চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(১)
পরের দিন একটু সকালের দিকে আদিত্য সোহিনী মৈত্রকে ফোন করল।
‘বলুন আদিত্যবাবু’ সোহিনীর গলায় হালকা উৎকণ্ঠা, ‘ক’দিন ধরেই মনে হচ্ছিল আপনার কাছ থেকে এবার একটা ফোন আসবে। কোনও খবর আছে?’
‘তেমন খবর এখনও কিছু নেই। শুধু জানিয়ে রাখি, শঙ্খমালা এবং শঙ্খদীপ দুজনের সঙ্গেই কথা হয়েছে। এবার মন্দাকিনী চৌধুরির সঙ্গে কথা বলা দরকার। সেইজন্য আপনাকে ফোন করলাম। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে হবে।’
‘এখখুনি তো হবে না। মা দুদিন আগে বিদেশ গেছে। ব্যবসার কাজে অনেকগুলো দেশ ঘুরবে। ঠিক কবে ফিরবে আমিও জানি না। একবার যেন বলেছিল কুড়ি-পঁচিশ দিন বাদে ফিরবে। তবে আমি নিশ্চিত নই। ফিরলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেব।’
‘ঠিক আছে। উনি ফিরলেই না হয় ওঁর সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু চৌধুরি প্যালেসের পুরোনো কর্মচারী, মন্দাকিনী চৌধুরির ড্রাইভার, সুবীর চৌধুরি যে ল ফার্মকে দিয়ে উইল করিয়েছিলেন, এদের সবার সঙ্গেই কথা বলা দরকার। আপনি কি তার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?’
‘ড্রাইভার এবং কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাদের আপনি কী বলবেন? সুবীর চৌধুরির ওপর বই লিখছেন?’
‘তাই বলব। খুব বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। মন্দাকিনীর ড্রাইভার শৈলেনবাবু, দীননাথ যোশি আর ধরুন এই পুরোনো ম্যানেজার গোছের যদি কেউ থাকেন, যিনি অনেক দিন ধরে সুবীর চৌধুরিকে কাছ থেকে দেখেছেন।’
‘দীননাথ যোশি তো এখানে থাকে না। যতদূর জানি চা-বাগানের কোয়ার্টারে থাকে। আমিই তাকে কখনও দেখিনি। তার সঙ্গে দেখা করানো শক্ত। আর মা বিদেশ গেছেবলে শৈলেনবাবু খুব সম্ভবত ছুটি নিয়েছেন। তবু আমি চেষ্টা করছি। আর পুরোনো ম্যানেজার বলতে আছেন শিশির চ্যাটার্জি। তিনি বৃদ্ধ মানুষ, চৌধুরি এন্টারপ্রাইজ থেকে রিটায়ার করে এখন চৌধুরি প্যালেসের দায়িত্বে আছেন। তার সঙ্গে কথা বললে আপনার অনেকটা কাজ হয়ে যাবে।’
‘আর সুবীর চৌধুরির ল ফার্ম?’
‘ওই ব্যাপারটা আমি ঠিক জানি না। ওটার জন্য মা ফিরে আসা অব্দি আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। অন্য দুজনের সঙ্গে যাতে আজই কথা বলা যায় আমি তার জন্য চেষ্টা করছি।’
বেলা বারোটা নাগাদ বেহালাগামী মিনিবাসটা বাঁক নেবার আগে আদিত্যকে একটা তেমাথায় নামিয়ে দিল যার একটা মুখ আলিপুর পার্ক রোড। সোহিনী বলে দিয়েছিল ওই রাস্তাটা ধরে খানিকটা হাঁটলেই বাঁ-হাতে চৌধুরি প্যালেস পড়বে। গেটের দরোয়ানের কাছে আদিত্যর নাম দেওয়া আছে। আদিত্য গিয়ে নিজের নাম বললে দরোয়ানই দেখিয়ে দেবে কোথায় যেতে হবে। অঞ্চলটা আদিত্যর পুরোনো পাড়া। অবস্থা পড়ে যাবার আগে তারা তেমাথার অন্য মুখ, বর্ধমান রোডে থাকত। এখন অবশ্য তাদের সেই পুরোনো বাড়িটা ভেঙে হাইরাইজ উঠেছে। এদিকটা আদিত্যর অনেকদিন আসা হয়নি। সে খেয়াল করল অঞ্চলটা অনেকটাই বদলে গেছে। নতুন নতুন হাইরাইজ হয়েছে, কিছু নতুন দোকানপাটও হয়েছে, জনবসতি নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে। তেমাথায় নেমে আদিত্য রাস্তার একটা দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেল। সিগারেট খেল। চারদিকটা তারিয়ে তারিয়ে দেখল। অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ওই সামনের রাস্তাটা দিয়ে সে ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরত। তখনও তেমাথার কোনায় ওই ছোট্ট মনিহারি দোকানটা ছিল। ক্রিকেট তারকাদের ছবিওলা স্টিকার পাওয়া যেত সেখানে। এক একটা চুয়িং গামের প্যাকেটের ভেতরে থাকত এক একটা স্টিকার। কিন্তু সেসব কেনা আদিত্যর বারণ ছিল। তার জন্য নিউ মার্কেটের বড় দোকান থেকে ফলের গন্ধ মেশানো অ্যামেরিকান বাবল গাম আসত। কিন্তু তার ভেতরে তো আসল জিনিস অর্থাৎ স্টিকারটাই থাকত না। সে যে কী গভীর দুঃখ আদিত্য কাউকে বোঝাতেই পারেনি। বাবাকেও না। মাঝে মাঝে দরোয়ানের সাহায্যে সে একটা-দুটো স্টিকারওলা চুয়িং গাম কিনতে পারত। অবশ্যই বাবাকে লুকিয়ে। বাবার ধারণা ছিল ওইসব জিনিস খেলে শরীর খারাপ হবে।
চৌধুরিদের গেটে পৌঁছে আদিত্য নিজের নাম বলতেই দরোয়ান দরজা খুলে দিল। ইন্টারকমে কারও সঙ্গে কী একটা কথা হল তার, সে আদিত্যকে বলল, লনের চারপাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটা ধরে খানিকটা এগোলেই চৌধুরিদের একতলা বারবাড়ি। সেখানে কেউ একজন আদিত্যকে রিসিভ করবে। লনটা সত্যিই মনোরম। একদিকে শীতশেষের বর্ণময় মরশুমি ফুল, ডালিয়া, জিনিয়া, বোহিনিয়া। পাশে অর্কিডদের ঘর। আর একটু হাঁটতেই আদিত্য বারবাড়িটা দেখতে পেল। এক সময় এখানে বোধহয় বাইজি-টাইজি নাচত, এখন কী হয় ভগবান জানেন। বারবাড়ির সামনে এক পক্ককেশ দীর্ঘকায় পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। আদিত্যকে দেখতে পেয়ে বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন, নমস্কার করে বললেন, ‘আমি শিশির চ্যাটার্জি, চৌধুরিদের এই প্রপার্টিটা দেখাশোনা করি। সোহিনী ম্যাডাম আপনার কথা বলেছেন। বলেছেন, আপনি চৌধুরিদের নিয়ে একটা বই লিখছেন। আমাকে কিছু প্রশ্ন করবেন। চলুন আমরা বারবাড়িতে গিয়ে বসি।’
‘আচ্ছা এই বারবাড়ি ব্যাপারটা কী? কী হয় এখানে?’ আদিত্য শিশির চ্যাটার্জির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল।
‘শুনেছি বহুদিন আগে এখানে নাচগান হত। সুবীর চৌধুরি নাচগানের খুব একটা ভক্ত ছিলেন না। উনি এই জায়গাটাকে নিজের আপিস হিসেবে ব্যবহার করতেন। বিবাদী বাগে অবশ্য ওঁর আসল আপিসটা ছিল। এখনও আছে। কিন্তু ব্যবসার কিছু গোপনীয় কথাবার্তা উনি এখানে বসেই সারতেন। ওঁর মৃত্যুর পর মন্দাকিনী ম্যাডামও সেইভাবেই জায়গাটা ব্যবহার করেন।’
কথা বলতে বলতে তারা বারবাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছিল। ঢুকেই একটা মস্ত হলঘর। গোল টেবিল। টেবিল ঘিরে অন্তত গোটা কুড়ি চেয়ার। আদিত্য লক্ষ্য করল মাথার ওপরে একটা ওভারহেড প্রোজেক্টর, তার সামনের দেয়াল জুড়ে পেল্লায় স্ক্রিন। বিজনেস প্রেসেন্টেশনের উপযুক্ত সরঞ্জাম বটে।
শিশিরবাবু আদিত্যকে নিয়ে হলঘরের লাগোয়া একটা ছোট ঘরে বসাল। বলল, ‘আপনি বসুন স্যার। আমি প্রথমে ড্রাইভার শৈলেনবাবুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। চা খাবেন তো?’
শৈলেনবাবু এলেন মিনিট পাঁচেক পর। কাঁচাপাকা চুল, ছোটখাটো চেহারা। বয়েস মনে হয় ষাট পেরিয়েছে। তিনি বসতে না বসতে টি-কোজি ঢাকা টি-পটে চা এল, সঙ্গে কিছু সৌখিন বিস্কুট। উর্দিপরা বেয়ারা পট থেকে চা ঢেলে দিয়েছে। আদিত্য চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েমোবাইলের অডিওটা অন করে বলল,
শৈলেনবাবু, আপনি এই বাড়িতে কতদিন কাজ করছেন?’
‘এখানেই বড় হয়েছি সাহেব। আমার বাবা চৌধুরিদের গাড়ি চালাত। আমার লাইসেন্স হবার পর বাবাই এখানে কাজে ঢুকিয়ে দেয়।’
‘আপনি তো সুবীর চৌধুরির গাড়ি চালাতেন?’
‘প্রথমে কিছুদিন বড় সাহেবের বাবার গাড়িও চালিয়েছি। তাকে আমরা কত্তাবাবা বলতাম। তারপর তিনি আর বাড়ি থেকে তেমন বেরোতে পারতেন না। সেই সময় এক্রামুল বড় সাহেবের গাড়ি চালাত আর মেমসাহেবের গাড়ি চালাত আমার বাবা। এই মেমসাহেব নয়, আগের মেমসাহেব।’
‘বুঝেছি, তারপর?’
‘এক্রামুল গাড়ির ব্যবসা করবে বলে কাজ ছেড়ে দিল। তখন থেকে আমি বড় সাহেবের গাড়ি চালাচ্ছি।’
‘সেটা কত বছর হবে?’
‘ঠিক হিসেব নেই সাহেব। পঁচিশ-তিরিশ বছর তো হবেই।’
‘বড় সাহেব মারা যাবার পর আপনি কার গাড়ি চালাতেন?’
‘বড় সাহেব মারা যাবার পর থেকে নতুন মেমসাহেবের গাড়ি চালাচ্ছি।’
আদিত্য প্রসঙ্গ পালটাল। শৈলেন ড্রাইভারের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার বড় সাহেব মানুষ কেমন ছিলেন?’
‘খুব গম্ভীর মানুষ ছিলেন। কম কথা বলতেন। তবে খুব দয়ালুও ছিলেন।’
‘দয়ালু?’
‘হ্যাঁ সাহেব। আমার বিপদে-আপদে তিনি অনেক সাহায্য করেছেন। শুধু আমাকে নয়, কর্মচারীদের অনেককে। চৌধুরি বাড়ির কর্মচারীরা তাই তাঁকে দেবতার মতো ভক্তি করত। পুরোনো মেমসাহেবও খুব ভাল ছিলেন। তাঁর কাছে একবার গিয়ে কেঁদে পড়লে আর চিন্তা নেই। খুব বড় মন ছিল। হবে না? কত বড় বংশের মেয়ে।’
‘আর নতুন মেমসাহেব? তিনি কেমন মানুষ?’
শৈলেন কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। মাথা নিচু করে নিরুত্তর রইল। আদিত্য বুঝতে পারল সে এ নিয়ে আর কোনও কথা বলতে চায় না। তাকে চাপাচাপি করাটা ঠিক হবে না ধরে নিয়ে আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার বড় সাহেবের মৃত্যুটা নিশ্চয় আপনার মনে আছে। কী ভাবে আপনার বড় সাহেব মারা যান?’
‘বেশ কিছুদিন ধরে বড় সাহেব হার্টের অসুখে ভুগছিলেন। নিয়মিত ডাক্তার দেখাতেন,তবু হার্টের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। শেষে মস্ত হার্ট অ্যাটাক হল। তাতেই চলে গেলেন।’
‘উনি কি বাড়িতেই মারা গিয়েছিলেন নাকি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?’
‘বাড়িতে একটা অ্যাটাক হয়েছিল। তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি নতুন মেমসাহেবকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে পেছন পেছন গেলাম। শুনেছি, সেই রাত্তিরে আরও দু’বার বড় বড় অ্যাটাক হয়েছিল। সেগুলো আর সামলান গেল না।’
‘কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?’
‘আলিপুর চিড়িয়াখানার কাছে একটা নতুন হার্টের হাসপাতাল হয়েছে, সেখানে। নামটা ঠিক বলতে পারব না। কী যেন একটা ইংরিজি নাম। বড় সাহেব ভর্তি হবার বছর খানেক আগে হাসপাতালটা খুলেছে।’
‘বুঝেছি। ক্যালকাটা ইন্সটিটিউট অফ কার্ডিওলজি।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওইরকম একটা নাম। ওটাই হবে।’
‘আপনার বড় সাহেবকে কোন ডাক্তার দেখেছিলেন?’
‘হাসপাতালে কে দেখেছিলেন বলতে পারব না। তবে এমনিতে সাহেবকে নিয়মিত দেখতেন ডাক্তার সেনগুপ্ত, পার্ক স্ট্রিটে যাঁর চেম্বার। আমি প্রত্যেক মাসে বড় সাহেবকে সেখানে নিয়ে যেতাম।’
‘ডাক্তার রণবীর সেনগুপ্ত? উনি তো খুব বড় হার্টের ডাক্তার। অনেকে বলে কলকাতার এক নম্বর।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। উনিই। নামটা ভুলে গিয়েছিলাম।’
আদিত্য কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘আপনাকে একটা অন্য প্রশ্ন করব। একটু ভেবে উত্তর দেবেন। আপনার কি মনে হয় আপনার বড় সাহেবের কোনও শত্রু ছিল?’
প্রশ্নটা শুনে শৈলেন বেশ থতমত খেয়ে গেল। তার মুখ দেখে মনে হল সে মোটেই এই প্রশ্নটার জন্য তৈরি ছিল না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আদিত্য বলল, ‘আপনাকে এই প্রশ্নটা করছি কারণ ড্রাইভাররা মালিকদের অনেক গোপন কথা জানতে পারে যেটা অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। ধরুন গাড়ির মধ্যে একটা ফোন এসে গেল কিংবা বিশেষ কাউকে সঙ্গে নিয়ে মালিক গাড়িতে উঠলেন এবং তাঁর সঙ্গে গাড়িতে যেতে যেতেই অনেক দরকারি কথা সেরে ফেললেন। সেইসব ফোন থেকে বা কথাবার্তা থেকে ড্রাইভারের পক্ষে অনেক গোপন কথা জেনে ফেলা সম্ভব।’
এবার শৈলেনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘যদি আমি আমার মালিকের কোনও গোপন কথা জেনেও থাকি সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করব কেন? আমি মালিকের নুন খেয়েছি। তার সঙ্গে গদ্দারি করলে আমার নরকেও জায়গা হবে না।’
তাকে শান্ত করার জন্য আদিত্য এক গাল হেসে বলল,
‘আরে আমি সেরকম কিছু জানতে চাইনি। আমি শুধু বলছিলাম যে আপনার বড় সাহেব তো খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। এত তাড়াতাড়ি তাঁর যাবার কথা ছিল না। হয়তো তাঁর ভেতরে কোনও একটা অশান্তি ছিল, যে অশান্তি তাঁর হার্টের অসুখের কারণ। জানেন তো, মনের ভেতরে অশান্তি থাকলে হার্টের অসুখ হতে পারে। তাই জানতে চাইছিলাম আপনার বড় সাহেবের মনের মধ্যে তেমন কোনও অশান্তি ছিল কিনা।’
শৈলেন কিছুটা ঠান্ডা হল। শান্ত গলায় বলল, ‘দেখুন, অশান্তি বলতে যদি আপনি দুশ্চিন্তা বলেন তাহলে সেটা বড় সাহেবের প্রচুর পরিমাণে ছিল। এত বড় ব্যবসা চালাচ্ছেন, দুশ্চিন্তা থাকবে না? গাড়িতে উঠেই নানা জায়গায় ফোন করতেন, ব্যবসার খবর নিতেন। কখনো কখনো গলার স্বর বেশ খুশি-খুশি শোনাত, কখনো কখনো বেশ গম্ভীর। এমনও হয়েছে, একটা ফোন এল, অমনি সাহেব এমন গম্ভীর হয়ে ভাবনায় ডুবে গেলেন যে কখন আপিস এসে গেছে টেরও পেলেন না। আর একটা কথা। মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে থেকে সাহেবের শরীরটা মনে হয় ভাল যাচ্ছিল না, কারণ উনি মাঝে মাঝেই গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়তেন। আপিস পৌঁছে গেছি তখনও ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। ডেকে তুলতে হত। এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারব না।’
শৈলেন ওঠার জন্য উসখুস করছিল। আদিত্য সেটা লক্ষ করে বলল, ‘আপনাকে আর একটাই প্রশ্ন করব। কিছুদিন আগে আপনি যখন নতুন মেমসাহেবকে নিয়ে পৈলানের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন উল্টোদিক থেকে একটা ট্রাক এসে আপনাদের গাড়িতে ধাক্কা মারে। শুনেছি, আপনার একটু চোটও লেগেছিল। ঘটনাটার কথা একটু বলবেন?’
প’ওটা একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা। আমি এতদিন গাড়ি চালাচ্ছি কখনও এমন হয়নি। আপনাকে আমি গর্ব করে বলতে পারি সাহেব, এতদিন গাড়ি চালাচ্ছি একবারের জন্যেও কেস খাইনি। ছোটখাটো সিগনাল ভাঙার কেসও না। যেদিন এবাড়িতে প্রথম গাড়ি চালাতে আসি কত্তাবাবা বলে দিয়েছিলেন, শোনো শৈলেন, গাড়ি চালানোর সময় সর্বদা মনে রাখবে তুমি আগুন নেভাতে যাচ্ছ না। তারপর যখন বড় সাহেবের গাড়ি চালাতে এলাম প্রথম দিকে উনি মাঝেমাঝেই বলতেন, শৈলেন, গাড়ি চালানোর সময় কখনও তাড়াহুড়ো করবে না। মনে রাখবে, আমি কারও চাকরি করি না, তাই দু’চার মিনিট পরে পৌঁছলে আমার চাকরি চলে যাবে না। আমি কথাগুলো মনে রেখেছিলাম।’
‘তাহলে সেদিনও আপনি সাবধানেই চালাচ্ছিলেন।’
‘আমি অকারণ জোরে গাড়ি চালাতে পারি না। সেদিন অবশ্য নতুন মেমসাহেব একটু তাড়া দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, পৈলানের ফ্যাক্টরি ছাড়াও ওঁকে আরও কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে। তাই আমি যেন একটু তাড়াতাড়ি চালাই। ওঁর কথা শুনে জোকা পেরোনোর পর আমি ষাট-এ ইস্পিড তুললাম। হঠাৎ উল্টোদিকের একটা অর্ধেক তৈরি হওয়া বাড়ি থেকে একটা লরি বেরোল। ওই যেরকম লরি ইট-বালি-সিমেন্ট নিয়ে যায়। আমি ধরে নিয়েছিলাম লরিটা আমার জন্য দাঁড়াবে। দাঁড়াল না। আমি যেদিকে যাচ্ছি তার উল্টোদিকে যাবার জন্য বাঁদিকে টার্ন নিল। এতেও কোনও অসুবিধে হত না, যদি লরিটা আমার উল্টোদিকের লেনেই থাকত। সেটা না থেকে আমার লেনে ঢুকে লরিটা সজোরে আমার গাড়িটাকে ধাক্কা মারল। কোন উজবুক চালাচ্ছিল কে জানে, বোধহয় শালার লাইসেন্সও হয়নি। আমার কপালটা ফাটল, ঠাকুরের কৃপায় প্রাণে বেঁচে গেলাম। গাড়িটা ধানখেতে নেমে গেল। নতুন মেমসাহেব যদি আমার ঠিক পেছনে বসে থাকতেন, উনিও রেহাই পেতেন না। আমার দিকের দরজা আর আমার পেছন দিকের দরজা দুটোই ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। ভাগ্য ভাল, মেমসাহেব আমার ঠিক পেছন দিকের জানলার ধারে না বসে ওপাশের জানলার ধারে বসেছিলেন। তাই ওঁর কোনও চোট লাগেনি। আমাদের মেরেই গাড়িটা পালিয়ে গেল। নম্বরটা পর্যন্ত নিতে পারলাম না।’
‘সেদিন কী গাড়ি চালাচ্ছিলেন?’
‘শহরের মধ্যে মেমসাহেব একটা ফেরারি চড়েন। আমিই চালাই। কিন্তু শহরের বাইরে যেতে হলে ফেরারিটা কখনও নেন না। খুব দামি গাড়ি কিনা। শহরের বাইরে যেতে হলে কখনও নতুন মার্সিটিজটা নেন, কখনও একটা পুরোনো হন্ডা অ্যাকর্ড আছে সেটা নেন। সেদিন অ্যাকর্ডটা নিয়েছিলেন। গাড়িটা পুরোনো হলে কী হবে, চলে বাঘের বাচ্চার মতো। সরাসরি জাপান থেকে আনানো তো।’
শৈলেন ড্রাইভার থামল। আদিত্যর মনে হল শৈলেনের কাছ থেকে যেটুকু জানার ছিল মোটামুটি জানা হয়েছে। যেটা বাকি রয়ে গেল, সেটা শৈলেন এখনই বলবে না। সে মুখে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ শৈলেনবাবু। আপনি এখন আসতে পারেন। আপনি ফিরে গিয়ে দয়া করে ম্যানেজারবাবুকে একটু পাঠিয়ে দেবেন।’
আদিত্য অডিওটা বন্ধ করে দিল।
(২)
আদিত্য আগেই লক্ষ করেছিল বয়েস আন্দাজে শিশির চ্যাটার্জি বেশ শক্তপোক্ত আছেন। এবার শিশির চ্যাটার্জি তার সামনে এসে বসার পরে আদিত্যর মনে হল ভদ্রলোকের বয়েস পঁচাত্তরের কম হবে না। গাল দুটো ভেঙে গেছে বটে, চুলও একেবারে ধপধপে সাদা, কিন্তু চোখের দৃষ্টি এখনও বেশ সজাগ।
আদিত্য কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শিশিরবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি যে বইটা লিখবেন সেটার প্রকাশক পেয়েছেন?’
‘না। প্রকাশক জোগাড় করার ব্যাপারে আমার কোনও দায়িত্ব নেই। আসলে মন্দাকিনী চৌধুরি আমাকে বইটা লিখতে বলেছেন। বইটা লেখা হয়ে গেলে পাণ্ডুলিপিটা তাঁর হাতে তুলে দেব। তিনি সেটা নিয়ে কী করবেন সেটা তিনিই ঠিক করবেন। আমি শুধু একটা পারিশ্রমিক পাব। তবে তাঁর সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছে, বইটা যদি কখনও ছাপা হয় তাহলে লেখক হিসেবে আমার নামটাই থাকবে।’
‘মন্দাকিনী ম্যাডামের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হল কীভাবে?’
‘ওঁর মেয়ে সোহিনীর মাধ্যমে। আমাদের কিছু কমন ফ্রেন্ড আছে।’
‘আপনি কি কোথাও সাংবাদিকতা করেন?’
‘টুকটাক লিখি, তবে ফ্রি লান্স।’
‘চিরদিনই ফ্রি লান্স নাকি কখনও চাকরি করেছেন?’
‘কিছুদিন একটা বাংলা কাগজে কাজ করেছি।
‘কোন কাগজে কাজ করেছেন?’
আদিত্য একটা বিখ্যাত বাংলা দৈনিকের নাম বলল যেখানে তার একাধিক বন্ধু কাজ করে এবং সেই বন্ধুদের সুবাদে সেই কাগজের আরও কয়েকজনকে আদিত্য চেনে।
‘মহীতোষ চ্যাটার্জিকে চেনেন? আমার ভাইপো। অনেক দিন ওখানে কাজ করেছে। এখন রিটায়ার্ড। রিটায়ার করার আগে বোধহয় নিউজ এডিটরও হয়েছিল। নিশ্চয় চেনেন?’
বলাই বাহুল্য, ওই নামে আদিত্য কাউকে চেনে না। কিন্তু সে কি মিথ্যে করে চিনি বলবে? নামটা যদি খুব প্রমিনেন্ট কারও হত সে নিশ্চয় শুনত। আদিত্য জানে অকারণে মিথ্যে বলতে নেই। একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘ঠিক চিনতে পারছি না। কবে কাজ করতেন?’
‘চিনতে পারার কথাও নয়। ও নামে কেউ নেই। কিছু মনে করবেন না আদিত্যবাবু আপনাকে একটু পরীক্ষা করে দেখছিলাম। চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর তো শত্রুর অভাব নেই, তাই একটু সতর্ক থাকতেই হয়। মন্দাকিনী ম্যাডামের ততটা অভিজ্ঞতা নেই, না জেনে কোনও অবাঞ্ছিত লোককে ঢুকিয়ে দিতেই পারেন। আমরা পুরোনো লোক, অনেক দেখেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে অচেনা কাউকে কোম্পানির ভেতরের কথা বলার আগে তাকে বাজিয়ে দেখে নেওয়াটা জরুরি। যাইহোক, আপনি পরীক্ষায় পাশ করে গেছেন। এবার বলুন আপনার কী জিজ্ঞাস্য।’
আদিত্যর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। সে বলল,
‘আমাদের কথাবার্তা টেপ করতে পারি?’
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘কথাবার্তা টেপ না করাই ভালো। আমি সেকেলে লোক, তাই হয়তো একটু বেশি সতর্ক। কিন্তু আগে থেকে তো বোঝা যায় না কোন কথা কীভাবে কম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। কথা টেপ না করে আপনার মাথায় ধরে রাখুন।’
‘কোনও অসুবিধে নেই। আমি টেপ করছি না।’ আদিত্য মোবাইলটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘আপনি তো সুবীর চৌধুরির বাবার আমল থেকে এই কোম্পানিতে আছেন। যদি সংক্ষেপে এই কোম্পানির ইতিহাসটা একটু বলেন, মানে আপনি যতটুকু দেখেছেন।’
‘আমার এখন আটাত্তর চলছে। পঁচিশ বছর বয়েসে এই কোম্পানিতে ঢুকেছিলাম। সেটা ছিল নাইনটিন সিক্সটি ফাইভ। তখন সুবীর চৌধুরির বাবা সুবিমল চৌধুরির আমল। আমি এম কম-এ ফাস্ট ক্লাস পেয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হব। বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না তাই চাটার্ড পড়া হল না। চাকরিতে ঢুকে যেতে হল। সুবিমল চৌধুরি নিজে আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। আমাকে পছন্দ করতেন।’
‘তখন কোম্পানির অবস্থা কেমন ছিল?’
‘দেখুন চৌধুরিদের তো অনেক পুরুষের ব্যবসা। সাধারণত এত পুরুষ ব্যবসা টেকে না। স্বাভাবিক কারণেই ভাইদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। আর সব ভাইয়ের তো আর সমান ব্যবসা করার ক্ষমতা থাকে না। সুবিমল চৌধুরি, সুবীর চৌধুরিরা চৌধুরি বংশের যে মূল ধারাটার প্রতিনিধি তারা কিন্তু সৌভাগ্যবশত প্রত্যেকেই বিচক্ষণ ছিলেন। অর্থাৎ সুবিমল চৌধুরি-সুবীর চৌধুরির পূর্বপুরুষেরা প্রত্যেকেই ছিলেন ধুরন্ধর ব্যবসাদার। তাই চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর এত রমরমা। আমি যখন এই কোম্পানিতে আসি তখন থেকেই এই রমরমা দেখছি। তবে এখানে কয়েকটা কথা আছে। সুবিমল চৌধুরি ছিলেন সাবধানী মানুষ। নতুন রাস্তায় হাঁটা তাঁর ধাতে ছিল না। যেটুকু আছে সেটাকেই পরম যত্নে আগলে রাখতেন তিনি। আমার চরিত্রে যে সাবধানতা আছে সেটা তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। আমি তাঁর কাছেই কাজ শিখেছি কিনা। সুবীর চৌধুরির চরিত্রটা ছিল ঠিক তাঁর বাবার উল্টো। তিনি ঝুঁকি নিতে ভালবাসতেন। তাই নতুন নতুন ব্যবসায় তিনি টাকা ঢেলেছেন। আর এটা স্বীকার করতেই হবে যে ব্যবসার ব্যাপারে তাঁর একটা আশ্চর্য সিক্সথ সেন্স কাজ করত। তিনি জীবনে কোনও দিন কোনও ব্যবসায় লোকসান দেননি। যেখানে টাকা ঢেলেছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। অনেকেই মনে করেন, চৌধুরি বংশের শ্রেষ্ঠ বিজনেস ট্যালেন্ট হলেন সুবীর চৌধুরি।’
উর্দিপরা বেয়ারা আবার চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। দুজনকে চা ঢেলে দিল। সেই অবসরে শিশির চ্যাটার্জি একটু থামলেন। চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন, ‘ভগবান বোধহয় সব কিছু এক সঙ্গে দেন না। সুবীর চৌধুরিকে যেমন হাত উজাড় করে ভগবান ব্যবসাবুদ্ধি দিয়েছেন তেমনি তাঁর একমাত্র ছেলে শঙ্খদীপকে শুধু ব্যবসাবুদ্ধি কেন, কোনও বুদ্ধিই দেননি। উল্টে একগাদা কুবুদ্ধি দিয়েছেন। বলতে বাধ্য হচ্ছি, শঙ্খদীপের মতো এতটা উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষ আমি অন্তত খুব একটা দেখিনি। তিনি যদি একটু স্বাভাবিক হতেন, তাহলে আজ চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর এই হাঁড়ির হাল হত না।’
‘হাঁড়ির হাল? চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর?’ আদিত্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ। হাঁড়ির হাল। এটা এখন বিজনেস মহলে সকলেই জানে। প্রতি বছর প্রফিট কমে যাচ্ছে। অনেকগুলো ব্যবসা বিক্রি হয়ে গেছে। গত বছর ব্যালেন্স শিটে লস দেখানো হয়েছে, কোম্পানির ইতিহাসে যা আগে কখনও হয়নি।’
‘কবে থেকে এরকম হল?’
‘বলতে পারেন, সুবীর চৌধুরি মারা যাবার পর থেকেই কোম্পানির পতন শুরু হয়েছে। একটা কথা খোলাখুলি মেনে নেওয়াই ভাল। মন্দাকিনী চৌধুরির কোনও বিজনেস অ্যাকুমেন নেই। উনি মূলত একজন শিল্পী মনের মানুষ। শুনেছি বিয়ের আগে অভিনয় করতেন। কিন্তু এতবড় একটা ব্যবসা চালাতে গেলে যে ধরনের মেধা লাগে সেটা তাঁর নেই। যদি শঙ্খমালা সেন কোম্পানি চালাতেন তাহলে কোম্পানির এই অবস্থা হত না। শঙ্খমালা সেনের বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর আমার অন্তত অনেক বেশি আস্থা আছে। যাইহোক, সেসব তো আর হবার নয়, যা ভজঘট একটা উইল করে গেছেন সুবীর চৌধুরি। থাক সেসব কথা। আশা করি আমার এই কথাগুলো আপনি আপনার বইএ ডিসক্রিটলি ব্যবহার করবেন। অন্তত আমার মুখে বসাবেন না। এবার বুঝতে পারছেন তো কেন আপনাকে আমাদের কথাবার্তা টেপ করতে দিইনি।’
ঘরে একটা স্তব্ধতা বিরাজ করছে। আদিত্যই প্রথমে স্তব্ধতা ভেঙে বলল, ‘গত বছর এই বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল। তার ছিঁড়ে বাড়ির লিফটটা তিনতলা থেকে একতলায় পড়ে গিয়েছিল। আপনার নিশ্চয় ঘটনাটা মনে আছে?’
শিশির চ্যাটার্জির মুখে আঁধার ঘনিয়ে এল। শঙ্কিত গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন করছেন কেন? এই ঘটনাটাও আপনার বইএ লিখবেন নাকি?’
‘না, না। এসব বইএ লেখার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু চৌধুরি বাড়ির অন্দরমহলের একটা দুর্ঘটনা থেকে সেখানকার বর্তমান টেনশনগুলো বোঝবার চেষ্টা করছি। আর একটু পরিষ্কার করে বলি। আপনার কি মনে হয়, লিফট ভেঙে পড়ার পেছনে কোনও ফাউল প্লে থাকতে পারে?’
শিশির চ্যাটার্জির মুখের ওপর নিমেষে চার-পাঁচ রকম অভিব্যক্তি খেলে গেল। ভয়, উদ্বেগ, বিরক্তি, ক্রোধ, তিক্ততা। কী একটা বলতে গিয়ে তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘আপনার প্রশ্ন যদি এটা হয় যে, কেউ মন্দাকিনী চৌধুরিকে খুন করার চেষ্টা করছে কিনা, তাহলে আমি বলব, সম্ভাবনাটা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাঁকে অপছন্দ করে এমন লোকের অভাব নেই। তাঁর মৃত্যুতে লাভবান হবেন এমন মানুষও একাধিক। এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারব না। অনুরোধ করব, এসব কথা আপনার বইতে না লিখতে। লিখলে কিন্তু আমি অস্বীকার করব। আইনের সাহায্যও নিতে পারি। কথাটা মনে রাখবেন। আমার মনে হয় আমাদের ইন্টারভিউ এখানেই শেষ।’
শিশির চ্যাটার্জি উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়িয়ে আবার বললেন, ‘আদিত্যবাবু আপনার সঙ্গে আমার কথা শেষ। আপনি এবার আসুন।’
(৩)
দেখতে দেখতে প্রায় তিনটে সপ্তাহ কেটে গেল। বলা যায়, ঘটনাহীনভাবেই কেটে গেল। মেসের খাটে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করা ছাড়া আদিত্যর হাতেও তেমন কোনও কাজ নেই। চৌধুরি বাড়ি সম্বন্ধে একটা আবছা ধারণা আদিত্যর মনে তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু মন্দাকিনী চৌধুরির সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত ধারণাটা কিছুতেই দানা বাঁধছে না। তিন সপ্তাহের মধ্যে সোহিনী বার দুয়েক ফোন করেছিল। দু’বারই আদিত্য জানিয়েছে মন্দাকিনী চৌধুরির সঙ্গে কথা বলার আগে সে এই কেসটা সম্বন্ধে কোনও মতামত দিতে রাজি নয়।
এর মাঝে একটা রবিবার স্যমন্তক তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছিল। ওদের বাড়িটা কলকাতার বাইরে, নরেন্দ্রপুর-সোনারপুর ছাড়িয়ে। ফলে আদিত্যর একটা আউটিং হল। স্যমন্তক তার বউকে মনে হয় আগে থেকেই বলে রেখেছিল তাদের বাড়িতে একজন জ্বলজ্যান্ত গোয়েন্দা নেমন্তন্ন খেতে আসছে। ফলে স্যমন্তকের বউ অমিতা প্রথম প্রথম আদিত্যর সঙ্গে ঠিক সহজ হতে পারছিল না। একটু দূর থেকে নজর রাখছিল। একটু পরেই অবশ্য অমিতার সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। ওদের এখনও ছেলেপুলে হয়নি। তাই সংসারে বেশ একটা ছাড়া ছাড়া বোহেমিয়ান ভাব আছে। সারাদিন নির্ভেজাল আড্ডা হল। গান-টান হল। প্রচুর খাওয়াদাওয়াও হল। অমিতা দুর্ধর্ষ রান্না করে আবার মোটামুটি ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীতও গায়। স্যমন্তকের গানের গলাও মন্দ নয়। গান গাওয়ার ব্যাপারে কাউকেই দু-বার বলতে হয় না। কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু স্যমন্তকরা কেউই খুব পরিষ্কার করে নীলাঞ্জন মৈত্রর হদিশ দিতে পারল না। অমিতা শুধু বলল, ‘আমি যতদূর জানি অনেক দিন আগে আমহার্স স্ট্রিটের কোনও একটা বাড়ির একতলার একটা ঘরে প্রান্তিক-এর রিহার্সাল হত। এখন আর হয় কিনা জানি না। তখন রবিবার আর শো-এর দিন বাদে রোজই রিহার্সাল হত। আমাদের দলের সুদীপ্ত এক সময় প্রান্তিক-এ ছিল। ও গল্প করেছিল।’
‘সুদীপ্ত-র সঙ্গে একবার দেখা করা যেতে পারে?’
‘অবশ্যই। তুই যে-কোনও উইক ডে রাত্তির নটার পর কালীঘাটে, আমরা যেখানে রিহার্সাল দিই, সেখানে চলে আয়। সুদীপ্ত-র সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।’ স্যমন্তক বলল। ‘তবে একটা ফোন করে আসিস। যদি কোনও কারণে সেদিন রিহার্সাল বন্ধ থাকে, বোর হয়ে যাবি।’
আদিত্য একদিন কালীঘাট গিয়ে সুদীপ্ত-র সঙ্গে দেখাও করে এল। একটু আগে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে অনেকক্ষণ বসে বসে রিহার্সাল দেখতে হল। দেখতে অবশ্য মন্দ লাগছিল না। সাড়ে নটার সময় শেষ হল রিহার্সাল। চা খেতে খেতে সুদীপ্তর সঙ্গে কথা হল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সুদীপ্তও নীলাঞ্জন মৈত্রের কোনও হদিশ দিতে পারল না। তার কাছ থেকে শুধু জানা গেল নীলাঞ্জন মৈত্র একরোখা, একগুঁয়ে ধরনের লোক, সবার সঙ্গেই দূরত্ব রেখে চলত। বিশেষ করে স্ত্রী ছেড়ে যাবার পর থেকে। সুদীপ্ত বলল, ‘নীলাঞ্জনদার সঙ্গে আপনার কতটা দরকার জানি না, তবে নেহাতই যদি দেখা করতে চান, তাহলে লক্ষ রাখুন ওদের পরবর্তী শো কবে হয়। অ্যাকাডেমিতেই সাধারণত ওরা শো করে। ওখানে গিয়ে খোজ করলেই জানতে পারবেন প্রান্তিক-এর পরের শো কবে আছে।’
অ্যাকাডেমিতে গিয়েও সুবিধে হল না। শুধু এইটুকু জানা গেল যে আগামী দুমাস অ্যাকাডেমিতে প্রান্তিক-এর কোনও শো নেই। নীলাঞ্জন মৈত্রকে খুঁজে পাবার আশা আদিত্য প্রায় ছেড়েই দিল।
এইভাবে শেষ হয়ে গেল ফেব্রুয়ারি মাস। মন্দাকিনী চৌধুরির সঙ্গেও দেখা হল না। তারপর মার্চের প্রথম দিকে একটা শনিবার অমিতাভর ফোন এল। ‘আজ সন্ধেবেলা পাথুরিয়াঘাটায় নন্দন গাইছে। হাতে কাজ না থাকলে চলে আয়। না এলে মিস করবি।’
‘হাতে কোনও কাজ নেই। তাছাড়া ক-দিন ধরেই ভাল গান শোনার জন্য মনটা ছটফট করছে। অবশ্যই যাব। কিন্তু পাথুরিয়াঘাটার কোথায়? আমাকে ঢুকতে দেবে তো?’
‘তুই আমার সঙ্গে যাবি। আমি তোকে তোর মেসের সামনে থেকে তুলে নেব। গান শুরু সাড়ে ছটায়। আমাকে একটু আগে পৌঁছতে হবে। তুই পৌনে ছটার মধ্যে রেডি হয়ে থাকিস। আমি তোর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে একটা ফোন করে দিলে তুই নেমে আসিস।’
‘ঠিক আছে। তাহলে সন্ধেবেলা দেখা হচ্ছে।’
আদিত্য ফোনটা কেটে দিয়ে সোহিনী মৈত্রর ফোন নম্বরটা লাগাল। ওপারে সোহিনীর গলা শুনতে পেয়ে বলল,
‘আমি একটা দরকারি কথা বলার জন্য ফোন করছি।’
‘বলুন।’
‘আজ সন্ধেবেলা আপনার বন্ধু নন্দন চক্রবর্তী পাথুরিয়াঘাটায় গান গাইবেন। আমার বন্ধু অমিতাভ মিত্রর সঙ্গে আমি শুনতে যাব। মনে হয় ওখানে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। দেখা হলে কিন্তু আমি ভান করব এই প্রথম আপনার সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। আমার ইনভেস্টিগেশনটা যতটা গোপন রাখা যায় ততই ভাল।’
‘ঠিক আছে। আপনি যেমন বলবেন। অমিতাভ মিত্র আপনার কীরকম বন্ধু?’
‘আমার কলেজের বন্ধু। ঠিক বন্ধুও নয়। আমার তো নিজের কোনও পরিবার নেই। আমার পরিবার বলতে ওই অমিতাভ আর ওর স্ত্রী রত্না।’
‘শুনে খুব ভাল লাগছে। অমিতাভবাবু একেবারে গান-পাগল মানুষ। নন্দনের জন্য অনেক করছেন।’
‘অমিতাভ আমাকে নন্দন চক্রবর্তীর গান শুনিয়েছে। আউটস্ট্যান্ডিং। এক্সকুইজিট। অমিতাভ অকারণে কাউকে প্রোমোট করে না। নন্দন চক্রবর্তী ডিজার্ভস টু বি প্রোমোটেড।’
‘আপনি গান বোঝেন, তাই বলছেন। ক’জন আজকাল গান বোঝে বলুন? গান-বাজনার জগৎটাও এত নোংরা হয়ে গেছে। একটু নাম করতে গেলে কনফারেন্স অরগানাইজারদের পেছন পেছন ছুটতে হয়। নন্দন কেন সেসব করতে যাবে? ওর তো ওটা কাজ নয়। তার থেকে ও বাড়ি বসে রেওয়াজ করবে। একমাত্র অমিতাভবাবুই আমাদের ওয়েল-উইশার। আর কেউ নয়। আমার মা-ও এ-ব্যাপারে ভীষণ অসহযোগিতা করছে।’ বলতে বলতে সোহিনীর গলা কান্নায় বুজে এল।
‘আপনার মা? তিনি এর মধ্যে কীভাবে আসছেন?’
সোহিনী নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে। বলল, ‘দেখুন, নন্দন ইজ আ জিনিয়াস, সত্যিকারের জিনিয়াস। জিনিয়াসদের কিছু কিছু লাইসেন্স দিতে হয়। নাহলে তাদের সৃষ্টি ব্যাহত হয়। নন্দনের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। নন্দন মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে। অন্য নেশাও আছে। আমি জানি এটা ধ্বংস হয়ে যাবার রাস্তা। তাই একটু একটু করে নন্দনকে এই রাস্তা থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু এটা একদিনে হবার নয়। জোর খাটিয়ে দেখেছি নন্দন গান একদম বন্ধ করে দিয়েছে। নন্দনের গান বন্ধ করাটা তো আমার উদ্দেশ্য নয়। তাই আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বুঝিয়ে নন্দনকে ঠিক রাস্তায় আনতে হবে।’
‘বুঝলাম। কিন্তু এর মধ্যে আপনার মা কীভাবে আসছেন এখনও বুঝতে পারলাম না।’
‘সেটাই বলছি। আমার মা গান-বাজনা একদম বোঝে না। শুধু ওপর ওপর দ্যাখে একটা নেশাখোর ছেলের সঙ্গে আমি বসবাস করছি, মার মতে যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তাই নন্দনকে বাড়ি থেকে বার করে দেবার জন্য মা ভয়ঙ্কর চাপ দিচ্ছে। বাড়িটা তো মার। মা বাড়ি থেকে নন্দনকে বার করে দিলে আমাকেও বেরিয়ে যেতে হবে। তখন জানি না কোথায় থাকব। চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস থেকে যে টাকাটা মাসোহারা হিসেবে পাই তাতে কিছুই হয় না।’
‘মাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন?’
‘করেছি। লাভ হয়নি। ক্রিয়েটিভিটি ব্যাপারটা মা কোনোদিনই বোঝে না। বুঝলে বাবার ট্যালেন্টটা অত সহজে নষ্ট করে দিতে পারত না। আমার বাবা ঠিক নরমাল ছিল না। বাবার নানারকম অসুবিধে ছিল। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে বাবা ভীষণ ট্যালেন্টেড ছিল। আমার ধারণা, মা বাবাকে ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে বাবার ক্রিয়েটিভ সত্তাটা একেবারে মরে গেল। আমি বলব, বাবার শিল্পী-সত্তার মৃত্যুর জন্য মা-ই একশ ভাগ দায়ী। মা নাট্যকার নীলাঞ্জন মৈত্রর জীবনটা শেষ করে দিয়েছে অ্যান্ড আই হেট হার ফর দ্যাট। কিন্তু মাকে আমি নন্দন চক্রবর্তীর ট্যালেন্টটা নষ্ট করতে দেব না। আমার শেষ রক্তবিন্দু অব্দি লড়াই করব।’
একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে সোহিনী থামল। ওদিক থেকে আর সাড়া-শব্দ আসছে না দেখে আদিত্যর মনে হল সোহিনী বুঝি ফোন নামিয়ে রেখেছে। সে-ও ফোনটা কেটে দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় আবার সোহিনীর গলা শোনা গেল, ‘আমি এসব কথা আপনাকে কোনও দিনই বলতাম না। কিন্তু নন্দনের প্রশংসা করে আপনি আমাকে একেবারে বেসামাল করে দিলেন। যাইহোক, আপনাকে একটা খবর দেবার আছে। খবরটা দেবার জন্য আমি নিজেই আপনাকে ফোন করতাম। আজ সকালে মেল পেয়েছি, মা পরশু দিন ফিরে আসছে। আশা করছি চার-পাঁচ দিনের মধ্যে মার সঙ্গে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিতে পারব।’
নন্দন চক্রবর্তী বেহাগ গাইছে। তামাটে রঙ, তোবড়ানো গাল, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। সুপুরুষ কেউ বলবে না। অন্তত সোহিনীর পাশেতো একেবারেই বেমানান। তার সঙ্গে সোহিনীর মেলবন্ধনটা যে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ সুরের মাধ্যমে হয়েছে একথা ভেবে আদিত্যর মতো জীবনযুদ্ধে পোড়-খাওয়া সৈনিকেরও চোখে জল এসে গেল। হয়তো তখন চারদিকে সুরের একটা আশ্চর্য বাতাবরণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল বলে, কিংবা হয়তো ঠিক তখনই পঞ্চম থেকে তীব্র মধ্যমে একটা নিদারুণ মোচড় খেয়ে গান্ধার, শুদ্ধ মধ্যম হয়ে সুর আবার গান্ধারে ঘুরে এসে খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছিল বলে, কিংবা হয়তো নন্দন চক্রবর্তীর গলায় শ্রাবণ মাসের টলটলে দিঘির মতো সুর উপচে পড়ছিল বলে আদিত্যর মনটা এতটাই নরম হয়েছিল। আদিত্য খেয়াল করল, নন্দন চক্রবর্তীর গানে কোথাও তাড়াহুড়ো নেই, নাটক নেই। শুধু শান্তি আছে। অপার শান্তি। অতি ধীরে ধীরে সুর নিজেই নিজের রাস্তা খুঁজে নিচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে কত নতুন রাস্তা বেরিয়ে পড়ল, সেসব রাস্তার কথা আদিত্য জানতই না। রাস্তার ধারে কত কুটির তৈরি হল। কত অট্টালিকা তৈরি হল। সেইসব কুটীর-অট্টালিকার ওপর ভর করে নন্দন একসময় দ্রুত খেয়ালে পৌঁছল। ঝাঁপতাল। নন্দন চক্রবর্তী সত্যিই প্রতিভাবান। বেহাগের পরে নন্দ, সেই পুরোনো বন্দিশ ‘ঢুঁডু বারি সঁইয়া’। শেষে ছোট করে নায়েকি কানাড়া। আসর ভাঙল সাড়ে দশটায়।
গান শেষ হবার পর অমিতাভ যখন নন্দন চক্রবর্তীর সঙ্গে আদিত্যর আলাপ করিয়ে দিচ্ছে, আদিত্য খেয়াল করল নন্দন নমস্কার এবং তারিফের প্রত্যুত্তরে সবিনয়ে নমস্কার জানাল বটে কিন্তু তার চোখ বলছে এই পৃথিবীর কোনও কথা তার মাথায় ঢুকছে না। সে তখনও পুরোপুরি অন্য জগতে রয়েছে। সেই অন্য জগৎটা কিছুক্ষণ আগে তার নিজের তৈরি করা সুরের জগৎ, নাকি মাদক-প্রভাবিত কোনও কৃত্রিম ভুবন, আদিত্য ঠিক ধরতে পারল না।