টিয়া রহস্য

টিয়া রহস্য

এক

দীপক দিন কয়েক বাইরে ছিল। দুপুরে বোলপুরে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরেই সে সোজা চলল বঙ্গবার্তার অফিসে। বঙ্গবার্তার সে একজন রিপোর্টার।

ভবানী প্রেসের এক ধারে সাপ্তাহিক বঙ্গবার্তার অফিস। শ্রীনিকেতন রোডের ওপর লম্বা ঘরখানায় কালিঝুলি মাখা কয়েকজন কর্মী প্রেসের কাজে ব্যস্ত। রাস্তা থেকে প্রেসের বারান্দায় পা দিয়েই দীপক থমকে গেল। একী। খোলা বারান্দায় ছাদের ছকে বাঁধা দড়িতে ঝুলছে একটা পাখির খাঁচা। তার ভিতর দাঁড়ে বসে একটি বড়সড় টিয়া পাখি। খাঁচার ভিতর ছোট ছোট বাটিতে রয়েছে ছোলা আর জল।

এ পাখিটা কার? এখানে কেন বাইরে বারান্দায়। যাওয়ার আগে তো দেখিনি?

খাসা দেখতে পাখিটা। চকচকে সবুজ গা। লাল বাঁকা ঠোঁট। ঘাড় বেঁকিয়ে টেরিয়ে দেখছে দীপককে। হঠাৎ পাখিট; খুব দ্রুত খানিক তীক্ষ্ণ নাকি সুরে উচ্চারণ করে উঠল— ‘কে কে কে’—অনেকবার।

অমনি প্রেসের পিয়ন হারু বারান্দায় উঁকি মারল।

দীপক হারুকে জিজ্ঞেস করল, ‘পাখিটা কার?’

হারু আঙুল দেখাল বঙ্গবার্তার অফিস ঘরের দিকে। ওখানে বসেন ভবানী প্রেসের মালিক এবং সাপ্তাহিক বঙ্গবার্তা কাগজের মালিক ও সম্পাদক শ্রীকুঞ্জবিহারী মাইতি।

কুঞ্জবাবুর যে পাখির শখ আছে জানত না দীপক। তার ওপর আবার প্রেসের বারান্দায় যেন সবাইকে দেখাতে রাখা হয়েছে পাখিটা। দীপক প্রেসের ভিতর ঢুকে ঘরের এক কোণে কাঠের পার্টিশান ঘেরা সম্পাদক মশায়ের চেম্বারের সুইং-ডোর ঠেলল।

মধ্যবয়সি গাট্টাগোট্টা কুঞ্জবাবু তাঁর ছোট্ট কামরায় চেয়ারে বসে টেবিলে ঝুঁকে প্রুফ দেখছিলেন। চশমার ওপর দিয়ে গোল গোল রক্তাভ চোখের দৃষ্টি হেনে হেঁড়ে গলায় দীপকের উদ্দেশে আল গর্জন ছাড়লেন— ‘এই যে ইয়ংম্যান, শ্রীমান দীপক রায়, তা অ্যাদ্দিন ডুব মারা হয়েছিল কোথায়?’

দীপক বুঝল যে তার পদবিসুদ্ধ গোটা নাম ধরে ডাকার অর্থ, সম্পাদকমশায়ের মেজাজ খিঁচড়ে আছে। সে চেয়ার টেনে সামনে বসে হাসি মুখে বলল, ‘মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। অনেক দিন পর গিয়েছি। আসতে দিতে চায় না।’ 

‘হুম।’

‘পাখিটা কোত্থেকে পেলেন?’ কৌতূহলী দীপক প্রশ্ন করে ফেলে।

‘পেলাম মানে?’ ফেটে পড়েন কুঞ্জবিহারী, উনি আমার ঘাড়ে চেপে বসেছেন।

উপকার করতে গিয়ে আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়েছি হে। এখন না পারছি ফেলতে, না পারছি রাখতে।’

‘কী ব্যাপার?’ দীপক উদগ্রীব।

হাতের পেনটা খটাস্ করে টেবিলে রেখে, চেয়ারে গা এলিয়ে কুঞ্জবিহারী জানালেন, ‘আর বলো কেন। পাঁচ দিন আগের ব্যাপার। ভোরে ছাদে উঠে পায়চারি করছি, কোত্থেকে ওই টিয়াটা উড়ে এসে বদল কার্নিশে। ভয় পাচ্ছে না। ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছে আমায়, আবার কক্ কক্ করে কী সব বলছে। মজা লাগল। তারপর দেখি ওর গায়ে একটা পেতলের রিং পরানো। মনে হল কারও পোষা পাখি পালিয়ে এসেছে।

আগের দিন ছাদে ডাল শুকোতে দিয়েছিল। তাই কিছু পড়েছিল। পাখিটা নেমে তাই খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল। বুঝলাম, ওর খিদে পেয়েছে। নিচে গিয়ে কিছু চাল আর গম এনে দেখি পাখিটা তখনও রয়েছে। ছড়িয়ে দিতেই টপাটপ চাল গম সাবড়ে দিল। তখন হাঁদে মোড়ায় বসে ডাকলাম, আঃ আঃ। গুটি গুটি পাখিটা এসে হাজির হল পায়ের কাছে।

টিয়াটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। কিচ্ছু বলল না। একটু ভয় করছিল বটে। যা খড়্গের মতো ঠোঁট। ঠোক্কর দিলেই গেছি। তারপর পাখিটা আর সঙ্গ ছাড়ে না।

ছাদ থেকে নেমে দোতলার বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। বেরুব প্রেসে। পাখিটা উড়ে এসে ফের বসল, সামনের রেলিঙে। পাঁউরুটির টুকরো দিলাম। দিব্যি খেল। গটগট করে পায়চারি করতে লাগল বারান্দার রেলিং ধরে।

তখন আমার মাথায় একটা ভাবনা জাগল, পাখিটাকে বেড়ালে না ধরে। আমাদের পাড়ায় গুচ্ছের বেড়াল ঘোরে। কার পোষা পাখি? তাই এমনি মানুষ ঘেঁষা স্বভাব। বাড়িতে একটা পুরনো পাখির খাঁচা ছিল। তাইতে পুরে দিলাম পাখিটাকে। বাটিতে জল আর খাবার দিলাম। তারপর খাঁচা বুলিয়ে দিলাম বারান্দায়।

গিন্নি আপত্তি করেছিল। আমার স্ত্রী পশু-পাখি পুষতে চায় না। বললাম, দুপুরে ফিরে ওটার ব্যবস্থা করব। কারও পোষা পাখি। পালিয়ে এসেছে। মালিককে খুঁজতে হবে।

তা দুপুরে খেতে ফিরে দেখি গিন্নি ফায়ার। নাকি পাখিটা সমানে— ‘কে কে’ আবার মাঝে মাঝে—‘পুঁটি পুঁটি’ বলে চেঁচিয়েছে।

তা আমার গিন্নির ছেলেবেলায় ডাকনাম ছিল পুঁটি। তাতেই খেপেছে বেশি। পত্রপাঠ পাখি বিদায় করতে হুকুম দিল।

তখন পাখিটা নিয়ে এলাম প্রেসে। খাঁচাসুদ্ধু বাইরে বারান্দায় ঝুলিয়ে রেখেছি যদি মালিকের চোখে পড়ে। বঙ্গবার্তায় পরপর দু’দিন বিজ্ঞাপনও দিয়েছি বর্ণনা দিয়ে। কিন্তু চার দিন হয়ে গেল কেউ আসেনি টিরাটা ক্লেম করতে। আচ্ছা ঝঞ্ঝাটে পড়েছি।’

দীপক বলল, ‘আহা ঝঞ্ঝাটের কী? এখানে রইল না হয় ক’দিন। দুটো খেতে দেওয়া বই তো নয়। বেশ দেখতে পাখিটা।’

‘নয় ঝঞ্ঝাট?’ তেড়েফুড়ে ওঠেন কুঞ্জবাবু, ‘রাতে তো এখানে রাখা যায় না। কেউ থাকে না প্রেসে। তাই হারুকে বলে ঠিক করেছি, ও পাখিটা বাড়ি নিয়ে যায় প্রেস বন্ধর সময়। ছোলা ছাতু, লঙ্কা—টিয়া পাখির এইসব খাবার ব্যবস্থা হারুই করে। তাই রোজ ওকে পাঁচ টাকা করে দিতে হয়। ডেইলি গচ্চা যাচ্ছে টাকাটা।’

‘ডেইলি পাঁচ কেন?’ দীপক অবাক হয়ে বলে।

‘কে জানে? হারুই হিসাব করে বলল। তাই দিচ্ছি। কতটা নিজে মারে গড নোজ। উপায় কী? এক এক সময় ভাবি চুলোয় যাক। দিই ছেড়ে। আবার মায়া হয়—পোষা পাখি। তেমন সতর্ক তো নয়। বেড়ালে খাবে কিংবা দুষ্টু লোকে ধরে বাজারে বিক্রি করে দেবে। কেমন হাতে পড়বে? যত্ন করবে কিনা কে জানে?’ গুম মেরে গেলেন কুঞ্জবিহারী।

দীপক কুঞ্জবাবুর এই আত্মত্যাগের প্রশংসা করার আগেই তিনি ফের ফোঁস করে ওঠেন—‘আর এক ঝামেলা হয়েছে। জনে জনে জবাব দিতে দিতে জেরবার হয়ে গেলুম।’

কুঞ্জবিহারী তাঁর ঝাঁটা গোঁফ ফুলিয়ে চোখমুখ ঘুরিয়ে নকল করেন— ‘পাখিটা কবে কিনলেন? কোত্থেকে? কথা বলে? কী খায়? হেন তেন। ছাপার কাজে যারা আসছে তাদের প্রশ্ন তো আছেই। পথ-চলতি চেনা লোকও ঢুকছে এইসব প্রশ্ন করতে। কাজকর্মের ডিস্টারবেন্স। যাক্‌গে, আর দুটো দিন দেখব। তারপর যেখানে হয় বিদায় করব পাখিটা।’

দীপক বলল, ‘ও নিয়ে ভাববেন না। বিদায় করলে আমায় দেবেন। আমি বাড়ি নিয়ে যাব। রাখব যদ্দিন না মালিকের খোঁজ পাওয়া যায়।’

গম্ভীর বদনে কুঞ্জবিহারী জানালেন, ‘শুনে নিশ্চিন্ত হলুম। তা চার্জ কি ওই পাঁচ টাকা?’

‘এক পয়সাও লাগবে না।’ দীপক গরম হয়ে জানায়।

‘ভেরি ভেরি গুড।’ একগাল হেসে কুঞ্জবিহারী টেবিল থেকে ফের প্রুফ তুলে নিয়ে বললেন, ‘সন্ধ্যায় এসো একবার। কিছু কাজের কথা আছে।’

দীপক উঠছে, এমন সময় পিয়ন হারু এসে বলল, ‘এক বৈরাগীবাবু, ওই পাখিটা নিয়ে কী জানি বলচেন।’

‘বৈরাগীবাবু! সে আবার কী?’ ধমকে ওঠেন কুঞ্জবিহারী।

‘আজ্ঞে তাই তো ঠাওর হল। গেরুয়া পরা। গলায় কণ্ঠী। কপালে তিলক। হাতে একতারা।’

‘কী বলছেন?’ জিজ্ঞেস করে দীপক।

‘আজ্ঞে বলচেন, উনি পাখিটা দেখেছেন কোন বাড়িতে।’

‘বটে বটে। নিয়ে এসো তাকে।’ নির্দেশ দেন কুঞ্জবিহারী।

হারু ভুল বলেনি। যে মানুষটি আবির্ভূত হলেন তিনি নিঃসন্দেহে একজন বৈরাগী। মাঝবয়সি প্রসন্ন হাসি হাসি মুখ। তিনি সম্পাদক কুঞ্জবিহারীর ঘরে ঢুকে নমস্কার জানালেন। ‘বসুন।’ কুঞ্জবিহারীর ইঙ্গিতে দীপকের পাশের চেয়ারটায় বসলেন বৈরাগী।

‘আপনার নাম?’ জানতে চান কুঞ্জবাবু।

‘আজ্ঞে পরান বৈরাগী।’

‘আপনি বাইরের পাখিটা দেখেছেন আগে?’

‘আজ্ঞে তাই তো মনে হচ্ছে। তাই কেন, আমার অনুমান ঠিকই। অমনি পায়ে আংটি পরা। অমনি গড়ল। পাখিটা এখানে এল কেমনে তাই ভাবছিলেম অবাক হয়ে। তবে খাঁচাট

‘কোথায় দেখেছিলেন পাখিটা?’ জিজ্ঞেস করে দীপক।

‘সুরুলের পুব পাড়ায়। বলাই সরকারের বাড়ি। একতলার ঝোলানো থাকত খাঁচাসুদ্ধু এই পাখিটা। হপ্তা দুই আগেও দেখেছি। ও পাড়ায় গান গাইতে যাই যে মাঝে মাঝে।’

‘পাখিটা কার? বলাই সরকারের?’ দীপক জিজ্ঞেস করে।

‘তা ঠিক জানি না। মনে হয় নিচের তলায় একটা ছেলে থাকত তার। ওরই ঘরের সামনে বারান্দায় ঝুলত খাঁচাটা।’ বললেন পরান বৈরাগী।

‘আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ।’ কুঞ্জবাবু হাতজোড় করে বিদায় জানান বৈরাগীকে, ‘এই পাখির আসল মালিককে খুঁজছি। খবরটা পেরে খুব উপকার হল।’

পরাগ বৈরাগী চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুঞ্জবিহারী টেবিল চাপড়ে বলে উঠলেন, ‘থাক বাবা, অ্যাদ্দিনে হদিশ মিলল। ওহে দীপক, এখুনি চলে যাও দিকি বলাই সরকারের বাড়ি। পাখিটার গতি করো। হ্যাঁ, মালিককে টুকে দিতে পার যে পাখিটাকে খাওয়ানোর খরচ গোটা কুড়ি টাকা আমার পকেট থেকে গিয়েছে।’

দুই

বলাই সরকারের বাড়ি খুঁজে বের করল দীপক।

ছোট পুরনো দোতলা বাড়ি। নিচের তলা একদম বন্ধ। বাইরে বারান্দায় লাগোয়া ঘরখানা তালা মারা।

‘ও বলাইবাবু। সরকারমশাই’ —অনেক ডাকাডাকির পর দোতলার জানালার একজন শুকনো চেহারার বৃদ্ধ উঁকি দিলেন। রিক্তি মেশানো খনখনে গলায় প্রশ্ন করা হল—‘কে?’

ঊর্ধ্বমুখ দীপক বলল, ‘আজ্ঞে আপনার বাড়ি থেকে একটা টিয়া পাখি হারিয়েছে কি?’

‘তা বলতে পাচ্ছি না।’ বৃদ্ধ নীরস গলায় উত্তর দেন।

‘আপনাদের একটা টিয়া পাখি ছিল তো?’

‘হ্যাঁ। আমার নয় নগেনের। নিচে যে থাকে। আমার ভাড়াটে।’

‘তা নগেনবাবুর ঘর তো দেখছি বন্ধ। কখন আসবেন?’

‘তা বলতে পাচ্ছি না’, বৃদ্ধের কণ্ঠে বিরক্তি উপচে পড়ে, ‘লিখে গিয়েছে আসতে ক’দিন দেরি হবে।’

‘উনি কি একাই থাকেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘উনি বুঝি বাইরে গিয়েছেন?’

‘হুঁ’

‘কোথায়?’

‘তা বলতে পাচ্ছি না।’

এইভাবে কথা চালানো কষ্টকর। দীপক বিনীতভাবে বলল, ‘আজ্ঞে একবার যদি নিচে আসেন। আমি বঙ্গবার্তার রিপোর্টার।’

‘রিপোর্টার! তা আমায় কী দরকার?’ বৃদ্ধের ভুরু কোঁচকায়।

‘আজ্ঞে ওই টিয়াটা নিয়ে একটু কথা বলব, আর কিছু নয়। আমরা একটা টিয়া পাখি পেয়েছি। একজন বলল, সেটা নাকি আপনার বাড়িতে দেখেছে। তাই আপনার কাছে জানতে এসেছি।’

‘আসচি। দাঁড়ান।’ বৃদ্ধ অদৃশ্য হলেন।

একটু বাদে নিচের তলার একটা দরজা খুলে বলাইবাবু বেরোলেন। পরনে লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি চাপানো। হয়তো ঘুম ভেঙে উঠে আসতে হয়েছে বলে বেজার মুখ।

দীপক জিজ্ঞেস করল, ‘নগেনবাবু কি বাইরে গিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, তাই তো লিখে গিয়েছে। চারদিন আগে ভোরে উঠে দেখি ওই দরজার নিচ দিয়ে গলানো নগেনের একটা চিরকুট। তাতে লেখা—ক’দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। জরুরি কাজ। কবে ফিরব ঠিক নেই। ব্যস, আর তার ঘরেও তালা দেওয়া।’

‘নগেনবাবু কখন ঘরে ফিরেছিলেন সেদিন?’

‘কখন ফিরেছিল জানি না। তবে অনেক রাতে। আমি শুয়ে পড়ার পর। নইলে ঠিক দরজা খোলার শব্দ পেতুম।’

‘নগেনবাবু পাখিটা কোথায় রাখতেন?’

‘দিনের বেলায় ওই বারান্দায় ঝুলত খাঁচায়। রাতে ঘরে নগেনবাবু আগেও তো বাইরে গিয়েছেন?’

‘গিয়েছে। খুব কম। দু রাক্তির। গিয়েই পরদিন ফিরেছে।’

‘তখন পাখিটা কোথায় থাকত?’

বোঝা যাচ্ছিল যে দীপকের জেরায় বৃদ্ধের মেজাজ গরম হচ্ছে। ভ্রূকুটি বাড়ছে। ভ্যাটকানো মুখে জবাব দিলেন, ‘শুনেচি কোথাও রেখে যেত। কার কাছে বলতে পাচ্ছি না।’

মহা মুশকিল। হঠাৎ একটা আইডিয়া খেলে দীপকের মাথায়।

বলল, ‘আপনি পাখিটা দেখলে চিনতে পারবেন সেটা নগেনের কিনা?’

‘তা পারব।’

‘তবে দাদা একটি অনুরোধ। আমার সঙ্গে একবার রিকশায় গিয়ে চট করে দেখে আসবেন ওটা নগেনের পাখি কিনা?

আপনাকে নিয়ে যাব আবার পৌঁছেও দেব। এই যাব আর আসব। বড়জোর আধঘণ্টা। আমাদের সম্পাদক কুঞ্জবাবু পাখিটা নিয়ে ভারি মুশকিলে পড়ে গিয়েছেন। উনিই পাখিটা রেখেছেন কিনা। কী করবেন? ওঁর বাড়ি ছেড়ে নড়ছিল না টিয়াটা। পাছে বেড়ালে ধরে তাই খাঁচায় পুরে রেখেছেন। বোঝা যায় পোষা পাখি। মালিককে খোঁজ করছে। যদি ওটা নগেনবাবুর হয়, ক’দিন না হয় অপেক্ষা করি। নয়তো আরও খোঁজ করতে হবে। প্লিজ। ভবানী প্রেসে আছে পাখিটা।’

‘ও, কুঞ্জ মাইতির কাছে। চলুন। মনে হল যে বৃদ্ধ কুঞ্জবাবুকে চেনেন বা নাম শুনেছেন।’

পথে রিকশায় যেতে যেতে বলাই সরকার একটা নতুন খবর দিলেন—নাকি নগেন যাওয়ার আগের দিন রাত সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ একজন অচেনা লোক এসে নগেনের খোঁজ করে। তখনও অবশ্য নগেন বাড়ি ফেরেনি। নগেন কখন বাড়ি থাকে? কোথায় কাজ করে? এই সব জিজ্ঞেস করেছিল।

‘কত বয়স হবে নগেনবাবুর?’ দীপক জানতে চায়।

‘এই আপনারই বয়সি! বছর পঁচিশ-তিরিশ।’

‘কদ্দিন আছেন আপনার বাড়িতে?’

‘এই বছরখানেক।’

‘লোকাল লোক?’

‘না।’

‘কোথায় বাড়ি ওঁর?’

‘মগরা। হুগলি ডিস্ট্রিক্ট।’

ভবানী প্রেসে খাঁচায় পোরা পাখিটি মনোযোগ দিয়ে দেখে বলাইবাবু ঘোষণা করলেন-’হুঁ, নগেনের পাখিই বটে।’

ফিরে যেতে যেতে দীপক জিজ্ঞেস করল বলাইবাবুকে, ‘পাখিটা কদ্দিন এনেছেন নগেনবাবু?’

‘তা মাস ছয়েক।’

‘পাখিটাকে যত্নআত্তি করতেন?’

‘তা করত।’

কতগুলো চিন্তা চকিতে খেলে যায় দীপকের মাথায়। রাতে তো পোষা পাখি খাঁচা বা ঘর ছেড়ে বাইরে যায় না। মানে যারা নিশাচর নয়। তবে কি হাত ফসকে পালায়নি? পাখিটাকে ইচ্ছে করে বের করে দেওয়া হয়েছিল? কিন্তু কেন? কী এমন জরুরি দরকার? এভাবে ছেড়ে গেলে প্রিয় পাখিটা যে মারা পড়তে পারে তা না জানার কথা নয়। তবু গিয়েছে। কাউকে দিয়ে যাওয়ার ফুরসত অবধি মেলেনি। সেই রাতে যে লোকটা ডাকতে এসেছিল তার সঙ্গে এভাবে নগেনের উধাও হওয়ার যোগ আছে কি?

দীপক জিজ্ঞেস করে বলাইবাবুকে, ‘আচ্ছা যে লোকটি সেই রাতে নগেনকে ডাকতে আসে সে কি ফের এসেছিল?’

‘তা বলতে পাচ্ছি না।’ জবাব দেন বলাইবাবু, ‘মানে আমি আর কিছু জানি না।’

‘নগেনবাবু কি রাত করে ফেরেন?’

‘মাঝে মাঝে রাত করে। একা লোক, আড্ডা-ফাড্ডা দিয়ে আসে।’

‘উনি করেন কী?’

‘রেডিও মেকানিক। তারা সাউন্ড নামে দোকানটায় চাকরি করে। ঘরে প্রাইভেট কাজও করে। এমনি বেশ ভালো ছেলে। কোনো গোলমাল ছিল না।’

‘আপনি এঁকে ভাড়া দিলেন কীভাবে,’ জানতে চায় দীপক, ‘পরিচিত কেউ নিয়ে এসেছিল।’

‘আলবাৎ। রেফারেন্স ছাড়া উটকো লোককে আমি ঘর ভাড়া দিই না। নিচুপট্টির শিবু ঘোষ মানে হরেন ঘোষের বেটা, রেডিও টিভির মেকানিক, সেই নিয়ে এসেছিল নগেনকে। একখানা ঘর চাই। বিয়ে থা করেনি। একা থাকবে। তারা সাউন্ডে চাকরি পেয়েছে। গ্যারান্টি দিল, ছেলে ভালো। ওর সঙ্গে কলকাতায় রেডিওর কাজ শিখতে গিয়ে চেনা। তাই দিলাম ভাড়া। তা অ্যাদ্দিন ছিল, গড়বড় কিছু দেখিনি।’

বলাই সরকারের বাড়ি পৌঁছে দীপক ফট করে বলাইবাবুকে বলে বসল, ‘পাখিটা আপনার কাছে রাখুন না। নগেনবাবু ফিরলে দেবেন।’

বলাইবাবু আঁতকে উঠলেন, ‘খেপেছেন? বুড়ো-বুড়ি থাকি। পাখির ঝামেলা কে নেবে?’

‘আচ্ছা সে যাহোক ব্যবস্থা করা যাবে। নগেনবাবু ফিরলেই তাঁকে বলবেন যে পাখিটা আমাদের কাছে রয়েছে।’

বলাইবাবু বাড়ি ঢুকে গেলেন।

দীপক কিন্তু তখুনি বাড়ি ফিরল না। তার রিপোর্টার মন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। হঠাৎ নগেনের এমন চলে যাওয়ার কারণটা জানা চাই। সেই লোকটার সঙ্গে কি গেল কোথাও? বাড়ি না অন্য কোথাও? দেখি এ পাড়াতেই একটু খোঁজখবর করা যাক। দীপক গুটিগুটি সামনের মোড়ে দোকানটার দিকে যায়। ওখানে চা-টার সঙ্গে দুপুরে রাতে ভাত-রুটিও মেলে। তাই রাত নটা সাড়ে নটা অবধি দোকানটা খোলা থাকে। ওই দোকানের ছোকরা কাজের লোক রামু তার পরিচিত। বেশ চালাক-চতুর ছেলে। রামু দোকানেই থাকে রাতে।

তিন

রামু বলল, ‘হ্যাঁ। একজন অচেনা লোক মঙ্গলবার রাতে খোঁজ করেছিল নগেনদার। মজা কি জানেন, তার একটু আগেই নগেনদা এই দোকানে ছিল। চা খাচ্ছিল। নগেনদা চলে যাওয়ার এই মিনিট পনেরো বদে সেই লোকটা এল। খোঁজ করল —নগেনবাবু কখন ঘরে ফেরে রাতে।’

‘বললাম, এই তো ছিল নগেনদা। রাতে যদি এখানে খায়, আসবে নটা নাগাদ।’

‘লোকটা জিজ্ঞেস করল, আর কোথায় খায়? বললাম, কখনও বোলপুর হোটেলে, কখনও এখানে। মানে মুখ বদলায়।’

‘আমি লক্ষ করেচি। রাত সাড়ে ন’টা অবধি লোকটা রাস্তায় একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে। নগেনদা কিন্তু ফেরেনি। তারপর দেখিনি লোকটাকে।’

দীপক জিজ্ঞেস করে, ‘নগেনবাবু কখন ফিরেছে?’

‘তা দেখিনি। তবে দশটার আগে নয়। ততক্ষণ আমি কাজ কচ্ছিলুম বাইরে। গেলে ঠিক দেখতাম। ওর ঘরের বারান্দায় পাখির খাঁচাটাও ঝুলছিল ততক্ষণ।’

‘নগেনবাবু কখন চলে গিয়েছে দেখেছ?’

রামু বলল, ‘নাঃ। তবে রাত থাকতেই গিয়েছে। আমি ভোরে উঠে আগুন দিই, তার আগেই। তখন গেলে চোখে পড়ত। তারপর থেকেই তো দেখচি নগেনদার ঘর বন্ধ।’

দীপক জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা সেই লোকটা আর নগেনবাবুর খোঁজ নিতে এসেছিল?’

‘নাঃ।’

‘কেমন দেখতে লোকটাকে?’

‘ভদ্দরলোক। বেশ লম্বা চওড়া। রং কালো। দাড়ি গোঁফ আছে: খুব ঘন কালো চুল। লম্বা জুলপি। তবে কেমন জানি চোয়াড়ে টাইপ। জামা প্যান্ট পরেছিল।’

‘কত বয়েস?’

‘এই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে।’

দীপক একটা টাকা বের করে রামুর হাতে দিয়ে বলল—‘রাখ এটা। বকালাম, তার, বকশিশ।’

রামু টাকাটা তৎক্ষণাৎ পকেটে ভরে একগাল হেসে বলল—‘রিপোর্টারদাদা আর কী খবর চাই?’

দীপক বলল, ‘ওই লোকটা এলে বা নগেন ফিরলেই আমায় খবর দিবি, বুঝলি।

‘জরুর। মিলেগা।’ ফাজিল রামু সেলাম জানিয়ে উত্তর দেয়।

টিয়া পাখিটার গতি করার চাইতে অন্য চিন্তাই পেয়ে বসল দীপককে। নগেনের রহস্যময় অন্তর্ধান। সে এবার ঢু মারল নিচুপট্টির শিবু ঘোষের কাছে।

শিবু ঘোষ বাড়িতে ছিল না। সুরধ্বনি নামে রেডিও টিভির দোকানে সে কাজ করে। সেখানে পাওয়া গেল তাকে।

শিবু ঘোষ যুবকটি ভালো মানুষ টাইপের। দীপককে সে নামে চেনে। টিয়া পাখির ব্যাপারটা জানিয়ে নগেনের পরিচয় জানতে চাইলে সে বলল –‘ওর সঙ্গে একটা ইলেকট্রনিক্স স্কুলে কাজ শিখেছিলাম কলকাতায়। তখনই খুব ভাব হয়েছিল। ভালো ছেলে ছিল। পাশ করে ও কলকাতায় একটা দোকানে চাকরি নিল। আমি চলে এলাম বোলপুরে। তারপর নগেনের সঙ্গে দেখা হত খুব কম।

বছর তিনেক বাদে, একবার কলকাতায় গিয়ে শুনি এক দুঃসংবাদ। নগেন নাকি ডাকাতির কেসে ফেঁসে গিয়ে জেলে রয়েছে। মামলা চলছে। কেন ও এমন কাজ করল ভেবে পেলাম না। ও নিজে নাকি ডাকাতি করেনি। কিন্তু ও যে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল প্রমাণ হয়েছে। আর ওর ঘরে নাকি ডাকাতির মাল পাওয়া গিয়েছে। কেসটা হলকলকাতায় একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে তিন-চারজন লোক কায়দা করে দুপুরে ঢুকে বাড়ির কর্তা-গিন্নিকে মারধর করে প্রচুর টাকা আর সোনাদানা নিয়ে পালায়।

নগেন একটু শৌখিন ছিল বটে। আর ওর একটা সাধ ছিল নিজের দোকান করবে রেডিও-টিভির। হয়তো সেই টাকা জোগাড়ের লোভেই। তবে ও রাজসাক্ষী হওয়ায় সাজা বেশি হয়নি। মাত্র এক বছর।

এরপর নগেনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হল, বছর খানেক আগে বর্ধমান স্টেশনে। নগেন বলল যে, ও বর্ধমানে একটা রেডিওর দোকানে কাজ করছে। খুব লজ্জিত ও কুণ্ঠিত মনে হল তাকে। অকপটে স্বীকার করল যে, সে বদসঙ্গে মিশেছিল। তার মতিভ্রম হয়েছিল। বলল যে, আর কখনও সে এমন ভুল করবে না। কথায় কথায় বলল, বর্ধমানের দোকানটায় তার মাইনে বড্ড কম। তাই অন্য কোথাও কাজ খুঁজছে। আমার সাহায্য চাইল—কোনো কাজের খোঁজ আছে কিনা কিছু বেশি মাইনেতে। তবে অনুরোধ করল, সে যে জেল খেটেছে যেন সেটা ফাঁস না করি। বর্ধমানেও বলেনি। জানাজানি হলে তার চাকরি থাকবে না। তাহলে তার বাড়ির লোক না খেয়ে মরবে। কারণ বাড়িতে সেই একমাত্র রোজগেরে। বিধবা মা আর অবিবাহিত বোন আছে দেশে। নগেনই তাদের একমাত্র ভরসা।

করুণা হল। তাই ওকে বোলপুরে তারা সাউন্ডে একটা কাজ জুটিয়ে দিলাম খানিক বেশি মাইনেতে। খবর পেয়েছিলাম, ও বেশ ভালোই কাজ করছে। তবে ইদানীং আমি বড্ড ব্যস্ত থাকতাম, তাই ওর সঙ্গে দেখা হত কদাচিৎ। কী জানি কেন এমন হঠাৎ গেল ওভাবে।’ শিবু ঘোষ ব্যাপারটায় বেশ অবাক।

‘ওঁর বাড়ির ঠিকানা জানেন?’ জিজ্ঞেস করে দীপক।

‘ঠিকানা? তা জানি। মগরা। হুগলি ডিস্ট্রিক্ট। স্টেশনের কাছে ওঁদের বাড়ি। মায়ের নাম বিভাবতী দেবী।

‘আপনি কি ওর বাড়িতে চিঠি দেবেন?’

‘তাই দেব ভাবছি।’ বলল দীপক। ‘হয়তো কোনো জরুরি কাজে হঠাৎ বাড়ি যেতে হয়েছে। পাখিটা নিয়েই হয়েছে সমস্যা।

শিবু বলল, ‘হ্যাঁ, ওর খুব পাখির শখ। কলকাতায় একজোড়া মুনিয়া পুষেছিল।’

দীপকের ভাবনা অন্য খাতে বইতে শুরু করে।

একজন অচেনা লোক যে সেদিন খোঁজ করেছিল নগেনের সেটা শিবুকে বলার প্রয়োজন বোধ করেনি সে। নগেনের পূর্ব ইতিহাস এবং আগন্তুকের বর্ণনা মিলিয়ে তার মনে হল যে, কোনো কুকর্মের ধান্দায় কি নগেন হঠাৎ বোলপুর ছেড়েছে? ওই কালো লম্বা দাড়ি-গোঁফওয়ালা লোকটার সঙ্গে। অসৎ সঙ্গে একবার জড়িয়ে পড়লে তার প্রভাব এড়ানো কঠিন।

সন্ধ্যায় দীপক ভবানী প্রেসে ফিরে রিপোর্ট করতে সম্পাদক কুঞ্জবিহারী গোমড়া মুখে বললেন, ‘তাহলে? সেই নগেন না খগেন কবে ফিরবে, সেই অপেক্ষায় থাকতে হবে? ধুততেরি তার চেয়ে বরং—’

দীপক আশ্বাস দেয়, ‘ভাববেন না। আমি পাখিটা নিয়ে যাচ্ছি। আমার দুই ভাইপো-ভাইঝি ওকে মহা আদরে রাখবে। তবে মুশকিল হল—’ দীপক চুপ করে যেতেই কুঞ্জবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন— ‘কেন, আবার মুশকিলটা কীসের?’

‘মানে ছোটন ঝুমা পরে পাখিটা ফেরত দিতে চাইবে কিনা সন্দেহ। দুটোই যা পশু-পাখির ভক্ত।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কুঞ্জবাবু জানালেন, ‘সেটা তোমার ব্যাপার। আমার এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। মালিককে পটাতে পারলে রাখবে পাখিটা।’

খাঁচাসুদ্ধ টিয়া নিয়ে দীপক সন্ধ্যায় বাড়ি ঢুকল।

যা ভেবেছিল তাই। পনেরো বছরের ভাইপো ছোটন আর তেরো বছরের ভাইঝি ঝুমা একটু দমে গেল বটে, তবে তখুনি পরিচর্যায় লেগে গেল পাখিটার। ঝুমার একটা মন্তব্য শোনা গেল, ‘দেখিস দাদা, ওর মালিক আর ফিরছে না।’

দীপকের মাথায় তখন প্ল্যান খেলছে-কাল-পরশুই যাব মগরা। টিয়ার মালিক উধাও হওয়ার রহস্যটা দিব্যি জটিল মনে হচ্ছে।

দীপক তারা সাউন্ডে খবর নিয়ে জানল যে একটা কালো লম্বা প্যান্ট-শার্ট পরা লোক গত মঙ্গলবার রাত আটটা নাগাদ নগেনের খোঁজ করেছিল। তবে নগেন তার আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর তো ফেরেইনি। না বলে কয়ে এভাবে ছুটি নেওয়া। ওর মাইনে কাটা যাবে।

চার

মগরা স্টেশনের কাছে নগেন দাসের মা বিভাবতী দেবীর বাড়ি খুঁজে পেতে খুব অসুবিধা হল না দীপকের।

জীর্ণ একতলা কোঠা বাড়ি। অনেকগুলো ঘর। বাড়ির চারপাশে বড় বড় গাছ আর ঝোপঝাড়। তবে সামনে উঠোনটুকু তকতক করছে। মনে হয় একদা এদের অবস্থা ভালো ছিল, এখন পড়ে গিয়েছে। সাদা থান পরা এক প্রৌঢ়া দাওয়ায় বসে কী জানি করছিলেন। দীপককে এগুতে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে তাকিয়ে থাকেন।

‘আপনি কি নগেন দাসের মা বিভাবতী দেবী?’ নমস্কার করে বলে দীপক।

চকিতে ভদ্রমহিলা কেমন ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। তবে ঘড় নাড়েন সম্মতি জানিয়ে। ‘নগেন দাস কি এখানে এসেছেন?’ প্রশ্ন করে দীপক।

আবার ঘাড় নাড়েন মহিলা। অর্থাৎ—না।

ইতিমধ্যে একটি সুশ্রী যুবতী মেয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। তার পরনের শাড়ি প্রৌঢ়ার মতোই ময়লা।

‘আমি বোলপুর থেকে আসছি। নগেন দাসের বিষয়ে একটু কথা বলতে চাই’, জানাল দীপক।

বিভাবতী এবার ভীত অস্ফুট স্বরে বলে ওঠেন—’কেন কেন?’

কোথায় বসা যায়? দীপক এদিক-সেদিক তাকাতে মেয়েটি একটি টুল এনে রাখে। তার ওপর বসে দীপক। মেয়েটি বোধহয় নগেনের বোন। উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকে মেয়েটি। দীপক বলল, “নগেন দাস তো বোলপুরে চাকরি করেন?’

‘হুঁ।’ মৃদুস্বরে জবাব দেন বিভাবতী।

‘নগেনবাবু কি কয়েক দিনের মধ্যে বাড়ি এসেছেন?’

‘না তো।’

‘উনি গত মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ কোথাও গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছেন জানেন?’

‘অ্যা।’ মা মেয়ে দু’জনের কণ্ঠ থেকে যেন আর্তনাদ বেরোয়।

মেয়েটি বলে ওঠে, ‘সেকি এখনো ফেরেনি?

দীপক বুঝল যে নগেনের অন্তর্ধানে এরা খুব ঘাবড়ে গিয়েছে। যেন কিছু একটা আশঙ্কা করছে। কিন্তু একটা জোয়ান ছেলে না হয় ক’দিন বাইরে গিয়েছে তাতে এত নার্ভাস হওয়ার কারণ কী? দীপক চারপাশটা একবার দেখে নেয়। নাঃ তাদের কথা কেউ শুনতে পাবে না। কাছাকাছি বাড়ি নেই। সে নিচু গলায় বলল, ‘দেখুন নগেনবাবুর পূর্ব ইতিহাস আমি জানি। মঙ্গলবার রাতে তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়াটা বেশ রহস্যজনক। বোলপুরে কাউকে কিছু বলে যাননি। কিছু হদিশ পেতে পারি কিনা জানতে আপনার কাছে এসেছি।’

দীপক অল্প কথায় টিয়া পাখির সূত্র ধরে নগেনকে খোঁজ করার বৃত্তান্ত জানায়। সে রাতে যে একজন অচেনা লোক নগেনের খোঁজে এসেছিল, তাও বলে। জিজ্ঞেস করে, নগেনবাবু কোথায় যেতে পারে আন্দাজ করতে পারেন? কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি?

মা-মেয়ে চোখাচোখি করে। তাদের চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ। বিভাবতী দেবী বিড়বিড় করেন, ‘কী জানি, কী জানি কোথায় গেল?’

দীপকের স্থির বিশ্বাস হয়, এরা কিছু চেপে যাচ্ছে। তবে নগেন উধাও হওয়ার ব্যাপারে এরা যে শঙ্কিত হয়েছে সেটা চোখেমুখে ফুটে উঠেছে। দীপক এবার সোজাসুজি প্রশ্ন করল বিভাবতী দেবীকে, ‘আপনারা কী নগেনের কোনো বিপদের ভয় করছেন?’

একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বিভাবতী মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে করুণ স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা।’

দীপক বলল, ‘দেখুন আগেই বলেছি আমি একজন রিপোর্টার। নগেনবাবুর বিপদে আমি যদি কোনো সাহায্য করতে পারি খুশি হব। তাই কী আশঙ্কা করছেন যদি একটু খুলে বলেন। আচ্ছা আপনার ছেলে তাঁর পুরনো অসৎসঙ্গ কি সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছিলেন?’

বিভাবতী জোর গলায় বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ বাবা, সে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে আর কখনও কুসঙ্গে মিশবে না। আমি নিশ্চিত জানি সেই প্রতিজ্ঞা ও ভাঙবে না। বাপ-মরা ছেলে মেয়ে দু’টিকে আমি অনেক কষ্টে মানুষ করেছি। ওরা দুটিও আমায় খুবই শ্রদ্ধাভক্তি করে।’

‘ওঁর কী বিপদের ভয় করছেন?’ দীপকের চিন্তা এবার রহস্যে নতুন কিছু ক্লু পাওয়ার আশায় উন্মুখ হয়।

বিভাবতী দেবী নতমুখে কাতর কণ্ঠে বলেন, ‘তুমি তো বাবা জানো, নগেন কর্মদোষে জেল খেটেছে। তবে সাজা বেশি হয়নি, রাজসাক্ষী হওয়ায়। এর কাছ থেকে ডাকাতির অনেক মাল পাওয়া যায়। তাছাড়া ওর মুখে খবর পেয়েই ডাকাতির প্রায় বাকি সব মাল উদ্ধার করে পুলিশ। ডাকাতগুলোর শাস্তির প্রধান কারণও নগেনের সাক্ষী। জেলে যাওয়ার সময় এই দলের পাণ্ডা নাকি নগেনকে ভয় দেখিয়েছিল যে জেল থেকে বেরিয়ে সে নগেনকে খুন করবে, এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিতে। ওই লোকটার জেল হয় ছয় বছর। বছরখানেক আগে সেই সর্দারটা ছাড়া পেয়েছে। নগেন খেয়াল রেখেছিল কবে ওই লোকটা ছাড়া পাচ্ছে। নগেন জেল থেকে বেরিয়ে কিছুদিন কলকাতায় আর বর্ধমানে কাজ

করে। তারপর যায় বোলপুর। ভালো কাজ জানে বলে ওর চাকরির অভাব হয় না। তবে সে যে জেলখাটা আসামি সেটা গোপন রাখে। আগেকার চেনাশোনাদের থেকে দূরে থাকে। লজ্জায় বাড়িও আসত খুব কম। এলেও লুকিয়ে লুকিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যেত। টাকা পাঠাত মনি অর্ডারে। তবে বোলপুরে যাওয়ার পর এখানে চিঠি বা মনি অর্ডার করত না। পাঠাত ত্রিবেণীতে আমার এক সইয়ের কাছে। আমরা সেখানে গিয়ে নিয়ে আসতাম। পাছে এখানকার পোস্ট আপিস থেকে এর ঠিকানা বেরিয়ে যায় সেই ভয়ে। এখানে কেউ জানে না নগেন এখন কোথায় থাকে।

দিন দশেক আগে একটা লোক আসে এখানে। নগেন কোথায় জানতে চায়। আমরা প্রথমে বলতে চাইনি। কারণ সেই দলের সর্দারটা যে জেল থেকে বেরিয়েছে, বলেছিল নগেন। শেয়ে লোকটা হুমকি দেয় যে নগেনের ঠিকানা না বললে আমাদের সর্বনাশ করবে। তখন ভয়ে বলতে বাধ্য হই নগেনের বোলপুরের ঠিকানা। লোকটা শাসিয়ে চলে যায়—ওর এখানে আসার কথা যেন কাউকে না বলি। আর ভুল ঠিকানা দেওয়া হয়েছে বুঝলে আমাদের নিস্তার নেই।

তা লোকটা চলে যাওয়া মাত্র আমি নগেনকে চিঠি দিয়ে জানাই খবরটা। কারণ লোকটার চেহারা দেখে সন্দেহ হয়েছিল যে এ সেই ডাকাত দলের পাণ্ডা। নগেনের মুখে তার বর্ণনা শুনেছিলাম যে, ওকে দলের লোক নাকি ওস্তাদ বলে ডাকত।

তা বাবা, তুমি যে লোকটার কথা বলচ, যে নগেনের খোঁজ করছিল, বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে ওই সেই ওস্তাদ। জানি না নগেন ওর খপ্পর থেকে পালাতে পারল কি না? —না’ বলেই বিভাবতী কেঁনে ফেললেন। অর্থাৎ নগেন যদি পালাতে না পারে? যদি খুন হয়ে যায় ওস্তাতের হাতে?

নগেনের অন্তর্ধানের এই নতুন কারণটা জেনে দীপক হতবাক। কী সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায় না। বলে, ‘অত দুশ্চিন্তা করবেন না। নগেনবাবু হয়তো আপনার চিঠি পেয়ে সতর্ক ছিলেন। ওস্তাদ যেতেই গা ঢাকা দিয়েছেন। একটা কথা বলে যাই। নগেনবাবুর কোনো খবর পেলে বা সেই ওস্তাদ ফের এলে আমায় তখুনি জানাবেন। আমার ঠিকানা রেখে যাচ্ছি। হ্যাঁ, ওস্তাদের বর্ণনাটা আর একবার ভালো করে বলুন তো।’

বিভাবতী বললেন। মন দিয়ে শুনে নিল দীপক।

মগরা থেকে সোজা বোলপুরে ফিরল না দীপক। গেল কলকাতায়। লালবাজারে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এক অ্যাসিস্টান্ট কমিশনার তার বিশেষ পরিচিত। তার সাহায্যে কিছু খবর জোগাড় করতে হবে।

পাঁচ

দীপক বোলপুরে ফিরতেই ছোটন ঝুমা তাকে চেপে ধরল। ‘কাকু নগেনের খবর পেলে? টিয়াটার কী হবে? ফেরত নেবে নাকি?’ ছোটনরা জানত যে দীপক মগরায় গেছে নগেনের বাড়ি। দীপক অল্প কথায় তার অভিজ্ঞতা বলে।

শুনে ছোটন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘যাক বাবা, পুঁটি তাহাল থাকছে?’ ইতিমধ্যে টিয়াটার নাম দেওয়া হয়ে গিয়েছে পুঁটি। ছোটন ঝুমা আবিষ্কার করেছে যে ওটাই নাকি তার আগেকার নাম। এই নামে ডাকলেই ও সাড়া দেয়।

দীপক বলল, ‘কী করে বুঝলি যে থাকছে?’

ছোটন বলল, ‘বাঃ হয় নগেন খুন হবে, নয়তো প্রাণের ভয়ে আর এমুখো হবে না। পাখি ফেরত নেবে কী করে?’

দীপক রোগ বলল, ‘তোরা তো অচ্ছা। পাখিটার লোভে একটা মানুষকে খুন করতে আপত্তি নেই।’

ছোটন ঝুমা লজ্জার ভান দেখিয়ে মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হাসে।

সম্পাদক কুঞ্জবিহারী তো দীপকের মুখে নগেন-বৃত্তান্ত শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন! চেয়ার ছেড়ে আধখানা উঠে টেবিলে দুম করে এক ঘুসি বসিয়ে হুঙ্কার দিলেন, ‘মার্ভেলাস। খুন। মার্ডার৷ নাটক জমে গিয়েছে হে। দীপক তুমি ফলো করে যাও। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় দেখে বঙ্গবার্তায় একখানা স্টোরি ছাড়বে। দুর্দান্ত হবে। কাটতি বেড়ে যাবে কাগজের। হুঁ হুঁ বাবা, ভাগ্যিস টিয়াটা আমার নজরে পড়েছিল, ধরলাম ভাগ্যিস। তাই তো এমন একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনার ক্লু মিলে গেল। আচ্ছা, স্টোরিটার নাম কী দেওয়া যায়?? কপালে বার দুই পেনের টোকা মেরে সম্পাদকমশাই ঘোষণা করলেন—হ্যাঁ পেয়েছি। টিয়া রহস্য।’

দীপক গেল নগেনের বাড়িওয়ালার কাছে।

বলাইবাবু তেড়েফুঁড়ে উঠলেন, ‘দেখুন মশাই নগেনের কাণ্ড। একজনের ট্রানজিস্টার সারাবে বলে ঘরে এনে রেখেছিল। নাকি দু’তিন দিনে দেব বলেছিল। সাত-আট দিন হয়ে গেল, বাবুর পাত্তা নেই। খুব হম্বিতম্বি করে গিয়েছে লোকটা। বলছিল, তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে তার ট্রানজিস্টার নিয়ে যাবে।

তা অবশ্য হতে দিইনি। তবে বলেছি, এ মাসের ভাড়া দেওয়া আছে। বারো দিন বাদে মাস শেষ। তদ্দিনে না ফিরলে সাক্ষী রেখে, তালা খুলে নিয়ে যাক তার রেডিও। আমার আপত্তি নেই। হ্যাঁ, নগেনের একটা চিঠি এসেছে।’

‘চিঠি। কই দেখি?’

ইনল্যান্ডটা দিতে বল’ইবাবু ইতস্তত ছিলেন। দীপক ভৱনা দিল—‘আমায় দেখাতে কোনো ভয় নেই! নগেনের এই হঠাৎ উধাও হওয়াটা বেশ রহস্যজনক। আমি এর বাড়ি গিয়েছিলাম। ও বাড়ি যাইনি| ওর বাড়ির লোক জানে না ও কোথায় গিয়েছে। তারা খুবই চিন্তিত হয়েছে। বঙ্গবার্তার তরফ থেকে আমি ইনভেস্টিগেট করছি কেসটা। দরকার হলে পুলিশেও ইনফর্ম করব।’

সাহস পেয়ে বলাইবাবু দীপকের হাতে দিলেন চিঠিটা।

দীপক ইনল্যান্ডটা খুলে দেখল যে এটা নগেনের মায়ের চিঠি। যে চিঠিতে তিনি নগেনকে সাবধান করে দিয়েছিলেন ওস্তাদ সম্বন্ধে। ডাক বিভাগের কৃপায় অ্যাদ্দিনে একলা চিঠিটা।

দীপক ভাবল, তবে তো নগেন সতর্ক হওয়ার সুযোগ পায়নি। ও তাহলে নির্ঘাৎ ওস্তাদের আগমন লক্ষ করে গোপনে। হয়তো সে যখন সামনের দোকানটায় বসে চা খাচ্ছিল—তখন। তাই উঠে তড়িঘড়ি পালায়। তারপর ঘরে আসে লুকিয়ে লুকিয়ে। কিন্তু কথা হল যে নগেন কি ওস্তাদের চোখ এড়িয়ে নিরাপদে পালাতে পেরেছিল?

ওস্তাদ ধূর্ত বদমাশ। হয়তো আড়াল থেকে নজর রেখেছিল, নগেন কখন ঘরে ফেরে। তারপর পলাতক নগেনকে যদি সে ফলো করে? শেষে সুবিধা মতো কোথাও পেয়ে নিকেশ করে?

দীপক চায়ের দোকানেররামুকে ডেকে বলল, ‘মনে রাখিস, যদি নগেন ঘরে ফেরে বা সেই কালো গুন্ডা টাইপ লোকটা আসে, সঙ্গে সঙ্গে অমায় খবর দিবি! অমনি বকশিশ পাবি।’ দীপক একখানা এক টাকার নোট রামুর হাতে দিয়ে বলল –‘অ্যাডভান্স।’

রামু অমনি একটা স্যালুট ঠুকে বলল, ‘জো হুকুম।’

আরও এক সপ্তাহ কেটেছে। সম্পাদক কুঞ্জবিহারী প্রায়ই খবর নেন দীপকের কাছে, ‘কীহে, টিয়া পাখির কেসটা কিছু এগোল?’

‘নাঃ।’ দীপক মাথা নাড়ে, ‘তবে আপেক্ষায় আছি। জাল পেতে রেখেছি।’

দীপক প্রত্যেক দিন অনেকগুলো দৈনিক খবরের কাগজ এনে উল্টেপাল্টে দেখে। একদিন কৌতূহলী ছোটন জিজ্ঞেস করল, ‘কাকু, অতগুলো কাগজে কী পড়ো?’

দীপক বলল, ‘কোনো বেওয়ারিশ মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে কিনা খুঁজি? পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে বিজ্ঞাপন দেয়। কখনও কখনও নিউজ হিসাবেও বেরোয়। এমন মৃতদেহ কাছাকাছি শহরে মর্গে রেখে দেয়। আমি কয়েকটা গিয়ে দেখেও এসেছি। নগেনের খোঁজ মেলেনি অবশ্য।’

‘তুমি কি ভাবছ সত্যি নগেন খুন হয়ে যেতে পারে?’

‘সে সম্ভাবনা খুবই,’ চিত্তিওভাবে জানায় দীপক।

‘যদি খুন না হয় নগেন ফিরবে?’

‘ফিরবে তো মনে হয়। তবে কবে বলা যায় না। ওর কিছু জিনিসপত্র পড়ে আছে নিজের ঘরে। তাছাড়া রেডিওর দোকানে মাইনে বাবদ এর কিছু টাকাও পাওনা আছে।’

‘ফিরলে আর এখানে থাকছে না। টুক করে এসে জিনিসপত্র মাইনে নিয়ে পালাবে। খাঁচাসুদ্দু পাখি নিয়ে যাবে কোথা?’ ঝুমার মন্তব্য।

অর্থাৎ ওরা ধরে নিয়েছে যে, টিয়া পুঁটি ওদেরই সম্পত্তি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটা যে নাও হতে পারে কারণটা ভাঙল না দীপক, বেচারিরা দুর্ভাবনায় থাকবে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত জল কোথায় গড়ায়?

আরও একবার দীপক কলকাতায় গেল লালবাজারে।

বোলপুর থানার দারোগার সঙ্গেও দেখা করল। সেদিন সকাল এগারোটা নাগাদ দীপক বাড়িতে বসে খবরের কাগজ ওল্টাচ্ছিল। সহস্যা গেটের সামনে রামুর আবির্ভাব।

‘কীরে রামু?’ জিজ্ঞেস করে দীপক।

রামু দীপককে কাছে আসতে ইশারা করে।

দীপক দ্রুত পায়ে তার কাছে যায়।

রামু ফিসফিসিয়ে বলে, ‘সেই কালো লম্বা লোকটা এসেছিল খানিক আগে। আমায় জিজ্ঞেস করছিল, নগেনদা ফিরেছে কিনা। নগেনদার ঘরের সামনেটায় ঘুরে দেখল—’

‘তারপর?’ তীব্র উদ্বেগ ফোটে দীপকের কথায়।

‘চলে গেল।’

‘কোথায়? কোন দিকে?’

রামু মিচকে হাসে। বলে—’রিপোর্টারদাদা, বকশিশ খেয়েছি, কাজে ফাঁকি পাবেন না। রামচন্দর সে পাত্তর নয়। এক কেজি পেঁয়াজ আনতে বলেছিল মালিক। লোকটা পা চালাতেই টপ করে পয়সা চেয়ে থলি হাতে লোকটার পিছু নিলুম। বাজারের দিকেই যাচ্ছিল লোকটা। দেখে নিলুম ও কোথায় ঢুকছে।’

‘কোথায়?’

‘ইন্ডিয়া বোর্ডিং হাউস। সটান ঢুকে গেল ভেতরে। একটু অপেক্ষা করে হোটেলটায় ঢুকে পড়লাম। আমার পাড়ার পঞ্চা কাজ করে ওখানে। তাকে জিজ্ঞেস করতে বলল যে আজ সকালেই বাইশ নম্বর রুমে উঠেছে লোকটা। একাই। ব্যস, তাপ্পর সোজা চলে এসেছি আপনার কাছে। এবার পেঁয়াজ নিয়ে ফিরব।’

দীপক জিজ্ঞেস করে, ‘লোকটার কপালে কাটা দাগটা লক্ষ করেছিলি?’

‘আলবৎ।’

‘লোকটা সন্দেহ করেনি তো ফলো করছিস।’

‘খেপেছেন স্যার। অনেক দূর থেকে পথের লোকের ভিড়ে মিশে ফলো করেছি। রামুকে ধরা অত সোজা নয়।’

রামু চলে যাওয়ার মিনিট কয়েকের ভিতর দীপক পথে নামল। সোজা গেল থানায়। আধঘণ্টার মধ্যে বোলপুর পুলিশ অ্যারেস্ট করল ওস্তাদকে ইন্ডিয়া বোর্ডিং থেকে। এ নিয়ে একটু উত্তেজনা হল বটে জনতার মধ্যে—কে লোকটা? ব্যাপারটা কী? কিন্তু থানার দারোগ! বিশেষ মুখ খুললেন না। শুধু জানালেন যে, লোকটা দাগি আসামি, পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, হেডকোয়ার্টার্সের ইন্সট্রাকশন ছিল একে অ্যারেস্ট করার।

দু’দিন বাদে দীপক ফের মগরায় হাজির হল বিভাবতী দেবীর কাছে।

‘এসো বাব৷৷’ দীপককে আহ্বান জানালেন বিভাবতী! মিনুও কৌতূহলী মুখে কাছে এসে দাঁড়ায়।

নগেনের কোনো খবর পেলেন?’ জানতে চায় দীপক।

‘কই না। তুমি কিছু পেলে?’ বিভাবতী জিজ্ঞেস করেন।

দীপক বলল, ‘আমি? হ্যাঁ পেয়েছি।’

‘কী?’ মা মেয়ে দু’জনরেই কণ্ঠে উদ্বেগ ভরা প্রশ্নটা বেরোয়।

দীপক চট করে কোনো জবাব না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দু’জনেরই মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলায়। তারপর ধীর স্বরে বলে, ‘নগেনবাবু যে নিরাপদে আছেন কেথাও এটুকু আমি জানতে পেরেছি। তার ঠিকানাটা জানি না এখনও। তবে, সেটা আপনারা জানেন। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত।’

‘আমরা। না না।’ প্রবল প্রতিবাদ করে ওঠে মা এবং মেয়ে।

দীপক মৃদু হেসে বলল, ‘আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। বেপাত্তা ছেলের কোনো খবর না জানলে যতটা দুর্ভাবনা ফোটা উচিত ছিল তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখলাম না আপনাদের চোখেমুখে। আমি না হয় জানতে পেরেছি যে আপনার ছেলে এখনও জীবিত কিন্তু সে খবর তো আপনাদের কাছে পৌঁছবার কথা নয়। অন্তত আমি যেভাবে জেনেছি। তার মানে আপনারা খবর পেয়েছেন অন্য সূত্রে। খুব সম্ভব নগেনবাবুই স্বয়ং আপনার ত্রিবেণীর সইয়ের বাড়িতে গোপনে চিঠি দিয়েছেন। তাই না?’

মাথা নিচু করে মৃদুকণ্ঠে স্বীকার করেন নগেনের মা, ‘হ্যাঁ বাবা, ঠিকই ধরেছ। তবে ওর ঠিকানাটা—’ তিনি ইতস্তত করেন।

‘ব্যস ব্যস, তাঁর ঠিকানা আমি জানতে চাইছি না। আমি শুধু বলতে এসেছি যে, নগেনবাবুকে চিঠি লিখে কয়েকটা খবর জানিয়ে দিন।’

‘কী খবর?’ মাথা তুলে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করেন বিভাবতী।

দীপক বলল, ‘এক নম্বর। ওস্তাদকে অ্যারেস্ট করেছে পুলিশ!’

‘অ্যা সেকি! কেন?’ মা মেয়ে চমকে ওঠে।

‘কারণ ওস্তাদ জেল থেকে বেরুবার কিছু বাদে দল জুটিয়ে ফের এক জায়গায় ডাকাতি করে। পুলিশ তার প্রমাণ পেয়েছে। তাকে খুঁজছিল ধরতে। ওস্তাদ গা ঢাকা দেয়। তারপর দাড়িগোঁফ গজিয়ে চেহারা পাল্টায় খানিক। সেই চেহারা নিয়েই আসে আপনার কাছে। এরপর নগেনবাবুর সন্ধানে যায় বোলপুর। খুব সম্ভব প্রতিশোধ নিতে। সেদিন নগেনবাবু দৈবাৎ তাকে বাড়ির কাছে দেখেই চিনে ফেলেন। তাই সেই রাতেই প্রাণভয়ে পালান। ফলে বেঁচে যান। আমি ওস্তাদের ব্যাপারে কলকাতায় পুলিশ ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারি তার এই নতুন কীর্তি। মানে ফের ডাকাতির কথা। আমি বোলপুর থানাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। নিজেও চোখ রাখছিলাম। দু’দিন আগে ওস্তাদ আবার বোলপুরে নগেনবাবুর খোঁজ করতে আসার পরই সে অ্যারেস্ট হয়।

সুতরাং নগেনবাবু এখন নির্ভাবনায় বোলপুরে আসতে পারেন। তাঁর বাকি জিনিসপত্র মাইনে নিয়ে যেতে পারেন। ইচ্ছে করলে বোলপুরে কাজও করতে পারেন। তাকে জানিয়ে দেবেন এসব। ভাগ্যিস আপনার চোখকে ওস্তাদ ফাঁকি দিতে পারেনি। তাই ওঁকে এত সহজে গ্রেফতার করা সম্ভব হল।’

‘ওঃ বাবা, কী যে নিশ্চিন্ত হলাম। তোমায় যে কী বলে আশীর্বাদ করব।’ আনন্দে বিভাবতী দেবীর চোখে জল এসে যায়।

দীপক হেসে বলল, ‘নগেনবাবুকে আর একটা কথা জানাবেন যে আমার একটি প্রার্থনা আছে। মানে, এটা ঠিক আমার প্রার্থনা নয়। বলতে পারেন আমার দুই ভাইপো-ভাইঝির আবদার, যারা নগেনবাবুর টিয়া পাখিটার দেখাশোনা করছে। পাখিটার ওপর ওদের ভীষণ মায়া পড়ে গিয়েছে৷ তাই যদি পাখিটা ওদের দান করেন নগেনবাবু, ওরা বড্ড খুশি হয়।’

‘হ্যাঁ বাবা, পাখিটা ওরা নিক,’ বিভাবতী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘আমি নগেনের হয়ে পাখিটা এদের দান করছি। তোমার এত বড় উপকারের এই সামান্য প্রতিদানটুকু দিতে পারব না। জানলে নগেন খুশি হয়েই তার টিয়েটা দিয়ে দেবে। তোমার ভাইপো-ভাইঝির কাছে ওটা সুখে থাকুক।’

দীপক উঠল। তার কাজ হাসিল। এবার বঙ্গবার্তার জন্যে জমাটি একখানা লিখে ফেলা যাক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *