জবরদখল – ৩

তিন

খবরটা তাহলে তুই—ই দিতে যাচ্ছিস তো মানকে?

মানস বলল মুচকি হেসে।

আ—আমি একলা?

তবে আবার কী?

না, না, একজন কেউ আমার সঙ্গে চল।

কেন হে সোনারচাঁদ? বাসরে ঢোকবার সময় কি তুমি আর কাউকে সঙ্গে নেবে? যাও বুড়োর ব্যাগটি নিয়ে সোজা চলে যাও, বীরের মত গেট পার হয়ে ‘বাড়ির লোকদের’ ডেকে দিতে বলো গে—তারপর যা পারো করো।

এতো হার্টলেসের মতন কথা বলছিস কেন রে মোনা? তোরা পাঁচটা পাশ করা, তোদের বুদ্ধি বেশী—

পেরেম করতে বেশী বুদ্ধি লাগে না যাদু। ঝোপ বুঝে কোপ মারলেই হলো। তা সেটা তো খানিক এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন দেখগে যা, যেই তুই খবর দিবি, সেই ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি নিয়ে ছুটবে তোমার আরাধ্যা দেবী, তোমাকেই সঙ্গে নিয়ে। তবে কেন মিছে আর কাউকে নিয়ে ঝুটঝামেলা.

তুই বুঝতে পারছিস না মোনা। যদি কী বলতে কী বলে ফেলি! দৃশ্যটা তো চোখের ওপর ভাসছে। অসাবধানে মুখ দিয়ে কিছু উল্টোপাল্টা বেরিয়ে গেলে? তুই চল না বাবা, বুদ্ধি—সুদ্ধি আছে—

আমি? আমি কী রে? আমার জ্যাঠামশাইয়ের বন্ধু, রাস্তায় পড়ে গেল দেখে, বুকে করে কুড়িয়ে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি করে দিয়েছি, শম্ভুনাথে জায়গা না পেয়ে—

তোর জ্যাঠামশাইয়ের বন্ধু?

আরে বলতে হবে তো একটা কিছু।

যদি এনকোয়ারি করে?

কোথায়? পরলোকে গিয়ে?

যাক। জ্যাঠামশাই ছিল তাহলে?

দ্যাখ মানকে, একটা জ্যাঠামশাই নেই কিম্বা ছিল না, এমন হতভাগা আমাদের এদেশে অন্তত নেই। নিজের না থাক, তুতোও থাকে। সে ম্যানেজ হয়ে যাবে। দেখিস, বুড়োর বাড়ির লোক কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়ে বলে উঠবে, হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে পড়েছে জ্ঞানপ্রকাশ বাগচী তো? নামটা খুব শুনতাম এঁর মুখে।

কেন বলবে?

বলবে রে বলবে। ওটাই মনুষ্য রীতি। তবে ওই ডাঁটুস মেয়েটা কী রীতি—প্রকৃতির কে জানে। পুলিশ কেসেও ফেলে দিতে পারে। বললেই হলো বুড়োর সঙ্গে অ্যাতো ছিল, ত্যাতো ছিল—

মানিক কড়া গলায় বলে, কক্ষণো না। তেজীরা কখনো মিথ্যা কথা বলে না।

কেন বলবে না? আমরাই কি কম তেজী? যে যার বাড়ি গিয়ে হিসেব করগে যা না। আমাকে তো বাড়ির সবাই বাঘের মত ভয় করে। জানে দারুণ তেজী ছেলে, ওকে ঘাঁটানো চলবে না। অথচ এই—তো মিথ্যে নিয়েই কারবার!

সেকথা আলাদা।

মানিক দুঃখিত গলায় বলে, কিন্তু পুলিস কেসের কথা বলছিস কেন বাবা। ভাল্লাগছে না।

আমারই কি লাগছে? উপায় কি? অ্যাকসিডেণ্টের সেন্সলেস পেসেণ্ট ভর্তি করতে গেলেই অনেক ঝুটঝামেলা। যতক্ষণ না সেন্স ফিরে আসছে। যাক, ঘাবড়াসনি! সুকুমারের পুলিশ অফিসার মামাকে বলতে গেছে সুকুমার। ম্যানেজ হয়ে যাবে।

মানিক ক্ষুব্ধ গলায় বলে, শালা সুকুমারটা দেখিস, ঠিক একদিন দল থেকে পিছলে পড়বে। ওই মামার দৌলতে চাকরি—বাকরি বাগিয়ে, দিব্যি একখানা বৌ জুটিয়ে ভদ্দরলোক বনে যাবে। এখনো মামা ব্যাটা ওকে সামলে বেড়াচ্ছে। আর আমার মামা মুখ দেখে না। এমন কি আমার কারণে, আমার মাকেও তফাত রাখে। নিজের মামা। অথচ সুকুমারের তুতো মামা—

মানস মুচকি হেসে বলে, ‘তুতো’ বলেই তো! তুতো দাদাদের তুতো বোনেদের ওপর টান বেশী। সে যাক, এখন সুকুমার না আসা পর্যন্ত—অন্তত বাড়ির লোকটোক এসে পড়লেও যদি আমার জ্যাঠামশাইকে মেনে নেয়, হয়ে যাবে ফয়সালা।

মানিক বলল, এতোসব হতে পারে ভাবিনি।

সেই তো—কে জানতো শ্রাদ্ধ এতো দূর গড়াবে। ভাবা গিয়েছিল, একটা ফার্স্ট এড গোছের দিয়ে, বুড়োকে বুকে ধরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে, সেই ফাঁকে তুই ওই চাবুকের সঙ্গে একখানা ভোঁকাট্টা করে ফেলবি। তারপর তো আর কেউ স্পটে থাকব না, তোর লাইন ক্লীয়ার।

খোদা জানে কে কোন সূত্রে স্পটে এসে যাবে।

আরে বাবা ওই জন্যেই তো বলছি—’একলা চলো রে।’

তুই—তো কান্নাকাটি করেছিলি, এতোখানি বয়েস হলো—একটা ভালবাসাবাসি হল না। তা’ তুই ফার্স্ট চান্স নে।

মানিক দুঃখের গলায় বলে, শুধু শুধু কান্নাকাটি করিনি রে, তোদের সঙ্গে আমার অনেক ফারাক। তোরা সব ইউনিভারসিটির জুয়েল এক একখানা। তোদের মামা—কাকার ভরসা আছে, ঠিকই একে একে বৈতরণী পার হয়ে যাবি। জগদীশটা তো অলরেডি একটা চাকরি বাগিয়ে ফেলেছে। আর হতভাগা মানকে পার্ট টু ফেল, বাড়ি ঢুকলে বাপ মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়, মা মুখনাড়া ছাড়া ভাত দেয় না, বোনটা সামনে দিয়ে কলেজ যায় আসে, ভাব দেখায় যেন চেনে না। আবার ছোট ভাইটাকে কী শিখিয়ে রেখেছে জানিস?—শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, মানিক মানিক মানিক, যাদুমণি, সোনামণি, দুদু খাবে খানিক। শুনে না রাগে—

বলিস কি। ও হো হো হো।

মানস হেসে ওঠে হো—হো—হো।

তারপরই বলে ওঠে, এই মানকে দেরী করিস না। অ্যাডমিশনের টাইম থেকে টাইমলি খবর না দিলে—দিদিমণি খিঁচিয়ে বলবে, অ্যাতোক্ষণ পরে খবর দিতে এলেন।

দূর। এখন আর আমার ভাল্লাগছে না মোনা। মনে হচ্ছে এতোসব না করলেই হতো। বুড়ো যদি টেঁসে যায়?

না, না। তেমন কিছু নয় বলেই মনে হলো! থলিটা তোর জিম্মায় আছে তো?

হুঁ!

থলির মাল নড়চড় হয়নি তো?

নড়চড় হবার আছে কি?

যা বলেছিস মাইরি? ব্যাপার বোঝা গেল না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *