দুই
শম্ভুনাথ পণ্ডিতে দিতে পারতো, সেটাই দেওয়া উচিত ছিল। কাছে পড়তো, কিন্তু ওটা চেনা পাড়া, কে কোন দিক থেকে দেখে চিনে ফেলবে! এটা সেফ!
যদি জেরায় পড়তে হয়, ‘ওপাড়া থেকে এপাড়ায় কেন বাবু? তার জবাব তৈরী আছে।’ ভর্তি করে নিতে রাজী হয়নি। ভাগিয়ে দিয়েছে।…
কে কখন ভাগিয়ে দিয়েছে?
তারও জবাব তৈরী।
দোষ স্বীকার করছে না। এই সব হাসপাতালে—টাসপাতালেই তো যত দুর্নীতি, যত মিথ্যাচার। এ যুগের ডাক্তাররাই হচ্ছে দুনিয়ার সেরা নিষ্ঠুর।
এ ছাড়াও রক্ষাকবচ আছে।
পূর্ণ, পবিত্র আর জগদীশ শম্ভুনাথে নেমে এমারজেন্সিতে ঢুকে একটু ঘোরাঘুরি করে বলবে, ‘একটা অ্যাকসিডেণ্ট কেস আছে।’ স্বভাবতই ওপক্ষ থেকে প্রতিরোধ আসবে। সত্যিই তো কর্তৃপক্ষ হৃদয়দুয়ার খুলে বসে থাকে না।
টালবাহানা করবে, কোথায় পেসেণ্ট? কি রকম অ্যাকসিডেণ্ট? কোন জায়গায় কীভাবে, গাড়ীর ধাক্কা, না গাড়িচাপা, জগদীশরা চোখ গরম করে বলবে, অত জেরার আগে লিখে নিন তো?
পেসেণ্ট না দেখেই?
আসছে পিছনে। সাবধানে আনছে।
আসুক দেখি।
ঠিক আছে…।
বলে গট গট করে বেরিয়ে আসবে ওরা রীতিমত শাসিয়ে। ওরা আবার দক্ষিণের ছেলে নয়, উত্তরের আর পূবের। জগদীশ বেলেঘাটার ছেলে, পূর্ণ কাঁটাপুকুরের, পবিত্র রামধন মিত্তির লেনের। ছটি গ্রহের একত্র সমাবেশ হল কি করে, তা এরা নিজেরাই ভুলে গেছে।
এই পেশা এদের।
পকেটমারই।
কিন্তু নিঃশব্দে কাঁচি কাটার খেলোমি নেই এতে। তাছাড়া কাঁচি কাটার যুগও তো ফুরিয়েছে। অতি সৌখিন বহু লাখপতি অবাঙালী বিজনেসম্যান ছাড়া—কাঁচি কাটার উপযুক্ত চিকন আদ্দির পাঞ্জাবী আর কে পরে আজকাল?
তাদের পাঞ্জাবীর বুক পকেট ফুঁড়ে ওঠা একশো টাকু গোছা চোখের সামনে দেখতে পেলেও তাদের ধারে—কাছে, আগে—পিছে বডিগার্ড। বোঝা যায় না, আবার বোঝা যায়। অতএব সেদিকে কাঁচি নিয়ে তাকিয়ে লাভ নেই।
আর সব তো পেণ্টুল।
‘এ’ থেকে ‘জেড’, অথবা ‘ক’ থেকে ‘চন্দ্রবিন্দু’ পর্যন্ত সক্কলের তো ওই সার। একটা পেণ্টুল, একটা বুশশার্ট! তাদের পকেট—ফকেট অনির্দিষ্ট। ধুতি—পাঞ্জাবী পরত নেহাত প্রাচীনপন্থী গেরস্থ বুড়ো—হাবড়ারা। তা তাদের পকেটে থাকেই বা কি?
এই যে বুড়ো ভদ্রলোক বাস থেকে ছিটকে পড়ল, মোটা ধুতি আর লংক্লথের পাঞ্জাবী পরা, কি আছে তার পকেটে? হাতের ব্যাগেই বা কোন মূল্যবান বস্তু?
আসল কথা, দোকানী—পসারি ছাড়া, ঘরোয়া লোকেদের তো আজকাল আর পুরুষের পকেট বলে কিছু থাকে না; সর্বদাই তো মহিলাদের হ্যাণ্ড—ব্যাগে গিয়ে উঠছে।…এদের তাই প্রধান টার্গেট মহিলা। তবে তাক বুঝে কর্তাদের ওপরও হামলা পড়ে বৈকি।
কিন্তু এই ভদ্রলোকের কাছে কী ছিল?
যার জন্যে তাঁকে এখন রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়তে হলো?
ব্যাগটা দেখেছে পবিত্র—জগদীশরা। দেখে মুখ বাঁকিয়েছে।
কিন্তু আজকের এই শিকারের টার্গেট, ওই বুড়ো নয়। অতএব তার হাতের ব্যাগটাও নয়। টার্গেট অন্য।
টার্গেট সেই চাবুকের মত মেয়েটা!
বুড়োর বাড়িতে যার অবস্থান।
অবশ্য সুইনহো স্ট্রীটের ওপর ওই সৌখিন গেট বসানো, সুন্দর বারান্দাওলা বাড়িটাকে বুড়োর বাড়ি বলাটা ভুল, ওই লোকের ওই বাড়ি হতেই পারে না। কিন্তু ওটাই যখন বুড়োর আস্তানা, তখন আর কীই বা বলা যায়?
বিজু অনেকদিন থেকেই চেষ্টা করছে তথ্য সংগ্রহ করতে, কিন্তু আবিষ্কার করতে পারেনি বুড়ো এ বাড়ির কে? কী সূত্রে এখানে বাস করে!
বিজু এসে আড্ডায় বলেছে মাইনে করা লোক বলে মনে হয় না, মানে বাজার সরকার—টরকার নয়। বাড়ির কাজ করবার লোকজনদের তো ধমক—ধামক দেয় শুনতে পাই। অথচ ওই চেহারা, ওই সাজসজ্জা।
বাড়ির খোদ কর্তার না প্যারালিসিস?
সেই তো। বছর তিন—চার ধরে বিছানায়। এদিকে নাকি হেলথ খুব ভালো, চেহারা অতি চমৎকার, কিন্তু ওই একটা দিক নাড়তে পারে না। এই বুড়ো চব্বিশ ঘণ্টাই সেই কর্তার ঘরে।
তার মানে মেল নার্স।
দূর। ওর কি সাধ্য যে সেই লাশকে নড়ায়? তার জন্যে আলাদা লোক আছে।
তবে এ কি করে।
কর্তার সঙ্গে তাস খেলে, দাবা খেলে, কাগজ পড়ে শোনায়।
ওই আগলি লোকটা? কেন মেয়েটা পারে না?
মেয়েটা যে বুড়োর কে তাই বা কে জানে।
তবে আর কি এনকোয়ারি যাদু?
ওই যা হয়েছে ঢের। যা একখানা কুকুর আছে বাড়িতে।
আর ওই দিদিমণিটি। উঃ! কলেজ যায় আসে, যেন একখানা জ্বলন্ত মশাল চলেছে। মানকের যেমন ভোকাট্টা বায়না। ওই মেয়ের সঙ্গে ভালবাসা করবে।
হ্যাঁ, ওদের পেশা যাই হোক, আপাতত আজকের ঘটনার মূল উদ্দেশ্য, ওই মেয়েটার কাছাকাছি পৌঁছনোর উপায় আবিষ্কার। এই অদ্ভুত উপায়টাই মাথায় এসেছে ওদের।
অবশ্য যুক্তি যে নেই তা নয়, কারো বিপদের সময়, মৃত্যুর বিশৃঙ্খলার সময় যত সহজে অন্দরের দরজায় পৌঁছে যাওয়া যায়, সহজ শৃঙ্খলা, সুখ—স্বস্তির সময় কি তা যায়? অতি ডাঁটুস বাড়িতেও এরকম আলগা সময় শিথিলতা আসে। আর সেই বিপদ—বিশৃঙ্খলার সময় যদি কেউ ত্রাণকর্তা হয়ে আসে?
সেই অবস্থাটা মনে মনে ছকে নিয়েই এদের এই কর্মপদ্ধতি।