জবরদখল – ৮

আট

বিজু বলল, যা চেয়েছিলি, তা’ তো পেয়ে গেলি বাবা, কাঁটায় কাঁটায় অঙ্ক মেলার মতন। তবে সর্বদা অমন বুঝ—ভোম্বল হয়ে বসে থাকিস কেন রে মানকে? বুড়ো যদি মরতো, তবেও না হয় একটা কজ থাকতো।…ঘণ্টাকতক চোখ উল্টে ভির্মি খেয়ে পড়ে থেকে ঘোড়েল বুড়ো তো তোর ঘোড়া জিতিয়ে দিল।…খুব তো পটিয়ে ফেলেছিস চাবুকের সঙ্গে।

মানিক বলল, অসভ্যর মত কথা বলবি না।

ও রে বাবাঃ! এ যে কেস সিরিয়াস। আমরা আবার কবে সুসভ্যর মতন কথা বলিরে! ‘বলব না’। এটাই তো আমাদের মটো।

মানিক তেমনি মেঘাক্লান্ত মুখে বলে, তাতে আমাদের লাভ কি হচ্ছে বল? নিজের অভ্যেস নষ্ট হয়ে যাওয়া ছাড়া?

হুঁঃ। বুঝেছি! প্রেয়সীর সামনে বেফাঁস কথা কয়ে ফেলে ফাঁস হয়ে যাচ্ছিস বুঝি?

ছাড় ওকথা ভাললাগে না।

দেখ মানকে আমিই তোর নৌকো কূলে ভিড়িয়ে দিয়েছি। তোর গাড়ি ওর দরজায় এনে দাঁড় করিয়েছি, আর তুই শালা আমায় একেবারে হুট আউট করে দিচ্ছিস? মাইরি, প্রাণে একটু দাগা লাগছে না?

হুট আউট আবার কী?

নয়? বুড়ো যে কদিন হাসপাতালে থাকলো, রোজ তুই ওর সঙ্গে এক গাড়িতে গিয়েছিস এসেছিস, একদিনো বলেছিস বিজু চল।

বাঃ তা’ কি করে বলব? গাড়ি আমার? ওর বাড়ির কাজ করার লোক ট্যাক্সী ডেকে আনে, আমায় দয়া করে সঙ্গে যেতে বলে।

হুঁঃ! তা বুড়ো বাড়ি ফেরার পরেও তো ও বাড়িতে দিব্যি যাতায়াত চালিয়ে যাচ্ছিস।

কী করবো। কাজ ঘাড়ে চাপায়।

তা তো চাপাবেই। এমন একটা ক্রীতদাসের ঘাড় পেলে কে ছাড়ে?

এ সময় মানস এলো।

নিজস্ব প্রথায় মুচকে হেসে বলল। কিসের টক? সেই চাবুক?

বিজু বলল, আবার কি? কিন্তু গাড়োলটা মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে বিবেকের চাবুক খেয়ে মরছে। শ্লার ভদ্দরলোক বনে যাবার ইচ্ছে জাগছে। বাবু ভাষায় কথা কইতে সাধ হচ্ছে?

মানস বলল, হোক না। ক্ষতি কি?

ক্ষতি নেই? বিজু বলে ওঠে, তুই কি বলছিস মোনা?

একে একে আমাদের দলের ইয়ে কী বলে—হ্যাঁ, ‘স্তম্ভোগুলো খসে পড়বে? পূর্ণটার শয়তানীর কথা ভাব? পাজীটা তলে তলে আমাদের অজ্ঞাতসারে ইণ্টারভিউ দিয়েছে। চাকরি জোগাড় করেছে, ট্রেনের টিকিট পর্যন্ত কাটা তখন এসে জানিয়ে গেল, ভাই, একটা চাকরি পেয়ে কানপুরে চলে যেতে হচ্ছে।

‘যেতে হচ্ছে।’ যেন জেলে যেতে হচ্ছে। ‘ভাই’। শ্লা নয়, ‘শূয়োর’ নয়, কিনা ভাই। একেবারে মায়ের আঁচল থেকে গড়িয়ে পড়ল যেন। আবার বলে কি না সি অফ করতে যাবি তো? মার থাপ্পড়। উনি বাক্স বেডিং বেঁধে, কপালে দইয়ের টিপ পরে রেলগাড়িতে গিয়ে উঠবেন, চারদিক ঘিরে আপনার লোকেরা চোখ মুছবে, নাক টানবে, আর মা গলা ধরে কাঁদবে, দাড়ি ধরে আদর করবে, আমরা যাব সেই দৃশ্যের দর্শক হতে। তারপর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে গড়েরমাঠ পকেট নিয়ে গড়ের মাঠে এসে বসে চানাভাজা চিবোবো কেমন? লক্কড় রক্কড়ের আর জায়গা পায়নি।

মানস বলল, আমাদের জন্যে কে আবার কাঁদতে যাবে রে বিজু? দেশছাড়া হচ্ছে দেখে বাঁচবে। হরির লুঠ দেবে। আমরা মরে গেলেও বাড়ির লোকের মন কেমন করবে না।

ওইটিই তোমার ভুল ধারণা হে গাড়োল। যা কিছু ‘দূর ছাই’ তা আমরা ওনাদের পছন্দসই ছাঁচের নই বলে। যেই দেখবে সুড়সুড়িয়ে ওদের পছন্দের ছাঁচে ঢালাই হতে যাচ্ছি, চাকরি করছি, টোপর মাথায় দিয়ে ফুলসাজানো গাড়িতে উঠছি, অমনি ছেঁহ ভালবাসা উথলে উঠবে।

মানিক বলল, আমার মাও নেই বাপও নেই, আমি তোর কথা ভেরিফাই করতে পারব না।

মোনা বলল, ভেরিফাই করবার দিন এগিয়ে আসছে তাহলে?

মানিক বিষণ্ণ মুখে বলল, ওসব কথা বলে মেজাজ খিচে দিসনি মোনা। এখন সত্যিই দুঃখু হচ্ছে, ইচ্ছে করে নিজেকে নষ্ট করেছি ভেবে। একটাই তো জীবন একবার ভিন্ন দু’বার পাওয়া যায় না। ছিঁড়ে খুঁড়ে নষ্ট করবার আগে ভাবা চেন্তা উচিত ছিল।

মোনা একটু ব্যঙ্গ হাসি হাসবার চেষ্টা করে বলে, ওই ছাঁচটা না হলেই নষ্ট?

আমি আমার মালিক, নিজেকে নিয়ে যা ইচ্ছে করতে পারি আমি, সুবোধবালক হবার দায় আমার নেই, এটা একটা দারুণ লাভ নয়?

মানিক উদাস গলায় বলে, লাভ মনে হতো যদি ভেতরে যন্ত্রণা না হতো। বড় গলা করে বলতে পারবি আমরা খুব লাভ করেছি, আমরা খুব সুখী?

হঠাৎ তিনজনেই চুপ হয়ে যায়।

জায়গাটায় একটা স্তব্ধতা নামে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *