ঝড়ের খেয়া – ১

এক

মেয়েটা নিপাট ভিজছিল।

পেছনে ক্রমশ হাইজ্যাক হয়ে যেতে থাকা ময়দান।

সামনে গ্র্যান্ড হোটেল, আরও কিছু গ্র্যান্ড দোকান পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত।

পুব থেকে এক একটা প্রবল অথচ সূক্ষ্মবিন্দু বায়ুতাড়িত বৃষ্টির ঝাপটা আসে, আর সমস্ত জলরঙের ইমপ্রেশনিজম হয়ে যায়।

অজস্র গাডি, মিনিবাস, সারাই হতে থাকা রাস্তার টিনের উঁচু ঘের, বিপদে পড়া পিঁপড়ের মতো ছত্রভঙ্গ পদাতিকের দল। সমস্তটাই জঙ্গম।

গাড়িগুলো থেমে আছে। ট্র্যাফিক লাইটে। কিন্তু জঙ্গমতা তাদের যন্ত্র—শরীরে উন্মুখ যেমন উড়ব—উড়ব পাখির শরীরে থাকে।

একমাত্র স্থাবর বিন্দু কতকগুলো ডাকাতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে যাওয়া গাছ।

আর ওই ফুটকি।

দুটো ঝাপটার হাইফেন—পথে বোঝা যাচ্ছে ওর অঙ্গে সালোয়ার কামিজ। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। বাস। আর কিচ্ছু না এবং কেউ না।

এত বড় করে ক্যানভাসটা আঁকবার দরকার ছিল না। এক ফুটকি তো একটা মেয়ে! কিন্তু ওই যে টলস্টয় একটা অর্ধসত্য বলে গিয়েছিলেন। মানুষের নাকি সাড়ে তিন হাত জায়গা লাগে। আরে সে তো কফিনের মাপ, শবের মাপ! জীবিত, জ্যান্ত, জিয়ল মানুষকে গোটা পৃথিবীটা ধরে দিলেও অনেক সময়ে কম পড়ে যায়। কার কতটা জায়গা লাগবে বলতে পারে সে যার জায়গা লাগবে, এবং হয়তো আরও ভাল করে সে যে তাকে দেখে, তার প্রয়োজনের চেহারাটা ছবির মতো ফুটে উঠতে দেখে। যেমন আজকে অদিতি দেখছিল। এই হট্টগোলময় কেজো যন্ত্রজগৎ, ওই খাবলা খাবলা ময়দান, রম্য প্রাসাদের এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত প্রভুত্ব, জ্যাম—জট, অক্টারলনি—শহীদ মিনার, এই ঝরো ঝরো ঝরিছে—সব সব দরকার ছিল একটা একফোঁটা মেয়ের চুপচাপ নিপাট ভেজার দৃশ্যটা দেখবার জন্য, বোঝবার জন্য।

স্টিয়ারিং হাতে অদিতির চোখে কেমন একটা ঘোর লেগে যায়। ব্লচ, ব্লচ, ব্লচ, ওয়শ, ওয়শ। প্রায় নীল—সাদার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রায়—সবুজ, প্রায়—ধূসর, প্রায়—সাদা এবং আরও প্রায়—রং। মিশে যাচ্ছে, ধুয়ে যাচ্ছে, তবু থাকছে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে অস্থির জলের তলার প্রতিবিম্বের মতো। ওই কম্পমান প্রতিবিম্বের মূল্য যেমন তার উপকরণের মিশ্র—বহুতায়, ঠিক তেমনই ওই একফোঁটা নিশ্চলতায়। ওটাই কেন্দ্রবিন্দু। যদিও সত্যি—সত্যি ও কেন্দ্রে নেই, একটু ডান দিকে সরে আছে। তাতেও ওর কেন্দ্রীয়ত্ব থেকে কিছু কম পড়ছে না।

হঠাৎ ঘোর কেটে যায়, এক্ষুনি ট্র্যাফিক লাইট বদলাবে। বাঁ দিকের ধোঁয়াটে কাচটা ঝুঁকে পড়ে নামাল সে—তাড়াতাড়ি উঠে এসো, উঠে এসো শিগগিরই।

ঝাপসা চোখ—মুখ, কেমন, কোথাকার, কী বৃত্তান্ত কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে ফিরেছে।

শিগগির উঠে এসো—বিপজ্জনকভাবে দরজা খুলে ধরে অদিতি। সালোয়ার পায়ে সেঁটে গেছে। কাঁধ বেয়ে ভিজে চুল, চুপচুপে। এক পা, দু’পা করে এগিয়ে এল—আমাকে বলছেন?

—আর কাকে?

—আমি তো…

—আগে তো উঠে এসো, তো—টো পরে হবে। কুইক।

কেমন একটা অগত্যা—ভঙ্গিতে উঠে এল। মোটেই বাব্বাঃ বাঁচা গেল ভঙ্গিতে নয়। খুলে—ধরা দরজাটার বাধ্যতামূলকতার ফাঁদে পড়ে যেন। চালিকার মান রাখতে, বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে। তেমন করে ডাকতে পারলে উঠে আসবেই এই বিশ্বাস।

আস্তে আস্তে ছাড়ছে, অদিতি প্রস্তুত, সমস্ত মনোযোগ সামনে, কানে এল—আপনার গাড়ি তো নদী হয়ে গেল।

—তুমি নিজেও তো নদী হয়ে গেছ। ঘাড় না ফিরিয়ে সে জবাব দেয়।

—সত্যি বলছেন? কেমন একটা খুশির হাসি চমকে উঠল গলা থেকে। ও কি নদী টদি হতে চেয়েছিল নাকি? কোনও কোনও মানুষের আবার মানব—অস্তিত্বকে বড় সীমাবদ্ধ মনে হয়। তারা কেউ রোদ্দুর হতে চায়, কেউ আকাশ হতে চায়, কেউ ঝরনা, এ মেয়েটি তা হলে নদী হতে চাওয়া, সীমাবদ্ধ—মানবতা থেকে মুক্তি পেতে চাওয়া কোনও মানুষ। নাকি অদিতি একটু বেশিই ভেবে ফেলছে।

—তোমাকে কোথায় নামাব?

—তুললেন কেন? মানে তুললেনই বা কেন?

—আচ্ছা—এবার সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের ভেতর ঢুকে পড়া গেছে। অতএব ফিরে তাকাবার একটু অবসর। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে অল্প বয়সের নিশ্ছিদ্র মসৃণ, শপশপে ভিজে চুল সেঁটে গেছে মাথার সঙ্গে। লেপটে আছে। কানে, কপালে। বেশ লম্বা চুল, তলার দিকটা কেমন কোঁকড়া মতো, এত ভিজেও যখন সোজা হয়নি, তখন পার্লারি নয়।

—একা একা ভিজছ। আকাশ থেকে তো গোটা গঙ্গা—গোদাবরীই ঢালছে মনে হচ্ছে, তুলব না?

—বা, বিপদে পড়তে পারেন না?

—এখনও সন্ধে হতে দেরি। ছেলে—ছোকরাও নয়, তুলতে অসুবিধে কী? পিস্তলধারিণী বালিকা দেখতে আমার এখনও বাকি আছে।

পাশ থেকে একটা ছোট্ট হাসি এল।

—কোনও ভদ্রলোকের গাড়িতে উঠতে কিন্তু তোমাকেও ভাবতে হত। অপর পক্ষে ভদ্রলোককেও। এ ক্ষেত্রে সে সব ঝামেলা নেই…যাক তোমাকে কোথায়…।

—এখানেই নামিয়ে দিন না, একটু বাঁ দিক ঘেঁষে রাখুন…আমি নেমে যাচ্ছি।

—আশ্চর্য, অমনি তোমার রাগ হয়ে গেল। আমি কি তোমাকে যেখানে—সেখানে নামতে বলেছি। তোমার বাড়ি বা গন্তব্য, যাই হোক, সেখানেই নামাব। এখানে পথের মাঝখানে! বৃষ্টি তো তুমুল।

—তাতে কী হয়েছে।

এবার হেসে উঠল, বেশ শব্দটা হাসির। বলল, নামাবেন কোথায়? আমি তো এদিকে থাকিই না!

—তবে?

—সাউথে। আপনি নর্থে না ইস্টে?

—নর্থ। তুমিও তো নর্থের দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়েছিলে…যা ভিজেছ এ অবস্থায় বাড়ি ছাড়া আর কিছুর কথা কেউ ভাবে না… ন্যাচারালি…আমিও …

—আপনি তা হলে বাড়ি ফিরছেন?

—হ্যাঁ। কেন?

—যদি অসুবিধে না হয় আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবেন?

ভেতরে ভেতরে খুব চমকে গেল অদিতি। বলে কী? পাগলটাগল নয় তো? কিংবা ডাকাতদলের চর?

নিজের ভাবনায় অবশ্য নিজেরই হাসি পেয়ে গেল তার।

পাগল এ নয়। অন্তত পুরো পাগল তো নয়ই। সিকি পাগল হলেও হতে পারে। আর ডাকাতদল? ডাকাতদলের চরণী এমন যোগসাজশ করল যে তাকে গাড়ি থামাতে হল। চরণীর কোনও আবেদন ছাড়াই তাকে তুলতে হল। সে ক্ষেত্রে তো রীতিমতো লং ডিস্ট্যান্স সম্মোহন প্র্যাকটিস করতে হয় এই খুদে ডাকাতকে। নয়তো ম্যাজিক। সেই তাসের খেলা আছে না। তোমাকে যে—কোনও একটা তাস টানতে বলবে। কিন্তু পুশ করার এমনই কায়দা যে ম্যাজিশিয়ানের চেনা তাসটাই তুমি টানবে!

—তোমার যদি কোনও অসুবিধে না থাকে, আমারও নেই। তবে আমার কিন্তু বাড়ি—ভরতি লোক। একটা বিছানা তোমাকে দিতে পারব, কিন্তু তেমন প্রাইভেসি হয়তো…অনেকের আবার খুব কৌতূহলও।

আবার একটু ছোট্ট হাসি, বলল, আমার সবকিছু অভ্যেস আছে।

—বেশ।

লাল আলো, হাঁড়ল হাঁড়ল গর্ত। বৃষ্টিতে চটা—উঠে—যাওয়া রাস্তা, রোড বাম্প। বেজায়গা দিয়ে পার হতে থাকা বেআক্কিলে। ভাববার আর সময় নেই। তলিয়ে ভাবতে গেলে সামনের গাড়ির বাম্পারে নির্ঘাত ভিড়িয়ে দেবে। তাই ওপর—মন দিয়ে খুব আলতো করে ছাড়া ছাড়া ভাবতে লাগল সে।

ট্রপিক্যাল—মেডিসিন এসে গেছে…এককথায় রাজি হয়ে গেল সে? ডান দিকের ঝুপড়িতে গরম গরম ভাঁড়ের চা খাচ্ছে কিছু কুলি শ্রেণীর লোক। ঝুপড়িটা কিছুটা তেরপলের, কিছুটা প্লাস্টিকের, ভেতরে উনুনের গনগনে আঁচ। তার আলোয় এক থুত্থুড়ে বুড়ির মুখ, চা খাচ্ছে। এই ইয়াং কুলিদের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক? মা? না ও—ই চা—ওয়ালি। উনুনের ধারে বসে রয়েছে যখন। আপাদমস্তক কালো একটা বিরাট কেটলির ঢাকনাটা খুলে ভেতরে একটু গুঁড়ো দুধ ছিটিয়ে দিল…একটা অজানা অচেনা উটকো, কিছুর মধ্যে কিছু নেই ভিজছে। সাউথে থাকে বলছে। অথচ ডেফিনিটলি নর্থের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল… ফলঅলা পলিথিনে ঢাকা ফলের ঝুড়ি সরাতে গিয়ে কাত করে ফেলেছে, পেভমেন্টে গড়াচ্ছে মুসাম্বি…আপেল—দুটো ভিজে—কাক বাচ্চা হেসে লুটোপুটি… চৌরঙ্গিতে একা একা ভিজছে…গন্তব্য নেই…খুব গোলমেলে কিছু হলে? মেয়েটা যদি তার বাড়িতে গিয়ে সুইসাইডফাইড করে? ‘হ্যাঁ’ বলল কেন? কেন সে রাজি হল? নিঃসংকোচ চাওয়ার জবাবে অন্য কিছু বলতে পারেনি। তাই?

হবেও বা। এ কথা সত্যি যে সে অনুরোধ এড়াতে পারে না। দুম করে মুখের ওপর এ রকম একটা অনুরোধ কেউ করতে পারে, সেটাই ধারণায় ছিল না। এই না গাড়িতেই উঠতেই চাইছিলি না! উঠতে—না—উঠতেই একেবারে গেস্ট হওয়ার অনুরোধ? অনুরোধও নয়। যেন প্রচ্ছন্ন দাবি! বসতে পেলে শুতে চায়।

হঠাৎ সে বেকায়দায় পড়ে গেছে।

হেদুয়া পেরিয়ে যাচ্ছে, এপারে বেথুন ওপারে স্কটিশ চার্চ।

—এ জায়গাটা চেনো?

হাসছে।—আপনি আমাকে কী ভাবেন?

—কোথায় পড়াশুনো করেছ?

—এখানে নয়।

প্রত্যেকটি কথার জবাব এড়িয়ে যাচ্ছে।

—বাড়ি থেকে পালিয়েছ নাকি বলো তো! মুখে একটা হালকা হাসি টেনে অদিতি ছুঁড়ে দিল, সে খুব ভাবিত। এই খুব—ভাবনাটা যেন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে।

—তা হলে তো আপনাকে আবার গাড়ি ঘুরোতে হয়।

—কেন?

—ভবানী ভবন? বাড়ি পালানোদের তো সেখানেই—খুঁক খুঁক করে হাসতে লাগল। ফাজিল খুব।

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামল গাড়িটা।

—নামো, এসে গেছি—অদিতি বলল।

রাস্তাটা কচ্ছপের পিঠের মতো, ধারে স্রোতের মতো জল বইছে। ওপরেও হালকা জল। তবে বৃষ্টি যেভাবে চলছে তাতে শিগগিরই ডুবে যাবে, কোনও সন্দেহ নেই।

—তুমি চট করে সিঁড়িটায় উঠে সদর দরজার কাছে দাঁড়াও। আমি গাড়িটা গ্যারাজ করে আসছি।

বহুকালের পুরনো বাড়ি। একশো বছর হবে বোধহয়। বয়স সঠিক হিসেব করতে হলে ঠিকুজি নিয়ে বসতে হয়। বাইরের ঝুল—বারান্দাগুলোর লোহার ফ্রেম তুবড়ে মরচে মেখে একেক্কার। তিনতলা বিরাট বাড়িটার গায়ে আগাগোড়া খোসপাঁচড়ার মতো ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া দাগ। কোথাও চটা উঠে যাওয়া, কোথাও চুনবালির চাঙড় খসে পড়া, কোথাও আবার স্রেফ বৃষ্টিটিষ্টির একটা কালচে শ্যাওলা ছাপ। কতদিন সারাই—ঝালাই হয়নি, কে জানে! খুব ছোটবেলায় একবার সব খসিয়ে নতুন করে দেয়ালটেয়াল হয়েছিল আবছা মনে পড়ে। বালি দিয়ে খেলার স্মৃতিটা একটা ছোট্ট লাল টিপের মতো মনের ভেতরে।

—চলো। অদিতি বুঝতে পারছে অদিতির সঙ্গে বাড়িটাকে মেলাতে পারছে না খুদেটা। মনে মনে সে খুব খানিকটা হেসে নিল।

ভেতরে ঢুকে, একটু বাঁয়ে একটা চৌকোনা বড় উঠোন, মাটির, তাতে গুচ্ছের আগাছা, শ্যাওলার ওপর যদি পা পড়ে তো হড়াস। একটা মাঝারি সাইজের হৃষ্টপুষ্ট ছাতিম গাছ। পাশেই নিমের পাতা বৃষ্টিতে ঝুরছে। উঠোনের তিন দিক দিয়ে বাড়িটা উঁচিয়ে উঠেছে, নিম—ছাতিমের মগডাল ছাড়িয়ে। উঠোনের চারপাশে চওড়া রোয়াক। বাঁ দিকে ঘুরেই সেকেলে কাঠের সিঁড়ি। ওদের পাশ দিয়ে দুটো হুলো বেড়াল তীব্র গতিতে ফ্যাঁশশ আওয়াজ করে নেমে গেল। এক্ষুনি বৃষ্টিটা থেমে গেলেই উঠোনটাতে ধুন্ধুমার ঝগড়া শুরু করবে। হুলো দুটোর অহি—নকুল সম্পর্ক।

দোতলায় উঠে কোলাপসিবলের তালা খুলল সে। কোলাপসিবলের পেছনে দরজাটা সাবেক নয়। চাবি ঘুরিয়ে খুলল—এসো।

তার বারান্দার লাল সিমেন্ট জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে। কিন্তু বাকিটুকু অদ্ভুত চকচকে। বাঁ দিকে কিছুটা গিয়ে একটা দরজার তালা খুলল অদিতি। হেসে উঠল ভেতরটা।

ফুটকি বলল—আপনি ভাল ড্রাইভ করেন না।

—শোনো এ ঘর থেকে বেরিয়ে ডান দিকের দরজাটাই বাথরুম। তোয়ালেটোয়ালে আছে। আমার একটা বাথরোব আছে—কাচা। শুকনো হয়ে নাও। ওটা পরতে পারো। আমি একটু আসছি।

এই সময়ে কালো কি ছবি কাউকে পাওয়া গেলে ভাল হত। কিন্তু এই বৃষ্টিতে কোনও আশাই নেই। অন্য হাতের তৈরি চা খাওয়ার বিলাস আজ হবার জো নেই। রান্নাঘরে গিয়ে অতএব কফির জল—দুধ চাপাল গ্যাসে। তারপর সিঙ্কে ভাল করে হাত ধুতে লাগল। রান্নাঘরটা খুবই বড়। আসলে তো এটা রান্নাঘর নয়, শোবারই ঘর। ছোটকাকুর। অবিবাহিত ছোটকাকুর ঘরটা আদরের ভাইঝির ভাগে পড়েছে। এটা খাবার ঘরও। পাথরের টপওয়ালা গোল টেবিলের চার পাশে তিনটে চেয়ার। টেবিলটা প্রাচীন, চেয়ারগুলো আধুনিক।

চিঁড়ে—বাদাম—কাঠি ভাজার সাড়েবত্রিশ ভাজাটা একটা বড় স্টিলের বাটিতে ঢালল অদিতি। স্টিলের পটে কফি, দুটো কাপ—ডিশ, দুটো বড় চামচ।

ফুটকি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। একেবারে মাঝখানে, গোল জাজিমটার ওপর, চারপায়া সেন্টার টেবিলটার পাশে। এ রকম জায়গায় দাঁড়াবার একটাই মানে হয়। পাখাটা পাওয়া। কিন্তু ও চালায়ইনি। অদিতি টেবিলের ওপর ট্রেটা রেখে বলল—ফ্যানের সুইচটা ওই দিকে দরজার পাশে। চুলটা ভাল করে মুছেছ? তবে আমার ড্রায়ার আছে, চট করে তো শুকোবে না, আগে খেয়ে নাও একটু…ঠান্ডা হয়ে যাবে। বসো।

গোলাপি তোয়ালের বাথরোবের মধ্যে ছোট্ট শরীরটা ডুবে গেছে, ভিজে চুলের গোছায় মুখটা প্রায় ঢাকা। বসল। এখনও সেই অগত্যা ভঙ্গিতে।

—তোমাকে ক’ চামচ?

—যা হোক।

কফি ঢেলে কাপটা এগিয়ে দিতে হঠাৎ বলল—আমার ভিজতে ভাল লাগছিল।

—তাই? রাগ করেছ?

—না, তা নয়, এটাও বেশ ভাল।

একমুঠো চিঁড়েভাজা মুখে পুরে অদিতি বলল—চামচটামচ দিয়ে মুড়ি—চিঁড়েভাজা পোষায় না। যাই বলো। মুঠো করে তুলে মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে এক ধাক্কায় চালান করে দিতে হয় ভেতরে। তুমি কী বলো? খাও! আচ্ছা তো।

একটু নিল, চামচ করে। এক চুমুক কফি।

—ভাল হয়েছে কফিটা?

—কী জানি, ভাল—মন্দ কিছু বুঝতে পারছি না।

মানুষ তো ভদ্রতার খাতিরেও ভালটাল বলে! এর সে বালাই নেই।

—তোমার জামা কাপড়গুলো মেলে দিয়েছ তো? ভাল করে নিংড়ে?

—হ্যাঁ বাথরুমে একটা রড ছিল।

—সে কী! বাইরে বারান্দায় দেখছ না? কত বড় দড়ি টাঙানো রয়েছে। ওইখানে দাও। হাওয়ায় শুকিয়ে যাবে।

—কালকের আগে শুকোচ্ছে না।

অদিতি মনে মনে ভাবল—যাক, কমনসেন্স ফিরে আসছে তা হলে।

মুখে বলল—জলটা টেনে যাক, তারপর ঝেড়ে ইস্ত্রি করে দেব। আমার শাড়ি বার করে দিচ্ছি, যদিও ব্লাউজ তোমার হবে না। পরে, কাঁধের ওপর দিয়ে টেনে নিতে পারো। ওটা অবশ্য ফ্যাশনেবল নয়, আই নো।

কোনও উত্তর দিল না। আনমনে চিঁড়েভাজা খেয়ে যেতে লাগল। মাঝে মাঝেই কফিতে লম্বা চুমুক। এবার বোধহয় আরাম লাগছে কফিটা খেতে। কিছু জিজ্ঞেস না করেই ওর কাপে আর একটু ঢেলে দিল, চিনি দিল, নিজেও নিল।

এই সময়ে আবার দ্বিগুণ জোরে একেবারে ঝমাঝঝম শব্দে বৃষ্টি নামল। বিরাট একটা বাজের ডাক আকাশের এ মোড় থেকে ও মোড় পর্যন্ত গড়িয়ে গেল। পরক্ষণেই চোখ—ঝলসানো ঝিলিক ঢুকল ঘরের ভেতর।

—আজ কলকাতা ভেসে যাবে—অদিতি উঠে গিয়ে আকাশের দিকে তাকাল—জানলা ভরতি কালো মেঘ। নড়বার লক্ষণ দেখছি না। ফিরে বলল ইশ। কী করে যাবে?

—যেভাবে এসেছিলাম…

—আমি তোমাকে একটা ছাতা দিতে পারি। শাড়িটাড়িও…কিন্তু এ বৃষ্টিতে কি ছাতা কোনও কাজে লাগবে?

—ওসব দরকার নেই।

—তার মানে?

—চলে যাব ঠিক।

—আমি কিন্তু তোমাকে চলে যাবার কোনও ইঙ্গিত টিঙ্গিত দিইনি। ডোন্ট মিসান্ডার্স্ট্যান্ড মি। এই সাঙ্ঘাতিক বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কেউ কোথাও যেতে পারে না। জল যা জমেছে, হাঁটু পর্যন্ত। তুমি যা পলকা। জল ঠেলতেই পারবে না। সন্ধে হয়ে আসছে, আসছে কেন এসে গেছে। পড়ে যাবে, ডুবে যাবে… যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। আমি অ্যাকচুয়ালি ভাবছিলুম তোমার বাড়ির কথা। দে’ল গেট ওয়ারিড।

ওদিক থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

অদিতি বলল—তুমি বরং বাড়িতে এইবেলা একটা ফোন করে দাও। আমার নম্বর আর ঠিকানাটা দিয়ে দেবে।…এইবেলা, কেননা এত বৃষ্টি হলে দেখেছি আমাদের ফোনটা চলে যায়। কী হল, কিছু বলছ না যে? এ ছাড়া কোনও উপায় নেই—ইউ’ল হ্যাভ টু অ্যাকসেপ্ট ইট—রাইট?

এবারও কোনও উত্তর নেই। সে হেয়ার—ড্রায়ারটা বার করে আনল। প্লাগটা লাগিয়ে দিয়ে বলল—শুকিয়ে নাও চুলটা। অতটা চুল, ভিজে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আচ্ছা, এক কাজ করো, বাথরুমে লাগিয়ে দিচ্ছি। ওখানেই শুকিয়ে নাও। এখানে তারটা সোফা পর্যন্ত যাচ্ছেই না। চলো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি…

হাতটা বাড়াল। ড্রায়ারটা নিল, বিনা বাক্যব্যয়ে বাথরুমে চলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে দু’কদম এগিয়ে ওর চামড়ার মুখবন্ধ ঝোলাটার চেন চররর করে খুলে ফেলল অদিতি। দুটো কবিতার বই, একটা রিলকে অনুবাদ, আর একটা অক্সফোর্ড বুক অব ইংলিশ ভার্স। একটা পার্স। হ্যাঁ এই যে একটা শক্ত মলাটের ডায়েরি। চটপট ডায়েরিটা খুলে দেখল—অনোহিতা সাহা রায়। ফোননম্বর মনে হচ্ছে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডটোড হবে। যথাস্থানে ডায়েরিটা ঢুকিয়ে রেখে সে বাথরুমের দরজা পেরিয়ে ওদিকের শোবার ঘরে চলে গেল। চটপট ডায়াল করল। বাজছে…বাজছে। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সাহা রায় স্পিকিং…সরি টু হ্যাভ মিসড ইয়োর কল। প্লিজ লিভ ইয়োর ফোননাম্বার অ্যান্ড মেসেজ। ওয়েট ফর দা বিপ। থ্যাঙ্কস ফ’ কলিং।

সামান্য একটু ছায়া নেমেছিল তার মুখে। পরক্ষণেই বিপটা শোনা যেতে সে তাড়াতাড়ি বলে গেল—অনোহিতা আজ আমার বাড়িতে থাকছে। বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল। লিফট দিয়েছিলুম। আমি অদিতি সরকার। ফোন ২৫৫৫—৩৯১৯।—বাস, মা—বাবা রাতে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন। একটা ফোন তাকে নিশ্চয়ই করবেন। মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন না বলুন উদ্বেগ—উৎকণ্ঠার ব্যাপারটা থাকছে না।

আলমারি থেকে একটা ছাপা শাড়ি, ব্লাউজ আর পেটিকোট বার করে ফেলল। তারপর বাথরুমের দরজায় টোকা দিল। খুলে গেল দরজাটা। দাঁড়িয়ে রয়েছে। হেয়ার—ড্রায়ার হাতে, চুপচাপ। শাড়ি ব্লাউজগুলো সে র‌্যাকে রাখল। তারপর ড্রায়ারের সুইচটা টিপে ওর হাতে দিয়ে বলল নাও, শুকোও। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল হাওয়ায় বাদামি চুল উড়ছে। বিলি কাটছে ও চুলের ভেতর। ড্রায়ারটাকে ভালই তো বাগিয়েছে। শাড়ি—ব্লাউজগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল—পরে নিয়ো। একটু অসুবিধে হবে। কিন্তু কী আর করা যাবে।

এতটা চুপচাপ কেন? বৃষ্টিতে অসাগর ভিজছিল। সঙ্গে এল, কিন্তু বাধ্য হয়ে, অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে। দেখলে খানিকটা সম্পন্নই মনে হয়, চেহারায় অল্পবয়সি লালিত্যের সঙ্গে মিশে রয়েছে একটা মার্জিত ছাপ। তা ছাড়া ব্যাগের বইগুলো তো বলেই দিচ্ছে—ভালই শিক্ষিত। ইংরিজিতে এম এ টেম এ পড়ে হয়তো। আপাতদৃষ্টিতে উড়নচণ্ডী। কিন্তু নোঙরহীন মনে হয় না ওকে। মেয়েটা কি খুব শকটক পেয়েছে? মা—বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছে? পরীক্ষায় ফেল? প্রেম চটকে গেছে?… এগুলো ছাড়া আর তো কিছু মনে আসছে না। যাক, ওই বৃষ্টিতে যে বেপরোয়া মেয়েটা ভেসে যায়নি, কিংবা বদ হাতে পড়েনি এটাই যথেষ্ট। অদিতির জায়গায় যদি কোনও ভূপতি টুপতি ওকে লিফটটা দিত, এবং এমনি না—না করে ও সেটা নিত, লোকটার যদি বদ মতলব থাকত, আনমনা মেয়েটা যদি নিজেকে বাঁচাতে না পারত, তা হলে এতক্ষণে এ পুলিশ—কেস। এতগুলো ‘যদি’ লাগিয়ে নিজেরই হাসি পেয়ে গেল অবশ্য।

খুট করে শব্দ হল। দু’ সেকেন্ড পরেই লাল ছাপের শাড়ি ঢিলে ব্লাউজ পরে, বাদামি চুল এলো করে এলেন। ঢিলে ব্লাউজটাকে ঢাকবার চেষ্টাও করেনি। ফ্যাশন অ—ফ্যাশনে ওর কিছু যায়—আসে না, যেমন কফিতে চিনি ঠিক আছে কি নেই তাতে বা বৃষ্টিতে ভিজে কাক হয়ে এসপ্ল্যানেডের শূন্যে দাঁড়িয়ে থাকতেও কিছু এসে যায়নি। কিছু মেয়ে!

—নামটা জানতে পারি কি? আমি অদিতি সরকার।

‘তোমার নাম কী খুকিটা’ই ঠিক হত। কিন্তু এ তো মেয়ে মেয়ে নয়!, মেজাজি নিশ্চয়! একটু অসরাসরি জিজ্ঞেস করাই ভাল। নামটা সে জানে, মিলিয়ে নিতে পারবে—মিথ্যে বলছে কিনা।

ঠিক! নাম ভাঁড়াচ্ছে, গম্ভীর মুখে বলল—তনিকা।

—তনিকা?

—আমি পদবি ইউজ করি না।

এ বয়সে সবাই অল্পবিস্তর বিদ্রোহী থাকে। তারও অনেক রকম বিদ্রোহ ছিল। কিছুতেই কাউকে প্রণাম করত না। এক বিজয়ার দিন ছাড়া। দিদিমা ব্যাপারটা খেয়াল করে একদিন বলেছিলেন কী রে বনি, আমার পায়ে হাত দিলি না?

—তোমার পায়ে কি আর তুমি আছ দিদিমা! আছে যত রাজ্যের গরগরে ধুলো।

—’পায়ের ধুলো’ নেওয়াই তো বলে কথায়।

—পা যদি ধুলো প্রোডিউস করত, গুরুঠাকুরদের ম্যাজিক—ভস্মের মতো, তা হলে ভেবে দেখতুম দিদিমা। কিন্তু ও ধুলো জীবাণু আর নোংরায় ভরতি রাস্তার ধুলো। লক্ষ্মীটি।

বলেটলে অবশ্য সে এক ছুটে দিদিমার গলা জড়িয়ে চুমু খেয়েছিল, বলেছিল, তুমি তো আমার প্রাণের বন্ধু, দিদিমা, বন্ধুকে কেউ প্রণাম করে?

দিদিমা নিজের গালে আঙুল রেখে বলেছিলেন—আর এই যে তুই তোর মুখামৃত দিয়ে আমার গালটা এঁটো করে দিলি? সেটা বুঝি নোংরামি নয়!

—একটি ফোঁটাও পাবে না। বেশ চলো। সাবান—ডেটল দিয়ে তোমার গাল ধুয়ে দিই।

দিদিমা বলেছিলেন—দেখিস রাণু তোর এই সৃষ্টিছাড়া মেয়েটা নির্ঘাত সাহেব বিয়ে করবে।

দিদিমা জেনে গেলেন না তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

পদবি ব্যবহার বা অব্যবহার নিয়ে অদিতি কোনও হালকা মন্তব্য করল না। কে জানে বাবা, কী ভাবে নেবে।

—একটু শুয়েটুয়ে নেবে?—সে বলল।

—যখন—তখন শুই না।

—তো করবেটা কী? কথাই তো বলছ না। বাড়ি কোথায়?

—সাউথে, বললাম তো!

—সাউথ তো অনেকখানি! ঠিক আছে না বলতে চাও না—ই বললে। তবে কারণটা বুঝলুম না। আমি তো একজন ভদ্রমহিলা। কোনও ভদ্রলোককে ঠিকানা টিকানা না দেওয়াই ভাল। কিন্তু…

কোনও উত্তর দিল না। উঠে র‌্যাকের বইগুলো দেখতে লাগল। অদিতি আঘাত—পাওয়া মুখে বসে আছে। ছদ্ম অবশ্য। তার একটু মজা লাগতে শুরু করেছে।

হঠাৎ ফিরে ফিক করে হাসল।

—হাসলে যে?

—হাসিরও এক্সপ্লানেশন দিতে হবে?

—তা দিতে হবে বই কী। কারণ ছাড়া হাসলে তাকে পাগল বলে।

—ব্ল্যাকমেল করছেন? ইমোশন্যাল? যদি এইসব বিশেষণের চাপে বলে ফেলি।

—আরে! আমি তো সোজাসুজিই জিজ্ঞেস করলুম। আচ্ছা মেয়ে তো তুমি।

—কৃতজ্ঞতা নেই, বেপরোয়া, ছন্নছাড়া…আধপাগলা না?

ঝিলিক ঝিলিক হাসতে লাগল।

যাক বাবা হাসছে। তেমন গুরুতর কিছু হয়নি তা হলে! তবে চালাক খুব। খুব কটকটেও আছে।

—ক্যাঁটক্যাঁট করে কথা বলে, না?—অদিতি চমকে তাকাল। মুখটা খুঁজে খুঁজে দেখল—হাসি হাসি ভাবটা নেই, তবে দুঃখী দুঃখীও নয় ঠিক। কী রকম যে তা তার বোধগম্য হল না।

—তোমার খিচুড়ি চলে?

—আমার কথায় উত্তর দিলেন না তো!

—দ্যাখো অনো…মানে তনিকা, তোমার কৃতজ্ঞতা আছে কি নেই, পরোয়া করো কি করো না, ক্যাঁটক্যাঁটে কি ক্যাঁটকেঁটে নয় এসব বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলুম জাস্ট অপরিচিত কারওর সঙ্গে দেখা হলে ওটাই স্বাভাবিক তাই। আর কোনও কারণ…

—চলে—ও বলে উঠল।

—চলে? কে চলে?

—কেউ নয়। আমার খিচুড়ি চলে। আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন না?

—তা হলে, এখন ধরো আটটা, আর আধঘণ্টা পরে চাপিয়ে দেব, হবে তো?

—খুব—যাক, এতক্ষণে একটা সোজা কথার সোজা জবাব পাওয়া গেল।

—তুমি বরং বইটই দেখো। আমি একটু কাজ করে নিই।

কম্প্যুটার খুলে গোটা তিনেক ই—মেল পেল সে। একটা মনীষার। অদিতি চলে আসবার পর থেকেই তার নাকি একদম ভাল লাগছে না। সে—ও ফিরে আসবে ভাবছে।

সর্বনাশ! মনীষা বড্ড নাছোড়বান্দা আর সেন্টিমেন্টাল টাইপের মেয়ে। তার ওপর খ্যাপাটে। চলে আসবে মানে? পাবলিশিং হাউসের অমন চাকরিটা ছেড়ে দেবে? এই নিয়ে তা হলে তিনবার হবে।

দ্বিতীয়টা আঁদ্রের। শিগগির দিল্লি আসছে ‘মাতিস’—এর কাজ নিয়ে। ফরাসি আর ভারত সরকারের মধ্যে সংস্কৃতির আদান—প্রদান, কাজটার ভার পেয়েছে সে। কলকাতা ইনটারেস্টেড কিনা জানতে চেয়েছে। আশ্চর্য! দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করতে অদিতিকে দরকার পড়ল না, কলকাতা বলেই দরকার পড়ে গেল? এখানে সরকার নেই? সে তো নিজেই এসেছে—চার বছর পোরেনি এখনও। নিজের আতলিয়ে গড়তেই দিন গেছে। তেমন যোগাযোগ এখনও হল কই? প্রথম দেড় বছর মা ছাড়া আর কিছু ভাবেনি সে।

তৃতীয়টা রাজর্ষির। এটাই সবচেয়ে বিরক্তিকর। রাজর্ষির মা বাঁকুড়া—বিষ্ণুপুরে থাকেন, তাঁর শরীর খারাপ হয়েছে। অদিতি কি একবার যেতে পারবে? অবশ্যই যেন যায়। রাজর্ষি খুব চিন্তিত হয়ে আছে। এ অনুরোধ মানেই আজ্ঞা। এর আগেও দু’বার এ আজ্ঞা পালন করেছে সে, এইভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় ও। সে ভালই বোঝে। কিন্তু রাজর্ষির মাকে সে একেবারে পছন্দ করে না। কেন করে না তার অনেক কারণ আছে, তবে স্থূলতম কারণটা হল উনি একদিন তার সম্পর্কে বলেছিলেন—’সাহেবের এঁটো’। ছিঃ। এ কথা যে মহিলা বলতে পারেন তাঁকে অপছন্দ করবার হক তার আছে। এমনকী ঘেন্নাও। কিন্তু মুশকিল হল—ঘেন্না জিনিসটা তার চট করে আসে না। ইংরেজিতে সে বলতে পারে আই হেট দিস, হেট দ্যাট, বা আই হেট য়ু। কিন্তু ইংরেজি হেট আর বাংলা ঘেন্নার অনেক তফাত। সে যাই হোক, ঘেন্নার জায়গায় তার যে অনুভূতিটা হয় সেটা হল বিরক্তি। দূর দূর! তা রাজর্ষির সংক্রান্ত সব ব্যাপারেই তার এই ‘দূর!’টা মনে হয়। ধূ—র!

মনীষাকে জবাবটা দিয়ে দিল চটপট। না হলে মুশকিল আছে। দিবারাত্র অদিতির কাছে এসে মড়াকান্না কাঁদবে। একবার যদি এসে পড়ে। ওটাই মনীষার স্বভাব। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না। ওকে প্রথম স্কলারশিপটার খোঁজ দিয়েছিল অদিতিই। মড়াকান্নায় অস্থির হয়ে গেল। প্রথমটা ডগোমগো। দারুণ ভাল, দারুণ ভাল সব। দারুণ কাজ করছে। তখন অদিতি গ্লাসগোতে স্কুল অব আর্টে ট্রেনিং নিচ্ছে, মনীষা লন্ডনে পোস্ট ডক। ও মা, কাউকে বলা নেই, কওয়া নেই, কাজকর্ম ডকে তুলে চলে গেল ইন্ডিয়ানা, খুব নাকি ভাল অফার পেয়েছে। ছ’মাসও গেল না, বিয়ে করে ফেলল ইন্ডিয়ানারই আর এক প্রফেসারকে, অন্ধ্রের লোক প্রফেসর রাও, দারুণ ভাল। বিয়ে যে কী জিনিস। কিছুদিনের মধ্যেই অদিতিকে লম্বা চিঠি, বিয়ে করে ভীষণ ভুল করেছে, এক পেশার লোককে কক্ষনও বিয়ে করতে নেই। অদিতি যেন ও ভুল না করে। রাও ওকে চাকরি ছেড়ে দেবার জন্যে চাপ দিচ্ছে। ও সংসারে মন দিচ্ছে না—এই নালিশ করছে অহরহ। ডিভোর্স করল, ইন্ডিয়ানা ছাড়ল, তারপর খুঁজে পেতে প্যারিসে এসে অদিতির ঘাড়ে চাপল। কোন পাবলিশারের অফিসে কাজ করছে, থাকার পয়সা কম পড়ছে, অদিতি যদি ওর ঘরটা শেয়ার করে। লাইফ হেল করে দিয়েছিল একেবারে। বড্ড অব্যবস্থিতচিত্ত আসলে। খুব স্বার্থপরও। এবং ভীষণ সেন্টিমেন্টাল। কথায় কথায় ঠোঁট ফোলানো টাইপ। তুই বোধহয় আমায় পছন্দ করছিস না।

অদিতি আমি আবার না তোর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াই।—এই রকম, আর এখন অত ভাল চাকরি করছে। ছেড়ে দেবে?

মনীষাকে অগত্যা খানিকটা স্তোক এবং খানিকটা মিথ্যে কথা লিখতে বাধ্য হল। এতদিনে একটা মনের মতো চাকরি হয়েছে। সেবার পোস্ট ডকটা ছেড়ে টিচিংয়ে আর আসতে পারলি না। এবার যদি কাজ ছাড়িস জীবনে তোর মুখ দেখব না। কলকাতায় যা পলিউশন তাতে তোর মতো হেঁপো রুগি—মাসখানেকও টিঁকবে না। শুধু কলকাতা নয়, দিল্লি মুম্বই চেন্নাই সর্বত্র পলিউশন লেভেল ভয়াবহ। ইত্যাদি ইত্যাদি।

মনীষা একেবারে যাকে বলে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। কিন্তু ওই অস্থির পরনির্ভর স্বভাবের জন্য এখনও কেমন না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে রয়েছে। নামকরা প্রকাশকের এডিটোরিয়াল বোর্ডে রয়েছে। তবু পালাই পালাই।

কম্প্যুটারটা বন্ধ করে, পেছন দিকে তাকাল। ঘরের মধ্যে নেই, বুকের মধ্যেটা ঢিপ করে উঠল। নাঃ ওই যে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কী দেখছিস বাবা? শ্যাওলা?—দ্যাখ! সে রান্নাঘরে চলে গেল। ফ্রিজ থেকে রম—এর বোতলটা বার করল, কোকের সঙ্গে পরিমাণ মতো মিশিয়ে তৈরি করে ফেলল ড্রিঙ্কটা। একটু একটু করে খেতে খেতে হয়ে যাবে রান্নাটা।

—আমি হেলপ করব?

তনিকা—অনোহিতা রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখ পানীয়র গ্লাসের দিকে। অদিতি পাত্তা দিল না। বলল—তুমি পারো?

—কিছু কুটতে হলে ছুরি লাগবে।

গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে অদিতি বলল আমিও তো ছুরিই ব্যবহার করি। দিচ্ছি। ক্রিসপারটা দেখল। নাঃ খিচুড়িতে দেবার মতো কিছু নেই। কটা ফ্রেঞ্চ বিন পড়ে আছে। দিয়ে ফেলা যাক। টোম্যাটো বার করল। আলুর ঝুড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল—আলু আর বিন ছাড়া আর কিছু তো নেই দেবার। আলু কয়েকটা ছাড়িয়ে আধখানা করে ফেলো। পেঁয়াজ? না, পেঁয়াজ আমি কেটে নিচ্ছি।

—থ্যাংকিউ।

চাল—ডাল ধুতে লাগল অদিতি। জল বসিয়ে দিল গ্যাসে।

—আপনি এইভাবে রান্না করেন?

—অর্থাৎ?

গ্লাসটার দিকে চিকচিকে চোখে তাকাল।

—চেখে দেখবে? অত বৃষ্টিতে ভেজার পর ভাল।

—চলবে।

আর একটা গ্লাস তৈরি করল অদিতি। বলল—ধীরে ধীরে খাবে।

নিজের গ্লাসটা অদিতির গ্লাসে ঠেকিয়ে খুব অভ্যস্ত গলায় বলল ‘চিয়ার্স’। পাকা পক্বান্ন একেবারে। তারই বোঝা উচিত ছিল। আজকালকার মেয়ে। সে যখন ‘আজকালকার’ ছিল তখন এসব কেউ কল্পনাও করতে পারত না। মেজদা সেবার স্কটল্যান্ড থেকে একটা অপূর্ব পারফিউম পাঠিয়েছিল। কলেজ যাবার সময়ে ঢেলেছিল একফোঁটা। মা স্তম্ভিত চোখে চেয়ে বলেছিলেন—তুত্তুই সেন্ট মেখে কলেজ যাচ্ছিস? এটা তাদের বাড়ির বাড়াবাড়ি। কিন্তু এই রকমই। ওদিক থেকে বলে উঠল—কই?

—কী কই?

—ওই যে, আপনার বাড়ি ভরতি লোক?

হেসে ফেলল অদিতি, রান্নাঘরের দরজার দিকে ইশারা করে বলল—ওই দিকে। অনেক। এদিকে আমি একা।

চাপা হাসিতে মুখটা ঝিকিয়ে উঠল।

—আর কৌতূহল?

—নেই।

দু’জনেই হেসে ফেলল।

পরের দিন বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে দরজা খুলতে গিয়ে দেখল উঠোনটা রোদে ভাসছে। বৃষ্টি বলে কোনও জিনিসই যেন ছিল না কোনওদিন।

কালোকে পাশের ঘরেও এক কাপ চা দিতে বলে সে বাথরুমে গেল। কিছুক্ষণ পরে কানে এল—কই গো দিদি, এ ঘরে তো কেউ নেই?

তাড়াতাড়ি বেরোল অদিতি। শোবার ঘরের খাটের ওপর তার শাড়ি ব্লাউজ সব পাট করা। পায়ের কাছে কাঁথাটাও। ভাঁজটা অসমান, সে এভাবে করে না। মানে শুয়েছিল। সকাল হতেই নিজের আধ ভিজে জামাকাপড়গুলো গলিয়ে পালিয়েছে।

যাবি তো যা। ঠিক আছে। আসতে আসতেই তো যাই যাই করছিলি? আজ সকালে যে চলে যাবি সে তো জানা কথাই। তাই বলে এমন না বলে কয়ে। ভদ্রতা বলেও তো একটা জিনিস আছে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *