ঝড়ের খেয়া – ১৫

পনেরো

তনিকা পরেছে একটা নাগাল্যান্ডের র‍্যাপ অন। টপটা অবশ্য বিদেশি। টপও ঠিক নয়। স্লিপ গোছের, হাত—কাটা। ওপরে একটা লেস লেস উপরাংশ আছে তার, কিন্তু সে সেটা পরেনি। অক্সিডাইজড ধাতুর ওপর লাল পুঁতি বসানো ঝোলা দুল, গলায় দু’তিন ছড়া পুঁতির মালা, হাতে পরেছে একটা কাঠের মোটা বালা, কোনও একটা ট্রেড—ফেয়ার থেকে কিনেছিল। লাল রং। রাজস্থানি গালার বালা একটা, সেই সঙ্গে অক্সিডাইজড মোটাসোটা চুড়ি—বালার মধ্যবর্তী কিছু। পায়ে একটা ফটাস ফটাস চটি গলিয়ে নেয়। চেহারাখানা দেখবার মতো। লম্বা আয়না এ ঘরে নেই। মিসেস উইলিয়ামসের কাছে ওপরে চলল। শুকনো ঝাড়ন দিয়ে মুছে মুছে কাচ পালিশ করছেন উইলিয়ামস।

—আন্টি, তোমার ঘরে কেউ আছে?

—কী?—আমি একজন ভদ্রমহিলা, এই সকালে আমার ঘরে কে থাকবে?

—উঃ। তনিকার ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়, —আমি তোমার লম্বা আয়নাটায় নিজেকে একটু দেখব।

—ফ্র্যাঙ্ক! ফ্র্যাঙ্ক! বেরিয়ে এসো।

তড়বড় করতে করতে সাদা ভুরুর ফ্র্যাঙ্ক বেরিয়ে আসেন।

—কী ব্যাপার? কী ব্যাপার? ডাকাত?

—টনিকার আজ সকাল থেকে পার্টি। শি হ্যাজ ড্রেসড আপ।

—আরে দেখি দেখি!—ফ্র্যাঙ্ক ভাবলেন—তাঁকে পার্টি—সাজ দেখতে ডাকা হচ্ছে, তাড়াতাড়িই বেরিয়ে এলেন, চশমা গলাতে গলাতে।

—আহ! জংলি কোনও পার্টি নাকি? উইথ অল সর্টস অব ট্রাইব্যালস! ইতিমধ্যে তনিকা শুট করে ঢুকে গেল। লম্বা আয়নাটা দেওয়াল থেকে ঝুলছে। পুরো চেহারাটা দেখা যায়। দুটো আঙুল ঠোঁটের ওপর চাপা দিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এদিক—ওদিকে একটু ঘুরল। ফ্র্যাঙ্ক আঙ্কল—ই অবশ্য আয়নার কাজটা করে দিয়েছেন। এইটাই তার পছন্দ। ঠিক এইটাই। র‍্যাপ অনটার সঙ্গে টপটা একেবারে যাচ্ছে না। তার সরু সরু হাতে অনেকগুলো চুড়িবালা। বেশ ঢলঢল করছে। প্রথমেই তার হাতের ওপর চোখ পড়বে লোকের। চোখের কাজলটা সে একটু ধেবড়ে নিল। এবার মাথা ঝাঁকিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। যেটুকু বা যত্নের ছাপ ছিল, এবার সেটা চলে গিয়ে একটা বেশ ‘ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’ গোছের এফেক্ট। সে আন্টিদের হাত নেড়ে একছুটে নীচে নেমে যায়। তনিকা আজ ‘চিত্রভানু’তে যাচ্ছে।

ঝড় বৃষ্টি গরম—সবই চূড়ান্ত হয়ে গেল বেশ কয়েক বার। পার্ক সার্কাসের রাধাচুড়াগুলো কিন্তু এখনও সমান সতেজ। লেক পেরিয়ে সে চিত্রভানুতে যাবে। দু’ধারে কৃষ্ণচূড়া। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সে বলল গাড়িটা একটু লেক—ক্লাবের দিকে রাখুন না।

—কী করবেন?

—আমি না আপনি। ওই যে ওই বেঁটে কৃষ্ণচূড়াটা! ওর তলার ডাল থেকে আমাকে একটু ফুল পেড়ে দেবেন?

—আচ্ছা, আপনি গাড়ির মধ্যে বসুন।

দিব্যি এনে দিল। একঝাঁক উজ্জ্বল হাসির মতো কৃষ্ণচূড়া।

যখন নামল, বুকের ওপর ফুলগুলো আঁকড়ে নামল সে।

একটা পার্কের ধারে বাড়িটা। বাইরে কিছু লেখা আছে নিশ্চয়। ঠিকানাটা সে জানে। কিন্তু এইসব অঞ্চলে ঠিকানা খুঁজে পাওয়া দায়।

 ওঃ ওই তো! একটা কঠের দরজা, তার সারা অঙ্গে ছবি আঁকা। নিশ্চয় ওইটা। শিয়োর, ওরই ভেতরে লেখা ‘চিত্রভানু’।

দরজাটা আধখোলা ছিল। ঢুকেই সিঁড়ি। ডানদিক দিয়ে ওপরে উঠে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখল, একটা মস্ত বড় ঘেরা দালান, চারদিকে কাচ বসানো বড় বড় জানলা। দুটো—তিনটে ইজেলের সামনে কাজে মগ্ন দু’—তিনজন। পাশে উঁচু টুলের ওপর রঙের পেলেট।

পেছন থেকে মনে হল—ওটাই শৌনক। ইচ্ছে করে চটিটাতে একটু শব্দ করে এগোল সে। একজন পেছন ফিরল।

—দিদি আছেন?

এবার শৌনক ফিরে তাকাল।

—তুমি…সেদিনের তারাতলার সেই…মিমি…।

—আমি তনিকা।—একটু ক্ষোভের সঙ্গেই বলল সে। কেন যে তার সঙ্গে মিমিকে লোকে গুলিয়ে ফেলে। একই ধরনের চেহারা ঠিকই, কিন্তু তারা তো এক দেখতে নয়! ইমপ্রেশনটাও এক হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া তার এই এতখানি লম্বা—চওড়া চুলটাই তো প্রথম দর্শনে তাকে চিনিয়ে দেয়।

—স্যরি, আমার নামটাই গুলিয়ে গিয়েছিল। তোমাকে তো আগেও দেখেছি সেই অ্যাকাডেমিতে—দুর্দান্ত ছবিটা এঁকেছিলে…লাল বেড়ালের। ভার্মিলিয়নের সঙ্গে ঠিক কী কী মিশিয়েছিল বলো তো? ব্যাপক, বীভৎস।

—দিদি নেই?

—আসছেন! জাস্ট একটু পরে।

আরও কতকগুলো ছেলেমেয়ে উঠে এল। কলকল করতে করতে একটা ঘরে ঢুকে গেল।

তুমি…চটিটা—শৌনক বলল।

—ওহ স্যরি।

সে সিঁড়ির এক পাশে চটি জোড়া খুলে এল। একটু বেশি নীচে নামতে হল, কেননা প্রত্যেক ধাপে একজোড়া করেই জুতো বা চটি।

বেশ শৃঙ্খলা। এই রকম ভাল লাগে তার। ছড়ানো ছিটোনো ব্যাপার তার দুটি চক্ষের বিষ। তবে হ্যাঁ বিশৃঙ্খলাও আবার। বিশৃঙ্খলা নয় বৈষম্য—যেমন তার ড্রেস।

—ফুলটা কি দিদির জন্য এনেছ?

—তোমার জন্যে নিশ্চয় নয়।

তুলি রেখে ছেলেগুলো সব ঠা—ঠা করে হেসে উঠল। ভেতরের ঘর থেকে ওরা বেরিয়ে এল—আমাদের বাদ দিয়ে কী এত হাসি মারছিস রে? ডেকে নিবি তো! এবার ভাল করে চোখ পড়ল তনিকার ওপর। দু’—তিনজন ওকে চিনতে পারল বোধহয়? শৌনক বলল—এই কাজল, ওই রুদ্ধ মানে অনিরুদ্ধ আমরা রুদ্ধ বলি, এটা গিয়াস—গিয়াসুদ্দিন বলবন আর কী! প্রাক্তন সম্রাট। আর রুদ্ধ অ্যান্ড কোং এই তনিকা। আগামী দিনে আমাদের ভাত মারতে আসছে।

—সত্যি, তনিকা তুই ‘চিত্রভানু’তে আসছিস। একটি মেয়ে বলল—কী ভাল হয়! জানিস তো এখানে আমরা মাইনরিটি। আমি আর চৈতালি ছাড়া আর কোনও মেয়ে নেই। এইবার দুই থেকে তিন হলাম।

—এক ঘড়া গঙ্গাজলে তিন ফোঁটা চোনা—কাজল বলে ছেলেটা বলে উঠল…

হংস মধ্যে বক বলতে পারতিস তো! রুদ্ধ বলল, এটাই চুজ করলি কেন?

—আরে বক, হংস, হংসবলাকা ও সব এখন রবিঠাকুর থেকে হেমন্ত মুখোর গানে ঢুকে বসে আছে। লোকসাহিত্য থেকে এইটেকে টেনে তুললাম। পোস্ট—মড বলতে পারিস।

—এই—এই—এই কাকে এত হিড়িক দিচ্ছিস রে…বলতে বলতে ওপরে উঠে এলেন অদিতি। সেই প্যান্ট আর কুর্তা। আঁকাআঁকির মধ্যে থাকলে বোধহয় উনি এমন ড্রেসই পরেন।

—আরে! অনো…দূর তনিকা…সমস্ত মুখে একটা দীপ্তি ছড়িয়ে গেল।

—আপনি আসতে বলেছিলেন…।

—এই এই—দিদিকে আপনি বলছে রে। গিয়াস বলল—এবার বোধহয় আমাদেরও পেন্নাম করবে।

—এই পেন্নাম বলতে নেই, বল কদমবুসি। পলিটিক্যালি কারেক্ট।

—চন্নামিত্তিরও খেতে পারে।—কাজল উদাসভাবে বলল।

—দিদি আমি যাচ্ছি।—তনিকা রেগে লাল হয়ে পেছন ফেরে…।

—না, না কোথায় যাবে? তাড়াতাড়ি এসে হাত ধরলেন। শরীরের ভেতরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল একটা।—ওদের কথা বাদ দাও। ওরা সব পাগল। খ্যাপা।

—শেয়ানা পাগল! তনিকা বলল, ভাবলেশহীন মুখে।

খুব একটা আনন্দের সাড়া পড়ে গেল ‘চিত্রভানু’তে।

—এই যে বাবা, পথে এসো, এতক্ষণে ‘পাস—ওয়ার্ড’টা বললে।—কাজল চোখ দুটো মজার মতো করে বলল।

—তা তুই—ও তো খ্যাপা কম না তনিকা, আর….আর…বেশ শেয়ানাও। হেসে ফেললেন অদিতি—চল তোকে সব দেখাই।

ভেতরে তিনটে ঘর, একটা পুরোই পার্মানেন্ট প্রদর্শনী এটা।

—দ্যাখ ওদের ফিনিশড ছবিগুলো এখানেই থাকে, ক্লায়েন্ট এলে দেখাই। অনেক সময়ে নিয়েও যাই।

—দিদি! অবাক চোখে তনিকা চেয়ে আছে—দেওয়ালে ওর ‘ফেলাইন মর্নিং।’

—ওটা আমাকে প্রেজেন্ট করেছেন তোমার মাস্টারমশাইরা। আমি চেয়েছিলাম। কিনতেই চাই। কিন্তু ও রকম নিয়ম বোধহয় নেই, কলেজের সম্পত্তি নাকি। ওঁরা উপহার দিয়েছেন। আর এখন আমি ওটা চড়াদামে এক ফরাসি আর্ট কালেক্টরকে বিক্রি করব..

—ফরাসি।…তনিকার চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে।

—হ্যাঁ ফরাসি। দামটা হাঁকব খুব…উনি প্রোমোটও করেন শিল্পীদের। আর ওই টাকাটা তুমি পাবে।

—আমি? আমি কেন?

—বা ওটা তো তোমারই।

এখন তো আপনার!

যদি বিক্রি করার সুযোগটা না পেতুম, তা হলে ওটা আমারই থাকত। কিন্তু ওই ভদ্রলোক—এই ডিসপ্লেটা দেখে গেছেন। বেশ কয়েকটা পছন্দ করেছেন। এদের সবার মন আজ খুব ভাল তাই। ছবিটা যেখানে ছিল চুপচাপ থেকে যেত। এবার ছবিটা দেশভ্রমণ করবে। তুমিও। নিশ্চয়। টাকাটা তোমারই প্রাপ্য।

—না, তা…।

—এ রকম গাঁইগুঁই করলে কিন্তু শুধু ছবি আঁকাই হবে তনিকা, ছবি বিকোনো হবে না। আমি যতটা আর্টিস্ট, তার চেয়ে বেশি এখন আর্ট প্রোমোটার। রাইট?

ঠিক আছে। আত্মসংযম, ডোন্টকেয়ার…সব সত্ত্বেও তনিকার মনটা ভরে যাচ্ছে। কেমন একটা ডানা মেলে শাঁ শাঁ করে উড়ে যাবার ইচ্ছে। নিজের হাতে ছবি এঁকে রোজগার! পাশ করার পর প্রথম বছরেই! এর আগে কয়েকটা ওয়ার্কশপে বা বড় কাজের মধ্যে অন্যতম শিল্পী হিসেবে কাজ করে রোজগার হয়েছে তার। কিন্তু এটা দাদা—বউদিকে একটা মস্ত চমক দেওয়া হবে। দাদার একেবারে ইচ্ছে ছিল না সে ফাইন আর্টসে আসে। কিছু না হোক অন্তত কমার্শিয়াল! কিন্তু সে জেদ ধরে ছিল। বউদিও বলে—ওর অত ভাল হাত। করুক না! এখন কিন্তু আগেকার সে সব দিন আর নেই!

সে বলেছিল—বাবা আমার বিয়ের জন্যে যে টাকাপয়সা, গয়না রেখে গেছে, সেই থেকে দে। তোকে দিতে হবে না!

—তোর বিয়ের টাকা দিয়ে তোর পড়াশোনা! আঁকাজোকা!

বউদি খুব রাগ করে…দ্যাখ তনি, তোর দাদা তোর চেয়ে অনেক বড়। বেশি চালকি করবি না।

—ইন এনি কেস, আমি তো ডাউরি দিয়ে লোক খাইয়ে বিয়ে করব না! ওসব গয়নাও আমি পরি না।

—সে তখন যা ইচ্ছে কোরো। এখন ও টাকাতে, গয়নাতে হাত দেওয়ার কথা ভুলেও উচ্চারণ কোরো না।

—বন্ধুর কী খবর?

—ভাল।

অদিতি তীক্ষ্ন চোখে তাকায়। স্বল্পভাষী মেয়েটির ওই ছোট্ট করে বলা ‘ভাল’টুকু অনেক কথা বলে। ওদের মধ্যে নির্ঘাত ঝগড়া হয়েছে। যেমন তার আর মনীষার মধ্যে হত, আর…আর… তার আর সুজানের মধ্যেও। সুজানের ভাবনা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না সে, মন থেকে ছিঁড়ে উপড়ে ফেলতে চায় ওর স্মৃতি। আশ্চর্য! ও মেয়ে, ও জানে মেয়ে সাধারণত অসহায়, তবু মেয়ের ওপরেই ওর রাগ। কেন? রাজর্ষির জায়গাটা অসাড় হয়ে গেছে, কিন্তু সুজানের জায়গাটা হয়নি। কেন? বোধহয় মেয়েদের ওপরেই বেশি ভরসা বেশি বিশ্বাস বলে।

—তোরা কাজ কর আমি একটু আসছি।

অদিতি তনিকাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

—চলো তোমাকে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যাই।

—কিছু চলছে? আপনার?

—উঁহু, ‘মাতিস’ আসছে। যেমন তোমাদের ‘লাগান’ আসে ‘শ্বশুরবাড়ি—বাপের বাড়ি’ আসে।

মিটিমিটি হাসি তার মুখে। তনিকা বলল—সত্যি?—ও তো দিল্লিতে এসেছে।

—ছিল, এবার কলকাতায় আসছে। এখনও তেমন প্রচার ঘোষণা এসব হয়নি। আমি বারণ করেছি। সিকিউরিটির কারণেও বটে।

—সিকিউরিটি বুঝলাম, তা ছাড়া?

—তুমি তো রদ্যাঁর ভিড় দেখোনি? রদ্যাঁ এসেছিল, এই বিড়লাতেই। কিউ গিয়েছিল পুরো শরৎ বসু রোড পার হয়ে। আগে থেকে জানালে লোকে হয়তো সাতদিন আগে থেকেই পোঁটলা—পুঁটলি নিয়ে বসে পড়বে।

—আমরা ও রকমই—তনিকা একটু গোঁয়ারের মতো বলল।

—অমনি গায়ে লেগে গেল? মোটেই তুমি ও রকম নয়। তুমি বেশ অহংকারী। চলো, এখন ছবিগুলো ক্রেট থেকে বেরোচ্ছে, ওই ভদ্রলোকের সঙ্গেও তোমার আলাপ করিয়ে দেব।

—কে?

—যিনি তোমার ছবিটা কিনছেন? আঁদ্রে বোর্দো।

চমকে উঠল তনিকা। অদিতি বোর্দো গুপ্ত সরকারটা তার শোনা ছিল। চমকটা চোখ এড়াল না অদিতির।

—চেনো?

মাথা নাড়ল তনিকা।

—নামটা জানো, না?

খুব জোরে মাথাটা আবার নেড়ে দিল তনিকা।

—ঠিক যেমন জানো না নিজের পদবি, ঠিকানা, নয়?—দিদি হাসছেন সে বুঝতে পারে গলার স্বরে, কিন্তু চলতে চলতে ততটা হাইটের তফাতে চকিত হাসি দেখা যায় না।

অদিতি ভাবে—এই মেয়ের গোপনতাপ্রিয়তা আর তার আকাশ—বাতাসের মতো বেআব্রু জীবন। দুটো যেন দুই মেরুতে। সে কখনও লুকোতে চায়নি আর একদা বোর্দো বা গুপ্ত পরিচয়। রাগও সে পুষে রাখতে পারে না। একটা দাগ রেখে চলে যায় রাগ, জায়গাটা অনুভূতিশূন্য, খালি শূন্য হয়ে থাকে।

বিড়লা অ্যাকাডেমির দোতলায় গ্যালারিতে কাজ চলছে। মাঝখানে বসে আছে, মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়াল জরিপ করছে আঁদ্রে। পেছন থেকে অদিতি গিয়ে পিঠে হাত রাখল।

—ওদিৎ! আঁদ্রে অ্যাবাউটটার্ন করে প্রথমেই তাকে জড়িয়ে ধরল, গালে চুমো। তারপরে তার নজর পড়ল পাশে।

—আঁদ্রে এই সেই তনিকা যার বেড়ালের ছবিটা তুমি….

—ওহ, দিস কিউতি! রিয়্যালি। শি হ্যাজ সাচ ত্রিমেন্দাস পাওয়ার!

তনিকার গালে হালকা চুমো খেল আঁদ্রে, নিচু হয়ে।

—ওকে তোমার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দিয়ে গেলাম, সাজাও তোমরা, আলাপ করো। আমি কাজ ফেলে এসেছি। তনিকা, এটা একটা মস্ত বড় সুযোগ, কাজ শেখবার। তুমি যেন না কোরো না। আঁদ্রেদার কাছ থেকে তুমি অনে—ক শিখতে পারবে।

আঁদ্রে নয়, মঁসিয়ে বোর্দো নয় আঁদ্রেদা। এত স্বাভাবিক এত সুন্দর শোনাল ডাকটা অদিতিদির মুখে! তার সমস্ত সংকোচ নতুন আলাপের আড়ষ্টতা উধাও হয়ে গেল।

—ক্রনোলজিক্যালি রাখবেন? আঁদ্রেদা?—’আঁদ্রেদা’র সংগীতটা ফুরোবার আগেই সে যেন সুরটা ধরে নিল।

—না, আমার সেটা….বেশ তো তোমার মত কী বলো? কী সহজ ভদ্রলোক। তার মতো একজন শিক্ষার্থীকে কত সহজে জিজ্ঞেস করছেন!

তনিকা একটু, খুব সামান্য থমথম খেল। তারপর বেশ স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল—আমার কোনও মত নেই। আমি তো জানি না…আপনি বলুন…।

—আমি আসলে বিষয় অনুযায়ী রাখতে চাইছিলাম।

আঁদ্রেদা কথা বলেন ইংরেজিতে, টবর্গীয় ব্যঞ্জনবর্ণগুলো নরম উচ্চারণে। কোনও ব্রিটিশ বা মার্কিন অ্যাকসেন্ট নেই। এবং সবচেয়ে মজা, খুব বাংলা শব্দ ব্যবহার করেন। আমি রিয়্যালি রাখতে চাই অ্যাকর্দিং তু বিষয়। এমনিতেই ফরাসি উচ্চারণে ইংরেজি শুনতে খুব ভাল লাগে, তার ওপর বাংলার পাঁচফোড়ন, মোহিত হয়ে যেতে হয়।

 * * *

অদিতিদি এত চেষ্টা করে সুন্দর বাংলা শিখিয়েছেন। এত সুন্দর বন্ধু, যেমন সহজ অথচ সাহসিক ব্যক্তিত্ব অদিতিদির, তেমনই মধুর অথচ বলিষ্ঠ এই আঁদ্রে বোর্দো। দু’জনে যখন কথা বলেন, আঁদ্রেদাকে কী রোম্যান্টিক লাগে, যেন ভিক্টর হুগো কিংবা আলেকজান্ডার দুমার পাতা থেকে উঠে এসেছেন। একদম প্রেমে পড়ে যাবার মতো লোক! অদিতিদি অতটা রোম্যান্টিক না হলেও, কেমন স্বচ্ছ, একটা কাকচক্ষু দিঘির মতো ব্যাপার আছে ওঁর মধ্যে। কী অদ্ভুত একটা আস্থা হয়, ভরসা হয়, কোনও বাড়াবাড়ি নেই অথচ মুহূর্তে আপন করে নিতে পারেন। তাকে কী রকম বিনা দ্বিধায় গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন! নিজের বাথরোব জামাকাপড়..সম্পূর্ণ অচেনা একটা মেয়েকে যে ঠিকানা বলতে চাইছে না। খিচুড়ি খাওয়ালেন নিজে রেঁধে। খাওয়া নিয়ে তার অত প্যানপ্যানানি নেই, কিন্তু ওঁর খিচুড়িটা খুব ভাল হয়েছিল।

কী হল দু’জনের মধ্যে? শুধু দেশের, সংস্কৃতির তফাতের জন্যই কি এমনটা হল? কিন্তু সে যতটা দেখেছে, বুঝেছে, অদিতিদি কেমন একটা আন্তর্জাতিক মানুষ। সে অবশ্য সমুদ্র পারে কখনও যায়নি, কিন্তু ফিল্মে, ডিসকভারি চ্যানেলে, বইয়ের পাতায় তো অনেক দেখেছে। শুনেছে! তার মনে হয় অদিতিদি সব জায়গায় স্বচ্ছন্দে মানিয়ে যাবেন। রেনোয়ার ‘সুইং’ ছবিটাতে আঁদ্রেদা আর অদিতিদি থাকলেও ভারী সুন্দর একটা চিত্রসংগীত রচিত হয়। সে কোনও—না—কোনও দিন তার এই আন্তর্জাতিক অনুভূতির কথা ছবিতে লিখবে। আরণ্য আলোছায়ার মধ্যে তার ভাললাগা দু’জন মানুষ। আদ্রেঁদাকে কি বাঙালি ফুলবাবু সাজাবে? কুঁচানো ধুতি আর কাঁথা—কাজ করা পাঞ্জাবিতে? উঁহু কুঁচনো ধুতিটা সামহাউ তার পছন্দ হয় না। কেমন লম্পট বাবু—বাবু দেখায়। এক কাজ করা যায়, প্যান্টের ওপর একখানা পাঞ্জাবি পরিয়ে দিলে হয়, আর দিদি? দিদি কি শাড়ি পরবেন? ‘সুইংটার গাউনের এফেক্টটা শাড়িতে আসবে ভাল। দিদিকেও প্যান্ট পরালে…না ছবিটা অন্য রকম একটা মেসেজ দেবে—ইউনিসেক্স, ইউনিসেক্স। তারা সবাই পোশাকেআশাকে এখন একলিঙ্গ হয়ে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু শাড়ির মহিমা কে অস্বীকার করবে! আঁদ্রেদার সোনালি চুলের পাশে দিদির ডার্ক ব্রাউন যা মানাবে না! যেন ‘আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা, গড়িব না।’ সত্যিই, যতই রোম্যান্টিকই দেখাক আঁদ্রেদাকে, কাজের মধ্যে এমন একটা মগ্নতা, দায়িত্ববোধ! আর দিদির? কমিটমেন্টেই যেন দিদির চেহারা বেশি খোলে! যখন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ঘোরেন, তাদের ছবি বিক্রির জন্য দৌঁড়োদৌড়ি করেন, যখন…যখন…যখন… যে সব সময়ে সে ওঁকে দেখেনি, সে সব সময়েও যেন সে দেখেছে ওঁকে। তবে এই স্বপ্নের অভীষ্ট ছবি আঁকতে হলে তাকে টেকনিক আরও আয়ত্ত করতে হবে। সে জানে তার আইডিয়া খুবই শক্তিশালী, রং—ও তাই, রঙের ব্যবহার নিয়ে তার নিজের প্রতি কোনও নালিশ নেই। কিন্তু টেকনিক। টেকনিক আরও শিখতে হবে। কোথায়, কোথায় সোজাসুজি ক্ল্যাসিক্সগুলোর কপি করতে পারবে? নিউ ইয়র্ক? ন্যাশানাল আর্ট? নাকি সুবিখ্যাত স্মিথসোনিয়ান? নাকি বিখ্যাততম, চিত্রকরের স্বপ্ন ল্যুভ? ভেতর থেকে একটা লকলকে উৎসাহ আর আনন্দের শিখা বেরিয়ে আসে।

—মাতিস সম্পর্কে তোমার রেসপন্স কী, তনিকা?—আঁদ্রেদা জিজ্ঞেস করলেন।

—দেখো, মাতিস তো আসলে একজনই। কেউ সেভাবে ওঁকে ফলো করেনি, যেমন করেছিল মানের ইমপ্রেশনিজম, পিকাসোর কিউবিজম। যদিও ব্রাক বা পিকাসো তাঁদের কিউবিস্ট ছবিকে পরীক্ষা—নিরীক্ষার বেশি গুরুত্ব দিতে চাননি, তবু পৃথিবী ভরে গেল কিউবিস্ট ছবিতে। এদিকে মাতিস বেচারি! সত্যিকারের মৌলিক শিল্পী, চাপা পড়ে গেলেন জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের তলায়।

—সেটা তো ভালই আঁদ্রেদা। ওঁকে কেউ নকল করল না, উনি অদ্বিতীয় রয়ে গেলেন।

—সত্যিই রইলেন কি? আঁদ্রেদা মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন।

তনিকার মুখটা একটু লাল হল—আমার ছবিটা কি একেবারেই মাতিসের কপি হয়েছে?

—আরে না না, একেবারেই না। টেম্পারামেন্টের দিক থেকে তোমার মাতিসের সঙ্গে মিল। দেখো, এ রকম হয়েই থাকে, খুব বন্যভাবে রং ব্যবহার করেছ, উগ্রতা আছে। বিদ্রোহ আছে চিৎকারও আছে, কিন্তু তুমি জানো তুমি কী করছ। তোমার নিয়ন্ত্রণ একেবারে চমৎকার। তবে কী জানো, মাতিস এই সময়ে আবার সমাধি থেকে উত্থিত হচ্ছেন।

ক্রেট থেকে ছবি নেমেছে অনেকগুলো। আঁদ্রেদা তুলে নিলেন ‘জিপসি ওম্যান’। চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

—লেৎ আস স্তার্ত উইথা ব্যাং, কী বলো? আঁদ্রেদা ওর অভিভূত মুখের দিকে চেয়ে বললেন।

 সবুজ, হলুদ, লাল, নীল, সাদা কালো কী নেই এই একখানা আবক্ষ ছবিতে। বাঁকা হাসি, ফুল্ল চোখ। একই সঙ্গে যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আবার উপহাস করছে। মোটা মোটা পোঁচড় রঙের। যাযাবর জীবনের বর্ণময় উৎসবে ভরতি ছবি।

—এরপর কি একটা নরম রঙের ছবি দেব, তনিকা?

—না আঁদ্রেদা, এই রকমই পোট্রেট—টাইপ দিন। জিপসিটা দেখলে আরও আরও রং—চং—সঙের জন্য খিদে জাগবে। অন্তত আমার।

—ওয়েল, এই প্রদর্শনী শুধু তোমারই জন্যে হোক। বলে আঁদ্রে বোর্দো বাছলেন।

—আ ওম্যান উইথ আ হ্যাট। টুপি কী? রঙের ফোয়ারা।

—দেখো এবার মাদাম মাতিসের ছবি রাখছি। তারপর অঁরি মাতিসের সেলফ পোর্ট্রেট।

লাল পোশাক—পরা ঘন নীল চুলের ব্যক্তিত্বশালিনী মাদাম যাঁর অর্ধেক মুখে গোলাপি উদ্ভাস, বাকি অর্ধেকে সবুজ হলুদ।

মাতিসের নীল সবুজের সংগীতপূর্ণ আত্মপ্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তনিকা বলল—উনি নিজেকে স্বপ্নের মতো, দূরের ভাবুক দেখতেন কিন্তু আঁদ্রেদা। আর দেখুন এই যে দির্যাঁর পোর্ট্রেট এঁকেছেন এর মধ্যে কিন্তু আবার জিপসির বর্ণোৎসব ফিরে এসেছে। খানিকটা মুখোশ—মুখোশ ব্যাপার।

—বর্ণোৎসব, আঁদ্রে চেষ্টা করে উচ্চারণ করেন, সেটা কী?

—বর্ণ তো আপনি জানেন, তারপর উৎসব, সন্ধি হয়ে গেছে, ফরাসিদের তো সন্ধি চট করে ধরতে পারার কথা।

—ঠিক…বলতে বলতে আরও দুটি বিখ্যাত ছবি বেরোলে—’লাক্সারি:কাম অ্যান্ড ভোলাপচুয়াস,’ এবং ‘ওম্যান উই থা প্যারাসল’। প্রথমটা সমুদ্রতীর। মহিলারা নানা ভঙ্গিতে কেউ ভিজে চুল উঁচু করে সামনের দিকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। কেউ হাত ফিরিয়ে বাঁধবার উদ্যোগ করেছেন। কেউ শুয়ে আছেন পাশ ফিরে হাতের ওপর ভর, চূড়ান্ত শৈথিল্য…পিকনিকের আয়োজন…এইভাবেই বার হল—’হার্মনি ইন রেড’, ‘স্টিল লাইফ ইন ভেনিশিয়ান রেড’, ‘রেড অনিয়নস’—কোথাও রঙের নিমন্ত্রিত হোলি, কোথাও স্বপ্নিল পশ্চাৎপটে আঁচড় দিয়ে দিয়ে রঙের বিন্যাস।

চারপাশে রং, শুধু রং। তার মাথার চিন্তাগুলো সুদ্ধু রঙিন হয়ে যাচ্ছে। নীল হতাশা, সবুজে—লালে অনন্ত ঊর্ধ্বে ওঠার আর্তি, ধূপছায়া রঙের প্রেমাকাঙ্ক্ষা তার। প্রত্যেকটি চিন্তা, মনোভঙ্গি, মেজাজের রং সে চিনতে পারছিল আলাদা আলাদা করে। এভাবে এত কাছ থেকে এত নিভৃতে একজন সত্যিকার রসিক ও বোদ্ধার সঙ্গে ছবি দেখা, মৌলিক ছবি একেবারে! মাত্রাটাই আলাদা। মাতিসের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে এ সব ক্যানভাসে, এ এক অলৌকিক অনুভূতি। কী আশ্চর্য এই আঁদ্রেদা, কোয়াইট ডেফিনিটলি এখন থেকে রুদ্রাংশুরা আউট, আঁদ্রেদা প্রবল ভাবে ইন। ভাস্কর চক্রবর্তী ফুঃ, অদিতি সরকার ওহ ফ্যানটাস্টিক। ওরা সব ঠিকঠাক শিল্পী নয়। ছন্দ মিল আয়ত্ত করলেই যেমন কবিতা হয় না, ড্রয়িং আর রং লাগাবার টেকনিক জানা থাকলেই তেমন শিল্পী হয় না। তার মনের গভীরে কোথাও বিশ্বাস আছে সে মৌলিক এবং সে শিল্পী। স্তর কী সেটা আলাদা কথা, কিন্তু সে শিল্পী। না হলে এমন চিত্রময় কেন তার জগৎ! এই যে কিছুক্ষণ আগে ‘চিত্রভানু’তে দেখে এল দৃশ্যটা! চার—পাঁচটি ছেলে তন্ময় হয়ে ইজেলের সামনে। এই ছবিটা এখনও তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চুলোয় বাক ড্রয়িং, সে মোটা মোটা ব্রাশ—স্ট্রোক দিয়ে বহুবর্ণ করে আঁকবে ওই ছবি আঁকার ছবি। শৌনক পেছন ফিরে, কাজলের তদগত পাশ মুখ, গিয়াস রং মেশাচ্ছে, অনিরুদ্ধই বোধহয়, সিলিংয়ের দিকে মুখ। কিছু ভাবছে, হাতে উদ্যত তুলি যেন উদ্যত রিভলভার। একটা বিস্ফোরক ছবি। কেন বিস্ফোরক! সে জানে না। যা—ই আঁকুক তার মধ্যে একটা প্রবল আত্মঘোষণা থাকে তার, যেন কুরুক্ষেত্র শুরু হবে পাঞ্চজন্য বাজছে, নেপোলিয়নের সঙ্গে জারের যুদ্ধ রণতুর্য বাজছে, বিউগলের আকাশফাটানো নৃশংস সুর। এত চড়া সুর কি হওয়া খারাপ! আড়চোখে দির্যাঁর পোর্ট্রেটা দেখে সে, ‘জিপসি’টা দেখে। কোথায় একটা তুমুল সমর্থন, একটা উত্তাল উদ্বেল ভরসা পেতে থাকে। এমন একটা আলোড়ন, যা তার মনে অস্পষ্ট দ্বিধা—দ্বন্দ্বগুলোর সামনে দাঁড় করিয়ে সম্মুখযুদ্ধে আহ্বান করে তাদের। চোখ দুটো কাচ—চকচক হয়ে ওঠে। চোখ লুকোতে সে ক্রোটের পরবর্তী ছবিগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ে, সাবধানে।

—ছবিতে তিয়ার্স পড়লে কিন্তু মিলিয়ন দলার্স ফাইন।

তনিকা ঝট করে মুখটা ফিরিয়ে নেয়। লজ্জা পেয়ে যায় খুব কিন্তু উত্তেজনাময় আবেগের চুড়ো থেকে তক্ষুনি নামতে পারে না। খুব লজ্জার সঙ্গে রুমাল বার করে, জানলার দিকে চলে যেতে থাকে। কী হবে, কী বলবে আঁদ্রেদা যদি কিছু জিজ্ঞেস করেন। এই কান্নার মধ্যে কি আঁদ্রে বোর্দোও নেই! অদিতি সরকারও নেই! দুটো দারুণ জোরালো চুম্বক—ব্যক্তিত্ব যা তাকে লোহাচুরের মতো টেনে নিচ্ছে অন্য এক আবহমণ্ডলে।

কিন্তু আঁদ্রে বোর্দ্রো কিছুই জিজ্ঞেস করেন না। মহৎ এবং প্যাশনেট শিল্পের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের ভেতরের নিরুদ্ধ আবেগ এভাবে বেরিয়ে আসে কিন্তু জানেন। ভ্যান গগ—এর সানফ্লাওয়ার্স চাক্ষুস দেখার পর, পিকাসোর গ্যেরনিকা প্রত্যক্ষ করার পর কি তিনি কাঁদেননি! হতে পারে এই কান্নার মধ্যে মেয়েটির কোনও ব্যক্তিগত দুঃখও আছে, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। ছবি আর দর্শকের মধ্যে একটা নিরন্তর দেওয়া—নেওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ছবি দিচ্ছে, এটা তো বোঝাই যায়, কিন্তু প্রত্যেকটি সমঝদার দর্শকও কিছু দিয়ে যায় ছবিকে, তাদের স্ফুরণের ঐশ্বর্যে আরও মণ্ডিত হয়ে ওঠে ছবি, যেমন অজন্তা হয়েছে, মুঘল মিনিয়েচার হয়েছে। দিল্লি থেকে কতদূর অজন্তা। কিন্তু তিনি তো না দেখে থাকতে পারেননি। আর সেই ক্ষীয়মাণ অলৌকিক শিল্পের সামনে দাঁড়িয়ে জলের ধারা বয়েছিল অঝোরে।

অনেকদিন আগে, অদিতি গুপ্তর একটা ছবি দেখেছিলেন, কোনও প্রদর্শনীতে। শুধু কতকগুলো বলিষ্ঠ রঙিন রেখায় আঁকা সঙ্গমী নরনারী, নারীর মুখ পাশ ফেরানো। একটি মাত্র বিরাট চোখ, দৃষ্টি অনুসরণ করলে দেখা যায় বেশ কিছু ভারতীয় পাম, যাদের বলে কোকোনাট পাম, পেছনে ম্লান তারার দল ঝরে পড়ছে। ‘দা পাম—লাভার’। লাভার্স নয়, লাভার। অর্থাৎ পামের দিকে নিবদ্ধদৃষ্টি মেয়েটিই ওই ছবির বিষয়, সঙ্গম নয়, পুরুষও নয়। মেয়েটি যেন বলছে, তুমি যখন শরীর নিয়ে এমন উন্মাদ, তখন আমি কেন পাম—যূথের দিকে, অস্ফুট তারাদের দিকে কাতর চেয়ে থাকি, কখনও ভাবো কি? সেবারও তার সোনালি গাল বেয়ে নেমে এসেছিল জলের ধারা। পুরুষ ও নারীর যৌনতার মধ্যে কী বিশাল ফারাক—ছবিটা ছন্দে বলেছিল। ছন্দে এবং ছন্দোভঙ্গে। চেষ্টা করেও ছবিটা কিনতে পারেনি সে। কোনও সুইডিশ আর্ট কালেক্টরের কাছে আগেই চলে গিয়েছিল।

—হয়তো স্পষ্ট জানি না, কিন্তু কুয়াশার মতো বুঝি ওদিৎ কেন তুমি অমন সময়ে পামগুচ্ছ আর তারার দিকে তাকিয়ে থাকো। তুমি আর তোমার মতো মেয়েরা।

সন্তর্পণে গলার আর্দ্রতা মুছে নিয়ে তনিকা বলল—আঁদ্রেদা, আপনি কি মনে করেন আমার ড্রয়িং নিয়ে আরও মাথা ঘামানো উচিত? বন্ধুরাও কেউ কেউ কেউ বলে রং চাপিয়ে আমি ড্রয়িংয়ের উইকনেস ঢাকি?

—তনিকা। আমি কিন্তু শিক্ষক জাতীয় নই। তোমার সৃজনের মধ্যে যদি সত্যি সৃষ্টি থাকে তা হলে আর ভাববার দরকার নেই। ও সব প্রি—ইমপ্রেশনিজম—এর যুগের ভাবনা। তবে একটা কথা, পিকাসো, ব্রাক বা মাতিসেরও দ্রয়িং কিন্তু খুব খুব স্ত্রং।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *