ছাত্রী – মহাশ্বেতা দেবী

 ছাত্রী – মহাশ্বেতা দেবী

দুপুরবেলা যে আমি কী করি সেটা কেউ জানে না। জানবেও বা কেমন করে? ঘড়িতে যখন ঠিক দুটো বাজে তখন আমি বইখাতা বগলে উঠে যাই ছাদের ঘরে। দীপা মাসি ভাবে আমার পড়াশোনায় মন বসেছে, দুপুরবেলা টিভি না দেখে বই নিয়ে বসছি। রোজ বিকেলে এটা-সেটা বানিয়ে দেয়। মার কাছে বলে – ‘বৌদি আজকাল না দুপুর হলেই দিদিভাই ছাদের ঘরে পড়তে বসে। একটুও টিভি দেখে না। কাউকে ডিশটাপ (ডিস্টার্ব) করে না।’ মাও তাই শুনে মুচকি হাসে। কিন্তু আসলে যে তখন আমি কী করি তা সত্যিই কেউ জানে না।

ঘটনাটা শুরু হয়েছিল মাসখানেক আগে। এই বাড়িতে তখন আমরা সবে এসেছি। দোতলা সুন্দর বাড়ি। খুব সস্তায় পাওয়া গেছে। তাছাড়া পাড়াটাও খুব ভালো। অতএব বাড়ি কেনা হল। ঘুপচি ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে সপরিবারে চলে এলাম। তখনও নতুন বাড়িতে টিভি লাগান হয়নি। দুপুরবেলাটা আমার কিছুই করার থাকে না। হোমওয়ার্ক করার বাঁধাধরা সময় হচ্ছে সন্ধে সাতটা থেকে রাত সাড়ে নটা। সেটাতে তো বদল আনা যায় না! সেই কবে থেকে নিয়মটা চলে আসছে।

সেদিন দুপুরটা ছিল অন্য দিনগুলোর থেকে একটু আলাদা। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদের বদলে একটু একটু মেঘ করেছে। পুব দিক থেকে ভেজা ভেজা হাওয়া দিচ্ছে। যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হবে। মেঝেতে একগাদা বইখাতা নিয়ে বসেছিলাম আমি। একটা পুরোনো খেলা খেলবার চেষ্টা করছিলাম – পড়ানো। আগে ছোট থাকতে নিজের সামনে পুতুল সাজিয়ে নিয়ে বসতাম পুরোনো ক্লাসের বই নিয়ে। রোল কল নিতাম পুতুল ছাত্রছাত্রীদের। পড়া না পারলে পুরীর লাঠি দিয়ে মারতাম। আরও কত কি এখন তো আর সে সব করা যায় না! বড় হয়ে গেছি (!) । ক্লাস সিক্সে পড়ি। এখন ক্লাসের বই নিয়ে বসে ও ঘরের আসবাবপত্রকেই পড়াই হয়তো।কিন্তু যাকেই পড়াই, পড়াই তো!

সেদিন পড়াতে পড়াতে ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম একটু। জানলার বাইরের দিকে চেয়েছিলাম। এমন সময় একটা খসখস আওয়াজে চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেল। বেশ ভয়ই পেয়ে গেলাম। কোথেকে আসছে আওয়াজটা? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম। না, সত্যিই কেউ নেই। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম। সেখানেও সেই একই জিনিস। একটা কাক-পক্ষীকেও দেখছি না। তাহলে আওয়াজটা কে করছে? ঘরে ফিরে এলাম। এখন খসখস আওয়াজটা আর নেই। সব কিছু একেবারে নিস্তব্ধ। নীরব।

তখনই স্লেটটার ওপরে চোখ পড়ল। স্লেটটা আমি আজ পর্যন্ত কখনও ব্যবহার করিনি। কিন্তু যখন আমি পড়াতে বসি তখন ওটা একটা মাস্ট। স্লেটটা ছাড়া ঠিক যেন ভাল করে পড়ানো যায় না। বাবাকে দিয়ে চকও আনানো হয়েছে এক বাকসো। তাই দিয়েই স্লেটে লিখি। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে সেদিন আমি কিছুই লিখিনি। চোখে পড়ল কাঁপা কাঁপা বাংলা হাতের লেখায় লেখা দু খানা বাক্য। কাছে গিয়ে স্লেটটা হাতে নিলাম। তাতে লেখা ছিল- ‘কী হল? আজ পড়াচ্ছো না যে? মন খারাপ?’

কি মনে হতে আমিও স্লেটের ওপরে লিখলাম, ‘ইচ্ছে হচ্ছে না। তুমি কে গো?’

ওমনি আবার স্লেটে নিজে থেকেই লেখা ফুটে উঠল। তারপর স্লেটে লিখে লিখে ও তার নিজের সম্বন্ধে সমস্ত কিছু আমায় জানাল। ওর নাম লেখা। এই বাড়ির আগের বাসিন্দাদের মেয়ে। বছর দশেক আগে সে এখানে তার বাবা, মা, দিদিদের সঙ্গে থাকত। বাড়িটা ওর দাদুর বানানো, তাই একটু সেকেলে ধরনের। একদিন সন্ধেবেলা বাগানে ঘুরছিল লেখা। ওর বয়স তখন এগারো। সেটা মার্চ মাস। হালকা হাওয়া বইছে। সব কিছু কি সুন্দর! কি অপূর্ব! ও মনে মনে ভেবে চলেছিল ওর নিজের কথা। কোন কিছুরই অভাব নেই তার। একটা ঠিকঠাক পরিবার, একটা এত সুন্দর বাড়ি! আর কী চাই? মনে মনে ভগবানের কাছে ও বলেই ফেলল, ‘হে ভগবান। আমার আর যাই কর আমাকে কখনও এই বাড়ি বা এই পরিবারের কাছ থেকে আলাদা কোরো না। ইচ্ছা ঠাকরুণ হয়তো কাছাকাছি কোথাও ছিলেন। এহেন ইচ্ছা শুনে তিনি মুচকি হেসে বললেন -’তথাস্তু।’

ব্যাস! হয়ে গেল। তার দিন দুয়েক পর লেখা সকালবেলা উঠে দেখল সে নিজেকে আর দেখতে পাচ্ছে না। মশারি তুলে বেরোল সে। খাটে শুয়ে ঠাণ্ডা স্থির তার শরীরটাকে দেখে খুব উদাস লেগেছিল তার। এই ঘটনার দিনদশেকের মধ্যে লেখার বাবা-মা-দিদি বাকসো-টাকসো বেঁধে চলে গেল অন্য কোথাও । কোথায় সেটা কেউ জানে না। ও কিন্তু আটকে গেল এই বাড়িতেই। ইচ্ছাঠাকরুণ হয়তো তার ইচ্ছার প্রথম ভাগটাই শুনেছিল।

গত দশ বছর বাড়িটা বন্ধ ছিল। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত, মন কেমন করত। কিন্তু একা থাকাটা একরকম সয়ে গেছিল ওর। এই বাড়ি আগলে, সব কিছু আগলে পাহারাদার হয়ে ছিল সে। কিন্তু আস্তে আস্তে বাড়ি অপরিস্কার হতে লাগল। ধুলোর পুরু আস্তরণ পড়ল আসবাবপত্রের ওপর। ফুলগাছগুলো মরে গিয়ে তাদের জায়গায় গজিয়ে উঠল আগাছা। বাগানটা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে গেল। ফাঁকা বাড়িতে বর্ষাকালে ছ্যাঁতলা পড়ল। ঘুঘুপাখি বাসা বানাল জানালার ধারে।

ও আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিল এই বাড়িতে এখন জীবন্ত লোক থাকতে না এলে সত্যিই এর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যাবে। একটা অজানা আশঙ্কা আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছিল ওর মনটাকে। বাড়িটা যদি ভেঙে যায়, কিংবা যদি নষ্ট হয়ে যায়, ও তাহলে কোথায় যাবে? কোথায়ই বা থাকবে?

তারপর একদিন সকালে কিছু লোকজন এল। বাড়ি দেখল। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করল সব কিছু। ভাঙা জিনিসপত্র সারালো। জানালার কাচ ঠিক করল। বাগানের আগাছা সরিয়ে ফুল গাছের চারা লাগাল ।

তারপর এলাম আমরা। খুব খুশি হয়েছিল ও সেদিন। কিছুদিনের মধ্যেই আমার এই পড়ানোর অভ্যাসটা চোখে পড়ল ওর। আর সেই থেকে আবার শুরু হল ওর পড়াশোনা। আমি রোজ পড়াই। আর ও রোজ পড়ে।

এতগুলো কথা লিখে বোধহয় ক্লান্ত হয়ে গেছিল ও। আমি ওকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু বুঝতে পারছিলাম ওর সত্তাটাকে। ঠিক যেন আর একজন মানুষ। খালি ওকে চোখে দেখা যায় না এই যা। মনে পড়ছিল সেই বাঙ্গালোরের আধুনিক মহিলাকে, যার কাছ থেকে বাবা বাড়িটা কিনেছে। তিনিই হয়তো আমার ছাত্রীর দিদি। কে জানে!

আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম চিন্তা করতে করতে। চমক ভাঙল আবার সেই খসখস শব্দে। এবার আর এদিক ওদিক তাকাতে হল না। সোজা স্লেটটার দিকেই তাকালাম। তাতে আবার কিছু লেখা ছিল-‘কী হল? আজ কি পড়াবেই না? আমি চলে যাব?’ ওর লেখাতে ছিল অনুরোধের সুর। আমি বইটা হাতে নিয়ে পড়াতে আরম্ভ করলাম। শুরুতে বেশ অদ্ভুতই লাগছিল। আমি কাকে পড়াচ্ছি? কেন পড়াচ্ছি? – এই সব প্রশ্ন জাগছিল মনে। কিন্তু আস্তে আস্তে আড়ষ্ট ভাবটা কেটে গেল। আমি পড়াতে লাগলাম আপনমনে, যেমনি আগে পড়াতাম।

ভয় পাওয়ার চেয়ে আমি খুশিই হচ্ছিলাম বেশি। মনেই হচ্ছিল না যে আমি কোন ভূত বা কোন মরা মানুষের আত্মাকে পড়াচ্ছি। শুধু মনে হচ্ছিল যে একজনকে পড়াচ্ছি। আমার ছাত্রীকে পড়াচ্ছি। ও-ই প্রথম এমন কোন মানুষ (বা ভূত) যে আমার পড়ানোকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে নিয়েছে। এর আগে, ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতে পাশের বাড়ির ভূতোকে পড়াবার চেষ্টা করেছিলাম। ভূতো রোজ বিকেল চারটেতে আমার কাছে আসত আর রোজ পাঁচটায় মায়ের কাছে ফেরৎ যেত। আর এই একঘন্টা যে কি হত তা না বলাই মঙ্গল। ভূতো কালা ছিল বলে জানতাম না। কিন্তু পড়তে বসে কালা হয়ে যাওয়াটা হয়তো ওর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল। ওকে যত কিছু বলি, যা কিছু বলি ওর মাথায় যদি কিচ্ছু ঢুকত ! বোকার মত কেবল তাকিয়ে থাকত আমার দিকে।

আমার নতুন ছাত্রী অন্তত সেরকম নয়। তার প্রমান পেয়েছি যখন তখন স্লেটের ওপর অঙ্ক-কষা দেখে। হয়তো ও আমায় প্রমান দিতে চায় যে ও পড়ছে, ও বুঝছে, ওর ভালো লাগছে।

তাই আমি রোজ দুপুরবেলা উঠে যাই ছাদের ঘরে আর সারা দুপুর ধরে পড়াই ওকে। এখন বাড়িতে টিভি লাগানো হয়ে গেছে। তবে আর দেখতে ভাল লাগে না। দুপুরবেলায় আমার এখন কত কাজ বলো তো! এত কাজের চাপ থাকলে কী করে টিভি দেখে সময় নষ্ট করি?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *