধ বিকেন বাবু? শ্বাসের ওষুধ? তাহলে আমার সঙ্গে আসেন৷’

আমি তো অবাক৷ অ্যাজমার ওষুধ বেচি শুনে লোকটার এত আনন্দিত হওয়ার কী হল? তবে ভাবনাচিন্তার আর সময় পেলাম না৷ লোকটা সামনের দিকে হাঁটা শুরু করতেই সংগ্রাম আমার পেটে একটা কনুইয়ের গুঁতো মেরে এগোতে লাগল৷ আমি চাপা গলায় বললাম, ‘এ কী, কোথায় যাচ্ছিস? জানা নেই শোনা নেই, একটা লোকের কথায় শুনে…’

সংগ্রাম চাপা গলায় বলল, ‘আহ, চুপ কর তো৷ কোথায় আর যাবে৷ নিশ্চয়ই ওর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে৷ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার থেকে কারও বাড়িতে বসা তো অনেক বেটার৷’

অগত্যা আমিও পেছন পেছন চললাম৷ লোকটা এমন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল যার মাথায় বড় বড় শালগাছের দল শাখাপ্রশাখা বিছিয়ে চাঁদোয়া বানিয়ে রেখেছে৷ ফলে অবিরাম ধারাপাত থেকে কিছুটা হলেও গা বাঁচিয়ে হাঁটতে থাকলাম৷ স্কুটারটা ওই নিমগাছের তলাতেই রয়ে গেল৷

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুটা হাঁটার পর হঠাৎ করেই সামনেটা পরিষ্কার হয়ে এল৷ ততক্ষণে বৃষ্টি প্রায় ধরে এসেছে৷ সন্ধের নিভে আসা অন্ধকারে সামনে ফুটে উঠল একটা ছোট্ট গ্রাম৷ বড়জোর দশ-বিশ ঘর বাসিন্দা৷ আর গ্রামের একদম সামনে একটা সাজানো গোজানো মাটির দোতলা বাড়ি, মাথায় টিনের ছাউনি৷ এরকম বাড়ি বাঁকুড়ার গ্রামেগঞ্জে হরবখত দেখা যায়৷

লোকটা সেই বাড়ির দাওয়ায় উঠে একটা হাঁকার পাড়ল, ‘ও বুল্টির মা, দ্যাখ কারা আইসেছেন৷’

একটু পরেই এক মহিলার অবয়ব দেখা গেল ঘরের দাওয়ায়৷ গলা অবধি ঘোমটা টানা পেছনে পেছনে একটি বাচ্চা মেয়ে, বছর দশেক বয়েস৷ দাওয়ায় একটা হ্যাজাক জ্বলছিল৷ তার আলোয় দেখলাম ভারী মিষ্টি দেখতে বাচ্চাটি৷ বউটির পরনে ছাপা শাড়ি, মেয়েটির গায়ে ফুলফুল ছাপ ফ্রক৷ অল্প আলোয় দেখা যায় নিকোনো দাওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন উঠোন৷ উঠোনের এক ধারে মস্ত ধানের গোলা৷ ঘরের ভেতরেও হ্যাজাকের আলো জ্বলছে৷ তার মৃদু আলো জানলা পেরিয়ে উঠোনে দাওয়ায় এসে পড়ছে৷ বাড়ির পাঁচিল ঘিরে ফনিমনসা আর নয়নতারার ঝোপ৷ এক কোনায় একটা করবী গাছ, তার গা বেয়ে হাসনুহানার লতা উঠেছে বাড়ির সামনে একটা ট্রাক্টর রাখা৷ সব মিলিয়ে একটা বেশ সম্পন্ন গৃহস্থের চিহ্ন৷ সর্বত্র গ্রামবাংলার চিরপরিচিত লক্ষ্মীশ্রী ছড়িয়ে আছে৷

গৃহস্বামীর আদেশে শুকনো গামছা এল৷ তাতে গা মাথা মুছে উঠতেই দেখি স্টিলের গ্লাসে করে দুই গ্লাস গরম ধোঁয়া ওঠা চা৷ আমি চা খাই না, তাই সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম৷ সংগ্রাম দু’গ্লাস চা একাই খেল৷

চা শেষ হতেই লোকটা কাজের কথা পাড়ল, ও এই এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান৷ টাকাপয়সার কমতি নেই৷ এখন চাষবাস ছাড়াও অন্য কিছু ধান্দাপানির ফন্দিফিকির খুঁজছে৷ এই এলাকায় ওষুধ-বিষুধের দোকানপত্তর বিশেষ নেই৷ বিপদে-আপদে বিষ্ণুপুর বা বাঁকুড়াই ভরসা৷ আমরা কি ওকে কোনও ওষুধের সাপ্লাইয়ের ব্যবসা দিতে পারি?

এ তো দেখি মেঘ না চাইতেই জল! সংগ্রাম তো পারলে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ সে তড়বড় করে নিজের কম্পানি, কম্পানির ওষুধ, কী কাজে লাগে, এসব ব্যাপারে বিস্তারিত জানাল৷ তারপর এই ব্যবসায় নামতে গেলে কত ইনভেস্টমেন্ট প্রয়োজন এসবও বোঝাল লোকটাকে৷ লোকটা তুড়ি মেরে বলল, ‘টাকার লাইগে চিন্তা করবেন নি বাবু৷ যে টাকা বইলছেন তার তিনগুণা টাকা সোবসময় আমার কোঁড়চে গুঁজা থাকে৷ বলেন, এখিন বের কৈরে দিব?’

সংগ্রাম ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলার আগেই ভেতর থেকে গরম গরম লুচি তরকারি এল৷ আমার যদিও বিশেষ ইচ্ছে ছিল না খাওয়ার৷ জানি না কেন কিছু আগে থেকেই কেমন যেন গা গুলোচ্ছিল৷ সেটা অবশ্য অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকার জন্যেও হতে পারে৷ তবে আশ্চর্য হলাম সংগ্রামকে সেই লুচি তরকারি গোগ্রাসে গিলতে দেখে৷ শ্যামবাজারের বনেদি রায়চৌধুরী বাড়ির একমাত্র শিবরাত্রির সলতে শ্রীমান সংগ্রামকুমার, যে নাকি ‘প্রপার প্লেস অ্যান্ড অ্যামবিয়েন্স’ না হলে কিছু খেতেই পারে না, সেও দেখলাম দিব্যি হাত না ধুয়েই মাটির দাওয়ায় বাবু হয়ে বসে ভারী তৃপ্তির সঙ্গে লুচি তরকারি খাচ্ছে৷ আমার সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতে একগাল হেসে বলল, ‘তুমিও কিন্তু একবার খেয়ে দেখতে পারতে চাটুজ্জেদা৷ দুর্দান্ত টেস্ট৷’

সংগ্রামের লুচি তরকারি খাওয়া শেষ হলে আমরা উঠে পড়লাম৷ ততক্ষণে লোকটা রেশন কার্ড ইত্যাদি নিয়ে এসেছে৷ সংগ্রাম সেসব দেখে জানাল দু’দিন পরেই সব পেপার টেপার নিয়ে চলে আসছে ও৷

লোকটা সেই নিমগাছ অবধি আমাদের পৌঁছে দিল৷ স্কুটারটা সেখানেই ছিল যেমন রেখে গেছিলাম৷ পুরো রাস্তাটা সংগ্রাম আর লোকটা ব্যবসার ব্যাপারে বকবক করতে করতে এল৷ ওই কী কী কাগজপত্তর লাগবে, কবে কত টাকা দিয়ে প্রথম স্টকের লট কিনতে হবে সেসব নিয়ে আলোচনা৷

বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশ এখন পরিষ্কার৷ আমার বহু সুখ-দুঃখের সঙ্গী ল্যামব্রেটাটা এক কিকেই মৃদু গর্জন করে উঠল৷ আমরা লোকটাকে টা টা করে স্কুটারে চড়ে বিষ্ণুপুরের দিকে রওনা দিলাম৷

* * *

এই ঘটনার পর প্রায় হপ্তা দুয়েক কেটেছে৷ ইতিমধ্যে অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে আবির্ভূত হয়েছে কালান্তক সেকেন্ড কোয়ার্টার অডিটের দুন্দুভিধ্বনি৷ সেই বজ্রনির্ঘোষে আমাদের কান পাতা দায়৷ সবাই চাকরি বাঁচানোর তাগিদে ঊর্ধ্বশ্বাস ছোটাছুটি করছি, এমন সময় হঠাৎ একদিন অফিসের পিওন রমজান এসে বলল আমার নামে নাকি আর্জেন্ট ফোন কল৷ রিসেপশনে কে যেন ফোন করে বলেছে ভবতারণ চট্টোপাধ্যায়কে এক্ষুনি চাই, যে করেই হোক৷

বিরক্ত যে বেহুদ্দ হলাম সে বলাই বাহুল্য৷ একে অফিসের কাজের চাপ, তার ওপর এই উটকো উৎপাত৷ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফোনের রিসিভার কানে তুলে বললাম, ‘হু ইজ দিজ?’

ওপার থেকে ভেসে এল, ‘আমি অ্যাজমাটেক কম্পানির দুর্গাপুরের ডিস্ট্রিবিউটর সুশীল আগরওয়াল বলছি৷ আপনি সংগ্রাম রায়চৌধুরীর বন্ধু ভবতারণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন কি?’

বললাম, ‘হ্যাঁ, কেন বলুন তো?’

ওপার থেকে কিছুক্ষণ সতর্ক নৈঃশব্দ্যের পর সুশীল আগরওয়াল বললেন, ‘দাদা, আজ একবার আমার অফিসে আসতে পারবেন? আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে৷ খুব জরুরি৷’

বিরস স্বরে বললাম, ‘কেন?’

সুশীলবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে সংগ্রামের লাস্ট কবে দেখা হয়েছে বলবেন একটু?’

খানিক ভেবে বললাম, ‘এই তো হপ্তা দুয়েক আগেই৷ একসঙ্গে বিষ্ণুপুর গেছিলাম৷ সেখান থেকে নতুন একটা রুরাল স্টকিস্টের খোঁজ নিয়ে এলাম৷ তারপর থেকে আমি অফিসের কাজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে… কেন? হয়েছেটা কী?’

ফোনের ওপার থেকে খানিক ইতস্তত অস্বাচ্ছন্দ্যের পর চাপা গলায় ভেসে এল এই ক’টা কথা, ‘সংগ্রাম ভালো নেই দাদা, একদম ভালো নেই৷ আপনি একবার আমার অফিসে আসবেন প্লিজ?’

সুশীল আগরওয়ালের গলায় এমন একটা চাপা ভয় ছিল যেটা আমার কান এড়াল না৷ বলতে নেই, অজান্তেই আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল৷ আমি গলা নামিয়ে বললাম, ‘কেন বলুন তো? এনি প্রবলেম?’

‘আপনি আসুন না৷ ব্যাপারটা খুব কমপ্লিকেটেড৷ ওর বাড়িতেও বলতে ভরসা পাচ্ছি না৷ এদিক ওদিক খোঁজখবর করে আপনার খোঁজ পেলাম৷ তাই ফোনটা করেই ফেললাম৷’

কিছুক্ষণ দোনোমোনো করে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম৷ সুশীল আগরওয়ালের স্টক পয়েন্ট বেনাচিতিতে৷ আমার অফিস থেকে খুব বেশি দূর নয়৷ আমার স্কুটারে করে যেতে লাগবে ঠিক কুড়ি মিনিট৷

* * *

‘সংগ্রাম কোথায় এখন?’

আমার প্রশ্ন শুনে অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে বসলেন সুশীল আগরওয়াল৷

সুশীলজির গোডাউনটা মেন রোড ছেড়ে একটু ভিতরের দিকে, একটা গলির মধ্যে৷ একটা বিল্ডিংয়ের একতলা আর বেসমেন্ট নিয়ে৷

বসেছিলাম একতলার অফিসঘরেই৷ প্রায়ান্ধকার ঘরটার অর্ধেক জুড়ে আছে দুটো টেবিল আর তিনটে চেয়ার৷ একপাশে একটা মানুষ সমান উঁচু লোহার ক্যাবিনেট৷ তার ওপর ধুলোটে কাগজের ফাইল ডাঁই হয়ে আছে৷ ঘরের কোণে একটা নীচু প্লাস্টিকের টুলের ওপর জলের কুঁজো রাখা৷

আমি আর সুশীলবাবু ছাড়া ঘরের মধ্যে আছে আরও দুটো ছেলে৷ বোঝা যায় যে এরা এই ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের কর্মচারী৷ দেওয়ালে একটা কালো রঙের হোল্ডারে লাগানো একটা হলুদ বাল্ব ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ সেদিকে তাকিয়ে শীতের মিঠে রোদটাও কেমন যেন শিরশির করে উঠল৷

খানিক ইতস্তত অস্বাচ্ছন্দ্যের পর সুশীল আগরওয়াল বললেন, ‘সেটাই তো সবচেয়ে বড় রহস্য দাদা৷ সংগ্রাম যে কোথায় সেটাই কেউ জানে না৷’

আশ্চর্য হলাম, ‘কেউ জানে না মানে? ওর ভাড়াবাড়িতে খোঁজ নেননি?’

‘নিয়েছিলাম দাদা,’ শুকনো গলায় বললেন সুশীলবাবু, ‘ওখানে ও নেই৷’

‘তার মানে?’ অজানতেই আমার ভুরু কুঁচকে গেল, ‘লাস্ট কবে দেখেছেন ওকে?’

‘এই দিন দশ-বারো আগে৷ আমার অফিসেই৷’

‘তারপর আর দেখা পাননি?’

‘না৷’

‘তাতে এত বিচলিত হওয়ার কী হল? ইন ফ্যাক্ট বিষ্ণুপুর থেকে ফিরে আসার পর ওর সঙ্গে আমারও যোগাযোগ হয়নি৷ হতেই পারে কলকাতা গেছে কোনও আর্জেন্ট মেসেজ পেয়ে৷ সে ফ্যামিলি ম্যাটার হতে পারে, বা অফিসের কাজেও যেতে পারে৷’

সুশীলবাবু মাথা নাড়লেন, ‘না দাদা৷ সংগ্রাম অফিসের কাজে কলকাতা যায়নি৷ কলকাতা অফিসে খোঁজ নিয়েছি৷’

কিছু বললাম না৷ সুশীলবাবুর দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে রইলাম৷

সুশীলবাবু গলা নামিয়ে বললেন, ‘সংগ্রাম ওর কলকাতার বাড়িতেও যায়নি৷ ওর বাড়ির ঠিকানা ফোন নাম্বার আমি জানি, একবার ওর কলকাতার ঠিকানায় লেখা একটা চিঠি আমার অফিসে রিডাইরেক্ট হয়ে এসেছিল৷ তাতে ওর বাড়ির ফোন নাম্বার লেখা ছিল৷ সেই নাম্বারে কল করে জানলাম যে গত দেড় মাস ধরে সংগ্রাম বাড়ি যায়নি৷ আর গত দু’হপ্তা ধরে যোগাযোগও করেনি৷’

আলোটা একটু নিভু নিভু হয়ে এল৷ বাইরে মরা শীতের হাওয়া৷ জানি না কেন, আমার গায়ে একটু কাঁটা দিয়ে উঠল৷

সুশীল আগরওয়াল আরও একটু ঝুঁকে এলেন৷ ‘আপনাকে আরও কয়েকটা কথা বলা খুব জরুরি দাদা৷ তাই আপনাকে এখানে ডেকে আনা৷’

সপ্রশ্ন চোখে চেয়ে রইলাম৷

‘যেদিন আপনি আর সংগ্রাম ফিরে এলেন বিষ্ণুপুর থেকে, তার পরের দিনের ঘটনা৷ সংগ্রাম এখানে এসেছে সকালে, দিনের টার্গেট একবার দেখে নিয়ে বেরোবে৷ এমন সময় বললাম, ‘কাল নাকি তোমার কোন বন্ধুর সঙ্গে রুরাল স্টকিস্ট খুঁজতে গেছিলে? কিছু হল তার? পেলে কাউকে?’ শুনে সংগ্রাম ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, একজনের সঙ্গে দেখা হল বটে৷ খুব ভালো পার্টি, পয়সাওয়ালা লোক৷ কাল যাব কাগজপত্তর আনতে’ কথা বলার সময় দেখলাম সংগ্রাম সামান্য হাঁপাচ্ছে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হে, হাঁপাচ্ছ কেন? দৌড়ে এলে নাকি?’ সংগ্রাম বলল, ‘আরে তেমন কিছু না৷ কাল বৃষ্টিতে ভিজে বুকে একটু সর্দি বসেছে, আর কিছু না৷ রাতে গরম জলে দু’পেগ রাম মেরে দেব, সব সেট হয়ে যাবে, হ্যা হ্যা হ্যা৷’

তার পরের দিন শুনলাম সংগ্রামের জ্বর এসেছে৷ আমি শুনে ঝটপট করে একটা ছেলেকে দিয়ে কয়েকটা ওষুধ পাঠিয়ে দিলাম… একা থাকে, বাড়ি থেকে খাবার দাবারও রান্না করে পাঠালাম৷’

শুনে আমার নিজেকে একটু অপরাধী লাগল৷ সেদিনের পর থেকে কাজের চাপে ছোকরার আর বিশেষ খবর-টবর নেওয়া হয়নি৷ অথচ বন্ধু হিসেবে এসব আমারই করার কথা৷

বললাম ‘তারপর?’

‘সংগ্রাম সেরে উঠতে সময় নিল দিন পাঁচ-ছয়৷ এই ক’দিন আমার অফিসের একটা ছেলে, নাম মানস, তার হাত দিয়ে নিয়মিত ওকে ওষুধ খাবার এসব পাঠিয়ে গেছি৷

শেষের দিন মানস এসে একটা অদ্ভুত কথা বলল৷ এই ক’দিন সংগ্রাম নাকি ওষুধ বা খাবার ওর হাত থেকে নেয়নি৷ দরজার আড়াল থেকে বলেছে বাইরে রেখে যেতে৷ এমনকি কথা-টথাও বিশেষ বলেনি৷ আমি ভাবলাম হবেও বা, সর্দিকাশি ভয়ানক ছোঁয়াচে রোগ৷ তাই হয়তো এই সতর্কতা৷

সংগ্রাম কাজে জয়েন করল আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে৷ দেখলাম একদম ফিট৷ অসুখ থেকে ফিরে ছোকরা একেবারে চনমনে ঝরঝরে হয়ে উঠেছে৷ আমারও দেখে ভালো লাগল৷ আমি পরের দিনই মানস আর সংগ্রামকে ওই লোকটার খোঁজে পাঠিয়ে দিলাম৷

দু’জনে যখন ফিরে এল তখন মানসের ধুম জ্বর৷ আমার মেজাজ গেল বিগড়ে৷ একে তো শুনলাম দু’জনে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নাকি লোকটার বাড়িঘরের খোঁজ পায়নি৷ তার ওপর মানস অসুস্থ৷ মানস হচ্ছে আমার ডান হাত৷ ও বসে যাওয়া মানে আমার কাজকর্মের ভয়ানক ক্ষতি৷ রাগের মাথায় দুটো কথা শুনিয়ে দিলাম সংগ্রামকে৷ একে তো টার্গেট কীভাবে হবে সে নিয়ে কোনও রাস্তা দেখাতেই পারছে না৷ এমন এক স্টকিস্টের খোঁজ নিয়ে এল, যার বাড়িঘরের কোনও পাত্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ এদিকে সেই বুনোহাঁসের পেছনে ছুটে আমার সবচেয়ে কাজের ছেলেটা বসে গেল৷ রাগ হবে না?

সংগ্রাম মাথা নীচু করে পুরোটা শুনছিল৷ একটা কথাও বলেনি৷ আমার কথা শুনে একবার ঘসঘসে স্বরে শুধু বলল, ‘ওষুধ দাও সুশীলদা৷ ওষুধ চাই৷’

আমার মেজাজ গেল আরও খাপ্পা হয়ে৷ একগাদা ওষুধ পথ্য খাবার-দাবার দিয়ে ঠিক করলাম ছেলেটাকে, তার জন্য একটা শুকনো ধন্যবাদ জানানো দূরস্থান, মানসকে কোথায় না কোথায় গিয়ে অসুস্থ করে নিয়ে এল, এখন আমার ওপরেই চোটপাট? টার্গেট কী করে হবে তার নাম-ঠিকানা নেই, মাঝখানে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে রইলি, এখন ওষুধ চাই, ওষুধ চাই বলে চোটপাট করছিস? যা দেব না তোকে কোনও ওষুধ৷

শুনে মাথা নাড়লাম, বটেই তো৷ সুশীল আগরওয়াল ব্যবসায়ী মানুষ৷ ব্যবসার ক্ষতি হলে তাঁর রাগ করার হক আছে বই কি৷ প্রশ্ন করলাম, ‘সংগ্রাম কী বলল?’

সুশীলবাবু একটু এগিয়ে এলেন, ‘সেটাই তো সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা চ্যাটার্জিসাহেব৷ আগেই বলেছি আমার বকাবকি করার সময় একেবারে সংগ্রাম চুপচাপ ছিল৷ একটা কথাও বলেনি৷ আপনি যে চেয়ারটায় বসে আছেন, ঠিক ওই চেয়ারটাতেই বসে ছিল ও৷ মাথা নীচু করে৷ যেভাবে হেডমাস্টারের বকা শুনে বাধ্য ছাত্র মাথা নিচু করে বসে থাকে, ঠিক সেরকম৷ আমার শেষ কড়া কড়া কথাগুলো শুনে চোখ তুলল একবার৷ আর আমি চমকে গেলাম৷’

ঘরের আলোটা ঠিক এইসময়েই ভোল্টেজ কমে একটু নিভু নিভু হয়ে এল৷ হঠাৎ করে শীতটাও একটু বেড়ে উঠল যেন৷ অজান্তেই আমার গলার স্বর নেমে এল, ‘কী বলল সংগ্রাম?’

সুশীলবাবুও একটু ঝুঁকে এসে চাপা গলায় বললেন, ‘কী বলব দাদা, সংগ্রামকে আমি ওই অবস্থায় কখনও দেখিনি৷ চোখ দুটো টকটকে লাল, নাকদুটো বুনো মোষের মতো ফুলে উঠেছে, ঠোঁটের কোণে ফেনা৷ ছেলেটার গলাটা হঠাৎই যেন পালটে গেল৷ একটা অজানা ঘষা ঘষা গলায় বলল, ‘ওষুধ চাই আমার, ওষুধ দে৷’

বলতে লজ্জা নেই দাদা, ধক করে বুকের মধ্যে একটা ভয়ের ঝাপটা এসে লাগল৷ মনে হল যে সংগ্রামকে আমি চিনি এ সেই সংগ্রাম নয়৷ ওর মধ্যে কী যেন একটা ভর করেছে৷ খুব ভয়ের কিছু একটা৷ খুব খারাপ কিছু একটা৷

তবুও তার মধ্যেই ওর তুই-তাকারি অগ্রাহ্য করে সাহস জুটিয়ে বললাম, ‘কীসের ওষুধ চাইছিস? যা, দেব না তোকে কোনও ওষুধ৷’

সংগ্রাম সেই রক্তলাল চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ৷ তারপর সেই একই ঘষঘষে গলায় বলল, ‘আমাকে ওষুধ দিবি না তুই? দেখ তাহলে তোর কী করি৷’

জানি না সুশীলবাবুর বলা কথাটার মধ্যে কী ছিল, স্পষ্ট বুঝলাম আমার ঘাড়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেছে৷ শুকনো গলায় বললাম, ‘তারপর?’

‘তারপরই ছেলেটা দুদ্দাড় করে চেয়ার উলটে সেই যে বেরিয়ে গেল তারপর থেকে আর তার পাত্তা নেই৷ ওর ফ্ল্যাট তালাবন্ধ৷ অফিসে, বাড়িতে খোঁজ নিলাম, সেখানেও কেউ জানে না সংগ্রাম কোথায়৷ কম্পানির অফিসে বা ওর বাড়িতে বলতেও পারছি না কেসটা কী৷’

‘ওর বসকে তো নিশ্চয়ই চেনেন৷ তাঁকে জানাননি?’

‘ওর বস মুখার্জি সাহেবকে আমি ভালো করে চিনি৷ খুব কড়া লোক৷ হাতে মাথা কাটেন৷

তাঁকে তো কিছু খুলে বলাই যায় না৷ সংগ্রামের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না শুনে হয়তো ওর চাকরিটাই খেয়ে নিলেন৷ বেকার বেকার কেন সেই পাপের ভাগীদার হই?’

‘আর ফ্যামিলি?’ প্রশ্নটা করেই বুঝলাম ভুল করেছি৷ কারণ ওর পরিবার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না৷ অথচ ওর বন্ধু হিসেবে আমারই জানা উচিত ছিল৷ এবং এই প্রথম অনুভব করলাম যে আমাদের সম্পর্কটা কতটা অগভীর ছিল৷ আমরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করেছি, হাসি ঠাট্টা করেছি, একসঙ্গে ঘুরতে গেছি, সপ্তাহান্তে মদের আসর বসিয়েছি, কিন্তু একে অন্যের জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টাই করিনি৷

সুশীল আগরওয়াল অবশ্য এত কিছু খেয়াল করলেন না৷ তিনি আনমনে বলতে লাগলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সংগ্রামের তিনকূলে আত্মীয় বলতে একমাত্র ওর মা৷ বাবা মারা গেছেন অনেকদিন৷ ভাই-বোন কেউ নেই৷ এও নিশ্চয়ই জানেন যে ওরা অনেক পুরনো বনেদি পরিবার৷ এককালে নদিয়া চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিশাল জমিদারি ছিল৷ এখনও শ্যামবাজারের মোড়ে ওদের মস্ত বড় বাড়ি৷ যদিও সে বাড়ি এখন ছোট বড় মেজ সব শরিকদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেছে৷ সংগ্রামের মা দুটো ঘর নিয়ে একাই থাকেন৷

আমার কাছে সংগ্রামের মায়ের ফোন নাম্বার ছিল৷ কিন্তু সত্যি বলতে কী, ওঁকে ফোন করার সাহস হয়নি৷ বয়স্ক মহিলাকে উতলা করে লাভ? সংগ্রাম কোথায় আছে তার উত্তর তো আমার নিজের কাছেও নেই৷’

‘পুলিশে খবর দেননি কেন?’

প্রশ্নটা শুনে সুশীল আগরওয়ালের মুখে অস্বস্তি আর ভয়ের ছায়া খেলে বেড়াতে লাগল৷ আর আমি এই প্রথম অনুভব করলাম যে সুশীলবাবুর গল্পের মধ্যে একটা মস্ত ফাঁক থেকে গেছে৷ আর সেই ফাঁকে অত্যন্ত অস্বস্তিকর কিছু একটা আছে যা লোকটা বলতে চাইছে না৷

আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুলিশে খবর দেননি কেন?’

সুশীল আগরওয়াল কিছু বললেন না৷ উঠে আমার হাত টেনে বললেন, ‘আসুন একবার৷’

* * *

বিষ্ণুপুরের দিকে গাড়িতে যেতে যেতে অনেকগুলো চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল৷ বাইরে অলস দুপুর৷ রিক্ত বিষণ্ণ মাঠ শুয়ে আছে বিগতপ্রসবা নগ্ন নারীর মতো৷ আকাশে অকাল মেঘ৷ অ্যাম্বাসাডারের খোলা জানলা দিয়ে ঢুকে আসছে শিরশিরে বাতাস৷ বাইরে জনমানুষ নেই৷

পেছনের সিটে বসেছিলাম আমি আর সুশীল আগরওয়াল৷ গাড়ি চালাচ্ছিল মানস৷ হ্যাঁ, মানসকেই ওষুধ খাইয়ে চাঙ্গা করে আনা হয়েছে আমাদের সঙ্গে৷ কারণ জঙ্গলের মধ্যে ওই বাড়িটা কোথায় সেটা একমাত্র ওই-ই নির্ভুলভাবে বলতে পারবে৷ আমিও দেখেছি বটে, কিন্তু সে বর্ষার রাত্রে, অন্ধকারের মধ্যে৷ আমার পক্ষে ও জায়গায় চিনে যাওয়া সম্ভব না৷

আবার সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা৷ এখন আকাশ পরিষ্কার৷ বাতাসে শীতের কামড়৷ মাঝে মাঝেই একটা লাল ধুলোর ঝড় পাকিয়ে উঠছে রাস্তার পাশে৷ তাতে মিশে যাচ্ছে শুকনো পাতা কুটো, আর একটা অজানা ভয়৷ জানি না কেন বুকের ভেতরটা থমথম করছিল৷

যেতে যেতে ফের কারসানির সেই চায়ের দোকানের সামনে এলাম৷ সেই একই দোকান, একই বেঞ্চ, তবে এবার দেখলাম দোকানের সামনেটা ফাঁকা৷ লোকজন নেই৷ দোকানি উনুনের সামনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে৷ তিনজনে নেমে এগিয়ে গেলাম৷ দোকানি ব্যাজার মুখে বলল, ‘কী দিব?’

বললাম ‘তিনটে চা দাও আপাতত৷ আর দুটো করে লেড়ো৷ তা আজ লোকজন নেই যে বড়?’

দোকানি বোধহয় এর অপেক্ষাতেই ছিল৷ ফ্লাডগেট খোলার মতো হুড়মুড় করে বলে গেল, ‘আর বৈলবেন নাই বাবু৷ লোকের আক্কেল দেইখলে গা জ্বইলে যায়৷ বলি বুড়ি মইরবেক ন মইরবেক নাই তার ঠিক নাই ইদিকে লোকজন রাস্তায় বেইরানো বন্ধ কৈরে দিল৷ কী ভয়, ন বুঢ়ি সমর্থ লোক দেইখলেই উয়ার জান হাফটাই লিয়ে ফির বাঁইছে উঠবেক৷ এখন বুঢ়ি কবে মইরবেক তার লাইগে হা কাড়্যে বইসে থাকা যায়? বলি তদের একটা আক্কেল নাই? বুঢ়ি না মরা তক্ক সোব কাজ কম্ম বন্ধ কৈরে বইসে থাকবি নকি?’

প্রথমে ঠিক বুঝলাম না৷ দোকানির পো খুব উত্তেজনায় মনের ভাব ঘেঁটে ফেলেছে৷ কথার পারম্পর্য নেই৷ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুশীলদা বলল, ‘কী কেস কাকা? খুলে বলো তো৷’

‘আমাদের গাঁয়ে একটা বুঢ়ি আছেন বাবু৷ উয়ার নকি নজর ভাল লয়৷ কবে পারা উয়ার আসে পাশের ঘর গিলায় গরু ছাগল মাইনষের মড়ক লাইগে গেইছল৷ তখন জানগুরু আইসে কড়ি চাইলে বৈলে দিঁয়ে গেইছিল উ ডাইন বঠে৷ সেদিন থাইকেই বুঢ়ি একঘইরা৷ কারো ঘর যাইতে পারে নাই, কারো বখুইল-এ উইঠতে পারে নাই৷ পেটের জ্বলন আমার দকানের কাছে ঘুইরে বুলে, খৈদ্দার-এর কাছে মাইগে খায়৷ বাবুরা কেউ দয়া কইরে কিছু মিছু কিনে দেই বা দুটা পইসা দেই৷ নাইলে রাইতে দকান বন্ধ করার সময় আমিয়েই একটা পাউরুটি নাইলে দুটা বিস্কুট দি৷’

চট করে আগের দিনের কথাটা মনে পড়ে গেল৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে বুড়ির?’

‘চাইর পাঁচ দিন হইল বুঢ়ির অবস্তা ভাল লয়৷ মর মর প্রায়৷ আর ইদিকে প্রায়ই লোকের ঘরে মুরগি ছাগল হাপিস হৈ যাচ্ছে৷ জানগুরু বৈলছে ইটা পারা ওই বুঢ়িরই কাজ৷’

আশ্চর্য হয়ে বললাম, যে বুড়ি মরো মরো সে রাতের বেলা ছাগল মুর্গি চুরি করছে? লোকে কী পাগল?’

দোকানি খানিক চুপ করে বসে রইল৷ তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘কী বৈলব দাদা, গত ক-দিন হইল বিষ্টুপুর থাইকে ইদিকে সাতটা গাঁয়ের লোক ডরে কাঁটা হইয়ে আছে৷ রাইত হইলেই ন কী গাঁয়ের পাশের জঙ্গল দিকের থিকে অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ আসছে৷ কখনু ছুটু বিটিছানার কাঁদার শব্দ, কখনু মরদ মায়া মানুষের বুক চাপড়াই কাঁদার শব্দ, কখনু চিৎকার৷ কুথা থাইকে এই আওয়াজ আইসছে কেউ জানে নাই৷ জুয়ান ছেইলা পেইলারা মিলে দিনের বেলায় যাইয়ে দেইখেছে কাঁচা হাড় মাংস ছইড়াই আছে বনের ভিত্রে৷ আর দু-দিন আগে হাসিগ্রাম-এর নয়ন সরেন-এর লাতি রাতের বেলা বাজার থিকে গাঁ আসছিল৷ তখন পারা দেখেছে বনের ভিত্রে কে জানি আতিপাতি কইরে কী একটা খুঁইজছে৷ সে ছকরা ত মারাংবুরহুর নাম লিয়ে কাঁইপতে কাঁইপতে ঘর ঢুইকে বেহুঁশ৷ সেই থাইকে রটনা হই গেছে ওই ডাইন বুঢ়িই রাইতের বেলা শাল গাছে চাইপে আসেপাশের গাঁয়ে সমর্থ মরদ বা মাইয়া মানুষ খুইজে বুইলছে৷ জান হাফটাই লিয়ে ফের বাঁইছে উঠবেক বইলে৷’

চা খেতে খেতে পুরো গল্পটা শুনলাম৷ বলতে নেই এসব গল্পগাছায় আমার কোনওদিনই আস্থা ছিল না৷ তবে সংগ্রামের কথাটা শুনে ইস্তক মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি খচখচ করছিল৷ দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বুড়ি যে মরতে বসেছে সে জানলে কী করে?’

‘গত সম মঙ্গল দুদিন আসেনাই দেইখে বুঢ়ির ঘরে যাঁইয়ে দেখি বুঢ়ি বেদম জ্বরে পইড়ে আছে৷ কাঁথা-লাতা গু মুতে একাকার৷ পাড়ার একটা মায়ামানুষকে দিয়ে সব সাফ করালম৷ সেই গায়ে হাত দিঁয়ে বৈল্ল গা পুইড়ে যাইচ্ছে একদম৷ আমি ওঝা কে ডাকতে গেলম, ওঝা সিধা বলে দিল ডাইনের লাইগে কোন ওষুদ দিবেক নাই৷ সেই থিকে বুঢ়ি ওমনি পইড়ে আছে৷ ডাইকলে রা দেয় নাই৷ আমি যাই রুটি ফল পাকুড় দিঁয়ে আসি কোনদিন খায় কোনদিন খায় নাই৷

বুঝলাম, দোকানির মনের মধ্যে খানিকটা মনুষ্যত্ব এখনও বেঁচে আছে৷ নইলে ডাইনিবুড়ির জন্য এত মানস! ঠাট্টার সুরে বলল, ‘তা কাকা, তোমার তো দেখছি বুড়ির জন্য খুব দরদ৷’

দোকানি ম্লান হেসে বলল, ‘দোকানের সামনে কুকুর বিড়াল ঘুরে বুইল্লেও মায়াজাল হই যায় বাবু৷ আর ইটা ত দেখুত মানুষ৷’

কথাটা বুকের মধ্যে ধক করে লাগল৷ তাই তো, কথাটা তো এভাবে ভেবে দেখিনি৷ মানুষের জন্য এটুকু না করলে আর নিজেকে মানুষ বলি কেন? উঠে পড়ে বললাম, ‘বুড়ির কাছে নিয়ে চলো তো কাকা৷’

* * *

বুড়ির কপালে হাত দিয়েই সুশীলদা আঁতকে উঠল, ‘এর তো সাঙ্ঘাতিক অবস্থা, বেঁচে আছে কী করে?’

সুশীলদার কথাটা যে কথাটা যে নেহাত ফেলনা নয় সেটা বুড়ির অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়৷ ভাঙা কুঁড়েঘরের মেঝেয় একটা শতচ্ছিন্ন নোংরা গদির ওপর বুড়ির শীর্ণ দেহটা মড়ার মতো পড়ে আছে৷ গায়ে একটা জীর্ণ মলিন কাঁথা৷ চোখ দুটো উলটে দেখল সুশীলদা, করমচা’র মতো লাল৷

সুশীলদা মেডিকেল লাইনের লোক বলে কি না জানি না, দেখলাম যে ওর গাড়িতে একটা ফার্স্ট এইড বক্স আছে৷ তাতে অনেক কাটাছেঁড়ার ওষুধের সঙ্গে বেশ কিছু জ্বরজারির ওষুধপত্তরও আছে৷ সুশীলদা প্রথমেই বুড়ির মুখের মধ্যে সযত্নে একটা থার্মোমিটার ঢুকিয়ে দিল৷ ততক্ষণ আমি ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম৷

ঘরের মধ্যে ওই গদি ছাড়া আসবাবপত্র বলতে একটা পুরনো কুঁজো আর দু-চারটে আধভাঙা বাসনকোসন৷ এক কোণে ডাঁই করে রাখা একটা সানকির থালা, একটা নোংরা স্টিলের গ্লাস, দুটো পোড়ামাটির হাঁড়ি, আরও দু-চারটে ধূলিমলিন অকিঞ্চিৎকর সাংসারিক জিনিসপত্র৷ আরও এক কোণে একটা কেলেকুষ্টি চৌপায়ার ওপর একটা ফাটা ফ্রেমে আটকানো ছবি৷ তার ওপর এত তেল সিঁদূর আর নোংরার পুরু আস্তরণ যে কোন দেবতা বা দেবীর ছবি বোঝাই দায়৷ আমি, মানস, সুশীলদা ছাড়া সঙ্গে ছিল সেই দোকানি, আর এক মহিলা৷ এই মহিলাই আজকাল বুড়ির ঘরদোর পরিষ্কার করে দেন, সাধনদা কিছু টাকাপয়সাও দেয় তার জন্য৷ মহিলা দেখলাম ফটোটার দিকে সভয়ে একটা প্রণাম ঠুকেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন৷

কিছুক্ষণ পর বুড়ির মুখ থেকে থার্মোমিটারটা বার করেই আর্তনাদ করে উঠল সুশীলদা, ‘আরে বাপরে… এ তো ১০২ ডিগ্রি জ্বর দেখাচ্ছে৷ এ তো অ্যাকিউট নিউমোনিয়া মনে হয়৷ এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি না করলে আজকের রাত্তিরটা কাটবে না৷’

মানস আমি কাজে লেগে গেলাম৷ মানসের তত্ত্বাবধানে সঙ্গে আসা মহিলাটি ঝটপট ঘর পরিষ্কার করা শুরু করে দিল৷ আমি আমাদের সঙ্গে আনা খিচুড়ি অতি যত্নে বুড়িকে কিছুটা খাইয়ে দিলাম৷ এর বেশি কিছু খাওয়াতে সাহস পেলাম না, ভয় হচ্ছিল যে বুড়ি বমি না করে ফেলে৷ খাওয়ানো শেষ হলে পর সুশীলদা দুটো ট্যাবলেট গুঁড়ো করে অল্প জলে মিশিয়ে চামচে দিয়ে অল্প অল্প করে বুড়িকে খাইয়ে দিল৷

তারপর সুশীলদা মানসকে দিয়ে গাড়ি থেকে একটা ব্যাগ আনাল৷ সেখান থেকে বেরোল একটা সিরিঞ্জ আর অ্যাম্পুল৷ তারপর টোকা দিয়ে অ্যাম্পুলের মাথা ভেঙে সিরিঞ্জে ওষুধ ভরে বুড়ির হাতে পুশ করতে টাইম লাগল ঠিক দু’মিনিট৷

আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘তুমি ইঞ্জেকশন দিতে জানো নাকি?’

‘না জানার কী আছে৷ এই লাইনে আছি পনেরো বছর৷ প্রেশার মাপা, ইঞ্জেকশন দেওয়া অনেক কাজই পারি৷ সবই ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে সঙ্গে থেকে শেখা৷’

‘কী ওষুধ দিলে সুশীলদা?’

সুশীলদা ওষুধের ব্যাগ গুছোতে গুছোতে বললো, ‘জ্বরের ট্যাবলেট দিলাম আর অ্যাজমার ইঞ্জেকশন৷ তবে এতে শানাবে না৷ এখন বুড়ির দরকার অ্যান্টিবায়োটিকের কড়া ডোজ, ঠিকঠাক বিশ্রাম আর নিয়মিত নজরদারি৷’

কথাটা শুনে দোকানি ম্লান হাসল, ‘সেসব ইখেনে কুথায় পাব বাবু? এই বন ধারে ডাক্তার হাসপাতাল কুথায়? ছোটমোট কিছু হইলে বনের পাতা শিকড় দিয়ে কাজ চালাই৷ আরটুকু বেশি হইলে ওঝা জানগুরু এরাই ভরসা৷’

‘পার্টির লোকেদের বলো না কেন?’

দোকানির ঠোঁটের কোণে একটা ম্লান বাঁকা হাসি দেখা গেল, ‘পাটির লোক আসে শুধু ভোটের আগেটয়৷ হাসপাতাল ডাক্তারঘর এইসব লিয়ে অনেক কথা বইলে যায়৷ কিন্তু অবস্তা যেই কে সেই৷ কাউকে সাপে কাটলে সেই বিষ্টুপুর সদরে ছুট৷ বেশিরভাগ রোগী ত পৌঁছাতে পৌঁছাতেই মরে যায়৷ তারপর ধরেন পুয়াতি মেইয়ারা৷ এই পাড়া গাঁয়ে বাচ্চা হইলে দাই মা-ই ভরসা৷ একটু জটিল কেস হলে শহরের হাসপাতালে লিয়ে যাইতে হয়৷ অথচ লিয়ে যে যাবেক তার উপায় কৈ? ভাঙাচুরা খানাখন্দ ভরা রাস্তা দিঁয়ে যেতে গিয়ে যে কত মেইয়ার রাস্তায়েই বাচ্চা হইয়ে গেছে যে কী বইলব৷’

কথাটা যে মিথ্যে নয় সে আমিও জানি৷ তাই আর কথা বাড়ালাম না৷ মানসদা কয়েকটা ওষুধ দোকানিকে বুঝিয়ে দিল৷ সঙ্গে থাকা মহিলাটি সেই তেল সিঁদূর মাখা পটের দিকে তাকিয়ে একবার নমো করে নিল৷ অস্ফুটে বলল, ‘ডাইনবুঢ়ি মরার আগে ওষুধ পাচ্ছে গো মা, সবই তুমার ইচ্ছা৷’

বেরিয়ে আসার আগে কী মনে হতে নীচু হয়ে একবার বুড়ির কপালে হাত ছোঁয়ালাম৷ আর তখনই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল৷ সঙ্গে সঙ্গে বুড়ির চোখ খুলে গেল, আর ডান হাতটা হঠাৎ করে উঠে এসে আমার হাতটা চেপে ধরল৷ আর দুর্বল ঘরঘরে গলায় বলল, ‘বুধন কই?! বনে কুথায় দিঁয়ে আলি উয়াকে?’

ব্যাপারটা এমনই আকস্মিক যে প্রথমে কেঁপে উঠলাম৷ মহিলার গলা দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল৷ বাকিরাও চমকাল বিলক্ষণ৷ দোকানি অবশ্য সামলে উঠল দ্রুত৷ তাড়াতাড়ি এসে বুড়ির হাত ধরে বলল, ‘এ বুঢ়ি, কার সঙ্গে কথা কইছুস? বুধন আইসবেক কুথা থাইকে? ই ত কৈলকাতার বাবু রে৷ দেখ তোর লাইগে ওষুধ আইনেছে৷ তোর ত কপাল ভাল রে বুঢ়ি৷’

বুড়ি সেসব কথায় কান দিল না৷ আমার দিকে লাল টকটকে চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বুধন সেদিন তোর সঙ্গে ছিল ন? কুথায় উ? কুথায় দিঁয়ে আলি উয়াকে? বনের ভিতর থাইকে বুধন ডাকে কেনে আমাকে?! উয়ার ডাক শুইনে আমার জ্বর আসে কেনে?’

দোকানি আরও ঝুঁকে এল বুড়ির ওপর, বলল, ‘ও বুঢ়ি মা, চিনতে লারছুস? ই তোর বুধন লয় রে৷ শহরের বাবু বঠে৷ খুব ভাল মানুষ৷ তুই যাতে সাইরে যাস তার লাইগে ওষুধ নিয়ে আইছে৷’

বুড়ি সেসব কথায় কান দিল না৷ আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘দুধের ছানাটাকে সেইদিন ভোকের জ্বালায় শাপ-শাপান্ত কইরেছিলম৷ তার লাইগেই আমার আইজ এই অবস্তা৷ বুধন কে আইনে দে, উয়ার মাথায় হাত না বলাই যে মইর্তে পাইর্ব নাই রে৷ ভোকের জ্বলনে আমার বুধনকে শাপ দিঁয়েছি, তাই ত ছানাটার উপরে ডাইন ভর হইছে৷ ছানা টা আমার বনে বনে ঘুইরে বুলে, আর কষ্ট পায়৷ বুধন কে আইনে দে বাছা, তোর ভাল হবেক৷ আমি ডাইনবুঢ়ি বলছি, আমার ছানা টাকে আইনে দে৷ বাছা আমার কত কষ্ট পাইচ্ছে৷ এরে, উয়াকে না দেইখে আমার শান্তি নাই রে, আমার মরণ নাই…’ বলতে বলতে বুড়ির হাত নিস্তেজ হয়ে এল৷ চোখ দুটো ফের বুজে গেল৷

সাবধানে বুড়ির হাত ছাড়িয়ে কুঁড়েঘরের বাইরে এলাম৷ গাড়ির দিকে যেতে যেতে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বুধনটা কে?’

দোকানি খানিক চুপ করে রইল৷ তারপর বলল, ‘বুধন ছিল এই বুঢ়ির ব্যাটা৷ বিধবা মায়ের একটি ই ব্যাটা৷ পাশের ঘরের ছেইলা দের সঙ্গে জমি লিয়ে বুঢ়ি আর উয়ার ব্যাটার সঙ্গে গন্ডগোল ছিল৷ উয়ারাই এক পরব দিনে বুধনকে ভুলাই ভালাই ভাঁকু খাওয়াই জঙ্গলে লিয়ে যাইয়ে মাইরে পুঁতে দিঁয়েছিল৷ বুধন তখন পনর বছরের জুয়ান ছানা৷ সেই শোকে ই বুঢ়ি খেপে গেছে৷ আইজঔউ সে মাঝে মধ্যেই বনে যাঁইয়ে বুধনকে ডাকে৷’

শুনে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম৷ এরকম কত ঘটনাই যে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে ঘটে তার কোনও ইয়ত্তা নেই৷

দোকানি আরও একটু থেমে বলল, ‘তবে একটা কথা বাবু৷ উই ঘটনার পর থিকেই পাশের ঘরে সব গরু বাছুর মইরতে শুরু করে৷ এক এক কইরে উয়াদের ছানা পানা গুলাও মইরে যায়৷ কেউ সাপে কাইটে, কেউ ওলাউঠায়, কেউ বা হাঁতিঠাকুরের পায়ের তলে৷ আর একটা ছিল্যা তো হাইরিয়েই যায়৷ সেই থাইকে বুঢ়িকে ডাইন বলে সবাই৷’

শুনে থেমে গেলাম৷ তারপর প্রশ্ন করলাম, ‘এ কবেকার ঘটনা?’

‘ধরেন আইজ থাইকে তিরিশ বছর আগের থাইকে৷’

‘তারপর থেকে এই গাঁয়ে বুড়ির সঙ্গে শত্রুতা করে কেউ মরেছে?’

মাথা নাড়ল দোকানি, ‘না বাবু৷’

‘তাহলে লোকে বুড়িকে ডাইনি বলে কেন? পড়শির ছেলে বা গরু ছাগল তো স্বাভাবিক ভাবেই মরতে পারে৷’

ম্লান হাসল দোকানি, ‘ইটা কইলকাতা শহর লয় বাবু৷ ইটা সামতাল গাঁ৷ ইখেনে জানগুরুই সব৷ একবার যাকে উ ডাইন বইলে দিবেক তার গা থিকে সেই দাগ তুলার ক্ষমতা কারুর নাই৷’

কী মনে হতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী নাম ছিল বুড়ির পড়শিদের?’

‘ওরা মাঝি ছিল বাবু৷ সনাতন মাঝি৷’

শুনে আমার মাথায় কী যেন একটা টিকটিক করে উঠল৷ মানস আর সুশীলদা গাড়িতে গিয়ে বসল৷ আমি দোকানিকে দু-একটা কথা বলে গাড়ির দিকে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম৷ মন শুধু বলতে লাগল, ও বুড়ি ডাইনি নয়৷ হতে পারে না৷

* * *

গাড়ি চলতে চলতে এক জায়গায় এসে হঠাৎ ব্রেক কষল মানস৷ তারপর গাড়িটা সাবধানে সাইড করে বলল, ‘আপনারা নামুন৷ গাড়িটা পার্ক করে আসছি৷’

গাড়ি থেকে নেমে গা হাত-পা ছাড়িয়ে নিলাম একটু৷ সুশীলদা মানসকে জিজ্ঞেস করল, ‘এইটাই সেই জায়গা? তুই ঠিক জানিস তো?’

মানস কিছু বলল না, শুধু ঘাড় নাড়ল তারপর রুকস্যাকটা পিঠে নিয়ে আঙুল তুলে একটা গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞে করল, ‘চাটুজ্জেদা, চিনতে পারছেন?’ এই বলে একটা মস্ত বড় নিমগাছের মাথার দিকে দেখাল৷ এবার আমিও দেখে চিনতে পারলাম৷ এই সেই নিমগাছ যার নীচে আমি আর সংগ্রাম আশ্রয় নিয়েছিলাম৷

যেখানে মানস গাড়ি পার্ক করল সেখান থেকে জঙ্গলের মধ্যে হেঁটে নিমগাছটার গোড়ায় পৌঁছতে সময় লাগল তিন মিনিট৷ যদিও আকাশে আলো আছে এখনও, তবুও সন্ধে নামার মুখে অত বড় নিমগাছটা দেখে গা ছমছম করছিল৷

সুশীলদা বলল, ‘হুম৷ এবার ওই লোকটার বাড়ি যাওয়া যাক৷’

মানস একটা সরু জঙ্গুলে রাস্তা ধরে এগোতে লাগল৷ দু’পাশে মস্ত মস্ত পলাশ, সেগুন আর শালগাছের দল৷ তাদের শুকনো পাতায় জঙ্গলের মাটি ছেয়ে আছে৷ কয়েকদিন আগের বৃষ্টি হয়েছিল৷ তাই বাতাসে একটা ভ্যাপসা ভিজে গন্ধ৷ ঘরে ফিরে আসা পাখিদের ডাকে কান পাতা দায়৷ ইতিমধ্যেই ঝিঁঝিঁ ডাকতে শুরু করেছে৷

পাঁচ মিনিট হাঁটার পরেই ঝুপ করে অন্ধকারটা নেমে এল৷ গ্রামদেশে শীতের রাত নাকি তাড়াতাড়ি নামে৷ কিন্তু এমন হঠাৎ করে নামে বলে জানা ছিল না৷ ঝিঁঝিঁর ডাক শতগুণে বেড়ে উঠল৷ সুশীলদা হতাশ সুরে বলল, ‘যাহ, এবার কী হবে? সামনে তো পুরো অন্ধকার, রাস্তাই দেখতে পাচ্ছি না যে৷’

যেন সুশীলদার কথার জবাব দিতেই সামনে একটা জোরালো টর্চের আলো জ্বলে উঠল৷ মানস ওর রুকস্যাক থেকে একটা মিলিটারি গ্রেডের টর্চ বার করে জ্বালিয়েছে৷ তখন পানাগড়ের কাছে কিছু কিছু দোকানে এই জিনিস পাওয়া যেত৷ মানস দেখছি তারই একটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে৷

টর্চের আলোয় সামনেটা দিনের মতোই পরিষ্কার৷ আমরা এগোতে লাগলাম৷ মানস বলল, ‘বেশি না, মিনিট পাঁচেকের রাস্তা৷ আশা করছি এবার লোকটাকে ঘরেই পাওয়া যাবে৷’

যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকালাম৷ কেন জানি না মনে হল আমরা যেমন একটু একটু করে আলোর স্রোত বেয়ে এগোচ্ছি, তেমনই আমাদের ছেড়ে আসা রাস্তাটা একটু একটু করে তরল অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে৷ ঘাড় ঘুরিয়ে নিলাম৷ একটা অস্বস্তিতে গা’টা শিরশির করে উঠল৷

কিছুক্ষণ হাঁটার পর টর্চের আলোয় দূর অন্ধকারের স্লেটে একটা খোড়ো বাড়ির অবয়ব ফুটে উঠল৷ মানস টর্চ নিভিয়ে দিল৷ আমাদের চাপা গলায় বলল, ‘আসুন৷’

আমরা অন্ধকারের মধ্যেই ধীরে ধীরে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম৷ নিঝুম নিষ্প্রাণ একটা বাড়ি৷ কোথাও কোনও আলোর আভাস নেই৷ মনে হল বাড়িটা যেন একগলা নিঝুম অন্ধকারের মধ্যে ডুবে আছে৷

আমি এদিক-ওদিক তাকালাম৷ সেদিন যে ধানের মরাই, ট্রাক্টর দেখেছিলাম, একটু দূরে তাদের অবয়ব দেখা যাচ্ছে বটে৷ কিন্তু এই তারার আলোয় তাদের কেমন যেন ভুতুড়ে দেখাচ্ছে৷

মানস পায়ে পায়ে এগিয়ে কোমরসমান উঁচু বেড়ার দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল৷ সঙ্গে সঙ্গে আমরাও৷ সবার শেষে ছিলাম আমি৷ কেন জানি না মনে হল আমি ভেতরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে যেন বেড়ার দরজাটা সজোরে বন্ধ হয়ে গেল৷

মানস অবশ্য ওসব দেখছিল না৷ ও একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল দাওয়ার দিকে৷ আমরা তিনজনে দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়ালাম৷ সুশীলদা একবার বলল, ‘টর্চটা জ্বাল মানস৷’

মানসের ডান হাতের তর্জনীটা সাপের ছোবলের মতো ওর ঠোঁটে উঠে এল৷ সঙ্গে একটা শিসের মতো আওয়াজ৷ আমাদের চুপ করতে বলছে মানস৷

মনে পড়ে গেল কালকের কথাটা৷

সুশীল আগরওয়ালকে কাল যখন প্রশ্ন করেছিলাম, ‘পুলিশে খবর দেননি কেন?’ সুশীলদা কিছু বলেনি৷ শুধু আমার হাত ধরে নিয়ে গেছিল তার গোডাউনে৷

দেখেছিলাম গোডাউনের দেওয়ালে এবড়োখেবড়ো ভাবে লেখা আছে একটা কথা৷

‘ওসুদ দে, আমার বিটির ওসুদ দে৷ নাইত তোদিক্কে জীয়ন্ত ছিঁড়ে খাব৷’

ওই প্রায়ান্ধকার গোডাউনের দেওয়ালে এই কথা লেখা দেখে যতটা না ভয় লেগেছিল, তার দ্বিগুণ আতঙ্কিত হয়েছিলাম ওটা কী দিয়ে লেখা সেটা বুঝতে পেরে৷

রক্ত৷ শুকিয়ে যাওয়া রক্ত৷ আর মনের ভেতরে কে যেন ফিসফিস করে বলছিল, ‘ওটা তোমার বন্ধুর রক্ত৷ সংগ্রামের রক্ত৷ ও বিপদে আছে, ভীষণ বিপদে আছে৷ যাও, ওকে বাঁচাও৷’

হুঁশ ফিরে এল একটা ক্যাঁচ শব্দে৷ মানস ঘরের দরজাটা ঠেলে ঘরের ভিতরে ঢুকল৷ তারপর সুশীলদা৷ সুশীলদা ঢোকার পর দরজাটা ফিরে এসে বন্ধ হয়ে গেল৷

একটুও দুলল না৷

আমি এগোতে যাব, এমন সময় মেঘ সরিয়ে ক্ষীণ চাঁদের আলো বারান্দায় এসে পড়ল৷ আর মেঝের দিকে তাকিয়ে আমি থমকে গেলাম৷

কোথায় সেই নিকোনো তকতকে বারান্দা, যেখানে আমরা বসে চা, লুচি তরকারি খেয়েছিলাম? এ তো ফুটিফাটা ভাঙা দাওয়া৷ এখানে ওখানে গর্ত৷ মাটি থেকে দাওয়ার ওপর অবধি বেয়ে উঠেছে লতানে গাছের জঙ্গল৷ বাঁশে ঘুন ধরেছে, তার ফুটিফাটা গা থেকে ঝুর ঝুর করে খসে পড়ছে গুঁড়ো৷

পিছন ফিরে তাকালাম৷ কোথায় সে গোলাভরা ধানের মরাই? যেন একটা ভুতুড়ে কাঠামো প্রকাণ্ড হাঁ করে অট্টহাসি হাসছে৷ আর তার পাশে হাড় পাঁজর বার করে দাঁড়িয়ে থাকা ওটা কী? সেই ট্রাক্টরটা? দেখে শিউরে উঠলাম৷ মনে হল যেন একটা প্রাগৈতিহাসিক বৃদ্ধ যন্ত্রদানবকে একটু একটু করে পিষে ফেলেছে এই সর্বগ্রাসী বুভুক্ষু জঙ্গল৷

ঘরের দরজার দিকে তাকালাম৷ আর ঠিক তখনই জঙ্গলের দিক থেকে একটা হাহাকার ভেসে এল, পথ নাই, পথ নাই, ঘুইরবার পথ নাই৷

মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিলাম৷ হ্যালুসিনেশন হচ্ছে নাকি?

ঘরের ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ আসছে না৷ সেদিন বৃষ্টিস্নাত সন্ধেবেলা যে মায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় দেখে মন তৃপ্ত হয়েছিল, তার সঙ্গে এই সর্বগ্রাসী রিক্ত কুঁড়েঘরের কোনও মিলই নেই৷ সব যেন মিলিয়ে গেছে ভোজবাজির মতো৷ যেন একটা মহামারী এসে শুষে নিয়ে গেছে একটা মস্ত জনপদ৷ তার হাসি নেই, শ্বাস নেই, প্রাণ নেই, বেঁচে থাকা নেই, এমন কি শান্তিতে মরে যাওয়াও নেই!

দরজাটা খুলে সাবধানে ভেতরে বাঁপাটা রাখলাম৷ পায়ে একটা এবড়োখেবড়ো মেঝে ঠেকল৷ সামনে ঘন নিঃসীম অন্ধকার৷ নিকষ, জমাট, পাথুরে অন্ধকার৷ তার গায়ে যেন আঁচড়ও কাটা যাবে না, এত কঠিন সেই তমসা৷ চাঁদের আলো এই ঘরের চৌকাঠে এসে থেমে গেছে৷ ভেতরে উঁকি দিতে তারও যেন বড় ভয়৷

একবার মৃদুস্বরে ডাকলাম, ‘সুশীলদা, মানস৷’

কোনও উত্তর এল না৷ কোনও প্রতিধ্বনিও ফিরে এল না৷ মনে হল নিঃসাড় গাঢ় অন্ধকারের সমুদ্রের মধ্যে আমার উচ্চারিত শব্দগুলো ভারী পাথরের মতোই নিঃশব্দে ডুবে গেল৷

ধীরে ধীরে ডান পা’টাও ভেতরে রাখলাম৷ আর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে চমকে দিয়ে পেছনের দরজাটা সজোরে বন্ধ হয়ে গেল৷ আমি চকিতে পিছনে ফিরে একবার ঠেললাম৷ কিন্তু কোনও ফল হল না৷

এবার ওই শীতের মধ্যেই আমি দরদর করে ঘামতে লাগলাম৷ জোরে চেঁচালাম, ‘সুশীলদা, মানস৷’ কিন্তু কোনও উত্তর নেই৷ আরও গলা চড়ালাম৷ কিন্তু প্রতিটা অক্ষর, শব্দ, বাক্য যেন গলে গেল, মিশে গেল, ডুবে গেল সেই অন্তহীন অন্ধকারের মধ্যে৷

একটু একটু করে পা বাড়াতে লাগলাম৷ ঘর যখন, কিছু না কিছু তো হাতে ঠেকবেই৷

কিন্তু না, কিচ্ছু না৷ থরথর কাঁপতে থাকা দুটো হাত শূন্যে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতে লাগল বার বার….

পায়ে পায়ে এগোতে এগোতে হঠাতই মনে হল পায়ের নীচে মাটিটা যেন একটু দুলে উঠল৷ থেমে গেলাম৷

ঠিক তখনই কানে এল একটা ক্ষীণ আওয়াজ৷ কে যেন ক্ষীণ বালিকাকণ্ঠে বলছে, ‘বাবা, বেদম কষ্ট হইচ্ছে গ৷ ওষুদ আইনেছ, ওষুদ?’

কোথা থেকে আসছে আওয়াজটা? বুঝতে পারলাম না৷

আর এক পা এগোতেই সেই আর্তি, ‘ও বাবা, বড় কষ্ট হইচ্ছে গ৷ দম আটকাই আইসছে৷ ওষুদ দাও না বাবা, একটু ওষুদ দাও না৷’

কোথা থেকে আসছে এই আওয়াজ? আমি এবার মৃদুস্বরে ডাকলাম, ‘সংগ্রাম৷’

মনে হল পাথুরে অন্ধকার যেন একটু সচল হল৷ এবার একটা অন্য আওয়াজ পেলাম৷ প্রথমে বুঝলাম না কীসের আওয়াজ….

তারপর শব্দটা বাড়তে লাগল৷ প্রথমে ধীরে৷ তারপর আরও একটু উচ্চকিত৷

নিঃশ্বাসের শব্দ৷ কেউ যেন ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে৷ ধীরে, অতি ধীরে৷ নিঃশ্বাস নিতেও যেন কত কষ্ট৷ আর প্রতি শ্বাসের সঙ্গে ভেসে আসছে সেই করুণ আর্তনাদ, ‘বাবা, ও বাবা, দাও একটু ওষুদ৷ আর যে পাচ্ছি নাই৷’

কে এই মেয়ে? কোথায় আছে সে? আমি উঁচু গলায় বললাম, ‘কে! কে! কে তুমি?’

কেউ উত্তর দিল না৷ শুধু সেই অন্ধকারে মাথা কুটতে লাগল একটা গাঢ় শ্বাস জড়ানো কষ্টের ডাক, ‘ও বাবা, বড় কষ্ট গো বাবা, বড় কষ্ট৷’ মনে হল সেই ঘরটাই যেন একটা মরণাপন্ন মেয়ের ফুসফুস৷ একটু খানি বাতাসের জন্য সেই আকুতি যেন ঘুরে মরছে ঘরের ভেতর, পাক খাচ্ছে, গুমরে মরছে৷

আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘কে তুমি, সাড়া দাও৷ ওষুধ এনেছি আমি৷ আমার কাছে ওষুধ আছে৷’

সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসের শব্দটা অনেক কমে গেল৷ এবার ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে একটা আবছা আলো জেগে উঠল৷ কোথা থেকে আসছে!

ওপরে তাকালাম৷ কুঁড়েঘরের ছাদ৷ সেখানে ফুটিফাটা হয়ে অল্প আলো আসছে৷ সূর্যের আলো নয়, ম্লান নিভু নিভু প্রদীপের আলো যেমন হয়, তেমন৷ বিষণ্ণ, মৃদু, অস্তপ্রায়৷

সেই আলোয় ঘরের অবস্থা দেখে শিউরে উঠলাম৷ সে ঘর আর ঘর নেই৷ দেওয়াল খসে পড়েছে জায়গায় জায়গায়৷ সারা ঘরে ঝুলে, নোংরায় ভর্তি৷ ওপাশের জানালা দিয়ে উঁকি মারছে জংলি লতা৷ কেউ নেই৷ কিচ্ছু নেই৷ সুশীলদাও নেই৷ মানসও নেই৷

আমার মাথার মধ্যে যেন জট পাকিয়ে গেল৷ এই তো ওরা ঘরের মধ্যে ঢুকল আমার চোখের সামনে৷ ওদিকে দরজা নেই৷ লোকদুটো কি ঘরের মধ্যে থেকে উবে গেল?

মেঝের দিকে আরেকবার চোখ গেল আমার৷ মেঝেতে পড়ে আছে….

কী ওগুলো? কী পড়ে আছে?

একটু পর চোখ সয়ে এলে বুঝতে পারলাম ওগুলো কী৷ হাড়৷ মুরগি আর ছাগলের হাড়৷

‘ওষুদ আইন্যেছু? আমার বেটির ওষুদ আইন্যেছু তুঁই?’

কথাগুলো এমন হঠাৎ ভেসে এল যে আমি চমকে গেলাম৷ চোখ গেল জানালার দিকে৷ আর আমার হৃৎপিণ্ডটা এক লাফে গলার কাছে উঠে এল৷

জানালায় একটা মুখ৷ একটা জংলি মুখ৷ ঘন জট পাকানো চুলে, নোংরা দাড়িতে তাকে সভ্য মানুষ মনে হয় না৷ আর তার জ্বলজ্বলে চোখে কীসের সেন একটা উদগ্র বুভুক্ষু খিদে৷

একটু তাকিয়ে থাকার পর চিনলাম ও কে৷ কিন্তু নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না৷ দ্বিধার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সংগ্রাম! তুই?’

সংগ্রামের চোখ দুটো আরও জ্বলজ্বল করে উঠল৷ ঠোঁটের কোণে একটা দুর্বোধ্য হাসি৷ একটা সম্পূর্ণ অচেনা স্বরে সে বলে উঠল, ‘ওষুদ দে রে, আমার বিটির ওষুদ দে৷’

আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷ এ তো সেই লোকটার স্বর যে সেই বর্ষার রাতে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছিল৷ তারই তো বাড়ি, ঘর, সংসার ছিল এটা! সংগ্রামের গলায় তার স্বর এল কোথা থেকে?

আমার মাথার মধ্যে সব জট পাকিয়ে গেল৷ কী হচ্ছে এসব? আমি কি জেগে আছি না স্বপ্ন দেখছি?

আবার সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সংগ্রাম, এ কী হয়েছে তোর? কোথায় ছিলিস এতদিন?’

এবার ঘরের মধ্য থেকে নয়, জঙ্গলের মধ্য থেকে ভেসে এল এক রমণীকণ্ঠের বিলাপ, ‘এ গো তুমার পায়ে পড়ি৷ মেইয়্যেটাকে একটুকু ওষুদ আইন্যে দাও… আর যে দেইখতে পাচ্ছি না৷ দোহাই তুমার…’

সংগ্রামের চোখ ঘোলাটে হয়ে এল৷ আবার সেই অচেনা স্বরে বলে উঠল, ‘ওষুদ দে রে, ওষুদ দে৷ আমার বিটিটা যে মইরে যাইচ্ছে৷ ওষুদ দে, ওষুদ দে…’

বলতে বলতে সংগ্রাম জানালার ওপর ভর দিয়ে উঠে দেহটা ঢুকিয়ে দিল ঘরের ভেতর গোবরাটে পেট ঠেকিয়ে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ নামিয়ে দিল জানালার নীচের দেওয়ালে৷ তারপর চার হাতে পায়ে দেওয়াল বেয়ে নামার চেষ্টা করতে লাগল মেঝেতে৷ দেখে মনে হল যেন একটা মস্ত বড় অজগর সাপ জানালা দিয়ে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে৷

সেই ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য দেখে আমার অন্তরাত্মা অবধি কেঁপে উঠল৷ আমি পেছোতে থাকলাম৷ পেছোতে পেছোতে ঠেকলাম দরজায়৷ ঘুরে দরজাটা খোলার চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু সেই পোড়ো কুঁড়েঘরের দরজা তখন শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে৷ আমি পাগলের মতো দরজায় ধাক্কা মারতে লাগলাম৷ তখন আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে৷ বুকটা খালি খালি লাগছেগ্ধ দরদর ঘামে ভেসে যাচ্ছে আমার সারা দেহ৷ আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘কে আছ, বাঁচাও৷’

পেছন থেকে সেই অচেনা ঘরঘরে স্বরে ফের ভেসে এলো, ‘ওষুধ দে রে…আমার বিটিটা যে মইরে যাইচ্ছে৷ ওষুদ নাই… কুথাও কুনও ওষুদ নাই… কত ঘুইরলম, কত মাথা কুইটলম, কত লোকের হাতে পায়ে ধইরলম… কেউ কিছু কৈরতে পাইল্ল নাই রে…একটুকু ওষুদের লিগে ফুলের মত বিটিটা আমার মইরে গেল রে…’

আমার বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পিটছে৷ আতঙ্কিত হয়ে পেছনে তাকালাম৷ সংগ্রামের অর্ধউলঙ্গ দেহটা ততক্ষণে ঘরের মধ্যে নেমে এসেছে৷ জন্তুর মতো সে চার হাত পায়ে এগোচ্ছে আমার দিকে….

এবার নিঃশ্বাসের শব্দটা যেন আরও জোর হয়ে উঠল৷ তার সঙ্গে মিশল একটা কান্নার রোল৷ আকাশ পেরিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে, সমস্ত বিশ্বচরাচর জুড়ে বাজতে লাগল সেই অশরীরী আর্তস্বর, ‘ওষুদ দাও ন বাবা, আর তো পাচ্ছি নাই…বুকটা ফাইটে যাইচ্ছে…এগো আমার বিটিটা যে মইরে যাবেক… দোহাই তুমার, যেখেন থিকে পার একটুকু ওষুদ আইনে দাও না…’

সেই প্রথম অনুভব করলাম তীব্র আতঙ্কের মধ্যেও মানুষের ঘুম পায়৷ প্রবল ঘুম৷ আমার সমস্ত চৈতন্য যেন অসাড় হয়ে এল৷ হাতে পায়ে আর কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই৷ শরীরে বিষ ক্লান্তি৷ আমি কোনওক্রমে জানালার পাশে দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়লাম৷ একটু দূরে একটা শীর্ণ উলঙ্গ দেহ৷ সে ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো আমার দিকে এগিয়ে আসছে জ্বলজ্বলে উন্মত্ত দুটো চোখে যেন কীসের ইশারা৷ আমি জানি না…আমি জানি না আমার কী হবে৷

চোখটা সম্পূর্ণ বুজে আসার ঠিক মুখে আমার কেমন যেন মনে হল আরও একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি৷ আমি কি ঠিক শুনলাম? ওই তো, আবার৷ কে যেন দরজায় ঠক ঠক করছে৷ হ্যাঁ, আমি নির্ভুল শুনেছি৷ কে যেন জোরে জোরে ঠোকা মারছে দরজায়৷

আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল৷ শুধু আমি নয়৷ ও-ও শুনেছে৷ ওর দু’চোখে এখন বিভ্রান্তি৷

আমার হাতে পায়ে সামান্য হলেও সাড় ফিরে এলা৷ কেউ এসেছে, দরজার ওপারে দাড়িয়ে আছে সে৷ কে যেন আমার মাথার মধ্যে গেঁথে দিল, ওর কাছেই আছে আমার মুক্তির চাবিকাঠি৷

চারিদিক নিঃস্তব্ধ৷ থেমে গেছে সেই বালিকার আর্তস্বর, সেই নারীকণ্ঠের ত্রস্ত আর্তচিৎকার৷ সেই আলো অন্ধকারের মধ্যে, স্তব্ধ শ্বাসশব্দের মধ্য দিয়ে ভেসে এল ক্ষীণ স্বর, ‘বুধন, বাপ আমার, কুথায় আছু বাপ?’

এসেছে! দোকানি তার কথা রেখেছে! আমার বুকটা আশায় আনন্দে ধক করে উঠল৷ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘বুড়িমা, এসেছ? তুমি এসেছ?’

এবার আরও জোরে ধাক্কা দিচ্ছে কেউ৷ দোকানির স্বর শোনা গেল, ‘হেই বুঢ়ি, কপাট থাইকে সেইরাই দাঁড়া৷ ইটা না ভাঙলে খুইলবেক নাই৷’

ফের সেই ডাইনিবুড়ির স্বর, ‘না না বাপ আমার, কিচ্ছু কইত্তে হবেক নাই৷ কপাট আপসেই খুইল্লে যাবেক৷ বুধন, এ বুধন, বুকে আয় বাপ আমার৷ শাপ দিঁয়েছি বলে রাগ কৈরেছু বাছা? আয় বাপ, বুকে আয় দিকি৷ গায়ে মাথায় হাত বুলাই দি৷ অনেক কষ্ট পাঁয়েছু বাপ আমার৷ মায়ের কাছে আয় দেখি…’

সংগ্রামের দিকে তাকিয়ে দেখি হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়েছে৷ তার রুগ্ন পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে৷ সংগ্রাম কাঁদছে!

আস্তে করে দরজাটা খুলে গেল৷ নিজে নিজেই৷ প্রথমে ঢুকল সেই ডাইনিবুড়ি আর দোকানি৷ তারপর হুড়মুড় করে ঢুকল সুশীলদা আর মানস! দু’জনে এসে আমাকে একেবারে জড়িয়ে ধরল৷ সুশীলদা বলল, ‘উফ, চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা৷ আরেকটু হলে পুলিশে খবর দিতে যাচ্ছিলাম৷ তোমাকে ওভাবে আচ্ছন্নের মতো ঘরে ঢুকতে দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা গড়বড় আছে৷ তারপর যত ধাক্কা দিই কিছুতেই দরজা খোলে না৷’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘মানে? এসব কী বলছ কী? তুমি আর মানস তো আমার আগে ঢুকলে ঘরে৷’

একে অন্যের দিকে তাকাল৷ তারপর মাথা নাড়ল মানস, ‘না চ্যাটার্জিদা৷ আমরা দাওয়াতে উঠিইনি৷ তোমাকে দেখলাম কেমন আচ্ছন্নের মত দাওয়াতে উঠলে৷ তারপর এদিক-ওদিক তাকালে তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লে৷ আমাদের উচিত ছিল তোমাকে বাধা দেওয়া৷ সেটা কেন দিইনি নিজেরাই বুঝতে পারছি না৷’

সুশীলদা বলল, ‘তুমি ঢুকে যাওয়ার পরেই দেখি দরজাটা নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গেল৷ তখন আমাদের টনক নড়েছে৷ আমরা দৌড়ে গেলাম৷ কিন্তু গেলে কী হবে, ধাক্কাধাক্কি করেও দেখি খোলে না৷ লাথি মেরেও দেখলাম, যে কে সেই৷’

চুপ করে রইলাম৷ কীসের মধ্যে গিয়ে পড়েছিলাম নিজেই জানি না৷

সুশীলদা বলল, ‘ভাবছি থানায় যাব কি না, দেখি একটু পরে সাইকেল নিয়ে দোকানি এসে হাজির৷ দেখে ধড়ে প্রাণ এল৷ শুনলাম তুমিই নাকি ওকে বলে এসেছিলে এমন কিছু একটা হতে পারে৷ দোকানি তাই ভাবছিল একবার দেখে যাবে কি না৷ সাইকেল নিয়ে বেরোবে, এমন সময় বুড়ি এসে হাজির৷ তার নাকি জ্বর এক্কেবারে সেরে গেছে৷ বুড়ির মন বলছে শাপমন্যির প্রায়শ্চিত্ত না করলে নাকি তার বুধনের আত্মা শান্তি পাবে না৷ জোরজার করে বুড়ি এসে হাজির৷ তারপর তো খেল দেখলেই৷ যে দরজা এতক্ষণ গায়ের জোরে খুলছিল না, বুড়ির দুই টোকাতেই কেমন অনায়াসে খুলে গেল৷’

ওদিকে তাকিয়ে দেখি বুড়ি সংগ্রামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আর বলছে, ‘আহা রে, ভোকের জ্বলনে দুধের ছানাটাকে কত কিছুই বৈলেছি৷ বাপ আমার, সনা আমার, জাদু আমার, ঘরে চ বাপ৷’ তাকিয়ে দেখি বুড়ির চোখেও জল৷

চোখ মুছলাম৷ এক মেয়ে হারানো বাপের দুঃখ ধুয়ে যাচ্ছে মরা ছেলেকে ফিরে পাওয়া এক ডাইনিবুড়ির ভালোবাসায়৷ ভালোবাসার কাছে আর কেই বা জিতেছে বলো৷ ভালোবাসাও তো একরকমের হেরে যাওয়াই৷

বলে নিজেই নিজেকে চুপ করালাম৷ ধুস, ডাইনি ফাইনি আবার কী! মা তো মা’ই হয়৷’

* * *

চাটুজ্জেমশাই থামতেই আমরা হইহই করে উঠলাম৷ ‘এটা কেমন হল? পুরো গল্পটা তো বললেন না৷’

চাটুজ্জেমশাই তো অবাক, ‘এই তো বললাম৷ আর বাকিটা রাখলাম কী?’

‘ওই লোকটা কে? মানে যার কাছে গিয়ে আপনারা বিপদে পড়েছিলেন?’

চাটুজ্জেমশাই চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ৷ তারপর বললেন, ‘পরে জেনেছিলাম বছর বিশেক আগে সত্যিই ওখানে একটা পরিবার ছিল৷ তাদের মেয়েটির বোধহয় হার্টের কিছু একটা গন্ডগোল ছিল৷ আর ছিল ভয়ানক শ্বাসকষ্ট, ক্রনিক অ্যাজমার পেশেন্ট৷ ওদিকে তখন ডাক্তার হাসপাতাল কিছুই ঠিকঠাক পাওয়া যেত না৷ এমন সময়ে এক শীতকালের বৃষ্টির রাতে মেয়েটি প্রবল শ্বাসকষ্টে হার্টফেল করে মারা যায়৷ মেয়ের মা সেই শোকে গলায় দড়ি দেয়৷ শোকে তাপে বাপের মাথা খারাপ হয়ে যায়৷ তার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ তারপর থেকে অনেকেই শীতের রাতে ওখানে বাপকে দেখেছে মেয়ের জন্য একটু ওষুধ চেয়ে বেড়াতে৷’

বিশু একটা ফোঁত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ গদাই বলল, ‘আর আপনার সেই বন্ধু, সংগ্রাম, সে এক্কেবারে ঠিক হয়ে গেল? তার হয়েছিলটা কী?

চাটুজ্জেমশাই বললেন, ‘আমাকে পরে বলেছিল যে রাতে ও লুচি তরকারি খেয়ে ফিরে আসে, সেই রাত থেকেই ও নাকি শুনতে পায় মাথার মধ্যে কে যেন সর্বক্ষণ একটানা কেঁদে চলেছে, ‘বাবা, ওষুধ এনে দে, ওষুধ এনে দে, করে৷ তারপর জ্বরের সময় একদিন টানা অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল৷ তারপর ওর আর কিছু মনে নেই৷ আমাদের অবশ্য দুইয়ে দুইয়ে চার করতে অসুবিধা হয়নি৷ খিদের জ্বালায় গ্রামের ছাগল মুরগি চুরি যে ওরই কাণ্ড সেটা বলাই বাহুল্য… সেটা অবশ্য আর চাউর হতে দিইনি৷ নইলে গ্রামের লোকেরা ওকে আস্ত রাখত না৷ ডাইনের কালাজাদুতে এসব করেছে, এসব বললে শুনতই না কেউ৷’

ভজা জিজ্ঞেস করল, ‘তিনি করেন কী এখন?’

‘এই ঘটনার পরপরই সে চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসে৷ তবে সে তার কুড়িয়ে পাওয়া মা’কে ভোলেনি৷ বুড়ি যদ্দিন বেঁচে ছিল, নিয়মিত দেখা করে আসত৷ টাকাপয়সা চাল-ডাল দিয়ে আসত৷ বলত কয়েক দিনের কষ্ট গেছে বটে৷ কিন্তু তার বদলে একটা আস্ত মা কুড়িয়ে পেলাম, সেটাই বা কম কী!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *