ছবিটা আপনি ভালোই আঁকেন!

ছবিটা আপনি ভালোই আঁকেন!

এক

বিকালবেলা ঘুম ভাঙতেই নিখিলেশের খেয়াল হল তাকে থানায় যেতে হবে৷ সাত সকালেই থানা থেকে একজন লোক এসে খবর দিয়ে গেছে, বড়ো সাহেব এত্তেলা পাঠিয়েছেন৷ নিখিলেশ চোর-ডাকাত-মস্তান বা পুলিশের টিকটিকি নয়৷ নিতান্তই সাধারণ মানুষ৷ গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, পরনে ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে সকাল বিকাল তার বেচারাম মল্লিক লেনের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বাচচাদের টিউশন করাতে যায়৷ একদম নির্বিবাদী বেকার যুবক নিখিলেশ৷ তবে তাকে থানায় যেতে হবে কেন? আসলে নিখিলেশ একজন আর্টিস্ট৷ হয়তো কাগজে তার নাম ছাপা হয় না, আর্ট এগজিবিশনে তার ছবি থাকে না, বাচচাদের আঁকা শিখিয়েই তার পেট চলে৷ তবে তার বিশেষ একটা গুণ আছে৷ কোনো লোককে না দেখে, শুধু অন্য কারও মুখ থেকে তার চেহারার বিবরণ শুনে হুবহু তার ছবি আঁকতে পারে নিখিলেশ৷ আর তার এই গুণের জন্যই মাঝে মাঝে তার থানায় ডাক পড়ে৷ দাগী অপরাধীদের ছবি পুলিশ ফাইলে থাকে, কিন্তু এমন কোনো অপরাধী যার কোনো ছবি নেই, কেউ শুধু তাকে দেখেছে মাত্র, এমন লোককে খোঁজা বেশ মুস্কিল৷ তাই সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনে পুলিশ অপরাধীর ছবি আঁকিয়ে নিয়ে সেই ছবির সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে৷ অনেক সময় অনেক বড়ো বড়ো অপরাধী ধরা পড়ে আঁকা ছবির মাধ্যমে৷

নিখিলেশের কিন্তু মোটেও ইচ্ছা করে না এ সব অপরাধীর ছবি আঁকতে৷ আর্টিস্টরাতো সবসময় সুন্দর জিনিস আঁকার চেষ্টা করে, অথবা নান্দনিক কোনো কিছু৷ কিন্তু তাকে আঁকতেই হয়৷ এক একটা ছবি আঁকলে পাঁচশ টাকা পাওয়া যায়৷ টিউশন নির্ভর নিখিলেশের বেশ কিছুটা সুরাহা হয় তাতে৷ ঘুম থেকে উঠে থানায় যাবার কথা মনে হবার পর, নিখিলেশ একবার ভাবল, না, থাক, যাব না৷ কিন্তু, তারপর তার মনে হল, ‘এ মাসে ঘর ভাড়ার টাকা বাকি আছে৷ ছবি এঁকে দিলে সে টাকাতে ভাড়ার ব্যাপারটা মেটে৷ কাজেই শেষ পর্যন্ত যে বিছানা থেকে উঠে পড়ল থানায় যাবার জন্য৷

কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিখিলেশ যখন বাড়ি ছেড়ে থানার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল তখন সে খেয়াল করল আকাশে মেঘ জমছে৷ বর্ষার সময়, যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে৷ তবে থানাটা তার বাড়ি থেকে খুব বেশি দূর নয়৷ এ-গলি, সে গলি বেয়ে সে দ্রুত এগোল থানার দিকে৷

বৃষ্টির নামার আগেই নিখিলেশ পৌঁছে গেল থানায়৷ বড়ো সাহেব তার ঘরেই ছিলেন৷ নিখিলেশ ঘরে পা রাখতেই তাকে চোখের ইশারাতে চেয়ারে বসতে বলে তিনি বললেন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি৷ বেশ বড়ো ক্রাইম৷ ছবিটা ভালো করে আঁকার চেষ্টা করবেন৷ অপরাধী ধরতে পারলে একটা পুরস্কারেরও ব্যাপার আছে৷ এক লাখ! পুলিশ সেটা পেলে আপনাকেও কিছুটা দেবে৷’ চেয়ারে বসে নিখিলেশ বলল, ‘কি ব্যাপার? কোনো উগ্রপন্থী-টন্থী?’

বড়ো সাহেব সান্যালবাবু বললেন, ‘না-না, অতবড় ব্যাপার না হলেও খুব ছোটো ব্যাপারও নয়৷ ডাকাতি এবং খুন৷ গতকাল রাতে গণেন্দ্র মিত্র লেনে একটা সোনার দোকানে ডাকাতি হয়েছে৷ ক্যাশ ও অর্নামেন্ট নিয়ে প্রায় তিরিশ লাখ হবে৷ দোকানের একজন কর্মচারী বাধা দিতে গিয়ে মারা গেছে৷ আজ তো রোববার৷ বডিটা থানাতেই আছে৷ কাল পোস্টমর্টেমে যাবে৷ মালিকের অনেক দিনের বিশ্বস্ত কর্মচারী৷ মালিক অঘোরবাবু বেশ ভেঙে পড়েছেন৷ টাকা-সোনা যা গেছে তা তিনি ইনসিওরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে পেয়ে যাবেন৷ কিন্তু, তাঁর লোকটাকে আর পাবেন না৷ তিনি বলছেন তাঁর কর্মচারীর খুনী ধরা পড়লে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেবেন!’

সান্যাল সাহেবের কথা শুনে নিখিলেশ প্রশ্ন করলেন, ‘তা প্রত্যক্ষদর্শী কে?’

সান্যাল সাহেব জিজ্ঞাসা দিলেন, ‘ব্যাপারটা যখন ঘটে তখন অঘোর মল্লিক সহ দুজন কর্মচারী ছিল৷ দুজন ডাকাত নাকি মুখে কালো কাপড় বেঁধে এসেছিল৷ অঘোরবাবুর স্টেটমেন্ট অনুযায়ী যখন তাঁর কর্মচারীকে ওরা খুন করে তখন তার সাথে ঝটাপটি করতে গিয়ে একজনের মুখের কাপড়টা নাকি খসে যায়৷ অঘোরবাবু আর তাঁর অপর সঙ্গী সৌভাগ্যক্রমে লোকটার মুখ দেখতে পেয়ে যায়৷ ডাকাতরা সংখ্যাতে দুজন হলেও ছুরি-পিস্তল ছিল ওদের হাতে৷ ওরা একজনকে খুন করার পর স্বাভাবিক কারণেই অঘোরবাবু আর তাঁর সঙ্গী ডাকাতদের বাধা দেবার সাহস দেখান নি৷’

এরপর তিনি আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আসতে পারি?’

তাকে দেখেই সান্যাল সাহেব বললেন, ‘আসুন, অঘোর বাবু৷ আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি৷ তা আপনার আর একজন কর্মচারী কোথায়?’

ভদ্রলোক প্রথমে ঘরে ঢুকলেন৷ নিখিলেশ তাকাল তাঁর দিকে৷ ভদ্রলোকের চোখে রিমলেস চশমা, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, পরিষ্কার ভাবে কামানো ফর্সা মুখমণ্ডলে একটা উৎকণ্ঠা মাখা বিষণ্ণতার ছাপ৷ ভদ্রলোকের উচচতা মাঝারি, কিন্তু বেশ শক্তপোক্ত গড়ন৷ পরনে ফর্সা ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে চকচকে পাম্পশু্য৷ হাতের আঙুলে বেশ কটা পাথর বসানো আংটিও আছে৷

ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে সান্যাল সাহেবকে বললেন, ‘তাকে মুকুন্দর বাড়ি কিছু টাকা পয়সা দিয়ে পাঠালাম৷ পরিবারটা একদম ভেঙে পড়েছে৷ ওদের পাশে দাঁড়ানোও তো দরকার৷ মুকুন্দ আমার দোকানে পঁচিশ বছর কাজ করছে৷ খুবই বিশ্বস্ত ছিল৷ ইনসিওরেন্স কোম্পানি যা গেছে তা ফেরতে দেবে ঠিকই, কিন্তু মুকুন্দকে আর ফিরে পাব না!’— এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভদ্রলোক নিখিলেশের পাশের চেয়ারে বসলেন৷ ভদ্রলোকের কথা বলার ধরন দেখে নিখিলেশের মনে হল, টাকার চেয়েও বিশ্বস্ত কর্মচারীর মৃত্যুতেই বেশি ভেঙে পড়েছেন ভদ্রলোক৷

সান্যাল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘অপরাধী ধরার চেষ্টা আমরা করছি৷ আপনার পাশের ভদ্রলোক হলেন আর্টিস্ট৷ আপনার কথা শুনে উনি ছবি আঁকবেন৷ আপনার কর্মচারীও এলে ভালো হোত৷ দুজনের কথা শুনেই তাহলে এখনই ছবি আঁকানো যেত৷ ঠিক আছে তাহলে আপনার সেই কর্মচারীকে নয় পরে ওনার বাড়ি পাঠাতে হবে৷ ওনার সাথে পাশের ঘরে গিয়ে ছবিটা আকিয়ে ফেলুন৷ ছবিটা হাতে পেলে আমার কাজের সুবিধা হবে৷’ কথাগুলো বলে নিখিলেশের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন তিনি৷

ছবি আঁকার জন্য ভদ্রলোককে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে নিখিলেশ তার মুখোমুখি বসল৷ এ ধরনের ছবি আঁকার নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে৷ প্রত্যেক মানুষের কপাল, চিবুক, ভ্রু, নাক, কান, চোখ, ঠোঁট অর্থাৎ মুখমণ্ডলের বিভিন্ন অংশের গড়ন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়৷ চুল, দাড়িরও রকমফের হয়৷ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী তার পছন্দের বিভিন্ন অংশ এঁকে তারপর সেগুলো একত্রিত করে মুখমণ্ডল তৈরি করা হয়৷ যে সব আর্টিস্ট কম্পিউটারে কাজ করেন তাদের কাজটা অপেক্ষাকৃত সহজ৷ কারণ মুখমণ্ডলের বিভিন্ন অংশের নানা ছবি আগেই তাদের কাছে থাকে৷ জোড়া দেবার কাজটা তাড়াতাড়ি হয়৷ কিন্তু, নিখিলেশের মতো যারা পেন্সিল স্কেচ করে, তাদের কাছে কাজটা বেশ কঠিন৷

কাগজ-পেন্সিল বার করে টেবিলে বিছিয়ে কাজ শুরুর আগে সে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা লোকটার বয়স কেমন? চুল, দাড়ি, গোঁফ ছিল?’

ভদ্রলোক একটু ভেবে নিয়ে জবাব দিলেন, ‘বয়স মনে হয় বছর পঁচিশ হবে৷ পাতা চুল, ডান দিকে সিঁথে৷ তবে গোঁফ দাড়ি ছিল না৷’ এরপর অঘোরবাবু বেশ অনুরোধের স্বরে বললেন, ‘ছবিটা দয়া করে ভালো করে আঁকার চেষ্টা করবেন৷ ডাকাতি না হয় হল, কিন্তু মুকুন্দর মৃত্যুটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না৷ কতো দিনের পুরনো লোক৷ অপরাধী গ্রেপ্তার হলে আমি এক লাখ টাকা দেব বলেছি৷’— এই বলে সম্ভবত চোখের জল গোপন করার জন্য চশমা খুলে চোখে রুমাল চাপা দিলেন ভদ্রলোক৷

কর্মচারীর অকালমৃত্যুতে মালিকের ভেঙে পড়াটাই স্বাভাবিক৷ নিখিলেশের বেশ কষ্ট হল তাঁকে দেখে৷ পেন্সিল হাতে তুলে নিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করতে নিখিলেশ বলল, ‘আমি চেষ্টা করব৷’

এরপর ছবি আঁকা শুরু হল৷ ভদ্রলোকের কথামতো সে আঁকতে লাগল ছবি৷ ঘণ্টা দেড়েক পর ছবিটা শেষ হল৷ ওই বছর পঁচিশের এক যুবকের ছবি৷ তার থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট, ভাঙা চোয়াল৷ লোকটার ডান কপালে একটা আঁচিলও আছে৷ চোখের দৃষ্টি হিংস্র৷ অপরাধীর মতোই দেখতে৷ ছবি শেষ হলে নিখিলেশ ছবিটা উঠিয়ে ধরে ভদ্রলোককে বলল, ‘কেমন হল?’ অনেকক্ষণ ধরে ছবি দেখে অঘোরবাবুর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল৷ তিনি বললেন, ‘বাঃ! একদম যেন ক্যামেরাতে তোলা ছবি! আপনি, ছবিটা কিন্তু ভালোই আঁকেন!’ নিখিলেশও হাসল৷ আত্মপ্রসাদের হাসি৷ এরপর দুজন ছবিটা নিয়ে গেল সান্যাল সাহেবের ঘরে৷ কিন্তু তিনি কি কাজে যেন বাইরে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে৷ কাজেই নিখিলেশ একজন অফিসারের হাতে ছবিটা দিয়ে সান্যাল সাহেব এলে তাকে দিয়ে দিতে বলল৷ অঘোরবাবুও নিখিলেশের থেকে বিদায় নিলেন৷ কাজ শেষ করে নিখিলেশ যখন থানার বাইরে এল তখন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ ভাগ্যিস নিখিলেশের ব্যাগে ছাতা আছে৷ বর্ষার বৃষ্টি সহজে কমবে না৷ বেশি বৃষ্টি হলে আবার রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে যাবে৷ তখন চলাই মুস্কিল হবে৷ কাজেই বৃষ্টি থামার অপেক্ষা না করে নিখিলেশ ছাতা মাথায় রাস্তায় নামল৷

দুই

নিখিলেশ তখন তার বাসার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে৷ আর দুটো গলি পেরলেই তার বাড়ি৷ বৃষ্টি কিন্তু থামার কোনো লক্ষণ নেই৷ সুনশান গলি, একটা কুকুর পর্যন্ত নেই৷ ইতিমধ্যেই বেশ জল জমে গেছে৷ ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো কেমন যেন হলদেটে, ম্রিয়মান৷ ঠিক এমন সময় পিছনে জলে পা ফেলার ছপছপ শব্দ শুনে নিখিলেশ পিছনে তাকিয়ে একটা লোককে দেখতে পেল৷ শীর্ণকায়, খর্বাকৃতি একজন লোক, তার কিছুটা পিছনে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসছে৷ গলির বিবর্ণ আলোতে তার মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ তবে লোকটার চলার ভঙ্গী কেমন যেন টলোমলো! ‘লোকটা কি অসুস্থ! নাকি অন্য কিছু?’ তাকে দেখে নিয়ে কথাটা ভেবে নিজের মতো হাঁটতে লাগল নিখিলেশ৷

কিন্তু আরও কিছুটা হাঁটার পর নিখিলেশের কেমন যেন মনে হল, লোকটা তাকে অনুসরণ করছে৷ এখানকার গলি-উপগলি সব নিখিলেশের চেনা৷ তার অনুমান সত্যি কিনা তা দেখার জন্য সে ইচ্ছা করে পর পর দুটো বাঁক নিল৷ লেকাটাও যে তার সাথে কিছুটা দূরত্ব রেখে একই ভাবে মোড় নিল তা পিছনে ছপছপ শব্দ শুনে নিখিলেশ বুঝতে পারল৷ একটু ভয় পেয়ে গেল নিখিলেশ৷ ফাঁকা গলি, লোকটা চোর-ডাকাত নয়তো৷ ভাবনাটা মাথায় আসতেই সে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালাল৷ আর তার সাথে সাথেই ছপছপ শব্দটা তাকে অনুসরণ করে চলল৷

একটু দ্রুত পা চালিয়ে নিজের দরজার কাছে নিখিলেশ পৌঁছে গেল৷ শব্দটা তখনও তার পিছনে৷ দরজার কাছে পৌঁছে তার সাহস ফিরে এল৷ নিখিলেশ ফিরে দাঁড়াল লোকটার দিকে৷ লোকটা যেন তার দিকেই আসছে৷ সত্যিই লোকটা নিখিলেশের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরল৷ নিখিলেশ তাকে বলল, ‘আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে লোকটা জবাব দিল, ‘আমি আপনার কাছেই এসেছি৷’

নিখিলেশ অবাক হয়ে বলল, ‘মানে?’

সে বলল, ‘মানে, আমি অঘোর বাবুর কর্মচারী৷ ওই ছবি আঁকার ব্যাপারে থানা থেকে…৷ ব্যাপারটা এবার স্পষ্ট হয়ে গেল নিখিলেশের কাছে৷ সান্যাল সাহেব একেই পাঠিয়ে দেবেন বলেছিলেন৷ এ লোকটাই অঘোর বাবুর টাকা খুন হয়ে যাওয়া কর্মচারীর বাড়ি দিতে গেছিল৷ নিখিলেশ বলল, ‘ও, বুঝলাম! কিন্তু রাস্তাতেই আমাকে চিনে নিয়ে পিছু নিলেন কি ভাবে?’ তার প্রশ্নর জবাবে লোকটা শুধু অস্পষ্ট ভাবে বলল, ‘আমি থানাতেই ছিলাম৷ আপনি যখন বেরোচ্ছেন…৷’ কথা শেষ করল না লোকটা৷

নিখিলেশ বলল, ‘ও৷ তার মানে তখন কেউ আমাকে চিনিয়ে দিয়েছে৷’

তার কথায় লোকটা আঁধো অন্ধকারে সম্ভবত ঘাড় নাড়ল৷ লোকটা যখন এসেছে তখন ছবি আঁকতে হবে৷ দুবার আঁকা মানে ডবল পয়সা৷ কাজেই পকেট হাতড়ে ঘরের চাবি বার করে নিখিলেশ তার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে ঘরে চলুন৷’ লোকটাকে সাধারণ বলেই মনে হল তার৷

তালা খুলে ঘরে ঢুকল নিখিলেশ৷ তারপর বাতিটা জ্বালাল৷ লোকটাও ঘরে ঢুকল৷ ছোটো ঘর৷ আসবাবপত্র বেশি নেই৷ একটা তক্তপোষ, একটা চেয়ার আর সামান্য কিছু কাজের জিনিস৷ বাইরে বৃষ্টি হলেও ঘরের ভিতর গুমোট ভাব কাটাবার জন্য একটা জানলা খুলে দিল নিখিলেশ৷ তারপর বাতির আলোতে ভালো করে দেখল তাকে৷ নিতান্তই সাদা-মাটা চেহারা লোকটার৷ পরনে সস্তা দামের জামা জলে ভিজে লেপ্টে আছে গায়ে৷ মাথার চুল থেকে জল ঝরছে৷ বছর পঞ্চাশের লোকটার চোখমুখ বিষাদগ্রস্ত৷ চোখের সামনে সহকর্মীর মৃত্যুর ধাক্কাটা সম্ভবত সে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ নিখিলেশ তাকে তক্তপোষে বসতে বলল৷ একটু ইতস্তত করে বসল লোকটা৷ নিখিলেশ লোকটাকে বলল, ‘আপনাকে একটা গামছা দেব? মাথাটা মুছবেন?’ লোকটা বিষাদগ্রস্ত স্বরে বলল, না, তার আর দরকার নেই৷ আমাকে ফিরতে হবে, বুকে বেশ ব্যথা হচ্ছে৷ তাড়াতাড়ি আপনি কাজ করুন৷’

নিখিলেশ এরপর কাগজে মুখাবয়বের ডায়াগ্রাম আঁকতে আঁকতে শুরু করল, ‘আপনিতো যে খুন হয়েছে তার বাড়ি গেছিলেন তাই না? নিশ্চয়ই বাড়ির লোকজন খুব ভেঙে পড়েছে?’

কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা৷ তারপর লোকটা বলল, ‘হ্যাঁ, গেছিলাম৷ সংসারটা ভেসে গেল! বাড়িতে ছোটোছোটো ছেলে-মেয়ে৷ একার রোজগারেই সংসার চলত৷ সব কিছু শেষ হয়ে গেল!’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার গলা থেকে৷ বুকের কাছটা হাত দিয়ে চেপে ধরল লোকটা৷

ডায়াগ্রাম আঁকা শেষ হলে নিখিলেশ নিয়মমাফিক তাকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, লোকটার চুল-দাড়ি ছিল তো?’

লোকটা জবাব দিল, ‘না চুল ছিল না, টাক মাথা৷ তবে চাপদাড়ি ছিল৷’

তার উত্তর শুনে কিছুটা আশ্চর্য হল নিখিলেশ৷ অঘোর বাবুর কথা অনুযায়ীতো লোকটার মাথায় চুল ছিল, আর দাড়ি ছিল না!’

এমনও হতে পারে অঘোরবাবু আর তার কর্মচারী আলাদা-আলাদা লোককে দেখেছে৷ ডাকাতরা তো দু-জন ছিল৷ দু-জনের ছবি পেলে কাজটা আরও সহজ হবে৷ কাজেই, আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ছবিতে মন দিল নিখিলেশ৷ অঘোর বাবুর কর্মচারীর বিবরণ অনুযায়ী এঁকে চলল সে৷ বাইরে বৃষ্টি আরও বাড়ছে৷ বেশ বাতাসও হচ্ছে৷ জানলা দিয়ে আসা সেই বাতাসে কড়িকাঠ থেকে ঝুলন্ত বাতিটা দুলছে৷ নিখিলেশের সামনে বসে থাকা লোকটার মুখ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে৷

এক সময় আঁকা শেষ হল৷ যে ছবিটা এল, তা হল টাকমাথাদাড়িঅলা এক মধ্যবয়সী মানুষের মুখ৷ ছবিটা দেখিয়ে নিখিলেশ লোকটাকে বলল, ‘তাহলে, এই রকমই তো?’

অনেকক্ষণ পর এই প্রথম ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল লোকটার ঠোঁটের কোণে৷ সে প্রথমে বলল, ‘হ্যাঁ, হুবহু এ রকম৷ তারপর নিখিলেশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি ছবিটা ভালোই আঁকেন!’

নিখিলেশ একই কথা শুনেছে অঘোরবাবুর কাছে৷ নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগে৷ নিখিলেশ লোকটাকে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময় বাতি নিভে গেল৷

নিখিলেশ বলল, ‘যাঃ, অন্ধকার হয়ে গেল! আপনি বসুন, আমি মোমবাতি জ্বালাচ্ছি৷’ লোকটা জবাব দিল, ‘না, আর বসব না, কাজ তো শেষ৷ আমাকে থানায় ফিরতে হবে৷’ নিখিলেশ তাকে বলতে যাচ্ছিল, ‘ও মশাই, এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যাবেন কি ভাবে?’ কিন্তু তাকে তাকে সে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা খুলে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় নেমে পড়ল লোকটা৷ নিখিলেশ দরজার কাছে এসে একবার ডাকল তাকে, ‘—শরীর খারাপ হলে আপনি এখানেই থেকে যেতে পারেন—৷’

সে লোকটা যেন শুনতেই পেল না নিখিলেশের কথা৷ ছপছপ শব্দে জল মাড়িয়ে টলতে টলতে লোকটা এগোল গলি ধরে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টিরজলে ঝাপসা হয়ে গেল তার অবয়ব৷ ‘আশ্চর্য লোক তো!’ এই ভেবে দরজা বন্ধ করে দিল নিখিলেশ৷

পরদিন সকাল বেলাতে নিখিলেশ ছবিটা যখন থানায় দিতে গেল, তখন সান্যাল সাহেব কি একটা কাজে গেছেন৷ কাজেই নিখিলেশ তার উদ্দেশ্যে ছবিটা থানার একজনকে দিয়ে, টাকা পরে নিতে আসবে বলে অন্য কাজে চলে গেল৷

তিন

ছবি দিয়ে আসার পর তিনদিন কেটে গেছে৷ দু-দিন ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টি৷ কার্যত গৃহবন্দি অবস্থা নিখিলেশের৷ টিউশন বন্ধ৷ থানাতেও আর টাকা আনতে যাওয়া হয় নি তার৷ দু-দিন পর বিকালের দিকে বৃষ্টি একটু ধরতেই থানা থেকে একজন লোক এসে বলে গেল, সান্যাল সাহেব নিখিলেশকে ডাকছেন৷ নিশ্চই, তাহলে টাকা নিতে ডাকছেন তিনি৷ কথাটা ভেবে নিয়ে নিখিলেশ ছাতা আর ব্যাগ নিয়ে বিকালবেলাই রওনা হল থানার দিকে৷

সান্যাল সাহেব নিজের ঘরেই বসেছিলেন৷ নিখিলেশ তার সামনে বসতেই তিনি হাসি হাসি মুখে টাকার খামটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘খবরটা নিশ্চই শুনেছেন?’ নিখিলেশ বলল, ‘কি খবর?’

সান্যাল সাহেব বললেন, ‘কেসটা তো সলভ হয়ে গেছে৷ আসামী দু-জন ধরা পড়ে গেছে৷ লোকটা গল্পটা বেশ সাজিয়েছিল৷ আপনার দ্বিতীয় ছবিটাই আমার চোখ খুলে দিল৷ আপনি আগে ভাগেই কি ভাবে ধরলেন বলুনতো ব্যাপারটা! আপনি যখন তার কথা শুনে ছবি আঁকছিলেন, তখন তিনি কি মুখ ফসকে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছিলেন?’ নিখিলেশ অবাক হয়ে বলল, ‘আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না৷’

সান্যাল সাহেব বললেন, ‘বোঝার আর কি আছে? ইনসিওরেন্স কোম্পানির থেকে টাকা পাবার লোভে সাজানো ডাকাতিটা এক কর্মচারীকে নিয়ে নিজেই করেন অঘোরবাবু৷

অঘোরবাবুর মুকুন্দ নামের কর্মচারী দলে আসতে না চাওয়াতে তাকে অঘোরবাবুই খুন করেন৷ ডাকাতির ব্যাপারটা আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে তার ফলে৷ অঘোবাবুর মাথায় টাক আছে৷ তিনি উইগ পরেন৷ দাড়িও ছিল৷ ঘটনার দিন ভোরবেলা পুলিশ ডাকার আগে কেটে ফেলেন৷ মাথায় উইগ পড়া, দাড়িহীন অবস্থাতেই আমরা তাকে দেখি৷ অঘোরবাবুর আর এক কর্মী জেরার মুখে স্বীকার করেছে, খুনটা করার সময় অঘোরবাবুর মাথায় পরচুলা বা উইগ ছিল না, আর দাড়ি ছিল৷ ঠিক যেমন আপনি তাকে এঁকেছেন৷ কিন্তু আপনি তার ওই ছবি কীভাবে আঁকলেন? লোকটা জববর ক্যামুফ্লেজ করেছিল!’

নিখিলেশ শুনে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘ওর আর একজন কর্মচারী যাকে থানা থেকে পাঠানো হয়েছিল, তার কথা শুনেই তো ছবিটা আঁকলাম৷ ও দিন সন্ধ্যাবেলা সে তো আমার বাড়ি গেছিল৷’ সান্যাল সাহেব বললেন, ‘কই, আমরা তো তাকে আপনার ওখানে পাঠাইনি৷ ওখানে পাঠাবার জন্য তাকে থানায় আসতে বলেছিলাম৷ সে না আসতেই তো আমাদের প্রথম সন্দেহ হল৷ পরদিন ওকে কলকাতার বাইরে থেকে আরেস্ট করি আমরা৷ ও আপনার ওখানে যায়নি৷ এমনকি সে যে খুন হল তার বাড়িও যায় নি৷ মিথ্যা বলেছিলেন অঘোরবাবু৷’

নিখিলেশ বলল, ‘কিন্তু, আমার ওখানে যে গেছিল সে তো বলল সেও অঘোরবাবুর কর্মচারী!’ সান্যাল সাহেব শুনে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘তাহলে ঘটনার সময় সেখানে কি কোনো লোক ছিল! যে আপনাকে কর্মচারী বলে পরিচয় দিয়েছে৷

আচ্ছা, তাকে দেখতে কেমন?’ নিখিলেশ বলল, ‘মাঝ বয়সী৷ দাঁড়ান, আমি আপনাকে তার ছবি এঁকে দিচ্ছি৷’

সান্যাল সাহেব বলল, ‘হ্যাঁ, আঁকুন৷ তার খোঁজ পেলে মামলাতে সাক্ষী কর যাবে৷’

নিখিলেশ আঁকতে বসল ছবি৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছবিটা এঁকে এগিয়ে দিল সান্যাল সাহেবের দিকে৷ ছবিটা হাতে নিয়ে সেটা দেখে হাঁ হয়ে গেলেন সান্যাল সাহেব৷ তারপর বললেন, ‘এ কি করে সম্ভব? এটা কার ছবি জানেন? মুকুন্দ বলে যে লোকটা খুন হল তার!’

নিখিলেশ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘কিন্তু এই লোকটাই তো গেছিল আমার কাছে!’ সান্যাল সাহেব কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘ব্যাপারটা সম্ভব নয়৷ সে দিন লাশটা থানাতেই ছিল৷ আপনি হয়তো দেখে থাকবেন৷ সেটাই আপনি অবচেতনে এঁকে ফেললেন৷ আপনার মনে হয় আজ শরীর খারাপ৷ এখন বাড়ি যান৷ পরে আসবেন৷’

নিখিলেশ আর সেখানে রইল না৷ মাথাটা এখন তার সত্যিই ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে৷ বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ তার মধ্যেই থানা থেকে বেরিয়ে পড়ল সে৷

বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বাড়ির দরজার কাছাকাছি পৌঁছে গেল নিখিলেশ৷ আর ঠিক সেই সময় পিছনে একটা ছপছপ শব্দ শুনে চমকে ফিরে তাকাল নিখিলেশ৷ হ্যাঁ, সেই লোকটা! কিছু দূরে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে! একটা বিষণ্ণ হাসি তাঁর মুখে৷ লোকটা তার উদ্দেশ্যে শুধু বলল, ‘ছবিটা আপনি ভালোই আঁকেন৷’ বৃষ্টি কথাগুলো বয়ে আনল নিখিলেশের কানে৷ কয়েক মুহূর্ত মাত্র৷ তারপরই বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেল তার অবয়ব৷ বর্ষণসিক্ত গলিতে শুধু ম্যাটম্যাটে আলো ছড়াচ্ছে বাতিটা৷ কেউ কোথাও নেই৷ নিখিলেশ এগোল তার দরজার দিকে৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *