জম্ভলা দেবতার পুরোহিত

জম্ভলা দেবতার পুরোহিত

বেশ ক’দিন বৃষ্টির পর মেঘ কেটে গেছে৷ ঝলমলে এক সকাল৷ নীল আকাশের বুকে জেগে আছে অনেক দূরে সার সার পর্বতমালা৷ ট্যুরিস্টরাও নেমে পড়েছে রাস্তায়৷ দু-পাশে সার সার দোকানপাট৷ কোনওটা রংচঙে শীতবস্ত্রের, কোনওটা অর্কিডের দোকান বা সুভেনিরের দোকান, কোনওটা আবার হাল ফ্যাশনের কেতাদুরস্ত শোরুম৷ এ ছাড়া ছোটোবড়ো হোটেল-রেস্টুরেন্ট তো আছেই৷ আর যেটা আছে তা হল ফুটপাথে কিছুটা দূর অন্তর অন্তর মোমোর দোকান৷ রাহুল আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে এ রাস্তায়৷ গত কয়েক বছর ধরে কাজের সূত্রে তাকে বেশ কয়েকবার আসতে হয়েছে এই পাহাড়ি শহর কালিম্পঙে৷ এখানকার রাস্তাঘাট তাই মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে তার৷ গত ক’দিন অফিসের কাজের চাপে আর বৃষ্টির জন্য হোটেল আর অফিস করেই তার সময় কেটেছে৷ কাজ শেষ হয়েছে, আর চাপ নেই৷ তাই সকাল নটা নাগাদই সে বেরিয়ে পড়েছিল৷ বেশ ভালোই লাগছিল তার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে৷ একসময় নির্দিষ্ট জায়গাতে পৌঁছে গেল রাহুল৷ ফুটপাথের গা বেয়ে ছোটো ছোটো সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে৷ রাস্তার দু-পাশে বড়ো বড়ো বাড়িঘর বেসমেন্টেও সার সার দোকান আছে৷ তাদের উপস্থিতি না জানলে সেই দোকানগুলো ট্যুরিস্টদের চট করে ঠিক চোখে পড়ে না৷ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে রাহুল এসে দাঁড়াল একটা দোকানের সামনে৷ হ্যাঁ, এই দোকানটাই৷ দোকানের মাথার ওপর ইংরেজি হরফে লেখা আছে ‘মলমল অ্যান্ড কোং’৷ কিউরিয়ো অ্যান্ড আর্ট ডিলার, কালিম্পং৷ দরজার ঠিক দু-পাশে দেওয়ালের গায়ে আটকানো আছে দুটো দন্তবিকশিত কাঠের মুখোশ৷ তাদের দিকে তাকালেই কেমন যেন অস্বস্তি হয়৷ হয়তো বা সেগুলো কোনও তিববতি অপদেবতার মুখোশ হবে৷ বছরখানেক আগে কালিম্পঙের এক হোটেল মালিক রাহুলকে সন্ধান দিয়েছিল এই কিউরিয়োর দোকানের৷ অনেকের যেমন গণেশমূর্তি সংগ্রহের শখ থাকে, তেমনই রাহুলেরও শখ হল বুদ্ধমূর্তি সংগ্রহ করা৷ এর আগে সে বেশ কয়েকবার এসেছে এই দোকান থেকে মূর্তি কিনতে৷ তিন-মাস আগেও একবার এসেছিল একটা বুদ্ধমূর্তির অর্ডার দিতে৷ রাহুলের মতো সাধারণ মানুষদের তো আর লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে অ্যান্টিক মূর্তি কেনার ক্ষমতা থাকে না৷ তাই সাধারণ সংগ্রাহকদের শখ মেটাতে এরা আগাম অর্ডার দিলে আসল অ্যান্টিক মূর্তির পাশাপাশি ছোটোখাটো ধাতুর মূর্তি বানিয়ে দেয়৷ যেগুলো দেখতে অ্যান্টিক মনে হলেও আসলে তা নয়৷ তিন মাস আগে এই দোকানে এসে তেমনই এক বুদ্ধমূর্তি বানাবার জন্য অগ্রিম দিয়ে গিয়েছিল রাহুল৷ সেটা সংগ্রহ করার জন্যই দোকানটাতে হাজির হয়েছে সে৷

রাহুল দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বাইরের পৃথিবীর কোলাহল যেন মুহূর্তের মধ্যে থেমে গেল৷ তার নাকে এসে লাগল একটা অদ্ভুত গন্ধ৷ পুরোনো জিনিসের গন্ধ৷ বেশ বড়ো একটা ঘর৷ দেওয়ালের গায়ে শোকেসে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সব মূর্তি, পাত্র, নেপালি কুকরি, তিববতি তলোয়ার ইত্যাদি৷ মাথার ওপর কোথাও ছাদ থেকে ঝুলছে ‘থাংকা’ বা তিববতি মন্ত্র লেখা প্রাচীন রেশমি কাপড়, কাঠের বা ধাতুর নানা ধরনের মুখোশ, রুপো বা হাড়ের তৈরি চোঙাকৃতি শিঙা, ডুগডুগি ধরনের বাদ্যযন্ত্র৷ ঘরের কার্পেট মোড়া মেঝেতে, ঘরের কোণগুলোতেও রাখা আছে পাথর বা কাঠের তৈরি বিভিন্ন মূর্তি৷ অ্যান্টিক জিনিস সব৷ দেখেই বোঝা যায় সেগুলো একসময় কোনও প্রাচীন স্থাপত্যের অংশ ছিল৷ আর ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা আছে একটা স্টাফ করা চিতাবাঘ৷ দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘাড়টা একটু পিছনে ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ রাহুল এর আগে যখন দোকানে এসেছিল, তখন দোকানের মালিক মলমল কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ওই বাঘটার বয়স নাকি দেড়শো বছর৷ ইংরেজেরা যখন পাহাড়ের জঙ্গল কেটে এখানে বসতি স্থাপন করছে, তখন এখন যেখানে কালিম্পঙের জনবহুল ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, ঠিক সেই জায়গাতেই এক সাহেব নাকি মেরেছিলেন বাঘটাকে৷ এ বাঘটার ছবি দোকানের ক্যাশমেমোতেও ছাপা আছে৷

ঘরের এক কোণে সেলস কাউন্টার৷ সেখানে দোকান-মালিক মাঝবয়সি শেঠ মলমলকে দেখতে পেল রাহুল৷ তাঁর সামনে রাহুলের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে টুপি-ওভারকোট পরা একজন লোক৷ রাহুল কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াতেই তারা দুজনেই ফিরে তাকাল তার দিকে৷ মলমল রাহুলকে চিনতে পেরে বললেন, ‘ও, আপনার সেই বুদ্ধমূর্তিটা তো? স্কেলিটন বুদ্ধমূর্তি৷ এসে গেছে ওটা৷’—এই বলে তিনি তাঁর পিছনের শোকেস থেকে একটা ইঞ্চি ছয়েক লম্বা বুদ্ধমূর্তি বার করে এগিয়ে দিলেন রাহুলের হাতে৷ রাহুল হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল সেটা৷ বেশ বানিয়েছে মূর্তিটা৷ কঙ্কাল বুদ্ধমূর্তি বা স্কেলিটন বুদ্ধমূর্তি৷ গৌতম যখন তপস্যায় বসেছিলেন, তখন অনাহারে তাঁর চেহারা কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল৷ অস্থিপঞ্জর প্রস্ফুটিত এই ধ্যানস্থ মূর্তিটা দেখে বেশ খুশি হল রাহুল৷ সে এর পর পকেট থেকে অগ্রিম বাবদ দু-হাজার টাকার রসিদ ও বাকি তিন হাজার টাকা বার করে দিল শেঠ মলমলের হাতে৷ শেঠ মলমল সেগুলো নিয়ে পাকা রসিদ লিখতে শুরু করলেন৷ রাহুল চারপাশের শোকেসের দিকে তাকিয়ে নতুন কোনও ছোটো বুদ্ধমূর্তির সন্ধান পাওয়া যায় কি না তা দেখার চেষ্টা করতে লাগল৷ শোকেসে নয়, হঠাৎই তার চোখ পড়ল অন্য একটা অদ্ভুত মূর্তির ওপর৷ সেটা তার সামনেই একপাশে কাউন্টারের ওপর রাখা আছে৷ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দেহের আড়ালে থাকায় সেটা এতক্ষণ নজরে পড়েনি রাহুলের৷ সেই অদ্ভুত মূর্তিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই রাহুল জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কীসের মূর্তি?’

প্রশ্ন শুনে মুহূর্তের জন্য মৃদ্যু দৃষ্টিবিনিময় হল শেঠ মলমল আর রাহুলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মধ্যে৷ শেঠ মলমল জবাব দিলেন, ‘ওটা জম্ভলামূর্তি৷ তিববতি দেবতা৷ এটাও ফেক৷ মানে আপনার বুদ্ধমূর্তির মতোই৷’ আগ্রহী হয়ে রাহুল আরও ভালো করে দেখার জন্য মূর্তিটাকে পাশ থেকে তুলে নিজের সামনে আনল৷ সেটা তুলতে গিয়েই সে বুঝতে পারল, প্রায় এক ফুট লম্বা মূর্তিটা যথেষ্ট ভারী৷ রাহুল দেখতে লাগল মূর্তিটা৷ সত্যিই বড়ো অদ্ভুত দেখতে৷ বজ্রাসনে বসে আছেন মাথায় মুকুট আর সর্বাঙ্গে অলংকার পরা স্ফীতোদর এক দেবতা৷ তাঁর ডান পা-টা পেটের কাছে গোটানো আর বাঁ পা বাইরের দিকে একটু প্রসারিত৷ দেবতার ডান হাতে ধরা আছে ফলজাতীয় কিছু একটা, আর বাঁ হাতে ধরা বেজি বা নেউল ধরনের কোনও প্রাণী৷ দেবতার পদতলে এক নারীমূর্তি৷ তার হাতে প্রস্ফুটিত পদ্ম৷

মূর্তিটা ভালো করে দেখার পর রাহুল জানতে চাইল, ‘ইনি কীসের দেবতা?’

শেঠ মলল বললেন, ‘হিন্দুদের অর্থসম্পদের দেবতা যেমন কুবের, ঠিক তেমনই তিববতিদের অর্থসম্পদের দেবতা হলেন এই জম্ভলা৷ মূর্তির ডান হাতে রয়েছে নরবু৷ ওটা এক ধরনের ফল৷ আর বাম হাতে যে বেজি ধরা আছে, জম্ভলাদেব তার পেট টিপলে বেজিটা হিরা-চুনি-পান্না অর্থাৎ রত্ন বমন করে বলে তিববতি ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে৷ জম্ভলা দেবতা একই সঙ্গে অপদেবতাদেরও দেবতা৷ কুবেরের অনুচর যেমন যক্ষরা, তেমনই জম্ভলা দেবতার অনুচর হল অপদেবতারা৷ এই মূর্তিটার পায়ের নীচে বসে থাকা নারীমূর্তি আসলে ডাকিনীমূর্তি৷ অর্থসম্পদ আর অপদেবতাকে বশ করার জন্য জম্ভলা দেবতার পূজা করা হয়৷’

দেবতা বেজির পেট টিপলে সে রত্ন বমন করে! রাহুল বেশ অবাক হয়ে গেলে মলমলের কথা শুনে৷ এর পর সে কৌতূহলবশত আরও কিছু জানতে যাচ্ছিল এই মূর্তিটার বিষয়ে, কিন্তু তার আগেই পাশ থেকে বাংলাতেই একটা প্রশ্ন ভেসে এল—‘আপনিও কি অ্যান্টিক কালেক্টর? কলকাতা থেকে এসেছেন?’ রাহুলের মুখোমুখি ফিরে দাঁড়িয়েছেন পাশের ভদ্রলোক৷ উত্তর দেবার আগে রাহুল তাকাল তাঁর দিকে৷ নিখুঁতভাবে কামানো লোকটার ফরসা মুখমণ্ডলে একটা মঙ্গোলয়েড ভাব আছে৷ চোখ নরুন-চেরা হলেও দৃষ্টি বেশ তীক্ষ্ণ৷ রাহুল হেসে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমি কলকাতা থেকে এসেছি৷ তবে আমি অ্যান্টিক কালেক্টর নই৷ ইচ্ছা থাকলেও অ্যান্টিক মূর্তি সংগ্রহের সামর্থ্য আমার নেই৷’

ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘ওই একই ব্যাপার হল৷ আমিও আপনার মতোই একজন কালেক্টর৷ তবে আপনি যেমন বুদ্ধমূর্তি সংগ্রহ করেন, তেমন আমার শখ হল তিববতি দেবতাদের মূর্তি সংগ্রহ করা৷ মহাকাল, মঞ্জুশ্রী, তারাদেবী—এসব নানারকম তিববতি দেবদেবীর মূর্তি৷ তা আপনি তো হোটেল অর্কিড-এ উঠেছেন তা-ই না? আমিও ওখানেই উঠেছি৷ আপনাকে দেখেছি সেখানে৷ আমার নাম পদ্ম শ্রীবাস্তব৷ কলকাতায় বহুদিন আছি৷ সেখান থেকেই এসেছি৷’

রাহুল জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, হোটেল অর্কিড-এই৷ আমি রাহুল৷’ এই বলে সে করমর্দনের জন্য হাত বাড়াল শ্রীবাস্তবের দিকে৷ শ্রীবাস্তবও হাত বাড়ালেন তার দিকে৷ তাঁর আস্তিনটা গোটানো৷ করমর্দনের সময় রাহুল লক্ষ করল তাঁর ডান হাতের পাতায়, কবজিতে অসংখ্য কাটাকুটির দাগ৷ হয়তো ভদ্রলোক কোনও সময় কোনও দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন৷

তিনি এর পর শেঠ মলমলের উদ্দেশে বললেন, ‘এ মূর্তিটা আপনি কত টাকায় বিক্রি করবেন?’

মলমল মূর্তিটা চট করে কাউন্টারের দেরাজে নামিয়ে রেখে বললেন, ‘না, এটা আমি বিক্রি করব না৷’

শ্রীবাস্তব হেসে বললেন, ‘এটা কেন আপনি বিক্রি করবেন না তা আমি জানি৷ কারণ মূর্তিটা ফেক নয়, আসল মূর্তি, এবং এটা কোন জায়গার জিনিস, তাও আমি অনুমান করতে পারছি৷’

ভদ্রলোকের কথা শুনে ফ্যাকাশে হয়ে গেল মলমলের মুখ৷ একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘তবে এটা চোরাই মূর্তি নয়৷ যেভাবে এ মূর্তি সংগ্রহ করা হয়, সেভাবেই করেছি৷ এটা আমি নিজের কাছে রাখব বলেই বেচব না৷’

শ্রীবাস্তব প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘তবে আপনার ভয় পাবার কোনও কারণ নেই৷ আপনি যখন এই সৌভাগ্যের দেবতাকে সংগ্রহ করেছেন, তখন ওটা আপনার কাছেই থাকুক৷ কিউরিয়ো ব্যবসায় এসব চলে আমি জানি৷ আমি এবার চলি৷’

শেঠ মলমল তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘হ্যাঁ, আসুন৷ অন্য তেমন কিছু অ্যান্টিক পেলে আপনাকে আমি জানাব৷’ কথাগুলো বলে তিনি রাহুলকে তার রসিদটা দিলেন৷ রসিদ আর মূর্তিটা নিয়ে রাহুল শ্রীবাস্তবের সঙ্গেই দোকানের বাইরে বেরোল৷

রাস্তায় ওঠার পর শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আপনি কি হোটেলে ফিরবেন? তবে একসঙ্গে ফিরব৷’

রাহুল জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ফিরব৷ একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাওয়া যাক৷ আমি একটা সরকারি চাকরি করি৷ অডিটর৷ সেজন্য কালিম্পঙে মাঝে মাঝে আসতে হয়৷ তা আপনি কী করেন? চাকরি না ব্যবসা?’

শ্রীবাস্তব মৃদু হেসে বললেন, ‘আসলে আমার পেশাটা একটু অদ্ভুত৷ একসময় আমার একটা স্নেক ফার্ম ছিল বারাসতের দিকে৷ এখন আর নেই৷ তবে আমি এখন সাপ ধরি সরকারের গবেষণাগারের জন্য৷ ওর থেকে ভেনাম বার করা হয়৷ জানেন তো, এই হিমালয়ের জঙ্গলে কিং কোবরা বা রাজগোখরো পাওয়া যায়৷ বলতে গেলে সে কাজের জন্যই আমার এখানে আসা৷ দু-দিন আগে ডেলো পাহাড়ের ওদিক থেকে ধরেওছি একটা৷ এখানে আরও ক’দিন থাকব আমি৷ লাভা-লোলেগাঁওয়ের দিকে যাব৷ যদি আরও দু-একটা সাপ ধরা যায়…৷’

রাহুল বলল, ‘আমার ওদিকে বেড়াতে যাবার ইচ্ছা আাছে৷ আপনার পেশাটা বড়ো অদ্ভুত৷ তা সাপটাকে নিয়ে কোথায় পাঠালেন?’

শ্রীবাস্তব হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘আশা করি ব্যাপারটা আপনি গোপনে রাখবেন৷ অন্য ট্যুরিস্টরা জানলে ভয় পেতে পারে৷ সাপটা আমার হোটেলের ঘরেই রাখা আছে৷ আপনি চাইলে দেখাতে পারি৷’

তাঁর কথা শুনে এবার সত্যিই চমকে উঠল রাহুল৷ সে বলল, ‘হ্যাঁ, দেখব৷’

মিনিট দশেকের মধ্যেই হোটেলে ফিরে এল রাহুলরা৷ দোতলায় রাহুলের একটা ঘরের পরই শ্রীবাস্তবের ঘর৷ তিনি তাঁর সাপ দেখাবার জন্য রাহুলকে সে ঘরে নিয়ে ঢুকে প্রথমে ভালো করে দরজা বন্ধ করলেন৷ তারপর রাহুলকে কিছুটা তফাতে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরের এক কোনায় টেবিলের ওপর রাখা বাচ্চা ছেলেদের স্টিলের স্কুল বাক্সর মতো একটু বড়ো একটা কাঠের বাক্সর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ টেবিলটার গায়েই একটা হাত দুই লম্বা স্টিলের লাঠি রাখা৷ তার মাথাটা হুকের মতো বাঁকানো৷ রাহুল চিনতে পারল লাঠিটা৷ ওকে বলে ‘স্নেহ হুক’৷ ডিসকভারি চ্যানেলে একবার এক সর্পবিশারদের সাপ ধরার ছবি দেখানো হয়েছিল৷ সেখানে লোকটার হাতে ও লাঠি দেখেছিল রাহুল৷ শ্রীবাস্তব স্নেক হুকটা তুলে নিলেন হাতে৷ রাহুলকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বলে এর পর তিনি সন্তর্পণে বাক্সটা খুলে, সাবধানে হুকটা বাক্সর মধ্যে ঢুকিয়ে তার ভিতর থেকে ধীরে ধীরে ঠেলে বার করে আনলেন বিরাট লম্বা মোটাসোটা একটা সাপ৷ আকারে অন্তত সেটা দশ ফুট হবে৷ গায়ের রং কালচে খয়েরি৷ এতে বড়ো সাপ এর আগে কোনও দিন দেখেনি রাহুল৷ সাপটাকে তিনি সাবধানে নামিয়ে রাখলেন টেবিলের ওপর৷ প্রাণীটা এদিক-ওদিকে মৃদু মৃদু মাথা নাড়াচ্ছে, আর বাতাসে ছুড়ে দিচ্ছে তার চেরা জিভ৷ বিস্মিত রাহুল তাকিয়ে রইল প্রাণীটার দিকে৷ হঠাৎই সাপটা মাথাটা টেবিল থেকে ফুট তিনেক ওপরে উঠিয়ে ফণা মেলল৷ তারপর তীব্র শব্দ করল—হি-স-স-স… যেন কোনও কানাডিয়ান স্টিম ইঞ্জিনের শব্দ! রাহুল শিউরে উঠল৷ এর পরই অবশ্য ফণা নামিয়ে মাথাটা নিজের দেহকুণ্ডলীর মধ্যে ঢুকিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেল মহাসর্প৷ শ্রীবাস্তব সাপটার দিকে চোখ রেখে রাহুলের উদ্দেশে বললেন, ‘হিমালয়ান কিং কোবরা৷ সাক্ষাৎ যমের দোসর! ভয়ংকর রাগি প্রাণী৷ এমন রাগি যে এরা মাটির ওপর পড়া উড়ন্ত পাখির ছায়াকেও কামড়াতে চায়! তবে ও ধরা পড়ার দিনই ওকে একটা আস্ত মুরগি খাইয়েছি৷ এখনও হজম হয়নি৷ পেটটা ফুলে আছে দেখুন৷ আপাতত কয়েক সপ্তাহের জন্য নিশ্চিন্ত৷ ও শান্তই থাকবে৷ নইলে ওকে বাইরে বার করে আপনাকে দেখাতে পারতাম না৷’

রাহুল বলল, ‘আপনার সাহস আছে বটে!’

শ্রীবাস্তব হেসে জবাব দিলেন, ‘অনেকেই সে কথা বলে৷ হয়তো বা সেটা সাহস নয়, দুঃসাহস৷’

এরপর তাঁর সঙ্গে আরও দু-চারটে কথা বলে নিজের ঘরে ফিরে এল রাহুল৷

দুই

বিকালবেলা সে দিন হোটেল ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছিল রাহুল৷ ইতিউতি একটু ঘোরাঘুরি করে সে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়েছিল গাড়ির খোঁজে, পরদিন লাভা-লোলেগাঁও যাবার জন্য৷ বেশ কয়েকবার কালিম্পং এলেও ওই দু-জায়গা তার দেখা হয়নি৷ তার ইচ্ছা লাভা-লোলেগাঁওতে দু-রাত্রি থাকার৷ কিন্তু ভরা ট্যুরিস্ট সিজন এই মে-জুন মাস৷ সব গাড়ি হয় আগে থেকে বুকড, নয়তো পাঁচগুণ ভাড়া হাঁকছে৷ গাড়ি ঠিক না করেই সে হোটেলে ফিরে এল৷ মনে মনে সে ঠিক করে নিল যে সে সকালবেলা আর একবার মনোমতো গাড়ির খোঁজ করবে৷ যদি গাড়ি না পাওয়া যায়, তবে শেয়ারের জিপ ধরে শিলিগুড়ি রওনা হবে কলকাতায় ফেরার জন্য৷

পাহাড়ি অঞ্চলে রাত আটটার মধ্যেই সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়৷ অন্য দিনের মতোই ওই সময় এ দিন শুয়ে পড়ল রাহুল৷ স্বাভাবিক নিয়মেই রাতটা কেটে গেল৷ শুধু মাঝরাতে একবার তার কানে যেন ভেসে এসেছিল সেই হি-স-স-স শব্দটা৷ মিনিটখানেকের জন্য ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার৷ বেড সুইচ থেকে বাতিও জ্বালিয়েছিল সে৷ তবে সেই শব্দটা শ্রীবাস্তবের ঘর থেকে ভেসে আসা শব্দ, নাকি রাহুলের মনের ভুল তা বুঝতে না পেরে রাহুল আবার বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়েছিল৷

সকালবেলা রাহুলের যখন ঘুম ভাঙল, তখন আটটা বেজে গেছে৷ আধঘণ্টার মধ্যেই সে তৈরি হয়ে নিল বাইরে বেরোবার জন্য৷ তাকে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যেতে হবে৷ তৈরি হয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরোতেই তার নজর গেল শ্রীবাস্তবের ঘরের দিকে৷ ঘর ভিতর থেকে বন্ধ৷ তার মনে পড়ে গেল গতকাল রাতের শব্দটার কথা৷ ‘হয়তো ভদ্রলোকের সঙ্গে আর দেখা না-ও হতে পারে৷ একবার দেখা করে যাই৷’ —এই ভেবে রাহুল তাঁর ঘরের সামনে এগিয়ে দরজায় নক করল৷

দরজাটা প্রথমে একটু ফাঁক করলেন ভদ্রলোক৷ তারপর রাহুলকে দেখে দরজা খুলে বললেন, ‘গুড মর্নিং৷ ভিতরে আসুন৷’

ঘরে ঢুকল রাহুল৷ কিন্তু শ্রীবাস্তবের দিকে ভালো করে তাকাতেই চমকে উঠল সে৷ ভদ্রলোক মনে হয় সদ্য বিছানা থেকে উঠলেন৷ খালি গায়ে সম্ভবত তিনি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন৷ সেভাবে উঠেই তিনি দরজা খুলেছেন৷ রাহুল দেখল শুধু হাতে নয়, তাঁর অনাবৃত গা জুড়েই নানা ক্ষতচিহ্ন আঁকা হয়ে আছে! যেন কেউ ধারালো কোনও কিছু দিয়ে চিরেছিল তাঁর সর্বাঙ্গ৷ রাহুল তাকিয়ে রইল তাঁর দেহের দিকে৷ ব্যাপারটা সম্ভবত বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে শ্রীবাস্তব বিছানা থেকে একটা চাদর তুলে নিজের শরীরে জড়িয়ে নিলেন৷ তারপর তিনি রাহুলের উদ্দেশে বললেন, ‘এই সাতসকালে কোথায় বেরোচ্ছেন?’

রাহুল বলল, ‘ইচ্ছা আছে লাভা-লোলেগাঁওয়ের দিকে যাবার৷ গতকাল ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে খোঁজ নিয়ে গাড়ি পেলাম না৷ সব বুকড৷ দেখি আজ পাই কি না৷ নইলে কলকাতার দিকেই রওনা হব৷’

রাহুলের কথা শুনে কী যেন একটু ভাবলেন শ্রীবাস্তব৷ তারপর বললেন, ‘আমিও তো ওইদিকেই যাব৷ কাল সম্ভবত ব্যাপারটা আপনাকে একবার বলেছিলাম৷ সাপ ধরা ছাড়াও ওদিকে একটা মন্দির আছে, সেখানেও আমি যাব৷ আপনি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গী হতে পারেন৷ বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাবেন৷ অজানা জায়গা, অচেনা পরিবেশ…’

রাহুল প্রশ্ন করল, ‘কীসের মন্দির?’

একটু চুপ করে থেকে তিনি জবাব দিলেন, ‘জম্ভলাদেবের মন্দির৷ মেঘ ঢাকা এক পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে মন্দিরটা৷ লোকজন সাধারণত ও জায়গাতে যায় না৷ জম্ভলাদেব যেমন একাধারে সম্পদের দেবতা, তেমনই আবার অপদেবতাদেরও দেবতা৷ এ জন্য স্থানীয় লেপচারা এড়িয়ে চলে ও জায়গা৷ আর ট্যুরিস্টরা ওখানে যায় না, কারণ ও মন্দিরের সন্ধান তারা জানে না৷ তা ছাড়া পাহাড়ের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘণ্টা চারেক ট্রেক করে ওখানে যেতে হয়৷ যাবেন আপনি?’

শ্রীবাস্তবের কথা শুনে রাহুলের হঠাৎ মনে পড়ে গেল মলমল কিউরিয়ো শপের সেই জম্ভলামূর্তিটার কথা৷ সে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, মলমল ওই জম্ভলামূর্তিটা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন?’

শ্রীবাস্তব প্রথমে জবাব দিলেন, ‘আমার ধারণা মলমল ওই মূর্তিটা জম্ভলা মন্দির থেকেই কোনওভাবে সংগ্রহ করেছে৷ ওটা বেশ প্রাচীন মূর্তি৷ তা ছাড়া অপদেবতাদের ভয়ে সাধারণত জম্ভলামূর্তি কেউ বানায় না৷’ এরপর একটু থেমে তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার সঙ্গে ওখানে গেলে কোনও অ্যান্টিক মূর্তি কপাল ভালো থাকলে আপনিও পেয়ে যেতে পারেন৷ মন্দির সংস্কারের জন্য অথবা অন্য কোনও কারণে অর্থের প্রয়োজন হলে অনেক সময় ওরা ছোটোখাটো মূর্তি নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেয়৷’

শ্রীবাস্তবের কথা শুনে কিছুক্ষণ ভাবল রাহুল৷ শ্রীবাস্তব লোকটাকে আপাতদৃষ্টিতে তার খারাপ বলে মনে হচ্ছে না৷ তা ছাড়া তাঁর মতো একজন মধ্যবয়সি লোক রাহুলের মতো একজন ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের যুবককে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কী-ই বা করবেন? রাহুল কোনও পয়সাওয়ালা লোক বা বিখ্যাত লোকও নয় যে তাকে কেউ অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করবে৷ শ্রীবাস্তবের সঙ্গী হলে তার একটা নতুন জায়গা দেখা হয়ে যেতে পারে৷ তা ছাড়া ভদ্রলোকের বক্তব্য ঠিক হলে হয়তো কোনও অ্যান্টিক মূর্তিও মিলে যেতে পারে! কোনও একটা অ্যান্টিক মূর্তি সংগ্রহের শখ রাহুলের বহুদিন ধরে৷ কিন্তু অর্থাভাবে সংগ্রহ করা হয়নি৷ সে শখও হয়তো মিটে যেতে পারে! —এসব ভেবে রাহুল শেষ পর্যন্ত বলল, ‘আমি রাজি আছি আপনার সঙ্গী হতে৷ কিন্তু আপনার শর্ত কী কী?’

শ্রীবাস্তব হেসে জবাব দিলেন, ‘আমার কোনও শর্ত নেই! আর এক ঘণ্টার মধ্যেই কিন্তু রওনা হব আমি৷ আপনি সেইমতো তৈরি হয়ে নিন৷ ঠিক সাড়ে নটায় রওনা হব৷ গাড়ি হোটেলের বাইরেই লাগানো আছে৷’

রাহুল বলল, ‘ঠিক আছে৷ গাড়ির অর্ধেক খরচ কিন্তু আমি দেব৷ আপনি না করতে পারবেন না৷’

শ্রীবাস্তব হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, তা-ই হবে৷’

নিজের ঘরে আবার ফিরে গিয়ে মালপত্র গুছিয়ে নিল রাহুল৷ সেসব নিয়ে নীচে নেমে ডাইনিং রুমে প্রথমে ব্রেকফাস্ট সারল৷ তারপর হোটেলের বিলপত্র মিটিয়ে দিয়ে সাড়ে নটার একটু আগেই হোটেলের বাইরে এসে দাঁড়াল৷ ঠিক সাড়ে নটাতেই বাইরে বেরিয়ে এলেন মিস্টার শ্রীবাস্তব৷ পিঠে একটা বিরাট বড়ো রুকস্যাক৷ ডান হাতেও বেশ বড়ো একটা প্যারাশুট কাপড়ের ব্যাগ আর বাঁ হাতে বুকের কাছে ধরে থাকা সেই কাঠের বাক্সটা৷ রাহুল জানে ওই বাক্সর মধ্যে কী আছে৷

হোটেলের সামনেই রাস্তার একপাশে একটা পুরোনো জিপ দাঁড়িয়ে আছে৷ রাহুলকে নিয়ে তিনি জিপটার দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রথমে নিজের, তারপর রাহুলের মালপত্র জিপের পিছনে তুলে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলেন৷ তা-ই দেখে রাহুল একটু অবাক হয়ে বলল, ‘ড্রাইভার কই? আপনিই চালাবেন নাকি?’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই চালাব৷ ড্রাইভার নিলে অনেক ঝামেলা তার থাকা-খাওয়া নিয়ে৷ তাই শুধু গাড়িটাই ভাড়া নিয়েছি৷ পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাবার অভ্যাস আছে আমার৷ আর পথটাও আমি চিনি৷ উঠে পড়ুন৷’

রাহুল উঠে পড়ল শ্রীবাস্তবের পাশে৷ তারপর একবার পিছন দিকে তাকাল৷ সেই কাঠের বাক্সটা তো পিছনেই আছে!

শ্রীবাস্তব মনে হয় রাহুলের মনের ভাব বুঝতে পেরে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করে হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, ‘আপনার চিন্তার কোনও কারণ নেই৷ বাক্সর মুখটা ভালোভাবেই বন্ধ করা আছে৷’

রাহুলদের হোটেলটা কালিম্পং ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে একটু নীচের দিকে৷ সেখান থেকে জিপ নিয়ে ওপরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে উঠে বাজারের রাস্তা প্রথমে ধরল তারা৷ কিন্তু সে রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল তাদের৷ সামনে সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ সম্ভবত কিছু একটা হয়েছে৷ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের চোখে-মুখেও কেমন যেন একটা উত্তেজনার ভাব! কী হয়েছে ব্যাপারটা! শ্রীবাস্তব সামনে কী হয়েছে দেখে আসার জন্য গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠিক তখনই রাহুল রাস্তার পাশে পরিচিত একজনকে দেখতে পেল৷ তাদের হোটেলের ম্যানেজার আচার্যবাবু৷ তাঁর হাতে দুটো থলে৷ সম্ভবত তিনি বাজার করতে বেরিয়েছিলেন৷ রাহুলের সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হতে তিনি গাড়ির সামনে এসে বললেন, ‘আপনারা চলে যাচ্ছেন নাকি?’

রাহুল জবাব দিল, ‘হ্যাঁ যাচ্ছি৷ সামনে কিছু হয়েছে নাকি?’

আচার্যবাবু বললেন, ‘এখানকার এক কিউরিয়ো শপের মালিক মলমলকে দোকানের মধ্যেই ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে! তাঁর সারা দেহ কেউ যেন ফালা ফালা করেছে৷ জ্ঞান থাকলেও মলমল কিছুতেই বলতে পারছে না কী হয়েছে৷ আতঙ্কে কথা বন্ধ হয়ে গেছে!’

বিস্মিত রাহুল বলে উঠল, ‘ডাকাতির ঘটনা?’

ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘তা ঠিক বলতে পারব না৷ হতেও পারে৷ তবে এখানকার কিছু লোক আবার অন্য কোথাও বলছে৷ তাদের ধারণা, কোনও অপদেবাতর কাজ এটা৷ এইসব কিউরিয়ো শপে নানা অপদেবতার মূর্তি-টুর্তি বিক্রি হয়, জানেন তো৷ সেইসব কোনও অপদেবতাই নাকি এ কাণ্ড ঘটিয়েছে৷ এখনই লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল৷ রাস্তা এবার খুলে যাবে৷’

ভদ্রলোকের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সামনের গাড়িগুলো এগোতে শুরু করল৷ রাস্তা খুলে গেছে৷ ম্যানেজারবাবুও অন্য দিকে এগোলেন৷ রাহুল দেখল শ্রীবাস্তবের মুখটা যেন বেশ গম্ভীর হয়ে গেল কথা শুনে৷ রাহুল তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপারটা কী হল মনে হয়?’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘আপনি যা শুনলেন, আমিও তা শুনলাম৷ বেশি জানা-বোঝার দরকার আমাদের নেই৷ অন্যদের মতো আমরাও শুধু ওঁর কাস্টমার ছিলাম৷ আমি কিউরিয়ো কিনতে এর আগে কয়েকবার গেছি ওঁর দোকানে৷ তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা ছিল না ওঁর সঙ্গে৷ গতকাল ঘটনাচক্রে ওঁর দোকানে গিয়ে ওই জম্ভলামূর্তিটা আমার চোখে পড়ে৷ এসব ব্যাপার নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামানোই ভালো৷ উটকো কোনও ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়তে পারে৷’

রাহুল জবাব দিল, ‘আপনাকে এমনিই কথাটা জিজ্ঞেস করলাম৷ লোকটা পরিচিত ছিল, তাই খবরটা শুনে খারাপ লাগছে, উত্তেজনা বোধ হচ্ছে৷’

জিপ যখন দোকানটার সামনের রাস্তা দিয়ে গেল, তখন দোকানের সামনের ফুটপাথে বেশ বড়ো একটা জটলাও চোখে পড়ল৷ গাড়ি চালাতে চালাতে সেদিকে তাকিয়ে একটু আনমনাভাবে শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আমার ধারণা, জম্ভলামূর্তিটা শেঠ মলমল কোনও অসাধু উপায়ে হস্তগত করেছিলেন৷ হয়তো যাদের মূর্তি, তারা আবার সেটা ফেরত নিয়ে গেল!’

রাহুল বলল, ‘তার মানে? কথাটা ঠিক বুঝলাম না৷’

শ্রীবাস্তব প্রশ্ন শুনে যেন তাঁর চিন্তার জাল কাটিয়ে উঠে সতর্কভাবে বললেন, ‘এটা আমার অনুমানমাত্র৷ আসলে ওইসব প্রাচীন মূর্তি নিয়ে অনেক সময় অ্যান্টিক ডিলার, স্মাগলারদের মধ্যে খুনজখম হয়৷ হয়তো জম্ভলামূর্তিটা নিয়েই কিছু ঘটে থাকতে পারে৷’

এ কথা বলার পর তিনি প্রসঙ্গ পালটে ফেলে বললেন, ‘এসব আলোচনা থাক৷ এসব দুর্ঘটনা মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে৷ আমাদের সঙ্গে তো এই ঘটনার কোনও যোগাযোগ নেই৷ এসব নিয়ে ভাবলে বেড়াবার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে৷’

রাহুল বলল, ‘ঠিক বলেছেন৷ অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করাই ভালো৷’

কালিম্পং শহর ছাড়িয়ে জিপ লাভা যাবার রাস্তা ধরল৷ মসৃণ পিচ ঢালা রাস্তা, কিন্তু সামনে ট্যুরিস্ট গাড়ির লম্বা মিছিল৷ অসম্ভবরকম শ্লথ গাড়ির গতি৷ পাকদণ্ডির বাঁকগুলোতে থেমে থাকতে হচ্ছে উলটো দিকের গাড়িগুলোকে পথ করে দেবার জন্য৷ লাভা মাত্র এক ঘণ্টার পথ৷ সেখানে পৌঁছোতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লেগে গেল রাহুলদের৷ বেশ ওপরে উঠে এসেছে রাহুলরা৷ বাতাসে বেশ ঠান্ডা আছে৷ লাভার ছোট্ট গাড়ি স্ট্যান্ডটাতেও বেশ ভিড়৷ কিছু দূরে আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট বড়ো লাল রঙের স্থাপত্য দেখিয়ে শ্রীবাস্তব বললেন, ‘ওটাই হল লাভার বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠ৷ ওর নাম জ্যাং ঢোক পালারি মনাস্ট্রি৷ ওখানে বহু দুষ্প্রাপ্য বৌদ্ধ পুথি আছে৷ ফেরার সময় মনাস্ট্রিটা দেখাব আপনাকে৷’

জিপ থেকে নেমে একটা ছোট্ট মোমোর দোকানে খেতে ঢুকল ওরা দুজন৷ খাদের ধারে ছোট্ট কাঠের দোকান৷ কাচের জানলা দিয়ে দূরের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে৷ অনেক উঁচুতে পাইনবন ছাওয়া একটা সবুজ পাহাড়ের মাথা ঘন মেঘে ঢাকা৷ যেন ও জায়গাটা সত্যিই মেঘের দেশ৷ রাহুল গরম মোমো খেতে খেতে পাহাড়টার দিকে শ্রীবাস্তবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘ওই পাহাড়টা কেমন মেঘে ঢাকা! যেন পৃথিবীর বাইরের কোনও জায়গা৷’

শ্রীবাস্তব সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই পাহাড়েই উঠব আমরা৷ ওটা সত্যিই মেঘের দেশ৷ ওই পাহাড়ের ঢালেই জম্ভলা দেবতার মন্দির আছে৷’

এ কথা বলার পরই তিনি কাছাকাছি অন্য একটা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে, পাহাড়টার মাথায় বর্ষার মেঘ জমছে৷ মেঘটা এদিকেই আসছে৷ বৃষ্টি নামবে মনে হয়৷ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হবে৷ পাহাড়ে একবার বৃষ্টি নামলে কতক্ষণে থামবে, তার ঠিক নেই৷ রাস্তায় আটকে যেতে হবে৷’

রাহুলরা তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বাইরে বেরিয়ে জিপে উঠে বসল৷ শ্রীবাস্তব জিপ স্টার্ট করলেন৷

তিন

লাভা শহর পিছনে পড়ে রইল৷ পাকদণ্ডি বেয়ে জিপটা আরও ওপরে উঠতে শুরু করল৷ গাড়ি চালাতে চালাতে শ্রীবাস্তব বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন৷ সেই কালো মেঘটা ক্রমশ আরও ঘন হয়ে যেন তাদের মাথার ওপরেই এগিয়ে আসছে৷ রাহুলদের যেখানে গন্তব্য, সেই সাদা মেঘে ঢাকা পাহাড়টা দেখিয়ে সে জানতে চাইল, ‘ওখানে যারা থাকে, তারা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে কীভাবে? খুব মুশকিল হয় নিশ্চয়ই?’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘ওদের তথাকথিত সভ্য জগতের সঙ্গে যোগাযোগের তেমন দরকার হয় না৷ খুব প্রয়োজন হলেই তবে ওরা কোনও সময় নীচে নামে৷ জনসংখ্যা ওখানে খুব কম৷ পাহাড়ের ঢালে কিছু সবজি চাষ হয়, ঝরনাতে ছোটো ছোটো মাছ পাওয়া যায়, জঙ্গলে খরগোশ, পাখি—এসব শিকার মেলে, তাতেই ওদের চলে যায়৷’

রাহুল আবার জানতে চাইল, ‘জম্ভলাদেবের মন্দির কি আসলে বৌদ্ধ মঠ?’

সতর্কভাবে রাস্তার মোড় ঘুরতে ঘুরতে শ্রীবাস্তব বললেন, ‘না, ওটা বৌদ্ধ মঠ নয়৷ আমাদের একটা ভুল ধারণা আছে যে তিববতি মানেই বৌদ্ধ৷ ঠিক যেমন বাইরের পৃথিবীর অনেকেই ধারণা করেন যে ভারতীয় মানেই হিন্দুধর্মাবলম্বী হতে হবে৷ এ দেশের তিববতি মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ হলেও অনেক তিববতি আছে, যারা বিভিন্ন লৌকিক দেবতার পূজা করে, ভূত-প্রেত, অপদেবতার পূজা করে৷ বরং তাদের কিছু লোকাচারই বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে মিশে গেছে৷ লামা তারানাথ বা তারানাথ তান্ত্রিক যেমন বহু শতাব্দী আগে তিববতের বৌদ্ধধর্মে তন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই৷ বৌদ্ধদের থেকেও বরং হিন্দু তন্ত্রসাধনার সঙ্গে ওদের আচার-আচরণের বেশ মিল আছে৷ খেয়াল করবেন, জম্ভলা মন্দির নিয়ে আলোচনা করার সময় আমি তাই মন্দির শব্দটাই ব্যবহার করেছি৷ মঠ বা গুম্ফা শব্দ বলিনি৷ জম্ভলাদেবের মন্দির৷’

কথা বলতে বলতে সবুজ বনপথে উঠে এল গাড়ি৷ পথের দু-পাশে ঘন পাইনবন৷ বড়ো বড়ো গাছ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রাস্তার ঢাল থেকে সোজা আকাশের দিকে উঠে নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে আছে৷ প্রাচীন গাছগুলোর গায়ে জমাট বেঁধে আছে শ্যাওলা অথবা মসের আবরণ৷ রাস্তার পাশের গাছগুলোর গায়ে ফার্নের ঝোপ৷ কোনও গাছের ডাল থেকে বাতাসে উড়ছে সুতোর মতো, কালচে ঝুলের মতো কোনও উদ্ভিদ৷ শুয়ে থাকা বিশাল গাছের গুঁড়ির ওপর ফুটে আছে থালার মতো দেখতে ছত্রাক৷ সূর্যের আলো দিনের বেলাই খুব একটা বেশি প্রবেশ করে না এ পথে৷ আধো-অন্ধকার খেলা করে৷ চারপাশে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ৷ জঙ্গল থেকে শুধু বাতাসের খসখস শব্দ আর ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে৷ এ পথে আরও কিছুক্ষণ ওপরে ওঠার পর হঠাৎই যেন মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার গাঢ় হয়ে এল৷ যেন রাত্রি ঘনিয়ে এল রাস্তায়৷ আর তারপরই মুষলধারে বৃষ্টি নামল৷ শ্রীবাস্তব তাড়াতাড়ি রাস্তার ধারে একটা পাথুরে দেওয়ালের গা ঘেঁষে জিপটা থামিয়ে জিপের ক্যানভাসের পর্দাগুলো নামিয়ে দিলেন৷ সে কী প্রচণ্ড বৃষ্টি! পাহাড়ি নির্জন রাস্তায় এ অভিজ্ঞতা কোনও দিন হয়নি রাহুলের৷ বৃষ্টির তোড়ে আন্দোলিত হচ্ছে বড়ো বড়ো গাছের মাথাগুলো৷ পাথরের ওপর বৃষ্টির ফোঁটায় একটা অদ্ভুত গুমগুম শব্দ হচ্ছে৷ কখনও কখনও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন৷ ওপর থেকে জলস্রোত নেমে এসে পথ ভাসিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে৷ গাড়ির ভিতর চুপচাপ বসে তারা দেখতে লাগল বৃষ্টির তাণ্ডব৷ রাহুলের এক একসময় মনে হতে লাগল, এই বৃষ্টি মনে হয় আর কোনও দিন শেষ হবে না!

কিন্তু সব দুর্যোগের মতোই এই দুর্যোগও একসময় শেষ হল৷ ঘণ্টাখানেক পর ধীরে ধীরে একসময় বৃষ্টি থেমে এল৷ পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো দেখা দিল৷ আবার জিপ স্টার্ট করলেন শ্রীবাস্তব৷ বৃষ্টিভেজা পাথুরে রাস্তা দিয়ে সাবধানে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি বললেন, ‘বৃষ্টি থামল ঠিকই, কিন্তু আজ আর আমাদের গন্তব্যে পৌঁছোনো যাবে না৷ ট্রেক করে মন্দিরে পৌঁছোতে অন্ধকার হয়ে যাবে৷ তা ছাড়া সদ্য বৃষ্টি হল৷ পাহাড়ের গা থেকে জল চুঁইয়ে ঢালগুলো পিছল হয়ে আছে৷ ট্রেক করাও বিপজ্জনক৷’

রাহুল বলল, ‘তাহলে কী হবে?’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আমি ভাবছি আরও কিছুটা এগিয়ে ট্রেকিং পয়েন্টে জিপেই রাত কাটিয়ে দেব৷ আপনি চাইলে আমি অবশ্য আরও এগিয়ে লোলেগাঁওতে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারি৷ সে ক্ষেত্রে অবশ্য সকালে উঠে ট্রেকিং স্পট থেকে যাত্রা শুরু করতে আমাদের বেশ কিছুটা দেরি হয়ে যাবে৷’

রাহুল শুনে বলল, ‘না, হোটেলের দরকার নেই৷ আমিও আপনার সঙ্গে জিপেই থাকতে পারব৷’

ভদ্রলোক মনে হয় খুশি হলেন রাহুলের কথা শুনে৷ তিনি বললেন, ‘দেখবেন, নির্জন জঙ্গলপথে রাত কাটানো এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!’ সেই জঙ্গল-ঘেরা পাহাড়ি রাস্তায় আরও বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একসময় রাহুলদের জিপ থামল৷ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা দুজন৷

চারপাশে তাকিয়েই রাহুল বুঝতে পারল, তারা প্রায় সেই পাহাড়টার মাথায় উঠে এসেছে, যে পাহাড়টাকে সে নীচ থেকে মেঘে ঢাকা দেখতে পেয়েছিল৷ রাহুলদের ডান দিকে পায়ের নীচে পাহাড়ের ঢালে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে৷ যেন কেউ কুয়াশার চাদরে মুড়ে রেখেছে জায়গাটা৷ একটা অস্পষ্ট পায়ে চলা পথ নেমে গেছে সেদিকে পাইনবনের ভিতর দিয়ে৷ সেটা দেখিয়ে শ্রীবাস্তব বললেন, ‘ওটাই আমাদের রাস্তা৷ নীচের ওই মেঘের আড়ালেই লুকিয়ে আছে জম্ভলা দেবতার মন্দির৷’

রাহুল সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘কুবের দেবতার যে বাসস্থান বা যক্ষপুরী আমাদের কল্পলোকে ভেসে ওঠে, সেও তো মেঘেরই রাজ্য৷ এই দুই দেবতার মধ্যে বেশ মিল আছে দেখছি৷’

জায়গাটা বেশ ভালোই৷ একটু খোলামেলা উন্মুক্তও বটে৷ পথের বাঁ দিকে রাস্তার গায়ে একটা ফাঁকা জায়গা পাহাড়ের গা থেকে ঝুলন্ত বারান্দার মতো বাইরে বেরিয়ে আছে, যে জায়গাতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তিনটে প্রাচীন পাইন গাছ৷ আকাশের দিকে মাথা তুলে তারা যেন নজর রাখছে সারা উপত্যকার ওপর৷ গাছগুলো যে কত প্রাচীন তা আন্দাজ করা শক্ত৷ তাদের কাণ্ড পুরু মসের আবরণে ঢাকা৷ এমনকি হিমেল বাতাসে তাদের পাতাগুলোতেও যেন ঝুলের মতো কীসের আবরণ পড়েছে৷ গাছগুলোর পায়ের তলায় সেই ফাঁকা জমিতে কিছু ঝোপঝাড়ও আছে৷ ফার্ন আর পিচার প্ল্যান্ট—কলসপত্রর গাছ৷ রাহুলরা এত ওপরে উঠে এসেছে বলে মাথার ওপরে আর মেঘ নেই৷ মেঘমুক্ত আকাশের পটে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে তুষারধবল পর্বতশ্রেণি৷ নগাধিরাজ হিমালয়৷ আর সেই পর্বতশ্রেণির ফাঁক গলে শেষ বিকালের রোদ এসে পড়েছে রাহুলদের সামনের ফাঁকা জমিটায় সেই প্রাচীন মহাবৃক্ষগুলোর পায়ের কাছে৷ খুব সুন্দর দৃশ্য৷

কিছুক্ষণ চারদিকের প্রকৃতিকে উপভোগ করার পর হঠাৎ শ্রীবাস্তব জিপের কাছে গিয়ে তার সেই কাঠের বাক্স আর স্নেক হুকটা বাইরে বার করে আনলেন৷ তা-ই দেখে রাহুল একটু বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আপনি কী করবেন ওগুলো নিয়ে?’

শ্রীবাস্তব একটু হেসে বললেন, ‘ভাবছি সাপটাকে এই ফাঁকা জমিতে একটু খুলে দিই৷ বেচারা অনেকক্ষণ বাক্সবন্দি হয়ে আছে৷’

রাহুল এবার স্পষ্টতই ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘খুলে দিই মানে! ও তো আমাদের কামড়াতে আসতে পারে? পালিয়েও যেতে পারে?’

শ্রীবাস্তব শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমি যতক্ষণ আছি, ততক্ষণ ও কামড়াবেও না, পালাবেও না৷ আমাকে মার্জনা করবেন, এই সাপটা যখন আপনাকে কাল দেখাই, তখন আপনি স্বল্প পরিচিত ছিলেন বলে ভরসা করে ওর সম্পর্কে পুরোটা সঠিক বলিনি আমি৷ সামান্য একটু মিথ্যা বলেছিলাম৷ ওকে আমি ক’দিন আগে এখান থেকে ধরিনি৷ ওকে আমি উদ্ধার করেছিলাম দশ বছর আগে তিস্তার চর থেকে৷ তখন ও মাত্র এক ফুট লম্বা ছিল৷ শিশু সাপটা হড়পা বানে ভেসে এসে কোনওরকমে নদীর ধারে একটা ছোটো গাছের ডালে জড়িয়ে ছিল৷ তারপর থেকে ও আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে সবসময়৷ অন্য সব সাপ ধরে আমি সরকারকে দিলেও ওকে আমি দিতে পারিনি৷ মায়া পড়ে গেছে বন্ধুর মতো৷ তবে সাপ সঙ্গে রাখা তো নিষিদ্ধ৷ তাই অনেক সময় মিথ্যা বলতে হয়৷ আপনি কিছু মনে করবেন না৷’

রাহুল খুব আশ্চর্য হয়ে গেল শ্রীবাস্তবের কথা শুনে৷ লোকটা বড়ো অদ্ভুত তো!

শ্রীবাস্তব এর পর একটু এগিয়ে রাস্তার পাশে ফাঁকা জমিটা যেখানে শুরু হচ্ছে, সে জায়গায় মাটির ওপর বাক্সটা নামালেন৷ তারপর বাক্সর মুখ খুলে স্নেক হুক দিয়ে ধীরে ধীরে সাপটাকে বার করে জমির ওপর ছাড়লেন৷ সাপটা প্রথমে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ মাটির ওপর পড়ে রইল৷ তারপর মাথাটা একটু ওপরে তুলে চারদিকে তাকাল৷ সূর্যের আলো এসে পড়েছে তার শরীরে৷ গতকালের চেয়ে আজ সাপটাকে যেন আরও বেশি বড়ো মনে হল রাহুলের৷ রাজগোখরো সত্যিই রাজকীয়! ভয়ংকর সুন্দর দেখতে! যেমন মোটা, তেমন লম্বা! তেমনই তার তেল চুকচুকে গাত্রবরন! সাপটা মাথা তুলে চারদিকে দেখে নিয়ে অতি মন্থর গতিতে রাজকীয় ভঙ্গিমায় এগিয়ে চলল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন গাছগুলোর দিকে৷ রাহুলও পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল শ্রীবাস্তবের পাশে৷ সাপটার দিকে চোখ রেখে শ্রীবাস্তব বললেন, ‘ও এখন ওই ঝোপঝাড়গুলোতে গিয়ে পোকামাকড় ধরে খাবে৷’

রাহুল বলল, ‘আপনি যে বললেন ওকে মুরগি খাইয়েছেন?’

শ্রীবাস্তব হেসে বললেন, ‘এ কথাটা কিন্তু মিথ্যা নয়৷ সত্যিই মুরগি খেয়েছে ও৷ তবে আমরা যেমন ভরা পেটেও অনেক সময় চিপস, ঝালমুড়ি, ফুচকা খাই, ওর পোকামাকড় ধরাটা তেমনই৷’

রাহুল এবার হেসে ফেলল তাঁর কথা শুনে৷ শ্রীবাস্তব কাঠের বাক্সটা হাতে তুলে নিলেন৷ দুজনে এগোতে লাগলেন জমিটার ভিতর৷ জমিটার মাঝখানে পৌঁছে গেল রাহুলরা৷ সেই মহাসর্প ততক্ষণে এগিয়ে গেছে পাইন গাছগুলোর পাদদেশের ঝোপঝাড়গুলোর দিকে৷ মাঝে মাঝে সে ছোটোখাটো ঝোপগুলোর মধ্যে মাথা ঢোকাচ্ছে, আবার তারপর মাথা বাইরে এনে চারপাশে তাকিয়ে তার চেরা জিভটা বাতাসে ছুড়ে দিচ্ছে৷ রাহুল আর শ্রীবাস্তব দেখতে লাগল তাকে৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে উপভোগ করতে লাগল কিরীটশোভিত হিমালয়ের অপূর্ব দৃশ্য৷ কনকনে ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে সেদিক থেকে৷ রাহুল তার মাফলারটা ভালো করে কান-মাথায় জড়িয়ে নিল৷

হঠাৎই পাইনবনের ঝোপের কাছে একটা পাইন গাছের গুঁড়ির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সাপটা৷ আর তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মাটি থেকে ফুট পাঁচেক উঁচু হয়ে বাঁশের মতো লম্বা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রাণীটার শরীর৷ তার বিরাট ফণাটা খুলে গেল৷ বাতাস চিরে সে তীব্র শব্দ করে উঠল, ‘হি-স-স-স!’

বেশ কিছুটা তফাত থেকেও রাহুলের কানে এসে লাগল তার ত্রুুদ্ধ গর্জন৷

গাছটার দিকে তাকিয়ে রাজগোখরো তার ফণাটা মৃদু দোলাতে দোলাতে স্টিম ইঞ্জিনের মতো শব্দ ছাড়তে লাগল—‘হি-স-হি-স-স-স!’ শ্রীবাস্তব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘নিশ্চয়ই ও কোনও কিছু ওখানে দেখেছে, তাই অমন করছে!’ —এই বলে তিনি বাক্স আর স্নেক হুকটা নিয়ে ছুটলেন সেদিকে৷ রাহুল সতর্কভাবে তাঁকে অনুসরণ করল৷ সাপটার একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন শ্রীবাস্তব৷ তাঁর কয়েক হাত পিছনে রাহুল এসে দাঁড়াল৷ সাপটা তার বিরাট ফণা দুলিয়ে গর্জন করে চলেছে, ‘হিস-হিস…৷’ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে রাহুলরা দেখতে পেল সামনের পাইন গাছটার আড়াল থেকে উঁকি মারছে একটা মুখ! একটা বাচ্চা ছেলের ভীতসন্ত্রস্ত আতঙ্কিত মুখ! এই নির্জন স্থানে একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেল তারা দুজন৷ পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে শ্রীবাস্তব তাড়াতাড়ি স্নেক হুক দিয়ে তাঁর পোষ্যকে ধরে তাড়াতাড়ি পুরে ফেললেন কাঠের বাক্সর মধ্যে৷

এর পর ছেলেটা বাইরে বেরিয়ে এল৷ দশ-বারো বছর বয়সি একটা লেপচা বা তিববতি ছেলে৷ খালি পা, পরনে শতচ্ছিন্ন পোশাক৷ হাতে ধরা আছে একটা কাপড়ের থলে৷ তার ভিতর এমন কিছু আছে, যেটা নড়ছে! কোনও জীবন্ত প্রাণী হবে৷

বাইরে বেরিয়ে ছেলেটা তখনও কাঁপছে৷ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ কাঠের বাক্সর ভিতর৷ সেখান থেকে তখনও ত্রুুদ্ধ সরীসৃপের ফোঁস ফোঁস গর্জন কানে আসছে৷ যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে সে৷ শ্রীবাস্তব তার হাতের ছোট্ট পুঁটুলিটার দিকে ইশারা করে জানতে চাইলেন, ‘ওতে কী আছে?’

বাচ্চাটা কাঠের বাক্সটার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে পুঁটুলিটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বার করে আনল নেউল বা বেজির বাচ্চা! সেই বেজির বাচ্চাটাও যেন ঠকঠক করে কাঁপছে৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘এবার বুঝলাম আমার কালো সোনা কেন অমন রেগে গেছে৷ বেজি আর সাপ জাতশত্রু৷ চোখে না দেখলেও বেজির বাচ্চাটার উপস্থিতি টের পেয়েছে৷ নইলে মানুষ দেখলে চট করে ও অমন রেগে যেত না৷’

বাচ্চাটা অসম্ভব ভয় পেয়ে গেছে৷ রাহুল এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে প্রশ্ন করল, ‘তোমার নাম কী? কোথায় থাকো?’

ছেলেটা তার কথা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার দিকে৷ তখনও সে কাঁপছে৷ ছেলেটার ভয় কাটাবার জন্য রাহুল মাথায় হাত বোলাতে লাগল৷ পকেট থেকে একটা লজেন্স বার করে ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিল৷ কাঁপা কাঁপা হাতে একটু ইতস্তত করে লজেন্সটা নিল ছেলেটা৷ তারপর সেটা নাকে ঠেকিয়ে গন্ধ শুঁকল জিনিসটা কী বোঝার জন্য৷ সে মনে হয় গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারল ওটা একটা খাদ্যদ্রব্য৷ ধীরে ধীরে তার কাঁপুনি থেমে গিয়ে একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে৷

শ্রীবাস্তব রাহুলকে বললেন, ‘আমি কাজ চালাবার মতো একটু-আধটু তিববতি ভাষা জানি৷ দেখি কোনও কাজ হয় কি না?’ —এ কথা বলে বিজাতীয় ভাষায় শ্রীবাস্তব কী যেন প্রশ্ন করতে শুরু করলেন ছেলেটাকে৷ সে প্রথমে কোনও জাবাব দিল না৷ একটু ভীতভাবেই সে চেয়ে রইল শ্রীবাস্তবের মুখের দিকে৷ শ্রীবাস্তব এর পর ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে কী একটা বললেন৷ এবার মুখ খুলল ছেলেটা৷ নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ‘ডং-পো৷’ সম্ভবত সেটা ছেলেটার নাম৷ ধীরে ধীরে কথা শুরু হল ছেলেটা আর শ্রীবাস্তবের মধ্যে৷ কথা বলতে বলতেই সে বারকয়েক আঙুল তুলে দেখাল নীচের মেঘে ঢাকা উপত্যকাটা৷ একসময় তাদের দুজনের কথা শেষ হল৷ রাহুল জানতে চাইল ছেলেটা কী বলল? শ্রীবাস্তব বললেন, ‘যদিও ওর কথা পুরোপুরি বুঝতে পারছি না, তবে মোটামুটি যা বুঝলাম তা বেশ চমকপ্রদ৷ ওর বাড়ি ওই নীচের গ্রামে জম্ভলা মন্দিরের কাছে৷ ক’দিন আগে একটা লোক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল গ্রামের কাছে পাহাড়ি রাস্তায়৷ ছেলেটা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে জম্ভলা মন্দিরে পৌঁছে দেয়৷ পরে বোঝা যায় লোকটা অসুস্থ ছিল না৷ ওটা ছিল তার ভান৷ জম্ভলা মন্দিরে যাবার জন্য লোকটা ও কাজ করে৷ লোকটা চোর৷ সে দিন রাতেই সে পঞ্চজম্ভলার এক জম্ভলাকে নিয়ে চম্পট দেয়৷ যদিও তার খোঁজে শহরে লোক পাঠিয়েছেন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কোঞ্চক৷ তবুও সে নিজেও বেরিয়ে পড়েছে শহরে গিয়ে সেই মূর্তি উদ্ধারের জন্য৷ কারণ গ্রামবাসীরা নাকি বলাবলি করছিল, যেহেতু ডং-পো নামের এই বাচ্চাটাই চোরটাকে পথ দেখিয়ে মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল, তাই মূর্তি না উদ্ধার হলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে তাকে জম্ভলা দেবতার ঘরে আটকে রেখে৷’

রাহুল বেশ অবাক হল কথাগুলো শুনে৷ শ্রীবাস্তব এর পর বললেন, ‘আমার ধারণা, ছেলেটা সত্যি কথাই বলছে৷ ও নীচের গ্রাম থেকেই এসেছে৷ ওর হাতের বেজিটা সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে৷ জম্ভলাদেবের উপাসকরা বেজি পোষে৷ জম্ভলাদেবের হাতে ধরে থাকা বেজি সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয় ওদের কাছে৷ তা ছাড়া অন্য কাজেও ব্যবহূত হয়৷ আমার ধারণা, মূর্তিটা যে এখান থেকে নিয়ে গিয়েছিল, সে শেঠ মলমল বা তারই কোনও লোক হবে৷ ওই মূর্তিটাই সম্ভবত আমরা দেখেছিলাম৷’

রাহুল বলল, ‘পঞ্চজম্ভলা কী?’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘পঞ্চজম্ভলা জম্ভলাদেবেরই পাঁচটা রূপ৷ তাঁর গাত্রবর্ণ পাঁচ ধরনের হয়৷ কালো, সাদা, নীল, হলুদ, সবুজ৷ সমৃদ্ধি লাভ করা ছাড়াও এক একটা কারণে বিভিন্ন বর্ণের জম্ভলার পূজা করা হয়৷ পাঁচ বর্ণের জম্ভলার অনুগত পাঁচ ডাকিনী আলাদা আলাদা পাঁচরকম ক্ষমতার অধিকারিণী৷ তাদের মধ্যে কেউ নাকি মানুষকে বশ করতে পারে, কেউ রোগগ্রস্তকে সারিয়ে তুলতে পারে, কেউ মানুষকে অদৃশ্য করতে পারে—এইসব ব্যাপার আর কী! তবে সবচেয়ে ক্ষমতাবান মনে করা হয় সবুজ জম্ভলা দেবতাকে৷ অন্য চারটে রূপ তাঁরই অংশবিশেষ৷ বিষ্ণুর প্রতিরূপ যেমন শ্রীকৃষ্ণ৷’

রাহুল শুনে বলল, ‘বাঃ, আপনি দেখছি এসব নিয়ে অনেক জানেন!’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আমি তিববতি মূর্তি সংগ্রহ করি তো৷ ওসব সংগ্রহ করতে করতেই এসব জানা হয়ে গেছে৷’

‘তা ছেলেটাকে আপনি কী পরামর্শ দিলেন?’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘শহর বলতে ও সম্ভবত কালিম্পং বোঝাচ্ছে৷ আমি ওকে বললাম, নামধাম না জানলে কোনও মানুষকে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না৷ তা ছাড়া শহর অনেক দূর৷ পায়ে হেঁটে শহরে গিয়ে কালকের মধ্যে তার পক্ষে গ্রামে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়৷ তার চেয়ে আবার তার গ্রামে ফিরে যাওয়াই ভালো৷ আমরা তো কাল যাচ্ছিই ওখানে৷ ও আমাদের সঙ্গী হতে পারে৷ যদিও এ ব্যাপারে সে হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না৷’

গাড়ির দিকে এগোল রাহুলরা৷ ছেলেটাও তাদের পিছন পিছন এসে দাঁড়াল৷ রাহুল আর শ্রীবাস্তব নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল৷ আর ছেলেটা লক্ষ করতে লাগল তাদের৷ আর মাঝে মাঝে ব্যাগ খুলে দেখতে লাগল তার পোষ্যটাকে৷

সূর্য ডুবে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে৷ ঠান্ডা কনকনে বাতাস আরও জোরে প্রবাহিত হতে লাগল৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘খেয়েদেয়ে জিপের মধ্যে ঢুকে যাওয়াই ভালো৷ নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে৷’

সাপের বাক্স, স্নেক হুক জিপের মধ্যে রাখার পর খাবার বার করা হল৷ বিস্কিট, ফল, কেক—এসব খাবার৷ ছেলেটাকেও দেওয়া হল কিছু৷ রাহুলদের সঙ্গেই খেল ছেলেটা৷ অন্ধকার নামল৷ শ্রীবাস্তব ছেলেটাকেও জিপের ভিতর উঠতে বলল৷ কিন্তু সে আঙুল দিয়ে জিপের নীচটা দেখাল৷ সে ওখানেই শুতে চায়৷ সম্ভবত সাপের ভয়ে সে জিপের ভিতর ঢুকতে চায় না৷ প্রচণ্ড ঠান্ডা নামছে৷ শ্রীবাস্তব একটা কম্বল বার করে দিলেন ডং-পো-কে৷ হাসল ছেলেটা৷ তারপর কম্বল আর তার পুঁটুলিটা নিয়ে জিপের নীচে ঢুকে গেল৷ রাহুলরাও জিপে উঠে ক্যানভাসগুলো ভালো করে নামিয়ে একজন সামনে, একজন পিছনে শুয়ে পড়ল৷

সামনে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রাহুল৷ মাঝরাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল৷ পর্দাটা ফাঁক করে বাচ্চা ছেলেটা হাত ঝাঁকিয়ে তাকে তোলার চেষ্টা করছে৷ রাহুল উঠে বসে দেখল ইতিমধ্যে শ্রীবাস্তবও উঠে বসেছেন৷ ছেলেটা ইশারায় তাদের গাড়ি থেকে নামতে বলছে আর মাঝে মাঝে কাদের দিকে তাকাচ্ছে৷

জিপ থেকে নামল তারা৷ ডং-পো আঙুল তুলে দেখাল উলটো দিকের খাদের দিকে৷ চাঁদনি রাত৷ সেই আলোতে রাহুলরা দেখল দুটো ছায়ামূর্তি ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে৷ তাদের একজনের মাথায় ছোটোমতো কী একটা জিনিস ধরা আছে৷ যদিও জিনিসটা কী তা এত ওপর থেকে বোঝা যাচ্ছে না৷ কয়েক মুহূর্ত, আর তারপরই তারা ঢালের ঝোপঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল৷ এত রাতে কারা ওই লোক দুটো? হয়তো কাছাকাছি কোনও গ্রাম আছে৷ কাজ সেরে ঘরে ফিরছে তারা৷ পাহাড়ি পথে সন্ধ্যার সময় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বলে আলো জ্বালিয়ে রাস্তার কাজ হয়৷ হয়তো সে কাজই করে ওরা৷ এর পর অবশ্য বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না ওরা দুজন৷ প্রচণ্ড ঠান্ডা৷ অনতিবিলম্বেই আবার জিপে ঢুকে যেতে হল৷

চার

রাহুলদের যখন ঘুম ভাঙল, তখন সূর্যদেব সবে উদয় হয়েছেন৷ চারপাশের কুয়াশা তখনও ভালোভাবে কাটেনি৷ নীচের উপত্যকাটাও মেঘে ঢাকা৷ ডং-পো সম্ভবত আগেই ঘুম থেকে উঠে গাড়ির বনেটের মধ্যে বসে ছিল৷ রাহুলের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে হাসল৷ তার ভয় ও বিমর্ষতা যেন অনেকটাই কেটে গেছে৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আশা করি ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব সেখানে৷ দেখবেন কী অদ্ভুত জায়গা লুকিয়ে আছে পাহাড়ের কোলে৷’ কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিল তারা৷ রাহুলের পিঠে একটা রুকস্যাক, আর শ্রীবাস্তবের পিঠে একটা ঢাউস রুকস্যাক৷ স্নেক হুকাটকে ফোল্ড করা যায়৷ সেটা আর সাপের বাক্সটাকেও সেই ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন শ্রীবাস্তব৷ জিপটাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে রাখা হল ফাঁকা জমির মধ্যে পাইন গাছগুলোর কাছে৷ অতঃপর যাত্রা শুরু হল৷ রাহুলরা ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল নীচের উপত্যকার দিকে৷ বাচ্চাটাও তাদের সঙ্গী হল৷

দু-পাশে ঘন পাইন গাছের বন৷ তার নীচে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমা হয়ে আছে পচা পাতার রাশি৷ গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জল খসে পড়ছে তার ওপর৷ সূর্যের আলো ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে জঙ্গলে৷ দু-একটা পাখি ডাকছে মাঝে মাঝে৷ এরই মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে পায়ে চলা পথ৷ তবে পথ একটু পিচ্ছিল৷ হয়তো বা গতকালের বৃষ্টির জন্যই৷ সাবধানে নামছে রাহুলরা৷ ডং-পো কিন্তু বেশ তিড়িংবিড়িং করেই নামছে৷ বেশ খুশি খুশি ভাব তার মুখে-চোখে৷ ব্যাপারটা নজর এড়াল না কারও৷ শ্রীবাস্তব চলতে চলতে কথা শুরু করলেন তার সঙ্গে৷ একসময় রাহুল জানতে চাইল, ‘ডং-পো কী বলছে? ওকে তো বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে!’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘ও একটা নতুন কথা জানাল৷ জম্ভলামূর্তি আবার নাকি ফিরে এসেছে! কাল রাতের লোক দুটোকে ও কাছ থেকে দেখেছে৷ ওদের মাথাতেই নাকি মূর্তিটা ছিল৷ এবার নিশ্চয়ই গ্রামে ফিরলে পুরোহিত তাকে শাস্তি দেবে না৷ আজ নাকি আবার মন্দিরে উৎসব আছে৷ জম্ভলা দেবতা দর্শন দেবেন৷’

রাহুল বেশ অবাক হয়ে বলল, ‘তা-ই নাকি? তাহলে ওই লোকগুলো কি শেঠ মলমলকে মারধর করে মূর্তিটা আবার ফেরত নিয়ে এল?’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘সম্ভবত তা-ই৷ ওরা হয়তো অনুসরণ করেছিল ওকে৷ অথবা কালিম্পঙে গিয়ে কিউরিয়ো শপগুলোয় খোঁজ করে শেষ পর্যন্ত ওর খোঁজ পেয়ে যায়৷ ওরাও তো জানে যে ওই কিউরিয়ো শপগুলোতেই প্রাচীন মূর্তি-টুর্তি বিক্রি হয়৷ দেবতার ব্যাপারে ওরা বড়ো স্পর্শকাতর৷ মূর্তিটা চুরি করে আনা ছিল বলেই হয়তো ওই ঘটনা সম্বন্ধে শেঠ মলমল পুলিশকে কিছু বলতে পারছে না৷ ওর গায়ে যে ধরনের ক্ষতচিহ্নর কথা শুনলাম, তাতে আমারও ধারণা হয়েছিল যে ওই জম্ভলা দেবতার মূর্তিটা নিয়েই কোনও ঘটনা ঘটেছে৷’

রাহুল বলল, ‘মানে? আপনার শেষ কথাটা ঠিক বুঝলাম না৷ ক্ষতচিহ্নর ব্যাপার দেখে কীভাবে ধারণা হল?’

শ্রীবাস্তব প্রশ্নটার সরাসরি জবাব না দিয়ে বললেন, ‘জম্ভলা দেবতার উপাসকদের কাজকর্ম সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা আছে তাই৷’

বাচ্চাটা আগে আগে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে৷ হঠাৎ তার বলা একটা কথা মনে পড়ল রাহুলের৷ শ্রীবাস্তবকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, জম্ভলা দেবতা দর্শনের ব্যাপারটা ও কী বলছিল?’

