জন্মভূমি মাতৃভূমি – ১৫

১৫

সুদীপ আজ একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেলেন। কমলিকাকে বলে রাখলেন ফিরতে একটু দেরি হতে পারে, জরুরি মিটিং আছে।

কমলিকা বললেন, ‘তোমাদের সেই ইনটার্মিনেব্‌ল জি. বি. মিটিং? তাহলে আমি আজ সোজা ভবানীপুর চলে যাবো।’

‘বেশ তো মণিকেও নিয়ে যেও, যদি পারো।’

চৌরঙ্গিতে ভীষণ জ্যাম। মেট্রো চালু হয়ে গেছে টালিগঞ্জ থেকে এসপ্লানেড পর্যন্ত। তা-ও কিন্তু ধুলো কমেনি। দারুণ গ্রীষ্ম এখন, ধুলো উড়ছে ঘুরে ঘুরে। গাছপালাগুলো ময়লা। যেন অনেকদিন না-কাচা জামাকাপড় পরে রয়েছে। পিচের ওপর গাড়ির চাকার দাগ। অর্থাৎ এরই মধ্যে পিচ গলেছে। মহেশকে আজ কিভাবে সময়টা দেবেন ভাবছিলেন সুদীপ। ও তো হোল-টাইমার নয়। অন্যত্রও কাজ আছে। খানিকটা ভেবে নিয়ে বললেন, ‘তুমি আজ সাড়ে সাতটা নাগাদ আমায় তুলতে যেও। পারবে তো?’

মহেশ বলল, ‘ঠিক আছে স্যার। আমার একটু দেরি হয়ে যেতে পারে। মজুমদার সাহেবের কাছ থেকে ফিরতে সাধারণত পৌনে আট হয়।’

কলেজে গাড়ি ঢুকতে সুদীপ অবাক হয়ে দেখলেন নতুন রং-করা ঝকঝকে কলেজ বিল্ডিং-এর সমস্ত দেয়ালে বিশ্রী হাতের লেখায় স্লোগান লেখা। “কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও”, ‘জবাব চাই, জবাব চাই’, ‘মুর্দাবাদ, মুর্দাবাদ’, ইত্যাদি কিছু মার্কামারা শব্দ সাঁজোয়া গাড়ির মতো চোখের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। গতকাল বিকেলেও তো এসব ছিল না! তবে কি রাতে লিখেছে! কলেজ-গেট খোলা পেল কোথা থেকে? কেয়ার-টেকার-কাম-দারোয়ান বাহাদুরকে জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে! আগে কলেজে কোনও কেয়ার-টেকার ছিল না। তিনিই বাহাদুরকে কেয়ার-টেকার পদে প্রমোশন দিয়ে কলেজের ভেতর কোয়াটার্স দিয়েছেন।

সব কটি রাজনৈতিক দলের ছাত্রশাখা আছে তাঁর কলেজে। ক’মাস আগে ইউনিয়নের নির্বাচনে ওরা যে-সব পোস্টার লাগিয়েছিল সেগুলো আগেকার চুক্তিমত লোক দিয়ে খুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এখন হঠাৎ এরকম লেখার মানে কি? কোনদিকে না তাকিয়ে রাগত মুখে সুদীপ নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। বেয়ারা শ্যামাকে বললেন বাহাদুরকে ডেকে আনতে। শ্যামা খবর আনল বাহাদুর নাকি রাতে বহোৎ বেমার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, ওর জেনানাও সেখানে। ছোট ছেলেটা হাতে ছুটির দরখাস্ত রেখে গেছে। ছাত্রনেতা সমীরণ ঘরে ঢুকল, ‘আসব স্যার?’ টেবিলের ওপর একটা লম্বা কাগজ মেলে ধরে বলল, ‘আমাদের বারো দফা দাবির মেমোরান্ডাম আপনার কাছে দিয়ে যাচ্ছি স্যার, জি. বি.র সব মেম্বারদের কাছে কপি পাঠানো হয়ে গেছে।’

হঠাৎ বোমা ফাটার মতো ফেটে পড়লেন সুদীপ, ‘দেয়ালে আলকাতরা দিয়ে স্লোগান লিখেছ কেন? তোমাদের সঙ্গে কী চুক্তি ছিল আমার?’ পেছু হঠতে হঠতে সমীরণ বেরিয়ে গেল। চোখে এখন কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেন না সুদীপ। সামনে বারো দফা দাবীর কাগজটা পড়তে পারছেন না। হাঁফ ধরছে। চুপ করে বসে আছেন। সামনে ক্রোধের অন্ধকার।

বৃদ্ধ উমেশ ভট্টাচার্য ঘরে ঢুকলেন। দুজনেই চুপচাপ বসে আছেন। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে উমেশবাবু বললেন, ‘আজকের দিনটা একটু সাবধানে কথাবার্তা বলবেন ডক্টর মুখার্জী।’

‘কেন বলুন তো?’

‘হাওয়া ভালো নয়। ছাত্রদের মধ্যে খুব উত্তেজনা। আসবার সময়ে, দেয়ালে কী লেখা আছে দেখেছিলেন?’

‘কি সব কালো হাত টাত দেখছিলুম বটে। সর্বদা সর্বত্র যেমন থাকে···।’

‘হ্যাঁ লিখেছে “সি আই এ-র কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও” ওই সি আই এ-টি কে জানেন? আপনি।’

‘কেন? স্টেটস্ থেকে ফিরেছি বলে?’ সুদীপ শব্দ করে হাসলেন।

‘সেইরকমই রটানো হচ্ছে।’

‘রটানো হচ্ছে কী রকম।’

‘ডক্টর মুখার্জী আপনি বড়ই সৎ এবং সরল মানুষ। নিজের ঘরটিতে বসে মুখ বুজে কাজ করে যান। ওদিকে স্টাফরুমে কি হয় না হয় খোঁজ রাখেন না। তার সুযোগ নিয়ে এরা নানারকম গণ্ডগোল পাকাবার চেষ্টায় আছে।’

‘কেন উমেশদা! টীচারদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হবার কোনও কারণ তো ঘটেনি?’

‘বাঃ, আপনি প্রতিদিন বার দুই করে করিডোরে টহল দিচ্ছেন। অধ্যাপকদের সময়মতো ক্লাসে যেতে হচ্ছে। ছাত্ররা গুলতানি করার সুযোগ পাচ্ছে না। পারচেজ, নিজের হাতে রেখেছেন। কোটেশন দেখে দেখে নিত্য নতুন পার্টি বহাল রেখেছেন। আপনি আসার আগে সন্তোষ আর ওই বিকাশ ছোকরার মধ্যে প্রিন্সিপালের পোস্টটা নিয়ে লড়াই চলছিল। কারোরই হয়নি। দুজনেই আপনার ওপর ক্ষেপে আছে।’

‘সন্তোষদার ব্যাপারটা আমি আন্দাজ করতে পারি অবশ্য। কিন্তু উনি বয়সে বড়। ওঁর সঙ্গে মোটামুটি আলোচনা করেই তো আমি চলি!’

‘কোথায় চলেন? বিকাশ সিন্‌হার বকেয়া আটকে রাখতে বলেছিল সন্তোষ, শুনেছিলেন?’

সুদীপ আর কথা বাড়ালেন না। এই ঘৃণ্য কূট-কচালি আর ভাল লাগছে না। ছাত্রদের দাবীর ওপর চোখ বুলোতে লাগলেন।

ছাত্রদের রাজনৈতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ চলবে না।

কলেজ বিল্ডিং সাধারণের সম্পত্তি, অধ্যক্ষের পিতৃসম্পত্তির মতো ব্যবহার করা চলবে না।

ফিজিক্সে খারাপ রেজাল্ট-এর কৈফিয়ত চাই।

সরকারী গ্রাণ্টের সিংহভাগ অধ্যক্ষের ডিপার্টমেণ্টে যায় কেন?

বহিষ্কৃত ছাত্র সর্বশ্রী অংশুমালী রায়, ধীমান শিকদার ও সুধন্য হোমচৌধুরীর ওপর থেকে বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক।

বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল ছাত্রদের ক্লাসে তুলে দিতেই হবে।

সুদীপের মাথায় আস্তে আস্তে রক্ত চড়তে লাগল। কয়েকমাস আগে ছাত্র-ইউনিয়নের নির্বাচন উপলক্ষ্যে কলেজের করিডরে এরা সোডার বোতল ছোঁড়াছুঁড়ি করেছিল। ক্লাস টুয়েলভের একটি বাচ্চা ছেলে সাংঘাতিক আহত হয়, অল্পবিস্তর আঘাত আরও অনেকেরই। পকেট থেকে ছুরি বার হয়েছিল ছাত্রদের। পুলিশে খবর দিচ্ছিলেন। অধ্যাপকরা হাতে-পায়ে ধরে থামিয়েছেন। তিনটি সবচেয়ে হিংস্র ছেলে, যারা হাতেনাতে ধরা পড়ে তাদের তিনি এক্সপেল করেছিলেন। কোনরকম চাপে পড়েই তিনি আর এদের কলেজে ঢোকার অনুমতি দিতে পারেন না। এদের পকেটে ছুরি ছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল নিষিদ্ধ নেশার ট্যাবলেট। এই হল তাঁর রাজনৈতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। কলেজ-বিল্ডিং পরিষ্কার রাখবার চেষ্টা করছেন, অতএব সেটা হল সর্ব সাধারণের সম্পত্তিকে নিজের সম্পত্তির মতো ব্যবহার করা। শিক্ষক-সংসদের মিটিং-এ প্রায় প্রত্যেক অধ্যাপক মত দেন বার্ষিক পরীক্ষা আটকানো যবে থেকে উঠে গেছে সেদিন থেকে ছাত্রদের মধ্যে বিশৃংখলা, পড়াশোনার অমনোযোগ দেখা দিয়েছে। তারা নিয়মিত ক্লাস করে না। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে পর্যন্ত গাফিলতি করে। সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয় বার্ষিক পরীক্ষায় এবার থেকে স্ক্রীনিং হবে। সেশনের শুরুতেই ছাত্রদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, ক্লাসে ক্লাসে সার্কুলার ঘোরানো হয়েছিল তিনদিন। বায়োলজি, জুলজি, বটানি—এসব ডিপার্টমেণ্টে রেকারিং এক্সপেন্স বেশি হবেই। তার ব্যাখ্যা হল অধ্যক্ষের ডিপার্টমেন্ট সরকারী অনুদানের সিংহভাগ পায়।

কাগজটা মুড়ে চাপা দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন সুদীপ। বেলটা বাজালেন একবার। মিটিং-এর জন্য আজ তিনটে থেকে ক্লাস বন্ধ। শ্যামাকে বললেন নোটিসটা ঘুরিয়ে এনে সন্তোষবাবুকে একবার ডেকে আনতে।

কিছুক্ষণ পরে শ্যামা এসে বলল, ‘আসেননি স্যার।’

শিক্ষক সংসদের সেক্রেটারি অনুপ এবং চারজন শিক্ষক প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠালেন সুদীপ। আধঘণ্টা খোঁজাখুঁজি করে এসে শ্যামা বলল, ‘কেউই আসেননি এখনও। সামনের টেবিলে, কাচের তলায়, আজকের টাইম-টেবল পড়ে রয়েছে, সুদীপ দেখলেন পাঁচজনেরই আজ ফাস্ট কিংবা সেকেন্ড আওয়ারে ক্লাস।

তিনটের সময়ে যখন গভর্নিং বডির মিটিং আরম্ভ হল তার মিনিটখানেক পরেই এসে ঢুকলেন চার শিক্ষক প্রতিনিধি। ছাত্র-প্রতিনিধি সমীরণ বলল ‘আমাদের বারো দফা দাবী নিয়ে আলোচনাটা আগে হোক।’

সুদীপ বললেন, ‘ওটা তো আমার হাতে পৌঁছেছে মাত্র আজ। অ্যাজেন্ডাভুক্তই করবার সুযোগ পাইনি। পরের বারে ওটা নিয়ে আলোচনা হবে।’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের বাইরে থেকে একটা তুমুল গোলমাল উঠল। বেশ কিছু উত্তেজিত ছাত্র ঢুকে পড়েছে ঘরে। প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়ালেন, রাগত গলায় বললেন, ‘তোমরা বাইরে যাও। বিশৃংখলার সৃষ্টি করো না।’

ছাত্রদের মধ্যে থেকে রব উঠল, ‘সি আই –এ-র দালাল নিপাত যাক।’ সমীরণ হাত উল্টে বলল, ‘ওরা আনরুলি হয়ে গেছে স্যার, ওদের কথা না শুনলে মিটিং চলতে দেবে না।’

প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমরা মিটিং মুলতুবি রাখছি।’

সারবেঁধে বেরোতে লাগলেন সবাই। সুদীপ দেখলেন ছাত্রদের ভিড়ের ঠিক প্রথম সারিতেই রক্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে সেই তিন ধনুর্ধর—অংশুমালী, ধীমান আর সুধন্য। কলেজ কম্পাউন্ড ভর্তি খালি কালো কালো মাথা। সবাই বেরিয়ে যাবার পর সুদীপ দেখলেন তাঁর বেরোবার পথ বন্ধ। কয়েক পা হটে এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়তে হল তাঁকে। সমীরণ চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি ঘেরাও হলেন স্যার, যতক্ষণ না আমাদের কথা দিচ্ছেন এদের ওপর থেকে বহিষ্কারের আদেশ তুলে নেবেন, অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রদের তুলে দেবেন ততক্ষণ এই ঘেরাও বহাল থাকবে।’

সুদীপ চুপ করে বসে রইলেন। প্রেসিডেন্টসমেত গভর্নিং বডির সদস্যরা এই জটলার বাইরে আছেন, তাঁরা যা হয় করুন। হাতের সামনে অনেক ফাইল রেখে গিয়েছিল শ্যামা। সেইগুলো দেখতে লাগলেন সুদীপ। ওভারহেড ট্যাঙ্ক বসানো হবে একটা। চারতলায় একসারি টয়লেট। নতুন কমনরুমের ছাদ ঢালাই হবে, চিঠিপত্র, কোটেশন। ফার্নিচারের বিল এসেছে অনেকগুলো। শুধু সই করে দিলেই চুকে যায়। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অনেক সময়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেলাতে লাগলেন সুদীপ সেগুলো। মন দিয়ে কাজ করছিলেন। হঠাৎ মনে হল নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। বিশ্রী গুমোট, ভ্যাপসা গরম। ঘামের দুর্গন্ধ। মুখ তুলে দেখলেন ছাত্রদের ব্যূহটা প্রায় তাঁর গায়ের ওপরে। হাওয়া ঢুকছে না সেই গরম বৃত্তের মধ্যে। কয়েকজন সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার ওপরে উঠে বসেছে। তিনি ফোনটা তুলে নিলেন। ধীমান লাফিয়ে এসে ফোনের তার কেটে দিল। হাতে চকচকে ছুরির ফলা। তাঁর দিকে চেয়ে বলল, ‘সময় খুব খারাপ স্যার, এক্সপেল করে আমাদের কেরিয়ার নষ্ট করে দেবেন না বলছি। এখনও সময় আছে।’

সুদীপ বললেন, ‘এক্সপেলই করেছি, রাসটিকেট তো করিনি। অন্য কলেজে যাও।’

‘কেউ নিতে চাইছে না। আপনার এক্সপালশন অর্ডার আছে সবাই জেনে গেছে।’

সুদীপ বললেন, ‘তোমাদের কাছে আমি চেয়েছিলুম তোমরা লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করো, আর কখনও এসব করবে না কথা দাও। সেটা তো করোনি!’

ধীমান বলল, ‘হীট অফ দা মোমেন্ট কি হতে কি হয়ে গেছে, কথা কি করে দিই স্যার, কথা-টথা দেওয়া সম্ভব নয়। বাড়াবাড়ি একটু হয়ে গিয়েছিল। সে না হয় মাপ চাওয়া গেল।’

‘মাপটা লিখিতভাবে চাও। সেটার রেকর্ড রাখতে হবে আমাকে। আর তোমরা কথা না দিলে আমার পক্ষেও কোন কথা দেওয়া সম্ভব নয়। হীট অফ দা মোমেন্টে সোডার বোতল কি আকাশ থেকে পড়ে? ছুরি মাটি থেকে গজায়? যাই হোক, আমার আর দেরি করিয়ে দিও না। এ নিয়ে অন্যান্য অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলি, তারপর ছাত্রপ্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসা যাবে। আমাকে প্রেশার দিয়ে কিছু করিয়ে নেবার চেষ্টা করো না।’

ভিড়ের মধ্যে থেকে কে চিৎকার করে উঠল, ‘তোর বাপ করবে।’

দু-একজন ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘এই কি হচ্ছে? এটা কি হচ্ছে?’

সুদীপ সামনের টেবিলটা জোর করে ধরে নিজেকে সামলালেন। যতদূর দেখতে পাচ্ছেন খালি মাথা আর মাথা। তাঁর ঘরে যারা রয়েছে, সব বসে। বাইরে কিছু দাঁড়িয়ে, কিছু বসে। তাঁর সন্দেহ হল, এতো ছেলে, এরা কখনও তাঁর কলেজের নয়, বাইরে থেকে ভাড়াটে গুণ্ডা, মস্তান ডেকে এনেছে এরা। কলেজের একজন বেয়ারা, একজন লেকচারারকেও এদিকে আসতে দেখলেন না।

সাড়ে সাতটার সময়ে সুদীপ বাথরুমে যাবার জন্য উঠলেন। ধীমান লাফিয়ে এসে পথরোধ করে দাঁড়াল। সুদীপ বললেন, ‘বাথরুমেও যেতে দেবে না?’ হেসে উঠল ধীমান। সুদীপ আবার বসে পড়লেন। ঘড়ি দেখলেন। সাড়ে সাতটার সময়ে মহেশকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলেছেন। কি করছে কে জানে? এখন তাঁর হাতে এই একটাই মাত্র রঙের তাস। ছেলেটি করিৎকর্মা।

ঠিক আটটা বেজে সাঁইত্রিশ মিনিটে পুলিসের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। চমকে উঠে হিংস্র মুখে ধীমান তাঁর দিকে তাকাল—‘কখন পুলিসে ফোন করলেন?’

‘তুমি তো তার কেটেই দিলে, ইচ্ছে থাকলেই বা করতে পারলুম কই?’

ধীমান বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় বললে, ‘অনুপ মিত্তির, বিকাশ সিনহা, সর্বেশ্বর দাশগুপ্ত সব ব্যাটা মীরণ, মীরজাফর।’

অংশু কেটে কেটে বলল, ‘ওদের বানাতে হচ্ছে শালা নেক্সট টাইম।’

পুলিসের গাড়িতে উঠে বসেছেন সুদীপ। কলেজ কম্পাউণ্ডে একটিমাত্র জোর বাতি জ্বলছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন কেয়ারটেকারের ঘরে এখনও তালা। মহেশ এবং তাঁর নিজের প্রিমিয়ার পদ্মিনীর চিহ্নমাত্র নেই। ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা খবর পেলেন কী করে?’

‘আপনার ড্রাইভার মহেশ দত্ত হাতে-পায়ে ধরে নিয়ে এলো। না হলে আজ সর্বনাশ হয়ে যেত।’

সুদীপ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনও ফোন যায়নি? আর কেউ যায় নি কলেজ থেকে?’

ইন্সপেক্টর আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘কই না তো? আমার তো ধারণা কলেজ আওয়ার্সের পর, অফিস-টফিস বন্ধ হয়ে যাবার পর এই ব্যাপার। আপনারা কেউ-কেউ এতো কাজ-পাগল স্যার যে এ যুগে এদেশে ব্যাপারটা কেমন বেখাপ্পা ঠেকে। তা আপনার পার্সোন্যাল বেয়ারা কোথায়? কেয়ারটেকার? কাণ্ড দেখে পালিয়েছে না কি? ছি ছি!’

সুদীপ রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। চৌরঙ্গীতে পড়েছে পুলিশের গাড়ি। জীবনে এই দ্বিতীয়বার পুলিসের গাড়িতে চাপা। প্রথমবার চড়েছিলেন পুলিসভ্যানে। বাড়িতে চুরি হয়ে গিয়েছিল। বাসনপত্র, গয়না, বেশ কয়েকহাজার টাকার জিনিস। থানায় ডায়েরি করতে গিয়ে পুলিস ভ্যানেই ফিরেছিলেন। ছুটকি আর সুকৃতের সে কি লজ্জা!

বহুতল প্রাসাদটার সামনে গাড়ি থামতে আস্তে আস্তে সুদীপকে নামালেন ইন্সপেক্টার। ‘দেখুন স্যার, ঠিক আছেন তো?’

‘আছি বলেই তো মনে হচ্ছে।’

‘এখন অন্তত দশ দিন আর ও মুখো হবেন না। সতেরজনকে অ্যারেস্ট করেছি। তাদের ব্যবস্থা হোক আগে।’

সুদীপ ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আটকে রেখে আর কী করবেন? আরও ফেরোশাস হয়ে যাবে লাভের মধ্যে।’

‘আটকে রাখবো না? বলেন কী? নিজের চোখে আপনাকে অ্যাসল্ট করতে দেখেছি। কলার ধরে সাংঘাতিক ঝাঁকুনি দিচ্ছিল, কি যেন নাম বললেন ছেলেটির? ধীমান, না? দে মাস্ট সাফার ফর ইট।’

সুদীপ কিছু বললেন না। এখন আর কিছু বলতেও পারছেন না, ভাবতেও পারছেন না। এখন অনেক সিঁড়ি ভাঙার আছে। কমলিকার কাছে, মণির কাছে, বাবুর কাছে পৌঁছতে হলে এখনও অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হবে। পঞ্চাশটা ফ্ল্যাটের মালিক মিলে আবেদন করেছেন, ভয় দেখিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত কেস ঠুকেছেন, তবুও খাঁচার মধ্যে তৈরি লিফট্‌টা অনড়ই রয়ে গেছে, ওটার ব্যাপারে এখনও কিছুই করা গেল না। প্রত্যেকটা ল্যান্ডিং-এ থামতে থামতে দম নিয়ে ওপরে তাকাচ্ছিলেন সুদীপ। কত দূর? আর কতদূর? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ওই তো দাবার ছকের মতো সাদা-কালো স্কার্ট আর সাদা পোলো নেক ব্লাউজ পরে তাঁর প্লেটে খাবার তুলে দিতে আসছে মণি, মুখে দুষ্টু হাসি কিচেনের দরজার কাছে নীল জমিতে সাদা ফুল ছাপ শাড়ি আর ঘোর নীল এপ্রন পরে চায়ের ট্রে হাতে কমলিকা। অরেঞ্জ পিকোর গন্ধে মাতোয়ারা চারদিক! হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে খাঁচার মধ্যে বন্ধ লিফ্‌ট্ চালু হল। প্রথমটা পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার কষ্ট। শূন্যের পাতলা বাতাসে শ্বাস নিতে কষ্ট। তারপর আহ্! বিনা আয়াসে শাঁ শাঁ করে অনেক তলা ওপরে উঠে গেলেন।

ঠিক চার আর পাঁচতলার মাঝখানের চওড়া ল্যান্ডিংটার ওপর স্বামীকে পেয়ে গেলেন কমলিকা। সঙ্গে মহেশ, মণি, বাবু। বাহাদুর মানুষ! পৌঁছেই গিয়েছিলেন! শুধু একটুর জন্য বাড়ি অবধি ওঠা হয়ে উঠল না। কমলিকা দেখলেন—ডানহাতে আঁকড়ে ধরেছেন বুকের জামা। সিঁড়ির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে। রাস্তার দিকের ঝিলিমিলি দিয়ে তীব্র এক ফালি তির্যক আলো পিঠের ওপর পড়ে ছিটকে গেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে লিকলিকে একটা ছুরি কে বিঁধিয়ে দিয়েছে পিঠের ওপর। রক্ত ছিটকোচ্ছে। কথার কথায় বলতেন, ‘আমি খুব ভাগ্যবান মানুষ, কত পেয়েছি জীবনে! যারা পায় নি, যারা আমার চেয়ে কম ভাগ্যবান, তাদের জন্য কিছু করব না!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *