টক অফ দি টাউন কল্পনা চাকমা – আবেদ খান
কোথায় কল্পনা চাকমা? কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সেই পাহাড়ি মেয়েটি? কতদিন হয়ে গেল সে তো আর ফিরল না! জুন মাসের এগার তারিখ রাত্রে সাত-আট জন সশস্ত্র ব্যক্তি বাঘাইছড়ির লাল্যাঘোনা গ্রামের পরলোকগত গুণরঞ্জন চাকমার বাড়িতে প্রবেশ করে এবং কল্পনা চাকমা, তার ভাই কালিন্দিকুমার ও লালবিহারীকে ধরে নিয়ে যায়। একটু পরেই গুলির আওয়াজ, কল্পনার দাদা দাদা চিৎকার, ঐ সুযোগে কালিন্দিকুমার ও লালবিহারীর আত্মগোপন এবং তারপর থেকেই কল্পনা চাকমা নিখোঁজ। কল্পনার দুই ভাইয়ের দাবী, তাঁরা সশস্ত্র ব্যক্তিদের তিনজনকে চিনতে পেরেছেন। কিন্তু বাঘাইছড়ি থানার এফআইআর-এ এই তথ্যটি লিপিবদ্ধ হয়নি। কেন হয়নি? ওঁরা কি বলেননি এ কথা? বলা হচ্ছে, যারা কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করেছিল তারা সশস্ত্রবাহিনীর লোক। কালিন্দিকুমার এবং লালবিহারী বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর লোকদের কি তাহলে চিনতেন কিংবা ঐ তিনজন কি তাদের এত পরিচিত যে রাতের অন্ধকারেও তাদের সনাক্ত করতে অসুবিধে হয়নি? তবে যেই হোক নিজের বোনকে রাতের বেলা অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে তারপর গুলির শব্দ এবং বোনের আর্তচিৎকারও শোনা যাবে অথচ সেই সময় কাউকে চিনলেও তার বা তাদের নাম জানানো হবে না, এমনটি হয় না। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে হয় তাঁরা কাউকে চিনতে পারেননি কিংবা নাম বলেছেন কিন্তু সেটা লিপিবদ্ধ করা হয়নি। আচ্ছা, কল্পনার মা বাঁধুনি চাকমা টিএনও-র কাছে যে জবানবন্দিটি দিয়েছিলেন সেটাই কেন এফআইআর হিসেবে নেওয়া হল? কেন কল্পনা চাকমার পরিবারের কোনো সদস্যের কাছ থেকে লিখিত এফআইআর নেওয়া হল না? সেটাই তো উচিত ছিল এবং সেটাই তো নিয়ম। তাহলে কি কোন বিশেষ কারণে দায়সারা ভাবে একটা এফআইআর করা হয়েছিল?
কল্পনা চাকমার বিষয়টি হালকা করে দেখবার কোন উপায় নেই। যখন এই ঘটনাটি ঘটে তখন ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। নির্বাচনের ঠিক আগের দিন। যখন এই ঘটনাটি ঘটে তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মূল কেন্দ্রটি ছিল অস্থিতিশীল, সুদূর পার্বত্য জেলার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা তখন ছিল বেশ অসুবিধেজনক। নির্বাচনের ঠিক আগের দিন রাতে একজন রাজনীতি সচেতন ও নির্বাচন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয়ভাবে নেমে পড়া নেত্রীকে হঠাৎ করে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হবে এবং এ নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের কারও বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে অভিযোগ উঠবে অথচ আইএসপিআর সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখবে এটা ঠিক নয়, এটা প্রত্যাশিত নয়। হঠাৎ এখন এই কদিন আগে সেনাবাহিনীকে দেখা গেল সক্রিয় হতে, দেখা গেল ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করতে দেখা গেল হেলিকপ্টারে করে লিফলেট বিলি করতে। প্রশ্ন কি করা যায় না, এতদিন কোথায় ছিলেন?
কী হতে পারে কল্পনা চাকমার? আমাদের দেশে যুবতী মেয়েকে অপহরণ করলে কী ঘটে তা তো আমরা সবাই জানি, সবাই কাগজে পড়ি। কল্পনা চাকমার তিনটি দোষ। একটা দোষ সে যুবতী নারী, দ্বিতীয় দোষ সে ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু এবং জাতিগতভাবে উপজাতি আর তৃতীয় দোষ সে প্রতিবাদী এবং রাজনীতি-সচেতন নেত্রী। এই তিনটি দোষের যে কোন একটির কারণেই একজন আক্রান্ত হতে পারে- শারীরিক কিংবা মানসিক কিংবা উভয়ভাবেই। কাজেই যে মেয়েটি গভীর অরণ্যে রাত্রির অন্ধকারে সশস্ত্র বক্তিদের দ্বারা অপহৃত হবে এবং তার কণ্ঠনিসৃত আর্তনাদের পর নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যাবে সেই মেয়েটির সম্পর্কে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার প্রচারণা কিংবা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় লাভের প্রচারণা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। আমার তিনটি প্ৰশ্ন : এক. এফআইআর কেন নিয়ম-মাফিক হল না? এফআইআর-এর ভিত্তিতে কেন যথাযথ তদন্ত হল না এবং ফলোআপ হল না?
দুই. কল্পনা চাকমার অপহরণকে কেন্দ্র করে যখন স্থানীয় সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল এবং আন্দোলন হল তখন কি গোটা ইউনিটকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে তদন্ত করার ব্যবস্থা হয়েছিল?
তিন. উপজাতি প্রতিনিধি কিংবা শান্তিবাহিনীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করে এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনা করার কোন উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে কিংবা ভাবা হয়েছে?
কল্পনা চাকমা বাংলাদেশের মেয়ে। পার্বত্যভূমির সচেতন নাগরিক-প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা মেয়ে। যদি শান্তিবাহিনীর কোন উপদল তাকে অপহরণ করে তাহলে সেই উপদল সততা এবং সাহসের সঙ্গে সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে ঘোষণা দেবে আর যদি সেনাবাহিনীর কারও দ্বারা একই ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। কল্পনাকে আমরা হারাতে চাই না। কল্পনা চাকমা যদি আর ফিরে না আসে তাহলে আমাদের ঘাড়ের ওপর যে বোঝাটি চেপে বসবে তার ওজন বড্ড বেশি, বড্ড বেশি!
ভোরের কাগজ : ২৪ জুলাই ১৯৯৬