জবরদখল – ১

এক

কার যেন গলার সাড়া পেয়ে ঝুপড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল কালী। কার আর, সেই পবন মুখপোড়ারই হবে। সে ছাড়া আর কালীকে জ্বালাতে আসবে কে? উঁচুনীচু ঢিবি জায়গা থেকে নেমে এসে কালী এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।

কিন্তু কই? কোথায় কে? একবার গলা ঝেড়ে মিথ্যে কাসি কেসে গেল কোথায় হতচ্ছাড়াটা? উঃ এত ফচকে! …কালী একটা ঢিল তুলে নিয়ে অকারণ অনেকটা দূরে ছুঁড়ে মারল। কাকে ভেবে কে জানে।

কালীর পরনে একখানা মোটা তাঁতের খাটো বহরের লাল ডুরে শাড়ি পেঁচিয়ে পরা, গায়ে গাঢ় বেগুনী রঙা একটা ব্লাউজ। শাড়ির নীচে থেকে সাদা সায়ার ঝুল বেরিয়ে এসেছে। কালীর গড়নটা এত বাড়—বাড়ন্ত যে এই হেটো শাড়ির বহরটা যেন নিজেই নিজের হ্রস্বতায় লজ্জা পাচ্ছে। কালী কিন্তু নির্বিকার। ও অনায়াসে গলায় রঙচঙা পুঁতির মালার হালি দুলিয়ে, রেশমি চুড়ির গোছা ঝমঝমিয়ে, আর টান করে বাধা খোঁপায় বুনোফুলের থোকা গুঁজে ঘুরে বেড়ায়।

খোঁপায় ফুলটা কালী এই বীরভূমে এসে শিখেছে। দেশে থাকতে এ সাজ ছিল না, ওতে নিন্দে ছিল।

শীতের হাওয়া বইছিল হু হু করে। কালী আর এই পড়ন্ত বেলার বাইরে ঘুরতে সুখ পাচ্ছিল না। এই কদিন আগে পোষ মেলা গেল, দিনে রাতে মেলায় ঘুরে ঘুরে কালী জ্বরে পড়েছিল। বাপ তাই কেবলই ঠাণ্ডা লাগা নিয়ে টিক টিক করে।

গ্রামের নাম খুঁটিগাড়া। বোলপুর থেকে কটা স্টেশন পরে। এখানে রেল লাইনের ধারে উঁচু ঢিবিতে পুরনো ঝুপড়িগুলোর ধারে—পাশে যে নতুন ঝুপড়িগুলো গজাচ্ছে কিছুদিন থেকে, তারই একটায় কালীরা থাকে। ‘রা’ আর কে, ব্রজ আর তার মেয়ে কালী, অথবা কালী আর তার বাবা ব্রজ।

বাড়ির আসল কর্তা কে, ব্রজ না কালী, এ বিষয়ে আশপাশের বাসিন্দাদের সংশয় আছে।

ঝুপড়িগুলো মানুষের বাসস্থান হলেও পাখির বাসার সঙ্গেই বেশী সাদৃশ্য ও বাসার! এর উপকরণে কাক পাখির বাসার মতই নেই হেন জিনিস নেই। ভাঙা ক্যানেস্ত্রা, কাটা বাঁশ, ছেড়া চট, কাঠি—খসা মাদুর, মচকানো ঝুড়ি, চটা—ওঠা রবার ক্লথ, উলিডুলি ক্যাম্বিসের টুকরো।…সবই কুড়নো মাল। কেমন করে যে বানিয়েছে সব, আর কেমন করেই ওর মধ্যে বাস করে, ভাবলে অবাক লাগে। দরজা মানে তো এইটুকু একটু গর্ত, এক টুকরো চটের ঝাঁপই তার কপাট। কী করে যে ঢোকে বেরোয় ওরাই জানে! ‘ঝুপড়ি’ নামটা খুব মানানসই।

অথচ কালী ওর মধ্যে বসেই টিনমোড়া আয়না ধরে চুলে ‘ভাবন’ করে, মুখে পাউডার মাখে, কপালে টিপ আঁকে, পায়ে আলতা লাগায়, আর ওর মধ্যে থেকেই সায়া—ব্লাউজের ওপর শাড়ি পেঁচিয়ে পরে, গলায় পুঁতির মালা দুলিয়ে খোঁপায় ফুল গুঁজে বেরিয়ে আসে।

ব্রজদের এই ঝুপড়িটা কিন্তু ব্রজর নিজের তৈরী নয়, ব্রজ এটা ভাগ্যক্রমেই পেয়েছে। কে বা কারা যেন এ জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছিল, পরিত্যক্ত ঝুপড়িটা থেকে এ ও সে চটের টুকরোটা, ছেঁড়া মাদুরটা, টেনে টেনে সরিয়ে, ঝুপড়ির গায়ে জানলা ঘুলঘুলি বানাচ্ছিল। বানভাসি ব্রজ কয়াল, আরো অনেক জলের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে এইখানে এসে গড়িয়ে পড়েছিল।

কিন্তু একা তো নয় যে, গাছতলায় পড়ে থাকলেও চলে যাবে, সঙ্গে একটা ধাড়ী—ধিঙ্গি মেয়ে, ঝুপড়িটার সন্ধান পেয়ে বর্তে গিয়েছিল। ওর কাছে তখন এইটুকুই স্বর্গ।

ক্রমশঃ আবার তার জানলা—ঘুলঘুলি বুজিয়েছে, কোথা থেকে মস্ত একখানা পলিথিন সীট জোগাড় করে চাপা দিয়ে বর্ষা, শিশিরের হাত থেকেও আত্মরক্ষা করছে।

রেল লাইনের ধারে, এদিক—সেদিকে আলতু—ফালতু মাল মেলে বিস্তর। ওই পলিথিন সীটটা কারা যেন বৃষ্টির দিনে নতুন সুটকেস মুড়ে নিয়ে এসেছিল, ট্রেনে উঠে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে মুচড়ে—কুঁচকে। ব্রজ কয়াল ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছে। ঝুপড়িতেই যখন থাকতে হচ্ছে, তখন সেটা সাধ্যমত মজবুত করা ভাল।

‘ভালমত একটা বাসা জোগাড় করে এখান থেকে উঠে যাব’ এমন স্বপ্ন দেখে না ব্রজ, দেখবে কোন সাহসে? সর্বস্বান্ত হয়েই তো চলে এসেছিল।

ভাবলে দুঃখ হয়, এই ব্রজ কয়াল মেদিনীপুর জেলায় তার গ্রামে, আস্ত একটা গেরস্ত ছিল। ধান জমি ছিল, মাঠ—কোঠার দো—চালা ছিল, ঘরে ঘরে কাঁঠাল কাঠের তক্তপোষ ছিল। শোবার বিছানা বাদেও, ‘সাঙায়’ রাশিকৃত লেপ—কাঁথার সম্বল ছিল, কাঁসা—পেতলের বাসন ছিল। সিঁদুর—চন্দনের ফোঁটা দেওয়া কাঠের সিন্দুকে ভালমন্দ কাপড়টা—চাদরটা, র‍্যাপারটা, গরম জামাটা ছিল। বৌ মরে যাওয়ার পর ব্রজই তাতে কর্পূর কালোজিরের পুঁটলি দিয়ে দিয়ে রাখত।

বৌ—ও ছিল বৈকি হতভাগার। একদা মা—বাপ, ভাই—বোনও ছিল। তারা কেউ নেই, তবে বানে যায়নি তারা, গেছে মড়কে।…তা সে অনেক কালের কথা। বাচ্চা একটা মেয়ের দিকে তাকিয়েই ব্রজ সেই শূন্য পুরীকেই আবার সংসারের চেহারা দিয়েছিল। ধান জমি ভাগ চাষে দিয়ে নিজে ফ্রি হয়ে একটা জ্বালানী কাঠের দোকান দিয়েছিল মেয়ে বড় হওয়া ইস্তক। টাকাতো জমানো চাই। বিয়ে তো দিতে হবে মেয়ের?

তা দোকানটি লক্ষ্মী হয়ে উঠেছিল। ইদানীং লোকে ওর দোকান থেকে মড়া পোড়াবার কাঠও কিনে নিয়ে যাচ্ছিল। শ্মশানটা তো দোকান থেকে খুব দূরে ছিল না।

রেঁধে—বেড়ে কালীকে খাইয়ে—দাইয়ে দোকানে এনে বসিয়ে রাখত ব্রজ। কালী পা ঝুলিয়ে বসে যত খদ্দেরের সঙ্গে গালগল্প করত। অবস্থায় অতিরিক্ত ভাল ভাল ফ্রক কিনে দিত ব্রজ মেয়েকে, তেল জবজবে করে চুল আঁচড়ে লাল ফিতে বেঁধে দিত, আর হাতে ধরিয়ে দিত মুড়ির মোয়া কি চিঁড়ের চাক্তি, নয়তো—বা দুখানা মিষ্টি বিস্কুট।

লোকে ওই ছোট্ট মেয়েটার মুখে পাকা—পাকা কথা শুনে মজা পেত খুব। বাক ফোটার কাল থেকেই কালী তার বাপের কথার সঙ্গী, দ্বিতীয় প্রাণী ঘরে না থাকায় মেয়ের সঙ্গেই ছিল তার সব কথা। অতিরিক্ত খেয়ে খেয়ে কালী সাত সকালেই বাড়ন্তও হয়ে উঠেছিল বেশ, আর অতিরিক্ত কথা কয়ে কয়ে হয়ে উঠেছিল গিন্নী।

ব্রজ মেয়ের বিয়ের সংস্থান করতে পোস্ট অফিসের খাতাও করেছিল, রাখতো দু’পাঁচ টাকা করে টিপে টিপে সংসার চালিয়ে।

তা সে সবই তো বানের জলে ভেসে গেছে, মায় পোস্ট অফিসটাও।… সর্বস্বান্ত ব্রজ কয়াল আবার যে এখন বুকে বল, আর কোমরে গামছা বেঁধে পেটের ভাতের জোগাড় করছে, সে শুধু ওই মেয়ের শিরদাঁড়ার জোরে। অথবা বলতে পারা যায় তার বাক্যির জোরে।

বানের জল ঠেলে বেরিয়ে এসে মেয়েটাকে নিয়ে অনেক ঘাটের জল খেয়েছে ব্রজ, কিন্তু যখনি ভেঙে পড়েছে তখনই কালী শাসিয়েছে ‘খবরদার বলে দিচ্ছি বাবা, তোমার ওই বাপ—পিতেমোর ভিটের জন্যে নিঃশ্বেস ফেলবেনি, আর কি ছিল, কি ছিল, বলে ‘হায় হায়’ করবেনি, মনে কর তোমার কিছু ছেল না। এই মাত্তর পৃথিবীতে এসে পড়লে তুমি একটা ধাড়ি পাহাড় মেয়ে ঘাড়ে করে।’ … বলেছে, ‘বাবা আবার? বসে বসে কপাল চাপড়াবে তো, এই কালীমতি যে দিকে দু’চক্ষু যায় চলে যাবে।’

কালীর জোরেই বাপ মেয়েতে বিনা টিকিটে রেলগাড়ি চড়ে চড়ে এখান—ওখান করেছে।

টিকিট চেকার উঠলে কালী আগেই এগিয়ে গিয়ে বলেছে, শুনুন, আমাদের টিকিট—ফিকিট নাই, এই আগে থেকেই বলে রাকচি।’

চেকার শুনে হতভম্বই হয়, এমন সত্যভাষণ কখনো শুনেছে কিনা মনে করতে পারে না—তবে ‘ভাষণ’ শুনে শাসন ছাড়বে, সবাই এমন নয়। এই বোলপুরে আসার সময়ই লেগে যায় খটাখটি, চেকার গম্ভীরভাবেই বলে, ‘আগে থেকে বলে রেখে কিছু লাভ নেই। হয় ভাড়া গুণে দিতে হবে, নয় নেমে যেতে হবে।’

কালীও গম্ভীর হয়, ‘ভাঁড়ার পয়সা থাকলে টিকিট না কেটে উঠতুম নি।’

‘ওঃ। তা পয়সা না থাকলে নেমে যেতে হবে।’

কালী আরো গম্ভীর হয় তখন, বলে, ‘এই দুটো প্রাণীর জন্যি ইঞ্জিনের কয়লা বেশী পুড়বে? গার্ট সায়েবের মাইনে বেশী লাগবে?

ব্রজ ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে, ‘আঃ কালী, সর্বত্র তোর কটকটানি। চেকনারসায়েব, আমরা বানভাসি, সর্বনাশী আমাদের সর্বস্ব খেয়েচে—’

‘তুমি থাম তো বাবা!’ কালী ঠিকরে উঠেছে, বানভাসিদের জন্যি গরমেন্ট কত রিলিপ খুলচে, নঙ্গর খানা খুলচে, কাপড়—কম্বল বিলুচ্চে, আর রেলগাড়িতে একবার বিনা টিকিটে উঠলেই ফাঁসির ব্যবস্তা?’

চেকার বিদ্রুপের গলায় বলেছে, ‘ওঃ’ তা বানভাসি তো সেই লঙ্গর খানাতেই যাওগে। নামো। নাহলে—’

কালী কড়া গলায় বলেছে, ‘না হলে পুলিস ডেকে নাবিয়ে দেবেন তো? তাই দিন না। ভালই হয়, জেল হাজতেও ভাত আছে, কী বল বাবা? সেখেনেও হরিহর ছত্তরের মেলা, সেই দিশ্যই দেকে আসি দু’দশদিন। দুটো ভাতের চেষ্টাতেই তো এদেশ সেদেশ করা বাবা? চল। … সায়েব ডাকুন আপনার পুলিস—মুলিস।’

কী জানি কী ভেবে চেকার সাহেব আর কিছু বলেননি, একটা অবজ্ঞাসূচক শব্দ করে নেমে গেছেন।

কালী বিজয় গৌরবে সমবেত জনতার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেছে, ‘লোকেরা যখন বস্তা বস্তা বেআইনী চাল চালান করে, ত্যাখন সায়েবদের টনক নড়ে না। দেকেচি তো আমাদের দেশ গাঁয়ে, আইনির চে বেআইনির কারবারই অধিক।’

ব্রজ হতাশ হয়ে বলেছে, ‘কালী, তুই চুপ করবি?’

কালী সতেজে জবাব দিয়েছে, ‘চুপ কেন করব বাবা? হক কতা কইচি বৈ মিচে কতা কইনি।’

এই কালী!

কাজেই এই ‘ঝুপড়ি নগরে’ও আপন খ্যাতি বিস্তার করতে বেশীদিন সময় লাগেনি তার। কালী এখন সর্বজন পরিচিতা।

এদিকে ক্রমশঃ ব্রজরও ‘জব ওয়ার্ক’ মারফৎ মন্দ আয় হচ্ছে না। ব্রজকে যে কত রকম কাজ করতে দেখা যায়, অথবা ব্রজ যে কত রকম কাজ করে। ব্রজ কখনো গার্ড সাহেবের ফরমাস খাটছে, কখনো স্টেশন মাস্টারের। কখনো ব্রজ বুকিং অফিসের মধ্যে ঢুকে বসে টিকিট বাছাইয়ে সাহায্য করছে, কখনো এঞ্জিনের কয়লা এগিয়ে দিচ্ছে। এই কাজটা দুচক্ষে দেখতে পারে না কালী, কিন্তু ব্রজ কী করবে, যে যখন কামাই করে ছুটি নেয়, ব্রজকে যে কেমন করে সবাই সেই খালি খাচাটায় পুরে দেয়। বাঁধা মাইনের কাজ কিছু নেই, এমনি উঞ্ছবৃত্তিতেই চলে, তবু আজকাল যেন হচ্ছে দু’পয়সা।

তাই বোলপুরের মেলায় মেয়ের জন্যে মবলগ খরচ করে ফেলেছে ব্রজ, কালীর পরণে এখন যা কিছু, সবই মেলা তলায় কেনা। মেলায় বারোমেসে হাটের থেকে দাম বেশী, তবু মেয়েকে নিয়ে মেলায় ঘুরে এটা সেটা কিনে দেওয়ার একটা আলাদা সুখ আছে।

কালীও জোর করে বাপের জন্যে একখানা জোর বাহারী সার্ট কিনেছে, তবে সেটা আর ব্রজ লজ্জায় পরতে পারে না। মেয়ে রাগ করলেই বলে, ‘ভাল জামাটা একটা ভাল দিন দেখে গায়ে দেব কালী।’

কালী অনায়াসে বাপের মুখের ওপর বলে, ‘তাহলে কালীর ছেরাদ্দর দিন পোর ব্রজ কয়াল, একটা দিনের মত দিন।’ রাগ হলেই কালী বাপকে নাম ধরে ব্রজ কয়াল বলে ডাকে।

তবু এত লাঞ্ছনাতেও নতুন জামার টিকিটটা খুলে ফেলে দিয়ে জামাটা গায়ে ঠেকায় না ব্রজ। কারণ ব্রজ মনে মনে একটা সুখস্বপ্ন দেখে রেখেছে। জামাটা একটা ভাল কাজে লাগাবে। আর এ স্বপ্নও দেখে রেখেছে, হাতে টাকা এলেই একটি একটি করে জিনিস পত্তর কিনবে মেয়ের বিয়ের জন্যে।

তা হলেও, দেশে থাকতে মেয়ের বিয়ের সম্পর্কে যে গুরুতর একটা অবশ্য কর্তব্যবোধ ছিল সেটা যেন শিথিল হয়ে গেছে। … এখন শুধু মনে মনে সাধ স্বপ্ন।

হয়তো এই কর্তব্যবোধ শিথিল হয়ে যাওয়ার অন্তরালে ব্রজর এখানকার পরিবেশই দায়ী।

এই ঝুপড়ির সংসারে কালী—বিহীন নিজেকে ভাবতে দারুণ অসহায় লাগে ব্রজর। কালী বিয়ে হয়ে বরের ঘরে চলে গেছে, আর কালীর হাতের ওই হাড়ি—কুঁড়ি কৌটো—শিশির সামনে ব্রজ বসে আছে, ভাবলেই হাত—পা হিম হয়ে আসে!

ব্রজদের ‘খণ্ডখোলা’ গ্রামে থাকতে এমনটা হত না। সেখানে চিরকালের বসতভিটে, আশপাশের জ্ঞাতিগুষ্টি, নিয্যস ভরসার একটা জীবিকা, এরা সবাই বল জুগিয়ে জুগিয়ে ব্রজকে আস্ত একটা মানুষের পরিচয়ে রেখেছিল।

এখানে ব্রজ যেন ‘মানুষ’ নামের জীবনটার ভাঙাচুরো কতকগুলো অংশের সমষ্টি। ব্রজর এখনকার জীবিকার চেহারার সঙ্গে যার মিল আছে।

কালী যেন সেই ভাঙাচোরা আর বাঁকাচোরা অংশগুলো মুঠোয় চেপে ধরে আস্তর মত দেখতে করে রেখেছে। মুঠোটা আলগা হয়ে গেলেই ওই অসমান অংশগুলো ছড়িয়ে পড়ে এলোমেলো হয়ে যাবে।

অবিশ্যি স্পষ্ট করে এতসব ভাববার ক্ষমতা ব্রজর নেই, তবে মনের মধ্যে ওইরকম একটা ‘সব বেঠিক হয়ে যাবে’ ভাব যেন ব্রজর সব ঝাপসা করে দেয়, ব্রজ পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পায় না।

তাই ব্রজর এখন মেয়ের বিয়ের জন্যেও তেমন উচাটন হয় না। যেমন বানের আগে হত। আর মেয়েকে নিয়ে তেমন কড়াকড়িও করে না। মেয়ে এখানকার সাঁওতালী মেয়েদের দেখাদেখি টাইট করে শাড়ি পরে আর খোঁপায় ফুল গুঁজে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে বেড়ায়, ব্রজর চোখে আরামদায়ক না ঠেকলেও বলতে কিছু পারে না। মেয়ে—বৌয়ের আব্রু নিয়ে কড়াকড়ি এমন একখানা সংসারই বা দেখতে পায় কই ব্রজ?

দেশে—ঘরে যতই দীনদরিদ্র নিঃস্ব পরিবার থাকুক, সর্বহারা নয় তারা। কিছু না থেকেও যেন তাদের সব কিছু আছে। …বানের জলে সেই সব কিছু টুকু হারিয়ে ফেলেই যেন লরবড়ে হয়ে গেছে ব্রজ। এখন যদি ওকে বংশপরিচয় জিজ্ঞেস করে বসা হয়, আগের মত গড়গড়িয়ে বলতে পারবে না, পিতার নাম ঈশ্বর রাধামোহন কয়াল, পিতামহের নাম ঈশ্বর মথুরামোহন কয়াল, প্রপিতামহের নাম, না চট করে বলতে পারে না। ভেবে—চিন্তে মনে আনতে হবে। …মাঝে মাঝে মনে হয় ব্রজর, সেটা বোধহয় পূর্বজন্ম। এই তিন—চারটে বছরে কখনো এমনভাবে জীবন বদলে যেতে পারে?

মন হু হু করে ওঠে।

কালী কিন্তু ওই পূর্বজন্মটা যেন জীর্ণবস্ত্রের মতই ত্যাগ করেছে। নিজের মন হু হু করা তো দূরের কথা, কোন সময় বাপের স্মৃতি—উদ্বেল ভাব দেখলে, তাড়না করে তাড়ায় সে ভাবকে। অনায়াসেই বলে, ‘বলি বাবা, মন্দটা কী আছে এখেনে? যা ইচ্ছে তাই করছ, যেমন ইচ্ছে চলছ, ওই কে কী মনে করল বলে তটস্থ হতে হচ্ছে? এখেনে তোমার বেঁচে থাকার কোন টেকসো খাজনা নেই। আর দেশে—গাঁয়ে? উঠতে বসতে টেকসো। জগৎ—সংসারে যে যেখানে আছে তাদের মান রাখ আর হাত জোড় করে থাক, ওই বুঝি কার গোঁসা হল, ওই বুঝি কার ক্রোধ হল। যেন চোর দায়ে ধরা পড়ে থাকা। কেন রে বাপু? জন্মভোর অপরাধী হয়ে থাকা কিসের জন্যে? সেই যে বলে না, ভিখ দেবার কেউ নয়, ধিক দেবার কুটুম? তোমার গাঁ—ঘরে তাই। এখেনে তোমার কেউ ধিক দিতে আসছে—ব্রোজো তুই এখনো মেয়ের বে দিলিনে? ধাড়ি—ধিঙ্গী মেয়ে নিয়ে এখনো বসে আচিস?

শেষের দিকটা বাপের জ্ঞাতি পিসি হরিবালার বাচনভঙ্গীর নকল করে হেসে লুটোপুটি খায়। ব্রজরও যেন তখন মনে হয়, তা সত্যি, এটাই বা মন্দ কী? নির্দায় জীবনের মতন আরামের কী আছে?

তবে—সংস্কার কি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়?

ওই পবনটাকে দেখতে পারে না ব্রজ। বড্ড যেন মস্তান মার্কা, অথচ কালীর সঙ্গেই যেন তার দিনমান ভোর যত দরকার। সব সময় শুনবে, ‘কালী কোথায়? তার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।’

একদিন ব্রজ বলে ফেলেছিল, ‘কালী একটা ডবকা—মেয়ে, তার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা তোমার এত কী দরকার হে বাপু?’

তদবধি যেন একটু কম দেখা যাচ্ছে তাকে। বলতেই হবে এই টাইটটি দেওয়া দরকার ছিল।

অবিশ্যি টাইটে সায়েস্তা হবার ছেলে পবন নয়। কিন্তু কালীর যে কড়া হুকুম ‘আমার বাবাকে যদি কোনদিন একটা কথা বলবি, তোর সঙ্গে হয়ে যাবে।’

ওই হয়ে যাবার ভয়ে পবন নস্কর আর ব্রজ কয়ালের মুখে—মুখে কথা কইতে আসে না এবং সেই টাইটের প্রতিক্রিয়ায় ব্রজ যতক্ষণ না পাড়াছাড়া হয় ততক্ষণ কালীরও ছায়া মাড়ায় না।

পরের ছেলেকেই চুপিচুপি টাইট দিয়ে রেখেছে ব্রজ, নিজের মেয়েকে বলতে পারে না কিছু। বলবেই বা কী নিয়ে?

মেয়ের কি কখনো কোন বেচাল দেখেছে? কারুর সঙ্গে ঢলাঢলি, গলাগলি, ওই পবনটার সঙ্গেও তো কথা কয় যেন কাটোয়া সেপাই। একশো পুরুষের মাঝখানে বসে আড্ডা দিতে পারে কালী আর একটা পুরুষের মত! ব্রজ কয়াল তো নিজেই ওই ডাকাবুকো মেয়ের ছত্রছায়ায় থাকে।

ঢিল ছোঁড়ার পর কালী আশ—পাশের আর দু’একটা ঝুপড়ির কাছে গিয়ে কান পাতল, না কোনখান থেকে পবনের গলার সাড়া উঠছে না।

দুর ছাই! বোধ হয় মনের ভ্রম।

ঠাণ্ডা বাতাস বড় জোর বইছে, ঝুপড়ির গায়ে চাপানো চট—ক্যাম্বিস—মাদুর—চাটাই সব যেন উড়ে যাবার তাল করছে, তাদের সেই চেষ্টার একটা শব্দ উড়ছে—মড়মড়, খসখস, ঝাপস ঝাপস।

ওদের দিকে একবার তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কালী। সহজে উড়ে যাবে না, আর কেউ যা না করেছে, কালী তাদের ঘরটায় তাই করেছে; মোটা একটা দড়া দিয়ে গোল করে ঘিরে বেঁধে। সে দড়ার খুঁট দুটো মাটিতে গোঁজ পুঁতে, তার সঙ্গে বেঁধে রেখেছ। লোকে তাই ঠাট্টা করে বলে ‘ব্রজর তাঁবু’! তাঁবুর দড়ির খুঁট ঠিক আছে কিনা দেখে কালী মাথা নীচু করে ঢুকতে গিয়ে অবাক। ঘরের মধ্যে এসে বসে আছে লক্ষ্মীছাড়া।

ঘরের মধ্যে শীতের পড়ন্ত বিকেলের ম্লান আলোটুকু যেন কাক—জ্যোৎস্নার মত। আলোর একটু আভাস দিচ্ছে, তাও দরজার সামনেটায়। বাকি চারিদিকে ঘন অন্ধকার।

পবন বসেও আছে দরজার দিকে পাশ করে। ওই অন্ধকারেই তবু কালী ঠিক বুঝতে পারছে পবনের গায়ে সেই ডোরাকাটা মোটা গেঞ্জিটা গেল শনিবারের হাটে কিনে এনেছিল পবন কালীর গঞ্জনায়।

শীত হলেও গায়ে চাদর জড়িয়ে বেড়াতে পারে না পবন, অথচ ঘাড়—ছেঁড়া একটা সার্টের অধিক সম্বলও নেই, তাই কালী কড়া হুকুম দিয়েছিল, ‘এই হাটে যদি একটা ‘সুয়েটার’ না কিনবি তো কালীর খাঁড়া পড়বে তোর ঘাড়ে। হিম লাগিয়ে লাগিয়ে মরবি নাকি?

পবন অগ্রাহ্য ভরে বলেছিল, ‘ওসব হিমটিম বাবু—ভাইদের জন্যে, দেখিস না তাদের চাপানোর বহর। গরীবের আবার হিম!’…তবু কিনে এনেও ছিল এই মোটা গেঞ্জিটা। সোয়েটার কেনা তার সাধ্যের বাইরে এটা ঘোষণা করে দেখিয়ে গিয়েছিল।

ওই গেঞ্জিটার সঙ্গে পবন একটা ডোরাকাটা পায়জামাও পরেছে। গলায় একটা রুমাল বাঁধা, তাও নজর এড়াল না কালীর। যাক, তবু হিমটাকে মানছে। কিন্তু এভাবে এসে চুপ করে ঘাড় গুঁজে বসে থাকবার মানেটা কী?

ক’দিন পবনের দেখা নেই, কেউ বলে লাভপুর গেছে, কেউ বলে রামপুর হাট। এত কী রাজকার্য পবনের? পবনের বন্ধু সত্য ঘুরছিল রেল লাইনের ওপারে, কালী তাকে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে ডেকেছিল, সত্য না এসে ভারী একটা অভব্যতা করেছিল। মুখের দুপাশে হাত আড়াল করে চেঁচিয়ে বলেছিল ‘পবন ভাইঝির পাত্তর দেখতে গেছে—’

যেন কালী শুধু ওই জন্যেই ডাকতে পারে ওকে। আর কোন কারণেই নয়। ওইভাবে চেঁচানো একটা ভদ্রলোকের কাজ? তাও কালী লাইনের এপারে উঁচু ঢিবির ওপর, আর সত্য ওপারে মাটিতে, অতএব মুখটা তুলে চেঁচাতে হয়েছে। সেই থেকে ভেবে রেখেছে কালী, আসুক পবন, তার বন্ধুর মুণ্ডুপাত করছি। কিন্তু পবন ভাইঝির পাত্তর দেখে ফিরেও এদিকে আসেনি।

আজ ব্রজ সিউড়ি গেছে, রাত দশটার আগে ফিরছে না, তাই ওর বাস ছেড়ে দেওয়া দেখে এসেছে।

কালী ওকে দেখে কড়া গলায় বলে, ‘সন্দ্যের অন্ধকারে ঘরের মদ্যি ঢুকে বসে আছিস যে? লাজ—লজ্জার মাথা একেবারে খেয়েছিস না কি পবন?’

কালী ওর বাপকে অভয় দেয়, ‘এখেনে তোমার মানুষ সমাজকে টেকসো দিতে হয় না।’ কিন্তু কালী নিজেই সেই ‘সমাজ’ নামের অদৃশ্য ঘাতকের ট্যাক্সটি জোগান দেয়। বলে, ‘লাজ—লজ্জার মাথাটা খেয়ে বসে আছিস না—কি রে পবন?’

পবন দুই হাঁটু তুলে মেঝের মাটিতে বসে মাটিতে এক টুকরো পাথরকুচি নিয়ে আঁক কাটছিল। তেমনি কাটতে কাটতেই ঘাড় গুঁজে বলে, ‘আর কতকাল লাজ—লজ্জা ধরে বসে থাকতে হবে শুনি?’

কালী নিতান্ত নির্মারিকের মতো বলে, ‘বলেই তো দিইছি কত দিন।’

‘ওঃ, সেই বোলপুর বাজারে দোকান দিয়ে না বসা অবদি তো? তা দোকান এখন হচ্ছেটা কী দিয়ে তাই শুনি? দাদার সঙ্গে ভাগের জমি, নিজের ভাগটা বেচে দিয়ে চলে যাব তার জো নেই। বাপ—ঠাকুদ্দার প্যাঁচ কষা আছে, কেউ ভাগ ভেন্ন হয়ে জমি বেচতে পাবে না। তা দাদার তো নিত্যি ফ্যাচাং। এই বলে গম রুই, এই বলে আখ বুনি, এই বলে ভুট্টার দর আছে বাজারে, এই ফ্যাচাঙের তালে তাল দিতে হবে।…তা খাটছি খুটছি, তাই দাদা সদয়, জমির ভাগ বেচে দোকান দেব বললে দাদা ঠ্যাঙ ভেঙে ঘরে শুইয়ে রেখে দেবে।’

কালী ইত্যবসরে ঘরের কোণে কাঠের ফুলকি জ্বেলে চায়ের জল চাপিয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট সব উনুন মজুত আছে কালীর, নানা কাজের জন্যে। উনুনে জ্বাল ঠেলতে ঠেলতে বলে কালী, ‘তাহলে ওই দাদার খামারে মুনিষ খাট, আর বৌদির পা—পুজো কর।…কালীমতির আশা ছাড়।’

পবন ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘বৌদির পা—পুজো করতে চাই না আমি, ওর সঙ্গে আমার দিনভোর লাঠালাঠি। নেহাৎ দাদা আর ওই ভাইপো—ভাইঝি দুটোর জন্যেই—’

কালী একটা ছোট মাটির হাড়িতে জল চাপিয়েছিল। তার মধ্যেই একটু চায়ের পাতা আর একটু গুড়, আর চামচ দুই দুধ ফেলে দিয়ে হাতার বাঁট দিয়ে নেড়ে নিয়ে বলে, ‘তোর দাদা লোক ভাল। দেখে ছেদ্দা আসে, কিন্তু তোর ডিপে—মুখী বৌদিকে দেখলে হাড় জ্বলে যায়। ওর সঙ্গে ঘর করা আমার কম্মো নয়।’

পবন মলিন গলায় বলে, ‘তবে তুই কী বলতে চাস বল? আপন জনের সঙ্গে সকল সম্পক্ক ত্যাগ করে, তোকে নিয়ে অকূলে ভাসব?’

কালী একটা এনামেলের গেলাসে চা ঢেলে পবনের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে চা ঢেলে আঁচলের কোণ দিয়ে চেপে ধরে ফুঁ দিচ্ছিল। ফুঁ থামিয়ে বলে, ‘আমায় নিয়ে অকূলে ভাসবি, এমন কথা বলেছি আমি তোকে? যা না বাবা, নিজের পথ দেখগে না। বানভাসি কালীমতি কয়ালকে তোর দরকারটা কী?’

পবন চায়ে হাত দেয় না, তেমনি মনমরাভাবে বলে, ‘দরকারটা যে কী তা যদি তোকে ঢাক পিটিয়ে বলতে হয় কালী, তাহলে তো নাচার।…দরকার আমার সংসার করার, দরকার আমার তোকে। বলি বয়েস কি বসে থাকবে?’

আসল কথা ভাইঝির জন্যে পাত্তর দেখতে গিয়ে পবনের মন বেদম বিগড়ে গেছে। সে ছোঁড়াটা বোধহয় হাঁটুর বয়সী, তার কিনা বিয়ের তোড়জোড়। দন্ত বিকশিত করে যখন এসে বসল ঘাড় হেঁট করে, তখন পবন তো থ। এই বর! ছোঁড়ার যে এখনো বলতে গেলে গোঁফ গজায়নি!

চুপি চুপি বলল, ”দাদা, এ যে একটা বাচ্চা!’ বলতে গিয়ে দেখল দাদার মুখ আহ্লাদে উদ্ভাসিত। দাদা সেই উদ্ভাসিত মুখে আরো চুপি চুপি বলল, ‘কমলিও তো এই সবে দশ ছাড়িয়েছে।’ তবু ওই ছেলেটার আহ্লাদ উপচানো মুখ দেখে পবনের মনে হল, ছেলেটা গোপাল গোপাল হলে কী হবে, আসলে ইঁচড়ে পাকা।

মোট কথা মেজাজটাই বিগড়ে গেল।

ভেবে ফিরল, গিয়েই একটা হেস্ত—নেস্ত করতে হবে। কালীর ওসব দোকান বাতিক ছাড়াতে হবে। বোলপুরে দোকান দিতে না পারলে বিয়ে করবার রাইট জন্মাবে না। এ কেমন কথা!

তাই রেগে রেগেই বলে, ‘বয়েস কি বসে থাকবে?’

কালী একটু দার্শনিক হাসি হেসে বলে, ‘তা কি আর থাকে রে পবন? এ পৃথিবীতে কেউ বসে থাকে না, বয়েসই বা থাকবে কেন? এক সময় আমারও দশ বছর বয়েস ছিল, বাবা তখন থেকে আমার বে’র জন্যি ক্ষেপে উঠেছিল। এই কনে দেখা, এই পাত্তর দেখা! তা—’

কালী একটু হাসল, ‘রক্ষেকালী মেয়ের যুগ্যি বর আর খুঁজে পেল না বাবা। সবার খুঁত কাটে, আর নাক কোঁচকায়। ওর বাবা মাতাল, ওর মা দজ্জাল, ওর চোখটা ট্যারা মতন, ও যেন একটু নেংচে হাঁটে, ঠগ বাছতে গাঁ ওজোড় হয়ে গেল।’

পবন চায়ের গেলাসটায় একটা চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রেখে বলে, ‘ভালই হয়েছিল। নইলে পবনের জন্যে তোলা থাকতিস না। প্রাণে কোন সুখ নেই রে কালী।’

কালী বেশ তাড়া দেওয়া গলায় বলে, ‘হয়েছে, সন্ধ্যেবেলা আর একা ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে মন—প্রাণের দুঃখু—গাথা গাইতে হবে নি। চা শেষ করে পালাও।’

পবন বলে, ‘ব্রজরাজ তো শিউড়ি গেছে।’

ব্রজকে পবন দাদাও বলে না, কাকাও বলে না, বলে ব্রজরাজ।

কালী রাগ করলে বলে, ”একেবারে ‘বাবা’ বলবার জন্যে ডাকটা তুলে রেখেছি রে কালী! দাদা, কাকা, মামা যা—হোক একটা বলে অভ্যেস খারাপ করতে চাইনে।”

কালী বলল, ‘বাবার আড়ালে এসে গালগল্প করা আমার পছন্দ হয় না পবন, মনে হয় যেন অকম্ম করছি। বীরের মতন আসবি, বলবি, আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার বে দিন, তবে তো বলি বেটাছেলে!’

পবন ঢকঢক করে চাটা খেয়ে নিয়ে গেলাসটা ঠক করে নামিয়ে রেখে বলে, ‘তা বীরপুরুষ হতে কি পারিনে ভেবেছিস? ব্রজরাজের নাকের সামনে দিয়ে সুভদ্রা হরণও করতে পারি। তোর যে আবার ওই এক বায়নাক্কা! বাপের কালে শুনিনি—শহর বাজারে দোকান দিতে না পারলে পুরুষের বিয়ে হয় না।’

কালী গম্ভীরভাবে বলে, ‘দোকানের কথা নয় পবন, ওটা উপলখ্যি, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দরকার, সেটাই হচ্ছে কথা। দাদা—বৌদির সংসারে যে কেমন থাকিস তা তো আর আমার জানতে বাকি নেই! এখন তোর সঙ্গে গিয়ে চাকরের বৌ চাকরানী হয়ে থাকতে হবে, এছাড়া আর কিছু না। কালীর দ্বারা ও পোষাবে নি, এই আমার সাদা বাংলা।’

পবন মনমরা ভাবটাকে তেজী করে বলে, ‘তা বিয়ের দু’দশ দিন পরেই যদি হয় ওসব, তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’

‘দু’ দশ দিন পরে তুই কোন তালুক থেকে টাকা আনবি?’

‘সে হয়ে যাবে।’

কালী বলে, ‘তা কি হয়? তখন তোর চেষ্টা চলে যাবে।’

পবন উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তার মানে তুই, আমার মনপ্রাণ বুঝছিস না, আমায় হতভাগা বলে ঘেন্না করিস, এই এক ফিকির করে এড়াতে চাস।’

কালী নীচু হয়ে বসে হ্যারিকেন জ্বালছিল, সেটা জ্বেলে উঁচু করে তুলে পবনের মুখের সামনে ধরে বলে, ‘এতদিন দেখে কালীকে তোর ফিকিরবাজ বলে মনে হল?’

আলোটা যে শুধু পবনের মুখেই পড়েছে তা নয়, কালীর গাঢ় কালো রংয়ের মাজা কাট—ছাঁটের মুখটার একপাশও আলোকিত করছে। ওই আলো—ছায়ায় কালীকে যেন একটা ভয়ঙ্করী প্রতিমার মতই দেখাচ্ছে।

পবন আস্তে ওর আলো ধরা হাতটার বাহুমূল চেপে ধরে আস্তে বলে, ‘আমায় মাপ কর কালী! আমার মাথার ঠিক নেই। কী বলতে কী বলেছি।’

কালী আলোটা নামিয়ে রেখে শান্ত গলায় বলে, ‘মাথা বেঠিক করতে নেই পবন, ভগবানে ভরসা রাখতে হয়। আমি বলছি—তুই কোনখান থেকে ঋণ কর্জ করে ছোট্ট একটা দোকান পেতে বোস, দেখতে দেখতে বাড়—বিদ্ধি হবে।’

পবন হতাশ গলায় বলে, ‘আমায় কে ঋণ—কর্জ দেবে? আমার কী আছে?’

কালী জিদের গলায় বলে, ‘তোর জমিজমা আছে।’

‘দূর, সে সবই তো দাদার হাতে।’

কালীর মুখে একটু অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে, বলে, ‘আর যদি আমি কর্জ করে এনে দিতে পারি? নিবি?’

‘তুই?’ পবনের গলায় বিদ্রূপের সুর ফোটে।

বলে, ‘তোরই বা কী সম্পত্তি আছে? তাহলে নিজেকেই বন্ধক দিবি বল!’

কালী হঠাৎ খুব হেসে ওঠে, ‘এই তো সবই বুঝে ফেলেছিস, কে বলে পবনের বুদ্ধি নেই! তা যা এখন বাড়ি যা।’

পবন গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আজ তোর একটা কথা না নিয়ে নড়ছি না। দাদা বৌদিকে বলছিল, ‘এই সঙ্গে পবনার বিয়েটাও লাগিয়ে দিলে হয়, এক আভ্যুদিক ছেরাদ্দর খরচে মিটে যায়।’ তা বৌদি বলল, ‘মেয়ের পাত্তর তো ঠিক করে এলে, ভাইয়ের কনেও ঠিক করে এসেছ নাকি?’ দাদা বলল, ‘মেয়ের আবার ভাবনা, এই খুঁটিগাড়া গ্রামেই কত যুগ্যি মেয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে।’ কালী ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলে, ‘তবে ওই গড়াগড়ি খাওয়া মেয়েই একটা কুড়িয়ে নিয়ে বিয়েয় বোস গে যা।’

পবন বলে, ‘তুই আমার দুঃখুটা বুঝিস না কালী, এটাই আমার সবচেয়ে দুঃখু! তোর কাছ থেকে সরে গেলেই আমার প্রাণের মধ্যে যেন কে কোদাল কোপায়, তোর কাছে আসবার জন্যে বুকের মধ্যে যেন কামান দাগে। গাধা খাটুনী খেটে মরি, সব যেন বিষ লাগে। ঘুরে—ফিরে বেড়াই, মনে হয় পিথিবীটার যেন কোন মানে নেই।’

কালী গম্ভীর গলায় বলে, ‘সব কথা অত খুলে বলতে নেই পবন। যে খুলে খুলে বলে না, তার যে কিছুই হয় না, তা ভাবিস না। তবে ভাবিস নি আমি রাজি হলেই তোর দাদা—বৌদি রাজি হবে। নিজের পায়ের তলার মাটির কথা অমনি বলিনি রে!’

পবন উত্তেজিতভাবে বলে, ‘রাজী হবে না মানে?’

‘হবে না তাই বলছি। কথা তুলে দেখিস।’

‘আচ্ছা এখনি গিয়ে বলছি।’

পবন যেতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘কিন্তু ওরা যদি রাজী হয়?’

কালী হেসে উঠে বলে, ‘তাহলে আমিও রাজী আছি। তবে তোর বৌদির সঙ্গে আমার বনবে না, তা আগে থেকেই বলে রাখছি। বাড়িতে কাক উড়বে, চিল পড়বে।’

‘পড়ুক উড়ুক।’ বেশ বীরদর্পে বেরিয়ে পড়ে ঢিবি চাপা এবড়ো খেবড়ো দিয়ে অবলীলায় নেমে যায় পবন।

কালী ওই ঠাণ্ডাতেও দাঁড়িয়ে থাকে, দেখে কেমন করে নেমে যাচ্ছে পবন।

ওদের এই ঢিবিটার থেকে রেল লাইন অনেকটা নীচুতে। গাড়ি আসে—যায়, ধারে দাঁড়িয়ে দেখে কালী।

প্রথম প্রথম বাবা বলত, ‘সর্বনাশ ঘটাবি কালী, সরে আয়! পড়ে মরবি।’ ক্রমশঃ আর বলে না, দেখে কালীর এ একটা নেশা। রেলগাড়ির যাওয়া—আসা দেখা।

এই খুঁটিগাড়া গ্রামে সব গাড়ি থামে না, হুশ হুশ করে আসে, হুশ হুশ করে বেরিয়ে যায়। দিনান্তে একখানা ট্রেন যেন বুড়ি ছুঁয়ে যায়। এক মিনিট মেয়াদে তার থামা। এ অঞ্চলের আসল সম্বল বাস! ব্রজ সেই বাসেই আসবে। রাত নটায়। ফিরতি বাসে ফিরবে।

শীতের রাতে একলা ওই ঝুপড়ির মধ্যে কাঁথা মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই, বেলা থাকতেই তো দু’খানা রুটি গড়ে কাজ সেরে রেখেছে। আর সকালের দরুণ ডাল, আলুর তরকারি আছে। শীতকালে এই একটা সুখ। দুবেলা রাঁধতে হয় না।

কিন্তু এত ‘সুখ’ নিয়েই বা করবে কি কালী? কাজের তার অন্ত নেই, অথচ অবকাশও বুঝি অফুরন্ত। রাঁধা, বাসন মাজা, জল তোলা, কাপড় কাঁচা, ক্ষার সেদ্ধ, কাঠ কাটা, কয়লা ভাঙা, পাড়া বেড়ানো, এত সব করেও কালী অবকাশ নিয়ে হাঁকপাক করে।

শীতকালটা আরো বিশ্রী। ‘অবকাশ’টা যেন কালীকে কেটে কেটে নুন দেয়।

এই এখন গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা, ভাবতে গিয়ে যেন নিজের ওপর ঘেন্না এল কালীর। অথচ এই জনশূন্য জায়গাটায় দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে? শেয়াল—কুকুর আছে, ‘মানুষ’ জাতটার মত দেখতে শেয়াল—কুকুরেরও অভাব নেই সংসারে।

তা তাদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কালী ধারালো ঝকঝকে একখানা টাঙ্গি কাছে রাখে। রাতে বিছানার মাথার কাছে রাখে।

এই রাখার কথা সবাই এখন জেনে ফেলেছে, তাই কালীর দিকে কেউ আর এখন নজর দিতে সাহস করে না। তাছাড়া শুধুই তো কালী নয়, পবন আছে না? পবনের বার্তাটা পবনেই রটেছে, ‘পাপচক্ষু’ লোকেদেরও তো প্রাণের ভয় আছে! পবনের জিনিসে চক্ষুদান করবে, এত সাহস এই খুঁটিগাড়া গ্রামে নেই কারুর?

কালীর কাছেই পবন কেঁচো! কিন্তু অন্য লোকের কাছে পবন দুর্দান্ত। ভীতিকর। যেমনি বেপরোয়া, তেমনি রগচটা! কথায় কথায় কারও সঙ্গে বচসা হলে পবন এক কথায় ঘুঁষি তুলতে পারে, আর দু’কথায় মাথা ফাটাতে পারে। কালী যে ওকে কী মন্ত্রে বশ করেছে? কালী মরতে বললে মরতে পারে পবন। কিন্তু কালী? ওইখানেই একটা মস্ত প্রশ্ন চিহ্ন।

পবন কালীর জন্যে যতটা অস্থির, কালী কি তাই? কালী ঠিক বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে নিজে প্রশ্ন করে কালী, আমি পবন বিহনে চক্ষে অন্ধকার দেখি? পবনের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা না হলে কি আমি ওই রেল লাইনে গলা পেতে শুতে যাব?

এ প্রশ্নের সদুত্তর পায় না কালী।

ওর মন যেন অনেক অনেক দূরে কোথাও ভেসে যেতে চায়। ঝুপড়ির মধ্যে থেকে কালী সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে। পবনের বাড়িঘর কালী দেখেছে। ঝুপড়ির তুলনায় স্বর্গ! মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, কিন্তু ঘর আছে অনেকগুলো, দাওয়া আছে, উঠোন আছে, পাতকুয়ো আছে, আবার খেড়কিতে পুকুরও আছে। এ বাড়ির বৌ—ঝির আরাম কত! তাছাড়া খাওয়া—পরার দুঃখু নেই। নিশ্চিন্তে রাঁধো—বাড়ো, গোয়াল নিকোও, ঢেঁকিতে পাড় দাও, চিঁড়ে কোটো, মুড়ি ভাজ এবং মাঝে মাঝে যোগাড়—যন্তর করে বোলপুরে গিয়ে সিনেমা দেখে এসো, ব্যস।

যাকে বলে সংসার—সুখ।

সুখ বৈকি! স্বামীও চোখ ছাড়া হয়ে এখান—সেখান ঘুরছে না পয়সার ধান্ধায়। সর্বদা চোখের ওপরই স্থিতি। ধান, চাল, অড়র, মটর, ছোলা, কলাই নানান জিনিসের চাষ পবনদের। পবনের দাদা নবীনের খামখেয়ালে তো আরো রকম রকম কারবার!…এখন আবার পোলট্রি করতে ঝুঁকেছে। তবে ইচ্ছেমত ডিমও খাবে।

কী আশ্চর্য! তবু কালী পবনকে অনিশ্চিতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বার প্ররোচনা দিচ্ছে। কালী কি বুঝছে না এই নিশ্চিন্ত নিরাপদ দুর্গটির মূল্য কত! আর এর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভাগ্য ফলাবার চেষ্টার ঝুঁকি কত!

নাঃ, কালী বুঝছে না। এত বুদ্ধি ধরে কালী, তবু এত সহজ হিসেবটা বুঝতে পারছে না। কালী দূরের স্বপ্ন দেখছে।

পবন চোখ ছাড়া হয়ে অনেকটা দূরে চলে গেল, তবু কালী দাঁড়িয়েই থাকল। শীত করছে, শাড়ির প্যাঁচানো আঁচলটা আলগা করে নিয়ে পিঠটা ঢাকলে শীত কমে, তাতেও যেন আলিস্যি লাগছে। পবনের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে কালীর মনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম মনোভাবের উদয় হল। কালী ভাবুকের মত ভাবল, ওই ছেলেটা যদি এইভাবে আমার জীবন থেকে একেবারে চলে যায়, যেমন আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল, তেমনি চিরতরে মিলিয়ে যায়, তাহলে কি আমি বুক ফেটে মরে যাব?

পবনের কথা ভাবতেই ওই ‘ছেলেটা’ই মনে হল কালীর। তাই হয়। মুশকিল তো সেইখানেই। কালীর থেকে তো পবন চার বছরের বড়, তবু কেন কালীর পবনকে ‘ছেলেমানুষ’ বলে মনে হয়; কেন ওর কথা ভাবতে গেলে ‘ছেলেটা’ ছাড়া আর কোন বিশেষণ মনে আসে না?

পবনের ওই ভালবাসার তীব্রতা, কালীকে পাবার জন্যে আকুলতা, এটা যেন কালীর কাছে একটা দুরন্ত ছেলের বায়না আব্দারের মতো লাগে। যেন সে তার একটা শখের জিনিস চাইছে, যেটা তার পাবার কথা নয়।

তবু যদি কালী সেটা ওকে দিয়েই দেয়। তা সে দেওয়ার ভাবটা হবে, ‘যাকগে, মরুকগে, নিকগে। না নিয়ে যখন ছাড়বেই না দেখছি।’

কিন্তু এইটা কি আত্ম—সমর্পণের ভাষা?

কালী বইয়ের মত করে ভাবতে না জানুক, কালীর মধ্যে অনেক ভাবের তরঙ্গ ওঠে, কালী সে তরঙ্গে আলোড়িত হয়।

নাঃ, আর দাঁড়ানো যাচ্ছে না, হাওয়া দুরন্ত হয়ে উঠেছে। …বাবার আসতে এখনো তিন ঘণ্টা। সাড়ে ছটার সময় যে ট্রেনটা এখানের লাইন কাঁপিয়ে গুম গুম করে চলে যায় না থেমে, সেটা এখনো আসেনি। সেটা চলে গেলে তবে কালী এখান থেকে যাবে ভাবছিল, কিন্তু দাঁড়াতে পারল না, দারুণ শীত ধরেছে। ফিরে দাঁড়িয়ে ঝুপড়ির দিকে যাবে, দেখে মালবাবু জগৎ সাহা।

তার মানে পিছনে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ ওৎ পেতে।…’ওৎ পেতে’ই মনে হল কালীর। কালীকে ফিরতে দেখেই জগৎ সাহা ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলে উঠল, ‘কী? ভাবের লোকটি চলে গেল? আর একটু বসল না? আহা—হা চুক চুক! তা এখুনি গেল কেন? ব্রজর ফিরতে তো আজ রাত্তির।’

রাগে মাথা জ্বলে গেল কালীর। ইচ্ছে হল ওই ঢিবির ধার থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। গড়াতে গড়াতে যমের বাড়ী পৌঁছে যাক।

লোকটাকে দেখলেই হাড় জ্বলে যায়, সুযোগ পেলেই জ্বালাতে আসে। অন্য কিছুই না, ভয়ঙ্কর কিছু করতে আসে না, আজেবাজে দুটো কথাই কইবে, কিন্তু ভঙ্গীটা কুৎসিত, হাসিটা নোংরা।

ওর ওই অলস্টার আর টুপী মোজায় মোড়া বেঁটে মোটা চেহারাটা দেখে কালীর বুনো ভালুকের চেহারার কথা মনে পড়ে যায়। ঠিক তেমনি পিঠ ফুলো, ঘাড় গোঁজা, আর হাত দুটো বেঁটে বেঁটে।

কালী চারদিক তাকিয়ে দেখল। কেউ কোথাও নেই। ঝুপড়িগুলো যেন এখুনি ঘুমের সাধনা করছে। গা’টা একটু যে ছমছম করে না উঠল তা নয়, তবে কালী সেই ছমছমানিকে প্রশ্রয় দিল না, শুধু কায়দা করে একটু পিছিয়ে একেবারে ঢিবির ধারে গিয়ে দাঁড়াল। এই দাঁড়ানোয় বুকে বল মজুত থাকল।

এগোতে আসে, নীচে ঝাঁপ দেবার ভয় দেখান যাবে। হঠাৎ বেশী এগিয়ে আসে, ঠেলে ফেলে দেওয়া যাবে।

আত্মস্থ হয়ে উদ্ধত গলায় বলল, ‘আপনি এখানে?’

‘আহা, বড় অন্যায় হয়ে গেছে, না? তা জায়গাটা তো বাপু কারো কেনা নয়, এলুমই বা।’

‘থাকুন।’ বলে কালী দাঁড়িয়েই থাকে, নড়ে না।

মালবাবু জগৎ সাহা দেঁতো হাসি হেসে বলে, ‘ভাবলাম ব্রজ বাড়ি নেই, তুই একা আছিস। একা যে নেই তা জানলে কি আর মরতে মরতে আসি?’

কালী কড়া গলায় বলে, ‘আপনি আমার বাবার নাম ধরে বলছেন যে? বাবা আপনার থেকে বয়েসে ছোট?’

জগৎ সাহা বোধহয় এ প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, থতমত খেয়ে বলে, ‘তা কী বলতে হবে? ব্রজবাবু?’

‘বাবু’ শব্দটার ওপর একটা জোর দেয়।

কালী গম্ভীরভাবে বলে, ‘তাই বলাই নিয়ম, ভদ্রলোকে ভদ্রলোককে বাবুই বলে। ছোটলোকের কথা আলাদা।’

কালীও ‘ছোটলোক’ শব্দটার ওপর জোর দেয়।

জগৎ সাহা তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, ‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা। বাবুই বলব এবার থেকে। ব্রজবাবু! তা চল ঘরে গিয়ে একটু বসি? শীতে যে হাড় কালিয়ে যাচ্ছে। ঘরে গরম আছে। যতক্ষণ না তোর বাবা ফেরে—’ একটু কেশে বলে, ‘একটু আগলাতাম। দিনকাল তো ভাল নয়। ভয় খেতে পারিস—।’

কালী নির্লিপ্ত গলায় বলে, ‘ভয় খাবার কী আছে? ঘরে টাঙি আছে, কাঠ কাটার দা আছে, মাছ কোটা বঁটি আছে, আর হাঁড়িতে গরম জল ফুটছে।’

জগৎ সাহা দু’পা পিছিয়ে গিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলে, ‘তুই আমায় ভয় দেখাচ্ছিস?’

কালী চোখ কপালে তোলে, ‘ওমা, আমি আসব আপনাকে ভয় দেখাতে? আপনারাই তো আমাদের মতন গরীবের ভরসা। তা আপনি আমার জন্যি চিন্তা করতেছেন, তাই আপনার চিন্তা দূর করতেছি।’

জগৎ সাহা বোধহয় বুঝতে পারে হিম লাগিয়ে সর্দি—কাশি ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু লাভ হবে না এক্ষেত্রে, চালাকী করে দাঁড়িয়েছে কোথায় গিয়ে দেখ। তবু ঝপ করে চলে যাওয়া যায় না, হয়ত দুঃসাহসী ছুঁড়ি পেছনে টিটকিরি দিয়ে হাসবে। তাই বলে, ‘কালী, বয়সের গরমে শীতকে শীত বলছিস না, গায়ে একখানা চাদর পর্যন্ত দিসনি, পাঁজরে হিম বিধে নিম্যুনিয়া হবে তা বলে দিলুম।’

কালী বলে, ‘হলে ভয় কি? আপনারা তো রয়েছেন, আমাদের ডাক্তারবাবু আছেন।’

এই আর একটি লোক।

বটু ডাক্তার। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, দু’রকম চিকিৎসা করে বটু। আসলে কোন বিদ্যেয় অধিকার তার তা কেউ জানে না। প্রেসকৃপশন দেয় বাঙলায়, আর বলে, ‘তোদের ডাক্তারখানায় ইংরিজি বুঝবে না বুঝবে, তাই বাঙলাতেই দিলাম।’

বটুরও এদিকে নজর আছে।

আসলে কালীর মত এমন দস্যি বেপরোয়া মুখরা যথেচ্ছ বিহারিণী বেওয়ারিশ মেয়ে, কে কবে কটা দেখতে পায়? কালীর বয়েসে সবাই বিয়ে হয়ে দু’ছেলের মা হয়ে বসে আছে। আর যদি বা কারো ভাগ্যে বর না জুটে থাকে যে আপন বয়েসের লজ্জার ভারে ঘরের মধ্যে বন্দী থাকে। অতএব লুব্ধ পুরুষের চোখে পড়বেই কালী।

হলেও রক্ষেকালী। কালীর রং কালো হলেও জেল্লাদার। মুখের কাটুনী ছুরি কাট, গড়নের বাড়—বাড়ন্ত তো অন্য মেয়েমানুষের চক্ষুশূল।

বটু ডাক্তারের নামোল্লেখে জগৎ সাহার বোধহয় মনে পড়ে যায়। বটু ততক্ষণে ঝাঁপ বন্ধ করে মাল নিয়ে বসে আছে, মালবাবুর অপেক্ষায়। এটাই ওই ‘মাল’টি নিয়ে বসবার সময়। দুই বন্ধুতে অনেক রাত অবধি ভোম হয়ে পড়ে থাকে।

জগৎ সাহা অতএব রণে ভঙ্গ দিয়ে বলতে বলতে চলে যায়, ‘বাপ তোকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথা খেয়েছে।’

কালী এখন গলা খুলে হেসে উঠে। ওর সেই বিখ্যাত হাসি, অনেকক্ষণ ধরে যা বাতাসকে চিরে চিরে সাত টুকরো করে তবে মিলোয়।

কালী ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে, ঝাঁপট টেনে বন্ধ করে যথারীতি দড়ি দিয়ে বেঁধে, হাতের কাছে কাঠ কাটা রামদা’ খানা বাগিয়ে নিয়ে নিজের চৌকীটায় শুয়ে পড়ে। চৌকীতে শুলে উঠতে গিয়ে চালে মাথা ঠেকে, তবু কালীর ওটি চাই। বাবার আর নিজের দুখানা চৌকী সে কিনিয়েছে সেবার সেকেণ্ড হ্যাণ্ড।

চুপ করে শুয়ে শুয়ে ভাবে কালী, দূর ছাই, আর এ জীবন সহ্য হচ্ছে না। সর্বদা নিজেকে রক্ষে করে চলা সোজা কাজ? মরুকগে, ঐ পবনটাকে ধরেই ঝুলে পড়া যাক। পবনের দাদা নবীনের সংসারটি দুর্গস্বরূপ হবে সন্দেহ নেই। ওর মধ্যে আর কাউকে নাক গলাতে আসতে হবে না।

কিন্তু?

তাহলে তো কালীর সমস্ত ইচ্ছে—বাসনার সলিল সমাধি। কালীকে এই খুঁটিগাড়া গ্রামেই খুঁটি গেড়ে পড়ে পড়ে মাটি হতে হবে।

ব্রজ কয়াল হয়তো মেয়ের বর দেখে না হোক, ঘর দেখে সন্তোষ প্রকাশ করবে কিন্তু কালীর যে স্বপ্ন—টপ্ন সব শেষ হয়ে যাবে।

কালী যে দূর অরণ্যের ঘ্রাণ নিতে চায়, দূর আকাশের তারা গুণতে চায়।…কালী মনে মনে শ্বশুরবাড়ি যায় রেলগাড়ি চেপে, নৌকা চেপে, ইষ্টিমার চেপে। কালীর পরণে থাকে জরির চেলি, গায়ে সোনার ঝিলিক, মুখে মাথায় ওড়নার আবরণ। ভাল ঘরের বিয়ে দেখেছে কালী দেশে থাকতে, ওড়নার মধ্যে কনের মুখ। কী রমণীয়!

কিন্তু ওই কনের পাশে বসে কে?

মাথায় টোপর, কপালে চন্দন, গলায় বাসি হয়ে আসা ফুলের মালা।…ও কি পবন? নাঃ, স্পষ্ট কোন অবয়ব মনে আনতে পারে না কালী। তার ভাসা ভাসা ছায়া ছায়া কে যেন! টোপরের নীচে তার শুধু ললাটটুকু দেখতে পাওয়া যায়। মুখটা নয়।

পবন হলে তো স্পষ্টই হয়ে উঠত।

কত কত যুগ যেন পার হয়ে গেল। দূরে দূরে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। কালী ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ঝাঁপটা ঠেলছে কে?

কালী দা’খানা বাগিয়ে ধরল, আর তখন বাবার গলার শব্দ পেল, ‘কালী, ঘুমিয়ে পড়লি না কি?’

হঠাৎ রাগে মাথা গরম হয়ে গেল কালীর।

ঝাঁপের দড়ির গিঁট খুলে ঝপাৎ করে ঝাঁপটা খুলে ধরে বলে ওঠে, ‘কালী, একেবারে সেই শেষ ঘুম ঘুমোবে বাবা, তার আগে তার ঘুমের রাইট নেই।’

হ্যাঁ, ‘রাইট’, ‘ফাইট’, ‘টাইম’, এরকম কিছু কিছু কথা শিখে ফেলেছে কালী এবং উপযুক্ত জায়গায় লাগাতেও শিখেছে।

ব্রজ কিন্তু এ রাগে রেগে উঠল না, বলল না, সমস্তটা দিন তেতে—পুড়ে এলাম, এখন ভাল নৈবিদ্যি সাজালি কালী! না, বলল না, আজ ব্রজর সর্বাঙ্গ দিয়েই যেন খুশী উপচে পড়ছে। ব্রজ ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে বলে, ‘ওঃ শীতটা জব্বর পড়েছে।’ তারপর হাত বাড়িয়ে শালপাতা চাপা একটা বেশ বড়সড় মাটির খুরি মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘নে ধর। শিউড়ির সবচেয়ে নামকরা দোকানের ল্যাংচা। এখনই খা দুটো।’

কালী বলে, ‘কী বাবা, হঠাৎ তালুক—মুলুক পেলে না কী; একেবারে এক কিলো ভাঁড় ভর্তি করে ল্যাংচা এনে হাজির করলে!’

ব্রজর মুখে অপরিসীম একটি লাবণ্যের ছটা।

ব্রজ গায়ের চাদরটা খুলে দেয়ালে টাঙানো দড়িতে রেখে উৎফুল্ল গলায় বলে, ‘হুঁ! ব্রজ কয়াল নইলে আর কে এক কিলো ল্যাংচা কিনবে! মুফতের ব্যাপার রে। এই যে আরো আছে—’ বলে ব্রজ হাতকাটা শার্টের পকেট থেকে মিঠে পানের দোনা বার করে বলে, ‘নে খা! বাবার খাওয়া হয়ে গেছে। পেট ভরে খেয়ে এসেছি। রুটি—মাংস, মিষ্টি। তুই খেয়ে নে। খেতে খেতে তোর জন্যে এত মন কেমন করছিল!’

বাবা ভালমত খেয়ে এসেছে শুনে কালীর মেজাজের পারাটা একটু নামে, তবে ঝঙ্কারটা ছাড়ে না। ‘হঠাৎ কি ভগবানের বর পেলে বাবা? তাই এত সব স্বপ্ন কথা!’

ব্রজ মিটি মিটি হাসে। ‘তা শুনলে তাজ্জবই হবি, কিন্তু তার আগে তুই খেতে বোস মা। আমার জন্যে বসেছিলি তো? তোর তো ওই—’

কালী কিন্তু বাবার এই স্নেহ—সহানুভূতির মান—টান রাখে না। অনায়াসে বলে, ‘তোমার জন্যি বসে থাকতে আমার দায় পড়েছে। খিদে ছিল না, তাই খাইনি।’

ব্রজ হেসে ফেলে বলে, ‘তা এখন তো হয়েছে খিদে, বোস। দুটো মিষ্টি নিয়ে বোস।’

কালী বাবার অনুজ্ঞা পালন করে না, একটা মিষ্টি নিয়ে বসে। ব্রজ অসন্তুষ্ট গলায় বলে, ‘ওইতো তোর দোষ কালী! নিজে কিছু খাবি না, কেবল বাপের জন্যে তাংড়াবি। অপরে দিয়েছে, তাও খাবি না প্রাণ ধরে?’

কালী বলে, ‘খাব বাবা, খাব। কাল খাব। এখন বলতো শুনি হঠাৎ এমন রাজ্যপদ জুটল কী সুবাদে। কে ভাঁড় ভর্তি মিষ্টি দিল, কে পেট ভরে রুটি—মাংস খাওয়াল—’

ব্রজ অবশ্য সহজে বলে ফেলবে না।

আজকের ঘটনাটা তার জীবনে রীতিমত একটা ঘটনা। তাই একটু কেশে একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে, ‘অকস্মাৎ এক দেলদরিয়া মানুষের দেখা পেয়ে গেলাম রে কালী! বাসে আমার পাশে বসল একজন, গা থেকে আতর আতর খোসবু বেরোচ্ছে, ফর্সা ধুতি পাঞ্জাবী উড়নি পরা, চোখ—মুখ খাশা, ভদ্দরলোকের মত হাবভাব। আমার তো বাতিক, কথা না কয়ে থাকতে পারি নে। বলে ফেললাম, ‘আপনার আতরের খোসবুটা খুব জোর।’ শুনে হাসল, বলল, ‘আতর নয়, বিলিতি এসেন্স। এক জায়গায় গাওনা করতে গেছলাম, তারা খুব ছিটোল। পয়সাওলা লোকতো।’ গাওনা করতে গেছল শুনে আমি তো পেয়ে বসেছি, কোথায়, কী বিত্তান্ত, কিসের গাওনা? কোথাকার লোক, এইসব—’

কালী রেগে উঠে বলে, ‘আমার চোখ ছাড়া হলেই তোমার এই সব গাঁইয়াপনা আরো বাড়ে বাবা! লোকের কথায় তোমার এত কী দরকার?’

ব্রজ মৃদু হেসে বলে, ‘আরে বাবা দরকার কি অমনি হয়? কোথাকার লোক জানিস? আমাদের খণ্ডখোলার।’

ব্রজ যেন দাবার একটা কিস্তি দিল। এইভাবে আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে একটু থামে।

এতক্ষণে কালীর চৈতন্যে ঘা দিতে সমর্থ হয় ব্রজ। কালী বলে, ‘খণ্ডখোলা! সে লোক আবার এখানে কী করতে? আমাদের মত বানভাসি তো নয়!’

ব্রজ বলে, ‘পাগল! তিনপুরুষ ওরা এই শিউড়িতে! ঠাকুদ্দার মস্ত ব্যবসা ছিল। বাপের আমলেও রমরমা ছিল, তবে এর অন্য মন। আছে, দোকান—পশার আছে সবই, ব্যবসাও আছে, তবে ওই নিয়েই থাকতে পারে না, ‘কেত্তন’ গায়।’

কালী কেমন যেন অস্ফুট গলায় বলে, ‘কেত্তন গায়?’

কালীর চোখের সামনে একটি মূর্তি ভেসে ওঠে, ফর্সা ধুতি পাঞ্জাবী উড়নি পরা, গলায় ফুলের মালা, গায়ে বিলিতি এসেন্সের খোসবাই। কেত্তন গাইছে আসরের মাঝখানে। হাবভাব ভদ্রলোকের মত। সেই লোকের সঙ্গে আলাপ হল। আবার সেই লোক বাবার দেশের লোক।

কালীকে বাবা সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কালী যেতে চায়নি। বলেছিল, ‘যারা তোমায় কাজে পাঠাচ্ছে, তারা তোমারই ভাড়া দেবে বাবা, তোমার মেয়ের তো দেবে না। শুধু শুধু গ্যাঁট—গচ্চা দেবে কেন?’

এখন মনে হচ্ছে গেলেই হত। সেই লোক ব্রজ কয়ালকে পাত্তা দিল শুধু দেশের লোক শুনে। তাজ্জব বৈকি! শুধুই পাত্তা দেওয়া?

ব্রজ বলে, ‘শিউড়িতে গিয়ে আমি দোকানে—মোকানে খেয়ে নেব শুনে কিছুতে ছাড়ল না। বলল, দেশ—গাঁ কখনো চক্ষে দেখিনি বটে, তবু নাড়ির টান, আপনি আমার দেশের লোক, আর আপনাকে আমি দোকানে খেতে ছেড়ে দেব? আমার ওখানে যেতেই হবে। নাওয়া—খাওয়া করতে হবে।’

ব্রজ হেসে বলে, ‘কথায় বলে যাচা অন্ন কাচা কাপড়, এ ছাড়তে নেই। গেলাম ওর সঙ্গে। কথায় কথায় প্রকাশ হল ওর ঠাকুদ্দা ভুবন নস্করের সঙ্গে আমার বাবা রাধামোহন কয়ালের মাল আমদানী—রপ্তানীর সম্পর্কে বন্ধুত্ব ছিল। সে শুনে তো আরো ব্যস্ত। বাড়ি নিয়ে গিয়ে নাওয়ান—খাওয়ান, আবার এবেলা রুটি—মাংসের ব্যবস্থা! তারপর আসার সময় ওই ল্যাংচার ভাঁড় গুছিয়ে দিল।…জগতে যে এখনো এমন মানুষ আছে, তা জানতুম নারে কালী।’

কালী গম্ভীরভাবে বলে, ‘তা বাড়ির গিন্নীও ভাল বলতে হবে। দুম করে পথ থেকে একটা দেশের লোক কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রাজ আদর, গিন্নী বেজার হল না?’

ব্রজর এবার হাসির পালা।

জোর হাসি হেসে বলে, ‘হায় কপাল! মাথা নেই তার মাথা ব্যথা! কোন ছোটবেলায় বাপ বিয়ে দেছল, সে বৌ ঘর করার আগেই মরে গেছে। তদবধি আর সংসার করেনি। বলে, আমি তো এক বাউণ্ডুলে, কেত্তন গাইছি, আবার লিখছি। দোকান—আড়ত লোকজনেই দেখে, দ্বিতীয়বার সংসার করা আর হয়ে ওঠেনি।…তথাপি বাড়িঘর যেন ঝকমক করছে, মা লক্ষ্মী উথলোনো সংসার! দেখে না কালী ইচ্ছে হচ্ছিল না যে আর ফিরে আসি। ওর দোকানের লোকজনের জন্যে যে মস্ত মস্ত দুখানা ঘর পড়ে আছে, তার আধখানায় আমাদের বাপ—বেটির থাকা হয়ে যায়!’…

কালী হেসে ওঠে, ‘বাবা, দিবা স্বপ্ন দেখছ? তোমার নিজের হয়ে গেলেই হল?’

ব্রজ গম্ভীর গম্ভীর গলায় বলে, ‘হত রে কালী। ওই মানুষ নিজে মুখে বলল, ইস কয়াল মশাই, আপনি যদি তখন ওই খুঁটিগোড়ায় খুঁটি গেড়ে না বসে এই শিউড়ির দিকে চলে আসতেন! আমার গার্জেনের মতন থাকতেন, দোকান—টোকান দেখতেন বর্তে যেতাম আমি। তা ব্রজ কয়ালের কপাল!’

কালীর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এত রাত্তিরে আর থালা ধুতে না বেরিয়ে এক পাশে রেখে দিয়ে হাত—মুখ ধুয়ে নিয়ে, বাবার দেওয়া মিঠে পান একটা হাতে নিয়ে বলে, ‘তা এখনও তো কপাল ফিরতে পারে বাবা! দিক না তোমায় একটা চাকরি, থাকতেও দেবে কোন না—’

ব্রজ গভীর রহস্যময় একটু হেসে বলে, ‘সে আশ্বাসও দিয়েছে রে কালী। বলেছে, আপনি চলে আসুন।…আসবেন একবার শীগগীরই এখানে।’

‘এখানে?’

কালী চোখ কপালে তুলে বলে, ‘এখেনে মানে?’

‘আহা, আসবে নিজের কাজে বোলপুরে, তবে আমাকে বলতে কইতেই আসবে। রাস্তা থেকে রাস্তায় তো আর চাকরীতে নিয়োগ হয় না।’

কালী কাঁথা ঢাকা দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে বলে, ‘হুঁ’! তার মানে এনেকোরি করতে আসবে। লোকটা তুমি সত্যি কিনা, একটা চোর—জোচ্চোর ধাপ্পাবাজ কিনা দেখে নেবে তো!’

ব্রজ শুয়ে পড়েছে। আহত গলায় বলে ওঠে, ‘সে ছেলেকে দেখলে আর অমন সন্দেহের কথা বলতিসনে কালী! উদোমাদা!’

কালী তীক্ষ্ন গলায় বলে, ‘ছেলে আবার কোথা থেকে এল? এই যে বললে আড়তদার—’

ব্রজ উদাস গলায় বলে, ‘বাপ—পিতামোর আড়ত আছে তাই আড়তদার! আমার কাছে ছেলেই। তিরিশের ঘরেই আছে এখনো।’

‘তাই বল, তাই অমন দিলদরিয়া।’ কালী বলে, ‘বয়েস বাড়লেই পাকা ঝানু হয়ে যেত।’

বলেই হেসে ওঠে কালী, ‘তা অবিশ্যি ঠিক নয়। তোমার মতন হলে কোন কালে ও ঝানু হবে না। তা নামটা কী?’

ব্রজ বলে, ‘নামও ভাল, নাম হচ্ছে সুদাম নস্কর। আমাদের বংশের মতন ওদেরও সব বৈষ্ণব নাম।’

কালী বলে ওঠে, ‘তা তোমাদের বংশে সবাইর যদি বোষ্টম নাম তো মেয়ের নাম কালী কেন বাবা?’

ব্রজ আস্তে বলে, ‘এতদিন পরে শুধুলি, তাই বলি। তুই গভ্যে আসার আগে তোর মা স্বপন পেয়েছিল রে! ধড়মড়িয়ে ঘুমের থেকে উঠে এসে বলল, মা কালী এসেছিল ঘরে।…ওই যে ওইখেনে কুলুঙ্গীর কাছে দাঁড়িয়েছিল।’

কালী এযাবৎ কোন দিনই তার নাম—রহস্য জানত না। কালী হঠাৎ যেন কেমন বিহ্বল হয়। নিজেকে যেন রহস্যময় কোন আত্মার অধিকারিণী বলে মনে হয়। কালীর চোখের কোণ দিয়ে অকারণ ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। হয়তো এ অশ্রু আনন্দের।

এইমাত্র কোথায় যেন বড় একটা আশ্বাস পেয়েছে কালী, এই জীবন থেকে মুক্তি পাবার। শিউড়িতে চাকরি হবে বাবার, থাকবার জন্যে কোঠাঘর পাবে, আর এক অদ্ভুত দিলদরিয়া মানুষের আশ্রয় পাবে, সে আড়তদার হলেও এখনো তিরিশের ঘরে বয়েস। যে টাকার মালিক হলেও উদোমাদা বাউণ্ডুলে। ফর্সা ধুতি উড়ুনি পরে গায়ে গন্ধ মেখে বেড়ায়, রাস্তা থেকে লোক ডেকে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে তুলে চব্য—চোষ্য খাওয়ার সঙ্গে মিষ্টির হাঁড়ি দেয়।

হ্যাঁ, এমন একটা লোককে দেখলেও পুণ্যি। কালী যেন সেই পুণ্যির প্রত্যাশাতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না।

ঘুম ব্রজরও আসছে না।

আজকের রোমাঞ্চকর ঘটনার ইতিহাস কালীর কাছে গল্প করলেও, প্রাণ খুলে সবটা বলতে পারেনি, কিছু রেখে—ঢেকে বলেছে।…সেটা বলেছে মেয়ের ভয়ে।…কারণ মেয়ে যে ফস করে কখন জ্বলে ওঠে! শুধু যে একটা চাকরীর ব্যবস্থাই পাকা করে এসেছে ব্রজ তা নয়, আরো একটা ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে এসেছে।…ব্রজ কয়াল পয়সার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পাচ্ছে না, আর ব্রজ কয়ালের মেয়ের বয়স বাইশ পার হয়ে গেছে শুনে সুদাম যেন হাতে চাঁদ পাবার মতন বিগলিত হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, সংসার একটা করা দরকার সেটা মনে—প্রাণে বুঝছি কয়াল মশাই। কারণ ঘরে—সংসারে একটা শক্ত—পোক্ত মেয়েছেলে না থাকলে কুবেরের ভাঁড়ারও উবে যায়। আমাকে তো এই দেখছেন, কিছুর আটক—বাঁধন করতে পারিনি, হঠাৎ হঠাৎ টের পাই মায়ের সংসারের বড় বড় বাসন—পত্তর সব হাওয়া হয়ে গেছে, চাদর—সতরঞ্জির প্যাঁটরা শূন্য। মানে, মাঝে মাঝে বাড়িতে একটু আসর—টাসর বসাই, পাঁচজন খায়—দায়, তাই ওসবের সন্ধান পড়ে।…আরো কত দিকে কত ছিল জানিই না। তাই মনে হচ্ছে, এমন লক্ষ্মীছাড়া হয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না।

তারপরই কথায় কথায় বোলপুরে কাজে আসার ছুতোয় ব্রজ কয়ালের মেয়েকে দেখতে আসার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল।

সাহস করে এই অলৌকিক আনন্দের খবরটা মেয়েকে বলতে পারেনি ব্রজ, কিন্তু না বলেও ঘুম হবে না। কথা চাপা তার ধাতে নেই। তবু ব্রজ মনে মনে দিব্যি গেলেছে, একথা সে এখন কারো কাছেই ফাঁস করবে না।

ছেলেটার কথাও কী মিষ্টি!

বলে কিনা ‘যেখানেই যান আর যত সুখের দেশই দেখুন আপনি কয়াল মশাই, ভিটে গাঁয়ের নামটা শুনলেই মনটা ধ্বক করে উঠবে। আমি তো ভাল করে চোখেও দেখিনি, কোন শৈশবে গেছি ঠাকুর্দার সঙ্গে, কিন্তু যেই বললেন আপনি খণ্ডখোলার লোক, অমনি মনে হল যেন চিরকালের আপন।’ একথা যে ব্রজরই মনের কথা।

সামনেই মেয়ের বিয়ে, কুসুমের সকল কাজ একা হাতে। তাই তলে তলে সব সারছে। কড়া শীত আর কড়া রোদ থাকতে থাকতে বাড়ির পর্ব মিটিয়ে ফেলেছে, এখন সুপুরি কাটতে বসেছে। অবিশ্যি ঘরে লোক না থাকলেও পাড়ায় কি আর মেয়েছেলে নেই? আছে, ডাকলে এসে কাজ—কর্ম তুলেও দিয়ে যায়। কিন্তু কুসুমবালার পাড়াসুদ্ধু সকলের সঙ্গেই ঝগড়া, ডাকতে যাবে কোন মুখে।

তাছাড়া ডাকতে চায়ও না। কাউকে বিশ্বাস নেই ওর। কে বলতে পারে বড়ি দিতে বসে হাত সাফাই করে খানিকটা ডাল বাটা হাতিয়ে ফেলল, কি সুপুরি কাটতে বসে পেট কাপড়ে চারটি কাটা সুপুরিই বেঁধে নিল। তার থেকে মরে মরে নিজে করাই ভাল।

কেটে কেটে স্তূপ দিয়েছে, পবন এসে কাছে বসল। মায়া—মমতা মাখানো গলায় বলল, ‘এই বাস, সেই তখন থেকে এখনো অবদি সুপুরি কাটছ তুমি? দাও, অস্তরখানা আমায় দাও, আমি চারটি কেটে দিই।’

দেওরের এমন মমতার কণ্ঠে কুসুম বোধহয় একটু খুশী হয়। মাড়ি বার করে হেসে উঠে বলে, ‘হ্যাঁ, তুমি নিলে আর সুপুরি কুচোবে কে?’

‘আরে বাবা অস্তরটা আমার দাওই না।’

কুসুম বলে, ‘ক্ষ্যাপার মতন কতা! এ কম্ম কি মদ্দ পুরুষের নাকি? ধান কাটতে পার বলেই বুঝি সুপুরি কাটতে পারবে? হ্যাঁ, তোমার একটা বৌ থাকত তো তাকে ঘাড়ে ধরে খাটিয়ে নিতাম।’

শুনে পবনের বুকের মধ্যেটা উথলে ওঠে। আহা! মেঘ না চাইতেই জল!

যে প্রসঙ্গ তোলবার জন্যে কাঠখড় পোড়াতে আসা, সে প্রসঙ্গ আপনিই উঠে পড়ল। সুযোগকে হাত বাড়িয়ে লুফে নিল পবন। বলে উঠল, ‘তা এনেই নাও না তেমন একটা চাকরানী। তোমার খাটুনীগুলো খেটে দেবে।’

ও তাই। কুসুমের আর বুঝতে বাকি রইল না, হঠাৎ দেওরের বৌদির ওপর এত দরদ উথলে উঠল কেন। ভাইঝির বিয়ের জোগাড়—যন্তর দেখে কাকার অন্তর খাঁ খাঁ করে উঠছে। এমন মাড়ি চেপে হেসে বলল, ‘তাই বল। আসল কতায় এসো। তা চাকরানী হবে কি আমার ওপর মহারাণী হয়ে উঠবে, ‘গেরাণ্টি’ আছে?’

পবন মহোৎসাহে বলে, ‘ইস! মহারাণী অমনি হলেই হল, তোমার ঠোনা নেই?’

‘হুঁ! বে করার বাসনা হয়েছে।’ কুসুম বলে, ‘তা বে বললেই তো বে হয় না, পাত্তির দেখতে হবে তো—’

পবন ঘাড় চুলকে বলে, ‘তা সে ঘর দেখা হয়েই আছে!’

‘অ!’

কুসুম হাতের জাঁতি থামিয়ে হাতের বদলে সেটাকেই গালে ঠেকিয়ে বলে, ‘ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে? বলি কোতায় দেখলে পাত্তির? তোমার স্যাঙাতের বোন ওই ড্যাবা চোখি দুগগাটি বুঝি?’

আবার পবনের হাতের মধ্যে কথার খেই এসে জোটে। পবন ঘাড় গুঁজেই মুচকি হেসে বলে, ‘দুগগা নয়, সাক্ষেৎ কালী। ওই যে ওই রেল লাইনের ওপারে—ব্রজ কয়াল আছে না?’ ঢোক গিলে বলে, ‘তার মেয়ে কালী। দেখেছ তো? এয়েছিল একদিন—।’

কথা শেষ করতে হয় না, কুসুম জাঁতি ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে একপাক ঘুরে বলে, ‘অ্যাঁ, কী বললে ঠাউরপো? কী বললে তুমি? ওই ঝুপড়িতে থাকা বানভাসিদের খাণ্ডার মেয়েটা? ওই তোমার পাত্তির? ওমা, আমি কোতায় যাব গো, শুনে যে আমার গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছে গো, আমার আপিং খেতে ইচ্ছে করছে গো—’

কুসুমের পায়ের দাপটে কুচনো সুপুরি ছিটকে ছড়াছড়ি যায়।

ব্যাপারটা এমন দুরন্ত নাটকীয় হয়ে উঠবে, তা ভাবেনি পবন। তবে বোকা গোঁয়ার হলেও এটা বুঝতে বাকি থাকে না তার, এই নাটকটি বৌদির ইচ্ছাকৃত। পবনের প্রস্তাবটা যে কত অযৌক্তিক, সেটা প্রতিপন্ন করতেই এত আয়োজন।

কিন্তু আপাততঃ তো নাটক থামাতে হবে।

কুসুমের আক্ষেপ ধ্বনিতে ছুটে এসেছে কমলি এবং তার ছোট ভাই গোপাল। কমলির আশঙ্কা হয়, নির্ঘাৎ সেই বরের বাড়ি থেকে কোন দুঃসংবাদ এসেছে। কমলি কাঁটা হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং গোপাল তারস্বরে কেঁদে ওঠে।

পবন ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘তা অত অমনই বা করছ কেন? বানভাসি তো কি পতিত হয়ে গেছে? আজ যদি আমাদের এখানে বান এসে তোমার সর্বস্ব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তোমাকেও বানভাসি হতে হবে। ঝুপড়িতে থাকতে হবে—’

এই যুক্তি—বাণীতে কুসুম আরো নেচে ওঠে, ‘ওমা! ইকী অলুক্ষুণে কতা গো! তোমার পছন্দর মেয়ের সঙ্গে বে হবে না বলে তুমি আমায় শাঁপমুণ্যি দিচ্ছ! ওমা, ওই সেপাইয়ের মতন মেয়েটাকে তোমার এমন পছন্দ হল যে, জ্ঞান—গম্যি হারাচ্ছ? বলি, ও মেয়ের বয়েসের ঠিক আছে না জাতের ঠিক আছে? কোতা থেকে না কোতা থেকে এসে—’

‘এই, খবরদার!’ গোঁয়ার পবন ফুঁসে উঠে বলে, ‘জাত ফাত তুলবে না বলছি। ভাল হবে না।’

‘কী! ভাল হবে না?’

এরপর কুসুম আর মাটিতে থাকে না, শূন্যেই পাক খায়, ‘আমায় তুমি ভাল হবে না দেখাতে এয়েছ? এখনো তোমার দাদা বেঁচে না? শ্যাঁকা—সিঁদুর ঘোচানো বেধবা ভাজ আমি তোমার? তাই ‘খবরদর’ বলতে এয়েচ! ওনার পরিবার এসে আমার চাকরাণী হবে! আরো কত শুনব! বে হয় নাই এখনো, তাই কান ভাঙিয়ে গুরুজনকে অপমান্যি করতে শেকাচ্চে, বে হয়ে এলে ওই রক্ষেকালী সিংঘবায়িনী হয়ে উঠবে না?’

কুসুম কপাল চাপড়ায়, আর নতুন নতুন কথার জোগান দেয়, ‘কী দেকে ওই দস্যিকে তোমার পছন্দ হল ঠাউরপো? নিঘঘাত ও তোমায় গুণতুক করেচে। ওই মেয়ে বৌ হয়ে এলে সোমসারে আর মা নক্কী দাঁড়াবেন? চার পা তুলে নেত্য করবেন না?’

‘তুমি থামবে?’ পবন বলে, ‘এসে তোমাদের ঘরে ঢুকবে না, হল? তবে ওই মেয়েকেই আমি বিয়ে করব, এই আমার সাফ কথা। আমি চলে যাব।’

‘অ্যাঁ! কুসুম আবার নতুন করে মূর্ছা যায়। ‘বে হবার আগেই তুমি ভেন্ন হবার কতা চিন্তা করচ ঠাউরপো? একবার খ্যাল করচ না, তোমার দাদার তুমিই ডান হাত! ওঁর আর কেউ নাই। ওমা, কী ডাকিনী মন্তর দিল গো তোমায় যে তোমার পেরাণতুল্য দাদাকে তুমি ভুললে!’

‘ঠিক আছে, তুমি চেঁচিয়ে মর—।’ বলে দাওয়া থেকে নেমে চলে যায় পবন, নাটকের এই মোক্ষম দৃশ্যে পবনের দাদা নবীনের রঙ্গস্থলে আবির্ভাব।

দূর থেকেই কুসুমের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল সে, তবে তাকে এমন গুরুত্ব দেয়নি। কুসুমের কণ্ঠনিনাদ তার কানে অভ্যস্ত। গোপাল আঁস্তাকুড় ছুঁয়ে এলেও কুসুম ওইভাবেই চেঁচায়।

কিন্তু এখন কুসুম শুধু চেঁচাচ্ছে না, নাচছে ও।

এটা গুরুতরের চিহ্ন। পড়শিনীদের সঙ্গে কোঁদল হলে এমন নাচে কুসুম কখনো কখনো।

সামনে গমনোদ্যত ভাইকে দেখে নবীন বলে, ‘হল কী?’ বলে হাতের কাস্তে খোন্তা নামায়।

তবে নবীনের গলায় উদ্বেগ—টুদ্বেগ ফোটেনা।

পবন দাদার এই আত্মস্থ ভাব দেখে নিজেও আত্মস্থ হয়। বলে, ‘যে চেঁচাচ্ছে তাকেই শুধাও।’

নবীন তাকে শুধায় না, কমলির দিকে তাকায়। কমলি হাত উল্টে মাথা নাড়ে। ততক্ষণে কুসুম নিজেই বলে, ‘তা তোমার নিজে মুকে বলতিই বা কী বাদা ঠাউরপো? বল! দাদার মুকের ওপরই বল? একন মুকে কতা নেই কেন?’

পবন ঘাড় তুলে বলে, ‘কথা আবার থাকবে না ক্যানো? খুন করেছি না ডাকাতি করেছি?’

কুসুম আর একবার কপাল চাপড়ে বলে, ‘তার থেকে কিছু কমও করনি। …শুনবে ঘেন্নার কতা? তোমার সোয়াগের ভাই ওই বানভাসি বেরজোর সেই দজ্জাল মেয়েটাকে বে করবার জন্যি ক্ষেপেচে। ওকে বে করবে, তোমার সঙ্গে ভেন্ন হবে, পরিবার নিয়ে আলাদা বাসা করবে—’

পবন এখন ক্ষেপে যায়, বলে, ‘বাজে বাজে কথা বলবে না বলছি। এসব আমি বলেছি?’

‘বলনি? নাক ঘুরিয়ে কান দেকাওনি? আমায় ‘খবদ্দার’ বলনি? ‘ভাল হবে না’ বলনি?’

‘বলেছি বলেছি বলেছি—’ পবন আগুন ঝরা গলায় বলে, ‘আরো যা যা বলতে চাও বল। সবই আমি বলেছি বলে মেনে নিচ্ছি। তবে হ্যাঁ, ভয় আমি কাউকে পাই না। ওই ব্রজ কয়ালের মেয়েকেই আমি বিয়ে করব, ব্যস।’

ভাই আর বৌ এই দুই আগুনের মধ্যিখানে শীতল জলের মত, শান্ত গলায় নবীন বলে, ‘তা ওই ব্রজ কি আমাদের স্ব—ঘর?’

পবন গোঁজ হয়ে বলে, ‘ওসব ঘর—ফর আমি বুঝিনা—’

‘আহা তুই না হয় না বুঝলি, আমায় তো বুঝতে হবে? সমাজকেও বোঝাতে হবে।’

পবনের সর্বাঙ্গের শিরা—বাহিত রক্ত এখন মাথায়। পবন সেই অবস্থার উপযুক্ত সুরেই বলে, ‘আমি তোমাদের সমাজ—ফমাজের ধার ধারি না। ওর সঙ্গে বিয়ে হবে। তাতে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাও, দেবে। আমি এই বলতে যাচ্ছি—’

‘বরফ মগজ’ নবীন সাবধানে বলে, ‘তা কমলির বেটা পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতেই হবে ভাই! নইলে মেয়ের বে’তে ব্যাগড়া পড়তে পারে।’

এখন পবন লজ্জিত হয়।

নরম গলায় বলে, ‘আমি তো এমন কথা বলিনি, অপেক্ষা সইছে না!’

ততক্ষণে কমলি বাপের হাতে তামাক ধরিয়ে দিয়ে গেছে। নবীন তাতে একটা টান দিয়ে বলে, ‘কী যে তুই বলেছিস, আর না বলেছিস, তুই—ই জানিস, আর তোর বৌদিই জানে, তবু আমি বলছি কমলির বেটা সুশৃংখলে হয়ে যাক।’

পবন এরপর ধীরে ধীরে চলে যায়। কিন্তু তার পিঠের উপর আবার এক বোমা পড়ে, ‘আগে পিছে জানি না, ওই কালী এসে এ ভিটেয় ঢুকলে, আমি সঙ্গে সঙ্গে বেইরে যাব! একনো মা—বাপ বেঁচে আছে কুসুমের।’

পবন আবার ফিরে দাঁড়ায়, গম্ভীর গলায় বলে, ‘তুমি সংসারের গিন্নী, তুমি যেতে যাবে কেন? যে যাবার সে যাবে। বাড়তি কেউ ঢুকতে আসবে না তোমার পুণ্যির বাড়িতে।’

নবীন হাঁ হাঁ করে, না, না ভাই, না পরিবার, কাউকেই সান্ত্বনা বাক্য শোনায় না, নিজের মনে তামাক খেতে থাকে। জানে, রক্ত ঠাণ্ডা হলে যে যার কাজে ঠিকই লাগবে। রক্ত—চড়াদের চড়ে যাওয়া রক্ত ঠাণ্ডা হতে সময় দিতে হয়। সান্ত্বনা দিতে গেলে আরো চড়ে।

এরপর নবীন তেল ডলে ডলে চান করবে, কমলিকে ডেকে বলবে, ‘কমলি, পারিস তো ভাত কটা ঢেলে দে, পেটে পুরে নিই। দিনমান তো পুইয়ে এল।’

দুই ভাই সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির।

পবন যদি দাদার মত হতে পারত, এমন সব পণ্ড করে বসত না। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ গুছিয়ে নিত। কিন্তু পবন বৌদির ওই কিম্ভূত ব্যবহারে মাথা ঠিক রাখতে পারল না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

গেল তো গেলই।

অকারণ হন হন করে খানিকটা হেঁটে বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে একটা গাছতলায় বসল পবন। মাঘের শেষ, বেলা পড়লে হাড় কাঁপায়, কিন্তু দুপুর রোদ্দুরে হাঁটলে, রোদ পোহালে ঘাম ছোটায়। পবন তো আবার তার ওপর নিজের মধ্যেই অগ্নিকুণ্ড বহন করে এনেছে।

ধুতি পরার একটা সুখ, কোঁচার কাপড়ে হেন কাজ নেই যা না করা যায়। মুখ মোছা থেকে জুতো মোছা, বাজার বওয়া থেকে গলায় ফাঁস লাগানো পর্যন্ত সব, সব কিছু।

পায়জামায় কোন সুবিধে নেই, একমাত্র লজ্জা নিবারণ ছাড়া। কিন্তু পবনের আজকের লজ্জা? সেটা নিবারণ হতে পারত পরণে ধুতি থাকলে। ওই উঁচু ডালটার ফেঁকড়াতে লাগিয়ে ঝুলে পড়ত পবন। কিন্তু সে তো দূরের কথা, এখন ঘাড় গলার চামটুকু মোছারও উপায় নেই।

ঘামতে ঘামতেই ভাবে পবন, এই মুখ এখন কালীকে দেখাব কি করে আমি? গিয়ে কি বলে উঠতে পারব, ‘কালী, তুই ঠিক বলে ছিলিস, ওরা রাজী হবে না। জানিনে দাদা হত কিনা, তবে ওই কুসুমবালা? নাঃ। তা’ছাড়া ভেবে দেখলাম সত্যিই ওর সঙ্গে ঘর করতে তুই পারবি না। করা অসম্ভব।’

না, এখনকার মাথায় এ কথা ভাবতেই পারছে না পবন। ইচ্ছে হচ্ছে বিবাগী হয়ে চলে যায়। যেখানে দু’চক্ষু যায়।

কিন্তু কালীকে একবার জানিয়ে না গেলে? ওকে না বলে চলে গেলে, ফিরে আসার পরই কি আর মুখ দেখবে আমার?

বড় দোটানায় পড়ে পবন। আবার গিয়ে সেই বাড়িতে ঢোকা, সেই কুসুমবালার হাতের রান্না খাওয়া, এর চাইতে ঘৃণ্য কী আছে?

হঠাৎ একবার মনের মধ্যে আর এক বীরপুরুষ জেগে উঠল পবনের।… তাই বা ভাবছি কেন? বাড়ি কি ওর? আমার বাবার বাড়ি নয়? ওর আর আমার সমান ভাগ নেই? আমি যদি বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে জোর করে ঘরে তুলি, ওর কিছু করবার আইন আছে?…ভেবে হঠাৎ বেশ ভাল লাগল। ঠিক হয়, উপযুক্ত উচিত জব্দ হয়ে যায় কুসুমবালা! কুকুরের উপযুক্ত মুগুর হয়। কালীর কাছে আর পারতে হবে না। এতটুকু না চেঁচিয়েও কালী ওকে ঠিক করে ফেলতে পারবে।

যত ভাবে ততই তার অনুকূলে চিন্তাটা প্রবাহিত হয়। যেন একটা যুদ্ধে নামা ভাব হয়। ক্রমশঃ কালীর কাছে মুখ দেখানোর লজ্জাটা কেটে যায় যেন। কীভাবে না বলে—কয়ে বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে বৌকে বাড়িতে ঢুকিয়ে ফেলবে, সেই পরিকল্পনায় উৎসাহী হয়ে ওঠে। এবং এই দণ্ডেই কালীকে জানাতে যেতে ইচ্ছে করে।

কিন্তু কে জানে, এই রোদের দুপুরে ব্রজরাজ আরামে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুম দিচ্ছেন কিনা। বেলা পড়ুক।

বেলা পড়েছে, এদিকে পিত্তিও পড়ছে, পেটের মধ্যে যেন জ্বালা করতে থাকে পবনের। আর এতকাল পরে, যে মাকে জ্ঞানে কখনো চোখে দেখেনি, সেই মায়ের জন্যে চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে তার। মা থাকলে কি পবনের এমন দুরবস্থা হত? পবনকে কি দাদা—বৌদির দয়ার কাঙাল হয়ে থাকতে হত? এমন কি মনে হত, পবনের কোন কিছুতেই অধিকার নেই, পবন ফালতু! কমলি গোপালের যে রাইট আছে সব বিষয়ে পবনের তার কিছুই নেই।

পবন একটা দার্শনিক চিন্তায় উদাস হয়।

পুরুষ বেটাছেলে তো নাঙ্গা ফকির, তার স্বার্থ হয় মা দেখে নয় বৌ দেখে, তা ব্যতীত কেউ না। কোঁচার অভাবে পবন হাঁটুতে চোখ ঘষে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল আর বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যে হয় হয়, তখন নবীন আশপাশের অনেক দিক ঘুরে আবার বাড়ি ফিরে কুসুমকে উদ্দেশ করে জিগ্যেস করে বলে, ‘ফেরেনি?’

কুসুম মুখ বাঁকিয়ে বলে; ‘ফেরেনি, সে তো দেখতেই পাচ্ছো। ঘরের কোণে লুকিয়ে তো রাখিনি।’

কি যে হয়, চিরস্থির নবীন হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে! চেঁচিয়ে উঠে বলে, ‘চুপ কর অলক্ষ্মী। তোর জন্যে আমার সব গেল। পাড়ায় আমার মান—ইজ্জত নেই, সংসারে আমার শান্তি নেই, ভাইটা ছিল, সেটাকে দূর করলি?’

বরের কাছে ধমক বড় খায় না কুসুম, তাই মনে মনে একটু ভয় পায়, তবু মুখে টনকো হয়ে বলে, ‘আমি দূর করলাম?’

‘করলিই তো, করলি না?’

হঠাৎ কোঁচার খুঁটটা তুলে চোখে দিয়ে বলে, ‘ভর দুপুরে খিদের সময়, একটা সামান্য কথা নিয়ে তুই যাত্রা—থেটার করলি, নাচন—কোঁদন করলি। বলি তার একটা মান—সম্মান নেই?’

কুসুম এখন আর রেগে না উঠে বেজার গলায় বলে, ‘কতাটা সামান্যি হল? তোমার ভাই ওই বেরজোর মেয়েটাকে বে করবার বায়না করবে, সেটাই মানতে হবে?’

হয়তো, কথাটা মেনে নেবার মত কিনা একথা নবীনও ভাবতো, কিন্তু নবীনের চোখের কূলে কূলে জল।

যত ভাবছে, সে নিজে খেয়ে—দেয়ে ঘুমিয়ে উঠেছে, আর পবনের ভাতটা বাড়া পড়ে আছে, রাগ দুঃখু করে কোথায় কোথায় ঘুরছে ছেলেটা, ততই আবেগ উথলে উঠছে। তাই নবীন খপ করে একটা বণ্ড লিখে বসে। পবনা যে খিদে সহ্য করতে পারে না একথা নবীনের মত আর কে জানে?

মা—মরা পবনকে টেনে তুলেছিল কে?

নবীনেরও আজ মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। তাই বৌয়ের নাকে ঝামা দেওয়ার ভঙ্গীতে মুখের ওপর চড়া গলায় বলে, হ্যাঁ হবে মানতে। ওর যাকে খুশী বিয়ে করবে। বাড়ি ওর বাপের বৈ তোর বাপের নয়, তুই বিচার করবার কে? বাড়টা তোর বড্ড বেড়েছে। ওই বেরজোর মেয়ের মতন একটা জা আসা তোর দরকার। তবে যদি জব্দ হোস। এই বলে দিলাম ওই মেয়েটাকেই পবনের বৌ করে ঘরে আনব।

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল! যেন আকাশ বাতাসকে সাক্ষী রাখল। আর বুঝি বা নিজেকে প্রতিজ্ঞা—পত্রে সই করাল।

বলতেই হবে পবনের পক্ষে শাপে বর হল কুসুমবালার বিদঘুটে ব্যবহারটা।

কিন্তু কোথায় সে হতভাগা?

যাকে দেখলে দাদা এখন হাত ধরে ভাত খাওয়াতে বসে। আজ বাদে কাল কমলির বিয়ে, পবন বিহনে সে বিয়ে কি বিষতুল্য হবে না নবীনের কাছে?

না, পবন এ পরিস্থিতির খবর শোনে না, পবন ইষ্টিশানের ধারে একটা চেনা চায়ের দোকানে ধারে একটু চা—বিস্কুট খেয়ে, কথঞ্চিৎ শান্ত হয়ে বসে ভাবতে থাকে, টাকা—পয়সার বড় দরকার। বিবাগী হয়ে চলে যেতে হলেও পকেটে টাকা থাকা দরকার। এবং বেঁচে থাকতে হলে জিনিসটার নিয়মিত জোগানের দরকার।

কিন্তু পবনের মত লোকের হাতে হঠাৎ টাকা আসতে পারে কী করে, পকেটমারা অথবা ট্রেনে উঠে ছিনতাই করা ছাড়া। এই ব্যবসাটাই আজকাল খুব চালু ব্যবসা হয়ে উঠেছে।…কিন্তু পবন কি জানে ওর পথঘাট কি?

দিন যাচ্ছে একটা দুটো করে।

ব্রজ ব্যস্ত হয়ে আছে, কবে সেই সুদাম নস্কর ব্রজর মেয়েকে দেখতে আসে।

ঠিক করে রেখেছে, এই ঝুপড়ির মধ্যে দেখানো নয়। তাছাড়া লোক জানাজানির ভয়, কে কিভাবে ভাংচি দেবে। খবর পেলে মেয়েকেই ব্রজ বোলপুরে নিয়ে যাবে সিনেমা দেখানোর ছুতো করে।

কালী এত কথা জানে না, তাই কালী বিদ্রূপ করে, ‘কী বাবা, তোমার দেশের লোকের কী হল? খুব তো এল। খুব তো চাকরী দিল।’

ব্রজর মুখ শুকিয়ে যায়। ভাবে; মানুষ কি এমন অদ্ভুত উল্টো—পাল্টা হতে পারে?

বাপের চিন্তার অংশীদার হয়ে কালীও ক’দিন ঘোরে আছে। কালী অহরহ বাবার চাকরির কথা ভাবছে আর এই ঝুপড়ির বাসা ছাড়ার কথা ভাবছে।

হঠাৎ খেয়াল হল, পবনটা ক’দিন আসেনি।

ক’দিন? তা ছ’সাত দিন হয়ে গেল। দুদিন ধরে বাবাকে না জানিয়ে সেই ল্যাংচা তুলে রেখেছিল দুটো, যদি আসে বলে। এল না। তারপরই যেন দিনগুলো কোথা দিয়ে কেটে গেল। আজ মনে হল সেই যেদিন বীরদর্পে চলে গেল, বাড়িতে রাজী করাবে বলে, তদবধি আর আসেনি।

কী হল? ওই নিয়ে বচসা করে বাড়িছাড়া হল নাকি? পবনের হাড়হদ্দ জেনে নিয়েছে বলেই চট করে ওই কথাই মনে এল। আবার ভাবল, নাঃ বোধহয় ভাইঝির বিয়ের কাজে ব্যস্ত আছে।

চাষীর ঘরের কাজ, এখন হয়তো কাঠই কেটে রাখতে হবে দু’গাড়ি।

কালীর যে আজকাল কী হয়েছে! এক কথা ভাবতে বসে অন্য কথায় যায়। পবনের ভাইঝির বিয়ের কথা ভাবতে গিয়ে ব্রজ কয়ালের মেয়ের বিয়ের কথা। ব্রজ কয়ালের কে আছে যে তার মেয়ের বিয়েয় খাটবে? যতই ঘটা না থাক, জন্ম—মৃত্যু—বিয়ে, তিনটে ব্যাপারে কিছু খাটুনি, অর্থব্যয় আছেই। ঘটা না থাকলেও ল্যাঠা আছে। ব্রজ কয়ালের না আছে লোকবল, না আছে অর্থবল। বলের মধ্যে তো দজ্জাল মেয়েটা, তা সে যদি কনে সেজে বসে—

কনে সাজা ভাবতে গিয়ে কালী যেন শূন্যে হোঁচট খায়।

কোথায় বসেছে কালী কনে সেজে? কে সাজিয়ে দিয়েছে?

আশপাশের ঝুপড়িতে যারা থাকে তারা তো ঠিক কালীদের মত নয়। তারা অবাঙালী রেলের কুলি ফ্যামিলি। বাবার চেনা—জানার মধ্যে মালবাবু আর ডাক্তারবাবু। হয়তো বাবা তাদেরই শরণাপন্ন হবে।

কিন্তু বাবা কি তাদের স্বরূপ চেনে?

তারা কালীর বিয়ের সহযোগিতা করতে আসবে? ব্রজ কয়ালের চোখে পৃথিবীর যে চেহারা, সত্যি তো আর তেমন নয় পৃথিবী!…এই যে বাবার দেশের লোক—

শীত শেষের পড়ন্ত রোদে পিঠ দিয়ে কালী বাবার কাঁথাখানা একটা পুরনো কাপড় বসিয়ে সেলাই করছিল, আর ভাবছিল বাবা এখনো মানুষ চিনতে শেখেনি, হঠাৎ দেশের লোক দেখে একটু আদিখ্যেতা করছে বলে সে অমনি ব্রজ কয়ালের মত একটা তুচ্ছ লোককে মনে রাখবে? চাকরি নিয়ে বসে থাকবে?

যার পাকা বড় বাড়ি, দোকান আড়ত, ব্যবসা। যে খাতা ভরে ভরে কবি গান লেখে। ব্রজরা তাদের মত লোকের কাছে কী? কালী কিনা সেই মানুষকে দেখবার আশায়—

হঠাৎ যেন কালীর সামনে বাজ পড়ে।

বাবা প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে বলে, ‘সর্বনাশ হয়েছে রে কালী, সে এসে হাজির!’ কার আসার সঙ্গে সর্বনাশের সম্পর্ক আছে বুঝতে পারে না কালী। শুধু কোল থেকে কাঁথাখানা গুটিয়ে ঝুপড়ির মধ্যে নিক্ষেপ করে বলে ফেলে, ‘কে, পবন?’

‘পবন? পবনের চিন্তা করছিস বুঝি বসে বসে হারামজাদি?’

কক্ষনো যা তাই বলে না মেয়েকে, ব্রজ তাই বলে বসে। এবং তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে বলে, ‘কী বলতে কী বলে ফেললাম মা, মনে নিসনি। বলা—কওয়া নেই, সুদাম এসে হাজির। সঙ্গের লোকের সঙ্গে দেখা, সে ব্রজ কয়ালের বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে ইস্টিশানের ধারেকাছে। সুদাম ইস্টিশান মাস্টারের ঘরে বসে। ওর সেই চাকর রামগতির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আমার। ওদের আসতে বলে, ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে আসছি।’

কালী এখন আত্মস্থ গলায় বলে, ‘তা আসবে তো বলেই ছিল, এসেছে। এতে হাঁপাবারই বা কী আছে?’

ব্রজর মুখে এসে যাচ্ছিল, ‘আসছে যে কনে দেখতে তা জানিস হতভাগী মেয়ে?’

তারপরই সামলে নেয়, মনে মনে বলে ‘নাঃ এখনো নয়।’ মুখে বলে, ‘কী আর? বলেছিল আগে খবর দেবে। ইস্টিশান মাস্টারের কেয়ারে চিঠি দেবে তো রোজই খোঁজ করছি—নেই নেই। এখন হঠাৎ না আছে ব্যবস্থা, না আছে দুটো মিষ্টি কেনা। বসবেই বা কোথা? মাথার মধ্যে কেমন করছে আমার। অমন একটা মান্যিমান লোক—’

কালী অবহেলায় বলে, ‘তোমার মান্যিমান লোক তো জানছেই গরীব হতভাগা বানভাসির ঘরে আসছি। অত লাজ—লজ্জার কী আছে?’

বলতে বলতেই ঢালু পথ বেয়ে নীচু থেকে উঁচুতে উঠে আসে দু’টো মানুষ। আগে আগে রামগতি, পিছনে সুদাম নস্কর।

কালী তাকিয়ে দেখে। কালী যেন তার স্বপ্নে দেখা রাজপুত্তুরকে দেখে। বাবার বর্ণনায় খাদ ছিল না বটে।

ব্রজ তদগদভাবে, ‘এই যে কালী, সেই যাঁর কথা বলেছিলাম। দেশের লোক শুনে যিনি আমায়’ ব্রজ হাঁপায়, ‘খাইয়ে—দাইয়ে মিষ্টি সঙ্গে দিয়ে—।’

কালী যদিও নিজে বিমোহিত, তথাপি বাবার এই আদেখলে—পনায় রেগে না গিয়ে পারে না। তাড়াতাড়ি বলে, ‘অত বলবার কিছু নেই বাবা! এত নেমক—হারাম নই যে এখুনি ভুলে যাব।’

ব্রজ মেয়ের সাহস দেখে অবাক হয়।

তবু নিজ স্বভাবে বলে ফেলে, ‘তা ঠ্যাঙা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পেন্নাম কর?’

ব্রজর ভাব দেখলে মনে হয়, পারলে সে নিজেই প্রণাম করে।

কালী আবারও বাবার ব্যাপারে বিরক্ত হয়। তবু বাধ্য হয়েই এগিয়ে যায় প্রণাম করতে। কিন্তু করতে হয় না। সুদাম নস্কর তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে নেয় ‘থাক থাক’ বলে। তারপর বলে, ‘চলুন কয়াল মশাই, আপনার ঘরে গিয়ে বসিগে।’

কনে দেখা বেলায় কনে দেখা তার হয়ে গেছে।

এমনি দীর্ঘাঙ্গী দৃপ্তদীপ্ত একটি মূর্তিই যেন তার কল্পনায় ছিল! যে সুদামের মায়ের হাতের সংসারটাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে, সুদামের দায়—দায়িত্ব সব নেবে।

কালীর যে রংটা কালো তা যেন খেয়ালে এল না সুদামের। কালীর দৃঢ় সপ্রতিভ ভঙ্গী তাকে মোহিত করল। ‘কনে দেখার’ সেই চির পরিচিত ভঙ্গীর সঙ্গে যেন আকাশ পাতাল তফাৎ।

সুদামের মা’ও কালো ছিলেন, সুদাম যেন এই ব্রজ কয়ালের মেয়ের মধ্যে সেই মায়ের ছায়া দেখতে পেল।…হ্যাঁ, এর হাতেই মায়ের সর্বস্ব আর নিজেকেও সঁপে দিয়ে সুদাম নিশ্চিত হয়ে ‘আপন কাজ’ করতে পারবে।

তাছাড়া—ব্রজ কয়াল মশাইও থাকবেন। যাঁর বাবা সুদামের ঠাকুরদার বন্ধু ছিলেন।

আঃ। কি মুক্তি।

সুদাম যেন এখনি একটা পরম নিশ্চিন্তার স্বাদ অনুভব করে।

ব্রজ ঘাড় হেঁট করে বলে, ‘আমার আবার ঘর।’

‘তাতে কি কয়াল মশাই? আমার বাবা বলতেন পুরুষের দশ দশা, কখনও হাতী কখনও মশা। চলুন।…রামগতি, তুই বরং ততক্ষণ এদিক ওদিক ঘোর।’

ব্রজ বাঁচে, কালীও। মনিবের কাছে যা না লজ্জা হচ্ছে, তার থেকে বেশী হচ্ছে ওই চাকরের কাছে। ও চোখ ছাড়া হলে শান্তি।

রামগতি সরে যায় কাঁধের ঝোলা থেকে একবাক্স সন্দেশ বার করে রেখে দিয়ে।

এ আর খুঁটিগাড়ার মেটে দোকান নয় যে শালপাতাই সার। শিউড়ি বাজারের সেরা দোকানের মাল।

বাক্স দেখে ব্রজ মরমে মরে বলে, ‘একি নস্কর মশাই, আপনি অতিথি, আর আপনিই—ছিঃ ছিঃ—’

কালী এখনো জানে না। সে ‘কনে’, তাই নিজ স্বভাবে বলে, ‘ছিঃ দেবার কিছু নেই বাবা! উনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, জানেন গরীবের সংসারে হঠাৎ গিয়ে পড়লে তারা অতিথিকে নিয়ে দিশেহারা হবে, তাই ব্যবস্থা সঙ্গেই নিয়ে এসেছেন।’

সুদাম আর একবার চমৎকৃত হয়।

আর ব্রজ মনে মনে কপাল চাপড়ায়; মরতে কেন আমি ইশারায় জানিয়ে রাখিনি হারামজাদিকে। তাহলে একটু নম্র নত হত। এই খই—ফোটা কথা শুনে আর দুবার তাকাবে? হুঁঃ! মনে মনে নমস্কার করে সরে পড়বে।

তবে এও বলি, নাই বা বললুম। একটা মান্যিগন্যি মানুষ তো বটে? তুই অমনি তার সামনে খই ফোটাবি?

রাগে গর গর করে অথচ সামান্য কিছু বলতে পারে না। কিন্তু সুদাম নস্কর যে কী ভদ্র! সে সবিনয়ে বলে, ‘আমায় যদি আপনি ‘আপনি আজ্ঞে, নস্কর মশাই’ করেন তা হলে তো বসা হয় না আমার।’

ব্রজ তাড়াতাড়ি বলে, ‘হবে হবে, তাই হবে। মানে হঠাৎ—’

‘হঠাৎ কিছু নয়, সেদিন তো আত্মীয়তা হয়েই গেছে কয়াল মশাই! আপনি আমার বাবাকে চিনতেন। তা বলুন আপনার মেয়েকে, উনি ঠিকই বলেছেন, হঠাৎ এসে পড়লাম, জানি আপনার ঘরে ছেলে নেই যে ছুটোছুটি করে দোকানে যাবে। আমিও তো আপনার ছেলের মতন। তাই বলি যে, নিয়ে যাই একসঙ্গে বসে খাওয়া যাবে। তবে চায়ের জন্যে খাটতে হবে আপনার মেয়েকে!’

একী ভাষা! এ কোন দেবলোকের কথা!

কালীর খই ফোটাও যেন শান্ত হয়ে যায়। কালী আচ্ছন্নের মত চা তৈরী করে। মেলায় কেনা নতুন কাঁচের গেলাশ দুটো বার করে বাপকে আর বাপের অতিথিকে চা দেয়, সন্দেশের বাক্স খুলে ঘরে মজুত শালপাতা থেকে পাতা নিয়ে সন্দেশ ভাগ করে ধরে দেয়। চটাওঠা কলাই করা প্লেটের থেকে শালপাতা ভাল।

ভয় করছিল, এই বুঝি বলে বসে, ‘কয়াল মশাই, আপনার মেয়েকেও বলুন নিতে।’ তা, কী ভাগ্যিস বলে না। ভদ্র আর বিচক্ষণ বলেই বলে না।… জানে গেরস্তর মেয়ে, বাইরের লোকের সামনে খায় না গবগবিয়ে।

‘মানুষ দেখলি কালী?’

ওদের সঙ্গে লাইনের ওপার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যখন ফিরে এসে বসল ব্রজ, তখন তাকে দেখে মনে হল, সত্যিই যেন একটা যুদ্ধ জয় করে ফিরেছে।

হাঁপাচ্ছে, এই ঠাণ্ডাতেও ঘামছে।

জিরিয়ে নিয়ে বলে, ‘মানুষ দেখলি কালী?’

কালী তার স্বভাব বহির্ভূত ভাবে চায়ের সরঞ্জাম, খাওয়া পাতা, সব ছড়িয়ে ফেলে রেখে এতক্ষণ বসেছিল চুপচাপ, বাবাকে ফিরতে দেখে তৎপর হল। ঘর মুছতে মুছতে বলল, ‘দেখলাম।’

ব্রজ সেই তখন মেয়ের চটপট কথায় জ্বলতে জ্বলতে ভাবছিল, পছন্দ যে করবে না, সে তো নিশ্চিত। ফিরে এসে মেয়েকে আচ্ছা করে ধুন্ধুড়ি নেড়ে দেবো। বলব, ‘বলি ভেবেছিস কি তুই? সবাই তোর ওই পবনা, সত্য, মালবাবু, বটু ডাক্তার?…ওদের সঙ্গে কটকটিয়ে কথা কয়ে কয়ে জিভ মাজা হয়ে গেছে, কেমন? মানী মানুষের সামনে একটু ঘাড় গুঁজে বসতে হয়, সাত চড়ে ‘রা’ কাড়তে নেই, এটুকু জান না তুমি?’

এই সবই ভেঁজে রেখেছিল এবং নীরবে মলিন মুখেই পৌঁছতে গিয়েছিল, কিন্তু কোন অমর্ত্যলোকের বার্তা শুনে এল ব্রজ?

ব্রজ আর একটু গৌরচন্দ্রিকা করল, বলল, ‘মানুষটা জ্বর হয়ে বিছানায় পড়ে, আর আমরা ভাবছি ভুলেই গেল বোধহয়। বড়লোকের খেয়াল তো, যখন চিনল তখন খুব চিনল, আর যখন ইচ্ছে হল না, তখন আর চিনতে পারল না।’ দেখ ভেবে কী অন্যাই করেছি।…

কালী কোন কথা বলে না। হৃদয়—ভারে ভারাক্রান্ত কালীর এখন এত বক—বকানি ভাল লাগে না। কিন্তু ব্রজর যে এখন প্রাণের মধ্যে কথার সমুদ্র।…তাই ব্রজ আবার গৌরচন্দ্রিকা ফাঁদে। ‘আজ যদি তোর মা থাকত কালী?’ কালী হঠাৎ চমকে উঠে বলে, ‘এতকাল পরে আবার মাকে চিতে থেকে তুলে আনা কেন বাবা?’

ব্রজ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘আর কেন! এদিকে পাত্তর বলে গেল, মেয়ে খুব পছন্দ হয়েছে, এই মাসেই শুভ কাজটা হয়ে যাক, অথচ আমার নেই কেউ করবার। অবিশ্যি বিচক্ষণ ছেলে, সব দায় নিজে নিচ্ছে, তবু—’

‘তবুটা’ কি সেটাই জোগাড় করে উঠতে পারে না বলেই বোধহয় ব্রজ থেমে যায়।

এই অবকাশে কালী বলে, ‘কী আবোল—তাবোল বকতে শুরু করলে বাবা? কোনখান থেকে আলাই—বালাই কিছু খেয়ে এলে নাকি?’

ব্রজ এ অপমানও গায়ে মাখে না।

বলে, ‘যা ইচ্ছে বল। তবে আবোল—তাবোল নয় কালী, সত্যি কথা, খাঁটি কথা, সুদাম তো শুধু শুধু আসে নি, এয়েছিল কনে দেখতে!’

কালী গম্ভীরভাবে বলে, ‘ও! সেদিন তাহলে ওই বাবদই মিষ্টির হাঁড়ি এসেছিল। তা আমি তো বাবা তোমার খুকী মেয়ে নই, আমায় বলতে কী হয়েছিল?’

ব্রজ আর এখন মেয়েকে ভয় করবে না। ব্রজ বড় গাছে নৌকো বেঁধেছে, তাই বীরদর্পে বলে, ‘হ্যাঁ, তোমায় বলি, আর তুমি সব ভণ্ডুল করে দাও। তোমায় বিশ্বাস নেই। এ বাবা পাকা কথা দিয়ে গেল, এখন নিশ্চিন্দি। বলে গেল, ঠিক এই রকম বড়সড় জোরমন্ত মেয়েই মনের মধ্যে ছিল ওর। সংসার দেখবে, আড়তের আয়—ব্যয় দেখবে—’

‘ওঃ!’ কালী বলে, ‘তোমার চাকরিটা তাহলে ভূয়ো। বোকা পেয়ে ঠকিয়ে নিজের কাজটি গুছিয়ে—’

ব্রজ রেগে উঠে বলে, ‘মেলা অহঙ্কার করিস নি কালী! তুই ছাড়া আর ওর কনে জুটত না? এক গাঁয়ের মানুষ, সেই সুবাদেই এত ইয়ে। আমার চাকরী ভূয়ো? আমায় একেবারে আড়তের ম্যানেজার, মানে দেখা—শোনার ভার সব দিয়ে দিল। দেবতা একদিকে, আর ওই ছেলে একদিকে কালী! ওর নামে নিন্দে করলে মহা পাপ হবে। নইলে কে কবে নিজে থেকে বলে কন্যেপক্ষর সব খরচা তার?’

আস্তে আস্তে ভাঙে ব্রজ।

অনেক ধানাই—পানাইয়ের পর কালী জানতে পারে, বোলপুরের বাজারে সুদাম নস্করের একখানা ছোট বাড়ি আছে, বাপের আমল থেকেই আছে। কাজের খাতিরে বোলপুরে প্রায়ই আসতে হয়, তাই স্থায়ী ব্যবস্থা। সেইখানে ব্রজ মেয়েকে নিয়ে গিয়ে বসবে। বিয়ের ব্যবস্থা সব মজুত থাকবে, বরযাত্রী খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকবে, বর আসবে একটু বেশী রাতের দিকে। লগ্ন যখন অধিক রাত্রে, তখন আর সন্ধ্যায় কেন? যা করবার সুদামের লোকজনই করবে, ব্রজ শুধু কন্যেদানের পুণ্যটুকু অর্জন করবে।

চিরমুখরা কালী শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে যায়।

এই কিছুক্ষণ আগেই না সে ভাবছিল, ধনবল, জনবল আর মনোবল, এই তিনটে বলই হীন ব্রজ কয়ালের মেয়ের বিয়ে কে উদ্ধার করবে? ভগবান এখনও কানে শোনেন?

একটা মানুষের কিছুক্ষণ উপস্থিতি, দু—চারটি কথা, একটুখানি হাসি, এতেই মানুষ জ্বরের ঘোর অথবা নেশার ঘোরের মত আচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারে?

কালীর যেন এখন আর মনে পড়ছে না, সে কে, কী কী কর্তব্য, এখন তার! বাবা একবার বলল, ‘আর রাত করে কী হবে’ কালী বলল, ‘এই যে দিই’, তারপর উঠতে ভুলে গেল। অনেকক্ষণ পরে আবার যখন বাবা বলল, তখন লজ্জিত হয়ে বলল, ‘শুধু শুধু এমন আলিস্যি ধরেছিল!”

কালীর বাপের ইচ্ছে হচ্ছিল যতক্ষণ পারে মেয়ের সঙ্গে গল্প চালিয়ে যায়! কিন্তু মেয়ে যেন আজ স্বভাব ছাড়া ব্যবহার করছে। কথাই নেই মুখে।

হুঁ বুঝেছি, আর কিছু নয়, সেই লক্ষ্মীছাড়াটার চিন্তা হচ্ছে। সাধে কি আর বলে, মেয়েমানুষ জাতটা হচ্ছে মুখ্যু বোকা, একের নম্বর বুদ্ধু।

কিন্তু ছোঁড়াটাকে তো আর দেখি না! হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল কেন?

কিন্তু ব্রজর আশঙ্কা অমূলক, ব্রজর মেয়ে সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া হতভাগা ছোঁড়াটার কথা মোটেই ভাবছে না তখন। তার জীবনে হঠাৎ এসে পড়া আলোর ঝলকের ধাক্কাটাই তাকে অমন শুষ্ক করে দিয়েছে।

ও শুধু ভাবছে, এ কী সম্ভব? এ কখনও হতে পারে? না, আপাতত কালী লোকটার পয়সা—কড়ি, ঘর—বাড়ির চিন্তায় বিভোর হচ্ছে না, বিভোর হয়ে আছে কেবল মাত্র মানুষটার চিন্তাতেই।

কালী নিজে প্রখরা মুখরা প্রবলা, অথচ একটা সূক্ষ্ম সুকুমার সুরুচিসম্পন্ন মানুষের সামান্যতম সংস্পর্শ এত মুগ্ধ করে কালীকে!

আজও কালীর ঘুম আসে না। ঘুম—জাগরণের মাঝখানে কালী একটা বিয়ে বাড়ির স্বপ্ন দেখে।…তখন আর সে বিয়ের বরের চেহারাটা ঝাপসা নয়।

পবনের কথা মনে পড়ল পরদিন।

কালী ধরে নিচ্ছিল, সেদিন জোর গলায় ঘোষণা করে এবং কালীকে রাজী করিয়ে নিয়ে চলে যাবার পর ভাই—ভাজের মত করাতে না পেরে লজ্জায় আর আসতে পারছে না।

অথচ আবার কালীর ধনুকভাঙা পণ।

কে জানে সেই অসাধ্য সাধনের কাজেই নেমে পড়ল না তো ছেলেটা? আবারও সেই ‘ছেলেটা’ই মনে হয় কালীর। ভাবল, সত্যর কাছ থেকে একবার সন্ধান নিতে হবে। ওদের বাড়িতে তো আর নিজে যাবার মুখ নেই কালীর।

কিন্তু কালীকে আর কষ্ট করতে হল না। সত্যর কাছে খবর নিতে যেতে হল না। পরদিন মালবাবু এল।

কালী তখন ঝুপড়ির বাইরে বাসন ধুচ্ছিল রোদে বসে! মালবাবু পিছন থেকে বলে ওঠে, ‘বাহারে কালী, তুই যা করিস, তাতেই কী সোনা ফলে রে? বাসন মাজছিস তা—ও দেখবার মতন।’

কালীর হাত ছাই—মাটি মাখা, তাই পিঠের আঁচলটা টানতে পারে না, নিজেই টানটান হয়ে বলে, ‘আপনার আর কিছু বলবার আছে?’

‘ও বাবা, তুই যেন কালী সর্বদাই মিলিটারী! বলি, কাল অত বাহারের কে এসেছিল রে তোদের বাড়ি? চাকর সঙ্গে করা লোক।’

কালী সংক্ষেপে বলে, ‘বাবার দেশের লোক।’

‘দেশের লোক, সেটি আবার কোথা থেকে জুটল?’

কালীর ইচ্ছে নয় যে এই লোকটার সঙ্গে সুদামের কথা বেশী বলে। কিন্তু চাপতে গেলে বিপদ আছে, তাই অগ্রাহ্যভরে বলে, ‘ওই তো শিউড়িতে গিয়ে!’

‘তা বাবা গিয়েছিল বলে, সে—ও এসেছিল বদলা দিতে?

কালী এ কথার উত্তর দেয় না।

মালবাবু সরে এসে বলে, ‘বেশ মেকদারের লোক বলেই মনে হল, নাম কী?’

কালী এবার নিজের স্বভাবে ফেরে, ঝঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে, ‘বাবার দেশের লোক তার নাম জেনে আমারই বা কী, আপনারই বা কী সাহা মশাই?’

জগৎ সাহা এতে টলে না, টেনে টেনে হেসে হেসে বলে, ‘না, তাই বলছি। তোর বাবা যা জামাই আদর ভাব করছিল, মনে করলাম বুঝি তোকে কনে দেখতেই এল!’

কালী কেঁপে ওঠে। তার বুঝতে বাকি থাকে না, শয়তানটা সব জেনে বুঝে এসে ন্যাকামি করছে। উঃ কী শয়তান!

জগৎ সাহা বলে, ‘অহঙ্কারে তো মটমট করছিস। তবে বলি, যার তেজে এত তেজ, সে তো কেটে পড়েছে! শুনেছিস তো পবনার কেলেঙ্কার?’

পবনের কেলেঙ্কার!

কালীর চোখের সামনে সব ধোঁয়া লাগে। গলায় দড়ি—টড়ি দেয়নি তো? এ যা শয়তান, সেই কথাটাই হয়তো হেসে হেসে বলতে এসেছে। তবু মুখে টান গলায় বলে, কারুর কেলেঙ্কার শোনবার সময় আমার নেই সাহা মশাই!’

‘আহা শোন শোন, তোর অত পেয়ারের লোক। ভাই—ভাজের সঙ্গে ঝগড়া করে ‘ভেন্ন হব’ বলে শাসিয়ে বেরিয়ে পড়ে বটু ডাক্তারের চেম্বার থেকে সাতাশটা টাকা চুরি করে পালিয়েছে।’

কালীর একথা বিশ্বাস হয় না! তাই বলে, ‘ভালই করেছে। ওষুধের নামে জল বেচে তো পয়সা, বটু ডাক্তারের পাপের ধন প্রাচিত্তে গেছে!’

‘হুঁ। বটু তো থানায় নালিশ করে এসেছে, যখন হাতে হাতকড়া পড়বে, তখন টেরটি পাবেন বাছাধন।’

‘হাতে হাতকড়া?’ কালী হঠাৎ হেসে উঠে বলে, ‘সে কী সাহা মশাই? আপনি গরমেণ্টের এত এত মাল সাফাই করছেন, তাতে হাতকড়া পড়ছে না, আর বটু ডাক্তারের তুচ্ছ কটা টাকার জন্যে হাতে হাতকড়া পড়বে পবনের?’

‘কী’? জগৎ সাহার ভালুকে পোষাক পরা শরীরটা যেন নেচে ওঠে। বলে, ‘আসপদ্দা বাড়তে বাড়তে যে আকাশে উঠছে রে কালী, মচকে ভেঙে যাবি যে!’

‘মচকাব কী বলুন? আপনারা নেই?’

বলে বাসন কটা তুলে নিয়ে গিয়ে ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে যায় কালী!

জগৎ সাহা কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে নেমে যায় ঢালু পথ দিয়ে। ঝুপড়ির মধ্যে উঁকি দেবার সাহস নেই। যা সব অস্তরের নাম করে করে রেখেছে।

জগৎ সাহা চলে যাবার পর কালী সত্যর সন্ধানে গেল! অধিকাংশ সময় চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে—টসে থাকে সে। দুই বন্ধুতেই থাকত। এখন একা ছিল।

কালীকে দেখেই সত্য গম্ভীরভাবে বলে, ‘পবনের সঙ্গে সম্পক্ক নেই আর আমার।’

কালী বিদ্রূপের গলায় বলে, ‘কেন, কী করল পবন?’

‘কী না করল? বলি, না করল কী? চুরির বাড়া অকম্ম আছে?…নাঃ, চোরটার সঙ্গে আর সম্পক্ক রাখছি না।’

শুনে কালী সরে আসে, যাতে সত্যর সামনে না দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ে তার।

সত্য নাকি পবনের বন্ধু ছিল?

‘বন্ধু’ মানে কী?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে পবন নামের একটা হতভাগ্য ছেলেও। বন্ধু মানে কী? চুরির কথাটা মিথ্যে না, বটু ডাক্তারের ড্রয়ার খুলে ওই টাকার ব্যাপারটি সেরেছিল পবন। কিন্তু গা ঢাকা দিয়ে পালানোর ক’দিন পরে একবার চুপি চুপি সত্যর কাছে এসেছিল। সত্য দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।

সগর্বে সে কথাটি ঘোষণা করে সত্য।

মাথা গরম পবন চলে গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা সুদাম নস্করের ‘পৌষ মাস’ করে দিয়ে গেল বলতেই হবে। পবন যদি সামনে থাকত, যদি অহরহ কালীর কাছে এসে যেমন পড়ত আগে, তেমনই পড়ত, তাহলে কালী কী করত বলা শক্ত। যদিও পরিণত যুবতী কালী পবনের কথা ভাবতে গেলেই ‘ছেলেটা’ ভাবে। তবু ওই আছড়ে এসে পড়ার একটা ভার আছে বৈ কি! কালী এখন সেই ভার মুক্ত।

আবার এমন একটা কুকর্ম করে চলে গেছে পবন, তার নামে বিরূপতা না এসে পারছে না। এখন আর অবিশ্বাস করার উপায় নেই, সবাই ওই এক কথাই বলছে।

এমন কপাল কালীর যে, একদিন কিনা নবীন এলো কালীর কাছে, পবনের কোন সন্ধান সে জানে কি না জিজ্ঞেস করতে।

কালী তো শুনে স্তম্ভিত। বলল, আপনাদের কী মনে হচ্ছে ‘চোরাই টাকাটা সে আমার কাছে গচ্ছিত রেখে গেছে?’

নবীন বলল, ‘মনে কিছু কর না মা, ভাইটার জন্যে মাথার ঠিক নেই। প্রকাশ্যে তো খোঁজারও উপায় নেই। বটু ডাক্তার থানায় ডাইরি করে রেখেছে।’

তার মানে পবন এখন পলাতক আসামী।

আর সুদাম?

আড়তদার সুদাম নলহাটিতে গিয়ে এমন কীর্তন গেয়ে এসেছে যে, সাড়া পড়ে গেছে। আবার ধন্যি ধন্যি পড়ে গেছে তার উঁচু নজরে! পাকা দেখায় এমন খাওয়ান খাইয়েছে, লোক অনেকদিন অমন খায়নি।

সেইসব লোকের মধ্যে মণিবাবুও আছে, সত্যও আছে, নবীনও আছে। সুদাম বলেছিল, আপনার চেনা—জানা সবাইকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসবেন কয়াল মশাই! যজ্ঞি যখন হচ্ছেই।’

না, এখন আর লুকোছাপা নেই, আর তো ভাঙচির ভয় নেই। এখন ব্রজ সগৌরবে বলে বেড়াচ্ছে সবাইকে, কালীর কপালটা কী রকম।

গায়ে হলুদের আগের দিন বাপমেয়ে সুদামের বোলপুরের বাড়িতে গিয়ে থাকবে। সবাই জেনেছে, ব্রজর কেউ করবার নেই, তাই ব্রজর ভাবী জামাই বিবেচনা করে বাড়ি দিয়েছে থাকতে, আবার খরচা দেবে সমস্ত।

নবীন কুসুমকে ডেকে বলে, ‘দেখলি কুসুম? কালী মেয়ে ফ্যালনা নয়। যে পাত্তর বিয়ে করছে, সে পাত্তরের দাম শুনলে ভিরমি যাবি। ব্রজ কয়াল ভদ্দর লোক, অবস্থার বিপাকে—’

এখন যেন সকলেরই চোখ পড়ছে, কালী মেয়ে ফ্যালনা নয়। এমন কি, আশপাশের অন্য ঝুপড়িগুলোর বাসিন্দারাও কালী সম্বন্ধে এখন সচেতন হয়ে উঠে বলতে আসছে, ‘ওহে কালী দিদিমণি শোশুর বাড়ি চলে যাবে, আমাদের পাড়া আঁধার হোয়ে যাবে।’

এখন আর ভাঙচির ভয় নেই, তাই আর লুকোছাপাও নেই। এখন কালীর ভাবী স্বামীর সুখ, ঐশ্বর্য, উদারতা, অকৃপণতা, এই খুঁটিগাড়া গ্রামের একমাত্র প্রসঙ্গ হয়েছে।

বিয়ের আগেই যে বর যখন—তখন তত্ত্ব পাঠাচ্ছে এবং বিয়ের পরেই ব্রজ কয়াল জামাইয়ের আড়তের ম্যানেজার হয়ে চলে যাবে শিউড়িতে, এ—ও এখন আর কারো অবিদিত নেই।

ব্রজ সবাইকে বলেই বেড়াচ্ছে। না বলতে পেরে হাঁপিয়ে মরছিল, এখন বাঁচছে।

গায়ে হলুদের আগের দিন কালীরা চলে যাবে বোলপুরে। সেখান থেকেই শিউড়ি। খুঁটিগাড়া গ্রামের এই ঝুপড়ির সংসারের এইখানেই ইতি।

কালী জিনিস—পত্তর তুলছিল। জিনিসপত্তর আর কী? বোলপুরের বাসায় বেমানান। তবু তুলছিল, ফেলছিল। ব্রজ বলল, ‘আমি দেখি একবার জায়গাটাকে শেষ দেখা দেখে আসি। যতই হোক, মায়া পড়ে গেছে।’

ব্রজ গ্রামটাকে শেষ দেখা দেখতে বেরোল, কালী বসে রইল চুপচাপ। আর কাজে হাত—পা আসছে না, মনটা কেমন উদাস হয়ে যাচ্ছে। তারও যেন ইচ্ছে হচ্ছে একবার সবাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা করে আসে।

কোন মানুষের সঙ্গে নয়। গাছ—পালা, মাঠ—পথ, ফুল—ফল, ঘাস, ধুলো! এরাই তো কালীর এ যাবৎ কালের একান্ত বন্ধু।

যাক, এখন ভগবান যে বন্ধু জুটিয়ে দিচ্ছেন, সব বিরহ—বিচ্ছেদ মুছে যাবে।

কালী আবার ঘরটার দিকে তাকাল, মনে মনে বলল, তুই আমাদের অনেক দিন আশ্রয় দিয়েছিস রে, তোকে প্রেণাম জানাই।

মেঝেয়ে মাথাটা ঠেকিয়েছে, সে মাথা তুলেই কালী যেন ভূত দেখল।

সামনেই দাঁড়িয়ে।

প্রায় বলে ফেলেছিল, ‘কে’? ‘কে তুমি?’ বলেনি ভাগ্যিস!

আস্তে বলল, ‘তুই?’

পবন বলল, ‘চলে এলাম।’

কালী পবনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। এই রোগা কালো, গালের হাড় উঁচু, চোখের কোল বসা লোকটার নামই পবন? এই কিছুদিনে এত পরিবর্তন হয়? নাঃ এখন আর পবনকে দেখে ‘ছেলেটা’ বলে মনে হচ্ছে না।

কালী আস্তে বলল, কোথায় ছিলি এতদিন?’

‘যেখানে সেখানে।’

‘যাবার আগে আমায় একবার বলে গেলি না কেন?’

‘মনের আক্ষেপে হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছিলাম—’

কালী স্থির গলায় বলে, ‘একেবারে ‘হঠাৎ’ বলা যায় কী করে? বটু ডাক্তারের ড্রয়ার খুলতে সময় লাগেনি?’

‘ওঃ, সব শোনা হয়ে গেছে?’

পবন তাচ্ছিল্যের গলায় বলে ‘গরীবের চোর হওয়া ছাড়া উপায় কী?’

‘গরীব হলেই চোর হতে হবে?’ কালীর কণ্ঠস্বর অনমনীয়।

পবন আরো অবজ্ঞার গলায় বলে, ‘নিরুপায় হলেই হতে হবে।’

কালী গভীরভাবে বলে, ‘তা হঠাৎ এই নিরুপায়টাই বা হতে হল কেন?’

‘কেন?’ পবন তীব্রস্বরে বলে, ‘কেন? বলতে তোর লজ্জা করল না কালী?’

কালী অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেন? লজ্জা করবে? আমি তো চুরিও করিনি, ডাকাতিও করিনি—’

পবন ক্ষুব্ধ গলায় বলে, ‘চুরি করিসনি? একেবারেই না?…ভাল করে ভেবে দেখ।’

পবনের দৃষ্টির তীব্রতা কালীকে কাঁপায়।

তবু কালী স্থির থাকবার চেষ্টা করে বলে, ‘ভেবে ভেবে তো মরলাম অনেক দিন, তুই কোন খবর দিলি? তোর বাড়িতে রাজি হল না হল, তুই কী ব্যবস্থা করতে পারলি, জানতে পারলাম আমি?’

পবন মাটিতে বসে পড়ে বলে, ‘দেবার মতন না হওয়া পর্যন্ত কী দেব? কিন্তু এ—ও ভাবিনি, এতকালের কালী তুই, এযাবৎ তোর বাবা কোনো ব্যবস্থা করছিল না, হঠাৎ এই কটা দিনের মধ্যে এত কাণ্ড হয়ে যাবে। ব্রজরাজ রাজপুত্তুর পাত্তর এনে কন্যে দান করতে বসবে, আর রাজপুত্তুরও এই হতভাগা পবনের বৌ—টা ছাড়া কনে খুঁজে পাবে না।

পবনের বৌ—টা!

কালী প্রায় ধমক দেওয়া সুরে বলে, ‘কী বলছিল যা—তা? তোর বুদ্ধি বড় কাঁচা পবন! বয়েসকালে অমন কত ঠাঁই মন পড়ে, সেই জাগিয়ে বসে থাকলে কি চলে?’

পবন ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘পয়সার গন্ধ পেলে অবিশ্যি চলে না। কিন্তু ছি ছি কালী, ধিক দিই তোকে, তুইও পয়সা দেখে এমন অজ্ঞান হলি? তোকে এমন ভাবতাম না।’

কালীর বলবার কথা অনেক ছিল। কালী ওই রুক্ষ—শুষ্ক পোড়া কাঠ সদৃশ মানুষটাকে সান্ত্বনা বাক্য শোনাতে পারত, স্নেহ আদরে সুস্থির করবার চেষ্টা করতে পারত, কিন্তু কালী সেদিক দিয়ে গেল না। কালী দেখতে পাচ্ছে, ওর মধ্যে আগুন জ্বলছে ধক ধক করে। এখানে সান্ত্বনাটা পরিহাস। বোঝানোর চেষ্টা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে।

কালী তাই সে পথে যায় না। দার্শনিকের গাম্ভীর্যে বলে, ‘কেনই বা ভাবতিস না রক্তমাংসের মানুষ বৈ তো আকাশের দেব—দেবী নই? ইহ সংসারে পয়সাই সবের মূলাধার, তা কে না জানে? তুই জানছিস না?’

পবন তেরিয়া গলায় বলে, ‘জানছি না? হাড়ে হাড়ে জানছি, তবু জানতাম কালী, জগতে মানুষ—মনিষ্যত্ব আছে। চিরকাল মনে জানি, তুই আমার বৌ, বাপের বাড়িতে পড়ে আছিস, অবস্থার গতিকে আনতে পারছিনে, আর তুই—’ কথা বলতে পারে না বলেই থামে।

কালী আস্তে ঘরের কোণ থেকে এক ঘটি জল আর বাটি করে দুটো বড় রসগোল্লা রেখে বলে, ‘রোদে রোদে ঘুরছিলি পবন, একটু জল খেয়ে ঠাণ্ডা হ! তাপর কথা কস।’

বড় বড় দুটো রসগোল্লা আর ঠাণ্ডা এক ঘটি জল! পবনের বহু দিনের ক্ষুধার্ত পিপাসিত অন্তরাত্মা যেন ওর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায়, তবু পবন ঘৃণাভরে তাদের বাঁ—হাতের ঠেলায় দূরে সরিয়ে দিয়ে বিদ্রূপের গলায় বলে, ‘বড়মানুষ বরের গিন্নী হবার আগেই যে মস্ত বড় মানুষ হয়ে গেছিস কালী! ঘরে সর্বদা রাজভোগ—রসগোল্লা মজুত। কিন্তু ঠাণ্ডা হতে আমি আসিনি কালী, স্পষ্ট কথা বলতে এসেছি, বড়মানুষের গিন্নী হওয়া তোর হবে না।’

কালী ওই তীব্র মূর্তির দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত হয়, খুব নরম গলায় বলে, ‘ছেলে মানুষের মতন কথা বলিসনে পবন, বাবার কথাই ভাব? কত দুঃখু—ধান্ধা, কত উঞ্ছবিত্তি করে এযাবৎকাল কাটিয়ে এতদিনে একটু সুখের মুখ দেখার আশা পেয়েছে। নস্কর তার আড়তের মেনেজার করে দিয়েছে বাবাকে, কত সাহায্য করছে, এখন আমার বেগড়ালে চলবে কেন বল? সেটাই কি মনুষ—মনিষ্যত্ব হবে? পবন এতক্ষণে বোধহয় কালীর মুখের দিকে তাকায়, কী দেখে কে জানে। একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘ঠিক আছে, তোকে বিগড়োতে হবে না, যা করবার আমিই করব।’

কালীর মতো মেয়েও এই আগুনের ঢেলা চোখ দেখে ভয় পায়। এ আগুন তো শুধুই প্রেম—পাত্রীর বিশ্বাসভঙ্গের জ্বালার আগুন নয়, এই দীর্ঘ দিনগুলোর অনাহার, অনিদ্রা, দুঃখ, ক্লেশ বারুদ করে তুলেছিল তাকে।

কালী ভয়ে ভয়ে বলে, ‘দোহাই তোর পবন, যা—তা কিছু করতে যাসনে। মনে কর তোর বৌ বাপের বাড়িতে পড়েছিল, ওলাউঠো হয়ে মরে গেছে। এমন মরে না?’

‘থাম কালী। আর সাজিয়ে—গুছিয়ে কথা বলতে আসিসনে।’ পবন কড়া গলায় বলে, ‘আড়তদারের বিয়ের সাধ আমি ঘুচিয়ে দিচ্ছি, ব্যস।’

‘পবন!’ কালীও এখন মহাকালী হয়। কড়া গলায় বলে, ‘তাই যদি দিতে যাস, ভেবেছিস আমি নাচতে নাচতে তোর গলায় মালা দিতে যাব?’

‘যাসনি।’ পবন দাঁড়িয়ে উঠে বলে, ‘বিয়ে পবনের এ জীবনে না হয় না হোক তবু এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করতে পারবে না। খুন করে ফাঁসি যেতে হয়, সে—ও বি আচ্ছা।

‘পবন, আমি তোকে মাতার দিব্যি দিচ্ছি, গেয়োর্তুমি করিসনে। অবস্থা ফেরা, কত ভাল বৌ জুটবে তোর। আমি নিজে দাঁড়িয়ে বে দেব তোর। বলতে গেলে আমি তো তোর দিদির মতন পবন! তুই একটা কাঁচা—বুদ্ধি ছেলে মাত্তর আর আমি সাত ঘাটের জল খাওয়া, দুঃখের আগুনে পুড়ে পুড়ে মরা, একটা গিন্নি। তুই আমার নাগাল পাবিনে পবন, তুই আমার আশা ছাড়।’

‘মরলে ছাড়ব’, তার আগে নয়,’ পবন ঝুপড়ি থেকে বেরোবার জন্যে পা বাড়ায়। কালী ব্যাকুলভাবে বলে, ‘আমার মাথা খা পবন, মিষ্টিটুকু খেয়ে জল খেয়ে যা। ‘না।’ বলে পবন বেরিয়ে পড়ে।

তবু কালী জিনিস দুটো ঘর থেকে বার করে এনে বলে, ‘না খেয়ে গেলে আমি বড় দুঃখু পাব পবন।’

‘ওঃ। দুঃখু পাবি।’ পবন তীব্র ব্যঙ্গে মুখ বাঁকিয়ে বলে, ‘এখন থেকেই ভদ্দর লোকের ভাষা শিখছিস? ওই—রসগোল্লা তো সেই শালার দেওয়া? পবন পা দিয়েও ছোঁবে না। আর তোকেও চরিত্তির খারাপ করে রাবড়ি—রাজভোগ খেতে দেবে না।’

‘পবন!’ কালী নিজেই রসগোল্লা দুটো ছুঁড়ে ধূলোয় ফেলে দিয়ে বলে, ‘যা মুখে আসছে তাই বলছিস যে দেখছি! বাড় বড্ড বেড়েছে! জানিস তোকে এক্ষুণি পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া যায়, তোর নামে থানায় ডাইরী করা আছে! বটু ডাক্তার—’

পবন তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, ‘শুধু ওই একটা? দেখগে যা আরো কত থানায় কত ডাইরী—’

‘ওঃ। তার মানে তুই এতদিন চুরি করেই বেড়াতিস? বাঃ পবন, বাঃ!’

পবন এ ধিক্কার গায়ে মাখে না, জোর গলায় বলে, ‘চুরি, ছিনতাই সবই। না করলে, কে আমায় ডেকে চাকরি দিচ্ছিল? পেটটা চালাতে হবে তো?’

কালী ঘৃণার গলায় বলে, ‘অমন চালানোর থেকে গলায় দড়ি দিয়ে মরা ভাল পবন!’

পবন হঠাৎ কখনো যা না করেছে তাই করে। কালীর দুই কাঁধ চেপে ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘তবে বলি কালী, তার আগে তোরও তাই উচিত। লোভে পড়ে বিশ্বাস ভাঙাও যা, চুরিও তা। তুই কি ওই আড়তদারটাকে চিনিস—জানিস? আগে কোনদিন দেখেছিস ওকে? কিছু না, শুধু লোভে পড়ে ওর গলায় মালা দিতে যাচ্ছিস। এত অধর্ম তোকে করতে দেব না কালী!’

কালী নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে না, শুধু খুব শান্ত হয়ে গিয়ে বলে ‘এখন অন্য রকম হলেও খুব অধর্ম হবে পবন। আমি তোর কাছে হাত জোড় করছি—’

‘ওঃ, হাত জোড়! অনেক নাটক শিখেছিস দেখছি—’

পবন ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই ছেড়ে ফেলে দিয়ে বলতে বলতে চলে যায়, ‘আচ্ছা, আমিও দেখাচ্ছি।’

কালী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে পবনের পথের দিকে নয়, পবনের সামনে ধরে দেওয়া সেই রসগোল্লা দুটোর কাদামাখা মূর্তির দিকে।…যতবার ঘরে খাবার মিষ্টি এসেছে ততবারই কালী বাবাকে লুকিয়ে তার থেকে কিছুটা তুলে রেখেছে, যদি হঠাৎ এসে যায় পবন। একটু গুড়ের চা ব্যতীত কোন দিন তো কিছু খাওয়াতে পারেনি, ভাল জিনিস খেতে গেলেই ওর কথা মনে পড়েছে। আজ ওকে দেখে বড় আহ্লাদ হল, কত আশা করে ঠাণ্ডা জলটা এগিয়ে দিল, তার এই দুর্দশা! অথচ ভেতরটা যে ওর ক্ষিধেয়, তেষ্টায় ‘টা—টা’ করছে তা তো স্পষ্ট চোখে দেখতেই পারছিল কালী।

জানি না কী অঘটন ঘটায়। আত্মঘাতী না হয়, এই ভাবনা কালীর।

ব্রজকে আসতে দেখা গেল। কালী তাড়াতাড়ি পা দিয়ে মিষ্টি দুটো আরো দূরে ফেলে দিল কোনদিন যাতে বাবার চোখে না পড়ে।

পবন কী—না—কি করে বসে, একথা কারোর কাছে প্রকাশের উপায় নেই। পবনের পিছনে পুলিশ ঘুরছে, এসেছিল শুনলেই হৈ—চৈ পড়ে যাবে। হয়ত ব্রজই ধরিয়ে দেবে।

আবার ভুল করে বসে কালী।

পুলিশের হাতে পড়া ছাড়া যে ওর গতি নেই, এইটা আন্দাজ করে, এখনি ধরিয়ে দিতে পারলে সব দিক রক্ষে হত। দুমাস চার মাস আটকে থাকত, ততদিনে মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে যেত।

আর যা এতদিন ভেবে রেখেছিল কালী। এতদিনে পাকাপাকি নস্কর গিন্নী হয়ে আব্দার করে বলতে পারত, ‘আমার বাবাকে তো চাকরি দিয়েছ। আমার এই বন্ধুটাকেও দাও দিকি একটা চাকরি—বাকরি। আমার চোখের সামনে থাকুক, বাউণ্ডুলে উড়ন চণ্ডেটা—’

আহা, কালীর হিসেবের ভুলে সেসবের কিছু হল না। হল এই—

গায়ে হলুদ মাখা বর মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে গেল, আর উগ্রচণ্ডা বাউণ্ডুলেটাকে হাতে হাত কড়া লাগিয়ে জেলখানায় যেতে হল।

ব্রজ মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘আমার কপালে এই ছিল কালী! সুদাম কি আর এরপর এ বিয়েতে রাজী হবে?’

কালী বিচিত্র একটু হেসে বলে, ‘সুদাম রাজী হলেও তোমার মেয়ে আর রাজী হতে পারছে কই বাবা!’

ব্রজ ছিটকে উঠে বলে, ‘তার মানে?’

কালী একটু হেসে বলে, ‘যে হতভাগা আমার জন্যে খুন করে ফাঁসি যেতেও প্রস্তুত, তোমার মেয়ে তাকে একটু বিয়ে করে কেতার্থ করতে পারবে না? কী এত মহারাণী মেয়ে তোমার বাবা।…নাঃ, বড় মানুষের শ্বশুর হওয়া আর তোমার ভাগ্যে হল না বাবা!’

স্বজাতি

স্পষ্ট দেখতে পাওয়া গেল ছেলে দুটো ওই বুড়ো ভদ্রলোককে বাসের দরজার সামনে থেকে ঠেলে ফেলে দিল। স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ। বাসের আরোহীরা সবাই দেখতে পেল। অবিশ্যি সবাই চট করে বুঝতে পারে নি, হঠাৎ ব্যাপারটা কি ঘটে গেল, কারণ ওই দরজাটার সামনেই তো যত জটলা।

পরে অবশ্য পারল বুঝতে।

বাসের আরোহীরা, আর বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরাও। ভদ্রলোকের হাতে একটা ভারীগোছের থলি ছিল। নেহাত চটের থলি নয়, সে জিনিস আজকাল আর বড় কেউ ব্যবহার করে না, বাদে রেশন আনা আর গমভাঙানো ছাড়া। চটের অথচ চটকদার এতো রকম থলি ঝোলা বাজারে মেলে যে, গরীবটরীব লোকেরা তাদের ভারবাহী চেহারা থেকে দীনহীন ভাবটা কমাতে পারে।

বুড়ো ভদ্রলোকের হাতে প্রিণ্টেড শাড়ির মত সৌখিন প্রিণ্ট করা রবার—কোটিং ক্যাম্বিসের ব্যাগ ছিল, বেশ ভারীগোছের। প্রায় বাসটা ছেড়ে দেবার মুখেই সেটা বয়ে তাড়াতাড়ি এসে উঠে পড়েছিলেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ উঠে পড়েছিলেন। পাদানীতে একটা পা, (ব্যাগ ছাড়া খালি হাতটা দিয়ে রডটা চেপেও ধরেছিলেন) এবং আর একটা পা বাসের ওপর তুলতে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় ঘটলো ঘটনাটা, মানে ছেলে দুটো ঘটালো।

দরজার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা হঠাৎ টুক করে চটি পরা একখানা পা তেরছা করে বাড়িয়ে দিল দরজার অপরদিকে, রডের দিকটায়। আর অন্য ছেলেটা, কাঁধটা ঝাঁকিয়ে, কনুইটা একটু তিনকোণা করে বাড়িয়ে দিল ভদ্রলোকের রড ধরা হাতটার দিকে।

অতএব ভদ্রলোককে মুখ থুবড়ে রাস্তার ওপর পড়ে যেতেই হল। ঠিক পুরোপুরি রাস্তার ওপরও নয়, কোমর থেকে পা অবধি রাস্তার ওপর, আর কোমরের ওপর থেকে শরীরের ওপর ভাগটা ফুটপাথের ওপর। তার কারণ বাসটা ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল।

সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি একটা হৈ—চৈ উঠল।

উঠবেই, মানুষ তো আর অমানবিক নয় যে, একটা বুড়োলোক বাসে উঠতে না পেরে, ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল, আর সেই দৃশ্যের দর্শকরা হৈ—চৈ করে উঠবে না? যারা রাস্তায় ছিল, তারা তো নড়েচড়ে এগিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ে দেখল ও মরেটরে গেল কিনা লোকটা।…

বাসের মধ্যেকার লোকেরা অবশ্য সিট বেদখল হয়ে যাবার ভয়ে দাঁড়ালো না। একখানা করে পা রাখবার মত সিটটাও তো দখলে রয়েছে। নড়ল না। শুধু গলা বাড়িয়ে যতটা সম্ভব দেখবার চেষ্টা করে পরস্পর পরস্পরকে জিগ্যেস করতে লাগল, ব্যাপার কী? কী হোল বলুন তো? কেউ পড়েটড়ে গেল না তো? ও, এই বুড়ো ভদ্রলোক? থলি হাতে?…রডটা চাপতে পারেনি, হাত ফসকে গেছে?…আঃ এইসব বুড়োলোকেরা কেন যে ভিড়ের বাসে চড়তে আসে। তাও আবার মোটঘাট বয়ে।

বেশীর ভাগ অ্যাকসিডেণ্ট নিজের দোষেই হয়। দেখতে পাচ্ছেন কিছু? মাথা—ফাতা ফেটে গেল না তো? গেলেই বা কি? শহরের রাস্তায় এ তো নিত্য ঘটনা! নিত্য কী মশাই, প্রতিক্ষণের বলুন। মানুষের জীবনের আর কোনো দাম আছে?

বাস ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে অবশ্য।

একটা লোক বাসে উঠতে না পেরে যদি রাস্তায় পড়ে গিয়ে থাকে, সে দেখবার দায়িত্ব বাসের নয়। রাস্তার লোকগুলো তাহলে আছে কী করতে?

তবে? যারা বাসে চড়ে রয়েছে, তারাই বা আর কী করতে পারে, আরো খানিকক্ষণ আলোচনা করে চলা ছাড়া।…বর্তমানের পৃথিবীতে জীবন কত অনিত্য, মৃত্যুটা কী সহজ, এমনই সব দার্শনিক ব্যাখ্যা করতে করতে যে যার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায়।

রাস্তায় পড়া লোককে রাস্তার লোকে দেখবে এটা নিশ্চিত বলেই বিবেকের দংশন অনুভব করে না কেউ। কিন্তু আশ্চর্য, একটা লোকও মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে না, টু শব্দেও না যে, দরজায় দাঁড়ানো ছেলে দুটো, বুড়োকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। স্পষ্ট দেখেছে সবাই, একেবারে সবাই না হলেও অনেকেই। কিন্তু বলবে কোন সাহসে? প্রাণের ভয় নেই? সমাজের সবচেয়ে ‘ভয়ঙ্কর’ জীবের সম্পর্কে স্পষ্ট কথা বলে ফেলার মত ভয়ঙ্কর দুঃসাহস কার আছে?

হ্যাঁ, আজকের সমাজে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এই ‘ছেলেরা’। সাপ, বাঘ, সিংহ, ভালুক, বোমা—বারুদ, আগুন কেউই ভয়ঙ্করতায় ওদের কাছে লাগে না। বড়বাজারের, গলায় কালো কারে বাঁধা রূপোর পদক পরা ‘কালু মিঞা’, ‘খোকা সর্দার’ ওদের কাছে খোকামাত্র। তাদের একদার নাম—ডাক, প্রভাব—প্রতিপত্তি এখন বাসি মুড়ির মত মিইয়ে গেছে এই ছেলেদের কাছে।

‘ছেলেই’ তো।

তাছাড়া আর কী বলা যায় ওদের? আর কোন পরিচয়ের মধ্যে ভরা যায়? ওই সুকুমারকান্তি, সুবেশ—সুকেশ সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ ছেলেগুলোকে তো ‘লোক’ও বলা যায় না…খুঁজে দেখলে হয়তো দেখা যাবে, বাড়িতে ওদের জামা—গেঞ্জি গুছিয়ে বেড়ায় মা কি দিদিরা এবং এখনো ওরা চকোলেট হাতে পেলে রীতিমত খুশী হয়ে ওঠে। …তাছাড়া—ওরা হয়তো উচ্চস্তরের সাহিত্য পাঠক, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত, রাস্তায় যেতে আলি আকবরের সরোদা কি রবিশংকরের সেতার কানে এলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে দোকান—টোকানের সামনে।

এদের কেউ কেউ হয়তো ব্রিলিয়াণ্ট ছাত্রও।

তবে?

তাহলে?

তাহলে, উদয়াস্ত রাস্তায় থাকে বলেই কিছু আর ওদের রাস্তার ছেলেদের মত ‘ছোঁড়া’ বলা চলে না। আবার ছোকরা বললে, এদের প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে, ভুল সংজ্ঞা দেওয়া হয়। অতএব এরা ‘ছেলে’।

যদিও এরা যে—কোনো ভয়াবহ ডাকাতির নায়ক হতে পারে। বিমান ছিনতাইয়ের হীরো হতে পারে অনায়াসে। পথচলতি মানুষের পিছন থেকে পিঠে ছোরা বসিয়ে দিয়ে, রুমালে হাত মুছে, কফি হাউসে গিয়ে বসে মৌজ করে কফি খেতে পারে এবং অতি অক্লেশে রাস্তায় পার্ক করে রাখা লক করা অ্যামব্যাস্যাডার গাড়ি লুঠ করে নিয়ে, চটপট রং নাম্বার পাল্টে ফেলে যা নয় তাই করে বেড়াতে পারে। তবু ওদের কথা বলতে হলে বলতেই হবে ‘ছেলে’।

আর এই বলার সময় ব্যবহারিক বাংলা ভাষা ‘কী দরিদ্র’ ভেবে দুঃখ করতে হবে। কিন্তু দুঃখ হলেও কাজ চালিয়ে তো যেতেই হবে।

যাক, রাস্তায় বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা দেখতে পেল ছেলে দুটোর কারসাজিতেই বুড়ো ভদ্রলোক পড়ে গেল কিন্তু সেকথা বলে হৈ—হৈ করে উঠবে এমন আত্মনাশা বুদ্ধি কার থাকতে যাবে?…ওরা পড়ে যাওয়া লোকটাকে ঘিরেই হৈ—হৈ করতে লাগল।

ভিড়ের মধ্যে থেকে টুকরো টুকরো শব্দ উঠছে ‘হাসপাতাল’ ‘অ্যাম্বুল্যান্স’ পকেটে ঠিকানা আছে কি?’ এই তো দোষ মানুষের। রাস্তায় মরলে, আইডেণ্টিফাই করাবার উপায় থাকে না’…’প্রত্যেকের উচিত পকেটে পরিচয়পত্র রাখা—

কিন্তু আপাতত লোকটার উচিত গতি করবার দায়িত্ব কার সেটা কারো মাথায় আসছে না। কিন্তু বেশীক্ষণ নয়, হঠাৎ দেখা গেল গোটাকতক ছেলেই যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এসে মুহূর্তে জটলাকে চিরে ফেলে সেই ফাঁক দিয়ে পড়ে থাকা লোকটাকে বার করে আনল, সাপটে তুলে বাগিয়ে ধরে।

ইতিমধ্যে যে একখানা ট্যাকসিও এনে ফেলেছে ওরা তাও নজরে পড়ে নি কারুর! নজরে পড়ল, বুড়ো ভদ্রলোককে তার মধ্যে ঠেলে তোলার সময়।

ওরা দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের গ্রাহ্যমাত্র করল না,—জিগ্যেসও করল না ব্যাপারটা কি। যা কথা নিজেদের মধ্যেই করল। মোটামুটি আস্তেই—’এই সুকুমার, তুই মাথার দিগটা ধর, আমরা পায়ের দিকে’—বিজু দেখিস, টানা—হ্যাঁচড়াতেই না বুড়ো পটল তোলে। বুড়োর মাথাটা মাইরী ঝুনো নারকেল’—ফেটে চৌচির হয়ে যাবার কথা, দিব্যি আস্ত রয়েছে—রক্তটা কিসের?

ও কিছু না, নাক—মুখ দিয়ে বেরিয়েছে…।

এমন ভাবভঙ্গী, লোকটা যেন ওদেরই সম্পত্তি, যা করাবার ওরাই করবে।

কিন্তু গাড়িতে ওঠানোর পর একটা অভাবিত ঘটনা ঘটল, প্রস্তুত ছিল না কেউ। দলের থেকে একটা ছেলে সরে এসে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে, দাঁড়িয়ে থাকা, মানে তখনো যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সামনে এসে বলে উঠল, আপনারা কেউ একজন সঙ্গে আসবেন না—কি দাদু?

আ—আমরা।

সবাই নয়, একজন কেউ? হ্যাঁ, একজন হলেও চলবে।

কেন? আ—আপনারা তো হসপিট্যালে নিয়েই যাচ্ছেন, আ—র—আর কী দরকার?

ছেলেটা দাড়ি—গোঁফের চাপের মধ্যে থেকে একটু মুচকি হেসে বলল, দরকার কিছু না, তবে আমাদের পক্ষে সুবিধে হতো। আপনারা তো গোড়া থেকে দেখেছেন ঘটনাটা।

আর একটা ছেলে বলল, আমাদের তো দাদু বাজারে তেমন সুনাম নেই, হসপিট্যালে নিতে চাইবে না হয়তো। হয়তো ভাববে, আমরা নিজেরাই খতম করে, পট্টি দিতে হসপিট্যালে নিয়ে গেছি…মানে ওইভাবেই তো অনেক সময় লাশ পাচার করা হয়।…

একেবারে সামনের লোকটার পিটটান দেবার উপায় নেই বলেই বোধহয় নিথর পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, পিছনের ওরা মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যায়।

যাবে না? কে না বুঝতে পেরেছে, ব্যাপারটার অর্থ হচ্ছে ‘সাক্ষী দেওয়া।’

‘আপনারা গোড়া থেকে দেখেছেন।’ ওরে সর্বনাশ!

কেউ কিছু দেখেনি বাবা। আগা—গোড়া—মাথা কিছু না। এ রাস্তা দিয়েই হাঁটেনি কেউ দশ দিনের মধ্যে।

বাজারে তোদের সুনাম নেই, তা যখন জানিস, তখন কেন নেই সেটা, তাও ভালোই জানিস। তবে? তবে তোদের সঙ্গে কে এক গাড়িতে উঠে মহানুভবতা দেখাতে হাসপাতালে ছুটবে মড়াটাকে নিয়ে।…

কী দাদু, স্ট্যাচু বলে গেলেন যে? যেতে সাহসে কুলোচ্ছে না? ভয়ের কিছু ছিল না দাদু। লাশ সঙ্গে নিয়ে ঠেলে হসপিট্যালে গিয়ে উঠলে, ব্যাপারটা কি আমাদের পক্ষে সুবিধের হবে?…যাক, যাবেন না তা হলে? আপনারা—আরেস সাবাস। সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল? এতোগুলো লোক বিলকুল হাওয়া? ঠিক আছে ঝুট—ঝামেলা হলে, ওই দোকানীবাবু রইল। ওর দোকান থেকে জল এসেছে। আচ্ছা দাদু, নোমোস্কার। এই বিজু, আর একটা ট্যাকসির কী হল? ওটার তো সবটা জুড়ে বুড়োর লাশ।

দুটো গাড়ি ভরে চলে গেল ছেলেগুলো।

যাবার সময় মুখ বাড়িয়ে ‘টা—টা’ বলে বেদম হাসির আওয়াজ তুলে গেল।

পাষণ্ড আর কাকে বলে?

যাচ্ছিস একটা মড়া কোলে করে, তার সঙ্গে ওই হাসি।…ছিঃ ছিঃ! আহা বুড়ো ভদ্রলোক কী কাজে বেরিয়েছিল।

এগুলো কিন্তু মনে মনে! পরস্পরকে বলা যাচ্ছে না।

হ্যাঁ, ভোজবাজির মত যারা হঠাৎ হাওয়া হয়ে গিয়েছিল, আবার তো ফিরে আসতে হচ্ছে তাদের বাস স্ট্যাণ্ডে। না এসে গতি কি? একটা বুড়ো রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে মরল বলে কি লোকের জীবনছন্দে তালভঙ্গ হবে?

তবে আহা—উহু না করে পারবে কী করে?

এসব বলছে পরস্পর পরস্পরকে, কিন্তু ওই ছেলেগুলো সম্বন্ধে? একটা কথা না।

একজন বুঝি বলতে যাচ্ছিল, ‘এই মস্তানবাবুরা এসব কাজে একপায়ে খাড়া—’

কিন্তু অন্য একজন ইশারায় থেমে যেতে বলল। প্রশংসাই হোক, আর নিন্দাই হোক, একই। ওদের প্রসঙ্গই বর্জনীয়। বাতাসে ওদের চর থাকে। অতএব কেউ কাউকে বলতে পারল না, ‘এই ছেলেগুলোর মধ্যে বাসের দরজায় দাঁড়ানো সেই ছেলে দুটোকে দেখলাম। স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ!’

শুধু মনে মনে তোলাপাড়া করতে লাগলো—আর ভাবতে লাগল, কতক্ষণে বাড়ি গিয়ে গল্পটা ফলাও করে বলতে পারবে।

আচ্ছা, এরকম করল কেন?

বুড়োর হাতের ব্যাগটায় কি কিছু খানদানী মাল ছিল? অনেক সময় এইভাবে বাজার বওয়া থলিটলি করেই ব্যবসার কারেন্সি নোটের বোঝা নিয়ে ব্যাংকে জমা দিতে যায় নিরীহ দারোয়ানরা। অথবা সোনার দোকানের মালিকরা দোকান গুটিয়ে নিয়ে ‘লকারে’ রাখতে যায়।

ছেলেগুলো নির্ঘাৎ আগে থেকে সন্ধান পেয়েছিল।

কে বলতে পারে, বুড়োকে সত্যিই হাসপাতালে নিয়ে যাবে, না থলিটা বাগিয়ে নিয়ে লাশটাকে ময়দানের আশপাশে কোথাও ফেলে দিয়ে যাবে।

যত রকম নৃশংসতা আর বীভৎসতা সম্ভব, তা ভাবা হচ্ছে ছেলেগুলো সম্পর্কে। কারণ ওরাই এযুগের সব থেকে ভয়াবহ জীব। ওরা না করতে পারে এমন কাজ নেই।

অথচ সব ছেলেরই একই সাজ। ঘরের ছেলেদেরও সাজের গুণে যেন পরের মত দেখতে লাগে। পথে—ঘাটে, বাসে—ট্রেনে যে চেহারা দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে, সেই চেহারার ছাঁদেই ছাঁচ।

সেই কোমল সুকুমার সদ্য তরুণ গালে চেষ্টা করে করে বানানো ঘন চাপ—দাড়ি—গোঁফ, সেই ঘাড়ে লতিয়ে পড়া, অথবা মাথার ওপর বাঁধা চুলের চাপ, আর সেই পলিয়েস্টার শার্ট, টেরিকট ট্রাউজার আর বহু বিচিত্র চপ্পল।

এটাই আদর্শ!

এটাই ছাঁচ।

‘নেই’ ঘরের ছেলেদেরও এই সাজের খাঁই।

এ—কি শুধুই ফ্যাসানের হুজুগ? না অবচেতনে অন্য কোনো রহস্য নিহিত? নিজেকে অন্যের কাছে ভীতিকর করে তোলার মধ্যে কি কিছু মজা আছে?

তা হয়তো আছে মজা।

অন্তত এই ছেলেগুলো রাস্তার ওই ভদ্রলোকদের ভীতি বেশ উপভোগ করলো।

পোড়া সিগারেটটা গাড়ির জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, মানস বললো, আমাদের সঙ্গে আসার প্রস্তাবে দাদুর আমাদের মুখটা কেমন হয়ে গেল দেখেছিলি বিজু? আহা, যেন সেই মাত্তর ইস্তিরি—বিয়োগের খবর নিয়ে টেলিগগেরাপ এলো।

বিজু খ্যা খ্যা করে হেসে বলল, আজ পর্যন্ত তো একখানা লাশ নাবাতে পারলাম না, তবু যে কেন এতো ভয়। দেখলো কি, যেন ভূত দেখলো।

সুকুমার বলল, যা বললি মাইরি। জ্যান্তে ভূত হয়ে বসে আছি। সেদিন ভাইফোঁটা নিতে দিদির বাড়ি যাচ্ছি শ্যামনগরে, বলব কি তোদের, রেলগাড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সারা গাড়ির প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে ঢেউ বয়ে গেল। ওই ভূত দেখার ঢেউ আর কি…মেয়েমানুষগুলো গলার হার—ফার ঢাকা দিতে শাড়ির কোণ গলায় টানছে, চুড়ি—বালা পরা হাতগুলো আঁচলের তলায় লুকোচ্ছে, বেটাছেলেগুলো চোরা চাউনি চেয়ে চেয়ে পুটপুট করে ঘড়ির ব্যাণ্ড খুলে খুলে পেণ্টুলের পকেটে চালান করছে, সে একটা দৃশ্য মাইরি। যেন ওই সব করলেই পার পাবি গাড়োলরা। দেখে মজাও লাগছিল মাইরি, আবার নিজের ওপর শালা ঘেন্নাও আসছিল।…নিরস্ত্র হয়ে দিদির বাড়ি যাচ্ছি নেমন্তন্ন খেতে,—

বিজু তেমনি ‘খ্যা খ্যা’ করে বলে, একেবারে নিরস্ত্র হয়ে? বিশ্বাস করতে বলছিস?

ওই তো! ওইটাতেই প্রাণে বড় দাগা লাগেরে। কেউ আর বিশ্বাস করে না। তোরাও না।

সুকুমার মুখ ফেরায়।

আহা—হা, মান করিস না, মান করিস না। কথার কথা বলেছি। তবে সত্যি নিরস্ত্র হয়ে বেরোনো ঠিক নয়। আমাদেরও আত্মরক্ষের দরকার আছে বাবা।

সুকুমার একটু হেসে বলল, সে যদি বলিস, সঙ্গে মামদোবাজী ছিল একটা। দিদির ছোট ছেলেটার সবচেয়ে লেটুস খেলা হচ্ছে মারদাঙ্গা। তাই ব্যাটার জন্যে একটা টয় রিভলবার নিয়ে যাচ্ছিলাম—

মানস দাড়ি—গোঁফের ফাঁকে তেমনি মুচকি হেসে বলে, সেইটাকে হাতে নিয়ে কথকনাচ শেখাচ্ছিলি বোধহয়?

সুকুমার মাথা নাড়ল।

গড প্রমিস মোনা, তখনও কিছুই করিনি। সবে রেলগাড়িতে পা ঠেকিয়েছি।…পরে অবিশ্যি—সুকুমারও মুচকি হাসল, প্যাণ্টের পকেটের মধ্যে থেকেই একটু লালুভুলু করে দেখালাম!…দরজার কাছ চেপে দাঁড়িয়ে আছি। কারুর নেবে যাবার উপায় নেই।

ওই তো শা—

বিজু বলল, এর নাম কি নিরস্ত্র?

সুকুমার পরিতাপের গলায় বলল, সে তো গরুগুলোর বেফায়দা ভয় দেখে রোখ এসে গেল। কিন্তু গোড়ায় যদি অমন না করতো, দিব্যি আড্ডা দিতে দিতে পলিটিকসের ছেরাদ্দ করতে করতে ওটুকু রাস্তা পার করে দিতাম।…মেজাজ খিঁচিয়ে দেয় মাইরি।

বিজু চোখ কুঁচকে বলল, গাড়িতে শুধুই গরু ছিল শা—দু’একটা হরিণী—টরিণী ছিল না?

ছিল বৈকি। তা ওই তো বললাম, আঁচল তলায় হাত ঢাকতেই ব্যস্ত।

বিজু ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের সিটের দিকে তাকিয়ে বলল, কি—রে মানকে, বুড়ো টেঁসে গেল না তো?

মানিকই বুড়োকে সাপটে ধরে সিটে বসে আছে।

এরা তিনজন সামনের সিটে ঠাসাঠাসি করে।

এ গাড়ির ড্রাইভার তাদের দোস্ত।

আরো একটা ট্যাক্সি নিয়ে আরো দু—চারজনকে নেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘এমারজেন্সি’তে ভর্তি করতে গেলে যদি গড়বড় করে, পৃষ্ঠবলটা দেখিয়ে দেবে।

লোকবল বড় বল।

মানিক বলল, না না, তেমন ঘাবড়াবার কিছু নেই মনে হচ্ছে মাথার চোটটা লেগে সেন্সলেস হয়ে গেছে।

মানস বললো, আর একটু কেয়ারফুলি কাজ করা উচিত ছিল রে মানকে। বুড়ো শুধু একটু ঘসটে পড়লেই কাজ মিটে যেতো।

এটা অঙ্ক কষা নয় মোনা।

নাঃ। তোর আর কোনদিনই জ্ঞান হবে না। এসব স্রেফ অঙ্ক কষাই।… পার্ক সার্কাসের মোড়ে সেদিন সেই হিড়িম্বার মতন দেখতে মহিলাটির ব্যাপার ভাব? পেটমোটা ব্যাগটা হাতে নিয়ে কী অহঙ্কারীর মতন রাস্তা ক্রশ করছিল মনে আছে? যেন নিজের বাড়ির বারান্দা পার হচ্ছে।…কিচ্ছু করেছিলাম আমি? স্রেফ ‘বুদ্ধু’ সেজে রাস্তা ক্রশ করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে আগু—পিছু করে পড়লাম মহিলার ঘাড়ে।…সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি এসে গেল ঘাড়ের কাছে।…হিড়িম্বা রাস্তায় পড়ে গেল। গাড়ি চলে গেল! কিন্তু হল কিছু তার? যা হয়েছিল ওই ‘লাশখানি’ নিয়ে আছাড় খাওয়ার জন্যে। অবিশ্যি ব্যাগটা হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। মনে আছে? বেশ কিছুদিনের মত রসদ জুটেছিল হিড়িম্বার ব্যাগ থেকে।

মনে আবার নেই? ব্যাগের মধ্যে ছিল না এমন জিনিস নেই। যাদুঘর বললেও হয়। কি কি ছিল রে বিজু?

আরে বাবা, সে তো চণ্ডী পাঠ থেকে জুতো সেলাই সব। ডাক্তারের প্রেসকৃপশন, দোকানের ক্যাশমেমো, লণ্ড্রীর বিল, ইনডেন গ্যাসের ভাউচার, নোভালজিন, ঘুমের বড়ি, টফি, সেপটিপিনের পাতা, মনিঅর্ডারের কূপন, স্টেট লটারির টিকিট, ব্যাঙ্কের পাশবই, একটা ইস্কুলের ছেলের মাইনের খাতা, কার যেন একখানা বিয়ের নেমন্তন্নর চিঠি।

উঃ সাবাস! বিজু। এতো মনে আছে তোর? ইস এই মেমারিটা লস যাচ্ছে। কোনো কাজে লাগছে না।…আচ্ছা, ওই ইস্কুলের মাইনের খাতা, আর ব্যাংকের পাশবইটা আমরা পোস্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম না?

হ্যাঁতো! তোর যে আবার সেদিন বিবেক উথলে উঠল। বললি, আমাদের তো এগুলো কাজে লাগবে না, অথচ যে হারিয়েছে, তার জীবন মহানিশা।

দ্যাখ বিজু, ভেবে সুখ পাই বিবেক—ফিবেককে ঝাড়ু মেরে সাফ করে ফেলেছি। কিন্তু মাঝে মাঝে কোথায় বসে যে পিন ফোটায়। সেদিন বাসে আর একটা মেয়ের হ্যাণ্ডব্যাগ সাফাই করে ভেতরে একটা নোটবুক পেলাম, বুঝলি। রাজ্যির ঠিকানা আর ফোন নম্বর লেখা…দেখে পেটের মধ্যে না বুকের মধ্যে কে জানে কোথায় যেন চিনচিন করে উঠল।…আহা নোটবুক হারানোর সঙ্গে সঙ্গে কত ভালবাসার সম্পর্কের যোগাযোগের রাস্তা হারালো বেচারী।…হয়তো পুরনো লাভারের ঠিকানা ছিল, কিম্বা নতুন প্রণয়ীর ফোন নম্বর।

এছাড়া আর কিছু মনে পড়ল না তোর। মাসি, পিসি, দাদু, দিদা এদের সব থাকতে পারে না? ইস্কুল—কলেজের সহপাঠী? তোর মাথায় এল ওই একঝাঁক প্রণয়ী?

দূর! তা কেন? ঝাঁকের মধ্যে দু—একটা। তাতে গোপন করে রাখা সুবিধে বলেই—যাক গে—নিঃশ্বাস ফেলল মানিক, সেটা তো পড়েই রইল!

তা, এতই যদি হাহাকার, দিলেই পারতিস পাঠিয়ে।

ওইখানেই তো বিউটি। এতোজনের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর আছে, নিজেরটা নেই।

তুই শালা একটা শুয়োর। কি করে জানলি নিজেরটা নেই?

আহা নিজেরটা তো ‘ইসপেশাল’ করে খাতায় পেরথম পিষ্ঠেয় লিখে রাখতে? প্রথম নম্বরই হচ্ছে কানপুরের একটা ঠিকানা। তারপরই হাওড়া রামরাজাতলা…এইরকমই ব্যাপার।

কলকাতার নেই?

থাকবে না কেন? শ’খানেক।

—তা’ যে—কোন একটা ঠিকানায় পৌঁছে দিলেই হতো। পেয়ে যেত।

পেয়ে যেত! মানে?

মানে অতি সোজা। যে পেতো, সে ঠিক লোককে পাঠিয়ে দিতো।

তোর কথাগুলো বিজু হান্ড্রেড পার্সেণ্ট গোলমেলে। সেই বা বুঝবে কি করে, কার খাতা তার হাতে এসে গেছে।

মানস আর একটা সিগারেট ধরিয়েছিল, সেটাও শেষ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, মিথ্যে খাটছিস বিজু, মানকের মগজের দরজা—জানালাগুলো টাইট দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে ভগবান। হাতের লেখা দেখে চিনবে না?…অন্য অন্য আত্মীয়বন্ধুদের নাম—ঠিকানা দেখে সিওর হবে না?…জানালা—দরজাগুলোর হ্যান্ডেল ধরে রোজ খানিকক্ষণ করে ঝাঁকুনি দিবি বুঝলি, কিঞ্চিৎ ঢিলে হয়ে যাবে।…দেদার দিসনি আবার বেশি ঢিলে হলেও মুশকিল। এই বাগিয়ে ধর। এসে গেছি।

গাড়ি মেডিক্যাল কলেজের গেট—এ এসে দাঁড়াল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *