জবরদখল – ১০

দশ

সেদিন গুরুর আশ্রম থেকে ফিরেই শোভনা যখন বলরামের কাছে শুনলো দিদিমণি সেই গোঁফ—দাঁড়িওলা বাবুটার সঙ্গে চলে গেছে, এখনো ফেরেনি, তখন শোভনার পা থেকে মাথা অবধি একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গিয়েছিল। আর মনের মধ্যে যে অপরাধবোধ চিড়িক দিচ্ছিল সেই বোধের তাড়নাতেই ছুটে মৃগাঙ্কমোহনের ঘরের মধ্য দিয়ে পাশের বই ভর্তি ঘরটায় ঢুকে পড়েই আলমারিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে এ ঘরে এসে তীব্র চীৎকার করে উঠেছিল বাবা!

মৃগাঙ্কমোহন সেদিন তখন সেই অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। রাত্রে ঘুমের বড়ি না খেলে যাঁর ঘুম আসতে চায় না, তাঁর এই অকালনিদ্রা আশ্চর্য বৈকি। আজকের দুঃসংবাদেরই বোধহয় মুহ্যমান হয়ে অসময়ে এই ঘুম। যদিও টিসুর শাসনে দুটো আঘাত পেতে হয়নি মৃগাঙ্ককে।

কিন্তু শোভনা অতো কেয়ার করবে কেন?

শোভনা অন্যের অপরাধের পাল্লায় অধিক ওজন চাপাবার সুযোগ পেয়ে, নিজের পাল্লাটা হাল্কা বোধ করছে, তাই চীৎকার করে ঘোষণা করতেই আবার ডাকে বাবা। শুনবেন, শুনবেন আপনার আদরের ভাইয়ের কীর্তি—

এই চীৎকারের পর ঘুমের ভান করলে ‘শ্বশুর মরে গেছে’ ভেবে আরো চেঁচাবে শোভনা। মৃগাঙ্ককে তাই ঘুম ভেঙে চোখ খুলতে হয় এবং শুনতেই হয় তাঁর আদরের ভাইয়ের কীর্তি।

হ্যাঁ, মহৎ কীর্তিই সন্দেহ নেই।

তলে তলে পুরো একটা তাকের বই প্রায় নিঃশেষ।

কী হয়েছে সেই দামী দামী মোটা মোটা আইনের বইগুলো?

আর কী হবে বেআইনীর পরাকাষ্ঠা দেখতে তলে তলে পাচার করা ছাড়া?

মৃগাঙ্কমোহন চীৎকার করে বলে উঠেছিলেন, বলছ কী বৌমা? আমার খোকার আলমারির বই থেকে বই চলে গেছে? আমি যে ভাবতে পারছি না। এ হতে পারে না।

হতে পারে না! কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যে তা হয়েছে বাবা।

মৃগাঙ্কমোহন তখন আরো চেঁচিয়ে বলেছেন, বলরাম, আমায় তুলে ধরে ও ঘরে নিয়ে চল। আমি দেখি গে, কে আমার খোকার আলমারির—

ওঠবার ক্ষমতা নেই, তবু ওঠবার চেষ্টা।

বলরাম চেপে ধরে রেখে বলেছে, বাবু, রাগারাগি করবেন না। আবার স্টোক হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবু রাগারাগি করতে ‘না’ করেছে। সে বলেছে আবার স্টোক হলে আর বাঁচানো যাবে না।

মৃগাঙ্কামোহন ডাক্তারের নির্দেশ অমান্য করে আরো চেঁচিয়েছেন বলেছেন, ‘আমি রাগারাগি করছি? পাজী স্টুপিড! আমি তোর ডাক্তারবাবুর পায়ে ধরে সেধেছি বাঁচিয়ে দেবার জন্যে? বলে আয় তোর ডাক্তারবাবুকে খানিকটা বিষ নিয়ে আসতে আমার জন্যে।’

ওঃ ভগবান। বলে ঘাড় লটকে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন! দীর্ঘকাল ধরে।

টিসু হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে কিছুক্ষণ সেই দৃশ্য দেখে দোতলায় উঠে এসে প্রশ্ন করেছিল, মা, ইতিমধ্যে দাদুকে বোধহয় কথাটা বলা হয়ে গেছে। তাই না?

শোভনা তখন গুরুদেবের চিত্রপটের সামনে ধূপ আরতি করছিল, অনেকক্ষণ ধরে সেটা চালিয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রণাম সেরে মুখ ফিরিয়ে বলেছেন কিসের কথা?

কিসের কথা তুমি ভালোই জানো। তা আজই ওটা না বললেই চলছিল না? ভবদাদুকে দাদু কতো ভালোবাসে, সেটা তুমি জানো না তা নয়। ভবদাদুই ওঁর সঙ্গী বন্ধু, ভরসা সহায়, তাঁর এই অ্যাকসিডেণ্টের খবরে দাদু আধমরা হয়ে গেছে। আর তুমি সেই যে কী বলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা তাই বসাতে গেলে? একটু দেরী সইল না? বারণ করলাম না তখন?

তুমিই প্রথমে বলেছিলে, চলো দাদুকে বলিগে।

বলেছিলাম হঠাৎ রাগের মাথায়। তারপর বারণ করেছি।

শোভনার মুখে আসে আমি তোমার হুকুমের চাকর নয় যে, যা বলবে তাই শুনতে হবে। কিন্তু সামলে নেয়। এখন আর তার যাকে যা ইচ্ছে বলার সাহস নেই। এখন মেয়েকেও ভয়। যদি মেজাজ দেখিয়ে চলে যায়। এ যুগে এইসব উগ্রচণ্ডী মেয়েদের জন্যে সুবিধের দরজা হাট করা আছে যে। দিকে দিকে ‘লেডিস হোষ্টেল।’ গিয়ে উঠলেই হল একটাতে। হোষ্টেল খরচের জন্যেই কি তোয়াক্কা করবে? যা হোক একটা কাজ জুটিয়ে নিয়ে চালিয়ে নেবেই। এম.এ. পাশ করেছে, গানে ডিপ্লোমা আছে, মিশন ইনস্টিটিউটে গিয়ে গিয়ে কিসব ভাষা শিক্ষা করে রেখেছে, ওদের পায়ের তলায় শক্ত মাটি! এ কি আর শোভনার মতন অভাগা যুগের মেয়ে?

বেচারা শোভনা।

ভরা যৌবনে স্বামী চলে গেল, ঘাড়ে রইল দুটো বুড়ো, আর একটা নাবালিকা মেয়ে, আর যাবতীয় দায়দায়িত্ব। তার ওপর আবার শ্বশুরঠাকুর পক্ষাঘাত হয়ে পরম উপকার সাধন করলেন। অথচ মেয়ের ইচ্ছে শোভনা বাড়ির মধ্যে বন্দী হয়ে থাকুক! কেন? কিসের জন্যে? শোভনা মানুষ নয়? সিনেমা থিয়েটার দেখে বেড়ালে তোমরা ভাল বলতে? ঘরে পরে ছি—ছিক্কার হতো না? গুরু আশ্রমে যাই তাও দোষ?

একদিন একথা বলে ফেলায় লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে আবার কটকট করে জবাব দেয় কিনা, ‘ঢের ভালো ছিল মা সেটা।’ সিনেমা থিয়েটার? সে তো উৎকৃষ্ট জিনিস। বিশ্বসুদ্ধ মানুষ দেখছে যাবারই জায়গা। সেখানে তো তুমি দর্শকমাত্র। আর তোমার ওই আশ্রমে? সেখানে যে তোমার নিজেরই নায়িকার ভূমিকা। বৃহৎ রিস্ক।

শুনলে হাড় জ্বলে যায়।

মায়ের হাড় জ্বালিয়ে কথা কয়েই ওর সব থেকে সুখ।

এই যে এখন?

বুঝছে তো মার হাড়মাস জ্বলে যাবে এমন কথায় তবু বলে কিনা তারপরে আমি বারণ করেছি। তুমি শোভনা রায়কে বারণ করবার কে হে?

তবু শোভনা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমার প্রাণের জ্বালা বোঝবার ক্ষমতা থাকলে বারণ করতে না, দেখগে তোমার বাপের চেম্বার তারপর বলতে এসো—

টিসু বলল, দেখেই এলাম তো।

দেখেছ? নীচের দিকের একটা তাক প্রায় খালি হয়ে এসেছে দেখেছ?

দেখেছি।

দেখেছিস? তবু এমন ঠাণ্ডা মেরে বসে আছিস? উঃ। ভাবা যায় না! যে লোকটা চিরদিন এ সংসারের ঘাড়ে চেপে—

সব বুঝলাম মা। কিন্তু দাদুকে বলে কোনো লাভ হবে?

লাভ? উনি ওঁর প্রাণের বন্ধুর আদরের ভাইয়ের স্বরূপ চিনুন।

টিসুর সে সময় হঠাৎ কিছুক্ষণ আগে দেখে আসা অসাড় নিস্পন্দ মুখটা মনে পড়ে যায়। তাই বলে ওঠে, ধরো ভবদাদুর আর হসপিটাল থেকে ফেরা হল না। ধরো ওখান থেকেই ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেন, তবে এইটুকুর জন্যে ‘স্বরূপ’ না চিনলেই বা ক্ষতি কি মা?

শোভনা বেজার গলায় বলেছিল, মরবে তো একদিন সবাই। তাহলে তো আর কাউকেই কিছু বলা চলে না।

টিসু বলেছিল, তুমি কিন্তু মা এখনো জিগ্যেস করনি লোকটা আছে কেমন। চোর হোক ডাকাত হোক, বাড়ির একটা লোক তো।

শোভনা নীরস গলায় বলেছিল, মা তো পাষাণ প্রাণ জানোই।

কিন্তু এসব তো সেই সেদিনের কথা। তখনের কথা।

যেদিন যখন ভবনাথ নামের লোকটা হাসপাতালের খাটে শুয়ে পড়েছিল চোখ বুজে।

তারপর গঙ্গায় কতো জল গড়িয়েছে, পরিস্থিতির কতো পরিবর্তন ঘটেছে।

ইত্যবসরে কেমন করে যেন ‘মানিক’ নামের ছেলেটা এ সংসারে প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। মানিককে রোজ আসতে হয় এখানে, কাজ করতে হয় একশো রকম এবং নিত্যই এ বাড়ি থেকে খেয়ে যেতে হয়।

কাজের গতিকে বেলা হয়ে গেলেই টিসু হুকুম দেয়, এই মানিক, খবরদার না খেয়ে যাবে না। যদি শুনি না খেয়ে চলে গেছো, মনে রেখো তারপর এ বাড়িতে ঢোকা বন্ধ।

হ্যাঁ, এখন আর ‘মানিকবাবু’ আপনি নয়, স্রেফ মানিক তুমি এবং কথা শুনলে মনে হয় বুঝি বলরামের পর‍্যায়ের কারো সঙ্গে কথা বলছে। অথচ সেই মানিক বলবে, এখন তো আপনার দাদু ভাল হয়ে উঠেছেন, এখন আর আমার এত আসার কী দরকার?

তখন টিসু অদ্ভুত এক রকম গভীর চোখে তাকিয়ে বলবে, আছে দরকার। আসতে হবে ব্যস!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *