চৌধুরি বাড়ির রহস্য – ১

পূর্বকথা

বউবাজার অঞ্চলের একটা প্রায়ান্ধকার সরু গলির ভেতর অতি প্রাচীন একটা বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। বাড়ির গা দিয়ে বটের ঝুরি নেমেছে। রাত নটা। ট্যাক্সি থেকে নামল পাজামা শার্ট পরা গায়ে আলোয়ান জড়ানো গ্রাম্য চেহারার এক যুবক আর আটপৌরে শাড়ি পরা, ঘোমটা দেওয়া এক যুবতী। যুবকের গালে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি, কাঁধে ক্যাম্বিসের ব্যাগ। যুবতীর হাতে শাঁখা-পলা-লোহা, দুগাছা ইমিটেশন চুড়ি। দুজনে খানিকটা ভয়ে ভয়ে সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকল। ভেতরটা গলির থেকেও অন্ধকার। একটু আগে কিছু শব্দ করে ট্যাক্সিটা চলে গেছে। এখন চারদিকে থমথমে নিস্তব্ধতা।

মনে হয় বাড়ির সব লোকজন এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিংবা হয়তো এ-বাড়িতে কেউ থাকেই না। যুবকটি ব্যাগ থেকে একটা টর্চ বার করে চারদিকটা দেখে নিল। তারপর তার সঙ্গিনীকে নিচু স্বরে বলল, ‘ওই দিকে একটা সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছি। চল দোতলায় উঠে দেখি।’

তারা সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সঙ্গিনী বলল, ‘রেলিং-এর দিকে বেশি যেয়ো না। নড়বড় করছে।’

যুবক-যুবতীর উচ্চারণে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার টান। দোতলায় উঠে দেখা গেল কোণের দিকে একটা ঘরের বন্ধ দরজার তলা দিয়ে একটু আলো আসছে। তারা ধীরে ধীরে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যুবকটি দরজায় টোকা দিয়ে চাপা গলায় ডাকল, ‘কবিরাজ মশাই, কবিরাজ মশাই।’

উত্তর নেই। উত্তর না পেয়ে আর একটু গলা তুলে যুবকটি বলল, ‘কবিরাজ মশাই, দরজা খুলুন, আমরা গোসাবা থেকে আসছি।’

এবার দরজার আড়ালে হাঁটাচলার শব্দ শোনা গেল। এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ দরজা খুলে বললেন, ‘ভেতরে এস।’

ঘরের একদিকে একটা তক্তপোশ, একটা অতি প্রাচীন আরাম-কেদারা, বাকি তিন দিকের দেয়াল জুড়ে শেকড়-বাকড়, ওষুধ-পত্র ঠাসা পুরোনো আমলের কাচের আলমারি। ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায় ঘরের মালিক আয়ুর্বেদের চর্চা করেন। বদ্ধ ঘরের বাতাসে একটা ওষুধ-ওষুধ গন্ধ থমকে রয়েছে। বৃদ্ধ কবিরাজ মশাই আরাম-কেদারাটি দখল করে বসলেন। যুবক-যুবতী বসল তক্তপোশের ওপর। কবিরাজ মশাই তাঁর অতিথিদের কিছুক্ষণ চোখ দিয়ে জরিপ করলেন। তারপর বললেন, ‘তোমাদের নাম বল।’

‘আমার নাম বিজয়, বিজয় মাকাল। আর ইনি আমার ইস্ত্রী করবি মাকাল। আমরা আপনাকে চিঠি দিয়েছিলাম। আপনি পত্তর দিয়ে আমাদের আসতে বলেছিলেন। এই দেখুন।’

যুবকটি শার্টের বুকপকেট থেকে একটি পোস্টকার্ড বার করে বৃদ্ধের হাতে দিল। বৃদ্ধ পোস্টকার্ডটি ভাল করে দেখে ফেরত দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের তো সন্ধে সাতটায় আসার কথা ছিল। এত দেরি করলে কেন?’

‘কী করব কবিরাজ মশাই, সেই ভোরবেলা উঠে ইস্টিমার ধরেছি। তখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। ক্যানিং পৌঁছে শুনি ট্রেনের গন্ডগোল। কখন ছাড়বে কোনও ঠিক নেই। সারাদিন বসে রইলুম। বিকেলের আগে ট্রেন ছাড়ল না। শেয়ালদায় ঢুকল সাড়ে আটটায়। এদিকটা তো ভাল চিনি না। ভাবলুম একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিই। গৌর দে লেন সে-ই চিনিয়ে নিয়ে যাবে। তা এতটা কম রাস্তা কেউ আসতে চায় না। শেষে হাতে-পায়ে ধরে, বেশি টাকা কবুল করে এক ব্যাটাকে রাজি করিয়ে এখানে এলুম।’

‘এলে তো বটে, কিন্তু ফিরবে কী করে? কলকাতায় থাকার জায়গা আছে?’

‘হ্যারিসন রোডে একটা হোটেল আছে। আমাদের গেরামের লোক কলকাতায় এলে সেখানে থাকে। সেখানে জানিয়ে রেখেছি। মনে হয় রাত্তিরটুকু কাটানোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

যুবতীটির অবগুন্ঠন কিছুটা সরে গিয়েছিল। কবিরাজ মশাই লক্ষ করলেন যুবতীটির রং ময়লা, মাথাভরা সিঁদুর, কপালে সস্তার টিপ, বাঁদিকের গালে একটা লালচে জড়ুল, চেহারায় বেশ চটক আছে। খুব হালকাভাবে কবিরাজ মশায়ের মনে হল মেয়েটিকে তিনি যেন কোথায় দেখেছেন। তবে কোথায়, তিনি মনে করতে পারলেন না। তিনি যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী করা হয়?’

 ‘আজ্ঞে, গোসাবা-হ্যামিলটন অঞ্চলে কয়েকটা মাছের ভেড়ি আছে। শ্রীমানি মার্কেটে মাছ চালান যায়।’

‘তাহলে তো তোমাকে মাঝে মাঝেই কলকাতায় আসতে হয়। কলকাতা চেন না কেন?’

‘আমি খুব বেশি কলকাতায় আসি না। আমার ভাই এদিকটা সামলায়। আমি ভেড়িগুলো দেখাশোনা করি।’

‘তা বেশ, তা বেশ।’ কবিরাজ মশাই কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর থেমে থেমে বললেন, ‘এবার কাজের কথায় আসি। তোমাদের সমস্যাটা তো চিঠিতে লিখেছ। এব্যাপারে কোনও অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার দেখিয়েছ তোমরা? রিপোর্ট-প্রেসক্রিপশন কিছু আছে?’

 ‘ডায়মন্ডহারবার হাসপাতালে দেখিয়েছিলুম। কাগজপত্তর সব সঙ্গে এনেছি। আপনি তো আনতে বলেছিলেন।’

বিজয় মাকাল তার ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে একতাড়া কাগজ বার করল। কাগজগুলো হাতে নিয়ে কবিরাজ মশাই বললেন, ‘আমরা সাত পুরুষের কবিরাজ। কিন্তু তা বলে অ্যালোপ্যাথি শাস্ত্রটাকে ধুর ছাই করি না। আমার বাবা মেডিকেল কলেজের পাশ করা ডাক্তার ছিলেন যদিও আয়ুর্বেদ ছাড়া অন্য কোনও চিকিৎসা কখনও করেননি। বাবা আমাকে কারমাইকেল থেকে ডাক্তারি পাশ করিয়ে তারপর আয়ুর্বেদ চর্চার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমার ছেলে আর বউমাও অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার, বিলেতে থাকে। কিন্তু ওরা বাপ-দাদার এত পুরুষের আয়ুর্বেদ চর্চাটা আর রাখল না। আমিই আমাদের কবিরাজ বংশের শেষ প্রদীপ, টিমটিম করে জ্বলছি। অ্যালোপ্যাথদের শাস্ত্রে এমন অনেক কিছু আছে যা আমাদের নেই। আমি তাই আমার রুগিদের দরকার মতো অ্যালোপ্যাথিক পরীক্ষা-টরিক্ষাগুলো করিয়ে আনতে বলি। তবে হ্যাঁ, শেষ কথাটা কিন্তু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রই বলতে পারে। আমি বহুবার প্রমাণ করে দিয়েছি, অনেক অসুখে অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসা নেই কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে আছে।’

কবিরাজ মশাই চুপ করলেন। কিছুক্ষণ মন দিয়ে রিপোর্ট-প্রেসক্রিপশনগুলো দেখলেন। তারপর করবী মাকালের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো মা, এই রিপোর্টগুলো থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তুমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। যা কিছু খামতি সব তোমার কর্তার। তা তোমার কর্তার জন্য আমি ওষুধ তৈরি করে রেখেছি। সমস্যা হল, ওষুধটা মারাত্মক কড়া। হার্টের অবস্থা খুব শক্তপোক্ত নাহলে এই ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। হার্ট দুর্বল হলে ওষুধ খাওয়ার পর হার্ট ফেল হতে পারে। তাই আগে তোমার কর্তাকে আমি পরীক্ষা করে দেখব। তারপর ঠিক করব আদৌ ওষুধটা দেব কিনা।’

করবী মাকালের মুখে চিন্তার ছাপ পড়ল। সে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আমার এসবের দরকার নেই। তোমার কোনও ক্ষতি হলে আমি মরে যাব।’

বৃদ্ধ বধূটিকে স্নিগ্ধভাবে বললেন, ‘মা, তোমার এই বুড়ো ছেলেটাকে পুরো বিশ্বাস করতে পার। পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল কোবরেজি করছি। কতবার কত লোককে যে এই ওষুধটা দিয়েছি তার হিসেবও রাখিনি। অনেককে আবার, তাদের শরীরের অবস্থা দেখে, ওষুধটা দিইনি। যাদের ওষুধটা দিয়েছি, তাদের বেশিরভাগেরই উপকার হয়েছে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়ওনি। আমি তো আর ভগবান নই যে সব অসুখ সারাতে পারব। তবে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি। আমার ওষুধ খেয়ে অপকার হয়েছে এমন লোক একটাও নেই। অপকারের কিছুমাত্র সম্ভাবনা থাকলে আমি নাড়ি দেখে টের পাই। তাকে আমি ওষুধটা দিই না। এবার কী করবে তোমরাই ঠিক করো।’

এবার বিজয় মাকাল মুখ খুলল। বলল, ‘ওসব মেয়েলি কথায় আপনি কান দেবেন না কবিরাজ মশাই। ও কী বলতে কী বলেছে। ও কি কিছু বোঝে? আপনি আমাকে পরীক্ষা করে দেখুন। যদি সব ঠিকঠাক মনে হয়, ওষুধ দিন। নাহলে আর কী করা যাবে। মন খারাপ নিয়ে ফিরে যেতে হবে।’

বিজয় মাকাল কবিরাজ মশাই-এর দিকে আর একটু সরে এল। কবিরাজ বললেন, ‘অ্যালোপ্যাথি রিপোর্টে দেখছি তোমার হার্টের অবস্থা যথেষ্টই ভালো। আমি নাড়ি দেখে সেটা যাচাই করে নেব। আমার দিকে আর একটু সরে এস। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিকভাবে নেবে। বেশি নড়াচড়া করবে না। নাড়ি দেখতে আমার একটু সময় লাগবে। ধৈর্য ধরে বসবে।’

কবিরাজ মশাই বিজয়ের নাড়ি ধরে চোখ বন্ধ করলেন। বোঝা যায় তিনি প্রবলভাবে মনঃসংযোগ করছেন। ঘরে নিখাদ স্তব্ধতা। হঠাৎ বাইরের গলি দিয়ে একটা রিক্সা চলে যাবার শব্দ শোনা গেল। আবার অনেকক্ষণ কোনও শব্দ নেই। একটা টিকটিকি টিকটিক করে উঠল। আবার স্তব্ধতা। বিজয় মাকাল একটু উসখুস করছে। তার স্ত্রী কিন্তু একগলা ঘোমটা টেনে ঠায় মাথা নিচু করে বসে আছে, নড়ন-চড়ন নেই, সাড়াশব্দ নেই।

প্রায় মিনিট দশেক পরে কবিরাজ মশায় চোখ খুললেন। বিজয় মাখালের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোনও চিন্তা নেই, সব ঠিক আছে। আমি ওষুধটা দিয়ে দিচ্ছি।’

তারপর করবী মাকালের দিকে তাকিয়ে নিয়ে কবিরাজ মশাই বিজয়কে বললেন, ‘শোনো, খুব মন দিয়ে শোনো। এই যে ওষুধটা দিচ্ছি, এটা তিন মাস খাবার ওষুধ। রোজ ভোরবেলা উঠে খালি পেটে এক চামচ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে একবার খাবে। এই তিন মাস তোমাকে নিয়মিত স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করতে হবে। যদি ওষুধ খাবার পর তোমার কোনও রকম অসুবিধে হয়, মানে বুক খুব ব্যথা করে বা নিশ্বাসের কষ্ট হয় কিংবা দরদর করে ঘাম হয় অথবা শরীরে অন্য কোনও তীব্র কষ্ট হয়, সঙ্গে সঙ্গে এই যে আরেকটা ওষুধ দিচ্ছি, এটা খেয়ে নেবে। আর প্রথম ওষুধটা সেদিন থেকে একেবারে বন্ধ করে দেবে। তবে আমার ধারণা তেমন কিছু ঘটবে না। আমি বলছি, তিন মাসের মধ্যে তোমার স্ত্রী গর্ভবতী হবে। নাহলে আমার সঙ্গে তিন মাস বাদে দেখা কোরো।’

কবিরাজ মশাই উঠে দাঁড়ালেন। আলমারি খুলে ওষুধ বার করে বিজয় মাখালের হাতে দিলেন। বিজয় ওষুধের পুঁটলিটা ব্যাগে পুরে বলল, ‘আপনার দক্ষিণা আর ওষুধের দাম বাবদ কত দেব কবিরাজ মশাই?’

 ‘আমাকে তুমি সব মিলিয়ে তিনশো পঁচিশ টাকা দেবে। একশো টাকা ফি আর দুশো পঁচিশ টাকার ওষুধ।’

কবিরাজ মশাই আলমারির দরজা খুলে একটা খাতা বার করলেন। খাতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার কথা তোমরা জানলে কী করে? মানে, আমার কাছে তোমাদের কে আসতে বলল?’

‘আজ্ঞে, আমার বাপের বাড়ির গেরামের লীলারাণী হালদার আর পরেশ হালদার আপনাকে দেখিয়ে খুব উপকার পেয়েছে। তাদের কাছ থেকে আপনার কথা জেনেছি।’ এবার করবী মাকাল উত্তর দিল।

‘তোমার বাপের বাড়ির গ্রামের নাম কি মা?’

‘চর মাদারিপাড়া, পোস্টাপিস বাসন্তী।’

খাতায় ছক কাটা আছে। কবিরাজ মশাই পেশেন্ট’স নেম-এর নীচে লিখলেন ‘বিজয় মাকাল, করবী মাকাল, গোসাবা কালী মন্দির, ব্লক গোসাবা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা’, রেফারড বাই-এর খোপে লিখলেন ‘লীলারাণী হালদার, পরেশ হালদার, গ্রামচর মাদারিপাড়া, পোঃ বাসন্তী, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা’, ডাওগনোসিস-এর জায়গায় খসখস করে কীসব লিখলেন আর প্রেস্ক্রিপশন-এর খোপে ওষুধের নাম লিখলেন অশ্বগন্ধেশ্বরী। তারপর বিজয়ের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে একটা রসিদ কেটে দিয়ে বললেন, ‘এখানে একটা সই কর।’ বলে খাতাটা এগিয়ে দিলেন।

খাতাটা নিয়ে বিজয় মাকাল গোটা গোটা অক্ষরে তার নাম লিখল। বলল, ‘আমরা আজ চলি কবিরাজ মশাই। ভাল-মন্দ যাই হোক আপনাকে পত্তর দিয়ে জানাব।’

কবিরাজ মশাই বললেন, ‘সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নেমো, আলোটা খারাপ হয়ে গেছে।’

‘চিন্তা নেই কবিরাজ মশাই, সঙ্গে টর্চ আছে।’

দরজা খুলে দুটি মূর্তি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কবিরাজ মশাই কপালে দু-হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে বললেন, ‘দুর্গা, দুর্গা, হরিনারায়ণ।’

প্রথম পরিচ্ছেদ

(১)

কাক ভোরে টেলিফোন এল। সাড়া দিতেই ওপারে নারীকণ্ঠ। গলায় উদ্বেগ। ‘হ্যালো, আদিত্য মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’

‘বলছি।’ আদিত্যর ঘুমের রেশ তখনও কাটেনি।

‘আমার নাম সোহিনী মৈত্র। একটা গোপনীয় ব্যাপারে আপনার সাহায্য দরকার। খুবই দরকার। আপনার সঙ্গে দেখা করা যাবে?’

‘বউবাজারে আমার একটা আপিস আছে। আজ রোববারে তো আপিস বন্ধ। সোমবার আসতে পারবেন?’

‘সোমবার আমার একটু অসুবিধে। মঙ্গলবারেও। বুধবারে হতে পারে কিন্তু অত দিন অপেক্ষা করলে দেরি হয়ে যাবে। আজ দেখা করা যায় না? আপনার বাড়িতে?

কোনও মহিলা মক্কেল তার মেসবাড়ির এক চিলতে ঘরে তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে ভেবেই আদিত্য শিউরে উঠল। যেটুকু ঘুম চোখে লেগেছিল, নিমেষে উধাও। তার ঘরের চেহারা দেখলে মক্কেল নির্ঘাত পালাবে। সে বলল, ‘আমার বাড়িতে ঠিক সুবিধে হবে না। তার থেকে বাইরে কোথাও দেখা করা যেতে পারে।’

ওপারে নারীকণ্ঠ বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। ফোন কেটে দিল, নাকি কল ড্রপ? নিজের উপস্থিতি জানাতে আদিত্য গলা খাঁকারি দিল, ‘হ্যালো, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি। শুনুন, আপনাকে আমি তুলে নেব। তারপর কোথাও বসে কথা বলা যাবে। কোথা থেকে তুলব?’

‘আমি কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে থাকি। কফি হাউসের সামনে থেকে তুলবেন?’

‘এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।’

আদিত্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে গেল। আদিত্য দেখল ঘড়িতে ছটা পনেরো। শীতের ভোর। এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। তার ওপর ক’দিন শীতটাও জাঁকিয়ে পড়েছে। এই উদ্ভট সময়ে খুব হতভাগ্য ছাড়া কাউকে বিছানা ছাড়তে হয় না। কিন্তু আদিত্যকে উঠতেই হবে, বিছানা ছাড়তে হয় হোক, মক্কেল ছাড়া চলবে না। তার গোয়েন্দা-জীবনে মক্কেল ব্যাপারটা বড়ই দুর্লভ। কিন্তু সবার আগে এক কাপ চা দরকার। আদিত্য জানলা দিয়ে দেখল, রাস্তার ওপারে সার দিয়ে চালকহীন ট্যাক্সিগুলো দাঁড়িয়ে আছে। দু’একটা ধোয়া-মোছাও চলছে। রাস্তাটাই ওদের গ্যারেজ। ট্যাক্সিগুলোর ফাঁক দিয়ে একটু ঠাহর করে দেখে মনে হল, ওপারের ফুটপাথে চায়ের দোকানটা খুলে গেছে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁক দিল, ‘বলরাম, এই বলরাম, একবার ওপরে আয়।’

বলরাম মেসের চাকর। সে আদিত্যকে সকালে চা এনে দেয়।

আদিত্য যখন মেস থেকে বেরোল তখনও শহরের শরীরে ঘুমের গন্ধ লেগে আছে। দু’চারজন ফুটপাথবাসী রাস্তায় মশারি খাটিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। কয়েকজন উঠে দাঁত মাজতে মাজতে রাস্তার কলে লাইন দিয়েছে। দোকানপাট সবই প্রায় বন্ধ, শুধু একটা-দু’টো পানের দোকান সদ্য খুলছে। আদিত্য এক প্যাকেট সিগারেট কিনল, দেখল ঘড়িতে পৌনে সাতটা। তার মেস থেকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। হাতে সময় আছে।

কফিহাউসের সামনে পৌঁছে আদিত্য সিগারেট ধরাল। কে জানে আবার কতক্ষণ পরে সিগারেট খাওয়া যাবে। আজকাল অনেকেই সিগারেটখোরদের কুষ্ঠরুগির সমগোত্রীয় মনে করে। আদিত্যর হবু মক্কেলও হয়তো সেই দলে। কফি হাউসের সামনেটা সাধারণত গাড়ি, বই ভর্তি ভ্যানরিক্সা আর পথচারীর ভিড়ে ঠাসা থাকে। কিন্তু একে রোববার তায় সাতসকাল, তাই রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দু’একটা গাড়ি না-থেমে চলে যাচ্ছে। ফাঁকা ট্যাক্সিও কয়েকটা চলে গেল। শেষে একটা সময়ে যখন নীল রঙের একটা মারুতি ডিজায়ার বড় রাস্তা থেকে খুব আস্তে আস্তে কফি হাউসের গলিটাতে বাঁক নিয়ে কফি হাউসের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে, আদিত্য আর একটা সিগারেট ধরাবে কিনা ভাবছে। চালকের আসনে বছর চব্বিশ-পঁচিশের এক তরুণী, তার চোখ এবং মুখের একটা অংশ বড় রোদ-চশমায় ঢাকা।

‘উঠে পড়ুন।’

চালকের পাশের দরজাটা খুলে আদিত্য গাড়িতে উঠল। সিট বেল্ট বেঁধে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘রাজারহাট নিউ টাউনে একটা নতুন ক্লাব হয়েছে। আমরা সেখানে বসে কথাবার্তা বলব।’

রোদ-চশমা ঢাকা মুখে সেই যে তালাচাবি পড়ল, আধ ঘণ্টা বাদে খোলা মাঠের মধ্যে ‘নিউ টাউন সিটিজেন্স ক্লাব’ লেখা একটা সাদা ছিমছাম বাড়ির মধ্যে গাড়ি ঢোকা অব্দি সে-তালাচাবি আর খুলল না।

একটু আগে ক্লাবের লনে ছাতার তলায় বসে টোস্ট-অমলেট-বেকন সহযোগে ব্রেকফাস্ট সমাপ্ত হয়েছে। আদিত্য অত সকালে কিছু খেয়ে বেরোতে পারেনি। তার বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিল। এখন পটে চা এসেছে। চমৎকার ফ্লেবার। চায়ে একটা চুমুক দেবার সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যর মধ্যে ধূমপানের ইচ্ছেটা চিড়বিড়িয়ে উঠল। সিগারেট ধরাবে কিনা ভাবছে এমন সময় নিজের হাতব্যাগ থেকে ডানহিলের একটা প্যাকেট বার করে সোহিনী বলল, ‘চলবে?’

ধূমপায়ী মহিলা আদিত্যর পছন্দ নয়, যদিও সে নিজে রোজ গোটা তিরিশেক সিগারেট খেয়ে থাকে। এই একটা ব্যাপারে সে মোটেই যুক্তিবাদী নয়, সে জানে। কিন্তু পছন্দ-অপছন্দের ওপর তো আর যুক্তি খাটে না। অবশ্য এই মুহূর্তে এই অচেনা ধূমপায়ী তরুণীটিকে তার পরম বন্ধু মনে হল। সোহিনীর সিগারেটটা ধরিয়ে দিয়ে সে ধীরে-সুস্থে নিজেরটা ধরাল। একটা সুখটান দিয়ে বলল, ‘এবার বলুন কেন আমার সাহায্য চাইছেন।’

‘আমার ধারণা আমার মাকে কেউ খুন করতে চাইছে। মার প্রোটেকশনের জন্য আপনাকে দরকার।’

‘দেখুন, আমি ব্যাপারটা এখনও ডিটেলে জানি না, কিন্তু জানার আগেই বলছি, আপনার মাকে প্রটেক্ট করার জন্য যদি আপনার মাসল পাওয়ার দরকার হয় তাহলে আমি সে কাজটা ভাল পারব না। যে-কোনও ভাল সিকিউরিটি এজেন্সিকে কাজটা দিলে তারা অনেক ভালভাবে আপনার মাকে প্রোটেক্ট করতে পারবে।’

‘আমি ফিজিকাল প্রোটেকশনের কথা বলছি না, তার জন্য মার পে-রোলে অনেক লোক আছে। আমি জানতে চাই, সত্যিই কি কেউ মাকে খুন করতে চায়? চাইলে, কে চাইছে?’

‘বেশ’।

আদিত্য পকেট থেকে মোবাইলটা বার করতে করতে বলল, ‘আপনার কথাগুলো টেপ করে রাখলে পরে আমার কাজের সুবিধে হবে। আপনার আপত্তি নেই তো?’

সোহিনী খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘ঠিক আছে।’

আদিত্য মোবাইলের রেকর্ডারটা চালিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর বলল, ‘এবার বলুন, আপনার মা কোথায় থাকেন, কী করেন, কেনই বা কেউ তাঁকে খুন করতে চাইবে?’

‘আপনি হয়তো চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর নাম শুনেছেন। আমার মা চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর কর্ণধার।’

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি কি মন্দাকিনী চৌধুরির কথা বলছেন? প্রাক্তন অভিনেত্রী চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর মন্দাকিনী চৌধুরি আপনার মা? তাঁর ছবি তো প্রায় রোজই কাগজে দেখি।’

‘দ্যাটস রাইট। আমার মায়ের নাম মন্দাকিনী চৌধুরি। আমি অবশ্য আমার বাবার পদবিটাই ব্যবহার করি।’

‘একটু গোড়া থেকে বললে সুবিধে হত। গুলিয়ে যাচ্ছে।’

‘গোড়া থেকে বলার চেষ্টা করছি। তবে কোথায় শুরু করা উচিত, জানি না। আমার মার দুটো বিয়ে। আমি প্রথম বিয়ের সন্তান। আমার বাবার নাম নীলাঞ্জন মৈত্র। বাবা অভিনয় জগতের মানুষ। মূলত গ্রুপ থিয়েটারের লোক। দুএকটা সিনেমা-সিরিয়ালেও অভিনয় করেছিল। তেমন নাম করতে পারেনি। এখনও ছোটখাটো একটা নাটকের দল চালায়। বাবার নাটক খুব ভাল চলে বলে মনে হয় না। তবু হাল ছাড়েনি। লড়ে যাচ্ছে। মা-ও একসময় বাবার দলে অভিনয় করত, সেই সূত্রেই ঘনিষ্ঠতা, বিয়ে।’

‘আপনার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয় কবে?’

‘বছর দশেক আগে। আমার বয়েস তখন পনেরো। শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে পড়ি। হস্টেলে থাকি। সদ্য ক্লাস টেনে উঠেছি। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বাবার একটা এন্ডিয়োরিং ইনটারেস্ট ছিল, এখনও আছে। তাই শান্তিনিকেতন। বাবা চেয়েছিল আমি আশ্রমিকদের মতো করে বড় হই।’

‘সেটা হল না?’

‘না। মার বিয়েটা ভেঙে যাবার পর আরও এক-দেড় বছর শান্তিনিকেতনে ছিলাম। ওখান থেকেই মাধ্যমিক পাশ করলাম। ততদিনে মা চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর সুবীর চৌধুরিকে বিয়ে করেছে। সুবীর চৌধুরির ইচ্ছেতে এবং আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে নৈনিতালের পাবলিক স্কুলে পাঠানো হল। প্রথম প্রথম অ্যাডজাস্ট করতে খুব অসুবিধে হয়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে মানিয়ে নিলাম। শুধু যে মানিয়ে নিলাম তাই নয়, পাবলিক স্কুলের জীবনটা রীতিমতো এনজয় করতে শুরু করলাম। ছুটিতে বাড়ি আসতে চাইতাম না। কোথায় আসব? আমার বাবা আর বিয়ে করেনি বটে, কিন্তু পাবলিক স্কুলে পড়তে যাবার পর থেকে বাবার সঙ্গে একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল। তাছাড়া মা ছেড়ে যাবার পর বাবার জীবনটা একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। তাই ছুটিতে কলকাতায় এসে বাবার সঙ্গে থাকা সম্ভব ছিল না। মা-ও সেটা অ্যালাও করত না। উল্টোদিকে চৌধুরি বাড়ির পরিবেশটা জঘন্য লাগত।’

‘আপনার সৎ বাবার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?’

‘একটু দূরের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সম্পর্কটা খারাপ ছিল না। দেখুন, মাই স্টেপ ফাদার ওয়াজ বেসিক্যালি আ জেন্টলম্যান। হার্ড ওয়ার্কিং, অনেস্ট, প্রিন্সিপলড টু দ্য কোর। মনেপ্রাণে সাহেব। ছেলেমেয়েদের স্নেহের আধিক্য দেখানো তাঁর ধাতে ছিল না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি তাদের জন্য ভাবতেন না। সুবীর চৌধুরির সঙ্গে একটা চলনসই সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব ছিল। আমি সেটা রাখতামও। আসল সমস্যাটা ছিল অন্য জায়গায়।’

আদিত্যর আবার ধূমপানের ইচ্ছে হল। পকেট থেকে তার সস্তার সিগারেটের প্যাকেটটা বার করে একটা ধরাতে যাবে, সোহিনী টেবিলের ওপর রাখা ডানহিলের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল, ‘প্লিজ হেল্প ইয়োরসেলফ।’

‘থ্যাঙ্কস। থাক। অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে।’ নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে আদিত্য বলল, ‘তারপর?’

‘সুবীর চৌধুরির দুটো বিয়ে। আমার মাকে বিয়ে করার আগে তিনি আরেকটা বিয়ে করেছিলেন। দুটি সন্তানের জন্ম দিয়ে যখন তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা যান তখন সুবীর চৌধুরির বয়েস মধ্য চল্লিশ। তারপর দীর্ঘ দিন তিনি বিয়ে করেননি। আমার মাকে দেখে তাঁর তপোভঙ্গ হল। তিনি আবার বিয়ে করলেন। সে সময়ে সুবীর চৌধুরির বয়েস বাষট্টি-তেষট্টি, মার বয়েস সাঁইতিরিশ-আটতিরিশ।’

‘কী করে আপনার মার সঙ্গে সুবীর চৌধুরির দেখা হয়েছিল?’

‘শুনেছি চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর কোনও একটা অ্যাড ফিল্মে মা অভিনয় করেছিল। সেই থেকে পরিচয়।’

‘তখন কি আপনার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?’

‘না। লোকে বলে, সুবীর চৌধুরির সঙ্গে মার ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল বলেই বাবা-মার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল। ব্যাপারটা আমি ঠিক আঁচ করতে পারিনি। আমি তখন শান্তিনিকেতনে পড়ি। হঠাৎ একদিন ছুটিতে বাড়ি এসে দেখলাম, বাবা-মার সম্পর্কটা ভেঙে গেছে। মা আলাদা থাকতে শুরু করেছে। কিছুদিন পরে মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেল। তার ছ’মাসের মধ্যে মা আবার বিয়ে করল।’

‘আপনি একটা সমস্যার কথা বলছিলেন। আপনার মার নতুন বাড়িতে।’

‘হ্যাঁ, সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম। সুবীর চৌধুরির আগের পক্ষে দুটি সন্তান। ছোট জন মেয়ে, নাম শঙ্খমালা, সবাই বলে মালা। আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়। সুবীর চৌধুরির একটু বেশি বয়েসের সন্তান। বড় জন ছেলে, নাম শঙ্খদীপ, ডাকনাম দীপ। এ প্রায় আমার মায়েরই বয়সি। মা মরা ছেলেমেয়েদের সুবীর চৌধুরি তেমন নজর দিতে পারেননি। ফলে কেউই ঠিকঠাক মানুষ হয়ে ওঠেনি। তবে দুজনের সমস্যা দুরকম।’ সোহিনী একটু থামল। বলল, ‘আর একবার চা খাবেন?’

‘চায়ে না বলা আমার ধাতে নেই। তাছাড়া এদের চা-টাও চমৎকার। খাঁটি দার্জিলিং।’ আদিত্য হাসল।

‘আমার মা মন্দাকিনী চৌধুরি এই নতুন ক্লাবটার একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। চা-টা আসে মন্দাকিনী চৌধুরির নিজস্ব চা-বাগান থেকে।’

চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে সোহিনী আবার শুরু করল, ‘প্রথমে মালার কথা বলি। ছোট থেকেই মালার লেখাপড়ায় বিশেষ মন ছিল না। বুদ্ধি-সুদ্ধি প্রচুর ছিল, তাছাড়া শি ওয়াজ অ্যান এক্সেলেন্ট অ্যাথলিট। কিন্তু কোনও কিছুতেই লেগে থাকার মতো মনের জোর তার ছিল না। পড়ার বই-এর তুলনায় সিনেমা পত্রিকা, টিভি, ফিল্মস্টারদের রসাল গসিপ তাকে অনেক বেশি টানত। আর খেলাধুলোটাও তো প্র্যাকটিস করতে হয়। রোজ সকালে উঠে প্র্যাকটিসে যাবার কথা ভাবলে মালার গায়ে জ্বর আসত। আমি যখন তাকে প্রথম দেখি তখন তার বছর কুড়ি বয়েস। কয়েকবার চেষ্টা করেও আই এস সি পাশ করতে পারেনি। ক্লাস ইলেভেনের ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি মনে রাখতে পারে না, কিন্তু তারকাদের ঠিকুজি-কুষ্ঠি গড়গড় করে বলে যেতে পারে। ইস্কুলে যায় না। লেখাপড়ায় একেবারে ইতি দিতে পারলে বেঁচে যেত। শুধু বাবার ভয়ে সেটা সম্ভব হয়নি। আমি যে বছর নৈনিতালের পাবলিক স্কুলে ভর্তি হলাম সে-বছর মালা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তার প্রাইভেট টিউটারকে বিয়ে করল। বিয়েটা এখনও চমৎকার টিকে আছে। একটা ছেলে। ওর স্বামী সুব্রত, সুব্রত সেন, বেহালার দিকে একটা কলেজে পড়ায়। ছোট থেকে মালা যেরকম প্রাচুর্যে মানুষ, স্বামীর সংসারে তার সিকির সিকিও নেই। স্বামী-ছেলে নিয়ে কিন্তু মালাকে বেশ সুখী মনে হয়। আসলে মালা মানুষটা মোটেও খারাপ নয়, শুধু একটু অ্যাটেনশনের কাঙাল, যেটা সে বাবার কাছ থেকে কোনও দিন পায়নি, কিন্তু স্বামী-ছেলের কাছ থেকে পুরো মাত্রায় পায়। মেয়ের ব্যবহারে সুবীর চৌধুরি খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। বয়সের সন্তান বলে মালাকে তিনি একটু বেশিই ভালবাসতেন। যদিও ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ তাঁর ধাতে ছিল না। যাইহোক বিয়ের পর কিছুদিন তিনি মেয়ের মুখ দেখেননি। মালার চৌধুরি বাড়িতে ঢোকা বারণ হয়ে গিয়েছিল। সুবীর চৌধুরি ভেবেছিলেন নিজের সম্পত্তি থেকেও মালাকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করবেন। তারপর আস্তে আস্তে বরফ গলতে শুরু করে। মালা আবার স্বামী ছেলেকে নিয়ে চৌধুরি বাড়িতে আসতে শুরু করল। সুবীর চৌধুরি তার উইলে কিন্তু একটা ছোট মাসোহারা ছাড়া সরাসরি মালাকে কিছু দিয়ে যাননি। সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ মালা পেতেও পারে তবে সেটা আমার মার মৃত্যুর আগে নয়। উইলের প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিতভাবে আসব। এখানে শুধু বলে রাখি, আমার মা মন্দাকিনী চৌধুরির কিন্তু প্রথম থেকেই মালার ব্যাপারে একটা সফট কর্নার ছিল। এখনও আছে। বলা যায়, মা-ই সুবীর চৌধুরিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মালার সঙ্গে চৌধুরি বাড়ির সম্পর্কটা রিভাইভ করেছিল।’

‘মালার স্বামী লোক কেমন?’

‘নিরীহ, কিন্তু নির্লোভ নয়। এটা অবশ্য আমার ইম্প্রেশন। ভুলও হতে পারে।’

‘তাহলে তো মালাকে নিয়ে আপনার কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। চৌধুরি বাড়িতে থাকতে আপনার জঘন্য লাগত কেন?’

‘চৌধুরি বাড়ির মূল সমস্যা ছিল দীপ, সুবীর চৌধুরির ছেলে। হি ওয়াজ অ্যান আউটরাইট স্কাউন্ড্রেল। হি স্টিল ইজ। একেবারে বখে যাওয়া বড়লোকের ছেলে বলতে যা বোঝায়। সতেরো-আঠেরো বছর বয়েস থেকেই বোধহয় মদ-জুয়া ধরেছিল। আমি যখন তাকে প্রথম দেখলাম তখন সে কিছুই প্রায় করে না। ব্যবসাও দেখে না। নিশাচর। এখানে-ওখানে ঝামেলা পাকিয়ে বেড়ায়। কেউ তাকে শাসন করতে পারে না। তার বাবাও নয়। দেখতাম সে একজন বিরাট উয়োম্যানাইজার। আজ এই বান্ধবী, কাল ওই বান্ধবী। আমি যখন ছুটিতে চৌধুরি বাড়ি আসতাম সে আমাকেও দিনরাত্তির বিরক্ত করত। মূলত ওর জন্যেই চৌধুরি বাড়িতে থাকতে জঘন্য লাগত।’

‘আপনার মা আপনাকে প্রোটেকশন দিতেন না?’

‘দেবার চেষ্টা করতেন, সব সময় পারতেন না। সুবীর চৌধুরিকে আমি কাকু বলতাম। কাকুর সঙ্গে পরামর্শ করে মা আমাকে নৈনিতালে পাঠিয়ে দিল। তারপর দিল্লিতে কলেজ। চৌধুরি বাড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছাড়াছাড়াই রয়ে গেল।’

‘আপনি সুবীর চৌধুরির উইলের কথা বলছিলেন।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। এবার উইলের প্রসঙ্গে আসি। সুবীর চৌধুরির নিজের দুই সন্তান তাঁকে এক মুহূর্ত শান্তি দেয়নি। হি ওয়াজ ডিসগাস্টেড উইথ দেম। বোধহয় সেইজন্য তিনি তাঁর উইলে সরাসরি বিশেষ কিছু তাদের জন্য রেখে যাননি। আমার জন্য একটা ছোট মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল। মালার জন্যেও তা-ই। প্রথমে দীপের জন্যেও আমাদের মতো মাসে মাসে একটা অল্প টাকা বরাদ্দ ছিল। পরে সেটা বাতিল হয়ে যায়। সুবীর চৌধুরির মৃত্যুর পর তাঁর বিপুল সম্পত্তির প্রায় পুরোটাই পেয়েছে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মন্দাকিনী চৌধুরি।’

‘সুবীর চৌধুরির ছেলেমেয়েরা এ-নিয়ে আপত্তি করেনি?’

‘উইল করার সময় মালা ওবাড়িতে ঢুকতই না, আপত্তি জানাবার কোনও জায়গা তার ছিল না। কিন্তু পরেও সে কোনও আপত্তি করেনি কারণ নিজের সংসার নিয়ে শি ওয়াজ কোয়াইট হ্যাপি। তাছাড়া সে জানত মন্দাকিনী চৌধুরি তাকে বঞ্চিত করবে না। কিন্তু উইল নিয়ে কাকুর সঙ্গে দীপের ফাটাফাটি ঝগড়া হয়েছিল। আমি তখন সেখানে ছিলাম না, মার মুখে শুনেছি। মাকে নাকি দীপ বারবার বিচ বলে সম্বোধন করছিল। নিজের বাবাকে বলছিল লেচারাস বাসটার্ড। বেশ কিছুক্ষণ সহ্য করার পর কাকু দীপকে দরোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেয়। বলে দেয়, সে যেন আর কখনও এমুখো না হয়। এরপর দীপের স্বল্প মাসোহারাটাও বাতিল হয়ে যায়। তাছাড়া, উইলে নতুন করে যোগ করা হয় যে মন্দাকিনী চৌধুরি চাইলেও চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর সম্পত্তি বা তার কোনও অংশ দীপকে দিয়ে যেতে পারবে না।’

‘দীপ বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করেনি?’

‘দীপ তার বাবাকে ভালই চিনত। সে জানত, সুবীর চৌধুরির উপস্থিতিতে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করলে আবার ঘাড় ধাক্কা খেতে হবে। তাই সে লুকিয়ে মন্দাকিনী চৌধুরির সঙ্গে মাঝেমাঝে দেখা করত। যদি আমার মা তার স্বামীকে বলে দীপের জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে পারে। অন্তত ওই অল্প মাসোহারাটা যদি পাওয়া যায়। মা দীপকে ঘোর অপছন্দ করত। তবু মনে হয়, মা দীপের জন্য খানিকটা চেষ্টা করেছিল।’

‘আপনি আপনার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন?’

‘সরাসরি কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু কিছুদিন পরে সুবীর চৌধুরি তাঁর উইল একটু বদলে ছিলেন। হয়তো মার কথা শুনে। নতুন উইল প্রায় আগের মতোই থাকল। শুধু যোগ করা হল, চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর সম্পত্তি মন্দাকিনী চৌধুরি উইল করে তাঁর যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে যেতে পারবেন। ইচ্ছে করলে, তাঁর জীবদ্দশাতে ছেলেমেয়েদের বাড়তি মাসোহারার ব্যবস্থাও তিনি করতে পারবেন। বলাই বাহুল্য সেটা হবে সুবীর চৌধুরির অবর্তমানে মন্দাকিনী চৌধুরির হাতে সম্পত্তি আসার পর। অর্থাৎ মন্দাকিনী চৌধুরি যদি মনে করেন দীপ খানিকটা শুধরেছে তাহলে তিনি ইচ্ছে করলে দীপকে তার বাপ-দাদার সম্পত্তির অংশ দিয়ে যেতে পারেন। তবে তিনি উইল না করে মারা গেলে সব সম্পত্তি মালা, দীপ আর আমার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। আর মন্দাকিনী যদি আবার বিয়ে করেন তাহলেও চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর সমস্ত সম্পত্তি মালা, দীপ এবং আমার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।’

‘কমপ্লিকেটেড উইল। ইমপ্লিকেশনগুলো ভাল করে ভেবে দেখতে হবে।’

(২)

কিছুক্ষণ হল সোহিনী মৈত্র তার রোদ-চশমাটি খুলে টেবিলের ওপর রেখেছে। আদিত্য সোহিনীর মুখটা এখন পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে। বয়কাট চুল। কালো টলটলে দিঘির মতো চোখ। অতল দিঘি। উদ্ধত নাক। উঁচু হনু। চুল-নাক-হনু মুখায়ববকে খানিকটা পশ্চিমি আদল দিয়েছে। অবশ্য মেমসাহেবদের এত দীঘল চোখ হয় না। শুধু যে লেখাপড়ায় শান্তিনিকেতনের সঙ্গে পাবলিক স্কুলের মিশেল ঘটেছে তাই নয়, চেহারার দিক থেকেও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের চমৎকার মেলবন্ধন। শুধু কপালটা আর একটু কম চওড়া হলে ভাল হত।

‘আর একটু চা খাবেন? নাকি এবার কফি?’

‘এবার তাহলে কফিই হোক।’

কফিটা আদিত্যকে হতাশ করল। বাজারের ইন্সট্যান্ট কফি। তাও খুব একটা ভালো জাতের নয়। বোধহয় চায়ের মতো কফিটা কোনও পৃষ্ঠপোষকের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া যায়নি। সে মনটাকে কফি পানের বিড়ম্বনা থেকে সরিয়ে আনার জন্য জিজ্ঞেস করল।

‘আপনার পরিবারের সকলের সম্বন্ধেই তো বললেন, কিন্তু আপনার নিজের সম্বন্ধে তো কিছু বললেন না।’

‘খানিকটা তো বললাম। ওই যে বললাম আমার লেখাপড়া প্রথমে শান্তিনিকেতনে, তারপর নৈনিতালের পাবলিক স্কুলে এবং শেষে দিল্লিতে। দিল্লির মিরান্ডা হাউস থেকে সোসিয়োলজিতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করেছি, দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স। এখন একটা এনজিওতে কাজ করি। ভালো সুযোগ পেলে পিএইচডি করার ইচ্ছে আছে। এই তো, আর কি বলব? ও হ্যাঁ, সেতার নিয়ে একটু আধটু পিড়িং পিড়িং করি। শান্তিনিকেতনেই শিখতে শুরু করেছিলাম, নৈনিতালে বন্ধ ছিল, দিল্লিতে আরও কিছুদিন শিখলাম, এখন কলকাতায় এসেও ঘষটাচ্ছি। খুব একটা এগোতে পারিনি। তবে গান-বাজনা নিয়ে উৎসাহের কমতি নেই।’

‘কোন ঘরে শিখেছেন?’

‘যখন যাকে পেয়েছি তার কাছে শিখেছি। এখন অবশ্য যাঁর কাছে শিখছি তাঁর খানদান আছে। একেবারে খাস সেনী ঘরানা। আপনি গান-বাজনা করেন? মিউজিশিয়ান গোয়েন্দা অবশ্য নতুন নয়। শার্লক হোমসই তো বেহালা বাজাতেন।’

‘কিছুদিন শিখেছিলাম। বাড়ির ট্র্যাডিশন। সেসব অনেকদিন চুলোয় গেছে। তবে গান না শুনলে চলে না।’

‘চমৎকার। আপনার সঙ্গে আমার বনবে মনে হচ্ছে। আমার মূল সমস্যায় আবার ফিরে আসি।’

আদিত্য বলল, ‘তবে তার আগে একটা প্রশ্ন। আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। আপনি আমার সন্ধান পেলেন কার কাছে?’

‘ও হো, সেটাই তো বলা হয়নি। আচ্ছা, একটু পরে বলছি।’ সোহিনীর চোখ দুটো কৌতুকে হেসে উঠল।

ছোঁয়াচে হাসি। আদিত্যও হেসে ফেলল। বলল, ‘ঠিক আছে, এই ধাঁধার উত্তরটা না হয় পরেই জানা যাবে। এবার আসল ব্যাপারটা বলুন। কেন আপনার মনে হচ্ছে আপনার মাকে কেউ খুন করার চেষ্টা করছে?’

‘প্রথম ঘটনা ঘটে মাস ছয়েক আগে। বাড়ির মধ্যেই। চৌধুরিদের আলিপুরের বাড়িটা তিন পুরুষের পুরোনো। নিয়মিত সারানো হলেও মাঝেমধ্যেই সমস্যা হয়। আজ হয়তো ছাত ফেটে জল পড়তে শুরু করল কিংবা কাল বাথরুমের কোনও ফিটিংস খারাপ হয়ে গেল। এই রকম আর কি। সব থেকে পুরোনো হয়ে গেছে ইলেকট্রিকের কানেকশনগুলো। বারবার তার বদলেও লাভ হচ্ছে না। সে যাই হোক, এবার বিপদটা এল অন্য দিক থেকে। আলিপুরের বাড়িতে একটা পুরোনো যুগের লিফট আছে। বাড়িটা তিনতলা হলেও ফ্লোরগুলো খুব উঁচু উঁচু। তাই একতলা থেকে তিনতলা উঠতে লিফট লাগে। রোজ রাত্তিরে লিফট-টা অটোমেটিক মোডে দিয়ে তিনতলায় রাখা থাকে। ভোরবেলা, লিফটম্যান আসার আগেই, প্রথম লিফট ব্যবহার করে তিনতলা থেকে একতলায় নেমে আসে আমার মা, মন্দাকিনী চৌধুরি। একতলায় নেমে ঘণ্টাখানেক লনে হাঁটা মার প্রত্যেকদিনের রুটিন। যেদিন ঘটনাটা ঘটল সেদিন মা একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার আগের রাতে অনেকক্ষণ জেগে কিছু ব্যবসা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখছিল বলে ঘুমোতে দেরি হয়েছিল। যাই হোক, ঘটনার দিন মা ঘুম থেকে ওঠার আগেই লিফটম্যান ডিউটি করতে চলে আসে এবং সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় পৌঁছে লিফট-এ উঠে একতলায় নামার জন্য লিফট-এর বোতাম টেপে। কয়েক সেকেন্ড নীচে নামার পরেই লিফট-এর দড়ি ছিঁড়ে যায়। বিকট শব্দ করে নীচে আছড়ে পড়ে লিফট। লিফটম্যান মারাত্মক জখম হয় এবং ক-দিন বাদে হাসপাতালে মারা যায়। তার পরিবারকে অবিশ্বাস্য অঙ্কের একটা ক্ষতিপূরণ দিয়ে এবং পুলিশের নানা স্তরে মোটা টাকা খরচ করে চৌধুরি পরিবার ব্যাপারটাকে ধামা চাপা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, সাহেবি আমলের শক্তপোক্ত লিফট হঠাৎ দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গেল কী করে? বলা দরকার, আগের রাত্তিরেই মেন্টেনেন্স কোম্পানি থেকে একটা লোক এসে লিফটটা চেক করেছিল। রুটিন চেক আপ। কিন্তু মেন্টেনেন্স কোম্পানি বলছে তারা কাউকে পাঠায়নি। তাদের রেকর্ড অনুযায়ী মেন্টেনেন্স ডিউ ছিল দুদিন পরে।’

আদিত্য চুপ করে রইল। সোহিনী কিছুক্ষণ নীরব। আদিত্য বলল, ‘তারপর?’

‘দ্বিতীয় ঘটনা প্রথম ঘটনার মাস দেড়েক পর। তখনও বেশ গরম চলছে। বিকেলের দিকে মার ফোন এল। ভীষণ উত্তেজিত। প্রায় হাঁপাচ্ছে। আমাকে বলল, একটু আগে সাংঘাতিক একটা অ্যাকসিডেন্টের হাত থেকে বেঁচে গেছে।’

‘এক মিনিট। আপনি কি আপনার মার সঙ্গে থাকেন না?’

‘না। আমি আলাদা থাকি। বহুদিন একলা থাকতে থাকতে বদভ্যাস হয়ে গেছে। কারও সঙ্গে থাকতে পারি না। পুরোনো বালিগঞ্জে মার একটা ফ্ল্যাট আছে। কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে ওখানেই থাকি।’

‘বুঝেছি। তারপর বলুন।’

‘হ্যাঁ যা বলছিলাম। ঠাকুরপুকুর, জোকা ছাড়িয়ে ডায়মন্ড হারবার রোডের ওপরে চৌধুরিদের একটা বিস্কুটের কারখানা আছে। সপ্তাহে অন্তত দুদিন মা সেখানে ভিজিটে যায়। সেদিনও যাচ্ছিল। ফ্যাক্টরিতে নানারকম সমস্যা থাকে যেগুলো মা নিজে না গেলে মেটে না। জোকা পেরিয়ে পৈলানের কাছে একটা ট্রাক ভয়ঙ্কর গতিতে উল্টো দিক থেকে এসে মার গাড়িতে ধাক্কা মারে। শৈলেনবাবু চৌধুরি বাড়ির অনেক দিনের ড্রাইভার। ভীষণ ভালো হাত। সেদিনও উনি চালাচ্ছিলেন। উনি না থাকলে সেদিন মার গাড়িটা চুরমার হয়ে যেত। মা বা শৈলেনবাবু কেউই বাঁচত না। শৈলেনবাবু বাঁদিকে কাটিয়েও পুরোপুরি সামলাতে পারেননি। ধাক্কার ইমপ্যাক্টে গাড়ি রাস্তার ধারে নালায় গিয়ে পড়ে। মা শারীরিকভাবে অক্ষতই ছিল, শৈলেনবাবুর সামান্য আঘাত লাগে। ধাক্কা মেরেই ট্রাক পালিয়ে যায়। তার নম্বর নেওয়া যায়নি। এটা দ্বিতীয় ঘটনা।’

সোহিনী দম নেবার জন্য আবার একটু থেমেছে। উত্তর দিক থেকে হাওয়া বইছে বেশ জোরে। হাওয়ায় কনকনে ভাব। অথচ চারদিকটা রোদ ঝলমলে। রোদ্দুরটা বেশ মিঠে লাগছে। আদিত্যর মনে পড়ল, তার ছোটবেলায় বছরের এইরকম সময়ে দেশ থেকে খেজুর গুড় আসত। বাবার নির্দেশে ডিনারে গুড়ের পায়েস মাস্ট ছিল। মাঝেমধ্যে জলখাবারে পয়রা গুড়ের সঙ্গে লুচি। অতি উপাদেয়, কিন্তু খেলেই অম্বল। অম্বল হলে বাবা কী যেন একটা হোমিওপাথিক ওষুধ খাইয়ে দিত। কার্বোভেজ? নাকি অন্য কিছু? আদিত্য অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। মনটাকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে আদিত্য দেখল লনে ভিড় বাড়ছে। আজ রবিবার সম্ভবত ক্লাবে কোনও অনুষ্ঠান আছে। আদিত্য ঘড়ি দেখল। এগারোটা বেজে গেছে। সকালে অমিতাভ-রত্নাদের বাড়িতে খাবার কথা ছিল। মনে হচ্ছে না যাওয়া হবে। আদিত্যর বাউন্ডুলে স্বভাব ওরা জানে। ঠিক বুঝে নেবে। সে ঘড়ি দেখছে দেখে সোহিনী বলল, ‘আপনার কি দেরি হয়ে যাচ্ছে? আমি তাড়াতাড়ি শেষ করছি।’

‘কোনও তাড়া নেই। আপনি ধীরে সুস্থে সবটা বলুন। একটা জায়গায় যাবার কথা ছিল ঠিকই, কিন্তু যাবার সময়টা পেরিয়ে গেছে। অতএব আর কোনও তাড়া নেই। আপনি শুরু করুন।’

সোহিনী একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ নীরবে ধূমপান করার পর আবার বলতে শুরু করল, ‘তৃতীয় ঘটনা পনেরো দিন আগের। চৌধুরিদের চা-বাগানের কথা আগেই বলেছি। ইন ফ্যাক্ট, একটা-দুটো নয়, চৌধুরিরা এখনও সবসুদ্ধু সাতটা চা-বাগানের মালিক। মাকে চা-বাগান দেখভাল করার জন্য প্রত্যেক মাসেই দার্জিলিং যেতে হয়। দিন পনের আগেও যেতে হয়েছিল। পাহাড় থেকে নামার পথে গাড়ির ব্রেক ফেল করে। অথচ যাবার সময় ব্রেকটা দিব্যি কাজ করছিল। সমতলে যেমন শৈলেনবাবু, পাহাড়ে তেমনি দীননাথ যোশি বহুদিন ধরে মার গাড়ি চালাচ্ছে। অত্যন্ত বিশ্বাসী, মার জন্য জীবন দিতে পারে। দীননাথের তৎপরতায় গাড়িটা সিরিয়াস অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে রক্ষা পায়। একটা গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা দিয়ে দীননাথ গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছিল। কথা হচ্ছে, ছ’মাসের মধ্যে এই রকম তিন-তিনটে ঘটনা, আপনি কি একে কোয়েন্সিডেন্স বলবেন?’

‘আপাতত আমি কিছুই বলব না। আপনি বলবেন। আমি শুধু শুনব। আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্ন, সুবীর চৌধুরি কবে এবং কীভাবে মারা যান?’

‘সুবীর চৌধুরি মারা গেছেন বছর সাতেক আগে। এটা তো ২০১৮-র জানুয়ারি, উনি ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে মারা যান। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাট্যাক হয়েছিল।’

‘এটা কি হঠাৎ হল?’

‘ঠিক হঠাৎ নয়। কাকুর হার্টের অসুখ অনেক দিনের। হাই ব্লাড প্রেসারও ছিল। খুব পরিশ্রম করতেন তো, তার ওপর ব্যাবসার নানা চিন্তা। ডাক্তার অনেকদিন ধরেই ওঁকে কয়েক সপ্তাহ বিশ্রাম নিতে বলছিল। উনি শোনেননি।’

‘আমার পরের প্রশ্ন, আপনার মা কি মনে করেন তাঁকে কেউ খুন করার চেষ্টা করছে?’

‘আশ্চর্য ব্যাপার, মা এখনও পুরোপুরি কনভিনসড নয় যে কেউ মাকে খুন করার চেষ্টা করছে। এটা মার একধরনের জেদ বলতে পারেন। আমি যে আপনার সাহায্য নিচ্ছি এটা অবশ্য মা জানে। প্রথমে খুব আপত্তি করছিল। আসলে মার মধ্যে একটা ওভারকনফিডেন্স আছে যেটা কিছু কিছু সময়ে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।’

‘রাজি হলেন কী করে?’

‘মা নিজেই একদিন ফোন করে আপনার কথা বলল। বলল আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করা যেতে পারে। দেখতে বলা যেতে পারে সত্যি সত্যি কেউ কোনও বদ মতলব আঁটছে কিনা।’

‘আপনার মা আমার কথা জানেন?’ আদিত্য একেবারে অবাক।

‘আপনাকে পারসোনালি চেনেন না, কিন্তু আপনার পরিবারকে চেনেন। আপনার বাবা অসিতবর্ণ মজুমদারের সঙ্গে কাকুর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল, এটা কি আপনি জানতেন?’

‘জানতাম। ক্লাবে ব্রিজের পার্টনার। একসঙ্গে গলফ-ও খেলতেন। কিন্তু কথাটা সংকোচবশত বলিনি। আপনি হয়তো জানেন, বাবা মারা যাবার পর আমাদের অবস্থাটা একেবারে পড়ে গেছে। নাহলে আমাকে এই উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়?

পরিবারের প্রসঙ্গ উঠলে খুব লজ্জায় থাকি। মজুমদার বাড়ির ছেলে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য টিকটিকির কাজ করছে, এটা খুব গৌরবের নয়।’

আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মাথা নিচু করে গালে হাত বোলাতে গিয়ে টের পেল, দাড়ি না কামিয়েই সকালে বেরিয়ে পড়েছে। সোহিনী নীরবতা ভেঙে বলল, ‘মা বলল, অত অভিজাত বাড়ির ছেলে, তার মধ্যে নিশ্চয় একটা ডিসক্রিশন কাজ করবে। এর ওপর মনে হয় নির্ভর করা যায়।’

আদিত্য অস্বস্তিটা খানিকটা কাটিয়ে উঠেছে। সে বলল, ‘ধরে নিলাম আপনার মাকে কেউ খুন করার চেষ্টা করছে। এ-ব্যাপারে আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?’

সোহিনী খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর খুব ঠান্ডা গলায় বলল,

‘এই প্রশ্নটা উঠবে, জানতাম। দেখুন, আমি যতদূর জানি মা এখনও কোনও উইল করেনি। করার ইচ্ছে আছে বলেও মনে হয় না। সেক্ষেত্রে মার খারাপ কিছু ঘটে গেলে আমি, মালা এবং দীপ তিনজনেই লাভবান হব। অর্থাৎ মোটিভ তিনজনেরই আছে। চৌধুরি এন্টারপ্রাইসেস-এর ওয়ান-থার্ড শেয়ারও তো বিশাল একটা ফরচুন। এর জন্য অনায়াসে মানুষ খুন করা যায়। কিন্তু সকলেই তো আর খুনি নয়, তাই সন্দেহের তালিকা থেকে মালাকে এবং নিজেকে বাদ দিচ্ছি। পড়ে রইল দীপ। লাইফ স্টাইল, অপরাধ প্রবণতা, অতীত ইতিহাস, মোটিভ, মার সঙ্গে সম্পর্ক সব মিলিয়ে দীপকেই প্রাইম সাসপেক্ট মনে হয় না কি?’

আদিত্য উত্তর দিল না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই মুহূর্তে শঙ্খদীপ চৌধুরি কি চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের থেকে কোনও মাসহারা পান?’

‘না, পায় না। মা অনেকবার ভেবেছে মালা এবং আমি মাসে মাসে যেরকম মাসোহারা পাই সেরকম একটা মাসোহারার বন্দোবস্ত দীপের জন্যেও করবে। কিন্তু আমার মনে হয় মাকে কাকু পরিষ্কার করে বলে গিয়েছিল দীপ যতদিন না নিজেকে শুধরোতে পারে ততদিন তার জন্য এক পয়সাও বরাদ্দ করা যাবে না। মাকে সেই শেষ ইচ্ছের মর্যাদা তো দিতেই হবে। এখনও দীপ নিজেকে শুধরোতে পারেনি, আর মা-ও দীপের জন্য কিছু বরাদ্দ করতে পারেনি।’

‘একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন। চাইলে না-ও উত্তর দিতে পারেন। মালা এবং আপনি মাসে মাসে যেটা মাসোহারা হিসেবে পান সেটা কতটা?’

‘খুব বেশি নয়। মাসোহারা হিসেবে যে টাকাটা পাই তা দিয়ে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার সংসার চালাতে পারবে না। মা আমাকে বাড়তি একটা মোটা টাকা প্রতি মাসে দেয় বলে আমার ভাল করেই চলে যায়।’

আদিত্য কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘আমার কাজটা ঠিক কী আর একবার জেনে নিতে চাই।’

‘আপাতত আপনার কাজ হল, যে লোকগুলোর কথা বললাম তাদের মিট করা। তাদের সঙ্গে কথা বলা। বোঝার চেষ্টা করা সত্যি সত্যি আমার মাকে কেউ খুন করার কথা ভাবছে কিনা। আমিও তো ভুল করতে পারি। তাই আমার সন্দেহটা ঠিক না ভুল সে ব্যাপারে আপনার একটা মতামত চাইছি। এই মতামত দেওয়াটাই আপাতত আপনার কাজ। বলাই বাহুল্য, আপনি যখন আমার বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলবেন তখন আপনার আসল পরিচয় দেবেন না। আমার মা অবশ্য আপনার পরিচয়টা জানে।’

‘কোনও একটা আইডেনটিটি আমাকে নিতে হবে। ভাবছি, সাংবাদিক হলে কেমন হয়? একজন সাংবাদিক যে চৌধুরি বাড়ির একটা ইতিহাস লিখছে।’

‘চমৎকার হয়। চৌধুরিবাড়ি নিয়ে একটা বই আছে। একবার দেখে নিতে পারেন। বোধহয় বছর তিরিশেক আগে বেরিয়েছিল। বহুদিন আউট অফ প্রিন্ট। লেখকের নামটাও ঠিক মনে নেই। তবে ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে পাওয়া যেতে পারে।’

‘কয়েকটা ভিজিটিং কার্ড করিয়ে নিতে হবে। তাছাড়া আমার কয়েকটা ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দরকার। আপনার নম্বরটা তো আমার মোবাইল থেকে পেয়ে যাব, আমার দরকার শঙ্খমালা সেনের, শঙ্খদীপ চৌধুরির, আর অবশ্যই আপনার মার নম্বর।’

‘আমার কাছে দীপের ফোন নম্বর, ঠিকানা কিচ্ছু নেই। সে কোথায় থাকে, কী করে কিচ্ছু জানি না। বাকিগুলো দিয়ে দিচ্ছি। আর একটা কথা। আপনার ফি এবং এক্সপেনসেস বাবদ এখন কত দেব বলবেন।’

‘ফি-এর কথা পরে হবে। আপাতত খরচ বাবদ হাজার তিরিশ দিলে ভাল হয়। অত হয়তো লাগবে না। তবু নিয়ে রাখছি। পরে হিসেব দেব।’

‘নো প্রবলেম।’ সোহিনী ব্যাগ থেকে চেক বই বার করল।

‘আমি ই-মেলে একটা রসিদ পাঠিয়ে দেব। আপনার মেল আইডি-টাও দেবেন।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *