তেরো
এই রকম একটা দিনে হাজিরা খাতায় সই করতে আসা মানিককে চলতি পথে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন ভবনাথ। আর কাছে আসতেই বিনা ভূমিকায় বলে উঠলেন, তুমি আর তোমার দলবল তো বাপু অসাধ্য সাধন করতে পারো। তা আমার একটা উপকার করতে পারবে?
‘তুমি আর তোমার দলবল!’
মানিকের মনে হল তার পা দুটো কে মাটিতে পুঁতে দিল। মানিক বোকার মত বলল, ‘আমি আর আমার দলবল’ মানে?
মানে বুঝতে পারছো না বুঝি?
ভবনাথ একটু হাসলেন। বললেন, আচ্ছা না হয় মানে নেই। বুড়োরা অমন কত ভুলভাল বলে। বলছি—এ বাড়ির কাউকে না জানিয়ে এই বুড়োকে বাড়ির বার করে নিয়ে যেতে পারো?
কাউকে না জানিয়ে? অসম্ভব কথা বলছেন কেন?
ভবনাথ বললেন, অসম্ভব সম্ভব করবে এই আশা।
আমার দ্বারা ওসব হবে—টবে না। আপনি তো দু’খানা বই নয়, যে ব্যাগে ভরে পাচার করা যাবে।
বলে ফেলেই থতমত খেয়ে যায় মানিক।
এ কী কথা বলে বসল সে।
এমন একটা কথা যে বলে বসতে পারে সে, এমন চিন্তা তো এক মুহূর্ত আগেও ছিল না। হঠাৎ যেন কেমন নিজেকে আক্রমিত মনে হলো। তাই—দিশেহারা হয়ে—
কিন্তু ভবনাথ কি এতে থমকে গেলেন?
তা তো নয়?
ভবনাথের মুখে একটা কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল।
বুড়োটি মুখে সেই হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন, তোমার দ্বারা হবে না? আর আমি যদি তোমায় ব্ল্যাকমেল করি?
ব্ল্যাকমেল মানে?
মানিক বসে পড়তে পড়তে সামলে নেয়।
মানিকের কানে একটা আর্তস্বর যেন আছড়ে পড়ে। ‘ও কে? ও কে? ও এখানে কেন?’
ভবনাথ বললেন, আরে অমন ঘাবড়ে গেলে কেন? সত্যি কি আমি তাই করব বাপু? তবে ভেবে পাচ্ছি না আর কাকে বলি?
কাউকে না জানিয়ে চলে যাওয়াই কি ভাল?
আস্তে বলে মানিক।
ভবনাথও আস্তে হেসে বলেন, কখনো কখনো জীবনে ‘ভাল—মন্দ’ দুটো শব্দ এক হয়ে যায় বাপু। এ জীবনের আরও কত বেশী লোকসান হবে? বড়জোর না হয় অপবাদ রটবে গৃহকর্ত্রীর লোহার আলমারীর মধ্যে থেকে গহনাগাঁটি পাওয়া যাচ্ছে না।
সেটা আপনার কাছে খুব তুচ্ছ হলো?
সবই তো আপেক্ষিক বাপু।
মানিক ওঁর নির্লিপ্ত নির্বেদ মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখল। ওই অবিচলিত ভাবটা দেখে মানিকের কেমন যেন রাগ হল। অথবা হিংসে। বসে উঠল, ‘ভাল আর মন্দ’ দুটোই যদি আপনার কাছে সমান, তবে কাউকে না জানিয়ে চোরের মতো চুপিচুপি চলে যেতে চান কেন? সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে চলে যান।
সে তোমায় বোঝাতে পারব না বাপু। মোটের মাথায় কোনো ‘নাটুকে দৃশ্য’র আমদানী করতে চাই না।
ওঃ।
মানিক হঠাৎ মরিয়া হয়ে বলে ওঠে, আপনি আমায় ব্ল্যাকমেল করতে পারেন বললেন কেন?
এমনি, ‘দাদু’ বলে ডাকো, ঠাট্টা করলাম একটু।
কক্ষনো না। আপনি নিশ্চয় আমায় চিনতে পেরেছেন।
চিনতে? আরে ভাই, এ জগতে কে কাকে চিনতে পারে? এই যে এ সংসার আমায় এতোকাল দেখছে, চিনতে পেরেছিল? এখন পারলো?
ওকথা আমি মানি না। কোথাও কিছু গণ্ডগোল আছে। তবে শুনুন, ব্ল্যাকমেল করতে গেলে কোনো সুবিধে হবে না আপনার। আমি নিজেই প্রকাশ করে যাবো, আমি কে, কী আমার পরিচয়, আর কোন কৌশলে আমি এ বাড়িতে ঢুকতে পেয়েছি। আপনার ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে ক্ষমা ফমা চেয়ে ন্যাকামি করতে চাই না। ধরে নিচ্ছি—এসব আপনার ভাগ্যে ছিল।
ও দাদা, তাহলে আমার ব্যবস্থা হবে না? নিজে ব্যবস্থা করে ওঠবার মত ক্ষমতা পেতে যে অনেক দেরী হয়ে যাবে।
আমি জানি না। বাড়ির লোককে না বলে—নাঃ অসম্ভব।
বেশ বলেই দিও—