জরা হটকে
জরা হটকে জরা বঁচ্কে ইয়ে হ্যায় নোবেল, মেরি জান্!
অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল জীনা যহাঁ
জরা হটকে জরা বঁচ্কে
ইয়ে হ্যায় নোবেল
মেরি জান!
ওই দ্যাখ্
—”ওই দ্যাখ ওই দ্যাখ নবনীতা দেবসেন! কে, বুঝলি? বুঝলি না? ওই তো, অমর্ত্য সেনের ফার্স্ট ওয়াইফ।” দুটো ছেলেই ফিরে তাকাল। পানওলাও। যিনি কোকাকোলা খাচ্ছিলেন, বোতল নামিয়ে তিনিও। সিগারেট কিনতে লাগল ছেলেগুলো। এই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, চিন্তামণির দোকানে। আমার কিন্তু টিপের পাতাটা আর কেনা হলো না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে সরে পড়ি। কান ঝিমঝিম করছে। পাঞ্জাবির দোকানের সামনে আসতেই—
—এই যে দিদি। নমস্কার।
ভদ্রমহিলাকে চিনতে পারলুম না। বগলে প্যাকেট।
—টিভিতে আপনাকে দেখলাম। ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন। ওই ওনার নোবেল প্রাইজ পাওয়ার খবরে। সত্যি, আমাদেরও প্রচণ্ড গর্বের বিষয়!
—সে তো ঠিকই।
খুবই আনন্দ পেয়েছি, বাঙালির এত বড় সম্মানে।
—হ্যাঁ। সত্যি। তাড়াতাড়ি ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাই—মিষ্টি করে হাসবার চেষ্টা করি। কিন্তু রাস্তাটা রাসবিহারী, জায়গাটা গড়িয়াহাট—উপায় কি এগোতে পারি? টাকমাথা ধুতি—পাঞ্জাবি ভদ্রলোক।
—নমস্কার। আপনি তো নবনীতা দেবী?
—হুঁ (সহাস্য)…
—আমরা আপনার লেখা—টেখা পড়তাম বটে, এখন আরও বড় পরিচয় জানলাম। এতবড় মানুষের স্ত্রী আপনি। অজস্র অভিনন্দন জানাচ্ছি। দেশের গর্ব।
—স্ত্রী নই। স্ত্রী ছিলাম।
—ওই একই হল আমাদের কাছে। বাঙালির গৌরব। বাঙালির সম্মান।
—(হাস্য)
—টিভিতে দেখে খুব ভাল লাগল।
—(হাস্য)
—আজকাল কী লিখছেন? ওনার ওপরে কিছু লিখুন এবারে।
—হ্যাঁ ভাবছি।….চলি?
তুমিও বিখ্যাত হলে? সেই দুঃখে—
একটা বিয়েবাড়িতে সেদিন সেন্টুদার সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র উনি হই হই করে ওঠেন।
—আরে আরে, কাকে দেখছি? অ্যাঁ? নবনীতা যে? কী? এখানে আসতে সময় পেলি? তুইও তো আজকাল দারুণ ফেমাস হয়ে গেছিস—অ্যাঁ? প্রচণ্ড মিডিয়া কভারেজ পাচ্ছিস, বিশাল পাবলিসিটি হয়ে গেল বটে তোদের! এদিকে তোর, আর ওদিকে অমিতাদির। রীতিমতো মিডিয়া ফেবারিট হয়ে গেছিস তোরা দুজনে—রেডিও খুললে তুই, টিভি চালালে তুই, কাগজ পড়তে গেলে তুই—হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ—
হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ আমিও হাসি।
স্যরি সেন্টুদা, আমি কিন্তু অনেকদিনই একটু একটু মিডিয়া ফেবারিট—এই ছোট্ট নিরীহ বাক্যটা বার কয়েক মনের মধ্যেই গুনগুন করে। মুখ ফুটে আর বেরোয় না।
বউদি অবশ্য আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন তাড়াতাড়ি—
কী যে বলো! নবনীতা বুঝি আজ ফেমাস? ওর বাবা—মার নামেই তো ওকে সবাই চেনে সেই ছোট্ট থেকে।
যাব্বাবা। ভালো ডিফেন্স। আমার তবে নিজে নিজে ফেমাস হওয়া আর হল না? হয় আমার বাবার নামে, নয় আমার মেয়েদের বাবার নামে। কেন, আমি যে অ্যাদ্দিন ধরে লেখালেখি করছি, তাতে বুঝি একটুও ‘ফেম’ হতে পারত না? কিন্তু এই বিতর্কও মনের মধ্যেই ঘুরে চলে। মুখে সৌম্যভাব, আর কাষ্ঠ হাসি ফোটাতে চেষ্টা করি। এদিকে রাগ মাথায় চড়ে যাচ্ছে।
”পলকহারা আলোকদিঠি মরমপরে”—লেজার বিমের মতো বিদ্ধ হচ্ছে। চারিদিকে এত চোখ, কোনও পর্দা নেই। আব্রু নেই। এসেছি বিয়েবাড়িতে, বর—কনে যতটা মনোযোগ পাচ্ছে, আমিও প্রায় ততটাই। যেন আমিই বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছি! ব্যাপারটা যখন শুরু হয়েছিল, প্রথম প্রথম মন্দ লাগছিল না। এখন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। যা ‘নয়’। তাই এখন ‘হয়’ হয়েছে। আমি আছি আয়নার ভূমিকায়। একটি অনুপস্থিতির প্রতিবিম্ব হয়ে। আমার নিজের আর কোনও আকৃতি নেই।
অথচ ব্যাপারটা তো সত্যিই দারুণ! কত আহ্লাদই হয়েছিল—কজন বাঙালি মা তার মেয়েদের বাবার নোবেল প্রাইজ পাওয়া দেখতে পেয়েছে?
—একজনও না।
কিন্তু আনন্দের তাণ্ডব নৃত্যে মানুষের মন ধাঁধিয়ে গেছে। ছিল দারুণ, হয়ে গেছি নিদারুণ।
সিলভার কার্প
—এই যে দিদি, আপনার তো আজকাল, খুব…. হেঁঃ হেঁঃ হেঁঃ—ইঙ্গিতপূর্ণভাবে ভুরু নাচিয়েই বাক্য শেষ করলেন। হাতে বাজারের থলি। ডাঁটা বেরিয়ে আছে। স্ট্রাইপড শার্ট। নস্যি রং ট্রাউজার্স। চিনি কি? চিনি? নাঃ, চিনি না। আজকাল চারিদিকে এত লোক…
—খুব টিভিতে দেখা যাচ্ছে আপনাকে
—…… (হাস্য)।
—বিশেষ করে স্যারের নোবেল প্রাইজ পারার পর থেকে আর কি। চতুর্দিকে ছবি উঠছে। দেশের লোক আপনাকেও চিনে গেছে। হেঁ হেঁ।
—হেঁ হেঁ।
—কত বড় সম্মান!
—”….”
—পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের, মানে বাঙালির মানে পশ্চিমবঙ্গের নাম পৌঁছে দিয়েছেন স্যার।
—তা ঠিক।
রবীন্দ্রনাথের পরেই অমর্ত্য সেন।
—বাজার করে ফিরছেন বুঝি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, এই গড়িয়াহাটে—
—কী মাছ কিনলেন?
—মাছ? মানে আজ খুব ভাল ইলিশ উঠেছে কিন্তু যা দাম!
—আমি তো সিলভার কার্প কিনি। পঁয়ত্রিশ—চল্লিশের মধ্যে টাটকা মাছ পাই। জলে থাকে। জ্যান্ত।
—সিলভার কার্প? নাঃ ও মাছ আবার আমাদের চলে না।
—কেন? খুব টেস্টি মাছ তো? কোপ্তা করে খাবেন, চপ হয় দারুণ—
—স্যার সি—লভার কার্প খান?
—ঠিক জানি না। তখনও তো এসব নতুন মাছ বাজারে ওঠেনি!
বড়দিদি মেজদিদি
—এক প্যাকেট গুডরিক চা দেখি। আড়াই শো।
—নমস্কার বউদি। ভালো আছেন?
—হ্যাঁ। আপনি ভালো?
—আপনাদের তো সব সময়ে দেখছি। কাগজে। টিভিতে। আপনার মেয়েরা চলে গেছে—ওদেরও দেখলাম।
—হ্যাঁ, ওরা তো অনেকদিনই—
—জামাইটি বেশ হয়েছে।
—হ্যাঁ [সহাস্য]
—শ্বশুরের বেশ ন্যাওটা।
—সে কি? না তো? কে বলল? [No হাস্য]
—ছবি দেখলাম কাগজে। শান্তিনিকেতনে।
—সেটা তো গ্রুপ ফটো। ফ্যামিলির বহুলোকই ছিল তাতে। আশ্চর্য!
—কই, আপনাকে তো দেখলাম না?
—দেখবার কথা ছিল নাকি?
—না এমনিই। দেখতে ইচ্ছা করে তো? দেখলাম না, তাই বলছিলাম। দাদার সঙ্গে একটাও ছবি দেখতে পেলাম না।
—এক প্যাকেট ক্রিমক্র্যাকারও দেবেন। জলদি করুন।
—দাদার ছবি দেখলাম, একপাশে ছেলে হাসছে, একপাশে মেয়ে। ছেলেকে দেখিনি তো পাড়াতে?
—ও বিলেতেই থাকে কিনা।
—ছেলেটা বুঝি আপনার নয়?
—না।
—ওর মা আসেননি?
—তিনি স্বর্গে। তাড়াতাড়ি করুন।
—একি? ক্রাকজ্যাক কেন? আমি তো ক্রিমক্র্যাকার বললুম।
—সরি বউদি, দিন, ঠিক করে দিচ্ছি।
—এই যে, ক্রিমক্র্যাকার—আচ্ছা বউদি কে আগে?
—মানে? খুচরোটা দিয়ে দিন, যেতে হবে।
—পঞ্চান্ন, ষাট, দুশো। মানে, কে ফার্স্টে? বউদিদের মধ্যে কে বড়? উনি না আপনি?
—ফার্স্ট—সেকেন্ড—বড়—মেজো দিয়ে আপনার তো কোনও প্রয়োজন দেখি না। এই পাঁচ টাকার নোটটা গলে গেছে। থাক, আর বদলে কাজ নেই, আমি চলি—
—মাইন্ড করলেন? বউদি? স্যরি। ভেরি ভেরি স্যরি, বউদি মাইন্ড করলেন?
শাক দিয়ে মাছ
—এই যে নবনীতা, শান্তিনিকেতনে যাচ্ছ বুঝি? অমিতাদির কাছে?
—না—শান্তিনিকেতনে আমার এক বন্ধু যাচ্ছেন, তুলে দিতে এসেছিলুম।
—অমিতাদি ভালো আছেন এখন? যা হুজ্জুতি গেল!
—সত্যি। বড্ড ধকল চলছে।
—এই বয়সে, এত বিশাল একটা ঘটনা সামাল দিচ্ছেন, একলা হাতে। চব্বিশ ঘণ্টাই বাইরের লোক, খবরের কাগজ টিভি, বিরক্ত করছে, ফোটো তুলছে, ইন্টারভিউ নিচ্ছে, পুলিশ আর কত আটকাবে!
—তাই তো। অবশ্য আনন্দটাও বিরাট।
—সে আর বলতে? রত্নগর্ভা! ওঁর জন্যেই তো হলো। মা গুণী না হলে ছেলে অত গুণের হয়? ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা—তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর বিদ্যা, তাঁর বুদ্ধি, সবই তো পুত্রের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন, অমন মা নইলে,….
—অমর্ত্যর বাবাও খুব বড় সায়েন্টিস্ট ছিলেন, ডঃ এ টি সেন, তিনি—
—জানি জানি। UPSC-তে যখন ছিলেন আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন—চাকরিটা হয়নি। দুর্ভাগ্য তাঁরও। দেখে গেলেন না ছেলের এত গৌরব! তবে মা তো দেখলেন। এমন মাতৃভক্ত সন্তানও আজকের যুগে বিরল। কতবার যে ছুটে ছুটে আসেন মাকে দেখতে। মার কথাটা তাই সর্বত্র খুব বেরুচ্ছে। তোমার কথাও অবশ্য বেরুচ্ছে। ছবিটবি—হেঃ হেঃ—ইন্টারভিউটিউ!! অ্যাঁ? খু—ব? কে না ইন্টারভিউ দিচ্ছে ভাই আজকাল? রাম—শ্যাম—যদু—মধু সব্বাই অমর্ত্য—স্পেশালিস্ট হয়ে গেছে! হাঃ হাঃ
—হাঃ হাঃ
—তোমার মেয়েরা এসেছিল বাপের সঙ্গে। চমৎকার মেয়েগুলি। বাপের কাছেই থাকে?
—না তো? ওরা তো বড় হয়ে গেছে। যে যার মতো নিজেরা নিজেরা থাকে।
—অমন বাবা অনেক কপাল করলে পায়। বুঝলে? খুব সৌভাগ্যবতী তোমার মেয়েরা। জেনে রেখো!
—জানি।
—সুইডেনে পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল মেয়েদের। মা—বোনকেও নিতে চেয়েছিল। শেষ মুহূর্তে ওঁরা যেতে পারে নি। লাস্ট মোমেন্টে টিকিট ক্যানসেল করতে হল। তা তুমি গেলে না যে?
—কোথায়?
—সুইডেনে?
—হঠাৎ সুইডেনে? আমি কেন যাব?
—না। এমনি। মানে তোমার মেয়েরা গেল তো? তাই বললাম।
—ওদের কথা তো আলাদা।
—আমরা সবাই আশা করছিলাম তুমিও যাবে। এই যে এতবার মিছিমিছি বাইরে যাও, আর এবারেই গেলে না। এতবড় আনন্দে যোগ দিলে না।
—আমি মিছিমিছি বাইরে যাই? কাজে যাই না?
—কাজ কি নয় এটা? ভাল দেখায়নি কিন্তু।
—কী ভাল দেখায়নি?
—এই তোমার রাগ করে না—যাওয়াটা খুবই দৃষ্টিকটু দেখিয়েছে। সারামাগোর সঙ্গে সমস্ত গ্রামসুদ্ধ গিয়েছিল শুনলাম।
—রাগ করে না যাওয়া মানে! কে রাগ করল? আমার কি নেমন্তন্ন ছিল?
—মেয়েদের নেমন্তন্ন ছিল?
—নিশ্চয়ই। বিনা নিমন্ত্রণে গেছে নাকি।
—ওদের টিকিট কে দিল? নোবেল কমিটি, না ওদের বাবা?
—আরে আমি কী করে জানব? আমি দিইনি। বাবাই বোধ হয়।
—আমরা ভাবলাম নোবেল কমিটি।
—হতেও পারে বা। জানি না আমি।
—এই যে তুমি গেলে না আনন্দে যোগ দিতে, এতে মনে হল তুমি বুঝি খুশি হওনি।
—মনে হলে আর কী করা।
—লোকের মতামতকে তুমি যে গ্রাহ্য কর না সে তোমার টিভিতে বসে মদ খাওয়া থেকেই বোঝা গেছে। পুরুষমানুষও অমন ক্যামেরার সামনে মদ—গাঁজা খায় না।
—মদ গাঁজা কে খেল আবার?
—ওই যে তুমি! শ্যাম্পেন খেলে? দশ তারিখে? খাটের ওপরে বাবু হয়ে বসে, কয়েকজন বয়স্কা বাঙালি ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে দিব্যি মদের বোতলটি খুললে, সবাই টিভিতে দেখলাম?
—ওফ! ঐ কথা! ছাড়ুন তো সোমেনদা, কতবার বলব, ওতে অ্যালকোহল ছিল না। ওটা ফ্রুট জুস। ওই নিয়ে ঢের হয়ে গেছে।
—অমন সবাই বলে ভাই! ওটা যে কেমন ফ্রুট জুস, তা তো আমাদের জানা আছে!
—এই তো আপনাদের মতো মানুষরাই তো শিলিগুড়িতে একটা সেমিনারে এক মন্ত্রীর সামনে আমাকে অবিকল এই প্রশ্নই করেছিল। মিডিয়া ও আধুনিক জীবন নিয়ে জরুরি সেমিনার—অডিটোরিয়াম থেকে প্রশ্ন এল হঠাৎ—
—”আপনি টিভি ক্যামেরার সামনে মদ খেলেন কেন? ওটার কি প্রয়োজন ছিল?” আমার ব্যক্তিগত জীবন এখন পাবলিক অ্যাফেয়ার হয়ে গেছে। যার যা খুশি বলে নেয়। শুনতে হয়।
—সত্যি, কেন খেলে, বল তো? আমিও তাই ভাবি।
—(ধমকে) বলছি খাইনি। ওটা ‘অ্যামব্রোজিয়া’ নামক একটা পীচফলের পানীয়। ”অমৃত”। অমর্ত্যর সঙ্গে ওটার নামের এত মিল বলেই আমার দিদিভাই আর ছোট ননদকে নিয়ে মজা করলুম ওইদিন। ওটা বেবিশ্যাম, নকল শ্যাম্পেন, ছোটদের জন্য—কতবার বলব? দিদিভাই, বুড়ু ওরা কেউই তো মদ খায় না! অকারণে ওদের—
—আরে, অমন সবাই—ই বলে। আজকাল মেয়েরা সব ঘরে ঘরে মদ্যপান করছে। আড়ালে যত খুশি খাও না বাপু? কে দেখতে যাচ্ছে? তা বলে এইভাবে খোলাখুলি, টিভিতে?—ওটা চলে না।
সে যাক। খেয়েছ, খেয়েছ! হয়ে গেছে যা হবার। এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না। নো ইয়ুজ ট্রায়িং। তার চেয়ে অন্য কথা বলি। হ্যাঁ, অমিতাদিকে বলবে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ঠিক পাঁচবার চেষ্টা করেছি। পাঁচবারই আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে ওঁর পুলিশরা। অবশেষে চিঠি দিলাম। পেলেন কিনা জানি না।
—বড্ড বেশি চিঠিপত্র আসছে—ঝাঁকামুটের মাথায় করে চিঠি আসছে প্রতীচীতে।
—এটা ফ্যাক্ট—কিলো কিলো মণ মণ সে যাই আসুক, অমিতাদি আমার চিঠির উত্তরটা দেবেনই। তুমি জানো না। অন্য সম্পর্ক আমাদের। বহুদিনের।
—তবে তো ভাবনা নেই।
—তুমি তাড়া দিও। মনে করিয়ে দিও। ”সোমেনদা” বলো না, চিনবেন না। বলবে ”সুমুর চিঠির উত্তরটা”—
—ঠিক আছে।
—কী বলবে?
—সুমুর চিঠির উত্তরটা।
—রাইট। থ্যাংক ইউ।
—কিন্তু আমি তো এখন শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি না সোমেনদা!
জবাব চাই। জবাব দাও
—”দিদি, অ দিদি! দিদি!” হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়তে দৌড়তে এসে পথ আগলে দাঁড়ালেন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকটি। দাড়ি—চুলে বেশ পাক ধরেছে। আমি চিরদিন লেট, সর্বত্র দেরি করে যাই। এখনও তাই—দৌড়চ্ছি। কেউ পথে দাঁড় করালে ভীষণ অসুবিধে। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। নন্দনচত্বরে। বাংলা অ্যাকাডেমিতে মিটিং। শুরু হয়ে গেছে।
—আপনাকে সেই তখন থেকে ফলো করছি।
—কেন বলুন তো? কিছু দরকার আছে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। দাদার ঠিকানাটা।
—দাদা? কোন দাদা?
—ওই যে, অমর্ত্য সেন।
—ও। ওই দাদা। ঠিকানা দিয়ে কী করবেন?
—চিঠি লিখবো। অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি—
—ট্রিনিটি কলেজ, কেমব্রিজ, ইংল্যান্ড।
—ব্যস? রাস্তার নাম? বাড়ি নম্বর? পিনকোড?
—ছুটতে ছুটতেই বলি—লাগবে না, নেই।
—নেই!!
—ওইটেই কমপ্লিট? ধন্যবাদ, দিদি…
—অ দিদি! অ দিদি। প্লিজ আরেকটা কথা!
—আবার কী হলো? থেমে পড়ি। মুখ খিঁচোই।
—বলি উত্তর দেবেন তো? দাদা উত্তর টুত্তর দেন?
—এমনিতে তো দেন। তবে এখন এই হাজার হাজার অভিনন্দন, জানি না ঠিক কতটা কি পেরে উঠছেন।
—ঠাকুমা দেবেন?
—ঠাকুমা?
—ঠাকুমাকে চিঠি দিলে উনি উত্তর দেবেন কি? যদি লিখি? ‘প্রতীচী’তে দাদার মা আর কি! তাঁকে চিঠি দিলে উত্তর পাব না? দাদার মা আবার ঠাকুমা কবে হয়?—এখন সবই তালগোল! ছুটতে ছুটতে বলি—
—তিনিও ব্যস্ত। অসুস্থও। কি দরকার তাঁকে চিঠি দেবার?
—আহা দিদি, অ—দিদি—শুনুন এই শেষ।
—??
—আপনি? আপনি উত্তর দেবেন তো? মানে ওঁদের যখন সময় নেই, তাহলে আর কী করা? আপনাকেই তাহলে চিঠি দিই? ”ভালোবাসা” হিন্দুস্থান পার্কে? আপনি উত্তর দিলেও কাজ চলে যাবে।
—আবার আমাকে কেন?
—ওই যে, অভিনন্দন। দাদার জন্য। উত্তর দেবেন তো? আমার শুধু একটা উত্তর চাই দিদি, যে কেউ একজন উত্তর দিলেই হবে। অন্তরা, নন্দনা, যে—কেউ প্লিজ। সেটা তুলে রাখব। মেমেন্টো। নোবেল প্রাইজের স্মৃতি। আমার বংশধরদের জন্যে। একটা রিপ্লাই।
—আমি না। আমি না। আমি চিঠিপত্র হারিয়ে ফেলি। আপনার চিঠি হারিয়ে ফেলব…
—সে কি কথা? তবে তো…
—খুবই মুশকিল…
সামান্য কাজ
প্রচণ্ড তাড়ায় একটা লেখা শেষ করছি, কানাই এল।
—দিদি, জামাইবাবুর এক বন্ধু এসেছেন দেখা করতে।
—কী নাম?
—বললেন, চিনবেন না। জরুরি দরকার। উঠতেই হলো লেখা বন্ধ করে।
—নমস্কার। এখন আমি বাটানগরে থাকি। আগে সেন্ট গ্রেগরিজ ইস্কুলে বাবলুর সঙ্গে পড়েছি ঢাকা শহরে। বাবলু আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ইদানীং খুব কম মানুষকেই আমি দেখছি অমর্ত্যর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন না। এখন ওঁকে ‘অমর্ত্য’ নামে খুব কম জনেই ডাকে, সবারই দেখছি তিনি হয় ‘বাবুল’, নয় তো ‘বাবলুদা।’ ওঁর মা আমজনতার ‘অমিতাদি’ বা ‘অমিতা মাসি’। অথচ গত চল্লিশ বছরে ওঁদের কাছাকাছি এঁদের দেখিনি। ঘনিষ্ঠতা যেন হঠাৎ ম্যাজিক শিমগাছ! আমার মুখে কী ভাব ফুটল কে জানে! ভাষা ফুটল না। এইজন্যে উঠে এলাম, লেখা ছেড়ে?
—অমিতা মাসির একটু ‘দর্শন’ চাই।
—উনি শান্তিনিকেতনেই আছেন।
—ঠিকানাটা?
—ওই তো, প্রতীচী, শান্তিনিকেতন?
—অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগবে কি?
—করে গেলেই ভালো তো।
—বেশ। তাহলে আপনি অমিতা মাসির সঙ্গে আমার একটা অ্যাপো করেই দিন। আমার ফোন নম্বরটা আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি। অমিতা মাসির ডেট ও টাইমটা পেলেই আপনি আমাকে জানাবেন। একটা খেয়াল রাখবেন শুধু।
—আমার কিন্তু উইক এন্ড ছাড়া সময় হবে না। উইক ডেজ—এ ব্যস্ত থাকি। —পকেট থেকে ছোট্ট নোটপ্যাড বের করে ভদ্রলোক খসখস করে কীসব লিখতে শুরু করলেন। লেখা হয়ে গেলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন।
—উনি কবে, কখন আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন, সেটা জানতে পারলেই এই নম্বরে আমাকে একটা ফোন করে দেবেন। সেই মতো আমি শান্তিনিকেতনের টিকিট কাটব।
আমি যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলুম।— আপনি আমাকে বলছেন? আপনার জন্যে শান্তিনিকেতনে ট্রাঙ্কল করে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করে দিতে? না ভাই, পারবো না, স্যরি। ওটা আপনাকেই নিজে নিজে করতে হবে। নিন, লিখুন টেলিফোন নম্বরটা লিখে নিন—
—কিন্তু উনি তো আমাকে চিনবেন না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেবেন কেন? ভাল হতো, যদি আপনার মাধ্যমে—
—আমি তো আপনাকে চিনি না। এই তো দিব্যি চলে এসেছেন? এমনি করেই যাবেন। কিন্তু কেন যেতে চান শান্তিনিকেতনে?
—প্রণাম করতে। আর অটোগ্রাফ নিতে। দু’জনেরই অটোগ্রাফ চাই। হঠাৎ তাঁর মুখে হ্যালোজেন বাল্ব জ্বলে উঠল।
—আচ্ছা, একটা কাজ তো করাই যায়। ধরুন, আপনার কাছেই অটোগ্রাফ খাতাটা রেখে গেলাম। আর আপনিই শান্তিনিকেতন থেকে ওঁদের মা—ছেলের দুটো অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে এনে রাখলেন। তারপরে আমাকে ফোন করে দিলেই আমি সুবিধে মতন এসে নিয়ে যাব। এইটুকুনি নিশ্চয়ই পারবেন? সামান্য কাজ! বলুন তাহলে, কবে নাগাদ পাব?
—প্রণাম করার কী হবে?
—ওটা পরে কখনও—
কী ভাল আমার লাগল আজ এই সকালবেলায়
শীতশীত ভোর হচ্ছে। রাস্তা যানশূন্য কিন্তু জনশূন্য নয়। দ্রুতগতি মনুষ্যের ভিড় লেকমুখী রাস্তায়। সকলেই যেতে যেতে যেন কেমন টেরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে। ওই দোতলাবাড়ির বারান্দায় নাইটি পরা এক মহিলা আমাকে দেখেই ভূত দেখার মতন চমকে উঠে, দৌড়ে ঘরের মধ্যে পালিয়ে গেলেন। কী হল? যেতে যেতে পেছন ফিরে ওই বারান্দার দিকে আর একবার তাকিয়ে দেখি, উনি ঘর থেকে আলোয়ান—জড়ানো এক ঘুমন্ত ভদ্রলোককে ধরে এনেছেন—দু’জনে মিলে আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন। এমন আগেও হয়েছে। ক’দিন আগে হলেও খুশি হয়ে ভাবতুম এঁরা নবনীতাকেই দেখছেন। দিব্যি গদগদ হতুম আহ্লাদে। এখন গা সিরসির করে উঠল। ওঁরা নিশ্চয়ই নোবেল লরিয়েটের প্রথমা পত্নীকে দেখছেন।
[কত বড় মানুষের সঙ্গে ঘর করেছে ষোলো—সতেরো বছর! আহা কী কপাল! রাখতে পারল না।]
দুটি মেয়ে চলে গেল পাশ দিয়ে। গা ঘেঁষে। ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। কী এত দেখার আছে? চুল আঁচড়াইনি? টিপ পরতে ভুলে গেছি? মর্নিং ওয়াকের আগে সাজসজ্জা ঠিক হয় না। কী মুশকিল। মেয়েগুলো এতবার তাকাচ্ছে কেন? আমি এই ডানদিকের গলিতে ঢুকে পড়ব?
—দিদি, নমস্কার।—চলেই এসেছে!
—নমস্কার।
—আমরা, মানে, আপনি আমাদের চেনেন না, কিন্তু আমরা আপনাকে চিনি।
এবার আমার মুখে একগাল হাসি। কেননা এই বাক্যবন্ধ দিয়ে যে—আলাপ শুরু হয়—তার পরবর্তী বাক্যটা আমি জানি।
এবার ওরা বলবে, ”আমরা আপনার লেখা পড়তে খুব ভালবাসি।” আমি খুশি মনে দাঁড়িয়ে পড়ি। লেখকের আসল পুরস্কার তো এখানেই। পাঠক—পাঠিকার ভালোবাসায়। আমার কাছে এই বাক্যের মূল্য অপরিসীম। এর চেয়ে ভালো সকাল কী হতে পারত?
মেয়ে দুটি বলল—আপনাকে আমরা চিনি। টিভিতে কত দেখেছি। কাগজে ইন্টারভিউ পড়েছি। আমরা দুজনেই ইকনমিকস পড়ি। আমরা স্যারের ভীষণ ভক্ত। আপনাকে দেখে তাই আলাপ করতে এলাম।
ন—নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই…
ক, খ—উনি অত বড়ো, ওঁর কাছে তো পৌঁছতে পারব না, তাই আমাদের অভিনন্দন আপনাকেই জানিয়ে দিই। অভিনন্দন আর প্রণাম।
—মেয়ে দুটো ঢিপ করে প্রণাম করল। ”থাক থাক।”
ক—আপনাদের মেয়েরা কেউ তো ইকনমিকস পড়েনি। না?
ন—নাঃ।
খ—একজন তো নন্দনা, সিনেমা স্টার। টিভিতে ”গুড়িয়া” দেখেছি। মুখখানা অনেকটা আপনারই মতন।
ক—অন্যজনের কিন্তু বাবার মতন মুখ—কাগজে ছবি দেখেছি বাবার সঙ্গে। অন্তরা। জার্নালিস্ট। তাই না?
খ—ওর তো স্বামীও জার্নালিস্ট। প্রতীক। সেও কি ইকনমিকস পড়েনি?
ন—নাঃ, সেও ইংরিজি। তোমরা তো সব্বাইকেই চেনো দেখছি।
ক—আপনার তো অ্যাজমা। তাই কি মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছেন?
ন—তাও জানো?
ক, খ—আপনাদের বিষয়ে স—ব জানি!
—ওরে বাবা! ভেরি গুড। রোজই হাঁটতে যাও?
ক খ—এই, মাত্র কদিন হল যাচ্ছি।
ন—ভালো অভ্যেস, চালিয়ে যাও….
দু’পাও যাইনি। উল্টোদিক থেকে পরমাসুন্দরী দু’জন মধ্যবয়স্কা, সালোয়ারকামিজসুশোভিতা, হাস্যবদনা এসে আমারই সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। পথ জুড়ে।
ক—আপনি তো নবনীতা দেবসেন?
ন—আজ্ঞে হ্যাঁ….
খ—হাঁটতে যাচ্ছেন বুঝি?
ন—হ্যাঁ।
ক—আমরা ফিরছি।
ন—তাই তো দেখছি।
খ—আপনাকে তো আগে দেখিনি?
ন—না। এই সদ্য শুরু করেছি…..
ক—হাঁপানির জন্য? না বাত? আপনার তো দুটোই আছে, আপনার লেখাতে পড়েছি।
খ—আপনাকে তো আজকাল খুব দেখা যায়। টিভিতে। কাগজে। এখন তো সকলেই আপনাকে চেনে। আমরাও চিনে গেছি এই সুযোগে। হি হি হি…
ক—সে কি? আপনি ওঁকে আগে চিনতেন না?
খ—আগে? মানে? মানে নোবেল প্রাইজেরও আগে?
ক—কি আশ্চর্য, নোবেল প্রাইজের সঙ্গে ওঁর কী?
খ—কিছু না, কিন্তু অতবড় মানুষটার সঙ্গে অতদিন ঘর করেছেন—সেইজন্যই তো কাগজে টিভিতে সর্বত্র আজ ওঁর এত নামডাক….
ক—আপনাকে বলেছে! আমি ওঁর লেখার দারুণ ভক্ত। তাই দাঁড় করিয়েছি। আপনিই তো বললেন, ওই যে নবনীতা দেবসেন আসছেন।!
খ—আমি তো বললাম অমর্ত্য সেনের কথা মনে করেই।
ন—আপনারা ক্লান্ত—বাড়ি যান, আমি বরং একটু হেঁটে আসি।
ক—কিছু মনে করবেন না, সকলে তো বই পড়ে না। আমি কিন্তু আপনার জন্যই…
খ—কেন। স্বামীর নামে পরিচিতিটা কি খারাপ?
ন—আপনারা কোন দিকটাতে হাঁটেন?
ক, খ—ঠিক হাঁটি না, আমরা লাফিং ক্লাবের মেম্বার। এক্সারসাইজ করি।
ক—লাফিং ক্লাবে আপনারও গেলে ভাল। হাঁপানি, বাত দুটোর পক্ষেই ধন্বন্তরি।
ন—লাফিং ক্লাব? নাম শুনেছি বাইরে থেকে হাহা—হোহো শুনেছি—যেতে সাহস হয়নি…
ক—আসুন না, আপনার অসুখটসুখ সব ভালো হয়ে যাবে, ফিট থাকবেন—
খ—সকলে আপনাকে পেলে কত খুশি হবে—সবাই তো আপনাদের চেনে…
ন—একটু ভেবে দেখতে হবে। আজকে থাক, এ নিয়ে বরং আরেক দিন কথা হবে।
মাস কমিউনিকেশন সেন্টার
(১)
—হ্যাঁ, বলছি, বলুন?
—দিদি অমর্ত্যদার কেমব্রিজের ফ্যাক্স নম্বরটা কত?
—কেন ভাই?
—মনিস্টার একটা জরুরি মেসেজ পাঠাবেন…
—বেশ। বলছি লিখে নাও 0044…
—থ্যাংক ইউ দিদি।
—ওয়েলকাম। অমর্ত্য কিন্তু এখন কেমব্রিজে নেই। বস্টনে।
—অ্যাঁ, বস্টনে? কবে ফিরবেন?
—সে তো জানি না ভাই।
—ওখানে কি কোনও ফ্যাক্স—ট্যাক্স—
—আছে। ফ্যাক্স নম্বরটা লেখো, 001…
—থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ দিদি, মেনি মেনি থ্যাংক্স…
(২)
—বলছি, বলুন?
—দিদি, অমর্ত্যদার বস্টনের ফোন নম্বরটা কত? ওই ফ্যাক্স নম্বরটাই কি?
—না—না, অন্য। ফোন নম্বর হচ্ছে…
—থ্যাংক ইউ দিদি, আমরা আপনাকে বড্ড জ্বালাচ্ছি…
—না না তাতে কী হয়েছে….
(৩)
—হ্যাঁ, বলছি, বলুন—
—আচ্ছা নবনীতাদি, বাবলুদার অ্যাকচুয়াল জন্মস্থানটা কোনখানে বলতে পারেন? একটা বই বেরুবে—তাতে যাবে। বাংলাদেশে কাগজে বেরিয়েছে ওঁর জন্ম ঢাকাতে, আর এখানে বেরিয়েছে শান্তিনিকেতনে। আরও শুনলাম কলকাতাতে, অমিতা সেনের মামার বাড়িতে। আজ শুনছি নাকি ওঁর বাবা যখন বর্মাতে চাকরি করেন উনি তখন রেঙ্গুনে জন্মেছেন। হয় উনি, নয়তো ওর ছোট বোন সুপূর্ণা—
—অমর্ত্যের জন্ম গুরুপল্লীতে, ক্ষিতিমোহন সেনের বাড়িতে। বর্মায় কেউ জন্মায়নি।
—ঠিক তো? বাঁচালেন নবনীতাদি। কী যে কনফিউশন সৃষ্টি হয়েছে….
—কনফিউশনের কী আছে, ওঁর মাকে জিজ্ঞেস করলেই তো জানতে পারতে।
—অমিতাদি বেচারিকে আর বিরক্ত করতে চাই না। এমনিতেই তো এত ঝামেলা পোয়াচ্ছেন—তা ছাড়া শান্তিনিকেতনে ফোনে লাইন পাওয়াও শক্ত।
—আমাকে ধরা সহজ—আমাকে বিরক্ত করলে ক্ষতি নেই—
—আরে না—না, আপনি তো আমাদেরই নিজেদের লোক, আপনার ওপর একটু—আধটু অত্যাচার তো আমরা করতেই পারি—পারি না? আচ্ছা তাহলে জন্মস্থানটা হচ্ছে গুরুপল্লী, শান্তিনিকেতন, ৩রা নভেম্বর ১৯৩৩, এই তো? ঠি—ক আছে। রাখছি তবে…
(৪)
—হ্যালো নবনীতাদি? স্যরি আপনাকে একটু বিরক্ত করতে হচ্ছে। আচ্ছা, আমরা না অমর্ত্যদার জন্য একটা কার্ড করাচ্ছি, তার জন্য ওঁর ব্লাড গ্রুপটা একটু জানা দরকার ছিল। কার্ডে থাকবে। ওঁর ব্লাড গ্রুপটা কী? আপনার কি মনে আছে?
—ব্ল্যাড গ্রুপ? অমর্ত্যর? ও বাবা। সে তো অনেকদিন হয়ে গেল। পূর্বজন্মের কাহিনী। প্রথমবার বাচ্চা হবার সময়ে ওঁর, আমার দুজনের ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করানো হয়েছিল কেমব্রিজে। সবই ঠিকঠাক ছিল, তাই অত খেয়াল রাখিনি। এখন নিজেরই ব্লাড গ্রুপ মনে নেই তো অমর্ত্যর। কী যে ভাবো না আমাকে তোমরা। ব্লাড গ্রুপ।
—তবে কে, কে বলতে পারবেন? সুপূর্ণাদি?
তিনি আমেরিকাতে। থাকলেও বলতে পারতেন না।
—অমর্ত্যদা এখন কোথায়?
—ঠিক জানি না, কোথায় যেন লেকচার দিতে গেছেন।
—অমিতাদি জানতে পারেন কি?
—বলতে পারব না ভাই। তুমি কেমব্রিজে অমর্ত্যর স্ত্রীকে ফোন করে জেনে নাও। উনি হয়তো জানবেন?
—ওঁকে কি বিরক্ত করাটা ঠিক হবে?
—আমাকে কি বিরক্ত করাটা ঠিক হচ্ছে?
—ছিঃ ছিঃ, নবনীতাদি, কী যে বলেন! এতে আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। ছোট ভাই হিসেবে এটুকু অধিকার তো আমাদের আছেই। তাই না? বলুন?
(৫)
—হ্যালো, স্যরি বেশি রাত হয়ে গেল না তো? নবনীতাদি? যাদবপুর ছেড়ে অমর্ত্যদা ফের ট্রিনিটি কলেজে গেলেন, না অক্সফোর্ড না লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে?
—ট্রিনিটি। এল এস ইতে অনেক পরে।—একাত্তর সালে।—তারও পরে, LSE থেকে গেছেন অক্সফোর্ডে।
—আর হার্ভার্ডে?
—ওখানে তো দুবার গেছেন। আটষট্টিতে প্রথমে। তারপর সাতাশি থেকে একটানা ছিলেন। তোমরা ওঁর একটা বায়োডেটা দেখে নাও না? ‘হু’ ‘জ হু’—তেই পাবে।
—এই একটুখানি দিদি, কেউ কেউ বলছে উনি স্ট্যানফোর্ডে ছিলেন, আবার কেউ বলছে বার্কলিতে। কোনটাতে?….
—একষট্টিতে স্ট্যানফোর্ড। চৌষট্টিতে বার্কলিতে। শোন ”ইন্টারন্যাশনল হু’জ হু’টা বরং তুমি দেখে নাও—এভাবে হয় না।
জামাই-আদর
—খুকু, অমর্ত্য তো কলকাতাতে আসছে?
—হ্যাঁ আসছেন।
—একদিন আমরা ওকে খেতে বলতে চাই। তুই ব্যবস্থাটা করে দে। মেয়েদের নিয়ে তুইও আসবি।
—না গো মীলুমাসি, খেতে টেতে বোলো না, ওঁর সময় হবে না।
—তাই তো এত আগে থেকে বলে রাখছি।
—কেনই বা বলতে চাও? কই, এত বছর তো কতবারই কলকাতায় এসেছেন, কখনও তো খেতে বলোনি।
—তোদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, অমর্ত্য আবার বিয়ে করল। সে অবস্থায় কি জামাইকে আর খেতে ডাকা যায়? তুইই বল? ইচ্ছে করে?
—তা, এখন কি অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে? খেতে ডাকছ যে! হঠাৎ ইচ্ছে করল কেন?
—হাজার হোক, এতবড় সম্মানটা পেল তো? ছিল তো আমাদেরই জামাই একদিন।
—ছিলেন, কিন্তু এখন তো নেই? আপনমনে আনন্দ করছ, করো।—ও সব সম্মানে ভাগ—টাগ যেন বসাতে যেও না।
—বড্ড কড়া কড়া করে কথা বলিস আজকাল।
—কড়া নয়। বাস্তব। বি প্র্যাকটিক্যাল।
উদ্ভ্রান্ত শ্বশুরকুল
—আরে ফুলকাকা। রাঙাকাকা! এসো এসো। এত সেজেগুজে? গিলে করা পাঞ্জাবি কোঁচানো ধুতিটা, গলায় চাদর, শ্রাদ্ধবাড়ি গিয়েছিলে বুঝি?
—তোর এখানেই এলুম।
—কি আনন্দ! কী ব্যাপারে? কতদিন পরে এলে!
—শোন বাপের বাড়ির কেউ এলে ”কী ব্যাপারে” বলতে হয় না। এমনিই এসেছি। চা বল।
—স্যরি, স্যরি—তারপরে? বলো, কারুর বিয়ের ব্যাপারে? নেমন্তন্ন বুঝি?
—নেমন্তন্ন নয়।
দুই সুদর্শন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। মনে হল মুশকিলে পড়েছেন। তারপর গলা ঝেড়ে নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসে ফুলকাকা বললেন,
—প্রাইজের খবরটা পেয়ে অবধি ভাবছি তোর কাছে একবার যাই।
—খুব ভালো করেছ কিন্তু মুখ এমন গোমড়া কেন? এত কিন্তু—কিন্তু কীসের—
—সত্যি বলব খুকু? ঠিক বুঝতে পারছি না এতে আমাদের খুশি হওয়া উচিত, না বুক ভেঙে যাওয়া উচিত। দুটোই হচ্ছে।
রাঙাকাকা এবার গলা ঝাড়লেন।
—ধর যদি সব কিছু আগের মতনই থাকত, আজ তাহলে তোর অবস্থাটা, আমাদের বাড়ির অবস্থাটা কেমন হত, ভাবতে পারিস? সেই উদ্দাম আহ্লাদের পরিমাণও আন্দাজ করতে পারছি না। কিন্তু এখন? কাগজে, টিভিতে আমাদের জামাইয়ের ছবি দেখি, বুকের মধ্যে যেন কেটে কেটে বসে। পুরনো দিনগুলো সব মনে পড়ে যাচ্ছে। তোদের এনগেজমেন্টের খবর এলো। তোর বিয়ে—বউভাতে সব্বাই দল বেঁধে শান্তিনিকেতনে গেলুম—এই তো, নতুনদার শ্রাদ্ধে ওর কত খাটাখাটনি—
—সেবার লন্ডনে তোদের বাড়িতে—
—ওই সব কথা একদম ভুলে যাও তো বাপু তোমরা! একেবারে মনেই রেখো না—ওই পুরনো অ্যালবাম ক্যানসেলড— ওই দিনগুলো নিয়ে মনে একটুও দুঃখ করো না, তাহলেই আজকের মুহূর্তটাকে এনজয় করতে পারবে—
—কী যে বলিস! দুঃখু করবো না? জানিস খবরের কাগজে ওর সঙ্গে ওর বউয়ের হাসি—মুখ ছবি দেখে তোর ফুলকাকি কেঁদে ফেলেছে?
—প্লিজ তোমরা একটু চেষ্টা করে মন ভালো করো—জগতে আজ সবাই আনন্দ করছে, কেবল এই আমাদের একটা বাড়িতেই মন খারাপ থাকবে। এটা কি ভালো? চিয়ার আপ, চিয়ার আপ, মন খারাপ করে থাকলে নিজেদেরই ঠকে যাওয়া হবে।
—মন ভালো করব? গুড। ভেরি গুড তাহলে নোবেল প্রাইজের খবরে আমরা আনন্দই করবো, বলছিস?
—নিশ্চয়ই। আমার কথা ভেবে তোমরা মুখ হাঁড়ি করে থাকবে নাকি সারা দেশ যখন আনন্দ করছে?
—নতুনদিদি—নতুনদা থাকলে কি আজ আনন্দ করতেন? তাঁদের বুক ফেটে যেত রে।
—কি জানি? কিছু বলা যায় না। এই তো আমিই তো খুব আনন্দে আছি।
—তাই তো দেখছি!
—কেবল কিঞ্চিৎ ব্যতিব্যস্ত এবং বিব্রত। বড্ড ঝামেলা করছে বাইরের লোকে। খালি খালি ফোন আর লোক। লোক আর ফোন। নিজস্ব সময় বলে কিছু বাকি নেই। নিজের কাজকর্ম চুলোয় গেছে। সারদিন ফোন ধরছি আর বৈঠকখানাতে বসছি। কথা বলতে বলতে ভাঙা গলা আরও ভেঙে গেছে। পুরস্কারপ্রাপক এ বাড়ির কেউ নন, তবুও সবাই এসে মিষ্টি খেতে চাইছে, মিষ্টিমুখ করাতে করাতে পকেট গড়ের মাঠ হয়ে যাচ্ছে।
—খুকু, এক্সকিউজ মি! পুরস্কারপ্রাপক এ বাড়ির কেউ নয় বললি? পিকো টুম্পার বাবা নয়? ওটা বলিস না। ওদের বাবার জন্যে তুই মিষ্টি খাওয়াবি না তো কে খাওয়াবে এ বাড়িতে?
—হঠাৎ বাড়িটা ”অমর্ত্য সেনের শ্বশুরবাড়ি” হয়ে গেছে। রাস্তার লোকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বারোন্দায় দাঁড়াবার উপায় নেই। আমার পথেঘাটে দোকানপাটে স্বচ্ছন্দ বিহার বন্ধ হয়ে গেছে। দু মিনিট হাঁটি, আর কেউ না কেউ দাঁড় করিয়ে অমর্ত্যর কথা বলবেই। পথেঘাটে ফোনে সাক্ষাতে চিঠিতে আমার জীবনটা একখানা অ্যাবসার্ড নাটক হয়ে উঠেছে ফুলকাকা। ফোন বেজে উঠল।
—ওই যে তোমার শ্যামের বাঁশি! যাও।
—বলুন? হ্যাঁ হ্যাঁ, পেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ। ছবিগুলো কোথায় পৌঁছে দিতে হবে? শান্তিনিকেতনে? নিশ্চয়ই পাঠিয়ে দেব। হ্যাঁ হ্যাঁ। নমস্কার।
—উফ। এই চলছে সমানে! ‘না’ বলার জো নেই!
—আমরা উঠি এবার। কথা বলে ভালো হলো। শক্ত করে রেখেছিস দেখে ভালো লাগছে। মেয়েগুলোও তো কাছে নেই। তোর ওপরেই সবটা ধকল পড়ে গেছে।
—মেয়েরা আসবে। সিভিক রিসেপশনে যাবে।
—তুই যাবি, সিভিক রিসেপশনে?
—নেমন্তন্ন করলে নিশ্চয়ই যাব।
—তুই যদি যাস, তবে আমাদের জন্যেও খান কয়েক কার্ড জোগাড় করতে পারবি?
—নিশ্চয়ই। যাবে তোমরা? মনে কষ্ট হবে না তো আবার? ওঁর বউ থাকবে কিন্তু সশরীরে।
গ্রীনরুম
—মাগো তুমি কী পরবে? কিছু ঠিক করেছ?
—হ্যাঁ। ওই যে নতুন লাল পাড় গাধওয়ালটা।
—অ্যাঁ? লালপেড়ে শাদা শাড়ি? সতী সাধ্বী সধবা হিন্দু নারীর ইউনিফর্ম? না দিদি, নো ইউ কান্ট ডু দ্যাট। কালারফুল কিছু পরো। লালপেড়ে ইজ আ হরিবল আইডিয়া।
—ঠিকই। ওটা চলবে না—মেয়েরা মুহূর্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খাটভর্তি শাড়ি ঢেলে ফেলে।
—কালো কাঁথারটা?—বড্ড জমকালো…।
—জামরঙা বালুচরী?—সেম প্রবলেম…
—গ্রে পোচমপল্লী?—চলবে—
—হলদে বোমকাই?—চলবে—
—সবজে ঢাকাই?—চলবে—
—লালপেড়ে ঢাকাই?—জরি বেশি…
—লাল—সাদা ঘট চোলি? জরি বেশি…
—সবুজপাড় ঢাকাই?—বড্ড ড্যাব…
বেস। হলুদ বোমকাই?—নো ব্লাউজ…
—সবজে ঢাকাই?— নো পেটিকোট…
—তাহলে?….
ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত মেয়েরা গুছিয়ে রাখল কী? না টুম্পার কালোপাড় মেরুন সিল্কের বাটিক। সেটা নাকি কালারফুল—কিন্তু সিমপল, আর খুব ডিগনিফায়েড। এবং কালো ব্লাউজ আছে। ম্যাচিং পেটিকোটও খুঁজে পেয়েছে। এরপরে আর কথা নেই। ফাইনাল।
—মেয়েরা কী পরবে ঠিক করলে?
—ওই তো, তোমার সাদা ঢাকাই বেনারসিটাই টুম্পা পরবে, সাদা—লাল ঘটচোলিটা, আমি পরব—দুজনেরই ম্যাচিং লাল ব্লাউজ আছে—
—ঠিক ছোটবেলার মতো। মায়ের শাড়ি না পরলে ওদের ঠিক ”সাজা—সাজা” মনে হয় না। যদিও দুজনেরই প্রচুর নিজস্ব শাড়ি ও ব্লাউজ আছে এখন! সেসব পড়ে রইল। আমার অবশ্য চোখ জুড়িয়ে গেল। অতএব মা পরলেন ছোট মেয়ের মেরুন শাড়ি। মেয়েরা পরল মায়ের সাদা—লাল জরির শাড়ি।
—মা, শাড়িতে পিন লাগাবে? তোমার তো ভীষণ শাড়ি খসে যায়। এখানে কিন্তু সর্বক্ষণ টিভি ক্যামেরা থাকবে।
—টিভি ক্যামেরাটা আমার ওপরে থাকবে না।
—মাগো, প্লিজ নতুন টিপ পরো। কৃপণতা করে পুরনো পরবে না, খসে পড়ে যাবে, সেই বইমেলার মতন!
—দিদি, প্লিজ বিশাল নোংরা ওই তোমরা ঠাকুমার ঝুলিটা নিও না। একটা ব্যাগেই কাজ চালাও। কী যে ক্যাবলকান্ত দ্যাখায়, তা যদি জানতে, পঞ্চাশটা থলে নিয়ে—
—আচ্ছা সিভিক রিসেপশনটা কি আমাকেই দেওয়া হচ্ছে? তোরা কী শুরু করলি? আজ আমার দিকে কেউ তাকাবেই না, রেস্ট অ্যাসিওরড—
—তা—ই? তবেই হয়েছে। তুমি বাঙালি চেনোনি। সব্বাই তোমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে। বারো হাজার লোক।
—কই রে? কই রে? নবনীতা দেবসেন কই রে? দেখতে পাচ্ছিস?—’ওই যে ওই যে, অমর্ত্য সেনের প্রথম পক্ষের বউটা? পাগলির মতন তিনটে থলে নিয়ে, হাঁটুর কাছে কাপড় তুলে যাচ্ছে,—ওই টে!’ এমনি বলবে।
—থ্যাংক ইউ। তোরা যা। আমি যাব না।
—আহা আহা সত্য নাকি? আমরা তোমাকে একটু খ্যাপাচ্ছিলুম। জাস্ট টিজিং ইউ।
—তুমি খুব স্মার্ট, মা। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না কতটা ক্যাবলাকান্ত। খুব ডিসেপটিভ অ্যাপিয়ারেন্স তোমার।
—বারো হাজার লোক কিন্তু তোমার দিকেও নজর রাখছে, মনে রাখবে মা, সচেতন হয়ে থাকবে—
—বারো হাজার? সে তো শুধু আডিটোরিয়ামেই! আর টিভিতে? পুরো পশ্চিমবঙ্গ দেখবে। দিদি! হঠাৎ ‘নামে—কী—ঢুকলো?’ বলে যেন নাক—টাক খুঁটে ফেলো না, কেলেংকারি হয়ে যাবে কিন্তু।
—কিংবা ঘাড়টা কাত করে মা হয়তো খোঁপা থেকে কাঁটা বের করে বাঁ কানটা চুলকোতে লাগলেন হঠাৎ, ক্যামেরার মধ্যে!”
আমাকে তোরা কী মনে করেছিস বল তো? দেহাতি আদমি? পাবলিক প্লেসে যাইনি? শোনরে বোকারা, আজ আমি কেউ না, সমস্ত ক্যামেরার অন্য দিকে নজর থাকবে—”তাই ভেবে আনন্দে থাকো আর কি! ক্যামেরার gaze টার gossip interest থাকবে, বুঝলে দিদি? সেটাই খেয়াল রাখতে বলছি। স্ত্রী তো স্ত্রী। তার চেয়ে প্রাক্তনী ঢের বেশি গসিপগন্ধী!”
যাবার আনন্দ শুকিয়ে গেল ছোটদের উপদেশের ঠেলায়। অবশেষে সদলবলে তাজ বেঙ্গলে। পিকো টুম্পা প্রতীক কবীর সব রেডি। শাশুড়ি মাও রেডি। হঠাৎ আমার বাহুটা জড়িয়ে ধরলেন—”তুই আমার সঙ্গে যাবি। আমার আলাদা কনভয়। ছেলেমেয়েরা তো বাপের সঙ্গে যাবে। আমার সঙ্গে কে তবে যাবে? একা একা যাব না। তুই সঙ্গে চল।” বেশ! আমার এতে ভালোই হলো। মূল কনভয়ের সঙ্গে যেতে যথেষ্ট সঙ্কোচ হচ্ছিল, ওঁরা আদর করে ডেকেছেন বলে এসেছি। আমিও তো শাশুড়ি? ব্যস আমিও খপ করে আমার জামাইয়ের হাতটা পাকড়ে ফেলি। —”তুই তাহলে আমার সঙ্গে যাবি। আমিও একা একা যাব না!” আমরা তিন প্রজন্মের তিনজন—যে যার শাশুড়ির সঙ্গে চললুম। চালাও পানসি নেতাজী ইনডোর!
কনভয়
সামনে পাইলট কার… সোঁ…. পোঁ… পোঁ করে সাইরেন বাজিয়ে। ছটা সাদা অ্যাম্বাসডার একসঙ্গে ছুটল। মাঝখানের একটাতে আমরা তিনজন, আর একজন পুলিশ অফিসার। বাকি সব গাড়িতে শুধুই নিরাপত্তারক্ষীরা।
সারাপথ মানুষে মানুষে সুসজ্জিত। আবালবৃদ্ধবনিতা। কাতারে কাতারে দর্শনপ্রার্থী, প্রীয়মাণ জনতা। আমি। আমি যেমন দাঁড়িয়েছিলুম ছোটবেলায়, ধীলন শাহনওয়াজকে দেখব বলে। আরেকটু বড় হয়ে ক্রুশ্চভ বুলগানিনকে দেখব বলে। কোনোদিন কি ভেবেছি এমনভাবে মানুষ দাঁড়াবে আমার পিকো টুম্পার বাবাকে দেখবার জন্যে?
সাইরেন শুনে ঝিমন্ত জনতা মুহূর্তে জেগে উঠলো ”মায়ের কনভয়” গুটি গুটি নেতাজী ইনডোরে ঢুকছে যখন, স্পষ্ট দেখলুম ফুটপাতে দাঁড়ানো লোকজন উৎসাহে নিচু হয়ে জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে যাত্রীদের দেখার চেষ্টা করছে, তারপর আশাহত, ব্যাজার মুখে উঠে দাঁড়াচ্ছে। আশাভঙ্গের দুটো কারণ থাকতে পারে। এক হতে পারে তারা কালো কাচ দিয়ে কিছুই দেখতে পায়নি। আর দুই—দেখেছে দূর যতো আজেবাজে ফালতু পার্টি। আসল মানুষটা নেই।
মন যারপরনাই বিষাদে ছেয়ে গেল। ওদের জন্য তো বটেই। নিজের জন্যও। ফালতু পার্টি হয়ে গেছি। ফলস কনভয়। দূরে আসল কনভয়ের সাইরেন শোনা যাচ্ছে। এসে পড়ল বলে।
সখি-সংবাদ
—তোকে সেদিন দেখলাম। শাশুড়িকে ধরে ধরে সিটে নিয়ে এলি। সিভিক রিসেপশনে।
—তুই গিয়েছিলি?
—না। টিভিতে দেখলাম।
—বাব্বা, কী মরণ ফাঁদ না ওখানে, ইলেকট্রিক তারে পা জড়িয়ে আরেকটু হলেই আছাড় খাচ্ছিলেন।
—কিন্তু তোকে যে কী খারাপ দেখাল টিভিতে, সেটা কি তুই ভেবে দেখেছিস একবারও?
—খারাপ দেখাল? কেন?
—মনে হল তুই তোর এক্স—শাশুড়িকে তেল দিচ্ছিস।
—কীসের তেল? পড়ে যাবেন, ধরব না?
—তুই কিন্তু বারবার রং স্টেপ নিস। মিডিয়া রেসপন্সটা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়।
—কী আবার করলুম? কী বলতে চাস তুই?
—বলতে চাই যে তোমাকে দেখে যারপরনাই লজ্জা করেছে আমাদের। হেসে হেসে ঘেঁষে ঘেঁষে কী সব বলছিলে অমর্ত্যর স্ত্রীকে? কাগজে লিখল বাংলা থেকে ইংরিজি অনুবাদ করে দিচ্ছিলে।
—ঠিক তাই। কাগজেও তা হলে ঠিক কথা লেখে মাঝে মাঝে? গুড!
—তোকে কি ইন্টারপ্রেটরের চাকরি দিয়েছিল রে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার?
—কেন, কী হলো?
—খুব খারাপ দেখিয়েছে। লজ্জা করল না তোর?
—যা বাব্বা। লজ্জা কেন করবে?
—মনে হলো তুই গায়ে পড়ে অমর্ত্যর বউয়ের সঙ্গে ভাব জমাচ্ছিস।
—ওকে তো ওদের বিয়ের আগে থেকেই চিনি—এখন নতুন করে ভাব জমাব?
—মহিলাটিও তেমনি। কী রকম ঢলে ঢলে পড়ছিল তোর ঘাড়ের ওপরে।
—কী করব? শুনতে পাচ্ছিল না যে?
—যাত্রা থিয়েটারের মতো দেখালি বাবা তোরা। দুজনে পাশাপাশি বসে বসে কী ভাব—বিনিময়!
—এতে তোর এত রাগারাগির কী আছে?
—আর কিছু নয় প্রগতিবাদী নারী হিসেবে তোমার আরেকটু আত্মসম্ভ্রম থাকা উচিত ছিল। ওর স্ত্রীর ঠিক পাশে গিয়ে না বসলেই তোমার কি চলছিল না?
—আমরা বসেছি কি স্ব—ইচ্ছায়? চেয়ারে প্রত্যেকেরই নাম লিখে সাঁটা ছিল না?
—তাই বল! সিটে নাম লেখা ছিল? বাঁচালি! তবে তো আমরা সব ভুল ভেবেছি। আমি ভাবলাম তুইই বুঝি সেধে ওর গা ঘেঁষে বসতে গেছিস—তা নয়? তবে তো ঠিকই আছে, এটা একদিক থেকে ভালই হয়েছে—কারেক্ট ডিসিশন—
—থাক। ঢের হয়েছে উল্টোপাল্টা কথা! ঢের বাজে বকেছিস—আমি নিজে বসলে ভুল ডিসিশন হতো—আর সরকার বসালেই কারেক্ট ডিসিশন!—প্লীজ বোর করিস না, এবার অন্য কথা বল—তোর মেয়ের শরীরটরির একটু সেরেছে?
—মেয়ে ভালো আছে, থ্যাংক ইউ। নাতনিটাও সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন সব ঠিকঠাক। বাই দি ওয়ে ‘অন্য কথা’ বলাতে মনে পড়ল, মেয়ে কী বলছিল জানিস? বলছিল—মাগো, নবনীতামাসির কি আর শাড়ি নেই? প্রত্যেকটা কাগজে ওই একটাই শাড়ি পরা? টেলিগ্রাফ, স্টেটসম্যান, এশিয়ান এজ, সর্বত্র—আবার এই মাসের ‘ভ্রমণ’ এল। সেখানে ‘গঙ্গাবক্ষে নৌকাবিহার’ করছেন, সেও ওই কাপড়টা পরে। তুমি ওঁকে একটা শাড়ি প্রেজেন্ট করো।
—দূর বোকা। সব ছবিই তো একই দিনে তোলা, সকালবেলা গাদিয়াড়াতে নৌকো চড়বার জন্যে যে কাপড়টা পরলুম সেটা কি আর বদলাতে চান্স পেয়েছিলাম, মিডিয়া তখন প্রবল আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারিধার। গাদিয়াড়াতেই শুরু হলো, ”আজকাল” পত্রিকা দিয়ে। তারপর ফিরে এসে দেখি বিধ্বস্ত কানাই লিখে রেখেছে নামের সুদীর্ঘ ফিরিস্তি, এক সন্ধ্যা ও এক সকালের মধ্যে দুশো তেতাল্লিশজন ফোন করেছে, পঁচিশজন চলে এসেছে। তার মধ্যে কে নেই। পি টি আই, ইউ এন আই, বি বি সি, জি টিভি, ইন্টারনেট, আজতক, স্টার টিভি, দূরদর্শন, আকাশবাণী সববাই—প্রত্যেকটা খবরের কাগজ এবং অগুনতি ব্যক্তিগত শুভানুধ্যায়ী। মিডিয়ার অনেকেই পরে আবার ঘুরে ঘুরে এলেন—একেবার পরের দিন সকালের আগে শাড়িটা বদলাবার সুযোগ হলো না। রাত্রে এত ক্লান্ত লাগল, ওটা পরেই ঘুমিয়ে পড়লুম। নাওয়া—খাওয়া সব কয়েকদিন মাথায় উঠেছিল। কয়েকদিন ধরে তাণ্ডব চলল, বাড়িতেই যেন প্রিভেসি বলে কিছু ছিল না। আর আমি লোকটা যে এতদিন ধরে কষ্ট করে লেখালিখি করলাম, বাঙালির মনে একটা ছোট্টখাট্টো জায়গা তৈরি করলুম নিজের জন্য—একটা অ্যালফ্রেড নোবেলের ঢেউ লেগে সে সমস্তই ধুয়ে মুছে গেল!— ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান।
জরা হট্কে, জরা বচ্কে, ইয়ে হ্যায় নোবেল, মেরি জান!
কির! কিররর। কিররর!!
—কে রে, এত জোরে বেল বাজাচ্ছে কে?
—দিদি পুলিশ! কানাই ভীত।
—পুলিশ? কেন? কী ব্যাপার। বারান্দায় বেরিয়ে পড়ি রণরঙ্গিণী মূর্তি ধারণ করে। নীচে পুলিশ মুখ তুলে ওপর দিকে চেয়ে। কোমরে দুই হাত। ইশারা করে আঙুল উলটে—
—গাড়িটা সরিয়ে নিন। মারুতি গাড়ি আপনার?
—হ্যাঁ। কেন সরাব?
—আজ বিকেল পাঁচটার সময় অমর্ত্য সেন এ বাড়িতে আসবেন!
—তার জন্য আমাকে গাড়ি সরাতে হবে কেন?
—সিকুরিটি।
—আমার গাড়িটা আমার বাড়ির সামনেই থাকে। থাকবেও। পারলে আপনিই সরিয়ে দিন।
—এবার পুলিশটি চিৎকার করে পাড়া কাঁপিয়ে ঘোষণাটি করে—সে ভাবে, আমি বোধহয় শুনতে পাচ্ছি না।
—”আজ পাঁচটার সময়ে অমর্ত্য সেন এই বাড়িতে আসবেন। রাস্তা ক্লিয়ার করতে হবে। গাড়ি হটান। সিকুরিটি!” এখন বেলা তিনটে অমর্ত্য বলেছেন ৬টার সময়ে এমাকে নিয়ে বেড়াতে আসবেন। এ যাত্রায় আর কোথাও যাচ্ছেন না, কোনও লোক—লৌকিকতা করতে পারছেন না, প্রবল নোবেল—তরঙ্গ বিক্ষোভে বিপর্যস্ত। আজ সন্ধ্যাটা নিজেদের মধ্যে থাকতে চান তাই কারুকে খবর দেওয়া বারণ। কিন্তু এই পুলিশের তো গলায় মাইক লাগানো আছে। একে থামানো দরকার।—”ঠিক আছে, দেখছি। আপনি যান।” চারটের সময় শিবু এসে বলল—”দিদি, গড়িয়াহাটের মোড় থেকে লোক দাঁড়িয়ে গেছে। জামাইবাবু আসছেন নাকি ৫টার সময়? সব বাড়ির ছাদে লোক। বারান্দায় লোক। কি ভিড়!”
—অ্যাঁ? কী বলচিস শিবু?
—তাই তো দেখলাম।
পরদিন সকালে একের পর এক ফোন আসা শুরু হল।
—খুকু, অমর্ত্যরা এলো, আমাকে একটা খবর দিলি না?
—বৌদি। বাবলুদারা আসবে আমাকে একবারও বল্লে না?
—মিনুমা, আমাদের একটিবার জানালে না?
—নবনীতা, এটা কি ঠিক হলো? আমাকে পর্যন্ত জানালে না বাড়িতে অমর্ত্য আসছে।
—তোমরা কেমন করে জানলে?
—কাগজে ছবি দেখলাম তো।
—কাগজে? কি ছবি দেখলে?
—”ভালোবাসা” বাড়ি থেকে অমর্ত্য সেন বেরুচ্ছেন সস্ত্রীক ওখানে ভোজন সেরে—তিন ছেলেমেয়ে সমেত—
—এত খবর কে দিল ওদের?
—তা তো জানি না?
টুম্পা চেঁচিয়ে ওঠে ”পুলিশ! পুলিশ সব খবর দিয়ে দিচ্ছে, মা! ‘অমর্ত্য সেন আসছেন রাস্তা ফাঁকা করো’ স্লোগান বোধহয় সেই গড়িয়াহাট থেকেই শুরু করেছিল।” যে জানে তেমন লোকের গলাতে পিকো বলল—এটা রুটিন। কাগজের লোকেরা পুলিশকে তাদের দিনের প্রোগ্রামটা জিজ্ঞেস করে—”আজ কোথায় ডিউটি?” তাই থেকেই মুভমেন্টস জেনে যায়। তারপর প্রেসও। সেইখানেই ‘ডিউটি’—তে চলে যায়।
—বাড়ি ভিতরে রিপোর্টাররা ধেয়ে আসেনি ভাগ্যিস!
—আসবে কি? পুলিশে পুলিশে তো বাড়ি ঘেরাও ছিল। তুমি তো বেরোওনি, জানবে কেমন করে। আমরা তো বাবাকে গাড়িতে তুলতে গিয়ে দেখলাম—প্রেস ফটোগ্রাফার, আর পুলিশের ভিড়—বাড়ির সামনে রাস্তা ভর্তি অজস্র মানুষ। সাইরেন বাজিয়ে বাবার গাড়ি চলে গেল। জ্যোতিবাবুর মতো!
[এই দৃশ্য নরেন্দ্র দেব কি কখনও কল্পনায় ভেবেছিলেন, তাঁর ‘ভালোবাসা’ বাড়িতে?]
দ্য রাইট পার্সন
—”হ্যাল্লো নাভানীথা। হাউ ইজ লাইফ? আফটার সাচ আ লং টাইম।” ঘরে ঢুকলেন হাস্যবদন, দীর্ঘদেহী, পক্বকেশ এক বৃদ্ধ দক্ষিণী। আগে দেখেছি বলে মনে হলো না। চমৎকার ডার্ক স্যুট পরা। লাল টাই।
—”কেশভন। শিওরলি ইউ রেকগনাইজ মি? সেই যে পঁচাশি সালে ব্যাঙ্গালোরে কনফারেন্সে—” হাতের ব্রিফকেসটাকে টেবিলে রাখলেন। বললেন, ওতে করে কয়েকটি বই এনেছেন আমাদের দেবার জন্যে। কিন্তু ব্রিফকেস আর খুলছে না। আমি হাত বাড়াই—”দিন, আমি খুলে দিচ্ছি—” কিন্তু তার আগেই উনি ঝাঁপিয়ে পড়ে টেবিল থেকে আমার হাতঘড়িটা তুলে নিয়েছেন। এবং তার স্টিল ব্যান্ডের খিলটাকে ব্যবহার করে চাড় দিয়ে ব্রিফকেসের লকটা খুলতে চেষ্টা করছেন। আমি হাঁ হাঁ করে উঠি, আর কেশভন আমাকে সান্ত্বনা দেন—”এই তো, এই হয়ে গেল!” বলতে বলতেই বাক্সের ডালা খুলে গেল। আহ্লাদে নেচে উঠে কেশভন বলেন,—”কেবল একটু স্কিল চাই!” যত্ন করে বইগুলি বের করলেন। দুটি উপন্যাস। একটি গল্পসংকলন। তিনটিই ইংরিজিতে লেখা। এবং একটি পাণ্ডুলিপি। নতুন উপন্যাসের কম্পিউটার প্রিন্ট আউট। উল্টে পাল্টে দেখলাম লেখা খারাপ নয়। বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কাছে বইগুলি পেয়ে আমি অভিভূত। ”ধন্যবাদ প্রভূত ধন্যবাদ!”
—কাগজে আপনার প্রবন্ধ পড়লাম আপনি লিখেছেন স্বদেশে প্রকাশিত ইংরিজি ভাষাতে রচিত ভারতীয় সাহিত্য আর বিদেশে প্রকাশিত ইংরিজি ভাষাতে লেখা ভারতীয় সাহিত্য কৌলীন্য বিচারে আলাদা। তাদের প্রচারের জাতই আলাদা, পাঠকের সংখ্যাও আলাদা, সাহিত্যের চরিত্রও তাতে আলাদা হয়ে যায়। কতদূর যে যথার্থ মন্তব্য, কি বলব! কেউই এ ব্যাপারটা বোঝে না। আপনিই প্রথম লিখলেন।”
প্রশংসা পেয়ে আমি যারপরনাই পরিতৃপ্ত। কিন্তু একটু তাড়া আছে। বেরুব। উঠে পড়ি।
—থ্যাংক ইউ ড. কেশভন। নিশ্চয়ই পড়ব আমি আপনার বই। এখন একটু—
—অফ কোর্স। পড়বে বইকি! আপনিও পড়বেন। আগে আপনি পড়ে নেবেন, তারপরে ডক্টর সেনকে দিলেই হবে।
—ডক্টর সেনকে?
—”আপনি তো সবই বোঝেন। বিদেশে যদি ছাপা না হয়, তাহলে ইংরিজিতে বই লেখার আজ আর কোনও মূল্যই নেই। তাই ডক্টর সেনকে একটু বলতে চাই—যদি—
—ডক্টর সেন কী করবেন? এ তো অর্থনীতি নয়, উপন্যাস—
—আমার একজন লিটেরারি এজেন্ট দরকার বিলেতে। ডঃ সেনের তো সব বই—ই বিলেত থেকে বেরোয়। উনি নিশ্চয় একজন লিটেরারি এজেন্ট জোগাড় করে দিতে পারবেন। পারবেন না!—আমি স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে থাকি।
—আমার পাণ্ডুলিপিটা উনি পড়ুন, এটা আমি চাই। আপনি নিশ্চয়ই ওকে এটা পড়াতে পারবেন? এতে উনি যা যা চান, সবই আছে—দুর্ভিক্ষ আছে, ক্ষুধা আছে, নির্যাতিতা নারী আছে ওঁর খুব পছন্দ হবে। ওঁরই গবেষণার বিষয় নিয়ে উপন্যাসটি লেখা। যদি একটু বিলেত থেকে বইটা উনি ছাপিয়ে দিতে পারেন, আপনি ওঁকে বলুন।
—ডঃ কেশভন, বইটি আপনি পোস্টে ওঁকে পাঠিয়ে দিন, চিঠি লিখে। এসব কাজে ডিরেক্ট কনট্যাক্টই ভালো!
—কিন্তু আমি তো ওঁকে চিনি না। যদি আপনি বইটি ওঁর কাছে রেকমেন্ড করে দেন—
—শুনুন, অন্য বইগুলোও আপনি ফেরত নিয়ে যেতে পারেন, আপনার কাজ যখন সিদ্ধ হলো না।
—ছিঃ ছিঃ ও কি কথা? আপনি আগে পড়ে নেবেন, তারপরে ডঃ সেনকে পৌঁছে দেবেন। তাড়া নেই। অরুন্ধতী রায়কে তো তার এজেন্টই এত বড় করেছে। ডঃ সেন ইজ দ্য রাইট পার্সন। উনি যদি আমাকে হেলপ করেন, কোথায় লাগবে অরুন্ধতী। আর কোথায় বিক্রম শেঠ। ইফ হি কুড গেট মি আ লিটেরারি এজেন্ট অ্যাব্রড—
… কেশভনের পুরু চশমার পিছনে বৃদ্ধ চোখের মণি স্বপ্নময় হয়ে উঠল—হঠাৎ আমার হাত দুটি চেপে ধরলেন—”ইউ উইল রিকোয়েস্ট হিম অন মাই বিহাফ, ওন্ট ইউ?—
কেশভন চলে যওয়ার পরে দেখি ঘড়িতে তখনও এগারোটা বেজে পাঁচ। তাঁর ব্রিফকেসটি যে মুহূর্তে খুলে গেছে, আমার ঘড়িটিও সেই মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেছে।
দাঁড়াও, সুন্দর মুহূর্ত!
শোননি কানে, হঠাৎ গানে কহিল ”আহা আহা” সকল বনভূমি
একটানা প্রবল গর্জন করে চলেছে মেট্রো রেল। যথেষ্ট ভিড়। তার মধ্যেই দণ্ডায়মান দুই ভদ্রলোক গল্প জুড়েছেন। মুখ দেখতে পাচ্ছি না।
—”কি বলব মশাই, কাগজ খুললেই শুধু অমর্ত্য সেন আর অমর্ত্য সেন। অথচ সেই মানুষটা যে কী বলছে, সেদিকে কান দিচ্ছে কেউ? খাদ্য বলুন, শিক্ষা বলুন, স্বাস্থ্য বলুন—যেদিকটাতেই তাকান, না রাজ্য, না কেন্দ্র, কেউই এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। কেবল ‘ভারতরত্ন’ আর ‘নাগরিক সম্মান’ দিয়েই কাজ ফুরল? লোকটার জ্ঞানটা দেশের কাজে লাগাবি না?” অত্যন্ত বিচলিত কণ্ঠস্বর। মোটা গলায় থমথমে উত্তর এল—
—এইটে যা বললেন। একেবারে খাঁটি কথা। অমর্ত্য সেনকে নিয়েই নাচানাচি, তাঁর কাজটাকে মূল্য দিচ্ছে না কেউ। জাতীয় জীবনে তার কোনও ইমপ্যাক্টই পড়ল না। শুধু হাঁকডাক, শুধু হাঁকডাক। কোনো পরিবর্তনই হল না রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে।
পাশের বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা হঠাৎ আমাকে কনুইয়ের গোঁতা মেরে, উটের গ্রীবার মতো গলা লম্বা করে দিলেন আলোচকদের মধ্যে—
—কিন্তু জিনিসপত্তরের দাম যে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে বাবারা? আমি তো কোনো ”উন্নয়ন” দেখছি না। কী লাভ হলো বাঙালির নোবেল পেয়ে? অমর্ত্য সেন কি বাজারের আগুনে জল ঢালতে পেরেছে?
—ঠিক কথা! কেউ সমর্থন করলেন বৃদ্ধাকে—যে লোক জিনিসের দর কমাতে জানে না, সে আবার কীরকম বড় ইকনমিস্ট?
অল্পবয়সী গলা ভেসে এলো—
—আরে মাসিমা, ওসব বাজারদর—টর অমর্ত্য সেনেদের দেখার কথা নয়। খাদ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, এঁদের বলুন। ওঁকে প্রাইজটা কেন দিয়েছে, তা কি আমরা জানি না?
—কেন? কেন? কেন দিয়েছে?
—গেল বছরে ইকনমিকসের প্রাইজটা ভুল করে দুটো মার্কিন জোচ্চোর ব্যাটাদের দিয়ে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল তাইতে বিশাল নিন্দে হয়েছে নোবেল কমিটির। সেইটেই মেক—আপ করল, একজন সজ্জন, পণ্ডিত মানুষকে পুরস্কার দিয়ে সবাই যাঁকে একবাক্যে মেনে নেবে।
কামরাটা রীতিমতো অমর্ত্য সেন স্পেশাল সেমিনারে পরিণত হয়েছে। যাত্রীরা সবাই মহোৎসাহে অংশগ্রহণ করছেন। আবহাওয়া যত সরগরম হচ্ছে আমার বুক ততই ধুকপুক করছে। ভিড়ের মধ্যে এখনও অদৃশ্য রয়েছি বটে, কিন্তু হঠাৎ এর মধ্যে যদি কোনও বহুদর্শীর প্রাজ্ঞ চোখে পড়ে যায় অমর্ত্য সেনের ফার্স্ট ওয়াইফের মুখখানা? সহ্য হয় না, আর সহ্য হয় না।
ইতিমধ্যে সভয়ে নজর করলুম আমার বাঁদিকে চশমাপরা ভদ্রমহিলাটি ঘুরেঘুরে আমার দিকেই তাকাচ্ছেন। হ্যাঁ, সন্দেহ নেই। আমাকেই। রীতিমত ডেনজারাস দৃষ্টি। না, থাকা যাবে না। সামনের স্টেশনেই নেমে পড়ব। এই প্রবল অমর্ত্য—সেমিনারের মধ্যে যদি হঠাৎ আমি আবিষ্কৃত হয়ে পড়ি—
মার্ক্সিস্ট ইকনমিস্ট তো নামেই, আসলে তত্ত্বে, কাজকর্মে ইনি কতদূর বামপন্থী সেটা একটা জরুরি প্রশ্ন।
—নাঃ, বামপন্থী তো বটেই—
—কিন্তু কতটা?
—দেখিনি। আমার মনে হয় ওঁকে হয়তো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বলে ধরাই উচিত হবে—
—সরকার ওকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করছে কেন বলতে পারেন? স্টেট গেস্ট। সেলুন কার—
—করছে, কিছু নিশ্চয় তার পিছনে মোটিভ আছে? ওঁকে কাজে লাগাবে ঠিকই সরকার কোনও না কোনভাবে—
—না না। অসীমবাবুর শিক্ষক, তাই একটু গুরুদক্ষিণা,—আর কিছুই না।
সেই মহিলা এখন একদৃষ্টে আমার পানে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছেন।—”কেন চেয়ে আছো গো মা?”
নাঃ, গিরিশ পার্ক অবধি যাওয়া হল না।
—যাই বলুন, লোকটা ভাল। গরিবের জন্যে ভাবে।
—নতুন গলা। নবদ্বীপটাইপের।
—বাজারে আগুন লেগেছে। গরিবের জন্যে ভাবে, তো দামটা কন্ট্রোল করুক আগে?
বৃদ্ধার সেই একই সুর। আমারও সেই একই বুক ধুকপুক। নেমেই যাব। গাড়ি থামুক। এই উদ্বেগ ভাল লাগছে না।
এই সময়ে আমার বাঁ হাতে মৃদু চাপ পড়ল। তাকিয়ে দেখি সেই ভদ্রমহিলা। এক মুখ হাসি।
—আপনিই তো নবনীতা?
আজ্ঞে না।—আমি মরীয়া। আর পারছি না।
—ন্না? খ্যি আশ্চর্য! ভদ্রমহিলার উজ্জ্বল হাসি দপ করে নিবে গেল। নিবিড় আঁধার ঘনিয়ে এল মুখে চোখে।
—অথচ আমি একদমই নিশ্চিত ছিলাম। অবিকল নবনীতা দেবসেনের মতোই দেখতে কিন্তু আপনাকে! ডাবল বলে চালানো যায়।
—জানি। অনেকেই আগে বলেছে। কথাটা প্রায়ই শুনতে হয়।
—ইশ কি ভীষণ মিল আপনাদের হাবভাবেও! আমি ওঁকে দেখেছি তো বইমেলায়। অবশ্য দূর থেকেই। কিছু মনে করবেন না ভাই। বিরক্ত করলাম।
—আরে না। তাতে কী হয়েছে? কতই তো শুনি। সাধ্যমতো মিষ্টি করে হাসি।
এবং খুবই ভুল স্ট্র্যাটেজি হয়। মহিলা শিউরে ওঠেন।
—আপনাদের হাসিতেও কি প্রচণ্ড মিল। কি অদ্ভুত! আমার গা সির সির করছে।”
—”…”
—আসলে কি জানেন? আমি ওঁর লেখার দারুণ ভক্ত। পড়তে এত ভালো লাগে। ভদ্রমহিলা আপন মনেই বলতে থাকেন। ”প্রত্যেকটা বই বেরুলেই কিনে ফেলি। আমার মা—ও খুব ভালোবাসেন নবনীতা দেবসেনের লেখা। প্রায়ই ভাবি একদিন গিয়ে আলাপ করে আসব, সাহস হয় না। আজ আপনাকে দেখে আমি তো হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম।” মহিলা একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
—ভাবলাম, হে ঈশ্বর। আজকে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলাম যে আমার প্রিয় লেখক আমারই পাশে। এত কাছে!
—”…”
—এতক্ষণ ধরে মনের জোর সংগ্রহ করলাম। তারপরে দেখুন তো কী বিশ্রী রকম ভুল করে ফেলেছি?
—ভুল আমাদের সকলেরই হয়ে যায়— আমার গলাও বুজে এসেছে।
—সত্যি বলছি, আপনি নবনীতা নন জেনে খুব মনটা খারাপ হয়ে গেল। এর চেয়ে মনে ভাবতাম দেখা হয়েছিল।
—সেটাই ভেবে নিন না কেন?
—সে আর হয় না। আমার সঙ্গে ওঁর নতুন বইটা ছিল, ভাবলাম সই করিয়ে নেব,—সত্যি এমন আশ্চর্য মিলও হয় মানুষে মানুষে?
—একদিন চলেই যান না ওঁর বাড়িতে, বইটা নিয়ে? গলা ঝেড়ে নিয়ে বলে ফেলি।
—এতদিন হয়নি, সে কি আর হবে?” ভদ্রমহিলা বিধুর হাসি হাসেন—আমার যেমন কপাল!
গিরিশ পার্ক অবধি থাকতে পারিনি। পরের স্টেশনেই পালিয়ে গেলুম।
আমারও কপাল বটে একখানা।
শারদীয় দেশ ১৯৯৯