পনেরো
তারপর? সমস্ত গোলমাল শান্ত।
শোভনা রাগ করে অসময়ে গুরু আশ্রমে চলে গেছেন, সেখানেই থাকবেন বলে।
ভবনাথকে মৃগাঙ্কর ঘরে নিয়ে এসে তাঁর নিজস্ব জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে। যদি মৃগাঙ্কর আবেগের অবিরল অশ্রু থামাতে পারেন তিনি।
মানিক আর টিসু এক শূন্য মঞ্চে বসে।
মানিক বলল, একজনের পাপ স্বীকার হয়ে গেছে। এবার মানিক হতভাগার পালা। আজ আমার কথা সব আপনাকে বলে যাব।
টিসু অগ্রাহ্যের গলায় বলল, যাবেটা কোথায়?
যে জাহান্নম থেকে এসেছি সেইখানেই যাব। আর কোথায় জায়গা বলুন আমাদের মত হতভাগ্যদের।
এ জায়গাটা জাহান্নামের থেকেও খারাপ লাগছে তোমার?
মানিক উত্তেজিত গলায় বলে ওঠে, আপনি যদি আমার পরিচয় জানতেন, জানতেন আমি কে, আমি কী, তাহলে আর একথা বলতেন না। নিজেই গলাধাক্কা দিয়ে—
গাঁইয়া কথাগুলো ছাড়ো মানিক। গলাধাক্কা কথাটা বড় সেকেলে।
এখনো আপনি ঠাট্টা করছেন? জানেন আমি কত বড় বিশ্বাসঘাতক। আপনার বিশ্বাস আর সরলতার সুযোগ নিয়ে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকেছি খাচ্ছি পরছি। অথচ আমি—
টিসু হঠাৎ কড়া গলায় বলে, অতো বুদ্ধির অহঙ্কার কেন হে মানিকবাবু? আমার সরলতার, অজ্ঞানতার, নির্বুদ্ধিতার সুযোগ নিয়ে ‘আপনি’—আহাহা। তোমার ইতিহাস যেন জানি না আমি। প্রথম দিনেই যেন আমি ধরে ফেলিনি, তুমি কী? কেন? কবে? কোথায়? ধরে ফেলিনি—দাদুর মাথা ভাঙার কারণ রহস্য? প্রথমদিনই জেনেছি বুঝলে হে!
কী বলছেন?
মানিক উঠে দাঁড়িয়ে বলে, কী বলছেন আপনি? তবু আপনি আমায় বাড়িতে—
হুঁ তবু আমি—
কিন্তু কেন?
রুদ্ধ গলায় বলে ওঠে মানিক কেন? কেন?
আমার শখ। বিদঘুটে শখই বলতে পারো। আর সেই বিদঘুটে শখেই তোমায় চিরকালের মত আটকে রাখবার তাল করছি।
টিসু।
বদ্ধ গভীর এই ডাকটার উত্তরে টিসু হালকা গলায় বলে ওঠে, থাক। তবু একটু উন্নতি দেখছি। সুলক্ষণ।
টিসু। তোমার এই বিদঘুটে শখ ছাড়ো। শখের খেয়ালে সুইসাইড করতে বোসো না। ভেবে দেখো—আমি কী, আর তুমি কী?
হঠাৎ চপলতা ছেড়ে গম্ভীর হয় টিসু।
ক্লান্ত গলায় বলে, ভেবে দেখেছি। দেখেছি তুমি আমি স্বজাতিই। তুমিও দুঃখী, আমিও দুঃখী।
তুমি দুঃখী।
দুঃখী বৈকি! বাপ নেই, মা থেকেও নেই। বৈধব্য জীবনের পবিত্রতা ভুলে গুরু আশ্রমের ছুতোয় আত্মপ্রবঞ্চনা করে চলেছেন তিনি। আমি যে তাঁর একটা মাত্র সন্তান, সেকথা মনেই পড়ে না। আর আমার শ্রেষ্ঠ অভিভাবক বাবার বাবা, তিনি তাঁর মৃত পুত্রের জিনিস বেচে নেশার খরচ জোগান দেন, আর একটা সৎ মহৎ ভাল লোকের ভালবাসার সুযোগ নিয়ে আজীবন তাকে ভাঙিয়ে খেয়ে চলেছেন, কখনো ভাবেননি তারও একটা মনপ্রাণ আছে, রুচি আদর্শ আছে। আর আমি নিজে?
টিসু আরো ক্লান্ত গলায় বলে, আমি আমার এই বঞ্চিত বিরক্তিকর জীবনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে বসে, নিজেকেই বিকৃত করে তুলেছি। গড়ে তুলেছি উদ্ধত, অভদ্র, দুর্মুখ স্বেচ্ছাচারী করে। তোমার প্রবলেমও তো তাই! জীবন আর সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চেয়ে হয়ে উঠেছো সমাজবিরোধী, জীবন বিরোধী। আমরা দুজনেই একই দুঃখের শিকার। কিন্তু দেখাই যাক না এই দুটো দুঃখী জীবন দিয়ে ‘একখানা’ সুখী জীবন গড়ে তোলা যায় কিনা।
—