বারো
রাস্তার ছেলে।
বলল একথা?
ছিটকে উঠেছিল বিজু।
মানিক উদাস হাসি হেসে বলেছিল, বললো তো।
প্রথম প্রথম নিয়মিত রিপোর্ট দিতে আসতে মানিক তাদের আড্ডায়। ক্রমশঃ নিয়মে ছেদ পড়তে শুরু করেছে, অতঃপর আরো ঝাপসা। কিন্তু তখন তো সদ্য টাটকা।
বিজু বললো, তবু তোর ওর সঙ্গে প্রেম করবার বাসনা শা—
মানস সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে ধীরে—সুস্থে মুচকে হেসে বলেছিল, সেইজন্যেই তো আরো। ওটা সাইকোলজির একটা বিশেষ থিয়োরি। যতো হ্যানস্থা, খিঁচুনি, দূর ছাই, প্রেম ততোই ঘনীভূত।
মানিক মলিন মুখে বলেছিল, ওসব বড়বড় কথা বলছিস কেন? কেমন যেন একটা ভূতে পেয়েছিল, মনে হতো যে কোনোভাবে একবারও যদি ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পাই, দুটো কথা কইতে পাই—
এখন ভূত ছেড়ে গেছে।
বুঝতে পারছি না। বুড়ো যখন বলে উঠল ‘কে? কে? ও কে?’ তখনই তো হয়ে গেল আমার। কিন্তু মাথাটা ফাঁকা তো আর কিছু বলল না। চোখ বুজে ফেলল।
আর একদিন এসে রিপোর্ট দিল মানিক, কাল ছাড়া পাবে বুড়ো। তার মানে আমার কাজ ফুরোলো ওঁনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া—আসা ডিউটি ছিল তো আমার।
পবিত্র ছিল আড্ডায়, বলল, কেন বাবা! ‘মশালের’ এমন মোমবাতির মতন ব্যাভার কেন? ওরা আবার বডিগার্ডের ধার ধারে না কি?
ধারে।
মানিক বলল, ও বলে, একলা বিলেত চলে যেতে পারি কিন্তু ট্যাক্সিতে একলা সাউথ থেকে নর্থে? অসম্ভব।
কথা শেষ হয় না, অন্য প্রসঙ্গ এসে যায়।
মানিককে কেউ কেউ অভিনন্দন জানায়, কেউ বা বলে, মাইরি শা—তোর সঙ্গে ভাগ্য বদল করতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু ক্রমশই মানিক বেপাত্তা! হঠাৎ হঠাৎ একদিন হয় তো এসে হাজির হয়।
এরা বলে, কী রে মাকড়া, সত্যি সত্যি সগগের টিকিট কিনে ফেললি না কি? সেদিন যে বললি বুড়োকে বাড়ি আনা হয়েছে—
হয়েছে তো—
তো চোরামি ধরা পড়ে কি বলছে?
কিছু বলছে না।
বলে মানিক কেমন আলগা গলায় বলল, সত্যি বটে হাতে হাতে ধরা পড়েছে। গিন্নী তো দেয়ালকে শুনিয়ে শুনিয়ে খুড়ো—শ্বশুরকে চোর জোচ্চোর ঠগ নেমকহারাম বলতে কিছু বাকি রাখল না, তবু বিশ্বাস হয় না লোকটা সত্যি খারাপ। মনে হয় ভেতরে বোধহয় অন্য কোনো ব্যাপার আছে।
রাখ তোর কথা—
মানস বলেছে, ওদেরই বলে ‘সিক্তমার্জার।’ বুঝলি? আগে বুড়োকে আমি রেস—এর মাঠে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি, খানদানী দোকান থেকে বোতল নিয়ে বেরিয়ে আসতেও দেখেছি, বাজারের থলির মতন থলিতে পুরে ফেলে এমনভাবে হাঁটে যেন পুঁইশাক কিনে ঘরে ফিরছে। ঘুঘু বুড়ো।
দিন যাচ্ছে। আর—
এ আড্ডায় ক্রমেই মানিকের জায়গাটা ফাঁকা থাকছে।
ওদিকে কড়া হুকুম, ‘একদিনও কামাই চলবে না—খবরদার।’
মানিক জানে না তার চাকরিটা কি। অথচ কামাই চলবে না।
প্রশ্ন করারও প্রশ্ন নেই। অদ্ভুত একটা স্বপ্নাচ্ছন্ন অনুভূতি নিয়ে যেন বাতাসে সঞ্চরণ করে বেড়াচ্ছে মানিক। মানিকের অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই, বর্তমান লুপ্ত। ‘মানিক’ নামের যে একটা ইচ্ছে করে উচ্ছন্ন যাবার প্রতিজ্ঞা নেওয়া ‘সর্বনেশে’ দলের ছেলে ছিল সেটা যেন কতদিন আগে দেখা একটা সিনেমার দৃশ্য।
আবার ভবনাথ নামের সেই—দীনহীন বৃদ্ধটার অবস্থাও প্রায় একই।
এ সংসারে ‘ভবনাথ’ নামের যে লোকটা বাড়ির কর্তার ঘরের একাংশের বাসিন্দা ছিল, তাঁর আজীবনের সঙ্গী বন্ধু স্নেহভাজন অনুগত হিসেবে পরম মূল্যবান ছিল, আর ‘বিশ্বস্ত’ শব্দটার প্রতীক হিসেবে এ সংসারের সমস্ত কিছু রক্ষণাবেক্ষণের ভারপ্রাপ্ত হয়ে একটা নিশ্চিন্ততার স্বর্গে বাস করতো—সে লোকটা যেন আর কেউ। যেন ভবনাথ অনেকদিন আগে দেখা কোনো নাটকের দৃশ্যের নায়ক।
এখনো ভবনাথ, সেই ভবনাথকে ঘুরতে ফিরতে কাজ করে বেড়াতে দেখেন। দেখেন এক অনড় রোগীর বিছানার পাশে বসে তাস খেলতে, দাবা খেলতে, কাগজ পড়ে শোনাতে, রাত জাগতে।
সেই স্বর্গভূমিতে আর পা ঠেকাননি ভবনাথ।
গৃহকর্ত্রীর কঠোর নির্দেশে হাসপাতাল ফেরত ভবনাথের যেখানে থাকার ঠাঁই হয়েছে, সিঁড়ির পাশের সেই ছোট্ট ঘরটার সবটাই প্রায় বাড়ির প্রাক্তন তৈজসজনিত মালপত্রে বোঝাই। তাদের সঙ্গে সহাবস্থান ভবনাথের। শুয়ে শুয়ে সেইগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন ভবনাথ, সেইসব ভাঙা ট্রাঙ্ক বাক্স, মরচে পড়া বড় বড় লোহার কড়াই, গামলা, চাটু, ঝাঁজরি, তুলো বেরনো পুরনো বালিশ—বিছানা, বেতছেঁড়া চেয়ার, পায়া ভাঙা টুল আর আরও কত হিজিবিজির দিকে। তখন মনে মনে হেসে ভাবেন, তা আমিও তো বাড়ির একটা প্রাক্তন মাল বৈ নয়। ঠিক জায়গাতেই ঠাঁই হয়েছে আমার।
শুধু ভরসা এই, এ জঞ্জালটার একদিন চলৎশক্তি ফিরে পাবার আশা আছে, তাই ভরসা হয় ঘরের খানিকটা জায়গা অন্ততঃ একদিন একটু ফাঁকা হয়ে যাবে।
শোভনা অবশ্য বলে, চোট লেগেছিল মাথায়, এখনো পায়ের জোর হল না!’ হুঁঃ! ছুতো! সুযোগ নেওয়া। জানা আছে, ‘সেরে গেছে ভাল আছে’ দেখলেই—লোকে বলবে, ‘পথ দেখো’। যতদিন পারা যায় উসুল করে নিই।
পূজনীয় খুড়শ্বশুরের কান বাঁচিয়ে বলে এমন মনে করার হেতু নেই।