জালিয়াত
‘ফোন করে বলেছে ফিরতে দেরি হতে পারে? কখন ফোন করেছে?’
এই সামান্য প্রশ্নটা শক্তিনাথ কেন বাঘের মতো গর্জে উঠে করলেন, তা শক্তিনাথই জানেন। অথবা সান্ত্বনাও জানেন, কিন্তু সান্ত্বনা সেই জানাটা জানতে দিলেন না, সান্ত্বনা যেন খেয়ালই করেননি শক্তিনাথ গর্জে উঠেছেন, এমনি ভাবে সহজ আলগা গলায় বললেন, ‘এই তো একটু আগে’।
সান্ত্বনার ঠিক এই সময়টাই যেন ফ্রীজ থেকে ঠাণ্ডা জলের বোতলটা বার করবার খুব দরকার পড়েছে, তাই মুখ না ফিরিয়েই সেটা নিয়ে টানাটানি করতে থাকেন। শক্তিনাথের গর্জনটা অতএব আর এক ধাপ ওপরে উঠলো, ‘একটু আগে মানে? আমি কোথায় ছিলাম? কটার সময় করলো?’
আর ঠাণ্ডা জলের বোতল নিয়ে নাড়ানাড়ি চলে না, সান্ত্বনাকে এবার মুখ ফেরাতে হয়, গলার স্বরও ফেরাতে হয়।
সেই ফেরানো গলায় বলেন, ‘ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টা মিনিট সেকেন্ড লিখে রাখতে হবে, এটা জানা থাকলে লিখে রাখতাম।’
হ্যাঁ, এক এক সময় এই রকম সুর বদল করতে হয় বৈ কি, গর্জনকে বাড়তে দিলে আপন প্রেসটিজটা থাকে কোথায়?
শক্তিনাথ গুম হয়ে যান, বলেন, ‘পাশের ঘরেই বসে রয়েছি। ফোন এলো জানতে পারলাম না, একটু আশ্চর্য লাগছে বৈ কি!’
‘বই পড়ছিলে, অন্যমনস্ক থাকতে পারো, বাথরুমে যেতে পারো, জানতে না পারাটাও আশ্চর্য নয়।….খেতে দিতে বলি তা হলে?’
‘ওঃ খেতে দিতে। খেয়ে নিতে হবে?’ শক্তিনাথ বলেন, ‘রাত বারোটা বাজবে, এই কথা বলেছে বুঝি?’
সান্ত্বনার ইচ্ছে হয় বসে পড়েন।
ইচ্ছে হয় আর একটিও কথা না বলেন, ‘আর পারছেন না মিথ্যার জাল বুনে বুনে ঘর সামলাতে। কতদিন থেকে চলেছে এই জাল বোনা? ছেলে-মেয়েরা বড়ো হয়ে ওঠা পর্যন্তই। সত্যি কথা আর কটা বলতে পান? ছেলে-মেয়েদের মন আর মন রাখতে এবং শক্তিনাথের মেজাজের ‘পারা’ ‘নর্ম্যালে’ রাখতে, অহরহই মিথ্যার চাষ করে চলেছেন।
বড়ো মেয়ে যখন বড়ো হয়ে উঠলো, সান্ত্বনার কী যন্ত্রণাতেই দিন গেছে।
শক্তিনাথের হুকুম, মেয়ে তার কলেজের বাইরে একটি মিনিটও সময় বাড়ির বাইরে থাকবে না, অথচ মেয়ে সে হুকুমের প্রতিবাদে মুখর। সে কলেজ-ফেরত বান্ধবীদের বাড়িতে চলে যাবেই যে-কোনো দিন, না বলা না কওয়া। ফিরবে সন্ধ্যা করে। আর এমনই আশ্চর্য, ঠিক সেই দিনই যেন হাত গুনে গুনে শক্তিনাথ অফিস থেকে ফিরে আসবেন সাত তাড়াতাড়ি। এসেই সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলবেন, ‘বুলিকে দেখছি না যে?’
অতএব মিথ্যার জাল বুনতেই হতো সান্ত্বনাকে, ‘বলে গেছে ক্লাসের কোন মেয়ের বাড়িতে যাবে, একসঙ্গে খানিকটা পড়তে, সামনে একজামিন আসছে তো।’
সত্যের জন্যে বেড়া বাঁধতে হয় না, খোলা দরজা হাট করে ফেলে রেখে দেওয়া চলে, মিথ্যার জন্যে অনেক আটঘাট, অনেক বেড়া বাঁধতে হয়। তাই সামনের একজামিনটা মনে পড়িয়ে দিতে হয়।
অবশ্য শক্তিনাথকে সন্তুষ্ট করা অতো সহজ নয়, শক্তিনাথ ব্যঙ্গের গলায় বলতেন, ‘বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে পড়া করতে হবে? কেন? নিজের বাড়িতে পড়বার জায়গা নেই?’
‘থাকবে না কেন’, সান্ত্বনার অম্লানকণ্ঠ, ‘দুজনে মিলে নাকি পড়া ভালো হয় বলে’—
‘দু’জনে মিলে পড়া ভালো হয়? একলা হয় না?’ শক্তিনাথ আরো ব্যঙ্গের গলায় প্রশ্ন করতেন, ‘আমরা কখনো একজামিনের পড়া করি নি, কেমন?’
তখনো শক্তিনাথের কণ্ঠে গর্জন দেখা দেয় নি, কটুতিক্ত কথায় ব্যঙ্গই দেখা যেতো! সান্ত্বনাও অতএব কিছুটা কৌতুকের গলায় উত্তর দিতে পারতেন, ‘সে তুমি তখন কী করেছো, তুমিই জানো। আমি তো আর একজামিন দিই নি যে, মেয়ের সঙ্গে তর্কে নামবো?’
‘তর্কে নামবার কথা উঠছে কেন?’ শক্তিনাথ বলতেন, ‘নিষেধ করে দেবে। বলবে এ সব আদিখ্যেতার দরকার নেই।’
সান্ত্বনা যদি তাঁর সন্তানের ‘মান বজায়’ রাখার চিন্তায় ব্যস্ত না হতেন, অনায়াসেই বলতে পারতেন, ‘নিষেধটা তুমিই করে দিও না, আসবে এখুনি।’
কিন্তু সান্ত্বনার ভয় হতো হয়তো তাতে তাঁর বড়ো হয়ে যাওয়া মেয়েটির মান বজায় থাকা শক্ত হবে। শক্তিনাথ হয়তো ভুলে যাবেন, বুলবুল এখন আর ফ্রক পরে না, বুলবুল এখন আর স্কুলের ছাত্রী নয়।
সান্ত্বনা ভুলে যান না।
বুলবুল নিজে যদি ভুলে থাকতো তার সেই সদ্যলব্ধ মর্যাদার অহঙ্কার, তাহলে কতো সহজই হয়ে যেতো সান্ত্বনার জীবন। সান্ত্বনা ভেবে অবাক হতেন ওইটুকু অহঙ্কার ছাড়লেই বা কী এসে যায় ওর? বাপের কাছেই তো?
কিন্তু তা তো হয় না। অন্তত হতো না। বুলবুল তো তার সেই বাপের মেয়ে? তাই বুলবুল আসার অগে কাঁটা হয়ে থাকতেন সান্ত্বনা। সিঁড়িতে তার পদধ্বনির জন্যে কান পেতে থাকতেন, ঠিক সেই মুহূর্তে যাতে কোনো একটা ছুতোয় নিজে তরতরিয়ে নেমে যেতে পারেন, নিচে থেকেই মেয়েকে অবহিত করিয়ে দিতে পারেন, ‘বাবা ফিরেছে, তোর দেরি দেখে চটিতং নির্ঘাৎ কষে ধমক মারবে একখানা, বুঝে-সুঝে উত্তর দিস বাবা!’
হ্যাঁ, এই ধরনের হালকা ভাষাই ব্যবহার করতে হতো সান্ত্বনাকে। জানতেন মেয়েকে যদি বলে বসেন, ‘তোর দেরি দেখে তোর বাবা ভীষণ রেগে আছে, সাবধানে কথা কস।’ তাহলে মেয়ে তদ্দণ্ডেই প্রতিজ্ঞা করে বসবে, ‘অসাবধানই হবো।’
কারণ ‘বাবা রেগে গেছে তার গতিবিধির অনিয়মে—’ এই খবরটুকুই তো তার মাথা জ্বলে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট।
আড়ালে কোনো কোনো দিন মেয়েকে বলে দেখেছেন, ‘কলেজ ফেরত এখান ওখান যাওয়া, ছুটির দুপুরে সিনেমা টিনেমা দেখতে বেরিয়ে যাওয়া, এসব যখন তোর বাবা দেখতে পারেন না, রেগে মেগে যায়, তখন করিস কেন বাপু?’
মেয়ে বরফ ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিয়েছে, ‘বাবা যা চাইবে, পৃথিবীতে ঠিক সেটাই ঘটবে, এমন ভাবাটাই ভুল মা।’
‘পৃথিবীর কথা হচ্ছে না, ওর নিজের সংসারে ওর ইচ্ছে অনিচ্ছের মূল্য থাকবে, এটা তো ও আশা করতে পারে?’
‘বাবার সংসারটাও পৃথিবী ছাড়া নয় মা, আর বাবার ছেলে-মেয়েরাও পৃথিবীরই মানুষ।’
‘চটাচটি করে তো কেবল অশান্তির সৃষ্টি করা বাপু?’
উনিশ বছরের বুলবুল ফট করে বলে বসেছে, ‘সে কথাটা বাবাকে বোঝালে আরও ভালো হয়।’
সান্ত্বনা আহত হয়েছেন। অপমান বোধও করেছেন হয়তো। তবু ওই মেয়েটাকে সরাসরি তার বাপের মুখোমুখি নিক্ষেপ করতে পেরে ওঠেন নি।
কেন পারেন নি?
সন্তান সম্পর্কে এতোই অন্ধ স্নেহ সান্ত্বনার? নিজেই অনেক ভেবেছেন সান্ত্বনা। বিশ্লেষণ করে করে দেখেছেন নিজেকে, কই তেমন স্নেহান্ধ তো মনে হয় নি নিজেকে। শক্তিনাথের মতো অতো ত্রুদ্ধ হয়ে না উঠলেও মেয়ের আচার-আচরণে বিরক্তিবোধ করেন যথেষ্টই। মেয়ের এই অধিকার বোধকে মোটেই সমর্থনের চোখে দেখেন না, তবু সংঘর্ষেও নামতে চান না। চান না সংসারের শান্তিকে বিঘ্নিত করতে। তাই অহরহ ম্যানেজ করে ফেলতে চেষ্টা করেন।
তার মানে সান্ত্বনা সংসার চান, চান তার শান্তি শৃঙ্খলা সভ্যতা।
শক্তিনাথও যদি সেটুকু চাইতেন?
যদি চাইতেন, তাহলে হয়তো সান্ত্বনাকে নিজের সঙ্গে এতো লড়াই করতে হতো না, আর এতো মিথ্যার জাল বুনে চলতে হতো না। ক্রমশই যে মাকড়সার মতো নিজের জালে নিজে আটকা পড়ে যাচ্ছেন সান্ত্বনা।
বুলবুলকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত চরমেই উঠেছিল।
তবু সান্ত্বনা কতো চেষ্টাই করেছিলেন।
শক্তিনাথ বলতেন, ‘সিনেমা দেখতে—বন্ধুর সঙ্গে যেতে হবে কেন? তোমার সঙ্গে ও তো যেতে ছাড়েন না, তাতে মন ওঠে না?’
সান্ত্বনা আটঘাট বাঁধতে বসতেন, ‘আহা আমার সঙ্গে তো শুধুই বাংলা ছবি, ইংরিজি মিংরিজি দেখতে ভালোবাসে—’
‘ওঃ ভারী একেবারে ইংরিজি নবীশ মেয়ে হয়েছেন! সিনেমার ইংরিজি বুঝতে ওর বাবারও সময় লাগে বুঝলে? অতো সোজা নয়। ওসব ছুতো।’
তখন—
হ্যাঁ তখন, সেই সব মুহূর্তে সান্ত্বনাকে সুর ফেরাতে হতো। সান্ত্বনাকে ডাঁট দেখাতে হতো।
‘তার মানে? তুমি বলতে চাও কি? ছুতোটা কিসের জন্যে?’
‘কিসের জন্যে সেটা আর দু’দিন গেলেই বুঝবে।’ শক্তিনাথ বলে উঠতেন, ”মেয়ে যখন এসে বলবেন, ‘মা আমি লভে পড়েছি,’ তখন জলের মতো বুঝবে?”
সান্ত্বনার বুকটা কেঁপে উঠতো।
সান্ত্বনা তবু মনে মনে অদ্ভুত একটু হাসি হাসতেন।
বুঝবার জন্যে আরও ‘দুদিন’ অপেক্ষা করতে হবে তাঁকে? অনেকদিন আগেই তো অনেক কিছু বোঝা হয়ে গেছে তাঁর। তবু—একেবারে উদঘাটিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে শক্তিনাথের কাছেও যেমন অবুঝ সেজেছেন, মেয়ের কাছেও তেমন অবুঝ সেজেছেন।
একটি ছেলে-গলা যখন ফোনের ওধার থেকে স্বচ্ছন্দ গলায় বলেছে, ‘বুলবুল আছে? একটু দিন তো—’
সান্ত্বনা তখন আরো স্বচ্ছন্দ গলায় ডাক দিয়েছেন, ‘ওরে বুলবুল, তোর ফোন।’
শক্তিনাথ অবশ্য সব সময় বাড়িতে থাকতেন না, অফিস তো ন’টা থেকে সাতটা মানে যাতায়াত সমেত। তবু তো অফিস থেকে গাড়ি পান, যেতে আসতে। সেই সময়ের এধার ওধার ফোন এলেই মাথা ঘুরে যেতো সান্ত্বনার। যদিও সেটা বেশি হতো না, তবু সান্ত্বনার মনে হতো, এরা এতোই বা বোকা কেন রে বাবা! এটুকু বুঝে সুঝে চলতে পারে না?
সান্ত্বনা জীবনভোর কেবল বুঝে সুঝেই চলে এলেন বলেই বোধকরি ওঁর এই বুঝে সুঝে চলাটাই সব থেকে স্বাভাবিক মনে হতো, কিন্তু কে চায় সেই স্বাভাবিকটা হতে? কে ধার ধারে কে কি ভাবলো ভাবতে? তাছাড়া ‘জরুরি’ বলেও তো ব্যাপার থাকতে পারে ওদের?
বুলবুল পর্বের সময় শক্তিনাথ বাড়িতে থাকাকালীন ‘টাইমে’ সান্ত্বনাকে প্রায় টেলিফোনের কাছেই বাসা বাঁধতে হতো, যাতে জিনিসটা শক্তিনাথের হাতে গিয়ে না পড়ে। মিলি আর সীতুও তো তখন নাবালকের দলে, ফোনটা এসে ধরলে হয়তো চিৎকার করে ডাকতো, ‘দিদি একটা ছেলে তোকে ফোনে ডাকছে।’
অতএব সান্ত্বনাকে পাহারা দিতে হতো, সান্ত্বনা তেমন অবস্থায় পড়লে রিসিভারের মুখে হাত চেপে গলা তুলে ডাক দিতেন, ‘বুলু দেখ তোকে বোধ হয় নিভা ডাকছে। তাই তো মনে হলো—’
এটা মেয়ের প্রতি ইশারা, যাতে মেয়ে বাপের কান বাঁচিয়ে প্রেমালাপ করে, যাতে পাশের লোক বুঝতে না পারে বন্ধু কি বান্ধবী। অথচ আবার মেয়েকেও জানতে দেওয়া চলে না, আমি তোমার লুকোচুরির উপদেষ্টা। তাই লাইনের শেষে যোগ করতে হয় —’তাই তো মনে হলো—’
এই করে চলেছেন।
এইভাবে চালিয়েছেন।
তবু শেষরক্ষা হলো না, একদিন ঝড় উঠলো বাড়িতে, শক্তিনাথ নিজের চক্ষে দেখে এসেছেন বুলবুল একটা ছোঁড়ার সঙ্গে হাসতে হাসতে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেল।
শক্তিনাথ অফিসের গাড়িতে, সঙ্গে আরও দুজন সহকর্মী, অফিসের চেনা ড্রাইভার। কাজেই শক্তিনাথের তখন হাত পা বাঁধা, শক্তিনাথ বাড়ি ফিরে রসাতল করতে লাগলেন।
সান্ত্বনা একবার ক্ষীণকণ্ঠে বলতে চেয়েছিলেন, ‘তুমি হয়তো কাকে দেখতে কাকে দেখেছো, বুলুর তো কলেজ ছুটিই হয় সাড়ে চারটেয়। ও কি করে ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখবে? তাও অফিস পাড়ায় গিয়ে?’
কিন্তু এ যুক্তি কি ধোপে টেকে?
সান্ত্বনা কি এইমাত্র পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হলেন? ‘কলেজ-পালানো’ বলে কোনো শব্দ শোনে নি কখনো?
বেশ, তা যদি না শুনে থাকেন তো বলুন সাড়ে চারটের পর সাতটা বাজতে যে সময়টা লাগে, মেয়ে ততক্ষণ কী করছে তবে? প্রমাণ করুন দেখাটা শক্তিনাথের চোখের ভ্রম?
সেদিন আর সান্ত্বনার মেয়ের জন্যে নিচে নেমে থাকা হলো না, নেমে দাঁড়িয়ে থাকলেন শক্তিনাথ নিজে। এবং চাক্ষুষ দেখলেন দুয়ার থেকে অদূরে একটা গাড়ি থেকে বুলবুল নামলো। আর অপর আরোহী সেই ছোকরা তাকে ‘টা টা’ করে গাড়ি করে বেরিয়ে গেল নিজে চালিয়ে।
তার মানে সান্ত্বনার বুদ্ধিমতী মেয়ে বেশ একটি তালেবর বরই যোগাড় করে ফেলেছেন।
এর জন্যে মেয়ের মা-বাপের মেয়ের কাছে কৃতজ্ঞ হওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু সান্ত্বনার বুদ্ধিহীন স্বামী তার বদলে অতো বড়ো মেয়ের গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বসলো।
তারপর যা হওয়া উচিত, যা হওয়া সম্ভব তাই হল, মেয়ে বাপের মুখের ওপর বললো, ‘ওকে আমি বিয়ে করবো।’ এবং পরদিন বাপের নাকের সামনে টেলিফোন তুলে বললো, ‘এখুনি এসে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।’
অর্থাৎ বাপ মেয়েকে যে ওজনের চড়টা মেরেছিলেন, মেয়ে তার চতুর্গুণ ওজনের চড় বাপকে ফিরিয়ে দিলো।
কিন্তু সান্ত্বনা কি তখন হার মেনে তাঁর জাল বোনার কাঠি দুটো হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলতে পারতেন, ‘ওরে পাজি মেয়ে, আমি কি এতোদিন বুঝি নি ভেবেছিস তুই যে তলে তলে উড়ছিস, সে কথা আমি তোর ওড়ার প্রথম দিন থেকেই বুঝেছি, শুধু এইটা বুঝি নি এতোটা দুঃসাহস তোর হবে! আমাকে পর্যন্ত না জানিয়ে তুই এতো দূর এগোবি! আমি তোর বাপের মতো গোঁয়ার আড়বুঝো নই, আমার কাছে ব্যক্ত করলে, তোর সাপও মরতো, লাঠিও ভাঙতো না।’
বলতে পারলেন না, বললে বাকি জীবনটা তো ওই জাল বোনা বন্ধ করতে হতো। ধরা পড়ে যেতেন শক্তিনাথের কাছে। তাই সান্ত্বনাকে আকাশ থেকে পড়তে হলো। সান্ত্বনাকে ‘মেয়ের মুখ দেখা’ বন্ধ করতে হলো।
সান্ত্বনাকে বলতে হল, ‘কী করে বুঝবো? কেমন করে ভাববো ও আমার সঙ্গে এতো চাল চালছে। আমি ভাবি সবই মেয়ে বন্ধু। এমন তো হরদমই দেখি গোটা কতক কমবয়সী মেয়ে দল বেঁধে সিনেমা যাচ্ছে, শাড়ি জামার দোকানে যাচ্ছে, চা খেতে দোকানে ঢুকছে, (এখানেও বেঁধে নিলেন একটু বেড়া, করে নিলেন একটু রিপুকর্ম!’ ‘হরদম দেখেন’ বলেই না সান্ত্বনার সরল মনে সন্দেহ ঢোকে নি, কাজেই সান্ত্বনা ওসবের মধ্যে কোনো দোষ দেখতে পান নি!) কেমন করে জানবো বুলুর বেলাতেই মেয়ে বন্ধু নয়, ছেলে বন্ধু।’
পিতৃগৃহে ঢোকবার অধিকার বুলবুল আজও পায় নি, আজও শক্তিনাথ বড়ো মেয়ের মুখ আর দেখেন নি। মেয়েও অবশ্য নত হয়ে এসে তেমন চেষ্টা করে নি, তবে মাসির বাড়ির ঠিকানায় মাকে মাঝে মাঝে চিঠি দেয়। এবং আগে থেকে যোগাযোগ করে সেই মাসির বাড়িতেই মাতা-কন্যার মিলন হয়।
মেয়ের পুজোর আর জন্মদিনের শাড়িও ওই পথেই মেয়ের হাতে পৌঁছয়। মিনি জানে, সীতুও জানতো, এখন আর জানে না সীতু। ভুলে গেছে ইহজগতে ‘দিদি’ নামের যে কোনো একটা প্রাণী ছিল, অথবা সীতুর কর্মজীবনের সঙ্গীরা ব্যতীত আর কেউ আছে এই জগতে, সে কথা মনে নেই সীতুর।
মিলি মাঝে মাঝে মা-র সঙ্গে যায়, তবে প্রকাশ করে না। কিন্তু শক্তিনাথ আজও অন্ধকারে। শক্তিনাথ জানেন তদবধি ‘বুলবুল’ নামটাই মুছে গেছে এ সংসার থেকে।
শক্তিনাথ কি তবে সম্পূর্ণ সুখী?
নিজের সংসারে নিজের এই মর্যাদা বজায় থাকায় শক্তিনাথ কি অহঙ্কারে মটমটে হয়ে আছেন?
কই আর?
বুলবুলের ঔদ্ধত্য ভুলতে না ভুলতে সীতানাথ বা সীতু একেবারে উদ্ধতের রাজা হয়ে বসে থাকলো।
সাংসারিক বিধি-নিষেধ নীতি-নিয়ম এ সবের ধার ধারে না সীতু। সীতুর নীতি যা ইচ্ছে করবে, কোনো কৈফিয়তের উত্তর দেবে না। জেরা করতে এলে এমন একটি মোক্ষম বুলি শুনিয়ে দেবে যে, দুবার আর জেরা করতে হবে না।
অতএব সীতু কখন বেরোয়, কখন ফেরে, কখন খায়, কখন না খায়, কিছু ঠিকঠাক নেই। শুধু রাতের খাওয়াটা বাড়িতে খায়, আর রাতের শোওয়াটা বাড়িতে শোয় এইটুকু ভরসা। আর ওইটুকুর জোরেই সান্ত্বনা সারাদিনের সমস্ত ‘বেঠিক’ গুলোকে ‘ঠিকঠাকে’র চেহারা দিয়ে শক্তিনাথের পাতে পরিবেশন করেন।
সীতু যদি না খেয়ে দেয়ে বেলা দশটায় বেরিয়ে গিয়ে রাত দশটা পর্যন্ত না ফেরে, সান্ত্বনা শক্তিনাথকে বলেন, ‘এই তো বিকেল বেলায় বেরোলো, তুমি আসবার একটু আগেই! কলেজ থেকে ফিরে জলটল খেয়ে—’
সীতু আজকাল আদৌ কলেজে যায় কি না সান্ত্বনা জানেন না, তবু এখনো তাঁর ওই জালটুকুর আবরণ দিয়ে ঢেকে রেখেছেন সেই সন্দেহটিকে।
সান্ত্বনা সীতুকেও বুঝতে দেন না সে সন্দেহ। সান্ত্বনা বোধকরি ভাবেন, একবার সন্দেহ প্রকাশ করলেই সীতু বেহেড হয়ে যাবে, সীতু নিরাবরণ হয়ে যাবে।
তাই তিনি সীতুকেও বলেন, ‘কলেজ ফেরত এখান সেখান ঘুরিস কেন? একবার বাড়ি এসে খেয়েটেয়ে তো যেতে পারিস বাবা! আড্ডা বড়ো, না শরীর বড়ো?’
ঠিক ওই মুখটায় সীতু বলে উঠতে পারে না, ‘কলেজ আবার যাচ্ছে কে? কলেজ-ফলেজ যাই নি।’
সীতু গুজ গুজ করে যা বলে, তার অর্থ এ হতে পারে, খিদে পেলে কোথাও না কোথাও খেয়ে নিতে পারে সে, অতো ভাববার দরকার নেই।
সীতু যেদিন বেশি রাত করে, সান্ত্বনা হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘এই রে একেবারে ভুলে মরেছি, সীতু যে বলেছিল, আজ একটু রাত হবে।’
এতোদিন শক্তিনাথের হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল, শক্তিনাথের নখদন্তহীন বৃদ্ধ ব্যাঘ্র বনে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু শক্তিনাথ সেই উচিত কর্মটি করেন নি। শক্তিনাথ যুগের দিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করেন নি, তাই শক্তিনাথ এখনো বাঘের গর্জনে প্রশ্ন করে উঠতে পারেন, ‘খেয়ে নিতে হবে? ফিরতে রাত বারোটা বাজবে, এ কথা বলেছে বুঝি?’
আজ আর হঠাৎ বলে ওঠবার উপায় ছিল না, ‘এইরে ভুলে মরেছি, সীতু যে বলেছিল ফিরতে দেরি হবে—’
আজ শক্তিনাথের শরীর ভালো ছিল না, শক্তিনাথ সারাদিন বাড়িতেই আছেন। আর শক্তিনাথের চোখের সামনেই বেরিয়ে গেছে সীতু সাত সকালে ভাত খেয়ে।
সান্ত্বনা হেঁকে বলেছিলেন, ‘আজ বুঝি তোর সাড়ে দশটায় ক্লাস?’
সীতু কী যেন একটা বলে, অথবা হয়তো কিছুই না বলে তড়বড়িয়ে চলে গিয়েছিল। অতএব আজ রাত্রে ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বুক যখন কেঁপে উঠলো, তখন বলতে হলো, ‘এই মাত্তর ফোন করলো।’
শক্তিনাথ ওবেলা খান নি, এবেলা দুখানা গরম লুচি খাবেন, তাই সান্ত্বনা কাঁপা বুককে শক্ত করে বললেন, ‘খেতে দিতে বলি?’
আর শক্তিনাথের তীব্র প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘ওকে নিয়ে তো পারা যাবেই না দেখছোই, নিজের শরীরটা আর নষ্ট করে কী হবে?’
শক্তিনাথ ত্রুদ্ধ গলায় বলেন, ‘তোমার প্রশ্রয়ে প্রশ্রয়েই এতো বাড় বেড়েছে।’
‘ওকথা নতুন না—’
বলে সান্ত্বনা বামুন ঠাকুরকে নির্দেশ দেন, ‘ঠাকুর, দাদাবাবুর খাবার ঢেকে রেখে আমাদের খেতে দাও। বাবুর লুচিকটা একসঙ্গে ভেজে ফেলো না, একখানা একখানা করে ভেজে দিও। আমাদের হয়ে গেলে তুমিও খেয়ে নিও।’
সান্ত্বনার প্রতি ভগবানের অসীম দয়া যে শক্তিনাথ খেতে বসলেন।
হয়তো সারাদিনের উপবাসের ফলশ্রুতি এটা। হয়তো ঠাকুরকে পর্যন্ত খেয়ে নিয়ে দাদাবাবুর প্রতি অবহেলা দেখানোর কথায় কিঞ্চিত প্রসন্ন হলেন।
মোটকথা খেতে বসলেন তিনি, এবং মিলি আর সান্ত্বনাও।
শক্তিনাথ তাঁর ছোটোমেয়ের পাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মাছটা সব ফেললি যে?’ মেয়ে উত্তর দেবার আগেই সান্ত্বনা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘খুব ঝাল লাগছে বুঝি মাছের ডালনায়? আমারও একটু একটু—’
‘ঝাল আবার কোথায়?’
বললেন শক্তিনাথ, ‘ঝাল-ফাল কিছু হয় নি।’
‘ও যে লঙ্কার ফোড়নটি পর্যন্ত খেতে পারে না—’
মিলি বেঁচেছিল কারণ ‘মাছ’ নামক বস্তুটিকে সে আদৌ গলাধঃকরণ করতে পারে না। শুধু বাবার ভয়ে ভাঙে, ভেঙে ছাড়িয়ে ফেলে দেয়। ঝালের সম্বন্ধে মিলি তবু রেহাই পাচ্ছিলো, সুশৃঙ্খলেই আহার পর্বটা মিটে যেত, কিন্তু গেল না।
শেষরক্ষা হলো না।
শক্তিনাথ তখনও দুধের বাটিতে হাত দেন নি, ঝনঝনিয়ে উঠলো টেলিফোনটা।
বেশি রাতে টেলিফোনের শব্দটা এইরকম জোরই লাগে। যেন এসে ধাক্কা মারলো, যেন কোনো অশুভবার্তা নিয়ে এসেছে।
সান্ত্বনার সর্বশরীরে যেন ওই ঝনঝনানিটা একটা ধাক্কা মারলো, সান্ত্বনার হাত থেকে ভাতের গ্রাসটা পড়ে গেল। সান্ত্বনার মনে পড়লো না ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে টেলিফোনটা তাঁরই ধরা উচিত।
সান্ত্বনার মনে পড়লো না, সেই অবসরে শক্তিনাথ ঝাঁপিয়ে পড়লেন, বাঁ হাতেই রিসিভারটা তুলে নিলেন।
তারপরই শক্তিনাথের মুখ থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বেরোতে লাগলো, মিলির মুখটা হাঁ হয়ে গেল। সান্ত্বনা আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে রইলেন, আর শক্তিনাথের সেই কথাগুলো যেন পরিস্থিতিটার ওপর আছড়ে আছড়ে এসে পড়তে লাগলো….’কে? সুব্রত? কী ব্যাপার? এতো রাত্রে? কোথা থেকে কথা বলছো? বেলেঘাটা থানা থেকে?’
সুব্রত সান্ত্বনারই দিদির ছেলে সান্ত্বনার অধিকার ছিল শক্তিনাথের হাত থেকে ফোনের রিসিভারটা নিয়ে নেওয়া, কিন্তু সান্ত্বনা যেন অব্যক্ত আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে রইলেন শক্তিনাথের দিকে।
আর বোধকরি ওইরকম আচ্ছন্ন ভাবের জন্যেই সান্ত্বনার মনে হতে লাগলো শক্তিনাথের কথার খাঁজে খাঁজে একটা উল্লাসের ঝঙ্কার ঠিকরে উঠছে। ওটা যে শক্তিনাথের উত্তেজিত চিত্তের কম্পন, সেটা বুঝতে পারছেন না সান্ত্বনা। সান্ত্বনা শুনতে পাচ্ছেন উল্লাস ঠিকরোনো গলায় বলে চলেছেন শক্তিনাথ। ‘তুমি বুঝি এখন বেলেঘাটা থানার ইনচার্জ? …….কখন বললে? বেলা তিনটের সময়?…. না না, আমি কিছু করতে চাই না। আমার ছেলে বলে ‘স্পেশাল কেস’ ভাববার দরকার নেই, সবাইয়ের যা ব্যবস্থা হবে, তাই হবে।…. নাঃ রাগ করে নয়, রাগের কি আছে? যা হবার তা তো হবেই। তুমি যে কষ্ট করে খবর দিলে এর জন্য—তোমার মাসীমা? উনি খেতে বসেছেন। ….ওঁকে আর বলার কি আছে? আমিই বলছি কিছু করার দরকার নেই। …..আচ্ছা ছাড়ছি—।’
ছাড়বেনই তো। যে মা রাত এগারোটা পর্যন্ত ছেলে বাড়ি ফিরছে না দেখেও নিশ্চিন্ত চিত্তে খেতে বসতে পারে, তার আর বলবার কি আছে?
সান্ত্বনা তখনও ওঠেন নি, হাত ধোন নি, শক্তিনাথ ফিরে এলেন, ঘুরে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘বলছিলে না—সীতু একটু আগেই ফোন করেছিল? তোমার কি মনে হয়, অন্য কেউ ওর নাম করে—? কারণ ওকে তো বেলা তিনটের সময় পুলিসে এ্যারেস্ট করেছে। সুব্রতর থানাতেই নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। সীতুর গলা বুঝতে পারলে না?’
সান্ত্বনা উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘থাক অত কষ্ট করে জেরা করার দরকার নেই। কেউ ফোন করে নি, আমি মিথ্যে কথা বলেছি। শুধু—আজ নয়, অনেকদিন, জীবন ভোর।’
শক্তিনাথ হঠাৎ হেসে ওঠেন, ‘তুমি বুঝি ভাবছো, আজই তুমি সে খবরটা এতো ঘটা পটা করে জানাচ্ছো? চিরদিনই জানি। তোমার প্রতিটি মিথ্যে কথা আমি ধরতে পারতাম, ধরতে পেরেছি। মাকড়সার মতো মিথ্যে ওই জালটা বুনে বুনে তুমি নিজেই জালিয়াত হয়ে গেছো।’
সান্ত্বনা পাথরের মতো তাকিয়ে থাকেন ওই হিংস্র আর নিষ্ঠুর মুখটার দিকে।
তারপর পাথরের মতো গলাতেই বলেন, ‘ওঃ সব জেনেছো, সব বুঝেছো? তবু এতোটুকু দয়া হয় নি তোমার? তবু কোনোদিন বলে উঠতে পারো নি; সান্ত্বনা, আর কষ্ট কোরো না তুমি, তোমার ওই জাল থেকে বেরিয়ে এসো। তোমার আমার তো একই জ্বালা, এসো দুজনে একসঙ্গে সেই জ্বালা বহন করি।….না, তা তুমি বল নি, শুধু বসে বসে আমার যন্ত্রণা দেখেছো, আর না দেখার ভান করেছো। তার মানে তুমিও একটা জালিয়াত, হ্যাঁ হিংস্র নিষ্ঠুর, পাকা একটা জালিয়াত।’
—