পাঁচ
মানস বলেছিল, বাড়ির লোক বিগলিত হবে। কচু হল।
অভাগার কপাল! ফটাফট জেরা।
কখন পড়ে গেছলেন? কোথায়? কী অবস্থায়? আপনি কোথায় ছিলেন? সাউথের অ্যাকসিডেণ্ট কেস নর্থে যায় কেন? সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে খবর দিলেই তো ঠিকমত কাজ হতো? যদি আরো সহকারী ছিল মানিকের তো তারা কোথায়? তাদের একজনের জ্যাঠামশাই এর বন্ধু ছিলেন? কী নাম তাঁর? ঠিকানা কি?—একসঙ্গে চার—পাঁচজন ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়েছিল কী উদ্দেশ্যে? ঠিক যেখানটায় পড়েছিলেন সেখানটা সনাক্ত করতে পারবে কি না এই সংবাদদাতা? ইত্যাদি ইত্যাদি, যেন জেরার ঝড়।
‘মা’ বলে ডাক দিল, কিন্তু সেই মা—জননীকে নীচের তলায় নেমে আসবার সময়টুকু না দিয়েই আইন নিজের হাতে নেওয়া হলো।
প্রথমটা কিঞ্চিৎ নার্ভাস বোধ করলেও, এই কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ভঙ্গী দেখে মেজাজ গরম হয়ে গেল মানিকের। বেচারী! খেয়াল করে না তাদের মূর্তিই সর্বদা তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কামানো জুমনো তেলাগোলা মুখ, আর পাট—দোরস্ত শার্ট—প্যাণ্ট পরে এলে এই দিদিই খাতির করে ড্রইংরুমে বসিয়ে কৃতজ্ঞ কৃতজ্ঞ মুখে ধন্যবাদের বচন ঝাড়তো। সেটা খেয়াল করল না বলেই রেগে গেল।
বলল, দেখুন, কেন যে মানুষ কারো বিপদ দেখলে তার মনুষ্যত্ববোধটুকু প্রকাশ না করে কেটে পড়ে, তা’ বুঝতে পারছি। ভাল করতে গিয়ে মন্দ হচ্ছি। আমি যদি আপনার এতোসব প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য না থাকি, কী করবেন? পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবেন, অনধিকার চর্চার অপরাধে?
এরকমের উত্তরে জন্য অবশ্যই প্রস্তুত ছিল না টিসু, তাই এখন ঈষৎ অপ্রতিভ হয়। সামান্য নরম গলায় বলে, কী হল, আপনি এমন রেগে উঠছেন কেন? জেরা কে করছে আপনাকে? হঠাৎ এরকম একটা খবরে মানুষ আপসেট হয়ে যেতে পারে না?
মানিক যতই আকুলতা করে থাকুক, এই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় ঘটাবার জন্যে, এবং যার জন্যে এতো জটিল পথ অবলম্বন, তবু ওই জেরাটার চোটপাট উত্তর দেবার বাসনাও প্রবল হয়ে উঠছে ওর। তাছাড়া—
মনে মনে ভেবে নেয়, বিপদের সূত্রে ভাব জমে যাওয়াও যেমন স্বাভাবিক, ঝগড়ার সূত্রে ভাব জমে ওঠাও তেমনি স্বাভাবিক। সিনেমায় তো এর অনেক উদাহরণ মেলে।
তবে? তবে কেন চোটপাট জবাব না দেবে?
বলে, দাঁড়ান, আপনি বোম্বে মেল চালিয়ে গেলেও, আমায় একটা একটা করে জবাব দিতে হবে। প্রথম, কখন পড়ে গেছলেন?
বেলা দশটা নাগাদ। তবে ক’ মিনিট, ক’ সেকেণ্ডে বলতে পারব না। তখন দেখে নেওয়া হয়নি। পরে জবাব দিতে হবে জানলে দেখে রাখতাম।…তারপর? আমি কোথায় ছিলাম?…আমি সেই বাসটাতেই ছিলাম। বুড়ো—লোকটি উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন দেখে লাফিয়ে নেমে তারপর—তারপর সাউথের কেস নর্থের হসপিটালে কেন? দেখুন, ক্যাওড়াতলায় চুল্লি ভেকেণ্ট না থাকলে মড়া ঘাড়ে নিয়ে নিমতলাতেও যেতে হতে পারে। অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা।
টিসু চোখ—মুখ—ভুরু—সব কুঁচকে বলে ওঠে, থাক, আপনাকে আর জবাব দিতে হবে না।…মা। তুমি নামছ না কেন?
মানকের জেদ চেপে গেছে, মানিক জোর গলায় বলে, না, আমায় বলতে দিন। শুনতেই হবে আপনাকে।
সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে খবর দেওয়া হল না কেন? হল না এই জন্যে, আমরা কেউ—ই ‘পামিস্ট’ নই যে, কারো চেহারা দেখলেই বাড়ির ঠিকানা বুঝে ফেলব।
আমার সঙ্গে আরো যারা ছিল তারা সকলেই বাসের জন্যে দাঁড়িয়েছিল। যার জ্যাঠামশাই ওনার বন্ধু? সে—তো ওখানে বসে আছে, নড়ছে না। তার ঠিকানা বলতে পারব, তবে তার জ্যাঠামশাইয়ের ঠিকানা? উহুঁ। বলা যাবে না। পরলোকের দিকে যাইনি কখনো।
থামুন তো। আপনি দেখছি বড্ড ইয়ে। এতো কথা কইছেন কেন?
আপনিই কওয়াচ্ছেন। এখনো তো বাকি—জায়গাটা সনাক্ত করতে পারব কিনা? না পারার কিছু নেই। রাসবিহারীর মোড়ে, ইয়ের দোকানটার সামনে—
ইয়ে মানে? ইয়ে ক্কি? কিসের দোকানের সামনে?
দেখুন, ওখানে এতো রকমের দোকান আছে, ঠিক কোনটার সামনে সেটা তো মেপে দেখা হয়নি।
মা! তুমি নামবে?
টিসু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়াতে থাকে।
এই বাচাল আর ইয়ার ছেলেটাকে উচিত শাস্তি দিতে পারতো টিসু। কিন্তু অবস্থাটা যে বড় গোলমেলে! মা যদি বলে, খবরটা পুরো না নিয়ে তাড়িয়ে দিলি? তখন তো অন্য ফ্যাসাদ। ফ্যাসাদ তো সবটাই। দাদুর কানে উঠলেই তো এক্ষুণি হৈ—চৈ বাঁধাবেন তিনি।…তাছাড়া যেতে তো হবে এক্ষুণি মেডিক্যাল কলেজে। বাবাঃ সে কি একটা জায়গা। পুরো নীচতলাটা তো জমাদারদের সাম্রাজ্য। তারাই সেখানকার হর্তা—কর্তা—বিধাতা। যেতে হলে তো এই মস্তানটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
রাগে অস্থির হচ্ছিল মায়ের উপর।
কী হলো কি তাঁর। আবার ডাকতে যাচ্ছে, তখন মঞ্চে এলেন শোভনা দেবী।
টিসু বিরক্ত দৃষ্টিতে মার সাজের দিকে তাকিয়ে দেখল। তার মানে মা এতোক্ষণ বৈকালিক প্রসাধন করছিল। বাড়ির একটা লোক না খেয়ে কোথায় ঘুরছে, তার খবর জানতে টিসুকে মৃগাঙ্কর কাছে পাঠিয়ে, মা’র দেরী সইল না? তার মানে ভবদাদু আসুক না আসুক, মা ঠিক একটু পরেই তার গুরুমঠে চলে যাবে। নিত্য সেখানে পাঠ—কীর্তন হয়। পৃথিবী উল্টে গেলেও মা যাবে।
তাই এখন শোভনার পরনে ফর্সা ধবধবে মিহি কালোপাড় শাড়ি, গায়ে আরো মিহি সাদা ভয়েলের ব্লাউজ। গলায় সোনার চেনে গাঁথা তুলসী কাঠের মালা, খোলা চুলের ঝাড় মুখের চারপাশে গোল হয়ে আছে। কপালে একটি চন্দনের টিপ।
টিসু ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে এতোক্ষণে নামতে পারলে?
শোভনা পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, কেন? কী হয়েছে?
কী হয়েছে, অথবা কিছু একটা হয়েছে, সেটা অনুমান করতে পারে শোভনা, ওই মস্তান মার্কা ছেলেটাকে ভগ্নদূতের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তবু উত্তরের অপেক্ষায় থাকে।
টিসু রাগ, অপমান, বিরক্তি, উদ্বেগ সব মেশানো গলায় বলে ওঠে, এই ভদ্রলোক বলতে এসেছেন, সকালে বেলা দশটায় ভবদাদুর বাস অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছে—এঁরা—
আঁ! বাস অ্যাকসিডেণ্ট!
শোভনা অদূরে সিঁড়ির কাছে পড়ে থাকা একটা মোড়ায় বসে পড়ে। হাতের রুমাল নেড়ে মুখে বাতাস দিয়ে বলে, পুরো চাকাটা বডির ওপর দিয়ে চলে গেছে? স্পটেই ডেড?
আঃ! কী মুশকিল।
টিসু রেগে বলে, ভাল করে না শুনেই যা তা বলছ কেন? ওসব কিছু না। বাসে উঠতে গিয়ে ছিটকে পড়ে মাথায় চোট লেগেছে। জ্ঞান নেই—
জ্ঞান নেই?
শোভনার ভুরু আরো কুঁচকে উঠল, তাহলে ঠিকানাটা পেলেন কি করে?
ঠিকানা?
মানিকের মুখে একটি আত্মপ্রসাদের হাসি ফুটে ওঠে। মানিক তার কাঁধে ঝোলানো ঝোলাটা নামায় কাঁধ গলিয়ে। যেটা দেখে পর্যন্ত টিসু ভেবেছে, আজকাল ছেলেগুলো সব মেয়েলি জিনিস ব্যবহার করে।…এদিকে মুখে দাড়ি—গোঁফের জঙ্গল বানায়, অথচ গায়ে রঙচঙা মেয়েলী স্কার্ট গায়ে দেয়, মেয়েলী চপ্পল পরে—পরে মেয়েলী ব্যাগ ঝোলা কাঁধে নিয়ে বেড়ায়। ‘ঠিক ওই রকম একটা আমার ছিল’ ভেবেছিল টিসু।
মানিক অবশ্য এসব কথা জানে না, মানিক মৃদু হাসি মুখে ফুটিয়ে বলে, এই যে এর মধ্যে থেকে পেয়েছি।
তারপর মানিক ঝোলার মধ্যে থেকে টেনে বার করে একখানা ভারী বোঝা, মোট্টাসোট্টা আইনের বই।
এই বইয়ের মধ্যে যে নাম—ঠিকানা রয়েছে, সেটাই কাজে দিল।
বইটা হাতে নিয়েই টিসু চমকে ওঠে, মা? এর মানে?
শোভনাও এগিয়ে আসে, তীক্ষ্ন কণ্ঠে বলে, এ বই আপনি পেলেন কোথা থেকে?
এই যে এই ঝোলার মধ্যে থেকে। আরো আছে। এই যে—ঝোলাটা সমেতই নামিয়ে দেয় মানিক। যার মধ্যে তেমনি একই সাইজের আরো দু’খানা বই মোটা চামড়ায় বাঁধাই, সোনার জলে নাম লেখা।
শশাঙ্কমোহন রায়।
হ্যাঁ, এই নাম ওই বইগুলোর অধিকারী। যে রকম বই আরো অনেক সাজানো আছে মৃগাঙ্কর ঘরের পাশের ঘরটায় উঁচু আলমারিটার ভিতর।
ওই ঘরে আগে শশাঙ্কর চেম্বার ছিল।
বাইরের দিকের দরজা খুলে বসত শশাঙ্ক মক্কেলদের সঙ্গে। এখন ঘরটা ভিতর থেকে বন্ধ, মৃগাঙ্কর ঘরের মধ্যে দিয়েই যাওয়া—আসা। বই ঠাসা, অন্ধকার অন্ধকার ভ্যাপসা ঘরটায় কে কত যায়—আসে? দিনে একবার ঝাড়ুটা নাড়তে ঢোকে বলরাম।
টিসু!
শোভনা চীৎকার করে ওঠে, বুঝতে পারছিস? তোর বাবার ‘ল—বুক।’ তোমাদের ভবদাদু পাচার করছিলেন! উঃ। ভাবা যায় না।…পৃথিবীতে বিশ্বাস করবার জায়গা বলে কিছু নেই।
মা থামো। ফিলজফি আউড়ো না। চল দাদুর কাছে দেখাবে। তাঁর সাধের ভাইয়ের কীর্তি। উঃ।
মানিক ডেকে বলে, দেখুন, আপনাদের ঘরোয়া ব্যাপারগুলো পরে মেটাবেন। এখন দয়া করে কেউ পেসেণ্টের কাছে চলে গিয়ে আমার বন্ধুকে ছুটি দিন।
চলে? চলে কে যাবে?
তাইতো টিসুদের তো এখন ছুটে হাসপাতালে চলে যাবার কথা। ভবদাদুর ওপর ভক্তি—ভালবাসার বালাই না থাকলেও, কর্তব্য তো বটে। দাদুর কোন সুবাদের ভাই তো।
টিসু তো ভাবছিল, দাদুর কানে কথাটা না তুলেই দেখতে যাবে। কিন্তু টিসুর মরে যাওয়া বাবার আলমারি থেকে বই চুরি করে পাচার করতে গিয়ে যে লোক বাস অ্যাকসিডেণ্ট করেছে, তার ওপর আমার মায়া কি? আর তার ভালবাসার দাদা ওই দাদুর ওপরই বা এতো কি মায়া!
সত্যি সমস্ত সহানুভূতি মুছে যাবে না? তার বদলে আসবে না রাগ—ঘৃণা—অশ্রদ্ধা।
একটা বুড়ো লোক তুমি, চিরকাল এই সংসারে প্রতিপালিত হয়েছে, এই তার প্রতিদান?
শোভনার তো আরো রাগ।
ওই অকারণ ঘাড়ে পড়ে থাকা লোকটার উপর তার কোনোদিনই মায়া ছিল না। মিছিমিছি অপচয়। একটা মানুষের খরচা কি কম? কি এমন আপন? সম্পর্ক খুঁজতে তো ইতিহাসের পাতা খুলতে হয়। কিন্তু শশাঙ্কও ছিল তেমনি, ‘ভবকাকা’ বলতে অজ্ঞান ছিল।
বলতো, ভবকাকার মতো একটা লোক বাড়িতে থাকা বাড়ির অ্যাসেট। ভবকাকা নাকি আজীবন তাদের ছাতা দিয়ে মাথা রক্ষে করেছে। যেদিকে জল পড়েছে সেদিকে ছাতি ধরেছে।
সেই শশাঙ্কই চলে গেল। টাটকা তাজা যুবাপুরুষ!
হাইকোর্টে প্র্যাকটিস উঠেছিল জমে।
হয়ে গেল সব শেষ।…তবে এখনো কেন এইসব আপদ পোষা?
একজনকে না হয় ফেলার উপায় নেই, মৃগাঙ্ক রায় নামক লোকটার ভার বইতেই হবে শোভনাকে তাঁর জীবৎকাল, অথবা শোভনার জীবৎকাল।
কিন্তু ওই গাঁইয়া বুড়োটাকে কেন?
চাকর চাকর দেখতে, ভাল জামাকাপড় দিলেও পরে না। (শশাঙ্ক তো দিতো) লোকের সামনে আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করে।
তাছাড়া—হলেও শশাঙ্ক অনেক টাকা রেখে গেছে এবং মৃগাঙ্কর তৈরী এই বাড়িটাও আছে আশ্রয়স্থল, তবু কলসীর জলের উদাহরণটা তো মানতে হবে?
শশাঙ্ক মারা যাবার কিছুদিন পরই, যখন শোভনা পাগল হয়ে গুরুদীক্ষা নিয়ে বসল দিদি জামাইবাবুর সঙ্গে গিয়ে, তখন তোড়জোড় চালিয়েছিল ভবনাথকে বিদায় করতে। কিন্তু ভাগ্যহীনা শোভনার ভাগ্য সবদিকেই মন্দ। জমি যখন প্রস্তুত হয়ে এসেছে, ঠিক তখন মৃগাঙ্কমোহন হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে, শোভনার পরিকল্পনার বারোটা বাজিয়ে দিলেন।
আর ভবনাথকে ছাড়া যায় না, ভবনাথ তখন অপরিহার্য! হলেও তিনিও মৃগাঙ্কর প্রায় সমবয়সী, কিন্তু রোগা খটখটে চেহারার জন্যে খাটতে পারেন খুব।
মৃগাঙ্কর ঘরেই তাঁর খাট—বিছানা তুলে আনতে হয়েছে। দিনের বেলা বলরাম। রাতের ভরসা ভবনাথ।
একটা বিরক্তিকর লোক, যাকে বিদায় করবার চেষ্টা চলছিল, বাধ্য হয়ে যদি আবার তাকে পুজ্যি করে রাখতে হয়, সে যদি অপরিহার্য হয়ে ওঠে, তার উপর কী আহ্লাদের ভাব আসবে?
অ্যাকসিডেণ্ট শুনে মমতা না এসে বিরক্তিই এসে গিয়েছিল। মস্ত একটা বিপদেই তো পড়া গেল। লোকবলহীন এই সংসারে কে এসব ঝামেলা পোহায়। তবু চাপা পড়ে থাকা বাড়াভাতের দৃশ্যটা মনে ভেসে উঠে মনটাকে একটু নরম করে আনছিল, কিন্তু এ কী? এ যে সহ্যের বাইরে।
প্রায় কড়া গলাতেই বলে উঠল শোভনা, চল দাদুর কাছে।
টিসু এখন মন বদলালো। বলল, দাদুর কাছে গিয়েই একেবারে হৈচৈ লাগিও না।
হৈচৈ আমার স্বভাব নয়। প্রকৃত ঘটনাটা বলতে হবে তো?
মানিক নাক গলাল।
বলল, উনি বুঝি অসুস্থ?
হুঁ। প্যারালিসিস।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে টিসু বলল, বলছিলাম, দাদুকে এখন বইয়ের কথা না বলে শুধু অ্যাকসিডেণ্টের খবরটা দিলেই ভাল হয়।
কেন? কেন শুনি?…শোভনা ঝেঁজে ওঠে।
একসঙ্গে দু’—দুটো আঘাত।
করা যাবে কি? যা বলবার বলে নেওয়াই ভাল।
আর হঠাৎ যদি হার্টফেল করে বসে?
টিসু বেজার গলাতেই বলে।
থাম। হার্টফেল অতো সোজা নয়। হলে ছেলে চলে যাবার দিনই হতো।…না বললে উনিও ত ভাবতে পারেন আমরাই কোনো কাজে পাঠিয়ে তাঁর বিপদ ঘটিয়েছি।
মানিক দেখল, ওদের এই ঘরোয়া ‘টক’—এর মধ্যে ও বেমানান। বিচ্ছিরি একটা অবস্থায় বোকার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে নিজেরই কেমন লাগছে।
একটা ঢিল ফেলল।
বলল, আমি তাহলে যাচ্ছি।
তার মানে?
টিসু ছিটকে ফিরে দাঁড়াল।
যাচ্ছেন মানে? আমাদের নিয়ে যাবে কে?
আ—আপনাদের? আ—আমি নিয়ে যাব?
না হলে? আমরা জানি কোথায় কি?
মানিক অবহেলাভরে বলে, কিছু না। মেডিক্যাল কলেজে এমারজেন্সি ওয়ার্ডে ঢুকেই—
থামুন। আমায় আর ডিরেকশান দিতে হবে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন। ট্যাকসি ডাকাচ্ছি, সঙ্গে যাবেন।
বাঃ গ্যারেজে গাড়ি রয়েছে দেখলাম যে—
আছে তো কি?
ট্যাকসির কথা বলছেন?
টিসু হঠাৎ খুব রেগে গিয়ে বলে, বলছি আমার ইচ্ছে। চলে যাবেন না বলছি।
শশাঙ্কমোহনের মৃত্যুর পর থেকে গাড়ি আর বেরোয়নি গ্যারেজ থেকে। সে তো নিজেই চালাতো।
মানিক সেই প্যাসেজের সামনে বোকার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে পায়ে এক বুড়োগলার হাউমাউ চীৎকার। তীক্ষ্ন—তীব্র মহিলাকণ্ঠের কঠোর সান্ত্বনাবাণী, আর একটা জ্বলন্ত স্বর, মা! মনে রেখো, লোকটাকে আটকে রেখে আসা হয়েছে। ভেগে গেলে ভবদাদুর খবর পাওয়ার বারোটা বেজে যাবে।
মানিকের কানের মধ্যে গলানো সীসে ঢুকে যায়।
‘লোকটাকে’। ‘ভেগে গেলে।’
তার সম্পর্কে এই মন্তব্য। সে মনে মনে বলে, হতভাগা মানকে। তুই এসেছিস এই রাজনন্দিনীর ছায়ায় একটু ভালবাসার স্বাদ পেতে? তার জন্যে বন্ধুদের কাছে মিনতি, এতোখানি অ—মানবিকতা—
অবশ্য ওই বই চুরির ব্যাপারে মানিকেরও বুড়োর ওপর হতশ্রদ্ধা এসে যাচ্ছে, তবু সেই কনুইয়ের ঠেলাটার কথা তো ভুলতে পারছে না।…যেটা তার আরো কেয়ারফুলি করা উচিত ছিল।
ওই মেয়ে যে আমায় আটকে রেখে গেল, কিসের অধিকারে? আমি যদি সত্যিই ভেগে যাই? করবি কী, খুঁজে বেড়াগে যা মেডিক্যাল কলেজের তিনটে গেটে।
অথচ পারাও যাচ্ছে না চলে যেতে।
যাক বেরিয়ে এল টিসু, হেঁকে বলল, বলরাম, একটা ট্যাকসি ডাক।
এবং এতোক্ষণ পরে বলল, আপনি তো দাঁড়িয়েই রইলেন।
মানিক বলল, ওর জন্যে কিছু না। ও আমাদের অভ্যাস আছে।
তা তো বুঝতেই পারছি—
টিসুর গলা ধাতব, রাস্তার মোড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ের ওপর খাড়া থাকাই তো আপনাদের পেশা।
মানিক মনে মনে বলল, মানকে দ্যাখ, এই থেকেই তোর ভাগ্য খুলে যায় কিনা। যে রকম বোলচাল ছাড়ছে।