জিটুৎসি
১
গভীর রাতে রুকাসের ঘুম ভেঙে গেল। রুকাসের ঘুম নিয়ে কখনো কোনো সমস্যা হয় না। সারাদিন পরিশ্রম করে সে যখন ঘুমাতে যায় তখন বিছানায় মাথা রাখা মাত্রই সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার ঘুম হয় গভীর এবং নিশ্ছিদ্র। আজকে হঠাৎ করে কেন ঘুম ভেঙেছে সে জানে না। আবার ঘুমিয়ে পড়বে ভেবে সে চোখ বন্ধ করে নিশ্চল হয়ে শুয়ে রইল কিন্তু তার চোখে আর ঘুম ফিরে এলো না। বরং খুব ধীরে ধীরে সে পুরোপুরি সজাগ হয়ে উঠে গভীর রাতের একেবারে নিজস্ব শব্দগুলো শুনতে লাগল। তার বাসার ভেতরকার নানা যন্ত্রপাতির নিচু কম্পনের ভোঁতা শব্দ ছাপিয়ে সে বাসার বাইরের ঝাপড়া গাছের পাতার শিরশির শব্দ শুনতে পায়। কী আশ্চর্য! সে কখনোই লক্ষ করেনি হালকা বাতাসে গাছের পাতা এ রকম বিচিত্র শব্দ করতে পারে, স্পষ্ট মনে হয় গাছটি কিছু বলার চেষ্টা করছে। শুধু তা-ই নয়, সে একটা পাখির ডাকও শুনতে পেল। এই গভীর রাতে পাখিটি জেগে আছে কেন? পাখির ডাকটি শুনে মনে হয় সেটি বুঝি নিঃসঙ্গ, তার মনে বুঝি কোনো কিছু নিয়ে গভীর একটি দুঃখ। সত্যি কী পাখির মনে গভীর দুঃখ থাকতে পারে?
রুকাস ধীরে ধীরে তার চোখ খুলল। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার। সে যখন ঘুমানোর জন্য বিছানায় শুয়ে সব আলো নিভিয়ে দেয় তখন মনে হয় ঘরটি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে গেছে। কিন্তু এখন এই মধ্যরাতে ঘরের আবছা অন্ধকারে সবকিছু হালকাভাবে দেখা যাচ্ছে। এক পাশে তার টেবিল, টেবিলের উপর তার ভিডি টিউব, কমিউনিকেশন মডিউল, পায়ের কাছে কাবার্ডের খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে তার কিছু কাপড়-জামা, শোয়ার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে বসার ঘরের ছাদে লাগানো পাওয়ার সাপ্লাইয়ের ঘোলা আলো মেঝেতে এসে পড়েছে। রুকাস হাত বাড়িয়ে জানালার পর্দাটা টেনে দিতেই নক্ষত্রের আলো ঘরের ভেতর ঢুকে। রুকাস মাথাটা ঝুঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। পরিষ্কার আকাশে নক্ষত্রগুলো ঝকঝক করছে। সে কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলীটি চিনতে পারল, যোদ্ধা মানুষটির ঝুলন্ত তরবারির তৃতীয় নক্ষত্রটি একটা নেবুলা, তার মাঝখানে একটি ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোলটি নিশ্চয়ই আশেপাশের সবকিছুকে দানবের মতো শুষে নিচ্ছে— পৃথিবী থেকে তার কিছুই বোঝা যায় না।
রুকাস জানালার পর্দাটা ছেড়ে দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। বিছানা থেকে নামার জন্য মেঝেতে পা রাখতেই সে এজেন্টের গলার স্বর শুনতে পেল, নিচু গলায় বলল, “বিছানা থেকে নিচে নামছো কেন রুকাস?”
“ঘুম আসছে না।”
এজেন্ট বলল, “ঘুম না আসলেই বিছানা থেকে নামতে হয় না। তুমি বিছানায় শুয়ে থাকো। আমি তোমার নিউরোলজি ক্যাপে সিগন্যাল পাঠাই।”
রুকাস উঠে দাঁড়াল, বলল, “নাহ্।”
“না? কেন না?”
“জানি না। ঘুম ভেঙে গেছে আর ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না।”
“কিন্তু তুমি প্রতিদিন সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাও। আজকে মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমিয়েছো।”
রুকাসের কেন জানি কথা বলার ইচ্ছা করল না। সে তার শোয়ার ঘর থেকে বের হয়ে এলো। খুব ধীরে ধীরে ঘরের আলো আলোকিত হতে থাকে। দেওয়ালে লাগানো স্পিকার থেকে আবার এজেন্টের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, সেটি বলল, “তুমি কি আমার কথা শুনেছো রুকাস? তুমি প্রতিদিন সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাও, ঘুম এর চাইতে কম হলে তোমার কর্মদক্ষতা কমে যায়।”
রুকাস এবারেও কোনো কথা বলল না। এজেন্ট বলল, “তুমি কেন কথা বলছো না রুকাস?”
“আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”
“কিন্তু তুমি যদি আমার সাথে কথা না বলো, আমরা যদি আমাদের মাঝে যোগাযোগ না রাখি তাহলে তো আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব না।”
রুকাস এগিয়ে তার সোফায় বসে সামনের টেবিলে পা তুলে দিয়ে বলল, “আমার যখন সাহায্যের দরকার হবে আমি তোমাকে বলব। এখন আমার কোনো সাহায্যের দরকার নেই। এখন আমি চুপচাপ একা একা বসে থাকতে চাই।”
রুকাসের এজেন্ট কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “ এখন তোমার কোনো সাহায্যের দরকার নেই এই কথাটি সত্যি নয় রুকাস। আমি তোমার এজেন্ট। প্রত্যেকটা মানুষের একজন এজেন্ট আছে। সেই এজেন্ট মানুষের অঙ্গের মতন। সে তাকে ছাড়া থাকতে পারে না। আমিও তোমার একটা অঙ্গের মতন।”
“আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাই না। আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও।”
“তুমি একা একা বসে কী করবে?”
রুকাস বলল, “কিছু করব না। চুপচাপ বাস থাকব। মাথায় যেটা আসে সেটা নিয়ে চিন্তা করব।”
“তুমি যেটা নিয়ে চিন্তা করবে সেটা আমাকে বলো। তোমার আগে পৃথিবীর আরো অনেক মানুষ সেটা নিয়ে চিন্তা করেছে। আমি জিটুৎসি-৩২ এর সাথে যোগাযোগ করে তোমার জন্য তাদের ভাবনাটুকু নিয়ে আসব। তোমার কষ্ট করে আর চিন্তা করতে হবে না। আমি আছি তোমার সব কাজে সাহায্য করার জন্য।”
রুকাস একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “এজেন্ট! তুমি বুঝতে পারছো না আমি কিছুক্ষণ তোমার সাহায্য না নিয়ে চুপচাপ একা বসে থাকতে চাই! আমাকে একা একা বসে থাকতে দাও।”
“ঠিক আছে।” বলে এজেন্ট চুপ করে গেল। শুধু ঘরের আলোটা ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে ওঠে, ঘরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমে একটু আরামদায়ক শীতল পর্যায়ে চলে আসে। খুবই মধুর একটি পিয়ানোর সুর বাজতে শুরু করে।
রুকাস এবারে প্রয়োজন থেকে বেশি জোরে গলা উঁচিয়ে বলল, “এজেন্ট, আমি তোমাকে ঘরের আলো জ্বালাতে বলিনি, তাপমাত্রা কমাতে বলিনি, কোনো মিউজিক বাজাতে বলিনি। ঘরটা যে রকম ছিল ঠিক সে রকম অবস্থায় নিয়ে যাও।”
“আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাইছিলাম।”
“আমি তোমাকে বলেছি আমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।” রুকাস হঠাৎ করে কেমন যেন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।
“আমি একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইন্টারফেস। তোমাকে সাহায্য করার জন্য তোমার কাজকর্ম বিশ্লেষণ করার বাইরে আমার কিছু করার নেই। আমার ওপর ক্রুদ্ধ হওয়া নিতান্ত অর্থহীন রুকাস।”
“আমি জানি। আমাকে সেই অর্থহীন কাজটি করতে বাধ্য কোরো না। তুমি যদি আরো একবার আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করো, আমি তাহলে তোমার পাওয়ার সাপ্লাইয়ের সুইচটি বন্ধ করে দেবো। বুঝতে পেরেছো?”
“বুঝতে পেরেছি। আমি তোমাকে এখন আর সাহায্য করার চেষ্টা করব না।”
“চমৎকার।” রুকাস সোফায় মাথাটা রেখে উপরের দিকে তাকায়। পিয়ানোর মিষ্টি সুরটি থেমে আসে। ঘরের তাপমাত্রা আগের জায়গায় ফিরে আসে। আলোগুলো ধীরে ধীরে কমে ঘরে আবছা অন্ধকার নেমে এলো।
রুকাসের কী হয়েছে বুঝতে পারল না। সে শুধু বুঝতে পারল বেঁচে থাকার অর্থ কী সে আসলে জানে না।
.
রুকাস বহুদিন পর জেগে থেকে রাতের অন্ধকার কেটে ভোর হতে দেখল। বেশির ভাগ সময়টা কাটিয়েছে সোফায় হেলান দিয়ে বসে। খানিকটা সময় ঘরের মাঝে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করে। ভোররাতের দিকে সে দুটি রুটি টোস্ট করে খেয়েছে। সাথে একটুখানি কফি। গৃহস্থালী কাজ করার জন্য বাসায় দুটি বেঁটে ধরনের রোবট আছে। তার এজেন্ট এই রোবট দুটিকে ব্যবহার করে রুকাসের সব কাজকর্ম করে থাকে কিন্তু আজকে রুকাস নিজে তার কফি তৈরি করেছে। পানি এবং কফির পরিমাণ সঠিক হয়নি বলে কফিটি একটু বেশি তেতো হয়েছে কিন্তু রুকাস সেটি নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এজেন্ট রুকাসকে একবার বলার চেষ্টা করেছে যে সে গৃহস্থালী রোবটটিকে ব্যবহার করতে পারে—রুকাস রাজি হয়নি।
ভোরবেলা রুকাস একটা ব্যাগে তার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঢুকিয়ে যখন বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন এজেন্ট একটু শঙ্কিত হয়ে জিগ্যেস করল, “রুকাস, মনে হচ্ছে তুমি দূরে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করছো এবং বেশ কয়েক দিনের জন্য।”
রুকাস মাথা নাড়ল, বলল, “হুঁ।”
“তুমি আমাকে কিছু বলোনি—বললে আমি ব্যবস্থা করে দিতাম।”
“ইচ্ছে করে বলিনি।”
“ঠিক আছে, সমস্যা নেই, কিন্তু একটু আগে থেকে পরিকল্পনা করলে ভ্রমণটা অনেক আরামদায়ক হয়। যাই হোক, কোথায় যাবে?”
রুকাস উত্তর দেবে কি না সেটা এক মুহূর্ত চিন্তা করল, তারপর বলল, “আমার মায়ের কাছে।”
“ভিডি টিউবে তুমি যখন ইচ্ছা তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে পারো, তুমি সশরীরে কেন যেতে চাইছো?”
“ইচ্ছা করছে।”
এজেন্ট বলল, “তুমি খুব দুর্বোধ্য আচরণ করছো রুকাস। তোমার কী হয়েছে?”
“আমার কিছু হয়নি।”
“তুমি কি মেডিক্যাল রিংটি পরবে, আমি দ্রুত তোমার শরীরটি একবার স্ক্যান করে নিই।”
রুকাস একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “এজেন্ট, তুমি যদি এভাবে বিরক্ত করো তাহলে আমি তোমাকে ছাড়া ঘর থেকে বের হব।”
“আশা করছি তুমি কথাটি গুরুত্ব দিয়ে বলোনি। আমাকে ছাড়া ঘর থেকে বের হলে ঘর থেকে দশ পা অগ্রসর হতে পারবে না। রুকাস, তুমি জানো আমি এবং তুমি মিলে একটি অস্তিত্ব।”
এজেন্টের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই তাই রুকাস এজেন্টের চোখের দিকে তাকাতে পারল না। খানিকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, “আমার আর আলাদা অস্তিত্ব নেই? তুমি এবং আমি মিলে একটা অস্তিত্ব?”
“হ্যাঁ রুকাস। এটি মেনে নাও, তোমাকে ছাড়াও আমি কার্যকর— যদিও সেই কার্যকর থাকার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু আমাকে ছাড়া তুমি কার্যকর নও।”
রুকাস অন্যমনস্কভাবে বলল, “তোমাকে ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই! কী আশ্চর্য!”
২
রুকাসের মা রুকাসকে দেখে যেটুকু অবাক হলেন তার থেকে অনেক বেশি ভয় পেলেন।
ফ্যাকাসে মুখে বললেন, “কী হয়েছে রুকাস? তুমি হঠাৎ করে কেন এসেছো?”
“তোমাকে দেখতে এসেছি মা।”
রুকাসের মা তার কথা বিশ্বাস করলেন না, বললেন, “আমাকে দেখার জন্য হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আসতে হয় না। ঘরে বসেই দেখা যায়। আসলে কী হয়েছে বলো।”
রুকাস হাসার চেষ্টা করল, “আসলেই কিছু হয়নি মা। অনেক দিন তোমার সাথে সামনাসামনি দেখা হয়নি। তোমাকে সামনাসামনি দেখার ইচ্ছা করল।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ মা সত্যি। আমার কথা বিশ্বাস না করলে আমার এজেন্টকে জিগ্যেস করো।” রুকাস তার হাতটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিলো। তার হাতে ছোটো কমিউনিকেশান মডিউলটি বাঁধা আছে, ঘরের বাইরে গেলে তার এজেন্ট এটা দিয়ে কথা বলে কিংবা দেখে।
মা মাথা নাড়লেন, বললেন, “না। আমার কোনো এজেন্টের সাথে কথা বলতে হবে না। তোমার কথাই যথেষ্ট।”
রুকাস তার ব্যাগটা ঘরের কোনায় রেখে বলল, “তুমি কেমন আছো মা?”
মা বললেন, “মনে হয় ভালোই আছি! তুমি কেমন আছো?”
“বুঝতে পারছি না।”
মা একটু অবাক হয়ে তাকালেন, বললেন, “বুঝতে পারছো না? এটা কেমন কথা?”
“আসলেই বুঝতে পারছি না। সে জন্য তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। সামনাসামনি।”
মা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে রুকাসের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে, কথা বলার অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন তুমি তোমার ঘরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম নাও। আমি দেখি আমার গৃহস্থালি রোবটটা তোমার জন্য কী খাবার বানাতে পারে।”
“চমৎকার!”
রুকাস তার ব্যাগটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। তার শৈশবের একটা বড়ো অংশ সে এই বাসাটিতে কাটিয়েছে।
.
খাবার টেবিলে মা জিগ্যেস করলেন, “তোমার কাজকর্ম কেমন হচ্ছে রুকাস। আজকাল কী করছো?”
“একটা প্রজেক্ট শেষ করেছি। বড়ো একটা বিল্ডিংয়ের নেটওয়ার্কিং। ইলেকট্রিসিটি, পাওয়ার, নিরাপত্তা, তথ্য সবকিছুর হাইব্রিড নেটওয়ার্ক।
“চমৎকার। কাজ করে আনন্দ পাচ্ছ?”
“বুঝতে পারছি না।”
মা চোখ তুলে তাকালেন, “বুঝতে পারছো না মানে?”
“অনেক জটিল একটা কাজ ছিল, কিন্তু কাজ শেষ করে বুঝতে পারছি আমি নিজে কিছু করিনি।”
“তাহলে কে করেছে?”
“জিটুৎসি-৩২ এর কয়েকটা মডিউল।”
মা একটু হাসলেন, বললেন, “আমরা সবাই তো আমাদের কাজে এ রকম টুল ব্যবহার করি।”
“না মা। টুল কী আমি জানি। জিটুৎসি-৩২ টুল না। এটা পরিব্যাপ্ত সিস্টেম। সবাই এটা ব্যবহার করে। কেউ যখন এটা তার কাজে ব্যবহার করে তখন জিটুৎসি সেটা শিখে নিতে পারে। টুল কিছু শিখতে পারে না।”
“তাতে তোমার সমস্যা কী?”
রুকাস তার স্যুপের বাটি থেকে এক চামচ স্যুপ মুখে নিয়ে বলল, “সমস্যা হচ্ছে এখন আমাকে কিছু করতে হয় না। আমি অপ্রয়োজনীয়। আমি বাহুল্য।”
মা কিছুক্ষণ রুকাসের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “যখনই নূতন কোনো প্রযুক্তি পৃথিবীতে এসেছে তখনই মানুষ এই কথা বলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে মানুষ কখনোই অপ্রয়োজনীয় হয়নি। মানুষ শুধু নূতন একটা জায়গা থেকে কাজ করেছে।”
“প্রযুক্তির জন্য এটা সত্যি। জিটুৎসি-৩২ প্রযুক্তি নয়।”
“এটা কী?”
“ডিকশনারিতে এর জন্য এখনো নূতন শব্দ তৈরি হয়নি। আমি একটা নাম ঠিক করেছি।”
“কী নাম ঠিক করেছো?”
“প্রযুক্তির পরের ধাপ, আমি এটার নাম দিয়েছি পরাযুক্তি! কেমন হয়েছে নামটা?”
“ভালো হয়েছে।” বলে মা হেসে পুরো বিষয়টা শেষ করে দিলেন। তবে রুকাসের জন্য বিষয়টা শেষ হলো না।
.
রুকাস কয়েক দিন তার মায়ের সাথে সময় কাটাল। বেশির ভাগ সময় সে তার এজেন্টকে বিচ্ছিন্ন করে রাখল। একদিন এজেন্ট তার সাথে সেটা নিয়ে আলোচনাও করল, রুকাসকে বলল, “তুমি যে নিজেকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছো সে জন্য তোমার সমস্যা হতে পারে।”
রুকাসকে সেটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তিত দেখাল না। এজেন্ট বলল, “সমাজে সবসময়েই একধরনের খাপছাড়া মানুষ থাকে। সবাই যেটা করে তারা সেটা করতে চায় না। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।”
রুকাস কিছু বলল না। এজেন্ট বলল, “তুমি কি তাদের মতো হতে চাচ্ছ?”
রুকাস এবারেও কিছু বলল না। এজেন্ট বলল, “তুমি যদি তাদের মতো হতে চাও, আমি সে ব্যাপারেও তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
“সেটা কীভাবে করবে?”
“যারা সব নিয়মকানুন ভেঙে অসামাজিকভাবে বেঁচে থাকে তাদের সব তথ্য তোমার জন্য নিয়ে আসতে পারি। তুমি সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখতে পারো তুমি কার জীবনটা বেছে নিতে চাও।”
রুকাস শব্দ করে হাসল, বলল, “জিটুৎসি-৩২ এর ইন্টারফেস হিসেবে তোমার রসবোধ খারাপ না, আমাকে স্বীকার করতেই হবে।”
এজেন্ট আহত স্বরে বলল, “আমি মোটেও ঠাট্টা করে বলিনি, আমি খুবই গুরুত্ব দিয়ে বলেছি।”
রুকাস বলল, “আমিও মোটেও ঠাট্টা করে বলিনি। আমি খুবই গুরুত্ব দিয়ে বলেছি।”
এজেন্ট হতাশ হয়ে বলল, “যতই সময় যাচ্ছে ধীরে ধীরে তুমি ততই দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছ।”
৩
রুকাস তার চুলের ছোটো একটি গোছা সামনে টেনে এনে হাতের কাঁচিটি দিয়ে সেটা ক্যাচ করে কেটে ফেলে। তারপর চুলের ছোটো গোছাটি সামনে ধরে রেখে সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
এজেন্ট বলল, “তোমাকে অভিনন্দন রুকাস।”
“ধন্যবাদ। তোমার সাহায্য ছাড়া আমি কখনোই এই কাঁচিটি তৈরি করতে পারতাম না।”
“আমি একটি ইন্টারফেস। তোমার জন্য তথ্য আনা-নেওয়া করি মাত্র। কাঁচি তৈরি করার প্রযুক্তিটিও আমি সেভাবে এনে দিয়েছি।”
“কাঁচি খুবই প্রয়োজনীয় একটা টুল, কাঁচি দিয়ে যেটি কাটতে হয় ছুরি দিয়ে সেটা কাটা যায় না। অথচ পৃথিবী থেকে কাঁচি উঠে গেছে।”
“কাঁচির বদলে নূতন অনেক যান্ত্রিক ক্লিপার তৈরি হয়েছে, অনেক স্বয়ংক্রিয় টুল তৈরি হয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই কাঁচি উঠে গেছে।”
রুকাস তার কাঁচিটির উপর সস্নেহে হাত বুলাল, তারপর সেটি তার ব্যাগের ভেতর রাখল। এজেন্ট জিগ্যেস করল, “তোমার যা যা প্রয়োজন তার সবকিছু কি জোগাড় হয়েছে?”
“হ্যাঁ। শুধু এই কাঁচিটি বাকি ছিল।”
“তোমার এই রহস্যময় ব্যাকপ্যাকে তুমি যে যে জিনিসগুলো ঢুকিয়েছো সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি দীর্ঘ সময়ের জন্য একটা দুর্গম অঞ্চলে অভিযানের জন্য যাচ্ছ।”
রুকাস তার ব্যাকপ্যাকটা তুলে তার ওজন অনুমান করতে করতে বলল, “তোমার অনুমান সঠিক।”
“তোমার এত বড়ো সিদ্ধান্ত, এত আয়োজন কিন্তু তুমি একবারও আমার সাথে কিছু নিয়ে আলোচনা করোনি। সব নিজে নিজে করেছো।”
রুকাস দ্বিতীয়বার বলল, “তোমার এই অনুমানও সঠিক।”
“বোঝাই যাচ্ছে তুমি পৃথিবীর এই জীবনধারাটি পছন্দ করছো না। এটি পরিত্যাগ করে কোনো দুর্গম জায়গায় জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছো। একজন মানুষের জন্য সেটি অনেক বড়ো সিদ্ধান্ত।”
“হ্যাঁ। আমার ধারণা সুযোগ পেলে আরো অনেকে এই সিদ্ধান্ত নিত।”
“তবে তুমি যত পরিশ্রম করে একটি কাঁচি তৈরি করেছো সেটি দেখে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে।”
রুকাস একটুখানি অবাক হয়ে বলল, “কী পরিষ্কার হয়েছে?”
“তুমি একসময় ফিরে আসার পথটি বন্ধ করে দাওনি।”
“কেন? তুমি কেন এই কথা বলছো?”
“তুমি বড়ো বড়ো চুল-দাড়ি নিয়ে লোকালয়ে ফিরে আসতে চাও না। তাই একটা কাঁচি তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছ। ফিরে আসার আগে তুমি তোমার চুল-দাড়ি কেটে ভদ্র চেহারায় ফিরে আসবে!”
রুকাস শব্দ করে হাসল, তারপর বলল, “আমি তোমার বুদ্ধিমত্তা দেখে মুগ্ধ হয়েছি এজেন্ট।”
এজেন্ট বলল, “আমি শুধু একটি ইন্টারফেস। এখানে কোনো বুদ্ধিমত্তা থেকে থাকলে সেটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিব্যাপ্ত সিস্টেমে। জিটুৎসি-৩২ এ।”
রুকাস মাথা নাড়ল। বলল, “আমার মনে থাকে না যে তুমি শুধু ইন্টারফেস। তুমি সর্বক্ষণ জিটুৎসি-৩২-এর সাথে যুক্ত।”
এজেন্ট কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “রুকাস, তোমাকে কি আমি একটা পরামর্শ দিতে পারি?”
“দাও।”
“তোমার প্রস্তুতি দেখে বুঝতে পারছি তুমি লোকালয় থেকে বহু দূরে চলে যেতে চাও। যেখানে বেঁচে থাকতে হলে প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।”
“বলতে থাকো। আমি শুনছি।”
“এ রকম একটা পরিবেশে চলে গেলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। আমি শুধু নেটওয়ার্কের আওতায় তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
রুকাস বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি এতদিনে বুঝে গেছো আমি তোমার সাহায্য ছাড়া বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
“হ্যাঁ। সেটা আমি জানি। দৈনন্দিন জীবনে সেটি যথেষ্ট কঠিন কিন্তু হয়তো একেবারে অসম্ভব নয়। তবে—”
“তবে কী?”
“হঠাৎ করে যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়, জরুরি অবস্থা হয় তাহলে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন হবে।”
“তুমি কী বলতে চাইছো।”
“আমি তোমাকে পরামর্শ দেবো তুমি স্যাটেলাইটভিত্তিক একটা কমিউনিকেশন মডিউল সাথে নিয়ে যাও। শুধু জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। আমি তখন তোমার পাশে চলে আসতে পারব।”
রুকাস একটা নিশ্বাস ফেলল। বলল, “তোমার পরিব্যাপ্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম সম্ভবত এখনো মানুষকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। মানুষ মাঝে মাঝেই তার পক্ষে করা সম্ভব নয় এ রকম অসম্ভব কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার কি মনে হয় জানো?”
“কী?”
“মানুষ যেদিন এটি বন্ধ করে দেবে সেদিন তারা বিবর্তনে উল্টো দিকে রওনা দেবে।”
এজেন্ট কোনো কথা বলল না।
“মানুষ তখন ধীরে ধীরে একটি বুদ্ধিহীন প্রাণীতে পরিণত হবে।”
এজেন্ট এবারেও কোনো কথা বলল না।
.
রুকাস পরের সপ্তাহে তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে রওনা দিলো। সাথে তার পিঠে ঝোলানো বিশাল একটি ব্যাকপ্যাক।
৪
পিঠে ঝুলানো ভারী ব্যাকপ্যাকটা নামিয়ে রুকাস একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে। পাহাড়ের যে উচ্চতায় এসে পৌঁছেছে সেখানে তাপমাত্রা যথেষ্ট শীতল, তারপরেও সে দরদর করে ঘামছে।
রুকাস চোখ বন্ধ করে কয়েকবার বড়ো বড়ো করে নিশ্বাস নিল। তার পানির তৃষ্ণা পেয়েছে এবং প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। রুকাস কোমরে ঝোলানো বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেল, তারপর বোতলটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে এখনো লোকালয়ের আশেপাশে আছে, কাজেই খাবার এবং পানীয় নিয়ে দুর্ভাবনা নেই, কিন্তু আর কয়েক দিনের ভেতর যখন সে লোকালয়ের বাইরে চলে যেতে থাকবে তখন এই পানি আর খাবার থাকবে না। তখন চারপাশের গাছপালা, পাথর, ঝরনা, পশুপাখি থেকে খাবার এবং পানি সংগ্রহ করতে হবে। বিষয়টা কেমন হবে সে জানে না। সেটি দেখার জন্য একটুখানি ভয় এবং অনেকখানি আগ্রহ নিয়ে সে অপেক্ষা করছে। তার ব্যাকপ্যাকে প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্রের সাথে সাতশ পৃষ্ঠার একটি বই আছে। মাইক্রো ফিল্ম করা কিংবা ক্রিস্টালে সংরক্ষিত ডিজিটাল বই নয়। প্রাচীনকালের কাগজে ছাপানো বই—তবে সত্যিকারের কাগজ নয়, পলিমারের কাগজ, পানিতে ভিজবে না, ছোটোখাটো আগুনে পুড়বে না। বইটির নাম ‘বনজঙ্গলে জীবন রক্ষা’—এই বইয়ে সভ্য জগতের বাইরে বনজঙ্গলে কীভাবে টিকে থাকতে হয় তার খুঁটিনাটি বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। পলিমারের কাগজে বইটি ছাপিয়ে নিতে তার অনেক ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।
রুকাস এখন তার ব্যাকপ্যাক থেকে কিছু শুকনো খাবার খাবে নাকি আরো কিছু দূরত্ব অতিক্রম করে নিবে সেটি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না তখন সে কিছু মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। এই এলাকাটি পর্যটকদের খুবই প্রিয় এলাকা, বছরের এই সময় অনেকে এখানে আসে। রুকাস তাই আপাতত তার খাওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করল।
কিছুক্ষণের ভেতরেই সে উপর থেকে তিন-চারজন সুঠামদেহী পর্যটককে নেমে আসতে দেখল। রুকাসকে দেখে তারা দাঁড়িয়ে যায়। একজন তার দিকে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হাসল, বলল, “তুমি এত বড়ো ব্যাকপ্যাক নিয়ে কোথায় যাচ্ছ! পাহাড়ের চূড়াতে চমৎকার গেস্ট হাউস! সেখানে সবকিছু পাওয়া যায়!”
রুকাস হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি প্রথমবার এসেছি তো—তাই কিছু জানি না! সবকিছু নিয়ে রওনা দিয়েছি!”
মানুষটি হাসল, তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো আমরা এখানে কিছুক্ষণ বসে যাই। জায়গাটা সুন্দর।”
সবাই যখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসতে থাকে তখন রুকাস চারিদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখল। সেই এই প্রথম বোঝার চেষ্টা করল জায়গাটা সুন্দর কথাটির অর্থ কী। আসলেই কি জায়গাটা সুন্দর? দূরে পাহাড়ের সারি, কাছাকাছি পর্বতমালা গাঢ় নীলাভ সবুজ, পিছনের পর্বতমালাগুলোর রং ধীরে ধীরে হালকা হতে হতে মিলিয়ে গেছে। আকাশ গাঢ় নীল, তার মাঝে ধবধবে সাদা মেঘ এত স্পষ্ট যে রুকাস একটুখানি বিস্ময় নিয়ে সেটি দেখে। তার চারপাশে উঁচু গাছ, গাছের পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে এবং শোনা যায় না এ রকম একটা শিরশির শব্দ করছে। সামনে ইতস্তত পাথরের ছোটো-বড়ো টুকরো, পায়ে হাঁটা পথের এক পাশে খাড়া খাদ, নিচে একটি জলধারা, পাথরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় মৃদু একটি শব্দ করছে। অনেক উচ্চতায় চলে এসেছে বলে তাপমাত্রা কম, বাতাস তার শরীরকে আরো শীতল করে দিচ্ছে। রুকাস তার চোখ, কান এবং ত্বক এই তিনটি ইন্দ্ৰিয় দিয়ে এই দৃশ্যটি অনুভব করছে কিন্তু তার অনুভবটি শুধু এই তিনটি ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির মাঝে নেই, এর বাইরেও সে কিছু একটা অনুভব করছে। সেই অনুভূতিটি কী?
রুকাসের পায়ের কাছ দিয়ে একটা গিরগিটি শুকনো পাতার মাঝে সরসর শব্দ করে ছুটে গেল, এই গিরগিটিটি কি এই সৌন্দর্যটি অনুভব করছে? কিংবা রুকাস নিজে যদি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ক্ষুধার্ত আতঙ্কিত বিপদগ্রস্ত হতো তাহলে কি সে এই সৌন্দর্যটি অনুভব করতে পারত? রুকাসের সাথে তার এজেন্ট নেই, থাকলে তাকে জিগ্যেস করতে পারত।
রুকাসের আশেপাশে বসে যাওয়া মানুষগুলো নিজেদের মাঝে কথা বলছে। রুকাসের কাছাকাছি বসা সোনালি চুলের একজন মেয়ে রুকাসের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে জিগ্যেস করল, “আমার সত্যি খুব কৌতূহল হচ্ছে, তোমার এই বিশাল ব্যাকপ্যাকের মাঝে কী আছে?”
প্রশ্নটিকে যথেষ্ট ব্যক্তিগত প্রশ্ন হিসেবে বিবেচনা করে রুকাস একটু বিরক্ত হতে পারত কিন্তু রুকাস বিরক্ত হলো না। হেসে বলল, “আমার যদি সময় থাকত তাহলে ব্যাগ খুলে তোমাকে দেখাতাম।”
“না, না, দেখাতে হবে না, তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করব।”
“শুকনো খাবার, কিছু যন্ত্রপাতি, শীতের পোশাক, বই—”
“বই?” একসাথে সবাই চমকে উঠল।
“হ্যাঁ, বই।”
“কেন? কেন কেন?”
“আমার সাথে এজেন্ট নেই। তাই বই।”
মানুষগুলো এবার আগের থেকেও বেশি চমকে উঠল, “এজেন্ট নেই?”
“না।”
মানুষগুলো এবারে কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের দৃষ্টিতে এবারে শুধু বিস্ময় নয়, বিস্ময়ের সাথে সন্দেহ।
রুকাস একটু হেসে বলল, “আমি আসলে একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইছি। এজেন্ট ছাড়া বনে-জঙ্গলে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকা যায় কি না সেই এক্সপেরিমেন্ট।”
“কিন্তু—কিন্তু—” সোনালি চুলের মেয়েটি তার কথা শেষ না করে
থেমে গেল।
“কিন্তু কী?”
“যদি কোনো ইমার্জেন্সি হয়? যদি জরুরি কিছু দরকার হয়।”
রুকাস হাসল, বলল, “এইটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। আমার এক্সপেরিমেন্টটাই সেটা।”
“কিন্তু তুমি মরে যেতে পারো।”
“কে আর সারা জীবন বেঁচে থাকে?”
ছোটো দলটির মাঝে যে মানুষটির বয়স একটু বেশি সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাকে দেখে আমারও লোভ হচ্ছে, মনে হচ্ছে আইডিয়াটা খারাপ না! প্রযুক্তির কোনো সাহায্য না নিয়ে শুধু প্রকৃতির সাথে থাকা নিঃসন্দেহে অসাধারণ অভিজ্ঞতা।”
তুলনামূলকভাবে বয়স কম মানুষটি বলল, “তোমার এজেন্ট তোমাকে এই এক্সপেরিমেন্ট করতে দিয়েছে?”
রুকাস বলল, “বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু তার কথা শুনতে হবে কে বলেছে?”
“তোমার পরিচিত আত্মীয়স্বজন?”
“মা ছাড়া আমার কেউ নেই। মা বাধা দেয়নি, কখনো কিছু করতে বাধা দেয় না।”
“তোমার একজন মেয়ে সঙ্গী থাকলে নিশ্চয়ই বাধা দিত।”
রুকাস উত্তরে কিছু না বলে একটু হাসার ভঙ্গি করল। তার একজন মেয়ে সঙ্গী ছিল যে তাকে ছেড়ে চলে গেছে এই তথ্যটি সে তাদের জানানোর চেষ্টা করল না।
সোনালি চুলের মেয়েটি বলল, “পার্বত্য এলাকায় অনেক বন্য প্রাণী থাকে।”
রুকাস মাথা নাড়ল, বলল, “জানি।”
“খাবার ফুরিয়ে গেলে তোমার খাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে।”
রুকাস বলল, “সেটাও জানি।”
“শীতের সময় তাপমাত্রা অনেক নিচে নেমে যাবে, বরফে ঢেকে যাবে। রুকাস মাথা নাড়ল, “আমি এই সবকিছু জেনেই এক্সপেরিমেন্টটা করতে যাচ্ছি।”
সোনালি চুলের মেয়েটা বলল, “আমরা তোমার এই বিপজ্জনক এক্সপেরিমেন্টের সাফল্যের জন্য শুভ কামনা করছি।”
“ধন্যবাদ।”
মেয়েটি বলল, “তুমি কি জানো যে তুমি খুবই বিচিত্র একজন মানুষ?”
রুকাস হাসল, বলল, “বোকা শব্দটি ব্যবহার না করে বিচিত্র শব্দটি ব্যবহার করার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”
রুকাসের কথা শুনে এবারে অন্যরাও শব্দ করে হাসল। দলের বয়স্ক মানুষটি বলল, “আমার কি মনে হয় জানো যুবক?”
“কী মনে হয়?”
“তোমার এজেন্ট নিশ্চয়ই জিটুৎসি-৩২-কে তোমার কথা জানিয়ে রেখেছে এবং জিটুৎসি-৩২ বাইভার্বাল আর ফরেস্ট গার্ড পাঠিয়ে তোমাকে ধরে আনবে! কে জানে তোমার হয়তো ছোটোখাটো শাস্তিও হতে পারে।”
রুকাস বলল, “আমি জানি। তারপরও আমি চেষ্টা করতে চাই।”
“তোমার জন্য শুভ কামনা রইল যুবক।”
“আমার নাম রুকাস।”
“রুকাস, তোমার জন্য শুভ কামনা।”
৫
বাইভার্বালের ইঞ্জিনটির চাপা গুমগুম শব্দটি মিলিয়ে যাবার পরও বেশ অনেকক্ষণ রুকাস তার গর্তের ভেতর লুকিয়ে রইল। সে এই মুহূর্তে ধরা পড়তে চায় না। বাইভার্বালটি তার খোঁজেই এসেছিল নাকি অন্য কোনো কাজে এসেছিল সে জানে না কিন্তু রুকাস কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি না। তাকে বিপজ্জনক পরিবেশ থেকে রক্ষা করা জিটুৎসি-৩২ নিজের দায়িত্ব মনে করলে রুকাসের পুরো পরিল্পনাটাই ভেস্তে যাবে।
বাইভার্বালের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পর রুকাস তার গর্ত থেকে বের হয়ে একটা পাথরে মাথা রেখে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে রইল। প্রথম সপ্তাহটি সে কোনো বড়ো রকম অঘটন ছাড়াই পার করেছে। সে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিল প্রথম কয়েক সপ্তাহ সে তার নিয়ে আসা রসদ ব্যবহার করে টিকে থাকবে, তারপর চেষ্টা করবে চারপাশের পরিবেশের ওপর নির্ভর করতে। তার মূল্যবান বইটির কোনো তথ্য ব্যবহার না করেই সে শুধু চোখ-কান খোলা রেখে সে এর মাঝে অনেক কিছু শিখে গেছে। যেমন সে এখন জানে, বন্য পশুদের নিয়ে ভয়ের কিছু নেই, তারা যথেষ্ট নিরীহ এবং তাদের সহজাত বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট ভালো। তাদের বেশির ভাগের আকার যেহেতু তার থেকে ছোটো, তাই পশুগুলো জানে রুকাসকে তারা খাবার হিসেবে খেতে পারবে না, সে কারণে তাকে নিয়ে তাদের বিশেষ আগ্রহ নেই। বুনো প্রাণী থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক হচ্ছে ছোটো ছোটো কীটপতঙ্গ। রাতে সে আগুন জ্বালিয়ে আবিষ্কার করেছে যে অসংখ্য পোকামাকড় সেই আগুন দেখে ছুটে এসেছে। সে পোকামাকড়ের খাবার নয় কিন্তু সেগুলি তার শরীরে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। কিছু কিছু পোকার কামড় যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক। তবে পোকামাকড় তার কোনো কাজে লাগেনি সেটা সত্যি নয়। আগুনে পোড়া এবং আধপোড়া কিছু পুরুষ্টু পোকা সে খেয়ে দেখেছে, সেগুলো যথেষ্ট সুস্বাদু। পোকা দিয়ে সে তার প্রোটিনের প্রয়োজন মেটাতে পারলে খাওয়ার অনেক ঝামেলা মিটে যাবে।
আদিমকালে মানুষ পাথর ঘষে আগুন জ্বালাত সেটি রুকাসের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সে শুকনো কাঠ কিংবা পাথর ঘষে দেখেছে, একটু গরম হওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি। সে প্রথম কয়েক দিন গ্যাস লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। গতকাল প্রথম বৃত্তাকার স্বচ্ছ পলিথিনের প্যাকেটে পানি ভরে কনভেক্স লেন্স তৈরি করে রোদকে কেন্দ্রীভূত করে আগুন জ্বালিয়েছে। এই পদ্ধতিটা অনেক বেশি কার্যকর।
এই নির্জন পাহাড়ে বেঁচে থাকার জন্য পানি এবং আগুনের মাঝে কোনটা বেশি দরকার সেটা নিয়ে তার নিজের ভেতর একটা কৌতূহল ছিল। অল্প সময়ের জন্য আগুন ছাড়াও সে কাটিয়ে দিতে পারবে কিন্তু দীর্ঘ সময় হলে আগুন ছাড়া চলবে না। পানি ভরা পলিথিনের প্যাকেট দিয়ে আগুন জ্বালাতে পেরে তার আত্মবিশ্বাস একটুখানি বেড়ে গেছে—তবে গভীর রাতে হঠাৎ করে আগুন জ্বালাতে হলে সেটা এভাবে সম্ভব হবে না।
পানি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। সে ইচ্ছে করে একটা ছোটো নদীর আশেপাশে আছে। এই নদীটি শুধু যে তার জন্য পানি সরবরাহ করছে তা নয়, এই পাহাড়ি এলাকার প্রায় সব পশু এখানে পানি খেতে আসে। নদীর পানি স্বচ্ছ-টলটলে, তার মাঝে সে অনেক ছোটো ছোটো মাছকে সাঁতার কাটতে দেখেছে। মাছ ধরতে পারলে তার খাবারে প্রোটিনের পরিমাণ নিয়ে দুশ্চিন্তা কমে যাবে। কিন্তু মাছ যথেষ্ট কৌশলী প্রাণী, তাকে ধরা খুব সহজ নয়। তার আগের জীবনে সে প্রতিদিন নিয়ম করে সময় নিয়ে গোসল করেছে, এখানে সে সেটি আর করছে না। করা সম্ভবও না—পানি যেটুকু ঠান্ডা হবে ভেবেছিল তত ঠান্ডা নয়, তারপরেও যথেষ্ট ঠান্ডা। গায়ের জামা-কাপড় কিছুদিনের ভেতর যথেষ্ট নোংরা হয়ে যাবে তখন কিছু একটা করতে হবে। তার জামা-কাপড় অবশ্যি নিও- পলিমারের, সেগুলো সহজে নোংরা হওয়ার কথা না।
রুকাস বেশ কিছুক্ষণ পাথরে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। মাথার মাঝে নানা রকম চিন্তা এসে ভিড় করে, মানুষ কি তার মস্তিষ্ককে পুরোপুরি নিশ্চল করতে পারে, যেন সেটি কোনো কিছু চিন্তাও করবে না? সে রকম করতে পারলে কেমন অনুভূতি হবে কে জানে।
রুকাস উঠে বসল, তার ব্যাকপ্যাকটি একটু গুছিয়ে নিল, তারপর সেটা ঘাড়ে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। সে কাছাকাছি যেকোনো লোকালয় থেকে অনেক দূরে সরে যেতে চায়। কোনো নির্দিষ্ট একটা এলাকায় সে বেশিদিন থাকতে চায় না। এখন পুরোপুরি গ্রীষ্মকাল, তারপরেও আবহাওয়া যথেষ্ট শীতল, রাতে তাপনিরোধক স্লিপিংব্যাগে সে মোটামুটি আরামে ঘুমাতে পারে। যখন শীতকাল এসে যাবে, চারিদিক বরফে ঢেকে যাবে তখন সে আর এভাবে বাইরে ঘুমাতে পারবে না। সে সময় তার একটা আবাসস্থল দরকার হবে। কোনো একটা গুহা বা সেরকম কিছু। আদিম মানুষেরা যেভাবে থাকত অনেকটা সেরকম।
রুকাস তার ব্যাগপ্যাকটি ঘাড়ে নিয়ে হাঁটতে থাকে। কোথায় যাচ্ছে সে নিজেই জানে না। তার ভেতরে কোনো তাড়া নেই, কোনো কিছু করতে হবে সে রকম কোনো চাপ নেই। যখন খুশি সে থামতে পারে, কোনো কিছু না করে সে চুপচাপ বসে থাকতে পারে। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ হয়েও সে কোনো কিছু না করে এভাবে দিনগুলো পার করে দিচ্ছে, এর জন্য তার ভেতরে কি কোনো অপরাধ জমা হচ্ছে? সজ্ঞানে হচ্ছে না কিন্তু নিজের অজান্তে মনে গভীরে জমা হচ্ছে কি না কে জানে। হওয়ার কথা না, সে পূর্ণ বয়স্ক পুরোপুরি সক্ষম একজন মানুষ কিন্তু শুধু নিজের বুদ্ধির ক্ষমতা খাটিয়ে শেষবার কখন সে একটি কাজ করেছে চিন্তা করে পেল না। প্রতিটি কাজ তার জন্যে জিটুৎসি-৩২ তার কোনো একটি মডিউল দিয়ে করে দিয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য তার খুঁটিনাটি করে দিয়েছে এজেন্ট। এই পার্বত্য এলাকায় আসার পর সে প্রথমবার নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে নিজের পরিশ্রমে কাজ করছে। যদি সে পুরো একটি বছর এখানে থাকতে পারে তাহলে আবার তার নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে। নিজেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি পরিব্যাপ্ত সিস্টেমের হাতের পুতুল মনে হবে না।
এই অনুভূতিটি তার এখন খুব দরকার।
৬
“রুকাস, আমি তোমাকে যেটুকু বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম, তুমি আসলে তার থেকে বেশি বুদ্ধিমান!”
“শুনে দুঃখ পেলাম যে তোমার ব্যাপারটা বুঝতে এতদিন লেগেছে!”
“আমাকে দোষ দিও না, এর আগে এটা বোঝার মতো একটা অবস্থা হয়নি।”
“এখন হয়েছে?”
“হ্যাঁ রুকাস, এখন হয়েছে।”
রুকাস পাথর ধরে ধরে নিচে নামতে নামতে নিজের সাথে কথা বলছে। এই নির্জন পার্বত্যভূমিতে একা একা থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন সে টের পেল দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, সে কারো সাথে কথা বলছে না। যদি দীর্ঘ সময় কথা না বলতে বলতে তার কথা বলার অভ্যাসটাই চলে যায় তাহলে কী হবে? তাই সে এখন নিজের সাথে কথা বলা শুরু করেছে। প্ৰথম প্ৰথম ব্যাপারটা তার কাছে হাস্যকর আর ছেলেমানুষি মনে হতো—আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রথমে সে কথা বলত মনে মনে এখন সে জোরে জোরে নিজের সাথে কথা বলে—যে কেউ দেখলে ভাববে সে অপ্রকৃতস্থ, কিন্তু এখানে দেখার কেউ নেই। আশেপাশে কিছু জন্তু-জানোয়ার ছিল, শীতের শুরুতে বরফ পড়ার পর সেগুলোও আর দেখা যাচ্ছে না।
রুকাস পাহাড়ের উপর একটা গুহার মাঝে থাকে। গুহার ভেতরে সে মোটামুটি আরামদায়ক একটা আবাসস্থল করে ফেলেছে। বাইরে যখন কনকনে ঠান্ডা তখন গুহার ভেতর জ্বলন্ত কিছু কাঠের কারণে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা। সময় কাটানো নিয়ে তার কোনো সমস্যা হয় না—প্রতিদিনই সে নূতন কিছু একটা বের করার চেষ্টা করে। পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর পদ্ধতিটা সে শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করেছে। বরফকে ঘষে ঘষে সে কনভেক্স লেন্স আর কনকেভ লেন্স তৈরি করে সেটা দিয়ে একটা টেলিস্কোপ তৈরি করেছে, গরম পড়া মাত্রই সেটা গলে যাবে কিন্তু এখন বেশ চমৎকার কাজ করে। গুহার দেওয়ালে খোদাই করে সে একটা মানবীর মূর্তি তৈরি করার চেষ্টা করছে। গাছের ছোটো ছোটো ডাল চেঁছে সে দাবার ঘুঁটি তৈরি করেছে। গুহার মেঝেতে দাবার ছক এঁকে সে নিজের সাথে নিজে দাবা খেলার চেষ্টা করে। খাবারের মাঝেও সে বৈচিত্র্য এনেছে, শীতের জন্য খাবার জমা করে রেখেছে। এখনো শুরু করেনি কিন্তু এখানকার জীবনের কাহিনিটুকুও সে লিখে রাখতে চায়।
প্রতিদিনই রুকাস কমপক্ষে একবার পাথর ধরে ধরে নিচে নেমে নদীর কাছে যায়। নদীর পানিতে সে শরীর রগড়ে গোসল করে। বরফে ঢাকা পর্বতে কনকনে শীতের মাঝে নদীর পানিতে গোসল করার কাজটি সহজ হওয়ার কথা ছিল না কিন্তু রুকাসের জন্য সেটি আশ্চর্য রকম সহজ—কারণ নদীর পানি বিচিত্র রকম উষ্ণ। এটি কীভাবে ঘটেছে সে জানে না, সম্ভবত নদীটি উজানে কোনো আগ্নেয়গিরির ভেতর দিয়ে এসেছে। এই এলাকায় আগ্নেয়গিরি আছে সে এটা কখনো শুনেনি। রুকাস একটা বড়ো পাথরের উপর পা রেখে নিচে তাকাল, তারপর বলল, “রুকাস। পাথরে বরফ জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। সাবধানে নামো।”
“আমি যথেষ্ট সাবধান। তুমি সেটা খুব ভালো করে জানো।”
“জানি। কিন্তু তোমার সমস্যাটা কি জানো রুকাস?”
“আমার সমস্যার কোনো শেষ নাই। তুমি কোন সমস্যার কথা বলছো?”
“তোমার আত্মবিশ্বাস একটু বেশি। মানুষের আত্মবিশ্বাস বেশি হলে সে বাড়াবাড়ি করে। ভুল করে। ঝুঁকি নেয়।”
রুকাস হাসির মতো শব্দ করে বলল, “তুমি আমাকে হাসালে রুকাস! আমি সবকিছু ছেড়েছুড়ে একটা পাহাড়ের গুহায় থাকি, এর থেকে বেশি বাড়াবাড়ি আর কী হতে পারে? এর থেকে বড়ো ঝুঁকি কী হতে পারে?”
“সেটা ঠিকই বলেছো। কিন্তু এই পাহাড়ের গুহায় থাকা হচ্ছে তোমার জন্য নূতন স্বাভাবিক অবস্থা। এখন সবকিছু এই স্বাভাবিক অবস্থার সাপেক্ষে বিবেচনা করতে হবে।”
“ঠিক আছে রুকাস, আমি তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু তুমি একেবারে তোমার বুকে হাত দিয়ে বলো, তুমি কি আমার কাজকর্ম দেখে চমৎকৃত হওনি?”
রুকাস নিজের প্রশ্নের উত্তরে নিজেই মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “তা হয়েছি। অস্বীকার করব না। বিশেষ করে তোমার ডিজেল গাছ—আমি কখনো চিন্তাও করিনি একটা গাছের রস এত ভালো জ্বালানি হতে পারে। এত উঁচু দরের জ্বালানি!”
“হ্যাঁ, আমি যে পরিমাণ জ্বালানি বাঁচিয়ে রেখেছি সেটা দিয়ে কয়েক শীত কাটিয়ে দেওয়া যাবে।”
“কিংবা পুরো পাহাড় জ্বালিয়ে দেওয়া যাবে।”
রুকাস জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, না— পাহাড় জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা বলবে না। যে পাহাড় তোমাকে আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, স্বাধীনভাবে থাকতে দিয়েছে, সেটা কেন জ্বালিয়ে দেবে?”
“তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নাই রুকাস। আমি কখনোই পাহাড় জ্বালিয়ে দেবো না, এটা একটা কথার কথা।”
রুকাস নিজের সাথে কথা বলতে নিচে নেমে আসে। বেশ খানিকটা বরফে ঢাকা সমতল জায়গা পার হয়ে একটা বালুকাবেলায় আসে। নদীর উষ্ণ পানির কারণে এখানে বরফ জমতে পারে না। রুকাস সেখানে দাঁড়িয়ে তার কাপড় খুলতে থাকে, আশেপাশে কোথাও কোনো মানুষ নেই, তারপরেও পুরোপুরি নগ্ন হতে সে একটু সংকোচ অনুভব করে। কোনোভাবে দ্রুত কাপড় খুলে তীরে রেখে সে নদীর পানিতে নেমে এলো, সাথে সাথে সে তার সারা শরীরে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা অনুভব করে। রুকাস একটা আরামের শব্দ করে ডাকল, “রুকাস।”
“বলো।”
“তুমি কি জানো তুমি যে এই নির্জন পর্বতে গুহার মাঝে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতে পারছো সে জন্য পুরো কৃতিত্বটা কিন্তু তোমার নয়!”
“তাহলে কার?”
“তোমার সৌভাগ্যের।”
“মনে হয় তুমি ভুল বলোনি রুকাস। এই পাহাড়ের ভেতর একটা নদী। শীতকালে এটা জমে বরফ হয়ে থাকার কথা। গরমের সময় গ্লেসিয়ার গলে কিছু পানি হয়তো বয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু তুমি একেবারে ভরা শীতের মাঝে এ রকম উষ্ণ একটা পানির ধারা পেয়েছো। কখনো কি চিন্তা করেছিলে এটা হওয়া সম্ভব?”
“না। আসলেই চিন্তা করিনি।”
“আমার কী মনে হয় জানো?”
“কী?”
“এই নদীর তীর ধরে তোমার হেঁটে যাওয়া উচিত। তোমার দেখা উচিত পানিটা কোথা থেকে আসছে। কেন পানিটা এ রকম উষ্ণ। ব্যাপারটা স্বাভাবিক না।”
“তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু
“কিন্তু কী?”
“আমি ভাবছিলাম শীতটা কেটে গেলে যাব—কত দূর যেতে হবে সেটা তো জানি না।”
“সেটা ঠিকই বলেছো। কিন্তু আমার কী মনে হয় জানো?”
“কী মনে হয়?”
“তোমার খুব বেশি দূর যেতে হবে না। যদি অনেক দূর থেকে উষ্ণ পানিটা আসত তাহলে আসতে আসতে শীতল হয়ে যেত। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে আসছে।”
“রুকাস।”
“বলো।”
“তোমার যুক্তিতে কোনো ভুল নেই। তোমাকে আমি যেটুকু বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম তুমি তার থেকে বুদ্ধিমান।”
রুকাস থেমে গেল। তারপর নিজেই শব্দ করে হাসতে থাকে।
রুকাস কখনোই কল্পনা করেনি যে একজন মানুষ কখনো নিজের সাথে কথা বলে নিজেই হাসতে পারে।
মানুষ একা একা থাকলে একটু অন্য রকম হয়ে যায়। একটু অস্বাভাবিক হয়ে যায়। সে যে রকম হয়েছে। সে কি পরে স্বাভাবিক হতে পারবে? নাকি বাকি জীবন এ রকমই থেকে যাবে?
৭
রুকাসের পিঠে একটা ছোটো ব্যাগ, হাতে একটা লাঠি। সে নদীতীর ধরে হাঁটছে, নদীর পানিটা কেমন করে এ রকম উষ্ণ হয়ে আসছে রুকাস আজকে সেটা দেখতে চায়।
শীত এখনো শেষ হয়নি কিন্তু নদীতীরে শীত নেই। নদীর উষ্ণ পানিতে নদীর দুই কূল যথেষ্ট উষ্ণ। সেই যতই এগিয়ে যাচ্ছে নদীর পানির উষ্ণতা ধীরে ধীরে আরো বেড়ে যাচ্ছে। নদীর পানির এই উষ্ণতার জন্যই কি না কে জানে, দুই ধারে গাছগাছালি এখনো সবুজ। ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় রয়েছে, তার ভেতরে কীটপতঙ্গ বাসা বেঁধেছে। রুকাস কিছু পাখিকেও কিচিরমিচির করে ডাকাডাকি করতে দেখল।
রুকাস খুব ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। নদীতে ইতস্তত পাথর ছড়ানো- ছিটানো—সেখানে নদীর পানি এসে আছড়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো জলপ্রপাত, ছোটো ঝরনা। নদী মাঝে মাঝে বিস্তৃত হয়ে যায়, সেখানে স্রোত কম। মাঝে মাঝে সংকুচিত হয়ে যায়, সেখানে প্রবল স্রোত। পানির ছুটে যাওয়ার শব্দ বহু দূর থেকে শোনা যায়।
অনেকক্ষণ হেঁটে সে একটা বড়ো পাথরের উপর বসে বিশ্রাম নেয়। রুকাস নিজেকে ডাকল, “রুকাস।
“বলো।”
“ক্লান্ত হয়ে গেছো?”
“উঁহু। আমি এত সহজে ক্লান্ত হই না, তুমি খুব ভালো করে জানো।”
“তাহলে বসেছো কেন? হাঁটো।”
“ক্লান্তি শুধু শরীরে হয় না, মনেরও ক্লান্তি হয়। কিছু না করে শুধু হাঁটতে হাঁটতে একধরনের মানসিক ক্লান্তি এসেছে। খানিকক্ষণ বসে থেকে চারপাশে দেখে, তোমার সাথে কথা বলে কিংবা কোনো কথা না বলে শুধু চিন্তা করে মনের ক্লান্তি একটু দূর করে নিই।”
“চমৎকার! তোমার ব্যাগে কিছু খাবারও আছে, বসে বসে খেতে পারো!”
“হ্যাঁ। সেটা খেতে পারি। তুমি মনে করে দেওয়ার পর মনে হচ্ছে বেশ খিদে পেয়েছে।”
রুকাস তার ব্যাগ খুলে কিছু শুকনো মাংস আর গোলাপি রঙের একটি মিষ্টি ফল বের করে। মাংসটা চিবিয়ে খেতে খেতে সে চারপাশে তাকায়। আশেপাশে বেশ বড়ো বড়ো গাছ, গাছগুলো সতেজ। পানি উষ্ণ এবং ভালো করে তাকালে দেখা যায় পানি থেকে একধরনের ভাপ বের হচ্ছে। নদীটা কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে, সামনে বড়ো পাহাড়ের আড়াল থেকে নদীটা বের হয়ে এসেছে। হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের আড়ালে গেলে মনে হয় গরম পানির উৎসটি দেখা যাবে। রুকাস মনে মনে হিসাব করল, অন্ধকার হওয়ার আগে তাকে ফিরে যেতে হবে। পাহাড় বেয়ে উঠতে তার বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে, যদি উপরে উঠে সে চমকপ্রদ কিছু নাও দেখে তবুও তাকে ফিরে যেতে হবে। আজকে সে আর বেশি দূর যেতে পারবে না।
রুকাস শুকনো মাংসটা চিবিয়ে খেয়ে তার ফলটাতে কামড় দেয়। ফলটির নাম সে জানে না, যথেষ্ট মিষ্টি। এই ফলটি খেয়ে পানি খেলে পানিটাতে একধরনের ঝাল মিশ্রিত টক স্বাদ পাওয়া যায়। কারণটি কী কে জানে।
রুকাস ফলটি কামড়ে খেতে খেতে এগিয়ে যায়। পানিটা এখন যথেষ্ট উষ্ণ। আরো এগিয়ে গেলে সে একেবারে ফুটন্ত পানি পাবে কি না কে জানে। গোলাপি ফলটা খেয়ে সে নদী থেকে আঁজলা করে পানি তুলে খেলো। উষ্ণ পানির মাঝে একধরনের ধাতব গন্ধ। গন্ধটা ঠিক কীসের সে ধরতে পারল না। আগ্নেয়গিরির ভেতর থেকে বের হলে এ রকম গন্ধ হওয়া বিচিত্র কিছু না।
রুকাস পাথর ধরে ধরে হেঁটে যায়। পাহাড়ের একটা বাঁক ঘুরতেই সে থেমে গেল। সামনে একটা বিশাল মালভূমির মতো। একটু আগেও সে চিন্তা করেনি এখানে সে এ রকম সমতল ভূমি পাবে। জায়গাটাতে গাছগাছালি কম। মালভূমিটি উত্তপ্ত, সেটিকে ঘিরে পানির ধারা বাষ্পীভূত হয়ে সাদা কুয়াশার মতো উপরে উঠে যাচ্ছে।
রুকাস নিজেকে ডাকল, “দেখেছো রুকাস?”
“হ্যাঁ দেখেছি।”
“কী দেখেছো?”
“গরম পানির উৎস। এই মালভূমিটি উত্তপ্ত। অনেক উত্তপ্ত। আমি এত দূরে দাঁড়িয়েও তাপটা অনুভব করছি।”
“হ্যাঁ। তাপটা কিন্তু আর আরামদায়ক নয়। রীতিমতো ভ্যাপসা গরম। পানি বাষ্পীভূত হয়ে এখানকার বাতাসে জলীয়বাষ্প অনেক বেশি।”
“এই তাহলে তোমার সেই আগ্নেয়গিরি?”
“মনে হচ্ছে।”
“তাহলে লাভা কোথায়? লাভা গড়িয়ে বের হওয়ার কথা না?”
“যদি এটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি হয় তাহলে লাভা বের হতো। আর হঠাৎ করে বের হবে না কে বলেছে? আমি তাহলে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাব।”
“রুকাস।”
“বলো।”
“আমি কিন্তু একটা বিষয় বুঝতে পারছি না।”
“আমি জানি তুমি কোন বিষয় বুঝতে পারছ না। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে লাভা গড়িয়ে বের হতে হতে তার পাহাড়ের চূড়ার মতো আকৃতি হয়। কিন্তু এটা পুরোপুরি সমতল।”
“হ্যাঁ রুকাস। একটু বেশি সমতল।”
“আমার কি মনে হচ্ছে জানো?”
“কী?”
“মনে হচ্ছে এটা কেউ এসে ভারী যন্ত্র দিয়ে ঘষে সমান করে দিয়েছে।”
রুকাস একটু হাসল। বলল, “কেন? বল খেলার জন্য?”
“ঠাট্টা কোরো না। আমি সিরিয়াসলি বলছি।”
“জানি।”
“কাজেই এখন কী করতে হবে বুঝতে পারছো?”
“বুঝতে পারছি। একেবারে কাছে গিয়ে দেখতে হবে এই আগ্নেয়গিরি কিংবা ভূজাগতিক বিষয়টা কী!”
“রুকাস।”
“বলো।”
“আমাদের হাতে কি সময় আছে? দেরি হয়ে যাবে না?”
“একটু দেরি হবে কিন্তু আমার কৌতূহলকে থামানো যাচ্ছে না।”
“ঠিক আছে চলো।”
রুকাস আবার হাঁটতে শুরু করে। উত্তপ্ত সমতল মালভূমিটি বেশ দূরে। চারপাশ থেকে জলীয়বাষ্প বের হয়ে জায়গাটিকে সাদা ধোঁয়ার মতো ঢেকে রেখেছে। বাতাসে মাঝে মাঝে জলীয়বাষ্পের আস্তরণ সরে গেলে পিছনের সমতল জায়গাটি একটু ভালো করে দেখা যায়। সেখানে ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় আছে কিন্তু বড়ো কোনো গাছ নেই। জায়গাটা উত্তপ্ত, বাতাস ধিকিধিকি করে নড়ছে। রুকাস পাথর ধরে উপরে উঠে আরো কিছু দূর এগিয়ে যায়। এখন সে একটা সমতল এলাকায় পৌঁছেছে, বেশ সহজেই হেঁটে যেতে পারে। হঠাৎ করে সে থমকে দাঁড়াল, চাপা গলায় বলল, “রুকাস!”
নিজেই চাপা গলায় উত্তর দিলো, “হ্যাঁ দেখেছি।”
“এর অর্থ বুঝতে পারছো?”
“না পারার কী আছে! বুঝতে পারছি। জায়গাটা নিষিদ্ধ এলাকা।” রুকাস যে জিনিসটি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে সেটি হচ্ছে একটা পাহাড়ি ছাগলের দেহাবশেষ। শুধু একটি নয়—একটা লাইন ধরে অসংখ্য ছোটো-বড়ো প্রাণী মরে পড়ে আছে। পাহাড়ের অন্য এলাকা শীতল, কোনো প্রাণী মারা গেলে তার দেহ দীর্ঘদিন অবিকৃত থেকে যায়। এই এলাকাটা উষ্ণ, তাই প্রাণীগুলোর দেহ পচে যাচ্ছে, চারিদিকে একটা চাপা দুৰ্গন্ধ। এখানে একটা অদৃশ্য রেখা রয়েছে, যখনই কোনো প্রাণী সেই রেখা অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে, সাথে সাথে সেটি মারা পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে অদৃশ্য লেজার রশ্মি দিয়ে পুরো এলাকাটি ঘিরে রাখা হয়েছে।
অর্থাৎ, সামনের এই উত্তপ্ত সমতল ভূমিটি একটি নিষিদ্ধ এলাকা। এখানে
কারো যাওয়ার কথা নয়।
রুকাস স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার মনে হতে থাকে দূর থেকে হঠাৎ একটি বুলেট ছুটে এসে তার দেহকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। সে যে এখানে এসেছে সেটি নিশ্চয়ই আর অজানা নেই—জায়গাটি কোন মাত্রার নিষিদ্ধ কে জানে।
কোনো বুলেট ছুটে এসে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিলো না। সে ফিসফিস করে নিজেকে ডাকল, “রুকাস!”
“বলো।”
“এ যাত্রায় মনে হয় বেঁচে গেলাম।”
“মনে হয়।”
“চলো ফিরে যাই।”
“চলো। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“একটু নিশ্চিত হওয়া যায় না?”
“আমিও তাই ভাবছিলাম। শুধু অনুমান না করে একটু নিশ্চিত হওয়া যাক।”
রুকাস তাই তার ধারণাটি সঠিক কি না সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে। তার হাতের লাঠিটা সে উঁচু করে সামনের দিকে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে সেটাকে নাড়ছে। অদৃশ্য রেখাটির কাছে আসতেই তার সামনে ধরে রাখা লাঠিটি হঠাৎ অদৃশ্য তীব্র লেজার রশ্মিতে ঝলসে ওঠে। রুকাস লাঠিটি ফিরিয়ে আনে, উপরের অংশটি ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেছে। এর পর কী ঘটে সেটা দেখার জন্য রুকাস নিঃশব্দে শুয়ে থাকে। কিছু ঘটল না। বোঝা যাচ্ছে একটা স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম চালু করে রাখা আছে। কেউ যেন এই অদৃশ্য রেখা পার হতে না পারে।
কেন? কী আছে এখানে?
৮
এতদিন এই পাহাড়ে রুকাসের জীবন ছিল সময়টা কাটিয়ে দিয়ে কোনোভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। হঠাৎ করে তার জীবনের উদ্দেশ্য পাল্টে গেছে। এখন তার জীবনের উদ্দেশ্য পাহাড়ের আড়ালে নিষিদ্ধ এলাকায় কী ঘটছে সেটি জানা। রুকাস কিছুতেই অনুমান করতে পারছে না এখানে কী রয়েছে। যদি সে লোকালয়ে থাকত তাহলে তার এজেন্টকে জিগ্যেস করতে পারত। এজেন্ট কী উত্তর দিতো সে জানে না, জায়গাটি শুধু নিষিদ্ধ নাকি নিষিদ্ধ এবং গোপনীয় রুকাস সেটাও জানে না।
আপাতত রুকাস আরো ভালো করে দেখার জন্য প্রায় প্রতিদিনই নদীর তীর দিয়ে হেঁটে হেঁটে সেই রহস্যময় উপত্যকায় যাচ্ছে। দূর থেকে জায়গাটি পরীক্ষা করছে। পুরো এলাকাটা ঘিরে হেঁটে সে অনুমান করার চেষ্টা করছে জায়গাটা কত বড়ো, কত উত্তপ্ত, কেন সেটাকে লেজার রশ্মি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত সে যেটা অনুমান করতে পেরেছে সেটা এ রকম: জায়গাটা বর্গাকৃতির, এক দিক প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা। নিচে কতটুকু বিস্তৃত সে জানে না। নিচেও সমান দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত থাকলে এটি একটি কিউব। এটাকে বেশ কয়েকটি লেজার অদৃশ্য প্রাচীরের মতো ঘিরে রেখেছে। সেই লেজার পার হয়ে ভেতরে যাওয়ার কোনো সহজ পথ নেই। তবে জায়গাটিকে পাহারা দেওয়ার জন্য কোনো রোবট বা অন্য কিছু নেই। লেজারের অদৃশ্য প্রাচীর পার হয়ে ভেতরে যেতে পারলে ভেতরের বাকি অংশটুকু মনে হয় সহজেই যাওয়া সম্ভব। তখন রুকাস একদিন একটা বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিল। সে একটা গর্ত খুঁড়ে লেজার রশ্মির নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। এ রকম গর্ত খোঁড়ার জন্য তার কাছে কোনো শাবল বা গাঁইতি নেই, কিন্তু তার যেহেতু সময়ের অভাব নেই সে তার কাছে যেটা আছে সেটা দিয়েই গর্ত খুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করবে। তা ছাড়া শীত শেষ হয়ে গরম পড়তে শুরু করেছে। এখন তাকে গুহার ভেতর থাকতে হয় না। দরকার হলে সে এক- দুই রাত এই এলাকার আশেপাশে কাটাতে পারবে।
রুকাসকে একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ভেতরে যেতে অনেক সপ্তাহ লেগে গেল। অদৃশ্য লেজার রশ্মির প্রাচীরের ভেতরেও একাধিক প্রাচীর আছে কি না কিংবা বিক্ষিপ্তভাবে লেজার রশ্মি ইতস্তত ঘূর্ণায়মানভাবে এলাকাটি পাহারা দিচ্ছে কি না সে জানে না। তাই সে তার সুড়ঙ্গ থেকে বের হওয়ার ঝুঁকি নিল না। সুড়ঙ্গ খুঁড়ে শেষ মাথায় সে নদীর পানি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারল। নদীর পানি বিশাল একটা ধাতব কিউবকে শীতল করার চেষ্টা করছে। কিউবটির ধাতব দেওয়ালটি উত্তপ্ত, সেখান থেকে উত্তাপ বিকিরণের জন্য ফিন বের হয়ে এসেছে। রুকাস কাছাকাছি পৌঁছে একটানা বেশি সময় থাকতে পারল না। শেষ পর্যন্ত উপরের দিকে কয়েকটা গর্ত খুঁড়ে তাপটা বের হতে দিয়ে তারপর কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করল। অনুমান করে নিল বর্গাকৃতির একটা বিশাল কিউব মাটির নিচে বসানো আছে। কিউবটার চারপাশ দিয়ে নদীর পানি তাপ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে চেষ্টা করেছে এমনভাবে সুড়ঙ্গটা খুঁড়তে যেন নদীর পানি তার সুড়ঙ্গে ঢুকে তাকে একেবারে ভাসিয়ে না নিয়ে যায়।
নদীর পানির ভেতর দিয়ে সে ধাতব দেওয়ালের কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করল। কাজটি সহজ নয়—পানি যথেষ্ট উত্তপ্ত, একটানা সেখানে বেশি সময় থাকা যায় না। ধাতব দেওয়ালটি কীসের তৈরি বোঝা যায় না। সেখানে হাত দিয়ে সে বিশেষ কোনো একটা চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা করে, যেটি থেকে সে বুঝতে পারবে দেওয়ালটি কী, সেটি কেন এখানে আছে। দেওয়ালটিতে কান পেতে রাখলে সে একটা কম্পনের যান্ত্রিক কম্পন অনুভব করতে পারে। ঘরের ভেতর কিছু যন্ত্র একটা নির্দিষ্ট কম্পনের শব্দ সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
রুকাস পানিতে ডুবে ধাতব ঘরটির দেওয়ালটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে, সে দেওয়ালের উপর কোনো একটা লেখা বা চিহ্ন খুঁজছিল। যখন সে আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন হঠাৎ করে এক জায়গায় একটা চিহ্ন খুঁজে পেল। একটি বৃত্তের ভেতর আরেকটি বৃত্ত, তার মাঝে একটি ক্রস। চিহ্নটি সহজ, মনে রাখা কঠিন নয়।
রুকাস চিহ্নটির উপর হাত বুলায়, তারপর পানির নিচে সাঁতার কেটে তার সুড়ঙ্গে ফিরে আসে। এই রহস্যময় গোপন জায়গায় যেটুকু দেখা সম্ভব সে দেখে ফেলেছে, এখন তাকে সম্ভবত কয়েক দিনের জন্য লোকালয়ে ফিরে যেতে হবে। তাকে গিয়ে একটু খোঁজ নিতে হবে। তার এজেন্টকে সে ফিরে পাবে কি না জানে না—কিন্তু না পেলেও ক্ষতি নেই। সে তার মায়ের কাছে যেতে পারে, তার মায়ের এজেন্টকে ব্যবহার করে একটু খোঁজখবর নিতে পারবে।
রুকাস ফিরে যাওয়ার আগে তার কাঁচিটি দিয়ে চুল-দাড়ি কেটে নিজেকে একটু ভদ্র করে নিল
৯
রুকাস ফিসফিস করে নিজেকে বলল, “রুকাস দেখেছো?”
রুকাস মাথা নাড়ল, “দেখেছি।”
“তোমার কী মনে হয়?”
“আমার একেবারেই ভালো মনে হচ্ছে না।”
রুকাস একটা ঝোপের আড়ালে নিচু হয়ে বসে সামনে তাকিয়ে আছে। একটু দূরে বিশাল একটা খাদ। খাদের পাশে একটা মেয়ে দুই হাঁটুতে মাথা রেখে নিশ্চল হয়ে বসে আছে। মেয়েটার বসার ভঙ্গিটিতে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা আছে, যেটা দেখে রুকাস নিজের ভেতরে একধরনের চাপা অস্বস্তি অনুভব করে। লোকালয়ে ফিরে আসার জন্য রুকাস প্রায় তিন সপ্তাহ হেঁটে হেঁটে আসছে। এখন সে পাহাড়ের গেস্ট হাউসের কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই মাঝে মাঝেই সে এক-দুইজন মানুষের দেখা পাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে একা দেখেনি। সবসময়েই কয়েকজন মিলে কথা বলতে বলতে আশেপাশের এলাকাটা দেখতে বের হয়েছে। এই প্রথম রুকাস শুধু একজনকে একা বসে থাকতে দেখেছে। শুধু তা-ই নয়, বিশাল একটা খাদের খুব কাছাকাছি বিপজ্জনক জায়গায় হাঁটুর উপর মাথা রেখে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটির ভেতরে একধরনের তীব্র হতাশা।
রুকাস ফিসফিস করে নিজেকে ডাকল, “রুকাস।”
“বলো।”
“মেয়েটা উঠে দাঁড়ালেই তোমাকে সাবধান হতে হবে।”
‘হ্যাঁ। যদি পিছনে চলে আসে তাহলে কিছু করতে হবে না। কিন্তু যদি সামনে এগিয়ে যায় তাহলে তার কাছে যেতে হবে।”
“নিঃশব্দে।”
“হ্যাঁ। নিঃশব্দে। মেয়েটা যদি আত্মহত্যা করার জন্য এসে থাকে, যদি খাদে লাফ দেয়—”
“তাহলে ধরে ফেলতে হবে।”
“হ্যাঁ, কাজটা সহজ হবে না। তোমার জন্যেও একটু বিপজ্জনক। কিন্তু কিছু করার নেই।”
কিছুক্ষণ রুকাস চুপ করে থাকে, তারপর ফিসফিস করে প্রায় নিঃশব্দে বলল, “রুকাস। একটা কথা বলব?”
“তুমি কী বলবে বুঝতে পারছি। আত্মহত্যা করা কি তার ব্যক্তিস্বাধীনতা? আমি কি সেখানে হস্তক্ষেপ করছি? আমার কি সেই অধিকার আছে?”
“হ্যাঁ। সেটাই বলতে চাচ্ছি।”
রুকাস নিজের মনে মাথা নাড়ে। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি জানি না। কিন্তু মানুষ হয়ে নিজের চোখে আমি আরেকজন মানুষকে তার প্রাণ নিতে দেখতে পারব না। কাজটা উচিত না অনুচিত আমার জানার প্রয়োজন নেই।”
মেয়েটি এ রকম সময়ে উঠে দাঁড়াল। রুকাসও সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা একটু এগিয়ে যায়। রুকাসও সাথে সাথে নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েটা হঠাৎ ছুটে খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
রুকাসও ঠিক তখন ছুটে মেয়েটিকে ধরে ফেলার চেষ্টা করল। ঠিক কীভাবে কী ঘটল রুকাস জানে না। পরের মুহূর্তে সে আবিষ্কার করল তার অর্ধেকটা শরীর খাদের মাঝে ঝুঁকে আছে এবং সেই অবস্থায় সে মেয়েটার একটা হাত ধরে রেখেছে। মেয়েটা তার হাতে ঝুলছে, রুকাস টের পাচ্ছে এক হাতে মেয়েটাকে ধরে রাখা অসম্ভব। যেকোনো মুহূর্তে তার শরীরের নিচের অংশ পিছলে যাবে এবং সে মেয়েটিকে নিয়ে কয়েকশ মিটার নিচে পাথরের উপর আছড়ে পড়বে।
মেয়েটার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রাণটাকে রক্ষা করার অদম্য একটা ইচ্ছা তার ভেতরে কাজ করে, কিন্তু সে তারপরেও মেয়েটাকে ছাড়ল না, দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েটাকে ধরে রাখল। মেয়েটা মনে হয় ঠিক বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। সে একটু অবাক হয়ে উপরে তাকিয়েছে। রুকাসের সাথে তার চোখাচোখি হলো—মেয়েটা যন্ত্রণার একটা শব্দ করে বলল, “ছেড়ে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও।” শুধু মুখে বলল না, নিজেকে ছাড়ানোর জন্য পুরো শরীরে একটা ঝটক দিলো।
রুকাস দুই পা দিয়ে মাটিকে আঁকড়ে রেখে নিজেকে কোনোমতে আটকে রেখে অন্য হাতটি বাড়িয়ে দুই হাতে মেয়েটার হাতটা ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুমি একটু সাহায্য করো, তাহলে আমরা দুজনে বেঁচে যাব—”
মেয়েটি হিংস্র গলায় বলল, “আমি বাঁচতে চাই না—”
“আমি বাঁচতে চাই—তুমি সাহায্য করো—দোহাই লাগে তোমার — আমি ধরে রাখতে পারছি না—”
মেয়েটার যন্ত্রণাকাতর মুখে এই প্রথম একটু বিস্ময়ের ছাপ পড়ল। রুকাস বলল, “তুমি তোমার দুই হাত দিয়ে আমাকে ধরো—দোহাই লাগে—আমি ধরে রাখতে পারছি না—”
মেয়েটার কী মনে হলো কে জানে, সে তার দুই হাত দিয়ে রুকাসকে ধরল। রুকাস তখন তাকে টেনে খাড়া পাথরের দেওয়ালের কাছে এনে বলল, “তোমার পা দিয়ে পাথরের খাঁজের উপর দাঁড়াও—আমি আর ধরে রাখতে পারছি না—”
মেয়েটা সত্যি সত্যি একটা পাথরের খাঁজের উপর পা দিয়ে দাঁড়াল। সাথে সাথে রুকাসের হাত থেকে মেয়েটার পুরো ওজনটুকু কমে যায়। রুকাস বুক থেকে একটা বড়ো নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “ ধন্যবাদ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার প্রাণটা রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ।”
মেয়েটা অবাক হয়ে রুকাসের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ফিসফিস করে বলে, “তুমি একটা উন্মাদ।”
এই অবিশ্বাস্য একটি পরিবেশেও রুকাস একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি তোমাকে ধরে রাখছি, তুমি পাথরের খাঁজে পা দিয়ে উপরে উঠে আসো—তারপর আমরা আলোচনা করব কে বেশি উন্মাদ। তুমি না আমি।”
মেয়েটি রুকাসের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে, এ রকম একটি অবস্থায় কেউ এভাবে কথা বলতে পারে। কিন্তু তার কী মনে হলো কে জানে, শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি পাথরের খাঁজে পা দিয়ে সে উপরে উঠে এলো।
রুকাস মেয়েটির হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমার প্রাণ রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ। আর একটু দেরি করলেই আমরা দুজনে নিচে পড়ে যেতাম।”
“অর্থহীন কথা বোলো না। তুমি আমাকে ছেড়ে দিলেই তুমি বেঁচে যেতে।”
রুকাস বলল, “কিন্তু সেটি সম্ভব ছিল না।”
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, “সম্ভব ছিল না?”
“না।”
“কেন?”
রুকাস একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “জানি না।”
মেয়েটা মনে হলো একটু রেগে গেল, “জানো না?”
“নাহ্। মানুষের মন কীভাবে কাজ করে সেটা অনুমান করা খুব কঠিন।”
মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “ঠিক আছে। তুমি আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি নিয়েছো, সে জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি অনেক বড়ো একটা কাজ করেছো চিন্তা করে নিজেকে বাবা দিতে পারো, কিন্তু আমি মনে করি এটি ছিল বড়ো ধরনের নির্বুদ্ধিতা। এখন আমি কি একা থাকতে পারি?”
রুকাস মাথা নাড়ল, বলল, “অবশ্যই পারো। তবে—”
“তবে কী?”
“খুব কাছেই হচ্ছে গেস্ট হাউস। তুমি কি গেস্ট হাউস পর্যন্ত আমার সাথে যাবে?”
“কেন?”
“আমি ব্যাপারটা ঠিক ভালোভাবে বোঝাতে পারব না—আমি দীর্ঘদিন মানুষের সাথে কথা বলিনি, তাই এখনো ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে পারছি না—”
“তুমি দীর্ঘদিন মানুষের সাথে কথা বলোনি?”
রুকাস মাথা নাড়ল, বলল, “না।”
মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন?”
রুকাস বলল, “আমি আসলে অনেক দিন এই পাহাড়ে একা একা আছি। “কেন? তুমি কি কোনো ক্রিমিনাল?”
রুকাস হাসার চেষ্টা করল, বলল, “না। আমি ক্রিমিনাল না।”
“তাহলে?”
“আমি আসলে ব্যাপারটা তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। আমি বলেছি আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তবে বলতে পারো পৃথিবীর জীবনে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।”
মেয়েটা কিছুক্ষণ রুকাসের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কভাবে সামনে তাকিয়ে রইল। রুকাস ইতস্তত করে বলল, “তুমি কি আমার সাথে গেস্ট হাউসে যাবে? আমি জানি না আমাকে নেটওয়ার্ক থেকে সরিয়ে দিয়েছে কি না। যদি সরিয়ে দিয়ে থাকে আমি একটু কফি পর্যন্ত কিনে খেতে পারব না। অনেক দিন কফি খাই না—খুব কফি খাওয়ার ইচ্ছা করছে। তুমি যদি একটু কফি কিনে খাওয়াও তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।”
মেয়েটি বলল, “তুমি গুছিয়ে কথা বলতে পারো না কথাটা সত্যি না। তুমি যথেষ্ট গুছিয়ে কথা বলতে পারো।”
রুকাস আবার হাসার ভঙ্গি করল, বলল, “ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি কি যাবে?” মেয়েটি কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রুকাস ইতস্তত করে বলল, “আমি খুবই দুঃখিত যে তোমার একটা পরিকল্পনা নষ্ট করে দিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার জায়গায় তুমি হলে তুমি একই কাজ করতে।”
মেয়েটা এবারও কোনো কথা বলল না। রুকাস অপরাধীর মতো বলল, “দেখো, আমি তো সারা জীবন তোমাকে দেখে রাখব না। তুমি যখন একা থাকবে তখন তোমার যেটা ইচ্ছা করে ফেলতে পারবে, কেউ তোমাকে বাধা দেবে না।”
মেয়েটা নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। রুকাস বলল, “ঠিক আছে, তুমি যেতে না চাইলে যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারব।”
এবারে মেয়েটা রুকাসে দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “চলো যাই।”
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি রুকাস।”
“আমার নাম কিটি।”
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কিটি। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম।”
“আমি এই কথাটি বলতে পারব কি না জানি না। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে আমি খুশি হয়েছি কি না বুঝতে পারছি না।”
রুকাস শব্দ করে হাসল, বলল, “তোমাকে খুশি হতে হবে না কিটি I দুজনে ভেতর একজন খুশি হলেই যথেষ্ট।”
১০
গেস্ট হাউসের ক্যাফেটারিয়াতে একটা ছোটো টেবিলে রুকাস আর কিটি সামনাসামনি বসে আছে। দুজনের সামনে দুটি মগে দুই মগ কফি। রুকাস খুব আগ্রহ ভরে তার কফিটি খাচ্ছে, কিটি তার মগটি স্পর্শ করেনি। দুজনের কেউ কোনো কথা বলছে না। নীরবতাটুকু অস্বস্তিকর, কিন্তু কিটির সেটি নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সামনে অনির্দিষ্ট তাকিয়ে আছে। রুকাস মাঝে মাঝেই চারপাশে তাকিয়ে গেস্ট হাউসের অন্য অতিথিদের দেখছে। বহুদিন পর সে সত্যিকারের মানুষ দেখছে। মানুষগুলোর ভেতর যে রকম স্বতঃস্ফূর্ত একধরনের উচ্ছ্বাস থাকার কথা সেটি নেই। বেশির ভাগের চেহারাই ম্রিয়মাণ। খুব ভালো করে তাকালে সেখানে একধরনের চাপা অস্বস্তি চোখে পড়ে।
রুকাসের মনে হলো অস্বস্তিকর নীরবতাটুকু ভাঙার জন্য কিছু একটা বলা প্রয়োজন, তাই সে তার মুখ খুলল। বলল, “কিটি, আমি জানি তুমি ঠিক কথা বলার মতো অবস্থায় নেই—কিন্তু তবুও আমি একটা বিষয় জানতে চাইছিলাম। আমি কি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
কিটি বলল, “যদি প্রশ্নটি আমাকে নিয়ে হয় তাহলে না, প্রশ্নটি করতে পারো না।”
রুকাস মাথা নাড়ল, বলল, “না। প্রশ্নটি তোমাকে নিয়ে নয়।”
“তাহলে করতে পারো। তবে আমি উত্তর দেবো কি না জানি না।”
“সমস্যা নেই। না চাইলে উত্তর দিতে হবে না।” রুকাস তার কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “আমি বহুদিন পর মানুষজন দেখছি। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু মনে হচ্ছে মানুষজন কেমন যেন বিমর্ষ। আমার ধারণা কি সত্যি নাকি এটি আমার বোঝার ভুল?”
কিটি কিছুক্ষণ রুকাসের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “না, এটা তোমার বোঝার ভুল নয়। এটা সত্যি।”
“কেন?”
“তুমি কেন সবকিছু ছেড়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছো?” রুকাস একটু থতমত খেয়ে বলল, “আমি, আমি—”
কিটি রুকাসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “যদি সবার সুযোগ থাকত, সাহস থাকত, তাহলে তোমার মতো অনেকে পাহাড়ে-জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিত। সবার তোমার মতো সাহস নেই, তাই তারা যেতে পারে না। তাই তারা বিমর্ষ।”
রুকাস বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“এই পাহাড়ে তুমি কি সুখী ছিলে?”
রুকাস ইতস্তত করে বলল, “আমি নিজের ইচ্ছায় গিয়েছি তাই সুখী ছিলাম কি না সেই প্রশ্নের উত্তর অবান্তর—”
কিটি সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, “আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। এই পাহাড়ে তুমি কি সুখী ছিলে?”
রুকাস একটু চিন্তা করে বলল, “সব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ কিংবা না বলে দেওয়া যায় না। আমি যখন পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি তখন সিদ্ধান্তটি যে খুব যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল তাও নয়। অনেকটা নিজের সাথে একধরনের প্রতিযোগিতা ছিল, তাই ভালো হোক মন্দ হোক, সোজা হোক কঠিন হোক, আনন্দময় হোক নিরানন্দ হোক আমাকে দাঁতে দাঁত চেপে সেটা করতে হয়েছিল।”
“কিন্তু তুমি সেটা করতে পেরেছিলে, পাহাড়ে তুমি একা একা কোনো সাহায্য ছাড়া ছিলে।”
রুকাস মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, ছিলাম।”
“সেখানে থাকতে তোমার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছিল?”
“হ্যাঁ। হয়েছিল।”
“তুমি নানা রকম বিপদের মাঝে ছিলে?”
“হ্যাঁ ছিলাম।”
“তুমি তারপরেও সব রকম কষ্ট সহ্য করে সেই বিপদের মাঝে, যন্ত্রণার মাঝে ছিলে। পৃথিবীর এই জীবন থেকে পাহাড় আর জঙ্গলের সেই জীবনটিকেই তুমি বেছে নিয়েছিলে।”
রুকাস মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। সেটা তুমি বলতে পারো।”
“এখন কেন তুমি লোকালয়ে ফিরে যাচ্ছ?”
“আমি পাকাপাকিভাবে ফিরে যেতে চাইছি না। কয়েক দিনের জন্য ফিরে যেতে চাইছি।
“কেন?”
রুকাস একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। তুমি আমাকে জিগ্যেস কোরো না—”
কিটি বলল, “ঠিক আছে জিগ্যেস করব না।”
রুকাস বলল, “এটুকু বলতে পারি যে আমার হঠাৎ করে কিছু তথ্যের প্রয়োজন হয়েছে, যে তথ্য শুধু আমি লোকালয়ে ফিরে গিয়ে জানতে পারব। সে জন্যে যাচ্ছি।”
“আবার ফিরে আসবে?”
“হ্যাঁ।”
“কতদিন পরে?”
“কয়েক দিন।”
“সত্যি কয়েক দিন? নাকি কয়েক সপ্তাহ? কয়েক মাস?”
রুকাস হেসে বলল, “কয়েক দিন! কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস নয়। সত্যিই কয়েক দিন।” একটু থেকে জিগ্যেস করল, “তুমি হঠাৎ করে কেন এটি জানতে চাইছো?”
কিটি একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি একটা বিষয় ভাবছিলাম।”
“কী ভাবছিলে?”
“তুমি নিশ্চয়ই টের পেয়েছো এই পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার কোনো আকর্ষণ নেই।”
রুকাস মাথা নাড়ল, বলল, “বিষয়টা আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে, কিন্তু অনুমান করেছি।”
“কিন্তু তোমার সাথে কথা বলে হঠাৎ আমার মনে হলো, যেহেতু এখন আমার কিছুতেই কিছু আসে-যায় না, আমি কেন তোমার মতো সবকিছু ছেড়েছুড়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে-ফিরে বেড়াই না।”
রুকাস চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। বলল, “আমিও তোমাকে এই কথাটি বলতে চাইছিলাম কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছিলাম না!”
“তুমি যদি সত্যি কয়েক দিনের মাঝে ফিরে আসো, তাহলে আমি এই গেস্ট হাউসে কয়েক দিন কষ্ট করে কাটিয়ে দিতে পারি। তুমি ফিরে এলে তোমার সঙ্গে জঙ্গলে যেতে পারি।”
“আমার মনে হয় একটা খাদে লাফ দেওয়া থেকে এটি অনেক ভালো একটি সিদ্ধান্ত।”
কিটি একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আমি এত নিশ্চিত নই।”
রুকাস কোনো কথা না বলে এই বিচিত্র মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। লক্ষ করল কিটি প্রথমবার তার কফির মগে চুমুক দিলো। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে কিন্তু কিটি সেটা টের পেয়েছে বলে মনে হলো না।
১১
লোকালয়ে পৌঁছে রুকাস কিছুক্ষণের মাঝে একটা বড়ো ধাক্কা খেলো— পৃথিবীর নেটওয়ার্ক থেকে তার নাম পুরোপুরি মুছে দেওয়া হয়েছে। এখানে কোথাও তার নাম-পরিচয় নেই, কেউ তাকে চিনে না। সে ট্রেনে উঠতে পারবে না, কোথাও যেতে পারবে না, কোনো কিছু কিনতে পারবে না। তার নিজের শহরে যাবার জন্য সে যখন টিকিট কিনতে গেল ইন্টারফেস যন্ত্র তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গেল—যেন তার কোনো অস্তিত্ব নেই। সে যদি খাবার পর্যন্ত কিনতে না পারে তাহলে না খেয়ে মারা যাবে। তথ্য- ইন্টারফেসে গিয়ে যে নিজের সম্পর্কে একটা খবর নেবে তারও কোনো উপায় নেই। যার কোনো অস্তিত্ব নেই সে কেমন করে কারো সম্পর্কে তথ্য নেবে? রুকাস প্রথমে অসহায় অনুভব করে এবং কিছুক্ষণের মাঝে আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করে। এখন সে যদি কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে, কেউ তাকে চিকিৎসার জন্যেও নেবে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়ে রিপোর্ট করতে পারে কিন্তু সেটিও কাজ করবে কি না সে জানে না। যদি শেষ পর্যন্ত কাজ করে তাকে এত রকম কৈফিয়ত দিতে হবে যে বাকি জীবন তাকে নিশ্চয়ই চোখে চোখে রাখা হবে। সে কিটিকে বলে এসেছে যে কয়েক দিনের মাঝে ফিরে যাবে কিন্তু কোনো বড়ো রকমের ঝামেলায় পড়ে গেলে সে ফিরে যাবে কেমন করে? সে যদি ফিরে না যায় মেয়েটি কি আবার খাদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়বে না?
রুকাসের এই বিশাল ঝামেলা যে রকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছে ঠিক সে রকম হঠাৎ করে সমাধান হয়ে গেল। সে কখনো কল্পনাও করেনি এত বড়ো একটা ঝামেলার এত সহজ একটা সমাধান থাকবে।
লোকালয়ে পৌঁছানোর পর যখন সে প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর তখন বুঝতে পারল দরকার হলে তার কোনো আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে কিংবা কোনো মানুষের হাত থেকে খাবার ছিনিয়ে নিয়ে হলেও কিছু একটা খেতে হবে। তখন বাধ্য হয়ে সে খাবার ডিসপেন্সারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার নিজের নাম-পরিচয় কিংবা অস্তিত্ব বলে কিছু নেই, তাই তার জন্যে কোনো খাবার বের হয়ে এলো না। একটু পর যখন মাঝবয়সি একজন মহিলা এসে দাঁড়ায়, তখন সেই মহিলার জন্য ডিসপেন্সারের দরজা খুলে ধূমায়িত গরম খাবারের একটা প্লেট বের হয়ে আসে। রুকাস তখন এগিয়ে গিয়ে মাঝবয়সি সেই মহিলার ট্রেটা টেনে নিয়ে নেয়, মহিলাটি চিৎকার করে কিছু একটা বলবে আশঙ্কা করে সে একটা দৌড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল কিন্তু মহিলা কিছুই বলল না। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজের জন্য দ্বিতীয় একটা ট্রে বের করে নেয়। মহিলাটি চলে যাওয়ার সময় চোখের কোনা দিয়ে রুকাসের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকাল, তার বেশি কিছু নয়।
রুকাসের কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে সে যে নাম-পরিচয় এবং অস্তিত্বহীন একজন মানুষ সেটি কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। সবাই ধরে নিচ্ছে সে অন্য সবার মতো একজন, নিজের খাবার ট্রে বের করার মতো ধৈর্য নেই তাই অভদ্রের মতো অন্যের ট্রেটা নিয়ে যাচ্ছে।
রুকাসের তখন সাহস বেড়ে গেল। সে একটা কাপড়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার জন্য দরজা খুলে গেল না। অন্য আরেকজনের জন্য যখন দরজাটি খুলেছে তখন সে পিছু পিছু ভেতরে ঢুকে যায়। নিজের জন্য একটা ভালো জ্যাকেট তুলে সে আরেকজনের পিছনে পিছনে বের হয়ে আসে, কোথাও কোনো অ্যালার্ম বেজে উঠল না। সে একজন অদৃশ্য মানুষের মতো, তার জন্য কোনো নিয়ম নেই।
কয়েকবার পরীক্ষা করে বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত হয়ে সে তার মায়ের সাথে দেখার করার সিদ্ধান্ত নিল। এর আগে প্রত্যেকবার ট্রেনে ওঠার আগে তার ইউনিট খরচ করে সিট নিশ্চিত করে নিতে হয়েছে। এবারে তার কিছুই করতে হলো না। সে শুধু অন্য মানুষজনের পিছু পিছু ট্রেনে উঠে যায়। ট্রেন ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে সে একটা খালি সিটে বসে পড়ে। কয়েক ঘণ্টা পরে সে যখন মায়ের শহরে পৌঁছেছে তখন সে অদৃশ্য মানবের মতো অন্যদের সাথে ট্রেন থেকে নেমেছে।
একটা বাইভার্বালে রুকাস মায়ের বাসার সামনে নেমে যায়। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে বাসাটাকে একটু অন্য রকম মনে হয়। রুকাস কারণটা ঠিক বুঝতে পারে না। সে অবশ্য বিষয়টা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না। প্রতিবার সে যখন তার মায়ের বাসায় এসেছে দরজায় বেশ কয়েকবার শব্দ করার পর মা এসে দরজা খুলেছেন। এবারে দরজায় স্পর্শ করা মাত্র দরজাটি খুলে গেল।
রুকাস দরজাটি ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে যায়। দরজার অন্য পাশে কেউ নেই। তাহলে কে দরজা খুলেছে? ঘরটি আবছা অন্ধকার। রুকাস উঁচু গলায় ডাকল, “মা। মা, আমি রুকাস।”
কেউ তার কথায় উত্তর দিলো না। রুকাস আবার ডাকতে যাচ্ছিল হঠাৎ চমকে উঠে দেখে মা ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে আছেন। মায়ের দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা কেমন যেন অসহায়। রুকাস অবাক হয়ে বলল, “মা! তোমার কী হয়েছে?”
“তুমি যখন ছিলে না তখন আমাকে ডিজিটায়িত করেছে।”
“ডিজিটায়িত?” রুকাস চিৎকার করে উঠল, “তুমি এখন ডিজিটায়িত?”
“হ্যাঁ রুকাস। আমি ডিজিটায়িত।”
রুকাস আর্তনাদ করে ওঠে, “কেন মা? কেন?”
“একজন একজন করে সবাইকে ডিজিটায়িত করে ফেলবে। প্রতিদিন নূতন নূতন মানুষকে ডিজিটায়িত করছে।”
“সত্যি?”
“হ্যা রুকাস। সত্যি।”
“তুমি কেমন করে জানো?”
“তাদের সাথে আমার দেখা হয়।”
রুকাস বুকের ভেতর একধরনের শূন্যতা অনুভব করে। যদি এসে জানতে পারত তার মা হঠাৎ মারা গেছেন সে এত বিচলিত হতো না। রুকাস কী বলবে বুঝতে পারে না।
সে স্থির চোখে তার মায়ের হলোগ্রাফিক অবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি কেমন আছো মা? এই নূতন জগতে তুমি কেমন আছো?”
মা অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়লেন, ফিসফিস করে বললেন, “আমি জানি না আমি কেমন আছি।”
“তুমি জানো না?”
“না রুকাস। যতদিন বেঁচে ছিলাম ততদিন সুখ-দুঃখের অনুভূতি ছিল। এখন আমি জানি না কেমন করে সুখ-দুঃখ অনুভব করব। এই জগৎটা অন্য রকম রুকাস।”
“কী রকম মা? এই জগৎটা কী রকম?”
“আমি কেমন করে বুঝাব? কিছু ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না এ রকম একটি জগৎ। অনেকটা স্বপ্নের মতো, সবকিছু আছে আবার যেন কোনো কিছুই নেই।”
“তোমার কেমন লাগে মা?”
“অনেক একা একা লাগে।”
রুকাস জিগ্যেস করল, “একা একা? কেন মা? তুমি না বলেছো প্রতিদিন অনেক মানুষ ডিজিটাইজ করছে? তাদের সাথে তোমার দেখা হয় না? তাদের সাথে কথা হয় না?”
“মা মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ রুকাস। দেখা হয়। কিন্তু কথা হয় না।”
“কেন মা? কথা হয় না কেন?”
“আমাদের তো কোনো কিছু জানার জন্যে কথা বলতে হয় না। যখন দেখা হয় তখন এক মুহূর্তে সব তথ্য বিনিময় করে ফেলতে পারি। আমরা একজন আরেকজনের সবকিছু জেনে যাই। তার চিন্তাভাবনা, স্মৃতি সবকিছু।”
রুকাস বলল, “কিন্তু মা, মানুষের মাথায় তো একশ বিলিয়ন নিউরন। প্রত্যেকটা নিউরন অন্য আরো কয়েক হাজার নিউরনের সাথে যুক্ত। তাদের সিন্যান্স প্রতি মুহূর্তে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে! এটি তো বিশাল পরিমাণ তথ্য— অসংখ্য মানুষের এ রকম তথ্য একসাথে বিনিময় করার মতো ব্যবস্থা কোথায় পাবে?”
মা বললেন, “আমরা জানতে পেরেছি সে রকম একটা সিস্টেম হয়েছে, সে জন্যে মানুষকে ডিজিটাইজ করতে শুরু করেছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি। বহু দূর একটা পাহাড়ের মাঝে সেটা বসানো আছে।” রুকাস ইলেকট্রিক শখ খাওয়ার মতো চমকে উঠল, আর্তচিৎকার করে বলল, “কী বললে মা? পাহাড়ের ভেতর?”
“হ্যাঁ। অনেক তাপ বের হয়, তাই নদীর পানিতে সেটা শীতল রাখতে হয়।”
রুকাস বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার মায়ের হলোগ্রাফিক অবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “এই যে আমি তোমার সাথে কথা বলছি রুকাস, আমার সব সিগন্যাল কিন্তু প্রক্রিয়া হচ্ছে সেই সিস্টেমে। নূতন যে পরাজগৎ তৈরি হয়েছে তার সব প্রক্রিয়া হয় সেখানে। যখন সেই সিস্টেমটি পুরোপুরি দাঁড়িয়ে যাবে তখন আর এই পৃথিবীর কোনো প্রয়োজন থাকবে না।”
রুকাস কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর জিগ্যেস করে, “মা, এই সিস্টেমটির কোনো নাম আছে?”
“না, নাম নেই। এর শুধু একটি চিহ্ন আছে।”
“কী রকম চিহ্ন মা?”
“একটা বড়ো বৃত্তের মাঝে একটা ছোটো বৃত্ত। তার মাঝখানে— রুকাস মায়ের কথা শেষ করে দিলো, “তার মাঝখানে ক্রস?”
মা মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ, একটা ক্রস। কিন্তু পরাজগতের ডিজিটাইজ মানুষ ছাড়া আর কেউ তো সেটা জানে না। তুমি কেমন করে এটা জানো রুকাস?”
রুকাস কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই তার মা চিৎকার করে উঠলেন, “রুকাস!”
“কী হয়েছে মা?”
“জিটুৎসি-৩২-এর বাহিনী তোমাকে ধরতে আসছে।
“কেন মা?”
“তুমি অনেক কিছু জেনে গেছো, যেটা জানার কথা না। পালাও—তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও। এক মুহূর্তও দেরি কোরো না—”
রুকাস উঠে দাঁড়াল, বলল, “ঠিক আছে মা, আমি উঠছি। যাওয়ার আগে শুধু একটা কথা বলো।”
“কী বলব?”
“তোমার এই জীবনটা নিয়ে তুমি কী সুখী? তুমি কি এই জীবনে বেঁচে থাকতে চাও?”
মা চিৎকার করে উঠলেন, বলেন, “না–না—না—আমি এই জীবনে আটকে থাকতে চাই না! আমি মুক্তি চাই! কিন্তু রুকাস এই জীবন থেকে কোনো মুক্তি নেই।” তারপর মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন I
রুকাস তার হলোগ্রাফিক অবয়বের মা’কে বৃথাই আলিঙ্গন করার চেষ্টা
করল। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
মানুষের ভিড়ে মিশে যাওয়ার পর লক্ষ করল অনেকগুলো বাইভার্বাল তীক্ষ্ণ শব্দ করতে করতে তার মায়ের বাসার দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে একজন অদৃশ্য মানুষ, তাকে আর ধরার কোনো উপায় নেই।
১২
বিপজ্জনক একটা চড়াই পার হয়ে মাঝারি একটা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে রুকাস কিটির জন্য অপেক্ষা করে। কিটি খুব সাবধানে চড়াইটা পার হয়ে পাথর ধরে ধরে উপরে উঠে রুকাসের পাশে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে নিতে চারিদিকে তাকিয়ে বলল, “কী সুন্দর!”
রুকাস মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, যারা বড়ো বড়ো শহরে থাকে, তাদের কাছে প্রকৃতির এই রূপটি সবসময় সুন্দর মনে হয়। যখন তুমি এখানে দিনের পর দিন থাকবে তখন এটি আর আলাদা করে চোখে পড়বে না।”
“আমার মনে হয় পড়বে। যেটি সুন্দর সেটি সবসময় সুন্দর। অভ্যস্ত হলেও সুন্দর, না হলেও সুন্দর।”
রুকাস তর্ক করল না। হেসে বলল, “কিটি! এখন তোমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
“সিদ্ধান্তটি যদি তোমার সাথে রোমান্টিক সম্পর্ক বিষয় হয় তাহলে তোমার জিগ্যেস করারও প্রয়োজন নেই।”
রুকাস এবার শব্দ করে হাসল, বলল, “না কিটি! আমি মোটেও সে রকম বিষয়ে তোমাকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বলছি না, এবং কখনো বলার ইচ্ছে নেই। কারণ শেষ যেই মেয়েটির সাথে আমার সম্পর্ক ছিল সে আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বলে গেছে আমি যেন ভুলেও কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক করার চেষ্টা না করি। একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক করার জন্য যেই বিষয়গুলো একজনের থাকতে হয়, আমার ভেতরে তার কিছু নেই। আমি তার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি এবং তারপর থেকে আমার কখনো কোনো সমস্যা হয়নি।”
কিটি এবারে একটু হাসল, বলল, “ঠিক আছে, বলো। আমাকে কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
“তুমি যদি ফিরে যেতে চাও তাহলে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এরপর আমরা এই পাহাড় থেকে যে উপত্যকায় নেমে যাব সেটি খুবই কঠিন। এখানে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। কাজেই তুমি যদি এই উপত্যকায় নেমে যাও খুব সহজে আর সভ্য জগতে ফিরে আসতে পারবে না।”
“সভ্য জগৎকে দেখে আমার বেঁচে থাকার শখ পর্যন্ত মিটে গিয়েছিল সেটা তুমি জানো।”
রুকাস মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। আমি সেটা জানি না। তোমার বেঁচে থাকার শখ মিটে গিয়েছিল সেটা আমি জানি কিন্তু ঠিক কী কারণে সেটা মিটে গিয়েছিল আমি সেটা জানি না।”
“ঠিক আছে, আমরা আপাতত সেটা নিয়ে আলোচনা না করলাম।”
রুকাস মেনে নিল। তারপর বলল, “আমার মনে হয় সভ্য জগৎ থেকে দূরে থাকা বলতে কী বোঝানো হয় সেটা আমার আরেকটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। এর অর্থ, তুমি তোমার পছন্দসই খাবার দূরে থাকুক, প্রয়োজনীয় খাবারও নিয়মিতভাবে পাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি একা একা থেকে খাওয়ার অনেক কিছু পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি কিন্তু তারপরেও বলছি, পুষ্টিকর সুস্বাদু নিয়মিত খাবারের বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা নেই। রাজি?”
কিটি মাথা নাড়ল, বলল, “রাজি। তুমি পারলে আমিও পারব।”
“এখনই রাজি হয়ে যেও না। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। শুধু যে খাবার পাবে না তা নয়। সভ্য জগতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার যে বিষয়টা আছে সেটা ভুলে যেতে হবে। নিয়মিত গোসল করতে পারবে না। পরিষ্কার কাপড় থাকবে না। চুলে পোকা হবে, তোমার শরীরের উপর নানা ধরনের পোকামাকড় ঘুরে বেড়াবে।”
কিটি মুখ টিপে হেসে বলল, “বলে যাও।”
“তোমার বিছানা হবে শক্ত পাথরের। শীতের সময় আগুন হবে বেঁচে থাকার উপায়। সবসময় চোখে-মুখে কালিঝুলি লেগে থাকবে। বুঝেছো?”
কিটি মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি। আর কিছু?”
“বিনোদনের কিছু থাকবে না। নৃত্য গীত শিল্প বলে কিছু নেই। কাঠবেড়ালির নাচ, পাখির গান আর ভোঁদড়ের শিল্পকলা হবে তোমার একমাত্র বিনোদন।”
কিটি বলল, “এখন পর্যন্ত তুমি আমাকে কোনো কিছু বলে ভয় দেখাতে পারোনি।”
রুকাস মুখ শক্ত করে বলল, “তার কারণ এখন পর্যন্ত আমি তোমাকে বিপজ্জনক কোনো তথ্য দেইনি। সেটি রেখেছি সব শেষে বলার জন্য।”
কিটি বলল, “ঠিক আছে, বলো।”
রুকাস বলল, “মনে আছে প্রথমবার তুমি যখন জানতে পারলে আমি পাহাড়ে একটা জঙ্গলের মাঝে একা একা থাকি, তুমি জানতে চেয়েছিলে আমি একজন ক্রিমিনাল কি না?”
“হ্যাঁ মনে আছে।” কিটি ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি তখন আমাকে মিথ্যা উত্তর দিয়েছিলে? আসলে তুমি একজন ক্রিমিনাল?”
রুকাস মাথা নাড়াল, বলল, “না, আমি তখন মিথ্যা উত্তর দেইনি। আমি আসলে তখন ক্রিমিনাল ছিলাম না। কিন্তু এইবার আমি যখন আমার ডিজিটায়িত মায়ের সাথে কথা বলেছি তখন কোনো একটা গোপন বিষয় জেনে যাওয়ার কারণে আমি জিটুৎসি-৩২-এর চোখে ক্রিমিনাল হয়ে গেছি।”
“শুধু কথা বলার জন্য?”
“কথা বলে কিছু তথ্য জেনে যাওয়ার জন্য। যে তথ্য আমার জানার কথা না। যদিও তার জন্য আমি দায়ী নই।”
কিটি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “সেই গোপন কথাটি কী?”
“তুমি যদি শেষ পর্যন্ত আমার সাথে গিয়ে আমার মতো জঙ্গলে বসবাস করতে শুরু করো তাহলে তোমাকে বলতেই হবে, কিন্তু এখন আমি তোমাকে বলতে চাই না।”
কিটি জিগ্যেস করল, “তোমার সব কথা কি বলা শেষ হয়েছে?”
“না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি এখনো বলা হয়নি।”
“বলো।”
“এখন পর্যন্ত আমার অপরাধটি খুবই নগণ্য—আমি সে জন্যে দায়ী নই। কিন্তু যে কারণে আমি খুবই দ্রুত আমার জায়গায় ফিরে যেতে চাইছি তার কারণ, আগামী কয়েক মাস আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। সে কাজটির কারণে আমি সত্যিকার ক্রিমিনালে পরিণত হব।”
“সেই কাজটি কী, সেটি কি বলা যাবে?”
“না। তুমি যদি আমার সাথে যাও তাহলে তুমি নিজেই দেখবে। আমি শুধু বলতে পারি কাজটি জটিল, কষ্টসাধ্য, ভয়ংকর, বিপজ্জনক, এবং সাফল্যের সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। কিন্তু সেই কাজটি শুরু করার কারণে জিটুৎসি- ৩২ নিশ্চিতভাবে আমাকে খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করবে। এবং তুমি যদি আমার সাথে থাকো তাহলে নিশ্চয়ই তুমিও সমান অপরাধী হবে। তোমাকেও নিশ্চিহ্ন করে দেবে।”
রুকাস ভেবেছিল তার কথা শুনে কিটি নিশ্চয়ই খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে। কী করবে সিদ্ধান্ত নিতে চিন্তাভাবনা করবে, কিন্তু তার ঠিক উল্টোটা হলো। কিটির মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটে ওঠে। সে রুকাসের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তোমার সাথে যাওয়া নিয়ে আমার ভেতর যেটুকু দুর্ভাবনা ছিল, তোমার কথা শুনে সেটা পুরোপুরি দূর হয়ে গেছে! চলো আমরা দুজন মিলে সেই জটিল কষ্টসাধ্য, ভয়ংকর, বিপজ্জনক কাজটি করা শুরু করি—যার সাফল্যের সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই।”
রুকাস তার হাসি গোপন না করার চেষ্টা করে বলল, “কিটি, তুমি খুবই বিচিত্র একটা মেয়ে।”
“জানি। এটা কেউ প্রশংসা করার জন্য বলে না—কিন্তু যখন বলে আমি সেটা প্রশংসা হিসেবেই নিই।”
রুকাস তার ভারী বোঝাটা কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, “চলো যাই।”
কিটি বলল, “চলো! আমি সেই বিস্ময়কর প্রজেক্টটা দেখার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না।”
রুকাস বলল, “আমি কথা দিচ্ছি, আমরা যেদিন গন্তব্যস্থলে পৌঁছাব সেদিন ওই এলাকার সবচেয়ে পুরুষ্টু গুবরে পোকা সেঁকে তোমাকে রাতের খাওয়া খাওয়াব।”
কিটি শব্দ করে হাসল। রুকাস এই প্রথমবার মেয়েটিকে সত্যিকারভাবে হাসতে দেখল। এমনিতে তার চেহারায় একধরনের কাঠিন্য আছে। হাসার কারণে সেই কঠিন চেহারা আশ্চর্যভাবে কোমল এবং কমনীয় হয়ে ওঠে।
১৩
নিষিদ্ধ উপত্যকায় বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে রুকাস কিটিকে বলল, “ওই যে দূরে সমতল জায়গাটা দেখছো, উপরে ছোটো ছোটো ঝোপঝাপ, গাছগাছালি হয়ে গেছে সেটা হচ্ছে জিটুৎসি-৩২-এর মস্তিষ্ক। এর ভেতরে ডিজিটায়িত সব মানুষের মস্তিষ্ক কাজ করছে।”
দু’দিন আগে রুকাস কিটিকে নিয়ে তার গুহাতে পৌঁছেছে। দুই দিন বিশ্রাম নিয়ে আজ তৃতীয় দিনে সে কিটিকে নিয়ে এখানে এসেছে।
রুকাস বিষণ্ন মুখে বলল, “আমি যখনই চিন্তা করি আমার মায়ের মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে এই চুতষ্কোণ কিউবের মাঝে আটকে রেখেছে, আমি অস্থির হয়ে যাই।”
কিটি রুকাসের পিঠে হাত দিয়ে নরম গলায় বলল, “আমি তোমার যন্ত্রণাটা বুঝতে পারছি।
“আমার মা এখান থেকে মুক্তি চাইছে।”
“তোমার মায়ের জায়গায় হলে আমিও নিশ্চয়ই মুক্তি চাইতাম।”
রুকাস কিটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আলাদা। ডিজিটায়িত না হয়েও তুমি মুক্তি চাও—আমি সময়মতো ধরে না ফেললে তুমিও সেদিন মুক্তি পেয়ে যেতে!”
কিটি কোনো কথা না বলে একটু হাসল।
রুকাস বলল, “এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমি কী করতে চাইছি।”
“খুঁটিনাটি বুঝতে পেরেছি দাবি করব না কিন্তু তুমি কী করতে চাইছো সেটা মোটামুটি অনুমান করতে পারছি।”
“খুঁটিনাটি আমিও এখনো জানি না। কাজটি সহজ সেটাও দাবি করছি না। কিন্তু যেটা করতে চাইছি তার পিছনের বিজ্ঞানটা খুবই সহজ। জিটুৎসি-৩২-এর মস্তিষ্ক খুব কার্যকর হতে পারে কিন্তু মানুষের শরীরের মতো কর্মদক্ষ নয়—শক্তির অপচয়ের কারণে প্রচুর তাপশক্তি বের হয়। সে জন্য এটাকে একটা আস্ত নদীর মাঝখানে বসিয়ে সেই নদীর পানি দিয়ে ঠান্ডা করতে হয়। আমি সেই নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ করে জিটুৎসি-৩২-এর মস্তিষ্ক প্রচণ্ড উত্তাপে বিস্ফোরিত করে দিতে চাই।”
কিটি বলল, “তুমি খুবই সহজে বললে ‘নদীর প্রবাহ বন্ধ করে’—কিন্তু নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ করা এত সহজ? আমার ধারণা এটি অসম্ভব একটি ব্যাপার। অনেক মানুষ, অনেক ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে অনেক ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং করে হয়তো করা যেতে পারে কিন্তু তুমি-আমি দুজনে মিলে কয়েকটা ছোটো স্ক্রু ড্রাইভার কিংবা চাকু দিয়ে এটা করে ফেলতে পারব?”
“এই নদীটা যদি সমতলের নদী হতো তাহলে তোমার কথা একশ ভাগ সত্যি। কিন্তু এটা সমতলের নদী নয়—এটা একটা পাহাড়ি নদী। এটা পাহাড়ের নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে নানা পাথরের ভেতর দিয়ে নেমে আসছে। আমি এই নদীর উজানে গিয়ে দেখতে চাই—যদি ভাগ্য থাকে তাহলে নিশ্চয়ই কোনো জায়গা পাওয়া যাবে, যেখানে নদীটি সরু—উপর থেকে কোনো পাথরের চাঙড় গড়িয়ে দিলে নদীর প্রবাহ বন্ধ না হলেও অন্যদিকে সরে যাবে—কিংবা প্রবাহ কমে যাবে। সে জন্য আমি বলছি এটা কয়েক দিন কিংবা কয়েক সপ্তাহের প্রজেক্ট নয়। এটা কয়েক মাসের প্রজেক্ট।”
কিটি যে রুকাসের যুক্তি পুরোটা মেনে নিল সে রকম বলা যাবে না, কিন্তু সে উত্তরে কিছু বলল না। রুকাসের উৎসাহে সে ভাটা শুরু করে দিতে চায় না।
রুকাস বলল, “আমার পরিকল্পনা শুধু একটা নয়। আরো আছে।”
“আরো কী পরিকল্পনা?”
রুকাস বলল, “আমি এখানে থেকে অনেক কিছু আবিষ্কার করেছি। তার একটা হচ্ছে ডিজেল গাছ।”
“ডিজেল গাছ?”
রুকাস হাসল, বলল, “এটা গাছটার সত্যিকারের নাম নয়। আমি এই নাম দিয়েছি। কারণ এই গাছ থেকে যে কষ বের হয় সেটা ডিজেলের মতো জ্বলে! আমি সেই ডিজেল গাছ থেকে অনেক জ্বালানি সংগ্রহ করেছি। সেই জ্বালানি নিয়ে আমি জিটুৎসি-৩২-এর মস্তিষ্কের উপর রেখে আসব। তারপর জ্বালিয়ে দেবো। যদি দীর্ঘ সময় জ্বালাতে পারি কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।”
কিটি মাথা নাড়ল, বলল, “এটা অবশ্য যথেষ্ট বাস্তব পরিকল্পনা। এ ছাড়া আর কোনো পরিকল্পনা?”
“আপাতত এই দুটোই। কাজে নামলে হয়তো আরো নূতন কিছু পরিকল্পনা বের হবে। তা ছাড়া তুমি এখন ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছো, দুটি মস্তিষ্ক সবসময়েই এটি মস্তিষ্ক থেকে বেশি কাজের। এখন আরো নূতন পরিকল্পনা বের হয়ে আসতে পারে।”
কিটি মাথা নাড়ল, বলল, “আমার ওপর বেশি ভরসা করে থেকো না। আমি সফলভাবে একটা খাদের ভেতর ঝাঁপিয়ে পর্যন্ত পড়তে পারি না!”
.
রুকাস আর কিটি পরের দিন থেকেই কাজ শুরু করে দিলো। প্রথমে এই এলাকায় যত ডিজেল গাছ রয়েছে সব খুঁজে বের করে সেগুলোর পুরু বাকলে খাঁজ কেটে গর্ত করে তার কষ সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করে নিল। আপাতত সেগুলো মাটিতে বড়ো গর্ত করে সেখানে জমা করছে। সময় হলে এখান থেকে সরিয়ে নেবে।
তারপর দুজন নদীর উজানে রওনা দিলো। নদীর পানিতে বাঁধ দেওয়ার জন্য ভালো কোনো জায়গা পাওয়া যায় কি না সেটা তারা খুঁজে দেখতে চায়। গেস্ট হাউস থেকে যেসব খাবার এনেছিল সেগুলো শেষ হয়ে গেছে। এখন খাওয়ার জন্য চারপাশের গাছগাছালি আর পশুপাখির ওপর নির্ভর করতে হয়। রুকাস এর মাঝে অনেক কিছু শিখে গেছে। একটা ছোটো ফাঁদ পেতে সহজেই একটা বুনো খরগোশ ধরে ফেলতে পারে। চাকু না থাকলেও পাথরের ধারালো টুকরো দিয়ে সে খরগোশের চামড়া খুলে নিতে পারে। পাথর দিয়ে ঘষে আগুন জ্বালাতে পারে। খরগোশের মাংস ঝলসে নিয়ে কিটির সাথে বসে খেতে পারে। শুধু তা-ই না, অসংখ্য গাছের ভেতর রয়েছে নানা রকম ফল, গাছের বিভিন্ন রকম মূল, মাশরুম, কচি পাতা, নদীতে মাছ—কেউ যদি এই বিশাল খাবারের উৎস ব্যবহার করতে শিখে যায় তাহলে সে এখানে অনির্দিষ্টকাল টিকে থাকতে পারে।
নদীর উজানে যেতে যেতে প্রায় সপ্তাহ খানেক পর তারা যখন নদীর ধারায় শতভাগ পছন্দের একটা জায়গা পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন তারা হঠাৎ করে সে রকম একটা জায়গা পেয়ে গেল। নদীটা এখানে সরু হয়ে এসেছে। পাহাড় থেকে বড়ো বড়ো পাথর নদীর কিনারায় এসে জমা হয়েছে। উপরে আরো কিছু বড়ো বড়ো পাথর বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে, মনে হয় নিচে থেকে কিছু মাটি-পাথর সরিয়ে নিয়ে কাছাকাছি একটা গাছের গুঁড়িকে ফালক্রাম হিসেবে ব্যবহার করে আরেকটা গাছের কাণ্ড দিয়ে চাড় দিলে পাথরটা গড়িয়ে পড়বে। নিচে গড়িয়ে পড়ার সময় এটা আরো অন্য পাথরকে ছুটিয়ে আনবে। তা ছাড়া চারপাশে পাইন বন। কিছু গাছ কেটে নদীতে ফেলে দিলে সেগুলো পাথরকে আটকে ফেলে নদীর পানিতে একটা বেষ্টনীর মতো তৈরি করবে। তখন পাথরগুলোর আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, নদীটির ডান পাশের তীরটি খাড়া নিচে নেমে গেছে, যদি নদীর স্রোতে পাথরের বাধা তৈরি করা যায়, তাহলে পানি ফুলে-ফেঁপে উঠে ডান দিকের তীর ভেঙে নেমে আসবে— সম্পূর্ণ নূতন একটা পানির প্রবাহ শুরু হবে।
রুকাস আর কিটি তাদের কাজ শুরু করে দিলো।
.
ঘুম ভাঙার সাথে সাথে তারা নদীর বাঁকে গিয়ে হাজির হয়। বিশাল একটা পাথরের নিচের পাথরগুলো তোলার চেষ্টা করতে থাকে। সারাদিন কাজ করে সন্ধোবেলা আবিষ্কার করে কোনো পাথরকেও তারা এক সেন্টিমিটারও সরাতে পারিনি! পরদিন আবার নূতন উৎসাহে কাজ শুরু করে—পাথরের সাথে পাথরের আঘাতের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে পুরো এলাকাটা প্রকম্পিত হয় কিন্তু দিন শেষে দেখা যায় কাজ কিছুই হয়নি।
টানা এক সপ্তাহ কাজ করার পর হঠাৎ করে তারা আবিষ্কার করে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা পাথরটা আরো বিপজ্জনকভাবে ঝুলে পড়েছে। তারা তখন আরো উপরে উঠে অন্য পাথরের উপর কাজ শুরু করে— তারপর আরো উপরে।
পাথরকে আঘাত করতে করতে যখন তারা ক্লান্ত হয়ে যায় তখন তারা তাদের ডিজেল গাছের কাছে ফিরে যায়। এই সময়ে বের হয়ে আসা জ্বালানিগুলো সংগ্রহ করে, তারপর সেগুলো জিটুৎসি-৩২-এর মস্তিষ্কের উপরে কাছাকাছি নিয়ে রাখতে থাকে। যখন তারা এর উপরে আগুন জ্বালিয়ে দেবে তখন সেগুলো এর উপরে নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখতে হবে। তারা যে পরিমাণ জ্বালানি সংগ্রহ করেছে সেটা দিয়ে পুরো এলাকাটিতে কয়েক ঘণ্টা আগুন জ্বলতে পারবে।
এভাবে দিন শেষ হয়ে সপ্তাহ গড়িয়ে যায়, সপ্তাহ শেষ হয়ে মাস গড়িয়ে যা, একটি মাস শেষ হয়ে পরের মাস শুরু হতে থাকে।
তাদের হাতে খুব সময় নেই। বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়টি তারা বেছে নিতে চায়—সেই সময়টি প্রায় চলে এসেছে।
১৪
রুকাস আর কিটি মিলে সারাদিন জ্বালানির পাত্রগুলো জিটুৎসি-৩২-এর মস্তিষ্কের উপরে ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন এই জ্বালানি পাত্রের যেকোনো একটিতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারলে পুরো এলাকাটিতে আগুন ধরে যাবে। যেটুকু জ্বালানি আছে তাতে কয়েক ঘণ্টা আগুন জ্বলার কথা।
তবে আগুনটা জ্বালাতে হবে নদীর পানি আসা বন্ধ হয়ে যাবার পর। যখন পানি আর তাপ সরিয়ে নিতে পারবে না তখন যদি আগুন বাড়তি তাপ তৈরি করে তাহলে কিউবের ভেতরে কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। কাজেই আগুনটা নিজে নিজে জ্বলে উঠতে হবে। রুকাস অনেক চিন্তা করে তার জন্য একটা পদ্ধতি বের করেছে— পদ্ধতিটা কয়েকবার চেষ্টা করে নিশ্চিতও হয়ে নিয়েছে।
তার কাছে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের যে শিটটি আছে সেটাকে কনভেক্স লেন্সের আকার করে ঝুলিয়ে দিয়েছে। নিখুঁত ফোকাল দৈর্ঘ্যের লেন্স হয়নি—কিন্তু বিশাল আকৃতির লেন্স হওয়ার কারণে সূর্যের আলো ফোকাস করে সহজেই আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। কাজ চালানোর উপযোগী লেন্সটা এমনভাবে ঝুলিয়েছে যেন সূর্য যখন একটুখানি পশ্চিমে ঢলে পড়ে তখন আগুন ধরে যায়।
রুকাস আর কিটি হিসাব করে পানির স্রোতের বেগ বের করেছে- পাহাড়ের উপর নদীর পানিকে যেখানে তারা আটকে দিয়ে অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, সেখান থেকে নদীর পানি এখানে আসতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় নেয়। কাজেই খুব ভোরবেলা তাদের নদীর পানির স্রোত আটকে দেওয়ার কাজটুকু করে ফেলতে হবে।
রুকাস আর কিটির হাতে সময় নেই। সূর্য একটু ঢলে পড়ার পর তারা রওনা দিয়েছে। সারা রাত হেঁটে ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে হবে।
তারা মোটামুটি অমানুষিক পরিশ্রম করে তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হয়ে গেল। কিন্তু তারা আবিষ্কার করল তাদের আগেই সেখানে একটা বাইভার্বাল শূন্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
রুকাস চাপা গলায় বলল, “হায় ঈশ্বর!”
কিটি কোনো কথা না বলে রুকাসের হাত চেপে ধরল।
১৫
কিটি চাপা গলায় বলল, “আমরা এখন কী করব?”
রুকাস বলল, “আমরা প্রক্রিয়াটা শুরু করে দিয়েছি। এখন পিছানোর কোনো উপায় নেই। এগিয়ে যেতে হবে।”
“কীভাবে?”
“তুমি যে আমার সাথে আছো এটি জিটুৎসির জানার কথা না। জিটুৎসি শুধু আমার কথা জানে। কাজেই আমি এদের ব্যস্ত রাখব, তুমি পিছন দিয়ে আমাদের জায়গায় চলে যাও। পারবে না?”
“কোনো বড়ো অঘটন না হলে পারব। নিশ্চয়ই পারব।”
“চমৎকার। খুব সাবধান।”
“তুমিও সাবধান।”
“তুমি জায়গায় পৌঁছানো মাত্রই দেরি কোরো না-যেভাবে সাজানো আছে তাতে এখন তোমার শুধু লাঠিটা টানতে হবে।”
কিটি বলল, “জানি। টানব। তারপর?”
“যদি পানির প্রবাহ আসলেই পাল্টে যায় তখন দেখা যাবে। রুকাস কিটিকে আলিঙ্গন করে ছেড়ে দিলো। ভোরের আবছা আলোয় রুকাস দেখল কিটি পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রুকাস একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর কাছাকাছি একটা বড়ো পাথরের উপর দাঁড়িয়ে দুই হাত উপরে তুলে বাইভার্বালটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “তোমরা কে? কেন এসেছো?”
বাইভার্বালের ভেতর থেকে একটা গমগমে ভারী গলার যান্ত্রিক শব্দ শোনা গেল, “তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। এক পা নড়বে না। খবরদার।”
“তুমি কে কথা বলছো না জানা পর্যন্ত মানুষ হিসেবে আমি তোমার কথা শুনতে বাধ্য নই।” রুকাস তার কথা প্রমাণ করার জন্য দুই পা সামনে এগিয়ে গেল।
“রুকাস, তুমি খুব ভালো করে জানো পৃথিবীর তথ্য ভান্ডারে তোমার পরিচয় নেই, তুমি নাম-পরিচয়-অস্তিত্বহীন একটা চরিত্র। তোমার মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে কোনো অধিকার নেই। তোমাকে যেকোনো সময় ভস্মীভূত করা হলেও পৃথিবীর কোনো আইন ভঙ্গ হবে না। এখন তোমার সাথে একটা ব্যাক্টেরিয়ার কোনো পার্থক্য নেই।”
রুকাস তার দুই হাত কোমরে রেখে আরেকটু উঁচু একটা পাথরে উঠে বলল, “আমি জানি। কিন্তু তুমি এখনো যেহেতু আমাকে ব্যাক্টেরিয়ার মতো ভস্মীভূত করোনি, আমি অনুমান করছি তুমি আসলে আমাকে ভস্মীভূত করতে আসোনি। আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছো। আমাকে সম্ভবত ডিজিটায়িত করে আমার মস্তিষ্কে উঁকি দিতে চাও। জানতে চাও আমি কতটুকু জানি।”
“তুমি কী অনুমান করছো তাতে কিছু যায়-আসে না। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকো। তোমাকে ধরে নেওয়ার জন্য আমি দুটো অনুসন্ধানী রোবট পাঠাচ্ছি।”
রুকাস চোখের কোনা দিয়ে দেখে অনুমান করার চেষ্টা করল কিটি কত দূর পৌঁছেছে, তার আর কতটুকু সময় বাকি। সে যদি সত্যিই ধ্বংস প্রক্রিয়াটি শুরু করে দিতে পারে তাহলে মুহূর্তের মাঝে পুরো এলাকাটি লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। রুকাস ভেবেছিল দুজন একসাথে একটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে সেটি ঘটাবে কিন্তু এই বাইভার্বালটি এসে তাদের সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। এখন যখন এই ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু হবে তারা বেঁচে থাকতে পারবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বাইভার্বালের নিচে একটি গোলাকার দরজা খুলে যায় এবং সেখান থেকে একটি ধাতব সিঁড়ি বের হয়ে আসে। রোবট দুটি নিশ্চয়ই এই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবে। রুকাস দ্রুত চিন্তা করতে থাকে ঠিক কী করে আরেকটু সময় এই বাইভার্বালটিকে ব্যস্ত রাখা যায়, যেন এটি কোনোভাবেই কিটিকে দেখতে না পায়। তার মুখের ভঙ্গি দেখেই নিশ্চয়ই এটি সবকিছু বুঝে ফেলতে পারছে, তাই তাকে বেশি সময় দেওয়া যাবে না।
রুকাস হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “ঠিক আছে, তোমার অনুসন্ধানী রোবট পাঠানোর প্রয়োজন নেই। তুমি একটু কাছে আসো, আমি নিজেই এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছি।”
বাইভার্বাল থেকে একটি গমগমে শব্দ বের হয়ে আসে, “আমি তোমার একটি কথাও বিশ্বাস করি না রুকাস। তোমার অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে।”
“অবশ্যই আমার অন্য পরিকল্পনা আছে। আমি জিটুসিকে ধ্বংস করতে চাই। যে পরিব্যাপ্ত সিস্টেম মনে করে মানুষকে ডিজিটায়িত করে সংরক্ষণ করা বুদ্ধিমানের কাজ, তাদের এই পৃথিবীতে কোনো স্থান নেই।”
“মানুষ একটি জৈবিক প্রাণী। এই পৃথিবীতে আরো দশ মিলিয়ন জীব আছে, তাদের কোনোটি কি এই পৃথিবীর জন্য কোনো অবদান রাখতে পেরেছে? মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী কি পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প- সাহিত্য-দর্শন কিংবা প্রযুক্তিতে বিন্দুমাত্র অবদান রেখেছে?”
রুকাস একটু উৎসাহিত অনুভব করে। ঠিক কী কারণ কে জানে, জিটুৎসি তার সাথে একটি দার্শনিক আলাপ শুরু করেছে, যদি এই আলাপটি আরো কিছুক্ষণ চালানো যায়, তাহলেই কিটি পাহাড়ের উপরে ওঠার সময় পেয়ে যাবে। রুকাস বলল, “তোমার প্রশ্নটির উত্তরে অনেক কিছু বলা সম্ভব। স্বীকার করছি অন্য সকল জীব থেকে মানুষ সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান কিন্তু সকল জীব নিয়ে পৃথিবীর ইকোসিস্টেম। এখানে সকল জীবের অবদান আছে।”
“এটি হচ্ছে প্রাচীন চিন্তাধারা। পৃথিবীর পরিবেশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মানুষের মতো স্পর্শকাতর দুর্বল জীব তাদের অচিন্তনীয় বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যেকোনো মুহূর্তে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আমি তাই চেষ্টা করছি মানুষের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে সম্পদ, তাদের বুদ্ধিমত্তা, সেটাকে সংরক্ষণ করতে। তাদের মস্তিষ্ককে ডিজিটায়িত করে রেখে দিতে চাই, যেন তারা সেটাকে ব্যবহার করতে পারে। আমি চাই তুমি এই ব্যাপারটি যেন বুঝতে পারো।”
রুকাস এবারে একটু অবাক হলো, জিটুৎসি তার সাথে এভাবে কেন কথা বলছে? সে সাবধানে জিগ্যেস করল, “তুমি একটু আগে আমাকে ব্যাক্টেরিয়ার সাথে তুলনা করেছো, এখন হঠাৎ করে তুমি কেন এত গুরুত্ব দিয়ে আমার সাথে কথা বলছো? কেন এখন তুমি আমাকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করছো?”
“কারণ আমি তোমার মস্তিষ্কে উঁকি দিতে পারছি না, তাই তুমি ঠিক কী চিন্তা করছো বুঝতে পারছি না, কিন্তু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি তোমার ভেতরে একধরনের আত্মবিশ্বাস রয়েছে যেটি খুব অস্বাভাবিক। তুমি যখন জিটুসিকে ধ্বংস করার কথা বলছো তখন সেটি মুখের কথা নয়, তুমি আসলেই সেটি বিশ্বাস করো। এটি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার, কিন্তু তুমি সত্যিই সেটি করার পর্যায়ে গিয়েছো। সে জন্য আমি তোমার সাথে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলছি, আমি তোমাকে বুঝাতে চাই যেন তুমি এই কাজটি করার চেষ্টা না করো।”
রুকাস একটুখানি অবাক এবং অনেকখানি আতঙ্কিত হয়ে বলল, “তুমি কেন মনে করছো আমি এত বড়ো একটি কাজ করতে পারব?”
“কারণ এখন আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি কী করেছো। নদীর এই সরু অংশে তুমি গাছের গুঁড়ি ফেলে একটা বেষ্টনী তৈরি করেছো। উপরে একটা বিশাল পাথর, সেটাকে গড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছো। সেটাকে গড়িয়ে দেওয়ার জন্য আরো উপরে পাথর রেখেছো, যেন গড়িয়ে পড়ার জন্য তার ভেতরে নিচের পাথরকে সরানোর জন্য যথেষ্ট গতিশক্তি সঞ্চয় করে। নদীর পানি আটকে যাওয়ার পর সেটা যেন উপচে উঠে তার গতিপথ পরিবর্তন করে ডান দিকে যেতে শুরু করে সেই ব্যবস্থাও করে রেখেছো। রুকাস, তুমি একটি ব্যাক্টেরিয়ার মতো তুচ্ছ হতে পারো কিন্তু তুমি অতিমারী সৃষ্টি করে মানবজাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতো ভয়ংকর।”
রুকাস হকচকিত হয়ে বলল, “তুমি—তুমি তাহলে এটা থামানোর চেষ্টা করছো না কেন?”
“কারণ, এটি আর থামানোর আর কোনো উপায় নেই। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার বান্ধবী পাহাড়ের উপর একটা লিভার টেনে ধরেছে। দেখতে পাচ্ছি ছোটো ছোটো কয়েকটা পাথর গড়িয়ে আসতে শুরু করেছে, দেখতে পাচ্ছি কিছুক্ষণের মাঝে সেগুলো গতিশক্তি সঞ্চয় করতে থাকবে। এটি বিশাল একটি পাথর আর মাটির তল শুরু করেছে রুকাস। তুমি জানো না তুমি মানবজাতির কত বড়ো একটা ক্ষতি করেছো।”
রুকাস উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ছোটো- বড়ো পাথর নেমে আসতে শুরু করেছে। প্রথমে মৃদু একটা শব্দ, ধীরে ধীরে সেই শব্দটি বাড়তে শুরু করেছে, একটু পরেই সেটি প্রলয়ঙ্করী মহাসমুদ্রের মতো গর্জন করতে থাকে।
রুকাস দেখতে পেল পাথরের আঘাতে বিশাল বড়ো পাথরটি গড়িয়ে আসতে শুরু করেছে, দেখতে দেখতে সেটি প্রচণ্ড বেগে গড়িয়ে আসে। বিশাল অতিকায় সেই পাথর সবকিছু গুঁড়িয়ে নদীর দুই কূল উপচে পানিতে এসে পড়ে, পানির প্রচণ্ড ঝাপটায় পুরো পাহাড় কেঁপে ওঠে। পানি আন্দোলিত হতে তাকে, ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে। ঢেউয়ের ধাক্কায় পাহাড়ের পাথর খুলে আসতে থাকে। প্রচণ্ড শব্দে সেগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে উঠে ডান পাশের কূল ভেঙে গড়িয়ে যেতে শুরু করে। তার প্রচণ্ড স্রোতে পাহাড় থেকে বড়ো বড়ো চাঙর খুলে আসতে থাকে।
দেখে রুকাসের মনে হয় তারা বুঝি নরকের দরজা খুলে দিয়েছে। বাইভার্বালটি একটু পিছনে সরে যায় কিন্তু তার আগেই পাহাড় বেয়ে নেমে আসা একটা পাথরের ধাক্কা খেয়ে সেটি কাৎ হয়ে নিচে আছড়ে পড়ে। মুহূর্তে সেটি আগুনের শিখায় ঢেকে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। একটা আগুনের গোলা উপরে উঠে যায়। ধোঁয়ায় চারিদিক ঢেকে যায়।
রুকাস পাথরের দেওয়াল হাত দিয়ে ধরে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। পানির ঝাপটায় তার শরীর ভিজে যায়—সে উপরের দিকে তাকিয়ে কিটিকে দেখার চেষ্টা করে, কিটি এখনো কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আছে—পাথরের ঢল কমেছে, কিন্তু পানির ঢল দ্বিগুণ বেগে কূল ভেঙে গড়িয়ে যাচ্ছে। কূলের বড়ো একটা বেষ্টনী ভেঙে হঠাৎ পানি দ্বিগুণ বেগে প্রবাহিত হতে শুরু করে, পুবের পাহাড়টি কেঁপে ওঠে। রুকাস আতঙ্কিত হয়ে দেখে কিটি উপর থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ছে—বিশাল পানির আলোড়নে কিটি মুহূর্তের মাঝে হারিয়ে যায়।
কোনো কিছু চিন্তা না করে রুকাস চিৎকার করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
.
রুকাস কিংবা কিটির কেউই দেখতে পেল না, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার কারণে উত্তপ্ত কিউবকে ঘিরে বহমান পানি হঠাৎ করে কমতে শুরু করে একসময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কিউবটি উত্তপ্ত হতে থাকে এবং ঠিক তখন হঠাৎ করে কিউবের উপর আগুন জ্বলে ওঠে। দেখতে দেখতে পুরো কিউবটির উপর আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দাউদাউ করে সেই আগুন জ্বলতে থাকে। প্রচণ্ড উত্তাপে আশেপাশের গাছ শুকিয়ে নেতিয়ে
যায়—বনের পশুরা প্রাণভয়ে পালাতে থাকে।
কালো কিউবের উন্মুক্ত ফিনগুলো প্রচণ্ড উত্তাপে দুমড়েমুচড়ে যেতে থাকে, কোলো বিষাক্ত ধোঁয়ায় আকাশ অন্ধকার হয়ে যায় এবং হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে পুরো কিউবটি বিস্ফোরিত হয়ে যায়। বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়।
.
শেষ কথা
একটা ছোটো আগুন ঘিরে বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণী বসে আছে। একজন একটা সরু কাঠিতে কয়েকটা পুরুষ্টু গুবরে পোকা গেঁথে সেটা আগুনে সেঁকতে সেঁকতে বলল, “আমি কিন্তু জিটুৎসির যুক্তিটি একেবারে ফেলে দিতে পারি না। মানব প্রজাতিকে যদি রক্ষা করতে না পারি অন্তত তাদের বুদ্ধিমত্তাকে ডিজিটালি রক্ষা করি।”
তার গায়ে হেলান দিয়ে থাকা মেয়েটি ঝট করে সোজা হয়ে বসে বলল, “এর ভেতরে কোথায় তুমি যুক্তি খুঁজে পেয়েছো? মানব প্রজাতি তাদের কীভাবে রক্ষা করবে সেই সিদ্ধান্ত নেবে মানব প্রজাতি, কিছু গ্যালিয়াম আর্সেনাইডের টুকরো কখনো সেই সিদ্ধান্ত নেবে না।”
আরেকজন মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছো। কিছু যন্ত্র মানুষের অনুভূতির বৈচিত্র্য কিংবা তীব্রতা কীভাবে অনুমান করবে?”
“কিংবা প্রকৃতি। নৈসর্গিক সৌন্দর্য।”
যে কাঠিতে গেঁথে গুবরে পোকা সেঁকছিল সে বলল, “আমার পোকাগুলো সেঁকা হয়েছে, কে কে খেতে চাও?”
আগুনে হাত সেঁকতে সেঁকতে একজন তরুণী বলল, “তোমার এই মহা সুস্বাদু খাবার খাওয়ার জন্য কেউ মারা যাচ্ছে না। তুমি নিজেই সবগুলো খেতে পারো।”
যে তরুণটি গুবরে পোকা সেঁকছিল সে বলল, “তোমরা জানো আজ থেকে তিরিশ বছর আগে মহামান্য রুকাস যখন এই পর্বতে একা একা থাকতেন, যখন তিনি জিটুৎসি কিউব উড়িয়ে দিয়ে মানব প্রজন্মকে রক্ষা করেছিলেন তখন তিনি প্রোটিনের অভাব মেটানোর জন্য এই গুবরে পোকা খেতেন?”
আগুনের পাশে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একজন মহিলা থেমে গেল। ছোটো দলটির দিকে তাকিয়ে বলল, “রুকাস কী খেয়ে বেঁচে ছিল তোমরা সেটি রুকাসের নিজের মুখ থেকে শুনে আসো না কেন?”
তরুণ-তরুণীগুলো চমকে উঠে বলল, “রুকাস? মহামান্য রুকাস এখানে এসেছেন? তিনি নিজে?”
“হ্যাঁ।”
তরুণ-তরুণীগুলো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। চোখ বড়ো বড়ো করে জিগ্যেস করল, “কোথায়? কোথায় তিনি?”
“ওই যে পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে ভুসভুসে একটা জ্যাকেট পরে, মাথার চুল সাদা হতে শুরু করেছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, সে হচ্ছে রুকাস।”
তরুণ-তরুণীগুলো সেদিকে ছুটে যেতে শুরু করে থেমে গেল। একজন জিগ্যেস করল, “আপনি কেমন করে রুকাসকে চেনেন? আপনি কে?
“আমি তিরিশ বছর থেকে রুকাসের সাথে আছি।”
“আপনার নাম?”
“কিটি। আমার নাম কিটি।”
***