এগারো
তার মানে মোনা কোম্পানীর একটা ক্যালকুলেশান ঠিক হলেও আর একটা নয়।
বিপদ—টিপদের হট্টগোলে কারো অন্দর মহলে পর্যন্ত ঢুকে পড়া যায়। বিশেষ করে যদি সে বাড়ি অভিভাবক শূন্য হয়, সাহায্যের হাতের দরকার থাকে। তাই না মানিকের অদ্ভুত আবদার মেটাতে সেদিনের সেই আয়োজন।
হিসেবে ভুল হয়নি। সেই সেদিন সঙ্গে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সূত্র ধরে, অবাধ প্রবেশাধিকার ঘটে গেছে অভাগা মানিকের। যে নাকি দলের মধ্যে সব থেকে নীরস।
সকলেরই বাড়িতে অল্পবিস্তর কিছু আছে।
বাপ না থাকুক মা আছে, মা না থাকুক বাপ আছে। কিছু না থাকুক দাদা বৌদি আছে? ‘স্নেহে বিগলিত’ না হলেও আছে তো? তাছাড়া—ভাল মন্দ যাই হোক ঘর—বাড়ি আছে (মোনার তো দারুণ বাড়ি আছে। গেটে দারোয়ান, গ্যারেজে গাড়ি) বাড়িতে বাড়া ভাত আছে এবং বেশ দু’চারটে ডিগ্রীও আছে ইউনিভার্সিটির! পবিত্রর তো আবার গীটারে রীতিমত হাত আছে। কিন্তু মানিক?
মানিকের কী আছে?
চাল না চুলো? কিছু না। দূর সম্পর্কের এক দিদি জামাইবাবুর বাড়ি থাকতে পেতো এবং দুবেলা দু মুঠো খেতে পেতো, কিন্তু অনিয়মিত গতিভঙ্গীর অপরাধে সেটুকু আশ্রয় গেছে। মানিক এখন একটা চায়ের দোকানের মালিকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে রাত্রে তার দোকান আগলাবার চাকরিটা জোগাড় করে ফেলে রাতের আশ্রয়ের সমস্যাটা ঘুচিয়েছে। খাওয়ার কোনো ঠিক নেই। তাছাড়া মানিকের কোনো ডিগ্রীও নেই।
দূর সম্পর্কের জামাইবাবু পড়াচ্ছিল, কিন্তু পার্ট টু—তে একবার ফেল মারতেই ঝেড়ে জবাব দিয়ে দিল। বলল, ভস্মে ঘি ঢালবার মত ঘি তার নেই।
সেই মানিক। দলের ওঁচা। যদিও মোনার দলে যখন এসে পড়েছিল, সে মোনা, জগদীশ; পুণ্য ওরা সমস্বরে একটা পুরানো কবিতার কটা লাইন গেয়ে উঠেছিল—
কিসের তরে অশ্রু ঝরে,
কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস?
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করবো
মোরা পরিহাস।
রিক্ত যারা সর্বহারা,
সর্বজয়ী বিশ্বে তারা
গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর
নয়কো তারা ক্রীতদাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে—।
নিজেদেরকে ওরা এই ‘সর্বহারা’র ছাপই দিয়ে রেখেছিল, তবু মানিক নিজেকে ওদের মধ্যে ওঁচা মনে করতো। আর কেমন করে যেন ওঁচা কাজগুলোই তার ওপরই নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিল। তার এবং বিজুর স্বভাবতই এটা হয়ে এসেছে। মোনা কি পুণ্য পবিত্র কি জগদীশ সহজে কখনো পথচারীকে ল্যাং মারতে বা কনুইয়ের খোঁচা দিতে যাবে না।
অথচ সেই মানিক এই বড়লোকের বাড়ির ডাঁটুস মেয়ের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠল।
মোনাদের দ্বিতীয় অঙ্কটা অতএব মিলল না। ‘দরকার ফুরিয়ে গেলে আর চিনতে পারবে না।’ এটা ঠিক হল না।
চাবুকের মত সেই মেয়েটা রাজেন্দ্রানীর ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত গভীর চোখে তাকিয়ে বলে, আছে দরকার! আসতে হবে ব্যস!
ব্যস।
এর উপর আর কথা চলে? অতএব আসতেই হয়।
অবশ্য ‘দরকার’টা ‘আবিষ্কার’ হয় কিছু কিছু।
মৃগাঙ্কমোহনের জন্যে অনেক কাজ।
ডাক্তার ওষুধ, ‘মাসাজের’ লোক কামাই করলে ধরে আনা, এসবের জন্যে কাজ আছে। যেগুলো ভবনাথের দ্বারা হতো। এখন ভবনাথও প্রায় রোগী।
কিন্তু কোথায় ভবনাথ?
মৃগাঙ্কমোহনের ঘরে তো দেখতে পাওয়া যায় না তাঁকে? নাঃ তার সেই চিরশয্যাটি এখনো খালি পড়ে। সিঁড়ির পাশের একটা ছোট্ট ঘরে ভবনাথ আস্তানা নিয়েছেন।
ভারী অদ্ভুত অবস্থায় এখনো এ বাড়িতে তাঁর অবস্থান। তিনি জেনে গেছেন, লোকে তাঁকে ‘জেনে’ গেছে।’ শোভনার স্পষ্ট বক্রোক্তি সেটা প্রতিনিয়তই বুঝিয়ে ছাড়ছে।
অথচ শোভনার মেয়ে তাঁকে এই দুর্বল শরীরে ছেড়ে দিতে চাইছে না।
প্রথম যখন জ্ঞান হয়েছিল ভবনাথের টিসুর পাশে মানিককে দেখে উত্তেজিত রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠেছিলেন, ওকে ও কে?
টিসু বলে উঠেছিল, ও কেউ না ভবদাদু। একটা রাস্তার ছেলে।