চলতে চলতে রাহুলের প্রশ্ন শুনে থেমে গেলেন ভদ্রলোক৷ তারপর বললেন, ‘আমি একবার তাকে দেখেছি৷ বহু বছর আগে৷ হয়তো আপনিও তাকে দেখবেন৷ আপাতত ব্যাপারটা আপনার কাছে একটু রহস্যই থাকুক৷ ওখানে গেলে আপনি সব জানতে-বুঝতে পারবেন৷’ কথাগুলো বলে রাহুলকে একটু কৌতূহলের মধ্যে ফেলে শ্রীবাস্তব চলতে শুরু করলেন৷ সময় এগিয়ে চলল৷ এগিয়ে চলল রাহুলরাও৷ পথের পাশে কখনও আদিম জঙ্গল, কখনও বা খাড়া পাহাড়ের ঢাল, ওপর থেকে নেমে আসা ঝরনার জল পা ভিজিয়ে দিয়ে আরও নীচে নেমে যাচ্ছে৷ মাঝেমধ্যেই ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা মারছে বা মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে চারদিক৷ পোশাক ভিজে যাচ্ছে৷ বিশ্রাম নেবার জন্য কখনও কখনও রাস্তার ওপর কিছুক্ষণ বসা৷ তারপর আবার চলা৷ এভাবেই ধীরে ধীরে ঘণ্টা চারেক কেটে গেল একসময়৷ তারপর এক মেঘের রাজ্যে প্রবেশ করল তারা৷ এত ঘন মেঘ যে কয়েক হাত দূরেই কিছু দেখা যায় না৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি৷ দূরত্বের নিরিখে এ জায়গা কালিম্পং থেকে খুব একটা দূরে নয়, কিন্তু এ জায়গা যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন অন্য এক পৃথিবী৷ আমরা যে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছি, সেই পাহাড়টার গঠন সুচালো হওয়ায় বাতাসের চাপ এখানে কম৷ তাই এত মেঘ৷ প্রায় হাতড়ে হাতড়ে বেশ কিছুটা পথ আরও নামার পর আস্তে আস্তে মেঘ কেটে যেতে লাগল৷ নীচে তাকিয়েই রাহুলদের চোখে পড়ল একটা মন্দিরের সোনালি চুড়ো৷ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা৷ ভালো করে তাকাতেই মন্দিরের পিছনে পাহাড়ের ঢালে বেশ কয়েকটা ঘরবাড়িও নজরে এল৷ ডং-পো সেদিকে আঙুল তুলে কী যেন বলল, তারপর তাদের কাছে এসে রাহুল আর শ্রীবাস্তবের হাতে চুমু খেয়ে হরিণের মতো দ্রুতপায়ে ছুটল সেদিকে৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে হারিয়ে গেল পথের বাঁকে৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘ও বলল ও গ্রামে ফিরে যাচ্ছে৷ আবার দেখা হবে৷ ওর মনে হয় আর ফেরার তর সইছিল না৷ তবে ডং-পো নাকি একাই থাকে ওর কুঁড়েঘরে৷ ও অনাথ, বাপ-মা কেউ নেই৷’

মন্দিরে পৌঁছোবার জন্য আরও বেশ কিছুটা নীচে নামতে হল রাহুলদের৷ রাস্তাটা নীচে নেমে তারপর উঠেছে মন্দির চত্বরে৷ সেই পথ বেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা দুজন উঠে এল মন্দিরের সামনে৷

রাহুল বেশ অবাক হয়ে গেল সেখানে পৌঁছে৷ বেশ বড়ো পাথুরে একটা চত্বরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কাঠ আর পাথরের তৈরি প্রাচীন মন্দিরটা৷ একপাশের দেওয়ালের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে আছে মন্দির, অন্য দিকের দেওয়াল দুটো দুই বাহুর মতন সমান্তরালভাবে দাঁড়িয়ে আছে৷ সম্ভবত পাহাড়ের গায়ে খাদ কেটে মন্দিরটা বানানো হয়েছিল৷ এ মন্দিরটা ঠিক বৌদ্ধ গুম্ফার মতো নয়৷ থামের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরটার শীর্ষদেশে বেশ কয়েকটা চুড়ো আছে৷ সেগুলো দেখতে অনেকটা প্রস্ফুটিত পদ্মকোরকের মতো৷ মন্দির স্তম্ভের অলংকরণে, মন্দিরগাত্রে, চূড়োয় একসময় মনে হয় সোনালি গিল্টি করা ছিল৷ বয়সের ভারে সেগুলো এখন সবই প্রায় উঠে গেলেও স্থানে স্থানে যতটুকু আছে, সেগুলো মেঘের ফাঁক গলে আসা সূর্যকিরণে চিকচিক করছে৷ মন্দিরের মাথার ওপরে চাঁদোয়ার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে দুধসাদা মেঘ৷ দূরের পাহাড়গুলোকে দেখাচ্ছে ঘন নীল৷ যেন এ এক নীল পাহাড়ের দেশ৷

জনাকয়েক লোক কাঠের বালতিতে জল নিয়ে মন্দির চত্বর ধোয়া-মোছা করছিল৷ তাদের পরনে খাটো পাজামা আর লম্বা ঝুলের হাতাওয়ালা পোশাক৷ কোমরের কাছে চামড়ার চওড়া কোমরবন্ধ৷ তাতে কারও কারও আবার কুকরি গোঁজা আছে৷ কান-উঁচু টুপিও আছে কয়েকজনের মাথায়৷ রাহুলদের দেখে কাজ থামিয়ে একটু বিস্মিতভাবে থমকে দাঁড়াল তারা৷ তারপর দুজন লোক এগিয়ে এল তাদের কাছে৷ শ্রীবাস্তব তাদের বললেন, ‘আমরা ট্যুরিস্ট৷ মন্দির দেখতে এসেছি৷’ লোকগুলো শুধু একবার ঘাড় নাড়ল৷ একজন মন্দিরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সঙ্গে মন্দিরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একজন দীর্ঘকায় লোক৷ তিববতিদের মধ্যে এত লম্বা লোক সাধারণত দেখা যায় না৷ তার গায়ে সোনালি জরির কাজ করা অনেকটা ওভারকোটের মতো রেশমের পোশাক, রেশমের কোমরবন্ধ, কানে সোনার মাকড়ি ঝিলিক দিচ্ছে৷ পায়ে চামড়ার ফিতে দিয়ে বাঁধা হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা জুতো৷ মাথায় একটা তেকোনা পশুলোমের টুপিও আছে৷ বাতাসে তার কানের ওপর টুপির লোমগুলো উড়ছে৷ তার পোশাক আর দৃঢ় ভঙ্গিতে রাহুলের দিকে এগিয়ে আসা দেখেই বুঝতে পারল এ লোকটা অন্য লোকগুলোর থেকে আলাদা গোত্রের৷

লোকটা এসে দাঁড়াল রাহুলদের সামনে৷ লোকটার মুখমণ্ডল ঘন দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ভরা৷ তার বয়স ঠিক ধরা যাচ্ছে না৷ চোখের রং রক্তাক্ত৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে রাহুলদের ভালো করে দেখল৷ তারপর ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কারা? এখানে কেন এসেছেন? কোথা থেকে আসছেন?’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘আমরা ট্যুরিস্ট৷ কলকাতা থেকে আসছি৷ মন্দির আর আশপাশের জায়গাগুলো দেখতে এসেছি৷’

‘ট্যুরিস্ট? ট্যুরিস্টরা তো এ পর্যন্ত আসে না? তারা লাভা-লোলেগাঁও পর্যন্তই দেখে৷ এখানে মন্দির আছে আপনারা জানলেন কীভাবে?’ সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করল লোকটা৷

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘হ্যাঁ, সাধারণ ট্যুরিস্টরা এখানে আসে না জানি৷ চার-পাঁচ মাস আগে আমার পরিচিত একটা ট্রেকিং দল ট্রেক করে নীচে নেমেছিল৷ যদিও সময়াভাবে তারা মন্দিরে আসেনি, কিন্তু দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে মন্দিরটা দেখেছিল৷ তারাই ফিরে গিয়ে গল্প করেছিল যে এখানে অদ্ভুত সুন্দর একটা মন্দির আছে৷ তাই দেখতে চলে এলাম৷ আমরা কলকাতা শহর থেকে এসেছি৷’

রাহুল বুঝতে পারল, যে কোনও কারণেই হোক, শ্রীবাস্তব যে আগে একবার এখানে এসেছিলেন, সে কথা চেপে গেলেন৷

লোকটা বলল, ‘আমি কলকাতা শহরের নাম শুনেছি, তবে সেখানে যাইনি কখনও৷ শুনেছি সেটা অনেক দূরের পথ৷ আপনারা যে সেখান থেকে এসেছেন, তার প্রমাণ কী?’

রাহুলের সঙ্গে ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড ছিল৷ বাইরে বেরোলে সেটা সঙ্গেই থাকে৷ সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ভোটার কার্ড সঙ্গে আছে, দেখাচ্ছি৷’

লোকটা বলল, ‘সেটা আবার কী জিনিস?’

রাহুল বুঝতে পারল যে লোকটা ভোটার কার্ড শব্দটার সঙ্গে পরিচিত নয়৷ পকেট থেকে কার্ডটা বার করে সে লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘সরকারি পরিচয়পত্র৷ এতে নাম-ঠিকানা সব লেখা আছে৷’

লোকটা কার্ডটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে সেটা রাহুলের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ক’দিন আগে এখানে একটা লোক এসেছিল৷ সেও নিজেকে ট্যুরিস্ট বলেছিল৷ কালিম্পঙের লোক৷ সে একটা কাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়েছিল৷’

রাহুল আর লোকটার কথার মাঝেই শ্রীবাস্তব তাঁর পকেট থেকে একটা কাগজের মোড়ক বার করলেন৷ তার মধ্যে রয়েছে একটা স্ফটিকের মালা৷ বেশ বড়ো একটা লকেটও রয়েছে তার সঙ্গে৷ মোড়ক খুলে মালাটা বার করে সেটা তিনি লোকটার দিকে এগিয়ে বললেন, ‘এটা আমাদের তরফ থেকে উপহার৷ আপনাকে দিলাম৷’

মালাটা হাতে নিয়ে দেখল লোকটা৷ সম্ভবত খুশিও হল৷ তারপর বলল, ‘আমার নাম কোঞ্চক৷ এই জম্ভলা দেবতার মন্দিরের প্রধান পুরোহিত আমি৷ এসেছেন যখন, তখন মন্দির ও আশপাশের জায়গা ঘুরে দেখুন৷ একটা রাত আপনারা মন্দিরের অতিথিশালায় কাটাতে পারেন৷ আজ বিকালে এই মঠ চত্বরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে৷ জম্ভলা দেবতা দর্শন দেবেন৷ অন্য অনুষ্ঠানও হবে৷ দেখতে পারেন৷ তবে কাল সকালেই কিন্তু আপনাদের মন্দির চত্বর ছাড়তে হবে৷ আর একটা কথা, আমাদের আচার-সংস্কৃতি শহরের লোকদের সঙ্গে ঠিক মেলে না৷ আশা করি আমাদের ধর্মীয় আচরণে আপনারা কোনও হস্তক্ষেপ করবেন না এবং আমাদের নিয়মবিধি মেনে চলবেন৷ আর মন্দিরে থাকার জন্য কিছু অর্থ দিলে ভালো হয়৷’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘কাল সকালেই চলে যাব আমরা৷ আশা করি আমরা নিয়মবিরুদ্ধ কিছু করব না৷’ কথা শেষ করে পকেট থেকে একশো টাকার কড়কড়ে দশটা নতুন নোট বার করে পুরোহিত কোঞ্চকের হাতে দিলেন৷

চকচক করে উঠল কোঞ্চকের চোখ৷ নোটগুলো হাতে নিয়ে একবার নতুন টাকার গন্ধ শুঁকলেন তিনি৷ তারপর সেগুলো জামার পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, ‘আমাদের এখানে এমনিতে টাকার প্রয়োজন হয় না৷ যুগ যুগ ধরে এখানে বিনিময়পদ্ধতি চলে আসছে৷ তবে মাঝে মাঝে কিছু জিনিস কেনার জন্য কালিম্পং শহরে লোক পাঠাতে হয়, যা এখানে পাওয়া যায় না৷ তখন টাকার প্রয়োজন হয়৷ আপনাদের এই টাকা মন্দিরের কাজেই লাগবে৷ আমি একজন লোক দিচ্ছি, সে আপনাদের ঘরে নিয়ে যাবে৷ মন্দিরটাও সে ঘুরিয়ে দেখাবে৷ খাবারের ব্যবস্থাও সে করবে৷’

এ কথা বলার পর তিনি হাঁক দিলেন ‘পেমবা’ বলে৷ একজন মাঝবয়সি লোক কাছে এসে দাঁড়াল সে ডাক শুনে৷ কোঞ্চক তাকে তিববতি ভাষায় কী যেন বলতেই সে ইশারায় রাহুলদের তাকে অনুসরণ করতে বলল, রাহুলরা এগোল তার পিছনে৷

চত্বরের ঠিক মাঝখানেই একটা চৌবাচ্চার মতো জায়গা৷ আকারে সেটা অনেকটা একটা ঘরের মতো৷ মন্দিরের চাতাল থেকে সেটা অন্তত দু-ফুট গভীর হবে৷ চাতালের ওপরে একটা অনুচ্চ প্রাচীর আছে সেই চৌবাচ্চার মতো গর্তটাকে ঘিরে৷ আর তার গায়েই আছে সিঁড়ির ধাপওয়ালা একটা বেদি৷ রাহুল পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখল সেই গর্তটার মধ্যে কিন্তু কোনও জল নেই৷ দুজন লোক জল দিয়ে সেই বেদিটা আর গর্তটাকে ঘেরা কোমর সমান অনুচ্চ প্রাচীরটাকে ঘষে-মেজে পরিষ্কার করছে৷

লোকটার সঙ্গে মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করল রাহুলরা৷ ছোটোবড়ো নানা প্রকোষ্ঠ মন্দিরের ভিতর৷ স্তম্ভ দেওয়ালের গায়ে খোদাই করা আছে নানা বিচিত্র ছবি৷ বিভিন্ন অপদেবতার মুখ, ডাকিনী আর বেজির ছবি৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘বেজিকে এরা জম্ভলা দেবতার প্রতীক বলে মনে করে৷ তাই চারপাশে এত বেজির ছবি৷’

এ অলিন্দ-সে অলিন্দ বেয়ে সিঁড়ি দিয়ে একটু নীচে নেমে একটা ছোটো ঘরে তাদের তুলল লোকটা৷ পাথরের মেঝে, কাঠের দেওয়াল৷ খোলা জানালা দিয়ে খাদ দেখা যাচ্ছে৷ মাটি অনেক নীচে৷ এটাই রাহুলদের রাত্রিবাসের জায়গা৷ তাদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল কোঞ্চকের অনুচর৷ শ্রীবাস্তব দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, ‘সামান্য একটু বিশ্রাম নিয়ে মন্দির দেখার পর গ্রামটা ঘুরে দেখব৷’

ঘরে একটা চৌকিমতো আছে৷ রাহুল তার ওপর মালপত্র নামিয়ে রেখে বসল৷ শ্রীবাস্তব তাঁর ব্যাগ থেকে সেই কাঠের বাক্সটা বার করে সেটাকে চৌকির তলায় চালান দিয়ে তার ওপর একটা কাপড় ঢাকা দিলেন৷ তারপর পোশাক বদলাবার জন্য জ্যাকেট, জামা খুলে ফেললেন৷ যত দ্রুতই তিনি পোশাক পরিবর্তনের চেষ্টা করুন না কেন, তাঁর দেহের ক্ষতচিহ্নগুলি কিন্তু রাহুলের নজর এড়াল না৷ ভদ্রলোক যদি কিছু মনে করেন—এই ভেবে সে ব্যাপারটা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেল৷ আধঘণ্টা সে ঘরে বিশ্রাম নেবার পর তারা দরজা খুলল৷ সেই লোকটা তখনও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে৷ দরজায় তালা লাগালেন শ্রীবাস্তব৷ তারপর তারা রওনা হল লোকটার পিছনে৷

ওপরে উঠে প্রথমে একটা বেশ বড়ো হলঘরে প্রবেশ করল তারা৷ সে ঘরের আনাচেকানাচে অসংখ্য অদ্ভুত ধরনের মূর্তি, প্রদীপদান, ধাতুর পাত্র রাখা আছে৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর বসানো আছে ভেরিজাতীয় একটা বাদ্যযন্ত্র৷ আর তার পাশেই সেটা বাজাবার জন্য রাখা একটা হাড়৷ রাহুলের দেখে মনে হল, সেটা সম্ভবত মানুষের বাহুর হাড় হবে৷ সেই বড়ো ঘর অতিক্রম করে আরও বেশ কয়েকটা ছোটো ঘর পেরোল তারা৷ প্রত্যেক ঘরই নানা প্রাচীন জিনিসে পরিপূর্ণ৷ কোথাও মাথার ওপর সিলিং থেকে ঝুলছে বিচিত্র ধরনের ভয়ংকর দেখতে কাঠের মুখোশ, কোথাও আবার রাখা আছে রেশমের ওপর কাজ করা দেবদেবীর নানা ছবি দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো অবস্থায়৷ একটা ঘরে বিভিন্ন প্রাণীর মাথার খুলি, চামড়া ইত্যাদিও টাঙানো আছে৷ শেষ পর্যন্ত লোকটা রাহুলদের নিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল গর্ভগৃহে৷ বিশাল একটা ঘর৷ কাঠের তৈরি মেঝে৷ দেওয়াল, থামের গায়ে চিত্রিত আছে নানা বিচিত্র মূর্তি৷ একটা জানলা দিয়ে বাইরের আলো ঢুকছে ঘরে৷ তবে তাতে ঘরের অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি৷ চওড়া থামগুলোর আড়ালে অন্ধকার খেলা করছে৷ হলঘরের মতো ঘরটার শেষ প্রান্তে কয়েকটা ধাপের পর প্রশস্ত একটা বেদি৷ তার ওপর বসে আছেন জম্ভলা দেবতা৷ রাহুলরা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সেই বেদির সামনে৷ বিশালাকৃতির এক কাঠের তৈরি মূর্তি বসে আছে বেদির ওপর৷ উচ্চতা অন্তত আট ফুট হবে৷ স্ফীত উদর, গাত্রবর্ণ ঘন সবুজ৷ দেবতা সোনা-রুপোর নানা অলংকারে ভূষিত৷ মাথার মুকুটটাও সম্ভবত সোনারই হবে৷ বজ্রাসনে বসা দেবতার ডান পা বাইরের দিকে একটু উন্মুক্ত৷ নখরগুলো বেশ বড়ো বড়ো আর তীক্ষ্ণ৷ সেগুলোও সম্ভবত সোনার পাতে মোড়া৷ আর সেই পায়ের সামনে বাসে আছে পদ্মকোরক হাতে এক ডাকিনী৷ কাছেই কারুকাজ করা একটা রুপোর প্রদীপদানে প্রদীপ জ্বলছে৷ দেবতার পায়ের সামনে ধূপও জ্বলছে একগোছা৷ ধূপের ধোঁয়া আর প্রদীপের আলোতে অদ্ভুত লাগছে দেবতার মুখটা৷ জম্ভলা দেবতার ঠোঁটের কোণে জেগে আছে এক রহস্যময় হাসি৷ তাঁর হাতে ধরা বিরাট বেজিটার দাঁতগুলো প্রদীপের আলোতে মৃদু ঝিলিক দিচ্ছে৷ জ্বলজ্বল করছে তার লাল চোখ দুটো৷ রাহুল অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অদ্ভুত মূর্তিটার দিকে৷ এমন মূর্তি এর আগে সে কোনও দিন দেখেনি৷ মূর্তিটার দিকে তাকালে সম্ভ্রমের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন ভয়েরও উদ্রেক হয় দেবতার হাত-পায়ের ওই তীক্ষ্ণ নখর আর তাঁর হাসিটার জন্য৷ রাহুল এর পর দেখতে পেল সেই বিশালাকার মূর্তির বেদির ঠিক নীচের ধাপটাতেই ছোটো ছোটো পাঁচটা সিংহাসন৷ তার একটা খালি৷ বাকি চারটের মধ্যে রাখা আছে লাল, হলুদ, সাদা, কালো চারটে ছোটো ছোটো জম্ভলামূর্তি৷ সেগুলোর প্রতি রাহুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে শ্রীবাস্তব চাপা স্বরে বললেন, ‘বাচ্চা ছেলেটার কথাই মনে হয় ঠিক৷ মূর্তিটাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ ওই কালো রঙের ছোটো জম্ভলামূর্তিটাই সম্ভবত আমরা মলমলের কাছে দেখেছিলাম৷’

রাহুল ক্যামেরা বার করল সেই বিশালাকৃতি জম্ভলা দেবতার ছবি তোলার জন্য৷ ঠিক সেই সময় তাদের সামনের লোকটা রাহুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তিববতি ভাষায় কী যেন বলল৷ শ্রীবাস্তব রাহুলকে বললেন, ‘ছবি তুলবেন না৷ ও নিষেধ করছে৷ বিগ্রহ বা মন্দিরের ছবি তোলা নিষেধ এখানে৷ কোনও ছবিই তোলা যাবে না৷’ —এ কথা শুনে রাহুল ক্যামেরা নামিয়ে নিল৷

রাহুলরা এর পর ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করল৷ দেওয়ালে, থামের গায়ে নানা অদ্ভুত অলংকরণ রয়েছে সারা ঘরে৷ বয়েসের কারণে সেগুলো কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গেলেও এখনও বোঝা যায়৷ ডাকিনী-যোগিনীর ছবি তো আছেই, তার সঙ্গে আঁকা রয়েছে নানা ধরনের নানা ভঙ্গিমাতে নেউল বা বেজির ছবি৷ ঘরটাতে ঘুরতে ঘুরতে একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করল রাহুল৷ ঘরের মেঝেতে, থামের গায়ে ছড়িয়ে রয়েছে গোল গোল গর্ত৷ ভেঙে যাওয়ার কারণে গর্ত নয়, গোলাকৃতি গর্তগুলোকে নিপুণভাবে তৈরি করা হয়েছে৷ থামের গায়ের একটা গর্তে চোখ রাখল রাহুল৷ ভিতরে জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না তার৷ গর্তগুলোর উপযোগিতা বুঝতে না পারলেও একটা জিনিস সে বুঝতে পারল, কাঠের তৈরি থাম ও কাঠের তৈরি মেঝেটা সম্ভবত ফাঁপা৷ টোকা দিলে বা মেঝেতে জোরে পা ফেললে তেমনই ঢপঢপ একটা ফাঁপা শব্দ হচ্ছে!

ঘরটায় কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াবার পর গর্ভগৃহ থেকে ওপরে উঠে এল তারা৷ লোকটা এবার তাদের নিয়ে প্রবেশ করল অন্য একটা ঘরে৷ সে ঘরের দেওয়ালে অজস্র কুলুঙ্গি৷ তাতে রাখা আছে বৌদ্ধ দেবদেবীদের অজস্র ছোটো ছোটো মূর্তি৷ তবে সেই মূর্তিগুলো কোনওটাই বুদ্ধমূর্তি নয়৷ পাথর, কাঠ বা ধাতুর তৈরি ছোটো ছোটো সেই মূর্তির কোনওটাই জম্ভলাদেবের মূর্তি নয়৷ তার কোনওটা মায়াদেবীর, কোনওটা মঞ্জুশ্রীর বা কোনওটা মহাকালের৷ তার মাঝে দু-একটা বুদ্ধমূর্তিও আছে৷ সেগুলো দেখিয়ে মন্দিরের লোকটা জানাল যে ইচ্ছা করলে রাহুলরা মূর্তিগুলো কিনতে পারে৷ তবে তার জন্য কথা বলতে হবে প্রধান পুরোহিতদের সঙ্গে৷

শ্রীবাস্তব রাহুলকে বললেন, ‘এই মূর্তিগুলো সত্যিই অ্যান্টিক৷ এরা জম্ভলা দেবতা ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করে না৷ তাই এই মূর্তিগুলো ওদের কাছে অপ্রয়োজনীয়, ওরা এগুলো বেচতে চায়৷’

রাহুল জবাব দিল, ‘একটা অ্যান্টিক মূর্তি সংগ্রহের আমার বহুদিনের শখ৷ আপনি কোঞ্চকের সঙ্গে কথা বলুন৷ দরে পোষালে আমি একটা মঞ্জুশ্রীমূর্তি কিনব৷’

শ্রীবাস্তব হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে৷ আচ্ছা, আপনি গর্ভগৃহে জম্ভলা দেবতার পেটটা খেয়াল করেছেন?’

রাহুল বলল, ‘দেখেছি৷ বেশ মোটা ভুঁড়ি৷ কিন্তু কেন?’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘না, কিছু না৷ পেটটা বেশ বেঢপ, তাই আপনাকে বললাম৷’

এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে এল তারা৷ বাইরের চত্বরটাতে তখন আরও বেশ কয়েকজন লোক এসে জুটেছে৷ তারা দড়ি দিয়ে কাপড়ের পতাকা টাঙাচ্ছে মন্দির চত্বরে৷ বিকালের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে৷ প্রধান পুরোহিত কোঞ্চক সব কিছুর তদারকি করছেন৷ বাইরে বেরিয়ে তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই শ্রীবাস্তব বললেন, ‘গ্রামটা একটু ঘুরে আসি?’

কোঞ্চক বললেন, ‘যান৷ তবে বিকালের মধ্যেই ফিরে আসবেন৷ জম্ভলা দেবতা দর্শন দেবেন আজ৷’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আমরা তার অনেক আগেই ফিরে আসব৷’

চত্বর ছেড়ে এগোল রাহুলরা৷ এবার কিন্তু কোঞ্চকের সেই অনুচর আর তাদের সঙ্গী হল না৷

পাঁচ

রাহুলের ঘড়িতে এগারোটা বাজে৷ বেলা দশটা নাগাদ মন্দিরে এসে পৌঁছেছিল তারা৷ মঠ চত্বর থেকে একটু নীচে নামার পর আবার ওপরে উঠে গ্রামের পথে এগোল তারা৷ পাহাড়ের গায়ে তিববতিদের গ্রামটা যেন পটে আঁকা৷ পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা গোটা তিরিশেক ছোটো ঘর৷ পাথরের দেওয়াল, কাঠের ঢালু ছাদ৷ আর তার পিছনেই সবুজ পাইনবন আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে৷ অনেক সময় মেঘ ভেসে যাচ্ছে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িঘরগুলোর ছাদ ছুঁয়ে৷ যেন পটে আঁকা ছবি৷ গ্রামে ঢোকার মুখেই পাহাড়ি ঝোরা বা ঝরনা৷ স্বচ্ছ জলধারা পথের একপাশের পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে রাস্তার ওপর পায়ের পাতা ভিজিয়ে উলটো দিকের খাদে নেমে যাচ্ছে৷ শ্রীবাস্তব থমকে দাঁড়ালেন ঝরনাটার সামনে৷ কিছুক্ষণ ঝরনাটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর তিনি বললেন, ‘এ জায়গাটা আমার খুব প্রিয় ছিল৷ এখানে স্নান করতাম আমি৷’

রাহুল বলল, ‘এর আগে আপনি এখানে এসে বেশ কিছুদিন ছিলেন বুঝি?’

তার প্রশ্নটা শ্রীবাস্তবের কানে পৌঁছোল কি না, রাহুল তা ঠিক বুঝতে পারল না৷ কারণ তার কথার জবাব না দিয়ে শ্রীবাস্তব সোজা হাঁটতে লাগলেন৷

রাহুলরা প্রথমে গ্রামে পৌঁছোল৷ ঘরের জানালা দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে উৎসুক কয়েকজন পুরুষ-মহিলা৷ এক বৃদ্ধ দাওয়ায় বসে পাইপ টেনে ধোঁয়া ছাড়ছে৷ মাথায় লোমের ছুঁচোলো কানওয়ালা টুপি৷ অসংখ্য বলিরেখাময় মুখমণ্ডল৷ বাড়ির দেওয়ালে ঝোলাবার জন্য কাপড়ের ওপর আঁকা ঠিক এরকম তিববতিদের ছবি বহু দেখা যায় কালিম্পঙের হস্তশিল্পের দোকানগুলোতে৷ রাহুল একটা ছবি তুলল লোকটার৷ ফোকলা দাঁতে সে হাসল, আপত্তি করল না৷ রাহুলরা দেখতে পেল এক জায়গাতে বেশ কতকগুলো বাচ্চা ছেলে বেজির বাচ্চা নিয়ে খেলছে৷ সব দেখতে দেখতে চলল রাহুল৷ শ্রীবাস্তব কিন্তু গ্রামে দাঁড়ালেন না, গ্রাম ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে গ্রামের পিছনের পাহাড়ের ঢালে পাইনবনের মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন৷ সুঁড়িপথ এগিয়েছে পাইনবনের মধ্যে দিয়ে৷ বাতাস কানাকানি করছে বনের মধ্যে৷ তা ছাড়া চারপাশে কোনও শব্দ নেই৷ কোনও লোকজনও নেই৷ হঠাৎই সেই বনের মধ্যে একটা পুরোনো ঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেল৷ বাড়িটার চাল খসে গেছে, শুধু দেওয়ালগুলোই এখনও পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে৷ আশপাশের পাইন গাছগুলো থেকে ঝরে পড়া পাতার রাশি ছড়িয়ে আছে চারপাশে৷ সে জায়গাতে পৌঁছে থামলেন শ্রীবাস্তব৷ তারপর তাঁর পোশাকের ভিতর থেকে তাঁর ফোল্ডিং স্নেক হুকটা বার করলেন৷ রাহুল তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানেও সাপের সন্ধান আছে নাকি?’

শ্রীবাস্তব মৃদু হেসে বললেন, ‘দেখা যাক পিছু পাওয়া যায় নাকি৷’ এই বলে তিনি ঢুকলেন পরিত্যক্ত পাথরের কাঠামোর মধ্যে৷ রাহুল তাঁকে অনুসরণ করল৷ ভিতরে ঢুকে একটা জায়গাতে এসে দাঁড়ালেন তিনি৷ বোঝাই যাচ্ছে, সেটা একসময় একটা ঘর ছিল৷ তবে কাঁধ সমান উঁচু পাথরের দেওয়ালগুলোই শুধু এখন দাঁড়িয়ে আছে৷ সেই ভেঙে যাওয়া ঘরের এক কোণে গিয়ে মেঝে থেকে স্নেক হুকটা দিয়ে পাতার রাশি সরাতে লাগলেন শ্রীবাস্তব৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের কোণে উন্মোচিত হল বেশ বড়ো একটা গর্ত৷ তার মুখে মাটি জমে আছে৷ হুকটা দিয়ে প্রথমে মাটি সরিয়ে দিলেন তিনি৷ তারপর ধীরে ধীরে স্নেক হুকটা গর্তের ভিতর ঢুকিয়ে দিলেন৷ রাহুল এবার বেশ খানিকটা তফাতে সরে এল৷ বলা যায় না, সাপটা থাকলে সেটা হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে৷ শ্রীবাস্তব হুকটা প্রায় সম্পূর্ণই ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন৷ রাহুলের মনে হল, হুকটার মাধ্যমে গর্তর ভিতর কিছু স্পর্শের অনুভব করছেন তিনি৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শ্রীবাস্তবের ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল৷ রাহুল জানতে চাইল, ‘পেলেন কিছু?’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, পেলাম৷ তবে ও এখন আপাতত শীতঘুমেই থাক৷ কাল ফেরার পথে ওকে নিয়ে যাব৷ আর একটা দিন মাটির গভীরে ঘুমোক ও৷’

রাহুল জানতে চাইল, ‘কী সাপ ওটা?’

শ্রীবাস্তব হেসে জবাব দিলেন, ‘যখন ওকে বার করে আনব, তখন দেখবেন৷’

এর পর আরও মিনিট পাঁচেক সেই পরিত্যক্ত পাথুরে কাঠামোর মধ্যে রইল রাহুলরা৷ শ্রীবাস্তব কাঠামোটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন, কোনও কোনও সময় হাত বোলালেন ভেঙে যাওয়া দেওয়ালগুলোর গায়ে৷ একটা ধাতুর তৈরি ছোটো প্রদীপও পাওয়া গেল দেওয়ালের কুলুঙ্গির মধ্যে৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘একসময় নিশ্চয়ই এই প্রদীপটা জ্বালানো হত৷’ —এই বলে তিনি রুমালে মুড়ে যত্ন করে প্রদীপটা পকেটে রেখে দিলেন৷

রাহুলরা এর পর ফেরার পথ ধরল৷ তারা যখন আবার মন্দির চত্বরে উঠে এল, তখন মন্দির চত্বরটা নানান রঙিন পতাকায় সেজে উঠেছে৷ চত্বরের পাথুরে মেঝে ঘষে-মেজে সাফসুতরো করা হয়েছে৷ সেই চৌবাচ্চামতো জায়গাটার অনুচ্চ প্রাচীর ঘেঁষেও লাগানো হয়েছে ধর্মীয় মন্ত্র লেখা অনেক পতাকা৷ হিমেল বাতাসে উড়ছে সেগুলো৷ আর চৌবাচ্চা সংলগ্ন বেদিটাও মুড়ে দেওয়া হয়েছে নানা রঙের রেশমের কাপড় দিয়ে৷ প্রধান পুরোহিত কোঞ্চক সেখানে না থাকলেও কয়েকজন লোক এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে৷ তারা একবার শুধু তাকাল রাহুলদের দিকে, কিন্তু কোনও কথা বলল না৷ রাহুলরা আর চত্বরে না দাঁড়িয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে তালা খুলে নিজেদের ঘরে গিয়ে ঢুকল৷ রাহুল ঘরে ঢুকে শ্রীবাস্তবকে বলল, ‘আপনার সঙ্গে না এলে এই অদ্ভুত সুন্দর জায়গাটা দেখা হত না৷ ধন্যবাদ আপনাকে৷’

শ্রীবাস্তব শুধু জবাব দিলেন—‘হুম৷’ পাইনবনের সেই বাড়িটা থেকে বেরোবার পরই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছেন শ্রীবাস্তব৷ ফেরার পথে একটাও কথা বলেননি৷ কী যেন গভীরভাবে চিন্তা করছেন তিনি৷ ব্যাপারটা রাহুলের নজর এড়াল না৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের দরজায় টোকা পড়ল৷ কোঞ্চকের সেই অনুচর পোর্সেলিনের পাত্রে খাবার এনেছে৷ তাতে স্যুপের মতো ধোঁয়া ওঠা গরম পানীয় আর কোনও একটা পাখির ঝলসানো মাংস৷ ঘরে খাবার নামিয়ে রেখে লোকটা চলে গেল৷ খাবার খেতে খেতে শ্রীবাস্তব একবার শুধু বললেন, ‘এই যে পোর্সেলিনের পাত্রগুলো দেখছেন, এগুলোও কিন্তু অ্যান্টিক৷ সম্ভবত মিং আমলের এগুলো৷ এক একটা প্লেটেরই বহু হাজার টাকা দাম হবে৷’

খাওয়া শেষ হবার পর চৌকিতে শুয়ে পড়ল ওরা৷ বাইরে থেকে কোনও শব্দ ভেসে আসছে না৷ সম্ভবত সাজানো শেষ করে চত্বর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে লোকজন৷ খোলা জানলা দিয়ে উপত্যকার কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে৷ আকাশের বুকে অনেক দূরে বিন্দুর মতো একটা পাখি উড়ছে৷ সেদিকে তাকিয়ে রইল রাহুল৷ শ্রীবাস্তবের দৃষ্টি ঘরের সিলিং-এর দিকে নিবদ্ধ৷ কী যেন ভাবছেন তিনি৷ রাহুল তাঁর এই চুপচাপ থাকার কারণ জিজ্ঞেস করবে ভাবল একবার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সমীচীন মনে করল না৷ তবে একসময় তার আর ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে ভালো লাগল না৷ চৌকি থেকে নেমে সে বলল, ‘আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি৷’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘যান, কিন্তু চত্বরের বাইরে যাবেন না৷ অচেনা জায়গাতে পথ হারালে বিপদ হবে৷’

রাহুল প্রথমে মন্দিরের বাইরে এল৷ সত্যিই চত্বরটা জনশূন্য৷ কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে৷ বাতাসে শুধু পতাকাগুলো উড়ছে৷ কিছুক্ষণ চত্বরে দাঁড়িয়ে থেকে সে আবার মন্দিরে প্রবেশ করল৷ মন্দিরের ভিতরেও কাউকে দেখতে পেল না সে৷ গর্ভগৃহে না নামলেও মন্দিরের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখতে লাগল রাহুল৷ কত বিচিত্র অ্যান্টিক সামগ্রী ছড়িয়ে আছে ঘরগুলোতে৷ কাঠের মুখোশ, পাথরের বা ধাতুর মূর্তি, পোর্সেলিনের পাত্র, রুপোর বাতিদান, আরও কত কিছু! ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে রাহুল মন্দিরের পিছনের অংশে চলে এল৷ একটা লম্বা বারান্দা ঝুলন্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে৷ বারান্দার একপাশে সার সার কাঠের ঘর৷ বারান্দার শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে অর্ধবৃত্তাকারে ল্যান্ডস্কেপ দেখা যায়৷ তা দেখার জন্যই রাহুল সেই বারান্দার শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল৷ সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন উন্মুক্ত হয়ে গেল তার সামনে৷ নীল আকাশের চাঁদোয়ার নীচে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়ের তুষারধবল শৃঙ্গগুলো৷ যেন হাত বাড়ালেই তাদের ছোঁয়া যাবে৷ তন্ময়ভাবে রাহুল চেয়ে রইল সেদিকে৷ হঠাৎ একটা শব্দে রাহুলের মনঃসংযোগ ছিন্ন হল৷ একটা শব্দ আসছে কাছেই কোনও জায়গা থেকে৷ অনেকটা চাপা গোঙানির মতো৷ ভালো করে খেয়াল করেই সে বুঝতে পারল, শব্দটা আসছে সামনের ঘর থেকেই৷ ঘরটা বাইরে থেকে শিকল তোলা৷ তবে পাল্লা দুটোর মধ্যে সামান্য একটু ফাঁক আছে৷ একটু দোনোমনো করে রাহুল সে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ হ্যাঁ, ঘরের ভিতর কে যেন গোঙাচ্ছে! কৌতূহলবশত রাহুল চোখ রাখল দরজার ফাঁকে৷ ঘরটা আধো-অন্ধকার৷ মাথার ওপরের ঘুলঘুলি দিয়ে শুধু একটু আলো আসছে৷ ঘরের মধ্যে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে একজন—একটা বাচ্চা ছেলে! আধো-অন্ধকারের মধ্যে চোখ একটু সয়ে যেতেই রাহুল চিনতে পারল তাকে৷ আরে, এ যে ডং-পো! ওকে এভাবে এখানে আটকে রাখা হয়েছে কেন? ঘরের ভিতর ঢোকা সমীচীন হবে কি না, রাহুল ঠিক বুঝতে পারল না৷ শ্রীবাস্তবের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার৷ রাহুল তাই দরজা ছেড়ে দ্রুত নিজেদের ঘরে ফেরার জন্য এগোল৷

সিলিং-এর দিকে একইভাবে চিন্তামগ্ন হয়ে তাকিয়ে ছিলেন শ্রীবাস্তব৷ রাহুল ঘরে ঢুকে উত্তেজিতভাবে তাঁকে বলল, ‘জানেন, ডং-পো বলে সেই ছেলেটাকে একটা ঘরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে৷ আমি দেখে এলাম৷ ঘরের আশপাশে কোনও লোকজন নেই৷ তাহলে মূর্তিটা ফিরে আসার পরও কি ওকে শাস্তি দেওয়া হল? ওটাই কি তাহলে জম্ভলা দেবতার ঘর? যে ঘরে ওকে আটকে রাখা হবে বলে ও শুনেছিল? মন্দিরের একদম পিছনের দিকে সেই ঘরটা৷’

রাহুলের কথা শুনে শ্রীবাস্তব তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘না, ওটা জম্ভলা দেবতার ঘর নয়৷ সে ঘরে আমরা গেছি৷ আমার ধারণা, ছেলেটাকে সে ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে৷ কিন্তু তার আগেই ছেলেটাকে মুক্ত করতে হবে৷ আমাকে সে ঘরে নিয়ে চলুন৷’

ঘর থেকে বেরিয়ে আবার সেই অলিন্দের দিকে রওনা হল ওরা দুজন৷ মিনিটখানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেল সেখানে৷ রাহুলরা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই আতঙ্কে গোঙিয়ে উঠল বাচ্চাটা৷ শ্রীবাস্তব তার সামনে বসে চটপট তার বাঁধন খুলে দিতেই মেঝেতে উঠে বসল ছেলেটা৷ তার মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ৷ শ্রীবাস্তব তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাকে ওরা আটকে রেখেছে কেন?’

ডং-পো ভীতসন্ত্রস্তভাবে জবাব দিল, ‘আমি গ্রামে ফিরে মন্দিরে ঢুকলাম৷ কোঞ্চকের সঙ্গে দেখা হতেই সে ধরে ফেলল আমাকে৷ সে বলেছে যে আজ রাতে আমাকে জম্ভলাদেবের ঘরে আটক করা হবে৷’

তার কথা শুনে যেন মৃদু কেঁপে উঠলেন শ্রীবাস্তব৷ তিনি বলে উঠলেন, ‘তুমি এখনই পালাও৷ ও ঘরে তোমাকে ঢোকালে তুমি আর বাঁচবে না৷ পালাও, পালাও৷’

সে ঘর থেকে এর পর দ্রুত বেরিয়ে এল ওরা তিনজন৷ বাইরে বেরিয়েই অলিন্দ দিয়ে ছুটে মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল ছেলেটা৷ রাহুলরাও কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করল৷

শ্রীবাস্তব ঘরে ঢুকেই বেশ উত্তেজিতভাবে পায়চারি শুরু করলেন৷ রাহুল তাঁকে বলল, ‘ছেলেটার কথা শুনে আপনি অমনভাবে ছুটে গেলেন কেন? জম্ভলা দেবতার ঘরে গেলে ও আর বাঁচাবে না কেন? আমরাও তো ও ঘরে গেছি৷ সেখানে তো তেমন কিছু চোখে পড়ল না৷’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘চোখে পড়েনি, কারণ তাদের সাধারণত চোখে দেখা যায় না৷ আর যারা দেখে, তারা ওই ঘর থেকে আর বেরোতে পারে না৷’

রাহুল বলল, ‘আপনি কি তবে কোনও ভূতপ্রেত-অপদেবতার কথা বলছেন?’

শ্রীবাস্তব কী একটা উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেলেন৷ তারপর বাচ্চাদের মতো রাহুলের সামনে দুটো আঙুল মেলে ধরে বললেন, ‘একটা আঙুল ধরুন তো৷ একটা সিদ্ধান্ত নেব কি নেব না তা ঠিক বুঝতে পারছি না!’

তাঁর এই কথা শুনে গম্ভীর পরিবেশের মধ্যেও হেসে ফেলল রাহুল৷ তারপর সে শ্রীবাস্তবের একটা আঙুল স্পর্শ করল৷ তিনি তাতে মৃদু উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘আপনি ঠিক আঙুলটাই ধরলেন৷ আমিও কাজটা করার ব্যাপারেই ভাবছিলাম৷’

রাহুল বলল, ‘আপনার কথাবার্তা, আচার-আচরণ কিছুই আমার বোধগম্য হচ্ছে না! আপনি কী কাজ করতে চাইছেন? জম্ভলা দেবতার ঘরের রহস্যটাই বা কী? খোলসা করে পুরো ব্যাপারটা বলুন৷’

কিন্তু শ্রীবাস্তব তার প্রশ্নর জবাব দেবার আগেই বাইরে একটা শব্দ শোনা গেল৷ কাঠের মেঝেতে পা ফেলে কেউ যেন দ্রুত এগিয়ে আসছে ঘরের দিকে৷ আর তারপরই দরজায় ধাক্কা দেবার শব্দ শোনা গেল৷

শ্রীবাস্তব দরজা খুললেন৷ সামনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রধান পুরোহিত কোঞ্চক৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের ভিতরটা একবার বাইরে থেকে দেখে নিয়ে তিনি গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘এ ঘরে কেউ এসেছিল?’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘আপনার লোক শুধু ঘণ্টাখানেক আগে খাবার দিতে এসেছিল৷’

কোঞ্চক আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা কেউ মন্দিরের পিছনের অংশে গিয়েছিলেন?’

রাহুলরা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারল কোঞ্চক কেন জিজ্ঞেস করছেন কথাটা৷ শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘না আমরা যাইনি ওদিকে৷’

কোঞ্চক উত্তর শুনে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে রইলেন শ্রীবাস্তবের দিকে৷ যেন তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন শ্রীবাস্তবের কথা সত্যি কি না৷ তারপর আর কোনও কথা না বলে যেমন এসেছিলেন, তেমনই কাঠের মেঝেতে জুতোর শব্দ তুলে অন্যদিকে চলে গেলেন৷ শ্রীবাস্তব আবার দরজাটা বন্ধ করে দিলেন৷

রাহুল উৎসুকভাবে তাকাল শ্রীবাস্তবের মুখের দিকে৷ শ্রীবাস্তব তার উদ্দেশে বললেন, ‘আপাতত আপনাকে আমি শুধু এই কথাই বলি, এ মন্দিরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটা ব্যাপারের পরিসমাপ্তি ঘটাব আমি৷ বিকাল হয়ে আসছে৷ আর কিছু সময় পরই মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠান শুরু হবে৷ নিজের চোখেই আপনি সব দেখতে-বুঝতে পারবেন৷’

শ্রীবাস্তবের এ কথাগুলোরও কোনও মানে বুঝতে পারল না রাহুল৷ তবে সে আর কোনও প্রশ্ন করল না৷ খোলা জানলা দিয়ে সে চেয়ে রইল বাইরের দিকে৷ সময় এগিয়ে চলল৷ ধীরে ধীরে মন্দির চত্বর থেকে নানারকম শব্দ ভেসে আসতে শুরু করল৷ সম্ভবত লোকজন জমতে শুরু করেছে সেখানে৷ তারই শব্দ কানে আসছে রাহুলদের৷

ছয়

ঠিক বেলা চারটে নাগাদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চত্বরে এসে দাঁড়াল ওরা৷ ইতিমধ্যেই লোকজনে ভরে গেছে সারা চত্বর৷ গ্রামের সব লোক এসে উপস্থিত হয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণে উৎসবে শামিল হতে আর জম্ভলা দেবতার দর্শন পাবার জন্য৷ সবার পরনেই ঝলমলে রংচঙে পোশাক৷ কারও কারও হাতে মুখবন্ধ মাটির হাঁড়ি, আবার কারও হাতে দড়ি বাঁধা বেজি৷ বৃদ্ধ, নারী, শিশু সবাই আছে সেই ভিড়ের মধ্যে৷ সবচেয়ে বেশি ভিড় উঁচু বেদির সামনে সেই চৌবাচ্চাটাকে ঘিরে৷ চত্বরের এক কোনায় বসে একটা বিরাট ভেরী ধীর অথচ ছন্দোবদ্ধভাবে বাজিয়ে চলেছে একজন৷ তার গুমগুম শব্দ পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে আসছে৷ বাতাসে উড়ছে রঙিন পতাকাগুলো৷ কোলাহলমুখর মন্দির প্রাঙ্গণ৷

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘চলুন, আমরা বেদির কাছে ওই চৌবাচ্চাটার ওখানে দাঁড়াই৷’ গ্রামের লোকেরা ওদের দেখে অবাক চোখে তাকাল ঠিকই, কিন্তু বিদেশি অতিথি বলেই হয়তো একটু সরে গিয়ে বেদির ঠিক সামনে চৌবাচ্চাটার গায়ে ওদের দুজনের দাঁড়াবার জায়গা করে দিল৷

বেদির সামনের চৌবাচ্চার তলাটা খটখটে শুকনো৷ তার সাদা পাথর বিছোনো মেঝেটা ঝকমক করছে৷ সম্ভবত সেটাও ঘষে-মেজে পরিষ্কার করা হয়েছে৷ চৌবাচ্চাটাই সম্ভবত অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু৷ সে জায়গাতে দাঁড়াবার জন্যই ঠেলাঠেলি-ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে৷ সবাই যেন কীসের একটা প্রতীক্ষা করছে আর উৎসুকভাবে তাকাচ্ছে মন্দিরের দিকে৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন প্রধান পুরোহিত কোঞ্চক৷ জনতার মধ্যে তাঁকে দেখে একটা হর্ষধ্বনি উঠল৷ তিনিই তো উৎসব পরিচালনা করবেন৷ ভেরিটা বাজতে শুরু করল দ্রুতলয়ে৷

কোঞ্চকের পরনে বেশ জমকালো পোশাক৷ ঘন নীল রেশমের ওপর সোনালি জরির কাজ করা লম্বা ঝুলের আলখাল্লা৷ লাল রঙের কোমরবন্ধ থেকে ঝুলছে রুপোর পাতে মোড়া খাপসুদ্ধ একটা তলোয়ার৷ হাঁটু পর্যন্ত মোজায় ঢাকা পায়ে থ্যাবড়া নাকওয়ালা ধাতুর নাল লাগানো ধবধবে সাদা জুতো৷ মাথায় তেকোনা পশুলোমের তিববতি টুপি৷ সেটাও বিকেলের সূর্যালোকে ঝলমল করছে৷ তাঁর হাতে ধরা আছে রুপোর তৈরি একটা ছোটো লাঠি৷ তার বাঁকানো মাথাটা বেজির মাথার আদলে তৈরি৷ কোঞ্চক দৃপ্ত ভঙ্গিতে সোজা এগিয়ে এসে উঠে দাঁড়ালেন চৌবাচ্চার সামনে বেদিতে ওঠার সিঁড়ির ধাপে৷ আবার হর্ষধ্বনি উঠল জনতার মধ্যে৷ হাতের ছড়িটা ওপর দিকে তুলে ধরে জনতাকে চুপ করার ইঙ্গিত করলেন তিনি৷ সূর্যের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল ছড়ির মাথায় বসানো বেজির লাল চোখ দুটো৷ সম্ভবত সেগুলো চুনি পাথরের৷ সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল জনতার কোলাহল৷ বাজনাও থেমে গেল৷ পুরোহিত কোঞ্চক এরপর তিববতি ভাষায় কী যেন বলতে শুরু করলেন৷ তাঁর ভাষণ মন দিয়ে শুনতে থাকল জনতা৷ রাহুল অবশ্য তাঁর কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘কোঞ্চক জম্ভলা দেবতার মহিমা ব্যক্ত করছেন গ্রামবাসীদের কাছে৷ দেবতাকে মান্য করলে গ্রামবাসীরা সব বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, আর না মানলে দেবতার কোপে তাদের কী ভীষণরকম ক্ষতি হতে পারে, সেসব কথা বোঝাচ্ছেন পুরোহিত৷’

একটানা প্রায় দশ মিনিট বলার পর থামলেন তিনি৷ উপস্থিত জনতা মাথা ঝুঁকিয়ে শ্রদ্ধা জানাল তাঁকে৷ কোঞ্চক এরপর আবার তাঁর ছুরিটা প্রথমে মাথার ওপর তুলে ধরলেন, তারপর ছুরিটা দিয়ে দিকনির্দেশ করলেন চৌবাচ্চার দিকে৷ অনুষ্ঠান শুরু করার ইঙ্গিত দিলেন তিনি৷ উল্লাসধ্বনি করে উঠল জনতা৷ ঢাকটা আবার বাজতে শুরু করল দ্রুতলয়ে৷ জনতা ঠেলাঠেলি করে ঝুঁকে পড়ল চৌবাচ্চার প্রাচীর ধরে৷

একজন লোক প্রথমে একটা বেজিকে নামিয়ে দিল চৌবাচ্চার ভিতর৷ রাহুলদের পাশেই কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল মুখবন্ধ মেটে হাঁড়ি নিয়ে৷ রাহুলের প্রাথমিক অবস্থায় ধারণা হয়েছিল যে, হাঁড়িগুলোর মধ্যে হয়তো দেবতাকে নিবেদনের জন্য খাবার বা পুজোর কোনও উপকরণ আছে৷ বেজিটাকে নীচে নামাবার পর সেটা বিরাট চৌবাচ্চার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কয়েকবার ছোটাছুটির পর এক জায়গাতে স্থির হয়ে দাঁড়াল৷ আর এর পরই একজন তার হাতের হাঁড়িটা ওপর থেকে ছুঁড়ে দিল চৌবাচ্চার ভিতর৷ সশব্দে পাথুরে মেঝেতে আছড়ে পড়ে ফেটে গেল হাঁড়িটা৷ কোনও খাদ্যদ্রব্য নয়, তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা হাত তিনের লম্বা সাপ! ব্যাপারটা এবার কী হতে চলেছে বুঝতে পারল রাহুল৷ সাপ আর বেজির লড়াই!

সাপটা ভাঙা হাঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেই খাড়া হয়ে উঠল বেজির লোমগুলো৷ সাপটাও তার চেরা জিভ বার করে কয়েকবার এদিক-ওদিক তাকাবার পরই দেখতে পেল বেজিটাকে৷ সঙ্গে সঙ্গে ল্যাজে ভর দিয়ে ফণা মেলে দাঁড়াল সাপটা৷ উত্তেজিত জনতা তা-ই দেখে চিৎকার করে উঠল৷

জাতশত্রুর চিনতে ভুল হয়নি কারও৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লড়াই শুরু হয়ে গেল৷ সাপটাই প্রথমে আক্রমণ করল বেজিটাকে৷ কাছে গিয়ে সে ছোবল মারল তাকে৷ কিন্তু বিদ্যুৎগতিতে সরে গেল বেজিটা৷ সাপের নিষ্ফল ছোবল আছড়ে পড়ল পাথরের মেঝেতে৷ বেজিটা এর পর পিছন থেকে আক্রমণ করল সাপটাকে৷ সে কামড়ে ধরল সাপের ল্যাজটা৷ সাপটা আবার ঘুরে গিয়ে ছোবল মারল৷ কিন্তু এবারও সরে গেল বেজি৷ বারবার এভাবেই আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ চলতে লাগল৷ সাপের ফোঁস ফোঁস আর বেজির ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দে ভরে উঠল জায়গাটা৷ সবার সঙ্গে রাহুলও উত্তেজিতভাবে দেখতে লাগল সেই লড়াই৷ বোঝা যাচ্ছে যে, লোকজনের মধ্যে জম্ভলাদেবের অনুচরের প্রতিই সমর্থন বেশি৷ কারণ বেজিটা সাপকে আক্রমণ করলেই হর্ষধ্বনি উঠছে তাদের মধ্যে৷ কিন্তু বারবার ল্যাজে কামড় খেয়ে আর ছোবল মারতে মারতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল সাপটা৷ বেজিটা মনে হয় এ জন্যই অপেক্ষা করছিল৷ বেজিটা এর পর সাপটাকে আর না কামড়ে বৃত্তাকারে তার চারপাশে ঘুরতে লাগল৷ আর সাপটা এক জায়গাতে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে বেজিটাকে দেখার চেষ্টা করতে লাগল৷ হঠাৎই বেজিটা আড়াআড়িভাবে একটা লম্বা লাফ দিল সাপের মাথার ওপর দিয়ে৷ মুহূর্তের মধ্যে একটা লাল দাগ যেন আঁকা হয়ে গেল সাপের ফণাতে৷ দেহটা ফণা সমেত পড়ে গেল মাটিতে৷ বেজির নখর দু-টুকরো করে দিয়েছে সাপের ফণা! মুহূর্তের নিস্তব্ধতা৷ তারপর উল্লাসে চিৎকার করে উঠল জনতা৷ শুরু হল জম্ভলা দেবতার নামে জয়ধ্বনি৷ বেজিটা তখন আক্রোশে টুকরো টুকরো করতে শুরু করেছে মৃত সাপটাকে৷ তার কৌশলের কাছে পরাজিত কালসর্প৷

সেই বেজি আর মৃত সাপটাকে তুলে এনে এরপর আর একজন একটি বেজি নামাল চৌবাচ্চায়৷ আবার একটা হাঁড়ি ফেলা হল৷ তার থেকে বেরিয়ে এল একটা সাপ৷ আবার লড়াই শুরু হল৷ খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ রাহুল খেয়াল করল, শ্রীবাস্তব তার পাশে নেই৷ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার সে খেলা দেখতে লাগল৷ মিনিট তিনেকের মধ্যে এই সাপটারও একই পরিণতি হল৷ তারপর আবার নতুন বেজি, নতুন সাপ নামানো চলল৷ প্রতিবার খেলার স্থায়িত্বই পাঁচ থেকে সাত মিনিট৷ বেজির কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে যাচ্ছে সাপরা৷ জয়ধ্বনি উঠছে জম্ভলা দেবতার নামে৷ বেশ কয়েক দফা এ খেলা চলার পর একটা বেজি যখন মৃত সাপের দেহটাকে টুকরো টুকরো করছে, তখন খেলা থামাবার নির্দেশ দিলেন পুরোহিত কোঞ্চক৷ ঢাকের বাজনা, জনতার চিৎকার থেমে গেল কিছু সময়ের জন্য৷ রাহুল খেয়াল করল, মন্দিরের ভিতর থেকে এবার বাজনার শব্দ কানে আসছে৷ সমবেত জনতা যেন সে শব্দ শুনে ধীরে ধীরে মন্দিরের দিকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে৷ রাহুল দেখল শ্রীবাস্তব তার পাশে ফিরে এসেছেন৷ তিনিও আঙুল নির্দেশ করে রাহুলকে মন্দিরের দিকে দেখালেন৷

বাজনার শব্দ ক্রমশ মন্দিরের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসছে৷ জনতা নিশ্চল নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে৷ মন্দির তোরণ থেকে প্রথমে শিঙা বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে এল একজন লোক৷ তার পিছনে পিছনে থালার মতো পিতলের ঝাঁজর বাজাতে বাজাতে দুজন৷ আর তারপরই আত্মপ্রকাশ করলেন জম্ভলা দেবতা৷ দুজন লোকের কাঁধে কাঠ আর রুপোর তৈরি ছোট্ট একটা পালকিতে মখমলের চাদরে আরাম করে বসে আছেন দেবতা৷ একটা লোক পালকির পাশে হাঁটতে হাঁটতে চামর দোলাচ্ছে পালকির দেবতার গায়ে৷ পালকির পিছনেও দুজন লোক আছে৷ তারা কাঁসর-ঘণ্টা বাজাচ্ছে৷ মিছিলটা বাইরে আসতেই তিববতিরা জয়ধ্বনি করতে লাগল জম্ভলা দেবতার নামে৷ দ্রুতলয়ে বাজতে শুরু করল ভেরি৷ কাঁসর-ঝাঁজর, ঢাক, জনতার উল্লাসধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাহাড়ে৷ মিছিলটা এগিয়ে এল রাহুলদের কাছে৷ তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপর উঠে জম্ভলা দেবতার পালকিকে বসানো হল বেদির ওপর৷ জম্ভলা দেবতাকে দেখে কিন্তু অবাক হয়ে গেল রাহুল৷ না, পালকির ভিতরে কোনও বিগ্রহ নেই, সেখানে বসে আছে একটা বিরাট বড়ো বেজি! এত বড়ো বেজি কোনও দিন দেখেনি রাহুল৷ আকারে সেটা মোটাসোটা হুলো বেড়ালের চেয়েও বড়ো! দেহে ছাই রঙের লোম৷ তার লোমওয়ালা ল্যাজটা ঝালরের মতো ঝুলছে পালকির বাইরে৷ অর্ধ-উন্মীলিত চোখে লোকজনের কোলাহল শুনে একবার হাই তুলল অদ্ভুত প্রাণীটা৷ দেখা গেল তার তীক্ষ্ণ দাঁতের মাড়ি৷ দেবতাকে বেদির ওপর বসাবার সঙ্গে সঙ্গেই জনতা তার নামে জয়ধ্বনি করল, তারপর মাটিতে শুয়ে পড়ে দেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানাল৷ শ্রীবাস্তব চাপা স্বরে বললেন, ‘ওই প্রাণীটাকেই জম্ভলা দেবতার জীবন্ত রূপ ভাবা হয়৷ লোকচক্ষুর অগোচরে ও প্রধান পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে থাকে৷ বছরে একবার ও জনতাকে দর্শন দেয়৷ সহজ সরল গ্রামবাসীরা ওকেই দেবতার অবতার বলে মানে৷ ভক্তির ঘটা দেখেছেন! কেমন সবাই শুয়ে পড়েছে দেবতাকে প্রণাম করার জন্য!’

প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল লোকগুলো৷ রাহুল একবার আকাশের দিকে তাকাল৷ আর ঘণ্টাখানেকর মধ্যেই অন্ধকার নামবে৷ দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তুঙ্গ পাহাড় আর পাইনবনের ফাঁক গলে দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে পড়েছে মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখে৷ ভক্তিভরে তাকিয়ে আছে তারা দেবতার দিকে৷ দেবতার দর্শনের সুযোগ বছরে এই একটা দিনই আসে৷

এবার অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্ব শুরু হবে৷ তাই প্রধান পুরোহিত কোঞ্চক বেদির দিকে সিঁড়ির ওপর আরও এক ধাপ উঠে দাঁড়ালেন, যাতে সবাই তাঁকে দেখতে পায়৷

সমবেত জনতার উদ্দেশে কোঞ্চক বললেন, ‘তোমরা সবাই দেবতার দাস, সবাই আমরা দেবতাকে মান্য করে চলব তা-ই-তো, পুরোহিতের নির্দেশ মান্য করে চলবে তো?’

সমবেত জনতা মাথা ঝুঁকিয়ে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ৷’

কোঞ্চক এরপর বললেন, ‘আজ কিন্তু তোমাদের কাছে নতুন প্রধান পুরোহিত নির্বাচনের সুযোগ আছে৷ তোমরা কেউ দেবতাকে পরাস্ত করতে পারলে সে-ই প্রধান পুরোহিত হবে বা তাকে নির্বাচন করতে পারবে৷ যুগ যুগ ধরে পুরোহিত নির্বাচনের এই পদ্ধতি এখানে চলে আসছে৷’

জনতা তাঁর কথা শুনে নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে রইল৷ স্বয়ং ভগবানের বিরুদ্ধে লড়াই! সে আবার হয় নাকি?

প্রধান পুরোহিতের চোখ ছুঁয়ে যাচ্ছে সবার মুখ৷ দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর সবার চোখে-মুখে ফুটে আছে তাঁর প্রতি ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা৷ কোঞ্চকের ঠোঁটের কোণে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল হালকা একটা হাসির রেখা৷ তাঁর কথাগুলো অবশ্য চাপা স্বরে রাহুলকে বুঝিয়ে দিলেন শ্রীবাস্তবই৷

কোঞ্চক এরপর বললেন, ‘তবে তো আবার আমাকেই প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব নিতে হবে৷ আমি শেষবারের জন্য জানতে চাইছি, জম্ভলাদেবের বিরুদ্ধে কেউ লড়াই দিতে আগ্রহী কি না? কেউ রাজি আছ?’

জনতা আবারও নিশ্চুপ হয়ে রইল৷

পুরোহিত কোঞ্চকের ঠোঁটের হাসিটা আরও চওড়া হল৷ অতঃপর তিনি নিজেকে আবার মন্দিরের সর্বময় কর্তা ঘোষণা করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেই সময় সবাইকে সচকিত করে শ্রীবাস্তব বলে উঠলেন, ‘আমি আপনার দেবতাকে আহ্বান জানাচ্ছি লড়াইয়ের জন্য৷’

অন্য সবাইয়ের মতো রাহুলও চমকে উঠে তাকাল শ্রীবাস্তবের দিকে৷ তিনি তাঁর একটা হাত উঁচু করে ধরেছেন৷ তাঁর সে হাতে ধরা আছে সেই কাঠের বাক্সটা! তিনি আবারও বললেন, ‘আমি আহ্বান জানাচ্ছি লড়াইয়ে৷’

তাঁর কথা শুনে কোঞ্চক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর দিকে৷ তাঁর মুখের হাসি মুহূর্তের জন্য মিলিয়ে গেলেও আবার তা ফুটে উঠল৷ তিনি বললেন, ‘ও আপনারা! কিন্তু আপনারা বিদেশি৷ আপনারা আমাদের ধর্মীয় কাজে অংশ নিতে পারবেন না৷ এটা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার৷’

এবারও শ্রীবাস্তব রাহুল আর অন্য সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন, ‘না, আমি বিদেশি নই৷ এ গ্রামেই আমার জন্ম৷ সে প্রমাণ আমি দেব৷’

পুরোহিতের মুখটা যেন এবার গম্ভীর হয়ে গেল৷ তিনি বললেন, ‘কী প্রমাণ?’

শ্রীবাস্তব মুহূর্তের মধ্যে জ্যাকেট-জামা সব খুলে ফেললেন৷ তাঁর উন্মুক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গে দিনশেষের সূর্যালোকে জেগে আছে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন! সেগুলো দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি যে এ গ্রামের লোক—এই তার প্রমাণ৷’

রাহুল তাঁর কথা বুঝতে না পারলেও উপস্থিত জনতার মধ্যে এবার কেমন যেন চাঞ্চল্য শুরু হল৷ মৃদু কথাবার্তা শুরু করল তারা৷ কোঞ্চকের মুখ যেন আরও গম্ভীর হল৷ তবে যেন তিনি শ্রীবাস্তবের ক্ষতচিহ্নগুলো দেখে তাঁর পরিচিতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে বললেন, ‘বুঝলাম যে তুমি বিদেশি নও, কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জানো যে জম্ভলা দেবতাকে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে যদি তাঁকে পরাস্ত করতে না পারো—তবে জম্ভলা দেবতার ঘরে একরাত একদিন আটকে থাকতে হবে৷’

শ্রীবাস্তব বলে উঠলেন, ‘আমি জানি, তার জন্য আমি প্রস্তুত৷ কিন্তু আপনি নিজে ভয় পাচ্ছেন নাকি? নইলে আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছেন কেন?’ স্পষ্ট বিদ্রুপ ফুটে উঠল তাঁর কণ্ঠস্বরে৷

জনতার মধ্যে আবারও একটা গুঞ্জন উঠল, ‘আরে, এ লোকটা বলে কী? তবে এ লোকটা যখন দেবতাকে সব জেনে-বুঝে লড়াইয়ের আহ্বান জানাচ্ছে, তখন লড়াইটা হওয়া উচিত৷ কারণ এটাই ধর্মীয় নিয়ম৷’ তবে তাদের এও বিশ্বাস, দেবতাই জয়ী হবেন৷ আর কোঞ্চকই আবার প্রধান পুরোহিত থেকে যাবেন৷ কারণ, দেবতা তো অমর৷ গ্রামের লোকরা পুরুষের পর পুরুষ ধরে দেখে আসছে এই একই দেবতাকে৷

কোঞ্চক মনে হয় পাঠ করতে পারলেন জনতার মনের ভাষা৷ তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ঠিক আছে, তবে তা-ই হোক৷’ এই বলে তিনি তাঁর অনুচরদের নির্দেশ করলেন দেবতাকে লড়াইয়ে অবতীর্ণ করার জন্য৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই দড়ি বেঁধে পালকি সমতে সেই দানব দেবতাকে নামিয়ে দেওয়া হল চৌবাচ্চার মধ্যে৷

শ্রীবাস্তবও প্রস্তুত হয়ে ছিলেন৷ বাক্স খুলে স্নেক হুক দিয়ে তিনি বার করে আনলেন তাঁর কালো মানিককে৷ তারপর তাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে দিলেন চৌবাচ্চার ভিতর৷ সাপটার দৈর্ঘ্য দেখে বিস্মিত হয়ে গেল লোকজন৷ তারা ঝুঁকে পড়ল চৌবাচ্চাটাকে ঘিরে৷ কোঞ্চক নিজেও এসে দাঁড়ালেন চৌবাচ্চার সামনে৷ সবাই নিশ্চুপ৷ একটা পাতা পড়লেও যেন শব্দ শোনা যাবে!

জম্ভলাদেব আরামেই পালকির মধ্যে বসে ছিলেন, কিন্তু শ্রীবাস্তব তাঁর পোষ্যকে নীচে নামাতেই যেন ছোটো পালকি থেকে আড়মোড়া ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এলেন জম্ভলাদেব৷

কোঞ্চক শ্রীবাস্তবের উদ্দেশে বললেন, ‘সাপ আর বেজির লড়াইতে সাপ জেতে না৷ ও বহু সাপকে টুকরো টুকরো করেছে৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই খেলা শেষ হয়ে যাবে৷ আর তারপর…’

হিংস্র একটা হাসি ফুটে উঠল কোঞ্চকের ঠোঁটে৷

শ্রীবাস্তব কোনও জবাব দিলেন না৷ তাঁর দৃষ্টি চৌবাচ্চার ভিতর নিবদ্ধ৷

বেজিটা বেরিয়ে আসতেই তাকে দেখতে পেল সেই মহাসর্প৷ তার মোটা কালো দেহটা প্রথমে লাঠির মতো লম্বা হয়ে গেল, তারপর মাটি থেকে অন্তত পাঁচ ফুট খাড়া হয়ে সে তার থালার মতো ফণাটা মেলে ধরে গর্জন করে উঠল—হি-স-স-স! ঠিক যেন স্টিম ছাড়ল কোনও রেল ইঞ্জিন৷ সে শব্দ শুনে চমকে উঠল সবাই৷ আগে যে সাপগুলো লড়াইতে নেমেছে, তারা কেউই এ সাপের মতো বিশাল নয়৷ আর বেজিগুলোও এত বড়ো ছিল না৷ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল জম্ভলা দেবতার প্রতিরূপ সেই দানবীয় বেজি আর দশ ফুট লম্বা হিমালয়ান কিং কোবরা৷ যুগ যুগ ধরে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী, জাতশত্রু!

লড়াই শুরু হয়ে গেল৷ সাপটাকে দেখেই বেজিটার পিঠের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল, থাবার আড়াল থেকে উঁকি দিল তীক্ষ্ণ নখর৷ প্রায় একই সঙ্গে পরস্পরকে আক্রমণ করল তারা৷ নখর বাগিয়ে বেজিটা ঝাঁপ দিল সাপটাকে লক্ষ্য করে৷ আর সাপটাও চাবুকের মতো ফণা ছুড়ল বেজির শরীরে বিষ ঢেলে দেবার জন্য৷ কিন্তু তাদের কারও দাঁত বা নখ প্রতিদ্বন্দ্বীর শরীর স্পর্শ করল না৷

আবারও ঘুরে গিয়ে পরস্পরের প্রতি আক্রমণ হানল তারা৷ কিন্তু কেউ কাউকে আঘাত হানতে পারল না৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেল, এই লড়াই এত দ্রুত থামবার নয়৷ সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইল দুই যোদ্ধার দিকে৷ মুহূর্ত, মিনিট কেটে যেতে লাগল৷ দু-পক্ষ মুহুর্মুহু আক্রমণ হানছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ কারও নাগাল পাচ্ছে না৷ বেজির ডাক আর মহাসর্পের ত্রুুব্ধ গর্জনে মাঝে মাঝে চমকে উঠছে সবাই৷ শ্রীবাস্তব আর কোঞ্চক দুজনেই চোয়াল শক্ত করে তাঁদের ভাগ্যের লড়াই দেখছেন৷ উত্তেজনায় রাহুলের হূৎপিণ্ড স্তব্ধ হবার উপক্রম৷ যে কোনও মুহূর্তে কিছু ঘটতে পারে!

ব্যাপারটা ঘটল প্রায় আধঘণ্টা লড়াই চলার পর৷ হঠাৎ বেজিটা পিছন থেকে লম্বালম্বিভাবে ঝাঁপ দিল সাপটাকে লক্ষ্য করে৷ পরমুহূর্তেই সাপটার কালো অঙ্গের এক জায়গাতে লাল রেখা দেখা গেল৷ উৎসাহে চিৎকার করে উঠল জনতা৷ অবশেষে দেবতা আঘাত হেনেছেন মহাসর্পের শরীরে! এটাই তো হবার কথা৷ আবছা হাসি ফুটে উঠল কোঞ্চকের ঠোঁটের কোণে৷

আঘাত খেয়েও নাগরাজ ঘুরে দাঁড়াল দেবতার দিকে৷ বাতাসে ছোবল দিয়ে সে ত্রুুদ্ধ গর্জন করে উঠল—হি-স-স-স…৷ কিন্তু বেজিটা দ্রুত সাপটার পিছনে গিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য আঘাত হানল৷ এ আঘাতটা বড়ো মারাত্মক৷ রাজগোখরোর ল্যাজের দিকে প্রায় ইঞ্চি ছয় অংশ প্রথমে হাঁ হয়ে গেল৷ ঝরঝর করে রক্ত পড়তে শুরু করল সেই ক্ষতস্থান থেকে৷ জনতার মধ্যে উল্লাসধ্বনি আরও তীব্র হল৷ এবার শেষ হতে চলেছে লড়াই৷

আঘাত খেয়ে এর পর পিছু হটতে শুরু করল সাপটা৷ ধীরে ধীরে সে চৌবাচ্চার কোণে আশ্রয় নিল৷ তার কালো অঙ্গ লাল হয়ে উঠেছে৷ অবসন্ন হয়ে পড়ছে সে৷ চৌবাচ্চার কোনায় গিয়ে সে ফণাটাও নামিয়ে নিল৷ আর বেজিটা গিয়ে ওঁত পাতল তার সামনে৷ লোকজনের চিৎকারে এবার যেন কানে তালা লেগে যেতে লাগল রাহুলের৷ জনতা বুঝতে পেরেছে, এবার খেলা শেষ৷ জয়ী হতে চলেছেন তাদের দেবতা৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সাপটার শরীর৷

বেজিটা কয়েক মুহূর্ত কুণ্ডলী পাকানো সাপটাকে জরিপ করে নিয়ে তার ওপর ঝাঁপ দিয়ে সরে এল৷ সাপটাও ছোবল চালাল ঠিকই, কিন্তু সবাই দেখল এবারও সফল হয়েছেন দেবতাই৷ সাপের পেটের কাছে একটা জায়গা ফাঁক হয়ে গেছে বেজির নখ বা দাঁতের আঘাতে৷ জনতার উৎসাহে তাল মিলিয়ে অট্টহাস্য করে উঠলেন কোঞ্চক৷ রাহুল শ্রীবাস্তবের দিকে তাকিয়ে দেখল, এই ঠান্ডাতেও টপটপ করে ঘাম ঝরছে তাঁর উন্মুক্ত শরীর থেকে৷

পরপর দুটো মোক্ষম আঘাত খেয়ে নিস্তেজ হয়ে গেল সাপটা৷ তার ফোঁসফোঁসানিও থেমে গেল৷ শুধু শোনা যেতে লাগল ত্রুুব্ধ দেবতার ফ্যাঁস ফ্যাঁস গর্জন৷ কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে বেজিটা শেষ আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হল৷ জনতাও সেটা দেখার জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেল৷ আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেবতার জয়ে উল্লাসধ্বনিতে ফেটে পড়বে চারদিক৷

শেষবার ঝাঁপাবার আগে ধনুকের মতো বেঁকে উঠল বেজির পিঠটা৷ তার লোমগুলো প্রচণ্ড আক্রোশে শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠল৷ এই বুঝি সে ঝাঁপ দেবে৷ ছিন্নভিন্ন করে দেবে নেতিয়ে পড়া সাপের ফণাটা! উত্তেজনা আর সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলতে যাচ্ছিল রাহুল, কিন্তু সে চোখ বন্ধ করতে পারল না৷

বেজিটা যেন বড়ো বেশি সময় নিচ্ছে ঝাঁপ দেবার আগে! রাহুল ভালো করে তাকাল বেজিটার দিকে৷ সে যেন কাঁপতে শুরু করেছে! হ্যাঁ, ঠিক তা-ই! কয়েক মুহূর্তমাত্র, তার আর ঝাঁপ দেওয়া হল না৷ টলতে টলতে পাশ ফিরে পড়ে গেলেন ভগবান৷ একটু কেঁপে উঠে চিরদিনের জন্য স্থির হয়ে গেলেন তিনি! ঠিক এই সময় মহাসর্প আবার ফণা তুলে গর্জন করে উঠল—‘হি-স-স-স…৷’ ঘটনাটা বুঝে উঠতে মুহূর্তখানেক সময় লাগল সবার৷ সাপটা আসলে কৌশলে পিছনে সরে গিয়েছিল, যাতে বেজিটা তাকে পিছন থেকে আক্রমণের সুযোগ না পায়৷ বেজিটা তার ওপর শেষবার আক্রমণ করার সময় তার দেহ চিরে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মহাসর্পও সেই সুযোগে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল জম্ভলা দেবতার পেটের নীচের রোমহীন অংশে৷ তার দেহে বিষ ঢেলে দিয়েছে হিমালয়ান কিং কোবরা, শ্রীবাস্তবের পোষ্য কালোসোনা৷

একটা গাছের পাতা পড়লেও যেন শব্দ শোনা যাবে! জনতা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না ব্যাপারটা! পা উলটে পড়ে আছেন তাদের দেবতা! কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল শ্রীবাস্তবের উল্লাসধ্বনিতে৷ আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন তিনি৷ তারপর এক লাফে চৌবাচ্চায় নেমে হাত দিয়েই তাঁর কালো সোনাকে ধরে নীচ থেকে তুলে আনলেন৷ সাপটার এক ছোবলেই যে তাঁরও ওই ভগবানের মতো দশা হতে পারে তা তাঁর খেয়ালই নেই৷ আর সাপটাও যেন আনন্দে জড়িয়ে ধরল শ্রীবাস্তবের দেহ৷ সাপটার ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত ঝরছে৷

কোঞ্চক নির্বাক, হতভম্ব৷ তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন চৌবাচ্চার মধ্যে পড়ে থাকা মৃত বেজিটার দিকে৷ এ ঘটনা যে ঘটতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি৷ উপস্থিত লোকজনও এবার একটু তফাতে সরে গিয়ে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল শ্রীবাস্তবের দিকে৷ এ লোকটাই তো এবার জম্ভলা দেবতার পুরোহিত হবেন অথবা নতুন পুরোহিত নির্বাচন করবেন৷ ধর্মের নিয়মকানুন তো মানতেই হবে৷

সাত

পাহাড়ের মাথায় সূর্য অস্ত যেতে বসেছে৷ অন্ধকার নামতে চলেছে চারপাশের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা পাইনবনের ভিতর৷ ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসছে সেই বনের ভিতর থেকে৷ শ্রীবাস্তবের একসময় খেয়াল হল যে সাপটাকে তিনি গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন৷ তিনি বাক্সে পুরে ফেললেন তাঁর পোষ্যকে৷ তারপর বাক্সটা রাহুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পুরোহিত কোঞ্চকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ কোঞ্চকের হুঁশ ফিরল এবার৷ তিনি কাষ্ঠ হাসি হেসে শ্রীবাস্তবকে বললেন, ‘তুমি তাহলে জিতে গেলে! তুমি যখন এখানে এলে, তখনই তোমাকে আমার চেনাচেনা লাগছিল৷ তুমি কে বলো তো?’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘সেসব পরিচয় পরে দেব৷ আমার দেহের ক্ষতচিহ্নগুলো নিশ্চয়ই প্রমাণ করছে আমি এ গ্রামেরই মানুষ৷ আর এই ক্ষতচিহ্নগুলো যে জম্ভলা দেবতার অভিশাপ, তাও তুমি জানো৷ যা-ই হোক, এসব কথা পরে হবে৷ অন্ধকার নামতে চলেছে, গ্রামবাসী তোমার শেষ কথা শোনার জন্য প্রতীক্ষা করছে৷ তুমি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের ফলাফল ও তোমার প্রধান পুরোহিতের পদ থেকে অপসারণের ব্যাপারটা ঘোষণা করো৷ নইলে কাজটা আমাকেই করতে হবে৷ সেটা তোমার পক্ষে সম্মানজনক হবে না৷’

শ্রীবাস্তবের কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত কী ভাবলেন কোঞ্চক৷ তারপর নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন ধীরে ধীরে বেদির ওপর গিয়ে উঠলেন৷ তাঁর সঙ্গেই তাঁর পাশে উঠে দাঁড়ালেন শ্রীবাস্তবও৷ কোঞ্চক একবার সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমার পাশে দাঁড়ানো এই আগন্তুক এ গ্রামের বাসিন্দা বলে প্রমাণ দিয়েছে৷ সে পরাজিত করেছে জম্ভলা দেবতাকে৷ কাজেই ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে সে বা তার নির্বাচিত কোনও লোক কাল থেকে মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করবে৷ এই মন্দির বা গ্রামের যাবতীয় কার্য পরিচালিত হবে তার নির্দেশমতো৷ মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব থেকে আমি অব্যাহতি নিলাম৷’

শ্রীবাস্তব তাঁর কথা শেষ হলে জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘আগামীকাল সকালে আপনারা আবার সমবেত হবেন এই চত্বরে৷ তখন প্রধান পুরোহিতের নাম ঘোষণা করা হবে৷ অনুষ্ঠান শেষ হল৷ এবার আপনারা ঘরে ফিরে যান৷’

উপস্থিত জনতা একবার জয়ধ্বনি করে উঠল জম্ভলা দেবতার নামে, তারপর নিশ্চুপভাবে মন্দির প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে লাগল৷ বিস্ময়ের ঘোর তখনও তাদের কাটেনি৷

জনশূন্য হয়ে গেল মন্দির চত্বর৷ সেখানে শুধু দাঁড়িয়ে রইল রাহুল, শ্রীবাস্তব, সদ্য অপসারিত পুরোহিত কোঞ্চক আর দু-চারজন মন্দিরের লোক৷ কোঞ্চক শ্রীবাস্তবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার ঘরে ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নাও৷ কাল থেকে তো তোমাকেই এ মন্দিরের দায়িত্ব নিতে হবে৷ ইচ্ছা করলে অবশ্য তুমি এখনই আমার প্রধান পুরোহিতের ঘরটারও দখল নিতে পারো৷ সে অধিকার তোমার এখন আছে৷’ কোঞ্চকের শেষের কথাগুলোতে স্পষ্ট ক্ষোভের আভাস ধরা দিল৷

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘আমরা যে ঘরে আছি, সেখানেই থাকব৷’

ঠিক এই সময় ঝুপ করে অন্ধকার নামল৷ রাহুল আর শ্রীবাস্তব মন্দিরের দিকে এগোল নিজেদের ঘরে ফেরার জন্য৷ কোঞ্চক আর অন্য লোকেরাও ঢুকে গেল মন্দিরে৷ শূন্য মন্দির প্রাঙ্গণে সেই চৌবাচ্চায় শুধু পড়ে রইল জম্ভলা দেবতার প্রতিরূপ সেই বেজিটা৷

নিজেদের ঘরে ঢোকার পর রাহুল বলল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ মাথার মধ্যে সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে!’

শ্রীবাস্তব একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে হেসে বললেন, ‘ব্যাপারটা বোঝার জন্য এতটা সময় যখন অপেক্ষা করলেন, তখন না হয় কালকে সকাল পর্যন্ত আর একটু ধৈর্য ধরুন৷’

রাহুল বলল, ‘আপনি কি পুরোহিতের দায়িত্ব নিয়ে এখানেই থেকে যাবেন?’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘না, ও দায়িত্ব নেবার ইচ্ছা আমার নেই৷ কাল সকালেই আমরা ফিরে যাব৷’

তিনি এরপর তাঁর ব্যাগ থেকে কিছু ওষুধ-মলম ইত্যাদি বার করলেন, তারপর সাপটাকেও বার করলেন বাক্স থেকে৷ সাপটা কিন্তু রক্তক্ষরণের ফলে সত্যিই অবসন্ন হয়ে গেছে৷ সে নেতিয়ে পড়েছে৷ শ্রীবাস্তব তার ক্ষতস্থানগুলোতে মলম লাগাতে লাগাতে বললেন, ‘আশা করি আমার এই বন্ধু সুস্থ হয়ে উঠবে৷ আজকে ঘটনার নায়ক তো ও-ই৷ একমাত্র হিমালয়ান কিং কোবরাই বেজির মহড়া নিতে পারে৷ আজকের দিনটার জন্যই ছোটোবেলা থেকে ওকে মানুষ করেছি আমি৷ ও আজ না জিতলে আপনি ফিরে যেতে পারলেও আমার হয়তো ফেরা হত না৷’

রাহুল বলল, ‘অত বড়ো বেজি কিন্তু আমিও দেখিনি৷ অবিশ্বাস্য রকমের আকার!’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘হিমালয়ের জঙ্গলে বেশ বড়ো একপ্রকার বেজি পাওয়া যায়৷ ওটা সেই প্রজাতিরই৷ জাপানে সুমো কুস্তিগিরদের যেমন বিভিন্ন আরক খাইয়ে দেহ বিশাল করা হয়, তেমনই বেজিটাকেও আরক খাইয়ে অমন বড়ো করা হয়েছে, যাতে লোকে ভাবে ও সত্যিই দেবতার প্রতিরূপ৷ প্রধান পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে খুব গোপনে কাজটা করা হয়৷ সারা বছর লোকচক্ষুর আড়ালে ওকে রাখা হয় ওই একটা দিন ছাড়া৷ সাধারণ লোকের ধারণা ছিল ও অমর৷ কারণ ও দেবতারই অংশ৷ ওকে আমার বাবা দেখেছেন, ঠাকুরদা দেখেছেন৷ গ্রামের অনেকেই চার-পাঁচ পুরুষ দেখেছে ওকে৷ কিন্তু একটা বেজি তো এত বছর বেঁচে থাকতে পারে না৷ আসলে একটা বেজির মৃত্যু হলে গোপনে তার জায়গাতে আর একটা বেজি আনা হয়৷ তাকেও একইভাবে বিশালাকৃতি বানায় প্রধান পুরোহিত৷’

নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল রাহুলরা৷ হঠাৎ দরজায় টোকা দেবার শব্দ হল৷ কথা নামিয়ে সাপটাকে বাক্সে পুরে দরজা খুললেন শ্রীবাস্তব৷ দরজার বাইরে কোঞ্চক দাঁড়িয়ে আছেন৷ তাঁর পরনে পুরোহিতের জেল্লাদার পোশাক নেই, নিতান্তই সাদামাটা একটা পোশাক৷ তাঁকে দেখে শ্রীবাস্তব জানতে চাইলেন, ‘কী ব্যাপার?’

কোঞ্চক বললেন, ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বরাবরের জন্য মন্দির ছেড়ে চলে যাব৷ সাত পুরুষ ধরে আমরা এ মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের কাজ করেছি, কাল থেকে অন্যের আজ্ঞাবহ হয়ে এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ তিববতে ফিরে যাব আমি৷ বাকি জীবনটা ওখানেই কাটাব৷’ শেষ কথাগুলো বলার সময় বেশ করুণ শোনাল প্রাক্তন পুরোহিত কোঞ্চকের গলা৷

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘তুমি কিন্তু অনায়াসে থেকে যেতে পারো এখানে৷ তোমাকে বিতাড়িত করার কথা কিন্তু আমি বলিনি৷’

কোঞ্চক বললেন, ‘যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় এ মন্দির পরিচালনার জন্য যে নিয়ম আমরা বানিয়েছি, তার কোনওটা নতুন পুরোহিত এসে ভাঙলে তা আমি সহ্য করতে পারব না৷ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি যাব৷ এখন তোমাকে একবার আমার সঙ্গে জম্ভলা দেবতার ঘরে যেতে হবে৷’

‘ও ঘরে যেতে হবে কেন?’ জানতে চাইলেন শ্রীবাস্তব৷

প্রাক্তন পুরোহিত কোঞ্চক বললেন, ‘দিনে দুবার, দ্বিপ্রহর আর সন্ধ্যায় পরমান্ন নিবেদন করা হয় জম্ভলা দেবতাকে৷ কাজটা প্রধান পুরোহিত অর্থাৎ আমাকেই করতে হত৷ অন্য কেউ দেবতাকে খাদ্য নিবেদন করতে পারে না৷ কিন্তু সে অধিকার এখন আর আমার নেই৷ তুমি সে ঘরে চলো৷ দেবতার সামনে তাঁর রুপোর দণ্ড আমি তোমার হাতে তুলে দিয়ে প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব অর্পণ করব৷ অবশ্য তুমি সে দণ্ড কাল অন্য কারও হাতে তুলে দিয়ে তোমার দায়িত্ব তাকে অর্পণ করতে পারো৷ তবে আজ তোমাকেই প্রধান পু%রোহিতের দায়িত্ব নিয়ে দেবতাকে পরমান্ন নিবেদন করতে হবে৷’

তাঁর কথা শুনে একটু ইতস্তত করতে লাগলেন শ্রীবাস্তব৷

তা-ই দেখে কোঞ্চক বললেন, ‘ভবিষ্যতে এই মন্দিরে নানা অনাচার ঘটবে ঠিকই, কিন্তু যাবার আগে আমি দেখে যেতে চাই যে অন্তত শেষবারের খাবারটা জম্ভলা দেবতা পেয়েছেন৷ এতদিন ধরে আমি তাঁর সেবা করেছি, এটুকু যাবার আগে আমি চাইতেই পারি৷ এ চাওয়া কি তোমার কাছে খুব অযৌক্তিক মনে হচ্ছে?’ এবার স্পষ্টতই শ্রীবাস্তবের প্রতি একটা অনাস্থা আর মৃদু বিদ্রুপ ফুটে উঠল কোঞ্চকের কণ্ঠস্বরে৷

ব্যাপারটা অনুধাবন করলেন শ্রীবাস্তব৷ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, চলুন৷’

কোঞ্চকের সঙ্গে সে ঘর থেকে বেরিয়ে রাহুলরা এগোল জম্ভলা দেবতার কক্ষে যাবার জন্য৷ সারা মন্দিরে কোনও আলো জ্বলছে না৷ শ্রীবাস্তব জিজ্ঞেস করলেন, ‘মন্দিরে অন্য সব লোকজন কই?’

কোঞ্চক জবাব দিলেন, ‘সবাই গ্রামে ফিরে গেছে৷ আমার পদচ্যুতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরে আমার অধীনস্থ অন্য পুরোহিত ও কর্মীদেরও পদচ্যুতি ঘটেছে৷ তুমি বা তোমার নির্বাচিত নতুন পুরোহিত তাদের আবার নিয়োগ করবে৷’

অন্ধকার অলিন্দ পেরোতে পেরোতে কোঞ্চক এরপর প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার আসল নামটা বলো তো? তোমাকে আমার চেনা লাগছে, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না৷’

একটু চুপ করে থেকে শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘তখন আমার নাম ছিল তাশি ডিং৷ তোমার বাবা পুরোহিত কর্মা রিনচেনের সময় আমি এ গ্রাম ত্যাগ করি৷ তখন তুমি যুবক ছিলে৷ কর্মার সহকারী পুরোহিত হিসাবে মন্দিরে কাজ করতে৷ তুমি আর তোমার বাবা মিলে…’ কথাটা আর শেষ করলেন না তাশি ডিং ওরফে পদ্ম শ্রীবাস্তব৷

কিন্তু এটুকু শুনেই যেন একবার থমকে দাঁড়ালেন কোঞ্চক৷ তারপর বললেন, ‘তোমার বাবার নাম ছিল—ম্যাংগেল ডিং!’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ম্যাংগেল ডিং৷ এবার মনে পড়ল তবে?’

অন্ধকারে কোঞ্চকের মুখের অভিব্যক্তি ঠিক বোঝা গেল না৷ তিনি আবার হাঁটতে লাগলেন৷

অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই জম্ভলা দেবতার গর্ভগৃহে নেমে এল ওরা৷ বড়ো একটা প্রদীপ জ্বলছে ঘরে৷ তবে সেই প্রদীপের আলোতে কেমন যেন গা-ছমছমে লাগছে ঘরটা৷ স্তম্ভ, মাথার ওপর থেকে ঝুলন্ত ডাকিনী, অপদেবতাদের মূর্তিগুলো যেন তাকিয়ে আছে রাহুলদের দিকে৷ খোলা জানালা দিয়েই বোধহয় একঝাঁক জোনাকি ঢুকেছে ঘরে৷ উড়ে বেড়াচ্ছে তারা৷ তাদের বিন্দু বিন্দু আলো ঘরের কোনা আর থামগুলোর আড়ালে জমে থাকা অন্ধকারকে যেন আরও গাঢ় করে তুলেছে৷

তিনজন এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল জম্ভলা দেবতার বেদির সামনে৷ ধূপের ধোঁয়ার আড়ালে প্রদীপের আভায় জম্ভলা দেবতার মুখে জেগে আছে রহস্যময় হাসি৷ তাঁর পদতলে বসে থাকা ডাকিনীও যেন ঘাড় ফিরিয়ে আছে রাহুলদের দিকে৷

হঠাৎ রাহুলের মনে পড়ে গেল শ্রীবাস্তবের একটা কথা৷ সে তাকাল জম্ভলা দেবতার স্ফীত পেটের দিকে৷ তাঁর পেটে যেমন লম্বালম্বিভাবে একটা চেরা দাগ আছে৷ যদিও ধূপের ধোঁয়াতে সেটা ভালো করে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না৷

বেদির নীচেই এক কোনাতে একটা কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর জম্ভলা দেবতার রুপোর দণ্ডটা রাখা ছিল৷ রাহুল চিনতে পারল সেটা৷ বেজিমুখী এই দণ্ড বা রুপোর ছড়িটাই বিকালবেলা ধরা ছিল কোঞ্চকের হাতে৷ কোঞ্চক স্ট্যান্ড থেকে সেটা তুলে আনলেন৷ তারপর জম্ভলা দেবতার উদ্দেশে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার ন্যায়দণ্ড আমি নতুন পুরোহিতের হাতে সমর্পণ করছি৷’ ছড়িটা তিনি তুলে দিলেন শ্রীবাস্তবের হাতে৷ তারপর তাঁরা দুজনেই নতজানু হয়ে প্রণাম করলেন জম্ভলা দেবতাকে৷ এ কাজ শেষ হবার পর কোঞ্চক তাশি ডিং ওরফে শ্রীবাস্তবকে বললেন, ‘তুমি এখানে দাঁড়াও৷ আমি পরমান্ন নিয়ে আসছি৷ তুমি সেটা দেবতাকে নিবেদন করার পর তা দেখে আমি মন্দির ছেড়ে চলে যাব৷’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আচ্ছা৷’

কোঞ্চক এগোলেন পরমান্ন আনার জন্য৷ রাহুলরা দাঁড়িয়ে রইল বেদির সামনে৷ ওপরের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে একটা দরজা অতিক্রম করে তবে গর্ভগৃহে ঢুকতে হয়৷ কোঞ্চক সেই দরজাটা অতিক্রম করলেন, আর তারপরই হঠাৎ সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল সেই ভারী কাঠের দরজাটা! কী হল?

শ্রীবাস্তব সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন দরজার সামনে৷ হাতের দণ্ডটা দিয়ে বন্ধ কপাটে আঘাত করে তিনি বলে উঠলেন, ‘তুমি দরজা বন্ধ করলে কেন?’

বন্ধ কপাটের আড়াল থেকে কোঞ্চকের অট্টহাসি ভেসে এল৷ তিনি বলে উঠলেন, ‘তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি তাশি৷ আমার সব ঘটনা মনে পড়ে গেছে৷ সেবার তুমি গর্ভগৃহ থেকে বেঁচে ফিরলেও এবার আর ফিরবে না৷ পরমান্ন নয়, তোমাদের দিয়েই ভোজ সারবেন জম্ভলা দেবতা আর তাঁর ডাকিনী৷ অনেকদিন তাঁরা নরমাংসের স্বাদ পাননি৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রদীপের আলো নিবে যাবে৷ কেউ কিছু জানার আগেই তোমাদের কঙ্কালগুলো আমি পুঁতে দেব৷ কাল ভোরে গ্রামবাসীরা যখন আসবে, তখন আমি তাদের বলব, তুমি আমার হাতেই আবার প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব সমর্পণ করে মন্দির ছেড়ে চলে গেছ৷ কেউ কিছু জানবে না…’

শ্রীবাস্তব তাঁর কথা শুনে উত্তেজিতভাবে হাতের দণ্ডটা দিয়ে দরজায় আঘাত করতে করতে বললেন, ‘কী পাগলামি করছ কোঞ্চক? দরজা খোলো! ভুলে যেয়ো না, এখন আমি দেবতার প্রধান পুরোহিত৷ আমি তোমাকে শাস্তি দিতে পারি৷’ ওপাশ থেকে আবার অট্টহাস্য শোনা গেল কোঞ্চকের৷ তিনি বলে উঠলেন, ‘মূর্খ৷ কাল সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকলে তো তুমি আমাকে শাস্তি দেবে? কালকে সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য তোমাদের আর হবে না৷ কাল থেকে আবার জম্ভলা দেবতার প্রধান পুরোহিত কোঞ্চক৷ যতদিন আমি বেঁচে থাকব, ততদিন আমিই এ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত৷’

শ্রীবাস্তব চিৎকার করে উঠলেন, ‘শয়তান!!’

আবার অট্টহাস্য শোনা গেল কোঞ্চকের৷ তারপর ওপরে ওঠার সিঁড়িতে তাঁর নাল লাগানো বুটের শব্দ আর অট্টহাস্য ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল৷ শ্রীবাস্তব পাগলের মতো বেশ ক’বার ঘা দিলেন দরজাতে৷ চেষ্টা করে দেখলেন দরজাটা কোনওভাবে খোলা যায় কি না৷ কিন্তু লোহার পাটা লাগানো ভারী কাঠের দরজা পাথুরে দেওয়ালের মতোই শক্ত৷ তাকে খোলা যাবে না৷

রাহুল দেখতে পেল ঠান্ডাতেই ঘাম জমে উঠেছে শ্রীবাস্তবের কপালে৷ তাঁর মুখটা সাদা কাগজের মতো ফ্যাকশে হয়ে গেছে! রাহুলের উদ্দেশে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমরা ফাঁদে পড়ে গেলাম! জানি না এ ঘর থেকে বেঁচে ফিরব কি না৷’

রাহুল বলল, ‘কেন বেঁচে ফিরব না? এ ঘরে কী আছে?’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এ ঘরে ঢুকবে তারা৷ তারপর আমাদের ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে৷’

রাহুল বলল, ‘কারা তারা?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘জম্ভলাদেবের অনুচররা৷ ভয়ংকর হিংস্র ওরা৷ ওদের দীর্ঘদিন অভুক্ত রাখা হয়৷ কোনও জীবন্ত প্রাণীর দেখা পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর৷ স্তম্ভ, মেঝেতে যে ছিদ্রগুলো দেখছেন, ওখান দিয়েই বেরিয়ে আসে!’

হঠাৎই রাহুলদের পায়ের নীচের মেঝেতে একটা অদ্ভুত শব্দ হল৷ আর তার পরমুহূর্তেই দেওয়াল-থামগুলোর ভিতর থেকে অদ্ভুত খসখস শব্দ শুরু হল৷ যে শব্দ কানে যাওয়ামাত্রই শ্রীবাস্তব বলে উঠলেন, ‘শয়তানটা মনে হয় এ ঘরের নীচে একটা কাঠের পাটাতন আছে, সেটা সরিয়ে দিয়েছে! মাটির নীচের ঘর থেকে দলে দলে উঠে আসছে তারা৷ ও তারই শব্দ! চলুন চলুন, দেবতার বেদিতে গিয়ে উঠতে হবে৷’ —এই বলে তিনি ছুটলেন জম্ভলা দেবতার বেদির দিকে৷ তাঁর পিছন পিছন ছুটে বেদিতে গিয়ে উঠে পড়ল রাহুলও৷

ঝুপ ঝুপ! একটু শব্দ হল৷ রাহুল দেখল দুটো বেজি লাফ দিয়ে স্তম্ভের ফোকর থেকে মেঝেতে নামল! তারপর অন্য একটা স্তম্ভের গায়ে বসানো অপদেবতার মুখের ভিতর থেকে আরও তিনটে! মেঝে ফুঁড়েও যেন উঠে এল বেশ কয়েকটা! সারা ঘরে ছোটাছুটি শুরু করল তারা৷ বেজির সংখ্যা যেন বাড়তেই থাকল ঘরের মধ্যে৷ তারা কেউ নেমে আসছে স্তম্ভের ভিতর থেকে, কেউ বা আবার উদয় হচ্ছে মেঝের ভিতর থেকে৷ রাহুল আর শ্রীবাস্তব ওপর থেকে দেখতে লাগল তাদের৷ অসংখ্য আলোকবিন্দু ছোটাছুটি করে চলেছে আধো-অন্ধকার ঘরের মেঝেতে! ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলোর চোখ যেন জিঘাংসায় জ্বলছে! বেশ কিছুক্ষণ ছোটাছুটির পর হঠাৎই যেন তারা শান্ত হয়ে ঘরের ঠিক মাঝখানে জড়ো হল৷ একসঙ্গে মাথা উঁচু করে তারা তাকাল বেদির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রাহুলদের দিকে৷ তারপর ধীর অথচ ছন্দোবদ্ধভাবে, ঠিক যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকরা এগোয়, তেমনই এগোতে শুরু করল বেদির দিকে৷ রাহুল আতঙ্কে শিউরে উঠল৷

বেদির ঠিক নীচে এসে থেমে গেল জম্ভলা দেবতার অনুচররা৷ তারপর কয়েকটা বেজি ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করল ওপরে৷ কিন্তু তারা বেদির কাছাকাছি পৌঁছোতেই শ্রীবাস্তব তাঁর হাতের ছড়িটা উলটো করে ধরে আঘাত হানতে শুরু করলেন৷ যে কয়েকটা বেজি ওপরে উঠে এসেছিল, তারা সে আঘাতে ছিটকে পড়ল নীচে৷ বিজাতীয় আর্তনাদ করে উঠল তারা৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও একটা দল সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল৷ শ্রীবাস্তব আবার আঘাত দিতে শুরু করলেন৷ আবারও নীচে পড়ে গেল বেজির দল৷ বারকয়েক এমন হবার পর পুরো দলটাই পিছু হটে ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল৷ ছোটো ছোটো পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে তারা, নিশ্চলভাবে৷ ঠিক যেমন গর্ভগৃহ বা দেওয়ালের গায়ে বেজির মূর্তি খোদাই করা আছে, সেইভাবে৷ মিনিটের পর মিনিট কেটে যেতে লাগল৷ একসময় রাহুল একটু আশ্বস্ত হয়ে বলল, ‘ওরা মনে হয় আর এগোবে না৷ মার খেয়ে ভয় পেয়ে গেছে৷ রাতটা এভাবে কোনওরকমে কাটিয়ে দিতে পারলেই ভোরে নিশ্চয়ই লোকজন চলে আসবে৷ আপনি তো এখন প্রধান পুরোহিত৷ তাই তারা নিশ্চয়ই এখন মুক্তি দেবে আমাদের৷’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আপনার ধারণা ভুল৷ ওরা অপেক্ষা করছে প্রদীপটা নিভে যাবার জন্য৷ তারপরই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর৷ আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন৷ আপনার এ বিপদের জন্য আমি দায়ী৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন, আগে যা-ই ভাবনা থাক আমার, আপনি যখন আমার সঙ্গী হলেন, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কোনও ঝামেলায় জড়াব না আমি৷ কিন্তু যখন শুনলাম যে কোঞ্চক বাচ্চা ছেলেটাকে এ ঘরে ঢোকাবে, তখনই আবার মনে হল, কিছু একটা করতে হবে৷ তবুও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, দোলাচলে ভুগছিলাম৷ শেষে আপনাকে দিয়ে আঙুল ধরালাম…৷’

প্রদীপ শিখাটা এবার দপদপ করে উঠল৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘ধরে নিন যতক্ষণ প্রদীপটা জ্বলবে, ততক্ষণই আমাদের আয়ু৷’

রাহুলরা বুঝে উঠতে পারছে না কী করা উচিত তাদের৷ এভাবেই কি মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনবে তারা? বেজিগুলো তাকিয়ে আছে তাদের দিকে৷ মাঝে মাঝে হাই তোলার মতো মুখ খুলছে৷ আধো-অন্ধকারও ঝিকমিক করছে তাদের তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো৷ অজস্র, অগুনতি বেজি জড়ো হয়েছে গর্ভগৃহে!

শ্রীবাস্তবের অনুমানই ঠিক হল৷ প্রদীপটা দপদপ করতে করতে নিভু নিভু হয়ে এল একসময়৷ বেজির দল এগোতে শুরু করল আবার৷ শ্রীবাস্তব লাঠি চালাতে শুরু করলেন৷ নীচে ছিটকে পড়তে শুরু করল প্রাণীগুলো৷ এবার কিন্তু তারা আর পিছু হটল না৷ দলে দলে উঠতে শুরু করল বেদির দিকে৷ পাগলের মতো লাঠি চালাচ্ছেন শ্রীবাস্তব৷ রাহুলও লাথি ছুড়তে শুরু করল বেদির মুখে উঠে আসা প্রাণীগুলোকে লক্ষ্য করে৷ কিন্তু এভাবে কতক্ষণ তারা ঠেকিয়ে রাখবে এত প্রাণীকে! একটা বেজি নীচে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনটে প্রাণী উঠে আসছে! ইতিমধ্যে কীভাবে যেন একটা বেজি উঠে এসে কামড়ে ধরল শ্রীবাস্তবের ডান পা৷ প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠে পা থেকে বেজিটাকে খুলে নিয়ে তিনি সজোরে ছুড়ে মারলেন একটা থামের গায়ে৷ বেজিগুলো তা-ই দেখে এবার প্রচণ্ড ফ্যাঁসফ্যাঁস চিৎকার শুরু করল বিজাতীয় আক্রোশে৷ ভয়ংকর সেই নারকীয় ধ্বনি!

প্রদীপটা প্রায় নিভে এসেছে৷ আর হয়তো কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র, তারপরই তারা বেদিতে উঠে এসে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে তাদের দুজনকে!

হঠাৎ রাহুলদের পিছনে অস্পষ্ট একটা শব্দ হল৷ প্রাণীগুলো কোনওভাবে পিছন থেকেও উঠে এসেছে নাকি? আতঙ্কে পিছনে ফিরে তাকাল রাহুল৷ জম্ভলা দেবতার মূর্তির গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে ছিল তারা৷ রাহুল দেখল জম্ভলা দেবতার পেটটা দু-ফাঁক হয়ে গেছে, তার তার মধ্যে দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা মাথা! আরে, এ যে ডং-পো! মাথার পর সে তার দেহটাও অর্ধেক বার করে ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে তাকাল৷ তারপর পরিস্থিতি বুঝতে পেরে চিৎকার করে কী বলে উঠল৷ লাঠি চালাতে চালাতে পিছনে ফিরে তাকালেন শ্রীবাস্তব৷ তারপর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে উঠলেন, ‘আপনি তাড়াতাড়ি দেবতার পেটের ভিতর দিয়ে বাইরে বেরোন, আমি তারপর বেরোচ্ছি৷’

সত্যিই জম্ভলাদেবের পেটের ভিতর মানুষ গলে যেতে পারে৷ ডং-পো-ও ইঙ্গিত করছে দ্রুত বাইরে বেরোবার জন্য৷ প্রদীপটা হয়তো এখনই নিভে যাবে৷ কালো শয়তানদের পুরো দলটাই যেন এবার উঠে আসছে বেদির দিকে৷ আর সময় নষ্ট করল না রাহুল৷ শরীরটাকে সে সেঁধিয়ে দিল জম্ভলা দেবতার পেটের ভিতর৷ আর তারপর শ্রীবাস্তবও ঢুকে পড়লেন সে পথে৷ ওপাশে একটা আধো-অন্ধকার ঘর৷ তবে সে ঘরে বাইরে যাবার জন্য দরজাটা খোলা আছে৷ শ্রীবাস্তব ডং-পো-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখানে এলে কীভাবে?’

সে জবাব দিল, ‘আমি মন্দির থেকে গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলাম৷ সন্ধ্যাবেলা শুনলাম তুমি নাকি দেবতাকে মেরে পুরোহিত হয়েছ৷ তাই দেখা করতে এলাম তোমার সঙ্গে৷ কিন্তু মন্দিরের কোথাও তোমাকে পেলাম না৷ হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম কোঞ্চককে৷ অন্ধকারে আমি তার পিছু নিলাম৷ দরজা খুলে সে ঢুকল এ ঘরে৷ আমি দরজার আড়াল থেকে তাকে দেখতে লাগলাম৷ সে প্রথমে দেওয়ালের গায়ের ওই বড়ো হাতলটা ঘুরিয়ে কী যেন করল, তারপর তোমরা যেখান দিয়ে বেরোলে, এই জায়গায় দেওয়ালের গায়ে চোখ রেখে কী যেন দেখতে লাগল৷ আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই ওপাশে জম্ভলা দেবতার ঘরের ভিতর থেকে তোমাদের চিৎকার আর বেজির ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম৷ কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর কোঞ্চক দরজা বন্ধ করে এ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই আমি ঘরে ঢুকে এই দেওয়ালের কাছে চলে এলাম৷ কাঠের দেওয়ালের গায়ে দেখি একটা দরজার পাল্লার মতো দাগ৷ সে জায়গা ধরে টানতেই সেটা একপাশে সরে গিয়ে একটা ফোকর বেরিয়ে গেল৷ সেটা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিতেই তোমরা দেখতে পেলে আমাকে৷’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল ডং-পো৷

শ্রীবাস্তব কথাগুলো রাহুলকে তরজমা করে দিয়ে বললেন, ‘দেওয়ালের গায়ের ওই হাতল ঘুরিয়েই সম্ভবত মাটির তলার কাঠের পাটাতন সরিয়ে নীচ থেকে বেজিগুলোকে ওপরে ওঠানো হয়, আর দেওয়ালের গায়ের এই ছিদ্র দিয়ে গর্ভগৃহের ভিতরটা লক্ষ করা হয়৷ আজ সকালে যখন আমরা গর্ভগৃহে ঢুকেছিলাম, তখনই ধূপের ধোঁয়ার মধ্যেই একবার যেন মনে হয়েছিল যে জম্ভলা দেবতার পেটটা মৃদু ফাঁক হয়ে গিয়েছিল৷ তা ছাড়া পেটের ওই দাগটা দেখে আমার কেন জানি মনে হয়েছিল যে দেবতার পেটটা ফাঁপা হতে পারে৷ যে কারণে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আপনি দেবতার পেটটা খেয়াল করেছেন কি না৷’

হঠাৎই জম্ভলা দেবতার ফাঁপা পেটের গহ্বর থেকে একটা বেজি লাফিয়ে নামল রাহুলরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তার সামনেই৷ রাহুল ফোকরটা বন্ধ করতে গেল, কিন্তু সেটা আর বন্ধ হচ্ছে না৷ ইতিমধ্যে আরও দুটো বেজি বেরিয়ে এল সেখান থেকে৷ তাদের একটা তো প্রায় রাহুলের বুকের ওপরই ঝাঁপ দিল৷ শ্রীবাস্তব বললেন, ‘এখনই আমাদের ঘর ছাড়তে হবে৷ বেজির দল আসতে শুরু করেছে৷ সংখ্যায় বেশি হলেই তখন ওরা আমাদের আক্রমণ করবে৷’

শ্রীবাস্তবের কথা শেষ হতে না হতেই আরও কয়েকটা বেজি বেরিয়ে এল ফোকর দিয়ে৷ রাহুলরা আর দাঁড়াল না সেখানে৷ দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে বেজিগুলো যাতে আর বাইরে বেরোতে না পারে, সেজন্য সে ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল৷

সামনে একটা আধো-অন্ধকার বারান্দা৷ দু-পাশে সার সার অন্ধকার ঘর৷ কোঞ্চক মন্দিরের ভিতর কোথায় আছে কে জানে? সন্তর্পণে ওরা তিনজন এগোতে লাগল সেই বারান্দা ধরে৷ সে বারান্দা সম্ভবত শেষ হয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণে৷ কিছুটা এগোবার পরই হঠাৎ একটা শব্দ কানে এল রাহুলদের৷ কাঠের মেঝেতে লোহার নাল লাগানো জুতোর শব্দ! বাইরের চত্বরটা মনে হয় সামনেই৷ কারণ, সামনের বাঁকের মুখেই আবছা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে৷ শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ওরা তিনজন থেমে গেল৷ তারপরই ওরা দেখল বাঁক ফিরে কোঞ্চক সোজা এগিয়ে আসছেন৷ তাঁকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা তিনজন ঢুকে পড়ল অলিন্দ লাগোয়া একটা অন্ধকার ঘরে৷ কোঞ্চক তাদের দেখতে পেলেন না৷ সে ঘরটার সামনে দিয়েই তিনি জুতোর শব্দ তুলে এগোলেন রাহুলরা যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে৷ সম্ভবত তিনি যাচ্ছেন গর্ভগৃহের লাগোয়া ঘরটাতে৷ জম্ভলা দেবতার পেটের ছিদ্র দিয়ে রাহুলদের অবস্থা দেখার জন্য৷

এগিয়ে গেলেন তিনি৷ রাহুলরা যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিক থেকে যেন ভেসে এল একটা শব্দ৷ সম্ভবত দরজা খোলার শব্দ৷ তারপর কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা৷ শ্রীবাস্তব বলেলেন, ‘চলুন, আমরা বেরিয়ে যাই৷ রাতটা বাইরে কোথাও আত্মগোপন করে থাকি৷ ভোর হলে ফিরে আসব৷ তারপর আমি শাস্তি দেব কোঞ্চককে৷’

কিন্তু তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই কোঞ্চকের প্রচণ্ড আর্ত চিৎকার কানে গেল রাহুলদের৷ বীভৎস এক চিৎকার! তারপর দেখা গেল চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছেন কোঞ্চক৷ রাহুলদের ঘরের সামনে দিয়েই চিৎকার করতে করতে বাইরের দিকে ছুটে গেলেন তিনি৷ সেই আধো-অন্ধকারেও রাহুলরা দেখতে পারল কোঞ্চকের দেহ কামড়ে ঝুলছে বেশ কয়েকটা বেজি৷ আর তাঁর পিছন পিছন ছুটছে বেজির ঝাঁক৷ ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হল না রাহুলদের৷ বেজির দল গর্ভগৃহ ছেড়ে জম্ভলা দেবতার পেটের ছিদ্র দিয়ে এসে জমা হয়েছিল রাহুলরা যে ঘর দিয়ে বেরিয়েছে, সে ঘরে৷ কোঞ্চক সে ঘরে দরজা খুলে ঢুকতেই অন্ধকারে বুভুক্ষু হিংস্র বেজির দল ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁর ওপর৷ নিজের ফাঁদে নিজেই পড়ে গেছেন কোঞ্চক৷ বেজির দল আর কোঞ্চক সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীবাস্তব বললেন, ‘চলুন, বাইরে গিয়ে দেখি কোঞ্চককে কোনওভাবে বাঁচানো যায় কি না৷ হয়তো ও আমাদের খুন করতে চেয়েছিল, ও অমানুষ হলেও আমরা তো মানুষ৷ কোঞ্চক যত বড়ো অপরাধীই হোক, তার জীবন বাঁচানো আমাদের কাজ৷’ এই বলে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোলেন তিনি৷ জম্ভলা দেবতার মন্দিরের বাইরের প্রাঙ্গণ থেকে তখন ভেসে আসছে কোঞ্চকের আর্ত চিৎকার৷ শ্রীবাস্তবের পিছনে ছুটতে শুরু করল ডং-পো আর রাহুলও৷ সামনে এগিয়ে বাঁক ঘুরতেই তারা বেরিয়ে এল মন্দির প্রাঙ্গণে৷ জ্যোৎস্নায় আলোকিত মন্দির প্রাঙ্গণ৷ রাহুলরা দেখল চত্বর পেরিয়ে ছুটে চলেছেন কোঞ্চক৷ তাঁর পিছনে ছুটে চলেছে বেজির ঝাঁক৷ কোঞ্চক তখন চত্বরের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছেন৷ শেষ একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল রাহুলদের কানে৷ আর তারপরই কোঞ্চক চত্বর ছেড়ে ঝাঁপ দিলেন নীচের দিকে৷ তাঁর পিছন পিছন অদৃশ্য হল বেজির দলও৷ শ্রীবাস্তব বলে উঠলেন, ‘দিনের আলো ফুটে ওঠার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই৷ কোঞ্চককে আর অন্য কোনও শাস্তি দিতে হল না৷ বংশপরম্পরায় গ্রামবাসীদের নিজেদের বশে রাখার জন্য যে পাপ ওরা করেছে, তার জন্য পেল কোঞ্চক৷’ এরপর তিববতি ভাষায় ডং-পো-র সঙ্গে কথা শুরু করলেন শ্রীবাস্তব ওরফে তাশি ডিং৷ মন্দির প্রাঙ্গণে বসেই রাতটা কেটে গেল রাহুলদের৷ একসময় দূরে পাহাড়ের মাথায় লাল আভা ফুটে উঠতে শুরু করল৷

আট

বেলা প্রায় আটটা বাজে৷ তার মধ্যেই মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়েছে গ্রামবাসীরা৷ ভিড়টা গতকালের থেকে যেন আজকে বেশি৷ গ্রাম ভেঙে পড়েছে নতুন পুরোহিতকে দেখার জন্য৷ তবে সে ভিড়ের মধ্যে প্রাক্তন পুরোহিত কোঞ্চক নেই৷ তিনি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় শুয়ে আছেন মন্দিরের ভিতরেই এক ঘরে৷ মন্দির প্রাঙ্গণের নীচে ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে ওপরে তুলে আনা হয়েছে৷ শ্রীবাস্তবের নির্দেশে তাঁর প্রয়োজনীয় পরিচর্যাও শুরু হয়েছে৷ তাঁর অবস্থা দেখে রাহুলদের মনে হয়েছে যে শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাবেন তিনি৷ কিন্তু গ্রামবাসীদের দয়ার ওপরই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে৷ কারণ, হিংস্র বেজিগুলোর আক্রমণে তাঁর দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেছে৷

ঢাক বাজতে শুরু করেছে মন্দির প্রাঙ্গণে৷ হিমেল বাতাসে উড়ছে রঙিন পতাকাগুলো৷ দিনের প্রথম সূর্যকিরণে উদ্ভাসিত মন্দির প্রাঙ্গণ৷ সূর্যের আলোতে ঝলমল করছে জম্ভলা দেবতার মন্দিরের সোনালি চূড়াগুলো৷ জনতার মধ্যেও যেন খুশির উচ্ছ্বাস৷ যেন তারা এক দম বন্ধ করা আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছে৷ রাহুলের এক একসময় মনে হতে লাগল যে গতকাল রাতের ঘটনাটা যেন নেহাতই একটা দুঃস্বপ্ন ছিল৷

ঢাক বাজতে শুরু করল দ্রুতলয়ে৷ তার সঙ্গে ঝাঁজর, ঘণ্টা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র৷ সমবেত জনতা গিয়ে উপস্থিত হল সেই বেদিটার নীচে৷ রাহুলরাও এগোল সেদিকে৷ ডং-পো-কে নিয়ে বেদির ওপর উঠলেন শ্রীবাস্তব৷ তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে তার হাতে তুলে দিলেন জম্ভলা দেবতার বেজিমুখী সেই রুপোর ছড়ি৷ জম্ভলা দেবতার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব গ্রহণ করল ডং-পো৷ তার জন্যই তো রাহুলরা প্রাণে বাঁচল৷ সমবেত জনতা জয়ধ্বনি করে উঠল ডং-পো আর জম্ভলা দেবতার নামে৷ দায়িত্বগ্রহণের পর ডং-পো কয়েকটা কথা বলল তিববতি ভাষায়৷ ছোট্ট অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল৷ জম্ভলা মন্দিরের নতুন পুরোহিতকে নিয়ে আনন্দ উৎসব শুরু হল৷ শ্রীবাস্তব নীচে নামার পর রাহুল তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘ডং-পো তার বক্তৃতায় কী বলল?’

শ্রীবাস্তব বা তাশি ডিং হেসে বললেন, ‘ও বলল, এবার থেকে আর বেজি পোষা হবে না মন্দিরে৷ জম্ভলা দেবতার ঘরেও কাউকে আটকে রাখা হবে না৷ বেজি আর সাপের লড়াইও বন্ধ এবার থেকে৷ এ ব্যাপারগুলো বন্ধ করবে বলে সে কথা দিয়েছিল আমাকে৷’

রাহুলরা ঘর থেকে তাদের জিনিসপত্র আগেই নিয়ে এসেছিল৷ শ্রীবাস্তব এরপর বললেন, ‘চলুন, সবাই এখন নতুন পুরোহিতকে নিয়ে যেতে আসছে৷ এই সুযোগে আমরা চত্বর ছাড়ি৷ নইলে ভালোবাসার টানে ডং-পো আমাদের আটকে দিতে পারে৷’ এরপর প্রায় সবার অলক্ষেই চত্বর ছাড়ল ওরা দুজন৷

সে জায়গা থেকে নীচে নেমে শ্রীবাস্তব বললেন, ‘ফিরে যাবার আগে আমি একটু গ্রামের দিকে যাব৷ আমি আর কোনও দিন হয়তো জন্মভূমিতে ফিরে আসব না৷ আমার কাজকর্ম, সংসার, পরিজন এখন সব কিছুই কলকাতাতে৷ আমি তো আর তাশি ডিং নই, পদ্ম শ্রীবাস্তব৷ তাই যাবার আগে শেষ কাজটা সেরে যাই৷’

রাহুলরা এরপর এগোল গ্রামের দিকে৷ গত দিনের মতোই কিন্তু গ্রামে থামল না ওরা৷ গ্রাম ছাড়িয়ে পিছনের পাইনবনে গিয়ে ঢুকল৷ প্রাচীন পাইনবনে বাতাসের কানাকানি৷ রাহুলরা উপস্থিত হল সেই বাড়ির ধ্বংসাবশেষের কাছে৷ শ্রীবাস্তব তাঁর ব্যাগ থেকে স্নেক হুকটা বার করে ঢুকে পড়লেন ছাদহীন সেই কাঠামোটার মধ্যে৷ রাহুল প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি ফেরার সময় এখান থেকে সাপ ধরে নিয়ে যাবেন নাকি?’

শ্রীবাস্তব বললেন, ‘দেখি কী পাওয়া যায়৷’

ছাদহীন সেই ঘরের কোণে গত দিনের সেই গর্তটার সামনে ঝুঁকে বসলেন তিনি৷ স্নেক হুকটা ঢুকিয়ে দিনের গর্তের মধ্যে৷ তারপর বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় যেটা বাইরে আনলেন, সেটা সাপ নয়, মাটি মাখা কী একটা জিনিস৷

ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে জিনিসটা তিনি ধুতে শুরু করলেন৷ মাটি খসে গেল তার গা থেকে৷ রাহুল অবাক হয়ে দেখল শ্রীবাস্তবের হাতে ধরা রয়েছে একটা সবুজ রঙের জম্ভলা দেবতার মূর্তি!

মূর্তিটা তুলে ধরলেন তিনি৷ পাইনবনের ফাঁক গলে আসা সূর্যের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল তার সবুজ অঙ্গ৷ ঝলমল করছে শ্রীবাস্তবের চোখও৷ মূর্তিটা দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘এটা একটা দুর্লভ অ্যান্টিক৷ এই মূর্তিটার বয়স অন্তত হাজার বছর৷ আমার পূর্বপুরুষরা তিববত থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন৷ এটা মন্দিরের নয়, আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি৷ জম্ভলা দেবতার যেসব মূর্তি আছে, তার মধ্যে সবুজ জম্ভলা দেবতাই সবচেয়ে দুর্লভ৷ আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন যে গর্ভগৃহে যে সিংহাসনগুলোতে ছোটো ছোটো জম্ভলা দেবতার মূর্তি আছে, তার মধ্যে একটা সিংহাসন ফাঁকা৷ সেটা ফাঁকা রাখা আছে সবুজ জম্ভলা দেবতার জন্যই৷ সিংহাসনের ছোটো মূর্তিগুলোকেই আসলে পূজা করা হয়৷ কোঞ্চকের পূর্বপুরুষরা কিছুতেই সংগ্রহ করতে পারেনি সবুজ পাথরের তৈরি তিববতি জম্ভলামূর্তি৷ তবে কীভাবে তারা যেন একদিন জেনে গেল আমাদের বাড়িতে আছে এই মূর্তি৷ কোঞ্চকের বাবা তখন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত৷ তিনি প্রথমে লোভ দেখালেন, তারপর ভয় দেখাতে শুরু করলেন এ মূর্তিটা তাঁর হাতে তুলে দেবার জন্য৷ কিন্তু আমার বাবা ম্যাংগেল ডিং কিছুতেই রাজি হলেন না পারিবারিক বিগ্রহকে কর্মা রিনচেনের হাতে তুলে দিতে৷ আমার মা আমার ছোটোবেলাতেই মারা গিয়েছিলেন৷ বাবা আর আমি এ বাড়িতেই থাকতাম৷ আমার একটা ছোট্ট বেজিও ছিল৷ একরাতে মূর্তিটাকে ছিনিয়ে নেবার জন্য কোঞ্চকের বাবা কর্মা, কোঞ্চক আর অন্য লোকজনকে নিয়ে হানা দিল আমাদের বাড়িতে৷ আমি তাদের আসতে দেখেই মূর্তিটা লুকিয়ে ফেললাম বেজির গর্তে৷ তারা এসে মূর্তিটা খুঁজে না পেয়ে বাড়িতে আগুন লাগাল৷ আমাদের ধরে নিয়ে ঢোকানো হল জম্ভলা দেবতার ঘরে! সে কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা!’ সে ঘটনার কথা বলতে বলতেই যেন আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন তিনি৷ এরপর একটু দম নিয়ে বললেন, ‘পরদিন আমাদের দুটো দেহ গ্রামের বাইরে ফেলে আসা হল৷ মৃত ভেবেই ফেলে আসা হয়েছিল৷ আমার বাবার দেহটা অবশ্য একরাতেই কঙ্কালে পরিণত হয়েছিল৷ এক ভদ্রলোক সাপ ধরতে এসেছিলেন এখানে৷ তিনি দেখতে পান দেহ দুটো৷ সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হলেও আমার দেহে তখনও প্রাণ ছিল৷ তিনি আমাকে তুলে নিয়ে যান হাসপাতালে৷ একটু সুস্থ হবার পর কলকাতায়৷ তাঁর পদবি ছিল শ্রীবাস্তব৷ নিঃসন্তান সেই শ্রীবাস্তব দম্পতি আমাকে মানুষ করেন৷ নাম-পদবি দেন৷ তাশি ডিং থেকে আমি হয়ে যাই পদ্ম শ্রীবাস্তব৷’

কথা শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি৷ রাহুল তাঁকে কী বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না৷ এরপর তিনি রাহুলকে অবাক করে দিয়ে সবুজ জম্ভলা দেবতার মূর্তিটা রাহুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার একটা অ্যান্টিক মূর্তির শখ ছিল তা-ই না? এটা আমি আপনাকে উপহার দিলাম৷’

রাহুল চমকে উঠে বলল, ‘এ কী করছেন? এর দাম তো পয়সা দিয়ে মাপা যাবে না!’

শ্রীবাস্তব হেসে বললেন, ‘যে বিশ্বাস নিয়ে আপনি আমার সঙ্গী হয়েছিলেন, আমার পাশে বিপদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তারও কোনও দাম হয় না৷ মূর্তিটা আপনার কাছেই রাখুন৷’

শ্রীবাস্তব এরপর ভাঙা দেওয়ালগুলোতে একবার পরম মমতায় হাত বুলিয়ে ফেরার জন্য রওনা হলেন৷

সেই পাইনবন, তিববতি গ্রাম, জম্ভলা দেবতার মন্দিরকে পিছনে ফেলে কিছু সময়ের মধ্যেই ওপরে ওঠার জন্য পাকদণ্ডি ধরল ওরা৷ যে পথ ওদের নিয়ে যাবে পাহাড়ের মাথার রাস্তায়, যেখান থেকে নীচে নেমেছিল ওরা৷ জিপটা যেখানে রেখে আসা হয়েছে৷ হঠাৎ একটা বাঁকের আড়ালে একটা শব্দ পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা৷ পরমুহূর্তেই সেই বাঁকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ডং-পো৷ তার পরনে সেই শতচ্ছিন্ন পোশাকের বদলে রেশমের ঝলমলে পোশাক, কাঁধে রেশমের ঝোলা, পায়ে জুতো৷ সে এখন জম্ভলা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত৷

বিষণ্ণভাবে সে বলল, ‘তোমরা আজই চলে যাচ্ছ?’

শ্রীবাস্তব জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, যাচ্ছি৷ তুমি ভালো থেকো৷’

ডং-পো তার কাঁধের ঝোলা থেকে তার সেই বেজির বাচ্চাটা বার করে বলল, ‘এটা তোমাদের আমি উপহার দিলাম৷ নিয়ে যাও৷ আমি তো আর এটাকে আমার সঙ্গে রাখতে পারব না৷’

শ্রীবাস্তব সম্ভবত হাত বাড়িয়ে ডং-পো-র উপহার গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁর ব্যাগের ভিতর সেই কাঠের বাক্স থেকে একটা শব্দ শোনা গেল—‘হি-স-স-স…!’ ঠিক যেন কানাডিয়ান রেল ইঞ্জিন স্টিম ছাড়ল! হাতটকে গুটিয়ে নিলেন শ্রীবাস্তব৷ তারপর হেসে বললেন, ‘মন্দিরে একটা বেজি থাকলে তেমন অসুবিধা নেই৷’ ডং-পো-র মুখে এবার হাসি ফুটে উঠল৷ সে ঝুঁকে পড়ে চুমু খেল দুজনের হাতে৷

রাহুল আর শ্রীবাস্তব আবার হাঁটতে শুরু করল সবুজ পাইনবন ঘেরা পাকদণ্ডি বেয়ে৷

1 Comment

I am really amazed. Reading such a story, a combination of Adventure, history, myth, crime and moreover a fabulous touch of humanity
Keep writing Bro

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *