ঠাম্মা – মহাশ্বেতা দেবী

 ঠাম্মা – মহাশ্বেতা দেবী

সেবার জুন মাসে আমারা চারজন – মানে বাবা, মা, ভাই আর আমি চলে এলাম ভোপালে থাকতে। নতুন জায়গা কীরকম হবে, বাড়িটাও বা কেমন হবে তা নিয়ে সবার বেশ চিন্তাই ছিল। অতএব আমার আশি বছরের ঠাম্মাকে আমাদের পৈত্রিক বাড়িতেই রেখে আসা হল। ঠাম্মার সঙ্গে রইল ইতিমাসি। বাউলপাড়ায়, আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে থাকত আরও দুজন, আমার বাবার কাকিমা মানে আমার কাকাঠাম্মা আর তাঁর ছেলে, মানে আমার কাকা। আশেপাশে আরও অনেক আত্মীয়স্বজন ছিল, তাই ঠাম্মাকে আমরা বেশ নিৰ্ভয়েই রেখে এসেছিলাম বাউলপাড়ায়।

তবে ভোপালে এসে দেখা গেল ভয় পাওয়ার বিশেষ কোন কারণ নেই। জায়গা, বাড়ি সবই ভাল। খুব তাড়াতাড়িই আমরা সবাই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিলাম। অতএব সে বছরই পুজোর পর ঠাম্মাকে ট্রেনে করে নিয়ে আসা হল ভোপাল। তবে আনাটা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না কারণ আমার ঠাম্মা নড়তে চড়তে পারে না মোটেও। বাথরুম নিয়ে যাওয়া থেকে উঠে বসিয়ে দেওয়া, সবই করে ওই ইতিমাসি।

সে যাই হোক ঠাম্মার ভোপালে আসার ঠিক পরপর কোন এক ছুটির দিনে সন্ধেবেলা আমরা সপরিবারে পেছনের বাগানে বসে আড্ডা মারছিলাম। চা-বিস্কুট খাওয়া হচ্ছিল। তখন ইতিমাসিকে ধরা হল, তোমরা বাউলপাড়ায় এতদিন একসাথে কাটিয়ে এলে, তার কিছু গল্প বল না। প্রথমে তা-না-না-না করলেও অনেক ধরাধরি করবার পর শেষ পর্যন্ত ইতিমাসি ওদের বাউলপাড়ায় থাকাকালীন কিছু ঘটনা আমাদের গল্প করে বলল।

প্রথম ঘটনাটা ঠিক এইরকম। বাউলপাড়ায় থাকাকালীন ঠাম্মার সঙ্গে সব সময় থাকতে হত ইতিমাসিকে। আর যথারীতি, ঠাম্মার সমস্ত কাজও করতে হত ওই ইতিমাসিকেই। এইসব দেখে ঠাম্মা কিছুদিন ধরে মাসিকে তারঁ কিছু সম্পত্তি দান করবার কথা ভাবছিল। তাই জুলাই মাসের কোন এক অন্ধকার সন্ধেবেলায় ঠাম্মা ইতিমাসিকে তলব করল। সে তখন বাড়িতে ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা দিচ্ছিল।

ইদানিং কালে ঠাম্মার সঙ্গে ইতিমাসির একটু ঝগড়াই চলছিল। ঠাম্মার ধারণা বাড়ির বাইরে অষ্টমীর পুজো চলছে, কিন্তু ইতিমাসি ইচ্ছে করে তাঁকে বের করছে না। ফোনে বাবাকে এ ব্যাপারে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছে। তবে ঠাম্মার জড়িয়ে আসা কথা খুব একটা বোঝা যায় না, অতএব বাবাও কিছু বোঝেনি আর ঠাম্মা হাজার চেষ্টা করেও বাবাকে এই অন্যায়ের কথাটা বোঝাতে পারেনি। এই কারণেই হোক আর অন্য কারণেই হোক, মনে মনে একটু বিরক্তই লাগল ইতিমাসির। কাজের মধ্যে এমন চিল্লা-মিল্লি! কিন্তু বিরক্তি লাগলেও তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা দেওয়াটা শেষ করে ঠাম্মার ঘরে চলে এল সে। তবে ঘরে ঢুকে বিরক্তিটা কেমন যেন চলে গেল।

চেয়ারে বসেছিল ঠাম্মা। চোখ গোল গোল করে তাকিয়েছিল দরজার দিকে। ইতিমাসি ঠাম্মাকে এরকম ভাবে কখনও দেখেনি, অতএব খুব অবাক লাগল তার। ঠাম্মা হাতছানি দিয়ে ডাকল তাকে। ইতিমাসি দরজার কাছ থেকেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল? ধন-মনকে ফোন করবেন?’ ঠাম্মার কথায় ধন হচ্ছে আমার ভাই আর মন হচ্ছি আমি। বাউলপাড়ায় থাকাকালীন সেই সময়গুলোয় ঠাম্মা মাঝে মাঝেই ইতিমাসির কাছে জেদ ধরত ভোপালে আমাদের বাড়ির নম্বর ধরে দিতে, ‘ধন-মন’ – এর সঙ্গে কথা বলবে। তাই শুরুতেই ইতিমাসির সন্দেহ হল যে হয়তো ঠাম্মা সন্ধেবেলা আমাদেরই ফোন করতে চাইছে। কিন্তু এর উত্তরে ঠাম্মার দুদিকে মাথা নাড়া দেখে ইতিমাসির সন্দেহটা বাড়ল। এই ভর সন্ধেবেলা কী হল হঠাৎ?

আস্তে আস্তে ঠাম্মার দিকে এগিয়ে গেল ইতিমাসি। ঠাম্মা অস্বাভাবিক রকম গোলগোল চোখে তাকিয়ে ছিল। কাছে আসতেই ইশারায় আরও কাছে আসতে বলল ঠাম্মা। ইতিমসি ঝুঁকে মাথাটা ঠাম্মার মুখের কাছে আনল যাতে ঠাম্মার অস্পষ্ট কথাবার্তা ভালো করে শুনতে পাওয়া যায়। ঠাম্মা ফিসফিস করে বলল, ‘ইতি, শোন, তুই এই যে আমার জন্য এত কিছু করছিস, আমার সমস্ত কাজ-কর্ম করে দিচ্ছিস এটা দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি।”

ইতিমাসি অবাক হয়ে গেল। ঠাম্মা আগে কখনও এরকম ভাবে কথা বলেনি। সে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী বললেন?’ ঠাম্মা  তার গলার স্বর আরও নীচুতে নামিয়ে বলল, ‘বুঝলি এরা মানে আমার ছেলে-মেয়েরা কেউ তো আমায় দেখে না। তুই আমার সঙ্গে থাকিস, আমার সমস্ত কাজকর্ম করে দিস। তোকে আমি কিছু দিয়ে যেতে চাই।’  ইতিমাসি বোকার মতো প্রশ্ন করল, ‘কী দিতে চান আপনি?’ ঠাম্মা চোখ দুটো আরও বেশি গোল গোল করে বলল, ‘তোর সেবা-যত্নে খুশি হয়ে আমি তোকে এই বাড়িটা দান করে দিতে চাই। ইতিমাসি অবাক হয়ে ঠাম্মার দিকে তাকাল। দিকে।
এবার ঠাম্মা আরও আস্তে আস্তে ফিসফিস করে বলল, ‘যা খাতা পেন নিয়ে আয়, তোকে বাড়িটা উইল করে দিয়ে দি। তুই যা আমার জন্য করিস, এটা তারই পুরস্কার।’

ইতিমাসি এর মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝল না কিন্তু ঠাম্মার ইশারায় তাড়া দেওয়া দেখে তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে খাতা আর পেন নিয়ে এল। ঠাম্মার হাতে পেনটা ধরিয়ে দিয়ে তার সামনে খাতাটার একটা সাদা পাতা মেলে ধরল ইতিমাসি। ঠাম্মা পেনটা হাতের মধ্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিক করে ধরল, তার পর সেটাকে নিয়ে খাতার ওপর লেখা শুরু করল। ঠাম্মার হাত কাঁপছিল। অনেকদিন পর আবার লেখা। ইতিমাসি একবার খাতাটা ঘুরিয়ে দেখতে যাচ্ছিল ঠাম্মা কী উইল করছে, কিন্তু ঠাম্মা সেটা হতে দিলে তো। ইতিমাসিকে কিছুতেই দেখতে দিল না, কী ধরণের উইল লিখছে।

বেশ অনেক্ষণ ধরে কিছু একটা লেখার পর ঠাম্মা হঠাৎ লেখা থামাল। ইতিমাসি লেখা শেষ হয়ে গেছে ভেবে খাতাটা টেনে নিজের দিকে আনতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠাম্মা সেটা করতে দিল না। আবার নিচে কিছু একটা লেখা শুরু করল। দ্বিতীয় বার অবশ্য লিখতে বেশি সময় লাগল না ঠাম্মার। মিনিট খানেকের মধ্যেই লেখা শেষ করে খাতাটা নিজে থেকেই এগিয়ে দিল ইতিমাসির দিকে। ইতিমাসির এবার আবার সন্দেহ হতে লাগল। কিছুক্ষণ আগেও ঠাম্মার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর, সিরিয়াস ধরনের ছিল, তাহলে এখন এরকম মুচকি মুচকি হাসছে কেন এখন? ইতিমাসি আর দ্বিরুক্তি না করে খাতাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল কী লিখেছে ঠান্মা। খাতার সাদা কাগজে কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় লেখা ছিল,

“সেবা যত্নে খুশি হয়ে আমি আমার সঙ্গী ও সেবিকা ইতি সরকারকে আমার বাউলপাড়ার বাড়িটি দান করলাম।”

ইতিমাসি এক ঝলক ঠাম্মার দিকে তাকাল। ঠাম্মার মুখে একটা অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। ইতিমাসি আবার মুখ ফিরিয়ে উইলটাকে দেখতে লাগল। আগেরবার যেটা দেখতে পায়নি, পাতার নিচে লেখা সেই এক লাইন এবার ইতিমাসির চোখে পড়ল। ঠাম্মা বিশেষভাবে ছোট ছোট করে লিখেছে এই এক লাইন,

‘ধন-মনের বাড়ি, আমি দেওয়ার কে?’

ঠাম্মার হাসিটা আর আগের মতো মুচকি মুচকি নেই। তার বদলে রয়েছে একটা বিশাল বড় অন্যরকম হাসি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *