জেরুসালেম

জেরুসালেমের বিভিন্ন নাম

মুসলমানদের কাছে জেরুসালেম শহর ‘আল-কুদস’ নামে পরিচিত। এর অন্য নাম হচ্ছে বাইতুল মাকদিস। আল-কুদস’ নামটাই সর্বাধিক পরিচিত। যদিও কোনটার উপর কোনটার প্রাধান্যের বিশেষ কারণ নেই। মসজিদে আকসাকেও কুদস বলা হয়। কুদৃ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পবিত্র। পক্ষান্তরে, বাইতুল মাকদিস’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, ‘হাইকালে সুলাইমানী’ বা সুলাইমান আলাইহিস সালাম-এর তৈরি ইবাদাতগাহ। হিব্রু শব্দ Bethammigdash থেকে মাকদিস” শব্দের উৎপত্তি। মাকদিস” শব্দের মূলেও কুদস’ শব্দ রয়েছে। মূলকথা হল, এটি পবিত্র শহর। এই শহরেই প্রখ্যাত আল আকসা মসজিদ রয়েছে। এই শহরের অন্যান্য নামগুলো হচ্ছে, মাদীনাতুল হক (সত্যের শহর), ‘মাদীনাতুল্লাহ’ (আল্লাহর শহর), আল-মাদীনাহ্ আত-তাহিরাহ’ (পবিত্র শহর) এবং আল-মাদীনাহ আল-মুকাদ্দাসাহ’ (পবিত্র শহর )। জেরুসালেম’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ইউরোসালেম’ শব্দ থেকে। রোমানরা জেরুসালেমকে এই নামেই অভিহিত করে। মুজাম আল-বুলদানের লেখক ইয়াকুত হামাওয়ী এর আরেকটি নাম উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে, “আল-বালাত’। অর্থ হল, রাজপ্রাসাদ। ‘ইউরোসালেম’ একটি কেনানী শব্দ। আরব ইয়াবুসী গোত্রের ১ম শাসকের উপাধি ছিল ‘সালেম। সালেম অর্থ শান্তিপ্রিয়। তিনি শান্তিপ্রিয় ছিলেন বলে

তাঁকে সবাই এই উপাধিতে ভূষিত করে। তার আসল নাম ছিল মালিক সাদেক। তাঁর এই কেনানী নামানুসারে শহরের নামকরণ করা হয়।

ইউরোসালেম। বর্তমান যুগে, এটাকেই জেরুসালেম বলা হয়। খৃস্টপূর্ব ৩ হাজার সালে আরবের ইয়াবুসী গোত্রের বসবাসের ভিত্তিতে এই শহরের প্রাচীন নাম হচ্ছে ইয়াবুস।

বর্ণিত আছে, ইয়াবুসী শাসক জেরুসালেমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে স্বাগত জানান এবং আঙ্গুর ও রুটি দিয়ে তাঁর মেহমানদারী করেন।

.

ভৌগোলিক অবস্থান

জেরুসালেম ৩৪ ডিগ্রী অক্ষাংশ ও ৩১ .৫২ ডিগ্রী দ্রাঘিমাংশের উত্তরে অবস্থিত। শহরটি একটি পাহাড়ী এলাকা অর্থাৎ অধিত্যকা। এর চারদিকে রয়েছে পাহাড়। উল্লেখযোগ্য পাহাড়গুলো হচ্ছে :

১. মোরিয়া পাহাড় : এই পাহাড়ের উপরই মসজিদে সাখরা ও মসজিদে আকসা অবস্থিত।

২ . যাইতুন পাহাড় : এর অপর নাম হচ্ছে তুর পাহাড়। এটি শহরের পূর্বদিকে সাগরের স্তর থেকে ৮২৬ মিটার উপরে অবস্থিত। হারামে কুদসের দেয়ালের পার্শ্বে দাঁড়ালে এই পাহাড়ের পাথরগুলো দৃষ্টিগোচর হয়। হারাম শরীফ ও পাহাড়ের মাঝখানে আছে কাদরুন” উপত্যকা। তালমু দে এই পাহাড়কে মাসেহ’ বা ‘তাইজ’ পাহাড় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তালমু দে আরো বর্ণিত আছে, ইহুদীরা এই পাহাড়ে লাল গাভী জ্বালিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে এর ছাই সংগ্রহ করে তা হাইকালে সুলাইমানীতে ছিটিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য কুরআনের তাফসীরকারগণ বলেছেন, গাভী লাল ছিল না বরং গাঢ় হলুদ রংএর ছিল। যাইতুন পাহাড়ের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, খৃস্টানদের ধারণা অনুযায়ী সেখানকার ‘ মুআসরাহ ’ কিংবা জাতসমানী’ বাগানের কাছে ইয়াসু নামায পড়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ পাহাড়ে একটি গর্ত আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কিছু শিক্ষা দান করেছিলেন, তার হাওয়ারীদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং জেরুসালেমের জন্য কেঁদেছিলেন।

৩ . সাহইউন পাহাড় : এই পাহাড়ের অপর নাম হচ্ছে দাউদ নবীর পাহাড়। এটি সাগরের স্তর থেকে ৭৭০ মিটার উপরে অবস্থিত।

৪. আকরা পাহাড় : এই পাহাড়ের উপর খৃস্টানদের ‘কিয়ামাহ’ গীর্জা অবস্থিত।

৫. যাইতা পাহাড় : এটি বাব-আস-সাহেরার নিকটবর্তী একটি পাহাড়।

৬. গাওল পাহাড় : এটি জেরুসালেম শহরের উত্তর দিকে এবং সাগরের স্তর থেকে ৮৩৯ মিটার উপরে অবস্থিত। প্রাচীন যুগে এই পাহাড়ের উপরই কেনানীদের ‘হাবৃআহ’ শহর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

৭ . সামউইল নবীর পাহাড় : এটি শহরের উত্তর পশ্চিম দিকে অবস্থিত। সাগরের স্তর থেকে এর উচ্চতা হচ্ছে ৮৮৫ মিটার।

এছাড়াও শহরের চারপাশে আরো অনেক পাহাড় আছে। শহরটি সাগরের স্তর থেকে ৭৩৫ মিটার উপরে অবস্থান করছে। পাহাড়ী এলাকার কারণে তা কোন প্রধান বাণিজ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং শহরের মাঝে কোন নদীনালাও নেই। অপরদিকে প্রাকৃতিক কারণে শহর সম্প্রসারণের বেশী সুযোগ নেই।

জেরুসালেম শহর প্রাকৃতিকভাবে দুইভাগে বিভক্ত। পুরাতন জেরুসালেম ও নতুন জেরুসালেম। ১৯৪৮ সালে নতুন ও পুরাতন জেরুসালেমের মোট আয়তন ছিল ৪১ বর্গকিলোমিটার। শহর সম্প্রসারণের পর বর্তমান আয়তন হচ্ছে, ১১০ বর্গকিলোমিটার। পুরাতন জেরুসালেম শহর ৪ দিক থেকে দেয়ালঘেরা। দেয়ালের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৪ কিলোমিটার এবং উচ্চতা হচ্ছে ১২ মিটার। দেয়ালে মোট ৮টা গেট আছে। বিভিন্ন দিক থেকে লোকেরা এ সকল গেট দিয়ে তাতে প্রবেশ করে। প্রসিদ্ধ গেটগুলো হচ্ছে, উত্তরে বাবুল আমুদ, দক্ষিণে বাবুল মাগারিবা, পূর্বে সানস্টিফান ও পশ্চিমে বাবুল খলীল। পূর্বদিকে অবস্থিত বাবুজ্জাহাবী নামক ৮ম গেটটি বন্ধ থাকে। ১৫৩৬ খৃস্টাব্দে উসমানী সুলতান সুলাইমান ৫ বছরব্যাপী ঐ দেয়াল নির্মাণ করেন।

.

লোকবসতি

১৯৮০ খৃঃ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেরুসালেমের লোকসংখ্যা হচ্ছে ৩ লাখ ৯২ হাজার। ১৯৬৭ খৃঃ থেকে ১৯৮০ খৃঃ পর্যন্ত বর্ধিত জনসংখ্যার ৫৮% ভাগ হচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে জেরুসালেমে আগত ইহুদী সম্প্রদায়। জেরুসালেম শহরের বিভিন্ন অংশে ইহুদী বসতি গড়ে তোলা হয়েছে এবং সেখানে ইয়েমেন, ইথিওপিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ থেকে ইহুদীদেরকে এনে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। ইসরাইল সরকার অধিকৃত ফিলিস্তিনের মুসলমানদেরকে তাড়িয়ে ইহুদীদেরকে পুনর্বাসন করছে। যাতে করে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং শহরের আরব ও ইসলামী বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ইহুদীকরণ করা সম্ভব হয়। ইসরাইল সরকার ১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধে, জর্দানের শাসন থেকে জেরুসালেম জবরদখল করার পর ২৫শে জুলাই এক আদমশুমারী পরিচালনা করে ও উপস্থিত আরব মুসলমানদেরকে ইসরাইলী পরিচয়পত্র গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়। এতে করে যুদ্ধের ফলে পালিয়ে যাওয়া ১ লাখ ২০ হাজার ফিলিস্তিনীকে অনুপস্থিত ধরে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে সেই স্থানে ইহুদীদের পুনর্বাসন করে। বর্তমান সময়ে ( ১৯৯১ খৃঃ) পুনর্বাসনের ফলে ইহুদী জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে জেরুসালেমে ইহুদীদের সংখ্যা হচ্ছে ৪ লাখ। ১৯৯২ সালে জেরুসালেমের লোকসংখ্যা হচ্ছে, ৫ লাখ ৫৫ হাজার। এর মধ্যে পূর্ব জেরুসালেমে বাস করছে ১ লাখ ৪০ হাজার ইহুদী। পক্ষান্তরে, মুসলমানদের সংখ্যা ১ লাখ ৫৫ হাজার। ১৯৯৩ সালে ৫৫ হাজার আবাসিক ইউনিট নির্মান শেষ হয়েছে। এতে করে মুসলমানদের চাইতে ইহুদীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে।

.

আবহাওয়া

জেরুসালেমের গড় তাপমাত্রা মাঝারি ধরনের। শীত ও গ্রীষ্ম ঋতু বাদ দিলে, অন্যান্য সময়ের তাপমাত্রা গড়ে ১৮ সেন্টিগ্রেড। সেখানকার ফসল, গাছপালা ও কৃষি ভূমধ্যসাগরের আবহাওয়ার আর্দ্রতা ভোগ করে। জানুয়ারী মাসে সর্বাধিক ঠাণ্ডা থাকে। তখন তাপমাত্রা থাকে ৯ . ৭ সেন্টিগ্রেড। পক্ষান্তরে আগস্ট মাসে সর্বাধিক গরম থাকে, তখন তাপমাত্রা থাকে ২৫ সেন্টিগ্রেড। তবে শীতকালে, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ৪ সেন্টিগ্রেড।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *