চন্দ্রলেখা অন্তর্ধান রহস্য – ৯

নবম পরিচ্ছেদ

(১)

আদিত্য অকাতরে ঘুমোচ্ছিল। ওই অবস্থায় ফোনটা অনেকক্ষণ বেজে বেজে থেমে গেছে। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। তাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না কারণ প্রথম ফোনটা যখন এসেছিল, ঘড়িতে তখন ভোর ছটাও বাজেনি। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে জমিদাররা খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে না এবং আদিত্যর শরীরে কিছু জমিদারি রক্ত এখনও বইছে। বস্তুত, সাড়ে সাতটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে, দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে, ধূমায়িত কফির কাপ হাতে নিয়ে সে যখন মোবাইলের দিকে চোখ রাখল তখন বেলা আটটা বেজে গেছে। আদিত্য দেখল পাঁচটা মিসকল, সব কটাই এসেছে কেয়া বাগচির কাছ থেকে। ফোনটা নিশ্চয় অনেকক্ষণ ধরে বেজে গেছে। তাহলে সে টের পেল না কেন? প্রশ্নটার উত্তর পেতে অবশ্য খুব বেশি সময় লাগল না তার। গতকাল অনেক কসরত করে সে তার রিং টোনটা বদলেছে। এখন কেউ তাকে ফোন করলে তার মোবাইলে নট মল্লার রাগে জ্ঞান গোঁসাই-এর ‘ছন্দে ছন্দে নাচে নন্দদুলাল’ গানটার দু-একটা কলি বেজে উঠছে। গানটা তার বিশেষ প্রিয়। কিন্তু সমস্যা হল আগে কম্পানির দেওয়া রিং টোনটা যেমন গাঁকগাঁক করে বাজত, সেই তুলনায় এই গানটা নেহাতই মিনমিন করে বাজে। ফলে সজাগ না থাকলে টেরই পাওয়া যায় না টেলিফোন বাজছে। আদিত্য ঠিক করে ফেলল এই রিং টোনটা বদলে আবার আগেরটাতে ফিরে যাবে। জ্ঞান গোঁসাই তাকে যতই কানের আরাম দিন, পেটের ভাত তো আর জোটাতে পারবেন না।

সকালের প্রথম সিগারেটটা ধরিয়ে সে কেয়া বাগচিকে ফোন করতে যাবে এমন সময় মৃদু স্বরে জ্ঞান গোঁসাই ‘ছন্দে ছন্দে নাচে নন্দদুলাল’ গেয়ে উঠলেন। আবার কেয়া বাগচি। আদিত্য ফোন ধরে বলল, ‘হ্যালো?’

‘সেই সকাল থেকে আপনাকে ফোন করছি, আপনি কিছুতেই ফোন ধরছেন না। ব্যাপার কী? অসুস্থ নাকি?’ ওপারে কেয়া বাগচির কন্ঠস্বর ঝনঝন করে বেজে উঠল। কেয়া মনে হল ধরেই নিয়েছে সকলেই তার মতো ভোর পাঁচটায় উঠে পড়ে।

আদিত্যর ভেবে দেখল, জ্ঞান গোঁসাই-এর গল্পটা বলতে গেলে অযথা জটিলতা বাড়বে। তাছাড়া এই সাত-সকালে খুব বেশি কথা বলতেও তার ভাল লাগছে না। সেক্ষেত্রে একটু-আধটু মিথ্যে বলতে দোষ নেই। সে সংক্ষেপে বলল, ‘না, না। তা নয়। আসলে ফোনটা ভুল করে সাইলেন্ট মোডে চলে গিয়েছিল।’

‘সাইলেন্ট মোড? আমি সকাল থেকে বোধহয় দশবার ফোন করেছি। সে যাক গে। শুনুন, একটা ব্যাপার ঘটেছে যে কারণে আপনাকে ফোন করা। কাল রাত্তিরে আমি আমার মোবাইলে একটা মেসেজ পেয়েছি। অজানা নম্বর থেকে মেসেজ। তাতে ইংরেজি হরফে বাংলায় লেখা, ‘আমি ভাল আছি, আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। চন্দ্রা।’ আমি বুঝতে পারছি না মেসেজটা সত্যি সত্যি চন্দ্রার কাছ থেকেই এসেছে কিনা। আপনার তো পুলিশের সঙ্গে চেনাশোনা আছে, আপনি নম্বরটা ট্রেস করতে পারবেন?’

‘অবশ্যই পারব। অবশ্যই পারব। চন্দ্রাকে খুঁজে বার করার ব্যাপারে এটা একটা ভাল লিড হতে পারে।’

‘তাহলে কি ধরে নেব চন্দ্রা বেঁচে আছে?’

‘আমার স্থির বিশ্বাস চন্দ্রা বেঁচে আছে। কিছুদিনের মধ্যেই আপনার বন্ধু ফিরে আসবে।’

কেয়া বাগচি ফোনটা রেখে দেবার পর আদিত্য খানিকক্ষণ চিন্তামগ্ন হয়ে সিগারেট খেল। তারপর কেয়া বাগচির পাঠানো নম্বরটা নিজের মোবাইলে সেভ করল। চন্দ্রার ছবি দুটো কেয়াকে পাঠানোর জন্য মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপ খুলে কেয়া বাগচি সার্চ দিতেই কেয়ার মুখের ছবি দেওয়া অ্যাকাউন্টটা বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে ছবি দুটো রয়েছে। সে নিবিষ্ট মনে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হল, এই ছবিটা তাকে সত্য উদ্ঘাটনে খুব সাহায্য করবে।

আদিত্য আবার কফি খাবে বলে কেটলিতে জল গরম করতে দিল। আর একটা সিগারেট ধরাল। সে কেয়া বাগচির কথাই ভাবছে। কেয়া বাগচির শরীরের গন্ধটা বারবার ফিরে আসছে তার স্মৃতিতে। কিছু ব্যাপার গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। সে অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবল। আরও দুতিনটে সিগারেট খেল। দুকাপ চা। মোবাইলের রিংটোন বদলে আবার আগের রিংটোনটাতে ফিরে গেল। তারপর রত্নার ফোনটা ডায়াল করল।

ওদিক থেকে রত্না সাড়া দেবার পর আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘তোর তো এখনও পুজোর ছুটি চলছে?’

‘অন্যদের চলছে। প্রিন্সিপ্যালকে মাঝে মাঝে যেতে হয়। কী ব্যাপার বলত?’

‘তেমন কিছু নয়। ভাবছিলাম, তোর কি কিছুক্ষণ কথা বলার সময় হবে? নাকি কলেজ যাবার তাড়া আছে?’

‘তুই বল কী বলবি। এই ছুটির মধ্যে সপ্তাহে তিন-চার দিন কলেজ যাচ্ছি। আজ যাব না। দুপুরে একটু হায়ার এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে যাব। কিন্তু তার দেরি আছে। তুই বল।’

‘পুজোর সময় তোদের বাড়িতে তোর এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মনে আছে? নামটা, যতদূর মনে পড়ছে, গার্গী বিশ্বাস।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ খুব মনে আছে। গার্গী আর তার স্বামী এসেছিল বলে তোদের গান শোনা মাটি হয়ে গেল। তা, গার্গীকে হঠাৎ মনে পড়ল কেন?’

‘বলছি কেন। তোর কি মনে আছে চন্দ্রাকে খোঁজ করার ব্যাপারে গার্গী বলেছিল কেয়া বাগচি বলে চন্দ্রার একজন বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে?’

‘একটু একটু মনে পড়ছে। চন্দ্রাকে খুঁজে পেয়েছিস?’

‘এখনও পাইনি। তবে মনে হচ্ছে খুব শিগগির পেয়ে যাব। শোন, তোকে একটা কাজ করতে হবে। গার্গীর কাছ থেকে জানতে হবে যথেষ্ট অ্যাট্র্যাক্টিভ হওয়া সত্ত্বেও কেয়া বাগচি এখনও বিয়ে করেনি কেন?’

‘ভারি অদ্ভূত প্রশ্ন তো! কেয়া বাগচি কেন বিয়ে করেনি গার্গী জানবে কী করে?’

‘জানাটা অস্বাভাবিক নয়। গার্গী কেয়া বাগচির ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’

‘গার্গী যদি জিজ্ঞেস করে কেন জানতে চাইছি? তখন কী বলব? আমি তো কেয়া বাগচিকে চিনিই না।’

‘বলবি, তোর এক বন্ধু একেবারে হাত-পা ভেঙে কেয়ার প্রেমে পড়ে গেছে। কেয়াকে প্রপোজ করার আগে সে শুধু জানতে চায় কেয়া কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে আছে কিনা।’

‘আমার বন্ধু? আমার কোন বন্ধু?’

‘গার্গী যদি সেই বন্ধুর নাম জানতে জোরাজুরি করে, বলবি তার নাম আদিত্যবর্ণ মজুমদার।’

ওপারে কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। রত্না বাস্তবিকই হতভম্ভ হয়ে গেছে। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে সে বলল, ‘আদিত্য, তুই কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস?’

‘ইয়ার্কি মারব কেন? আমি কি প্রেমে পড়তে পারি না? শুধু তোরাই প্রেমে পড়তে পারিস? তুই শুধু আমায় জেনে দে কেয়া বাগচির কোনও স্টেডি বয় ফ্রেন্ড আছে কিনা। আর থাকলে কেয়া তাকে এতদিন বিয়ে করেনি কেন? খবরটা জেনে দে, তারপর দ্যাখ আমি কী করি। খবরটা কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি জেনে দিতে হবে। ধর এই আজ-কালের মধ্যে।’

আরও মিনিট কয়েক পরে আদিত্য যখন ফোনটা রেখে দিচ্ছে তখনও রত্নার হতভম্ভ ভাবটা পুরো কাটেনি।

আদিত্য ফোনটা নামিয়ে রেখে ভাবছে এবার দাড়িটা কামিয়ে নেবে, আবার ফোনটা বেজে উঠল। এখন আর জ্ঞান গোঁসাই-এর গান নয়, ফোনটা গাঁকগাঁক করে বাজছিল। ফোনটা তুলতেই গৌতমের গলা। সেটাও গাঁকগাঁক করে ভেসে এল।

‘কলকাতা আসছিস কবে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘বলেছিলি না নভেম্বরের শেষে কলকাতা আসবি?’

‘আরে কলকাতা থেকেই তো বলছি। কাল রাত্তিরে এসেছি। দুএকদিনের জন্যে নয়, একেবারে পাকাপাকিভাবে। আজ থেকে আবার লালবাজারে বসছি।’

‘তোর অ্যাসাইনমেন্টটা কি শেষ হয়ে গেল?’

‘আরে না, না। অ্যাসাইনমেন্ট পুরোপুরি রয়েছে। তবে বাকি কাজটা দিল্লি থেকে নয়, কলকাতা থেকে বসে করব। কারণ এটা আমরা বুঝতে পেরেছি টেররিস্টদের আর্মসগুলো বাংলাদেশ বর্ডার পেরিয়ে আসে। আমার অপারেশনের হেড কোয়ার্টারটা কলকাতা থেকে হলে কাজে সুবিধে হবে।’

‘তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। মনে হচ্ছে আমি তোকে খানিকটা সাহায্য করতে পারব। তাছাড়া চন্দ্রা সেন অন্তর্ধানের কেসটা প্রায় গুটিয়ে এনেছি। সেই ব্যাপারেও তোর সাহায্য দরকার। কবে তোর সঙ্গে দেখা করব?’

‘দ্য সুনার দ্য বেটার। আজ জয়েন করছি, কিছু হাবিজাবি ফরম্যালিটি আছে। কাল আবার কালীপুজো। ছুটি। তুই পরশু সকালের দিকে চলে আয়। ধর এই এগারোটা নাগাদ?’

‘চলে আসছি। তুই গেটে আমার নামটা বলে রাখিস। আজকাল লালবাজারে ঢুকতে খুব অসুবিধে হচ্ছে।’

‘অবশ্যই বলে রাখব। তুই চলে আয়।’

‘ঠিক আছে। পরশু এগারোটার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।’

একটু পরে আদিত্য গালে সাবান লাগিয়ে রেজার বোলাতে যাবে এমন সময় আয়না দিয়ে দ্যাখে একটা মুন্ডু দরজা ফাঁক করে উঁকি মারছে। বিমল।

‘ভেতরে এসে বোসো।’ আদিত্য কামানো থামিয়ে বলল। ‘বলরামকে একটু চা দিতে বলো। আমি ততক্ষণে দাড়িটা কামিয়ে নিই।’

একটু থেমে আবার আদিত্য বলল, ‘দ্যাখো আমার ঝোলানো শার্টটার পকেটে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট আছে। বলরামকে টাকাটা দিয়ে বলো চা আর প্রজাপতি বিস্কুট আনতে।’ বিমলের পছন্দের সেই প্রজাপতি বিস্কুট।

বিমল ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটু পরে ফিরে এল। এসে বিছানার এক ধারে বসেছে। আদিত্যর দাড়ি কামানো শেষ। সে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘তারপর? সেনবাটি থেকে আর কোনও খবর পেলে?’

‘একটা দরকারি খবর পেয়েছি স্যার। মনে হল আপনাকে একবার জানাই। ফোনেই জানানো যেত। তা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একবার দেখাও করে যাই।’

‘ভাল করেছ। আগে বলো তোমার বউ আর মেয়ে কেমন আছে?’

‘মেয়ে মোটামুটি সেরে উঠেছে স্যার। ভাইফোঁটার পর ওদের ইস্কুল খুলবে। কিন্তু গিন্নি ঠিক সারছে না। মনে হয় অপরেশনটা ঠিকমতো হয়নি। ডাক্তার বলছে আর একবার অপরেশন করতে হবে। ডাক্তার তো বলেই খালাশ। আমি এত টাকা কোথায় পাই?’

‘শোনো, দ্বিতীয় বার অপরেশন করানোর আগে আর একজন ডাক্তার দেখাও। এসব ব্যাপারে সব সময় আর একটা মত নেওয়া দরকার। আমার এক বন্ধু আছে। পিজির ডাক্তার, খুব নাম করা। তাকে একবার আউটডোরে দেখাও। আমি বলে দিলে বেশিক্ষণ বসতে হবে না।’

‘নিশ্চয় দেখাবো স্যার। আপনি শুধু বলে দেবেন কবে দেখাতে হবে।’

‘আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে তোমাকে দুএকদিনের মধ্যেই জানিয়ে দেব।’

বলরাম কেটলিতে চা নিয়ে এসেছে। সঙ্গে মাটির ভাঁড়, খবর কাগজের ঠোঙায় প্রজাপতি বিস্কুট।

‘এবার বলো কী জানতে পারলে।’ আদিত্য চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বলল।

 ‘বলছি স্যার। এই কদিন নিয়মিত বিল্টুর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। ও কোনও সন্দেহ করেনি। ওর মনে হয়েছে আমি চাকরির জন্যে ওর কাছে ঘুরঘুর করছি।’

‘আবার সেই কাকের মাংসের বিরিয়ানি খাইয়েছ?’

‘না স্যার এবার আর বিরিয়ানি নয়।’ বিমল মুচকি হাসল। ‘বিল্টুই আমাকে ওর বস্তির পেছন দিকে একটা চোলাইয়ের ঠেকে নিয়ে গেল। হাবেভাবে বুঝলাম ও চাইছে আমি ওকে কয়েক পাত্তর খাওয়াই। আমাকেও খাবার জন্য জোর করছিল। আপনি তো জানেন স্যার ওসব আমি খাই না। বললাম, আমি খাই না। পেটে ঘা আছে। মাল খেয়েই হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আবার যদি মদ খেতে শুরু করি আমাকে আর বাঁচানো যাবে না। মনে হল ও বিশ্বাস করেছে। কয়েক গেলাস খাবার পর, যখন ওর বেশ নেশা হয়েছে, উল্টোপাল্টা বকছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কাজটা তো বলেছিলে খুব ভারি নয়। মেমসাহেব কি আজকাল বাড়িতেই থাকেন? ও বলল, হ্যাঁ বাড়িতেই বেশি থাকেন। মেমসাহেবের এক বন্ধু আছে। মন্টু রায়। সে নাকি সাহেব কম্পানিতে বড় চাকরি করে। রোজই সন্ধেবেলা মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসে। মাঝে মাঝে রাত্তিরে থেকেও যায়। এই নিয়ে কাজের মাসি থেকে বাড়ির দরোয়ান পর্যন্ত সবাই নানান কথা বলে। ওই বাড়িতে যে পুরোনো বামুন ঠাকুর আছে সে বলেছে, মেমসাহেব আর মন্টু রায় নাকি রাত্তিরে একই ঘরে শোয়। অথচ বাড়িতে তো ঘরের অভাব নেই। আমি বললাম, বলো কী, এতো রীতিমতো কেচ্ছা। বিল্টু ভারিক্কি চালে বলল, সব বড় ঘরেই ওরকম কেচ্ছা একটা দুটো থাকে। যেন কত বড় বড় ঘরের লোকদের ও চেনে। সে যাই হোক, আমি বিল্টুকে একটু খুঁচিয়ে দিয়ে বললাম, এসব তো তোমার শোনা কথা। তুমি নিজের চোখে কিছু দেখেছ? শুনে বিল্টুর কী রাগ। বলল, দেখিনি মানে? আমি কি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলছি? প্রত্যেক সপ্তাহে একদিন কি দুদিন দুজনে মিলে ক্যামাক স্ট্রিটে প্রোমোটারের আপিসে যায়। আমার গাড়িতেই তো যায়। কখনও কখনও সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি না ফিরে দুজনে চলে যায় ডায়মন্ডহারবার কিংবা কোলাঘাট। তখনও তো আমিই গাড়ি চালাই। একবার তো দীঘায় গিয়ে দুদিন একসঙ্গে কাটিয়ে এল। আমিই তো নিয়ে গেলাম। আমার মতো ওদের কেচ্ছা আর কে জানে? বিল্টুর মতে, মেমসাহেবের মাথার ওপর বলার তো কেউ নেই। তাই যা-ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে। আমি বললাম, অত ঘন ঘন প্রোমোটারের কাছে যায় কেন? বিল্টু বলল, মনে হয় আলিপুরের বাড়িটা প্রোমোটারের কাছে বিক্রি করে দেবে। গাড়িতে উঠে মেমসাহেব আর মন্টু রায় ইংরিজিতে কথা বলে, যাতে আমি বুঝতে না পারি। কিন্তু আমি একটু একটু ইংরিজি বুঝি। তাতেই বুঝলাম বাড়িটা বিক্রির মতলব চলছে। সেদিন রাত্তিরবেলা ধরাধরি করে বিল্টুকে বাড়ি পৌঁছে দিলাম। ওর বউএর কী রাগ। আমাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল দিল। বলল, আমার মতো বন্ধুদের জন্যেই নাকি বিল্টু খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’

‘প্রোমোটারের ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করেছিলে?’

‘করেছিলাম। ঠিকানাটা বিল্টু বলতে পারল না। তবে বলল, সারকুলার রোড দিয়ে ক্যামাক স্ট্রিটে ঢুকেই বাঁদিকে যে প্রথম দশতলা বাড়িটা পড়ে সেটাতে প্রোমোটারের আপিস। কত তলায় বিল্টু জানে না। তবে প্রোমোটারের নাম জানে, নবীন সরাফ।’

‘ওতেই হবে। চমৎকার খবর এনেছো। নাও আর একটা বিস্কুট খাও।’ প্রজাপতি বিস্কুটের ঠোঙাটা আদিত্য বিমলের দিকে এগিয়ে দিল। বিমল যখন উঠল তখন প্রায় বেলা বারোটা।

অফিসে বেরোবার আগে আদিত্য আর একটা নম্বর ডায়াল করল। ওদিক থেকে সাড়া পেয়ে সে বলল, ‘নূপুর, একটু কথা বলতে পারবে?’

‘আমি ক্লাশে আছি আদিত্যদা। তোমাকে দশ মিনিট বাদে ফোন করছি।’ নূপুর ফিসফিস করে বলল।

আদিত্য ফোন রেখে কফির জল বসাল। সিগারেট ধরাল। একটু বেশি সিগারেট খাওয়া হয়ে যাচ্ছে। আজকাল মাঝে মাঝে বুকের বাঁদিকটা ব্যথা করে। একটা চিনচিনে ব্যথা। হার্ট। আদিত্যর পরিবারে হার্টের অসুখের ইতিহাস আছে। বাবা হার্ট অ্যাটাকেই মারা যান। সিগারেট যে তার মারাত্মক ক্ষতি করছে এটা যে আদিত্য বোঝে না তা নয়। কিন্তু কিছুতেই সিগারেটটা ছাড়তে পারছে না। এমনকি কমাতেও পারছে না। বিশেষ করে এইসব সময়ে যখন একটা রহস্য একটু একটু করে উন্মোচিত হচ্ছে। আদিত্য কফি খেতে খেতে আরও কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় ডুবে রইল।

নূপুরের ফোনটা এল মিনিট পনের পরে। ‘আদিত্যদা, আমিই তোমাকে ফোন করতাম। খবর আছে। আমি এখন স্কুলের বাইরে চলে এসেছি। কাছাকাছি কেউ নেই। ফ্রিলি কথা বলা যাবে।’

‘আমি দুএকটা জিনিস আগে বলে নিই। বনবীথি ইস্কুলের মালিক রণবীর রায়ের ঠিকানাটা তোমাদের অফিস থেকে জোগাড় করে আমাকে টেক্সট করতে হবে। সেদিন নিয়ে নেব ভেবেছিলাম, ভুলে গেছি। আর গৌর বাঁড়ুজ্জেকে একটু চোখে চোখে রেখ। মনে হয়, ও যতটা বলছে তার থেকে আর একটু বেশি জানে। ফলে ওর বিপদ হতে পারে। পার্থর পেনটা পাওয়া গেল?’

‘না আদিত্যদা। আমি পাইনি, অন্য দিদিমনিরাও কেউ পায়নি। হয়ত অন্য কোথাও পড়ে গেছে।’

‘সেই মর্নিং ডিউ ইস্কুলটার খবর নিয়েছ?’

‘নিয়েছি আদিত্যদা। একটা মারোয়াড়ি স্কুলটা চালায়। ঝানু ব্যাবসাদার। বনবীথির নামে গুজব ছড়ানো ওর পক্ষে মোটেই অসম্ভব নয়। তবে ব্যবসার স্বার্থে একটা মানুষকে লোপাট করে দেওয়াটা ঠিক ওর সঙ্গে মেলাতে পারছি না। আমার মনে হয়, অতটা রিস্ক ও নেবে না। তবে মানুষকে ওপর ওপর দেখে তো সব সময় বোঝা যায় না।’

‘ঠিক আছে। আমি বুঝে নিয়েছি যা বোঝার। আর কিছু খবর আছে?’

‘আসল খবরটাই তো বলা হয়নি। একজন সাপুড়ের সন্ধান পেয়েছি। তার মেয়ে আমাদের ইস্কুলে ক্লাশ থ্রিতে পড়ে। সাপুড়ে বলল, কিছুদিন আগে বেশ মোটা টাকা দিয়ে একটা লোক ওর কাছ থেকে একটা কালো কেউটে সাপ কিনেছে। লোকটাকে সাপুড়ে চেনে না। এই অঞ্চলের লোক নয়। কিন্তু আসল কথাটা হল, সাপটার বিষদাঁত ভাঙা ছিল। মানে, কাউকে ক্ষতি করার কোনও ক্ষমতা সাপটার ছিল না।’

‘ভেরি ইন্টারেস্টিং। ভেরি ইন্টারেস্টিং।’ আদিত্য উত্তেজিত গলায় বলল।

আদিত্য আপিসে পৌঁছে দেখল নূপুরের কাছ থেকে রণবীর রায়ের ঠিকানাসুদ্ধু এস এম এস-টা এসে গেছে।

(২)

সার্কুলার রোডের দিক থেকে ক্যামাক স্ট্রিটে ঢুকলে বাঁ হাতে যে প্রথম হাইরাইজটা চোখে পড়ে তার নাম মধুবন। উল্টোদিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আদিত্য গুণে দেখল বাড়িটা দশতলাই বটে। রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথের দোকান থেকে একটা বিট নুন দেওয়া কালো চা খেল আদিত্য। একটা সিগারেট খেল। তারপর খুব স্মার্টলি মধুবন নামক বাড়ির ভেতরে ঢুকল। একতলায় ঢুকেই রিশেপশন, তবে সেখানে কেউ বসে নেই। রিশেপশনের বাঁদিকে একটা দেয়াল জুড়ে কাঠের প্যানেলে সারি সারি নেমপ্লেট। আদিত্য তার সামনে গিয়ে নভীন সরাফ নামটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করতে লাগল। নেমপ্লেটগুলোতে নানা কম্পানির নাম লেখা, প্রত্যেকটির পাশে কম্পানিটির ফ্ল্যাট নম্বর এবং সেটি কত তলায় সেটা লেখা আছে। ব্যক্তির নাম নেই বললেই চলে। অর্থাৎ এই বাড়িটায় সবই অফিস, রেসিডেন্সিয়াল ফ্ল্যাট প্রায় নেই। নিশ্চয় এই নামের ভিড়ে নভীন সরাফের কম্পানির নামও রয়েছে, কিন্তু ঠিক নামটা না জানলে সেটা খুঁজে বার করবে কী করে? অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আদিত্য ভাবছে কী করবে এমন সময় নীল ইউনিফর্ম পরা একটি লোক কোথা থেকে যেন উদয় হয়ে বলল, ‘কাঁহা জানা হ্যায়?’

আদিত্য হাতে চাঁদ পেল। সে নরম গলায় বলল, ‘ইধর নভীন সরাফজীকা এক রিয়াল এস্টেটকা অফিস হ্যায়। উধর জানা হ্যায়।’

এবার লোকটা বাংলায় বলল, ‘সরাফ সাহেবের অফিস ছতলায়। ফ্ল্যাট সিক্স এ। কম্পানির নাম নভনীড়। এদিক দিয়ে সোজা চলে গেলে লিফট পেয়ে যাবেন।’ আদিত্যর হিন্দি শুনে লোকটার নিশ্চয় করুণা হয়েছে। তবে লোকটা নিজে অবাঙালি, তার বাংলায় পশ্চিমি টান আছে।

ছ-তলায় উঠে বাঁ দিকে তাকালেই মস্ত কাঁচের দরজা চোখে পড়ে, তার ওপরে ইংরেজিতে লেখা নভনীড়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আদিত্য দেখল সাত-আটজন সুবেশ যুবক-যুবতী নীরবে কাজ করছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কর্পোরেট পরিবেশ।

আদিত্যর মন বলছিল, এখানে ইংরেজিতে কথা বললে লোকে তাকে বেশি পাত্তা দেবে।

সামনেই যে মেয়েটি বসেছিল আদিত্য তাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ‘ইজ ইট পসিবল টু সি মিস্টার সরাফ?’

‘মে আই নো হোয়াট ইট ইজ অ্যাবাউট?’ মেয়েটি কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে ঠান্ডা গলায় বলল।

‘মাই কাম্পানি ইজ লুকিং ফর আ প্রপার্টি ইন আলিপুর। প্রেফারেবলি আ লারজ কনডো। উই হার্ড মিস্টার সরাফ ইজ সুন গোইং টু প্রোমোট ওয়ান। বাট ইট হ্যাজ নট বিন অ্যাডভারটাইজড ইয়েট। আই ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট ইট।’

মেয়েটি কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর আঙুল তুলে ডানদিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাটস হিজ সেক্রেটারি। প্লিজ টক টু হার।’

আরও কিছুক্ষণ ইংরেজিতে কথাবার্তা চালানোর পর আদিত্য নভীন সরাফের ঘরে ঢোকার অনুমতি পেল। ঢুকে দেখল এই নভেম্বর মাসেও কড়া এসি চলছে। সরাফ সাহেব তার টেবিলে নেই। পাশের একটা কাউচে আধশোয়া অবস্থায় একটা বিদেশি রিয়াল এস্টেট পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন। তার সামনে একটি কফি টেবিলে খাদ্য ও পানীয়ের ভুক্তাবশেষ সহ কিছু কাপ প্লেট পড়ে আছে। বোঝা যায় তিনি একটু আগে তাঁর মধ্যাহ্নভোজন সমাপ্ত করে অধুনা বিশ্রাম নিচ্ছেন। সরাফ সাহেব ঈষৎ স্থূলকায়। তার মাথার চুলগুলো সব সাদা, সেদিক থেকে তার নাম নবীনের বদলে প্রবীণ হলে আরও লাগসই হতো।

আদিত্যকে ঘরে ঢুকতে দেখে নভীন সরাফ উঠে দাঁড়ালেন, আদিত্যকে তার টেবিল সংলগ্ন চেয়ারে বসার ইংগিত করলেন। নিজে এসে আদিত্যর উল্টোদিকে নিজের চেয়ারে বসলেন। পরিষ্কার বাংলাতে বললেন, ‘বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘আপনি বাঙালি তো?’

আদিত্য ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। তার চেহারায় নিশ্চয় একটা বাঙালিয়ানা আছে যা দিয়ে লোকে তাকে বাঙালি বলে চট করে চিনে যায়। নভীন সরাফের বাংলাটা প্রায় নিখুঁত।

‘আপনার বাংলাটা কিন্তু চমৎকার।’ আদিত্য বলল।

‘আমি তো কলকাতাতেই জন্মেছি, বড় হয়েছি। সেন্ট লরেন্স স্কুলে পড়তাম, তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। আপনার কি কোনও বিজনেস কার্ড আছে?’

সরাফ সাহেব যে বিজনেস কার্ড দেখতে চাইতে পারেন সেই সম্ভাবনাটা আদিত্যর হিসেবের মধ্যে ছিল, তাই মনে মনে সে এটার জন্যে তৈরি হয়ে এসেছিল। সে বলল, ‘আমার বিজনেস কার্ড দেবার একটু অসুবিধে আছে। কেন সেটা বললেই বুঝতে পারবেন।’

দরজায় টোকা দিয়ে বেয়ারা ঢুকল। ব্যবহৃত কাপ-প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে বেরিয়ে যেতে নভীন সরাফ আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন কী বলছিলেন।’

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমি একজন বিখ্যাত ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের পারসোনাল সেক্রেটারি। আমার বসের নামটা বললেই চিনতে পারবেন, তাই বলছি না। উনি খুব কনফিডেন্সিয়ালি আলিপুরে একটা রেসিডেন্সিয়াল কনডো কিনতে চান। এটা উনি ওঁর স্পেশাল এক বন্ধুকে গিফট করতে চান। এবং উনি চান না কেউ জানুক উনি এইরকম একটা কনডো কিনছেন বা গিফট করছেন। কনডোটা হবে এক্সক্লুসিভ, সেপারেট অ্যান্ড লাক্সুরিয়াস। টাকাটা কোনও সমস্যা নয়। আমার বস শুনেছেন আলিপুরে আপনারা একটা বড় প্রপার্টি প্রোমোট করছেন। কথাটা কি ঠিক?’

নভীন সরাফ একটু ইতস্তত করলেন। তারপর থেমে থেমে বললে, ‘আপনার বস ঠিকই শুনেছেন।’

‘এটা আলিপুরের কোন জায়গায়?’

‘প্রপার আলিপুর। বর্ধমান রোড।’

‘গুড। আমার বসের আরেকটা রিকয়ারমেন্ট হল, কনডোর দক্ষিণ দিকটা সম্পূর্ণ খোলা হতে হবে।’

‘আপনারা কত স্কোয়ার ফিট চাইছেন?’

‘আমরা চাইছি একটা টু-স্টোরি কনডোমিনিয়াম যার দুটো ফ্লোর মিলিয়ে অন্তত পাঁচ হাজার স্কোয়ার ফিট কার্পেট এরিয়া থাকবে। আর একটা কথা। ভেতরের ডিজাইনটা আমাদের আর্কিটেক্ট করবে। তার জন্য অবশ্য যেটা এক্সট্রা লাগবে আমরা দিয়ে দেব। আর, কনডোটা টপ ফ্লোরে হতে হবে। যাকে বলে পেন্টহাউস। আবার বলছি, টাকাটা এখানে কোনও ফ্যাক্টর নয়।’

সরাফ সাহেবের কপালে সামান্য চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তিনি সাবধানি গলায় বললেন, ‘দক্ষিণ-খোলা কনডো আপনাদের নিশ্চয় দিতে পারব, কিন্তু টপ ফ্লোরটা গ্যারেন্টি করতে পারছি না। আসলে, যদিও আমরা এখনও অ্যাড দিইনি, বাই ওয়ার্ড অফ মাউথ আমাদের প্রজেক্ট-এর কথাটা রেলেভেন্ট সার্কেলে অলরেডি ছড়িয়ে গেছে। অ্যাট দিস মোমেন্ট টপ ফ্লোরে দক্ষিণ-খোলা ফ্ল্যাট একটাও আর খালি নেই। সব বুক হয়ে গেছে।’

‘তাহলে অবশ্য আমার বস ইন্টারেস্টেড হবেন না। উনি বারবার আমাকে বলে দিয়েছেন দক্ষিণ-খোলা পেন্টহাউস ছাড়া উনি নেবেন না। দেখুন, আমি আবার বলছি, মানি ইজ নট আ ফ্যাক্টর। মাই বস ইজ উইলিং টু পে দ্য প্রপার প্রাইস প্রোভাইডেড হি গেটস হোয়াট হি ওয়ান্টস।’

 সরাফ সাহেব চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। আদিত্যর মনে হল তিনি লোভে পড়ে গেছেন। তারপর বললেন, ‘দেখুন আমাদের এই প্রজেক্টটা খুব এক্সক্লুসিভ। খুব বেশি ফ্ল্যাট এখানে আমরা রাখছি না। কিন্তু প্রত্যেকটা ফ্ল্যাট খুব বড়। মিনিমাম সাইজ আড়াই হাজার স্কোয়ার ফিট, ম্যাক্সিমাম সাড়ে তিন হাজার। আপনাকে একটা পাঁচ-ছয় হাজারের ফ্ল্যাট দিতে গেলে দুটো ফ্ল্যাটকে একসঙ্গে জুড়তে হবে। দেখুন, যদিও আমরা অ্যাডভারটাইস করিনি তবু জাস্ট বাই ওয়ার্ড অফ মাউথ প্রজেক্টের খবরটা স্প্রেড করে আমার প্রায় সমস্ত ফ্ল্যাট বুক হয়ে গেছে। বুঝতেই পারছেন, যারা বুক করেছেন দে আর অল রিচ পিপল। ফ্ল্যাট বুক করার সময় এরা অর্ধেক টাকা অ্যাডভান্স করে দিয়েছেন। মোস্ট অফ দেম আর মোর কন্সার্নড অ্যাবাউট গেটিং আ ফ্ল্যাট ইন দিস এক্সক্লুসিভ প্রপার্টি দ্যান স্পেন্ডিং মানি। আমি খুব চেষ্টা করে দেখব যাদের টপ ফ্লোরে সাউথ-ওপেন ফ্ল্যাট প্রমিস করেছি, তাদের মধ্যে অন্তত দুজন হেভি ডিস্কাউন্ট দিলে অন্য ফ্ল্যাট নিতে রাজি হন কিনা। আমাদের বালিগঞ্জেও একটা প্রজেক্ট চলছে। দেখতে হবে ডিসকাউন্ট দিয়ে সেখানেও এদের রিলোকেট করা যায় নাকি। এই ডিস্কাউন্টের কস্টটা কিন্তু আপনাদের বেয়ার করতে হবে।’

‘সেটা আমরা গ্ল্যাডলি বেয়ার করব। আবার বলছি এখানে টাকাটা কোনও ফ্যাক্টরই নয়। তাছাড়া দেরি করে আসার জন্য একটা প্রাইস তো আমাদের দিতেই হবে। আপনি শুধু আমার বস-এর মনের মত একটা কনডো তৈরি করে দিন। সমস্ত ব্যাপারটা কিন্তু একেবারে সিক্রেট রাখতে হবে। আপনাদের কাছ থেকে গ্রিন সিগনাল পেলে তবেই আমরা আমাদের আইডেন্টিটি ডাইভালজ করব। কিন্তু সেটা শুধু আপনি জানবেন। আর কেউ জানবে না কনডোটা আসলে কে কিনছে। আপনার একটা কার্ড দিন। আপনি কতটা এগোলেন জানার জন্য আমি আপনাকে ফোন করব। বলুন, কদিন পরে ফোন করব?’

‘আপনি অন্তত দুটো উইক আমাকে সময় দিন। আপনারা যেরকম চাইছেন তাতে তিন-চারজনের সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে তারা অন্য ফ্ল্যাট নিতে রাজি আছেন কিনা। ইট উইল টেক টাইম। আপনার ফোন নাম্বারটা আমাকে দেবেন?’

আদিত্য টেবিলের ওপর থেকে একটা স্লিপ নিয়ে তাতে নিজের ফোন নাম্বারটা লিখে নভীন সরাফের হাতে দিল। বলল, ‘আজ চলি।’

‘চললেন? একটু চা খাবেন না?’

‘আজ থাক। অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে। যদি ডিলটা হয় তাহলে এসে মিষ্টি খেয়ে যাব।’ আদিত্য উঠে দাঁড়াল।

রাস্তায় নেমে আদিত্য সারকুলার রোডের দিকে হাঁটছিল, পথে একটা চায়ের দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা চায়ের ফরমাস করল। একটা সিগারেট ধরাল। তারপর দোকানের বেঞ্চিতে বসে ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। নভীন সরাফ কি কুমুদকিশোর সেনের শেষ উইলের কথা জানে? কমলিকা সেনও কি এই উইলের কথা জানে? ভাবতে ভাবতে আদিত্য পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে বিমলকে ফোন করল।

‘তোমাকে খুব চটপট একট কাজ করতে হবে। তোমার বন্ধু বিল্টুর কাছ থেকে কায়দা করে জেনে দিতে হবে তার মেমসাহেব এখন বাড়িতে আছেন কিনা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে জেনে দিতে পারবে?’

‘পারব স্যার। জেনে নিয়ে ফোন করছি।’

আদিত্য আর একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে আবার একটা সিগারেট ধরাল। কেউ না কেউ যে কুমুদকিশোরের শেষ উইলটার কথা জানে এবং সেটাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই দলে কে কে আছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, যারা উইলটাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে তারা কি চন্দ্রা সেনকেও সরিয়ে ফেলেছে? তৃতীয় প্রশ্ন, কুমুদকিশোরের শেষ উইলটা এখন কোথায় আছে?

মোবাইলটা বাজছে। বিমলের ফোন।

‘বিল্টু বলল মেমসাহেব আজ সারাদিন কোথাও বেরোননি। বাড়িতেই আছেন। বিল্টুকে বলেছেন, তুমি বাড়ি চলে যেতে পার। আজ বেরোচ্ছি না।’

আদিত্য পকেটে ফোন রেখে উঠে দাঁড়াল। এখান থেকে আলিপুর যাবার সরাসরি কোনও বাস নেই। ওলা-উবার কিছু একটা ধরতে হবে।

 কমলিকা সেন সম্ভবত রূপনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। উর্দি-পরা বেয়ারা আদিত্যকে সেই ঘরটিতে বসতে বলল যেখানে আগের দিন গানের অনুষ্ঠান হয়েছিল। ঘরটা হারিয়ে যাবার মতো বড়। আদিত্য এক কোণে বসে আছে তো বসেই আছে। মিনিট পঁচিশ পরে কমলিকা সেন ঘরে ঢুকলেন, মুখচোখ সামান্য ফোলা, অনেকক্ষণ ঘুমোলে যেমন হয়।

আদিত্য উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম বলে ক্ষমা চাইছি। বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না। একটা দুটো জিনিস জিজ্ঞেস করেই চলে যাব।’

‘না, না। বিরক্ত করার কী আছে? আপনি আগে চা খান। আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি বলে আমারই ক্ষমা চাওয়া উচিত।’

বেয়ারা সুদৃশ্য টি-পটে চা নিয়ে এল, সঙ্গে দুরকম বিস্কুট, প্লাম কেক। চায়ে চুমুক দিয়ে আদিত্যর প্রবল সুখানুভূতি হল। খাঁটি দার্জিলিং।

‘আপনি আপনার প্রশ্ন শুরু করার আগে আমি একটা অনুরোধ করে নিই। আমার খুব ইচ্ছে নন্দন চক্রবর্তী একদিন আমার এখানে এসে গান করুন। আপনার বন্ধু অমিতাভ মিত্র যদি ওঁকে একবার অনুরোধ করেন তাহলেই উনি রাজি হয়ে যাবেন। আমিও অমিতাভবাবুকে ফোন করব। কিন্তু আপনি বললে তার আলাদা ওজন হবে।’

‘বলব, অবশ্যই বলব।’ আদিত্য আবার চায়ে চুমুক দিল। ‘এই চা-টা কিন্তু সত্যিই চমৎকার।’

‘আমার এক টি-টেস্টার বন্ধু আছে। এই চা-টা সে এনে দেয়।’ কমলিকা সেন তৃপ্তির হাসি হাসলেন। চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বললেন, ‘এবার বলুন কী জিজ্ঞেস করবেন।’

আদিত্য প্রশ্নটা করার আগে কিছুক্ষণ নিজেকে গুছিয়ে নিল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘সেদিন আপনি বলেছিলেন, আপনি এই বাড়িটা বিক্রি করে দেবার কথা ভাবছেন। কিন্তু যেহেতু চন্দ্রা তার অংশটা বিক্রি করতে চাইছে না তাই বাড়িটার যা দাম হওয়া উচিত তার থেকে অনেক কম দাম আপনি পাচ্ছেন। ঠিক বলছি তো?’

‘ঠিক বলছেন। এবং এটা নিয়ে যে চন্দ্রার সঙ্গে আমার একটা বড় রকমের কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে সেটাও এখন পাবলিক নলেজ।’

‘ঠিক। এখন কথা হচ্ছে যে কুমুদকিশোর সেন মারা যাবার আগে তার পুরোনো উইলটা বদলে একটা নতুন উইল করেছিলেন। এটা কি আপনি জানেন?’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কমলিকা সেনের মুখের অভিব্যক্তিটা বদলে গেল। প্রথমে বিস্ময় এবং পরে রাগের চিহ্ন ফুটে উঠল তাঁর মুখে।

‘আমার স্বামী মারা যাবার আগে আর একটা উইল করেছিলেন? আমাকে না জানিয়ে? আপনি কি আমাকে ব্লাফ দেবার চেষ্টা করছেন? আপনার মতলবটা কী?’ ভদ্রতার মুখোশ খুলে গিয়ে কমলিকা সেনের দাঁত-নখ বেরিয়ে গেছে।

‘তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি কুমুদকিশোরের শেষ উইলটির বিষয়ে আপনি কিছুই জানেন না।’ আদিত্য খুব শান্তভাবে বলল।

‘ওরকম একটা উইল থাকলে তো জানব। ওরকম কোনও উইলের অস্তিত্ব নেই। আপনার উদ্দেশ্যটা কী? আমি কিন্তু আপনাকে আর খুব একটা সময় দিতে পারব না।’ কমলিকা সেনের গলা বেশ কয়েক পর্দা ওপরে উঠেছে।

‘মিসেস সেন আপনি একটু শান্ত হোন। সত্যটা জানা ছাড়া আমার আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। নতুন উইল যে একটা হয়েছিল সেটা প্রমাণ করা খুব কঠিন নয়। তিনজন সাক্ষী ছিল সেই উইলের। একজন আপনার পুরোনো ড্রাইভার মদন মান্না। অন্য দুজনের একজন আপনার স্বামীর আর্দালি রামসেবক পাসোয়ান, আর অন্যজন আপনার স্বামীর ক্লার্ক নিমাই সরকার। মদনবাবুর সঙ্গে আমার নিজের কথা হয়েছে। পুলিশও তখন উপস্থিত ছিল। উনি যে সাক্ষী হিসেবে উইলে সই করেছিলেন সেটা উনি স্বীকার করেছেন। অন্য দুজন সাক্ষীর সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।’

‘আপনি মিথ্যে বলছেন!’ কমলিকা সেনের গলা এখনও চড়া পর্দায়।

‘এখানেই ব্যাপারটা শেষ নয়। মদনবাবু যাতে উইলের ব্যাপারটা চেপে যান তার জন্য তাকে মোটা টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেই টাকা নিয়ে চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এটাও কি আপনি জানতেন না?’

‘মদনবাবু চাকরি ছেড়ে দিতে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু উনি যে ঘুষ নিয়ে চাকরি ছাড়ছেন সেটা আমি কী করে জানব?’ কমলিকা সেন এখনও বেশ শক্ত আছেন।

‘মদনকে চাকরি ছাড়ার জন্য কে ঘুষ দিতে পারে? আপনার কোনও ধারণা আছে?’ কমলিকা সেনের চোখের দিকে তাকিয়ে আদিত্য প্রশ্ন করল।

‘আমি কী করে জানব কে কাকে ঘুষ দিয়েছে?’

‘আমার প্রগলভতা মাফ করবেন মেসেস সেন, আপনি যাদের নিকটতম বন্ধু ভাবছেন তারা কিন্তু আপনাকে নির্দয়ভাবে ব্যবহার করছে। কুমুদকিশোরের শেষ উইলটা প্রকাশ পেলে তাদের অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে। এর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা হবে।’

‘কী আছে সেই উইলে?’ কমলিকা সেনের গলা একটু কাঁপছে।

‘যেটা আছে সেটা আপনার পক্ষে ভাল নয়। কুমুদকিশোরের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী কুমুদকিশোরের মৃত্যুর পর তার আলিপুরের বাড়ি এবং সেই বাড়ির সংলগ্ন জমির সবটা পাবেন তার মেয়ে চন্দ্রলেখা সেন আর হাজারিবাগের বাড়ি ও জমির সবটা পাবেন তার স্ত্রী কমলিকা সেন, অর্থাৎ আপনি। আর টাকা যা থাকবে তা সমান ভাগে আপনাদের দুজনের মধ্যে ভাগ হবে। তবে আলিপুরের এই বাড়িটায় আপনি যতদিন খুশি থাকতে পারবেন। এখান থেকে আপনাকে কেউ তাড়াতে পারবে না।’

কমলিকা সেনকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি কাঁচের জগ থেকে এক গ্লাস জল ঢেলে এক ঢোঁকে প্রায় পুরোটা খেয়ে ফেললেন। তারপর অনেকক্ষণ কপালে বুড়ো আঙুল ও তর্জনী ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। কয়েক মিনিট পরে তিনি খুব মৃদু গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘উইলটা এখন কোথায় আছে?’

‘সেটা কেউ জানে না। আপনাদের সলিসিটররাও এই উইলটার কথা জানেন না। হয়ত ওটা চন্দ্রার কাছে আছে। কিন্তু সে নিজেই তো এখন নিরুদ্দেশ। তবে যতদিন না সে নিজে সেই উইলটা নিয়ে কোর্টে গিয়ে তার দাবী জানাচ্ছে, আইনের ভাষায় যতদিন না এই নতুন উইলটা প্রোবেট করা হচ্ছে, ততদিন কিন্তু পুরোনো উইলটাই কার্যকর থাকবে। এই দাবী জানানোর কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে কিনা আমি বলতে পারব না।’

‘আমি এসবের কিছুই জানতাম না, বিশ্বাস করুন, কিছুই জানতাম না।’ আদিত্যর মনে হল কথাগুলো বলতে কমলিকা সেনের কষ্ট হচ্ছে।

‘আমি না হয় আপনার কথা বিশ্বাস করলাম, কিন্তু পুলিশ কি বিশ্বাস করবে?’ খানিকটা কড়া গলায় আদিত্য বলল। ‘নতুন উইলটা বেরিয়ে পড়লে আপনার অন্তত একশ কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে যাবে, তাই ওটা নষ্ট করে ফেলতে পারলে আপনার তো বিলক্ষণ লাভ আছে।’

‘একশ কোটি! আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন! আপনি বলতে চাইছেন এই পুরো বাড়িটার দাম দুশ কোটি?’ কমলিকা সেন আর সব কিছু ভুলে অবাক হয়ে গেছেন।

‘তার থেকে বেশি বই কম হবে না।’

মিনিট দশেক পরে রত্নার ফোন এল। আদিত্য তখন সেনবাটি থেকে বেরিয়ে মেট্রো ধরবে বলে কালীঘাট স্টেশনের দিকে হাঁটছে।

‘তোর কপালটা ভাল না মন্দ বলতে পারছি না রে, আদিত্য। গার্গী বলল, কেয়া বাগচির একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল। অনেক দিনের প্রেম। কিন্তু ছেলেটির মা কোনও কারণে কেয়াকে পছন্দ করত না। আর ছেলেটিও ভীষণ মাতৃভক্ত। তাই ছেলেটি কেয়াকে বিয়ে করেনি। বছর কয়েক আগে ছেলেটি মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। কিন্তু কেয়া আর বিয়ে করেনি। বোধহয় পুরুষ জাতটার ওপরেই ওর একটা ঘৃণা জন্মেছে। পচা গল্প। বিশ্বাস হয় না আজকালকার দিনে এরকম হয়।’ রত্না গলায় বিরক্তি।

‘গার্গী কি কখনও কেয়ার বয়ফ্রেন্ডকে দেখেছে?’

‘দেখেছে। অনেকবার দেখেছে।’

 ‘তাহলে আমার খুব একটা চান্স নেই বলছিস।’ আদিত্য ঠাট্টার গলায় বলল।

‘জানি না। আর আমি বুঝতে পারি না তুই কখন ঠাট্টা করছিস আর কখন সিরিয়াস। আমি ভেবেছিলাম এত দিন পরে তোর একটা হিল্লে হল। সেইজন্যেই উৎসাহ নিয়ে গার্গীকে ফোন করেছিলাম। এখন দেখছি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।’

‘আহা, এতে বোঝার কী আছে? তুই তো বললি কেয়া বাগচি পুরো পুরুষ জাতটাকেই ঘৃণা করে। জানিস তো আমার কপালটা চিরকালই মন্দ।’ আদিত্য গলাটা করুণ করে বলল।

(৩)

আদিত্য কাগজে পড়েছিল এবছর কালীপুজোয় নাকি শব্দবাজি শোনা যাবে না। শব্দবাজি বস্তুটা আদিত্যর প্রকৃত-অর্থেই অসহ্য লাগে, তাই খবরটা দেখে সে বেশ উৎসাহবোধ করেছিল। কিন্তু কার্যত দেখা গেল কালীপুজোর আগের রাত্তির থেকেই শব্দবাজির বিক্রম শুরু হয়েছে। আদিত্যর মেসবাড়িটা বড়বাজারের কাছেই। তাছাড়া চিৎপুর-চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-এর অবাঙালি অঞ্চলও তার বাসস্থান থেকে খুব দূরে নয়। বাজি পোড়ানোর ব্যাপারে বাঙালিদের তুলনায় অবাঙালিদের টাকার জোর এবং মনের ইচ্ছে দুই-ই বেশি। তাই বাঙালি পাড়ার তুলনায় আদিত্যদের অঞ্চলে শব্দবাজির দাপটও অনেক বেশি। তার ওপর আজকাল কলেজ স্ট্রিট ও শেয়ালদার বাঙালিরাও অবাঙালিদের সঙ্গে শব্দবাজি ফাটানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সেই সাঁড়াশি আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য বেশ কয়েক বছর হল আদিত্য কালীপুজো থেকে ভাইফোটা অব্দি অমিতাভ-রত্নাদের বাড়িতে পালিয়ে যায়। মেসে ফেরে ভাইফোঁটার পরের দিন সকালে। ভাইফোঁটার রাত্তিরে ফিরতে পারে না কারণ ভাইফোঁটা উপলক্ষে রত্না তাকে যে ফাঁসির খাওয়াটা খাওয়ায় সেটা খাবার পর বাড়ি ফেরা ঔদরিকশ্রেষ্ঠ ভীমসেনের পক্ষেও সম্ভব হত না।

রত্না বলে দিয়েছিল কালীপুজোর দিন সকাল-সকাল চলে আসবি। অমিতাভও তাই বলেছিল। অন্যান্য বছর আদিত্য তাই করে। সকালে উঠে এক কাপ চা খেয়েই চলে যায় অমিতাভদের বাড়ি। তিনদিন ধরে নিরবিচ্ছিন্ন আড্ডা চলে, গান শোনা হয়। এটা এখন প্রায় একটা বাৎসরিক অনুষ্টানে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু সেটা এবছর সম্ভব হচ্ছে না। আজ কালীপুজোর সকালে আদিত্যকে একটা দরকারি কাজ সারতে হবে। কাজটা কখন শেষ হবে আদিত্য জানে না। তাই রত্নাকে ফোন করে বলে দিয়েছে সে বিকেলের আগে আসতে পারবে না।

যেখানে যেতে হবে সেই জায়গাটা দমদম গোরাবাজারের কাছে। আদিত্যর মেস থেকে বড়জোর মিনিট চল্লিশ। বেলা এগারোটায় পৌঁছতে হবে। এখন সকাল আটটা। হাতে সময় আছে। আদিত্য কফি খেতে খেতে ল্যাপটপ খুলে খবর কাগজ পড়ছিল। আজকাল এই একটা মস্ত সুবিধে হয়েছে। সব খবর কাগজই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। আদিত্য খেয়াল করল, তার টেবিলের ওপর লাল পিঁপড়ের সারি হাঁটছে। ওরা খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। বাইরে কোনও দেয়ালের ফাটলে ওদের বাসা। কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসন্ন হলে ওরা ঠিক টের পায়। দুর্যোগ আসার আগেই ওরা খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তাহলে কি বৃষ্টি আসছে? কালীপুজোর দিন বৃষ্টি হয় কখনও? অবশ্য আজ আকাশে বেশ মেঘ আছে, সুজ্জি ঠাকুর এখনও মুখ দেখাতে পারেননি। আদিত্যর মনে পড়ল, চন্দ্রার হারিয়ে যাবার গল্পটা যেদিন সে অমিতাভ-রত্নাদের বলছিল, সেদিনও খুব বৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন ছিল দুর্গাপুজো। আর আজ, সে যখন রহস্যটা প্রায় ভেদ করে ফেলেছে, আবার বৃষ্টি। কালীপুজো। সঙ্গত সমাপ্তি।

আদিত্য কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে ট্রাম ধরে যখন শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে পৌঁছল তখন বৃষ্টি নেমে গেছে। আকাশের অবস্থা দেখে আদিত্য ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিল, তার সেই লম্বা ছাতা যেটা অমিতাভ তাকে ইটালি থেকে এনে দিয়েছে। খুলতে না হলে ছাতাটা চমৎকার ওয়াকিং স্টিক-এর কাজ করে। কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে ছাতা না খোলার প্রশ্নই ওঠে না। ছাতা খুলে আদিত্য রাস্তায় নামল। এবার দমদমের বাস ধরতে হবে। মাঝারি ধরনের বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা না থাকলে ভিজিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। রাস্তাঘাটে লোকজন নেই, ফাঁকা একটা পুজো মণ্ডপ থেকে পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত ভেসে আসছে। ভাগ্য ভাল, একটু দাঁড়াতেই বাস এসে গেল। একে ছুটি, তায় বৃষ্টি পড়ছে, তাই বাসে মোটে ভিড় নেই। আদিত্যকে নাগেরবাজার পেরিয়ে দমদম ক্যান্টনমেন্টের দিকে যেতে হবে। ওদিকে লর্ড ক্লাইভের একটা পুরোনো বাড়ি আছে, নামতে হবে তার সামনে। তারপর পায় হেঁটে খানিকটা ভেতরে গেলেই রায়দের বাড়ি, আদিত্যর গন্তব্যস্থল।

রণবীর রায়কে আদিত্য ফোনে বলেছিল সে একজন সাংবাদিক। বীথি বলে রণবীর রায় যে এন জি ওটি চালান, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বনবীথি, নীপবীথি, কুঞ্জবীথি, কাননবীথি ইত্যাদি নামে গরিব মেয়েদের জন্য তাদের অনেকগুলো ইস্কুল আছে। সেসব নিয়ে সে একটা স্টোরি করতে চায়। একটা ইন্টারভিউ-এর জন্য রণবীর রায় যদি তাকে একটু সময় দেন তাহলে খুব ভাল হয়। রণবীর রায় তাকে কালীপুজোর দিন সকাল এগারোটায় সময় দিয়েছেন।

এগারোটার কিছু আগেই আদিত্য রণবীর রায়ের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল। বাড়িটা খুঁজে বার করতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। রায়দের বাড়িটাকে স্থানীয় লোক বলে রাজবাড়ি। সকলেই চেনে বাড়িটা। রাজবাড়িই বটে। দুর্গাদালান, নাটমন্দির, বারমহল, অন্দরমহল সব নিয়ে অন্তত দুশো বছরের পুরোনো বাড়িটা এখনও মহাকালের প্রতিস্পর্ধী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় থাম ফুঁড়ে বট-অশত্থের চারা বেরিয়েছে। গায়ে শেওলা, বাগানে আগাছা। বোঝাই যায় বাড়িটা এখন আর তেমন যত্ন পায় না। আদিত্য লক্ষ করল, তবু দুর্গাদালানে কালীপুজো হচ্ছে। তার সামনে দিয়ে হেঁটে আদিত্য বাড়ির ভেতরে ঢুকল। সে যে আসবে এটা বোধহয় বলা ছিল। বাড়ির বয়সের সঙ্গে মানানসই একজন অতিবৃদ্ধ পরিচারক তাকে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসাল। বলল, কর্তামশাই পুজোর তদারকি করছেন, খবর দিচ্ছি, এখনই এসে পড়বেন।

কর্তামশায়ের আসতে আসতে অবশ্য মিনিট কুড়ি লেগে গেল। সেই অবসরে আদিত্য বৈঠকখানা ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। মস্ত ঘর, দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে, কড়ি-বরগা দেওয়া পুরোনো আমলের সিলিং—সবই একটা শেষ হয়ে যাওয়া সময়ের ইতিহাস বহন করছে। তার মধ্যে দুতিনটে আসবাব—একটা দেরাজ, একটা সোফা সেট, একটা শ্বেত পাথরের সেন্টার টেবিল—আদিত্যর চোখে পড়ল। এগুলোর ধাঁচ সে চেনে, কাঠ থেকে বাটালি দিয়ে কেটে কেটে হাতে বানানো অতি সূক্ষ্ম সব কারুকাজ। তাদের পুরোনো বাড়িতে এই ধরনের আসবাব অনেক ছিল। আদিত্য লক্ষ করল, বাড়িটা যত্নে না থাকুক আসবাবগুলো বেশ যত্নে আছে। আদিত্য এক মনে দেরাজের কারুকার্যগুলো দেখছিল, হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলল, ‘আপনার বুঝি পুরোনো ফার্নিচারে ইন্টারেস্ট আছে?’

বাড়ির মালিক রণবীর রায় কখন ঘরে ঢুকেছেন আদিত্য টের পায়নি। পেছন ফিরে আদিত্য দেখল বক্তা ষাট-উত্তীর্ণ গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় এক বলিষ্ঠ পুরুষ, এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায় রাজার বংশ। বাঙালিদের মধ্যে এত লম্বা চট করে দেখা যায় না।

‘ল্যাজারাসের ফার্নিচার না?’ আদিত্যর গলায় কিছু অকৃত্রিম মুগ্ধতা ছিল।

‘একেবারে সঠিক ধরেছেন। কম্পানির নাম সি ল্যাজারাস অ্যান্ড সানস। ১৮২০ সালে ইংরেজ বণিক বি ডাব্লিউ ল্যাজারাস এই কম্পানির পত্তন করেন। প্রত্যেকটি আসবাব হ্যান্ডমেড। ওদের মতো ফার্নিচার আর কেউ তৈরি করতে পারত না।’

রণবীর রায় একটা আরাম কেদারায় বসলেন। আদিত্যকেও বসার জন্য ইঙ্গিত করলেন। বললেন, ‘আপনার রুচির কিন্তু প্রশংসা করতেই হবে। আজকাল কজন এসব জিনিস অ্যাপ্রিশিয়েট করে?’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘আপনিই তো সেই সাংবাদিক যার এগারোটায় আসার কথা ছিল? কোন কাগজ যেন আপনার?’

আদিত্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর একটা নামজাদা বাংলা দৈনিকের নাম বলল যেখানে তার অনেক বন্ধু কাজ করে।

রণবীর রায় বললেন, ‘দোতলায় আমার একটা পুরোনো বিলিয়ার্ড টেবিল আছে। সেটাও ল্যাজারাস কম্পানির। দেখার মতো জিনিস। আপনার ইন্টারেস্ট থাকলে দেখতে পারেন। এসব জিনিস আমি শত অভাবেও বিক্রি করিনি, করার কথা ভাবতেও পারি না। এই বাড়িটাতে একটা মিউজিয়ম বানিয়ে ফার্নিচারগুলোকে রাখার ইচ্ছে আছে। অন্য কোথাও ওগুলো মানাবে না। ‘

‘বীথি বলে যে এন জি ওটা আপনি চালান তার অফিসটাও কি এই বাড়িতে?’ আদিত্য সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন করল।

‘আরে না, না। বীথি গরিব মেয়েদের জন্য পাঁচটা ডিস্ট্রিক্টে পাঁচটা স্কুল চালায়। উত্তর চব্বিশ পরগনায় বনবীথি, পুরুলিয়ায় নীপবীথি, পশ্চিম মেদিনীপুরে কুঞ্জবীথি, বাঁকুড়ায় কাননবীথি আর বীরভূমে পুষ্পবীথি। এই প্রত্যেকটা জেলায় আমাদের আলাদা আলাদা অফিস আছে।’

পকেট থেকে নোটবই বার করে আদিত্য নোট নিচ্ছিল। লিখতে লিখতে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘স্কুল চালানো ছাড়া আপনাদের আর কি কোনও অ্যাক্টিভিটি আছে?’

‘আছে। আমাদের কিছু চাষের জমি আছে। আমার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। সেখানে আমরা ফার্মিং করি। তবে চাল-ডাল-শাক-সব্জি যা উৎপন্ন হয় সবই আমাদের স্কুলগুলোতে মিড ডে মিলের কাজে লেগে যায়। বাইরে কিছু বিক্রি করতে পারি না।’

‘আপনাদের স্কুলগুলো চলে কীভাবে? মানে, স্কুল চালানোর একটা খরচ আছে তো? সেই খরচটা কি আপনি নিজেই বহন করেন?’

‘না, না। স্কুলের খরচ চালানোর মতো সামর্থ আমার নেই। স্কুল চলে ডোনেশনে।’

‘কারা ডোনেট করেন? একটু বিস্তারিত বলবেন?’

সেই বৃদ্ধ পরিচারক ঠেলাগাড়ি করে জলখাবার এনেছে। সাদা পাথরের প্লেটে কাটা ফল, মিষ্টি। পাথরের গ্লাসে সরবত। মনে মনে আদিত্য রণবীর রায়ের বনেদিয়ানার তারিফ না করে পারল না।

রণবীর রায় বললেন, ‘সামান্য জলখাবার। একটু খেয়ে নিন। তবে এগুলো কিন্তু পুজোর প্রসাদ নয়। পুজো তো সেই রাত্তিরে হবে।’

আদিত্য সরবতের গ্লাসে একটা চুমুক দিল। মালাই সরবত। গোলাপের পাপড়ি দেওয়া।

‘আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন কারা ডোনেট করেন। দেখুন, এই এন জি ওটা আমার স্ত্রীর নামে। আমার স্ত্রী বীথি অকালে চলে যান। আমি আর বিয়ে করিনি। আমাদের ছেলেমেয়েও নেই। বীথির মৃত্যুর পর আমি খুব একা হয়ে গেলাম। সময় কাটতেই চাইত না।’ এত বছর পরেও স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে রণবীর রায়ের গলাটা ধরে এল।

আদিত্য চুপ করে রইল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে রণবীর রায় আবার বলতে শুরু করলেন, ‘মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে বীথির খুব উৎসাহ ছিল। এ-ব্যাপারে বেশ কিছু সংস্থার হয়ে ও ভলানটারি কাজ করত। তবে নিজের কোনও অরগানাইজেশন ওর ছিল না। বীথির মৃত্যুর পর ওর স্মৃতিতে এই এন জি ওটা শুরু করি। নিজের পয়সাতেই শুরু করেছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে বুঝলাম এটা একা টেনে নিয়ে যাবার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ইংল্যান্ডে লেখাপড়া করেছি। ইয়োরোপের কয়েকটা দেশে চাকরিও করেছি। তাই কিছু যোগাযোগ ছিল। সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে বিদেশ থেকে কিছু ডোনেশন জোগাড় করতে শুরু করলাম। তাছাড়া দেশের মধ্যে অনেক পয়সাওলা মানুষ আছেন যাঁরা আমাকে বিশ্বাস করেন। তাঁরা মনে করেন আমি আর যাই করি টাকা তছরূপ করব না। এঁরাও হাত খুলে ডোনেশন দেন। সেইসব ডোনেশনে আমাদের এন জি ও ভালই চলছে।’

‘আপনি কি এখন ফুল টাইম এই এন জি ওটাতেই কাজ করেন?’

‘আমি বিলেত গিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলাম। সেই বিদ্যে ভাঙিয়ে এখনও একটু-আধটু কনসাল্টেন্সি করি। বাকি সময়টা পুরোটাই বীথির জন্য। আমার টাকার খুব প্রয়োজন নেই। একা মানুষ, চলে যায়।’

আদিত্য এক টুকরো ফল মুখে পুরে চিবোচ্ছিল। গিলে নিয়ে বলল, ‘আপনার স্ত্রী কোন সালে মারা যান?’

‘বীথি মারা যায় নাইন্টি ফাইভে। ওর একটা দুরারোগ্য রক্তের অসুখ হয়েছিল। বলা যায়, ওটা নিয়েই ও জন্মেছিল। চিকিৎসার জন্য আমি ওকে সুইটজারল্যান্ড নিয়ে যাই। তাতেও শেষ পর্যন্ত কোনও লাভ হল না। সুইটজারল্যান্ডেই ও মারা যায়।’

‘আপনার স্ত্রীর কোনও ছবি কি আপনার কাছে আছে? আমার লেখার সঙ্গে কিছু ছবি দিতে পারলে ভাল হয়। আপত্তি না থাকলে, আপনারও কয়েকটা ছবি নেব।’

‘আমার ছবি নিন, আপত্তি নেই। তবে বীথির ছবি নিতে গেলে একটু কষ্ট করে দোতলায় আসতে হবে। আমার বেডরুমে বীথির দুটো পোর্টট্রেট আছে। ও-দুটোই বীথির সব থেকে ভাল ছবি। তাছাড়া দোতলায় আমার বিলিয়ার্ড টেবিলটাও দেখতে পাবেন।’

বীথি রায়ের পোর্টট্রেট দুটো দেখতে দেখতে আদিত্যর মনে হচ্ছিল এরকম পরমাসুন্দরী মহিলা বাঙালির ঘরে খুব একটা দেখা যায় না। তবে একটু যেন রুগ্ন, বিষণ্ণ। হঠাৎ আদিত্যর চোখে পড়ল বিছানার ধারে সাইড টেবিলে একটা হাতঘড়ি খুলে রাখা রয়েছে। ওমেগা সিমাস্টার। আদিত্য আন্দাজ করল এই ঘড়ির দাম সাত-আট লাখের কম হবে না। রণবীর রায় সৌখিন মানুষ, সন্দেহ নেই।

বিকেলে নূপুর মণ্ডল ফোন করল। আদিত্য তখনও রত্নাদের বাড়িতে ঢোকেনি, মেট্রো থেকে নেমে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। অনেকক্ষণ কথা বলল নূপুর। আদিত্য তাকে খুব দরকারি কয়েকটা নির্দেশ দিল।

(৪)

একটু আগে কালীপুজোর ডিনার সমাপ্ত হয়েছে। এত বেশি খাওয়া হয়েছে যে উঠে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে আসার ক্ষমতাও আদিত্যর নেই। সে অমিতাভর দিকে তাকিয়ে অলসভাবে বলল, ‘একটা কিছু বাজা।’

বাইরে মাঝে মাঝেই শব্দবাজির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তবে আদিত্যর পাড়ার থেকে অনেক কম।

‘মালকোষ শুনবি?’ অমিতাভ জিজ্ঞেস করল। ‘শুনেছি ভাল করে মালকোষ গাইতে পারলে নাকি ভূত আসে। আজ কালীপুজোর রাত্তিরে এমনিতেই চারদিকে ভূত-প্রেত কিলবিল করছে। মালকোষ শুনলে হয়ত দুএকটা আমাদের বাড়িতে চলে আসতে পারে।’

‘তোমার সব সময় যত আজেবাজে কথা। রাম রাম রাম। আজ কালীপুজোর রাত্তিরে মালকোষ-টালকোষ কিচ্ছু শুনবে না, এই আমি বলে দিলাম।’ রত্না ঝংকার দিয়ে উঠল। ওর প্রচণ্ড ভূতের ভয়। এইরকম ভূতের ভয় নিয়ে কীভাবে যে ও একটা কলেজ চালায় আদিত্য ভেবে পায় না।

‘তাহলে মালকোষ থাক।’ আদিত্য সন্ধি করার চেষ্টা করল। ‘তোর কাছে আলি আকবরের একটা মালুহা কেদার ছিল না? অনেক দিন শুনিনি। ওটা বাজা না।’

‘ঠিক হ্যায়। মালুহা কেদারই হোক। তবে কোন হার্ড ডিস্ক-এ আছে একটু খুঁজতে হবে।’

অমিতাভ একটা হার্ড ডিস্ক ল্যাপটপে লাগিয়ে খুঁজতে শুরু করল। রত্না কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ আদিত্যর মোবাইলটা বেজে উঠল। একটা ভীষণ উত্তেজিত গলা।

‘আমি বনবীথি স্কুলের অনিমা সামন্ত বলছি।’

‘অনিমা সামন্ত?’ আদিত্যর চিনতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। ‘ও বনবীথি ইস্কুলের বড়দিদি বলছেন? বলুন, বলুন।’

‘আদিত্যবাবু, ভয়ানক একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। গৌরবাবুর একটা সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি আছেন।’

‘গৌরবাবুর অ্যাক্সিডেন্ট? কখন? কোথায়?’ আদিত্য যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না।

‘এখনও পুরোটা জানি না। যেটুকু শুনলাম বলছি। অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে আজ সন্ধেবেলা, শেয়ালদা স্টেশনে। যতদূর মনে হয়, বাড়ি ফিরবেন বলে গৌরবাবু হাসনাবাদ লোকাল ধরার জন্যে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্ল্যাটফর্মে বেশ ভিড় ছিল। ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে তখন ভিড়ের ঠেলায় উনি রেললাইনের ওপর পড়ে যান। যারা সেখানে ছিল তারা তাই বলছে। গৌরবাবুর ভাগ্য ভাল ট্রেনটা ভীষণ আস্তে আস্তে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছিল। তাই ড্রাইভার ওঁকে পড়ে যেতে দেখে ব্রেক কষে গাড়িটা থামাতে পেরেছিল। ফলে উনি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন। তবে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত লেগেছে। নীলরতনে ভর্তি আছেন। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। ওঁর পকেটে বনবীথি ইস্কুলের ফোন নম্বর পাওয়া গিয়েছিল। হাসপাতাল সেই নম্বরে ফোন করেছিল। এমনিতে তো কালীপুজো বলে স্কুল বন্ধ, তাছাড়া রাত্তির, কিন্তু স্কুলের সিকিউরিটি সফিকুলের ঘরে ফোনের একটা এক্সটেনশান আছে। সফিকুলই হাসপাতাল থেকে খবরটা পায়। তারপর আমাকে জানায়। আমি অন্য দিদিমনিদের জানিয়েছি। মনে হল আপনাকেও জানানো দরকার।’

‘গৌরবাবু ভিড়ের ঠেলায় পড়ে গেছেন, না কেউ তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে?’

‘ওঁকে কেউ ঠেলে ফেলে দেবে কেন? ওঁর তো কোনও শত্রু নেই। নিশ্চয় ভিড়ের ঠেলায় পড়ে গেছেন।’ আদিত্যর প্রশ্নে অনিমা সামন্ত অবাক হয়ে গেছে।

‘আপনারা কি এখন হাসপাতালে?’ আদিত্য প্রসঙ্গ পালটে বলল।

‘না আদিত্যবাবু। যখন খবরটা পেলাম, তখন রাত্তির হয়ে গেছে। আর ট্রেন নেই। কাল ভোরের ট্রেনে সোনাদিদি আর ছোড়দিদিকে নিয়ে কলকাতা যাব। নূপুরকে ফোনে পেলাম না। সে যাবে কিনা জানি না। হাসপাতালে পৌঁছে আপনাকে ফোন করব। আপনি কি একবার হাসপাতালে আসবেন?’

‘কাল আমার কতগুলো জরুরি কাজ আছে। কাল যেতে পারব না। ফোনেই জেনে নেব কী হল।’

আদিত্য ফোন কেটে দিয়ে নূপুরের নম্বরটা ডায়াল করল। সুইচট অফ। আলি আকবর খাঁ সাহেব মালুহা কেদার বাজাতে শুরু করেছেন।

 (৫)

পরের দিন গৌতমের সঙ্গে দীর্ঘ কথাবার্তা সেরে আদিত্য যখন লালবাজার থেকে বেরোল তখন প্রায় দুপুর দুটো। সোয়া তিনটে নাগাদ শেয়ালদা থেকে একটা কৃষ্ণনগর লোকাল আছে। আদিত্য সেই ট্রেনটা ধরে পায়রাডাঙা যাবে।

গৌতমের সঙ্গে মোটামুটি সব কথাই হয়ে গেছে। আদিত্যর নির্দেশ পালন করে সামনের কটা দিন পুলিশকে কিছু কিছু দরকারি কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। পুলিশের টিমগুলোকে নেতৃত্ব দেবার জন্য দিল্লী থেকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের কয়েকজন অফিসার এসেছেন। আদিত্য তাদের সঙ্গেও অনেকক্ষণ কথা বলল। নীলরতনের যে ঘরে গৌরহরি বাঁড়ুজ্জে ভর্তি আছেন আদিত্যর কথা মতো কাল রাত্তির থেকে তার সামনে সাদা পোষাকের পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। সাবধানের মার নেই। আজ সকালে গৌরবাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছে। জ্ঞান ফিরে আসার পর তিনি পুলিশকে বলেছেন তিনি নিশ্চিত যে শেয়ালদা স্টেশনে কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন লাইনের ওপর ফেলে দিয়েছিল।

আদিত্য আগেও লক্ষ করেছে দুপুরবেলা কিছুক্ষণের জন্য শেয়ালদা স্টেশনটা ঝিমিয়ে পড়ে। ট্রেনের সংখ্যা কমে আসে বলে যাত্রীর সংখ্যাও কমে আসে। আদিত্য স্টেশনে ঢুকে দেখল সাইনবোর্ডে ‘কৃষ্ণনগর সিটি’ কথাটা জ্বলজ্বল করছে। এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনটা ছাড়বে। হাতে এখনও মিনিট পনের সময় আছে। তার মধ্যে টিকিটটা কেটে নিতে হবে।

টিকিট ঘর প্রায় ফাঁকা। আদিত্য একটা যাতায়াতের টিকিট কেটে নিয়ে অলস গতিতে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে হাঁটা লাগাল। ট্রেন এখনও প্ল্যাটফর্মে ঢোকেনি। প্ল্যাটফর্মের একদিকে জনা চার-পাঁচ তল্পিবাহক মরিয়া হয়ে ঘুমোচ্ছে। চায়ের স্টলের ঝাঁপ নামানো। দোকানদার দুপুরের এই ঝিমিয়ে থাকা ইস্টিশনে নিজেই নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য ছুটি দিয়েছে। আর একটু এগিয়ে কয়েকজন তরি-তরকারির ফড়ে তাদের শূন্য ঝুড়িগুলো একটার ওপর আর একটা জড়ো করছে। এরা নিশ্চয় বৈঠকখানা বাজারে তরকারি বেচতে এসেছিল। এখন ফিরে যাবে। আদিত্য আন্দাজ করল, যে জায়গায় ঝুড়িগুলো জড়ো হচ্ছে তার আশেপাশেই কোথাও ভেন্ডারের কামরাটা এসে থামবে। সে সেই জায়গাটা ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে চলল। আরেকটা চায়ের স্টল। এটার দোকানদার মনে হয় আগের জনের তুলনায় উদ্যোগী, তাই দোকানটা খোলা রেখেছে। আদিত্য একটা চায়ের ফরমাশ করল, সঙ্গে দুটি বিস্কুট।

কৃষ্ণনগর লোকাল প্রায় ঠিক সময়েই ছাড়ল, আদিত্যর কামরায় সে ছাড়া আর মাত্র কয়েকজন লোক। বেলঘরিয়া থেকে বেশ কিছু লোক উঠল, বারাকপুর থেকে আরও বেশ কিছু। কামরায় আর কোনও সিট খালি নেই, তিনজনের সিটে চারজন করে বসছে। ভাগ্যিস আদিত্য জানলার ধারে সিট পেয়েছিল, না হলে দুজনের মাঝখানে পড়ে চিঁড়ে-চ্যাপটা হতে হতো। নৈহাটি পৌঁছে কামরাটা অর্ধেক খালি হয়ে গেল। কল্যাণীতে আরও দু-চারজন নামল, ট্রেন যখন পালপাড়া পৌঁছেছে তখন কামরা আবার ফাঁকা।

পালপাড়া, চাকদা, পায়রাডাঙা। শীতের বেলা দ্রুত পড়ে আসছে। পথে নিশ্চয় ট্রেনটা লেট করেছিল, কারণ পায়রাডাঙা পৌঁছতে তার সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। পৌঁছনোর কথা পাঁচটা বেজে দুই মিনিটে। আদিত্য ট্রেন থেকে নেমে দেখল ইস্টিশন চত্বরে আলো জ্বলে উঠেছে। আজকাল যেমন মফস্বলের দোকানে দোকানে এলইডি আলো জ্বলে তেমনি সাদা সাদা আলো। স্টেশনে খুব বেশি লোক নেই। মনে হয় এখনও আপিসযাত্রীদের ভিড় শুরু হয়নি।

ট্রেন থেকে নেমেই আদিত্য একটা দরকারি ফোন সেরে নিল। তারপর স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দ্যাখে রিক্সা স্ট্যান্ডে মাত্র দুটি রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে।

 ‘হেতমপুরে যাব। ওখানে লাহিড়িদের বাড়ি চেনেন?’ আদিত্য এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল। ‘আগে বুড়োবাবু থাকতেন, ইস্কুলে পড়াতেন। ওর ছেলে মারা গেছেন। এখন শুধু বউমা থাকেন। উনিও ইস্কুলে পড়ান। ছোটদের পড়ান। তার একটা ছোট ছেলে আছে।’

রিক্সাওলাকে খুব বেশি ভাবতে হল না। সে বলল, ‘আপনি অরুণ লাহিড়ির বাড়ি যাবেন? মাস্টারমশাই-এর বাড়ি? যে বাড়িতে বৌদির ভাই অ্যামেরিকা থেকে এসেছেন?’

আদিত্য ঠিকই আন্দাজ করেছিল। এইসব ছোট্ট জায়গায় সবাই সবাইকে চেনে।

‘আপনি ও বাড়িতে কার কাছে যাবেন?’ একটু পরে প্যাডেল করতে করতে রিক্সাওলা জিজ্ঞেস করল।

‘বৌদির ভাই আমার বন্ধু। ওই যিনি অ্যামেরিকা থেকে এসেছেন। তার কাছে যাব। আপনি চেনেন মাস্টারমশাইদের?’ আদিত্য পালটা প্রশ্ন করল।

‘সবাইকে চিনি। আমার তো হেতমপুরেই জন্ম। আমার বাবা এই অঞ্চলে রিক্সা চালাত। এখন আর পারে না। আমি রিক্সা চালাই। অন্য দুই ভাই-এর একজন কলকাতায় আর একজন রানাঘাটে কাজ করে। আমিই এখানে রয়ে গেলাম। না থাকলে বুড়ো বাবা-মাকে কে দেখবে?’ মনে হল রিক্সাওলা গল্প করতে ভালবাসে।

‘মাস্টারমশাইকে আপনি দেখেছেন?’ কিছুক্ষণ নীরবে চলার পর আদিত্য প্রশ্ন করল।

‘দেখেছি মানে? মাস্টারমশাই-এর কাছে পড়েওছি। উনি আমাদের ক্লাশ টেনে অঙ্ক পড়াতেন। আমি অবশ্য লেখাপড়ায় ভাল ছিলাম না। উনি বলতেন বাড়িতে আয় অঙ্ক বুঝিয়ে দেব। অনেকে যেত। আমার যাওয়া হয়নি। মাধ্যমিকটাও পাশ করা হলো না।’ আদিত্যর মনে হল রিক্সাওলা যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘ওর বউমাও তো ওই ইস্কুলেই পড়ায়?’

‘হ্যাঁ। তাও অনেকদিন হয়ে গেল। মাস্টারমশাই-এর ছেলের যখন বিয়ে হল আমি তখন ছোট। আমার মনে আছে পুরো হেতমপুরের লোক নেমন্তন্ন খেয়েছিল। তারপর একদিন শুনলাম দাদাবাবুর কঠিন অসুখ করেছে। কিছুদিন পরে দাদাবাবু চলে গেলেন। তারপর একে একে দাদাবাবুর মা, মাস্টারমশাই। এখন বৌদি একা ছেলে নিয়ে অত বড় বাড়িতে থাকেন।’

তারা এখন খুব সরু একটা রাস্তায় এসে পড়েছে। এবড়ো-খেবড়ো গ্রামের রাস্তা, ঘন ঘন বাঁক, রিক্সাওলাকে মন দিয়ে চালাতে হচ্ছে। ‘এই একটুখানি রাস্তা খারাপ। এর পর আবার ভাল রাস্তা। এটা দিয়ে এলে অনেক কম সময় লাগে। বড় রাস্তা ধরলে আরও দশ মিনিট বেশি লাগত। আমাকে আবার তাড়াতাড়ি ইস্টিশনে ফিরতে হবে। সোয়া ছটার গাড়িতে আমার এক বাঁধা খদ্দের আসেন। ট্রেন থেকে নেমে আমাকে দেখতে না পেলে রাগারাগি করবেন।’ রিক্সাওলা এতক্ষণে মোটামুটি ভাল একটা রাস্তায় এসে পড়েছে।

‘আর কতটা?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘এই তো, প্রায় এসেই গেছি।’ রিক্সাওলা অভয় দিল।

‘বৌদির ইস্কুলটা এখান থেকে কত দূরে?’ আদিত্য কথাবার্তা চালিয়ে যেতে চাইছিল।

 ‘ইস্কুলটা এই রাস্তা ধরে সোজা গেলে আরও মিনিট দশ। রাজা মল্লিকের রিক্সায় বৌদি যাতায়াত করেন। গত একমাস অবশ্য বৌদি ছুটি নিয়েছেন। শুনেছি, তার শরীর ভাল নেই। খোকাবাবু রাজার রিক্সায় একাই ইস্কুলে যায়। এই তো এসে গেছি। সামনের একতলা বাড়ি।’

আদিত্য আরও কিছুক্ষণ রিক্সাওলার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু রিক্সাওলা তাড়ায় আছে। সে আদিত্যকে নামিয়ে দিয়ে ভাড়ার পয়সা নিয়ে চলে গেল।

ছোট একতলা বাড়ি। চারদিকে পাঁচিল। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায় বাড়িটা পুরোনো কিন্তু পাঁচিলটা সদ্য তোলা হয়েছে। সিমেন্টের পলেস্তারায় এখনও চুনকাম পড়েনি। একটা লোহার গেট আছে, তালাবন্ধ। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বাড়ির সামনে একফালি বাগান, পাতকুয়ো। পাতকুয়োর সামনে একটু বাঁধানো জায়গা। তার ওপর পোড়া দাগ। গতকাল কালীপুজোয় নিশ্চয় বাজি পোড়ানো হয়েছে।

গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আদিত্য ভাবছিল কেমন করে বাড়ির লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। গেটের রেলিং-এ তালাটা ঠুকে ঠুকে শব্দ করবে? নাকি গলা ছেড়ে হাঁক পাড়বে? সৌভাগ্যক্রমে দুটোর কোনোটাই করতে হল না। আদিত্য লক্ষ করল গেটের গায়ে একটা কলিং বেল লাগানো আছে। কলিং বেলের তার খানিকটা পাঁচিলের গা বেয়ে, খানিকটা বাঁশের খুঁটির ওপর দিয়ে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে। আদিত্য কলিং বেল বাজাল।

অন্ধকার নেমে এসেছে। দ্বিতীয়বার বেল বাজানোর পর বারান্দায় একটা আলো জ্বলে উঠল। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজন। আদিত্যকে অন্ধকারে চিনতে না পেরে, বলল, ‘কেএএ?’

আদিত্য কিন্তু লোকটাকে চিনতে পেরেছে। পার্থ সান্যাল। আদিত্য গলা তুলে বলল, ‘পার্থ, আমি আদিত্য রে। দরজা খোল।’

আদিত্যর গলা শুনে পার্থ যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। বলল, ‘তুই এখানে? কী ব্যাপার?’

‘তুই এখনও ফিরে যাসনি? আমি তো ভেবেছিলাম তুই ফিরে গেছিস।’ আদিত্য পালটা প্রশ্ন করল।

‘দিদির শরীরটা ভাল নেই বলে যাওয়াটা পিছিয়ে দিলাম।’ পার্থ বাগান দিয়ে হেঁটে এসে গেটের তালা খুলল। বলল, ‘তুই এখানে চলে আসবি ভাবতেই পারিনি।’

‘একটা কাজে রানাঘাটে এসেছিলাম। ভাবলাম তোর দিদির সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। ওঁকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল।’

‘দিদি তো বাড়ি নেই। ছেলেকে কোচিং ক্লাশে পৌঁছে দিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। ছেলেকে নিয়ে ফিরবে। মনে হয় দেরি হবে। তুই বোস।’

ওরা এখন বাড়ির ভেতর ঢুকে বাইরের ঘরে বসেছে। সাদামাটা বসার ঘর। দুটো বেতের চেয়ার, একটা বেতের সোফা, বেতের সেন্টার টেবিল। ঘরের এককোণে একটা বুককেসে কিছু বই আছে, প্রায় সবই ছোটদের। মেঝেতে প্যাস্টেল, আঁকার খাতা ছড়ানো। খাতায় অর্ধসমাপ্ত কালী ঠাকুরের মুখ।

‘তোর ভাগ্নে বোধহয় এখানে বসে ছবি আঁকছিল।’ আদিত্য সোফায় বসতে বসতে বলল।

‘ও তো সব সময়েই ছবি আঁকছে। যখন যেটা মাথায় ঢোকে সেটা আঁকে। এখন কালী ঠাকুর মাথায় ঢুকেছে। চা খাবি তো?’

‘সে খাওয়া যাবে এক কাপ। কিন্তু দিদিই তো বাড়ি নেই। কে চা করবে?’

‘কাজের মাসি আছে, সে-ই চা করে।’

‘এদিকে আর এক কাণ্ড ঘটেছে।’ আদিত্য বসতে বসতে বলল। ‘বনবীথি ইস্কুলের গৌরবাবুর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। শেয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠতে গিয়ে ভিড়ের ধাক্কায় প্ল্যাটফর্ম থেকে রেললাইনের ওপর পড়ে গেছেন, মাথায় চোট লেগেছে। নীলরতনে ভর্তি, কাল রাত্তির পর্যন্ত জ্ঞান ফেরেনি। ভিড়ের ধাক্কায় পড়ে গেছেন না কেউ ইচ্ছে করে ঠেলে ফেলে দিয়েছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।’

কথাগুলো বলতে বলতে আদিত্য চোখের কোনা দিয়ে খেয়াল করল বাড়ির ভেতরে যাবার দরজার পাশ থেকে একটা নারীমূর্তি চট করে সরে গেল। কেউ যেন আড়ি পেতে তার কথা শুনছিল।

হঠাৎ আদিত্য গলার আওয়াজটা তুলে বলল, ‘চন্দ্রা লুকিয়ে থাকিস না, বেরিয়ে আয়। আর তোর কোনও ভয় নেই।’

পার্থ বাড়ির ভেতরে চা বলতে যাচ্ছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে ভীষণ অবাক হয়ে যাবার ভান করে বলল, ‘চন্দ্রা? এখানে কোথায় চন্দ্রা? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

‘আমার মাথা একদম পরিষ্কার কাজ করছে। শোন পার্থ। তোর আর অভিনয় করার দরকার নেই। চন্দ্রারও আর লুকোবার দরকার নেই। আমি তোকে গ্যারেন্টি দিচ্ছি আর কেউ এখন চন্দ্রাকে মারতে পারবে না।’

পার্থ হতভম্ভের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আদিত্য আবার তাকে বলল, ‘আমি জানি তোর ইনটেনশনটা খুবই ভালো ছিল। তুই যে করে হোক চন্দ্রাকে বাঁচাতে চেয়েছিলি। তাই তাকে তোর দিদির বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলি। কিন্তু আমাকে তোর কনফিডেন্সে নিলে পারতিস।’

আদিত্য আবার গলা তুলে ডাকল, ‘চন্দ্রা বেরিয়ে আয়। চন্দ্রা, এই চন্দ্রা।’

এবার ভেতর মহলের দরজা দিয়ে খুব ফর্সা, ঈষৎ শীর্ণকায় যে মেয়েটি বেরিয়ে এল আদিত্য তাকে কলেজ জীবন থেকেই চেনে। তার পরনে আটপৌরে শাড়ি ব্লাউজ, কপালে সবুজ টিপ।

‘কেমন আছিস আদিত্য?’ চন্দ্রা খুব মৃদুস্বরে বলল।

আদিত্য খেয়াল করল চন্দ্রার কথা বলার ধরনটা একই রকম আছে। তবে সাজপোষাকে অনেক বাঙালি হয়েছে। আদিত্য বলল, ‘আমি ভাল আছি রে। তুই কেমন আছিস?’

পার্থর হতভম্ভ ভাবটা এখনও কাটেনি। চন্দ্রা বলল, ‘আদিত্য আমি তোর সঙ্গে কলকাতায় ফিরব। এখানে অনেকদিন হয়ে গেল।’ তারপর পার্থর দিকে ফিরে তার হাতদুটো ধরে বলল, ‘তুমি আমার জন্যে যা করেছ কোনওদিন ভুলব না। তুমি আমাকে জীবন দিয়েছ। কিন্তু আমি এখন কিছুদিন আলিপুরের বাড়িতে থাকতে চাই। তুমি কাল বা পরশু একবার আসবে তো?’

পার্থ কিছু বলার আগেই আদিত্য বলল, ‘বাইরে কয়েকজন আর্মড পুলিশ অপেক্ষা করছে। বড় রাস্তায় ওরা ওদের জিপটা দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছে। আমরা ওটা করেই কলকাতায় ফিরব। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। কেউ চন্দ্রার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না’

মিথ্যে নয়। ভেজানো দরজা ঠেলে সত্যি সত্যি কয়েকজন বন্দুকধারী পুলিশ ঘরে ঢুকে এসেছে। বাগানের বড় গেটটা নিশ্চয় খোলাই ছিল। একটু পরে একটা পুলিশের গাড়ি এসে পার্থদের বাড়ির সামনে থামল। চন্দ্রাকে নিয়ে যখন আদিত্য গাড়িতে উঠছে তখনও পার্থ হতভম্ভ হয়ে রয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *