জন্মভূমি মাতৃভূমি – ১৬

১৬

ওম্, পৃথ্বি ত্বয়া ধৃতা লোকা
দেবি ত্বং বিষ্ণুনা ধৃতা
ত্বং চ ধারয় মাং নিত্যং
পবিত্রং কুরু চাসনম্।

অর্থহীন ঘুমপাড়ানি গান। শুনতে শুনতে ঢুল আসছে। ঘুম আসছে। স্বপ্নের ঘোর। কোটি কোটি যোজন দূরের, ঊর্ধ্বের কোনও লোক থেকে আবহমণ্ডলের ধূলিজাল ভেদ করে অস্ফুট শব্দ। মাঝে মাঝে ঘণ্টাধ্বনির মতো গম্ভীর, অনুরণনময়, আবার মৃদু হয়ে যাচ্ছে, মন্দ্র হয়ে যাচ্ছে। অস্পষ্ট দৃশ্য। জলের তলায় বুঝি নাগলোকে মুণ্ডিতমস্তক বালক, শিখাধারী বৃদ্ধ। অভিনিবেশ সহকারে শুনছে একজন, বলছে একজন। ওরা কারা? নচিকেতা-যম? শ্বেতকেতু-উদ্দালক? সতত আবর্তমান জন্মমৃত্যুক্রমের কোন ঘূর্ণনপর্বে যেন ওদের সঙ্গে দেখা? ···নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেঽস্মিন সন্নিধিং কুরু। তোমার ব্যবহৃত আজকের এই জলে গঙ্গা-যমুনা-গোদাবরী সরস্বতী-নর্মদা-সিন্ধু-কাবেরী এই সপ্ত নদী এসে অধিষ্ঠিত হলেন। আসনশুদ্ধি, জলশুদ্ধির পর অর্থাৎ কিনা তোমার সমস্ত পরিবেশ পবিত্র করে নিয়ে তবে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করবে। শ্বেতপুষ্প, শ্বেত চন্দন, শ্বেত পরিধেয়, কৃষ্ণ তিল, শয্যা, কাংস্য পাত্র···রৌপ্য পাত্র··· ভোজ্য···।

সাদা শাড়ির আঁচল গায়ের ওপর টেনে জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিল আরাত্রিকা। বড়পিসি বললেন, ‘সব রকম ফল, সব রকম মিষ্টি, লুচি, ভাজা ধরে দিয়েছি। আর যা যা ভালোবাসত তোর বাবা, মনে কর মণি, যদি দিতে চাস।’

আরাত্রিকা রান্নাঘরে গেল, অরেঞ্জ পিকোর কৌটোটা পাড়ল তাক থেকে। হ্যাপিভ্যালি থেকে সরাসরি এসেছে এই চা। বাবার বিশেষ প্রিয়। টিউলিপ ফুলের মতো আকারের সাদা বোন চায়নার কাপে ঢালল সোনালি চা। ট্রেতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। রান্নাঘর আর হলঘরের মাঝখানের ছোট্ট পরিসরটায় দাঁড়িয়ে সে উন্মনা, গোটা হলঘর সুগন্ধে ভরে গেছে। কবে কোথায় যেন এমনি, ঠিক এমনি একটা দৃশ্য? গন্ধ? আরাত্রিকা বলল, ‘বড়পিসি আর একটু দাঁড়াও।’ ফ্রিজ থেকে গাঢ় কফি রঙের পানীয়র বোতল বার করল। স্বচ্ছ কাঁচের ছোট্ট পাত্রে মাপ করে ঢেলে দিল। মেক্সিক্যান লিকিঅর কালুয়া। সুচিত্রা বললেন, ‘এটা··· এটা দিবি মণি?’

আরাত্রিকা বলল, ‘দাও বড়পিসি।’

কলেজ থেকে সন্তোষ চ্যাটার্জি, বিকাশ সিন্‌হা, অনুপ মিত্র, সর্বেশ্বর দাশগুপ্ত আরও অনেকে এসেছেন। এসেছে জুলজি, বটানির ছাত্ররাও। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচুর সাদা গোলাপ সবার হাতে। বিকাশ সিন্‌হার হাতে মালা। ছোটপিসি সুরূপা সেগুলো হাত পেতে নিলেন, মৃদুস্বরে বললেন, ‘মণি, এগুলো রান্নাঘরের সিঙ্কে রেখে দিয়ে আয়। রক্তমাখা নোংরা ফুল পুজোর কাজে লাগে না।’ মহেশকে বললেন, ‘ওদিকের ঘরে গিয়ে ওঁদের মিষ্টিমুখ করিয়ে দাও গে মহেশ। শর্মি, টুলটুল, তোরাও যা, সাহায্য কর্।’

অগ্নিদগ্ধ ও আত্মীয়বান্ধবহীনদের জন্য প্রথম পিণ্ডটি দান করো। যেষাং ন মাতা ন পিতা ন বন্ধুর্নৈবান্নসিদ্ধির্নতথান্নমস্তি···। প্রযান্তি লোকায় সুখায় তদ্বত্।··· বিছোনো কুশের ওপর দক্ষিণ হস্তের তর্জনী আর অঙ্গুষ্ঠের মাঝখান দিয়ে পিণ্ডটি এমনি করে ফেলে দাও। হ্যাঁ। হাত ধুয়ে আচমন করো। এখন দক্ষিণ কর্ণ স্পর্শ করে বলো··· ওম্, পিণ্ডদানমহং করিষ্যে।··· বন্ধ চোখের সামনে কতকগুলো অস্পষ্ট ছায়া। আলো না ছায়া বোঝা যায় না। কম্পমান কতকগুলো চৈতন্যময় শিখা। অস্ফুট কণ্ঠে তারা হাহাকার করছিল, ‘সংকল্প দাও, সিদ্ধি দাও, প্রত্যয় দাও। আমরা তোমার ব্যর্থ পিতৃপুরুষ। তুমি পূর্ণ হলে তবে আমরা পূর্ণ হবো।’

সুকৃত বললেন, ‘নীতা, সেজবউদির য়ুনিভার্সিটি থেকে সব এসেছেন, ডাকো একবার।’

নীতা ভয়ে ভয়ে একবার তাকিয়ে বলল, ‘সেজদিভাই চোখ বুজিয়ে রয়েছে, আমি এখন ডাকতে পারব না।’

সুকৃত বললেন, ‘কর্মস্থলের ব্যাপার, খানিকটা ফর্ম্যাল তো হতেই হবে।’

নীতা চাপা গলায় বলল, ‘হতে হলে তুমি হও। ওঁরা এসে বসুন না। আমি বলছি বসতে।’

ফলের থালা, ফুলে ভর্তি তামার টাট, বিছোনো কুশ···সব কিছু পেরিয়ে কমলিকার কাছে পৌঁছনই দুষ্কর।

সুকৃত ডাকলেন, ‘সেজ বউদি! সেজবউদি!’

‘আঃ।’ আরক্ত চোখ মেলে তাকালেন কমলিকা। এরা যে কেন তাঁকে বিরক্ত করে এতো! তিনি এইমাত্র অগ্নিপ্রদক্ষিণ সেরে বসলেন। একটা হাতের মধ্যে আরেকটা হাত এখন। গম্ভীর গলায় কে আবৃত্তি করছে— ‘মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু, মম চিত্তং অনুচিত্তং তেস্তে ··· মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু, মম ব্রতে···’ কান ফেটে যাচ্ছে আওয়াজে। সভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেললেন কমলিকা। কার ব্ৰত? কেন ব্রত? কিসের?

সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ডক্টর সম্বরণ বোস সুকৃতকে বললেন, ‘ডাকবার দরকার নেই ভাই। যেমন আছেন থাকতে দাও। বড় ভালো মেয়ে। ডেকে সাড়া পাই নি এমন তো হয়নি কখনও!’

আরাত্রিকা অবাক হয়ে দেখল মায়ের সহকর্মীদের পাশ কাটিয়ে জ্যোতিকাকু ঢুকছেন। একবার বাবুর দিকে তাকালেন, একবার বেদীর ওপর ছবিটার দিকে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল আরাত্রিকা, ‘জ্যোতিকাকু তুমি?’

ডানহাতে আরাত্রিকাকে জড়িয়ে ধরে জ্যোতির্ময় বললেন, ‘তোর মা কই?’

‘মা’—ফিসফিস করে ডাকল আরাত্রিকা—‘মা, জ্যোতিকাকু এসেছে।’

খুব সুন্দর স্বপ্ন-শংকা-সম্মোহঘন আলো জ্বলছিল ঘরে। ঘর ভরে যুঁইয়ের গন্ধ। যে শানাই থেমে গেছে, ভিজে হাওয়ায় এখনও তার চাপা রেশ। মুক্তোর আংটি পরিয়ে দিচ্ছেন সুদীপ ডান হাতের অনামিকায়। সেই হাত জোর করে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে হল কমলিকাকে। অনেকক্ষণ বসে বসে পা ধরে গেছে। মণি সাবধানে ধরে ধরে নিয়ে এলো। সুদীপের ঘরে বসে আছেন জ্যোতির্ময়। কমলিকা আসতে উঠে দাঁড়ালেন।

‘কুমু!’

ক্লান্ত গলায় কমলিকা বললেন, ‘দীপালি কোথায়? দীপালিকে আনলে না?’ হাতদুটো সামনে বাড়িয়ে শূন্য চোখে কাকে খুঁজছেন কমলিকা? সুদীপকে? না দীপালিকে? জ্যোতি হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মণি দেখল মা বালিশের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে। শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছে। সে ফিসফিস করে ধরা গলায় বলল, ‘জ্যোতিকাকু, তুমি এখন কোথাও যেও না। মা এতদিনে এই প্রথম কাঁদল।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *