টীকা ও অনুলেখ
অধ্যায় : তিন
‘কালাঞ্জু’ হল সুপ্রাচীন তামিল দেশীয় মুদ্রা। তামিল লেখমালায় প্রায়শই এর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন পাণ্ড্যরাজাদের লেখমালায় এই দ্রাবিড় সংস্কৃতির মুদ্রা কালাঞ্জুকে আর্য সংস্কৃতির ‘কৃষ্ণকাচ’-র সমতুল বলা হয়েছে। সিংহলে আবার কালাঞ্জুকে বলা হত ‘কাহাপণ’। কোথাও-বা আবার এরই অন্য নাম ‘নিষ্ক’। বহির্ভারতীয়দের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রাচীন যুগ থেকে অবশ্য যে-মুদ্রা ব্যবহার করা হত, তার নাম ‘দ্রম্ম’। এ এল ব্যাসমের মতে এই ‘দ্রম্ম’শব্দটি এসেছে গ্রিক ‘ড্রাকমে’থেকে। পরে এই ‘দ্রম্ম’ থেকেই ‘দাম’শব্দটি এসেছে। ড্রাকমে>দ্রম্ম> দাম। এই উপন্যাসের তৃতীয় অধ্যায়ে নূপুরজোড়া মানাইক্কন তাই কিনেছেন ভারতীয় ব্যবসায়ী মণিকগুনের কাছ থেকে কালাঞ্জুর মূল্যে। আবার তেরো অধ্যায়ে মিশরীয় আমেনহোটেপের অভীষ্ট পুথিটির বিনিময়মূল্য প্রসঙ্গে তাই আমি ‘দ্রম্ম’শব্দটি ব্যবহার করেছি। আর শিলল্পদিকরম-এ নর্তকী মাধবীকে দেওয়া রাজার পারিতোষিক প্রসঙ্গে স্বয়ং ইলাঙ্গো আডিগল ‘কালাঞ্জু’শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সতেরো অধ্যায়ে আমিও তাই বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ‘কালাঞ্জু’ শব্দটি ব্যবহার করেছি।
অধ্যায় : ছয়
ক. সেযুগের কিছু কিছু পাখি ও মাছের অধুনাচলিত নাম: পাখি
ক্রৌঞ্চ—কোঁচবক। মদ্গু—পানকৌড়ি।বলাহক—বক। শ্যেন—বাজপাখি। কঙ্ক—হাড়গিলে।
মাছ
সহস্রদংষ্ট্র—বোয়াল, গড়ুক— গড়ুই, উলুপি—চ্যাং, শফরী–পুঁটি, রোহিত—রুই, কলক— শোল, চিলিচিম—ইচামাছ, জলাণুক—শোলপোনা, গ্রাহ—হাঙর।
খ. শিলপদিকরম-এর ২৭ অধ্যায়ের ৮৪-১০২ শ্লোক থেকে প্রমাণিত হয়, কোভালনের পিতা মাশাত্তুবান বৌদ্ধ ও কন্নকীর পিতা মানাইক্কন জৈন সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। অথচ শিলল্পদিকরম-এর ভাষ্যকার আডিয়ারক্কুনাল্লার মহাকাব্যের ১৬ অধ্যায়ের ১৮-২৮ শ্লোকের ভাষ্য করতে গিয়ে কোভালনকে জৈন সম্প্রদায়ভুক্ত দেখিয়েছেন। অনুবাদক অ্যালেন ড্যানিয়েলো পর্যন্ত অনুবাদকালে প্রভাবিত হয়েছেন আডিয়ারকুনাল্লারের দ্বারা। কিন্তু আডিয়ারকুনাল্লারের এই অনুমানের সঙ্গে একমত হতে পারেননি পণ্ডিত ভি আর রামচন্দ্র দীক্ষিতর। রামচন্দ্র দীক্ষিতর-এর মতটিই (অর্থাৎ কোভালনের পিতৃকুল বৌদ্ধ ও কন্নকীর পিতৃকুল জৈন) আমার ২৭ অধ্যায়ের আলোকে যথাযথ মনে হয়েছে। আডিয়ারকুনাল্লার পঞ্চদশ শতকের মানুষ। শিলল্পদিকরম দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধে রচিত হয়েছে।
অধ্যায় : নয়
এই অধ্যায়ে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সংবাদীভ্রম ও বিসংবাদীভ্রমের ধারণা প্রয়োগ করেছি। বিদ্যারণ্যমুনি রচিত ‘পঞ্চদশী’-গ্রন্থের ‘ধ্যানদীপ’-শীৰ্ষক নবম অধ্যায়ে আছে—
“দীপপ্রভামণিভ্রান্তিঃ বিসংবাদিভ্রমঃ স্মৃতঃ।
মণিপ্রভামণিভ্রান্তিঃ সংবাদিভ্রমঃ উচ্যতে।। ৬।।”
অস্যার্থ—দীপপ্রভায় যে-মণিভ্রম, তা নিষ্ফল, একে বিসংবাদীভ্রম বলা হয়। আর মণিপ্রভাতে যে-মণিভ্রম, তা ফলপ্রদ, একে সংবাদীভ্রম বলা হয় ।
অধ্যায় তেরো ও সতেরো
অধ্যায় তিনের টীকা দ্রষ্টব্য।
অধ্যায় : আঠেরো
সঙ্গম-যুগের প্রাচীন তামিল সাহিত্য প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। অকাম (subjective) ও পূরম (objective)। মানুষের মনোগত বিষয়—যথা কাম, প্রেম, ঈর্ষা, মিলনেচ্ছা, সাধ, সাধনা—এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত সাহিত্যকে ‘অকাম’ বলা হয়। আর মনোনিরপেক্ষ বস্তুমুখী তথ্য—যথা যুদ্ধ, রাজ্যজয়, উপপ্লব, অনুষ্ঠান—এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত সাহিত্যকে ‘পূরম’ বলা হয়। প্রাচীন তামিল সাহিত্যে অকাম-কেন্দ্রিক উপাদানই সিংহভাগ দখল করে আছে। এজন্য সঙ্গম-যুগের সুপ্রাচীন তামিল সাহিত্যসম্ভারকে চরিত্রগতভাবে মুখ্যত মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ভুক্ত করা যেতে পারে।
অধ্যায় : কুড়ি
ক. তামিল মহাকাব্য অনুসারে সমগ্র তামিল দেশ পাঁচটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। নদীবক্ষা মারুদম, পার্বত্যপ্রদেশ কুরিঞ্জি, সমুদ্রতীরবর্তী নেইডাল, ঊষরভূমি পালাই ও ঘন অরণ্যভূমি মুল্লাই। এই মুল্লাই অঞ্চলের ভূমিপুত্র একদল আদিবাসী, পশুপালন যাদের জীবিকা। সায়াহ্নে এদের বাঁশির সুর ভেসে আসত পুষ্পহার নগরীতে—ইলাঙ্গো আডিগল একথা জানিয়েছেন। ফুলের উপর এসে বসা মৌমাছির ঝাঁককে ইলাঙ্গো আডিগল ‘কুরুম্বু’-নামে অভিহিত করেছেন। শব্দটি আমি সেখান থেকেই নিয়েছি। এই শব্দের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম, প্রায়-সমোচ্চারিত এমন আরেকটি শব্দ তামিল ভাষায় আছে। সেই শব্দটি হল—কুরুম্বর’। ‘কুরুম্বর’ বলতে তামিল দেশের এক প্রাচীন উপজাতিদের বোঝাত, যারা অতর্কিতে বনভূমি থেকে বেরিয়ে এসে রাজসৈন্যের উপর হামলা চালিয়ে লুঠপাট করে চলে যেত। এখানে ফুলের উপর এসে বসা দস্যু মৌমাছিদের ‘কুরুম্বু’ অভিধায় অভিহিত করে ইলাঙ্গো আডিগল এই উপমার একটা অন্যতর সামাজিক তাৎপর্যও তৈরি করেছেন, দেখা যাচ্ছে।
খ. বিলাসিনী বারবধূদের ঘুমোনোর আগে ধুনো জ্বালানোর দৃশ্যটিও আমি ইলাঙ্গোর রচনা থেকেই নিলাম। সেখানে ‘প্রতীচীর আয়িরচূর্ণের সঙ্গে প্রাচী পর্বতমালার আগরচূর্ণ’ মেশানোর কথা আছে। আগর আমাদের চেনা, কিন্তু ‘আয়ির’ বস্তুটি কী? পণ্ডিত আডিয়াক্কুনাল্লারের মতে ‘আয়ির’ হল এক ধরনের সুগন্ধি মিছরির গুঁড়ো, যা পশ্চিমের যবনদেশ থেকে ভারতে আমদানি করা হত। কিন্তু পণ্ডিত ভি আর রামচন্দ্র দীক্ষিতর তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারেননি। আমারও মনে হয়েছে, এই মিছরি বা তালমিছরি নিয়ে এতটা ভাবা মোটেই ঠিক হবে না এখানে। প্রতীচী মানে এখানে পশ্চিমদেশ নয়, পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। এবং ‘আয়ির’ বলতে কর্পূর বা লোবানজাতীয় কোনো শৈলবৃক্ষজাত সুগন্ধি বলেই মনে হয়েছে আমার ।
অধ্যায় : তেইশ
এই অধ্যায়ে ‘ধর্মশাস্তা’-র কথা বারবার এসেছে। প্রশ্ন হল, কে এই ধর্মশাস্তা? কোন দেবতার কথা বলা হচ্ছে এখানে? বহু অগ্রগণ্য তামিল পণ্ডিত এরূপ নির্ণয় করেছেন যে, ‘ধর্মশাস্তা’ এখানে হরিহরপুত্র আইয়াপ্পা। পৌরাণিক কাহিনি-অনুসারে বিষ্ণু নারীরূপ ধারণ করেন, তখন তাঁর নাম হয় ‘মোহিনী’। মোহিনী ও শিবের মিলনে উদ্ভূত হন আইয়াপ্পা। আইয়াপ্পার অন্য এক নাম ‘ধর্মশাস্তা’।
কিন্তু এই কাব্যে ঘটনা যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তার থেকে ‘ধর্মশাস্তা’ বলতে যেন বুদ্ধকে বোঝানো হচ্ছে বলে মনে হয়। ‘ধর্মশাস্তা’ ভগবান বুদ্ধেরও এক নাম। ‘শাস্তা’ (তামিল : শাত্তাণ) শব্দের অর্থ লোকগুরু বা আচার্য। এখানে মৃত শিশু কোলে নিয়ে রোরুদ্যমানা জননীর বিভিন্ন স্থানে শিশুটির প্রাণভিক্ষা করে বেড়ানোর দৃশ্য সহজেই কিসা গৌতমীর উপাখ্যান মনে করিয়ে দেয়। এ আখ্যানে বলা হয়েছে, ধর্মশাস্তা ইন্দ্রজালকুশল। বুদ্ধকেও অনুরাগী প্রসেনঞ্জিত ও বিরুদ্ধবাদী দেবদত্ত বহু ঋদ্ধিসম্পন্ন মায়াবী অলৌকিক পুরুষ বলে চিহ্নিত করতেন।
অনেকে বলেন, আইয়াপ্পা কাল্ট বৌদ্ধ ধর্মাদর্শেরই বিবর্তিত রূপ। আইয়াপ্পা ও বুদ্ধ উভয়কেই শিলল্পদিকরম রচনার কালে অবৈদিক ধরা হত। অন্যরা বলেন, বুদ্ধের সঙ্গে আইয়াপ্পার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সমাজের নীচু তলার মানুষদের দ্বারা পূজিত ‘আয়াণার’ দেবতাই পরবর্তী কালে ‘আইয়াপ্পা’-র রূপ ধরেছেন। কিন্তু তাই যদি হত, তাহলে ইলাঙ্গো আডিগালের মূল রচনাতেও নগর-বহির্বর্তী ‘আয়াণার’ দেবতার মন্দিরের কথা (পুরমপাণ-আইয়াণ-বালকোট্টম্) ধর্মশাস্তার মন্দিরের থেকে পৃথকভাবে উল্লিখিত হয়েছে কেন?
ইলাঙ্গো আডিগল অবশ্য দেবান্দীর স্বামী মন্দিরে ধর্মশাস্তার মূর্তিতে মিলিয়ে গিয়েছিলেন, এমন লিখেছেন। এদিকে আবার এও লিখেছেন যে, স্বামীর অদর্শনের পর দেবান্দী অন্যদের কাছে বলতেন যে, তাঁর স্বামী তীর্থ পর্যটনে গিয়েছেন। সেটা যেন দেবান্দীর দিক থেকে স্বামীর অন্তর্হিত হওয়ার ব্যাপারটা আড়াল করার একটা ছুতো। উভয় দিক থেকে তুলনা করে, দেবান্দীর স্বামী প্রব্রজ্যা নিয়েছিলেন বলেই মনে হয়। এই প্রব্রজ্যা নেওয়ার ব্যাপারটাও আবার আমাদের, ধর্মশাস্তা যে আসলে বুদ্ধ, সেই ভাবনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
যেহেতু ‘ধর্মশাস্তা’ কে, তার উত্তরে নানা মুনির নানা মত, তাই এই ব্যাপারে যদিও আমি কোনো যুক্তিসঙ্গত স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না, তবু ইলাঙ্গোর রচনা পড়ে ‘ধর্মশাস্তা’ অভিধার আড়ালে বুদ্ধই যেন আভাসিত হচ্ছেন বলে আমার মনে হয়েছে। এই অধ্যায়ে ইলাঙ্গো আডিগল বর্ণিত ডাকিনীর আবির্ভাব আমাদের মনে পরবর্তী কালের বৌদ্ধ বজ্রযান মতানুসারীদের দ্বারা সমুপাসিত বজ্রডাকিনীদের কথাও মনে করিয়ে দেয় ।
অধ্যায় : চব্বিশ
ক. যবন ব্যাপারীদের কথা লিখেছেন ইলাঙ্গো আডিগল। অনেকের মতে ‘যবন’ শব্দটি ‘আইওনিয়ান’-শব্দ থেকে উদ্ভূত। এখানেও বর্ণনার রীতি থেকে যবন ব্যাপারী বলতে গ্রিক ব্যাপারীদের কথাই বলা হয়েছে, এমন প্রতীত হয় ।
খ. ইলাঙ্গো আডিগল নৃত্যগীতবিদ্যায় অতিশয় সুপণ্ডিত। শিলল্পদিকরম মহাকাব্যে নানা স্থানে ইলাঙ্গো ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্যশাস্ত্রে তাঁর অনুপুঙ্খ জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। ইলাঙ্গোর রচনা দক্ষিণ ভারতে নৃত্য ও গীতবিদ্যার বিকাশ অতি প্রাচীন যুগ থেকে কীভাবে হয়েছিল, সে-ব্যাপারে গবেষণার অতি উত্তম সহায়ক হতে পারে। এখানে তিনি উৎসবমুখর জনতার বর্ণনা দিতে গিয়ে দুই প্রকার লোকনৃত্য বা ফোক ডান্সের উল্লেখ করেছেন—তুণাঙ্গাই ও কুরাভাই। কোমরে হাত রেখে একা একা যে-নাচ, তাকে বলা হত তুণাঙ্গাই। আর হাতে হাত রেখে যে-বৃন্দগীতনৃত্য বা গ্রুপ ডান্স, তাকে বলা হত কুরাভাই ।
অধ্যায় : পঁচিশ
সমুদ্রতীরের এই বাতিঘর আমার কল্পনা নয়। স্বয়ং ইলাঙ্গো আডিগল তাঁর মূল রচনায় বাতিঘরের কথা লিখেছেন। আমরা যে অনেকে ভাবি, বাতিঘর বা লাইটহাউস আমাদের দেশের সমুদ্রতটে অনেক পরে নির্মিত হয়, সেই ভাবনা নিতান্তই অমূলক। সেই সুদূর দ্বিতীয় শতকের ‘শিলপদিকরম’মহাকাব্যে বাতিঘরের এই উল্লেখ প্রাচীন ভারতে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ-ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
অধ্যায় : ছাব্বিশ
ক. ‘শিলল্পদিকরম’ মহাকাব্যে নানা স্থানে প্রাচীন ভারতে প্রচলিত লিখন-সামগ্রী বা রাইটিং মেটিরিয়াল সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। প্রধানত, এই তিনটি বস্তু লিখন-সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হত : ১. তালপাতা, ২. বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি স্টাইলাস ও ৩. গালা এবং আঠা মিশিয়ে তৈরি কালি। তালপাতা মাপমতো কেটে, হলুদ-জলে ভিজিয়ে লেখালেখির উপযুক্ত করে তোলা হত । বাঁশ বা বেতের কঞ্চির প্রান্ত ছুঁচালো করে কেটে তৈরি হত লেখনী। আর কালি হিসেবে গালা ও আঠা মিশিয়ে তৈরি করা হত এক ধরনের লেই, যা দিয়ে লিখবার পরে লেখা খুব দ্রুত শুকিয়ে যায় ও স্থায়ী হয়। ইলাঙ্গো আডিগল কখনও আবার প্রণয়িনীর হাতে লেখনী হিসেবে তুলে দিয়েছেন লম্বা বোঁটাযুক্ত ফুল। পুষ্পবৃত্ত দিয়ে প্রেমপত্র লেখার ভাবনাটি ইলাঙ্গোর কবি-কল্পনাও হতে পারে।
খ. কোভালনের পত্রোত্তরে তখনকার তামিলনাড়ুতে প্রচলিত দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যশিল্পের আট প্রকার রূপভেদ ব্যবহার করেছি। এই ব্যবহার ইলাঙ্গো আডিগলকে অনুসরণ করেই। এই আট প্রকার নৃত্যভেদ হল ক. কাকুডুবারি—এটি একেবারে নাচের শুরুতে পরিবেশিত হত । যাকে বলা যেতে পারে—প্রিলিউড। গৃহস্থ বধূরা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে যে-নৃত্য পরিবেশন করতেন, তার প্রিলিউডকে বলা হত—কুরাবাই। আর নটীরা নৃত্যানুষ্ঠানে যে-নৃত্য দিয়ে নাচ আরম্ভ করতেন, তাকে বলা হত কাণ্ডুবারি।
খ. কাণবারি—এই ধরনের নাচে নর্তকী মঞ্চের সামনে-পেছনে এগিয়ে ও পিছিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করতেন।
গ. উলবারি—এই নৃত্যে নৃত্যশিল্পী নাচের মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে দেখাতেন।
ঘ. পুরবারি—উপেক্ষা প্রদর্শনের ভাব এই নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হত।
ঙ. লিবারি—অভিমানাহত নায়িকার ভাব ফুটিয়ে তোলা হত এই নাচের মাধ্যমে।
চ. তেরচ্চিবারি—বিপ্রলব্ধা নায়িকা যেন তাঁর মনোবেদনা সখীদের কাছে তুলে ধরছেন, এমন একটা ভাব এই ধরনের নৃত্যের বিষয়।
ছ. কাটচিবারি—অপরিসীম বেদনায় ভেঙে পড়ার ভাব প্রকাশিত হত এই নৃত্যে। জ. এডুভুক্কোলবারি—এই নাচে প্রিয়বিরহে মূর্ছা যাওয়ার অভিনয় করতেন নৃত্যশিল্পী। তাঁর সখীরা তাঁকে মূর্ছা থেকে জাগিয়ে তুলতেন নাচের শেষে।
অধ্যায় : আঠাশ
ক. তামিল কবিতায় বারংবার ব্যবহৃত ফুলগুলি নেইথাল, পালাই, মুল্লাই, কুরুঞ্জি। এই ফুলগুলির বৈজ্ঞানিক নাম হল যথাক্রমে Nymphaea nouchali, Wrightia tinctoria, Jasminum auriculatum, Strobilanthus kunthianus । এই সব ফুলের নানা আঞ্চলিক নাম থাকায় এদের পরিচয় পেতে গিয়ে পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাই বৈজ্ঞানিক নামের দ্বারা এদের চিহ্নিত করা হল ।
খ. ড. স্বামীনাথ আয়ারের মতে, দেবান্দী-কথিত সূর্যকুণ্ড ও সোমকুণ্ড আসলে তিরুভেনকাডুতে অবস্থিত সূর্যতীর্থ ও সোমতীর্থ। বর্তমানে কামদেব বা মন্মথদেবের মন্দির কোথাও নেই, কিন্তু কামদেব-কেন্দ্রিক উৎসব এখনও তামিলনাড়ুতে অল্পবিস্তর প্রচলিত আছে।
অধ্যায় : উনত্রিশ
পুরোনো কয়েকটি শব্দ ও তার অর্থ:
খনিত্র—মাটি খোঁড়ার শাবলজাতীয় যন্ত্র। চকমকি বা অগ্নিমন্থ—এমন পাথর, যা ঘষে আগুন জ্বালানো হত। হণ্ডী—হাঁড়ি। দবী—হাতা বা চাটু ।
অধ্যায় : ত্রিশ
ক. পুরোনো কয়েকটি শব্দ ও তার অর্থ:
বলভী—গৃহের ঊর্ধ্বস্থিত বক্রকাষ্ঠ। কপোতপালী-পায়রা পালনের জন্য ঘরের উপরের দিকে কাঠের তৈরি ছোটো ছোটো খোপ। সংস্তর-শয্যাবস্ত্র। প্রাবরণ—উত্তরীয় । স্থূলশাট—মোটা কাপড়। নিচোল – পাছুড়ি বস্ত্রের নাম। পেষণী–চাল প্রভৃতি গুঁড়ো করার যন্ত্র। পর্যঙ্ক—খাট বা পালঙ্ক। উৎপীঠিকা—ছোটো ডেস্ক-জাতীয় কিছু। বিপণিকোশ—দোকানের ক্যাশবাক্স বা ওই জাতীয় কোনো অর্থ সঞ্চয়ের স্থান।
খ. নিতান্ত রসালাপের মধ্যেই উঠে আসা গোডার্ড-কথিত এই কথাটি——a story should have a beginning, a middle and an end, but not necessarily in that order’-প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু এর সম্ভাব্য উৎস হচ্ছে দ্য ডেইলি নর্থ-ওয়েস্টার্ন পত্রিকার
৩ অক্টোবর, ১৯৬৯-এ প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার—ইন্টারভিউ উইথ গোডার্ড : ‘But Mr Godard-doesn’t every film have a beginning, a middle and an end?’ the puzzled critic demanded of elusive Jean Luc. ‘Yes,’ replied the cinema’s most outrageous rebel, ‘but not necessarily in that order.’
অধ্যায় : একত্রিশ
তামিল ভাষায় ‘কাদম্’ হল দূরত্বের একক । এক কাদম্ প্রায় দশ মাইলের সমতুল।
অধ্যায় : তেত্রিশ
জৈনদের প্রধান দুই সম্প্রদায়—দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর। দিগম্বর সম্প্রদায়ের অনুসারীরা তীর্থংকর মহাবীরের প্রাক্-সন্ন্যাস জীবনে বিবাহের কথা স্বীকার করেন না। পক্ষান্তরে শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের অনুসারীরা বলেন, মহাবীর অল্প বয়সে যশোদা নাম্নী কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন ও তাঁদের প্রিয়দর্শনা নামে এক কন্যা ছিল। আলোচ্য অধ্যায়ে আর্যিকা কাভুন্দি শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের সাধ্বী।
অধ্যায় : চৌত্রিশ
ধানঝাড়ার সময়ে যে-লোকগান গাওয়া হয়, তাকে ‘মুহাভি’বলে। আর ‘কিনাই’ হল চামড়ার তৈরি ছোটো বাদ্যযন্ত্র।
অধ্যায় : আটত্রিশ
এই অধ্যায়ে শিকারী মারাভার জনগোষ্ঠীর দ্বারা যে-দেবীপূজার বর্ণনা এসেছে, তা আমার স্বকপোলকল্পিত নয়। এক্ষেত্রে আমি ইলাঙ্গো আডিগলের মূল রচনার কাছে ঋণী । এই দেবীমূর্তি, পূজা, দেবীর আবেশ বা ভর ও তৎসংশ্লিষ্ট যে-স্তোত্রাদির বর্ণনা আমরা শিলল্পদিকরম-এ পাই, তা নিতান্তই বিস্ময়কর। আইয়াই দেবীর অবয়বে দুর্গা ও কালীরূপের মিশ্রণ লক্ষণীয়। বলিদানের স্তোত্রটি, আমি যা অংশত কাব্যানুবাদ করেছি, তার অন্তিম স্তবকে কৃষ্ণকথা ও কালীকথা কেমন অদ্ভুতভাবে মিশে গেছে। অবাক হয়ে ভাবি, আমাদের দেশে এই দেবী-কাল্ট স্থানকাল নিরপেক্ষভাবে কতখানি ব্যাপক! আজ থেকে আঠেরোশো বছর আগে তামিলনাড়ুর প্রত্যন্ত বনাচ্ছন্ন প্রান্তে তথাকথিত আর্য-সংস্কৃতি থেকে বহু দূরে অবস্থিত ভূমিজ অরণ্যপুত্রদের দ্বারা এই দেবী পূজিত হয়েছেন। সমন্বয়ের ভাবনাও এদেশে কত প্রাচীন! এই অধ্যায়ে ভূমিজ মানুষদের ভাষা আমাকে নিজের মতো করে কল্পনায় গড়ে নিতে হয়েছে; আমাদের রাঢ় বঙ্গের ভাষার সঙ্গে তা খানিকটা মিলবে আবার অনেকটাই মিলবে না—এমনই আমার অভিপ্রেত ছিল।
অধ্যায় : উনচল্লিশ
ক. সঙ্গম যুগে তামিল ভূখণ্ডে ব্রাহ্মণদের দুই প্রধান শ্রেণীবিভাগ ছিল। প্রথম, বৈদিক ব্রাহ্মণ—যাঁরা বেদপাঠ, বেদাধ্যাপনা, যজন, যাজন করতেন। দ্বিতীয়, লৌকিক ব্রাহ্মণ—যাঁরা স্মৃতিনির্দিষ্ট ব্রাহ্মণোচিত কর্ম ছেড়ে অন্য প্রকার কর্মের দ্বারা জীবিকা-নির্বাহ করতেন। ব্রাহ্মণোচিত কর্ম পরিত্যাগ করায় এই দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্রাহ্মণরা সমাজে খানিকটা ব্রাত্যরূপে পরিগণিত হতেন। যদিও উপবীত ধারণে এঁদের অধিকার ছিল। অম্বনাভর ব্রাহ্মণেরা বেদপাঠ ছেড়ে সঙ্গীতচর্চা করায় তাঁরাও এই লৌকিক ব্রাহ্মণরূপেই পরিচিত ছিলেন। এখানে লক্ষণীয়, সমাজে শুধু ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের মধ্যেই যে উঁচুনীচু ভেদ ছিল, তা নয়। এমনকি ব্রাহ্মণদের মধ্যেও বেদাধিকারের ভিত্তিতে উঁচুনীচু ভেদ ছিল।
খ. বাদ্যযন্ত্র চারপ্রকার—তত্, শুষির, ঘন ও আনদ্ধ—এই চার শ্রেণী। তারযুক্ত যন্ত্র যা, তা তত্যন্ত্র, যেমন—সেতার, বীণা ইত্যাদি। ফুঁ-দিয়ে যা বাজানো হয়, তা শুষির, যেমন—বাঁশি, সানাই, শিঙা ইত্যাদি। ধাতুনির্মিত যন্ত্র যা, তা ঘন, যেমন—কাঁসর, করতাল ইত্যাদি। আর চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি যন্ত্র হল আনদ্ধ, যেমন— ঢোল, ঢাক বা তবলা।
অধ্যায় : বিয়াল্লিশ
ক. ‘অন্তরাপণ’শব্দের অর্থ বাজার। আজ থেকে আঠেরোশো বছর আগের পটভূমিকায় ‘বাজার ‘ শব্দটি নিতান্তই বেমানান। এই কারণে এই উপন্যাসে কোথাও ‘বাজার’ শব্দটি ব্যবহার করিনি, পরিবর্তে ‘অন্তরাপণ’ ব্যবহার করেছি।
খ. এ উপন্যাসে বারবার নানা রত্নের উল্লেখ আছে। সেই রত্নগুলোর ইংরেজি নাম আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু তাদের উত্তর-ভারতীয় নামেই আমাকে উল্লেখ করতে হয়েছে উপন্যাসের মধ্যে। তামিল নাম ব্যবহার করলে বাঙালি পাঠক ওদের চিনতে পারতেন না । এখানে সেই সব রত্নের ভারতীয় নাম ও তাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ পাশাপাশি দেওয়া গেল—
পদ্মরাগমণি বা চুনি:Ruby; নীলকান্তমণি: Sapphire; স্ফটিক: Crystal; পুষ্পরাগমণি বা পোখরাজ: Topaz ; প্রবাল:Coral; গোমেদ: Onyx; মুক্তা: Pearl; হীরক: Diamond; পান্না: Emerald
এ ছাড়া জাতরূপ, কিড়িচ্চিরাই, আড়কম্, জাম্বুনাদম্ হল তামিল ভাষায় সোনার চতুর্বিধ অবস্থা বা প্রকারভেদ।
গ. এই উপন্যাসে বারবার রাজা ও রাজকীয় জীবনের কথা এসেছে। আলোচ্য সময়কালে প্রধান তিন রাজা দক্ষিণ ভারতে রাজত্ব করছেন। চোলবংশীয় রাজা কারিক্কাল, চেরবংশের রাজা শেঙ্গুখুবান ও পাণ্ড্যবংশীয় রাজা নেডুঞ্জেলিয়ণ। এঁরা প্রত্যেকেই ঐতিহাসিক চরিত্র। এঁদের সকলের কথাই উপন্যাসে এসেছে। কারিক্কাল ও নেডুঞ্জেলিয়ণ তো উপন্যাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবেই উপস্থিত আছেন। নেডুঞ্জেলিয়ণ-এর পট্টমহিষী কোপ্পারুনদেবী। কোপ্পারুনদেবী সম্ভবত কোনো নাম নয়। শব্দটির অর্থই হল পাটরানি ।
অধ্যায় : চুয়াল্লিশ
ক. এর আগে শিকারী জনজাতি মারাভারদের দ্বারা পূজিতা দেবীর নাম আইয়াই বলা হয়েছিল। এখন আবার মূল কাহিনিতে আশ্রয়দাত্রী মাদারি-র কন্যার নামও আইয়াই পাওয়া যাচ্ছে। উপাস্য দেবদেবীর নামে সন্তানের নামকরণ—আমাদের দেশের অতি প্রাচীন প্রথা । তাহলে গোপালক সম্প্রদায়ের উপাস্যাও এই এক আইয়াই দেবী। অরণ্য বা নগর নির্বিশেষে সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই আইয়াই দেবীর পূজা প্রচলিত ছিল, প্রমাণ হয়।
খ. মাদারিকন্যা আইয়াইয়ের মুখে ইলাঙ্গো আডিগলও এই শ্রীকৃষ্ণ-সম্পর্কিত সংলাপ বসিয়েছেন। আমি ওই সংলাপটুকু মূল রচনা থেকেই নিয়েছি। মূল আখ্যানের অন্যান্য সংলাপ ও রীতিনীতি থেকে একথা অনুমান করা যায়, গোপালিকা মাদারির পরিবার ধর্মবিশ্বাসে জৈন । কিন্তু তাদের সংলাপে এই কৃষ্ণকথার উল্লেখ থেকে আবার নিঃসংশয়িতভাবে প্রমাণিত হয়, তখনও ভারতে, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে পৌরাণিক হিন্দুধর্মের সঙ্গে অবৈদিক জৈনধর্মের কোনো সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি হয়নি। এই সব বিভাজন এল অনেক পরে, যখন এদেশের মানুষ ‘বোধ’-এর থেকে ‘বাদ’-এর দিকে ক্রমশ সরে যেতে আরম্ভ করল।
অধ্যায় : আটচল্লিশ
তামিল কালভুনূল বা সংস্কৃত স্তেয়শাস্ত্র নামে আলাদা একটি শাস্ত্রই আছে, যেখানে চুরি করার অষ্টবিধ উপায় বর্ণিত আছে।
ক. মন্ত্র—মন্ত্র পাঠ করে চোর অদৃশ্য হয়ে যেতে পারত। সেই অদৃশ্য অবস্থায় চুরি করত।
খ. দৈব—অপদেবতাবিশেষের সহায়তা। যেখানে কোনো অপদেবতা চোরের অনুরোধে কোনো বস্তু চুরি করে চোরকে এনে দিত, কেউ দেখতে পেত না।
গ. মাদক—মাদকদ্রব্য খাইয়ে গৃহস্থকে জড়বৎ ফেলে রেখে চোর চুরি করে পালিয়ে যেত।
ঘ. লক্ষণ—শুভ লক্ষণ দেখে চোর চুরি করতে বেরিয়ে সফল হত।
ঙ. ছল—ঐন্দ্রজালিক উপায়। এই উপায়ের সাহায্যে মুহূর্তে চুরি হয়ে যেত, কেউ টেরটিও পেত না।
চ. স্থান—চুরির উপযুক্ত স্থান নির্ণয়ের কৌশল।
ছ. কাল – চুরির উপযুক্ত সময় নিরূপণের বিদ্যা।
জ. যন্ত্র—চুরি করার বিভিন্ন যন্ত্র। যেমন, সিঁধ কাটার যন্ত্র ইত্যাদি। ড. স্বামীনাথন আয়ার শিলল্পদিকরম প্রসঙ্গে স্তেয়শাস্ত্রের এই ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন।
অধ্যায় : একান্ন
এই অধ্যায়ে দৌবারিকের সংলাপে দেবীপ্রসঙ্গ আমার কল্পনা নয়। এ সংলাপটি আমি মূল শিলপ্পদিকরম থেকেই নিয়েছি। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, সেই সময়কার তামিলনাড়ুতে সমাজের উঁচু তলার মানুষদের মধ্যে বিষ্ণু, শিব, বুদ্ধ, মহাবীর, আইয়াপ্পা প্রভৃতি পুরুষ দেবতারা অধিক অর্চিত হলেও সাধারণ মানুষের চেতনায় দেবীপূজা অধিকাধিক প্রচলিত ছিল। আইয়াই, কোরাভাই, অনঙ্গু, দারুকাসুরমর্দিনী, কালিকা, দুর্গা প্রভৃতি নানা নামে ও রূপে সাধারণ মানুষদের দ্বারা দেবী সমর্চিতা হতেন। এর আগে মারাভারদের আখ্যান ও এখানে দৌবারিকের এই সংলাপ তারই সাক্ষ্য প্রদান করছে।