জিন
“আমি মানুষ ও জিনকে কেবলমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।”
(আল-কোরআন- সূরা যারিয়াত, ৬নং আয়াত, পারা-২৭)
১
আমাদের গ্রামের নাম খাজুরনান। এ বছর এই গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে যে চারজন ছাত্র-ছাত্রী বৃত্তি পরীক্ষা দিবে, তাদের মধ্যে আমিও একজন। অন্যরা হল আমার চাচাতো ভাই রিয়াজুল, সেখ পাড়ার মুজিবর এবং আমার বড় মামার সেজ মেয়ে লালবানু। স্কুলের হেড স্যার হলেন আমার ছোট মামা। দু’বছর হল আমাদের গ্রামে নতুন স্কুল হয়েছে। এ বছর প্রথম বৃত্তি পরীক্ষার জন্য আমাদেরকে পাঠানো হবে। সকালে ও রাতে হেড স্যারের বাড়িতে গিয়ে আমাদের পড়তে হচ্ছে। স্কুলের ছুটির পরও তিনি দেড়-দু’ঘন্টা পড়ান। আমাদের বাড়ি স্কুলের ও মামাদের বাড়ির কাছে। মুজিবরের বাড়ি কিছুটা দূরে। মুজিবর আমাদের মধ্যে সব থেকে ভালো ছাত্র। সে একজন গরিব রংমিস্ত্রির ছেলে। তার সঙ্গে ক্লাস টু-থেকে আমার বন্ধুত্ব। তখন আমরা পাশের গ্রামের ভূঁ“এ”ড়া স্কুলে পড়তাম। পরের বছর আমাদের গ্রামে স্কুল হতে আমার সঙ্গে মুজিবরও এই স্কুলে চলে আসে।
পরিক্ষার সেন্টার পড়েছে পাঁচ মাইল উত্তরে বাগনান হাইস্কুলে তাই পরিক্ষার দু’দিন আগে আমার মেজ চাচা আমাদের চারজনকে ওঁর খালাতো ভাইয়ের বাড়ি টেপুরে নিয়ে এলেন। এখানে থেকে আমরা পরীক্ষা দেব। টেপুর থেকে পরীক্ষার সেন্টার পনের মিনিটের পথ। তাদের অবস্থা খুব ভালো। যেমন বাড়িঘর তেমনি বৈঠকখানা। তখন এপ্রিল মাস খুব গরম পড়েছে। আমরা বৈঠকখানায় থেকে এক সঙ্গে পড়াশুনা করতাম। এক বিছানায় ছেলে তিনজন মশারী খাঁটিয়ে ঘুমাতাম। আর লালবানু বাড়ির ভিতরে মেয়েদের কাছে ঘুমাতো। মেজ চাচা আমাদের পাশে আলাদা বিছানায় ঘুমাতেন। আমরা দু’টো হারিকেন নিয়ে গিয়েছিলাম। রাতে দুটো হারিকেন জ্বেলে গোল হয়ে বসে পড়তাম। বলা বাহুল্য আমার মেজ চাচাও আমাদের স্কুলের একজন মাস্টার।
সবাই বেশ ভালোভাবেই পরিক্ষা দিলাম। শেষ পরিক্ষার দিন মেজ চাচা। আমাদেরকে বাগনানের চিত্রবাণী সিনেমা হলে “ক্ষুদিরাম” বই দেখালেন। সিনেমা দেখে ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা গল্প করতে লাগলাম। এক সময় মেজ চাচা বললেন, এবার ঘুমিয়ে পড়। আর গল্প করিস না। আমরা ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে রিয়াজুল ও মুজিবর ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু গরমের জন্য আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। ওদেরকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। মেজ চাচারও সাড়াশব্দ না পেয়ে বুঝতে পারলাম, তিনিও ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাড়ির ভিতরের দেওয়াল ঘড়িতে বারোটা বাজতে শুনলাম। তখনও আমার চোখে ঘুম নেই। মাঝে মাঝে এপাশ ওপাশ করছি। মুজিবর আমার পাশে শুয়েছিল। ঘুমের ঘোরে সে আমার গায়ে পা তুলে দিল। আমি বিরক্ত হয়ে তার পা সরিয়ে দিয়ে বললাম, এই মুজিবর ঠিক করে শো। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলাম, বৈঠকখানার সামনের রাস্তা দিয়ে কালো আলখেল্লা পরা খুব লম্বা একটা মানুষ চলে যাচ্ছে। মানুষটা এত লম্বা যে, রাস্তার পাশের বড় নারকেল গাছের ঝুলন্ত পাতার কাছে তার মাথা। দেখে আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। মেজ চাচাকে ডাকতে গেলাম; কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বের হল না। নড়াচড়া করতেও ভয় লাগছে। কোনো রকমে পাশ ফিরে মুজিবরকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঠ হয়ে পড়ে রইলাম। এভাবে জেগে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। মেজ চাচার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর রাতের দৃশ্যটা মনে পড়ল। ভয়ে ভয়ে সবার সাথে নামায পড়ে এসে যে যার বেডিংপত্র ও বইখাতা গুছিয়ে ফেললাম। গত রাতেই মেজ চাচা আজ সকালে বাড়ি চলে যাবার কথা বলেছিলেন।
আমরা সকলে বাড়ির ভিতরে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করতাম ও সবকিছু গোছগাছ হয়ে যাবার পর সবাই ভিতরে গিয়ে নাস্তা করলাম। তারপর রিয়াজুল, মুজিবর ও লালবানুকে মেজ চাচা বললেন, তোমরা বাইরে গিয়ে বসো আমরা আসছি।
মেজ চাচার খালাতো ভাই তিনজন। আমরা বড়র কাছে খাওয়া দাওয়া করেছি। তার নাম আব্দুর রসিদ। আব্দুর রসিদের স্ত্রী বাঁজা। তাই তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। বড় চাচি এই কয়েকদিন আমাকে আপন ছেলের মতো করে নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী হয়েছে? এতো মন খারাপ কেন? কোনো অসুখ-বিসুখ করেনি তো? তারপর বুকে ও কপালে হাত ছুঁয়ে পরিক্ষা করে বললেন, কই জ্বরটরতো হয়নি।
আমি বললাম, না চাচি আম্মা, আমার কোনো অসুখ হয়নি।
: তাহলে তোমার মুখ অত শুকনো কেন? চোখও লাল। রাতে কি ঘুমাওনি?
: গরমের জন্য ঘুম আসছিল না। আপনাদের দেওয়াল ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতে শুনি। তারপর যা দেখেছিলাম বললাম।
বড় চাচি কিছু বলার আগে মেজ চাচা হেসে উঠে বললেন, অন্ধকার রাতে গাছপালা দেখে ঐ রকম মনে হয়েছে। তোর দেখার ভুল।
বড় চাচি মেজ চাচাকে বললেন, না মেজ ভাই, ও যা দেখেছে তা ভুল নয়। ওঁকে আমরাও অনেকবার দেখেছি। তোমার ভাই বলে, উনি জিনদের একজন আলেম। বহুবছর ধরে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে এখান দিয়ে যান। কোথায় থেকে আসেন, কোথায় যান, তা কেউ জানে না। তবে কখনো কারো কোনো ক্ষতি করেন না।
মেজ চাচা বললেন, তা হলে হবে হয়তো। যাকগে, আমরা এখন চলি। আমি চাচি আম্মাকে সালাম করলাম।
উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় ও দু’গালে চুমো খেয়ে বললেন, তুমি কয়েকদিন আমার কাছে থেকে যাও।
আমি গত রাতে যা দেখেছি তাতে ভয় পেয়ে এখানে থাকতে আমার মন চাইল না। সেই কথা আমি বলতে যাবার আগে মেজ চাচা বললেন, পরে একসময় এসে থাকবে। এখন থাকা চলবে না। তারপর আমরা বেরিয়ে এসে সকলে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম।
আমার মায়ের এক ফুপার জিন হাসিলের আমল ছিল। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে তার বাড়ি। তিনি জিনে ধরা রুগীকে তদ্বির করে ভালো করতেন। বহু দূর দূর গ্রামের লোক এসে তার কাছে জিনের তদ্বির করে নিয়ে যেত। তাকে আমি নানা ডাকতাম।
আমার চাচাতো ভাইয়ের এক জামাইয়েরও জিন হাসিলের আমল ছিল। তিনি বংশের বড় জামাই। তার নাম সহিদুর রহমান। তিনি কোনো তদ্বির করতেন না। একই পাড়ায় বাড়ি। আমরা সবাই তাকে খাঁ সাহেব বলে ডাকতাম। আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তার বাংলায় অনেক ধর্মীয় কিতাব ছিল। আমি হাই স্কুলে ভর্তি হবার পর সেইসব কেতাব পড়ি। তার কাছে জিনের অনেক রকম কথা শুনে শুনে আমার জিন দেখার খুব ইচ্ছা হল। বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে যাকে দেখলাম, সে জিন বলে জানলেও অন্ধকার রাতে দূর থেকে ছায়ার মতো দেখেছিলাম। কাছ থেকে দেখার খুব ইচ্ছা হল। তাই একদিন খ সাহেবকে বললাম, আমাকে জিন দেখাবেন?
খাঁ সাহেব হেসে উঠে বললেন, তুমি শালা ছেলেমানুষ। জিন দেখলে ভয়ে মরে যাবে। সেয়ানা হও তখন দেখাব।
তার কাছে বিফল হয়ে পাড়ার চাচা ও বুড়ো দাদাদের জিজ্ঞেস করলাম, তারা জিন দেখেছে কি-না?
অনেকে বলল, জিনকে সহজে দেখা যায় না। গভীর রাতে তারা চলাফেরা করে। যদি কোনো মানুষ কোনো কারণে জিনের সামনে পড়ে যায়, তাহলে সেই জিন ভালো হলে সাপ হয়ে লুকিয়ে যায়। আর যদি খবিশ হয় অর্থাৎ খারাপ জিন হয়, তাহলে মানুষকে ভয় দেখায় অথবা তার ক্ষতি করে। আবার অনেকে বলল, আমাদের মসজিদে জিনেরা গভীর রাতে নামায পড়তে আসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জিনদেরকে মানুষের আকৃতিতে দেখেছে। তবে জিনদের পা দুটো ঘোড়ার খুরের মতো।
গোলাম রসুল নামে দূর সম্পর্কের এক চাচা বলল, গরমের সময় আমি একরাতে মসজিদের সিঁড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ গভীর রাতে কেউ যেন আমাকে একটা থাপ্পড় মারল। মারের সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ। মেলে চেয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু শুনতে পেলাম কেউ যেন বলছে, “মসজিদ কা সিঁড়িমে বেয়াদব কি তরফ শো রাহা।” আমি ধড়মড় করে উঠে দেখি আমার পরনের লুংগী হাঁটুর উপরে উঠে গেছে। লুংগী হাঁটুর নিচে নামিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে খুব ভয় পেলাম। তখনও পিঠে থাপ্পড় মারার জায়গাটা ব্যথা করছিল! তাড়াতাড়ি করে ঘরে চলে গেলাম। পরের দিন ঘটনাটা আব্বাকে বললাম, আব্বা বলল, মসজিদে জিনেরা নামায পড়তে আসে। তোর হাঁটুর কাপড় উঠে গিয়েছিল বলে মেরেছে। আমাকেও ঐ একই কারণে একবার মেরেছিল।
গরমের সময় খাঁ সাহেব ও আরও অনেকে মসজিদে ঘুমায় জেনে আমিও তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে ঘুমাতে শুরু করলাম। গোলাম রসুল চাচার কাছে ঐ কথা শুনার পর খুব সাবধানে ঘুমাতাম। আর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতাম জিন দেখার জন্য। কিন্তু দেখতে পাইনি। যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একটা কিতাব পেলাম। কিতাবটা খাঁ সাহেব এতদিন চাবি দিয়ে রেখেছিলেন। আজ হয়তো ভুলে টেবিলের উপর রয়ে গিয়েছিল। বইটা পড়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমিও জিন হাসিলের আমল শিখব। তা হলে জিনকে ডাকলেই আমার সামনে হাজির হবে। তখন আমি তাকে স্বচক্ষে দেখতে পাব এবং তাকে যা হুকুম করব তাই সে করবে। কথাটা একদিন খাঁ সাহেবকে বললাম।
খাঁ সাহেব বললেন, এটা খুব কঠিন কাজ। সবাইয়ের দ্বারা হয় না। একটু ভুল ত্রুটি হলে জিনেরা তোমার ক্ষতি করবে। এমনকি মেরে ফেলতেও পারে।
আমি বললাম, তাহলে আমাকে জিন দেখান।
খাঁ সাহেব বললেন, ঠিক আছে, সময় মতো একদিন দেখাব।
তিনি বললেন বটে, কিন্তু নানা রকম অসুবিধের কথা বলে টালবাহানা করে কাটাতে লাগলেন। বুঝতে পারলাম, তিনি দেখাবেন না। একদিন মায়ের ফুপাকে ঐ কথা বললাম। তিনিও খাঁ সাহেবের মতো বললেন। তখন আমি জিন ও তাদেরকে হাসিল করার অনেক বই পুস্তক যোগাড় করে পড়তে শুরু করলাম। প্রায় প্রত্যেক বইয়ে জিন হাসিলের নিয়ম-কানুন লেখার শেষে বলা আছে ওস্তাদ ছাড়া নিজে নিজে এটা করতে গেলে ভীষণ বিপদ হবে। ওস্তাদ ধরার পরও জিনেরা তোমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে। তখন ওস্তাদ তোমাকে রক্ষা করবেন। সেই জন্যে কোনো বুজুর্গ লোককে পীর ধরবে। তারপর তার হুকুম ও উপদেশ নিয়ে এই কাজে নামবে। আমি চিন্তা করে ঠিক করলাম, ফুরফুরা শরীফের বড় হুজুরের কাছে মুরীদ হয়ে জিন হাসিলের আমল শিখবো। আমাদের ওখানকার মুরুব্বিরা ওঁর মুরিদ। তাদের মুখে শুনেছিলাম, ফুরফুরা শরীফে ওঁদের মাদ্রাসায় জিনদের ছেলেরাও পড়ে।
ওখানে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের ২১/২২/২৩ তারিখে তিন দিন উরশ হয়। সে বছরে আমি আমার সমবয়সি দূর সম্পর্কের এক চাচার সঙ্গে উরশের সময় ফুরফুরা শরীফে গিয়ে বড় হুজুরের কাছে মুরীদ হলাম। তিন দিন সেখানে ছিলাম। কিন্তু হুজুরের কাছে যেতেই পারলাম না। সব সময় তার কাছে বড় বড় আলেমদের ভিড়। তিনদিন পর ফিরে এলাম। এরমধ্যে মা যেন কার কাছ থেকে। জেনে গেছে, আমি জিন হাসিলের আমল শিখার জন্য ফুরফুরা শরীফে পীর ধরতে গেছি। সেখান থেকে আমি ফিরে আসার পর মা আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করল।
আমি স্বীকার করলাম।
মা বলল, খবরদার ঐ, জিনিস কখন শিখবি না। জিনেরা তোর দুশমন হয়ে যাবে। তোকে সুযোগমত শেষ করে ফেলবে। আমার এক খালু জিন হাসিলের আমল করতে গিয়ে পাগল হয়ে মারা গেছে। তাকে আমি কিছুতেই ঐ জিনিস শিখতে দেব না। তারপর আমার একটা হাত নিয়ে তার মাথায় রেখে বলল, তুই ওয়াদা কর, জীবনে কোনোদিন জিন হাসিলের আমল শিখবি না। মায়ের চোখ দিয়ে তখন পানি পড়ছিল।
মায়ের চোখে পানি দেখে বললাম, আমি ওয়াদা করলাম। তারপর থেকে জিন হাসিল করার বাসনা চিরকালের জন্য ত্যাগ করলাম।
২
এই ঘটনার কিছুদিন পর এক রাতে আমার এক চাচাতো চাচার বিয়ে দিতে গেলাম। মেয়েটা আমাদের গ্রামেরই অন্য পাড়ার। বিয়ে হয়ে যাবার পর খেয়েদেয়ে আমি ও রিয়াজুল রাত তিনটের সময় বাড়ি ফিরে এলাম। রিয়াজুল ও আমার মধ্যে খুব ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব। নিচের ক্লাস থেকে একসঙ্গে পড়ছি। সব সময় এক সঙ্গে থাকি। সেদিন ছিল জ্যোৎস্না রাত। বৈঠকখানার কাছে এসে রিয়াজুল বলল, ডাব খেতে পারলে হতো।
আমি বললাম, ঠিক কথা বলেছিস। এই গাছের ডাব খাব বলে বৈঠকখানার পাশে এজমালী গাছটা দেখালাম।
রিয়াজুল বলল, আস্তে বল, দেখছিস না, বড়বেটা শুয়ে আছে। আমরা বড়চাচাকে বড়বেটা বলতাম। ওঁনি বেশ কিছুদিন থেকে বৈঠকখানায় ঘুমাতেন। তারপর আবার বলল, এই গাছে তুই কি উঠতে পারবি?
বললাম, কেন পারব না, এর থেকে কত মোটা ও বড় তাল গাছে উঠে পাখির বাচ্চা পেড়েছি, তা তো তুইও জানিস।
কিন্তু ডাব পাড়ার শব্দ হলে বড়বেটা জেগে যাবেন।
ডাব পড়বে না, কাঁদি কেটে নামাব। তুই এখানে দাঁড়া, আমি কাটারী ও রশি নিয়ে আসি। এইকথা বলে আমি ঘর থেকে সেগুলো নিয়ে ফিরে এসে লুংগীটা মালকোচা মারলাম। তারপর কাটারী ও রশি পিছনের দিকে কোমরে গুঁজে নিয়ে গাছে উঠতে লাগলাম। এই গাছটায় গেছোল ছাড়া কেউ উঠতে পারে না। আমিও এর আগে কানোদিন উঠিনি। গাছটা খুব মোটা, আর অর্ধেকের পর থেকে পেট খাওয়া বাক। সেই বাকে এসে আমাকে থামতে হল। কারণ সেখানটা কিছুতেই টপকাতে পারছিলাম না। একটু জিরিয়ে নিয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করতে পা ফসকে হড়হড় করে নেমে এলাম।
রিয়াজুল জানে আমি গেছোলের থেকে কম না। আতঙ্কিত স্বরে বলল, কিরে উঠতে পারলি না?
বললাম, শালা ঐ বাঁকটার কাছে গাছটা খুব মোটা। ওখানে উঠবার সময় পা ফসকে গেল। এবার ঠিক পারব বলে আবার উঠতে লাগলাম। এবারও একই ঘটনা ঘটল।
রিয়াজুল বলল, ডাব খাবার দরকার নেই। শুনেছি রাতের বেলা গাছে ভূত থাকে, সে তোকে ঠেলে নামিয়ে দিচ্ছে।
আমি বললাম, ভূতটুত বলে কিছু আছে নাকি? তবে জিন বলে একটা জাত আছে। তাদের কাউকে দেখার জন্য কত চেষ্টা করলাম, দেখতে পেলাম না। এখন তুই আবার ভূতের কথা বলছি। আমি ওসব বিশ্বাস করি না। তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? এবার ইনশআল্লাহ ঠিক উঠতে পারব। তারপর আমি আবার উঠতে লাগলাম। এবার অনেক কষ্ট করে সেই বাকটা পার হয়ে মেথিতে উঠলাম। তারপর ডাবের একটা কাঁদি কেটে রশিতে করে বেঁধে কাটারীসহ নামিয়ে দিলাম। তারপর আমি গাছ থেকে নেমে এসে রিয়াজুলকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললাম, কিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? গাছের মাথায় ভূতকে তো খুঁজে পেলাম না। চল স্কুলের ধারে বসে বসে খাব।
রিয়াজুলের এতক্ষণে ভয় কেটে গেছে। বলল, ডাবের কাঁদি নামতে দেখে মনে করেছিলাম, ভূত তাকে মেরে রেখে ডাবের কাদি কেটে নামাচ্ছে। নিচে এসে আমাকেও মেরে ফেলবে।
আমি অনুচ্চস্বরে হেসে উঠে বললাম, তোর মতো ভীতু আর নেই। তারপর আমরা ডাবগুলো স্কুলের কাছে নিয়ে এসে দু’জনে চারটে খেলাম। বাকিগুলো স্কুলের পাশের পুকুরে ডুবিয়ে রেখে এলাম আগামীকাল রাতে খাব বলে।
আমরা যখন বৈঠকখানায় এসে ডাব খাবার কথা বলছিলাম তখন বড়বেটা জেগেই ছিলেন। তিনিও জানতেন গেছোল ছাড়া ঐ গাছে কেউ উঠতে পারে না। তাই আমরা শেষমেষ কি করি দেখার জন্য চুপ করে ছিলেন। তারপর সব ঘটনা দেখেশুনে অবাক হলেন। পরের দিন সকালে বড় চাচিকে বললেন, ফরিদুলের কি দুরন্ত সাহস। তারপর ডাব খাওয়ার কথা বর্ণনা করলেন। বড় চাচি সে কথা মাকে বললেন। মা শুনে এক সময় আমাকে কসম খাইয়ে বলল, তুই আর কখনও রাতের বেলা গাছে উঠবি না। সেই থেকে রাতে গাছে উঠা ছেড়ে দিলাম।
এর দু’তিন দিন পর একরাতে আমার স্বপ্নদোষ হল। আমি গোসল করার জন্য স্কুলের পাশের পুকুরে গোসল করতে যাচ্ছি। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় চারিদিক ফুটফুটে হয়ে আছে। বৈঠকখানা পার হয়ে কিছুটা এসে দেখলাম, মসজিদের অল্পদূরে যে খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানে রাস্তার ধারে বেশ বড় তুলোর স্তূপ। স্তূপটাতে চাঁদের আলো পড়ে আরও বেশি সাদা ধবধব করছে। দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। ভাবলাম, এখানে এভাবে তুলো পড়ে রয়েছে কেন? অন্য যে কেউ হলে ভয় পেত। আমার কিন্তু ভয় ডর বলে কিছু ছিল না। সেটার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার ধারণাই ঠিক, সেটা তুলোরই স্তূপ। হঠাৎ আমার মন বলল, হাত দিয়ে পরিক্ষা করতে যেও না, শুননি জিনেরা মানুষের সামনে পড়ে গেলে যে কোনো জিনিসের রূপধারণ করে? তুমি এখন নাপাক অবস্থায় রয়েছ। তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও। নচেৎ তোমার বিপদ হতে পারে। কথাটা মনে হতে আমি দ্রুত পুকুর ঘাটে এসে গোসল করলাম। তারপর ফিরার সময় চিন্তা করলাম, এবার দেখব জিন বেটা কেমন। খা সাহেবকে যখন জিন হাসিলের আমল শিখাতে বলেছিলাম তখন শেখায়নি। কিন্তু জিনের সামনে পড়ে গেলে কোরআন শরীফের কোন আয়াত পড়তে হয়। শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, ঐ আয়াত পড়লে জিন ভয় পেয়ে তীরের মতো ছুটে পালাবে। সেই আয়াতটা মনে মনে পড়তে পড়তে সেখানে এসে দেখি, তুলোর স্তূপটা নেই। চারপাশে তাকিয়েও কিছুই দেখতে পেলাম না। মৃদু হেসে বিড়বিড় করে বললাম, দূর থেকে আয়াতটা পড়াতেই ব্যাটা পালিয়েছে।
পরের দিন খাঁ সাহেবকে ব্যাপারটা বললাম।
খাঁ সাহেব বললেন, ওটা ভালো জিন, তাই তোমাকে নাপাক অবস্থায় পেয়েও কিছু বলেনি।
আরও ছয়-সাত মাস পরের ঘটনা। তখন শীতকাল। আমি সব সময় জামাতে নামায পড়ি। সেদিন এশার নামায পড়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। অন্ধকার রাত। তাই হারিকেন নিয়ে বেরিয়েছি। মসজিদের কাছে এসে দেখলাম, খুব শীত পড়েছে বলে দরজা অল্প ফাঁক রেখে ভিড়ান। আমার খড়মের শব্দ পেয়ে খা সাহেব মসজিদের ভিতর থেকে বললেন, কে ফরিদুল?
আমি সাড়া দিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
খাঁ সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি অযু করে এসো, আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
আমাকে তখন পেশাবে পেয়েছে। আমি পেশাব করে কুলুপ নিয়ে ঘাটের দিকে এগোলাম। ঘাটের কাছে গিয়ে দেখলাম, খুব বড় বড় লোমওয়ালা কালো কুচকুচে একটা কুকুর ঘাটের নিচের ধাপে দু’পা ও উপরের ধাপে দু’পা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমার মামাদের একটা ঠিক ঐ রকম কুকুর ছিল। তার ভয়ে বাইরের কোনো লোক বা আত্মীয়-স্বজন বাড়ির ভিতর ঢুকতে পারত না। তবে কুকুরটা আমাকে কিছু বলত না।
আমি গেলে আমার কাছে এসে কুঁই কুঁই করে লেজ নাড়াত। তার নাম ছিল কালু। আমি তখন তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলতাম, কিরে কালু কি খবর? খিদে পেয়েছে বুঝি? তারপর বড় মামিকে বলতাম, বড় মামি, কালুকে আজ পেট ভরে খেতে দাওনি বুঝি?
বড় মামি বলতেন, কেন দেব না। রোজ যেমন দিই তেমনি দিয়েছি। ও। তোমাকে দেখলেই অমন করে।
আমি বলতাম, এখন না হয় ওকে কিছু খেতে দাও। দেখছ না কেমন করছে।
বড় মামি হেসে উঠে ভাতের সঙ্গে কিছু তরকারি মিশিয়ে খেতে দিত। মামাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছেই। আমি প্রায় নানিকে দেখতে যেতাম।
ঘাটের কুকুরটাকে দেখে মামাদের কুকুর বলে মনে হল। তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, এই কালু সর, আমি অযু করব। তারপর এগোতে গেলে কুকুরটাকে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করতে দেখে আমার কেন জানি সন্দেহ হল, এটা মামাদের কুকুর নয়। মামাদের কুকুরটার সারা শরীর কালো লোমে ঢাকা হলেও তার ডান পায়ের থাবার উপর বেশ বড় একটা গোলাকার সাদা চাকতির মতো দাগ আছে। মনে সন্দেহ হতে হারিকেনটা একটু সামনে বাড়িয়ে ডান পায়ের থাবার সেই সাদা চাকতিটা দেখতে গিয়ে দেখলাম, নেই। তখন আমার মনে পড়ল, খাঁ সাহেব বলেছিলেন, “জিনেরা মানুষের সামনে পড়ে গেলে যে কোনো জিনিসের রূপে বদলে যায়। কিন্তু যা হবে তা এক রংয়ের।” সেই কথা মনে পড়তে জীবনে এই প্রথম ভয় পেলাম। কারণ আমার দৃঢ় ধারণা হল, এ জিন। খাঁ সাহেবের শেখান দোয়াটা পড়তে গিয়েও পড়তে পারলাম না। কারণ তখনও আমি কুলুপ ধরে আছি। ততক্ষণে কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পিছনের দিকে একটু ঝুঁকেছে, আমি তা বুঝতে পেরে দ্রুত ছুটে ফিরে এসে মসজিদের সিঁড়ির প্রথম ধাপে উঠে খাঁ সাহেব বলে চিৎকার দিয়ে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
দশ বারোজন মুসল্লি মসজিদের ভিতর আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সবাই আমার চিৎকার শুনতে পেয়ে ছুটে এল। সকলের আগে খাঁ সাহেব এসে আমাকে ঐ অবস্থায় দেখে সিঁড়ির চাতালে শুইয়ে দিল। ততক্ষণে অন্যরাও এসেছে। খাঁ সাহেব তাদের একজনকে বদনায় করে পানি আনতে বললেন। পানি নিয়ে এলে, তিনি পানি দম করে আমার চোখেমুখে ছিটা মারতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার জ্ঞান ফিরে এল। খাঁ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার বলতো ভাই?
আমি ঘটনাটা বললাম।
খাঁ সাহেব বললেন, ভয় নেই, ও তোমার চোখের ভুল। চল অযু করবে, আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।
আমি ভয়ে ভয়ে খাঁ সাহেবের সঙ্গে সেই ঘাট থেকে অযু করে এসে নামায পড়লাম।
এই ঘটনার দু’দিন পর এশার নামায পড়তে এসে মসজিদের কাছে পাড়ার গোলাম আলী দাদাকে ঘাট থেকে অযু করে উঠে আসতে দেখলাম। আমি পেশাব করব বলে ঘাটের একটু দূরে গেছি এমন সময় দেখি একটা গোলাকার চতুষ্পদ জন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি ভয় পেয়ে গোলাম আলী দাদাকে ডেকে বললাম, দাদা তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসুন। তিনিও সেদিনকার ঘটনার সময় মসজিদে ছিলেন। তার কাছেই আমি জ্ঞান হারাবার পর কি ঘটেছিল শুনেছিলাম।
আমার ডাক শুনে গোলাম আলী দাদা তাড়াতাড়ি করে আমার কাছে এসে বললেন, কি ভাই কি হয়েছে?
ততক্ষণে সেই প্রাণিটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমি তাকে ব্যাপারটা বলে বললাম, আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি পেশাব করে অযু করে নিই। তারপর মসজিদে এসে কথাটা খাঁ সাহেবকে বলি।
খাঁ সাহেব বললেন, সেদিন তোমাকে বলি নাই, আজ বলছি। এই দু’দিন যা দেখেছ, তা হল জিন। তুমি রাতের বেলা কখনও একা বেরিও না। কালকে তোমার মায়ের ফুপাকে ঘটনাটা বলে তদ্বির করে নিও।
সেদিন ঘরে ফিরে মাকে দু’টো ঘটনা বলে খাঁ সাহেবের কথা বললাম। বিয়ের খোঁপা-৩
মা আতঙ্কিত স্বরে বলল, কই সেদিন তো কিছু আমাকে বলিনি? রাতে তুই আর মসজিদে নামায পড়তে যাবি না। কালকেই তোর নানাকে বলে তদ্বির করে দিতে বলব। আর শোন, রাতে কোথাও যাবার দরকার হলে কাউকে সঙ্গে নিবি।
পরের দিন মা তার ফুপাকে আমার ঘটনা বলল ও তিনি বললেন, ঠিক আছে, কাল এর ব্যবস্থা করব।
পরের দিন নানা মাকে বললেন, আচ্ছা মা, তুমি খুব মনে করে দেখ তো, তোমার এই ছেলে যখন পেটে ছিল অথবা ছোট ছিল তখন কোনো মানত। করেছিলে কি না?
মা অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তবে আপনার কথা শুনে আবছা আবছা যেন মনে পড়ছে, কি ব্যাপারে যেন এর জন্য ছাগল। সদকা দেব বলে মানত করেছিলাম।
নানা বললেন, যত তাড়াতাড়ি পার দু’একদিনের মধ্যে একটা এক রংয়ের ছাগল কিনে সদকা দিয়ে দাও। তারপর আমি একটা তাবিজ দেব, সেটা মাদুলীতে ভরে ওর ডান হাতে বেঁধে দিবে।
বাপ-চাচারা সবাই আলাদা। আব্বা তখন চাষবাসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সেই দিনেই মা আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, তোর আব্বার সময় নেই। তুই আজ স্কুলে যাস না। তোর নানা যে রকম ছাগলের কথা বলেছে, সে রকম একটা ছাগল কিনে নিয়ে এসে সদকা দেবার ব্যবস্থা কর।
আমি সারাদিন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে খুঁজলাম, কিন্তু এক রং এর ছাগল পেলাম না। পরের দিন দূরের একগ্রামে গেলাম। সেদিনেই ছাগলটা কিনে এনে সদকা দিয়ে দিলাম। তারপর মা মাদুলীটা আমার ডান হাতে বেঁধে দিল। এরপর থেকে আমি আজ পর্যন্ত আর কোনো কিছু দেখিনি। এর কিছুদিন পর আমার ঐ নানা মারা যান।
৩
ম্যাট্রিক পাস করার দু’বছর পর আমি প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারির চাকরি পাই। এর দু’বছর পর আমার বিয়ে হয়। বিয়ে হবার এক বছর পর একদিন স্কুল থেকে বিকেল চারটের সময় বাড়ি ফিরে শুনি, আমার ছোট চাচার একমাত্র ছেলে। আনসারকে দুপুরের পর থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার ছোট চাচি ভীষণ কান্নাকাটি করছে। ছোট চাচা ও চাচি আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। আমাকে দেখে ছোট চাচি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ফরিদুলরে, আমার আনসারকে তুই খুঁজে এনে দে।
আমি বললাম, চুপ কর ছোট চাচি। ইনশআল্লাহ আমি আনসারকে খুঁজে এনে দেব।
সেখানে আমার মা ছিল। তাকে আমি বললাম, কি করে কি হল বলতো মা।
মা বলল, আমরা দুপুরে চার পাঁচজন মেয়ে পোনা পুকুরে গোসল করছিলাম। সেই সময় আনসারের মা আনসারকে নিয়ে এসে তাকে গোসল করিয়ে ঘাটের উপর তুলে দিয়ে বলল, তুই ঘরে যা। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমরা সবাই গোসল করে ঘরে এসে শুনি, আনসার আসেনি। তারপর থেকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমাদের বাস্তুর পর পাশাপাশি সাতটা পুকুর। বাপ-চাচারা ততক্ষণে সেই সব পুকুরে খেয়া জাল ফেলে খোঁজ করেছে। সে কথা জেনে আমি তাদেরকে বললাম, সব পুকুরেই আবার বেড় জাল দিয়ে দেখতে হবে। তারপর আমি নিজে জেলে পাড়ায় গিয়ে জেলেদের নিয়ে এসে সব পুকুরে জাল টানালাম। কিন্তু না, আনসারকে পাওয়া গেল না। সবাই মনে করেছিল, আনসার ঘরে আসার সময় ছেলেমি খেয়ালে অন্য পুকুরে আবার গোসল করতে নেমেছিল। হয়তো পানিতে ডুবে গেছে। জেলেদের বিদায় করতে করতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। যারা আশপাশের গ্রামে খুঁজতে গিয়েছিল, তারাও বিফল হয়ে একে একে ফিরে এল। সেই রাতে ছোট চাচির কান্নাতে আমরা ঘুমাতে পারলাম না।
আমার ঐ নানা যিনি জিনের তদ্বির করতেন, তার এক শাগরেদ ছিল। তিনি একজন আলেম। তার জিন হাসিলের আমল ছিল। তিনিও জিনে ধরা রুগীর তদ্বির করতেন। তার বাড়ি আমাদের বাড়ির প্রায় আট’নয় মাইল উত্তর-পশ্চিমে আজানগাছি গ্রামে। রাত্রে পুরুষরা সলাপরামর্শ করে ঠিক করল, কাল সকালে তাকে নিয়ে এসে হজরত (এক রকমের তদ্বির) করে দেখবে, আনসার কোথায়। আর তাকে নিয়ে আসার ভার পড়ল আমার উপর। আমার সাইকেল ছিল। আমি পরের দিন ফজরের নামায পড়ে তাকে আনার জন্য সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তার বাড়িতে গিয়ে শুনলাম, তিনি কলকাতায়। কথাটা শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। মাঝ পথে বিশাল চওড়া রূপনারায়ণ নদী। সেই নদীর খেয়া পারাপার হয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল। যখন বাড়ি ফিরলাম তখন দুপুর। আমার কাছে সেই আলেমের কথা শুনে আমার ছোট চাচা বলল, আমরা বেনাপুর গ্রাম থেকে একজন গুণীন এনেছিলাম। সে বলল, আনসারকে জিনেরা তুলে নিয়ে গেছে। পরশু রাতে খুব ভোরে মসজিদ পুকুরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ফেলে দিয়ে যাবে। আপনারা তাকে সকালে ঐ জায়গায় পাবেন; তবে মৃত।
শুনে আমি বললাম, গুণীনের কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি আর একবার মসজিদ পুকুরে বেড়জাল দিয়ে দেখতে চাই।
ছোট চাচা বলল, তা দেখতে পার।
আমি আবার জেলে পাড়ায় গিয়ে জেলেদের এনে বেশ কয়েকবার জাল টানালাম। আমরাও অনেকে পুকুরে নেমে খোঁজ করলাম। পুকুরটা বেশ বড় হলেও ভরাট হয়ে গেছে। গরমের সময় কোমর পর্যন্ত পানি থাকে। তখন গরমের সময়। এক কোমর পানি। তাই আমি ও অনেক আধলা ছেলে-মেয়েরাও গোটা পুকুর তোলপাড় করে ফেললাম। কিন্তু আনসারকে পাওয়া গেল না।
এদিকে ছোট চাচি না খাওয়া, না দাওয়া অবস্থায় কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে। এখন ফিসফিস করে কাতর স্বরে কি সব। বলছে আর চোখের পানি ফেলছে। আমার দৃঢ় ধারণা ছিল, খাঁ সাহেব আনসারের খবর জানে। জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করবে ভেবে করিনি। শেষে। আনসারকে যখন পাওয়া গেল না তখন আমি পরের দিন যোহরের নামাযের পর খাঁ সাহেবকে একাকী মসজিদে পাকড়াও করলাম। বললাম, আমি কথা দিচ্ছি, কাউকে বলবো না। আপনি আনসারের খবর বলুন। আপনারও তো জিন হাসিলের আমল আছে। আপনি কি সেই জিনের দ্বারা আনসারের খোঁজ নিয়ে। তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেন না? জানি আপনি কোনো তদ্বির করেন না; তবু এ। ব্যাপারে কিছু করা যায় না?
খাঁ সাহেবের সঙ্গে থেকে থেকে আমি ধর্মের অনেক কিছু শিখেছি এবং সেগুলো মেনেও চলি। সেইজন্য তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমার কথা শুনে ম্লান মুখে বললেন, না পারি না? পারলে তুমি বলার আগে এনে দিতাম। গুণীন ঠিক কথা বলে গেছে। জিনেরা আনসারকে তুলে নিয়ে গেছে। তাকে কাল সকালে গুণীনের কথিত জায়গায় আনসারের লাশ পাওয়া যাবে। খুব সাবধান, আমার কথা কাউকে বলবে না।
তার কথাশুনে বুকটা ঘঁাৎ করে উঠল। আমার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। আমি মাথা নিচু করে নিলাম।
খাঁ সাহেব আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, আমার কথা শুনে তুমি মনে কষ্ট নিও না। আল্লাহ পাকের ইশারা ছাড়া দুনিয়াতে কোনো কিছু হয় না।
আমি আর কিছু না বলে চোখ মুছতে মুছতে সেখানে থেকে চলে এলাম। আনসারের জন্য আমার ভীষণ কান্না পেতে লাগল। আমি আনসারকে অত্যন্ত ভালোবাসতাম। বাইরে থেকে আসার সময় কিছু না কিছু খাবার তার জন্য আনবই। আমাদের বাড়িতে ছোট ছোট অনেক ছেলেমেয়ে। তাই তাকে ঐ সব খুব গোপনে দিতাম। অবশ্য তার মা বাবা জানত।
গরমের সময় মসজিদের চওড়া বারান্দায় অনেকে ঘুমায়। খাঁ সাহেবও ঘুমায়। আমি মাঝে মাঝে এক-আধদিন ঘুমাতাম তা আগেই বলেছি। সেদিন রাতে আমি খাঁ সাহেবকে বললাম, আজ আমি আপনার পাশে ঘুমাব।
খাঁ সাহেব মৃদু হেসে বললেন, জিনেরা আনসারকে পুকুরে ফেলবে তা দেখতে চাও বুঝি?
আমি বললাম, হ্যাঁ তাই।
আমি কাউকে খাঁ সাহেবের কথা না বললেও আনসারকে তিন দিন না পেয়ে সবাই ভাবল, গুণীনের কথা মতো তাকে কাল সকালে মসজিদ পুকুরে পাওয়া যাবে। তাই অনেকে আজ মসজিদের চাতালে ঘুমাতে এসেছে। তারা কথা বলতে বলতে এক সময় সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। খাঁ সাহেবও আমার সাথে কথা বলতে বলতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। আমি জেগে রইলাম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। খাঁ সাহেবের ধাক্কাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি আমি উঠে বসে বললাম, কি ব্যাপার?
খাঁ সাহেব বলল, যাও অযু করে এসে আযান দাও, ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে।
আমি খাঁ সাহেবের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
খাঁ সাহেব বুঝতে পেরে বলল, আনসারকে একটু আগে জিনেরা ফেলে দিয়ে গেছে। জেগে থাকলেও তুমি তাদেরকে দেখতে পেতে না। তবে পানিতে ফেলে দেবার শব্দ শুনতে পেতে।
আমি ভীত কণ্ঠে বললাম, এখন আমরা গেলে আনসারকে দেখতে পাব?
খাঁ সাহেব বলল, পাবে। তবে অন্ধকারে পানিতে দেখতে নাও পেতে পার। যাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে। অযু করে এসে আযান দাও। নামাযের পর যা করার কর।
আমি আযান দেবার পর যারা সেখানে ঘুমিয়ে ছিল তারা উঠে অযু করে এসে নামায পড়ল। তারপর আমরা নামায পড়ে সবাই মিলে পুকুরের দক্ষিণ পূর্ব কোণে গিয়ে দেখতে পেলাম, কিনারেই আনসার উপুড় অবস্থায় ভেসে আছে।
পাড়ার হানিফ চাচা আনসারকে তুলে নিয়ে এল, আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম, আনসার যেন এই কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে। তার পেট একটুও ফুলে নাই। একদম টাটকা লাশ।
বাড়ির ভিতরে আনার পর সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ছোট চাচিকে গুণীনের কথা কেউ বলেনি। সে তো আনসারের লাশ দেখে ঘন ঘন ফিট হয়ে যেতে লাগল। দুপুরের মধ্যে আমরা আনসারের দাফন-কাফন সম্পন্ন করলাম।
৪
তারপর থেকে জিনের কথা ধীরে ধীরে একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। কয়েক বছর পর একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবার মনে পড়ল।
আমার বড় মামাতো বোনের নাম রোকেয়া। যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি তখন তার বিয়ে হয়। দুলাভাইয়ের নাম রবিউল। তাদের বাড়ি মেদনীপুরে। দুলাভাই কলকাতায় রং-এর কন্ট্রাকটারী করত। একবার তার সঙ্গে কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে বেশ কয়েকদিন ছিলাম। একদিন দুলাভাইয়ের সঙ্গে তার এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে রওয়ানা দিলাম।
আমাদের সঙ্গে দুলাভাইয়ের এক সমবয়সি চাচাও গিয়েছিল। তার নাম কবির। চাচা-ভাইপো সম্পর্ক থাকলেও তারা একে অপরকে তুই তোকারি করত। কবিরের যে জিন হাসিলের আমল আছে তা আমি জানতাম না। দুলাভাইয়ের বাসা জাকারিয়া স্ত্রীটে। আর আমরা দাওয়াত খেতে এলাম তালতলায় আলিয়া মাদ্রাসার কাছে।
দুলাভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে কবিরেরও খুব বন্ধুত্ব। চাচা-ভাইপোর বন্ধুর নাম জামাল। জামাল চাটার্ড একাউন্টেন্ড। একটা ভালো কোম্পানীতে চাকরি করে। কলকাতার বাসিন্দা। নিজেদের চারতলা বাড়ি। নিজেরা একটা ফ্লাটে থাকে। বাকি সব ভাড়া দিয়েছে। বেশ সুখী সংসার। কবিররা এক ভাই এক বোন। বোনটা বড়। তার অনেক আগে বিয়ে হয়ে গেছে। কবির বছর তিনেক হল বিয়ে করেছে। আজ তার তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে আমাদের দাওয়াত।
আমরা রাত আটটার সময় গিয়ে পৌঁছালাম। জামাল আমাদেরকে ড্রইং রুমে বসাল। দুলাভাই তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। দেখলাম ভদ্রলোক বেশ অমায়িক ও মিশুক। বেশি লোকজন দেখলাম না। আমাদের তিনজনকে নিয়ে মোট আট-দশজন! আর চার-পাঁচজন মহিলা। তাদের মধ্যে জামানের দুলাভাই ও বড় বোন আছে। তার দুলাভাইয়ের নাম সাগির। সেও খুব আমুদে লোক। প্রথমে হালকা নাস্তা পরিবেশন করা হল। কবিরের স্ত্রী ও তার বড়বোন খাদেমদারী করল। নাস্তার পর ভাত খাওয়ান শুরু হল। সে যে কত করমের তরকারী তা বলতে পারব না।
খাওয়া দাওয়ার পর বাইরের যে কয়েকজন এসেছিল তারা চলে যাবার পর মেয়েরা অন্যরুমে খেতে বসল। আমরা সেই ফাঁকে গল্পে মেতে উঠলাম। এক সময় দুলাভাইয়ের চাচা কবির দুলাভাইয়ের কানে কানে কিছু বলল।
দুলাভাই বেশ অবাক হয়ে বলল, তুই সিওর? কবির বলল, আমি প্রমাণ দিতে পারব।
দুলাভাই বলল, দেখ তুই যা বললি, তা যদি প্রমাণ করতে না পরিস, তা হলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে ভেবে দেখেছিস্?
কবির বলল, আমি আন্দাজে কোনো কিছু বলি না। দস্তুরমতো প্রমাণ পেয়ে তবে বলছি।
দুলাভাই বলল, বেশ তা হলে প্রমাণ কর।
জামাল, দুলাভাই ও কবিরকে চুপে চুপে কথা বলতে শুনে বলল, তোরা কি গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিস্?
দুলাভাই বলল, কবির তোর বৌয়ের সম্বন্ধে এমন একটা কথা বলছে, যা শুনলে শুধু তোর নয়, সবাইয়ের মাথা ঘুরে যাবে।
জামাল বলল, তাই নাকি? তাহলে তো কথাটা আমাদের শোনা উচিত।
দুলাভাই কবিরকে বলল, প্রমাণ যদি পেয়ে থাকি, তাহলে প্রমাণ করে সবাইকে জানিয়ে দে।
কবির জামালকে বলল, তুই ভিতরের ও বাইরের দিকের দরজা লাগিয়ে দে, তারপর কথাটা বলব।
জামাল খুব অবাক হলেও দুটো দরজা বন্ধ করে এসে বসে বলল, এবার বল কি কথা। কবির কয়েক সেকেন্ড জামালের দিকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তুই কতদিন হল বিয়ে করেছিস্?
: তিন বছর।
: এরমধ্যে ভাবির মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি?
: না। কেন বলতো?
: সেই কথা বলছি, তোর বৌ কিন্তু মানবী নয়।
জামাল হেসে উঠে বলল, তোদের বৌয়েদের চেয়ে আমার বৌ বেশি সুন্দরী বলে হিংসা হচ্ছে, না ইয়ার্কি করছিস?
কবির গভীর স্বরে বলল, না, সত্যি বলছি।
জামাল বলল, আরে বাবা, আমার বৌকে নিয়ে আজ তিন বছর ঘর করছি। সে মানবী কি না আমি জানলাম না, আর তুই একদিন দেখে এই কথা বলছি। ইয়ার্কি করার আর কথা পেলি না।
কবির দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমি কিন্তু হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর তোর বৌ মানবী নয়।
কবিরের দৃঢ়স্বর শুনে জামাল একটু আতঙ্কিত হয়ে বলল, তাহলে সে কে, তুই বল?
কবির বলল, আমি মুখে বললে তোরা বিশ্বাস করবি না। তার মুখ থেকে প্রমাণ করাব। ভিতরে গিয়ে দেখ, মেয়েদের খাওয়া শেষ হয়েছে কিনা। হয়ে গেলে এখানে সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়। সবাইয়ের সামনে আমি প্রমাণ করব।
এবার জামাল একটু ঘাবড়ে গেল। উঠে ভিতরে চলে গেল।
একটু পরে ফিরে এসে গম্ভীর মুখে বলল, ওদের খাওয়া হয়ে গেছে, সবাই। আসছে।
কবির আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ভাবি আসার পর লাইটে তার ছায়া দেখতে পাও কিনা লক্ষ্য করবে। মানবী হলে আলোতে তার ছায়া পড়বে।
এই কথা শুনে আমার মনে পড়ল, খাঁ সাহেব আমাকে বলেছিলেন, জিনেরা আগুনের তৈরি বলে তাদের কোনো ছায়া হয় না। তখন আমি মনের মধ্যে খুব উত্তেজনা অনুভব কালাম। ভাবলাম, জামালের বৌ যদি জিন হয়, তা হলে জীবনে তবু একটা সত্যিকার জিন দেখতে পেলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে জামালের বৌ, তার বড়বোন ও মা আমাদের রুমে এসে বসল। কবির জামালের স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, ভাবি আমাকে একগ্লাস পানি দিন তো।
জামালের বৌয়ের নাম খাদিজা। সে টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে কবিরের কাছে এগিয়ে এসে গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরল।
আমরা সবাই তখন লাইটের আলোতে তার ছায়া পড়ে কিনা দেখতে লাগলাম।
কবির পানির গ্লাসটা নিয়ে পানি খেয়ে তার হাতে ফেরত দিল।
আমরা খাদিজার ছায়া দেখতে না পেয়ে হতবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলাম।
তাই দেখে কবির বলল, কিছু বুঝতে পারলে?
আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না। ঘরের মধ্যে পিন অফ সাইলেন্স বিরাজ করতে লাগল।
আমরা সবাই খাদিজার পা থেকে মাথা পর্যন্ত লক্ষ্য করছি।
আমাদের অবস্থা দেখে খাদিজা বলল, কী ব্যাপার? সবাই আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন কেন?
আমাদের তখন কথা বলার মতো শক্তি নেই। সবাই কবিরের দিকে তাকালাম।
কবির গভীর স্বরে খাদিজার দিকে চেয়ে বলল, আপনি কে? খাদিজা থতমত খেয়ে বলল, মানে?
কবির বলল, মানে বুঝতে পারছেন না? আমরা আপনার আসল পরিচয় জানতে চাইছি।
খাদিজা হাসিমুখে বলল, সে কথা আপনাদের বন্ধুকে জিজ্ঞেস করুন।
কবির বলল, সে বলতে পারেনি বলেই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।
এবার আমরা লক্ষ্য করলাম খাদিজা চমকে উঠল। তারপর ম্লান মুখে বলল, আমি আপনাদের কথা এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না।
কবির দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ভালো চান তো আপনার পরিচয় বলুন, নচেৎ আজ আর আপনার রক্ষা নেই। তারপর উঠে গিয়ে ভিতরের দিকের দরজা লাগিয়ে এল।
খাদিজা স্বামীর কাছে গিয়ে বলল, তুমি চুপ করে রয়েছ কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
জামাল যেন বাস্তবে ছিল না। সে খুব ভয় পেয়েছে। স্ত্রীর কথা শুনে শুধু তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল।
কবির খাদিজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ও কি বলবে। ওকে সহজ সরল পেয়ে এতদিন তার বৌ হয়ে থেকেছ। আর নয়, আজ তোমার শেষ দিন। এখন তুমি তোমার আসল পরিচয় বলবে, না আমি বলবার ব্যবস্থা করব?
এবার খাদিজা মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
কবির বলল, ভালয় ভালয় পরিচয় দিয়ে এখান থেকে চিরকালের মতো চলে যাও। নচেৎ আমি চিরকালের জন্য তোমাকে বন্দি করে ফেলব।
খাদিজা আরও কিছুক্ষণ ঐভাবে থেকে কবিরের দিকে চেয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, না-না তা করবেন না। আমার পরিচয় দিয়ে আমি চলে যাব। আমি একজন মেয়ে জিন। আপনার বন্ধু যখন সাত বছরের তখন একদিন দুপুরে ছাদে একা একা খেলা করছিল। সেই সময় আমি এখান থেকে যাচ্ছিলাম। তাকে দেখে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি। তারপর থেকে চোখে চোখে রাখি। বড় হয়ে সে যখন বিয়ে করল তখন আমার ভীষণ দুঃখ হল। সেজন্য বাসর ঘরে যাবার আগে তার বৌ যখন বাথরুমে ঢুকল তখন তাকে গলাটিপে মেরে ফেলে তার লাশের মধ্যে আমি ঢুকে পড়ি। তাই আমি জিন হলেও এতদিন কেউ আমাকে চিনতে পারেনি। এমনকি আপনার বন্ধুও না। কিন্তু আজ আপনি আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছেন। আমি কথা দিচ্ছি, এখুনি আমি চলে যাচ্ছি। আর কোনো দিন আসব না। এই কথা বলে খাদিজা বাইরে যাবার দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে ধড়াম করে পড়ে গেল।
আমরা এতক্ষণ রুদ্ধনিঃশ্বাসে সবকিছু শুনছিলাম ও দেখছিলাম। মেঝেয় পড়ে যাবার পরও বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না।
একসময় কবির উঠে এসে জামালের কাঁধে হাত রেখে বলল, মেয়ে জিনটা। সত্যিই তোকে ভালোবাসত। তা না হলে এত সহজে তোকে ছেড়ে যেত না। চিন্তা করিস্ না, আমি একটা কবজ দেব, সেটা তুই সারাজীবন গলায় পরে থাকবি। তাহলে, শুধু ঐ মেয়ে জিনটা নয়, অন্য কোনো জিনও তোর ধারেকাছে। আসবে না। তারপর তার মায়ের দিকে চেয়ে বলল, আপনিও খুব ভয় পেয়েছেন তাই না খালাম্মা? ভয়ের কোনো কারণ নেই। এবার ভালো মেয়ে দেখে আবার জামালের বিয়ে দিন।
কবিরের কথা শোনার পরও আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না। সে আবার বলল, এখন এসব কিছু ভুলে যান। লাশ দাফন করার ব্যবস্থা করুন। তারপর জামালকে নাড়া দিয়ে বলল, কিরে আমার কথা শুনতে পাচ্ছি না? নে উঠ, লাশ দাফন করার ব্যবস্থা করা যাক।
সেদিন লাশ দাফন করে আমরা রাত একটার সময় জাকারিয়া স্ট্রীটে দুলাভাইয়ের বাসায় ফিরলাম।
আমার কাছে ঘটনাটা স্বপ্নের মত মনে হয়েছিল। দুলাভাইয়ের চাচা কবিরকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তো বললেন, মেয়ে জিনটা জামাল সাহেবকে খুব ভালোবাসে, আবার তার কাছে আসতেও তো পারে?
কবির বলল, না আর আসবে না। জিনেরা ওয়াদা ভঙ্গ করে না। আর যদি একান্ত আসে, তবে আমি তাকে যে কবজটা দিব, সেটা গলায় থাকলে কোনো জিনই তার কাছে আসতে পারবে না।
এই ঘটনার পর আজ পর্যন্ত জিনেদের কথা আর কোনোদিন চিন্তা করি নাই এবং কোনো ঘটনাও শুনি নাই।