চরৈবেতি

চরৈবেতি

বছর তিরিশ আগে এক বিপ্লবী পিতার ‘হাইসেন্ডারি’ পাশ পুত্র ঘরের মধ্যে লেপটে বসে ছিল, সে কলেজে গিয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না, কেননা তার মতে এবং তার বাবার মতে কলেজে পড়াশুনো কিছু হয় না। অথচ যে সময়ের কথা বলছি, তখন কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে বিপ্লবীরাই পড়াতেন, যাঁরা এই পিতা পুত্রের সমভাবাপন্ন। যাই হোক, ওই দুই পক্ষ বিপ্লবীদের মাঝখানে থাকা সেই তরুণ বিপ্লবী কলেজটির ওপর কৃপা-পরবশ হয়ে বি.এ পাশ করলেন বটে, কিন্তু তারপর থেকে তার আর কিছুই ভালো লাগে না। নিজের লেখাপড়ার ফলও খারাপ, তার ওপরে সকলের প্রতিই সে ক্রোধ বিচ্ছুরণ করে চাকরি না পাওয়ার অজুহাত তৈরি করত। অবশেষে সে এক ঘণ্টা ধরে দাড়ি কাটা অভ্যাস করল, বাপের পয়সায় ফুলটুস জামা-কাপড় পড়া আরম্ভ করল এবং অমোঘ পরিণতি হিসেবে পাড়ার একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমও করা আরম্ভ করল।

এই বিপ্লবী বালকের ঠাকুমা বাঙাল ছিলেন। তিনি বললেন—এই যে গতরডা নাড়াইছে, এইখানেই কাম। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো দর্শন এটাই—চল, চলতে থাকো। সংস্কৃতে ‘চর’ বলে যে ধাতুটি আছে, তার অর্থ চলা বা চলতে থাকা। তার মানে যা কিছুই চলে, যার পরিবর্তন হয় সেটাই চর। আর যা চলে না, স্থির থাকে সেটা অচর, স্থাবর। সত্যি বলতে কী, অচর বলে কোনো কিছু হতেই পারে না। যাকে বা যেটাকে আপনি স্থির-জড় বলে দেখছেন, সেটাও কিন্তু চলছে। অচর, জড় বস্তুর চলার ভাবটা গুপ্ত থাকে কালের গভীরে। যে কাঠের টেবিলটাকে শক্ত-পোক্ত স্থির দেখছেন, পঞ্চাশ বছর ধরে কাজ চলার পর তার পায়া লড়বড়ে হয়ে যাবে, রং চটে যাবে, কাঠও জীর্ণ হয়ে পড়ে যাবে এক সময়। তার মানে সেই দৃশ্যত জড় বস্তুটিও কিন্তু পথ চলেছে। চলেছে অগোচর এক যাত্রাপথ। জড় বস্তুও যে চলে, তার সবচেয়ে দ্রষ্টা হলেন দোকানদারেরা। তাঁরাই শুধু বলেন—নিয়ে যান। বহুদিন চলবে। এখানে ক্রেতা যদি জিজ্ঞাসা করেন—চলবে কী? সে বলে চলবে কী মশাই, দৌড়োবে।

সকলের এবং সব কিছু চলার এই পেক্ষাপটে ‘চর’ শব্দটা আরও একটু বিশ্লেষণ করে বলি যে, সংস্কৃত ভাষায় অনেক সময়েই ‘র’-বর্ণ আর ‘ল’-বর্ণের অভেদ কল্পনা করা হয় এবং এই অভেদের ছোঁয়াটুকু হিন্দি এবং বাংলা ভাষায় কাব্যের মহিমা তৈরি করে দেয়। আর বাংলা ভাষায় ‘র’ টাকে প্রায় বাদ দিয়ে শুধুই চল, চল, চল বলে ঊর্ধ্বগগনে মাদলের বাজনা শুনিয়েছি। মৃদুভাবে বলেছি—’চল সখি গৃহ চল, মুঞ্চ নয়নজল’ অথবা গীতগোবিন্দে—চল সখি কুঞ্জং সতিমির পুঞ্জং/শীলয় নীল-নিচোলম/আমি বলতে চাই—’চর’ মানেও যা ‘চল’ মানেও তাই। ঠিক যেমন ‘অচর’ মানেও যা ‘অচল’ মানেও তাই। তাহলে ‘চরাচর’ আর ‘চলাচল’ কিন্তু একই কথা। পুনরায় এই ‘চলাচল’ কথাটাও প্রমাণ করে যে, সবই চলছে অচল বলে কিছু নেই। এই কথাটা যদি বলি যে, এই রাস্তায় কোনো মানুষের চলাচল নেই—তার মানে দাঁড়ায়—এই রাস্তায় মানুষ চলেও না, আবার কোনোভাবে স্থির হয়ে দাঁড়ায়ও না। অতএব চল-অচল একাকার হয়ে যায় চর বস্তুর মধ্যে অর্থাৎ সব চলছে।

চলাটা জগৎ এবং জীবন—দুয়েরই ধর্ম। আমি অবাক হয়ে যাই সংস্কৃত ভাষার চমৎকার দেখে। গম ধাতুর অর্থ যাওয়া, চলা, সেই রকম একটা ক্রিয়াপদ বা ধাতু থেকেই জগৎ শব্দটা। আবার জীবন! একটা মানুষ জন্মানো-মাত্রেই তার প্রথম নিশ্বাসের পর থেকেই যেমন প্রতিটি নিশ্বাসে সে বাড়তে থাকে, তেমনই তার শেষ নিশ্বাস অর্থাৎ মৃত্যুর দিন থেকে সে ছোটও হতে থাকে এক-একটি নিঃশ্বাসে। জগৎ এবং জীবন একাকার হয়ে যায় আসা-যাওয়ায়, চলাচলে।

 জগৎ এবং জীবনের এই চর-ভাব, এই চলমানতার সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদের দর্শন তৈরি হয়েছে। চলার দর্শন। ভারতবর্ষকে তো খুব ধর্মের দেশ বলা হয়, কিন্তু এটা অনেকেই বোঝেননি যে, সেই ধর্মটা এখানে কর্মের কথা বলে। ভারতবর্ষ কর্মভূমি আর কর্ম করতে গেলে প্রথম যেটা প্রয়োজন হয়, সেটা হল চলার ক্ষমতা, যেটা পছন্দ নয়, আলস্য ত্যাগ করে সেটা সম্পন্ন করার মানসিকতা এবং ক্ষমতা। এই দিকটা মাথায় রেখেই বেদ-ব্রাহ্মণ-উপনিষদ আমাদের ‘চরৈবেতি’-র মন্ত্র শিখিয়েছে।

চরৈবেতির মন্ত্রে সবচেয়ে বড়ো নির্দেশিতা হল—’চর’ শব্দটা বোঝা—চর মানে এই ব্যাপ্ত পৃথিবী—আমাদের জীবন চালনার ভূমি এবং সেই ভূমিতে ‘চরা’ ফেরার বা চলাফেরা, চলাচলের জন্যই আমাদের চরণ—বসে থাকা চলবে না, স্থির হওয়া চলবে না—এই চরাচরে চরার জন্যই তোমাকে চরণ দিয়েছেন ঈশ্বর। এই ব্যাপ্ত চরাচর পরিক্রমণ বলেই ব্যাপ্তির বিগ্রহ ভগবান বিষ্ণুও হাঁটেন তাঁর চরণ দিয়ে—ত্রীণি পদানি চক্রমে। আর সেই চরণ দিয়ে বিচরণ করেন বলেই বিষ্ণুর তৃতীয় চরণের দিকে দেবতাদের মতো অনিমিখে তাকিয়ে থাকেন সাধুরা—তদ বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ। আর এই পৃথিবীতে আমাদের পুর্বপুরুষেরা বহুকাল ধরে আমাদের প্রকট করে তোলার জন্য পথ হাঁটছেন—পৃথিবীর পথ, এই চরাচর, এই কাল—হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে—আর ঠিক সেইজন্যই সেই চরাচর বিচরণ করা চরণকেই আমরা নমস্কার করি—শ্রীচরণেষু—এতটা পথ শুধু আমাকে দেবার জন্য তাঁরা হেঁটেছেন, অতএব শ্রীচরণযুগলেষু।

ঠিক এইখানেই আমার সেই বন্ধুর কথা বলতে চাই। ধনী পিতার আদরের ছেলে। পড়াশুনোও কিছু করল, জীবনের আনন্দ-উপভোগ তাও যথারীতি ঘটে গেল। কিন্তু কোনো কিছুই যেন সে নিজে করে না, সবই তাকে দিয়ে করাতে হয়। এইরকম ভাবে জীবন কাটাতে গিয়ে আলস্য তাকে এমন পেয়ে বসল যে, তার বিয়াল্লিশ বছরেই শরীর থপথপে, গেঁটে বাত, হাঁটা চলা বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ডাক্তার তাকে বললেন—ভগবান তোমাকে হাঁটার জন্য দুটো পা দিয়েছেন, কিন্তু তার কল-কবজা এমনই যে, না হাঁটলে তার চলমানতা (চরমানতা) কমে যায় এবং সে দুটি চরণ জড়, স্থবির, অচল হয়ে যায়।

ডাক্তার আরও বললেন—খেয়াল করে দেখুন, শহরের লোকেরা প্রায় সকলেই এখন রুটিন করে হাঁটছেন এবং বড়োলোকদের আরও বেশি হাঁটতে হচ্ছে এই বুড়ো বয়সে এসে। কেননা, তাঁরা আগে চরণ চালনা করেননি। গাড়ি তাদের যৌবন এবং প্রৌঢ়তায় যে সুখ দিয়েছে, সেই সুখ ভেঙে যাচ্ছে বুড়ো বয়সে এসে। অথচ সেই যৌবনের চরণ-চালনা সহজ ছিল, বুড়ো বয়সে সেটা সহজ তো নয়ই বরং কঠিন। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে গ্রামের মানুষের যে জীবনযাত্রা ছিল, তাতে হাঁটতে হত মাইলের পর মাইল, তাঁদের পায়ে কোনো জড়তা ছিল না, হাঁটুর ব্যথাও ছিল না কোনো কালে। এখন গ্রামগুলি শহরে পরিণত হচ্ছে, ফলে সেখানেও চরাচর স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে, শহরের রোগ গ্রামগ্রাসী হয়ে উঠছে।

মহাভারত এখানে ব্রাহ্মণ্যের নিদান দিয়েছে। আপনারা তো ভাবেন—ব্রাহ্মণ মানেই সুবিধে-খোঁজা সেইসব নাদুস-নুদুস মানুষ, যারা বিনা পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন করেন পরের মাথায় শাস্ত্রাচরণের টুপি পরিয়ে। আমরা জানাই, প্রকৃত ব্রাহ্মণের চেহারা এবং আদর্শ কখনোই এরকম নয়। বস্তুত সেটা এতটাই ত্যাগ এবং কষ্টকর পরিশ্রমের পথ যে মহাভারত এক জায়গায় বলেছে—ব্রাহ্মণের শরীর কখনও কোনো সুখ বা আরাম পাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। এই পৃথিবীতে তাঁকে অনেক কষ্ট, অনেক কৃচ্ছ্রসাধন করতে হয় বলেই, পরজন্মে তাঁর সুখ নির্ধারিত হয়—ব্রাহ্মণস্য দেহো’য়ং ন সুখার্থায় কল্পতে।

ব্রাহ্মণের শরীর যে সুখের জন্য নয়, তা একভাবে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছিলেন ‘ব্রাহ্মণ’ নামের একটি প্রবন্ধে। তিনি লিখেছিলেন—

যদি প্রাচ্যভাবেই আমাদের দেশে সমাজে রক্ষা করিতে হয়, যদি য়ুরোপীয় প্রণালীতে এই বহুদিনের বৃহৎ সমাজকে আমূল পরিবর্তন করা সম্ভবপর বা বাঞ্ছনীয় না হয়, তবে যথার্থ ব্রাহ্মণসম্প্রদায়ের একান্ত প্রয়োজন আছে। তাঁহারা দরিদ্র হইবেন, পণ্ডিত হইবেন, ধর্মনিষ্ঠ হইবেন, সর্বপ্রকার আশ্রমধর্মের আদর্শ ও আশ্রয়-স্বরূপ হইবেন ও গুরু হইবেন।

যে সমাজের একদল ধনমানকে অবহেলা করিতে জানেন, বিলাসকে ঘৃণা করেন—যাঁহাদের আচার নির্মল, ধর্মনিষ্ঠা দৃঢ়, যাঁহারা নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞান-অর্জন ও নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞান-বিতরণে রত—পরাধীনতা বা দারিদ্র্যে সে সমাজের কোনো অবমাননা নাই। সমাজ যাঁহাকে যথার্থভাবে সম্মাননীয় করিয়া তোলে, সমাজ তাঁহার দ্বারাই সম্মানিত হয়।

কিন্তু যে ব্রাহ্মণ সাহেবের আপিসে নতমস্তকে চাকরি করে, যে ব্রাহ্মণ আপনার অবকাশ বিক্রয় করে, আপনার মহান অধিকারকে বিসর্জন দেয়, যে ব্রাহ্মণ বিদ্যালয়ে বিদ্যাবণিক, বিচারালয়ে বিচারব্যবসায়ী, যে ব্রাহ্মণ পয়সার পরিবর্তে আপনার ব্রাহ্মণ্যকে ধিককৃত করিয়াছে—সে আপন আদর্শ রক্ষা করিবে কী করিয়া? সমাজ রক্ষা করিবে কী করিয়া? শ্রদ্ধার সহিত তাহার নিকট ধর্মের বিধান লইতে যাইব কী বলিয়া? সে তো সর্বসাধারণের সহিত সমানভাবে মিশিয়া ঘর্মাক্তকলেবরে কাড়াকাড়ি-ঠেলাঠেলির কাজে ভিড়িয়া গেছে। ভক্তির দ্বারা সে ব্রাহ্মণ তো সমাজকে ঊর্ধ্বে আকৃষ্ট করে না, নিম্নেই লইয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মহাভারতের সেই ব্রাহ্মণকেই ব্রাহ্মণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যিনি দরিদ্র অথচ দ্রষ্টা, যিনি বিলাসকে ঘৃণা করেন অথচ সকলের হিতার্থী, যিনি জ্ঞানী অথচ আশ্রমী—এই ব্রাহ্মণই চলেন এবং চলতে শেখান এবং এটা এমন এক চলা, যেখানে ধন নয়, মান নয়, পদ-পদবি নয়, শুধু আনন্দই তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এই সানন্দ চলমানতাই অনাদ্যনন্ত সংসারের সংসরণ সূচনা করে, এই চলমানতাই চরাচরের মধ্যে চরণ-বিচরণের লাক্ষণিক তাৎপর্য ঘোষণা করে।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ‘চরৈবেতি’-র মন্ত্র বলার আগে একটা পটভূমিক কাহিনি আছে, যেখানে দেবতা মানুষের জীবনের মধ্যে চলে আসেন এবং সেখানে দেবতাকে মনুষ্যযুক্তির কাছে হার মানতে হচ্ছে এই চরমানতার কারণে। চরমানতার ক্ষেত্রে কাল যে একটা খুব বড়ো ব্যাপার সেটা আগেই বলেছি। মানুষের জন্ম, তার বড়ো হওয়া, তার পরিবর্তন, তাল মিলিয়ে জরা মৃত্যুকে অতিক্রম করার একমাত্র ঔষধ হল চরৈবেতি।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সেই কাহিনিতে আছে—রাজা হরিশ্চন্দ্রের সন্তান হয় না বলে দেবর্ষি নারদের কাছে তিনি পরামর্শ চাইলেন। তাঁর কাছে বংশ-বিস্তারও তো এক প্রকারের চলমানতা—পিতা নিজেই পুত্ররূপে বিস্তারিত হন আপন বংশের চলমানতার জন্য। নারদ হরিশ্চন্দ্রকে বললেন—আপনি বরুণের কাছে প্রার্থনা করে বলুন যে, পুত্র জন্মালে সেই পুত্রকেই যজ্ঞে বরুণের উদ্দেশে আহূতি দেবেন আপনি। হরিশ্চন্দ্রের প্রার্থনায় ভগবান বরুণের বরে হরিশ্চন্দ্রের পুত্র জন্মাল। তাঁর নাম রাখা হল রোহিত।

পুত্র জন্মাতেই বরুণ বললেন—যেমন চেয়েছিলে তেমনটাই তো হল। এবার পুত্রকে আহূতি দাও আমার উদ্দেশে। হরিশ্চন্দ্র বললেন—যজ্ঞে যদি পশুমাংস আহূতি দিতে হয় তবে সে পশুটাকেও একটু বড়ো হতে দিতে হয়। জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেটাকে বলি দেওয়া যায় না। আর এটা তো আমার ছেলে, একটা মানুষ। জন্মের পর অশৌচ কালই তো দশ দিন। তা আমাদের জাতাশৌচের সময়টা যাক, তারপর না হয় যাগ করব। বরুণ বললেন—তাই হোক তবে। কিন্তু দশ দিন যেতেই তিনি আবার এলেন হরিশ্চন্দ্রের কাছে। হরিশ্চন্দ্র বললেন—একটা পশুর দাঁত যতক্ষণ না গজায়, ততদিন যজ্ঞের কাজেই লাগে না। আর এ তো একটা মানুষ, আমার ছেলে। দাঁত না গজালে তো এর যাগযজ্ঞের যোগ্য হবে না।

হরিশ্চন্দ্রের যুক্তিতে বরুণ আবার প্রতিহত হলেন। এবার বরুণ এলেন রোহিতের দাঁত ওঠার পর। হরিশ্চন্দ্র বললেন—দাঁত উঠেছে ঠিকই, কিন্তু ওই দুধের দাঁত না পড়লে যজ্ঞের কাজে লাগবে না। বরুণ আবার এলেন রোহিতের দুধের দাঁত পড়ে যাবার পর। হরিশ্চন্দ্র বললেন—দাঁত পড়ে আবার দাঁত ওটার সময়টুকু তো দেবেন। তা না হলে যজ্ঞকর্মের কোনো যোগ্যতা হয় না। কিছুদিন পর বরুণ এসে বললেন—দাঁত পড়ে আবার তো দাঁত গজাল নতুন করে, এবার তো যজ্ঞটা করো।

হরিশ্চন্দ্র বললেন—শুনুন প্রভু! আমরা হলাম ক্ষত্রিয়ের জাত। ক্ষত্রিয় যতদিন না হাতে ধনুক-বাণ নিতে পারছে, যতদিন না একটা লোহার বর্ম তুলতে পারছে বুকে, ততদিন এর পবিত্রতা নেই। যজ্ঞের কাজে লাগতে গেলে পূর্ণ পবিত্র না হলে, তাকে দিয়ে যজ্ঞ করি কী করে? বরুণ তাঁর যুক্তি শুনে চলে গেলেন। কিন্তু ফিরে আসলেন আবার—যখন রোহিতের ‘সন্নাহ’-কর্ম হয়ে গেল। অর্থাৎ রোহিত এখন যৌবনসন্ধিতে—হাতে ধনুক বাণ, গায়ে লোহার বর্ম। হরিশ্চন্দ্রকে বললেন—এবার তো যাগ করবে অন্ততঃ।

হরিশ্চন্দ্র এবার প্রিয় পুত্র রোহিতকে ডেকে বললেন—পুত্র! এই বরুণই তোমাকে আমার পুত্ররূপে প্রদান করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে, পুত্র হলে সেই পুত্র দিয়েই দেবতার যজ্ঞানুষ্ঠান করবো। আমার কপাল! পুত্র এবার তোমাকে আহুতি দিয়েই এই বরুণ-যজ্ঞ সম্পন্ন করতে হবে আমাকে। পিতার কথা শুনে রোহিত বললেন—এরকম হয় নাকি? কিছুতেই এটা তুমি করতে পারো না। এই কথা বলে রোহিত তাঁর ধনুক-বাণটি হাতে নিয়ে বনের পথে চলে গেলেন এবং এক বছর ধরে সেই অরণ্যের মধ্যেই ঘুরে বেড়ালেন।

হরিশ্চন্দ্র হয়তো পুত্রের এই স্বাধীন চলাটুকুর জন্যই বরুণদেবের কাছে এত অজুহাত দিয়েছেন—এই অশৌচ, এই দাঁত ওঠেনি, এই আবার দাঁত উঠুক—এইরকম অবস্থা থেকে তিনি পুত্রের সেই ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দিয়েছেন যখন সে নিজের চলার পথ বেছে নিতে পারে। আমাদের কাল পর্যন্ত তাই ছিল। আমাদের হায়ার-সেকেন্ডারি পাশ করা পর্যন্ত বাবা-মা দেখেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করার পর হাফ প্যান্ট পড়েই কলেজে ভর্তি হওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম নিজেই। কোনো বাবা, কোনো মা বা দাদা আমার জন্য লাইন দেয়নি এবং আমার তৎকালীন বন্ধুদের জন্যও তেমন কোনো গার্জেনদের দেখিনি।

আমাদের পিতা-মাতারা জানতেন যে, একটা সময়ের পর সন্তানকে নিজের পথে চলতে দিতে হবে, আহুতি দিতে হবে পুত্র-কন্যাকে এই চরাচরে কোনো এক বরুণের কাছে। আর সেই আহুতি থেকেই পুত্র-কন্যা নিজেদের চলার পথ তৈরি করে। এখনকার পিতা-মাতারা পুত্র-কন্যাকে কিছুতেই ছাড়তে চান না এবং এমন ভাবেই তাঁদের ব্যক্তিত্ব-প্রসারণের পথ স্তব্ধ করে রাখেন যে, সামান্য আঘাত-মাত্রেই তারা ভঙ্গুর—অবসাদগ্রস্ত অথবা আত্মহত্যাপ্রবণ।

হরিশ্চন্দ্র রোহিতের রাতে ধনুকবাণ দেখেই নিশ্চিন্ত হয়েছেন, তাঁকে মুক্ত করে দিয়েছেন ‘চলমানে’-র মুক্ত মঞ্চে। রোহিত পালিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁর পিতা হরিশ্চন্দ্রকে বরুণ ছাড়লেন না। একদিন বরুণ তাঁকে ধরে ফেললেন। তবে তাঁকে তেমন কিছু করতে পারলেন না বরুণ। শুধু তাঁকে চেপে ধরেছিলেন বলে হরিশ্চন্দ্রের উদরী রোগ হল। পিতার অসুস্থতার কথা শুনে রোহিত অরণ্যের পথ ছেড়ে গ্রামে আসতেই দেবতাদের রাজা ইন্দ্র এক ব্রাহ্মণের বেশে তাঁকে খানিক অবসন্ন দেখে বললেন—যে মানুষ এইভাবে চলতে চলতে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তাঁর নানা সম্পদ আসে। আর খুব বড়ো মানুষও যদি শুধু বসেই থাকেন, তাহলে সমাজে তাঁর ক্লেশের অন্ত থাকবে না। যে চলে বেড়ায়, ইন্দ্র দেবরাজ তাঁর সখা হয়ে ওঠেন। অতএব তুমি শুধু চলতে থাকো—ইন্দ্র ইচ্চরতঃ সখা, চরৈবেতি।

ব্রাহ্মণ বিচরণ করতে বলেছেন—এই নির্দেশ মনে রেখে রোহিত আবারও গ্রাম ছেড়ে অরণ্যে গিয়ে আরও এক বছর ঘুরে বেড়ালেন। অনেক দিন বাইরে আছেন, তাই আবারও তিনি অরণ্যের চলমানতা ছেড়ে গ্রামে এলেন। আবারও ইন্দ্ররূপী সেই ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা হল রোহিতের। ব্রাহ্মণ বললেন—দ্যাখো বাছা! যে চলে বেড়ায় তার জঙ্ঘা হয়ে ওঠে পুষ্পিত বৃক্ষের মতো, তার শরীর দৃঢ় হয়। উৎকৃষ্ট পথে চলতে চলতে যে শ্রান্তি আসে, সেই শ্রান্তিই তার সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে দেয়। অতএব তুমি চলতে থাকো—চরৈবেতি।

এই কথাগুলি অন্তত সাড়ে তিন হাজার বছর আগে লেখা এবং এই কথাগুলি প্রতীকী। আজকের দিনে এসে মনস্তত্ত্ববিদেরা উপদেশ দিচ্ছেন সেই সব অবসন্ন মানুষদের যাঁদের ছোটবেলা থেকে ‘স্ট্রেস’ নেবার ক্ষমতাই তৈরি হয়নি। যাঁরা অবসাদে ভুগছেন তাঁদের বলছেন—একটা কিছু নিয়ে ‘এনগেজড’ থাকতে হবে। কিছু একটা করে ব্যস্ত রাখতে হবে নিজেকে। মনস্তাত্ত্বিক পণ্ডিতদের এইসব কথা শুনলে আমার হাসিও পায়, রাগও ধরে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে একজন মনস্তাত্ত্বিকের চেম্বার খুঁজতে গেলে এতটাই আপনাকে হাঁটতে হত, আর চলতে হত যে, আপনার মনোরোগ আপনিই দূর হয়ে যেত। আর আজকাল ফোর-ফাইভের বাচ্চাদেরও কাউনসেলিং করাতে হচ্ছে। মনস্তাত্ত্বিক প্রভুদের আগে বোঝা উচিত যে, বাচ্চাদের নয়, তাঁদের উচিত আগে তাঁদের মা-বাবাদের কাউনসেলিং করানো। তাঁরাই সবচেয়ে বড়ো মনোরোগী যাঁরা বাচ্চাদের পড়াশুনোর বিচিত্র কালেকশনের জন্য স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, আর নিজে হায়ার সেকেন্ডারিতে ফেল করে বাচ্চাদের আইনস্টাইন করার তপস্যায় মজে আছেন।

এখনকার যে-সব বাচ্চাদের বাবা-মা ইলেভেন-টুয়েলভ ক্লাস পর্যন্ত আগলে রাখেন—দৌড়োতে দেন না, হাঁটতে দেন না, পাড়া বেড়াতে দেন না, পৃথিবী দেখতে দেন না, ইস্কুলে পড়া না পারলে মাস্টারের বকুনি, খেতে দেন না, তারা প্রচুর পরিমাণ মাতৃদুগ্ধ সেবন করে যখন চাকরি করতে যায়, তখন সেই চাকরির চাপ সহ্য করতে না পেরে অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়ে—সারাজীবন এই চরাচরে চলাচল না করার ফল। এইসব ছেলেমেয়েদের মা-বাবাই জন্মাবধি যৌবন পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই বুড়ো করে দেন। আমি বুড়ো বয়সেও চলতে চাই, কেননা এই আমার গৌরব-কাল যখন পৃথিবীর যৌবনের সঙ্গে একত্তর হয়, সেটাই আমার কাল। কিন্তু আমি চলতে থাকি, চলতে চলতে ফুরোতে থাকে—সফর মে হাম হ্যায়, গুজরতে হাম হ্যায়। জিসে সমঝতে হ্যায় গুজরতা হ্যায়, উয়ো থামা হুয়া হ্যায়।

ঠিক এতটা যখন আমি দার্শনিকভাবে বুঝতে পেরেছি, তখনই আমার বোধ হল, এমন বিচ্ছিরিভাবে বুড়ো হলে চলবে না : কেননা মানুষের যে মনটা চলে, সেই মনের কিন্তু সত্যিই কোনো বুড়োমি নেই। এরই মধ্যে অবশ্য যাঁরা যৌবনকাল থেকেই বৃদ্ধত্বের চর্চা করেন, অত্যল্প কারণেই অবসন্ন বোধ করেন, একাকিত্বকে যাঁরা এক কর্মশেষের অভ্রান্ত পরিণতি বলে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের প্রতি আমার কোনো আবেদনও নেই নিবেদনও নেই। মহামতি বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন—

‘আমি অন্ত্র-দন্তহীন ত্রিকালের বুড়ার কথা বলিতেছি না—তাঁহারা দ্বিতীয় শৈশবে উপস্থিত। যাঁহারা আর যুবা নাই বলিয়াই বুড়া, আমি তাঁহাদিগের কথা বলিতেছি। যৌবন কর্ম্মের সময় বটে, কিন্তু তখন কাজ ভাল হয় না। একে বুদ্ধি অপরিপক্ব, তাহাতে আবার রাগ দ্বেষ ভোগাসক্তি, এবং স্ত্রীগণের অনুসন্ধানে তাহা সতত হীনপ্রভ, এজন্য মনুষ্য যৌবনে সচরাচর কার্য্যক্ষম হয় না। যৌবন অতীতে মনুষ্য বহুদর্শী, স্থিরবুদ্ধি, লব্ধপ্রতিষ্ঠ, এবং ভোগাসক্তির অনধীন, এজন্য সেই কার্য্যকারিতার সময়। এই জন্য আমার পরামর্শ যে বুড়া হইয়াছি বলিয়া, কেহ স্বকার্য্য পরিত্যাগ করিয়া মুনিবৃত্তির ভান করিবে না। বার্দ্ধক্যেও বিষয়চিন্তা করিবে।’

এই ‘বিষয়চিন্তা’ ব্যাপারটা যে জীবনাবধি টাকা জমানো, আর বাড়ি-গাড়ি-সম্পত্তির ভাবনা করা নয়, সেটা বুঝিয়ে দিতে সময় নেননি বঙ্কিম। তিনি বলেছিলেন—পরের জন্য কাজ করার এই সময়। আমি অবশ্য পরহিতের চেয়েও নিজের হিতের জন্য বেশি চিন্তা করি। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। এইজন্য বলছি এ-কথা যে, শত শত মানুষকে এখন দেখছি—বৃদ্ধত্বের আভাস তাঁদের অকারণে পঙ্গু করে তুলছে, কতগুলি যুবক-যুবতীর মধ্যেও আমি এই নিরুত্তাপ বৃদ্ধত্ব দেখতে পাচ্ছি। এক-একটি অণু-পরিবারে একটি-একটি ছেলে কিংবা মেয়ে। পিতা-মাতার অনন্ত সুনজরে তারা এত শিক্ষিত, এত ভালো, এত ভদ্র এবং এত ‘গাণ্ডু’ হয়ে উঠছে যে, একটি মা-বাবাকে দেখলাম—তিনি ছেলেকে প্রেম করিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এমনই কপাল যে, আধারভূতা রমণীটি আমাকে আড়ালে এসে বলল—এটা কী একটা ছেলে? আমি ভাবলাম—সত্যিই তো, এ ছেলে তো কোনো দিন গুলি খেলেনি, কোনো দিন ঘুড়ি ওড়ায়নি। কোনো দিন বাপের পকেট কেটে যৌবনসন্ধিতে হেলেন-এর নিতম্ব-নৃত্য দেখেনি, কোনোদিন ভুল করেও জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির বউদির সালস্য চুল-আঁচড়ানোও দেখেনি, এমন দুধু-ভাতু ছেলেকে নিয়ে কোন রমণী আশ্বস্তবোধ করবে! বস্তুত বৃদ্ধত্ব তোলা রইল এঁদের জন্য। আর রইল টি. এস. এলিয়ট-এর সেই সাংঘাতিক কথাটা, যা তিনি বোদলেয়ার এর কথা টেনে বলেছিলেন—So far as we are human, what we do must be either evil or good; so far as we do evil or good; we are human; and it is better in a paradoxical way, to do evil than to do nothing : at least we exist.

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ থেকে অসামান্য কাহিনিটা বলছিলাম, সেখানে এই ‘চলতে থাকা’র জন্য রাজা হরিশ্চন্দ্র কিন্তু বরুণ-দেবের কাছে বার বার অজুহাত সৃষ্টি করেছেন, অর্থাৎ খারাপ হতে তাঁর বাধেনি। আর যে ছেলেটি দেবরাজ ইন্দ্রের কথা শুনে চলতে আরম্ভ করল, তাকে কিন্তু থামতে দেননি সেই ইন্দ্ররূপী ব্রাহ্মণ। দু-বছর, তিন বছর চলার পর আবার যখন রোহিত সুখের গ্রাম্য জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন, তখন ইন্দ্র আবার ব্রাহ্মণের বেশে রোহিত এমন কথাটাই বললেন, যা আজও প্রবাদ হিসেবে প্রচলিত। ইন্দ্র বললেন—যে মানুষ বসে থাকে, তার ভাগ্যও বসে থাকে। যে দাঁড়ায়, তার ভাগ্যও উঠে দাঁড়ায়, যে নিজে শুয়ে থাকে, তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে, আর যে মানুষ চলতে থাকে, তার ভাগ্যও বিচরণ করে, তার ভাগ্য চলতে থাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধির দিকে। অতএব চলতে থাকো—চরাতি চরতো ভগশ্চরবৈতি।

পাঁচ বছর ব্রাহ্মণের কথা শুনে শুধু চলার মধ্যে রইলেন রোহিত। তিনি পুনরায় গ্রামের দিকে এলে পুরুষবেশী ইন্দ্র এবার বললেন—চলতে চলতেই জীবনের সেই মধু পেয়ে যাবে একদিন—চরন বৈ মধু বিন্দতি। মধু মানুষের ভাগ্যসিদ্ধির মধু, যা শুধু নিরলস পরিশ্রমে মেলে—এই চলমান পৃথিবীতে শুধু এই একটাই ধর্ম—চলতে থাকো! চরাচরের চরম চর্যা এটাই চলতে থাকো—চরৈবেতি। চরন বৈ মধু বিন্দতি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *