জীবন থেকে

জীবন থেকে

ছেলেবেলায় শোনা যাত্রার বিবেকের সেই গান আজও আমার কানে বাজে; ও পথে বাড়াসনে তুই পা। শুনলে কী হবে, আমি ঠিক সেই পথেই পা বাড়িয়েছি। বিবেকের মুখে গামছা পুরে, মুখ বেঁধে, কন্ঠ রোধ করে আমি নেচে নেচে সেই পথেই পা বাড়িয়েছি। বিবেক ড্যাবরা ড্যাবরা চোখে আমার কেলোর কীর্তি দেখেছে। বিবেক! তুমি কি জানো ভায়া, প্রেম হল অজগরের শ্বাস। গুটি গুটি ছাগলের মতো এগিয়ে যেতেই হয়। কোনো মতেই নিজেকে ধরে রাখা যায় না। দেহটাকে ধরে রাখলেও মনটা পাকা আমের আঁটির মতো পচাত করে বেরিয়ে যায়।

ভেটারেন প্রেমিকরা আমাকে সাবধান করেছিলেন। বিশে, জেনে শুনে খাল কেটে কুমীর ঢোকাসনি। আমরা ঠেকে শিখেছি, তুই দেখে শেখ। শিবুর অবস্থাটা একবার দেখ। প্রেমকলে পড়া ইঁদুরের জলজ্যান্ত উদাহরণ। অমন একটা প্রাণোচ্ছল, বিশাল চেহারার গুডবয়ের আজ কী অবস্থা! চেহারা ধসে গেছে। অমন চাঁচর চিকুল চুলে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। জুলপিতে পাক ধরেছে। মুখে সবসময় অমাবস্যা। আগে দিস্তে দিস্তে কবিতা লিখত। নাটকে নায়ক সেজে কত জ্ঞান দিত অডিয়েন্সকে! আর আজ! দেখে যাও বঙ্গবাসী। প্রেমের পরিণাম। ধসা রোগে ধোসকে গেল। আরে রাম রাম!

শিবুদার কথা ভাবিনি যে তা নয়, তবে এও ভেবেছি একটা দুটো কেস অমন মিসফায়ার হলেও প্রেম ইজ প্রেম। মহাপুরুষ থেকে কাপুরুষ ইচ অ্যাণ্ড এভরিওয়ান প্রেমের উপকারিতার কথা বলে গেছেন। প্রেমে পৃথিবী সবুজ হয়, কোকিল কুহু কুহু করে, খুন জখম, রাহাজানি বন্ধ হয়ে যায়। প্রেমে অফিসে বড়কর্তা শ্রীচৈতন্যের মতো ঢুলুঢুলু চোখে তাকান। ট্র্যাফিক পুলিস বিনাপণে লরি পাস করিয়ে দেয়। প্রেমিক ব্যাঙ্ক কর্মচারী নিমেষে চেক পাশ করিয়ে দেন।

কবি লিখে গেছেন, প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে ভুবনে। তা না হলে এমন কেন হবে? কুঁচকি কন্ঠা ঠাসা ভিড় বাসে প্রেমের ফাঁদ। ভাবা যায় না। লেডিজ সিট থেকে তিনি উঠলেন। আমার বুক বেয়ে কুচকুচে কালো চুলে ঢাকা মাথাটি ওপর দিয়ে উঠল। বুকে যেন ঢেঁকির পাড় পড়ছে। সে কী আনন্দ, সে কী আনন্দ! ওদিকে আমার অনেক সাধের বিদেশি কলমটি সুন্দরীর সুন্দর চুলে চড়ে আমার খাঁচা ছাড়া হৃদয়ের প্রতীক হয়ে গেটের দিকে চলতে শুরু করল। আমি এক হাবাগবা। কিছুই বুঝতে পারলুম না। মহিলা যখন টুকুস করে রাস্তায় নামলেন প্রায় নৃত্যের ভঙ্গিতে। অনেকটা টুইস্ট নাচই বলা যায়। ইস্ক্রুপ নাচ বলতেও আপত্তি নেই। কলকাতার বাস থেকে ওই ভাবেই লেত্তি ছাড়া লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতেই নামতে হয়। তখন আমার পাশে যে প্রবীণ ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি ফিস ফিস করে বললেন, ‘যা: চলে গেল!’

আমি তাঁর কথা শুনে লজ্জায় প্রায় লাল। এতক্ষণ আমি যা দেখেছি, বা ভেবেছি এই প্রবীণ মানুষটি নিশ্চয়ই তা জেনে ফেলেছেন। এই বয়েস সাঁতরেই তো তিনি ওই বয়সে উঠেছেন! আমতা আমতা করে বললুম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ চলে গেল।’

‘যান ছাড়িয়ে আনুন।’

এ আবার কী কথা! হেঁয়ালি ভাষা! কী ছাড়িয়ে আনব? মন, না আঁখি পাখি। বললুম রসিকতার সুরেই, ‘মার খেয়ে মরি আর কী!’

‘আ মোলো। মার খাবেন কেন? কলমটা তো আপনারই?’

‘অ্যাঁ কলম। কার কলম?’

‘আপনারই কলম। কলম আবার কার হবে! চুলে আটকে চলে গেল মানিক!’

ছাগলের মতো গুঁতিয়ে-টুতিয়ে চলন্ত বাস থেকে টাল খেয়ে রাস্তায়। কানে এলো মন্তব্য, ‘এই ভাবেই মরে। ডিস্কো দিওয়ানে, আহা:, আহা:।’

অনেকটা এগিয়ে এলেও শিকারীকে তখনও দেখা যাচ্ছে। মন্থর গতিতে হাঁটছেন। এদিকে- ওদিকে তাকাতে তাকাতে। আমি দৌড়বীরের মতো হাঁটছি। হাঁটা বললে ভুল হবে, ছুটছি। আমার সাধের কলম। মাসিমা বিলেত থেকে পাঠিয়েছিলেন জন্মদিনে।

সুন্দরীকে ধরে ফেলেছি। হাঁপাতে হাঁপাতে বললুম, ‘আমার কলম!’

থমকে দাঁড়িয়ে, ধনুক ভুরু হয়ে তিনি বললেন, ‘কলম? কী কলম?’

‘ওই যে টায়রার মতো, আপনার চুলে আটকে ঝুলছে। দ্যাট ইজ মাই কলম।’

উত্তেজিত হলেই বাঙালি সায়েব হয়ে যায়। ঘুমিয়ে আছে পাক্কা সাহেব সব বাঙালির অন্তরে।

সুন্দরী মাথায় হাত দিলেন। আমার কলম দুলে উঠল। মুখের রাগরাগ ভাব কেটে গিয়ে লজ্জার নরম ছায়া নামল। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘ছি: ছি:, মেয়েদের চুল যে এইরকম পাকা পকেটমার হয় জানা ছিল না। কী সুন্দর আটকেছে দেখেছেন!’

কী সুন্দর মুখ। মুক্তোর মতো কচিকচি দাঁত। ওই দাঁতে যখন ছুঁচ চেপে ধরেন ছুঁচ নিশ্চয় মূর্ছা যায়। কলমটা চুল থেকে খুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আয় অ্যাম সরি।’

আঙুলে আঙুলে ঠেকে গেল। আমার মনে হল চড়া রোদ যেন নরম চাঁদের আলো। কোকিল আমার আঙুল ঠোকরাচ্ছে। এ একেবারে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। হৃদয় আমার ফোঁপরা হয়ে গেল।

প্রেম মানুষকে কীরকম দাতা করে। যে কলম নিয়ে নিত্য আমার বোনের সঙ্গে চুলোচুলি হয় সেই কলমটা আমি দান করতে চাইলুম।

‘কলম আপনি নেবেন? আমার অনেক কলম আছে।’

সুন্দরী বললেন, ‘আপনার কলম আমি নেব কেন?’

করুণ সুরে বললুম, ‘আমার যে খুব দিতে ইচ্ছে করছে।’

‘আমার যে নিতে ইচ্ছে করছে না।’

‘কেন নিষ্ঠুর হচ্ছেন? আমি ভীষণ সেন্টিমেন্টাল! এখুনি কেঁদে ফেলব।’

কলকাতার রাস্তা মানে হাট। একান্তে দাঁড়িয়ে একটু রোমান্স করার উপায় নেই। বেশ লায়েক গোছের এঁচোড়েপাকা একটি ছেলে পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, ‘হাত থাকতে মুখে কেন মাইরি!’

সুন্দরী চট করে একটা গাড়ি-বারান্দার তলায় সরে গেলেন। চুম্বকের আকর্ষণে লোহার মতো আমিও সরে গেলুম।

সুন্দরী বললেন, ‘মতলবটা কি?’

আমি ভালো মানুষের মতো হাঁকপাঁক করে বললুম, ‘মাইরি বলছি, কোনো বদ মতলব নেই। আমার ভেতরটা কেমন যেন মরে যাবার মতো হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। একটু জল পেলে হত!’

‘আমারও ভেতরটা ধড়ফড় করছে। মনে হচ্ছে এক বোতল ঠাণ্ডা জল খাই। বিশ্বাস করুন আপনাকে আমি মাস্তান ভেবেছিলুম। এর আগে আমি বার তিনেক মাস্তানের পাল্লায় পড়েছিলুম।’

‘এই চেহারায় মাস্তান! হাসালেন আপনি!’

‘আপনিও হাসালেন। আজকালকার মাস্তানদের চেহারাও আপনার মতো। বত্রিশ ইঞ্চি বুক।’

‘বত্রিশ নয় চৌত্রিশ।’

‘ওই হল। বকের মতো লিকলিকে ঘাড়ে ইয়া একটা ঝুলঝাড়ুর মতো পাটের মাথা। তবে হ্যাঁ আপনার মুখটা শিশুর মতো। চোখে বদমাইশের সেই মার্কামারা চাহনি নেই।’

এই শেষ কথায় মনটা বেশ ভরে গেল। যুগযুগ জিও বেটি। আমি বললুম, ‘আমারও ভীষণ ভয় করছিল আপনার সামনে দাঁড়াতে। ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে পাবলিক প্যাঁদানি খাওয়াতে পারতেন। সরি।’

‘কী হল, সরির কী হল?’

‘মুখ ফসকে প্যাঁদানি শব্দটা বেরিয়ে গেছে।’

‘তা যাক না। পাবলিকের সঙ্গে প্যাঁ-টা যায় ভালো। একে বলে অ্যালিটারেশন। পাবলিকে পেঁদিয়ে পুঁটকি পাঁট।’ সুন্দরী হাসতে লাগলেন। দাঁত নয় তো যেন টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন। গাড়িবারান্দার তলায় যেন বসন্তের বাতাস বয়ে গেল। হালকা হলুদ রঙের ঝাপসা ছাপা শাড়ি। কাঁধকাটা ব্লাউস থেকে বেরিয়ে এসেছে মৃণালভুজের মতো দু-বাহু। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার জীবন-স্বপ্ন। মনের গাছে একটা নয় জোড়া কোকিল ডাকছে।

‘তাহলে অনুমতি করুন কোথাও বসে দু-জনে দুটো কোল্ড ড্রিংকস খাই।’

‘আমি খাওয়াব।’

‘না আমি।’

‘তাহলে প্রস্তাব বাতিল।’

করুণ মুখে বললুম, ‘আজ আমি খাওয়াই না। কাল আপনি।’

‘কাল আর আমাকে পাচ্ছেন কোথায়?’

‘তাও তো বটে। আচ্ছা আর কোনো দিনই দেখা হবে না? তাই না?’

‘কি করে হবে?’

‘ধরুন, আমি যদি ইয়ে করি।’

‘ইয়েটা কি?’

‘মানে, যদি আসি।’

‘কোথায় আসবেন?’

‘যেখানে বলবেন, যখন বলবেন।’

‘ভেবে দেখি।’

‘দয়া করে ভালোটাই ভাববেন।’

‘কেন ভাবব?’

‘জানেন কারুর মনে দুঃখ না দেওয়াই ভালো। চারপাশে এই রোগ-শোক-জরা-ব্যাধি কারুর মুখে হাসি নেই, বিবর্ণ পৃথিবী।’

‘হয়েচে, হয়েচে, আর নয় স্টপ, স্টপ।’

থেমে গেল আমার উচ্ছ্বাস। স্টপ বলার মধ্যে এমন সুন্দর একটা ব্যক্তিত্ব। ঘ্যাঁচ করে কথার গাড়ি থেমে গেল। আমার আমি যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল নরম কোনো বুকে। না, অশ্লীল কোনো ইঙ্গিত নয়। প্রেমে অশ্লীলতা নেই। পবিত্র দেবালয়। এই বোম্বে ব্যাটারাই প্রেমে সেক্স আর ভায়োলেন্স এনে দেশটার বারোটা বাজিয়ে দিলে। কোথা থেকে একটা ভিলেন আসবে। ঢিসুম ঢিসুম ঘুষি চলবে। জল ঘোলা করে তবে নায়ক-নায়িকার মিলন।

একটা বেশ শীতল রেস্তোরাঁয়, দু বোতল শীতল পানীয়। প্ল্যাস্টিকের স্বচ্ছ চোষনল উঁচিয়ে আছে ঝাণ্ডা উঁচা রহে হামারার মতো। অফিসের বারোটা।

চুক করে এক চোষণে কিছুটা পানীয় তুলে নিয়ে, দুগালে দুটো হাত রেখে, টেবিলে দু-কনুইয়ের ভর রেখে সুন্দরী বললেন, ‘কী করা হয়?’

‘চাকরি।’

‘কোথায়, ব্যাঙ্ক?’

‘ঠিক ধরেছেন। কী করে বুঝলেন?’

‘ডেরেসের চেকনাই দেখে। ভালো মাইনে। হাতে কাঁচা টাকা। নাম কী?’

‘আজ্ঞে মৃগাঙ্ক।’

‘আজ্ঞে আজ্ঞে আবার কী? গৃহভৃত্যের মতো আজ্ঞে আজ্ঞে করছেন কেন?’

‘ছেলেবেলার অভ্যাস। আপনার নাম?’

‘কী নাম হওয়া উচিত?’

‘সুদেষ্ণা।’

‘ওটা একটা নাম হল, সুদে-আসলে, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ।’

‘তাহলে শর্মিষ্ঠা।’

‘হল না, নিষ্ঠা-ফিষ্ঠা আমার তেমন নেই। কোনো কিছুতেই। ভালো করে ভেবে বলুন, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।’

মুখের দিকে সরাসরি তাকাতে গিয়ে লজ্জায় অধোবদনে। লুকিয়ে-চুরিয়ে মুখ দেখি। সোজাসুজি সাহসে কুলোয় না। মুখ নীচু করে বললুম, ‘গোপা।’

খিলখিল হাসি, ‘এবার হয়েচে। কী করে বললেন?’

‘আজ্ঞে, ওই খোঁপা দেখে।’

‘আবার আজ্ঞে!’

‘ভুল হয়ে গেছে।’

‘সত্যিই আমার মাথায় সাংঘাতিক চুল। ছেড়ে দিলে গোড়ালি ছোঁবে।’

‘মাইরি।’

‘মাইরি।’ এ আবার কী ধরনের কথা। মাইরি, আজ্ঞে। হালুইকর বামুন নাকি?’

‘ওই দুটো আমার বদ অভ্যাস। কিছু মনে করবে না মাইরি!’

‘না মাইরি।’

আমরা দু-জনেই হো-হো করে হেসে উঠলুম। ফাঁকা রেস্তোরাঁয় ঘোলাটে চোখ, ফুলোগাল মালিক ত্যারছা তাকালেন। বয়েই গেল।

‘একটু দেখাবেন?’

‘কি?’

‘চুল।’

‘আহা! একদিনেই অত দূর যাওয়া যায় না মশাই। ধীরে রজনী ধীরে। গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। মৃগাঙ্ক কি?’

‘চাটুজ্যে।’

‘আমি বাঁড়ুজ্যে।’

‘বহত আচ্ছো।’

‘আচ্ছো মানে?’

‘আচ্ছা হবে। উত্তেজনায় ওকার এসে গেছে।’

‘কীসের আচ্ছা?’

‘আমি ফিউচার দেখছি।’

গোপা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ নীচু করে পানীয় চুষলেন। পাতলা, টিকোলো নাকে নীলচে আলো খেলছে।

‘আমি তো ব্যাঙ্কে! আপনি কোথায়?’

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডক্টরেট করছি।’

একটু ঘাবড়ে গেলুম। আমার চেয়েও শিক্ষিতা? কী হবে মাইরি। এ তো রমণী নয়, রমণীরত্ন।’

‘কী বিষয়ে ডক্টরেট করছেন?’

‘দর্শন শাস্ত্রে। দর্শন আর আধুনিক বিজ্ঞানের সামঞ্জস্যবিধান।’

‘বাপরে!’

‘বাপরে করার কিছু নেই। ওসব জ্ঞানের কচকচি। বেঁচে থাকতে হলে করতেই হয়। ভয় পাবার কিছু নেই।’

অনেকক্ষণ ধরে তারিয়ে তারিয়ে বোতল খেয়ে, চোষ-নলটাকে দুমড়ে বোতলে ঢুকিয়ে, আমরা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলুম। খেলা বেশ জমে উঠেছে। গোপা বললে, ‘এবার কী হবে?’

‘আজকের দিনটা একটু অন্যরকমভাবে খরচ করলে কেমন হয়?’

‘যেমন?’

‘যেমন গানে আছে—বাঁধন হারা, বৃষ্টি ধারা।’

‘প্ল্যানটা শুনি!’

‘এখান থেকে হাওড়া অথবা শেয়ালদা।’

‘শেয়ালদা কাছে।’

‘হাঁ কাছে। যাকে বলে স্টোনস থ্রো। সেখান থেকে একটা ট্রেন। যে কোনো একটা মনের মতন স্টেশনে নামা। সারাদিন ঘোরা। এটা-ওটা খাওয়া। অবশেষে, বেলা শেষে ঘরে ফিরে আসব।’

‘মন্দ না। দিন ছাড়া দিন এক! ডানা খসা পাখির-পালক। নিত্য যা ঘটে যায়, কাল তা ঘটুক। দেখা যাক আজ। নতুন কী পাওয়া যায়!’

‘তাহলে শেয়ালদা?’

‘তাই হোক।’

‘ক্লাস?’

‘ক্লাস নয়। লাইব্রেরি। কাল গেলেও চলবে।’

শেয়ালদা থেকে একটা ট্রেনে দু-জনে চেপে বসলাম। কোন দিক কোন লাইন, দেখার দরকার নেই। শর্ত ছিল, খালি ট্রেন। সে যেদিকেরই হোক। ট্রেন চলেছে আপন মনে। আমরাও বসে আছি বোমভোলা হয়ে। বাতাসে আঁচল উড়ে ডান কাঁধ ডান গাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সর্ব অঙ্গে যেন শীতকম্প। মনে মনে বলছি মৃগু, একি স্বপ্ন, না সত্য? যদি স্বপ্নই হয়—‘স্বপন যদি মধুর এমন/হোক সে নিষ্ঠুর কল্পনা/জাগিও না, তাকে জাগিও না।’

কোলের ওপর হাত দুটো পড়ে আছে। কবজিতে সোনার ঘড়ি টিক টিক করছে। সোনায় যেন সোনা মিশেছে। জীবনে কবিতা লিখিনি তবু কাব্য আসছে! প্রেম আর কাব্য যেন ইলিশ আর সরষেবাটা। যেন লাউ আর চিংড়ি। যেন বাঁকা দুই ভুরু আর টিপ। হাত দুটো, আর চম্পাকলি আঙুলের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, ‘প্রখর রৌদ্র কিরণে মৃণাল ভূজ আলোক সায়রে ক্লান্ত শয্যায় প্রভাত বিরহের দিবা স্বপ্ন দেখছে।’ এর মানে কী মৃগু? জানি না ভাই। আমাতে আর আমি নেই। চিৎপটাং।

দু-জনেরই মুখে কোনো কথা নেই। তাকাই আর মিটি মিটি হাসি। প্রকৃত প্রেমে বকর বকর বেশি থাকে না। হৃদয় থেকে হৃদয়ে উড়াল-পুল তৈরি হয়। ভাষাহীন ভাব আসা যাওয়া করে। আই লাভ ইউ যদিও বা বলা যায়। আমি তোমাকে ভালোবাসি, বোম্বে মার্কা খেলো কথা। কোনও ডেপথ নেই প্যানোরমা নেই, ম্যাদামারা সেন্টিমেন্ট।

এক বাউল ঢুকে একতারা বাজিয়ে গান ধরেছে:

সহজ গোপন প্রেম করলাম না

আমার মনে জানে প্রাণে জানে, অন্যে জানে না।

সহজের ভাব জেনে শুনে,

পীরিত করো সতের সনে,

যেমন কুমরে পতঙ্গ পেলে

কভু ছাড়ে না।

ফ্যানটাসটিক গান! যেমন বাণী, তেমনি সুর, তেমনি গলা। ধ্যাস শালা ব্যাঙ্কে চাকরি! বাউল হয়ে ঘুরে বেড়ানোয় কত সুখ। গোপা হবে বাউলানী। সোনার অঙ্গে গেরুয়া, নাকে চন্দনের তিলক। গ্রামে গ্রামে, মাঠে মাঠে, হাটে বাটে একতারা বাজিয়ে গেয়ে যাও।

আছে এক সোনার মানুষ দেহ-পিঞ্জরে

ও তারে রাখতে নারে কেউ ধরে।

রেখে ঘুমের ঘোরে শয্যার ’পরে

ও সে কোন দেশেতে যায় উড়ে।।

সে মানুষ ঘোরে ফেরে চলে সব সময়

তারে কেউ চোখে দেখে নাই

ও সেই হাওয়ার মানুষ হাওয়ায় বেড়ায়

যে তার মনোমতো হয় তার কাছে সে যায় উড়ে।।

তারে বশ করে কেউ রাখতে পারে না।

সে কত ভাঙে জেলখানা

ও তার সঙ্গে নেয় না সৈন্য-সেনা

সে যে ঢুকতে পারে সব ঘরে।।

চোখ মুখ ঢুলু ঢুলু করে, ভাবের রসকদম্বের মতো গোপাকে বললুম, ‘বাউল হলে কেমন মজা হত! ঊর্ধ্বে আকাশ, পায়ের তলায় সবুজ মাটি, হাতে একতারা, নেচে নেচে, নেচে নেচে।’

গোপা আমার গলা অনুকরণ করে বললে, ‘আহা আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। নেচে নেচে নেচে শেষে লেংচে লেংচে ডাক্তারখানায়, পায়ে প্লাস্টার। ও সব কাব্যি চার দেয়ালের ঘেরায় সোফায় বসে বসেই ভালো লাগে।’

একটু দমে গেলুম। বেশ বিষয়ী মেয়ে নাকি? কে জানে? একদিনে কী আর বোঝা যায়? নারীর মন দেবতারাও বোঝেন না। কুতঃ মনুষ্যা।

স্টেশনের নাম ভবদেবপুর। নামে প্রেম আছে। হইহই করে নেমে পড়া হল। গোপার আর সেই ডক্টরেট, ডক্টরেট ভাব নেই। বেশ সহজ হয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মে একটা বকুলগাছের ছায়ার নীচে দাঁড়িয়ে বললে, ‘অতঃপর!’

চারপাশে ফাঁকা মাঠ। অজস্র গাছ। দু একটা গোরু চরছে। এ তো আগ্রা নয় যে টাঙা ফিট করে তাজমহল দেখতে যাব। গিরিডি নয় যে উশ্রী দেখতে যাব। ভবদেবপুর! ছোট্ট স্টেশন। মাঠ, গাছ, গোরু, পুকুর, গোরু, গাছ, মাঠ ছাড়া কিছুই নেই।

অতঃপর যাত্রা। ‘চলো যাই, চলো যাই, দূর, বহু দূর।’

‘কী আছে সেখানে?’

‘কিছুই হয় তো নেই! না থাকাটাই কত আনন্দের!’

‘তা হলে আমি এই বকুলতলায় বসলুম। বকুলতলার মিষ্টি ছায়া। একটু পরেই শুয়ে পড়ব। এখান থেকে আমাকে আর নড়তে বললেও নড়ছি না।’

‘সে কী কথা। আমরা কী তো কী দেখব বলে এলুম!’

‘কতোও কী দেখবে বলে এলুম!’ গোপা ভেঙচি কাটল। ‘এখানে দেখার কী ঘোড়ার ডিম আছে?’

গোপা গ্যাঁট হয়ে বকুলতলায় বসে পড়ল। যেন কাজের বাড়ির পান সাজতে বসেছে।

‘একটা বটগাছ, শিবমন্দির, নদীর তীরে ভাঙা ঘাট, কিছু না থাক এসব তো আছেই।’

‘বট থাকতে পারে। নদী যেখানে-সেখানে থাকে না। পানাপুকুর অবশ্য অনেক থাকবে।’

‘ভেঙে পড়া জমিদার বাড়ি!’

‘সেসব এখানে নেই। আমার ভীষণ জলতেষ্টা পেয়েছে। আমি মিষ্টি ডাব খাব।’

‘ডাব! ডাব এখানে পাব কোথায়?’

‘ওসব জানি না। আমাকে ধরে এনেছেন কেন?’

‘স্টেশনের বাইরে চলুন চেষ্টা করে দেখি।’

স্টেশনের বাইরে চায়ের দোকান। জিজ্ঞেস করলুম, ‘ভাই ডাব পাওয়া যাবে এখানে?’

‘বাজারের দিকে দেখতে পারেন। পাবেন কি-না জানি না।’

দু-জনে একটা সাইকেল রিকশায় উঠে পড়লুম। রিকশায় ছাড়া প্রেম ঘনীভূত হয় না। কাঁধে কাঁধে ঠেকছে, হাতে, হাত হাঁটুতে হাঁটু। উঁচু নীচু রাস্তায় রিকশা দুলে উঠলে আরও প্রেম। দু-জনে যেন ব্রেড অ্যাণ্ড বাটার।

রিকশাঅলা জিজ্ঞেস করলে, ‘যাবেন কোথায়? উকিলবাবুর বাড়ি?’

‘উকিলবাবুর বাড়িতে যাব কেন?’

‘না সকাল থেকে সবাই যাচ্ছে তো, উকিলবাবুর মেয়ের বিয়ে!’

‘না আমরা বিয়ে বাড়িতে যাব না, আমাদের সেইখানে নিয়ে চলো যেখানে ডাব পাওয়া যাবে।’

‘ডাব! এখানে ডাব পাবেন কোথায়?’

‘তা জানি না। দিদিমণির তেষ্টা পেয়েছে।’

‘ঠাণ্ডা জল খেলে হয় না? এক গেলাস দু গেলাস!’

‘না আমার ডাবই চাই। ডাব ছাড়া আমার চলবে না।’ গোপার একেবারে ধনুকভাঙা পণ।

রিকশা সরসর করে চলতে শুরু করল। কোথায় যাচ্ছে সেও জানে না আমিও জানি না। গোপা রানির মতো বসে আছে, ওভাবে বসে থাকা তারই সাজে। যার অত রূপ! একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে।

মাইলখানেক চলে এলো। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কোথায় চলেছ ভাই?’

‘আমি কী করে বলব কোথায় চলেছি? রাস্তা সোজা চলে গেছে, প্যাডেল ঘুরিয়ে চলেছি।’

গোপা বললে, ‘শুনেছি পৃথিবী গোল, যতই চলুক ঘুরে আবার সেই শুরুর জায়গাতেই আসতে হবে।’

‘সে তো তাহলে বহু বছর পরে। এক যুগও লেগে যেতে পারে।’

রিকশাচালক বললে, ‘আমার বাড়িতে চলুন। ঠাণ্ডা জল খেয়ে, বিশ্রাম করে ফিরে আসবেন। পাঁচটা পাঁচের ট্রেন।’

গোপা লাফিয়ে উঠল, ‘ফ্যান্টাসটিক। সেই ভালো।’

গাড়ি বাঁয়ে বাঁক নিল। পুকুর বাঁশঝাড় আমবাগান ধুলো আঁকাবাঁকা বেড়া ঘেরা বাগানে সে গাড়ি থেমে পড়ল।

‘নিন নামুন।’

গোপা নেমেই বললে, ‘কী সুন্দর বাগানবাড়ি। তুমি তো ভাই বড়োলোক, রিকশা চালাও কেন?’

‘এ বাগান আমার নয় দিদি। কলকাতার এক বাবুর। আমাকে দেখাশোনা করার জন্যে থাকতে দিয়েছেন। রিকশা চালিয়ে যা পাই, আর বাবু যা দেন তাইতে চলে যায় কোনোরকমে।’

বাগানের এক পাশে আটচালা। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সুন্দর ছিমছাম। ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। চৌকির ওপর সতরঞ্চি বিছানো। গোটা দুই মোড়া। দাওয়ায় পরিষ্কার নিকোনো উনুন। বাঁশের আলনায় কাপড়।

গোপা চৌকিতে বসে বলল, ‘স্বর্গ! স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, এই মাটির ধরা ’পরে! তোমার নাম কী গো?’

‘কানু।’

‘বা: সুন্দর নাম। কোনো যুক্তাক্ষর নেই। আচ্ছা এখানে জামরুল পাওয়া যাবে?’

‘জামরুল? না দিদি। তবে আমড়া পাওয়া যাবে। নুন আর লঙ্কা দিয়ে থেঁতো করে দোবো।’

‘আঃ ফ্যান্টাসটিক।’ গোপা জিভে জল টানল। চৌকির ওপর পা মুড়ে এমন ভাবে বসল যেন দেবী চৌধুরানি। হুঁ-হুঁ করে গান ধরল। বেশ প্রাণ আছে মেয়েটির। কে বলবে এই মেয়ে ডক্টরেট করছে দর্শনে!

বাইরের দাওয়ায় শিলে আমড়ার আঁটি ঠুকছে কানু। ঠোকার তালে তালে সেও গান চালিয়েছে। চেনাচেনা গান, রামা, রামা, রামা। কিছু পরেই কচি কলাপাতায় আমড়ার কাঁচা আচার নিয়ে কানু ঘরে এলো। কাঁচা সরষের তেল আর কাঁচা লঙ্কার গন্ধে নোলায় জল এসে গেল।

চৌধুরানি হাসি হাসি মুখে সেই বস্তু গ্রহণ করল কানুর হাত থেকে। কানুর সরল মুখে সে কী তৃপ্তির হাসি। যেন রাষ্ট্রপতি ভারতরত্ন অর্পণ করছেন প্রাপকের হাতে।

মুখে একটা টুকরো ফেলে গোপা টাক করে একটা শব্দ করল। সেই আদি অকৃত্রিম মেয়েদের আচার খাবার শব্দ। মানুষ চাঁদে গেল, আণবিক বোমা ফাটাল, পৃথিবী অন্ধকার থেকে আলোয় এসে গেল—মেয়েদের কিছু কিছু একান্ত ব্যাপার কিন্তু পালটালো না। বাংলার মেয়ে সেই চিরকালের মেয়েই রয়ে গেল।

ঘরের চৌকিতে আচার তেমন জমল না। বাইরের দাওয়ায় গিয়ে বসল উবু হয়ে। সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি। অল্প দূরেই ছায়াঘেরা বাগান। ঘুঘু ডাকছে ক্লান্ত সুরে। ঘাসে ঢাকা জমি থেকে সূর্যের আলোর সবুজ আভা গোপার মুখে এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে সবুজ পৃথিবী বুঝি গোপার রূপে দাওয়ায় বসেছে গ্রীষ্মের দুপুরে। প্রেমে না পড়লেও ওইরকমই মনে হত। ঝালে আর টকে চোখ মুখ কেমন যেন দুষ্টুমি মাখা। নাকের ডগায় ঘাম চিকচিক। ঝালের চোটে মাঝে মাঝে রক থেকে নীচে জমির দিকে জিভ ঝুলিয়ে দিচ্ছে। দু-এক ফোঁটা লালা ঝরে যাবার পর আবার জিভে আচারের টুকরো ফেলছে।

কচি সবুজ কলাপাতার টুকরোটা আমার সামনে এগিয়ে ধরে বললে, ‘খেয়ে দেখুন দুর্দান্ত হয়েছে।’

‘আমি যে ঝাল একেবারে সহ্য করতে পারি না।’

‘তাহলে আমার ঠোঁটের মিষ্টি ঝাল খান।’

হঠাৎ এমন একটা কথা বলে ফেলায় ভীষণ লজ্জিত হয়ে পড়ল। মুখ নীচু করে, পাতার কোণা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললে, ‘প্লিজ কিছু মনে করবেন না। অসভ্যতা করে ফেলেছি।’

‘আমার কিন্তু এই মুহূর্তে আপনাকে খুব আপন মনে হচ্ছে।’

গোপা ফিরে তাকাল। চোখে কোনো দুষ্টুমি নেই। এক ধরনের উদাসীনতা লেগে আছে। ভেবেছিলুম কিছু হয়তো বলবে। কিছুই বলল না। আপন মনে সরু আঙুল চুষতে লাগল।

কানু এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে? এক ঝুড়ি তালশাঁস নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এল। সেও যেন আমাদের অনেক কাছে সরে এসেছে। কানুকে বোম্বে ছবির হিরোর মতো দেখতে। ঘেমে গেছে খুব। ঝুড়িটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘দিদি কচি তালশাঁস। জল টুসটুসে। ডাবের চেয়ে ভালো। দাঁড়ান খুলে খুলে দি। একটা একটা করে খান।’

গোপা বাঁশে ঠেসান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছিল। বাঁ-হাত বাড়িয়ে কানুর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘তোমার কে কে আছেন কানু?’

ছুরি দিয়ে শাঁস ছাড়াতে ছাড়াতে বললে, ‘কেউ নেই দিদি। আমার আমি ছাড়া কেউ নেই।’

গোপা, চোখে বেদনা। মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। হাতে ধরে থাকা কচি কলাপাতা বাতাসে উড়ছে। গোপা বললে, ‘একেবারে একা একজন মানুষ কেমন করে বাঁচে!’

কানু হাসল। হেসে একটি টলটলে তালশাঁস গোপার পাতায় ধীরে ধীরে শুইয়ে দিতে দিতে বললে, ‘দেখবেন দিদি সিলিপ করে বেরিয়ে না যায়।’

গোটা দশেক তালশাঁস গোপা একাই মেরে দিল। কানু বললে, ‘ডাবের চেয়ে ভালো হল না দিদি?’

‘ফ্যান্টাসটিক।’

‘আমি তাহলে চট করে চান সেরে দুটো খেয়েনি। আপনারা একটু বিশ্রাম করে নিন ততক্ষণ।’

কোমরে একটা লাল গামছা বেঁধে কানু দৌড়োল। মনে হয় ওদিকে একটা পুকুর আছে। গোপা পা ছড়িয়ে বসল।

‘গ্রামে থাকতে বেশ লাগে তাই না।’ গোপা এবার দার্শনিক।

‘বেশিদিন ভালো লাগবে না এই যা দুঃখ। শহর আমাদের চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছে।’

‘আমার কিন্তু বেশ লাগছে। কানু ছেলেটা কী সুন্দর!’

‘সব মানুষই সুন্দর। দেখার চোখ থাকা চাই।’

‘তা ঠিক। আমাদের যখন যাকে ভালো লাগে।’

পেছন দিকে দু-হাত ঘুরিয়ে তেলা বাঁশের খোঁটা ধরে গোপা শরীরটাকে পেছনের দিকে বাঁকিয়ে, অদ্ভুত কায়দায় উঠে দাঁড়াল। মেয়েদের বয়েস বোঝা যায় না। তবে শরীর অসম্ভব নমনীয়। আজকাল মেয়েরাও যোগাসন করে।

গোপা বললে, ‘চলুন না আমরাও পুকুরে স্নান করে আসি।’

‘স্নান! গামছা নেই তোয়ালে নেই, স্নান কী করে হবে?’

‘তা ঠিক। ভীষণ সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে। আপনি সাঁতার জানেন?’

‘ছেলেবেলায় শিখেছিলুম।’

‘সাঁতার আর সাইকেল কেউ ভোলে না।’

কানু এসে গেল চান করে। ভিজে চুল বেয়ে জল পড়ছে টপ টপ করে। শরীর মসৃণ তেল চুকচুকে। গামছাটা গাছের ডালে মেলে দিয়ে, দাওয়ার কোণের দিকে যেখানে উনুন, সেইখানে গিয়ে একটা কাঠের টুকরো টেনে বসে পড়ল। অ্যালুমিনিয়ামের থালায় কী যেন চাপা ছিল, কোলের দিকে টেনে নিল।

পান্তা ভাত। ভাঙা কৌটো থেকে বেরোলো পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা। একটা শিশি থেকে খানিকটা সরষের তেল ঢেলে দিল তাতে! গোপা এগিয়ে গেছে, ‘ব্যস, এই তোমার খাওয়া?’

কানু হাসি মুখে বললে, ‘আর কি চাই! এর যা টেস্ট না! রোববার রোববার দুটো ফুলুরি! ভেঙে ছড়িয়ে দি।’

‘আমার খুব খেতে ইচ্ছে করছে।’

কানু লাজুক মুখে বললে, ‘এ আপনি খেতে পারবেন না দিদি। আমি আপনাদের ডিম ভাজা করে দেবো।’

‘ডিম তুমি পাবে কোথায়?’

‘আমার ইস্টকে তিনটে ডিম আছে।’

‘তুমি খাচ্ছ না কেন?’

‘খেলেই যে ফুরিয়ে যাবে।’

গোপা খিল খিল করে হাসল, ‘তুমি খেলে ফুরিয়ে যাবে! আর আমরা খেলে ফুরোবে না!’

‘দিদি ডিম খেলে, ডিম বেড়ে যাবে। আমার তো কেউ কোথাও নেই। সবাই বলে, ব্যাটা রিকশাঅলা। আপনাকে মনে হচ্ছে সত্যিই আমার দিদি।’

গোপা স্তব্ধ হয়ে গেল। ‘দাঁড়াও আমি তোমাকে ডিম ভেজে দি।’

‘ভাজার অনেক হাঙ্গামা দিদি। বাগান থেকে শুকনো কাঠকুটো আনতে হবে। ভাজার জন্যে এই থালাটা খালি করে মেজে আনতে হবে। আমি সপাসপ এটা সেরে দি। তারপর হবে। আমি খুব ভালো ভাজতে জানি। কিছুকাল একটা দোকানে কাজ করেছিলুম।’

‘তাহলে আমরা কাঠ জোগাড় করে আনি।’

গোপা লাফিয়ে বাগানে নামল। একটা কাঠবেড়ালি কী করছিল। ভয়ে লেজ তুলে উঠে গেল সুপুরিগাছে!

সোনা রোদ বেলাশেষে কোল্ড স্টোরেজের কমলালেবুর মতো হলুদ হয়ে এল। পোড়া কাঠের ছাই বাতাসে উড়ছে। অমলেট কানু সত্যিই ভালো ভেজেছিল। তেল লাগা কচি কলাপাতা পড়ে আছে গাছতলায়। কানু বললে, ‘চায়ের জোগাড় নেই, তা না হলে চা খাওয়াতুম। চা, চিনি, দুধ, তিনটেরই ভীষণ দাম। চলুন স্টেশনের দোকানে খাওয়াব। পাঁচটা পাঁচের ট্রেন। এবার উঠতে হবে।’

প্রায় সাতটা বাজল। শেয়ালদায় গিজগিজ করছে লোকে। বাড়ি ফেরার জন্যে সবাই ব্যস্ত। স্টেশনের বাইরে এসে গোপাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘আবার কবে দেখা হবে?’

‘যে কোনো দিন। আজকের দিনটা বড়ো সুন্দর কাটল।’

‘ঠিকানাটা দেবেন?’

একটা কাগজে গোপা ঠিকানাটা লিখে দিল। জিজ্ঞেস করলুম, ‘পৌঁছে দিয়ে আসব?’

হাসল, ‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! লেবু বেশি চটকাতে নেই, তেতো হয়ে যায়।’

দু-জনে দু-পথে পা বাড়ালুম।

পরের দিন বিকেল বেলা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলুম না। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। ঘরদোর সাজিয়ে ফেলেছি মনে মনে। প্রয়োজন হলে পায়ে ধরব। কলজে খুলে উৎসর্গ করব। মেয়ে তো তেমন নয়। শুধু রূপ নয়, হৃদয়ও আছে। রাস্তা খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল না। জিজ্ঞেস করে করে নম্বর বের করে ফেললুম। বেশ কেতাদূরস্ত বিশাল এক বাড়ি। বেল টিপতেই এক অবাঙালি ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন।

‘গোপা ব্যানার্জি? ওয় কোন!’ ভদ্রলোক অবাক হলেন। ও নামে এ বাড়িতে কেউ থাকে না।

কী আশ্চর্য! মেয়েটি আমাকে ধাপ্পা দিয়ে গেল! মানুষ চিনতে আমার কী তাহলে এত ভুল হল! রাতের বেলায় কাগজের টুকরোটা টেবিল-ল্যাম্পের তলায় ফেলে খুব ভালো করে পরীক্ষা করার ইচ্ছে হল। কোনো ভুল হচ্ছে না তো! মুক্তোর মতো গুটি গুটি হাতের লেখা। ওপিঠে কী আছে? হতে পারে, এপিঠে অন্য কারুর ঠিকানা।

ওপিঠে পিঁপড়ের মতো অক্ষরে একটি প্রায় অদৃশ্য লাইন—‘একবারই ভালো। স্বপ্ন থেকে বাস্তবে নাই বা এলাম। সব ভুল!’

সবাই বলে আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি! আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকি। সারাদিন আমি ট্রামে ট্রামে বাসে বাসে ঘুরি। যদি হঠাৎ আবার দেখা হয়ে যায়!

আমি কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে।।

ভবদেবপুরে সেই কানুর আস্তানায় ফিরে ফিরে যাই। কখনো সে থাকে, কখনো সে থাকে না। শূন্য দাওয়ায় বসে থাকি। থাকতে থাকতে এক সময় গোপাকে যেন দেখতে পাই। আচার খাচ্ছে। লাফিয়ে বাগানে নামছে। খোঁটায় পিঠ রেখে বসে আছে পা ছড়িয়ে।

আমার অফিস গেছে। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। সত্যিই কী আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি!

একদিন কানু আমাকে বললে, ‘কেন অমন করছেন! একটা মানুষকে ওভাবে না খুঁজে, মানুষ যিনি তৈরি করেছেন তাঁকে খুঁজুন। তাহলে অনেক অনেক মানুষ পেয়ে যাবেন।’

কানু গানও জানে।

তারে যে দেখেছে

সেই মজেছে

ছাই দিয়ে সংসারে।

হঠাৎ কানু আমাকে এমন একটা কথা বললে! আবার আমাকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। কানু বললে, ‘রূপ না খুঁজে অরূপকে খুঁজুন!’

‘একথা তুমি কোথায় পেলে?’

কানু দেবতার মতো হাসতে হাসতে বললে, ‘জীবন থেকে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *