জগমোহনের মৃত্যু
গল্পের নাম ‘জগমোহনের মৃত্যু’ হলেও জগমোহন, সোমরা গঞ্জু ও বুলাকি তিনজনেই এই মৃত্যু দ্বারা অসম্ভব কিংবা সদাই সম্ভব সব পরিণামে উত্তীর্ণ হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটে সাতাত্তরের অক্টোবরে। কাহিনীটির একটি অলৌকিক দিকও আছে। সেটি এখন বুরুডিহা গ্রামের হনুমান মিশ্রের এখতিয়ারে। বস্তুত, বুরুডিহার সন্নিকটে সেই অক্টোবরে, দেবীপক্ষে যেসব অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে, তাতে হনুমানের শ্রেষ্ঠতা এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা অঞ্চলটিতে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ভারত ও ভারতবাসীর মন থেকে ছুয়াছুত ও নিম্নবর্ণ উৎপীড়ন বন্ধ করতে যাঁরা আইনের মাধ্যমে বদ্ধপরিকর, তাঁদের শিক্ষা দেবার জন্যেই ঘটনাটি ঘটেছিল বলে মিশ্র—সমর্থকরা বলে থাকেন। সেই মর্মে ব্রিজভূষণ ছত্রী লিখিত ‘জগমোহন কে অমর কহানী’ পুস্তিকাটি পাটনায় ছাপা হয় ও গোমো—ডালটনগঞ্জ লাইনের স্টেশনসমূহের কোথাও—কোথাও বিক্রি হয়। জগমোহন মন্দিরে স্বভাবতই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এ লাইনটি কেতাব বিক্রির লাইন নয়। গ্রামগুলি প্রাগৈতিহাসিক। অধিবাসীরা ভারত সরকারের মর্মপীড়ার কারণ। এই সব ওঁরাও, মুণ্ডা, হো ইত্যাদির লিখিত ভাষা—লিপি নেই। তারা দিনান্তের চীনা ঘাসের দানার ঘাটো জোগাড়ে হাজার বছর ধরে হাঁটছে। জগমোহনের কেতাব এই নিরন্ন নেংটেরা পড়বে না। অতএব কেতাবটি ভুরকুণ্ডা খালাড়ি পত্রাতু ইত্যাদি নয়া—ধনী শিল্পাঞ্চলে বিক্রি হয়। এই সব আদি অধিবাসীরা ভারত সরকারকে না—জেনে নানাবিধ মর্মপীড়া দেয়। উন্নয়ন দপ্তরকে ডিফাই করে এরা অনুন্নত থাকে। ছুয়াছুত সরকারের পছন্দ নয় জেনেও এরা উচ্চবর্ণকে ভয় পায়। দেশের ধনসম্পদে এদের অধিকার থাকাই সরকারের ঘোষিত বাসনা, তবু ম্যাঙ্গানিজ, বক্সাইট, মাইকা, লোহা, তামা, সিমেন্ট, কয়লা সব অনাদিবাসীদের হাতে তুলে দিয়ে এরা দূর থেকে অনাহারে শীর্ণ শরীর নিয়ে কলকারখানার শোভা দেখে। সবচেয়ে বিচ্ছিরি ব্যাপার হল, আকালের সময়ে দেশি ও বিদেশি প্রেস ফোটোগ্রাফার এলে এরা কেন যেন ছবি তুলতে দেয় এবং মানুষ নামের ক্যারিকেচার সদৃশ সে সব চেহারার ছবি বাইরে প্রচার হয়ে ভারত রাষ্ট্রের ইমেজ নষ্ট করে। আসলে এরা দুঁদিয়া খচ্চর। আগের রেজিমে জরুরি অবস্থার হুমকিতে এদের জীবনে আকাল ও খরার ব্যাপার চেপে দেওয়া গিয়েছিল। বর্তমান সরকার ল্যাকস বলে এরা সমানে নিজেদের দারিদ্র্য জানাবার সুবিধে নিচ্ছে। আশ্চর্য কি, এরা জাতকে জাত লোপ পেলে সরকার বাঁচে? ভারতের বহির্বিশ্বের খাদ্য রপ্তানির ব্যাপারটি বদমাশি মনে হয় না? যা হোক, বর্তমানে বুরুডিহা অঞ্চলে জগমোহনের বিদেহী প্রভাব অতীব সংক্রামক। কেতাবে সবই লেখা আছে। এই আটাত্তরে কর্পূরী ঠাকুরের জব রিজার্ভেশানের সদিচ্ছা বুমেরাং হবার পর জগমোহনের কেতাবে সে ঘটনাও অ্যাডেড হয়েছে। হবার পেছনের সদুদ্দেশ্য হল, জগমোহনের ঘটনাতেই প্রমাণ হল, ছোটলোক ছোটলোকই থাকবে। অ্যাবস্ট্রাক্ট ঈশ্বর, সমূর্ত কাশীবিশ্বনাথ, হনুমানদেও, রামজী অওতার সকলেরি তাই ইচ্ছে। এর পরেও কর্পূরী ঠাকুর লাফালাফি করতে গিয়ে হিন্দু দেবতাবর্গের হাতে হজিমতটি হলেন। কেতাবটি লাখে লাখে বিক্রি হয় এবং বুরুডিহা অঞ্চলের কাস্ট হিন্দু রমণীরা সেটিকে সাঁইবাবা ও সন্তাোষী মার ছবির সঙ্গে রেখে পুজো করেন। এইভাবে জগমোহনের মৃত্যুটি ক্রমে মালটিপার্পস হয়ে দাঁড়াচ্ছে কিন্তু তা পরে বিবেচ্য। জগমোহনের ব্যাপারটি জাতির জীবনে কত বড়ো ঘটনা, বিগত রেজিমকে ফিরিয়ে আনার পক্ষে কত বড়ো দিগদর্শক, তা কলকেতার মানুষ বুঝবেন না। কেননা তাঁরা কলকাতাকেই ভারতবর্ষ এবং নিজেদের সকল ভারতীয় মনে করেন। তাঁরা এ খবরও রাখেন না, জগমোহনের ব্যাপারে সরকারের ওপরমহলের বহুজন নূতন পথের আলো দেখেছেন এবং সরকারি সহায়তায় অচিরে জগমোহন কাহিনী চিত্ররূপ পেতে পারে। সেকুলার ইন্ডিয়া মানে যে উচ্চবর্ণ শাসিত ইন্ডিয়া এ সত্যটি সবাই জানেন, মুখে বলেন না, কাজে করে দেখান। সিনেমা হয়ে দেখা দিলে আইডিয়াটি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃতি পাবে। কেননা ফিলম না দেখলে ভারতের জনগণ কিছু শিখতে চায় না। দেশপ্রেম, মাতাল স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য ও প্রতীক্ষার প্রয়োজন, পুলিশের সততা, গরিবের জন্য ধনীর মর্ম—বেদনা। এ সব দেশেই আছে ও থাকে। কিন্তু ধর্মেন্দ্র বা হেমা মালিনী বা লতা মুংগেশকর সহায়তা না করলে ভারতীয়রা ভারতীয়ত্বের এ সকল এ—বি—সি—ও শিখতে পারে না। শোনা যাচ্ছে এ চিত্রে স্বয়ং তৈলঙ্গস্বামী এবং কাঠিয়াবাবা জগমোহন হাতির দেহে মিলবেন ও দেহ থেকে বেরোবেন। জগমোহন যে চতুষ্পদ বৃহৎ স্তন্যপায়ীমাত্র নয়, উক্ত মহাপুরুষদের গজরূপ, তা ওইভাবেই প্রমাণ হবে। নিরন্ন সোমরা, মাহুত বুলাকি ইত্যাদি চরিত্রে সর্বভারতীয় স্টার কাস্ট থাকবে। জগমোহন চরিত্রের জন্যে অভিনেতা পেলেই ছবি শুরু হবে। তবে হাতির চরিত্রে অভিনয় করতে কোনো ভারতীয় রাজি না হলে আমেরিকায় ফিলার পাঠানো হবে। যা হোক, ভবিষ্যতের কথা শিকেয় থাকুক। জগমোহন কাহিনীর গ্রাসরুটে প্রত্যাবর্তনই প্রার্থনীয়।
সাতাত্তরের অক্টোবরে, অন্যান্য অক্টোবরের মতো পালামৌয়ের জঙ্গল সরস বাঁশ ঝাড় ও অকেশ্যনাল বটগাছে সুশোভিত ছিল। বাঁশ বলতেই বাঙালিরা প্রবাদীয় বাঁশের পায়ুভেদ বোঝেন। কিন্তু বাঁশ ও বট দুটি গাছের পাতা ও কচি ডাল হাতির প্রিয় খাদ্য, তা সবাই জানেন না। জানা দরকার নয় বলে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের জেনে রাখা ভালো। তাঁরা যা যা জানেন, তাতে ভারত রাষ্ট্রের কিছু এসে যায় না। তাঁরা জানেন, বাঙালি হচ্ছে ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি এবং রাজনীতিতে সংগ্রামী কিন্তু তাতে ধানবাদের গুন্ডারাজ বা আচার্য ভাবের গোহত্যা নিবারণে অনশন প্রভাবিত হয় না। জগমোহনজাতীয় এক বৃহৎ ম্যামাল তাঁদের চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী ও ভারতে আবার জরুরি অবস্থা কায়েমের পক্ষে সহায়ক। হাতির বাঁশগাছ ও বটগাছ প্রীতি, ভারতে আবার বিগত রেজিম ফিরিয়ে আনার পরিবেশ সৃজনে সহায়ক হয়েছিল। কারণ, কাশীবাসী চরণদাস মোহান্তের কঞ্জুস স্বভাব। সে জন্যেই এত সব ঘটে গেল ও এক নূতন, এমার্জেন্সি—উজ্জ্বল এশিয়ার মুক্তি—সূর্যালোকিত ভারতভূমির সূচনা হল।
চরণদাস বহু মোহান্তের একজন। বেনারসে তার হাবেলি কে হাবেলি— বাস—ট্যাক্সি—সেবাদাসী—মোষ—দেহাতে জমি এবং চারটি হাতি আছে। হাতিগুলি তার স্টেটাস সিম্বল। কিন্তু হাতির খোরাক বিষয়ে তার আশ্চর্য নির্বেদ। বেনারস থেকে অদূরে গ্রামের বাড়িতে (পাকা বাড়ি ও চারতলা) স্থাপিত লক্ষ্মী—জনার্দনই হাতির কারণ, অথবা তাঁদের কারণেই হাতি। দোল, জন্মাষ্টমী ও দশেরাতে লক্ষ্মী ও জনার্দন হাতির পৃষ্ঠে চড়ে গ্রাম ও শহরতলি ঘোরেন ও প্যালা নেন। সে কারণে মাদী হাতি মোতি আছে। মোহান্তের হাতির খোরাক তাঁর ভক্ত প্রজারাই দিয়ে থাকে। বাকি তিনটি পুরুষ হাতিতে মোহান্তর একবারই দরকার পড়ে। রথযাত্রায় জগন্নাথ দর্শনে তিনি আঠারোনলা থেকে গজপৃষ্ঠে শহরে ঢোকেন। জগমোহন, গণেশ ও ঘনশ্যাম তিনটি হাতির পিঠে মোহান্ত ও সাঙ্গপাঙ্গরা বসেন। এছাড়া সম্বচ্ছর হাতি তাঁর কোনো কাজেই লাগে না। ‘হিউজ ফোর ফুটেড প্যাকিডার্ম’দের দেখলে তাঁর মোহান্তগিরির মতো ফায়দাজনক কারবারকে অলীক মনে হয়। ওদের আহার উনি কখনোই দেন না, তবু ‘হাতির খোরাক’ ভাবলেও তাঁর হৃৎকম্প হয়। গোরু—মোষ নয় যে খাওয়ালে দুধ দেবে। ট্যাক্সি বা বাস নয়, যে পেট্রল খাওয়ালে পয়সা এনে দেবে। পোষা মেয়েছেলে নয়, যে খাওয়ালে—মাখালে শয়নকালে মাংস—সুখ দেবে। বেগর—ফয়দা কারবারকে ‘হাতি—পোষা’ বলা হয়। এ তো আক্ষরিক অর্থে হাতি পোষা। হায়! সেদিন নেই, যে জরুরি অবস্থার সুখে হাতি দিয়ে দেহাতি ভাঙ্গি প্রজাদের ঘর মাড়াই করবেন, তাদের চাল থেকে খড় নিয়ে হাতি খাবে, গোলার ধান। অথচ মোহান্ত হবার বিপদ হল, চারটি হাতি ওকে রাখতেই হবে। তাই হাতি মরলে শোনপুরের মেলা থেকে ফিন ভি হাঁথি খরিদ করতে হয়। এটি না রাখলে বদনাম হয়। চরণদাস খুবই মডার্ন মোহান্ত। কিন্তু পিতৃপুরুষের স্থাপিত ঐতিহ্যটি অস্বীকার করতে পারেন না।
কিন্তু হাতি তো হাওয়া খেয়ে বাঁচতে পারে না। চরণদাসের ঠাকুরদা নিয়মিত হাতিদের পানফলের জিলিপি খাওয়াতেন। চরণদাস যাতে যাবজ্জীবন হাতিদের জিলিপি খাওয়াতে পারেন সেজন্যে তিনি হাবেলি পর হাবেলি উঠাকে রেখে যান। চরণদাস তাঁর ইচ্ছে পূর্ণ করেন না। কেননা কাশীমাহাত্ম্য বলতে কিছুই নেই এখন। উচ্চবর্ণের দাপট ছাড়া। সেটি আছে বলেই নিম্নবর্ণের মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে রগড়া খেয়ে যান। কিন্তু অন্যদিকে সব ডামাডোল। জিলিপি এখন চড়া দামে বিকোয়।
হাতিদের খাওয়ার ব্যাপ্যারটি মোহান্ত সুকৌশলে সেরেছেন। বেনারসে দুটি হাতি রাখেন। দুই ছেলের বিয়ে হয়েছে। মোহান্তর বেয়াইরা তাদের খাওয়া জোগান। শর্ত করেই বিয়ে দেওয়া। সে দুটি গণেশ ও ঘনশ্যাম, বাচ্চা হাতি। এখনো টেনে খায় না।
জগমোহন বুড়ো হাতি। তার মাহুত বুলাকিও বুড়ো। বুলাকি ফি বছর জগমোহনকে নিয়ে বেনারস থেকে পুরী যায়। সারাবছর ও যেখানে জঙ্গল পায় সেখানে হাতি চরাই করে বাঁশপাতা ও কচি ডাল এবং বটপাতা খাওয়ায়। পুরী থেকে ফিরে অন্য হাতিরা বেনারসে ফেরে। জগমোহন ফেরে না। মেদিনীপুরের পথে হেঁটে হেঁটে সে আবার পালামৌ বা চাইবাসার জঙ্গলে হারিয়ে যায়। চরণদাস জগমোহনকে যেমন খেতে দেন না, বুলাকিকেও তেমনি মাইনে দেন না। বুলাকি জগমোহনকে গ্রাম্য জোতদারের বিয়ের শোভাযাত্রায় ভাড়া দেয়, রাঁচি শহরে ছেলেপিলেকে পয়সা নিয়ে পিঠে চড়ায়। তাতে যা মেলে তা, চরণদাসের ধারণা হেভি মেলে, বুলাকি জানে কিছুই মেলে না। জগমোহন ও বুলাকি, দুজনের বয়সই সাতান্ন। আঠারো বছর বয়সে বুলাকি জগমোহনের মাহুতত্বে অ্যাপয়ন্টেড হয়। মাইনে ঠিক হয় দু—টাকা, খোরাকি ও বছরে তিনবার কাপড়—লত্তা। মাইনে কম বলা চলে না। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় দু—টাকায় এক মন চাল মিলত। বেনারসে দু—টাকার দাম অনেক বেশি ছিল।
কিন্তু কেন যেন, বুলাকিকে মাইনে দেওয়া আর হয়ে ওঠেনি। বুলাকিও চাইতে পারেনি, চরণদাসও দেয়নি। হাতি নিয়ে তখন শহরে বেরুনো এবং যে প্যালা পড়ত, বুলাকিও তার ভাগ পেত। জগমোহনের পুরুষকার সুবিদিত ছিল ও আশপাশের গ্রামীণ রহিস লোকেরা মাদী হাতি কিনলে মস্তির সময়ে জগমোহনকে নিয়ে যেতেন। তা থেকে চরণদাসের বিলক্ষণ কিছু আসত। কেননা রহিসগণ হাতির বাচ্চা বিক্রি করত ভালো দামে। জগমোহন খেটে মরেছে, বাচ্চা বেচেছে রহিসরা। চরণদাস টাকা পেত। বুলাকি পেত বকশিশ ও জামাকাপড়। জগমোহন পেত শীত আটকাবার কম্বল।
প্যাকিডার্মরা পরিবার নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। হাতি খুবই সংসারী ম্যামাল। জগমোহনের মুশকিল হয়েছিল, হাতি হয়ে তাকে হস্তিনীর গর্ভাধান করতে হত। কিন্তু হস্তিনীর গর্ভাবস্থা, তার শাবক জন্মালে তাকে দেখাশোনা করা এসব স্বাভাবিক কাজ সে করতে পায়নি। মানুষের প্রয়োজনে তার হস্তিত্ব সম্পূর্ণ হতে পেত না। বুলাকি তার ব্যথা বুঝত এবং ছুটকি—ছাটকি ঝি বা সস্তার রান্ডি ছাড়া তার স্বাভাবিক যৌনাকাঙ্ক্ষার কোনো পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট যেহেতু হয়নি, সেহেতু সে জগমোহনের সঙ্গে একটা আশ্চর্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়। জগমোহনকে সে মাঝেমধ্যে কিসসা বলে সান্ত্বনা দিত।
যেমন : ‘জানি তোর দুঃখ আছে। কী করবি বল? তু ভি মনিবের নোকর, আমিও। তুকে কী বলব? মনিবটো নিজে ভি লা—মরদ আছে। বচপনসে এত রান্ডির সঙ্গে লাটপাট করল, যে রাত—কি—কাম করতে পারে, লেকিন ওর গর্মিসে কখুনো বেটা পয়দা হয় না। পর—পর তিনটো সাদি করে নিল। কিছু পয়দা হল না। তখুন সাধু—সন্ত, ডাগদার—ইলাজ খুব করলে। আরে গর্মিতে জীউ নেই, হেকিম কী করবে? তাতে বনারসে খুব হাঁস উঠে গেল। তখুন মনিব ভাইকে বলল, ঘর কি লাজ, তু লঢ় যা। ভা ই ভি লড়ে গেল। বাস। আট বছরে তিন বহুর ঘরে সাত বেটা—বেটি পয়দা হল। জগমোহন। তু মরদ, হামি মরদ, লেকিন ও লা—মরদ, হম দোনোকো খরিদ করে লিয়েছে। তোর দুঃখ আমি বুঝি। ই সমঝ যা, আর দুঃখ মৎ কর।’
কাহিনীটি সত্যি বলেই তা কিসসা। জগমোহন এ কাহিনীর কতটা বুঝত কে জানে। তবে বুলাকি তার আত্মার আত্মীয় ছিল। চরণদাসের প্রয়োজনে এক আনরিয়াল জগতে বাঁচত বলেই জগমোহন বুলাকির ক্ষণিক অদর্শনে, রিয়ালিটি হারিয়ে গেল বলে বেজায় ভয় খেত। বুলাকি রান্ডি—বাড়ি গিয়ে মাঝেমধ্যে দু—তিনদিন ডুব মারলে সে খাওয়া ছেড়ে দিত। চরণদাস বলত ‘ওকে ছেড়ে যাবি না কখনো।’ এবং শোনা যায়, একবার হাতি চেপেই বুলাকি কোনো চার আনার রান্ডিবাড়ি গিয়েছিল। ফলে সেদিন বেনারসের সস্তার রান্ডিরা কুলকর্ম ভুলে সবাই এসে জগমোহনের শুঁড়ে গাঁদার মালা পরায়, পায়ে জল দেয় এবং খোল বাজিয়ে ‘গোকুলবানে শঁবরিয়া’ নামক ভক্তিগীতি গায়। বুলাকিকে তারা সেদিন সঙ্গকামী পুরুষ হিসেবে না দেখে, গডের এমিসারি রূপে দেখে এবং রান্ডিদের মালকিন বুড়ি গুলাবি সহসা, ‘বুলাকি কাঁয়? ই তো বাবা বিশ্বনাথ ছে’ বলে ভরের বশে মুচ্ছো যায়।
ঘটনাটি বেনারসে ব্যাপক প্রচার লাভ করে এবং দামি রান্ডি গাইয়ে বাইজি সকলের মহলেই বুলাকি জগমোহনকে ঘুরিয়ে বহু পতিতাকে ফর দ্য টাইম বিয়িং উদ্ধার করেছিল। উদ্ধারের পুণ্যকাজটি স্থায়ী হয়নি, তার কারণ বড়ো গভীর। স্থায়ী হলে, উক্ত রমণীদের দেহবেচা কাজটি ছাড়তে হত। ছাড়লে তারা খেত কী? খদ্দের পুরুষরাই বা কোথায় যেত? এ ঘটনার ফলে বুলাকির জীবনেও ফোর্সড অ্যাবস্টিনেনস ঘটে যায়। কেননা রান্ডিদের চোখে সে চিরতরে গডের এমিসারি হয়ে যায়। গডের এমিসারির সঙ্গে সুরাপান, মেটুলি ভোজন ও শয়ন—রমণে তারা রাজি হয় না, ‘নহী� নহী� দেওতা’ বলে প্রমাণ ঠুকতে থাকে। চরণদাসের ছুটকি দাসীরাও উক্ত রোগের সংক্রমণে ভোগে, এবং বুলাকি ফাঁপরে পড়ে স্বাভাবিক ইচ্ছার অকেশ্যনাল তৃপ্তি—সুখও হারায়। দু—হাজারি হাতি চেপে চার আনার রান্ডিবাড়ি গমনের এইসব আনফোরসিন সুদূরপ্রসারী ফললাভ ঘটে।
ফলে বুলাকি ও জগমোহন, দুই পোটেনট মেল আরও দুর্বোধ্য ও ব্যাখ্যা—অসাধ্য এক মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়। রহিসদের মাদী হাতিকে গর্ভাধান করাবার কাজে জগমোহন যখন মেতে থাকে, তখন বুলাকি স্বীয় বুদ্ধি খাটিয়ে সেইসব অঞ্চলে স্বীয় প্রবৃত্তি নিবৃত্ত করে আসতে থাকে। ফলে পরগৃহে জগমোহন ও বুলাকির আত্মজ ও আত্মজার সৃষ্টি হতে থাকে। কিন্তু সাতচল্লিশ সালের পর রহিসদের অবস্থা পড়ে। হাতি পোষা কমে যায়, জগমোহন ও বুলাকি সহসা দেখে তারা বেকার। এ সময়েই চরণদাস, জগমোহন ও বুলাকিকে ‘ওয়ানডারিং জু’ করে বেনারস ছাড়া করে। তারা বেরিয়ে পড়ে বটে কিন্তু চরণদাসের দাস হিসাবেই। লিবারেটেড বুলাকি, লিবারেটেড জগমোহনের পিঠে চেপে বেনারস ত্যাগ করলে, সামান্য মানুষ ও যন্ত্র জগতে বাতিল প্যাকিডার্মের সে যাত্রা এক কিংবদন্তীর বিস্তার লাভ করত। কার্যকালে তা হয় না। বুলাকি মাইনে পায় না। জগমোহন খাদ্য পায় না। কিছু না দিয়েই ওদের চিরদাস করে রেখে চরণদাস ভাগিয়ে দেয়। আষাঢ়ে পুরীধামে তিনদিন সার্ভিস দেবে এবং বাকি তিনশো বাষট্টি দিন নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করবে,—চরণদাসের এ অ্যারেজমেন্টে বুলাকি বা জগমোহন কোনো অন্যায় দেখে না। ব্যবস্থাটি মেনে নেয় ও সরে পড়ে।
বছর—কে—বছর ওরা বহু জায়গা ঘুরেছে। ক্রমে জঙ্গল কাটা পড়ছে, পথ—ঘাট হচ্ছে, বাস—মোটর চলছে। প্যাকিডার্ম ও মানবটির বিচরণ ক্ষেত্রও সীমিত হয়েছে। এখন বুলাকি ও জগমোহন, পালামৌ—চাইবাসা বেলটটিই বেশি পছন্দ করে। অল্পাহারে জগমোহন প্রায় কঙ্কাল। প্রায়শ অনাহারে বুলাকি মানুষের ক্যারিকেচার। কিন্তু জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরার ফলে জগমোহন নিজের রুট ট্রেস করতে পেরেছে। তার মস্তিষ্কের কোনো একটা অংশ জঙ্গলকে স্বগৃহ বলে চিনতে পারে এখন। বুনো হাতি দেখলে সে ভয় পায়। নগ্নপ্রায় আদিবাসীদের সে উপেক্ষা করে। তবু অরণ্যে সে স্বস্তি পায়। স্বস্তি পায় বুলাকিও। জঙ্গলে গ্রামগুলিতে গেলে জগমোহনও খেতে পায়, সেও ঘাটো, বাথুয়া শাক, ভেলিগুড় ইত্যাদি খেয়ে বাঁচে। আদিবাসীদের কাছে বছরে—বছরে সে এটুকু স্বীকৃতি পেয়েছে।
জগমোহন আগে, রাঁচি বা খালারি বা হাটিয়ারে ছেলেপিলেকে ‘জয় রাইড’ করতে দিত। এখন ও আর শহর বা মানুষ চায় না। বুলাকি বুঝতে পারে। দীর্ঘদিন অল্পাহার ও অনিয়মিত আহারে জগমোহন ভেঙে পড়ছে। নিজের দেহ টেনে চলতেও ওর কষ্ট হয়। বুলাকির খুবই ভয় হয়। জগমোহন মরে গেলে ও কী নিয়ে থাকবে? জলাশয় দেখলেই ও জগমোহনকে স্নান করায়। পয়সা পেলে ওকে লবণ, কলা ধান খাওয়ায়। কিন্তু তাতেও জগমোহনের চোখ থেকে সেই চাহনিটা যাচ্ছে না। চাহনিটা অত্যন্ত মানুষী, বেদনার্ত ও করুণাময়। চাহনি দিয়েই জগমোহন ওকে বলে, ‘অব মুঝে ছুটি কর দো ভৈয়া।’ বুলাকি চোখ ফিরিয়ে নেয়। জগমোহনই এই অসম্ভব আনরিয়াল জগতে তার একমাত্র রিয়ালিটি। আনরিয়াল জগৎ। যে জগতে বুলাকি মাইনে না পেয়েও চরণদাসের বান্দা হয়ে ঘুরে ঘুরে বৃদ্ধ ও শীর্ণ হয়। অনাহারে শীর্ণ হাতির সাহচর্যের চেয়ে বেশি কিছু পায় না। মানুষের, সামান্য মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন। সে জগৎ আনরিয়াল বই কি! রিয়ালিটি একমাত্র জগমোহন এবং জগমোহনের রুগণ নিশ্বাস। জগমোহন মরে গেলে বুলাকি কী করবে?
হতদরিদ্র পালামৌ ও চাইবাসাতেও ধনী রহিস আছে। মহাজন—জোতদার—বেনে—শুঁড়ি। তাদের বলে দেখেছে বুলাকি। কিন্তু জগমোহনকে নিয়ে তাদের কাছে থাকার প্রস্তাবে কেউ রাজি হয় না। জগমোহন যা খাবে, সেই বাঁশ ও বটপাতায় ওদের কোনো খরচ নেই। তবু ওরা রাজি হয় না। আজ বটপাতা খাবে, কাল যদি পাকা ধান খায়? ‘নহি জী, এ্যায়সান বেইমানি উ জানতা নহি’—বলেও লাভ হয় না।
কোনো গ্রামে দুদিন থাকলে, তিন দিনের দিন চলে যেতে হয়। ‘উ থোড়া আরাম মাংতা’ বলেও লাভ হয় না। শোনে না কেউ। বুলাকি জানে, আর পথ চলতে না হলে জগমোহন বাঁচে। কিন্তু তবু পথ চলতে হয়। গ্রাম প্রান্তর। ধুলো। জঙ্গল। গ্রাম। ‘হাঁতি চঢ়েগা? দশ দশ পয়সা?’ কথাগুলি প্রায়শ জলে যায়। কেননা দরিদ্র আদিবাসীদের, আধুনিক ও গতিমান ভারতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, বাউন্ডুলে প্যাকিডার্মের সংগ্রামের মতোই ভয়ানক ও হিংস্র। প্রতি মুহূর্তে তারা একসটিংশনের থ্রেটের মধ্যে বাঁচছে। বাড়তি দশ পয়সা বা হাঁথি চড়ার বাসনা ওদের থাকে না। কেন থাকে না, তা একটি সংলাপ থেকে বোঝা যাবে। সংলাপটি বুলাকি এবং যেকোনো আদিবাসীর। আদিবাসীটি গাঁওবুড়োও হতে পারে, পহান অথবা যেকোনো জন। আদিবাসীদের পুরুষ ও রমণীদের নাম, সাধারণত জন্ম বার মতে। ফলে পুরুষদের নাম এতোয়া, সোমাই বা সোমনা বা সোমরা, মংলি, বুধনা, বীরসা, শুকিয়া বা শুকচর, শুকদেও, শনিচর ইত্যাদির মধ্যে লিমিটেড। মেয়েদের বেলা তা এতোয়ারি, সুমি বা সোমনি, মুংলি, বুধনি, বিশি, শুকনি বা শুকচরি, শনিচরি। জন্মবার মতে নাম রাখা সাধারণ নিয়ম।
সংলাপটি এইভাবে শুরু হয়। বৃদ্ধ, অশক্ত, ক্লান্ত এবং উপবাসশীর্ণ জগমোহন কুঁচকোনো চামড়া, ঘোলাটে ও পিচুটি—কাটা চোখ, কুঞ্চিত ও শুষ্ক পুরুষাঙ্গ, ধুলো—মাখা দেহ নিয়ে গ্রামে ঢোকে। সতৃষ্ণ চোখে জলাশয় খোঁজে। তারপর, বাঁশপাতা বা লবণের মতো জলও পাবে না জেনে কোনো গাছের ছায়ায় দাঁড়ায়। সময়টি দুপুর।
এ সময়ে এবলবডিড সকল নর—নারী ও বালক—বালিকা পাথরকাটাই ছাগলচরাই, জোতদারের খেতচষাই জঙ্গলে ঠিকা কাজ, কোনো—না—কোনো কাজে বাইরে। খুব পরিচিত দৃশ্য হল, অশক্ত বুড়ো—বুড়ি ও অতি ছোটো ছেলেমেয়েরা ধুলোমাখা পাথরের মতো আদিম চেহারা নিয়ে চীনা ঘাসের দানা বের করছে। চোরকাঁটার চেয়ে একটু বড়ো ঘাসের মাথায় দানা। তার খোসা বের করা ওদের কাজ। সারাদিন পরিশ্রমে এক খুঁচি দানা মেলে কি না মেলে। তারপর তা জলে সেদ্ধ করে ঘাটো। জলীয়। লবণ মিললে গ্রেট লাকসারি।
বৃদ্ধ, অশক্ত, ক্লান্ত উপবাসশীর্ণ বুলাকি হাতি থেকে নামে ও এদের কাছে আসে। এই পরিবেশে, এমন দুপুরে, ঠিক এমটি লোকজনের কাছে সে বহুবার এসেছে। আসার পর, ছোটো ছেলেপিলে ও বুড়ো—বুড়িরা হাতি দেখে আকৃষ্ট হবে কিনা, তা নির্ভর করে অন্যান্য জিনিসের ওপর। বস্তুত, এ পৃথিবীতে সবকিছুই এ—ওর ওপর নির্ভরশীল। নাংলা গরিব গ্রামে হাতি ঢুকল। সবাই ছুটে এসে ভিড় করার কথা।
আগে করত। তখন বুলাকিরও খুব আনন্দ হত এবং হাতির পিঠ থেকেই ফ্লারিশ দিয়ে নামত। গ্রামটি চেনাজানা হলে সে চেঁচিয়ে বলত, ‘আ রে এতোয়া। তোহার লালোয়া গৈয়া জঙ্গলে ঘুসেছে রে।’ যেহেতু বুলাকিও ছেঁড়া ধুতি—পরা পাগলাখ্যাঁচা সেহেতু এদের মধ্যে সে সহজ বোধ করত। ট্যাঁকে পয়সা থাকলে এদের সঙ্গে মৌয়া খেত। কিছুদিন থেকে যেত। বিনে পয়সায় জগমোহনের পিঠে সকলকে চড়াত।
এরকম রিসেপশন সে তখনি পেত যখন পরপর কবছর ‘কালে বর্ষতু, পর্জন্যং পালামৌ শস্যশালিনী’ হয়েছে। বৃষ্টি হলে শস্য হয়। শস্য যায় জোতদার বা মহাজনের গোলায়। আদিবাসী খেতমজুররা মজুরি পায় না, কিছু পান—মাড়োরা—ভুট্টা পায়। খেতের ধুলো ও ঝাড়াই—খামের ধুলো ও ঝাড়াই—খামারের ধুলো জলে কেচে—ধুয়ে তারা কিছু শস্য পায়। তা ছাড়া, বৃষ্টি হলে জঙ্গলে ফল—কন্দ হয়, চীনা ঘাসের ঝাড় বাঁধে, জলে মাছ আসে। বৃষ্টিপাতের পর কোনো ফরেস্টবেলট গ্রামে এলে, বুলাকি গ্রামবাসীর চোখে সোৎসাহ অভ্যর্থনা পেয়েছে। এই ওঁরাও, কোল, হো উপজাতির মানুষরা বহুকাল ধরেই জানে, তাদের চাষে অধিকার, ভূমিতে বা শস্যে নয়। শ্রমে অধিকার, পারিশ্রমিকে নয়। ফলে বর্ষা হলেই তারা খুশি। অন্তত চীনা দানা মিলবে। তখন বুলাকিকে বলা যায়, ‘হাঁ, অনেকদিন বাদে এলে বটে। তিন সন আস নাই। শুনেছি রাঁচি জিলায় ঘুরতেছিলে। হাঁটিটো শুকায়ে গেছে, তোমার চেহারাতেও ভালো দেখি না। বল কি দেখে এলে বল। বস। জিরাও। টুকচে মদ খাও। ভালো দিনে এসেছ। আজই শজারু মারলাম তিনটা। কুণ্ডিতে নাহাও হাঁথিকে। লবণ ভি দিব ওকে।’
এই সানন্দ স্বাগতম পরিবেশে সঞ্চারিত হয় ও জগমোহন সানন্দে কুণ্ডিতে নেমে যায়, বটপাতা খায়, শুঁড়ে জড়িয়ে বাচ্চাদের পিঠে বসায়।
এখন, বহুকাল, বছর পাঁচেক বুলাকি আর সে অভ্যর্থনা পায় না, বৃষ্টির পরেও নয়। নকশাল ও জে পি আন্দোলন। দুই কারণে পুলিশ এইসব দূর দুর্গমও চষেছে। দিকু মহাজন—জোতদারের অত্যাচার চরমে উঠেছে। খরার প্রকোপে আকালও হয়েছে। আদিবাসী—উন্নয়ন আপিস শহরে। শহর অনেক দূর। সেখানে নিয়ন আলো ও ঘুরন্ত টেবিল—চেয়ার পর্যন্ত অরণ্য গ্রামবাসী যেতে পারে না। যাবার কোনো কারণও খুঁজে পায় না তারা। কেননা, আদিবাসী যখন দপ্তরে আপিসে যায়, তখনও কেন যেন তার, এবং ওই চেয়ারের মধ্যেকার দূরত্ব যোজন—যোজন থেকে যায়। ঘোচে না। মাঝেমধ্যে ওদের কেউ কেউ, কোনো গ্রামীণ প্রাইমারি মাস্টার, বা ফরেস্ট বিট অফিসার, বা অন্য কোনো অনুরূপ প্রশাসনে বিশ্বাসী লোকের উপদেশে রাঁচি গিয়েছে। বিনা টিকিটে ট্রেনে মান্ডার, সেখান থেকে রাঁচি, রাঁচি বহুৎ দূর অস্ত, অরণ্য গ্রাম থেকে সাঁইত্রিশ মাইল নয়, সাঁইত্রিশ লক্ষ মাইল। সেখানে আদিবাসী উন্নয়ন আপিস।
—কিছু জানি নাই, কিছু করি নাই, গ্রামে পুলিশ। পুলিশের খাইখরচ জগাতে পারি না।
—পুলিশ, মোদের বিটিছেলাদের ইজ্জত কেড়ে লিল। বললে কেউ মানে না।
—মহাজন বেঠবেগারি লেয়। আইন মানে না।
—মহাজন করজ কাটে, মাড়োয়া দেয় না।
—জঙ্গলে গাই চরাই, জ্বালানি কুড়ানো, মোদের হক!
—জঙ্গলের মৌয়াগাছে মোদের হক। ফরেস গার্ড শুনে না, খেদায়ে পয়সা লেয়!
—মহাজন জল দেয় না। পঞ্চায়েতি কুয়া।
নালিশ। নালিশ নালিশ। জানাতে জানাতে ভীরু—চোখে আপিসঘর ও অফিসারকে দেখা। অদৃশ্য দেওয়ালে মাথা ঠোকা। ফিরে আসা। আসার সময়ে বহু শিল্প—কারখানার কারণে ন্যুভেল রিশ রাঁচি শহরটি দেখা। আলো এবং যানবাহন এবং সিনেমাহাউস এবং মদের বার এবং সুসজ্জিত নরনারী। মাংসল কণ্ঠে ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানের অশ্লীল আক্রমণ। হাটিয়ারের পথে বীরসা মুণ্ডার ব্রোঞ্জের মূর্তি। মূর্তিটি সুউচ্চ বেদিকা থেকে ভাবলেশহীন চোখে অরণ্যের অধিকারে বঞ্চিত, দিকু—পুলিশ—মহাজন—সরকার ও জুডিশিয়ারি পিষ্ট তার সন্তানদের দেখে ও ব্রোঞ্জের বোবা ভাষায় বলে ‘ঘর ফিরি যা বাপ সকল। উলগুলান না হলে তুরাদের দুঃখ যাবেক নাই।’
নিঃশব্দ কণ্ঠটি হতাশ। জীবিত বীরসা জানত, উলগুলান হবে। মূর্তিটি জানে, উলগুলান হবে না।
আজ পাঁচ বছর ধরে রাঁচি—পালামৌ—সিংভূমের আদিম সন্তানদের জীবন জ্বলছে। আদিবাসীদের জীবনটা প্রাণদণ্ডের আসামি। মহাজন, জোতদার প্রশাসন, জুডিশিয়ারি সে জীবনের চার হাত পা, চারটে ঘোড়ায় বেঁধে, ঘোড়াগুলোকে চাবুক মেরে চারদিকে ছুটিয়ে দিয়েছে। জীবনের ধড়টা শেকল বাঁধা হয়ে পড়ে আছে। চার হাত পা ছেঁড়া, উৎপাটিত। ধড়টি ব্লিডিং টু স্নো ডেথ।
অথচ এরকম হবার কথা ছিল না। কেননা ভারতের সংবিধানে লেখা আছে, এই সকল উপজাতি ও আদিবাসীর সংখ্যা ত্রিশ মিলিয়ন।…দে শুড বি মেড টু এনজয় দি প্রিভিলেজেস অফ সিটিজেনশিপ অ্যানড শুড বি এবল টু টেক পার্ট ইন দি মেকিং অ্যানড স্ট্রেংদেনিং দি ডেমোক্রাটিক ইনস্টিট্যুশনস ইন দি কানট্রি। দে শুড রিয়ালাইজ দি ফুল অ্যাডভানটেজ অফ অ্যাডালট ফ্রানচাইজ। দে শুড এনজয় দি ফ্রুটস অফ লিবার্টি, ইকুয়ালিটি অ্যানড ফ্রেটারনিটি।
কার্যকালে দশকের পর দশক ধরে শব্দগুলি সংবিধানে শোভা হয়ে থাকে এবং আদিবাসীদের দুঃখ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার দপ্তর থেকে হতাশা নিয়ে ফিরে এসে আদিবাসীরা স্টেশনে উবু হয়ে বসে থাকে, ট্রেন ধরে, সাঁইত্রিশ লক্ষ মাইল হেঁটে গ্রামে ফেরে এবং অপরিচিত, হিংস্র আলোকোজ্জ্বল নয়া ভারত থেকে স্বীয় পরিবেশের অপরিমেয় অন্ধকারে ফিরে স্বস্তি পায়।
সে কারণেই ওরা বাইরের সব কিছুকে অবিশ্বাস করে। কিন্তু আদিবাসী অরণ্যজীবনে বহিরাগতের এনক্রোচমেন্ট অনিবার্য। ওরা জানে, দিকু, মহাজন, জোতদার, নকশালি বা জে. পি.পন্থী—সন্ধানী পুলিশ ওদের জীবনে ঢুকবে, ঢুকে গেছে। ওরা বিশ্বাস করতে পারে তাকেই, যে দারিদ্র্যেও শোষণে ওদের সমগোত্রীয়। খাদ্যে বঞ্চিত মৃতপ্রায় হাতি এবং মাইনেবঞ্চিত অর্ধমৃত বুলাকিকে ওরা সে জন্যেই বিশ্বাস করেছে।
এখন করে না। শক্তি নেই। এমার্জেন্সিতে জোতদার ও পুলিশ ওদের নিঃশেষ করে ছেড়েছে। চোখে এনে দিয়েছে মৃতের নিস্পৃহতা। শিশুরা, ওদের শিশুরা, অপুষ্টিতে—অনাহারে রোগে সবচেয়ে বুড়ো হয়ে গেছে। বুলাকির এখন, আদিবাসী শিশু দেখলে ভয় হয়।
আদিবাসী গ্রামে ঢুকলে এক ধরনের হিংস্রতার কারেন্টও বুলাকিকে চমকে দেয়। বুলাকির কাছে তার হাতি জগমোহন সবচেয়ে মূল্যবান। চরণদাস জগমোহনের মালিকানা ছাড়েনি, এবং সবরকম দায়িত্বে লাথ মেরেছে, তার বিষয়েও তাই করেছে। প্যাকিডার্ম এমনিতেই বিলোপের পথে। আদিবাসীদের মতোই। একদিন তারাও যূথে—যূথে অরণ্য ভারত চংক্রমণ করে ফিরত। আজ তারা লুপ্তপ্রায়। কিন্তু বুলাকির মনে হয়, আদিবাসীদের বক্তব্য হল, ‘আমরাও মুছে যাচ্ছি ভারতের ম্যাপ থেকে। স্ব—পরিচয়ে বাঁচতে পারছি না। চা—বাগান বা কয়লা খনির মজুর হলে আমরা আদিবাসী থাকছি না। মজুর হয়ে যাচ্ছি। মানুষের বিলুপ্তির মুখে একটি হাতির বিলুপ্তি কতটা মূল্যবান মনে হতে পারে? ওর এবং আমাদের মৃত্যুই কাম্য। সকলের কাছে। জোতদার ও মহাজন, প্রচুর বাঁশপাতা, ধান, কলাগাছ দিয়ে ওকে বাঁচাতে পারে। আমাদের বাঁচাতে পারে ঋণ ও বেঠবেগারির থাবা তুলে নিয়ে। উপোস করিয়ে মারাই ক্ষমতাশালীর কাম্য। আমরা তা জানি। মেনে নিয়েছি, স্ব—অস্তিত্ব সংকুচিত করতে করতে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছি। তুমি এবং তোমার ওই ‘হাতি’ নামের অ্যাপোলজি, জীবনের এই হিংস্র নিয়ম যত তাড়াতাড়ি বোঝ, ততই ভালো। তোমাদের পক্ষে।’
এই নির্মম ঔদাসীন্য ও হিংস্রবিদ্বেষ আজকাল বুলাকিকে ঘাবড়ে দেয়। চরণদাস তাকে ও জগমোহনকে রিজেক্ট করবে তা সে বোঝে। কিন্তু এরাও? সে তো কিছু চায় না? জল—বাঁশপাতা—বটপাতা। কিছুই পয়সার জিনিস নয়। লবণ। হ্যাঁ, তৃণভোজী প্রাণীর লবণ দরকার। জগমোহন বন্যহাতি নয়, যে ন্যাচারেল সলট লিক থেকে লবণ পাবে। জঙ্গলের সংরক্ষিত হাতি নয় যে ফরেস্ট ডিপাট তাকে লবণ দেবে। বুলাকি লবণ তো কিনে নিতেই চায়। অরণ্য আদিবাসীর জীবনে লবণ এত দামি জিনিস, যে বুলাকি তাদের কাছে তা চায় না। নিজে থেকে দিলে, ভালো না দিলে? কোই হরজা নেই, কিনে নেব। কিন্তু চোখে একটু স্বাগত জানাও। অমন করে রিজেক্ট কোরো না। রিজেক্ট যদি তোমরাও করো, আমার বুকে বড়ো বাজে। বহুদিন ধরে আমি ও জগমোহন, সব মৌল অধিকার থেকে রিজেক্টেড। আমাদের পুরুষত্বও রিজেক্টেড। তাই তো আমি তোমাদের গ্রামে গ্রামেই ঘুরি। তোমাদের সঙ্গেই আমি সমান—সহজ—স্বচ্ছন্দ বোধ করি। স্ব—অস্তিত্বের জন্যে সংকোচ হয় না। এখন রিজেক্ট করছ কেন? আমি খোঁচোড় নই। আমার হাতি তোমাদের ঘর ভাঙে না। আমি আদিবাসী নই, কিন্তু অবাঞ্ছিত দিকুও নই, আমি তোমাদের জীবনে মহাজন ও পুলিশ ঢোকাইনি।
এই ব্যাক গ্রাউন্ডে বুলাকি গ্রামে ঢোকে। এই সংলাপ থেকে তার অস্তিত্ব কত বিপন্ন, তা বোঝা যাবে।
সংলাপ। বুলাকি ও যেকোনো গ্রামবাসী। সময় দুপুর। ধূলিধূসর মনোলিথগুলি চীনা ঘাসের দানা বাছছে। বুলাকি নামে, জগমোহন তার দিকে চায়। রিসেপশন ও সংলাপ কী হবে, জগমোহন তা জানে। ও জানে বুলাকি মুখে নুনঘষা খাবে এবং গভীর সমবেদনায় ও ঘোলাটে চোখের দৃষ্টিতে মমতা ঢেলে বুলাকিকে স্নান করাবে। তারপর সরে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াবে। নিজেকে নিয়ে আরও সরে যেতে পারলে ও স্বস্তি পেত। কিন্তু প্যাকিডার্ম পিঁপড়ে নয়। স্ব—অস্তিত্ব চোখের আড়াল করা তার সাধ্যি নয়। স্ব—অস্তিত্ব এখন খুব অবাঞ্ছিত এবং সকলের চোখে পীড়াদায়ক, তা জগমোহন শুঁড়ের রেডার চালিয়ে বাতাস থেকেই বুঝে গেছে। জগমোহন, স্থির হয়ে থাকে, যেন বিবর্ণ পাথরের হাতি, যাকে সবাই ভুলে গেছে।
বুলাকি এগিয়ে আসে। মনোলিথগুলি চীনার দানা বেছে চলে, মুখ তোলে না। অপুষ্ট, ক্রিমি, প্লীহা ও রক্তাল্পতা আক্রান্ত শিশুগুলি যার যা করার, তাই করে। এরা সকলেই উলঙ্গ। প্রায় সকলেরই পেট বা গলায় ঘুনসি। পাঁচ বছর থেকে আট বছর যাদের বয়স, তারা চীনার দানা বাছে। চার বছরের শিশুরা তিন ও দু—বছরের শিশুদের আগলায়। এক বছর ও তার কম বয়সি শিশুরা মেয়েদের শীর্ণ, কুঞ্চিত চামড়ায় এঁটুলির মতো লেগে থাকে। কমন মিটিংপয়েন্ট, প্রতি শিশুরই চোখ নিরুত্তর ও মৃত। আট বছরের ওপর বয়েস যাদের তারা ফিট টু বি আর্নিং মেম্বরস। আজ দুপুর রোদে সবাই গেছে বনে। উদ্দেশ্য ছাগল বা গাই চরানো, জ্বালানি আনা, আলু জাতীয় কন্দ, বা সরস মূল সন্ধান। শেষোক্ত উদ্দেশ্য দুটি প্রায়শ ব্যর্থ হয়। তখন এরা তেঁতুল পাতা নিয়ে ফেরে। বুনো রামনাথের মতোই এরা তেঁতুলপাতার মহান কার্যকারিতা জানে। ঘাটোতে লবণ ও তেঁতুলপাতা মিশালে ঘাটো স্বাদু হয়।
বুলাকি কর্মরত মনোলিথগুলির কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ছায়া মানুষগুলির ওপরে পড়ে। সময় যায়। ছায়া প্রলম্বিত হয়।
ছায়া প্রলম্বিত হবার সময়টি বড়ো করুণ। দুপুরও নয়, বিকেল নয়, সূর্য পশ্চিমে সরতে যাচ্ছে। অরণ্য গ্রাম। সব নিঃশব্দ, ক্লান্ত রোদে পোড়া মাটি তাপ বিকিরণ করছে। এ সময়ে গাঁওবুড়ো বা পহানেরও চুপ করে থেকে বুলাকিকে উপেক্ষা করায় ক্লান্তি আসে। সে কথা বলে। বহিরাগতকে উপেক্ষা করবে, আদিবাসীর সাধ্য কি? হাতিটাও তো বাইরে থেকেই গ্রামে এল? বহিরাগতকে স্বীকার করে নেওয়াই ভারতের আদিবাসীর নিয়তি।
—কী চাও?
—তুমি পহান?
—হোথা চলো।
বৃদ্ধটি বুলাকিকে নিয়ে সরে আসে। কপনি পরা শীর্ণ দেহে উপযুক্ত মর্যাদা আনতে চেষ্টা করে। চেষ্টাটি ভারতভূমে একজনের বেলাই সম্ভব হয়েছিল। জাতির জনকের বেলা। ওঁরাও বা হো, বা মুণ্ডা গাঁওবুড়োর সাধ্য কি তাঁর মতো এ কাজে সফল হয়? জনশ্রুতি, কৌতুকময়ী ও মাতৃকাভাবেপরিপূর্ণ শ্রীমতী নাইডু স্নেহভরে জাতির জনককে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘ওঁরা গরিবিয়ানা রেখে চলতে আমাদের কত খরচ হয় তা যদি উনি জানতেন।’ উদ্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসকের নিরাপত্তা বাহিনীর খরচ—খরচার কথাই বলেছিলেন। আমাদের কথার বিশেষ অর্থ হল, শেষ অব্দি সব খরচ—খরচা, ট্যাকসোদান, জনতার ঘাড় ভেঙেই আদায় হয়।
বুলাকির সঙ্গে সংলাপরত গাঁওবুড়োর কপনি—সম্বল দারিদ্র্য রেখে চলতে স্বাধীন ভারত সরকারের খরচও কম হয় না। আইন প্রণয়ন করার জন্য সংসদীয় নির্বাচনের খরচ, জুডিশিয়ারির খরচ, মহাজনকে ধনী ও জোতদারকে সর্বশক্তিমান রাখার খরচ, আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর রাখার খরচ, এদেরকে ঠ্যাঙাতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী রাখার খরচ—এত খরচ করে তবে এদের যে গরিব, সেই গরিব রাখা চলে। এর চেয়ে এদের ধনী করে দিলে খরচ কম হত। কিন্তু সে রকম ঐতিহ্যবিরোধী কাণ্ড ঐতিহ্যপ্রেমী ভারতের কাছে আশা করা যায় না। অধিকাংশ লোককে নিরন্ন ও নেংটে রাখতে গিয়েই শত—শত কোটি টাকা বিদেশে ঋণ—
—হোথা চলো—বলে বুড়োটি বুলাকিকে নিয়ে সরে যায়। কারণটি মহৎ। মেয়েদের ইজ্জত বাঁচানো। বাইরে থেকে মানুষ আদিবাসী জীবনে ঢুকলে, সাধারণত আদিবাসী মেয়েদের ইজ্জত হরণ করে ফুটে যায়। অভ্যাস। জন্মাধিকার গোছের। আদিবাসী মেয়েরা যখন আছে, এবং ওদের শরীরও আছে, তখন তা বহিরাগতের ভোগের জন্য। বুলাকি বহুকাল আগেই পুরুষত্ব শরীরে অ্যাসার্ট করতে ভুলে গেছে এবং তা গাঁওবুড়ো জানে না।
বুলাকি ও বৃদ্ধ কোনো গাছের নীচে বসে। বুলাকি বিড়ি দেয়, বৃদ্ধটি নেয় না। নিজের ট্যাঁক থেকে চুটি পত্র নেয় ও চকমকি ঠুকে জ্বালায়।
—তুমি কে?
—বুলাকি।
—হাঁথি নিয়ে হেথা কেন?
—ওরে একটু পাতা—উতা খাওয়াব। লবণ কিনব একটু।
—নাই।
—কী?
—লবণ।
—দোকানে নাই?
—গ্রামে দোকান নাই।
—হাটে?
—মোদের বিকে না।
—কেন?
—কোথা বন্দুক ছিনতাই, জোতদারের গোলায় আগুন, পুলিশকে বোম মারে কারা। জঙ্গলে লুকায় কারা। পুলিশ মোদেক সন্দ করে। তাতেই লবণ বিচে না। শাস্তি দেয়।
—লবণ বেচে না?
—দুই হাট, তিন হাট বিচে না, একবার বিচে। আবার জব্দ করে।
বিদ্রোহী পলাতকদের সহায়তা সন্দেহে লবণ না—বেচে জব্দ করবার মানে যে অত্যন্ত সফিস্টিকেড টরচার, তা বুঝে বুলাকি তাজ্জব বনে যায়।
—কে বেচে না? পুলিশ হুকুম দিয়াছে?
—না। মহাজন, জোতদার, সবে মনে করে মোরা ওরাদের উচ্ছেদ করতে মদত দেই। তাতেই মোদের লবণ বিচে না।
—হাট?
—হাট জোতদার কন্টোল করে।
—আমি ভাবলাম…।
—কী?
—হেথা তিনদিন জিরাব।
—না।
—কেন?
—কাঁড় মেরে মেরে ফেলাবে।
—কে?
—মোদের ছেলেরা।
—কেন?
—রিজার্ভ ফরেসে হাঁথিরে, হরিণকে লবণমাটি দেয়। ওরা মাটি চুরি করে। তুমি বাহারের লোক। তোমা হতে কথা ছড়াবে, তাতে মেরে ফেলাবে।
—আমি কারে বলব না। বহুতদিন ঘুমতেছি। হাঁথিটো বুঢ়া। থকে গেল বলত। একটু জিরাতাম।
—না।
—তুমি তো গাঁওবুড়ো।
—না। হাঁথি জল খাবে, তুমি নাহাবে। জল কোথা? কুণ্ডীতে টু’নি জল। হাঁথি শুষে লিবে।
—কোথা যাই?
—ফরেসে যাও, কোমাণ্ডি যাও, সরভুজা যাও, হেথা হতে যাও।
অন্ধকার বনছায়ে শুষ্ক চোটি নদী তীরে চলে যায় বুলাকি। বহু খুঁজে জগমোহনের রেডার সদৃশ শুঁড় একটি কর্দমাক্ত জলের দঁক আবিষ্কার করে ও সেখানে নেমে যায়। বুলাকি চ্যাটালো পাথরে শুয়ে জগমোহনের ফোঁসফোঁস লম্বা নিশ্বাস শোনে, কতকাল এভাবে হাঁটবে তাই ভাবে, এবং এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নদীর শুকনো বুকে বাতাসের ঝাপটায় বালির কণা ছুটে বেড়ায়। বালির ঝাপটায় জগমোহনের চামড়া বেঁধে ও সে নড়েচড়ে। এভাবে শুয়ে থাকা খুবই অস্বস্তিজনক। তবু হসটাইল আদিবাসী গ্রামের চেয়ে এখানে শুয়ে বুলাকি স্বস্তি পায়।
সকালে আবার শুরু ক্লান্ত, ক্লান্ত যাত্রা। জগমোহনের সঙ্গে থেকে, বুলাকি নিজেও আধা—জগমোহন হয়ে গেছে। জগমোহনকে উৎসাহ দেবার জন্যে সে কোনো প্রচলিত মাহুতীয় শব্দ ব্যবহার করে না। দলত্যাগী যে কারণে দলের এমব্লেম—ব্যাজ—পতাকা ব্যবহার করে না। সেই কারণেই।
জগমোহন ও সে, হাতি ও মাহুত নেই আর। ফোর্সড রেনিগেড তারা। জগমোহন অরণ্য হাতি নয়। তার আদিম চরিত্র খোয়া গেছে চরণদাসের বান্দা হবার পর। আরণ্য হাতি হলে সে আরণ্য প্যাকিডার্মের নিয়মে পুত্র—স্বামী পিতা হত। যূথপতি হয়ে ফিরত। সম্মানের সঙ্গে মরত এন্তেকাল ফরমাইলে। সে প্রপার আরণ্য হাতি নয়।
সে প্রপার মানুষেপোষা হাতি নয়। তেমন হাতিরা ব্যক্তিগত পিলখানায় বা সার্কাসের তাঁবুতে বা চিড়িয়াখানার বেষ্টনীতে ওয়েল ফেড, সন্তুষ্ট চেহারায় বিরাজ করে। মানুষের সঙ্গে তার কামারাদোরি হয়।
জগমোহন হাতি হিসাবে ইমপ্রপার। বুলাকি ছাড়া অন্য কোনো মানুষকে সে বিশ্বাস করে না। বুনো হাতি দেখলে সভয়ে পালায়। গেঁয়ো কুকুর ডাকলেও সে ভয় পায়। সেইজন্যই জোতদার ওকে খরিদ করেনি। হাতি স্টেটাস সিম্বল নিশ্চয়। বিয়ে—সাদিতে হাতি চড়া যায়। কিন্তু হাতি মানে প্রয়োজনও। প্রজা বা খাতক—এর ঘর ও ধানের টাল মাড়াতে—গুঁড়োতে, গ্রাম তছনছ করতে হাতি বড়ো কাজে লাগে। জগমোহনকে দেখেই জোতদার জাতীয় প্রসপেকটিভ বায়ার বুঝে ফেলে জগমোহনকে দিয়েই ত্যাকার প্রয়োজনীয় কাজগুলি হবার নয়। চরণদাস কর্তৃক মেলনেস ডিনায়েড হবার ফলে জগমোহনের এই লা—মরদ হাল। নিরীহ খাতকের ঘর ও টাল গুঁড়োতে—মাড়াতে পৌরুষ দরকার। এ পৃথিবীতে। কেননা ডিফেনসলেসকে অত্যাচারে নিষ্পিষ্ট করার কাজেই সবাই সুপিরিয়র শক্তি পৌরুষের চূড়ান্ত পরিচয় ব্যয় করে থাকে। উন্নত দেশে মানুষের পৌরুষের সহায়ক উন্নত অস্ত্র। প্রাক—কলোনিয়াল ভারতভূমে গ্রামবাসীকে ত্রাসেতে রাখতে হাতি খুবই সহায়ক। জগমোহন হাতি হিসেবে ফেলিওর।
মেলনেসে ডিনায়েড বুলাকিও মাহুত হিসেবে ফেলিওর। চিড়িয়াখানা বা সার্কাস বা সংরক্ষিত জঙ্গল ঘোরানো পোষা হাতির মাহুত নয় সে। ব্যক্তি মালিকের মাহুত, হয়েও নয়। সে সব মাহুতের জীবনে থিতু থাকে। বাঁধা মাইনে ও ফুলফিলড মেলনেসের ফলে চেহারায় আত্মবিশ্বাস থাকে। সে সকল মাহুত জানে, ম্যানগ্রাফে তারা কোথায় বিলং করে। বুলাকিকে দেখেই বোঝা যায় ও ভিতুর ডিম, স্ব অস্তিত্বের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। এবং ও কোথাও বিলং করে না।
কোন বিশ্বাসে, বিফল এগিয়ে চলার সময়ে বুলাকি মাহুতীর বোল বলবে? ও মাহুত হয়েও মাহুত নয়। জগমোহন হাতি হয়েও হাতি নয়। অতএব বুলাকি কয়েকটি অদ্ভুত শব্দ বলে যায়—কোমাণ্ডি কোমাণ্ডি জগমোহন। হেহেগড়া মেরে লাল! জুজুভাতু জুজুভাতু মেরে ইয়ার!
ম্যানগ্রাফ থেকে বুলাকি কতখানি বেরিয়ে গেছে, উল্লেখিত শব্দাবলিই তার প্রমাণ। কোমাণ্ডি—ভুরকুণ্ডা—হেহেগড়া জুজুভাতু কয়েকটি জায়গার নাম। এইসব বিকট নামে সে হাতিকে চালায়। একইসঙ্গে হাতিকে সন্তান বাচক ‘লাল’ ও ‘দুলার’ বলে। আবার বন্ধু—বাচক ‘ইয়ার’ও বলে। লাল ও দুলার বলাটা ওর পাগলাখোঁচামির পরিচয়। কেন—না ও এবং জগমোহন একই বয়সি। সমবয়সি কোন বুড়োকে ও মদের ঠেক—এ বসে ইয়ার্কি মেরে চিবুক ধরে ‘দুলার’ ও ‘লাল’ বললে তা বেমানান হত না। মৌয়ার নেশায় মানুষ বোতলটিকেও ‘পিয়ারি’ বলে চুমু খায়। নির্জন পথে, মৃতপ্রায় সমবয়সি হাতিকে চালাবার জন্য ‘দুলার’ ও ‘লাল’ বলা খুবই দ্যোতক। সম্বোধনটি শোনে শুধু আকাশ, গাছ, পথ। জগমোহন হাপরের মতো ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে পথ চলে।
বঢ়হাই রেল স্টেশন। কুলি বস্তি। বটগাছ। থোড়া পানি মিলে ভাইয়া? থোড়া পানি? হাঁথিকে লিয়ে?
—ইঞ্জিন কা পানি লো।
—গরম হায়?
—নেহি। লেকিন—
মেটালিক স্বাদের বিস্বাদ জল। চৌবাচ্চায়। স্টেশনে আগুন লাগলে নিভানোর জন্য। জগমোহন জল খায়।
—হিঁয়া কী ধার কুণ্ডী ছে?
—কাঁহা? পানি মিলত নই।
—কি ধার ভি নেহি?
—পাতরা মেঁ দেখো।
—য়ে পিপল পেঁড় কিস কা?
—টিশন কা জমি মেঁ।
জগমোহনের লাঞ্চটি বঢ়হাইতে বটপাতায় হয়। চার মাইল দূরে পাতরার নালাতে স্নান। ডিনারের জন্যে বঢ়হাই প্রত্যাবর্তন। কিন্তু ডিজেল ইঞ্জিনের সিটিতে জগমোহনের আতঙ্ক। আবার পথ চলা। টাহাড়া—নালিগাতু—জোঝোরা—শাগু—মোচরা—জায়গার পর জায়গা।
এইভাবে পথ চলতে চলতেই একদিন হঠাৎ আর কোনো পথ থাকবে না, সব পথ ফুরিয়ে যাবে কেননা জগমোহন মরে যাবে। তা বুলাকি জানে। সেই ভয়ে ওকে ইদানীং বিবশ করে রাখে। সে মৃত্যুও খুব নিঃশব্দে হবে। প্রায় মুছে যাওয়া দুটি বিন্দুর একটির ফাইনাল বিলুপ্তি। ভয়। তারপর? শূন্যতা, শূন্যতা, শূন্যতা। চলো জগমোহন, মেরে লাল, মেরে ইয়ার। হেহেগড়া হেহেগড়া জগমোহন—কোমাণ্ডি কোমাণ্ডি।
বুলাকি জানতেও পারে না। জগমোহন সহসা কী কী ঘটনাবলি ট্রিগার করবে। এবং বুরুডিহা নামক গ্রামের সন্নিকটে জঙ্গলে ঢোকে সাতাত্তরের অক্টোবরে।
দুই
বুরুডিহা গ্রামের ম্যানগ্রাফ ও টোপোগ্রাফি এ কাহিনীতে খুব প্রয়োজনীয়।
গ্রামটির নামেই প্রমাণ হচ্ছে, নামটি আদিবাসী। একদা আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামটির ম্যানগ্রাফে আবশ্যিক পরিবর্তন বহুকাল আগে ঘটে গেছে। গ্রামটিতে বসবাসী আদিবাসীদের জমিতে দখল প্রায় নিঃস্ব। গ্রামে সাতশো লোক বাস করে। একশো চারটি পরিবার। অধিকাংশ পরিবার গঞ্জু জাতির লোকের। গ্রামটি আদতে গঞ্জুদের ছিল। তারপর পারশনাথ ও বারাণসীদাস দুই লালা এসে জোটে। ক্রমে আরও কিছু লালা এসে বসবাস করে। কিছু রবিদাস। ধোপা দু—ঘর ও হাজাম। লালারা স্বভাবতই গঞ্জুদের জমিজমা হাত করে এবং গ্রামটিকে তাদের ওপর নির্ভরশীল করে ছাড়ে। গ্রামে তাদের মহাজনী কারবার এবং সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত তাড়িখানাও তাদের। দুটি দোকান। কাপড় ও বেনেতি জিনিসের।
দোকান চলার মতো সংগতিপূর্ণ গ্রাম বুরুডিহা নয়। কিন্তু বুরুডিহা হল এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো হাটের জায়গা। এখানে সোম ও শুক্রবারে এক বিরাট হাট বসে। লঙ্কা, পেঁয়াজ, ধনে বিক্রি হয়। সময়ের শাকসবজি ও ফল। বুরুডিহার অনতিদূর, মাত্র এক মাইল দূরে ভালাতোড়। গঞ্জ জায়গা। সেখানে আছে বৈষ্ণব—মণ্ডলী পরিচালিত মঠ ও হাসপাতাল। আদিবাসী উন্নয়ন শাখা অফিস এবং পুলিশ স্টেশন। বুরুডিহা, ভালাতোড় এসব জায়গা রোডওয়েতে কানেকটেড, রেলওয়েতে নয়।
এই লালারা মিশ্রকে এনে জমি দিয়ে বসত করায়। কালে হনুমান মিশ্র আশপাশে জোতজমা ও ফলবাগিচা খরিদ করে প্রভূত ধনী হয়। বস্তুত এ জংলি জায়গায় হনুমান মিশ্রের মতো কাস্ট বামুনের আগমন ও বসতি স্থাপন ব্যাপারটি কতখানি বহুমুখী, তা কলকাতার লোকজন কিছুতে বুঝবেন না। শহর কলকাতায় দীপক ও আয়েশায় প্রেম হয় বলে, রুইদাস গিয়ে চাটুজ্জে বাড়ি ভাত রাঁধে বলে, শহুরে আঁতেল ভাবেন, ভারত থেকে জাতপাতের সমস্যা ঘুচে গেছে। শহুরে বা শিক্ষিত বিপ্লবীও এ হেন ভুল করেন। তাঁদের সততায় কোনো সন্দেহ নেই, নিহিত—হওনই সততার ডকুমেন্ট। কিন্তু তাঁরাও যখন গাঁ—গেরামে গেছেন, জাতপাত ছোঁয়াছুঁয়ি ও ধর্মের ত্রয়ী প্রতিরোধ তুচ্ছ করে পরের বাস—স্টপ থেকে কাজ করেছেন।
সেটি ভুল। এ ভারতভূমে ন্যাড়া—ন্যাংটোদের লড়াকু করতে হলে, কুরুক্ষেত্রে নামার আগে জেনে নিতে হবে, প্রয়োজনে গঞ্জু ও দোসাদরা গোলবদন সাহুকে ক্ষেত্রপাল দেবতা ও সূর্যদেবের উদ্দেশে উচ্ছুগগু করে কেনানদ্রাপাহাড় থেকে নীচে আছড়ে ফেলে মারতে পারে। কিন্তু হনুমান মিশ্রের মন্দির—সংলগ্ন কুয়ো থেকে জল নিতে তাদের হাত উঠবে না।
তাঁদের জানতে হবে, অর্থনীতিক শোষণ যেমন একটা টার্গেট, তেমনি আর—আর টার্গেট হল জাতপাত ছুঁয়াছুত ও ধর্ম। এ ত্রিমূর্তি, ত্রিমূর্তি ভবনের মতোই ভারতীয়ের হৃদয়ে পাকা হয়ে আছে। ভবন থাকলেই মন তাতে চেনা মূর্তি বসাতে চাইবে।
যাঁরা তা বিশ্বাস করেন না তাঁদের পক্ষে বুরুডিহা দর্শন আবশ্যিক। বুরুডিহা এক আণবিক ভারত—কসমস। রবিদাস—ধোবি—গঞ্জু—দোসাদ এরা কে কার চেয়ে ছোটো বা বড়ো, তা এরা ঠিক করেনি। একদা বামুনরাই সৎকর্মটি করে থাকবে। নিশ্চয় তারা সকল ব্রাত্য জাতিকে ডিভাইড করে রুল করতে চেয়েছিল। তার জন্যই বুরুডিহার এই জাতিগুলির রক্তে রক্তে বিশ্বাসটি বসে গেছে।
বিশ্বাসগুলি এরকম—এ—ওর সঙ্গে ভাত খেতে পারে, জল খেতে পারে না। শুঁড়িখানায় বসে মাল খেতে খেতে এ, ওর কাছ থেকে ঝাল চানা খেতে পারে, তেলেভাজা খেতে পারে না। সে তার সঙ্গে চা খেতে পারে, মুড়ি খেতে পারে না।
মানুষগুলি অত্যন্ত সরল, ভিতু, ব্রহ্মণ্যতা ও উচ্চবর্ণের সর্বময়তায় বিশ্বাসী। ফলে ছুঁয়াছুতের গণ্ডগোল করে ফেললে জাত গেল পাত গেল বলে তারা হনুমান মিশ্রজীর কাছেই ছোটে।
হনুমান মিশ্র মহাপাপটির কথা শুনে কানে আঙুল দেন, কাঁদেন। বুক চাপড়ান, ঘন ঘন মন্দিরের দিকে চান। তারপর বিধান দেন। পূজা, প্রায়শ্চিত্ত, মাথা মুড়োনো, জাতভাইদের অন্নদান। ফলে আবার ধার নিতে হয়। ধর্মীয় বিচ্যুতির দরুন প্রায়শ্চিত্ত কাজে যে টাকা লাগে তা হনুমান নিজেই ধার দেন।
ওঁরাও মুণ্ডা বা হো, এরা হনুমান মিশ্রের চক্ষুশূল! যাদের সূজনকার্যে ব্রহ্মার কোনো হাত ছিল না, কোথাকার কোন সিংবোঙা বা হড়ামদেও সৃজন করেছিলেন, তাদের অস্তিত্ব তিনি একেবারে উপেক্ষা করেন। ওরা এত পাতিত, যে জাতপাত বা ছুঁয়াছুত বোঝে না, আগেই বলেছি, এই হনুমান মিশ্রের বুরুডিহা অবস্থান ব্যাপারটি গভীর তাৎপর্যময়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বুরুডিহাতে এক অশান্তির ঘটনা ঘটে। বুরুডিহাতে জঙ্গলের উপকণ্ঠে ছিল কয়েক ঘর ওঁরাও। এতোয়া ওঁরাওয়ের বউ বিখনি লালাবাবুদের বাড়ি মজুরনি ছিল। কুয়ো থেকে জল তুলে অন্দরে মেয়েদের স্নানের চৌবাচ্চা ভরত, খামার সাফ করত, রান্নার কাঠ চ্যালা করত। এক বেলা জলখাই ও মাসে চার টাকা মাইনে। এর চেয়ে বেশি টাকা তখন বুরুডিহার কেউ দিত না। আজও ও অঞ্চলে বাঁধা মাইনের আদিবাসী মাসে পনেরো—বিশ টাকা ও একবেলা জলখাই পেলে বর্তে যায়। জলখাই বলতে মাড়োয়াড় ছাতু বা ঘাটো। তাতেও বিখনির অসংগত রকম উগ্র দেহ ছিল। এতোয়া সে বিষয়ে খুবই সজাগ ছিল, এবং বিখনিকে বিয়ে সংক্রান্ত ভোজ দিতে লালাদের কাছেই ঋণগ্রস্ত না হলে সে বিখনিকে কাজ করতে দিত না।
মাসে মাসে সে হিসেব করত, বিখনির মাইনে লালারা কেটে নিলে মূল ঋণের কত শোধ হয়। স্বভাবতই আসলে ও সুদে হিসেবটি জটিল হয়ে পড়ে এবং জটিল হিসেব কোনো আদিবাসীদের বোধাতীত। এতোয়ার মনে হতে থাকে, সে দিয়ে চলেছে। কিন্তু ধার শোধ হচ্ছে না। ফলে তার মনে লালাদের ওপর বিদ্বেষ জমতে থাকে।
একদিন সে গিয়ে লালাদের বড়ো ছেলেকে চেপে ধরে, কত টাকা গেল, কত বাকি আছে, বুঝিয়ে বল। বউটা আর কতদিন খাটলে ধার শোধ হবে?
উত্তরটি তার মনোমতো হয় না। সে বলে, তু নিশ্চয় ঝুটা হিসাব দেখাইচিস। ই হয় না।
গাল দিয়ে সে উঠে আসে এবং মনোদুঃখ ভুলতে হাটে লংকা বেচতে গিয়ে মৌয়া খেতে বসে। তখন মৌয়ামত্ত আরেক ওঁরাও তাকে বুঝিয়ে বলে, তুর ধার শোধ হবার লয়। ই জন্মে লয়।
কেনে?
দিকু হতে ওঁরাও ধার লিলে শোধ যায় না। কারো যায় নাই আর…
আর কী?
শনিচরিরে শুধা।
শনিচরি একপাশে বসে মৌয়া খাচ্ছিল ও জিভে ভাজা লংকা ঠেকাচ্ছিল। সে মদটুকু খেয়ে ঠোঁট মোছে ও যা বলে, তার সারাংশ এই : বিখনির দেহে যৌবন থাকতে ও ধার শোধ হবার নয়। শনিচরির বর লালাদের কাছে ধার নেয় বিশ টাকা। মাস দু—টাকা মাইনে ও জলখাইতে বর্তমান লালার পিতার কাছে যুবতী শনিচরি নিযুক্ত হয়। সে পঁচিশ বছর আগে। দশ বছর কাজ করেও সে ধার শোধ হয়নি। শনিচরির বর উক্ত ঋণের দু—বছরের মধ্যে টেঁসে যায়। ফলে শনিচরিকে বাঁচাতে কেউ থাকে না। তার যৌবনও বহুকাল থাকে। যতদিন থাকে, ততদিন শনিচরি বৃদ্ধ লালাকে শরীর ও লালা পরিবারকে শ্রম দিয়ে ধার শোধ করার চেষ্টা করে। তার যৌবন ও বৃদ্ধ লালার পরমায়ু একদিন শেষ হয়েছে। ধার আজও শোধ হয়নি। শনিচরি আর খাটতে যায় না, এবং সে ডিক্লেয়ার করে রেখেছে, আর খাটব নাই। জেহেলে দিবি ত দে। এরপর শনিচরি মৌয়া—জনিত আবেগাকুল হৃদয়ে এতোয়াকে বলে বিখনিকে লিয়ে ভাগি যা। লালার ছোটো ছেলেটা শয়তান। উ বিখনিরে ছাড়বেক নাই।
এতোয়া জানতে চায়, বিখনি নিজে কি হারামি করেছে?
শনিচরি সংসারী দাশনিকতায় বলে, আজ করে নাই, কাল করবে।
কথাগুলির ফল ভালো হয় না। কেননা মদ খেয়ে এতোয়া লালার ছোটো ছেলেকে কেটে ফেলে এবং ভালাতোড়ে গিয়ে থানার দারোগাকে বলে বুরুডিহায় গোবিন লালাকে কেটে ফেললাম। কী করবি কর।
উক্ত হত্যাকাণ্ডে আসামি স্বয়ং স্বীকার গেলেও দারোগাকে সুরতহালে আসতে হয়। এসে তিন দিন বুরুডিহা থাকতে হয়। দারোগার পদবি পাঁড়ে। তিনি সদাচারী মৈথিলী বামুন এবং বুরুডিহাতে তিন দিন অবস্থানকালে তিনি অন্নজল খান না লালাদের ঘরে। পুত্রশোকের ওপর ব্রাহ্মণের অনাহারী থাকার শোকে লালা—জননীর বুক ফেটে যায়। ফল সুদূরপ্রসারী হয়। এতোয়া পরিণামে পুলিপোলাও হয় এবং জেলেই মরে যায়। বিখনিকে মৃত গোবিন্দের দাদা জবরদখল করে। লালারা ভালাতোড় বৈষ্ণব সমাজগুরুর সহায়তায় হনুমানপ্রসাদ মিশ্রকে এনে গ্রামে বসত করায়। আদিবাসী ও অন্ত্যজ বেলট—গ্রামসমূহের শান্তিরক্ষার কাজে কাস্ট হিন্দু নিয়োগ করা প্রশাসনের ইচ্ছে নয়। তাতে আদিবাসীরা ও অন্ত্যজরা সুবিচার পায় না। কিন্তু কার্যকালে উক্ত ডেফিনিশনের গ্রাম সকলের রক্ষক থানার পাণ্ডে—ঠাকুর—মিশিররা অ্যাপয়েন্টড হন, এবং বুরুডিহার আশপাশের যেকোনো গ্রামে সুরতহালে বা তদন্তে এলে তাঁরা হনুমান মিশ্রের বাড়িতে বৈষ্ণব ভোজন করে থাকেন।
গুটি দশেক গঞ্জু পরিবারের জমি অধিকার করে লালারা মিশ্রজীকে দেয়। হনুমান মিশ্র লালাদের তাতে হাত না দিয়েই স্বীয় বৈভব বাড়াতে থাকেন। অঞ্চলটি চোটি, তিরুহি, কুইলা ও ঝিঠরি নদী চতুষ্টয় বেষ্টিত, বনসমৃদ্ধ, মাটি সরস। ভালাহোতুর জমিদার বংশের অধিকারভুক্ত গ্রামগুলিতে জমিদারদের ফলবাগিচা বিস্তর। পেয়ারা,আতা, আম, লিচু, পেঁপে ও জাম গাছ প্রচুর। কুঞ্জরা বা হোলসেল খদ্দেররা বাগিচার ফলের প্রসপেক্ট আঁচ করে ফরোআর্ড ট্রেডিং করে, বাগিচা মালিককে আগাম থোক টাকা দিয়ে ভবিষ্যতে যে ফল ফলবে তা কিনে নেয়।
হনুমান মিশ্র লালাদের ভাতে হাতটি দেন না। বাগিচার পর বাগিচা খরিদ করেন, প্রতি বাগানে মিশ্র বংশের কোনো বেকার পুরুষকে বসান। কুঞ্জরাদের সঙ্গে কথা হয়, প্রতি বাগিচা থেকে গৃহ সদস্যদের খাবার ফল দিতে হবে। এইভাবে ফল—বাগিচা কেনা হয়। বস্তুত মিশ্রজী বহুদূর ছাড়িয়ে জগৎবেড় ফেলেন। অঞ্চলটি এমন অদ্ভুত, যে এখানকার প্রাকৃতিক ভূগোলও বদখেয়ালি। বুরুডিহা, পালানি, টাহাড় ইত্যাদি জায়গায় বাস দাঁড়ালে ফলে ফলাক্কার। দু—মাইল দূরে বাস স্টেশনে খাদ্য বলতে ভিজে চানা ও পেঁয়াজ। মিশ্রজীর লোকরা অন্যান্য বাস স্টেশনের ফল—বিক্রেতাদের মারদাঙ্গা করে হটিয়ে দিয়ে নিজেরা বিক্রি করতে থাকে। ভালাতোড় থানাতে তিনি এত ফল সম্বৎসর পাঠান যে ফলাপ্লুত থানায় অ্যান্টি—মিশ্রজী কোনো রিপোর্ট আমল পায় না। তাঁর লোকরা মেয়েমানুষ, বুড়ো—বুড়ি বালক নির্বিশেষে ঠ্যাঙায় ও একটি রেইন অফ টেরর স্থাপনে সক্ষম হয়। ব্রাহমন লোক দেওতা লোক, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো নালিশই সোচ্চার হতে পায় না।
আশপাশে কোন ল্যান্ড ডিসপুটেড সে খবর তিনি ভালাতোড়ের থানা ও পাটুলিহার আদালত থেকে পেয়ে যান এবং জোতজমা খরিদ করতে থাকেন। মিশ্র পরিবারে পরিবার—পরিকল্পনা নেই। ফলে উক্ত জোতজমা সমূহে মিশ্ররা ঢুকে পড়ে। এতে স্থানীয় কংগ্রেসি পঞ্চায়েত—প্রধান, ব্রিজভূষণ ছত্রীর টনক নড়ে। সে নিজে এসে মিশ্রজীর সঙ্গে দেখা করে এবং বলে, যো আপ কিয়া, এহি হ্যায় দেশমাতা কি সেওয়া।
কৈসে?
ব্রিজভূষণ ছত্রী প্রবল প্রতাপী ও দুঁদে লোক। তার শাসনে পঞ্চায়েতি কুয়ো ও প্রাইমারি স্কুল বর্ণহিন্দুর অধিকারে। সে বলে, ব্রাহ্মণ সামনে থাকলে হিন্দুরা বুকে বল পায়। মিশ্রজীর দূরদর্শিতার ফলে অঞ্চলটিতে সর্বত্র ব্রাহ্মণ নিউক্লিয়াস গড়ে উঠেছে। ছত্রী, ভুঁইহার, লালা এদের কাছে ব্রাহ্মণ সব চেয়ে বড়ো দেওতা। অঞ্চলটিতে দোসাদ— রবিদাস—গঞ্জু—আদিবাসী ইত্যাদির প্রাধান্য বড়ো বেশি। এদের দাবিয়ে রাখা খুবই দরকার।
মিশ্রজী সুপরিসর হেসে বলেন, কিন্তু এদের দেখভাল করার জন্যে সরকার খুব মদত ভি দিচ্ছে, ঔর ইন্দিরাজী ভি তাই চান।
দেওতা, তা চাইলে পরে এদের নাসবন্দি করাচ্ছে কেন? এদের সংখ্যা যাতে না বাড়ে সে জন্যে সরকারি দপ্তর? আমলা? আইন যা বলুক, আদালত পঞ্চায়েতি আপিস, বি ডি আপিস, থানা, সবাই আমাদের মদত দেয়। আমি একলা লড়ছিলাম, এখন দেওতাদের সামনে পেয়ে গেলাম। কী করে এদের জব্দ রাখা যায়, দেখিয়ে দেব। আপনি যা বলছেন, এ ঠিক নয় ছত্রীজী। আপনি আমি শিক্ষিত লোক। আমরা দোনো ভারতীয় যে সমঝনা চাহিয়ে। আপনি জানেন, অছুত ঔর আদিবাসীদের জন্যে সরকার কত আইন করেছে?
আইনে কী হ দেবতা, আইন ত কাগজ পর সোয়াহিসে লিখাঁই। আইনকে বলবৎ করে মানুষ। শিক্ষিত মানুষ। আমি কী বলেছি? ওদের জানে মারব? নহি নহি। কিন্তু জুতির নীচে আপনি যে মাটি মাখেন, উসসে তো ভাল মেঁ তিলক পরেন না? য়ে ভি ঠিক নহি। জুতির নীচের মাটিকে একথা বলা ঠিক নয়, যে তুমি তিলক মাটি হতে পার।
য়ে ঠিক বাত হ্যায়।
আমার পঞ্চায়েতি মেঁ এক হি নীতি। সরকারি ইস্কুল ভি করেছে। কিন্তু আমি বলে দিই, লিখাই—পড়াই করে তোদের কোনো লাভ নেই। কে মরা জানোবারের চামড়া ছুলবে, কে জুতো বানাবে, কে কুলি—কাম করবে, সব ভগবান ঠিক করে তবে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। পড়াঁই করে তোমরা করবে কী? তোমরা পড়তে এলে উঁচু জাতের মাস্টার পড়াবে না, ছাত্রও পড়বে না। দেওতা! এসব জায়গা জংলা জায়গা। শহরের বাতাস এখানে আসে না। রাজার মতো থেকে যান, কিছু চিন্তা করবেন না।
কথাগুলি বলার সময় ব্রিজভূষণের চোখ ও মুখ পবিত্র দীপ্তিতে জ্বলে। হনুমান মিশ্রের বুঝতে বাকি থাকে না ব্রিজভূষণ জনৈক ফ্যানাটিক। খুবই আনন্দ হয় তাঁর। ফ্যানাটিক ও ফ্যানটিসিজম বড়ো ভালো জিনিস। তা যদি অছুত—আদিবাসীকে দাবিয়ে রাখা বিষয়ক হয়, আরও ভালো। কেননা, তিনি ফলবাগিচা, জোতজমা, এবং আর যে যে পার্থিব সম্পত্তি বাড়াতে চান, তাতে খাটাখাটনির জন্য উক্ত হতভাগাদের দরকার। তারা যদি লিখি—পড়ি হয়, স্ব—অধিকার বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়, তাহলে হাওয়া বিগড়ে যায়। বস্তুত পাটনা—রাঁচি—গয়া—আরা—ছাপরায় ছোটো জাতের রিকশাওলা যেভাবে বলে, ঠিকসে বাত বলিয়ে—তাতে বামুনের রক্তে আগুন জ্বলে।
হনুমান মিশ্র বোঝেন, ব্রিজভূষণ ছত্রী তাঁকে যথাসাধ্য মদত দেবেন। তিনি খুব আনন্দ পান ও বলেন, আজকাল আপনার মতো মানুষ হয় বলে জানতাম না।
ব্রিজভূষণ ছত্রীও মহোৎসাহে ফিরে যায় নিজের গ্রামে। এরপর অঞ্চলটিতে কয়েকটি সিংগুলারলি সিগনিফিকেন্ট ঘটনা ঘটে।
খুবই আশ্চর্য কথা, বুলাকি বা জগমোহন কিছুই না জেনেও প্রতিটি সিগনিফিকেন্ট ঘটনার সময়ে কোনো না কোনো ভাবে ঘটনাগুলির বলয়ের মধ্যে থাকে।
স্বগ্রামে ফিরে যাবার পর ব্রিজভূষণ ছত্রী নিজের ছেলেকে বিয়ে দেয় এবং ছেলে ও বউকে হাতির পিঠে বসিয়ে শোভাযাত্রা করে হনুমান মিশ্রের মন্দিরে নিয়ে গিয়ে দেওতার আশীর্বাদ নেবে বলে স্থির করে। প্রস্তাবটি সকলেরি মনোমতো হয় এবং এই সময়ে নিয়তি দারুণ যোগাযোগের খেল দেখায়। গ্রামে যেহেতু সকলেই খেতে গিয়ে মলত্যাগ করে ও ‘ঘর কা নজদিগ সনডাশ বনতা নই’—সেহেতু শিক্ষিত ও আলোকপ্রাপ্ত ব্রিজভূষণও যবক্ষেত্র উর্বর করতে যায়—হিউম্যান ওফাল ভেরি গুড ফার্টিলাইজার—এবং সহসা দেখে যবখেতের মাঝের পথ ধরে এক নো—গুড হাতি এবং নো—গুড মাহুত আসছে। ব্রিজভূষণের ব্যক্তিত্ব প্রবল। তাই মলত্যাগ করতে করতেই সে প্রশ্নগুলি করে নেয়।
—কিসকা হাঁথি?
—মোহান্ত কা।
—মোহান্ত কোথায়?
—বনারসে।
—এখানে হাতি নিয়ে ঘুরছ কেন?
—হুজুর…
—যব খেয়ে দেয় যদি?
—না হুজুর।
—কী করছ এখানে?
—ভাড়া মিললে, সোয়ারি নিলে…অমনি করেই হাতির খোরাক চালাই হুজুর।
—দাঁড়াও, আসছি।
ব্রিজভূষণ দরকারি কাজটি সারে এবং তারপর বুলাকির সঙ্গে দরদস্তুর হয়। শেষ অবধি হাতির খোরাক ও দশ টাকায় রফা হয়। বুলাকির জলখাই।
মহানন্দে বুলাকি জগমোহনকে স্নান করায় এবং বটপাতা খাওয়ায়। অতঃপর গোলা রং দিয়ে জগমোহনের কপালে ও শুঁড়ে আলপনা আঁকে। নিজেও ভরপেট ছাতু, জোলো দই ও ভেলি গুড় খায়।
কিন্তু কপালের ফের। সংবাদ আসে দেওতা চলে গেছেন ধানবাদ। দশ দিন না গেলে ফিরবেন না। দশদিন বাদে কোনো শুভদিন পঞ্জিকায় মেলে না। অতএব ব্রিজভূষণ বুলাকিকে বিদায় দেয়। জগমোহনকেও। বুলাকি চলে যায় বুঝারের দিকে। বুরুডিহা যেতে যেতে যাওয়া হয় না।
এবার ও তল্লাটে একে একে সিগনিফিকেন্ট ঘটনাবলি ঘটতে থাকে।
(এক) বুঝার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার বালকৃষ্ণ সিং সোসালিস্ট পার্টির লোক। সে এসেই ব্রিজভূষণ ছত্রীর ফ্যানাটিক বর্ণবিদ্বেষ ধরে ফেলে, এবং ব্রিজভূষণের প্রতিটি পাবলিক অ্যাক্টের পেছনে উক্ত মানসিকতা দেখতে পায়। কেন যেন তার ধারণা হয়, তার খুঁটির জোর আছে। মনে হয় রাঁচিতে লোকজন আছে ম্যাও ধরাবার। কিন্তু বনবিভাগের জঙ্গল, জোতদারের জমি ও বন্ধ্যা পাথুরে প্রান্তর দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই আদিবাসী গ্রামগুলি যে আসলে রাঁচি থেকে শত লক্ষ যোজন দূরে, তা সে বোঝে না। বাস রুটের দূরত্ব নয়, এ অন্য দূরত্ব। রাঁচি নয়া ভারত। গ্রামগুলিতে নিয়ানডারথাল যুগ চলছে। জল নেই, মহুয়া তেলের লালচে আলো একমাত্র বাতি, মাড়োয়া বা ভুট্টা বা চীনাদানার ঘাটো একমাত্র স্টেপল ফুড, লবণ বিলাসিতা। রোগেদুঃখে নয়া ভারতে ঘৃণ্য মিশনারি একমাত্র ভরসা;সারাবছর ধারকর্জ নিতে জোতদার বা মহাজন একমাত্র সহায়। এরা এমন তুচ্ছ ও এক্সপেনডেবল, যে ভোটের সময়ে এদের কেউ এক টাকা মাথাপিছু দিয়েও ভোট দেয়ায় না। মহাজন বা জোতদার বা ব্রিজভূষণ চোখ রাঙিয়ে যাকে ভোট দিতে বলে, এরা তাকেই ভোট দিয়ে আসে।
অবোধ বালকৃষ্ণ সিংয়ের মনে হয়, এদের প্রতি অবিচার হচ্ছে। সে মাঝেমধ্যে ভালাতোড় থানায় রিপোর্টও করে। ব্রিজভূষণ বোঝে এ ছোকরাকে টাইট দিতে হবে। ইস্যুর অভাব হয় না। কলেরার মড়কে ইঞ্জেকশন দিতে এসে সরকারি জিপ ঝুঝার গ্রামটি উপেক্ষা করে চলে যায়। কারণটি জানতে চাইলে ব্রিজভূষণ সদর্পে বলে, যে সূঁচে বর্ণহিন্দুকে ইঞ্জেকশন দেবে, সেই একই সূঁচে অছুত ও আদিবাসীকে?
নহি নহি মাস্টারবাবু। য়ে হো নহি সকতা। পোড়া স্বাধীনতার পর বর্ণ হিন্দু এই অছুত ও আদিবাসীর চাপে লোপ পেতে বসেছে। থাকার মধ্যে আছে ওই রক্তের পবিত্রতাটুকু। দেহে রক্ত থাকতে তা নষ্ট হতে দেবে না ব্রিজভূষণ।
বালকৃষ্ণ সিং গলায় সাধ্যমতো সারকাজম মেনে বলে, এদের কলেরা হলে কে দেখবে? ব্রিজভূষণ ছত্রী কঠোর গাম্ভীর্যে বলে, বুরুডিহাতে জীবন্ত দেওতা আছেন। হনুমান মিশ্র। তিনি ভগবানকে ডাকবেন। জীবন আর মৃত্যু লিখাই—পড়াই দিয়ে মাপার জিনিস নয়। যখন ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা ছিল না, তখন কি সবাই কলেরায় মরে যেত?
বালকৃষ্ণ সিং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছুটোছুটি করেও ফল পায় না। এবং বোঝে, ব্রিজভূষণ ও হনুমান মিশ্রকে চটিয়ে সরকারি আমলাও কিছু করতে রাজি নয়। ব্রিজভূষণ শুধু সামান্য পঞ্চায়েত—প্রধান নয়। এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রতাপ ও প্রভাবশালী লোক।
বালকৃষ্ণ সিংয়েরও অহেতুক জেদ চাপে। কলেরা ছড়াতে থাকে। আশপাশের গ্রামে মানুষ মরে। অতঃপর সে বুঝায় এবং বলে, আমি ঝুঝারে হায়জার সুঁই দেওয়াব। রাঁচি যাচ্ছি। রাঁচি থেকে ডাক্তারের গাড়ি এনে সুঁই—ইলাজ।
কেন?
গাঁওবুড়ো তার সহিষ্ণু, শান্ত ও হলদেটে চোখ দুটি তুলে বালকৃষ্ণের দিকে চাইল। বলল, কিছু হবে না রে।
কেন?
হায়জা ঝুঝারে আসছে।
কে বলল?
মিশ্রজী বলেছে।
কাকে বলেছে?
ছত্রীজীকে।
কবে বলল?
রোজ বলছে।
না না, ভয় দেখিয়েছে।
বলেছে, সুঁই নিলে মরদরা খাঁসি হয়ে যাবে। সরকার নাসবন্দি করাতে চায়। মরদরা খাঁসি হবে বলে ভয়ে নাসবন্দি করে না। তাই হায়জার সুঁই দিচ্ছে বলে মরদদের খাঁসি, আওরতদের বাঁজা করে দিচ্ছে। তাই বলছে।
তা যদি হবে, তাহলে ছত্রীজী, মিশ্রজী নিজেরা সুঁই নিল কেন? শোনো, এ ওদের কৌশল। তোমাদের হায়জা হলে তোমরা মরবে। ওরা নিজেরা ভালো থাকবে। তারপর দেখো, কোনো মরদ মরলে তার জমি বেহাত হয় কিনা?
সে তো হায়জায় না মরলেও জমি চলে যায়। একসময়ে আমরা জানি নি জমি ছত্রীজী নিয়ে নেবে, আমরা হব তার চাকর। তাই তো হল।
শোনো, সুঁইদার এলে আমি আগে সুঁই নেব। তোমরা দেখো, কিছু হয় কি না। তোকে মেরে দিবে।
কে?
ছত্রীজী।
মেরে দেওয়া অত সোজা?
তোর লেগে ডরাই। তুই হেথা থাকিস। মোদের তরে ভাবিস।
বালকৃষ্ণ বলে এবার শহর থেকে আমার বউ—বাচ্চাটাকেও নিয়ে আসব।
তোমাদের দেখাব।
তোর বউ সুঁই নেবে?
বউ নেবে। বাচ্চা নেবে।
সকালে এ মিটিং হয়। বিকেলে ব্রিজভূষণ ছত্রী সাইকেলে চেপে চলে আসে ঝুঝার। বালকৃষ্ণকে বলে, হাট থেকে দশ কিলো চাল আর দু কিলো গুড় দিতে হবে।
কেন?
হায়জার মড়ক চলছে জানেন না?
কেমন করে জানব?
এ আপনার রাগের কথা। সুঁইদার চলে গেল। তাতে রাগ করেছেন।
চাল আর গুড় কী হবে?
হায়জা শান্তি করতে যজ্ঞ হবে। মিশ্রজী নিজে যজ্ঞ করবেন। সব গ্রাম থেকে চাল আর গুড় নিচ্ছি। সুঁই ইলাজ কী করে মাস্টারবাবু? আপনি মাস্টার মানুষ, ব্রাহ্মণ দেওতার পর বিশ্বাস নেই আপনার?
ঝুঝার আপনার রাজ্য হতে রাঁচি নয়। রাঁচি গিয়ে আমি সুইগাড়ি—ওষুধ আনব। সে তো খুব ভালো কথা। এখন যে আসবে, সে ওদের সুঁই দিক। সরকারি বন্দোবস্ত, আমি পঞ্চায়েত—প্রধান, কি ‘না’ বলতে যাব? এখন চাল আর গুড়ের কথাটা বলে দিন।
দিন।
আপনি বলুন।
ব্রিজভূষণ ছত্রী সরাসরি গাঁওবুড়োকে ডাকে। বলে, দশ কিলো চাল দিবি, দু—কিলো গুড়, বুরুডিহা নিয়ে যাবি। মিশ্রজী তোদের জন্যে হায়জা তাড়াতে যজ্ঞ করছে। কোথা পাব। চাল কার ঘরে আছে?
তা আমি জানি?
মাস্টারবাবু বলে সুঁই নিলে হায়জা যাবে। যাগযগ করলে মোদের কি? মোদের কি খেতে দিবি? মিশ্রজীর যাগযগে চাল আর বেগারি ত কতবার দিলাম। এবার খুব আকাল।
না দিলে না দিবি।
ব্রিজভূষণ সহাস্যে চলে যায়। গ্রাম থেকে যাবার আগে বালকৃষ্ণকে টাকা দিয়ে ওর রেডিও ব্যাটারি আনতে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে যায়। বলে যায়, দেখে বড়ো ভালো লাগল মাস্টারবাবু। ওরা আপনার কথায় খুব ভক্তি করে।
বালকৃষ্ণ এর পর সকালের বাসে রাঁচি চলে যায়। কর্তৃপক্ষকে জানাতে ও ব্যবস্থা করতে ওর দু—দিন লেগে যায়। দু—দিন ঝুঝারের লোকেরা সভয়ে দূরে দূরে কলেরায় মৃতদেহের চিতাগ্নি দেখে, মাস্টারে আস্থা রেখে ব্রিজভূষণকে চাল না দেওয়া অবিমৃষ্যকারিতা হল কি না, তা ভাবে। এর মধ্যে মিশ্রীজীর ওখানে মহাযজ্ঞ লেগে যায়। সে যজ্ঞে অন্যান্য ব্রাত্যরা প্রসাদ পাবে না জেনেও চাল ও বেগারি দিচ্ছে, তারা শুধু বাকি রইল। এ কেমন হল, তা নিয়ে ভেবে চিন্তাকুল হয়।
কার্যকালে দেখা যায় যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন, সেই খানেতে ‘তাঁর’ চরণ ফেলার কোনো ইচ্ছাই নেই। ওটি বিশ্বাসী ও সৎ কবির ইচ্ছা মাত্র। কেননা সেই ‘তিনি’ মিশ্রজীর যজ্ঞে পূজা নিতে থাকেন। অফিসিয়ালি সকল মস্তান যজ্ঞের জায়গায় থাকলেও মাস্টারের জনহীন ঘর ও স্কুলচালা পুড়ে যায়। ঝুঝারের একমাত্র জলউৎস পঞ্চায়েত দীঘিতে জনৈক কলেরায় মৃতের দেহ ভাসে এবং দু—পাশের গ্রামবাসীরা মড়াটিকে ডিনাই করে, ঝুঝারবাসীদের ‘অবিশ্বাসী’ ‘হারামি’ বলে গাল পেড়ে জল নিতে দেয় না নিজেদের কুয়ো থেকে। মড়াটি টেনে তুলে দূরে ফেলে ঝুঝারবাসীরা সেই জলই পান করে। ফলে ঝুঝারে কলেরার মড়ক লাগে।
মাস্টার কখনোই এসে ঝুঝারে পৌঁছয় না, ফলে ঝুঝারবাসী আতঙ্কে বিশ্বাস হারায়, ব্রিজভূষণের কাছে ছোটে এবং চাটিমাটি বেচে প্রায়শ্চিত্ত পূজা পাঠাতে চায় মিশ্রজীকে। ব্রিজভূষণ বলে, না না, ব্রাহ্মণ দেওতাকে তোরা অপমান করেছিস। তোদের পূজা তিনি নেবেন না।
মিশ্রজী ক্ষমাসুন্দর হেসে স্বয়ং চলে আসেন ঝুঝার। সকলকে প্রসাদী পেঁড়া ও পচা পেঁপে দেন। বলেন, ব্রাহ্মণ ক্ষমা করতেও জানে রে।
ফলে ব্রাহ্মণত্ব যে সুপ্রিম ফোর্স তা ঝুঝারবাসীর ও অন্যান্য গ্রামীণদের মনে প্রতিষ্ঠা পায়।
মাস্টার আসে না বলেই হেলথ ডিপাট গাড়ি পাঠায় না। পরে হাটিয়ারের পথে মাস্টারের গাড়ি—চাপা শব পাওয়া যায়। তার মৃত্যুর সদুত্তর শহরে মেলে না। কিন্তু জঙ্গলে মহাজন পদাশ্রয়ী গ্রামগুলিতে এই মৃত্যু প্রতীকী ডাইমেনশন লাভ করে। ভালাতোড় থানার অফিসার গোপন রিপোর্টে লেখেন, ‘লোকটি এজিটেটর ছিল। গ্রামবাসীদের সঙ্গে তার মেলামেশা দেখে বোঝা যেত ও আসলে কমনিস বা সোসালিস।’ এর পরে পরে যে ঘটনা ঘটে, তা খুবই দ্যোতক। সময়, অর্থাৎ কাল দশকে দশকে এগোতে থাকে এবং অঞ্চলে কোথাও থার্মাল পাওয়ার স্টেশন উদ্বোধন করতে এসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী প্রেস মারফত ভারত ও বহির্ভারতকে জানান, ‘উই রিচ দা মডার্ন টাইমস।’ ফলে রাঁচি ও অন্যান্য শহরে উক্তিটি প্রচুর প্রচারলাভ করে।
মডার্ন টাইমসে অঞ্চলটি পদক্ষেপ করার পর যে ঘটনাটি ঘটে, ষাটের দশকের শেষ বছরে, সেটি শিক্ষককেন্দ্রিক নয়, ছাত্রকেন্দ্রিক। টাহাড় গ্রামটি ফলবাগিচার জন্য বিখ্যাত। সেখানকার আমরুদ, সরিফা, জামুর, লিচু, পাপাইয়া ও আম দেখার মতো অতিকায়। গ্রামটি ওরিজিনালি ভালাতোড় এস্টেটের অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে, মিশ্রজীর চাচেরা ভাইয়ের, কুন্দনজীর দখলে। কুন্দনজীর বয়স বছর চল্লিশ। সে অতীব বলিষ্ঠ, এবং সাইকেলের চেন দিয়ে দুষ্কৃতকারীদের পেটানোতে দক্ষ। মিশ্রজীর ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং ব্রিজভূষণের মিশ্র—ভক্তি দুই কুন্দনের মধ্যে মূর্ত হয়েছে। টাহাড় গ্রামের স্কুলটি ভালো। মিশ্রপরিবারের পাকা বাড়িতে। ফলে গ্রামের বর্ণেতর জাতির ছেলেরা পড়তে হলে পালানি গ্রামের স্কুলে যায়। যায় না বলাই সত্য হবে। কেননা, আট বছরের ছেলে স্কুলে গেলে এদের চলে না। এদের হিসেবে আট বছরের ছেলে সাবালক। গাইচরি বা অন্য কাজ করে সংসারে সে সাহায্য করে থাকে। ইত্যকার কারণে টাহাড় গ্রামের ছেলেরা কখনো স্কুলে যায় না। পালানি গ্রাম ও টাহাড় গ্রামের মাঝে একটি বোলডার আচ্ছন্ন আন্দোলিত রুক্ষ প্রান্তর। কোনো কোনো বোলডার মনোলিথ সদৃশ। ফলে চাঁদনি রাতে প্রান্তরটির দিকে চাইলে হঠাৎ মনে হয়, বিভিন্ন মাপের ও দৈর্ঘ্যের বহু মানুষ নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। একটি বিশেষ পাথর খুবই অদ্ভুত। লম্বা, চৌকো, মোটা। পাথরটি সম্পর্কে প্রবাদ আছে, ওটি জীয়ন্ত হয় এবং প্রত্যহ একটু করে জায়গা বদল করে। ওটি পাথর নয়, প্রেতাত্মা এবং ওটির কোনো উদ্দেশ্য আছে। প্রবাদটির সত্যতা কেউ যাচাই করতে যায়নি। কিন্তু নির্জন সময়ে পাথরটির কাছ দিয়ে কেউ একা যায় না। কুন্দন মিশ্র একদিন ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ দেখল একটা বছর দশেকের ছেলে পাথরটির নীচ থেকে কী নিয়ে লুকিয়ে পড়ল। কুন্দন সভয়ে চোখ ফিরিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। কিছুদূর এসে শোনে কে তাকে ডাকছে, হুজুর! হুজুর সাহেব! আমি!
কুন্দনের কিষাণ সুখিয়া গঞ্জুর ছেলে এতোয়া। সুখিয়া বছর ছয়েক জেল খাটছে কুন্দনের জমি নিয়ে দাঙ্গায়। কুন্দনই ওকে ভরসা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছে। এতোয়ার বউ ঝালো অত্যন্ত দলমলে মেয়েমানুষ। কুন্দনের সে কৃপাভাজন। সুখিয়া জেলে যাবার আগে থেকেই। ঝালোকে কুন্দন কাঁচা ইটের পোক্ত বাড়ি করে দিয়েছে। এ অঞ্চলে কাঁচা ইট রোদে পুড়িয়ে নিলে তা দিয়ে, খাপরার চাল দিয়ে বাড়ি করলে তা বহুকাল টেকে এবং কোনো গঞ্জু পরিবার ওরকম ঘরবাসী হলে জাতের চোখে জাতে ওঠে।
ঝালো যে ওরকম ঘরে থাকবে তা খুবই স্বাভাবিক। কুন্দন যে ঘরে আসে যায়, সে ঘর ভালো হতেই হবে। কুন্দনের যাওয়া আসা সুখিয়ার বা ঝালোর অনুমোদিত কি না, এ প্রশ্ন কেউই তোলেনি। ঝালোদের সমুখের ও পিছনের প্রোজেকশন অসংগত রকম উঁচু ও নৃত্যশীল হলে কুন্দন মিশ্ররা পরগোয়ালে জাবনা খাবে, মুনি বাক্য। ঝালোর বড়ো ছেলে এতোয়ার চেহারা কুন্দনের মতো, সেটি ঝালোর পক্ষে খুবই পয়মন্ত হয়েছে। কুন্দনের ঘরওয়ালির গর্ভজাত সন্তানরা বাপের কুপুত্তুর। যেমন চেহারা, তেমনি রুগণ। স্কুলে পড়ছে তো পড়ছেই, ঘষছে তো ঘষছেই, বুদ্ধির ছিটেফোঁটা নেই।
এতোয়া অফিসিয়ালি সুখিয়ার ছেলে। সে কুন্দনের অতি প্রিয়। কুন্দন তাকে দিয়ে ঘোড়ার পরিচর্যা করায়। ওকে ঘোড়া চড়তেও দেয়, সাইকেল চালাতেও।
এত পেয়ার দিলে নষ্ট হয়ে যাবে। গরিব—দুঃখীর ছেলে।—ঝালো বলে।
এতোয়াকে তুই কিছু বলবি না। ওকে আমি পরে বাগিচা দেখার কাজে দেব। লিখাই—পড়াই জানে না।
পালানিতে যাক না স্কুলে।
কুন্দন ব্যাপারটিকে সম্যক গুরুত্ব দেয়নি। এতোয়ার বিষয়ে ওর মনে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। এরকম একটা ছেলেও ওর ঘরওয়ালির পেটে হয়নি। এত বুদ্ধি, এত সজীবতা আর দুঃসাহস। মরদ বাচ্চা যাকে বলে।
এখন এতোয়াকে আসতে দেখে ও খুবই অবাক হল ও ঘোড়া থামাল। সস্নেহে ওর চুল নেড়ে দিয়ে বলল, দুপুরে এখানে কী করছিস?
হুজুরের জন্যে দাঁড়িয়ে আছি!
কেন?
মাস্টার এই চিঠি দিয়েছে।
মাস্টার? চিঠি।
হাঁ হুজুর। আমি পাশ হয়ে গেলাম।
পাশ হলি?
হাঁ হুজুর। পাঁচ ক্লাস হল। ভালাতোড়ে গিয়ে পড়তে হবে আর আমি বৃত্তিও পাব।
কিসের?
গঞ্জু লোকের বৃত্তি মেলে।
বৃত্তি মেলে?
হাঁ হুজুর, অছুতের বৃত্তি মেলে।
এ পর্যন্ত কুন্দন এতোয়ার কথাগুলি খুব মন দিয়ে শোনেননি। ‘অছুত’ শব্দটি ওর কানে বাজে, এবং তখনি মনে হয়, ওর ঔরসে জন্মালেও এতোয়া ‘অছুত’। এতোয়া ওর ছেলে, তা সবাই যখন জানে ও নিজেও জানে নিশ্চয় কিন্তু কখনোও ওকে ‘হুজুর’ ছাড়া সম্বোধন করে না। কুন্দনের অবৈধ ছেলে হিসেবে টোলিতে ও যথেষ্ট খাতির পায়। ছেলেটা ভালো। কুন্দনকে লজ্জায় ফেলে না। গ্রামে ও দূরত্ব রেখেই চলে। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে আবদার করে একটু কাছে আসে। এসেও নীচেই থাকে। এখন যেমন। কুন্দন চলেছে ঘোড়ার পিঠে। ও হাঁটছে। মার আদরে ও যত্নে ওর চেহারাও বাড়ন্ত। যারা কুন্দন মিশ্রের বংশ বজায় রাখবে, তারা দুধে ঘিয়ে ডুবে থেকেও কি অপুষ্ট আর রুগণ।
আমাকে কী করতে হবে?
ভালাতোড়ে থাকব, একটু বলে দেবেন।
দেখা যাবে।
গ্রাম চোখে পড়তেই কুন্দন ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
এতোয়া হেঁটে হেঁটে চলল।
পালানির স্কুলে এতোয়ার পাশ করা ও বৃত্তি পাবার ব্যাপারটির রিপারকেশন বহুদূর গড়াল। এতদূর গড়াবে, তা কুন্দনও বোঝেনি।
রাত না হলে কুন্দন বাড়ির অন্দরে ঢোকে না। বাইরের মহলেই তার বাস। রাতে একবার অন্দরে খেতে যায় মাত্র। সে সময়েই তার সঙ্গে ঘরওয়ালির যত কথাবার্তা। এ ব্যবস্থায় ঘরওয়ালিও খুশি। সরু পাছা, চ্যাপটা বুক ও অপুষ্ট শরীর নিয়ে পাঁচবার আঁতুড়ে গিয়ে তার পুরুষ বিষয়ে ভীতি জন্মেছে। উর্বরা মেয়েছেলে সে দেখতে পারে না। ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা কয়েকটি বুড়ি দাই ও চাকর করে। সে থাকে ঠাকুরঘরে। বড়ো জোতদারের মেয়ে এবং স্বামীর সঙ্গে সে যথেষ্ট দাপটে কথা বলে। হনুমান মিশ্র এ পরিবারের কর্তা। তিনি ওকে ‘স্বয়ম লছমী’ বলে থাকেন।
কুন্দন ঘরওয়ালির কথা এতোয়ার পাস সম্পর্কে মনেই রাখে না। উলঙ্গ হয়ে যুবতী দাইয়ের কাছে তেল মেখে স্নান করে ঘুমিয়ে সে সন্ধ্যায় ঝালোর ঘরে গেল, ঝালোকে একটি আটাভাঙা কল কিনে দিয়ে বাসরুটের গ্রাম তিজিহাটে বসত করাবে, এ কথা বলতে এবং তার প্রাপ্য সুখ পেতে।
হুজুরকে আতে দেখে ঝালোর ছেলেরা দিদিমার ঘরে চলে গেল। কুন্দন কিছুক্ষণ ঝালোর শরীরে চাষ দিল। তারপর আটাভাঙা কলের খবরটি দিল।
ঝালো বলল, কথা ছিল একটা।
কী?
এতোয়া।
কী?
ও পড়াই করতে চায়।
পড়াই করবে? তা অনেক পড়াই তো করল। যা শিখেছে, হিসাব রাখতে পারবে। ও পড়াই করতে চায়।
আরে ছোটোজাতের ছেলে, পড়াই করে করবে কী? এতোয়া বলে আমি ওকে পালানির স্কুলে যেতে দিলাম। এর আগে কোন গঞ্জু কোন দোসাদ কোন ধোবির ছেলেকে স্কুলে যেতে দিয়েছি?
মাস্টার বলে ওর দিমাক খুব।
কাকে বলে? তোকে?
হাঁ। ওকে বলে দিল বাবাকে ডাকতে। তো ও বলল, বাবা হাজতে। মাস্টার বলল, তবে মাকে ডাকো।
তুই গেলি?
হাঁ।
কবে গেলি?
কাল। না না। আর বলিস না। এ মাস্টারকেও তাড়াতে হচ্ছে। গঞ্জু—দোসাদ সবাই পড়াই করবে, তো ফল বাগিচা, খেতি—জমি, কাজ করবে কে?
সরকার! আমি আপনার কাছে কুছু মাগি না। না মাঙতে আপনি সব কুছু দেন। এবার আমি এই ভিখ মাঙছি। আমিও ওকে অনেক বুঝিয়েছি, বলেছি। ও মানতা নহি। খুব জিদ্দি। আপনি জানেন ও কীরকম আর কেন এরকম করে। আদর দিয়ে আপ উসকো আশা বাড়িয়ে দিলেন।
যা যা, আমি ওকে একটা সাইকেল কিনে দেব পরে। এখন সময় খুব খারাপ। আরে জানিস না? যে মাস্টার এরকম গঞ্জু—দোসাদকে পড়াইমে উসকানি দেয়, সে নিশ্চয় নকশাল লোক। পুলিশকে ভি পাত্তা দিয়ে দেব।
ঝালো চুপ করে রইল। তারপর বলল, তাই বলব। গঞ্জু—ছেলে, পড়াই করে উ ভি মাস্টার হবে, অনেক কথা বলছে।
না, না, এ ঠিক নয়। এরকম দিমাক বিগড়াবে জানলে আমি ওকে থোড়াই স্কুলে যেতে দিতাম? তা ছাড়া, এখানে সবাই জানে ও কার ছেলে, আমার ভয়ে মুখ খুলে না। ভালাতোড়ে ওকে পড়তে দিলে সবাই বলবে কুন্দন মিশ্র তার গঞ্জু ছেলেকে পড়িয়ে উপরে উঠতে চায়। সেখানে সবাই হাঁস উঠাবে। ইধর—উধর আমার যত দুশমন আছে, সবাই হাতে তুরুপের তাস পেয়ে যাবে। উ ছত্রী, বহোৎ খচড়াই, আমাকে…! ব্রিজভূষণ ছত্রী কুন্দনের প্রতিপক্ষ। যে হনুমান মিশ্র হতে অঞ্চলে ব্রাহ্মণ ধর্মে শ্রেষ্ঠতা প্রচার পাচ্ছে, তাঁরই চাচেরা ভাই কুন্দন। ঝালোদের গর্ভে কুন্দনদের সন্তান উৎপাদনে কুন্দনদের অধিকার আছে। সে সন্তানকে স্কুলে পড়িয়ে মাথায় তোলার অধিকার নেই। ব্রিজভূষণ, কুন্দনকে হেয় করার সুযোগ পেলে ছেড়ে দেবে না। কুন্দনের কপাল এমন হনুমান মিশ্র তার কথায় চেয়ে ব্রিজভূষণের কথায় আস্থা রাখেন বেশি। এতোয়াকে কোনো মতেই ভালাতোড় গিয়ে উঁচু ক্লাসে পড়তে দেবে না, সে বিষয়ে কুন্দনের মন অনড়। কিন্তু এতোয়া বিষয়ক কনভারসেশন চালাতে চালাতে কুন্দনের মনে কয়েকটি উপলব্ধি অসংলগ্নভাবে খেলা করে জলে আঁকা ছবির মতো মিলিয়ে গেল। যেমন—
এতোয়াকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। শুধু জবরদস্তি বা জোর খাটানো নয়, তার সঙ্গে ই সন্তানের প্রতি তীব্র স্নেহ ও মমতা। সম্ভব হলে সে এতোয়াকে হয়তো পড়তে দিত। কিন্তু তা কি সম্ভব?
ঝালো খুবই প্রয়োজনীয় তার কাছে এবং ঝালোর চুপ করে যাওয়ার মধ্যে, কুন্দনের হুকুম মেনে নেওয়ার মধ্যে এই ভাবটা স্পষ্ট ঝালো খুব প্রসন্ন মনে মেনে নিচ্ছে না হুজুর সরকারের হুকুম। স্বগত চিন্তাতেও ঝালো তার বিরুদ্ধে যেতে পারে? চিন্তাতেও অসহ এবং নিষ্ফল ক্রোধ। ঝালোকেও সে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে।
এতোয়ার পড়তে চাওয়া ও পালানির মাস্টারের সে প্রসঙ্গে মদত দানের মধ্যে যেন একটা বদলে—যাওয়া হাওয়ার আঁচ আছে। কুন্দনের কি সাবধান হওয়া উচিত? সাবধান? কিসের বিরুদ্ধে বা বিষয়ে? মনের নীচে ভয় কেন? কুন্দন কালই বন্দুক দুটো সাফ করবে।
কুন্দন ঝালোকে বলল, এ মহল্লার ছত্রিশটা গ্রামের মধ্যে কোনোদিন আমরা গঞ্জু— দোসাদকে সরকারি ব্যবস্থায় স্কুলে পড়তে দিইনি, আজও দেব না। উ নাখারা বাত ভুলে যা। গঞ্জু পড়বে। তাহলে তো জুত্তি সে ছাতা বনত, মানুষ মাথায় দিত।
এই সময়ে বন্ধ দরজার বাইরে একটা অদ্ভুত শব্দ হল। যেন বহুক্ষণ দম আটকে ধরে রেখে কেউ নিশ্বাস ফেলল। ছোটো ছোটো পায়ের শব্দ। ঝালোর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। কুন্দন কিন্তু হাসল ও বলল, এ নিশ্চয় এতোয়া। ভালোই হয়েছে বেটা আপন কানে সব শুনে নিল।
তারপর বলল, আজ তাড়াতাড়ি চলে এলাম, বলতে… এতোয়াকে দিয়ে যাব ক—দিন বাদে…ঠিক বলতে আসিনি। এখন মনে হল…ওর এত পড়াইয়ের শখ, রামগড়ে দোকানে ঝাড়ু—জল দেবে…কাহনু ওকে অঙ্ক হিসাব শেখাবে। তোর আটা কলে তো হিসাব রাখতে হবে।
ঝালো এবং কুন্দন গভীর বিস্ময়ে পরস্পরের দিকে তাকাল। এ—রকম গলায় এত ইতস্তত করে কুন্দন কখনো কথা বলেনি। এতোয়া ছাড়াও ওদের আরও দুটি সন্তান আছে যেমন, তেমন এও সত্য যে কালই কুন্দন ওকে তাড়িয়ে দিলে দেশ—ঘর কেউ তাতে নিয়মের ব্যতিক্রম দেখবে না, ঝালো তো নয়ই। দেওয়ালে গোলা রঙে আঁকা বিকট প্রোপোরশনের পাখি ও বানরদের চোখও বিস্ময়ে বড়ো বড়ো হয়ে উঠল। রাতে ঘরে খেতে গিয়ে কুন্দন প্রথম টের পেল হাওয়া সত্যিই বদলেছে। কোথাও বন মেঁ আগ লেগে থাকবে। কেননা বাতাসে দাবানলের আঁচ ছিল।
ঘরওয়ালির মুখ থমথমে, চোখ লাল, কান্না ও রাগে গলার স্বর বিকৃত। কুন্দনের সামনে বসে সে পাখির বাতাস করে গেল। কিন্তু কথা বলল না।
কী হল?
আমি বাপের বাড়ি যাব।
কেন?
এ অপমানের পর টাহাড়ে থাকব না।
কী অপমান?
আমার গোপাল—গোবিন স্কুলে পাশ করল না, আর ওই ঝালোর ছেলে।…
ও।
এতোয়াকে দেখ—ভাল করতে লোক আছে আমার ছেলেরা বাপ থাকতে অনাথ। এখন আমার মুখে লাথি মেরে এতোয়া যাবে বড়ো স্কুলে। ব্রাহ্মণের ছেলে থাকবে গ্রামের স্কুলে, গঞ্জুর ছেলে…
না।
কুন্দন হঠাৎ ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে উঠল। গর্জে উঠল, তার আগে আমি ওকে মেরে ফেলব।
কথাটা কুন্দন খুব জোরেই বলে এবং অন্তরের দাসীরা বাইরের দাসী ও নোকররা সবাই শুনতে পায়। পরে কথাটি নিয়ে কানাঘুষোও হয়েছিল।
কুন্দনের গলায় প্রচুর হিংস্রতা ছিল, তাতেও ভয় পেল না ঘরওয়ালি। বলল, এর ব্যবস্থা না হলে আমি দেওতার কাছে যাব। ঝালোকে বাড়ির সামনে ঘর করে না দিলে চলছিল না? দেওতা কতবার বলেছিলেন বাহারের জঞ্জাল বাহার রাখতে। বক্তব্যটির আণ্ডারলাইং থ্রেট কুন্দনের কানে বাজল এবং সে বলল তারও ব্যবস্থা করব। ব্যবস্থা হবে আমি মরলে।
তুই মরবি? তুই পাঁচশো বছর বাঁচবি।
কুন্দন ঘন দুধ ও মিছরির কটোরা ঠেলে দিয়ে উঠে গেল।
কুন্দন সকালে এতোয়াকে ডেকে খুব ডেঁটে দেয়, ঝালোকেও, এবং তারপর ব্যাপারটিকে আর গুরুত্ব দেয় না। ও বোঝেনি পাশ করা এবং মাস্টারের ভূয়সী প্রশংসা এতোয়ার মানসিকতায় কী রূপান্তর ঘটিয়েছে। মানুষের মন, এক গঞ্জু বালকের মন, ভূস্তর সদৃশ। তাতে নিরন্তর স্তরপরিবর্তন—বিচূর্ণ—সম্ভেদ—অবক্ষতি চলতে চলতে পালল শিলা কেলাসিত হয়ে হীরক—কঠিন হতে পারে। এতোয়ার মনে এ সবই ঘটে যায়। দ্রুত। মানুষের মন জড় পৃথিবী নয়। তাতে রূপান্তর সকল দ্রুত ঘটে। যা কোটি কোটি বছরে ঘটার কথা, তা দু—তিন দিনে ঘটলে ফলটি পরিমাণে মানুষটির পক্ষে বিধ্বংসী ও বিনাশকারী হতে পারে। এতোয়ার ক্ষেত্রে হয়েছিল।
দিন তিনেক বাদে ঝালো একটি বেতলের রেকাবিতে কয়েকটি পেঁপে, ফুল ও তিলকুট রেখে যায় কুন্দনের গোহালে। পুজোর প্রসাদ গঞ্জু ও দোসাদারা গোয়ালেই রেখে যায়। কিসের পুজো, কেন পুজো তা জানা যায়নি।
এতোয়াকে গ্রামে পাওয়া যায় না। জানা যায়, পালানির মাস্টারও তাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। বুরুডিহার সোমরা গঞ্জু টাহাড়ে মেয়ের বাড়ি সোশাল ভিজিটে এসে গঞ্জুদের কাছে এতোয়ার কেসটি যথেষ্ট সহানুভূতি সহকারে শোনে। এক নম্বর চোলাইয়ের মহিমায় তার শীর্ণ, উড়ন্ত পরীর উলকি—আঁকা বুকে অসংগত উদারতা জাগে। সে বলে, এতোয়া যাক না কেন? ভালাতোড়ে আমার চাচি আছে। তার ঘরে থাকবি। জলপানি হতে তারে দুটো টাকা দিস, ছাগল চরাই করে দিস। হাঁ, আমি বলে দিব।
সোমরার মানসিকতা যথারীতি গ্রামীণ টরচুআস পদ্ধতিতে ফাংশান করে। যে কাজ করতে কুন্দনের অনিচ্ছে, সে কাজ করলে তার ভালো লাগবে।
কেন ভালো লাগবে? কেননা কুন্দন, হনুমান মিশ্রের চাচেরা ভাই। হনুমান মিশ্র সোমরার কী করেছে, কী করছে?
খচড়াই।
কেমন করে?
সোমরার সর্বসাকুল্যে এক বিঘা জমি। জমিটি যে তার, সে কবুলিয়ত পাট্টা আছে। হনুমান মিশ্র এবং লালারা সকল গঞ্জুর জমি, বিভিন্ন ধার কর্জের এগেনস্টে বৈধ ও আইনসম্মত প্রশাসন—অনুমোদিত উপায়ে হাত করেছে। সোমরার জমিটি সোমরা তার জামাইকে দিতে চায়। জামাই বুদ্ধি করে জমির খাজনা দিচ্ছে রিটার্ন নিচ্ছে। এ এক কারণে জমি নেওয়া যাচ্ছে না।
কোনো গঞ্জুর জমিই কাগজেপত্তরে পরিষ্কার নয়। সোমরার জমি একসেপশন। এ স্বখাতসলিল লালাদের সৃষ্ট। লালাবাবুদের একজনের শখ যায় বাগানে শিকার খেলবে। শখটির পিছনে বিলাইতি সাদা ঘোড়া ছিল। অশ্বশক্তিতে ইলেকট্রিফায়েড লালাবাবু আদাড়ে পাঁদাড়ে গুলি ছুঁড়ে এক বৈপ্লবিক গন্ডগোল বাধান। বুড়ি গাইটি জাবর কাটতে কাটতে দাপনায় গুলি খায়। গো—হত্যা ঘটে যেত, ভীষণ পাপের করাল ছায়ায় লালা ভবন অন্ধকার হয়ে যেত।
সোমরার বাপ তার নেটিভ ওষুধ প্রয়োগ করে গাই বাঁচায়। ফলে লালা জননী তাকে একটি এঁড়ে বাছুর দেন। এবং ছেলেদের বাধ্য করেন ওর জমি না নিতে, লিখাইপড়াই করে দিতে। আসন্ন নরক থেকে খালাস পেয়ে হৃষ্ট মনে ছেলেরা মায়ের কথা শোনে। এখন মিশ্রজী বুরুডিহায় মোতায়েন হবার পর থেকে, তাঁর শিবমন্দির সংবলিত বাসগৃহের পাশে ফণীমনসার বেড়া দেওয়া সোমরার জমিটি বড়ো খারাপ দেখায়। গঞ্জুরা সবাই জমি হারিয়ে জঙ্গল এনক্রোচ করে টোলি বেঁধে বাস করছে। সোমরা একটা প্রায় আফলা, মাড়োয়া ও জই জমানা জমির মালিক। এটি অসহ এক অ্যানাক্রোনিজম। তারপর বউ মরে যাবার এতকাল কাটিয়ে হঠাৎ সে বিয়ে করবে বলে তাল তুলেছে। জামাইকে সে টিপ দিয়ে জমি দিয়ে দিয়েছে। অতএব তার বিয়েতে মেয়ে জামাইয়ের অমত নেই।
হনুমান মিশ্রের রীতিমতো অমত। তিনি সোমরার পিছনে লেগে আছেন। ইত্যকার কারণে সোমরাও দেওতার ওপর চটে গেছে। এতোয়া বড়ো ইস্কুলে পড়লে কুন্দন কেন, দেওতাও চটে যাবেন তা সে জানে। অতএব সে এতোয়াকে মদত দিল।
ঝালো বুঝল, কুন্দন চটবে। কিন্তু সবাই বলল, আমাদের ঘরে কেউ পড়াই করেনি, এতোয়া করবে, তাতে আমাদের বুক বড়ো হবে।
হুজুর সরকার…
সবাই বলল, হুজুর সরকার চটলে কি তোর মাথা কেটে নেবে? জেল থেকে ফিরছে সুখিয়া, সে ফিরলে তোকে এই গঞ্জুটোলিতে থাকতে হবে না আবার?
অবশেষে ঠিক হল, পালানির মন্দিরে পূজা দিয়ে নিলে কোনো আপদ ঘটবে না। ঝালো সেই পুজোর প্রসাদই কুন্দনের গোহালে রেখে আসে। ঝালো খুব খুশি মনে রাজি হয়নি আবার অখুশিও হয়নি। ওর বিশ্বাস ছিল এতোয়ার বয়স বিবেচনা করে, কুন্দন তাকে এখনো চায় যখন, তখন সে জন্যেও মাপ করবে। ঝালো কখনোই কুন্দনকে কোনো নির্মম বা নিষ্ঠুর কাজ করতে দেখেনি। কুন্দন খুব নিদারুণ শাস্তি দেবে সে ভয় ওর কমে যাচ্ছিল। পাঁচজন ওকে ভরসা দেয়। ঠিক হয় টাহাড় থেকে চলে গিয়ে পালানিতে গঞ্জুটোলিতে এতোয়া থেকে যাবে এবং সন্ধ্যায় যে সরকারি বাস পোস্ট—ব্যাগ নেয় তাতে চড়ে ভালাতোড় যাবে। সোমরা আগে থেকে ভালাতোড় গিয়ে অপেক্ষা করবে। কুন্দন কী ভাবে জানতে পারে অথবা আদৌ জানতে পার কি না তা নানাবিধ স্পেকুলেশনের আনডারে। কয়েকটি কথা জানা আবশ্যিক।
(১) বুরুডিহাতে হনুমান মিশ্র সন্ধ্যারতি করতে করতে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন ও ঢলে পড়েন। সুস্থ হলে পরে বলেন, তিনি হঠাৎ দেখলেন ও মন্দির—টন্দির কিছু নেই। তিনি টাহাড় ও পালানির মাঝামাঝি সেই প্রান্তরটা দেখতে পাচ্ছেন। সেই প্রাতে পাওয়া প্রান্তর। সেই অশান্ত ও অস্থির পাথরটা যেন পথের দিকে ঝুঁকে পথে কী দেখছে। এখন সকলের মনে পড়ে ঝুঝার গ্রামে কলেরার মড়ক ও বালকৃষ্ণ মাস্টারের মৃত্যু সবই তিনি দিব্যচোখে দেখেছিলেন। সকলেই ভয় পায় ও এ—ওর দিকে চায়। ভারত মুণ্ডা বলে, সব হল সময়ের দোষ। ওগুলো এক কালে মুণ্ডা জনপদ ছিল। ওগুলি মুণ্ডাদের সোঁসানবুরু। সমাধি প্রস্তর। এখন না হয় সে গ্রাম নেই। তবু ওই সব পাথরের নীচে পিসাব করা, ওগুলোর গায়ে ছাগল—গোরুকে দিয়ে হাগানো কি ঠিক?
(২) সন্ধ্যার পর ঘোড়ার খুরের নীচে বালির থলি বেঁধে চললে যেমন শব্দ হয়, তেমন চাপা শব্দ জোড়া ঘোড়ার খুরে শোনা যায়। শব্দ শুনে টাহাড়ের লোকরা ডাকাতের ভয় খায় ও ঘরের ইন্দিছিন্দি এঁটে শুয়ে পড়ে।
(৩) ভোর রাতে টাহাড় গ্রামের সকলে একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ন চিৎকার ভেসে আসতে শোনে। চিৎকারটিতে এত আর্জেনসি আতঙ্ক যে সেটি রাতচরা পাখির ডাক বলে মনে হয় না। যেন মানুষ চেঁচাল।
সকাল হয়। দুপুর হয়। বিকেলে ঝালো পালানি—যাত্রী গোয়ালাদের বলে দেয় এতোয়া ভালোয়—ভালোয় গেছে সে খবরটি জেনে আসতে। গোয়ালারা সন্ধ্যার পর ফিরে এসে বলে ঝালোর ননদ—নন্দাই খুব চটে গেছে। বাসস্টপে ওকে বসিয়ে নন্দাই গিয়েছিল দোকানে। এসে দেখে ছোঁড়া উধাও। দোকানে বসে চা খেতে, কথা কইতে, বিড়ি খেতে সময় গিয়েছিল বটে, তা বলে ছোঁড়া না বলে চলে গেল? ছেলে নিশ্চয় টাহাড় ফিরেছে। ঝালো ন্যাকামি করে খোঁজ করতে পাঠিয়েছে কেন?
এখন ঝালোর মনে অ্যালার্ম সিগনাল বাজে। কারো কথা না শুনে সে হাতে ধোঁয়াটে লণ্ঠন নেয়। সকলকে বলে, ছোটো ছেলে! শেষ অবধি দূরে যেতে সাহস পায়নি। হয়তো ফিরে আসতে পারেনি।
সবাই বলে, ফিরে আসতে পারেনি, তো গেল কোথায়?
ঝালো বিপন্ন বোধ করে বলে প্রথমে কুন্দনের কাছে যায় কিন্তু কুন্দন দুদিন বাদে রামগড় থেকে ফিরে তখনি শুয়েছে। সে ঝালোর বিপন্ন আর্জিকে মোটে আমল দেয় না ও ভীষণ ধমকে বলে, হারামি ছেলে, লিখাই পড়াই করার নামে কোথায় ভেগেছে তা আমি জানি? বাড়ি এসে কথা বলছিস? জুতোকে প্রশ্রয় দিলে ছাতা হয়ে মাথায় ওঠে, সে দেখছি কহাবৎ নয়, সাচ্চা বাত।
ঝালো তখন একাই লণ্ঠন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রান্তরটির অপবাদে সে আমল দেয় না। অগত্যা আর দু—চারজন পুরুষও চলে তার সাথে। এগোতে এগোতে ঝালো আর্তস্বরে ডাকতে থাকে, এতোয়া! বোলৎকায় নাই? কাঁহায়াছে, এতোয়া? এবং লণ্ঠনটি তুলে ধরে সে জ্যোৎস্নার অস্পষ্টতা ভেদ করে দেখতে চেষ্টা করে। চেষ্টা করতে করতে তারই চোখে পড়ে সেই অস্থির ও পিপাসিত পাথরটির নীচে সাদা কি যেন। পুরুষরা প্রেতভয়ে দৌড় মারে, কিন্তু ঝালো হনহন করে এগিয়ে যায়, টিলায় ওঠে, এবং আর্ত হাহাকারে প্রান্তরে প্রত্যেকটি সুষুপ্ত মনোলিথের ঘুম ও কৌতূহলী করে তোলে। মূল ভূগর্ভে প্রোথিত না থাকলে তারাও ছুটে এসে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৯ ধারা মতে কালপেবল হমিসাইড অ্যামাউটিং টু মার্ডার—এর কেসটি দেখত।
এতোয়া পড়তে চেয়েছিল বলে তার লেখার আঙুল, তর্জনী ও বুড়ো আঙুল কেউ কেউ কেটে নেয়। রক্তপাতের ফলে মৃত্যু।
পুলিশ কেস। কুন্দনই অপরাধী গ্রেপ্তারে আগ্রহী। অজ্ঞাত কারণে অজানা আততায়ী কর্তৃক…তদন্ত চলিতেছে ইত্যাদি।
ঝালো কাঁদে না ও গুম মেরে থাকে। তারপর শ্মশান থেকে ফিরে এসে ছেলেমেয়েকে নিয়ে গঞ্জুটোলি চলে যায় প্রথমে। আবার শ্বশানে যায়। খুবই অসংলগ্ন আচরণ। তারপর গ্রামে ফেরে। ওর অস্বাভাবিক চলাফেরা দেখে কৌতূহলী হয়ে গঞ্জু স্ত্রী—পুরুষ—ছেলে—মেয়ে একটু তফাত রেখে ওর পেছন পেছন অনুসরণ করে। এতোয়ার মৃত্যুর ফলে গ্রামে একটা অন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়। একটা অস্বাভাবিক মৃত্যু, আরও আরও অস্বাভাবিক সোশ্যাল অথবা অ্যান্টিসোশ্যাল কনডাক্ট অ্যাক্টিভেট করে। মিশ্রবাড়ির পাইকপেয়াদাও নির্বিষ দর্শক হয়ে দেখে যায়। ঝালো তার শুকনো লাল চোখ, ভীষণ মুখ নিয়ে কুন্দনের বাড়ির কাছারি ঘরে ঢোকে ও এক মুঠো ছাই কুন্দনের মুখে ছুঁড়ে মারে। বলে, তোর বেটার ছাই। ছেলেকে মেরে ল্যাংটো হয়ে দাইয়ের কাছে স্নান করে গদিতে বসেছিস? মাথা কামাবি না? অশৌচ করবি না? না করলি, তোকে নির্বংশ করব, তুই নির্বংশ হবি।
গঞ্জুর শবদাহের ছাই দিয়ে ব্রাহ্মণের ঘর অপবিত্র করে সে হনহন করে চলে যায় ও মুখ ফিরিয়ে বলে যায়, নির্বংশ হবি। কুষ্ঠ হয়ে পচে মরবি। নিজের ছেলে খেয়ে গোরক্ত খেয়েছিস।
এর রিপারকেশনে কুন্দন ফার্দার প্রতিশোধ নেয় না এবং হনুমান মিশ্র ঘোষণা করেন, মনোলিথটি এখন স্থির হবে। অচ্ছুত জাতের নিষ্পাপ বালকের রক্ত হল শুদ্ধতম রক্ত। তাতে মনোলিথ বা মানবগঠিত প্রতিমা বা সেতু—বাঁধা পড়তে অনিচ্ছুক নদী, সকলেই তৃপ্ত ও শান্ত হয়। কিন্তু পাথরকে রক্ত খাওয়ানো ঠিক নয়। একবার স্বাদ পেলে বাঘের মতোই পাথরও রক্ত খেতে চায়। মানুষের। জোগাড় করে। বাঘ পাউনস করতে পারে।
পাথর মানুষকে তাইয়ে তাইয়ে স্ব—কাজ হাসিল করে নেয়।
যেহেতু ঝুঝার ও টাহাড়ের দুটি ঘটনাই সময়ের করেন্টে নিক্ষিপ্ত ডাইনামাইট চার্জার, সেহেতু সময়ের নিম্নস্তরে বহু ক্রসকারেন্ট বইতে থাকে। যেহেতু সত্তরের দশক পৌঁছে যায় ও তিন বছরেরটি হয়, সেহেতু ঘটনাবলিও নব নব রূপে বিভাসিত, বিকশিত হয়।
বুরুডিহার পর জঙ্গল। জঙ্গলের পুবে কেনানদ্রা গ্রাম ও পাহাড়। প্রতি দীপাবলিতে আদিবাসীরা তাদের নিঃশেষিত সত্তা নিয়ে প্রেত তাড়ানোর উৎসব করে। এ দিনে কেনানদ্রা পাহাড়ের উপর চ্যাটাল প্রশস্ত পাথুরে প্রান্তে মেলা হয়। আদিবাসীরা প্রেত—প্রতিভূ ধ্বজাগুলি আনে। পাথরের ফাঁকে গোঁজে। তারপর একটি শুয়োরছানাকে খড়ের দড়িতে বেঁধে ক্ষেত্রপাল দেবতা ও সূর্যদেবের উদ্দেশে নিবেদন করে ছুটে যায় পাহাড়ের কিনারে। নীচে, অনেক নীচে একটি বিশাল পাথর। যেন কাছিমের পিঠ। ওটি সমবচ্ছর পাথরই থাকে। কিন্তু এই সকালে হয়ে যায় ক্ষেত্রপালদেব ও সূর্যদেবের প্রতিভূ। প্রতিভূ হয়ে পাথরটি বলি নেয়।
তিয়াত্তর সালের মধ্যে এই সব জায়গা ও জীবনে পুলিশ ঢুকে পড়ে। ব্যাপারটি খুবই বিপ্রতীপ বলতে হবে। কেননা অঞ্চলটি এমন যে, সেখানে টাইম, স্পিড—মোশন ইত্যাদি কথার কোনো মানে দাঁড়ায় না। প্রান্তর—পাহাড়—গাছ—বন—আদিবাসীদের অন্নের বা ঘাটোর তরে আদিম সংগ্রাম—পাথরের পাহারা। পথ বলতে কয়েকটি বাসপথ। নইলে সব পথই পায়ে চলা পথ। গ্রামগুলি এত জনবিরল, এত দূরে দূরে যে চতুর্দিকে নৈঃশব্দ্য আর নৈঃশব্দ্য। ‘সময়’ শব্দটি এখানে এসে থেমে গেছে। সকাল নয়টা বাজল, না দুপুর দুটো—সন্ধে সাতটা না রাত দশটা, সব চিন্তার মানে যেন এখানে বাস করলে হারিয়ে যায়। জীবন—মানুষ প্রকৃতি সব কিছুই আদিম চেহারায় থেকে গেছে এখানে।
পুলিশ হল একেবারেই মানব—সৃষ্ট ব্যাপার। এ হেন পরিবেশে বুট—উর্দি—হেলমেট—বন্দুক সংবলিত পুলিশ ঢুকে পড়ে এবং উগ্রপন্থী পলাতকদের উদ্দেশ্যে গ্রাম—কে—গ্রাম তছনছ করতে থাকে। চলতে থাকে। চলতেই থাকে কুমবিং অপারেশন। কারণ নানাবিধ। সত্তর—একাত্তরের সুবিধে নিয়ে জোতদার মহাজনের অত্যাচার চরমে ওঠে, প্রশাসনের চোখে জোতদার—মহাজন অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হয়ে ওঠে। আর্গুমেন্ট : কেন? উগ্রপন্থীদের টার্গেট কি জোতদারি ও মহাজনি কারবার নয়? যুক্তিটি খুবই বিশ্বাসযোগ্য। ফলে পুলিশ জোতদার—মহাজনকে হেভি মদত দেয়। জোতদার—মহাজন অত্যাচার করবে। বেঠবেগারি নেবে, দেউলে করে ছেড়ে দেবে, এ আদিবাসীদের জীবনে নতুন ব্যাপার নয়। এসব তারা ন্যায্য ও প্রচলিত পাওনা হিসেবেই ধরে নেয়। কিন্তু সত্তর—একাত্তরে অত্যাচার ও শোষণ মাত্রা ছাড়ায়। ফলে স্পোরেডিকালি জোতদার—মহাজন কাটা পড়ে, বন্দুকবাজদের বন্দুক ছিনতাই হয় এবং বন্দুক ছিনতাইদের সঙ্গে নকশালদের জোড়া যায় না। কেন না বহু ক্ষেত্রে বন্দুকটি ভেঙে টুকরো করে ফেলে রেখে যায় ছিনতাই পার্টি। ফলে খোঁচোড়রা ব্যথা পায়। এ কি জঙ্গুলে উজবুকি? বন্দুক ভাঙলি কেন? বন্দুকের সেলিং ভ্যালু প্রচুর। আবার কুমবিং চলে। ক্রমে ক্রমে চারপাশের স্পোরেডিক ঘটনা—সমূহ বুরুডিহার আশপাশে আদিবাসী—মানসিকতায় একটা আশ্চর্য উপলব্ধি ঘটায়। তারা বোঝে জোতদার ও মহাজনও গলা কাটলে মরে যায়, ভয় পায়।
তারা কথা বলে। গোপনে, অন্ধকারের ভাষায়। এখন মনের ব্যাক গ্রাউন্ডে বুড়োবুড়ির কাছে শোনা কোল বিদ্রোহ, খেরোয়ার বিদ্রোহ, হুল, উলগুলানি বিরসা মুণ্ডা, এসব গল্পগুলি যেন সত্য হয়ে ওঠে। রেজাল্ট গোলবদন সাহু।
গোলবদন সাহু বড়ো মহাজন। কেনানদ্রা—কেন্দ্রিক সকল ভূসম্পত্তি সে বছরভোর বন্ডেড লেবার দিয়ে কাজ করায়। কিন্তু সে কারণে তার মৃত্যু ঘটে না।
এবার ১৯৭৩ সালের অঘ্রাণে সে হঠাৎ ভালাতোড় থানা ও রামগড় আর্মি ক্যাম্পের সহায়তায় কেনানদ্রায় একটি পুলিশ ও সেনা ঘাঁটি খোলার অফার দেয়। বন্ডেড লেবাররা জানতে পারে না প্রথমে কেন তারা জঙ্গল কেটে সাফ করছে, ঘরের পর ঘর তুলছে, পথ তৈরি করছে, কুয়ো কাটছে।
তারপর থানা—দারোগা ও আর্মি—অফিসার সরেজমিনে দেখতে আসেন ব্যবস্থাপনা। দেখে তাঁরা সন্তুষ্ট হন ও যেসব কথাবার্তা বলেন, তা জনৈক পোরম ওঁরাও ভাবেটিম রিপোর্ট করে।
—ব্যবস্থা তো জবর। কিন্তু মদ?
—বার খুলে দেব।
—রান্ডি পট্টি খুলতেন যদি একটা…
—এদের মেয়েছেলেরা আছে। দেখুন সেন্টার খুললে খরচ আছে।
সে আমরা ওদের ঘাড় দিয়ে তুলে নেব। এখানে একটা সেন্টার হলে আমার মতো সব মহাজন বাঁচে। কিছু হলে ভালাতোড় থানা ছাড়া উপায় নেই।
আদিবাসীরা সব জানে। অতঃপর সব ভেবেচিন্তে ওরা কয়েকটি হাটবারে, গোলবদনের খাতক অন্য গ্রামীণদের সঙ্গে কথা বলে নেয়। স্থির হয়, পরবের দিনে গোলবদন সাহুকে নেমন্তন্ন করবে ওরা।
গোলবদন নেমন্তন্ন পেয়ে খুশিই হয়। এতে বোঝাই যাচ্ছে, ওরা কিছুই জানে না। এও বোঝা যাচ্ছে, ওরা গোলবদনকে বিশ্বাস করে। গোলবদনেরও ইচ্ছে, ওদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা। ও হেসে বলে, যাব, যাব। মেলা দেখে, পূজা দেখে চলে আসব। তোরা নেশা করবি ত? যাঃ, সেদিনকার তরে আমি তোদের এক পিপা মদ দিব। কাঠের পিপা, সিপাহীদের রাম। অমন জিনিস তোরা খাস নাই।
কেনানদ্রা পাহাড়ের উপরে দেয়ালির সুন্দর সকালে দশটা নাগাদ বহু গ্রামের নরনারী শিশু বালক—বালিকা বৃদ্ধ—বৃদ্ধা পরিষ্কার কাপড় পরে প্রেতনিশানি ধ্বজা নিয়ে আসে। প্রচুর মদ খায় তারা, ভীষণ প্রতিজ্ঞায় কঠোর মুখে সূর্য পানে লাফ মেরে মেরে নাচে, ধ্বজাগুলি কাটে স্পেশাল হিংস্র কোপে। এরপর জনৈক পহানের ওপর ভর হওয়া ও বলিদান বাকি থাকে।
ভর হয়। জনৈক জীর্ণ ও শীর্ণ বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে হাত তুলে চুপ করে থাকে ও দুলতে থাকে। গোলবদন সাহু বলে, লেঃ বাবা, এলাম, পূজা দেখলাম, এবার তো তোরা শুওর বলি দিবি? ওটা আর নাই দেখলাম।
খাতকরা আর্মি রাম পিয়ে মাতাল আনন্দে ঘেঁষে আসে ও কথা বলে না। গোলবদনকে কর্ডন করে।
লেঃ, সর তোরা…
গোলবদনের কথা শেষ হতে পায় না। পহানটি আকাশ থেকে কোন নির্দেশ পায় ও চিৎকার করে। রাহো রাহো রা… হো বলে পাথর থেকে নামে। হতচকিত গোলবদনকে সবাই চেপে ধরে, ল্যাংটা করে। খড়ের দড়িতে তাকে পেঁচিয়ে বাঁধে, মাথায় মদ ঢালে, কপালে সিঁদুর দেয়। তারপর তাকে শূন্যে তুলে ধরে পাহাড়ের কিনারে চলে যায়। পহান চেঁচিয়ে বলে, সূর্যদেব! ক্ষেত্রপাল! এবার বড়ো বলি এনেছি হে, বড়ো বলি। গোলবদনকে তারা সূর্য পানে ছুঁড়ে দেয়। নীচে পাথরটি সাগ্রহে অপেক্ষা করে। ধপ। একটা ভীষণ শব্দ। সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখে। গোলবদনকে চাকর ছুটে পালায়। যে আর্মি ও পুলিশ ঢুকে পড়বে জীবনে বলে আদিবাসীদের ভয়, সেই আর্মি, সেই পুলিশ, পহান এবং যে ছয়জন গোলবদনকে ধরে তুলেছিল তাদের খোঁজে গ্রাম—কে—গ্রাম চাষ করে, ঘর নাড়ায়, পিটুনি খাজনা বসায়, যুবতীদের রান্ডি করে ছাড়ে। সাতজন ওঁরাও পালায়, শুধু পালায়। কেনানদ্রা—কেন্দ্রিক জঙ্গলকেই তাদের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বলে মনে হয়। পহান বলে, জল আছে। চল খুঁজে নিব।
—কোথায়?
—জঙ্গলের ভিতর।
জঙ্গলের মধ্যে কোথাও জলাশয় আছে জেনে তারা ছুটতে থাকে ও অন্ধকারে কুলুকুলু শুনে বোঝে ঝরনা আছে। জল অবধি পৌঁছে ওরা নীচু হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জল খেতে এবং তখনি শোনে ক্রুদ্ধ ফোঁসফাঁস। মাথা তুলে দেখে জলপান নিরত একটি হাতি।
হাঁথি, হাঁথি।
ভীষণ ভয়ে জল না খেয়ে ওরা ওঠে ও তখনি শোনে—ডরো মৎ। হাঁথি কুছু করবে না। জগমোহন। উ লোক কি জল পিবে। হটকে আও ভৈয়া!
মানুষী কণ্ঠস্বরে পলাতকরা আরও ভয় পায় এবং হাঁচড়ে পাঁচড়ে জল থেকে উঠে ছুটতে থাকে। বুলাকি খুব অবাক হয়। জগমোহনকে শান্ত করে এবং ভাবতে চেষ্টা করে ব্যাপারটি কী ঘটল। রাত ঘনালে আদিবাসী লোক জঙ্গল দিয়ে শর্টকাট করতে পারে। কিন্তু তাদের হাতে লণ্ঠন, গলায় কথাবার্তা থাকবে। নয়তো গান। এ রকম নিশ্চুপে ওরা এল কেন, এবং বুলাকির গলা শুনে ভয় পেল কেন?
সকাল হতে বুলাকি গাছে চড়ে ও দূরে বুরুডিহা গ্রামের শিবমন্দিরের ধ্বজা দেখে সেখানে যাবে বলে ঠিক করে।
কিন্তু সকালে সে দেখে পুলিশ। জঙ্গলে পুলিশ দেখে সে ঘাবড়ে যায় এবং পুলিশরাও তাকে দেখে ঘাবড়ায়।
—তুমি কে?
—বনারসের মোহান্তের মাহুত। এ হাঁতি ভি মোহান্ত মহারাজের।
—সরকারি বনে ঢুকেছ কেন?
—জানি না হুজুর।
—সাতটা ওঁরাওকে দেখেছ?
মনের মধ্যে বিপদের সংকেত। বুলাকি বোঝে সে বিপন্ন এখন।
—না হুজুর।
—ঠিক বলছ?
—ঠিক বলছি। মোহান্তের হাঁথি নিয়ে আমি তো কতদিন থেকে বনে জঙ্গলে ঘুরি, সবাই জানে। মিছে কেন বলব?
—নিকাল যাও জঙ্গল সে।
বুলাকি অত্যন্ত ভয় পায় ও ”কোমাণ্ডি কোমাণ্ডি জগমোহন” বলে বুরুডিহা পিছনে রেখে চলে যায়। এভাবেই সে তৃতীয় সিগনিফিকেন্ট ঘটনাটির আওতায় আসে। সে ও জগমোহন। এবং এভাবেই মানুষ সৃষ্ট পুলিশ ও পলাতকের ঘটনাটি পিছনে ফেলে আবার কোনো ডেসটিনেশনে রওনা হয়। বুরুডিহা ও জগমোহনের যোগাযোগ এবারও ঘটে না।
সাতজন ওঁরাও পালায়, শুধু পালায়। পাঁচদিন বাদে ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত, তাড়িত সন্ধ্যার মুখে ঢুকে পড়ে বুরুডিহা। ভয়ে নিঃসাড়ে থাকে ও রাত হলে গ্রামে ঢুকে জল খোঁজে। যেহেতু লালাদের সঙ্গে গোলবদনের দীর্ঘকালীন শত্রুতা ও বিধির দীর্ঘ মেয়াদি মোকদ্দমা, সেহেতু বুরুডিহাকে মনে হয় নিরাপদ। তারা সোমরা গঞ্জুকে ডেকে তোলে ও জল খায়। সোমরা কলসিতে লাথি মেরে দেখে জল নেই। সে বলে, দড়ি ও কলসি নিচ্ছি। চল, জল দিব।
ও পলাতকদের হনুমান মিশ্রের শিবমন্দিরের সামনে আনে। কিন্তু সভয়ে পহান চেঁচিয়ে ওঠে, দেওতার কুয়া। আমরা ছুঁব না।
চুপ চুপ!
না, তু জল এনে দে।
আরে আমি তো গঞ্জু আছি।
আমরা ছুঁব না।
জল চুরায়ে খাবি, ডর কি?
না।
কথাবার্তা শুনে মিশ্রজী বেরিয়ে আসেন। ওদের ডাকেন। বসতে বলেন। স্বহস্তে জল তুলে ছোঁয়া বাঁচিয়ে ওদের আঁজলায় ঢেলে দেন। তারপর বলেন, রাতে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকগে। ভোরে পালাস।
রাতেই তিনি থানায় খবর দেন, এমার্জেন্সি আউটপোস্টে। বলেন, খুব জল খেয়েছে। পালাতে পারবে না। নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে।
দেওতার কথা মিথ্যে হয় না। তারা ধরা পড়ে। হনুমান মিশ্রের আন্তরিক চেষ্টাতেও ওদের সঙ্গে সোমরাকে জোড়া যায় না। তবে অছুত হয়ে মন্দিরের কুয়োর জল চুরি করার ইচ্ছে হয়েছিল বলে দারোগা সোমরাকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন।
এর পর, মাঘ মাসে শিবরাত্রির প্রসাদ নিতে সোমরা অস্বীকার করে ও মৌয়া খেয়ে চেঁচিয়ে বলে, ব্রাহ্মণ। দেওতা! আশ্রয় নিচ্ছিল ওরা মন্দিরে? ধরিয়ে দিলেন? এটা দেওতার কাজ হল?
হনুমান মিশ্রের কানে কথাগুলি যায়। তিনি রাগে গুমরে থাকেন। লালাদের বলেন, ছোটো জাতের জমি মন্দিরের বগলে। তার হাতে আদালতের কাগজ! ওকে না উঠালে আমার শান্তি হবে না।
লালাদের কিছু করার থাকে না। মাকে কথা দেওয়া আছে।
জরুরি অবস্থার সময়টি ভালো ছিল। তখন সোমরাকে জমি থেকে ঠেঙিয়ে তোলা যেত। কিন্তু এ বৎসরাধিক কাল, আর্মির কন্ট্রাক্টরি পাওয়ার ফলে মিশ্রজী রামগড় ও রাঁচিতে কাটান। জরুরি অবস্থা যায়। ভারতের মুক্তিসূর্যকে রাজনারায়ণ হোম কনস্টিটিউয়েনসিতে ল্যাং মেরে ফেলে দেন। হঠাৎ হনুমান মিশ্রের মাথা থেকে হাত, পায়ের নীচ থেকে মেঝে সরে যায়। নতুন সরকার আসে। পুরোনো প্রশাসনিক লোকজন প্রথম কয় দিন বোঝে না কী হল। কিন্তু হঠাৎ সবাই ঘাবড়ে যায়। কেননা জেলার কমিশনার ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে ভালাতোড় থানার ও. সি. অবধি সবাই বদলি হতে থাকেন। এ রকম সামারি ট্রানসফারে থানা—বি.ডি.ও. আপিস—কৃষি আপিস—সব জায়গার লোকজন আতান্তরে পড়েন। ব্রিজভূষণ ছত্রী অবধি ঘাবড়ে যায়, কেননা হঠাৎ বেছে বেছে তপসিলি জাতের একজন এ সব বেলটে আসতে থাকে। স্কুল—ইনসপেক্টর ব্রিজভূষণকে বলে যান, আদিবাসী ও তফসিলি বেলটে আদিবাসী ও তফসিলি ছেলেমেয়ে যদি স্কুলে না আসে, তবে স্কুলের পার্পাস ব্যর্থ। সরকার এ্যায়সা স্কুল নহি রাখেগি। বুঝলেন?
—আমাদের ছেলেমেয়েরা?
—আপনি হলেন সুপারম্যান। তিন গাঁয়ে তিন বউ, এগারোটি ছেলে পাঁচটি মেয়ে। আপনার ছেলেমেয়ে তো পড়বেই। তা বলে লোয়ার কাস্ট ট্রাইবাল ছেলেমেয়ের নাম স্কুল রোলে থাকতে পারে না?
—এ কী বলছেন?
—পছন্দ না হয়, সরকারকে বলে আপার কাস্টের জন্যে স্কুল বানিয়ে দিন। আমার আন্ডারে যে সব স্কুল, তাতে আমি ওদের নাম দেখতে চাই। নইলে আমার চাকরি চলে যাবে। আপনার জন্যে আমি চাকরি খোয়াব?
—ওরা স্কুলে এলেই পারে?
—আপনি আর আপনার দেওতা থাকতে? এতোয়া গঞ্জুর কথা সবাই ভুলে গেছে?
—এ দেখিয়ে! উসমে মুঝকো ফাঁসানা নহি।
—যা বলবার বলে গেলাম। আপনার অনেক ফল—দুধ—ঘি খেয়েছি। ভালো কথা বলে গেলাম।
—আপনিও বদলি হচ্ছেন?
—হতে কতক্ষণ? নয়া এম.এল.এ. নয়া এম.পি.। এদের সঙ্গে যোগাযোগের লাইন বের করবার টাইমই দিচ্ছে না। খচড়াই হয়ে গেল।
—তাহলে?
—আসবে, লাইনে আসবে। তবে টাইম নেবে তো? জনতাকে ভালো করব বাতিক কদ্দিনে যায়, সেই বুঝে লাইন লাগাব। আপনার ভালাতোড় থানা, আপনার শ্বশুরাল তো গেল। সব নতুন লোক। পুরা খচড়াই।
—অফিসার?
—য়ো ভি। থানা অফিসার যখন লালাদের ফলের ভেট ফেরত দেয়, তখন জানবেন লক্ষণ খারাপ। খু—ব খারাপ।
ক্রমে দেখা যায় ডামাডোল। এমন কি মিশ্রজীর ফল বাগিচার ওপর বকেয়া খাজনা বসে যায়। বি.ডি.ও. বুরুডিহার গঞ্জুদের যাতে রাস্তা তৈরির কাজে লেবর নেওয়া হয় সে জন্যে চাপ দেয়। ফলে গঞ্জুদের মনে অহৈতুকী ভরসা জাগে, তাদের তরেও রাজ আয়া হ্যায়।
এ সময়ে হনুমান মিশ্রেরও মাথা খারাপ হয়। এখন ডবল ফ্যানাটিক হয়ে তিনি ডিকলেয়ার করেন, যা হচ্ছে সব ঝুট। কলির খেলা। ঈশ্বরের সেওয়া যদি তিনি শুদ্ধাচারে করে থাকেন, তবে সত্যের জয় হবে।
একথা বলে তিনি হঠাৎ বলেন, সোমরাকে ও জমি ছাড়তে হবে। মন্দিরের আওতায় গঞ্জুর ঘর থাকবে না।
সোমরা খুবই ঘাবড়ায় এবং বি.ডি. বাবুর কাছে চলে যায়। নতুন বি.ডি. ও. ছোকরা। তিনি সোমরার কেসটি শুনে বলেন, কাগজপত্র থাকলে তোমায় ওঠায় কে?
—মিশ্রজী।
—না না। তিনি মহাতমা।
—তবে আমার জমির ওপর রোখ কেন?
—রোখ হলেই কি জমি নেওয়া যায়?
—যদি…
—কী?
—বেড়া উপড়ে নিয়ে নেন।
—আদালতে যাবে।
সোমরার বুকে উড়ন্ত পরীর উলকি আঁকা হলে কি হয়, তার কমনসেনস ভূ—প্রোথিত। সে বলে, গঞ্জু লোক মামলা করতে পারে?
বি.ডি.ও. তার কেসে আগ্রহী হন এবং বলেন, তোমার কথা যে সত্যি তার প্রমাণ কী? পথে লেবর—দাতা বুরুডিহাই গঞ্জুরা সানন্দে কাজ ছেড়ে বিড়ি ধরিয়ে এসে বসে এবং খুব বিশদ করে বুঝিয়ে দেয়, মিশ্রজী দীর্ঘকাল ধরে সোমরার জমি নিতে চাইছেন। কিনতে চাইছেন না, নিতে চাইছেন।
—সে কী?
—সাচ বাত হুজুর।
সোমরার কেসটি ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অফিসারকেও জানানো হয়। গঞ্জু এক ট্রাইব। অফিসার বলেন, আমি থানাকে বলে দেব। তুমি কোনো অন্যায় ঘটলে সুবিচার পাবে। থানা অফিসার বলেন, নিশ্চয় পাবে। জোর করে জমি নিলে তা হবে সাব—পোলিশ মাস্টার। এখন সরকার খুব কড়া। হরিজনদের ব্যাপারে… তুমি কি হরিজন?
—হাঁ হুজুর।
—ট্রাইবাল না?
—হাঁ হুজুর।
—জাতে গঞ্জু তো?
—হাঁ হুজুর।
—সে কী?
—কাঁয় নই হুজুর? গঞ্জু আমি, সবাই জানে গঞ্জু অচ্ছুত। যাকে কেউ ছোঁয় না সে যদি হরিজন হয়, তবে আমি গঞ্জু ভি হলাম, হরিজন ভি হলাম। য়ো মোচবালা অপসার, টাইবল অপসর বললেন, গঞ্জু লোকের নাম ওঁদের রেকডে আছে। তা হলে দেখুন না কেন, আমি টাইব ভি হলাম।
—ওফ। কী কাণ্ড!
—কী করব হুজুর? দেওতা খেপে গেছে। আঁখ মোটা করে ঘুরাচ্ছে। ধুনচি নিয়ে নাচছে আর বলছে সাত দিনে ধরমরাজ কায়েম হবে। উনি আমার জমি লিবে।
—নিলেই হল? আদালত নেই?
—কেস মামলা গঞ্জু করে না।
—সরকার তোমাদের উকিল দেবে।
—অ্যাঁ?
—উকিল, উকিল, মামলাতদার।
—তবে ভয় নেই হুজুর?
—না।
—দেওতাকে দেখলে যে ডর উঠে যায়? উনি সকল সময়ে শিবকে ডাকছেন।
—তা তো ডকবেনই।
—আপনি জানেন না হুজুর। দেওতার চাচেরা ভাই কুন্দন, তার গঞ্জু ছেলে এতোয়াকে…
—জানি জানি। যা তোমার এক্তিয়ারে নয়, তা নিয়ে বোক না। পুলিশ আছে, থানা আছে, অপসার আছে কেন?
সোমরার মুখে এল ‘ঘুষ খেতে আর গরিবকে ঠ্যাঙাতে’। কিন্তু সে তা বলল না। বলল, দেওতা আমার জমি নেবে না তো?
—না, না, না।
সোমরা এরপর টাহাড়ে গেল। মেয়ের বাড়ি। ওর জামাই গঞ্জু কম্যুনিটিতে এলেমদার যুবক। স্থানীয় জনতা এম.এল.এ—কে ভালোভাবে চেনে, এমন এক কন্ট্রাক্টরের মাল পাহারা দেবার কাজ পেয়েছে ভালাতোড়ে।
সে শ্বশুরের কেসটি মন দিয়ে শুনল এবং বলল, আমার ঘর টাহাড়। ও জমি নিয়ে আমার মোটা ফায়দা নেই কিছু। তব ভি আপনার হকের জমি কোই বাম্ভোন—উম্ভোনকে নিতে দিব না। বাম্ভোনের খেলা অনেক হয়েছে এতদিন। এখন জনতা রাজ বলছে, আমাদের সওয়াল ভি শুনবে।
কার্যকালে দেখা যায় এম.এল.এ. নিজেও তপসিলি। তিনি মন দিয়ে শোনেন ও সোমরাকে বলেন, আগে আমার জান নেবে পরে তোমার জমি। ও অঞ্চল মিশ্র পরিবারের থাবা হতে ছাড়াতে হবে। শুধু কি তুমি? এমন শত শত গঞ্জু…
এবারে সোমরাকেই এম.এল.এ. এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনিয়ে দেন এবং আশ্বস্ত করে ফেরত পাঠান। এতে সোমরার বুকের পরীর ডানায় বাতাস লাগে। সে ঘরে ফেরে। এখনো উৎসাহী আছেন বলে এম.এল.এ. হিআরসে বা জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করে ঝুঝারের বালকৃষ্ণ মাস্টারের মৃত্যু, টাহাড়ের এতোয়ার মৃত্যু, দুটিকে যোগ করেন। উত্তর দাঁড়ায় গোলবদন সাহুর মৃত্যু।
এম.এল.এ. নিজে একবার অঞ্চলটিতে ভ্রমণে যান এবং জিপ যোগে ঝটিকা ভ্রমণের মাঝেই বুরুডিহার হনুমান মিশ্রমে দেখে আসেন। ঋষিপ্রতিম, নেড়া মাথা, বলিষ্ঠকায় মিশ্রজীকে দেখে তিনি বোঝেন ভেতর ভেতর ভয় ধরছে। তাই গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি হাটে সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে, বর্তমান সরকারের অস্পৃশ্য, তফসিলি ও আদিবাসী—বিষয়ক নীতিটি ব্যাখ্যা না করে ভরসা দেন। ইচ্ছে করে সোমরার জমিটিতে গিয়ে দাঁড়ান ও বলেন, সরকার এখন গঞ্জু বা দুসাদ বা রবিদাসের উপর অত্যাচার ঘটলে মাপ করবে না কারুকে। তোমার জমি কেউ নিতে পারবে না, নিশ্চিন্তে থাকো।
হনুমান মিশ্র মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে কথাগুলি শোনেন।
ক্রমে অকটোবর আসে। সাতাত্তরের অকটোবর। এ বছর প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল হঠাৎ আশ্বিনের গোড়ায়। ফলে এখনি বাতাসে হিম। সোমরা এবার ভালো ভুট্টা পেয়েছে। ভুট্টা দানা বোরায় ভরে রেখেছে। বেশ কিছুদিন দেওতার দিক থেকে কোনো উৎপাত নেই। সোমরা এক সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ঘাটো খেল ও ঘুমোবে বলে মাচাঙে চট পেতে, দোরগোড়ায় বসে বিড়ি ধরাল।
—সোমরা!
—সোমরা চমকে মাথা তুলল। অদূরে, আধো আঁধারে মিশ্রজী।
—দেওতা! গোড় লাগে দেওতা!
সোমরা মাটিতে প্রণাম ঠুকে উঠে দাঁড়াল। দেওতার চেহারা মুখের চেহারা খুব অচেনা। গলার স্বরেও দীন আকুতি।
—তুই আমাকে জমিটা দিয়ে দে সোমরা। আমি তোর কাছে দেওতার নামে চাইছি।
—দেওতা!
—আমি দেওতা নই, সোমরা। আমি সামান্য মানুষ। দেওতা হলে বাগিচায় খাজনা বলে? কন্টাক্টরি ছুটে যায়? মেয়ে বিধবা হয়?
—আমি কী করব দেওতা?
—দেওতা আমি নই। ওই মন্দিরে যিনি, তিনিই দেওতা। তাঁর নাম করে আমি চাইছি, জমিটা তুই দিয়ে দে। আমার ইজ্জত বাঁচা।
—আপনার ইজ্জত? আমি বাঁচাব?
—দিয়ে দে।
—হম কা খায়গা?
—তোকে রোজ পরসাদ ভেজে দেব। তোর নাম থেকে যাবে। সবাই নাম উঠাবে।
—আমি…আমি কিছু বলতে পারব না। আমার জামাইকে না শুধায়ে…
—দিবি না?
সোমরা সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেলল, জমি দিলে ঔর ঔর গঞ্জু লোক আমাকে মারবে, মেরে ফেলবে। এতোয়াকে লিয়ে সব কোই কো মনে দাগা আভিতক গহরি হ্যায়। আপনি জানতেন সব, তব ভি কুছু বললেন না। মন্দিরে যো বাত উঠালেন…মায়ের দুলার, দুধের ছেলে মরে গেল…
হনুমান মিশ্র অপ্রকৃতিস্থ গলায় তীক্ষ্ন স্বরে হাসলেন। বললেন, তুই মানিস না আমি দিব্যচোখে সব দেখতে পাই?
—হম কা জানে দেওতা?
—সব দেখতে পাই। এই জমি সব ছেড়ে দিয়ে তোকে কুত্তার মতো পালাতে হবে। গভীর অস্বস্তি বুকে নিয়ে সোমরা ঘুমোতে গেল। এর কয়েক দিন বাদেই বুলাকি ও জগমোহন বুরুডিহার জঙ্গলে ঢুকল।
তিন
বুলাকি ও জগমোহন জঙ্গলে ঢোকে সন্ধ্যাবেলা। জঙ্গলের পূর্বদিকে একটা বটগাছ আছে, বুলাকি পথেই জেনে এসেছে। জঙ্গলে ঢুকে বুলাকি জগমোহনকে সেদিক পানে নিয়ে যেতে থাকে।
জগমোহন হঠাৎ দাঁড়াল। থরথর করে কাঁপতে থাকল ওর শরীর।
বুলাকির মনের নীচে অজানা ভয়। সব যেন অশুভ। জগমোহন দাঁড়াল কেন? দাঁড়াল যদি, তবে কাঁপল কেন? সে জগমোহনকে বলল,—কোমাণ্ডি কোমাণ্ডি জগমোহন। ভুরকুণ্ডা বেট। হেহেগড়া হেহেগড়া মেরে লাল।
জগমোহনের কাঁপুনি থেমে গেল। সে আবার চলতে থাকল। অন্ধকার বন। যেন অলৌকিক ক্ষমতার পথ জেনে জগমোহন বটগাছটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মাটির ধস নামারমতো নিঃশব্দে ও নিঃশেষে বসে পড়ল।
বুলাকি দেখল দূরে টিমটিমে আলো। ওটাই তাহলে জঙ্গলের আঁচল কেড়ে নিয়ে বসতি—বাঁধা গঞ্জুটোলি।
বুলাকি বটপাতা ভাঙল। জগমোহনের সামনে রাখল। তারপর গঞ্জুটোলিতে গেল। জল চাই একটু জল।
গঞ্জুটোলির লোকজন খুবই অবাক হল। বুড়ো পারশ গঞ্জু বলল, তোমাকে তো আমি দেখেছি। রামগড়ে।
—জল কই। জল পাব?
—খাও না।
—আমার জন্যে নয়। হাতির জন্যে…
—হাতি কোথায়?
—বটগাছের কাছে।
—সেখানেই তো জল পাবে। এবারে হঠাৎ যে বৃষ্টিটা হয়ে গেল, ওখানেই তো।
বুলাকির মুখ সাদা হয়ে গেল ভয়ে। জলের কাছে এসেও জগমোহন জলের অস্তিত্ব টের পেল না কেন? তখন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে কাঁপল কেন? বসবার সময় যেন ধসে পড়ল নিঃশেষে, এমন করে বসল কেন?
পারশ গঞ্জু বলল, চল, বাতি নিয়ে যাচ্ছি আমি। তোমার মুখ ভয়ে সাদা দেখায় কেন? কোনো ভয় নেই ওখানে।
মাটির কমণ্ডলুতে বাতি বসিয়ে পারশ আগে আগে এল, পেছনে বুলাকি। পারশ বলল, ওই তো, তোমার হাতি জলের কাছে চলে গেছে। কিন্তু জল খাচ্ছে না তো?
মাটির ঢাল। পাথরের বুকে জল। কিন্তু জগমোহন স্থির ও অনড়। বুলাকির বুকের নীচে অসহ্য চাপ। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট।
জগমোহন! পানি, পানি জগমোহন! যা, আগা, জুজুভাতু, জুজুভাতু, জগমোহন! কোমাণ্ডি। কোমাণ্ডি। জল খা!
জগমোহন যেন চিন্তার সমাধি থেকে নড়ে চড়ে জেগে উঠল ও মাথা ঘোরাল। শুঁড় বাড়িয়ে সহসা ও বুলাকির মাথা ও কাঁধে বোলাল তারপর আস্তে, ধসের মতো বসে পড়ল। তারপর শুয়ে পড়ল। পারশ গঞ্জু অসীম কৌতূহলে বাতি নিয়ে একটু এগোল ও বলল, তোমার হাতি কাঁদছে হে। চোখে জল। শুঁড়ের ফুকর হতে দেহবাসী পোকা বেরিয়ে যাচ্ছে। তোমার হাতি মরে যাচ্ছে।
পারশের কথা যেন বুলেট। বুলাকি বুঝল, তার ফুসফুসে রক্তাক্ত ফেনা। সে জগমোহনের মাথার কাছে বসে পড়ল। জগমোহনের কপালে মাথা রাখল। তারপর মাথা তুলে পারশকে বলল, ভাই একটা টিন দিতে পার? জল তুলব?
জল তুলে শুঁড়ে ঢালল বুলাকি। ঢালল, ঢেলে চলল। বুকের নীচে বুলাকির পৃথিবী ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। কোমাণ্ডি, কোমাণ্ডি জগমোহন। কোমাণ্ডি—সারাণ্ডি —রাই—জুজুভাতু—হেহেগড়া—ভুরকুণ্ডা। আরও কত জায়গা আছে যে? কত পথে যে চলা হয়নি, কত সপত্র স্নেহময় ছায়া দাত্রী বটগাছের পাতা খাওয়া হয়নি—কত সতেজ বেণুকুঞ্জের কচি ডগা ও নরম পাতা বাকি আছে অপেক্ষায়—বনের ভেতরে ও বাইরে কত কুণ্ডী ও ঝরনা—আদিবাসী শিশুদের হাতি দেখে হাততালি।
সব পথ জগমোহন শেষ করে দিচ্ছে কেন? বুলাকি কান্নায় অন্ধ হয়ে বসে পড়ল। জগমোহন মাঝে মাঝে শুঁড় তুলে ওর গায়ে বোলাচ্ছে। খেল খতম পয়সা হজম মেরে বুলাকি। তোমাকে একা রেখে যাচ্ছি। আপশোস। চরণদাস না থাকলে তুমি আর আমি হয়তো যে—যার মতো, এর চেয়ে ভালো অথবা মন্দ স্বাধীন জীবনে বাঁচতে পেতাম। হল না। চরণদাসরা সে সবকিছু দখল করে ফেলে, সব সময়ে, সকল সময়ে। চরণদাস ধরেই নিয়েছিল আমার ও তোমার বিনাশ নেই। কিন্তু আমরা তো খুবই বিনশ্বর। তোমাকে মাইনে দেয়নি, আমাকে খাদ্য। অথচ আমাদের ওপর থেকে ওর থাবা সরায়নি। আমার ও তোমার যৌবনে আমার ওপর থাবা বসিয়ে বাঘ ঝুলে পড়েছে। তার থাবা ছাড়িয়েছে ঝাঁকি দিয়ে, তাকে মাড়িয়ে মেরেছি। কিন্তু চরণদাসের থাবা। সে থাবায় ধৃত আমি এখনো। তুমি তো থাকবেই।
পুরীতে যখন আমাদের ঢুকতে দেখল চরণদাস, আমি হাতি নামের অ্যাপলজি, তুমি মানুষ নামের। কোনোদিন জিগ্যেস করেনি কী খেয়ে আমরা বেঁচে আছি।
হাতি আর মানুষে সাদৃশ্য পয়েন্টগুলি অনুরূপ—পঁচিশে যৌবন, পঞ্চাশে বৃদ্ধ। সাধারণত একবার একটি শাবক জন্মায়। সে হিসেবে তুমি ও আমি হ্যাভ আউটলিভড আওয়ার টাইম। কিন্তু চরণদাস না থাকলে। শুধু তুমি ও আমি থাকলে কত ভালো হত? আমি জানি তুমি আমাকে বুরুডিহার জঙ্গলে মুখ থুবড়ে পড়ে মরতে দিতে না। কিন্তু চরণদাস না থাকলে। তুমি তোমার মতো মানুষী জগতে—আমি আমার মতো অরণ্য জগতে থাকলে কত ভালো হত? সবচেয়ে ভালো হত, তাই না? কিন্তু চরণদাসরা যে সবকিছু দখল করে ফেলে, সব সময়, সকল সময়ে। একজন বুলাকিকে তারা হতভাগ্য গরিব হয়ে নিজের মতো বাঁচতে দেয় না। আমাকে দেয় না অরণ্যচারী যূথপতি হতে। কোমাণ্ডি—কোমাণ্ডি—কোমাণ্ডি—বলে কেঁদ না। আর কোনো পথ চলার নেই। কিন্তু এত মানুষ কেন?
গঞ্জুটোলির সবাই এসেছে। দূরে দাঁড়িয়েছে। এ হিমেল রাতে, বুরুডিহার জঙ্গলে। এক হাতির আসন্ন মৃত্যুতে এক মানবের শোক খুব দুর্লভ ও ভয়ংকর দৃশ্য। দৃশ্যটির পেছনে যে রক্তাক্ত নির্মমতার ইতিহাস আছে, তাই গুরুভারে বাতাস ভারি।
জগমোহন নড়ে উঠল। পা মাটিতে ঘষে ঘষে ও উঠছে। সহসা বুলাকি বুঝল, মৃত্যু এসেছে জানলে হাতি নির্জন স্থান খোঁজে বলে যে কিংবদন্তী আছে, সেই মিথ এখন রিয়ালিটি হতে চলেছে। তার শোকবিমূঢ়, অন্ধকার ও অশিক্ষিত মন এটুকু বুঝল, মিথ যখন রিয়ালিটি হয়, সেই অমোঘ মুহূর্তে মানুষের দূরে সরা উচিত। পিছিয়ে ও গঞ্জুদের দলে গিয়ে দাঁড়াল।
জগমোহন অশেষ চেষ্টায় উঠে দাঁড়াল ও সদ্য অন্ধের মতো টলতে টলতে চেতনার রেডারে পথ চিনে সঠিক পথে এগোল। ভীত। বিচলিত। সন্ত্রস্ত জনতা ওর সঙ্গে তফাত রেখে অনুসরণ করল।
বনের অঞ্চল ফুরাল। গঞ্জুটোলি। পথ। খেত। জগমোহন শুঁড়টা বাতাসে ঘোরাল। বাঁ দিকে ঘুরল। আরও পথ। সোমরার জমি ফণীমনসার বেড়া টপকাল। কোনো বন্য হাতি কাঁটাতারের বা ফণীমনসার বেড়া সুস্থ অবস্থায় পেরোয় না। বেতলার জঙ্গলে কাঁটাতারের বেড়া দেখলে বুনো হাতি, পাগল না হলে, কখনো টপকায় না, খুঁটি উপড়ে ফেলে। হাইলি ইনটেলিজেন্ট অ্যান্ড সেনসিটিভ অ্যানিম্যাল। কিন্তু জগমোহন বুনো বা পোষা হাতির ডেফিনিশনের বাইরের হাতি। বুনো সে ছিল না। এবং পোষা হয়েও তাকে বনবাসী থাকতে হয়। এখন তো ও সব ডেফিনিশনের বাইরে যাবে বলেই চলেছে।
সোমরার জমি। জগমোহন দাঁড়াল টলল, শুঁড় আকাশ পানে ওঠাল, দুপাশে দোলাল। তারপর একটা আর্ত নিষ্ফল বৃংহণ বাতাসে ছুঁড়ে দিয়ে হুড়মুড় করে হাঁটু ভেঙে প্রথমে বসে পড়ল, তারপর শুয়ে পড়ল।
জগমোহনের বৃংহণের পরেকার নৈঃশব্দ্য ভেঙে খানখান করে বুলাকির চিৎকার, জ—গ—মো—হ—ন।
ভীষণ গন্ডগোল। জনতার চিৎকার। সোমরা বিমূঢ় দর্শক। হনুমান মিশ্র এগিয়ে এলেন। শূন্যে দু—হাত তুলে এসে মাটিতে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করলেন।
জগমোহন? জগমোহন?
ক্রন্দনরত বুলাকিকে হনুমান মিশ্র লাথি মারলেন। বললেন, সরে যা অবিশ্বাসী? ছুঁস না। আকাশে জ্যোতি দেখেছিস?
জগমোহন? হাঁথি? হাঁথি ত নয়, কোনোদিন ছিল না। কলিকালে ব্রাহ্মণ আর দেওতার মাহাত্ম্য ফিরিয়ে আনবে বলে দুই মহাপুরুষ গজরূপ ধরেছিলেন মাত্র। তৈলঙ্গস্বামী আর কাঠিয়াবাবা। এক থে শরীর, ঔর থে মন। আজ কাজ সমাপ্ত করে তারা স্বর্গে ফিরে গেলেন। এখানে এই গজরূপের মন্দির বসবে ঔর যতকাল ধরতি থাকবে, ততকাল মানুষ সে মন্দির দেখে জানবে
ব্রাহ্মণ যব ভি ভ্রষ্ট
তিনোঁ ভুবন মেঁ শ্রেষ্ঠ
ব্রাহ্মণ যব ভি নষ্ট
তিনোঁ ভুবন মেঁ শ্রেষ্ঠ।
চার
সকাল না হতে শত শত লোক দা কুড়োল নিয়ে এসে পড়ে ও জগমোহনের শব কুপিয়ে দেহখণ্ড নিয়ে স্বগৃহে বেদি বানাতে চলে যায়। মৃতবৎসারা জগমোহনের নখ নিয়ে যায় মাদুলি করে পরবে বলে। অন্ধ ও খঞ্জরা তার শরীর ছোঁয়। কুষ্ঠরোগীরা জগমোহনের চর্বি গায়ে মাখে। লালাবাবুরা পুরুষাঙ্গটি নিয়ে ভস্ম করে ঘি দিয়ে খেয়ে ফেলেন।
মন্দিরের সব টাকাই লালাবাবুরা দিতে রাজি হন, ও মাংস—লাগা কঙ্কালটি সোমরার জমিতে বিশাল চিতায় ভস্ম করে, ছাই সে জমিতে পোঁতা হয়। সোমরার ঘরও পুড়ে ছাই হয়।
খুব হেঁটেছিল সোমরা। এম.এল.এ.—বি.ডি.ও.—ট্রাইবল ওয়েলফেরার অফিসার—থানার ও.সি.।
কোনোই সুরাহা হয়নি। সকলে তাকে যা বলেন, এবং যা বলেন না, তার সারাংশ এইরকম :
হনুমান মিশ্র যদি সোমরার জমি দখল করতেন, তবে তা মানুষের জন্য সৃষ্ট আইনের আওতায় পড়ত এবং সোমরা রিড্রেস পেত। হরিজন বলে ব্রাহ্মণ তার জমি নেবে এ অন্যায় সরকার সহ্য করত না কিছুতেই।
যা ঘটেছে, তা সাব—জুডিস বা সাব—পোলিশ ম্যাটার নয়, অলৌকিকত্বের দেশ ভারতবর্ষ। যুগে যুগে অবিশ্বাসীকে শিক্ষা দিতে মহাপুরুষরা মানবরূপে অবতীর্ণ হন। এখনও সাঁইবাবা, বালক ব্রহ্মচারী, মা আনন্দময়ী, মোহনানন্দ ইত্যাদি ইনস্টিটিউশনস বর্তমান আছেন। মহাপুরুষদের লীলা বোঝা ভার। তৈলঙ্গস্বামী বেজায় মোটা ছিলেন। কাঠিয়াবাবা বেজায় চিমড়ে। কিন্তু পালামৌ বেলটে অবিশ্বাসী ব্রাহ্মণের তাদের শিক্ষা দিবার জন্য তাঁরা এক হন ও গজরূপ ধরেন। চরণদাসও মহাপুরুষ। সে জগতে জগমোহন দুই মহাপুরুষের প্যাকিডার্ম সংস্করণ। মহাপুরুষরা বায়ুভুক। জগমোহনকে খেতে দিলে অন্যায় করা হত বলেই সে হাতিটিকে যাবজ্জীবন প্রায় অনাহারে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। বুলাকিকেও। মহাপুরুষ যখন প্রায় অনাহারী, তাঁর সেবককে অনাহারী রাখাই হল ধর্ম।
বোঝাই যাচ্ছে, জগমোহনের মন্দির হলে আপামরজন ব্রাহ্মণ ও দেবতার মহিমা বুঝবে। এতে প্রশাসনের কোনো অফিসারই বাধা দিতে পারেন না। ভারতের ধর্মীয় মহিমা স্থাপিত হতে চলেছে তাতে তাঁরা বাধা দেবেন না।
সোমরা বলে—হামানি কো কাঁয় হোগা? জমিন চল গেল।
—তোর জমি। তুই তো ধন্য হয়ে গেলি রে।
সোমরা কাঁদতে কাঁদতে চলে আসে। এখন ধর্ম বিশ্বাসের হোলি ফায়ারে প্রজ্বলন্ত মুখে দারোগা বলেন, ব্রাহ্মণ সে সবার বড়ো, এরা এই ছোটলোকেরা যে কিসসু নয়, তাও তো প্রমাণ হল? শুনতে পাচ্ছি, তফসিলিদের জন্য জব রিজার্ভেশন হবে। এরপর তা করতে গেলে আগুন জ্বলে যাবে। সে সরকার ঈশ্বরের মহিমা, ঈশ্বরের উদ্দেশ্য, দেখেও দেখে না, য়ো ভি ফিরতি চুনাও মে হেরে যাবে।
—কে আসবে?
—মত পুছিয়ে বি. ডি. বাবু।… যাঁর চুনাও হলে ধর্ম থাকে, ব্রাহমন থাকে। অছুত ফিন পায়ের জুত্তি বনে, তিনি আসবেন? এ তো সহজ কথা।
—কবে?
—তা কে বলতে পারে? জগমোহনকে নিয়ে হয়ে গেল, ও এক দর্পণ। এই দর্পণে আপনি যো হোয়েগা তার ছায়া দেখতে চেষ্টা করুন।
—একটা হাতি এল মরে গেল…
—হাতি নয়।
মির্যাকলের যুগ তাহলে শেষ হয়নি?
—হলেই কি আপনি খুশি হতেন? মিরাকল যাকে বলছেন, য়ো ভি নেসেসারি কমোডিটি হ্যায় না? মাইনেতে কী হয়? আমার পয়সা চাই, সবসে বেচারি এম. এল. এ. ঔর এম. পি. লোক। পাঁচ বরিষে জীবন চলবার রেস্ত গুছানো চাই। মিরাকল চলতে থাকলে সব কোইকো সুবিস্তা।
মহামহিমায় জগমোহনের মন্দির ওঠে। চরণদাস মোহান্তও বেনারস থেকে আসেন ও হনুমান মিশ্রকে এক লাখ টাকা দেন মন্দির নির্মাণ—কল্পে। বুক পুড়ে যায় তাঁর। জগমোহন মহাপুরুষ তা ইউ. পি—তে কেউ জানল না, তাকে আবিষ্কার করল বিহার। যত ফায়দা সব এই মিশ্রজীর হল। বুলাকিটাও নিখোঁজ। তাকে পেলে বাকি দুটো মাহুতকে ট্রেনিং দেওয়াতেন এবং বুলাকিসহ তারা দুজন আর তিনটে হাতিকে অনাহারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মারতে পারত। তাদের মধ্যে সোহং স্বামী—ভোলাগিরি, অনুকূল ঠাকুর, বরদাযোগী, দুধিয়া বাবা, তুলসী গিরি, যাঁর যাঁকে পছন্দ, জোড়ায় জোড়ায় থাকতে পারতেন ও বেরোতে পারতেন। নিশ্বাস ফেলে চরণদাস মিশ্রজীকে বলেন মন্দির উদ্বোধনের সময়ে একটু খবর দেবেন।
—জরুর।
—কে উদ্বোধন করবেন?
—হিমালয় সে সারস্বত স্বামী আসবেন।
—উনি নেমে আসেন?
—এবার আসবেন।
চরণদাস মোহান্ত চলে যান।
বুরুডিহার জগমোহনের মৃত্যুর খবরটি এখন সর্বভারতীয় ঘটনা। বিদেশি কোনো স্টার জগমোহন হয়ে অভিনয় করতে রাজি হলে ঘটনাটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাবে। অঞ্চলটিতে অলৌকিকত্বের অ্যারা বিরাজ করছে। গোলবদন সাহুর বিধবা স্বপ্নাদেশে জগমোহনের মুখে শুনেছেন, মিশ্রজীর শিবকে প্রত্যহ দশ লিটার দুধে স্নান না করালে গোলবদনের মুক্তি হবে না।
বুলাকি ও সোমরা দুজনেই যে কোথায় গেছে কেউ জানে না। গঞ্জুটোলিতেও তারা থাকতে পায়নি। কেন না বুলাকির পাপ, সে জগমোহনকে হাতি ছাড়া আর কিছু বলে চেনেনি।
সোমরার পাপ, মিরাকলের পরেও সে জমি ফেরত চেয়েছিল।
এদের থাকতে দিলে গঞ্জুটোলির ওপর মিশ্রজীর অভিশাপ এসে পড়ত।
গোমোর স্টেশন প্ল্যাটফর্মে দুজন নবাগত শরণার্থীকে দেখা যায়। হত দরিদ্র, রোগা জীর্ণ, হলদেটে চোখ তাদের। কুলির কাজও তাদের নিত্য জোটে না এবং তারা উপোসেই থাকে।
মাঝে মাঝে কুলি কাম জোটে। সেদিন ওরা দুজনেই আট আনার টিকিটে ‘হাতি মেরে সাথি’ দেখতে যায়।
ছবিটি শেষ হলে দেখা যায় একজন অঝোর ধারে কাঁদছে আরেকজন তার পিঠ থাবড়ে থাবড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
তারপর তারা পয়সা থাকলে মদ খায়, নয়তো এসে প্ল্যাটফর্মে শুয়ে পড়ে। একজনের বুকে দেখা যায় উড়ন্ত পরীর ছবি উলকিতে আঁকা। দুজনে দুজনের হাত ধরে প্রেমিকের মতো ঘুমোয়, যেন দুজনে ছাড়া পরস্পরের আর কেউ বা কিছু নেই। ওদের নাম কেউ জানে না বা জানার চেষ্টা করে না। স্টেশন প্ল্যাটফর্ম একমাত্র ঠিকানা হয় যাদের, তাদের নাম না জানলেও ভারতবর্ষের চলে, কেননা ওরা অত্যন্ত এক্সপেনডেবল।