১
এটা হয়তো যথার্থ বলা হোল না। ”তাই যেন পাই শেষে,” এর মধ্যে ”যেন” শব্দটির ওপর জোর দিচ্ছি। শেষে যেন তাই পাই, এটা তো সেই প্রার্থনা, যা স্বপ্ন বললেও হয়। যা প্রার্থনা, তা স্বপ্ন বটে। যখন যেখানে ছিলাম, তিনি ছিলেন ইচ্ছে হলেই দেখে আসতে পারার মানুষ :—তখন যত না ভেবেছি, আজ পশ্চিম দিগন্তের দিকে চলার সময়ে রবীন্দ্রনাথের কথা অনেক ভাবি, অনেক বেশি। আবার পড়ছি রবীন্দ্রনাথ, খুব গুছিয়ে নয়, যখন যা পাচ্ছি। হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথের কিছু বই নেই এরকম তো হয়নি কখনো।
এই লেখাটি লিখতে বসার আগে, ব্যাখ্যাতীতভাবে হাতে পেয়ে গেলাম দুটি বই। ১৯৩৭ সালে আমার সহপাঠিনী যিনি, সেই মীরা দাশগুপ্তের কথা অনেক লিখেছি ”আমাদের শান্তিনিকেতন” (সৃষ্টি প্রকাশন, বইমেলা ২০০১) বইয়ে। মীরাদি (তাঁকে ”দিদি” বলতাম। তেমনিই অভ্যেস হয়েছিল।) সে বইটি পড়ে। আর ২০০৩ সালে ওর লেখা ”সব হতে আপন” বইটি আমাকে পাঠায়। বইটি সকলকে কিনে নিয়ে পড়তে বলি। ”সমতট প্রকাশনী”র ছাপা।
মীরাদি শান্তিনিকেতনে যায় ১৯৩৭ সালে। আমি যাই ১৯৩৬ সালে, ১৯৩৮ শেষ করে ফিরে আসি। ও ওখান থেকেই ম্যাট্রিক দেয়। আই. এ. পাশ করে। ফলে ছিল বেশি দিন, আর সে সব কথা বড় যত্নে লিখেছে। মীরাদিকে তার বন্ধুরা যখন লিখতে বলতেন, সে বলত, আমি লিখব? আমি কি সাহিত্যিক? বন্ধুরা বোঝাতে সক্ষম হয়, সে বই স্মৃতি থেকে লেখা হয়। মীরাদিই বইটা পাঠাল। চিঠিও লিখল। তার কিছুকাল বাদেই চলে গেল। সমবয়সীদের বয়সে ছোটদের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে মনে হয় বুকের ভেতরটা যেন একটা বাড়ির অন্ধকার ঘর। দরজাটা খোলা। ঝোড়ো বাতাসে ঝাপটাচ্ছে আর ঝাপটাচ্ছে।
”শান্তিনিকেতন” মানেই আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ। আর পরিবেশ জুড়ে ”বিপুল তরঙ্গ”, সংগীতের, প্রকৃতি বীক্ষণের, আশ্চর্য সমন্বয়। যেন প্রাচীন তোরঙ্গ খুলে সব দেখছি, আর ভেসে যাচ্ছি।
২.
”তোমার খোলা হাওয়া”
যথার্থ সত্য বলতে গেলে ”রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর” নামটির সঙ্গে বড় হয়েছি। তাঁর লেখা ”সহজপাঠ” (১ ও ২), ”শিশু”, একটু বড় হয়ে ”কথা ও কাহিনী” শৈশব থেকে পড়েছি। খুব দ্রুত পড়তাম, মা বিশ্বাস করতেন না আমি সত্যিই পড়ছি। কিছু জিজ্ঞেস করলে পটাপট বলেও দিতাম। সেদিন (যা মনে পড়ে) ”পুনশ্চ”, ”মহুয়া”, ”বিচিত্রিতা” বই বেরিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রচ্ছদ নিয়ে। তাঁর বইয়ে বাড়িতে কয়েকটি তাক বোঝাই। রেকর্ডে (দম দেওয়া গ্রামোফোন) তাঁরই গান। এ ভাবে তিনি ছড়িয়ে ছিলেন আমার ছোটবেলা ঘিরে। বই পড়ার ক্ষুধাও ছিল অন্তহীন। এ আমি ৮/৯ বছর বয়সের কথা বলছি।
৪ বছর বয়সে বাবা, আমি, মিতুল (আমার পরের বোন) আর মা—কে নিয়ে শান্তিনিকেতনে যান। সে স্মৃতিও আজ ঝাপসা। বহুযুগের ওপারে কোনো মেঘে লেখা স্মৃতি। এটা মনে আছে, রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় পাশাপাশি বসে ছিলেন। আমি দু’জনকেই প্রণাম করলাম। তারপর মূর্খের মতো রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে শুধোই, তুমি বুঝি রবীন্দ্রনাথ?
মা খুব চটে যান। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বাংলা ”প্রবাসী”, ইংরিজি ”মডার্ন রিভিউ” আর হিন্দী ”বিশাল ভারত” কাগজের সম্পাদক ছিলেন বলে মনে হচ্ছে। ভুল হতেই পারে, কোন সুধী পাঠক সংশোধন করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।
১৯৩৬ সালে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনে প্রথম ও প্রচণ্ড অভিঘাত, সে কখনো ভুলব না। তা হচ্ছে সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হওয়া। মন উদ্বেল হওয়া। কি দেখে?
ওখানকার ঘর, বাড়ি, যথা শ্রীভবন, কলাভবন, কিচেনের সামনে চৈতী, সিংহসদন, মন্দির,পুরনো গেস্ট হাউস, উত্তরায়ণ—এর মধ্যে উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, (ভেঙে যায় ঝড়ে, পরে হোল পুনশ্চ) উদীচী, প্রতিটি বাড়ির অপরূপ গঠন শৈলী। তখন অবধি দেখেছি জেলা শহর, মফঃস্বল শহর। সরকারী বড় চাকুরেদের বাড়ি মানেই রানীগঞ্জের টালির ছাউনি, বড় বড় বাংলো বাড়ি। তাদের বিশাল হাতা (কম্পাউণ্ড)—এর মধ্যেই আলাদা রান্নাঘর, প্যানট্রি, কাজের লোকদের থাকার ঘর। এক শহরের ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি আরেক শহরের জাজের বাড়ি, কোনো তফাৎ নেই। সাজসজ্জায় খুব দেখা যেত উদ্ধত সব সোফা ও সেটি। তিনটে হরিণের শিং—এর ওপর জয়পুরী মিনা কাজের গোল ট্রে। তাতে পিতলের উট, হরিণ, বাঘ, সিংহ ইত্যাদি। এ রকমই ছিল কেতা। আমার বাবা ছোট অফিসার। বাড়ি দেখে বোঝা যেত কার মাইনে কত। হয়তো সেটাই ছিল উদ্দেশ্য।
শান্তিনিকেতনে ও’সবের বালাই ছিল না। এত সুন্দর সবকিছু, যে বলাই চলে ”এলেম নতুন দেশে”।
আমাদের বিছানা ঢাকার বেডকভার আশ্রমের তাঁতে তৈরি। গাঢ় চকলেটে বা মেরুর রঙের ঢাকনি, তাতে হলুদ ঘেঁষা কমলা রঙ—ঘন ঘন ডোরা। হলুদ ঘেঁষা কমলা রঙের পর্দা আমাদের বাকস রাখার ঘরে। ধোপাকে কাচতে দেব, ময়লা কাপড় রাখার ব্যাগে।
শ্রীভবনে বসার ঘরে, দেওয়ালে ভারতেশ্বর পঞ্চম জর্জ ও সম্রাজ্ঞী মেরির ছবি থাকত না। মেদিনীপুরে বাবা জুনিয়ার ইনকামট্যাকস অফিসার মাত্র। সেটা সেদিনের নতুন তৈরি বার্জ টাউনের একপ্রান্তে একটি মনোরম দোতলা বাড়ি। বাইরের ঘরে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। নিচু বিষ্ণুপুরী চৌকি। দরজা জানলায় মণিপুরী পর্দা।
সমালোচনা শুনলেই বাবা বলতেন, আমি আপনাদের সার্ভেন্ট। আমার স্ত্রী তো সংসারে সম্রাজ্ঞী। তাঁর অনিচ্ছায় কোন কাজই আমি করতে পারি না।
সবাই জেনে গিয়েছিল। অথবা সন্দেহ করত। বাবা বিশেষ আজ্ঞাবহ মানুষ ছিলেন না।
একটি বেজায় মূল্যবান বই পেলাম, ”শান্তিনিকেতন সেকাল—মধ্যকাল ও একাল”। (লেখক ননীগোপাল সিকদার। প্রকাশক : আন্তরিক প্রকাশনী। প্রাপ্তিস্থান : (১) পার্থপ্রতিম সিকদার, নিরালা শিল্পালয়/৮/১৪ এ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোড/ কলকাতা—৭০০ ০৬৩)।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কি ভাবনা মূর্ত করতে চেয়েছিলেন, কি ছিল তাঁর শিক্ষা ভাবনা, তা জানতে গেলে এই ছোট বইটি (২৪০ পৃঃ) বারবার পড়া দরকার। ননীগোপালকে এমন মূল্যবান এক বই লেখার জন্য শত শত ধন্যবাদ।
এই একটি বই পড়লাম, যাতে জ্ঞানীগুণী সহ বহুজন উপস্থিত। সেদিনের শান্তিনিকেতনের প্রলয় পয়োধি জলে বিসর্জন হোল কেন তার ব্যাখ্যা মিলবে।
আমি গিয়েছিলাম শিশুবিভাগের ছাত্রী হিসেবে। ১৯৩৬—১৯৩৮ ছিলাম সেখানে। শান্তিনিকেতনে পৌঁছে পায়ের জুতো খুলতাম। গ্রীষ্ম, শীত, ইত্যাদি ছুটির সময়ে জুতো পরতাম। সকাল—থেকে সন্ধ্যা খালি পায়ে হাঁটো। রাঙামাটির রাস্তা বেয়ে সর্বত্র দৌড়ে বেড়ানো নিয়ম ছিল। অন্তত বাধা ছিল না।
তেমনই সহজে চলে যেতাম রবীন্দ্রনাথের কাছে। গিয়ে ভব্যসভ্য হয়ে মাথা নুইয়ে নমস্কার করতাম। লজেনস আপনা থেকেই দিতেন। দিতেন দেশবিদেশের ডাক টিকিট। অটোগ্রাফ খাতা সুযোগ পেলেই বের করতাম।
কখনো হাতের ইঙ্গিতে বলতেন ”বোস”। আমরা স্থির, নিশ্চল বসে থাকতাম। নিশ্চল হয়ে বসে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ।
কত প্রখর তপন তাপের দ্বিপ্রহরে দেখেছি উদয়নের বারান্দায় বসে আছেন কেদারায়। এতটুকু নড়ত না শরীর। মনে হোত এই প্রচণ্ড তাপ, জ্বলন্ত সূর্য, প্রখর গরম বাতাস আর ওই মানুষটি যেন এই দারুণ দহন বেলার সঙ্গে একাত্ম। প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে গেছেন।
এমনই স্থির বসে থাকতে দেখেছি উদয়নের ঘরে যখন একটির পর একটি নৃত্যনাট্যের মহলা চলতো। প্রথম মহলা গানের, নাচের। তারপর রবীন্দ্রনাথ বসলেন কেদারায়। শ্বেতশুভ্র জ্যোতির্ময় পুরুষ। সিল্কের জোব্বা, নরম সিলকের পাজামা। বসে দেখতেন আর দেখতেন। কোথাও গানে—বাজনায় বা নৃত্যে তাল কাটল কি আঙুলটি তুলতেন। ওঁর কাছে নাটক, গান হবে। আর চলতেই থাকবে রিহার্সাল। তারপর একদিন উদয়নের বারান্দায় আশ্রমিকরা আশ্রমের বন্ধুজনেরা সব্বাই দেখবেন। স—ব কিছু মিটে যাবার পর বাংলার বাইরে বড় বড় মঞ্চে শান্তিনিকেতনের নাচ, গান, নৃত্যনাট্য, মঞ্চস্থ হবে তাঁর উপস্থিতিতে। শুনেছি, একবার বোম্বে না কোথা গিয়ে সম্ভবত অসুখ হল। মহাত্মা গান্ধী বলেন, আশ্রমের টাকা তুলবার জন্য আপনি এভাবে ঘুরবেন না।
ভারতের কোনো মহীরূহ শিল্পপতি শান্তিনিকেতনকে বাঁচাতে গান্ধীজির ইচ্ছানুসারে টাকা পাঠান।
পরে জেনেছি, অভিজ্ঞ, জ্ঞানী শিক্ষকরা, যাঁরা ভারত এবং বাইরে থেকে আসতেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শকে শ্রদ্ধা করে আসতেন। বেতন এতই কম ছিল যে শুনলে বিশ্বাস হবে না।
রবীন্দ্রনাথকে ঘরের মানুষের মত কাছ থেকে দেখতে পেতাম। কাছাকাছি বসতে পেতাম। শান্তিনিকেতনে রবিবার ছুটির দিন নয়, বুধবার ছুটি থাকত। যেমনটি লেখা আছে ”সহজপাঠে” —”আজ বুধবার, ছুটি। নুটু তাই খুব খুশি।” বুধবার মন্দিরে বসত (আজও হয়) প্রভাতী উপাসনা। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ আচার্য হয়ে বেদীতে বসলেন। পরে শরীর অপারগ হওয়াতে প্রতি বুধবার আর যেতেন না। ক্ষিতিমোহন সেন ওঁর বেদীটির পাশে আসনে বসে উপাসনা করতেন। তবে ভাদ্রোৎসব, পৌষ উৎসব—এর দিনে মন্দিরে আসতেন। ভাদ্রোৎসবের দিন কাচে তৈরি মন্দির মোমবাতির আলোয় ঝলমলিয়ে উঠত। ভাদ্রোৎসবের গান,
”আঁধার এল ব’লে
তাই তো ঘরে উঠল আলো জ্বলে”
বাইরে বাতাস, মন্দিরের পিছনে পাহাড়ের ওপর ঝাঁকালো গাছের মাথায় নাচানাচি, আকাশের সমুদ্র কেটে কালো মেঘের ভেসে যাওয়া মনে পড়ে। ছবি সব, ছবি যেন। ”ভাদ্রোৎসব” শব্দটি লিখতেই কত না ছবি মনে এল।
রবীন্দ্রনাথ ছোটদের ভালোবাসতেন। সে তো খুবই জানা কথা। কি করে ভালোবাসতেন, তাই ভাবি। আমরা বন্য ছিলাম। বড় গাছ থেকে আম—জাম—বকুলফল—সবেদা—কুল—পেয়ারা তো খেতামই, প্রতিযোগিতা করে আমলকি খেতাম। রান্নাঘর থেকে চুরি করে খেতাম, ইত্যাদি ইত্যাদি। যথেষ্টই বাঁদর ছিলাম। তাঁর কাছে চলে যেতাম যখন তখন। তখন মনেই হয়নি কত বড় মানুষের সামনে বসে আছি।
৩
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী
শান্তিনিকেতন যাবার আগে মনে রবীন্দ্রনাথ বা শান্তিনিকেতন বিষয়ে ধারণা কি ছিল, আজ ৬৮ বছর আগেকার কথা সত্যিই যা বলেছি, তার বেশি মনে পড়ে না। ওখানে যাবার পর কেমন লেগেছিল তার প্রথম অনুভূতির কথা বলেছি। বাকিটা পরে বলব। কেন না সমস্ত জীবনের ওপর তার প্রভাব বিছিয়ে থাকল। এ তো সত্যি কথা। যা দেখলাম, তা স্বপ্নভঙ্গ তো কোনমতেই নয়। প্রত্যাশা? মনে হয়েছিল ঠিক এ রকমটিই হওয়ার কথা ছিল। তারপর, বিশ্বাস করি শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় শান্তিনিকেতন কি ছিল, কেন তার অবদান ফুরিয়েও ফুরায় না, কেন বারবার সেদিনের স্মৃতির কাছে ফিরে যাই তৃষ্ণার্ত মরু—যাত্রীর মতো জলের জন্য,—সে সব কথাও বলে যেতে হবে। মনে করি না সে সব কথার কোন গুরুত্ব আছে। থাকলে আছে, নইলে নেই। আর ভাবতে পারি না।
সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে দেখা তো বলতে গেলে প্রায় রোজই হোত। আমার কেন, আমাদেরই হোত। সবচেয়ে মন জয় করেছিল বন্ধুর দল। মীরাদির বইটি পড়ে তেমন অনেক কথা মনে পড়ছে। এ সব নাম তো এখন কেউ শোনায় না। মনে রাখতে হবে, ১৯৩৬—৩৮ আমার থাকার সময়। ১৯৩৮—এর শেষে চলেই এলাম। ৩৯—৪৪ কলকাতায় পড়লাম ক্লাশ এইট থেকে আই, এ (আজকের উচ্চমাধ্যমিক)। তারপর ১৯৪৪—এর শেষে আবার শান্তিনিকেতন। বি. এ. পড়লাম ইংরেজি অনার্স নিয়ে। সবাই বললেন, বাংলাতে অনার্স নাও। যদি বলতেন, আর যা করো বাংলায় অনার্স নিও না। আমি তখন বাংলা নিয়েই পড়তাম। আমার মতো নিজের অহিতাকাঙ্ক্ষী মানুষ দ্বিতীয়টি নেই। এ আমি সারাজীবন ধরে দেখছি। আসলে তখন আমার আর দুই প্রাণের বন্ধু সুদর্শনা রায় (পরে বাগচী। বছর তিনেক মারা গেছে) আর কল্যাণী দাশ (পরে শান্তিনিকেতনের রণজিৎ রায়ের স্ত্রী। বিখ্যাত গায়িকা প্রমিতা মল্লিকের মা) ইংরেজি অনার্স নিল। আমিও গাধার মতো ওদের সঙ্গে চলে গেলাম। কলেজে সহপাঠী মোফাজ্জুল হায়দার চৌধুরী। ও নিল বাংলায় অনার্স। আর, আজও ভাবতে গেলে গর্ব হয়, হায়দার সেবার (১৯৪৬—এ) বাংলা অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পর্বে হায়দার নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়। বেঁচে থাকলে ও অনেক, অনেক ওপরে উঠত। সেই পর্বে তো বাংলাদেশের অসংখ্য উজ্জ্বল মানুষ চলে গেছে। ছিন্ন পাতার তরণীই সাজাচ্ছি এখন। এত রকম কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়েছি, আর এত জাতের কাগজ জমেছে যে, কোনো দিন কাগজের জেলখানা থেকে বেরোনো হবে না।
১৯৩৬—৩৮—এ একশো খানেক বন্ধু। ওখানে সহশিক্ষা। ক্লাসে সবাই বন্ধু। শ্রীভবনে ফিরে এলে মেয়েদের গুলতুনি। সিনিয়ররা আমাদের খুব দেখাশোনা করতেন। দীপ্তি ব্যানার্জি, তৃপ্তি ব্যানার্জি, ওদের ভাই অনিল, সবাই বনফুলের শ্যালক শ্যালিকা। শ্যামল রং, সুন্দরী, দীপ্তিদি ভালো গাইত। এদের সর্বকনিষ্ঠা বোন হচ্ছেন আজকের সুপ্রিয়া চৌধুরী। বিহারের মেয়ে গোলাপ শ্রীবাস্তব আমার ক্লাসে। ওর দিদি উঁচু কোন ক্লাসে পড়তেন। বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান ও চলচ্চিত্র নির্মাতা বিমল রায়ের দুই বোনঝি আরতি সেন রায় আর প্রতিমা (হাসি) সেন রায়কে স্কুলেই দেখেছি। হাসিদি খুব সুন্দরী ছিল। ওর গলায় ”চৈত্র পবনে মম চিত্ত বনে” গানের গুনগুন মনে পড়ে। কমলা তরওয়ে, পুষ্পা তরওয়ে এসেছিল কাশী থেকে। গয়া থেকে এসেছিল ওদের কেমন যেন বোন সরোজ তরওয়ে। সুষমা মাঙ্গলিক, ঊষা মাঙ্গলিক লক্ষ্নৌ—এর মেয়ে। আমাদের সহপাঠিনী ছিল কিটু (কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়) আর দাশুদি (মঞ্জুলা বন্দ্যোপাধ্যায়)। সেবা মাইতি (আমার এক ক্লাস ওপরে), পুষ্প মাইতি (সেবার ছোট বোন)। দুই বোনই ঢলঢলে সুন্দরী। তাতে সেবা ছিল বেজায় দুষ্টু। কিন্তু চমৎকার নাচত। অনীতা বরুয়া ময়মনসিংহ—গৌরীপুর রাজকুমারী নীহারদির মেয়ে। ওদের ছোট মামী কিরণ বরুয়া ছিল কলাভবনে। নীহারদি, নীলুদির বয়স বাড়ছিল। রূপও বাড়ছিল। নীলুদির একটি পোষা কালনাগিনী সাপ ছিল। তিনি কণ্ঠস্থ হয়েই থাকতেন।
আমার ক্লাসে ছিল বীরেন বরুয়া (আসাম), পদ্মা মনসুখানি, গোলাপ শ্রীবাস্তব (বিহার), জলি বরুয়া (আসাম), পদ্মা (সিন্ধি), গুল—চান্দির—রাণী (সিন্ধি)। ছিল সিন্ধি মেয়ে মোহিনী। উত্তর পাঞ্জাবের মেয়ে আমিনা দিদি। জয়া আপ্পাস্বামী কলাভবনী। বেজায় লম্বা, বেজায় রোগা, বেজায় গুণসম্পন্না। এঁরা সঙ্গীত ভবনে কলাভবনে। এই রকম অনেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বনামধন্যা। শ্রীভবনেই সবার বাস। জয়াদি (চেন্নাই), কুট্টিদি (চেন্নাই), লীলা এন্ড্রুস (দক্ষিণ ভারত), রাজেশ্বরী বাসুদেব (পরে দত্ত), বিষ্ণু জাগসিয়া (গুজরাট), ভগবানী ইরানী (সিন্ধি), মৃণালিনী স্বামীনাথন (সারাভাই), সুশীলা আয়ার(?), মোহিনী (সিন্ধি), আমিনা (সিন্ধি), অনেক গুজরাটী মেয়ে, একটি চীনা মেয়ে, কাশীর কন্যা সোমা যোশী, এমন কত জন।
এইটুকু যা বললাম, তার মধ্যে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিষয়ে স্বকীয় চেতনার অনেক কথাই বলা হোল। তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ১৯০১ সালে। অর্থাৎ একশো তিন বছর আগে। প্রাচীন তপোবনের আদর্শ তাঁর মনে ছিল। তপোবনে শিক্ষার্থীরা যায়, তারা নিরন্তর থাকে প্রকৃতির কোলে। নিয়ম মেনে চলে। অজানিতেই প্রকৃতিপাঠ তারা শিখে নেয়। একান্ত ভারতীয় এই শিক্ষা পদ্ধতি। কিন্তু তাঁর আদর্শ ছিল, সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে তাঁর আশ্রমের যোগাযোগ থাকুক। ”যেখানে বিশ্ব একই নীড়ে বসবাস করে” এ তো আশ্রমের ঘণ্টাতলার সামনে গেটের ওপর লোহার ফলকে লেখাই থাকতো।
প্রথম দিকের অধ্যায়ে আশ্রমে ১২৫টি বালক। আর কুড়িজন তরুণ, মেধাবী, আদর্শদীপ্ত শিক্ষক। একজন শিক্ষক ৫/৬টি বালককে পড়াতেন।
আমাদের সময়ে বহিরাগত ছাত্রছাত্রীদের কিছু পরিচয় দিয়েছি। আমাদের সময়ের অনেক আগে থেকেই শান্তিনিকেতনের শিক্ষাব্যবস্থাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এখানে পড়েই, ম্যাট্রিক, ইনটারমিডিয়েট, বি. এ.;বি.এস.সি. পরীক্ষা দেওয়া যেত। স্কুলের ক্লাসে বার্ষিক পরীক্ষা ছিল না। তাই ১৯৩৯ সালে বেলতলা স্কুলে ভর্তি হয়ে আমি যেন অচেনা কোথাও হারিয়ে যাই। তিন মাস বাদে কোয়ার্টারলি, ছয়মাস বাদে হাফইয়ারলি, বৎসর শেষে বার্ষিক পরীক্ষা—এ সব নিয়ম বুঝতেই পারিনি অনেক দিন।
সহপাঠেই আমার অভ্যাস। ছেলেরা মেয়েরা এক সঙ্গে পড়বে, এটাই যেন ছিল স্বাভাবিক। যা তখন অন্য কোনো স্কুলে দেখিনি।
এখন বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দানের জন্য, কলকাতায় পথঘাট, দোকানপাট, সব কিছুর নাম—পরিচয় বাংলায় হতে হবে এমন আন্দোলন দেখতে পাই। এমন স্বভাষা প্রেমে যদি ওড়িশা, মাদ্রাজ, কর্নাটক, কেরল, পাঞ্জাবের মানুষরা উদ্দীপিত হন, তাতে বিভেদ বাড়বে বই কমবে না।
রবীন্দ্রনাথ এই বিভেদকামিতা ও সংকীর্ণতার একান্ত বিরোধী ছিলেন। বাঙালী, সিন্ধি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, সিলোনিজ (আজকের শ্রীলঙ্কা, বিহারি, চীনা, জাপানি, সকলে একসঙ্গে পড়তাম। শিক্ষার মাধ্যমই তো বাংলা। কোনো অসুবিধাই হোত না। এই যে জগৎ জুড়ে একটাই জাত, সেটা মানুষের জাত—এই সত্যটি আমাদের শৈশবে প্রাত্যহিকতার মধ্য দিয়ে শিখে যেতাম।
ধনী দরিদ্রের ব্যাপারটাও অত বুঝতাম না। আমার পাঠ্যজীবন কালেই শ্রীভবনে থেকেছে ”মণিপুর নৃপ দুহিতা” বিনোদিনী। সে মণিপুর মানবাধিকার রক্ষা কমিশনের নেত্রী। একদা অসামান্য নাচত। আজ ফিলম বিষয়ে লেখে, সেমিনার করে। মণিপুরী নারী সমাজ বিষয়ে অত জানাশোনা, এমন শ্রদ্ধা কম দেখেছি। ছিল কুচবিহারের দুই রাজকন্যা। ইলা ও কমল। নিজাম বংশীয়া নিখাত সামসদ ছিল কলাভবনে। কোনোদিন আর্থিক সামাজিক অবস্থিতি নিয়ে চিন্তাই ছিল না। এর নাম, রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থার শান্তিনিকেতন।
৪
”আনন্দধারা বহিছে ভুবনে”
তাই তো বয়ে যেত। প্রত্যহের সূর্যোদয় যেন এক নতুন দিন।
শান্তিনিকেতন নিয়ে যতই লিখি, সে লেখা তো ফুরাবে না। মীরাদির বই পড়ে দেখছি (আমারও মনে আছে) যে সে সময় বড়ই বাঁদর ছিলাম। ফরাসী মহিলা মাদমোয়াজেল বসনেঁ কিছুকাল শ্রীভবনের দিদি (তত্ত্বাবধায়িকা) ছিলেন। তাঁর ইংরেজি কথাবার্তা খুব সড়গড় ছিল না। রাতে সাড়ে ন’টা নাগাদ আমরা বিছানায়, দিদি প্রত্যেককে বলতেন go to bed. কিন্তু আমরা তখনো গল্প করতাম। দিদি ভাবতেন, উনি বাংলা বললে সবাই বুঝবে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, go to bed-এর বাংলা কি?
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, ”ভজ মন নন্দ ঘোষের নন্দনে”। (তখনকার ”মানময়ী গার্লস স্কুল”—সিনেমার গান)। দিদি প্রতি ঘরে ঢুকে কথাটি বলছেন। গান তো তখনকার হিট গান! মেয়েরা দিদির কথা বুঝছে না। দিদির কেমন সন্দেহ হোল। তৃপ্তিদির কাছে মানেটা জেনে নিলেন। তারপর আমাকে বেজায় বকলেন। এমন হবে সে তো জানতাম। নির্বিকার দাঁড়িয়ে বকুনি খেলাম।
রবীন্দ্রনাথ ছোটদের দিকে খুব মন দিতেন। ”লক্ষ্মীর পরীক্ষা” নাটক হবে। আমি ক্ষীরি, সেবা মাইতি (পরে মিত্র) রানী কল্যাণী, আর মীরাদির দিদি অণিমাদি লক্ষ্মী। তা, ওখানকার যা নিয়ম, শেষের দিকে রিহার্সাল হবে উদয়নে। রবীন্দ্রনাথ ”হ্যাঁ” বলবেন, তবে হবে নাটক।
ঠিক কেমন করে বলতে হবে, ”ভোলা ময়রার শয়তানি এ”,—সেটি বারবার বলছেন, আমিও বলছি। চোখে জল এসে যায় প্রায়। যা হোক, সে নাটক তো হোল। তারপর ১৯৩৭ সালে ইচ্ছে হয়েছিল ”ডাকঘর” করাবেন। আমি হবো সুধা আর শান্তিদেব ঘোষের সবচেয়ে ছোট ভাই ভুলু (শুভময়) হবে অমল। কেন যে হয় নি, আজ তা মনে নেই।
ভয় তো ওঁকে পেতাম না। তবে ওই যে আত্মস্থ হয়ে বসে থাকতেন, যেন দুপুরের রোদের সঙ্গে এক হয়ে গেছেন, তা দেখলেই পা যেত থেমে। দাঁড়িয়ে পড়ে দেখতাম আর দেখতাম।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের রথীদাকে আশ্রমের উপাচার্যরূপে, বা কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে দেখি ১৯৪৪—এর শেষে যখন বি. এ. পড়তে শান্তিনিকেতনে এলাম। সে সময়ে ২/৪ বার কথাও বলেছি। রথীদা কৃষিবিদ্যা পড়তে আমেরিকা গিয়েছিলেন, সে তো বই পড়েই জানতাম। ”বই—খিদে” ছিল রাক্ষুসের মতো। ”জীবনস্মৃতি”, ”ছিন্নপত্র”, এ সব তো ১৯৩৫—এর মধ্যেই পড়া। তাতেও রথীদার কথা অনেক পড়িনি।
আমরা যে রথীদাকে দেখেছি, তিনি সৌন্দর্য রচনার কারিগর। উদয়নের অন্দর বাগানে পাঁচিলের সঙ্গে ডালপালা বেঁধে লতানে আমগাছ, লতানে পেয়ারা গাছ বানিয়ে ছিলেন। সে দেখার মতো। বাগান রচনায় রথীদা আর বৌঠান (প্রতিমা দেবী) দুজনেই খুব কুশলী। বৌঠানের স্বহস্ত রচিত একটি বটগাছের ”বনশাই” উদয়নের বারান্দায় বসানো থাকত। এইটুকু গাছ, যেন বুড়োগাছটি একটি পুতুল গাছ। ছোট ছোট ঝুরি, ছোট ছোট লাল ফল!
রথীদার হাতের কাজ খুব সুন্দর ছিল। ছোটবেলার শ্রীভবনে পুতুলের দোতলা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন। একতলায় বসার ঘর। সিঁড়ি দিয়ে উঠে শোয়ার ঘর। সুইচ টিপলে আলো জ্বলে।
ছোটবেলাই, বেবিদি, (নিবেদিতা) আর নন্দলাল বসুর ছেলে বিশ্বরূপদার বিয়ে আর নন্দিতা (বুড়িদি), রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী আর কৃষ্ণ কৃপালনীর বিয়ে হয়। আমরা সবাই আমন্ত্রিত ছিলাম। আশ্রমে এমন বিয়ে হলে কিচেনে ভোজটা খাওয়া হোত। খাওয়ার পর আনন্দ জানাতে ”সাধু! সাধু” বলা হোত।—তা; দুই বিয়ের একটিতে রথীদা এক ঝোড়া তুষার শুভ্র লিলি ফুল বানিয়ে দেন। তাতে সোনার মৌমাছি, যার ডানা কাঁপছিল।
দেখেছি বেশি বৌঠানকে। রবীন্দ্রানাথের সর্বকনিষ্ঠা কন্যা মীরাদিকেও কম দেখিনি। মীরাদিকে ভয় পেতাম। উনি দাঁত দেখাতে বলতেন, (ময়লা, না ফর্সা!)। আবার নিজের রুমাল বের করে কান মুছে দেখতেন। ময়লা আছে কি না। মাথায় উকুন আছে কি না। তাও দেখতেন।
বৌঠান ছিলেন অতি সুন্দরী। অতি ধীরস্থির, অতি স্নেহভরা মিষ্টি স্বভাব। নৃত্যনাট্যের মহলার পর বড় টেবিলের এক মাথায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। আর মাথায় আমরা, ছোটরা বসে খেতাম, কত যত্ন করে না খাইয়েছেন!
কত যে অমূল্য সে সব দিন, সেদিন তা বুঝিনি। এখন বুঝি খুব দুর্লভ সব দিন ছিল। সেদিন বুঝিনি। এমনটা বোধহয় অনেকেরই হয়।
মাস্টারমশাই, নন্দলাল বসু, অমন মানুষ আর দেখব না। মাঝারি মাপের মানুষ। হাড়পেটানো শক্ত চেহারা। কপালে কোঁকড়া চুল, খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি পরতেন। সাইকেলেও ঘুরতেন। হেঁটেও ঘুরতেন। রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই তাঁর আরাধ্য। শান্তিনিকেতন তাঁকে নিজ শিল্পজগৎ সৃষ্টির পথ খুঁজে দিয়েছিল। একটি ভবনে প্রাচীর চিত্রই আঁকতে দেখেছি তাকে। তাঁর ছাত্রশিল্পীদের নিয়ে চীনাভবনের দেওয়ালে।
ঘুরতে ফিরতে ছবি দেখলে চোখ ছবি দেখা শেখে। তাই কিচেনের সামনে ”চৈতী”—তে সব সময়ে বদলে বদলে ছবি রাখা হোত। আমরা ছবির কি বা বুঝি! কিন্তু দেখতাম। কলেজে যখন পড়তে যাই, তখন বলে কয়ে আমরা একবার ছবি দেখতে যাই কলাভবনে। রামকিঙ্কর—দার সে কি কথা!—”এই শংখ ! দেখ, দেখ খুকুরা বুঝি কলাভবনেই ভর্তি হবে!”
তখন সব জানতাম না। অথচ জানা উচিত ছিল। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে নৃত্যনাট্যগুলির সবইতো দেখেছি। মঞ্চসজ্জায় পশ্চাৎপট থাকত কালো। নৃত্যনাট্যের পোশাক, আলপনায় নানা বৈচিত্র্য, এরা স্রষ্টা তো তিনি। ওঁর মেয়ে গৌরী ভঞ্জ আশ্চর্য আলপনা দিতেন। ছোট মেয়ে যমুনাদি একদা নাচতেন কুরূপা চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায়। মীরাদি তার বইয়ে লিখেছে। মাস্টারমশাই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্ত ছিলেন। বড়ই দেশজ মানুষ। দেশের মাটির মানুষ।
কিঙ্করদা (রামকিঙ্কর বেজ) হলেন মাটি থেকে মাথা তোলা একটি উদ্ধত ও শাণিত পাথর। সকল অর্থেই পাথর। শিলার মতোই অনমনীয়, এবং আদিমও বটে। প্রথম পর্ব এবং দ্বিতীয় পর্ব, দুই পর্বেই কিঙ্করদাকে দেখেছি। তাঁর সম্বন্ধে কে ভাবছে, কি ভাবছে, তাতে ওঁর কিছুই এসে যেত না। উনি ছিলেন জাতশিল্পী। ”সাঁওতাল পরিবার”, ”সুজাতা” এগুলি তো সেদিনের শান্তিনিকেতনে দিগদর্শন চিহ্ন। পুরনো অতিথিশালার সামনের বিমূর্ত মূর্তি কিছুকাল সকলকে খুব ধাঁধায় ফেলেছিল।
ছোটমামা শঙ্খ চৌধুরী ভাস্করের কাজই করেছেন। শিখেছেন এবং কিঙ্করদার প্রত্যক্ষ শিষ্য। নেপালের তৎকালীন মহারাজা নন্দলাল বসুর কাছে প্রাসাদে বা দরবারে মূর্তি গড়ার জন্য ভাস্কর চেয়ে পাঠান এবং কিঙ্করদাকে পাঠানো হয়। কিঙ্করদার সঙ্গে তো লোক দরকার। কিঙ্করদা খুবই ভালো। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে কোনো ভবিষ্যৎবাণী করা বুদ্ধির কাজ নয়। শঙ্খ চৌধুরী গেলেন কিঙ্করদার সঙ্গে।
গত শতকের ত্রিশের দশকে নেপাল যাওয়া খুব সহজ কাজ বোধহয় ছিল না। কিঙ্করদার নেপাল অভিযান ও প্রত্যাবর্তন—এর কাহিনী শঙ্খ চৌধুরীর ”স্মৃতি বিস্মৃতির আড়ালে” বইয়ে পাওয়া যাবে। শঙ্খ চৌধুরী শান্তিনিকেতনে একটি মাটির বাড়ি করেছিলেন। এক সময়ে সৈয়দ মুজতবা আলিকে ওখানে থাকতে দেখেছি। কিঙ্করদাও ওখানে থেকেছিলেন অনেক কাল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছু দিন (নিশ্চয় খুব কম দিন) বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন। তখন উনি ওরকম দায়িত্বের কাজ করতে আর সক্ষম ছিলেন না বলেই মনে পড়ছে। একদিন দেখা করতে গেলাম। দেখি এক গুচ্ছ হলদে পলাশ ফুল নিয়ে বসে আছেন। বারবার বলছেন, এ রকমটি দেখেছিস?
আমার মনে পড়ল, গোয়ালপাড়া গ্রামে ফুটত হলদে পলাশ। পরে পড়লাম হলদে পলাশ যে গাছে ফোটে, সে গাছের লাক্ষার রং সোনার মতো হয়।
বলতাম কাকে? তবে শুনেছিলাম, যাঁর ছবি গল্প বলে, আর লেখা ছবি আঁকে, সেই অবনীন্দ্রনাথের কথায় ”উদীচী” বাড়িতে নাকি একটি হলদে পলাশ গাছ লাগানো হয়েছিল। তারপর?
তার পরের খবর আর জানি না।
মীরাদি লিখেছে, অবনীন্দ্রনাথের চলাফেরার অসুবিধের জন্য ওঁর জন্য একটি রিকশা ঠিক করে দেওয়া হয়। অবনীন্দ্রনাথ তাতে চড়ে ”চৈতী” অবধি চলে যেতেন। যেখানে শিশুরা ওঁর জন্যে বসে থাকতো। ওদের গল্প বলতেন। এই ভালো কাজটা আমরা করি না কেন?
প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, দাড়ি গোঁফে সম্ভ্রান্ত মুখ, গেরুয়া জোব্বা পরতেন। বেশ গম্ভীর ছিলেন। আমরা সমীহ করতাম। রবীন্দ্রজীবনী তো উনি পরে লেখেন। (না কি তখনি লিখছেন?—জানি না।)
উনি আমাদের অভিজাত লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিকও বটে। রবীন্দ্রনাথের নিজের সংগ্রহের যত বই সব ওখানে দিয়েছিলেন। ফলে লাইব্রেরি ছিল জাঁকালো। আমাদের বই নেবার বা পড়ার কোন বাধা ছিল না। বই দিতেন সত্যদা। সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়। ইনি মোহরের বাবা। মোহর তো শান্তিনিকেতনের সংগীতলক্ষ্মী। ছোটবেলা থেকেই বাঁশির মতো গলা। দেখতেও টুকটুকে সুন্দরী।
আমরা ক্লাস সেভেনে, মোহর হিন্দুস্থান (?) কোম্পানিতে এক রেকর্ড করল। সেদিন কলে বাজানো গান! রেকর্ডটি ডিসকে বসানো। গ্রামোফোনে দম লাগিয়ে রিসিভারে পিন লাগিয়ে ডিসকে বাড়িয়ে দাও, গান বাজবে। গানটি আমার আজও মনে পড়ে। ৯০—৯২ সালে সে গান তাকে শুনিয়েও এসেছি। বড়ই দুঃসাহস করেছিলাম। কিন্তু মোহর খুশি হয়েছিল। মোহরের বয়স বেড়েছিল। কিন্তু স্বভাবে চির অভিমানী কিশোরী থেকে গিয়েছিল। এই রোদ, এই বৃষ্টি, যেন শরতের মেঘ। আমি যখন কলেজে ভর্তি হলাম, সেবা মাইতি (মিত্র) আর মোহর সংগীতভবনে মাসে ৪০ টাকার বৃত্তি পেল। ১৯৪৪ সালে ৪০ টাকার দাম যে কত, তা বোঝানো যাবে না। আমরা টাকার একটা ব্যবহারই জানতাম—খাওয়া। টাকাটা সেবার, না মোহরের, না অন্য কারো, তাতে কিছু এসে যেত না।
অজিত কুমার চক্রবর্তী অনেক আগেকার মানুষ। তাঁকে আমি দেখিনি। রবীন্দ্রনাথের চারপাশে একদা দেখেছি সুধাকান্ত রায়চৌধুরী, প্রভাতদা, কৃপালনীজী, অনিল চন্দ, রানী চন্দ, আরো কতজনকে। গুরুদয়াল মল্লিক, আমাদের মল্লিকজী, সি. এফ. এ্যানড্রুজ, এমন সব অবিস্মরণীয় মানুষ। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে নীড় রচনা হয়েছিল বিশ্বের। এখানে ”সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কি শর্তে?”
৫
বিপুল তরঙ্গ রে
গান শেখার কোন স্মৃতিকথা শোনাই বলো তো! শান্তিনিকেতনে আমরা শিখতে শিখতে গেয়েছি আবার গাইতে গাইতে শিখেছি। সাতসকালে উঠে বৈতালিক গান। এ ভাবে গাওয়ার নিয়ম সব বিভাগেই। স্কুলের শিশুবিভাগ—মধ্যবিভাগ—অন্য বিভাগ। আমার গলা ছিল তেজী, দাঁত বড় বড়, চেঁচিয়ে গান গাইতাম।
ছিল, গানের ক্লাস ছিল, ছিল না গানের খাতা বা বই। শৈলজারঞ্জন মজুমদার, এসরাজ বাজিয়ে গান শেখাতেন। বৈতালিকের গানের সূচীতে অনেক গানের প্রথম ছত্র লেখা আছে। তার প্রায় সব গানই গাওয়া হোত।
ছিল বৈতালিক। জ্যোৎস্না রাতে বেরোত নৈশ বৈতালিক। কলাভবনের সঞ্জয় রেড্ডি, বা রেড্ডিদা’র গলা সব ছাপিয়ে শোনা যেত।
এ ছাড়াও নৃত্যনাট্য যেটি যখন হোত, তার গানগুলি ছাত্রছাত্রী সবাই মিলে গাইতাম, সংগীতভবনে শৈলজাদা শেখাতেন। আর যা শিখলাম, তা শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাসই শেখাত। উৎসবগুলি ছিল ঋতুবন্দনা। বৃক্ষরোপণ উৎসব প্রথম বার হয় ১৯৩৬ বা ১৯৩৭ সালে। ভুবনডাঙার বাঁধের পাশে সার বেঁধে নেচে চলছিলেন আমাদের বিখ্যাত নর্তকীরা—নন্দিতা (বুড়ীদি), নিবেদিতা (বেবিদি), মমতাদি, হাসুদি, অনুদি, অনিতা বরুয়া, সেবা এমন কতো জন। এমন তো জীবনে দেখিনি। এও ছিল সৌন্দর্যের অভিঘাত।
তারপর ছিল গানের ক্লাস। শৈলজাদা কেমিস্ট্রির এম.এস.সি. একসময়ে শান্তিনিকেতনে সত্যিই কেমিস্ট্রি পড়িয়েছেন। গানও শেখাতেন। গলায় গান গাইতেন না, ছড় তুলে আমাদের চুপ করিয়ে এস্রাজে সুর শেখাতেন।
যাঁরা অসামান্য গাইতেন, যেমন ইন্দুদি, অমিতা সেন, রাজেশ্বরী বাসুদেব (দত্ত), সুবিনয় রায়, আজও ভালো লাগে। মোহর আর সুচিত্রা এঁদের পরের ব্যাচের, পরের প্রজন্মের। মোহর আর আমি তো প্রায়, অথবা অবশ্য এক বয়সী।
কলেজে একসঙ্গে পড়ত সুদর্শনা। ও কলকলিয়ে গান গাইত। ভুলু (শান্তিদার ভাই) চমৎকার গাইত। নীলিমা সেন (বাচ্চু) ভালো গাইত।
গানের বিষয়ে একটি মহার্ঘ স্মৃতি বিষয়ে না বললে নয়। গানের বিষয়ে এমন নয় যে আমি রবীন্দ্র সংগীতই ভালোবাসি। সে বিষয়ে আমি অসীম উদার এবং গান ভালোবাসতে শিক্ষা, কখনো হয়নি। নিয়ম মেনে শিখিনি কিছুই। আমার বাবা, ছোটমাসি, ছোটমামা সবাই হিন্দুস্থানী মার্গ সংগীতেরও ভক্ত ছিলেন।
আমি যে গান কানে লেগে যায় তাই ভালোবাসতাম। সে উমা বসুর গাওয়া জসীমউদ্দীনের গান হোক, উমা বসুর গাওয়া হিমাংশু দত্তের গান হোক, শচীন দেববর্মনের বাংলা গান হোক, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গান হোক, দিলীপ রায়ের ”মুঠো মুঠো রাঙা জবা” হোক, বা সাহানা দেবীর গলায় অতুলপ্রসাদ সেনের ”কত গান তো হোল গাওয়া” হোক, বা ওই গলাতেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (?) ”তোমারেই ভালোবেসেছি, তোমাকেই ভালবাসিব” হোক। কানে যা ভাল লাগে তাই তো গান। এর মধ্যে অবশ্যই যুক্ত হবে কিছু ইংরেজি গান। অনেক ফিলমি গান (বাংলা কম, হিন্দী বেশি), ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এ রকম আমি বইপড়া বিষয়েও। বাংলাতে প্রাচীন যুগ থেকে বিংশ শতকের পাঁচ দশক পর্যন্ত বাংলা যেমন পড়েছি, ইংরেজি এবং ইংরেজি অনুবাদে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাহিত্য যেমন পড়েছি, তেমনিই পড়েছি শিকার, বন ও প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে। আর ডিটেকটিভ উপন্যাস এবং ভূতের গল্প পড়ে পড়ে মাথা বোঝাই করেছি।
এ রকমই আমি। বড় বেশি যা—ইচ্ছে—তাই করে চলা মানুষ। সেই আমার কাছে ১৯৩৭ সালটি বড় গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রসংগীত প্রেক্ষিতে। বিশ্বাস করি, কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষায়, প্রকৃতিতে মগ্ন হয়ে ওই যে উনি বসে থাকতেন, প্রকৃতির কাছ থেকে গ্রহণ করতেন, শুধুই গ্রহণ করতেন। শান্তিনিকেতন বিষয়ে নিশ্চয় ছিল সুগভীর চিন্তা। শিক্ষার আদর্শ গড়ে তুলেছিলেন সেখানে। সেটি ওঁর গবেষণাগারও বটে। তবে কোনো সংকীর্ণ অর্থে নয়।
১৯৩৬—৩৮, যে কয়বছর তাঁকে দেখেছি, নতুন নতুন সৃষ্টির প্রেরণায় তখন তিনি কত না ব্যস্ত। কত সজীব! ওই সময়ের মধ্যে সৃষ্টি করলেন নৃত্যনাট্য ”চিত্রাঙ্গদা”, ”পরিশোধ” (পরে শ্যামা), ”তাসের দেশ”, এবং মহত্তম ”চণ্ডালিকা”। শুধু কি লেখা? গানে সুর দেওয়া, নৃত্যকল্পনা নৃত্যগুরুদের বোঝানো, নিত্য মহলায় উপস্থিত থাকা। তিনি বিশ্বমানব। প্রকৃতিতে নিরন্তর সৃজনের যে তাগিদ থাকে তা তাঁরই ছিল।
১৯৩৭ সালে বর্ষামঙ্গলের বিষয়ে অনে—ক বার মনে হয়েছে এই সব নতুন গান, নতুন সৃষ্টির মধ্যে তাঁরই অন্তহীন জিজীবিষার আত্মপ্রকাশ।
১৯৩৭ সালের বর্ষামঙ্গল আসন্ন। আমাদের গোঁসাইজীর (নিত্যানন্দ বিনোদ গোঁসাই) ছেলে বীরুদা এক মেঘমলিন সন্ধ্যায় মারা গেলেন। টাইফয়েড বিষয়ে তখন বলা হোত, এ রোগে সবার আগে চাই নার্সিং।—তা আশ্রমে যে কারো অসুখ হলে সবাই বুক দিয়ে পড়ে সেবা করত। রোগে সেবা, গ্রামে আগুন লাগা, পরের যে—কোনো বিপদে দৌড়ানো, এ আশ্রমের কর্মসূচীতেই পড়ত। বীরুদার তাগড় তাজা চেহারা, বড় বড় চোখ, আজও মনে পড়ে। আমরা কিচেন অবধি হেঁটে এসে গুরুপল্লী যাবার পথের মোড়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আশ্রম নিস্তব্ধ। সিংহসদনের ঘণ্টা জানিয়েই দিয়েছে বীরুদা আর নেই। রবীন্দ্রনাথের গাড়ি এল। গুরুপল্লীর দিকে চলেও গেল। আবার কিছুক্ষণ বাদে ফিরেও এল। তখন আমরা শ্রীভবনে ফিরলাম।
বীরুদার জন্য আশ্রমে বর্ষামঙ্গল হয়নি সে বছর। ১৯৩৭—এর বর্ষামঙ্গল উৎসব উদযাপিত হোল কলকাতার ”ছায়া” সিনেমার মঞ্চে। রবীন্দ্রনাথ মঞ্চে। কলকাতা ভেঙে পড়েছিল বললে হয়। সেই একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একই ট্রেনে কলকাতা এলাম। থাকলাম হয়তো ৩/৪ দিন।
জোড়াসাঁকোয় থাকলাম। আমার কি উত্তেজনা। জোড়াসাঁকোর বাড়ির কথা কত না পড়েছি। কোন ঘরে কে থাকতেন, কোন সিঁড়ি দিয়ে ছাতে উঠে সারা রাত কবি হাঁটতেন, জানার জন্যে কি আকুলতা, জিজ্ঞেস করি কাকে। কোথায় সে দীঘি, যার পাশে ছিল প্রাচীন বটগাছ?
বর্ষামঙ্গলের আগে শৈলজাদাদা গান শেখাচ্ছেন। একটা বিষণ্ণ মেঘ যেন সবার মনে ছায়া ফেলে রেখেছে। কয়েকটি নতুন গানই লিখেছেন এ তো আমরা শুনেছি। গানতো তখনো শুনি নি। শৈলজাদা সেবার যে গানগুলি শেখান, সবগুলিই কি ১৯৩৭—এ রচিত? কয়েকটি তো বটেই। আমি মন থেকেই লিখছি। ভুল হলে কেউ শুধরে দেবেন। যে সব গান—এর কথা লিখছি, তার কোনো কোনো গানের কথা বীরুদাকেই মনে পড়িয়ে দিত।
যেমন :—
”এসো শ্যামল সুন্দর!
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা”, অথবা ”মন মোর মেঘের সঙ্গী উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে—নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে”—
অথবা অত্যাশ্চর্য সেই অতি আধুনিক গান
”শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ণ সন্ধ্যায়
সাথীহারা ঘরে মন আমার
উদাসী পাখি উড়ে যেতে চায়
দূর কালের অরণ্য ছায়া তলে
কি জানি সেথা আছে কি না, আজও বিজনে
বিরহী হিয়া
নীপবন গন্ধ ঘন…(?)
সাড়া দিবে কি গীতহীন নীরব সাধনাতে
জানি সে নাই জীর্ণ নীড়ে জানি সে নাই আর
তীর্থহারা যাত্রী ফিরে ব্যর্থ বেদনায়
ডাকে তবু হৃদয় মম মনে মনে
রিক্ত ভুবনে
রোদন ভরা সঙ্গীহারা অসীম শূন্যে (?)
গানটি আমাকে বিচলিত করে।
এছাড়াও কত গান, কত গান! তিনি নিজে পড়লেন ”আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণ খেলা রাত্রিবেলা!”
শান্তিদা বুকে ও হাতে কড়ির গহনায় সেজে বীর নৃত্য নাচলেন। আমাদের কোন যৌথ নৃত্য ছিল। সব মনে নেই।
নাচ, বিশেষ করে গান বিষয়ে আমার উৎসাহ ছিল। বেয়াড়া রকম প্রাণশক্তি ছিল বললে হয়। উৎসাহ ছিল অঙ্কনে, আলপনা দেওয়াতে, চামড়ার কাজ একটু শিখি, বাটিক আলপনাও শাড়িতে আঁকতাম।
কিছুই হয় নি। গায়ের জোরে কি সব হয়?
৬
রবীন্দ্রনাথ—শিক্ষাদর্শ—শান্তিনিকেতনকে যেমন বুঝেছি
”প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো দাও প্রাণ”
শান্তিনিকেতনে তাঁর জীবিত কালে পড়েছি ১৯৩৬, ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯—১৯৪৪, নবম ও দশম শ্রেণী আর আই, এ পড়লাম কলকাতায়। ১৯৪৪—এর শেষে আবার শান্তিনিকেতন, ১৯৪৬—এ বি.এ. পাশ করি।
১৯৪১—এর ২২শে শ্রাবণও ভোলার নয়। বস্তুত, শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসা ও ফিরে যাওয়ার মধ্যবর্তী বছরগুলি ছিল টালমাটালের। ১৯৩৯ সালে ঘোষিত হোল বিশ্বে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। ৪২ সালে আগস্ট আন্দোলন, ৪২—এর অক্টোবরেই বঙ্গোপসাগরে মহা ঘূর্ণীবাত্যা, বৃষ্টি, বঙ্গোপসাগর উপকূলে সমুদ্রে প্লাবন আর নদীগুলিও প্লাবিত। ধান পাকবে, কাটবে, তারপর জমিদারকে কর্জ শোধ দেবে। যখন ধান তৈরি নয়, তখন ওরা কর্জ নিয়েই চালায়। এবার ধানক্ষেত ধুধু, ক্ষুধায় কঙ্কালসার মানুষগুলি মিছিল করে চলল খাদ্য ভিক্ষায়। সে সময়ে কম্যুনিস্ট পার্টি যুদ্ধে মিত্রপক্ষকে সমর্থন করে। যুদ্ধকে বলে জনযুদ্ধ। ইতিমধ্যে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সমর্থনে, কংগ্রেস সমর্থনেও আগস্ট আন্দোলন শুরু হয়। সে আন্দোলন ছিল জনগণের আন্দোলন। মানুষ আপনা থেকেই তাতে যোগ দেয়। এদিকে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বড় সংস্কৃতি আন্দোলন গড়ে ওঠে। গোড়াতে বহুজন বহু গান রচনা করেন। ভাঙা স্তবক মনে পড়ে। যেমন,
”জাগো জাগো”
জাগো ও ভাই
ঘুমে অচেতন থেকো না আর
অনাহার আর মহামারী মিলে
সোনার বাংলা হোল উজাড়
গ্রামে গ্রামে আর নগরে নগরে
হাটে মাঠে বাটে রাজপথ পরে
বাংলার প্রাণ ধুঁকে ধুঁকে মরে
কে বাঁচাবে প্রাণ বাংলা মা—র!”
স্মরণ থেকে লিখছি। বোধহয় বিনয় রায়ের গান। ভুল হতেই পারে।
শান্তিনিকেতন থেকে এসে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদিতে প্রবেশ করতে খুব অসুবিধা হয়। ঘরকুনো হয়ে গিয়েছিলাম। সে সময় দুর্ভিক্ষ ত্রাণের কাজ—এ ঢুকে পড়ি পিপলস রিলিফ কমিটিতে। বিজন ভট্টাচার্যের লিখিত এবং একঝাঁক গণশিল্পী অভিনীত ”নবান্ন” ওই সময়ের সর্বাধিক খ্যাত নাটক। পরে কে.এ.আব্বাস এই নাটকের উপরেই আধারিত ”ধরতি কে লাল” ছবি করেন। এই সময়কালে অনামা অখ্যাত আমরা কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বারা খুবই প্রভাবিত। ”সেই ট্র্যাডিশান” সমানে চলছে যদিও কালের নিয়মে নিজের মনে বহু নিজস্ব চিন্তাও ঢুকে গেছে। বড় কম জানি, বড় কম পড়েছি, এখন আর নিজেকে বদলাবার সময় নেই। তবু ইচ্ছে, কত লেখার, কত জানার, কত জানাবার ইচ্ছে, যদিও সময় পাব না।
রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ, প্রায় শেষ শয্যায় এ তো কাগজে পড়ছি, রেডিওতে শুনছি। ১৯৪১—এর সাতই আগস্ট, বেলতলা স্কুলের প্রধানা শিক্ষিকা শকুন্তলা শাস্ত্রী ডেকে পাঠালেন। এমন ডেকে পাঠালে ভয় করে। অদ্ভুত কিছু না হলে কখনো ডেকে পাঠান না। আমাদের ভয় ও সমীহের প্রধানা শিক্ষিকা। নিচে গেলাম। তিনি বললেন, তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন। তিনি আসছেন, তোমাকে নিয়ে যাবেন।
স্কুল ছুটির নির্দেশ পাঠিয়ে দিয়ে দিদি বললেন, তুমি তোমার বই খাতা নিয়ে এসো।
আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। বাবা এলেন, আগে গেলাম বাড়ি। বড়মাসি, মা আর আমাকে নিয়ে বাবা বেরোলেন। সমস্ত শহর স্তব্ধ। জোড়াসাঁকোর কাছে যায় কার সাধ্যি। পরদিন কাগজে পড়েছিলাম, বাংলার গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্ন বলেছিলেন, কবিকে দেখতে অনেক, অনেক লোক আসবেন। দেশের নেতারা অনুমোদন করল, কবির মরদেহ পূর্ণ মর্যাদায় গড়ের মাঠে কড়া পাহারায় উঁচু মঞ্চে রাখা হবে। সারা রাত উজ্জ্বল বাতি জ্বলবে। দর্শনার্থীরা আসুন, ফুল দিন, অন্ত্যেষ্টি হোক পরদিন।
কে শুনবে। রাস্তায় এত মানুষ, যে সে দৃশ্য যে না দেখেছে সে বুঝবে না। শোক এবং অবিশ্বাস একইসঙ্গে। জোড়াসাঁকো থেকে যে ব্যবস্থা হয়, সে তো থাকল না। সবাই কাঁধ দিতে চায়। মানুষের কাঁধে কাঁধে কবির দেহ যেন প্রবল স্রোতে ভেসে চলেছে।
আকাশ মেঘলা, কিন্তু প্রথমে বৃষ্টি ছিল না। মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটি হাতপাখা আর ঠাণ্ডা জলের ধারা ঝারি থেকে বিতরণ করছিলেন। পায়ে পায়ে কতটা জানি না হেঁটে আমরা দাঁড়িয়ে যাই। কবিকে একবার ছোঁবো, এ আকাঙ্ক্ষা দুর্বার ছিল। ছিল না কান্না ছাড়া আর কোন শব্দ। ঘাটে যখন পৌঁছয় মরদেহ, তখন ওপার থেকে সাদা পদ্ম, বেলফুল, রজনীগন্ধা বোঝাই নৌকো আসছে তো আসছেই। আজ ভাবলেও অবিশ্বাস্য লাগে। তাঁর অন্ত্যেষ্টি অন্যভাবে হতে পারত, এমন কথা বহুদিন ধরে শুনেছি। মনে হয় না তা সম্ভব হোত। তিনি ভারতের, তিনি জগতের। কিন্তু বাংলার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ কোথায়, কে কাকে বোঝাবে?
সেদিন ছিল রাখী পূর্ণিমা। আর চোখের সামনে থেকে যখন তাঁর শরীর ভেসে চলে গেল, তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমেছিল।
এর পরে কথাটি এতকাল পরে প্রথম বলছি। আশ্রমে তো খুব শুনতাম টাকা নেই আশ্রমের। তাঁর সব বইয়ের টাকা আশ্রমে যেত। তাঁর স্ত্রীর গহনাগাঁটি সব বেচে আশ্রমেই দেওয়া হয়। নৃত্যনাট্য নিয়ে ঘুরতেন, সেও টাকা তোলার জন্য। নোবেল পুরস্কারের সমস্তটা দিয়ে দিয়েছিলেন। ”আমায় যে সব দিতে হবে, সে তো আমি জানি। আমার যত বিত্ত প্রভু, আমর যত বাণী, সব দিতে হবে।” এ গান তো অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
যাক। আমার যেমন স্বভাব! আমার মনে হোল আমি তো কিছু করতে পারি। মনে হোল আমার স্কুলে যদি টাকা তুলি?
প্রধান শিক্ষিকার অনুমতি নিয়ে ক্লাসে টাকা তুলেছিলাম। বাবাই টাকাটা পাঠান।
তখন পাঠভবনের অধ্যক্ষ কৃষ্ণ কৃপালনী কী সৌম্য, শান্ত, পরিশীলিত, অত্যন্ত শিক্ষিত। কৃপালনীজীর চিঠি পেলাম, ”মহাশ্বেতা, তোমার পাঠানো আঠারো টাকা পেলাম তোমার প্রাক্তনী বিদ্যায়তনের জন্য। তোমার ভালবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।”
চিঠিটি আমার কাছে ছিল, অনেককাল ছিল। এখনো মনে করি আমি যে জঞ্জালে বাস করি, তার ভেতর থেকেই বেরোবে। বেরোলে সেটি ভাষাবন্ধনই পাবে।
ক্রমে ক্রমে ম্যাট্রিক ও আই.এ.পাশ করি। সে সময়ে বাবা রংপুরে বদলি হন। রংপুর রেড—রংপুর নামে পরিচিত ছিল। শিক্ষিত সমাজসেবী কম্যুনিস্ট সেখানে অনেক। পরপর সব কম্যুনিস্ট পরিবার। কতজন কত ভাবে লেখায় উঠে এসেছেন।
থার্ড ইয়ারে ভর্তি হই শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনে কি যেন ছিল না। একটি মানুষ চলে গেছেন, যেন অকালে গেলেন। তাঁর শান্তিনিকেতনকে কাদের হাতে রেখে গেলেন?
৭
”বাজাও আমারে বাজাও
বাজালে যে সুরে প্রভাত আলোরে
সেই সুরে মোরে বাজাও।”
যখন ভাবি কি পেয়েছি, তখন বুঝি সব পেয়েছি,
এখন ওঠো, এখন খেতে চলো,
এখন উপাসনা হবে
—এ সব কেউ বলে দিত না। শান্তিনিকেতনে এ ভাবে বলে বলে নিয়ম মানানো হোত না। শিক্ষার্থীরা, ছোট থেকে বড়, জানতেন কোনটি ভোরে ওঠার ঘণ্টা, কোনটি সুশৃঙ্খল লাইন বেঁধে সকালে খেতে যাবার ঘণ্টা, কোনটি প্রভাতী বৈতালিকের ঘণ্টা।
তুমি আপনা থেকেই নিয়ম শেখো। নিয়ম মানো। যে গান গাইছ, যে পড়া করছ, সব কিছুরই নিজ নিজ নিয়ম আছে। কেন নিয়ম মানবে এমন আপনা থেকে? বুঝে দেখো বিশ্বজগৎ চলছে তার নিয়মে। সেখানে কোনো ব্যতিক্রম নেই। সূর্য কখনো নিয়ম ভাঙে না। যখন ওঠবার ওঠে, যখন ডোববার, ডোবে।
প্রকৃতিপাঠ আমাদের সেই পাঠক্রম, যার কোন বই ছিল না। তেজেশদার (তেজেশচন্দ্র সেন) সঙ্গে সঙ্গে ওঁর কথা শুনে গাছপালা—ফুল—ফল—কীট—পতঙ্গ—প্রজাপতি—ফড়িং—মাছি—সাপ—ব্যাঙ দেখো আর দেখো। এরা সবাই প্রকৃতির রাজ্যে আগে এসেছে, তোমরা পরে এসেছ। ওদের চেনো, জানো। ওরাও কিন্তু বেনিয়মী নয়।
এই সব জানতে জানতে এই সব শিখতে শিখতে বড় হওয়া, সে যে রবীন্দ্রনাথের শিশুশিক্ষা সার্থকতার কারণেই, তা অনেক দিন বুঝেছি। অন্য কোথাও লিখেছি, ”সেদিনের শান্তিনিকেতনের কাজই ছিল, শৈশব থেকে মনের সহস্র চোখ ও দরজা খুলে দেওয়া।”
শিখিয়েছিল, প্রকৃতির রাজ্যে যেমন কোনো বিরতি বা আলস্য নেই, সর্বদা চলছে কাজ, আনন্দধারা বয়ে যাচ্ছে কাজের মধ্যেই,—সেই পাঠ গ্রহণ করো অন্তরে।
কাজেই যে মুক্তি, কর্মময়তাই যে আনন্দ, এ শিক্ষাও শৈশবেই হয়। কাজ করো নিজ দায়িত্ব বোধ থেকে। সেদিনের কথা ভাবলে মনে হয় পাঠভবনের শিশুরা একেকদিকে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হবে এ কথা তিনি ভাবেন নি। চেয়েছিলেন একটি প্রজন্ম হোক, যেখানে শিক্ষার্থীরা কেজোকর্মা, দায়িত্বশীল, অনুকম্পায়ী স্বাধীনভাবে চিন্তা ও কাজ করতে সক্ষম হবে। বঙ্গজননীকেও বলেছিলেন বাংলার সন্তানরা ”বাঙালী” নয় ”মানুষ” হোক।
ননীগোপাল শিকদারের ”শান্তিনিকেতন—সেকাল—মধ্যকাল—একাল” বইটি এতই তথ্যবাহী, যে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর শান্তিনিকেতনকে বুঝতে গেলে এটি পড়াই চাই। ছোট বই, নিত্যসাথী হিসেবে একে রাখা যায়। আমি তো রেখেছি।
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এর আদি স্রষ্টা। ভুবনডাঙা গ্রামে, মহর্ষি, রায়পুরের ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে ওই গ্রামে কুড়ি বিঘা জমির মৌরসী পাট্টা গ্রহণ করেন। সেই বছরেই একটি অতিথিশালার ভিত্তি স্থাপিত করেন। নাম দেন শান্তিনিকেতন।…একটি ছোট স্কুল হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এটি শুরু করেন ১৯০১ সালে। রবীন্দ্রনাথ নাম দেন ”ব্রহ্মচর্যাশ্রম”। পরে তা প্রতিষ্ঠিত হোল শান্তিনিকেতন আশ্রম নামে। পুরোন আশ্রমিকদের কাছে শান্তিনিকেতন আজও ”আশ্রম” বলেই পরিচিত। সূচনাপর্বে ধূ ধূ কঙ্কর বিস্তৃত জমিতে দুটি ছাতিম গাছ মাত্র ছিল।
তারপর বহু ব্যয়ে ওই ”শান্তিনিকেতন” নামাঙ্কিত অতিথিশালার দোতলা অবধি তৈরী হয়। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ যে বিদ্যালয় করেন, তার পিছনে অত্যধিক বাঁধাবাঁধি, ইংরেজি শিক্ষাদর্শের ছাঁচে পঠনপাঠন এ সব বিষয়ে তাঁর মানসিক বিরোধ ছিল। শিক্ষার্থীরা শহরের ইঁটকাঠের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির কোলে প্রকৃতিকে চিনবে, তা চেয়েছিলেন। বিদ্যালয়টি স্থাপনকালে রবীন্দ্রনাথের মনে ছিল, আদর্শ ভারতীয় রূপ থাকবে তার। অন্যদিকে পৃথিবীর প্রতি এক উদার উন্মুক্ত মনোভাব। প্রথম অবস্থায় বিশেষ ভাবেই ভারতীয় শিক্ষাধারার ঐতিহ্যে আশ্রম ও তপোবন রচনার কথা মনে ছিল। আবার পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ ভারত আত্মার ধারণাও বিশ্বভারতীতে আনেন। এর অন্তর্গত ছিল রবীন্দ্রনাথের চিন্তা। বিশ্ব বিশ্বভারতীমুখীন হোক, আবার বিশ্বভারতীর মাধ্যমেই প্রকাশ হোক বিশ্বের প্রতি ভারতের আতিথ্য, ভারতের চর্চা, জগৎ সংস্কৃতি বিষয়ে ভারতের ঔৎসুক্য এবং মানব প্রেম।
শান্তিনিকেতনের সূচনা স্বদেশী যুগের চেতনার সূচনায়। তা বিশ্বভারতীতে পরিণত হোল প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে। সেটা অসহযোগ আন্দোলনের সময়। স্বদেশী যুগে দরকার ছিল ইংরেজি স্কুল নয়, স্বদেশী প্রতিষ্ঠান। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সেটি। শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে।
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ১৯০১ সালে।
তিনি চেয়েছিলেন, শিক্ষা এবং প্রতিদিনের জীবনকে এক করতে। ভারতের মাটিতে চাপানো পশ্চিমী শিক্ষার প্রতি তাঁর বিরাগ ছিল। সে শিক্ষা আমাদের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। ভারতীয় সমাজকে তা বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল। তিনি খোঁজেন বিচ্ছিন্নতার প্রতিকার। ইংরেজি শিক্ষায় বিকল্প ব্যবস্থার অনুসন্ধানও সে জন্যই। ইংরেজি ভাষার প্রতি বিরাগ ছিল না। ইংরেজি ও সংস্কৃত ছিল অবশ্য পাঠ্য। বলতেন, ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে আমরা আজকের পৃথিবীর বহু জ্ঞাতব্য বিষয় জানতে পারি। তাঁর এই লেখাটি কত না মূল্যবান।
”সকল দেশেই শিক্ষার সঙ্গে দেশের সর্বাঙ্গীণ জীবনযাত্রার যোগ আছে। আমাদের দেশে কেবলমাত্র কেরাণি—গিরি, ওকালতি, ডাক্তারী, ডেপুটিগিরি, দারোগাগিরি, মুনসেফি, প্রভৃতি ভদ্রসমাজে প্রচলিত কয়েকটি ব্যবসায়ের সঙ্গেই আমাদের আধুনিক শিক্ষার প্রত্যক্ষ যোগ। যেখানে চাষ হইতেছে, কলুর ঘানি, কুমোরের চাক ঘুরিতেছে, সেখানে এ শিক্ষার কোন স্পর্শও পৌঁছায় নাই। অন্য কোন শিক্ষিত দেশে এমন দুর্যোগ ঘটিতে দেখা যায় না। তাহার কারণ আমাদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দেশের মাটির উপর নাই। তাহা পরগাছার মত পরদেশীয় বনস্পতির উপর ঝুলিতেছে। ভারতবর্ষে যদি সত্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তবে গোড়া হইতেই সে বিদ্যালয় তাহার অর্থশাস্ত্র, তাহার কৃষিতত্ত্ব, তাহার স্বাস্থ্যবিদ্যা, তাহার সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে আপন প্রতিষ্ঠা স্থানের চতুর্দিকবর্তী পল্লীর মধ্যে প্রয়োগ করিয়া দেশের জীবনযাত্রার কেন্দ্র স্থান অধিকার করিবে। এই বিদ্যালয় উৎকৃষ্ট আদর্শে চাষ করিবে, গোপালন করিবে, কাপড় বুনিবে এবং নিজের আর্থিক সম্বল লাভ করিবার জন্য সমবায় প্রণালী অবলম্বন করিয়া ছাত্র, শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হইবে। এই রূপ আদর্শ বিদ্যালয়কে আমি বিশ্বভারতী নাম দিবার প্রস্তাব করিয়াছি।”
বিশ্বভারতীর একটি মূল অঙ্গ হিসাবে অনতিদূরে, সুরুল গ্রামে শ্রীনিকেতন কৃষি ও পল্লী সংগঠন কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ভারতে অধিকাংশ মানুষ পল্লীবাসী এবং দীন। কবি মনে করতেন ভারতীয় শিক্ষা যদি পল্লীর শুভাশুভ স্বীয় সূচীর অন্তর্গত না করে, তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁর ধারণায় বিশ্বভারতীর এক অর্থ বিশ্বকর্ম। অন্য অর্থে তিনি চেয়েছিলেন বিশ্বভারতী হবে সেই যুগের বিশ্ববোধের প্রকাশ। পূর্ব ও পশ্চিম যেখানে মিলিত হবে। এক কথায় বিশ্বভারতী বলতে আমাদের বুঝতে হবে শান্তিনিকেতন এবং শ্রীনিকেতন মিলিয়ে এক সমগ্র শিক্ষাপ্রণালী। যে শিক্ষা শিক্ষার্থীকে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করবে, তার জীবনে আনবে নিষ্ঠা, বিদ্যাচর্চায় আনবে ঐক্য। এমতো উদ্যোগ থেকে দেশের মানুষের মননশক্তি, আত্মশক্তি ও আত্মসম্মান পূর্ণভাবে ফিরে আসবে। ভারতবর্ষকে জানতে হবে আবার, বিশ্বের জ্ঞানজগতের সঙ্গেও যুক্ত হতে হবে।
প্রথমতম অধ্যায়ে তাঁর ইচ্ছা ছিল, কাজেও হোত, গুরু এবং শিক্ষার্থীর আদর্শ হবে ব্রহ্মচর্য ও সরল জীবনযাত্রা। গাছের তলায় ক্লাস হবে প্রকৃতির কোলে, মুক্ত অঙ্গনে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে শয্যাত্যাগ এবং পরপর কর্মসূচী মেনে চলা।
এ জন্যই আমি বলি, ভিতর থেকে দায়িত্ববোধের অঙ্গুলি নির্দেশই আমাদের দিয়ে সারাদিন কাজ করিয়ে নিত। প্রথম যুগের শান্তিনিকেতনে ফুটবল খেলার খুব নাম ছিল। দৈনিক কর্মসূচীতে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে কাঠের কাজ, তাঁত বোনা, বই বাঁধাই চলত। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গাছপালা ও উদ্ভিদ জগৎ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হোত। শিক্ষার্থীদের সংগ্রহ দিয়ে তৈরি হোত স্কুলের সংগ্রহশালা। বড় ছেলেরা গ্রামে গিয়ে চাষি, কুমোর, কামার, তাঁতিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করত। ছিল দরিদ্রসেবা। ভুবনডাঙা গ্রামের গরিবদের শিক্ষা ও প্রাথমিক চিকিৎসার কাজ এই ছেলেরাই করত। প্রথম পর্বে আশ্রমের বাড়ি, ঘর, রাস্তা মেরামতের কাজে ছেলেরা হাত লাগাত। তারা গাছ লাগাত, বাগানও করত।
মেয়েদের শিক্ষার কাজ চলছিল ১৯০৮ থেকে। ১৯২২—এ বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা। তখনি নারী বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বসবাসের স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। শিক্ষা, অনুশীলন, লেখায় উৎসাহ দেবার জন্য মাঝে মাঝে সাহিত্যসভা, সব তাতেই ছেলে ও মেয়েরা একসঙ্গে।
১৯৩৬—এ যখন ওখানে গেলাম, তখন তো কর্মপ্রবাহের জোয়ার চলেছে। আমরা শিশুবিভাগেই তাঁত বুনতে শিখেছি। চামড়ার কাজ শিখেছি, একটি ঝুলন্ত কঙ্কালের সামনে বসে হাড়গোড়ের রহস্য শিখেছি, বৃষ্টি হলে বৃষ্টি মেপেছি। আবার গৌরপ্রাঙ্গণে বালি ভিজিয়ে রিলিফ ম্যাপ তৈরি করে ভারতের ভূ—গঠন—এর প্রকৃত রূপ শিখেছি।
প্রকৃতিপাঠ তো এমনভাবে শিখেছি, যে গাছপালা, কীটপতঙ্গ তো বটেই, সাপের বিষয়েও ভয় ছিল না। গাছ থেকে গুটি পোকা জোগাড় করে পাতা খেতে দিতাম। একদিন গুটি পোকাটি নিশ্চল হয়ে ঝুলত। অর্থাৎ ”পুত্তল” বা “Pupa” হোত। সময় হলে খোলসটি ছেড়ে বেরিয়ে আসত প্রজাপতি বা মথ।
৮
শান্তিনিকেতন—রবীন্দ্রনাথের কালে এবং আজ
এই প্রসঙ্গটি কোনো একজন আলোচনা করলে প্রসঙ্গটির প্রতি সুবিচার হবে না। বিশেষত এই সময়ে। কোনো সময়েই কি হবে? আমার নিজের ঘোর সন্দেহ আছে। আমি একজন প্রাক্তন ছাত্রী, যে শান্তিনিকেতনে খুব বেশি যায়নি।
আমার মা একসময়ে শঙ্খ চৌধুরীর (ছোটমামার) মাটির বাড়িতে গিয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাঝে মাঝে থাকতেন। সে সময়ে মা—র কাছে গেছি দু—বার ছোট নবারুণকে নিয়ে। তারপর পৌষ মেলার ৫০তম (?) বা শততম বর্ষে গেছি। আরো ২/৪ বার হতে পারে। আমার জীবনে তখন অন্যরকম, ব্যস্ত সময়। প্রাক্তন দিনের সুন্দর স্মৃতি যতো, আজও মনে আছে। এ বই লেখার সময়ে বিশেষ উপকৃত হয়েছি ননীগোপাল সিকদার লিখিত ”শান্তিনিকেতন : সেকাল—মধ্যকাল—একাল”, এবং আমার সহপাঠিনী ৺মীরা রায় চৌধুরীর লেখা ”সব হতে আপন” এই বই দুখানি পড়ে। মীরাদির বইতে আমাদের বাঁদুরে আচরণের বেশ কিছু উল্লেখ আছে।
জীবন বড় ছলনা করে। ১৯৮৩ থেকে বারবার গেছি পুরুলিয়াতে। মীরাদি টাউনেই থাকত। ও যখন ওর বইটা পাঠাল, পেলাম মৃত্যুর পরে।
তারপরে বলি। বিশ্বভারতীর অবনমন নিয়ে লিখেছেন অনেকে। কেউ কেউ প্রতিবাদও করেছেন, ননী গোপালের বইয়ে দেখছি। জনৈক উপাচার্যের বিষয়ে সবাই জেনেছি। তিনি কারাগারেও ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি পড়ে অনেকটা জেনেছি। মনে হয়েছে এই যে দ্রুত বদলে গেল সব, এ ক্ষয় অনেক আগে শুরু হয়েছিল।
যে বিষয়ে যেটুকু জানতে হোল, সেটুকুই সংক্ষেপে বলতে পারি।
১৫/১২/১৯৮৯, বেলপুরের ১৫টি মৌজা নিয়ে শ্রীনিকেতন—শান্তিনিকেতন উন্নয়ন সংস্থা তৈরি হয়। বোলপুর পুরসভা এর বিরোধিতা করে। বিশ্বভারতীও এ সংস্থার বিরোধিতা করেছে।
বলা দরকার, রবীন্দ্রনাথ নিজেই বিশ্বভারতীর ভবিষ্যৎ বিষয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী শেষবার যখন শান্তিনিকেতন যান, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এক লিখিত পত্র দিয়ে জানান, গান্ধীজি যেন অবশ্যই তাঁর সৃষ্ট বিশ্বভারতীকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন।
এর পরিণামেই ১৯৫১ সালে পার্লামেন্টে বিশ্বভারতী অ্যাক্ট পাশ হয়। তারও পরে নেহরুর উদ্যোগে বিশ্বভারতী হয় অন্যতম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে বিশ্বভারতীর অর্থচিন্তা দূর হয়। কিন্তু এই নতুন সংস্থা কোনো জনমুখী উন্নয়নের কথা ভাবল না।
প্রান্তিক—এ নতুন আবাসন প্রকল্প এঁরাই তৈরি করছেন একটি স্যাটেলাইট শহর। সাঁওতালসহ তপশীলভুক্ত অন্যান্য জাতির শালিসুনা জমি ৮৫০ কাঠায় কেনে এই সংস্থা, ডাঙা জমি কেনা হয় ৫০০০ কাঠায়। এই উন্নয়নী সংস্থা এই সব জমি ১৩ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা কাঠায় বিক্রি করেছে ও করছে। গন্ধটি খুবই সন্দেহজনক।
২৫/১১/৯৩, শান্তিনিকেতন—শ্রীনিকেতন উন্নয়নের নামে সাঁওতাল উচ্ছেদের প্রতিবাদে কয়েক হাজার সাঁওতাল। বক্তাদের মধ্যে দুজন আদিবাসী নন। অন্যেরা প্রত্যেকেই সাঁওতাল।
আমি ২০০৩ বইমেলার সময়ে জানতে পারি তালতোড় নামক ছোট্ট গ্রামটির (সেখানে এক প্রাচীন মন্দির ছিল) সংলগ্ন, ৩০০ বছরের পুরাতন লাহাবাঁধ নামক জলাশয়টি থেকে উক্ত প্রখ্যাত সংস্থা সম্পূর্ণ জল তুলে ফেলেছেন। সরকারের নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর কর্তৃত্বাধীন বিভাগ, উক্ত সংস্থাকে ওই কাজ করতে দিয়েছেন এক প্রমোদ রিসর্ট, (সম্ভবত পানশালা) ইত্যাদির জন্য।
আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে বিপুল সাড়া পাই। বাধা আসছে। আমরা সংবিধান অনুমোদিত পথে শেষ অবধি লড়ব।
বুঝে নিন, শান্তিনিকেতন কেমন আছে।
৯
দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া
আমার লেখা এবং রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয়ের প্রভাব নিয়ে কি বলি? আজ মোহনার দিকে চলছি, অথবা পশ্চিম সীমান্তে অস্ত যাবার পথে, সে তো অনস্বীকার্য। আমাদের চেনা সময়ে মহিলারা বলতেন, ঝিঙে ফুল ফোটার সময় হোল। ঝিঙের ফুল ফোটে শেষ বিকেলে। তাই জবাবদিহি করার সময় এসেছে।
রবীন্দ্র সাহিত্য বহু বছর ধরে অনেক পড়েছি। সে বলা চলে অনে—ক দিন! কলেজে পড়তে গেলাম যখন, লাইব্রেরিতে সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় (মোহরের বাবা, সহকারী গ্রন্থাগারিক) একদিন বললেন, ”শান্তিনিকেতন বইগুলো পড়িসনি কেন?” রবীন্দ্রনাথ মন্দিরে উপাসনায় যে ভাষণ দিতেন, তা তখন খণ্ডে খণ্ডে বেরোত। এখন দুই খণ্ডে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ কিনতে গেলে বিশ্বভারতী প্রকাশিত বই সবচেয়ে ভালো।
সত্যদা বললেন, পড়ে ফেলবি।
তখন শান্তিনিকেতন শান্তিনিকেতনেই আছে। রাস্তায় গাড়ি দৌড়চ্ছে না, পর্যটকরা উঁকি মেরে গাছের নিচে ক্লাস চলার দৃশ্য দেখছে না।
ছাতিমতলায় নিরালায় বসে মনোযোগে ”শান্তিনিকেতন” পড়লাম কদিন ধরে। পড়েছি, তাঁর সাহিত্য পড়ে এক সময়ে বড় হয়েছি। তারপর আরো নানা রকম বই পড়ার দিকে মন চলে গেল।
অরণ্য, গাছপালা, আরণ্যপ্রাণী, এ সবের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার মূলে শৈশবের শান্তিনিকেতন। আর শত বাধার মধ্যেও কাজ করে চলার যে শিক্ষা, তার মূলেও শান্তিনিকেতন। আজকাল ”রবীন্দ্রনাথ” বলতেই মনে পড়ে সেই উজ্জ্বল মানুষটি বসে আছেন নিশ্চল। তিনি দুপুরের রোদের তাতে নিমগ্ন। প্রকৃতি আর তিনি দুইয়ের মধ্যে নিরন্তর চলত সংবাহন। তিনি দুপুর বিষয়ে লিখেছিলেন, ”যেন রৌদ্রময়ী রাত্রি।” কথাটি এখন কতবার মনে হয়।
আমি মনে করি, অরণ্য, আদিবাসী, গ্রামীণ মানুষ এঁদের বিষয়ে আমার লেখায় যা পাওয়া যায় (যদি যায়) তার মূলেও তিনি। আমার মধ্যে উলটোপালটা অনেক।
তবু তার মধ্যেও শৈশবশিক্ষার কিছু আছে। সে সময়ে শান্তিনিকেতনে না থাকলে, মূক মানুষের না—বলা কথা শোনার কাজ তৈরি হোত না। কাজটা যতই কঠিন, হোক, সেটা করতে চেষ্টা করার মন তৈরি হোত না। আমি যেমন মানুষ, তেমন হয়ে তৈরিই হতাম না। জীবনে দুঃখ দিয়েছি অনেককে। পেয়েছিও অনেক। তবু যে সকর্মক আছি, থাকি, বেঁচে আছি, অন্যেরাও বাঁচুক, সে চেষ্টা মাত্র করি, সব কিছুর মূলেই সেই প্রাচীন বনস্পতি। একমাত্র মহীরুহ, বিশাল মাপের মানুষ যাঁকে আমি কাছ থেকে দেখেছিলাম বড়ো হয়ে ওঠার সময়।
মনে হয়, ও রকম বড় মাপের মানুষ, যিনি শোকে—দুঃখে অবিচল, যাঁর মন শতত ক্রিয়া ও সৃষ্টিশীল, ৫০ বছর পূরবার আগেই যিনি স্ত্রী, একপুত্র, দুই মেয়েকে হারান, তারপরেও নিজেকে নিঃস্ব করে শান্তিনিকেতন গড়েন,—এমন মানুষ আজও কোথাও না কোথাও আছেন। তাঁরা থাকেন। হয়তো লেখেন না, আঁকেন না, এসব কাজ করেন না। তবু থেকে যান। পাহাড়ের মতো, সমুদ্রের মতো, সতত ক্ষমাপ্রার্থী ভিখারির মতো।
এই চিরকালীনতা নিয়ে নিশ্চয় আরো মানুষ জন্মান, বেঁচে থাকেন, নইলে মানুষ রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যা কি? আমি তাই দরজায় দাঁড়িয়েই থাকি। যতটা পারি, দেখে যাই।
যাঁদের দেখেছি
.
২০০৬ সালের জানুয়ারিতে আশি পুরে একাশিতে পড়ব। বহুকাল লেখালেখিই মূলকাজ হয়ে থেকেছে। অবশ্য ৭০—এর দশকে কাজ করতে করতে বিশাল এক জনসমাজের মধ্যে পৌঁছে যাই। সে প্রসঙ্গে আজ যাব না। লেখালেখি প্রসঙ্গেই বলব আজ।
প্রথম বই বেরোয় ১৯৫৬ সালে। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের দেখার ব্যাপারটা তার অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। আজ, আজকের তরুণ লেখকদের বলতে চাই, কেমন ছিল সেই সময়, তখনকার লেখকরা একজন নতুন লেখককে কি ভাবে গ্রহণ করেছিলেন, এই সব কথা। যাঁদের জেনেছি, তাঁদেরই কথাই বলব। আজকের তরুণ লেখকরা হয়তো তাঁদের ”সমসময়ের কাছে প্রাপ্ত” নিজ নিজ অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করতে পারবেন।
বলেছি, ”প্রতিষ্ঠিত লেখকদের চোখে দেখার ব্যাপারটা অনেক আগেই শুরু হয়েছিল,” —সত্যিই তাই। আমার বাবা এক সময়ে ”কল্লোল” কাগজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই এক সময়ের লেখক বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় এমন লেখকরা। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সকলের পবিত্রদা। এঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় তখন আমার হবার কথা নয়। তা হয়নি। তবে বইপড়ার ব্যাপারে কোন বিধিনিষেধ ছিল না বলে যে বই পেতাম, তাই গোগ্রাসে গিলতাম। ম্যাকসিম গর্কির ”মা” নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের অনুবাদেই পড়েছি ছোটবেলায়, পড়েছি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুবাদে মেটারলিংকের ”নীলপাখি”। শেষোক্ত বইয়ে দুটি শিশুর নাম ছিল তিলতিল ও মিতিল। শুনেছি সেই জন্য বাবা আমাদের দুই বোনের নাম দেন তুতুল ও মিতুল।
যখন আই.এ.পড়ছি ১৯৪৩—৪৪ সালে সে সময় আমরা বসন্ত রায় রোডে আছি। বাবা সরকারী কাজ করেন। বদলিও হন। সে সময় আমরা কলকাতায়। বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসু অনেক এসেছেন সে বাড়িতে। এসেছেন বিষ্ণু দে ও প্রণতি দে। সে সময়েই কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, তাঁর স্ত্রী রেখা, বিষ্ণু দে, সবাই মিলে ইংরেজিতে অভিনয় করেন ”রেজারেকশান” নাটক। নামে পরিচিত সবাই। ওঁদের সঙ্গে অনেক কথা বলার সুযোগ পাইনি। নিজে লেখক হব, এমন কথা তো জানতাম না। এসব কথা ১৯৪৩—৪৪—এর সময় কালের। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আবার বাংলার মহামন্বন্তরও ১৯৪৩ সালের ঘটনা।
মন্বন্তরের পটভূমিতেই বিজন লেখেন ”নবান্ন”, তারও আগে লেখেন ”জবানবন্দী”। সে ছিল আদি ও এক কম্যুনিস্ট পার্টির দিন। আমরা কম্যুনিস্ট পার্টির ”গার্ল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশান”—এর ছাত্রীরা ছিলাম ১৩৫০—এর মন্বন্তরের ত্রাণ কর্মী। আমি কেমন করে ক্রমে ক্রমে আজকের আমি হলাম, তার পিছনে সময়ের অবদান অনেক।
১৯৩৬—৩৮, পড়েছি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জীবিত কালে। সেদিনের শান্তিনিকেতন সাধ্যমতো মানুষ গড়তে চেষ্টা করত। সম্ভবত ১৯৩৭ সালে বা ১৯৩৮—এ, রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যান তখনকার প্রথিতযশা বাঙালী লেখকরা। তাঁরা পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হন নি বলেই মনে পড়ে। ছুটিতে বাড়ি ফিরে সকিপিং রোপ নিয়ে লাফাতাম আর বলতাম, জলধর সেন এসেছিলেন, দীনেন্দ্রকুমার রায়! কুমুদরঞ্জন মল্লিক!
যাঁদের লেখা পড়েছি, তাঁরা যে গিয়েছিলেন, তাতেই আমার বেজায় আনন্দ। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ডিটেকটিভ উপন্যাস তখন খুব চলত। তবু সাহিত্যপিপাসু তরুণদের বলব, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা ”পল্লীচিত্র”; ”পল্লীচরিত্র”; ”পল্লীবৈচিত্র্য”; এই তিনটি বই পড়ে নিলে লাভবান হবেন।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি এমন কাছ থেকে। সেটা যে কতবড় সৌভাগ্য সে তখন বুঝি নি, আজ বুঝি, সর্বদা মনে করি।
আজকের লেখকরা দেশ ও কালের প্রচণ্ড চলমানতার মধ্যে থাকার তেমন সুযোগ পান নি, যা আমরা পেয়েছি। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ; স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার, যাতে ফ্যাসিজম বিরোধী বড় বড় লেখকরা গিয়েছিলেন। হেমিংওয়ের নাম কে ভুলবে?
দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে ১৯৪৩—এর ও বাংলা ১৩৫০—এর মহামন্বন্তর। কম্যুনিস্ট পার্টি, কংগ্রেসসহ সব রাজনীতিক দলের স্বেচ্ছাসেবী দল পথে নেমেছিল।
১৯৪২ সনে মহাত্মা গান্ধীসহ দেশনেতারা গ্রেপ্তার হন ৯.৮.১৯৪২। সমগ্র ভারতে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হয়। শুরু হয়ে যায় আগস্ট আন্দোলন। এত কিছু ঘটনার সমসাময়িক হবার কোনো অভিঘাত তো থাকবে।
আজকের তরুণ লেখক প্রজন্মকে আমরা কি বা দেখাতে পেরেছি, তাই ভাবি নিরন্তর।
সময় তাদের প্রতি বড়ই মমতাশূন্য, হিংস্র।
.
প্রথম বই বেরোল ”ঝাঁসীর রানী”। নবারুণ সে পর্বে খুবই ছোট। বই লেখার জন্য যে খাটাখাটনি করব, তাতে বিজন খুব খুব সাহায্য করেন। চলে যেতাম ন্যাশনাল লাইব্রেরি। সন্ধ্যায় যেতাম মরাঠা ইতিহাসে বিশেষজ্ঞ ডঃ প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের বাড়ি। বইয়ের বহির্রেখা ছকে নিয়েছিলাম, লিখতাম।
বোধহয় ৩০০/৪০০ পাতা লিখেছি, মনে হোল কিছুই হচ্ছে না। সে সময়েই ডঃ গুপ্ত জানালেন, এবার ইতিহাস কংগ্রেস হবে আমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে আসবেন রানীর আপন ভাইপো গোবিন্দ চিন্তামণি তাম্বে। বলা দরকার, মহারাষ্ট্র, বোধ হয় কর্ণাটক আর দাক্ষিণাত্যে অন্যত্রও, কি পুরুষ, কি মেয়ে, স্বনামের পর পিতার নাম লেখাই রীতি। মেয়েটির বিয়ে হলে স্বনামের পর স্বামীর নাম লেখাই প্রথা। এখন তেমনটা হয়তো চলে না, জানি না।
তখনকার সময় কেমন ছিল, তা তরুণ লেখকরা জানুন। তাঁদেরই তো জানাতে চাই। আমি ”ঝাঁসী” বিষয়ে কিছুই জানি না। অথচ এমন বই লিখতে চাই। বিজন তার চেনাজানা অনেককে বললেন। আর সেদিনের কম্যুনিস্ট পার্টির কতজন না এলেন। শুনছি, ডঃ মহাদেব প্রসাদ সাহা ঝাঁসীর মানুষজনকে জানেন, যোগাযোগ করিয়ে দেবেন।
কষ্ট এবং চেষ্টা করে চারশো টাকা ধারও নিলাম, সাহায্যও নিলাম। শুনছি শীতের জায়গা, গরম জামাও উক্ত উপায়েই জোগাড় হোল। বিজন বললেন, নিশ্চিন্ত মনে চলে যাও। বাপ্পাকে আমি দেখব। তাই হয়েছিল। মহাদেব প্রসাদ সাহা যাঁদের লিখে দেন, সবাই সাহায্য করেছিলেন প্রাণপণে। ঝাঁসীতে এক মহারাষ্ট্রীয় সেনাবিভাগীয় অফিসার ও তাঁর স্ত্রী খুবই সহায়তা করেন।
একটা বই লিখব, সে জন্য এত সাহায্য পেলাম।
লেখাটি বেরোয় ”দেশ” কাগজে। এই যে ”দেশ”—এর মতো প্রতিষ্ঠিত কাগজ এক নতুন লেখকের লেখা ছাপল, তার পিছনেও সময়, পরিবার, সব কিছুরই অবদান ছিল। এ সব কথা আগে কোথাও লিখিনি। কিন্তু এখন সব কথাই বলে যেতে হবে। লিখতে লিখতে ভাবছি, পরিবারে নতুনতম অতিথি কি বড় হয়ে এ লেখা পড়বে? তার সময়ে সময়টা কেমন হবে জানি না।
”দেশ” কাগজে লেখাটি বেরোয়। সাগরময় ঘোষ একসময় বিজনের সহকর্মী ছিলেন আনন্দবাজার কাগজে। যখন বিজনের মামা প্রখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ওই কাগজের সম্পাদক। আমার লেখা বেরোবার সময়ে সাগরদা আমাদের পদ্মপুকুর রোডের বাড়িতে কয়েকবার এসেছেন। বিজনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ, বিখ্যাত বিনয় ঘোষ। গল্প ও উপন্যাস লেখক প্রভাত দেব সরকার; গল্পলেখক স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, এঁরা সবাই। আসতেন সরোজ দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, এমন অনেক জন। ”ঝাঁসীর রানী” বেরোয় ১৯৫৬ সালে। তার ১/২ বছরের মধ্যে প্রমথনাথ বিশী ও গজেন্দ্রকুমার মিত্র ওই একই পটভূমিতে লেখেন উপন্যাস ও গল্প। ওঁরা অনেক প্রতিষ্ঠিত, নামী লেখক। খুবই স্নেহ করেছেন। প্রমথনাথ বিশী সব সময়ে বলতেন, ”আপনি তো সবচেয়ে আকর্ষক চরিত্র নিয়েই লিখে ফেললেন।” এর পর ওই পটভূমিতেই লিখি ”নটী”। সে সময়ে হুমায়ুন কবীর সম্পাদনা করছেন ত্রৈমাসিক ”চতুরঙ্গ”। ”নটী” সেখানেই বেরোয়।
”কোথায় লিখব?”—কোনো সমস্যা ছিল না। ”দেশ” কাগজে আর লেখা বেরোয় নি নিশ্চয়। কিন্তু লিখেছিও, ছাপাও হয়েছে। অনেক পরে আকাশবাণীর ”বেতার জগৎ” কাগজে ধারাবাহিক বেরোয় ”অরণ্যের অধিকার”। পাঠক যাঁর লেখা পড়ছেন, তেমন লেখক যে কোন কাগজেই লিখতে পারতেন। ”এঁদের লেখাও ছাপা হোক। এঁদের বইও বেরোক।” এমন বক্তব্য নিয়ে ১৯৮০—র দশকে আমি সে সময়ের তরুণ লেখক অভিজিৎ সেন, অমর মিত্র, সাধন চট্রোপাধ্যায়, কিন্নর রায়, এঁদের কথা বারবার বলেছি, দোরে দোরে ঘুরেছি।
আজকের তরুণ, প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন লেখকরা কতটা সুযোগ পান, তা নিয়ে ভাবি, আর ভাবি।
জীবনভোর লেখালেখিই করেছি, তাই বলি। আমার লেখালেখির সময়ে সাহিত্যসমাজে একটা অন্য পরিবেশ ছিল। একজন লেখক লেখার জায়গা পেতেন। তাঁরও পাঠক তৈরি হোত। তাঁর লেখা নিয়েও কিছু আলোচনা হোত। পাঠকদের পড়ার ক্ষুধা ছিল। সবাই কিছু অনুকম্পায়ী, বা সাহিত্যরুচিতে তীক্ষ্ন ছিলেন না সবসময়ে। আজ, খুবই বলা হয়, বাংলা বই কে পড়ে, অথবা বই পড়া কমে যাচ্ছে, ইত্যাদি। তবু বলব, পত্রপত্রিকা, দৈনিক কাগজের রবিবারের পাতা, এঁদেরও দায়িত্ব আছে। তাঁরা পাঠক তৈরি করতে পারেন। আর প্রতিষ্ঠিত লেখকরা? আজ তাঁরা কতজন সাহিত্যিক হতে ইচ্ছুক নতুন লেখকদের লেখা পড়েন, দু’লাইন লেখেন লেখককে, ইত্যাদি ইত্যাদি তা জানি না।
এখন তখনকার প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সম্পর্কে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতির মধ্যে ফিরে যাই।
রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় ছিলেন, আছেন ও থাকবেন সবার উপরে। এটুকুই বলব, সেদিন জানা ছিল না আমি কোনদিন লিখব। কিন্তু শান্তিনিকেতনে পাঠভবনে, অর্থাৎ স্কুলে পড়ার সময়ে, এবং পরে ৪৫—৪৬ সালে বি.এ.পড়ার সময়ে ছাত্রছাত্রীদের বাংলায় মৌলিক লেখায় উৎসাহদানের ব্যবস্থা ছিল।
পাঠভবনে বছরে কয়েকবার সাহিত্যসভা হোত। কখনো তা শিশুবিভাগের, অর্থাৎ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর, কখনো তা মধ্যবিভাগের,—সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর, শেষে তা উচ্চ বিভাগের, নবম ও দশম শ্রেণীর।
শিক্ষাভবন বা কলেজে এটি ছিল সাহিত্যিকা। কি পাঠভবনে, কি সাহিত্যিকায়,—এর সম্পাদক হবো আমরা, লেখা সংগ্রহ ও নির্বাচন করব আমরা, মঞ্চসজ্জা আমাদের, সভাপতি নির্বাচনও আমাদের। শিশুবিভাগে একবার আমরা সরলা দেবী চৌধুরাণীকে পেয়েছিলাম।
পড়াশোনায় ভালই ছিলাম বলে শুনতাম। তাই ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ একবার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাংলা ক্লাস নিতে চাইলেন। আমরা, সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা নির্বাচিত হই। সে কি গর্ব আমাদের।
উনি ক্লাস নিলেন। পাঠ্য অংশ খুব গভীর মনোযোগে পড়ার ওপর খুব জোর দিয়েছিলেন। এসব কথা মীরা রায়চৌধুরী (দাশগুপ্তা), যিনি ১৯৩৬—এ আমার সহপাঠিনী ছিলেন, তিনি তাঁর ”সব হতে আপন” বইয়ে লিখেছেন।
প্রথমেই মনে পড়ে বুদ্ধদেব বসুর কথা। তাঁর বাড়িকে ”কবিতাভবন”—ই বলতাম। বুদ্ধদেব বসুর কথাবার্তা ছিল খুব নরম, খুব স্নেহমাখা। গেলেই বসতে বলবেন, কি লিখছি, কি পড়ছি, জিজ্ঞাসা করবেন,—ভারি নরম, ভদ্র, স্নেহশীল মানুষ।
একটা সময়ে আমেরিকা চলে যান। আজও ভুলতে পারি না, ডাকে এসে পৌঁছল দুটি পেপারব্যাক বই। ছিপছিপে বই। দুটিই ছোটগল্পের সংকলন,—তলস্তয় ও আন্তন চেকভের। সঙ্গে ছোট চিঠি। চিঠিটি সামনে নেই, সঠিক শব্দ মনে নেই। যা লিখেছিলেন তার মর্মার্থ, আমেরিকাতেই কোনো জায়গা থেকে অন্য কোনো জায়গায় যাবার পথে কোনো স্টেশনে নেমেছিলেন। প্লাটফর্মে এক বইয়ের দোকানে বই দুটি কেনেন। ”কল্যাণীয়া মহাশ্বেতাকে বু. ব.” লিখেছিলেন বলে মনে পড়ছে।
আজও মনে হয়, আমি তাঁর বন্ধুকন্যা মাত্র। কি সৌভাগ্য যে আমার কথাই মনে হয়েছিল?
এমন আশ্চর্য প্রাপ্তি অনেক। স্মৃতিই কি এক রকম? সত্তরের দশকে অকসফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস—এর জন্য আমি ”আনন্দপাঠ” নাম দিয়ে রীডার এবং ওয়ার্কবুক গ্রন্থমালা লিখি। পাঠ্য বই ও অনুশীলনী নিয়ে সে অনেক বই। নানা বড় বড় লেখকের নানা বই থেকে লেখা সংকলন করা হয়। বুদ্ধদেব বসুর একটি লেখাও নিই। আমরা সেই সময় বানানের সমতা রক্ষার জন্য ”চলন্তিকা”—র বানান অনুসরণ করি। উনি বললেন, যে বানান লিখেছেন তাই রাখতে হবে। খুব কাতর মিনতিতেই বলেছিলাম, পাঠ্যবই লিখছি, তাই আমাকেও এমনটা করতে হচ্ছে। বুদ্ধদেব বসুর মতো স্নেহশীল নরম মানুষ আমি কম দেখেছি।
প্রেমেন্দ্র মিত্র একেবারে অন্যরকম। বয়ঃসন্ধি কালের এক কিশোরকে নিয়ে লেখা ”উপনয়ন” কেউ পড়েছেন তো বুঝবেন কি আশ্চর্য কলমই না ছিল ওঁর। ”মিছিল” পড়েই কি কম মুগ্ধ ছিলাম খুব অল্প বয়স থেকে। খুব, খুব স্নেহপ্রবণ, আবার ছেলেমানুষ। খামখেয়ালীও ছিলেন। শান্তিনিকেতনে বি.এ. পড়তে গেছি বড় হয়ে। ১৯৪৫ সালের কথা। একতমা কন্যা মাধবী। বড়ছেলে মৃণ্ময়, দুজনকে শান্তিনিকেতনে স্কুলে (পাঠভবনে) ভর্তি করলেন। যা দেখে খুব মধুর লাগত। ওঁর ছেলেমেয়ে ওঁকে খুব মান্য করত। ওঁর স্ত্রীকে কাকিমা বলেছি। তবে কাকিমাকে দেখেছি অনেক পরে। যা হোক, উনি এসেছেন, ডেকে পাঠালেন। দৌড়েই গেলাম। আমাদের হস্টেল ”শ্রীভবন”—এর সামনে খেলার মাঠ। শিরীষ গাছের নিচে সিমেন্টের বেঞ্চে উনি বসে আছেন ছেলেমেয়েকে নিয়ে। দুটো শিরীষ গাছ ছিল। আমরা নাম দিয়েছিলাম বুদ্ধু আর ভুতুম।
তখন তো খুব মান্য করি। প্রেমেন্দ্র মিত্র আর বুদ্ধদেব বসু সর্বদা বলতেন, দেখ! মনীশ অনেক আগে বিয়ে করে। আমরা বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি অনেক পরে। তুমি হচ্ছ প্রথম শিশু, যাকে আমরা শৈশবে কোলে নিয়েছি।
সেই মানুষ এসে বসে আছেন। আমি তো হতবাক। তারপর উনি বললেন, এদের তো ভর্তি করলাম। তা তুমি এখানেই আছ এখন। তোমাকেই ওদের লোকাল গার্জেন হতে হবে।
আমি ”হ্যাঁ” বলে বসে থাকলাম। ওরা কি ওখানেই পড়েছিল? আমি যথেষ্ট দুরন্ত ও ডাকাবুকো ছিলাম। আমিই বা কেমন লোকাল গার্জেন ছিলাম? এ—সব কথা মোটে মনে নেই।
প্রেমেন বাবুর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটের বাড়িতে কত যে যেতাম। ওঁর মেয়ের বিয়েতে গিয়ে দেখি, উনি বোধহয় প্রথম ব্যাচেই খেয়ে দেয়ে নিয়েছেন। আমাকে দেখেই বললেন, আচ্ছা। ওরা চিংড়ি মাছ না ক’রে ভেটকি করল কেন?—অর্থাৎ এ মাছ কেন করল?
আমার বেজায় হাসি পেয়েছিল। বুঝতেই পারলাম সব ব্যবস্থাই কাকিমাকে করতে হয়েছে।
সব সময়েই তাই হোত। দোতলায় কাকিমার রান্নাঘরটি তত বড় ছিল না। একবার সেই ঘর ভেঙে বড়সড় ঘর বানাচ্ছেন। বললাম, কাকিমা, এবার আপনার সুবিধে হবে।
কাকিমা বললেন, তোমার কাকাবাবু তো!
কাকিমা ”ঘনাদা”কে ঠিকই চিনেছিলেন, মাঝখানে বেশ কিছুদিন যাইনি। গিয়ে যা দেখলাম তা বেজায় মৌলিক ব্যাপার। ঘর হয়েছে। বেশ বড় ঘরই হয়েছে। তাতে রোদ হাওয়াও অনেক।
সে ঘরটি মুরগির ঘর।
কাকিমার রান্নাঘর চুনকামের পর ফরসা হয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
আমাকে দেখেই ব্যাখ্যা করলেন, মুরগি রাখা মানে কত সাশ্রয়, কত আশ্রয়। কাকিমাকে বললেন, ওকে ডিম ভেজে দাও।
আরেকবার দেখালেন, বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু বই এসেছে, যেমন আকাশের
(না কি মহাকাশের) মানচিত্র। তথ্য পরিসংখ্যানের বই বিষয়ে আমার খুব আগ্রহ। ওঁর আগ্রহ আর কৌতূহল ছিল শিশুদের মতো। বললেন, বাংলাদেশ থেকে এমন কত বই যে বেরোয়!
যখন কথা হচ্ছে, তার অনে—ক বছর বাদে বাংলাদেশে প্রথম যাই। বাংলাদেশের বইয়ের সম্ভার যেমন বিচিত্র ও দামী (গুণগত উৎকর্ষে ”দামী”) সে একটা অসামান্য ব্যাপার। বাংলায় বিচিত্র জ্ঞানসমৃদ্ধ, তথ্যপূর্ণ, বই প্রকাশনা দেখলে মন গর্বে ভরে ওঠে।
আমি কি লিখছি, নতুন কি বই বেরোচ্ছে, এ সব কত না জিজ্ঞেস করতেন। ওঁর স্বভাবে তো একটা কৌতূহলী বালক বেজায় জ্যান্ত ছিল। ২—৩টে ঘটনা মনে পড়ছে। লীলাদি (লীলা মজুমদার) যে সময়ে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের সঙ্গে খুব যুক্ত। কোনো একটা মিটিঙে নিয়ে যাবেন। আমি আছি। প্রেমেন বাবুকে পথ থেকে তুলে নেওয়া হবে। ওঁর বাড়ি তো ট্রাম—বাস রাস্তার ওপরে নয়। কথা ছিল, উনি কোনো এক বিশেষ ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে থাকবেন। এবং উনি সেখানে ছিলেন না। দু’স্টপ পিছিয়ে অন্য স্টপে অপেক্ষা করছিলেন!
এমনই আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা ব’লে ওঁর প্রসঙ্গে ইতি টানব। সব কথা বলে ওঠা কি সম্ভব?
যা হোক, কলেজ স্ট্রীটে সম্ভবত ”মিত্র ও ঘোষ” আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠান থেকে বেরোচ্ছি। উদ্যোক্তাদের কেউ এগিয়ে এসে বললেন, (প্রেমেন্দ্র মিত্রর জন্য গাড়ির ব্যবস্থা ছিল)—”মহাশ্বেতাদিও তো ও দিকেই যাবেন, আপনারা একসঙ্গেই…”
প্রেমেন্দ্র মিত্র ট্রামে চড়েন, ছবি পরিচালনা করার সময়ও টালিগঞ্জের ট্রামে চেপেই যেতেন, এমনই শুনেছি। তা উনি বললেন, না না, আমরা দিব্যি ট্রামে চেপে চলে যাব।—তা ট্রামে বসে বললেন, এসপ্লানেডে নেমে ঝাল চানাচুর (অথবা ওই জাতীয় কিছু) খাব। তারপর সাউথের ট্রাম ধরব, বুঝলে?”
তাই হোল। সে ভাবেই গেলাম। ট্রাম আমাদের বড়ই প্রিয় বাহন ছিল। তখনকার কলকাতা, ট্রাম, সবই ছিল বড়ই প্রিয়। প্রেমেন্দ্র মিত্র খুব খুশি হন আমি বই লিখি ব’লে। কিন্তু জীবন তো অত সময় দেয় না! কলকাতা আজও প্রিয়তম শহর, তবে ট্রামে আর চড়ি না।
ওঁর ছেলেদের অনুরোধে একবার গেলাম ওঁর বাড়ির পাড়াতেই। আর এ লেখা লিখতে লিখতেই মৃণাল সেনের সঙ্গে কথা হোল। মৃণাল বললেন, ‘খণ্ডহর ছবি করার জন্য গল্প খুঁজতে খুঁজতে কি ভাবে ”তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্প আবারও পড়েন। আর ছবির বিষয়বস্তু আবিষ্কারই করেন?”—আমার লিখতে আসা, আর প্রতিষ্ঠিত বড় লেখকদের দিক থেকে কোনো নবাগতকে গ্রহণ করার পর্বের কথা লিখছি তরুণ লেখকদের কথাই মনে রেখে। তাঁরা কেমন ভাবে গৃহীত হচ্ছেন পূর্বসূরীদের কাছে? এই সময়টাই খুব, খুব হিংস্র। কোনো লেখাপাগল তরুণকে জায়গা করে দেয় না। পড়ে না, পড়ে মন্তব্য করে না, লিখে জানায় না। কিন্তু বিংশ শতক এমন ছিল না।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত সেই কবে থেকেই প্রতিষ্ঠিত লেখক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ”যতনবিবি” ও অন্যান্য গল্পগুলি কে ভুলবে। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন তাঁর ”পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ” (মিত্র ও ঘোষ সংস্করণ; প্রথম সংস্করণ সিগনেট প্রেস) ঝাঁকা ঝাঁকা বিক্রি হচ্ছে। দপ্তরীর কাছ থেকে বই বাঁধাই হয়ে কুলীর মাথায় ঝাঁকা চাপিয়ে আসছে তো আসছেই। ঠিক এই ভাবেই, আরো বেশি সংখ্যায় বিক্রি হতে দেখেছি অবধূতের ”মরুতীর্থ হিংলাজ”। বাংলা বইয়ের সে এক দিন ছিল। বছর বছর দেখা যেত বিয়েতে, পূজাতে, জন্মদিনে, উপনয়নে বাংলা বই উপহার আসছে। অচিন্ত্যকুমার ও অবধূতের নাম করলাম। আরো অনেক ”বেস্ট সেলিং” লেখক ছিলেন। আজও আছেন। তবে ঘরে ঘরে বাংলা বই কেনা ও পড়ার অভ্যাস অনেক কমে যাচ্ছে মনে করি। হয়তো সে অভ্যাস কোনোদিন ফিরবে।
অচিন্ত্যবাবুর সঙ্গে প্রথম দেখা হোল ”দৈনিক বসুমতী” অফিসে, প্রাণতোষ ঘটকের ঘরে। বই লিখেছি, বেরিয়েছে, আরো লিখছি, সে সবই জানতেন। মানুষটি বেশ রাশভারি বলে মনে হোল। হতে পারি তাঁর এক কালের বন্ধুর মেয়ে,—তবে অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা, ব্যবহার ও আচরণেও খোলামেলা, মেয়েদের মধ্যে এ সব খুব পছন্দ করতেন না বলেই মনে হয়েছিল সেদিন।
কিন্তু আমাকে অবাক করেই যেতে বললেন ওঁর রজনী সেন রোডের বাড়িতে। গেলামও। উনি ওঁর ঘরে লেখার চেয়ারে বসেছিলেন। বড় দরের সরকারী হাকিম ছিলেন। ঘর তেমনই সুসজ্জিত। খুব স্নেহভরে লেখালেখির কথা জিগ্যেস করলেন। খুব অবাক করে হঠাৎ বললেন, শুনেছি তোমার ছেলেও কবিতা লেখে।—এ সব কথা মনে আছে। মানুষ হিসেবে একেকজন একেক মেজাজের। তবু নতুন লেখকদের প্রতি ওঁরা স্নেহশীল ছিলেন। সেও তো অনেক পাওয়া। বলা দরকার, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত একদা ছোটদের জন্য এক অসামান্য উপন্যাস লেখেন। ”ডাকাতের হাতে”। সে বই আমি থেকে শুরু করে আমার সব ভাইবোন, বোধহয় বাপ্পা পর্যন্ত সবাই পড়েছে। অতীব সুখপাঠ্য বই। তখন যাঁরা প্রতিষ্ঠিত লেখক, তাঁরা ছোটদের জন্যও লিখতেন।
ছোট থেকে বড়, সকলের আপনজন শিবরাম চক্রবর্তী আমাদের বাড়ি চলে আসতেন ছোট্ট নবারুণেরই আকর্ষণে। বাড়িতে দুজন বয়স্ক লোক তো ছিলাম। কিন্তু ”সচিত্র ভারত” কাগজে উনিও লেখেন, আমিও লিখি। সেখানেই আলাপ। যেই নবারুণ—এর কথা জানলেন, সেই চলে এলেন। বাপ্পা যেমন দুরন্ত ছিল, তেমনি ছিল বইপড়ুয়া। শিবরাম বাবুর সেই সিলকের শার্ট আর ধুতি পরা চেহারা, সর্বদা প্রসন্ন হাসি মুখ, সে তো ভোলা যাবে না।
মানুষ কেমন ছিলেন? একটা ছোট্ট স্মৃতিকথা বলি। তখন লিখছি ”বসুধারা” কাগজে। অফিসটি কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট আর বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিং—এ। প্রকাশক ডি.এম.লাইব্রেরির ওপরতলায়। উলটো দিকে বিখ্যাত চাচার দোকান। সেদিনের কলকাতায় চাচার দোকান একটি বিখ্যাত গন্তব্য জায়গা। উত্তর কলকাতার ঐতিহ্য বলে কথা! স্বামী বিবেকানন্দের বাড়িও কাছেই।
যাক গে! একদিন আমি আমার উপন্যাসের কিস্তির টাকা পেলাম পনেরো টাকা, উনিও পেলেন পনেরো টাকা। সে যদি ১৯৫৮—৫৯ সালের কথা হয়, সে অনেক টাকাই বটে!
তা উনি নামতে নামতে বলছেন, ক’টাকা নিয়ে ফিরতে পারব, কে জানে!
আমরা ফুটপাথে পা দিয়েছি, অমনি নেহাৎ কুচো—কুচো ৮—১০টা বাচ্চা ছেলেমেয়ে, ওঁকে জড়িয়ে ধরল। বলল, আমরা জানি, তুমি টাকা পেয়েছ। এবার চলো!
ওরা তো বটেই, উনি আমাকেও দলে টানলেন। সবাই চাচার দোকানের কাটলেট খেলাম। ওরা হইহই করে চলে গেল। ওরা খেয়ে যত খুশি, উনি খাইয়ে তত খুশি। বললেন, দেখলে তো?
তখন বুঝলাম, যত কথা ওঁর নামে শুনেছি, সব সত্যি। মুক্তারাম বাবু রো—তে ওঁর খাটে যে নতুন মশারি টাঙানো হয়, তা জীর্ণ হয়ে ফেটে যায়, তখন আরেকটা মশারি আসে। খাতায় লেখা খুব ঝামেলা, তাই যত নাম ঠিকানা লেখেন দেয়ালে। নিত্য ধোপদোরস্ত জামা ও ধুতি পরেন। এক সেট থাকে লনড্রীতে। ধপধপে ধুতি ও জামা সেখান থেকেই পরে বেরোন। ওই বাড়িটি মেস বাড়ি। ওঁর ঘর চুনকাম হোত না, ওঁর হুকুম নেই। শুনেছি, চাঁচোল বা অন্য কোথাও ওঁদের জমিদারি ছিল। ওঁর জ্যাঠামশাই বা কাকা ওঁদের সে জমিদারির ন্যায্য অংশ দেবেনই দেবেন।
শিবরামবাবুরা ”সে জমিদারি ওঁর, আমাদের নয়”, এই মর্মে কেস করেছিলেন। এ যদি গল্প কথাও হয়, অসামান্য মানুষের নামেই অসামান্য গল্প রটে। তাই না?—সদাই হাসি মুখ। এমন লোক তখনকার দিনেও অনেক ছিল না। বাংলা মঞ্চের জন্য শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ উনিই দেন।
এ বড় দুঃখের কথা, যাঁর ”দিবারাত্রির কাব্য”, ”পুতুলনাচের ইতিকথা” ছোটবেলাই পাঠের ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত আমি পড়ে ফেলি,—সেই মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনো ব্যক্তি—আলাপ বা কথাবার্তা কোনোদিনই হোল না। বই ঘেঁটে দেখছি। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু (১৯০৮—১৯৫৬) মাত্রই ৪৮ বছরের ব্যাপার। অদ্বৈত মল্লবর্মণও এমনই স্বল্পজীবী ছিলেন বলে মনে পড়ে। তবে এখন তো মন সব ভুলে যাচ্ছে।
১৯৪৯—বছর দুই টালিগঞ্জে ছিলাম আমরা। নবারুণের জন্ম ১৯৪৮ সালে। আর ওই বাড়িতে আমার ছেলের এক বছর পূর্ণ হয়। সে সময়ে শুনেছি, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় ওই অঞ্চলেই থাকতেন। তখনো তিনি প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘের সঙ্গে যুক্ত কিনা জানি না। ওঁর ”দিবারাত্রির কাব্য” যখন ধারাবাহিক বেরোত, তখনই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে নিতাম। তখন বয়স এত কম, যে বুঝি—না—বুঝি, ছাপার অক্ষর গোগ্রাসে গিলতাম। পরে ”পুতুলনাচের ইতিকথা” ও ”পদ্মানদীর মাঝি”—ও ওভাবেই পড়ি।
হয়তো ”চোখের দেখা দেখেছি” এমনটা বলতে পারতাম। তাও পারি নি। তার জন্য আমার বাবাকেই দোষ দিতে হয়। বাবার কাছে, কলকাতাতেও অনেক লেখকদের আসতে দেখি নি, তবে ১৯৪৩—৪৪ সালে সস্ত্রীক বুদ্ধদেব বসু, সস্ত্রীক বিষ্ণু দে আসতেন, এ কথা আগেই বলেছি। আসতেন আমাদের ”বটু কাকা”, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রও। অসামান্য গায়কই ছিলেন। বটু কাকা বিজনেরও বন্ধু, তাই তাঁকে পরেও দেখেছি। ওঁরা বাইরের ঘরেই বসতেন। বসতেন, চলে যেতেন। একদিন একজন লম্বা, কালো, ধারালো চেহারার ভদ্রলোক এলেন। তিনি ছাতা ফেলে চলে গিয়েছিলেন। ছাতাটি দিলাম।
পরে বাবা বললেন, ওই যে ছাতা ফেলে গিয়েছিল, ওই মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শুনে মা খুব ক্ষুণ্ণ হন, ”যাঁর লেখা কত, কত বার পড়েছি,—সেই মাণিক বাবু এলেন, তুমি একবার আলাপ করিয়ে দিলে না?” এ সব কথা অতীতের।
তবে হুগলীতে একটি গ্রামে যাই আশির দশকে, একদা সেটি অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির এক শক্ত আন্দোলন কেন্দ্র ছিল। সেখানে শুনি, সেই গ্রামের, ও আন্দোলনের পটভূমিতেই ”ছোট বকুলপুরের যাত্রী” ও ”হারাণের নাতজামাই” লেখা হয়।
কে জানত কোনোদিন লিখব। সাবিত্রী রায়কে দেখিনি। সুলেখা সান্যালকে দেখেছি। ”রকেট”—এর লেখক বরেন বসুকে দেখিনি। পুরোন দিনের মানুষদের কথাই বলি।
আশাদি, আশাপূর্ণা দেবীর সঙ্গে চাক্ষুষ দেখা অনেক পরে। অথচ বেলতলা বালিকা বিদ্যালয়ে ওঁর মেয়ে পুষ্প আমার ক্লাসেই পড়ত। ভারি শান্ত, ভালো মেয়ে। কথাও কমই কইত। শুনতাম ওর মা লেখেন।
আর, যখন থেকে ওঁর কাছে যাওয়া শুরু করি, তখন শুনতাম, বুঝতেও পারতাম। ওঁর লেখালেখির ব্যাপারে ওঁর স্বামীর বিশাল অবদান ছিল। শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারেও সকলের সহযোগিতা পেয়েছেন।
আমাকে উনি খুব সাদরে গ্রহণ করেন। আমি লিখছি, শুধুই লিখি, এতে খুব উৎসাহ দিতেন। একবার উত্তরপাড়ার কোনো সাহিত্যসভায় যাই,—সেদিন প্রথম জানলাম, উনি সম্পূর্ণ নিরামিষাশী। ওঁর শ্বশুরবাড়ি বৈষ্ণব, আর নিরামিষাশী। কি সুন্দর হেসে বলতেন, ”আমাদের ছোট বয়েসে বিয়ে। দু’জনায় ভারি ভাব গো।” স্নেহমমতা নিশ্চয় পেয়েছি। এত যে নাম, এত নাম, কোনো নাকতোলা ভাব দেখি নি। ওঁর লেখা খুবই ভালো লাগে আজও। এই যে এত বইয়ের বিরাট সাফল্য, সিনেমায় এত গল্পের জয়জয়কার, এতটুকু অহংকার ছিল না।
ওঁর পুত্রবধু নূপুর যে খুব শিক্ষিত, লেখাপড়ার চর্চায় সমর্পিত প্রাণ, তাতে ওঁর আনন্দের অবধি ছিল না। খুব আনন্দিত ছিলেন নুপূরকে নিয়ে। লেখিকা হিসেবে উনি খুব বড় মাপের। দুঃখের কথা, তীব্র বিশ্লেষণী ক্ষমতা, নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমান চোখে দেখার চোখ, এই সবই তাঁর লেখায় জ্বলজ্বল করে।
শুধু হৃদয়গ্রাহ্য লেখা নয় তাঁর, একাধারে মস্তিষ্কগ্রাহ্যও বটে। এ কথা আশাপূর্ণা দেবী ও জ্যোতির্ময়ী দেবী এ দু’জনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। উনি কত প্রতিষ্ঠিত, বয়সে আমার মাতৃসমা। কিন্তু কি অপার স্নেহ না পেয়েছি। সাহিত্য সমালোচকরা যথোচিত গুরুত্বে আশাপূর্ণা ও জ্যোতির্ময়ীকে বিচার করেন নি।
বই যখন পড়ি, যাঁরা লেখেন/লিখেছেন, লেখাটাই পড়ি। যিনি লিখছেন, তিনি পুরুষ না মেয়ে, সে বিচার করি না। লিখিত সাহিত্যের সম্পূর্ণতাই বিচার্য হওয়া উচিত। সেই প্রেক্ষিতেই বলি, কি আশাপূর্ণা, কি জ্যোতির্ময়ী এঁদের বিষয়ে আধুনিক মন ও কলম নিয়ে খুব কম লেখা হয়েছে। এতকাল হোল না, আর কি নতুন সময়ের নতুন সমালোচক—প্রবন্ধকাররা এ কাজ করবেন?
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ভাবতেও মন ভরে ওঠে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় এঁদেরকে চোখে দেখিনি, সাহচর্য পাইনি। অবশ্যই এঁরা খুব বড় লেখক, অপু এবং ঢোঁড়াই—এর স্রষ্টা দু’জন তো নিশ্চয়। ”নীলাঙ্গুরীয়”—র লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ও যথেষ্ট ভালো লিখতেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যাই খুব সমীহ নিয়ে। ওঁর বসার ঘরে ঢুকতেই বলেছিলেন, এসো মা এসো।—শুনে মন ভরে যায়।—অতি নিরহংকার, খোলা মনের মানুষ! ওঁর বড় ছেলে সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তেমনই ছিলেন। সনৎদা’ (দাদাই বলতাম) নিজেও লিখতেন। ”চন্দন যাত্রা” (?) নামে একটি উপন্যাসের নাম মনে পড়ছে। বাবাকে খুব ভক্তি করতেন। সনৎদা কিন্তু অনেক লেখেন নি। ওঁর বাবাকে ”জেঠামশাই” বলেছি।
সে সময়ে জেঠামশাই ”যুগান্তর” কাগজে কলম লিখতেন। এর মধ্যেই উনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেলেন। আর তারপর ভবানীপুরের শিখ সমাজ ওঁকে সম্বর্ধনা জানাতে চাইলেন। ওঁর কথাতেই তাঁরা আমাকেও ডেকেছিলেন। এর পরেই নিখিলভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন হয় নাগপুরে। উনিই প্রধান, আর মনে পড়ছে উমা রায়, ৺মৈত্রেয়ী দেবী, এঁরাও ছিলেন। নাগপুর সার্কিট হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। ওঁর সঙ্গে আছেন সনৎদা, ওঁর ছোট জামাই ও চিকিৎসক ডাঃ বিশ্বনাথ রায়। আমরা ওঁর বাংলোয় দেখা করতে গেছি। ”যুগান্তর”—এর লেখা পড়ছি জেনে উনি বললেন, ”আর তো লিখব না মা। জ্ঞানপীঠ পেয়ে গিয়েছি, এবার যতটা পারব, নিজের লেখাই লিখব।”
আমাকে বললেন, তুমি লেখো, অনেক লেখো।
প্রয়াত ক্ষিতীশ রায় যখন কলকাতা সাহিত্য আকাদেমির সচিব, তাঁর সাহসেই আমি একটি ”তারাশংকর” মনোগ্রাফ লিখি, এবং ওঁর ”বেদেনী” গল্প অনুবাদ করি আকাদেমির ইংরেজি কাগজের জন্য। সে ইংরেজি কত যে নিকৃষ্ট হয়েছিল, কাকে বলি! এখন তো যেখানে যখন দরকার, ইংরেজিতে ভাষণ/বক্তৃতা ইত্যাদি দিই। আজকাল হরদম ফ্যাশনেবল—বিদগ্ধ ইত্যাদি ইংরেজি শুনতে পাই। ইংরেজি যে ভারতের মতো বহু ভাষার দেশে একটা প্রধান যোগাযোগের ভাষা, তাও মানি। ঠিক আছে! কিন্তু আমার ভাষা তো নয়। কাজ চালাবার মতো বলে যাই, আমার পক্ষে সেই যথেষ্ট।
তারাশঙ্কর একটি খাঁটি লেখক মানুষ ছিলেন। বীরভূম,তথা দেশের মাটিতে তাঁর শিকড় প্রোথিত ছিল। কত ভাগ্যি থাকলে এমন সব মানুষের দরজা আমার জন্যে খোলা থাকত।
সময়! এই সময়! আমি আজকের প্রৌঢ়, প্রবীণ, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কথা ভাবি। তাঁরা তো সমাজ, দেশ, পাঠকের কাছে অনেক পেয়েছেন। তরুণ লেখকদের জন্য তাঁদের কি কিছু করার নেই? তারাশঙ্কর বরেণ্য লেখক ছিলেন। তাঁর সমাজবিবেকও ছিল। সে সময়ের অনেকের মতই।
লীলাদি, লীলা মজুমদার (১৯০৮—), যাঁর জন্মসাল আমার মায়ের জন্মেরই বছরে,—তিনি আছেন, আজও আছেন। তবে চলচ্ছক্তি নেই। সেই ঝকঝকে ব্যক্তিত্ব, লেখনী, হাস্যকৌতুক বোধ, তরুণতরো লিখিয়েদের প্রতি অপার স্নেহ, তাদের লেখালেখিতে বেজায় উৎসাহ দান, সবই অস্তে গেছে। দেহটা প্রাণে বেঁচে আছে মাত্র।
ছোটদের লেখালেখি বাড়ির কাগজ ”সন্দেশ”—এর পাতায় শুরু। সেই ঝরনা ক্রমে স্রোতস্বিনী নদীই হয়। অতি শিক্ষিত তাঁর সাহিত্যমানস ও ভাষা। বড়দের জন্য লেখা ”ঝাঁপতাল,” ”চীনেলণ্ঠন” এ সব বই বড় আমলে বারবার পড়েছি। আরো কি, বড়দের জন্য লেখাগুলি, যে একজন মুক্তমনা, রোমান্টিক, স্মৃতিকাতর একটি মেয়েরই লেখা, সেও এক বড় প্রাপ্তি।
চিরদিন তাঁর বাড়ির এবং মনের দরজা হাট করে খোলা।
শৈশবে যখন শুধুই মুখ্য পাঠক ছিলাম, কখনো ভাবিনি যাঁদের বই পড়ছি, তাঁদের দেখতে পাব। আর লিখতে এসে কতজনকে না দেখলাম! দেখা হোল না সেও কতজনকে।
লীলাদি ভারি ঝকঝকে সদাই বেজায় খুশি মানুষ। একদা ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের সঙ্গে খুবই যুক্ত ছিলেন। ওঁর কথাতেই অনেক ছোট ছোট বই অনুবাদ করেছিলাম। অনেক পরে ”গান্ধী মানস” গোছের বড় বড় বই অনুবাদ করি, তখন লীলাদি আর যুক্ত নেই।
পার্কস্ট্রীট—চৌরঙ্গীর মোড়ে এক পেল্লায় বাড়ির দোতলায় ওঁর স্বামীর (বিখ্যাত দাঁতের ডাক্তার এস. মজুমদার) চেম্বার ও বাড়ি। ও বাড়িতেই যেতাম। উনি যখন ”সন্দেশ” কাগজের সম্পাদিকা, তখন ওই কাগজে লিখেছি।
সদাই খুশি মেজাজ, রান্নাবান্নায় খুব উৎসাহ। ওঁদের বাড়ির একতলাতে ”গ্রান্ড” বা ”গ্রেট ইস্টার্ন” হোটেলের স্টোর ছিল। একদিন বললেন, ”দাঁড়া, তোকে হাঁসের রোস্ট শিখিয়ে দিই।” খুব বিশদ ভাবে শিক্ষা দিলেন। একটা আস্ত হাঁসের পেটে পেঁয়াজ, ফুলকপি, কত কি পুরতে হবে। তারপর সেটি সেলাই করতে হবে, তারপর…তারপর…তারপর…।—আমি তো জানতাম, জীবনেও সে রোস্ট আমি করব না। আবার একদিন দেখি বাতাবি লেবুর জেলি বানিয়ে বয়ামে ভরছেন। কেমন করে বানাতে হবে, তা বিশদ বুঝিয়ে দিলেন। অবশ্যই আমি সে জেলি বানাইনি।
ওঁকে সেনাপতি রেখে ১৯৭২ সালে আমরা অনেকে একটা বেজায় ভালো কাজ করে ফেলি। যেহেতু তেমন কাজ আমাদের আগেও কেউ করে নি, পরেও নয়, সেহেতু সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেই গর্ব করার মতো কাজটির কথা বলতেই হয়। লীলাদি শুনেই বললেন, আমি আছি, আমি থাকব। তোরা এগিয়ে চল।
কি সেই বেজায় ভালো কাজ? আমি, চিত্রা ঘোষ (শরৎ বসুর মেয়ে), শ্যামশ্রী লাল (অধ্যাপক, লেখক—সম্পাদক পি. লালের স্ত্রী, ডঃ কালিদাস নাগের মেয়ে), ওর বোন পারমিতা, সবাই ছিলাম।
কী সেই কার্যসূচী? যা আগেও হয়নি, পরেও হয়নি? বাংলা সাহিত্যে আমাদের তো বটেই, আশাপূর্ণা দেবী, লীলাদি, এঁদেরও অগ্রজা ক’জন লেখিকাকে সংবর্ধনা জানানো হবে। তাঁরা কে কে? শৈলবালা ঘোষজায়া, জ্যোতির্ময়ী দেবী, গিরিবালা দেবী, সীতা দেবী, শান্তা দেবী ও পুণ্যলতা চক্রবর্তী। শৈলবালা ঘোষজায়ার লেখা ”শেখ আন্দু” খুব নাম করেছিল। এক মুসলিম গাড়োয়ানকে নিয়ে সেই উপন্যাস। জ্যোতির্ময়ী দেবীর মতো বুদ্ধিদীপ্ত, বিশ্লেষণধর্মী গল্প—উপন্যাস তো আজও লিখতে দেখি না কাউকে। সীতা দেবী, শান্তা দেবী দু’জনই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে। গল্প, উপন্যাস লিখতেন। ”প্রবাসী প্রেস” প্রকাশিত ”আরব্যোপন্যাস”—এ অনেক গল্প অনুবাদ করেন। শিশু সাহিত্যেও অনেক অবদান ওঁদের। পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ”ছেলেবেলার দিনগুলি” অতি বিখ্যাত। আর জ্যোতির্ময়ী দেবীর মতো কলম কমই দেখেছি। যেমন প্রবন্ধ, তেমন গল্প—উপন্যাস, বাংলা সাহিত্যে আরেকজন জ্যোতির্ময়ী দেবী নেই। এঁর সমগ্র রচনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ”স্কুল অফ উইমেনস স্টাডিজ” প্রকাশ করেছেন।
আমরা নিজেদের নাম দিই ”সাহিত্যিকা”, সঙ্গে থাকেন ইউনিভার্সিটি উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন। লীলাদি সেনাপতি, আমরা অনুগত সৈনিক। রবীন্দ্রসদন পাই বোধহয় বিনা দক্ষিণায়। দৈনিক ”যুগান্তর” ও ”আনন্দবাজার পত্রিকা” পরপর দুই রবিবার প্রথম পাতায় অনুষ্ঠান বিষয়ে লেখেন।
সকাল দশটায় পর্দা সরে যাবে। তখন লীলাদি বলছেন, যদি হল ফাঁকা থাকে? কি হবে, ভেবেছিস?—দশটা বাজল, পর্দা সরল। দেখি রবীন্দ্রসদন ফেটে পড়ছে। পিছনের দরজা খোলা। অতিথিদের ভিড় হল বোঝাই করে দরজায় পিছনের বারান্দায়। একেবারে সামনে বসেছিলেন প্রবোধ কুমার সান্যাল, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, আরো কতজন!
ডক্টর রমা চৌধুরী স্বস্তি বাচন পাঠ করলেন। একেকজন লেখিকা একেকজনের ওপর বললেন। ওঁরাও বললেন। আমরা যা দেবার, তা দিলাম। তারপর সাহিত্যিকরা, প্রকাশকরা ওঁদের ভারে ভারে বই দিলেন।
আমরা ভেবেছিলাম এরপর লীলাদি, আশাপূর্ণা দেবী, বাণী রায়, এঁদের একটি সংবর্ধনা দেব। পারি নি। সে দুঃখ থেকেই গেল। সেই লীলাদি আজ অসুস্থ, স্থবির, শয্যাশায়ী, ভাবলেও বড় দুঃখ হয়। লীলাদির জন্ম ১৯০৮ সালে। আর তিন বছর বাঁচলে উনি শতায়ু হবেন। কিন্তু সজীব, সচল না থাকলে বেঁচে লাভ কি? যাঁর কথা বলছি, তিনি যে কি বুদ্ধিদীপ্ত, শীলিত, সংবেদী মানুষ কি বলি!
এই সংবর্ধনার পিছনে মস্ত ব্যাপার জ্যোতির্ময়ী দেবী। বাল্যবিবাহ, বাইশ বছরে বিধবা। পাঁচটি সন্তান। জয়পুরে বাবা ছিলেন মহারাজের মন্ত্রী। জ্যোতির্ময়ী দেবী পড়াশোনা, লেখা, ইত্যাদিতে স্বইচ্ছাতেই নিজেকে নিবেদন করেন। ওঁর লেখা বলতে শুধুই গল্প—উপন্যাস ও কিছু কবিতা নয়, সমাজে নারীর অবস্থান সেদিনের রাজনীতিক প্রেক্ষাপট, ইত্যাদি বিষয়ে অনেক প্রবন্ধও আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ যা, আরেকজন সমমনা মহিলার সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য বন্ধুত্ব হয়। এ—ওর লেখা পড়ে। তিনি অনিন্দিতা দেবী, কবি অমিয় চক্রবর্তীর মা। এই অনিন্দিতা দেবী আবার আমার মায়ের মেজমামীমা ছিলেন। শৈশবে তাঁকেও দেখেছি।
যে জ্যোতির্ময়ী দেবীর লেখা পড়ে তাঁকে শ্রদ্ধা করেছি এত, তিনি অশোকা গুপ্তের মা, সে কথা জেনে অশোকা দি’র বাড়ি চলে যাই। আমার মাকেও একবার নিয়ে গিয়ে তাঁর প্রিয় লেখিকার সঙ্গে পরিচয় করাই। জ্যোতির্ময়ী দেবী সত্যিই অনন্যা ছিলেন। নিজের চেষ্টাতেই ইংরেজি শেখা। দেখেছি কান্ট, হেগেল, ইবসেন পড়তে। পড়তেন ভার্জিনিয়া উলফ। আবার আগাথা ক্রিস্টি, উডহাউসও সমান উপভোগ করতেন। ওঁর রাজস্থানের নারী সমাজ আশ্রিত গল্পগুলি আমি আজও পড়তে পারি, যদি সময় পাই।
খুব ভাবছি, ভেবে ভেবে লিখছি। যাঁদের সঙ্গে কিছু ঘনিষ্ঠ হয়েছি, তাঁদের কথাই লিখছি। লিখছি আজকের লেখকদের জানাতে। আমাকেও অনেক চেষ্টায়, কষ্ট করেই লেখালেখির জীবিকায় টিকে থাকতে হয়েছে। তা করতে পেরেছি, তার পিছনে বিশাল অবদান সেদিনের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য জগতের শ্রদ্ধেয় মানুষদের। আজ যাঁরা প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা কতজন নতুন কলমচিদের লেখা পড়েন, উৎসাহ দেন। যাতে তারা সাপ—লুডো খেলাতে সাপের মুখে বারবার না ঢুকে যেতে বাধ্য হয়? জানি না। তবে লেখালেখি করেই বেঁচে থাকা এখন খুব কঠিন। বাংলায় লিখে বেঁচে থাকা এত কঠিন হয়ে গেল কেন? যাঁরা ইংরেজিতে লিখছেন, তাঁরা খ্যাতি পান। অর্থ পান প্রচার পান। বাংলা ভাষার জায়গা বড়ই একটুখানি। এ তো দুঃখের, ও লজ্জার কথা! সময়টা বড়ই হিংস্র, সশস্ত্রও বটে। সময়ের দাঁত ধারালো, নখও তাই। আমরা অনেক ভালো সময় পেয়েছি।
যাঁদের অনেক লেখাই ভালো লাগত, সেই নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বিমল কর—এঁদের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয় নি। তবে ”অচলপত্র” সম্পাদক দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল আমাদের পদ্মপুকুরের বাড়িতে খুব আসতেন। মনে রাখার মতো বন্ধু ও সজ্জন ছিলেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ”তিতাস একটি নদীর নাম” পড়ে আমরা যখন চমকে গেছি, তখন অদ্বৈত তো চলে গেছেন। ঋত্বিক সেই বই নিয়েই ছবি করল। সেটা মনে করলেও গর্ব হয়।
হয়তো সব গুছিয়ে লেখা গেল না। তা সম্ভবও হোল না। এখানেই শেষ করি। কিন্তু ”শেষ” বলে তো কিছু নেই। তাই ”শেষ কথা কে বলবে” এ প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথই রেখে গেছেন। আমি আমার সময়ের কথা সাধ্যমতো লিখে গেলাম।