চলে গেছি তবু আছি
এক
এর আগে শিবুদার লেখাটা ওঁনারই বাড়ির বাইরের ঘরে বসে একবার উলটে পালটে
দেখেছিলাম। ভালো করে পড়া হয়নি। তাই এখন আবার সেটা পড়তে শুরু করলাম।
শিবুদা ছিলেন একলা মানুষ। একটা মাধ্যমিক স্কুলের সায়েন্স—টিচার। বয়স বছর সাতান্ন আটান্ন হবে। বেঁটেখাটো, মাথায় হালকা টাক, পরিষ্কার কামানো গাল আর শুঁয়োপোকার মতন মোটা একজোড়া ভুরু। পুরুলিয়া শহরের হুচুকপাড়ায় একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। ওঁনার মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আমি কলকাতা থেকে দৌড়ে এসেছিলাম আর বাঁকুড়া থেকে এসেছিলেন ওঁনার এক ভাই। তিনিই আমার হাতে কয়েকটা কাগজ তুলে দিয়ে বললেন, দেখুন তো অনীকবাবু! এগুলো খাটের ওপর ছড়িয়ে পড়েছিল। শুরুতেই আপনার নাম দেখে মনে হচ্ছে দাদা আপনার পত্রিকার জন্যেই কিছু লিখছিলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, খাটের ওপর ছড়ানো ছিল মানে? এই বাড়ির খাটে? তাতে শিবুদার সেই ভাই ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে বললেন, না না। এখানে কেন? আপনাদের ওই ভূতুড়ে বাড়িতে। যে ঘরে দাদা মারা যান সেই ঘরেই একটা চৌকির ওপর এগুলো পড়েছিল। দেখুন, পড়ে দেখুন। হয়তো বুঝতে পারবেন আপনাদের পত্রিকার পাগলামোর ঠেলায় একজন মানুষ কেমন করে বেঘোরে প্রাণ—টা দিল।
পত্রিকার ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের যে একটু পাগলামো আছে এটা অনেকেই বলে থাকেন। ঠিক চেনা পথে ওটাকে চালাই না তো, তাই।
পত্রিকার নাম ‘নিশিডাক’। ত্রৈমাসিক রহস্য রোমাঞ্চ পত্রিকা, দাম কুড়ি টাকা। নিশিডাক গত অগাস্টে সবে তিন—বছরে পা দিল, তবে এর মধ্যেই খুব পপুলার হয়ে উঠেছে। সম্পাদক হিসেবে আমি এবং শিবুদার মতন পত্রিকার ওয়েল—উইশাররা সারাক্ষণ কেমন করে পত্রিকাটাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা যায় তার জন্যে নানারকমের প্ল্যান খাটাই। ভালো শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকাই। নতুন নতুন ফিচার যোগ করি। গত সংখ্যা থেকেই যেমন একটা নতুন ফিচার শুরু করেছি। নাম ‘চলে গেছি তবু আছি’। বিষয় ভূতুড়ে বাড়ি।
কলকাতার ভূতুড়ে বাড়ির ইতিহাস নিয়ে আগে অনেক লেখালেখি হয়ে গেছে। তাই ঠিক করেছিলাম গার্স্টিন—প্লেসের পুরনো রেডিও—অফিস, ব্যারাকপুরের সাহেব—কুঠি কিংবা রাইটার্স বিল্ডিং—এর ভূতের কথা আর লিখব না। বরং গ্রাম কিংবা মফসসলের অল্প জানা সব ভূতুড়ে বাড়িতে আমাদের লেখকরা এক একটা রাত কাটিয়ে তাদের সেই হাতে—গরম অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন।
আগের সংখ্যায় পালসিটের এক পুরনো জমিদারবাড়িতে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন আমাদের সহ—সম্পাদক তরুণ ব্যানার্জি। লেখাটা নিয়ে হইচই পড়ে গেছে। কাল অবধি পাঠকদের কাছ থেকে প্রশংসা জানিয়ে চুয়াল্লিশটা চিঠি এসেছে। তবুও শিবুদার ভাইয়ের মতন লোকজন যদি এটাকে পাগলামি ভাবেন, তাহলে ভাবতেই পারেন।
আগামী সংখ্যার জন্যে যখন ভাবনাচিন্তা শুরু করেছি তখনই পুরুলিয়া থেকে শিবেন্দু অধিকারী, মানে আমাদের শিবুদা ফোন করে বললেন, অনীক, আমাদের এদিকে একটা ভূতের বাড়ি আছে বলে শুনলাম। কভার করব?
আমি বললাম, আরে, পারমিশন নেওয়ার কী আছে শিবুদা? করে ফেলুন।
আমার আগ্রহের কারণ ছিল। শিবুদা নিজে রহস্য—কাহিনির পোকা। দেশ বিদেশের মিস্ট্রি আর হরর স্টোরি গুলে খেয়েছেন। উঁচুমানের সাহিত্য বলে ওগুলো পড়তে ভালোবাসেন কিন্তু নিজে মোটেই ভূতে বিশ্বাস করেন না। ভয়ঙ্কর ডাকাবুকো লোক। নিশিডাক পত্রিকার প্রথম ছটা সংখ্যায় ডাকিনী আর তান্ত্রিকদের নিয়ে ওঁনার লেখা একটা দারুণ ধারাবাহিক বেরিয়েছিল। সেই লেখাটার মেটিরিয়াল জোগাড় করার জন্যে শিবুদা বীরভূমের শ্মশানে—মশানে যেভাবে রাতের পর রাত প্রাণ হাতে করে ঘুরে বেরিয়েছিলেন, তাই নিয়েই আলাদা একটা গল্প লেখা যায়।
মুশকিল একটাই। নিজে ভালো পাঠক হলেও শিবুদার ভাষাটা তত জোরালো নয়। কীভাবে একটা ছোট জিনিসকে বেশ খেলিয়ে বড় করে লেখা যায়, সেটা বুঝতে পারেন না। তাই উনি আমাকে লেখার কাঁচামালটুকু ধরিয়ে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলেন। সেটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে বড় করে আমি পত্রিকায় ছাপাই।
এবারেও সেইরকমই কথা হয়েছিল। শিবুদার আবার কম্পিউটারে অ্যালার্জি। বলেছিলেন প্রত্যেকবার যেমন করেন, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি আমাকে স্পিড—পোস্টে পাঠিয়ে দেবেন। পাঠাতে পারেননি অবশ্য। ওঁনার ভাইয়ের হাত ঘুরে লেখাটা আমার কাছে এল।
শিবুদার শেষযাত্রা থেকে ফিরে কলকাতার ট্রেন ধরতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছে করেই ধরলাম না। বরং লোকজনকে জিজ্ঞেস করে চলে গেলাম শিবযজ্ঞ রোডের সেই ভূতুড়ে বাড়িটায় যেখানে রাত কাটাতে গিয়ে শিবুদা প্রাণ হারিয়েছেন। শিবুদার কাছেই শুনেছিলাম পাশের প্রাইমারি স্কুলের কেয়ারটেকারের কাছে ওই বাড়ির চাবি থাকে। তাকে গিয়ে বললাম, রাতটা ওখানে থাকতে চাই। শুনে তো ভদ্রলোকের ভিরমি খাওয়ার দশা। বললেন, মশাই, সবাই জানে ভূতের বাড়ি। গোঁয়ার্তুমি করে ওখানে থাকতে গিয়ে অধিকারীমাস্টার সদ্য সদ্য প্রাণটা খোয়ালেন, আর তারপরেও আপনি বলছেন ওই বাড়িতে ঢুকবেন!
আমি বললাম, আহা! অধিকারীবাবুর মারা যাওয়ার ব্যাপারটা তো অ্যাকসিডেন্ট। ডাক্তার তো তাই বলেছে। এর মধ্যে ভূতকে টানছেন কেন? তারপর ঝোলা থেকে নিশিডাকের পুরনো কটা কপি বার করে ভদ্রলোকের হাতে গুঁজে দিলাম। প্রত্যেকটার মলাটে মড়ার খুলি, কালো বাদুড়, হানাবাড়ি, প্ল্যানচেটের টেবিল—এইসব রোমহর্ষক ছবি। বললাম, আমি এই পত্রিকার সম্পাদক।
ভদ্রলোক মলাটগুলোর দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কী বুঝলেন কে জানে। প্যান্টের পকেট থেকে চাবিটা বার করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, যা ভালো বোঝেন করুন। কিছু হয়ে গেলে আমাকে দোষ দেবেন না।
সেটা সন্ধেবেলার ঘটনা। এখন রাত হয়েছে। বাস—স্ট্যান্ডের কাছে একটা ধাবা থেকে রাতের খাওয়া সেরে এসে ওই বাড়িরই একটা ঘরে জমিয়ে বসেছি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে এই ঘরেই শিবুদার সঙ্গে মৃত্যুদেবতার মোলাকাত হয়েছিল।
ঘরটায় একটা চৌকি ছিল। ভালো করে গায়ে হাতে—পায়ে মশা তাড়ানোর ক্রিম মেখে সেটার ওপর পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলাম। তারপর ঝোলা থেকে শিবুদার সেই লেখাটা বার করে লণ্ঠনের আলোয় পড়তে শুরু করলাম।
দুই
শিবুদা বরবারই ‘কথা কম, কাজ বেশি’ টাইপের মানুষ। এই লেখার মধ্যেও ওঁনার সেই কেজো নেচার—টা স্পষ্ট। কোনো ভ্যানতাড়া না করেই শুরু করেছেন :
অনীক, বাড়িটার মধ্যে অনেক গা ছমছমে ব্যাপার রয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেগুলোকে ভৌতিক বলা যায় না। অস্বীকার করব না, কাল সারা রাত ভালো করে ঘুমোইনি। অনেকবার আঁতকে উঠেছি। হঠাৎ কোনো আওয়াজ শুনে, কিংবা অদ্ভুত কিছু একটা দেখে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেছে। কিন্তু এটাও ঠিক, প্রত্যেকবারই আঁতকে ওঠার মতন ঘটনাগুলোর পেছনে একটা করে নিতান্ত লৌকিক কারণও খুঁজে বার করেছি— ওই মাথায় ঘোমটা—টানা পেত্নীকে কলাগাছের ছায়া বলে চিনতে পারার মতন আর কী।
পড়তে পড়তেই ভাবলাম, বেশি রাত হওয়ার আগে বাড়িতে একটা ফোন করে নিলে হয়। কটা বাজল?
জানি, চলছে না। তবু দেয়ালের পুরনো আমলের পেন্ডুলাম ক্লকটার দিকে আপনা থেকেই চোখ চলে গেল। ওটা বারোটা বেজে পাঁচ—মিনিটে বন্ধ হয়ে গেছে। এই ঘরে প্রথমবার যখন পা দিলাম তখনই ঘড়িটা আমার চোখ টেনেছিল। চারিদিকে আর সবকিছুই যখন এক ইঞ্চি ধুলোর চাদরে মোড়া, তখন ওই ঘড়িটা কিন্তু বেশ সাফ সুতরো রয়েছে। নিশ্চয় শিবুদা ওটাকে পরিষ্কার করে চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। চললে ভালোই হত। বারবার পকেট থেকে সেল—ফোন বার করে সময় দেখতে হত না।
দেয়ালঘড়ি বন্ধ, তাই সেল—ফোনেই সময় দেখলাম— সাড়ে এগারোটা। বাড়িতে ফোন করার পক্ষে রাতটা বেশিই হয়ে গেছে। একবার জানলা দিয়ে বাগানের দিকে তাকালাম। কাচের সার্সি দেওয়া জানলা। পর্দা নেই। ঘরের ভেতর থেকেই দেখা যাচ্ছে বাইরে জ্যোৎস্না ফট—ফট করছে। সেই জোরালো জ্যোৎস্নার সামনে এই পৃথিবীর সবকিছুরই রং কাজলের মতন কালো— ইটের পাঁচিল, পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বেড়াল, সুপুরিগাছের কঙ্কালসার শরীর— সব।
আবার লেখার দিকে চোখ ফেরালাম। শিবুদা লিখেছে, তোমাকে যদি বলা হয় একটা বাড়ির বাগানের জামরুলগাছের ডালে দড়ি ঝুলিয়ে চার—বছর আগে একটা মেয়ে সুইসাইড করেছিল, তাহলে সেই বাড়িটার সম্বন্ধে তোমার মনে স্বাভাবিকভাবেই একটা ভয় ঢুকে যাবে। ওই ভয় থেকেই তুমি তখন প্রত্যেকটা গাছের ছায়ায় ভূত দেখবে। বেড়ালের ডাক শুনে মনে হবে মানুষের কান্না।
ঠিক এই সময়েই বাগানের দিক থেকে একটা কান্নার শব্দ ভেসে এল। মনে হল একটা কমবয়েসি মেয়ে কাঁদছে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। তারপরেই নিজের মনে হেসে উঠলাম। মেয়ে নয়। মেয়ে কোত্থেকে আসবে? ওই বেড়ালটাই হবে নিশ্চয়, যেটা একটু আগে পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়েছিল। শিবুদার কথার মোক্ষম প্রমাণ দেওয়ার জন্যেই যেন বেটা ঠিক এইসময়ে কেঁদে উঠল।
কান্নাটা যেমন শুরু হয়েছিল, তেমনই হঠাৎ করে থেমে গেল। আমি আবার শিবুদার লেখাটার দিকে মন দিলাম।
বুঝলে অনীক, রাত বারোটার সময় টপ—টপ করে একটা আওয়াজ শুরু হল। নিস্তব্ধ বাড়িতে শব্দটাকে এত বিকট লাগছিল কী বলব। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে শেষ অবধি ধুত্তোর বলে উঠে পড়লাম। বাড়িটায় ইলেক্ট্রিকের কানেকশন নেই। আমি একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে শুয়েছিলাম। সেটা হাতে নিয়েই বাথরুমে ঢুকলাম।
বাথরুমের ভেজানো দরজাটা ঠেলে খোলা মাত্র আমার হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে গলার কাছে চলে এল। আমার মুখোমুখি একটা মুখ। অন্ধকারের মধ্যে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। লণ্ঠনটা একটু তুলে ধরতেই ওদিকের লোকটাও একটা লণ্ঠন তুলে ধরল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। দেয়ালের আয়নাটার কথা মনে ছিল না।
লৌকিক কারণ নাম্বার ওয়ান।
এবার সেই শব্দের উৎস খুঁজতে হয়। তাও পেয়ে গেলাম। দেয়ালে লাগানো কলের মুখ থেকে কী জানি কেন এই রাত বারোটার সময় ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে শুরু করেছে। হতেই পারে। আজ চারবছর বাদে এই কলটা খোলা হয়েছে। আমিই খুলেছিলাম। তখনই ওয়াশার—টোয়াশার কিছু একটা আলগা হয়ে গেছে নিশ্চয়। স্টপ—ককটাকে অনেকভাবে টাইট দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছু করতে পারলাম না। টপ টপ করে জল পড়েই যেতে লাগল। হতাশ হয়ে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। চেষ্টা করলাম, শব্দটা থেকে মনটা সরিয়ে আনতে। সে তো পারলামই না, উলটে অন্য একটা শব্দ বড় বীভৎসভাবে কানে ধাক্কা মারতে শুরু করল। এটা ‘টপ—টপ’ নয়; ‘টিক—টিক’।
আবার বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ঘড়িটাকে দেয়াল থেকে নামিয়ে সামনের খুপরিটার মধ্যে হাত গলিয়ে পেন্ডুলামটাকে ধরে একটা টান দিলাম। কট করে একটা আওয়াজ হল। তারপরেই পেন্ডুলামের দুলুনি বন্ধ। নিশ্চিন্ত। ঘড়িটাকে আবার দেয়ালে টাঙিয়ে রাখলাম।
আমি মনে মনে বললাম, ও! এইজন্যেই ঘড়িবাবাজি নট নড়ন চড়ন। শিবুদা ঠিক বারোটা পাঁচ মিনিটে ওটার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন।
কিন্তু বাথরুমের কল থেকে এখন তো আর জল পড়ছে না। বন্ধ হল কেমন করে? শিবুদা তো লিখেছেন ও ব্যাপারে কিছু করে উঠতে পারেননি। হয়তো এরই মধ্যে মরচে জমে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে।
সারাদিনের নানান ধকলে কখন যে চোখদুটো জুড়ে এসেছিল নিজেই জানি না। হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। টপ—টপ—টপ—টপ ক্রমাগত হয়েই চলেছে শব্দটা। বুঝতে পারছি ওটা কীসের শব্দ। কলটা থেকে আবার কোনো কারণে জল লিক করতে শুরু করেছে। ওটা বন্ধ করতে হবে, নাহলে ঘুমোতে পারব না। মাথার কাছে লন্ঠনটা নিবু নিবু হয়ে এসেছিল। সেটার দম বাড়িয়ে বাথরুমের দিকে এগোলাম।
দরজা খুলতেই দেখলাম উল্টোদিকে একটা মুখ। না, ভয় পাওয়ার প্রশ্ন নেই। আমি তো শিবুদার লেখা পড়েছি। ওই দেয়াল আয়নাটার জন্যে আমি তো মনে মনে তৈরিই ছিলাম। ওটার দিকে আর না তাকিয়ে কিছুক্ষণ স্টপ—ককটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম। কিছুই করতে পারলাম না, আবার ঘরে ফিরে এলাম।
ভয় পাওয়ার কথা নয়, তবুও একটু একটু ভয় করছিল। আয়নার মধ্যে থেকে যে মুখটা আমার দিকে তাকিয়েছিল, সেটা কি আমারই মুখ? একটুক্ষণই দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল যেন ছায়ার মানুষটার সামনের চুল পাতলা। ভুরু দুটো মোটা। সবচেয়ে বড় কথা, আমার চোখে চশমা ছিল, ছায়াটার চোখে ছিল না। শিবুদাও চশমা পড়তেন না। আমার থেকে শিবুদার সঙ্গেই যেন বেশি মিল ছিল ছায়াটার। মনের ভুল? তাই হবে।
জানি চলছে না। তবু পাপোশে পা মুছে চৌকিতে উঠবার আগে আরেকবার দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকালাম।
না, এটার জন্যে তৈরি ছিলাম না। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা বরফের স্রোত নেমে গেল। ঘড়িটা চলতে শুরু করেছে! মিনিটের কাঁটা টিক টিক করে এগিয়ে চলেছে! সময় দেখাচ্ছে বারোটা বেজে সাত মিনিট। সেলফোনের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম— ঠিকই দেখাচ্ছে। কিন্তু ভাঙা পেন্ডুলাম নিয়ে কেমন করে ঘড়িটা চলল? এরও কি কোনো লৌকিক ব্যাখ্যা রয়েছে?
তিন
না, আর ঘুমোব না। বরং বসে বসে শিবুদার লেখার বাকিটুকু পড়ে শেষ করি। যে অবধি পড়েছিলাম, তারপর থেকে আবার পড়তে শুরু করলাম। শিবুদা লিখেছেন :
ভূতুড়ে বাড়িতে এসেছি ভৌতিক কাণ্ডের খোঁজে। মনে মনে জানি কিছুই পাব না, কিন্তু এই যে গা—ছমছমানি— এটাই বা কম কী? আজকের আবহাওয়াটাও অদ্ভুত। আকাশ পরিষ্কার, বেশ জ্যোৎস্না ফুটেছে। কিন্তু তার সঙ্গে একটা জোরালো হাওয়াও বইতে শুরু করেছে। জানলাগুলো বন্ধ থাকায় হাওয়ার আওয়াজ ঘরের মধ্যে পৌঁছচ্ছে না, কিন্তু সুপুরি গাছের দাপাদাপি দিব্যি টের পাচ্ছি।
এতক্ষণ একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছিল। হঠাৎ সেই ডাকটা বন্ধ হয়ে গেল। এরকম অবস্থায় সবার যা হয় আমারও তাই হল। পুরো মনোযোগটা এসে জড়ো হল দুটো কানে। তখন হয়তো আমি সত্যিকারের সুচ পড়ার শব্দও শুনতে পেতাম। কিন্তু যেটা শুনলাম সেটা সুচের শব্দের চেয়ে অনেক জোরালো— চুড়ির আওয়াজ। এই ঘর থেকে বেরিয়েই একটা করিডর রয়েছে, যার একদিকে বাথরুম, অন্যদিকে একটা সরু দরজা। খিড়কি দরজা বললে বোধহয় ঠিক হয়। সেটা খোলে বাগানের দিকে। চুড়ির শব্দটা এল ওই দরজাটার কাছ থেকেই। কিন্তু সেই দরজাটায় তো আমি নিজের হাতে খিল লাগিয়েছি।
এবার আর শুধু লণ্ঠন নয়, ব্যাগের ভেতর থেকে আমার গুপ্তিটাও বার করে হাতে নিলাম। তারপর একলাফে বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে গেলাম করিডরে। না, অলৌকিক কিছু নয়। তুমি যতই ‘নিশিডাক’ পত্রিকার সম্পাদক হও, মনে মনে তুমি নিজেই জানো অলৌকিক বলে কিছু নেই। তাই চুড়ির শব্দ খুঁজতে গিয়ে আবারও পৌঁছে গেলাম ভীষণরকম লৌকিকে। একজন কাঠের মিস্তিরিকে লাগিয়েছিলাম খিল আর ছিটকিনিগুলো ঠিক করে দেওয়ার জন্যে। লোকটা ওখানে ওই দরজাটার সামনে বসে কাজ করেছিল। যাওয়ার সময় এক কৌটো কাঁটাপেরেক ফেলে গেছে। আমি আলো নিয়ে বেরোনোমাত্র দুটো ধাড়ি ইঁদুর সেই পেরেকের কৌটো থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে দৌড় লাগাল। আবার শব্দ উঠল রিন রিন রিন। আমি একা একা হেসে উঠলাম।
এইখানে আমাকে পড়া থামিয়ে দিতে হল। কারণ, পরিষ্কার শুনলাম, বাইরে করিডরে চুড়ির শব্দ হল। ঠিক এরকম একটা শব্দই কি শিবুদা শুনেছিলেন? আমি কি বাইরে বেরিয়ে দেখব কীসের শব্দ? কী দরকার? শিবুদা তো বলেই দিয়েছেন এ বাড়িতে ইঁদুর রয়েছে। কাঁটাপেরেক না হোক, অন্য কিছু নিয়ে সেগুলো নিশ্চয় টানাটানি করছে আর তাতেই ওই রিনরিনে আওয়াজ হচ্ছে।
না, একবার যাই।
গেলাম এবং ফিরে এলাম। কিছু দেখতে পেলাম না। শব্দটা করিডর ধরে চলে গেল বাড়ির সামনের দিকে। ইঁদুর নয়। অন্য কিছু।
শিবুদা লিখেছেন— আকাশ পরিষ্কার, তবু বাইরে বাগানে হাওয়ার তাণ্ডব চলছে। ঘুম আসছে না। মন বলছিল, যদি কিছু হয় ওই জানলাটার কাছেই হবে। কিন্তু কী হবে অনীক? এমন কী হতে পারে, বিজ্ঞান দিয়ে যার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না?
জানি, সবই জানি। কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার এই শিবযজ্ঞ রোডের বাড়িতে বসে মনে হচ্ছে চারবছর আগে অনেক যন্ত্রণা নিয়ে যে মেয়েটা মরে গিয়েছিল, তার সেই যন্ত্রণার কোনো চিহ্নই কি কোথাও থাকবে না?
ওই তো। ওই তো সে এসেছে। জানলার বাইরে ও দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধু কোমর থেকে গলা আর দুটো হাত। মাথাটা কি বুকের ওপর ঝুঁকে আছে? তাই দেখতে পাচ্ছি না? দাঁড়াও অনীক। আমি একবার জানলা খুলে দেখে আসি ব্যাপারটা কী? হয়তো ও সেই মেয়েটা নয়। হয়তো এর পেছনেও একটা নিতান্ত সাদমাটা ইঁদুর—বাদুড়ের মতন কোনো কারণ খুঁজে পাব। একটু বাদে সেটা লিখছি। দাঁড়াও।
না, আর কিছু লিখতে পারেননি শিবুদা। শিবুদার শরীরটা ওই জানলার কাছেই মেঝের ওপর পড়ে ছিল। এর পেছনেও একটা নিতান্ত লৌকিক কারণ ছিল। সেটা শিবুদা জেনে যেতে পারেননি, কিন্তু আমি জানি। এই বাড়িতে ঢোকার আগে যখন চারিদিকটা ঘুরে দেখে নিচ্ছিলাম, তখনই আবিষ্কার করেছিলাম— বাগানের তারে মেলে দেওয়া শিবুদার একটা ফুলহাতা টি—শার্ট হাওয়ায় উড়ে এসে জানলার কাচে লেপটেছিল। এখন বুঝতে পারছি, ঘরের ভেতর থেকে সেটাকে দেখেই শিবুদা ভেবেছিলেন…।
শিবুদা দুহাতে জানলার পাল্লার লোহার ফ্রেম দুটো ঠেলে সরিয়ে বাইরে ঝুঁকে পড়েছিলেন। এমন সময় হঠাৎ হাওয়ার একটা প্রচণ্ড ঝটকায় একটা লোহার ফ্রেম ওঁনার ডানহাতের আঙুলের ওপর আছড়ে পড়ে। হাতের তালু থেকে তিনটে আঙুল সঙ্গে সঙ্গে কেটে পড়ে যায়। জানলার ফ্রেমে শুকনো রক্তের দাগ ছিল।
শিবুদার পোস্টমর্টেম করেছেন যে ডাক্তারবাবু তাঁর সঙ্গে আমি আজ সকালেই কথা বলেছি। ওঁনার বক্তব্য— এই শক—টাতেই শিবুদার হার্ট—অ্যাটাক হয়। উনি মারা যান।
শিবুদার লেখা শেষ হয়ে গিয়েছিল। শূন্য চোখে কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম। হঠাৎই লণ্ঠনটা দপদপ করতে করতে নিভে গেল। একইসঙ্গে থেমে গেল বাথরুমের কল থেকে জল পড়ার টপ—টপ শব্দটা।
শিবুদা অলৌকিকে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর বিশ্বাসকে সম্মান জানাবার জন্যেই আমি কোনোরকমে চৌকি থেকে নেমে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। কলের জলের এই যে স্বেচ্ছাচার— এই যখন ইচ্ছে টুপিয়ে পড়া, যখন ইচ্ছে বন্ধ হওয়া— এর একটা সহজ ব্যাখ্যা খুঁজে বার করা যাবে নিশ্চয়।
তবে বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে যা দেখলাম তার কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ থাকতে পারে কি না আমার জানা নেই।
একটা আঙুল— একটা রক্তাক্ত কাটা আঙুল স্টপককের মুখে ঢুকে জলের ফোঁটাগুলোকে আটকে রেখেছে।
আমি ঘরে ফিরে এলাম। ততক্ষণে ঘড়ির শব্দও বন্ধ হয়ে গেছে। এরকমটাই আশা করছিলাম। আরও দুটো কাটা আঙুল পেন্ডুলামটাকে প্রাণপণে চেপে ধরে রেখেছে।
তাহলে তো আর একটা জিনিসই বাকি থাকে। আমি জানলার দিকে তাকালাম।
হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তাই। সার্সির ওপাশে যা ভেসে আছে তা কোনো উড়ে আসা টি—শার্ট নয়।
শিবুদার মুখ।