অষ্টম পরিচ্ছেদ
(১)
মাথাভাঙা নদীর উৎপত্তি পদ্মায়। কুষ্ঠিয়ার মুনশিগঞ্জ অঞ্চলে পদ্মা থেকে বেরিয়ে কিছু পথ অতিক্রম করার পর নদীয়া জেলায় ঢুকে এই নদী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। একভাগের নাম চূর্ণী, অন্যভাগ ইছামতী। উইকিপডিয়া থেকে এইটুকুই জানতে পেরেছিল আদিত্য। এছাড়া অবশ্য অনেকদিন আগে ইছামতি নদীর সঙ্গে একবার সামনা সামনি দেখা হয়েছিল তার। কলেজে পড়ার সময় তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে বনগাঁয় বিভূতিভূষণের বাড়ি দেখতে গিয়েছিল। বাড়ির পেছনেই ইছামতি। তবে আদিত্যর যতদূর মনে পড়ে, সেদিনের ইছামতি ছিল ক্ষীণকায়া, কচুরিপানায় ভর্তি। আর আজ পার্থ সান্যালের সঙ্গে সে যেখানে এসেছে সেখানে সমুদ্রের কাছে পৌঁছে সেই একই ইছামতি বিপুল আকার ধারণ করেছে।
পার্থ বলেছিল, প্রথমে নদী দেখবে তারপর অন্য কাজ। আগে বার দুয়েক যখন এসেছিল তখনও তাই করেছিল। এখন নদীর ধারে বালির ওপর বসে তারা দুজন কফি সহ চিকেন স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। খুব ভোরবেলা বেরিয়ে পড়েছিল বলে ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়নি। পার্থর হোটেল কিছু স্যান্ডউইচ এবং কফি তৈরি করে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিল। তারা নদীর ধারে বসে সেই খাদ্যেরই সদ্ব্যবহার করছে।
নদীর ধারে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি। আর খুব হাওয়া। একটা ঘাটও আছে। পায়ে চলা পথ বালির মধ্যে দিয়ে ঘাট অব্দি পৌঁছেচে। দুচারটে নৌকো ঘাটে ভাসছিল। আরও কয়েকটা মাঝ নদীতে। নদীর মাঝ বরাবর কোথাও একটা ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার রয়েছে। চোখে দেখা যায় না, আন্দাজ করে নিতে হয়। একটা রোগা, কালো লম্বা মত লোক ঘাটে নৌকো বেঁধে ডাঙায় উঠল। এখন সে পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে আদিত্যদের দিকে এগিয়ে আসছে।
‘ও দাদা, বনবীথি ইস্কুলটা কোনদিকে বলতে পারেন?’ লোকটা একটু কাছে আসতে আদিত্য গলা তুলে বলল।
‘ইস্কুল? বনবীথি ইস্কুল? এই যে পথটা পাকা রাস্তায় গিয়ে উঠেছে, ওই রাস্তায় উঠে ডানদিকে যাবেন। মিনিট দশেক হাঁটলেই বনবীথি ইস্কুল। তা আপনারা কোথা থেকে আসছেন?’
‘আমরা আসছি কলকাতা থেকে।’ আদিত্য আলাপ জমানোর ভঙ্গীতে জানাল। ‘আপনি কি এখানেই থাকেন?’
‘আমার গ্রাম এই সামনেই। তা আপনারা সেই কলকাতা থেকে এতদূর এসেছেন বনবীথি ইস্কুল দেখতে?’
‘ঠিক ইস্কুল দেখতে আসিনি। একটা জরুরি কাজ আছে। ওই ইস্কুলে একজন খুব ফরসা দিদিমনি পড়াতেন। আপনি জানেন?’ এবার পার্থ বলল।
‘জানি। মেমদিদি। খুব বেশি দিন তিনি আসেননি, তাও এই তল্লাটে সকলেই চেনে তাকে। তা তিনি নাকি কাউকে কিছু না বলে কোথায় জানি চলে গেছেন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি তো সব জানেন দেখছি।’ আদিত্যর গলায় হালকা বিস্ময়।
‘আমি কেন? সকলেই জানে। তাছাড়া আমার মেয়ে তো বনবীথি ইস্কুলেই পড়ে। তা আপনারা মেমদিদিকে চেনেন নাকি?’
‘খুব ভালই চিনি। আমরা ওর বন্ধু। ওর খোঁজেই তো এখানে এসেছি।’ আদিত্য বলল।
‘তা ওর খোঁজে এখানে কেন? উনি কি আর এখানে কোথাও লুকিয়ে বসে আছেন?’
কথাটায় যুক্তি আছে। তাই আদিত্য সরাসরি এর উত্তর দিতে পারল না। প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘আপনাদের এদিকে এবার ইলিশ উঠেছে?’
‘ইলিশ? কোথায় ইলিশ? দুচারটে যা উঠছে সব চারশো পাঁচশো গ্রাম। এক কেজির ওপরের ইলিশগুলো সব বেপাত্তা হয়ে গেছে। ওই মেমদিদির মতো।’ লোকটা নিজের রসিকতাতেই হেসে উঠলো।
আদিত্য পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই বার করেছে। লোকটার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘চলবে?’
লোকটা আদিত্যদের সামনে উবু হয়ে বসল। নদীর ধারে খুব হাওয়া। দেশলাই জ্বালালেই নিভে যাচ্ছে। হাতের আড়াল দিয়ে হাওয়া আটকে আদিত্য তিন-চারবারের চেষ্টায় নিজের সিগারেটটা ধরালো। তারপর জ্বলন্ত সিগারেটটা লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি এটা থেকে ধরান।’
সিগারেট ধরিয়ে লোকটা হাত মুঠো করে একটা লম্বা টান দিল। আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি কাছেই থাকেন?’
‘এই দুপা গেলেই আমার বাড়ি। আমরা সাত পুরুষের জেলে। ছেলেটাও এখন নদীতে যেতে শুরু করেছে। এখানে যাকে জিজ্ঞেস করবেন সে-ই বলবে কিরণ দলুই-এর মতো মাছ-ধরিয়ে এ-তল্লাটে আর নেই।’
‘কী মাছ ওঠে এখানে? ইলিশ তো উঠছে না বললেন।’ পার্থর গলায় অকৃত্রিম কৌতুহল।
‘রুই-কাতলা-মিরগেল তো ওঠেই। তাছাড়া ভেটকি ওঠে। বড় ট্যাংরা ওঠে। পাবদা-কাজলি ওঠে। এই তো শীতকাল আসছে। এবার ভাল মাছ উঠবে।’
‘মাছ বিক্রি করেন কোথায়?’ পার্থ জিজ্ঞেস করল।
‘হাসনাবাদে মাছের বড় আড়ত আছে। ওখানেই সব মাছ বিক্রি হয়ে যায়।’
‘তাহলে তো আপনাদের কোনও সমস্যাই নেই। ইছামতির মতোই শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন জীবন।’ আদিত্যর দ্বিতীয় বাক্যটা খানিকটা স্বগতোক্তির মতো শোনাল। তাতে হয়ত হালকা শ্লেষও ছিল।
‘সমস্যা কেন থাকবে না দাদা? সমস্যা তো জীবনে থাকবেই। মাঝে মাঝে দিনভর জাল ফেলে গেঁড়ি-গুগলি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। তখন বুঝে উঠতে পারি না বাজারে কী বিক্রি করব আর ঘরেই বা কী নিয়ে ফিরব? তবে এটুকু দুশ্চিন্তা তো সব জেলেরই আছে। সেসব নিয়ে দিব্যি ছিলাম আমরা। কিন্তু কিছুদিন হল এই এলাকায় নানারকম অপদেবতার উৎপাত দেখা দিয়েছে।’
‘অপদেবতার উৎপাত?’ আদিত্য খানিকটা উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করল।
‘অপদেবতার উৎপাত ছাড়া আর কী বলব? গত কয়েক মাসে চারখানা লাশ পড়েছে এখানে। যারা মরেছে তারা সকলেই বাইরের লোক। তবে চারজনই চেনা মুখ। কাজে—কম্মে এখান দিয়ে যাতায়াত করত। কেউ চালের ব্যাপারি, কেউ শাক-সবজির ফড়ে। একজন আবার ভ্যান রিক্সা চালাত। আর একজন দূরের গ্রাম থেকে এসে নদীর ঘাটে মোট বইত। নৌকোতেও কাজ করত। একটা ব্যাপারে কিন্তু সকলের মিল। কাজের খাতিরে চারজনের সবাইকেই রাতবিরেতে বাড়ি ফিরতে হতো।’
‘কী করে মারা গেল লোকগুলো?’ পার্থ জিজ্ঞেস করল।
‘সকলেরই ঘাড় ভাঙা। যেন খুব শক্তিশালী কেউ হাতের চাপ দিয়ে ঘাড়টা মটকে দিয়েছে। এ তো বোঝাই যাচ্ছে অপদেবতার কাজ।’
‘পুলিশ আসেনি?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘পুলিশ অনেকবার এসেছিল। কিন্তু এসব ব্যাপারে পুলিশ কী করবে? পুলিশ বলছে এখান দিয়ে নাকি চোরাকারবারিরা বাংলাদেশ থেকে মাল পাচার করে। তাদের নিজেদের মধ্যে বখরার গণ্ডগোল নিয়ে এইসব খুন খারাপি। গ্রামের লোক কিন্তু সেটা বিশ্বাস করে না।’
‘গ্রামের লোক কী বিশ্বাস করে?’
‘গ্রামের লোক বিশ্বাস করে এখানে তেনারা অনেকদিন ধরে থাকতেন। কারও কোনও ক্ষতি করতেন না। আমরাই তাদের শান্তিতে থাকতে দিচ্ছি না। তাই তাঁরা রেগে গেছেন।’
‘তেনারা কোথায় থাকতেন?’ পার্থ সরলভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘ওই যে বাড়িটায় এখন বনবীথি ইস্কুল হয়েছে, ওটা খুব পুরোনো একটা বাড়ি। একসময় নীলকুঠি ছিল। তারপর বহু বছর জঙ্গলে ঢাকা পড়ে থাকত। ওখানেই তেনারা থাকতেন। ইস্কুলের মালিক ওই বাড়িটা কিনে সারিয়ে নিয়ে ইস্কুল চালাচ্ছে। তখন থেকেই তেনাদের বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটছে। আমরা খেয়াল করে দেখেছি বনবীথি ইস্কুলটা চালু হবার পর থেকে এই অঞ্চলে অপদেবতার উপদ্রব শুরু হয়েছে।’
‘কেউ কি কখনও বনবীথি ইস্কুলে ভূত-টুত কিছু দেখেছে?’ পার্থর আবার সরল প্রশ্ন।
‘দেখেছে বৈকি বাবু, নিশ্চয় দেখেছে। আমার মেয়ের ক্লাশে একটা মেয়ে পড়ত। দুষ্টুমি করার জন্য তাকে দিদিমনিরা ইস্কুলের একটা ঘরে সারা রাত্তির বন্ধ করে রেখেছিল। সে দেখেছে রাত্তিরবেলা তালগাছের মতো লম্বা লম্বা কিছু লোক ইস্কুলের পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকছে। দিদিমনিরা অবশ্য বলছে এসব বাজে গুজব। গুজব রটানোর জন্য সেই মেয়েটিকে ইস্কুল থেকে তাড়িয়েও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা এটাকে গুজব মনে করি না। তাছাড়া গ্রামের প্রায় সক্কলে বিশ্বাস করে মেমদিদিকে তেনারাই গায়েব করে দিয়েছেন। আসলে মেমদিদি চারদিকে বলে বেড়াচ্ছিল যে ইস্কুলে ভূত-টুত কিছু নেই। তাই তেনারা রেগে গেছেন। গ্রামের সবাই তাই ঠিক করেছে একটা বড় করে শান্তি-স্বস্তয়ন করবে। এদিকে তো আবার ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় না। ইস্কুলের কেরানিবাবু গৌর বাঁড়ুজ্জেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজো-আচ্চা করেন। তিনি শান্তি-স্বস্তয়ন করতে রাজি হয়েছেন।’
আদিত্য আবার সিগারেট বার করল। তাদের নবলব্ধ মৎসজীবী বন্ধুটিকে আর একটা সিগারেট দিয়ে বলল, ‘কিরণবাবু, আপনার মেয়ের সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে?’
‘নিশ্চয় যাবে। চলুন না, সামনেই আমার বাড়ি। ঝর্ণার ইস্কুল যেতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি আছে। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারবেন। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা বলতে ভুলেই গেছি। শেষ যে লাশটা নদীর ধারে পাওয়া গেছিল সেটা আমার মেয়ে ঝর্ণাই প্রথম দেখতে পায়।’
ঝর্ণার সঙ্গে কথা বলে আদিত্যরা যখন কিরণ দলুই-এর বাড়ি থেকে বেরোল তখন বনবীথি ইস্কুল বসব বসব করছে।
(২)
পার্থকে সঙ্গে নিয়ে আদিত্য বেলা এগারোটা নাগাদ বনবীথি ইস্কুলে ঢুকল। ঝর্ণা দলুই-এর কাছ থেকে ইস্কুল সম্বন্ধে তার মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে গেছে। নূপুর মণ্ডলকে আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছিল বনবীথি ইস্কুলে আদিত্যদের সঙ্গে দেখা হলে সে যেন না চেনার ভান করে। তবে গেট দিয়ে ঢুকেই আদিত্যদের সঙ্গে যার দেখা হল সে নূপুর মণ্ডল নয়, ইস্কুলের ক্লার্ক গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায়।
গৌরবাবুর সঙ্গে পার্থর আগে কয়েকবার দেখা হয়েছে। সেই সুবাদে পার্থকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। নমস্কারের ভঙ্গীতে দুই হাত বুকের ওপর জড়ো করে বললেন, ‘আরে, আসুন আসুন। ভাল আছেন তো?’ তারপর আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এঁকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না?’
‘ইনি আমার বন্ধু আদিত্য মজুমদার। পেশায় বেসরকারি গোয়েন্দা, চন্দ্রার ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করছেন।’ পার্থ আলাপ করিয়ে দিল, ‘আর ইনি গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায়, বনবীথি স্কুলের অফিসটা দেখাশোনা করেন, এর কথা তো তোকে আগেই বলেছি।’
আদিত্য হাত তুলে নমস্কার করল। নূপুর আর ঝর্ণার কথা শুনে গৌর বাঁড়ুজ্জে সম্বন্ধে তার মনে যে ছবিটা তৈরি হয়েছিল আসল লোকটার সঙ্গে তার পুরো মিল না থাকলেও খানিকটা মিল আছে। সে লক্ষ করল গৌরবাবুর উচ্চতা বেশি নয়, সাড়ে পাঁচ ফিটও পুরো হবে না, গৌরবর্ণ, ঈষৎ নাদুসনুদুস, উন্নতনাসা, মাথা ভর্তি উস্কোখুস্কো, কাঁচাপাকা চুল, গোলমরিচের সঙ্গে নুন মেশালে যেমন হয়। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, সরল দৃষ্টি। আদিত্য বলল, ‘চন্দ্রার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। হাতের দুএকটা কাজ সেরে নিয়ে আপনাদের সঙ্গে বসছি। চলুন ততক্ষণ একটু আপিস ঘরে বসবেন। চা খাবেন তো?’
আপিস ঘরে জায়গা খুব বেশি নেই। চেয়ারও একটা। সম্ভবত গৌরবাবুই সেটাতে বসেন। আর দুটো টুল আছে। গৌরবাবু খুব কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘চেয়ার তো একটার বেশি নেই, একজনকে মনে হয় টুলে বসতে হবে।’
‘কোনও ব্যাপারই না। আমি টুলে বসছি।’ পার্থ এগিয়ে গিয়ে টুলে বসল। বলল, ‘আপনি তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে আসুন।’
আদিত্য চেয়ারে না বসে ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। কিরণ দলুই ভুল বলেনি। সত্যিই পুরোনো আমলের কড়ি-বরগা দেওয়া বাড়ি। দু-একটা জায়গায় দেয়ালের চুন খসে গিয়ে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। ছোট চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা ইঁট। দেখে মনে হয়, বাড়ির বয়েস অন্তত দুশো বছর। এত পুরোনো বাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে আছে, এটা আশ্চর্য। কিংবা হয়ত পুরোনো বলেই এখনও টিকে আছে।
লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা এক ব্যক্তি মাটির ভাঁড় ও চায়ের কেটলি নিয়ে ঘরে ঢুকল। সাদা চুল, বলিষ্ঠ চেহারা, কষ্টিপাথরের মতো কালো গায়ের রং। আদিত্য আন্দাজ করল এ এই ইস্কুলের দরোয়ান, সফিকুল। সে মুখে বলল, ‘আপনি সফিকুল?’
‘হ্যাঁ সাহেব।’
আদিত্যর মনে হল সফিকুল অল্পকথার মানুষ। তাছাড়া কৌতুহল ব্যাপারটা তার মধ্যে নেই, কারণ সে একবারও জিজ্ঞেস করল না আদিত্যরা কে, তারা কেন এখানে এসেছে, সফিকুল নামটার সঙ্গে তাদের পরিচয়ই বা কী ভাবে ঘটল। এরকম অধীনতাবোধ বোধহয় একমাত্র মিলিটারিতেই সম্ভব। তবু সে খানিকটা ব্যাখ্যা করার মতো করে বলল, ‘আপনি তো জানেন চন্দ্রা দিদিমনিকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা ওর ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে এসেছি।’
সফিকুল উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আদিত্য আন্দাজে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি মিলিটারি থেকে কবে রিটায়ার করেছেন?’
‘বছর দশেক হল সাহেব।’
আদিত্যর আন্দাজ মিলে গেছে। পার্থ অবাক হয়ে আদিত্যর দিকে তাকাল। সফিকুল নির্বিকার।
‘এখানে কত বছর হল?’
‘তিন বছর পুরো হয়নি।’
‘তার আগে কী করতেন?’
‘বেশ কিছুদিন বর্ধমানে একটা সিকিউরিটি কোম্পানিতে গানম্যানের কাজ করেছি। চা-টা ঢালব?’
মনে হল সফিকুল তার নিজের অতীত নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে চায় না। উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে ভাঁড়ে চা ঢালল। চা টেবিলে রেখে ফাঁকা কেটলি নিয়ে চলে যেতে যাবে, আদিত্য তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘একটু দাঁড়ান, আরও দুএকটা জিনিস জানার আছে।’
সফিকুল দাঁড়িয়ে পড়ল। অ্যাটেনশন বললে ফৌজিরা যেভাবে দাঁড়িয়ে যায়, প্রায় সেইভাবে।
আদিত্য বলল, ‘সিকিউরিটি কম্পানিতে আপনি কী কাজ করতেন?’
‘বললাম তো। গানম্যানের কাজ করতাম।’
‘গানম্যানের দরকার পড়ত কেন?’
‘কম্পানির কাজ ছিল ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে গাড়ি করে চেস্ট-এ পৌঁছে দেওয়া। আমি গাড়িতে বন্দুক নিয়ে থাকতাম।’
‘চাকরি ছাড়লেন কেন?’
‘বয়েস হয়ে যাচ্ছিল। আমার বাড়ি বসিরহাটে। সেখানে আমার ছেলে, ছেলের বৌ থাকে। দুটো নাতি আছে। তাদের কাছাকাছি থাকতে চাইছিলাম।’
‘আপনার স্ত্রী?’
‘আমার বউ অনেকদিন আগে মারা গেছে।’
‘অন্য একটা প্রশ্ন। আপনি তো রাত্তিরে গেটের পাশের ঘরটাতে থাকেন। কখনও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে?’
সফিকুল অনেকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘না, তেমন কিছু আমার কখনও চোখে পড়েনি।’
‘একটু ভাল করে ভেবে দেখুন। একটা গুজব রটেছে, ইস্কুলে নাকি ভূত আছে। আপনি কিচ্ছু দেখেননি?’
‘ভূত-প্রেত-জিন এসব বানানো কথা। আমি এসব বিশ্বাস করি না। না সাহেব, আমি কিচ্ছু দেখিনি।’
‘ঠিক আছে সফিকুল ভাই। আপনি এখন আসতে পারেন। অনেক ধন্যবাদ।’
পার্থ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। সফিকুল চলে যেতে মৃদুস্বরে বলল, চা-টা একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।’
গৌর বাঁড়ুজ্জে ফিরে এল আধঘন্টা পরে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বলল, ‘ছোড়দিদি হিসেব দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল। তাই দেরি হয়ে গেল। আপনারা চা খেয়েছেন?’
‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা হাতে সময় নিয়েই এসেছি। আপনার সঙ্গে কথা শেষ হলে দিদিদের সঙ্গে কথা বলব। আমরা এসেছি ওরা জানেন তো?’ আদিত্য তাড়াতাড়ি বলল।
‘জানেন। তবে বড়দিদি নেই। কলকাতায় গেছেন। কালকে ফিরবেন। আমি ছোড়দিদিকে বলে দিয়েছি। একটা কথা বলি। এখানে কথা বলার একটু অসুবিধে। জায়গা নেই। চেয়ার নেই। যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে আমার বাড়ি গিয়ে আলাপ করা যেতে পারে। ইস্কুলের পেছন দিকে আমার বাড়ি। এখান থেকে দুপা।’
‘আপত্তি নেই। চলুন।’ কথাটা বলে আদিত্য পার্থর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মনে হয় আমার বন্ধুরও আপত্তি হবে না।’
দেড় কামরার বাসা। একটা শোবার ঘর, আর বাকি আধখানাতে রান্নাবান্না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা মাটিতে। বসার ব্যবস্থা শোবার ঘরে। গৌরবাবুর বাসাবাড়িটা ছোট হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
শোবার ঘরে তক্তোপোষ পাতার পর যেটুকু জায়গা বেঁচেছে তার মধ্যে একটা উঁচু টুল আর দুটো মোড়া রাখার জায়গা হয়েছে। টুলের ওপর একটা টেবিল ফ্যান শব্দ করে ঘুরছে। মোড়াগুলো বেশ নিচু, বসে আরাম নেই। সেটা আন্দাজ করে আদিত্য তক্তপোষের একদিকে বসে পড়ল, তার দেখাদেখি পার্থও তক্তপোষের অন্য দিকে বসল। ঘরের মাঝখান দিয়ে আড়াআড়িভাবে টাঙানো দড়িতে গৌরবাবুর ধুতি, গামছা, লুঙ্গি ঝুলছে। গৌরবাবু লজ্জিতভাবে সেগুলো এক কোণে সরিয়ে দিয়ে একটা মোড়ার ওপর বসলেন।
‘আপনি তো জানেন আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। চন্দ্রা সেনের হঠাৎ উধাও হয়ে যাবার ব্যাপারটা তদন্ত করছি। আমার বন্ধু পার্থ সান্যাল এই কাজে আমাকে নিযুক্ত করেছে।’ আদিত্য শুরু করল।
গৌর বাঁড়ুজ্জে কথা না বলে শুধু শুনছে। আদিত্যর প্রশ্নের অপেক্ষা করছে।
‘চন্দ্রাকে আপনি কতটা চিনতেন?’
‘অন্য দিদিমনিদের থেকে চন্দ্রা দিদিমনিকে অনেক বেশি চিনতাম। চন্দ্রা দিদিমনি আমার দুটো বাড়ি পরে থাকতেন। অন্য দিদিমনিরা যেমন ইস্কুল শেষ হলে এখান থেকে চলে যেতেন, চন্দ্রা দিদিমনি সেরকম নয়। তাই তার সঙ্গে অনেক বেশি দেখা হতো। কথাবার্তাও হতো অনেক বেশি। বলা যায়, বিপদে আপদে তিনি আমার ওপরেই নির্ভর করতেন।’
‘মানুষ হিসেবে চন্দ্রাকে আপনার কেমন মনে হত?’
‘চমৎকার মানুষ। অন্য দিদিমনিদের সঙ্গে চন্দ্রা দিদিমনির বেশ তফাত ছিল। ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে, তবু বলব, অন্য দিদিমনিদের কাছে ইস্কুলের কাজটা হচ্ছে পেটের দায়ে করা চাকরি। চন্দ্রা দিদিমনির কাছে ইস্কুলের কাজটা ছিল সখের, মানে, ঠিক সখেরও নয়, ভালবাসার তাগিদে করা চাকরি। অত যত্ন করে আর কেউ মেয়েদের পড়াতেন না। এটা আমি মেয়েদের কাছ থেকেই শুনেছি। তাছাড়া চন্দ্রা দিদিমনি যতটা লেখাপড়া জানতেন, অন্য দিদিমনিরা তার অর্ধেকের অর্ধেকও জানতেন না। মনে হয়, চন্দ্রা দিদিমনির নিজস্ব টাকা-পয়সা অনেক ছিল, তাই তাঁকে ইস্কুলের মাইনের ওপর নির্ভর করতে হতো না। কিন্তু যেটা সব থেকে বড় কথা, নিজের বিদ্যে বা টাকা-পয়সা নিয়ে চন্দ্রা দিদিমনির বিন্দুমাত্র অহঙ্কার ছিল না। সকলের সঙ্গে মিশতে পারতেন। এমনকি আমার মত অতি নগন্য একজন পাড়া-গাঁয়ের ইস্কুলের কেরানির সঙ্গেও সমানের মতো মিশতেন। এমনভাবে মিশতেন যে মনে হত আমি যেন বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, টাকা-পয়সায় তারই মত একজন কেউ। এর জন্য আমি তার কাছে খুব কৃতজ্ঞ।’ কথাগুলো বলতে বলতে গৌরবাবুর গলাটা ধরে এল।
আদিত্য গৌরবাবুকে স্বাভাবিক হবার জন্য কিছুটা সময় দিল। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি তো জানেন, হারিয়ে যাবার কিছুদিন আগে দু-দুবার চন্দ্রা নেহাত ভাগ্যের জোরে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। আপনার কি মনে হয় কেউ চন্দ্রাকে খুন করার চেষ্টা করছিল?’
‘চন্দ্রা দিদিমনির মতো মানুষকে কে খুন করতে চাইবে দাদাভাই?’ গৌরবাবুর গলার আওয়াজটা রীতিমত বিপন্ন শোনাল। তারপর প্রশ্নের ওজনটা একটু সামলে নিয়ে গৌরবাবু আস্তে আস্তে বললেন, ‘চন্দ্রা দিদিমনি হারিয়ে যাবার পর পুলিশ এসে একই প্রশ্ন করেছিল। আমি তাদের আসল উত্তরটা দিতে পারিনি। আসল কথাটা বললে আমাকে তারা বিশ্বাস করত না। কিন্তু আপনারা চন্দ্রা দিদিমনির আপনজন। আপনাদের আমি সত্যি কথাটাই বলব। বিশ্বাস করা না করা অবশ্য আপনাদের হাতে।’
বাইরে গাড়ির শব্দ। মনে হয় সরু রাস্তা দিয়ে ভারি কোনও গাড়ি সাবধানে এগিয়ে আসছে। আদিত্য গাড়ির শব্দ শুনে বাইরে তাকাল। তাই দেখে গৌরবাবু বললেন, ‘আজ তো মঙ্গলবার, তাই মিড ডে মিলের খাবার নিয়ে লরি এসেছে। আমি সফিকুলকে বলে এসেছি। সে-ই সব সামলে দেবে।’
আদিত্য গভীর কোনও চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল। গৌরবাবুর কথায় বাস্তবে ফিরে এসে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি আসল কথাটা বলবেন বলছিলেন।’
‘যেটা বলতে যাচ্ছিলাম দাদাভাই সেটা আমার নিজের চোখে দেখা। তবে অনেকে আমার কথাটা বিশ্বাস করেনি। আমার বাড়িটা দেখছেন তো? জানলা দিয়ে ইস্কুলের পেছন দিকটা পরিষ্কার দেখা যায়। ইস্কুলের পেছনে ওই অশথ গাছটা দেখছেন, ওইটা খুব গণ্ডগোলের গাছ। বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, ওই গাছটাতে কয়েকজন অতৃপ্ত আত্মা বাস করেন।’
‘অতৃপ্ত আত্মা!’ পার্থর গলা শুনে মনে হল সে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে।
‘ওই যে বললাম। আপনারা বিশ্বাস করবেন না। আমি কিন্তু নিজের চোখে দেখেছি।’
‘কী দেখেছেন সেটা বলুন।’ আদিত্য খানিকটা ব্যগ্রভাবে বলল।
‘ওই গাছে কয়েকজন অতৃপ্ত আত্মা আছেন। তাঁরা যখন মাটিতে নামেন তখন দেখেছি তাদের মাথা দোতলা ছাড়িয়ে যায়। মাঝরাত্তিরে মাঝে মাঝে বাথরুম করতে উঠে দেখেছি তাঁরা গাছ থেকে নেমে নদীর দিকে হেঁটে যাচ্ছেন।’
‘বুঝলাম। কিন্তু এদের অতৃপ্ত কেন বলছেন?’
‘অতৃপ্ত বলছি কারণ এঁরা মানুষ পছন্দ করেন না। এঁদের সামনে কেউ পড়লে তার আর নিস্তার নেই। জানেন তো এই অঞ্চলে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে? অতৃপ্ত আত্মারাই এদের মেরেছে। আর সব কটা মৃত্যুই ওই গাছটার নিচে ঘটেছে।’
‘কিন্তু আমি তো শুনেছি শেষ মৃতদেহটা নদীর ধারে পাওয়া গিয়েছিল।’ আদিত্য সন্দেহের গলায় বলল।
‘আপনি ঠিক শুনেছেন দাদাভাই। কিন্তু পুলিশকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন মৃত্যুটা ঘটেছিল ওই গাছটার নিচে। লোকটা মারা যাবার পর তার শরীরটাকে অতৃপ্ত আত্মারা টেনে-হিঁচড়ে নদী অব্দি নিয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাবার চিহ্ন দেখতে পেয়েছে।’
‘অতৃপ্ত আত্মারা মানুষের ওপর এত রেগে আছে কেন?’ পার্থ সরলভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘কারণ আছে দাদাভাই, যথেষ্ট কারণ আছে। আমাদের ইস্কুলবাড়িটা একসময় নীলকুঠি ছিল। নীল বিদ্রোহের সময় নীলকুঠির কয়েকজন সাহেবকে এখানে পুড়িয়ে মারা হয়। তাদের অতৃপ্ত আত্মা এখানেই বাস করত। কারো কোনও ক্ষতি তারা করত না। তারা যে ঘরটাতে বাস করত সেটা বন্ধই থাকত। সকলেই জানত ওই ঘরটাতে ঢুকতে নেই। কিন্তু কিছুদিন আগে চন্দ্রা দিদিমনি ওই ঘরটা খুলিয়ে, পরিষ্কার করিয়ে ওটাতে মেয়েদের ইংরেজি শেখার ক্লাশ নিতে শুরু করেন। তখন থেকেই অশান্তি। সেই অতৃপ্ত আত্মারা তাদের এত বছরের থাকার জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন ওই অশথ গাছে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের চোখে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে। সমস্ত মানুষের ওপর তাদের রাগ।’
‘আপনার কথা ঠিক হলে তো চন্দ্রার ওপরেই ওই আত্মাদের সব থেকে বেশি রাগ হওয়া উচিত। ও-ই তো ঘর থেকে আত্মাদের তাড়িয়েছে।’ আদিত্য চিন্তিত গলায় বলল।
‘চন্দ্রা দিদিমনির ওপর তাদের রাগ কি কম? আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন না কে চন্দ্রা দিদিমনিকে মারতে চাইবে, আমি সেই প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছি। ওই অতৃপ্ত আত্মারা দু-দুবার চন্দ্রা দিদিমনিকে মারতে চেষ্টা করেছে। বিশ্বাস করুন, শুধু আমার জন্যে পারেনি।’
‘আপনার জন্যে পারেনি? কীভাবে?’ পার্থ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘তাহলে আমার জীবনের কাহিনিটা একটু বলি দাদাভাই। আমাদের দেশ বর্ধমান জেলার রায়নায়। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। কাকার বাড়িতে থাকতাম, কেউ ভালবাসত না। গলার কাঁটা মনে করত। মাধ্যমিক পাশ করার পর লেখাপড়ায় আর মন বসল না। ছোটবেলা থেকেই আমার সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গ খুব ভাল লাগত। ইলেভেন ক্লাশে পড়ার সময় এক সাধুদের দলের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে পালালাম। কেউ খোঁজও করল না আমি কোথায় গেলাম। কাকা-কাকি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কারও ভালবাসা না পেয়ে বেঁচে থাকাটা যে কী দারুণ কষ্টের সেটা আমি আপনাদের বুঝিয়ে বলতে পারব না, দাদাভাই।’
গৌর বাঁড়ুজ্জে একটু থেমে আবার শুরু করলেন, ‘কতদিন সাধুদের সঙ্গে তীর্থে তীর্থে ঘুরলাম তার হিসেব নেই। এক সাধুদের দল ছেড়ে অন্য সাধুদের দলে গেলাম। হিমালয়ের পায়ের নিচে এক জঙ্গলে অনেক দিন কাটালাম। নর্মদার তীরে প্রায় এক বছর কাটল। সাধুদের সকলে ভাল লোক নয়। অনেক খারাপ লোক পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য সাধু সেজে লুকিয়ে থাকে। তাদের থেকে সাবধানে থাকতে হয়। আবার কিছু সত্যিকারের সাধুও আছেন। তাদের আশ্চর্য সব ক্ষমতা। তবে সংখ্যায় তাঁরা খুবই অল্প। আমার পরম সৌভাগ্য একজন সত্যিকারের সাধুর সন্ধান পেয়েছিলাম। উনি একা একাই থাকতেন। বাঙালি। আমি গিয়ে ওঁর পায়ে পড়ে গেলাম। বললাম, আমাকে আপনার শিষ্য করে নিন। আমি শুধু আপনার সেবা করব। উনি কিছুতেই রাজি হতে চান না, আমিও নাছোড়। শেষে এক মাস ধরে পেড়াপেড়ি করার পর উনি রাজি হলেন। সেই গুরুর সঙ্গে আমি প্রায় পাঁচ বছর কাটিয়েছি। অনেক মন্ত্র-তন্ত্র শিখেছি। গুরুর কাছে শেখা কিছু মন্ত্র পড়ে আমি চন্দ্রা দিদিমনির জন্য শান্তি-স্বস্তয়ন করেছিলাম। আর কেউ না জানুক আমি জানি ওই স্বস্তয়নের জোরেই চন্দ্রা দিদিমনি দু-দুবার বেঁচে গেছেন।’
‘আপনি সাধুর জীবন ছেড়ে আবার গৃহীর জীবনে ফিরে এলেন কেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘সে আরেক গল্প। পাঁচ বছর পর একদিন গুরু আমায় বললেন, শোন, সন্ন্যাসীর জীবন তোর জন্যে নয়। তুই সংসারে ফিরে যা। ফিরে গিয়ে গরীব বাচ্চাদের সেবা কর। তাতেই তোর মুক্তি। আমি তোকে কলকাতার একটা ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। এই ঠিকানায় গিয়ে রণবীর রায়ের সঙ্গে দেখা করবি। আমার কথা বলবি। গরিব মেয়েদের জন্যে এ অনেকগুলো ইস্কুল চালায়। কোনও একটা ইস্কুলে তোর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। ওখানেই তুই ভাল থাকবি, শান্তিতে থাকবি। গুরুর কথা মেনে আমি সংসারে ফিরে এসেছি। বনবীথি ইস্কুলে চাকরি পেয়েছি। এখানকার ছোট ছোট মামনিরা আমাকে খুব ভালবাসে। আমিও তাদের খুব ভালবাসি। খুব শান্তিতে আছি। গুরুর কথা সত্যি হয়েছে।’
গৌরবাবু থামলেন। আদিত্য এক মনে একটা কিছু ভাবছে। ঘরে শুধু টেবিল ফ্যান ঘোরার শব্দ। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আদিত্য বলল, ‘রণবীর রায়, মানে এই ইস্কুলগুলো যিনি চালান, তাঁর ঠিকানাটা আপনার কাছে পাওয়া যাবে?’
গৌরবাবু মনে হল প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। একটু থেমে বললেন, ‘আমার কাছে এক সময় তো ছিল। কিন্তু এখন বোধহয় হারিয়ে ফেলেছি। তবে ঠিকানাটা আপিসে নিশ্চয় পাওয়া যাবে। আপনারা তো এখন ওইদিকেই যাবেন। আমি ওখান থেকে দিয়ে দিচ্ছি।’
‘আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপনি বলছেন অতৃপ্ত আত্মারা চন্দ্রার ক্ষতি করতে চাইছিল?’
‘হ্যাঁ দাদাভাই। চন্দ্রা দিদিমনিই তো ওই ঘরটা খুলিয়েছিল। ওঁরা তো চন্দ্রা দিদিমনির ক্ষতি করতে চাইবেই।’
‘তাহলে কি আপনার মতে ওরাই চন্দ্রাকে গায়েব করে দিয়েছে?’
‘হ্যাঁ দাদাভাই। এছাড়া আর কী হতে পারে? তবে চন্দ্রা দিদিমনিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি নিয়মিত স্বস্তয়ন করছি।’
‘তাহলে আপনার মনে হয় চন্দ্রা ফিরে আসতে পারে?’ এবার পার্থর ব্যগ্র প্রশ্ন।
‘গুরুর মন্ত্রে সবই সম্ভব দাদাভাই। তবে আমি যত চন্দ্রা দিদিমনিকে আগলাবার চেষ্টা করছি, ওই অতৃপ্ত আত্মারা আমার ওপর তত রেগে যাচ্ছেন। চন্দ্রা দিদিমনি ফিরে এলেও আমার বড় কোনও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তা নিয়ে আমি ভাবি না।’
‘আর একটা প্রশ্ন। একটু ব্যক্তিগত। ইচ্ছে না হলে উত্তর দেবার দরকার নেই। এখান থেকে আপনি কত টাকা মাইনে পান?’ আদিত্য আচমকা জিজ্ঞেস করল।
প্রশ্ন শুনে গৌরবাবু অবাক। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আগে সাড়ে ছয় হাজার দিত, এবছর থেকে সাত হাজার হয়েছে।’ তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘ওতে আমার ভালোই চলে যায়, দাদাভাই। একা মানুষ, চাহিদাও বেশি নয়। এই পাড়াগাঁয় জিনিসপত্রের দামও আপনাদের শহরের থেকে অনেক কম। তাছাড়া এ-তল্লাটে ব্রাহ্মণ নেই বলে পুরোহিত পাওয়া যায় না। বাড়িতে পুজো-পার্বণ থাকলে লোকে আমাকেই ডাকে। সেখান থেকেও কিছু আয় হয়।’
(৩)
‘চন্দ্রা আমাদের থেকে বয়েসে অনেক ছোট হলেও আমাদের অভিভাবকের মতো ছিল,’ বনবীথি ইস্কুলের ছোড়দিদি সুপ্রভা দে বলছিলেন, ‘চন্দ্রা ইস্কুলটাকে আগলে আগলে রাখত। ইংরিজিতে চিঠিপত্র লেখাই হোক বা ইস্কুল ডিপার্টমেন্টের লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, চন্দ্রা এই ইস্কুলে আসার পর থেকে এইসব কাজ সে-ই করত।’
বনবীথি ইস্কুলের বড়দিদি অনিমা সামন্ত কলকাতায় গেছেন। আগামীকাল ফিরবেন। এ যাত্রা তার সঙ্গে কথা বলা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তার বদলে স্টাফ রুমে বসে ছোড়দিদি সুপ্রভা দের সঙ্গে আদিত্যরা কথা বলছিল।
‘একবার একটা গবেষণার দল ইস্কুল দেখতে এল। দলে একজন মেম, একটা সাহেব আর দুজন বাঙালি। তারা গরিব মেয়েদের নিয়ে গবেষণা করছে। গরিব মেয়েরা কেমন লেখাপড়া করছে, লেখাপড়া শিখে তারা নিজেদের বাড়িতে বেশি খাতির-যত্ন পাচ্ছে কিনা, তাদের বিয়ের বয়েসটা বাড়ছে কিনা এইসব তাদের প্রশ্ন। দেখলাম সাহেব-মেমের সঙ্গে চন্দ্রা গড়গড় করে ইংরিজিতে কথা বলে গেল। এই পাড়াগাঁয়ে ওরকম ইংরিজি শুনে তারা তো অবাক।’
‘চন্দ্রার কি এখানে থাকতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল? মানে, হঠাৎ যে সে এইভাবে কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেল, এই ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়?’ আদিত্য সরাসরি জিজ্ঞেস করল।
প্রশ্নটা শুনে ছোড়দিদি খানিকটা থমকে গেল। তারপর আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি ঠিক জানি না। এই প্রশ্নটা নিয়ে আমিও অনেক ভেবে দেখেছি। উত্তর পাইনি। এখানে চন্দ্রাকে তো বেশ সুখীই মনে হতো।’
‘এই ইস্কুল সম্বন্ধে একটা কথা চালু আছে। এর চারপাশে নাকি অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। এ-ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?’
‘এইসব বাজে কথা যারা ছড়াচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য অতি জঘন্য।’ ছোড়দিদির গলাটা রীতিমত উত্তেজিত শোনাল। ‘দেখুন, এই অঞ্চলে মর্নিং ডিউ বলে একটা ইংরিজি মিডিয়াম ইস্কুল আছে। নামেই ইংরিজি মিডিয়াম। পড়াশোনা হয় অষ্টরম্ভা। তবু ছেলেমেয়ে ইংরিজি শিখে চাকরি-বাকরি পাবে এই আশায় গ্রামের লোক ঘটিবাটি বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের ইংরিজি মিডিয়াম ইস্কুলে পাঠাত। চন্দ্রা এখানে আসার পর ছবিটা একেবারে বদলে গেছে। চন্দ্রা আমাদের মেয়েদের খুব যত্ন করে ইংরিজি শেখায়। অঙ্ক শেখায়। মর্নিং ডিউ ইস্কুলের কোনও টিচার ওর নখেরও যুগ্যি নয়। গ্রামের মানুষ সেটা বোঝে। তাই এখন গ্রামের সকলে তাদের মেয়েদের বনবীথি ইস্কুলেই পাঠাচ্ছে। ফলে মর্নিং ডিউ-এর ব্যবসা প্রচণ্ড মার খাচ্ছে। ফলে ওই ইস্কুলের মালিকই এসব আজগুবি গল্প রটাচ্ছে। নেহাত আমরা ছেলেদের নিই না বলে। নইলে ছেলেরাও এখানেই আসত। আর ছেলেরাও এখানে পড়লে মর্নিং ডিউ একেবারে বন্ধ হয়ে যেত।’
‘কীভাবে এই আজগুবি গল্পগুলো রটছে বলে আপনার মনে হয়?’
‘কিছুদিন আগে আমাদের ইস্কুলেরই একটি মেয়ে এইসব গল্প রটাতে শুরু করেছিল। মেয়েটির রেকর্ড ভাল নয়। নানা অপকর্ম করে আগেও কয়েকবার ধরা পড়েছিল। পড়াশোনাতেও মা গঙ্গা। আমাদের ধারণা, ইস্কুলে ভূত আছে, অপদেবতা আছে এইসব গল্প রটানোর জন্যে মর্নিং ডিউ ইস্কুলের মালিক ওকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়েছিল। মেয়েটি অবশ্য সেসব কিছু স্বীকার করেনি। আমরা মেয়েটিকে ইস্কুল থেকে রাস্টিকেট করে দিলাম। ও তখন গ্রামের লোকেদের মধ্যে ওইসব গল্প রটাতে লাগল। এতে আমাদের বেশ ক্ষতি হল। বেশ কিছু মেয়ে ইস্কুল ছেড়ে চলে গেল। গ্রামের মানুষদের মন কুসংস্কারে ভর্তি এটা তো স্বীকার করবেন?’
‘এখনও কি বনবীথি ইস্কুলের মধ্যে কেউ আছে যে এই গল্পগুলো রটাচ্ছে?’
উত্তরটা দিতে ছোড়দিদি খানিকক্ষণ ইতস্তত করল। তারপর বলল, ‘আছে। কেউ কেউ আছে।’
‘তাদের নাম বলা যাবে?’ আদিত্য কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘আমার বলতে অসুবিধে নেই। একজন আমাদেরই সেলাই দিদিমনি সোনালী সাঁতরা, আর একজন আমাদের কেরানিবাবু গৌর বাঁড়ুজ্জে।’
‘এমন তো হতে পারে এরা সত্যিই বিশ্বাস করে ইস্কুলে এবং তার আশেপাশে অশরীরী আত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে?’ পার্থ সরলভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘না, না। ব্যাপারটা এতটা সোজা নয়। গৌর বাঁড়ুজ্জে বা সেলাই দিদিমনি দুজনেই অভাবী মানুষ। দুচার পয়সা দিয়ে এদের কিনে নেওয়া খুবই সহজ কাজ। আর আমার স্থির বিশ্বাস সেটাই হয়েছে।’
‘আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে ওই ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের মালিকই চন্দ্রাকে সরিয়ে দিয়েছে?’ প্রশ্নটা করতে করতে পার্থ যেন নিজেই শিউরে উঠল।
”এটাও আমি অনেক ভেবে দেখেছি। সম্ভাবনাটা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বরং আমি বলব এটা হবার সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি। এটা ছাড়া চন্দ্রার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়াটা কিছুতেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।’
‘দুএকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন। আপনার বাড়ি কোথায়?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমার বাড়ি বসিরহাটে। সেখান থেকেই আমি রোজ ইস্কুলে আসি।’
‘বাড়িতে কে কে আছেন?’
‘বাড়িতে থাকি আমি আর আমার স্বামী। আমাদের দুটি ছেলে, দুজনেই বাইরে চাকরি করে। একজন কলকাতায়, একজন ব্যাঙ্গালোরে। আমার স্বামী বসিরহাট মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি করতেন। বছর খানেক হল রিটায়ার করেছেন।’
‘একটা শেষ প্রশ্ন। বড়দিদির সঙ্গে তো কথা হল না। হলে ওঁকেই জিজ্ঞেস করতাম। আপনার মতো কি বড়দিদিও বিশ্বাস করেন, গুজব ছড়ানোর পেছনে মর্নিং ডিউ ইস্কুলের মালিকই আছে বা চন্দ্রার হারিয়ে যাওয়ার পেছনেও তার হাত থাকতে পারে?’
‘একশ পার্সেন্ট বিশ্বাস করেন। বস্তুত বড়দিদিই আমার মাথায় এই সন্দেহগুলো প্রথম ঢুকিয়েছেন।’
‘অনেক ধন্যবাদ সুপ্রভাদি। আপনাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আপনি এবার একটু সেলাই দিদিমনিকে পাঠিয়ে দেবেন?’
সেলাই দিদিমনি সোনালী সাঁতরা মনে হয় বাইরেই অপেক্ষা করছিল। ছোড়দিদি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল সে। আদিত্যর সন্দেহ হল, সেলাই দিদিমনি বোধহয় আড়ি পেতে আদিত্যদের কথাবার্তা শুনছিল।
‘বসুন। চন্দ্রার হারিয়ে যাবার ব্যাপারে আমরা আপনাকে দুএকটা প্রশ্ন করব।’
সেলাই দিদিমনি সসঙ্কোচে চেয়ারের একধারে বসল। ক্ষয়াটে খর্বকায় চেহারা। সারা অঙ্গে দারিদ্রের চিহ্ন স্পষ্ট। তার ওপর মুখে-চোখে পরিষ্কার ভয়ের ছাপ।
‘আপনাকে তো ছাত্রীরা সোনাদিদি বলে? আমরাও তাই বলব, কেমন?’
সোনালী সাঁতরা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না। আদিত্য কথাবার্তা শুরু করার জন্য সহজ প্রশ্ন করল, ‘আপনার বাড়ি কতদূরে?’
‘আমার বাড়ি খুব কাছে। এই সোলাডাঙায়।’ সোনাদিদির গলার আওয়াজ এতই ক্ষীণ যে শোনাই যায় না।
‘বাড়িতে কে কে আছেন?’
‘মা আছে, আমার বোন আছে আর আমি।’ এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ সোনাদিদি কান্নায় ভেঙে পড়ল। কান্না জড়ানো গলায় বলল, ‘দাদা, আমার কোনও দোষ নেই। এটা ঠিক যে আমরা পাড়াগাঁয়ের মানুষ ভূত-প্রেত-অপদেবতায় বিশ্বাস করি। তাছাড়া আমি যেটা নিজের চোখে দেখেছি সেটা তো আর অবিশ্বাস করতে পারি না। হয়ত তা নিয়ে দুচারটে কথা এদিক-ওদিক বলেছি। কিন্তু টাকা নিয়ে ইস্কুলের ক্ষতি করব এমন মানুষ আমি নই। বড়দিদি ছোড়দিদি দুজনেই বলছে আমি মর্নিং ডিউ ইস্কুলের থেকে টাকা খেয়ে বনবীথি সম্বন্ধে গুজব ছড়াচ্ছি। তাই ওরা আমাকে আর রাখতে চায় না। কিন্তু আমি কেন একাজ করতে যাব? যে ইস্কুল থেকে আমার রুটি-রুজির ব্যবস্থা হচ্ছে তাকে বন্ধ করে দিয়ে আমার কী লাভ? দাদা, আমার পুরো পরিবারের পেট চলে আমার রোজগারের টাকায়। আমার চাকরি চলে গেলে পুরো পরিবারটা না খেয়ে মরবে। আপনারা বড়দিদি আর ছোড়দিদিকে একটু বুঝিয়ে বলুন।’
‘আপনি নিজের চোখে কী দেখেছেন?’
‘আমি কিছু দেখিনি। আমি কিচ্ছু দেখিনি।’
সোনালী সাঁতরাকে দিয়ে আর কিছু বলানো গেল না। কিন্তু তার নীরবতা বলে দিচ্ছিল সে অনেক কিছু দেখেছে।
সোনালী সাঁতরা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ছোড়দিদি আবার ঘরে ঢুকল। বলল, ‘আর একজন দিদিমনি এখানে অতি সম্প্রতি এসেছেন। তাকে ডাকব?’
‘না তার দরকার হবে না,’ আদিত্য বলল, ‘তিনি তো একেবারে হালে এসেছেন। চন্দ্রাকে কখনও চোখেই দেখেননি। তাকে আর কী জিজ্ঞেস করব?’
আদিত্য ঘড়ি দেখল। দুপুর আড়াইটে বেজে গেছে। এখনও তাদের লাঞ্চ খাওয়া হয়নি। বসিরহাটে গেলে মনে হয় কিছু একটা খাবার পাওয়া যাবে। একবার বসিরহাট পুলিশ স্টেশনেও যাওয়া দরকার। যে এস আই চন্দ্রার ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করছে সে হয়ত নতুন কোনও খবর দিতে পারে। দেখা যাক পার্থ কী বলে।
(৪)
বসিরহাট থানার সামনে কী একটা ঝামেলা চলছে। ঝাণ্ডা নিয়ে গোটা পঞ্চাশেক লোক খুব উত্তেজিত হয়ে স্লোগান দিচ্ছে আর পুলিশের বাপান্ত করছে। আদিত্য শুনতে পেল কোন পলিটিকাল গুণ্ডাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে বলে এত আক্রোশ। একটু আগে সে আর পার্থ একটা অতীব নিকৃষ্ট লাঞ্চ খেতে বাধ্য হয়েছিল। অত বেলায় এর থেকে ভাল কিছু পাওয়া গেল না। ভাতটা শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে গিয়েছিল, ডাল বলে যেটা দিয়েছিল সেটাতে ডালের থেকে ভাতের ফ্যান বেশি ছিল। বেগুন ভাজাটা ছিল পাথরের মতো শক্ত এবং ঠাণ্ডা আর কাটা পোনা বলে যেটা দিল সেটা অন্তত এক মাস বরফে রাখা নির্ভেজাল চারাপোনা। খাওয়া শেষ করে আদিত্য পুলিশের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। পার্থ আসেনি। সে গাড়িতে বসে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে। আদিত্যকে বলল, ‘আমি থাকলে পুলিশ তোর সঙ্গে ভাল করে কথাই বলবে না।’ আসলে ওর ঘুমোনোর ইচ্ছে।
দূর থেকে দেখে আদিত্য ভেবেছিল থানাতে বুঝি ঢুকতেই পারবে না। কাছে গিয়ে দেখল আন্দোলনকারীরা থানায় ঢোকার মেন দরজাটা অবরোধের বাইরে রেখেছে। সেখান দিয়ে যাতায়াত করা যাচ্ছে। আদিত্য দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে থানার ভেতরে ভীড়, বিরাট বিশৃঙ্খলা। বড়বাবুর টেবিল ঘিরে কিছু লোক উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। মনে হয়, এরা অবরোধকারিদের মাতব্বর কিছু নেতা, পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে ভেতরে এসেছে। আদিত্য ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে দেখে একজন উর্দিপরা অফিসার এগিয়ে এসে রুক্ষভাবে বলল, ‘কী চাই?’
‘একটা তদন্তের ব্যাপারে এস আই সম্বিত কুণ্ডুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। লালবাজার থেকে বলা আছে। ইন্সপেক্টর সঞ্জয় সমাদ্দার বলে দিয়েছেন।’
‘লালবাজার শুনে লোকটা খুব একটা বিচলিত হয়েছে বলে মনে হল না। দায়সারাভাবে বলল, ‘কুণ্ডু একটা ইনভেস্টিগেশনে করিমপুর গেছে। ফিরতে রাত্তির হবে। আপনি বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলুন।’
বড়বাবুর কাছে পৌঁছনো অবশ্য সহজ নয়। তাকে ঘিরে ডজন খানেক লোক তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। আদিত্য সেই লোকগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে কখন বড়বাবু একটু ফাঁকা হবে সেই সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর আদিত্যর ভাগ্য খুলল। লোকগুলো, হয়ত বৃহত্তর কোনও আন্দোলন করার মতলবে, একসঙ্গে বাইরে বেরিয়ে গেল। তাদের বাইরে বেরিয়ে যাবার পেছনে বড়বাবুর কোনও আশ্বাসও থাকতে পারে। এবার বড়বাবু আদিত্যকে নজর করলেন। জলদগম্ভীর গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার? আপনি এতক্ষণ থানার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? দেখছেন না এখানে একটা ঝামেলা চলছে। বাইরে যান, বাইরে যান। কিছু বলার থাকলে পরে আসবেন।’
আদিত্য মরিয়া হয়ে বলল, ‘আমি সাব ইন্সপেক্টার সম্বিত কুণ্ডুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। লালবাজার থেকে ইন্সপেক্টার সঞ্জয় সমাদ্দার কুণ্ডুবাবুর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিলেন। কুণ্ডুবাবু বলেছিলেন এই সময় থাকবেন।’
‘কুণ্ডুকে আমি একটা কাজে করিমপুর পাঠিয়েছি। কুণ্ডুর সঙ্গে কী দরকার?’
‘এখানকার একটা ইস্কুলের দিদিমনি চন্দ্রলেখা সেন যে নিখোঁজ হয়ে গেছেন, কুণ্ডুবাবু তো সে ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করছিলেন। সে ব্যাপারে উনি কতটা এগোলেন সেটা একটু জিজ্ঞেস করতাম।’
‘ইনভেস্টিগেশনে কতটা এগিয়েছে সেটা কুণ্ডু তোমাকে বলবে কেন? তুমি কোন হরিদাস পাল?’
অপমানে আদিত্যর কানদুটো লাল হয়ে উঠল। তবু সে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল, ‘আমার নাম আদিত্য মজুমদার। আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। শুধু চন্দ্রলেখা সেনের কেসটা নয়, এই অঞ্চলে যে ইদানীং বেশ কয়েকটা খুন হয়েছে সে বিষয়টাও তদন্ত করছি। লালবাজার এবং দিল্লির স্পেশাল অ্যান্টিটেররিস্ট ব্রাঞ্চ আমাকে সাহায্য করছে। আমাদের ধারণা এই খুনগুলোর সঙ্গে টেররিস্টদের একটা সম্পর্ক আছে। আমার মনে হচ্ছে আমি আসছি জেনে আপনি ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর একটাই মানে হতে পারে। লোকাল পুলিশ বা তাদের একটা অংশ টেররিস্টদের প্রোটেকশন দিচ্ছে। আমি যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। এখানে আমার আর থাকার কোনও দরকার নেই। নমস্কার।’
হতভম্ভ বড়বাবুকে থানার ভেতরে রেখে আদিত্য বাইরে এসে দেখল আন্দোলনকারিরা আবার স্লোগান দিতে শুরু করেছে।
ফেরার পথে আদিত্যরা যখন গাড়ি থামিয়ে রাস্তার ধারের একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছে, পার্থ হঠাৎ ককিয়ে উঠল, ‘আরে আমার পেন? আমার পেনটা কোথায় গেল?’
‘কোথায় ছিল পেনটা?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমার বুক পকেটে গোজা ছিল। সব সময় থাকে। ওটা আমার লাকি চার্ম।’ পার্থর গলাটা প্রায় কাঁদোকাঁদো।
‘কী পেন ছিল ওটা?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল। ‘ওটা তোর পকেটে দেখেছি বটে, কিন্তু কখনও তোকে ওটা দিয়ে লিখতে দেখিনি।’
‘দামী পেন। ম ব্লঁ। হাজার দেড়েক ডলার দিয়ে কিনেছিলাম। জানিস তো আমার খুব পেনের সখ। তবে দামটা ব্যাপার নয়। বললাম না ওটা আমার লাকি চার্ম।’
‘চল গাড়িতে গিয়ে দেখি। গাড়িতে পড়ে গেছে কিনা।’ আদিত্য মাটির দিকে তাকাতে তাকাতে গাড়ির দিকে এগোল।
গাড়িতে পেনটা নেই। আদিত্য বলল, ‘বনবীথি ইস্কুলে পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। খোঁজ নিতে হবে।’
বাকি পথটা পার্থ প্রায় কোনও কথাই বলল না।
রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর নূপুরকে ফোন করল আদিত্য।
‘ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?’
‘আরে না, না, এখন কী ঘুমোব? আমি অনেক রাত্তিরে ঘুমোই। সেক্টর ফাইভে কাজ করার অভ্যেস। তুমি বল কী বলবে। আচ্ছা তার আগে আমার দুএকটা কথা বলার আছে, সেগুলো বলে নিই।’
আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘কোনও নতুন খবর আছে?’
‘দু-একটা খবর দেবার ছিল আদিত্যদা। স্কুলে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারছিলাম না। স্কুলে কথা বললে সকলে সব শুনতে পায়। কোনও প্রাইভেসি নেই। দুটো জিনিস বলার ছিল। প্রথমত, তুমি চন্দ্রা সেনের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো নাড়াচাড়া করে দেখতে বলেছিলে। জিনিসপত্রগুলো একটা সুটকেস ভর্তি হয়ে গৌরবাবুর বাড়িতে রাখা আছে। আমি সোনাদিদিকে নিয়ে সেগুলো দেখতে গিয়েছিলাম। মেয়েদের ইংরেজি শেখানোর জন্য চন্দ্রা দিদিমনির একটা নোটখাতা ছিল, সেটা খুঁজতে যাবার অছিলায়। তুমি বলেছিলে কী কী আছে তার থেকেও কী কী নেই সেটা জানা বেশি জরুরি। সোনাদিদি বলল, চন্দ্রা দিদিমনির একটা নীল শাড়ি, একটা হলুদ শাড়ি আর দুটো সাদা শাড়ি সুটকেসের জিনিসপত্রের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। আমি অনেকবার সোনাদিদিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ঠিক বলছ তো? সোনাদিদি বলল, মেয়েরা শাড়ির ব্যাপারে কখনও ভুল করে না।’
‘বেশ, বেশ। আর দ্বিতীয় খবর?’ আদিত্যর গলাটা খুশি খুশি শোনাল।
‘দ্বিতীয় খবরটা হল, চন্দ্রা যে বাড়িটায় থাকত সেটা খুব পুরোনো একটা বাড়ি। বাড়িওলা ওখানে থাকে না। বসিরহাটে থাকে। ভাড়া নিতে পারি এই অছিলায় বাড়িওলার কাছ থেকে চাবি নিয়ে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। ছাতে একটা ছোট্ট চিলেকোঠার ঘর আছে। দেখে মনে হয় বহুদিন কেউ ভেতরে ঢোকেনি। দরজায় হুড়কো লাগানো। হুড়কো খুলে দেখি নানারকম জঞ্জাল, পুরোনো জামাকাপড়, কিছু বাতিল থালাবাসনের সঙ্গে একটা বেতের মুখ ঢাকা ঝাঁপি, যে ধরনের ঝাঁপিতে সাপুড়েরা সাপ রাখে। ঝাঁপির মুখটা খানিকটা খোলা, সাপ-টাপ কিছু নেই। কিন্তু সাপের খোলস কিছুটা রয়ে গেছে। আর একটা বুনো গন্ধ। সব মিলিয়ে এটা পরিষ্কার যে কিছুদিন আগে ঝাঁপির মধ্যে একটা সাপ ছিল।’
আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘দুটো কাজ করতে হবে তোমাকে। বনবীথির কাছে মর্নিং ডিউ বলে একটা ইংরেজি মিডিয়াম ইস্কুল আছে। চন্দ্রা বনবীথিতে আসার পর থেকে তাদের ব্যাবসার অবস্থা খারাপ। সবাই চন্দ্রার কাছে ইংরেজি শিখতে আসছে, মর্নিং ডিউতে কেউ ভর্তি হচ্ছে না। কারও কারও মতে, চন্দ্রার উধাও হয়ে যাবার পেছনে মর্নিং ডিউএর মালিকের হাত আছে। ব্যাপারটা তোমাকে একটু খোঁজ নিতে হবে। বুঝতে পেরেছ তো?’
‘বুঝতে পেরেছি আদিত্যদা। আমি খোঁজ নিয়ে দুএকদিনের মধ্যেই তোমাকে জানাচ্ছি। আর কী কাজ?’
‘আর তুমি বললে না, চন্দ্রার চিলেকোঠার ঘরে সাপের ঝাঁপি দেখেছ? তুমি খোঁজ নেবে আশেপাশের গ্রামে কোনও সাপুড়ে আছে কিনা। যদি কোনও সাপুড়ের সন্ধান পাও তাকে জিজ্ঞেস করবে সে কিছুদিন আগে কাউকে কোনও কালো কেউটে সাপ বিক্রি করেছে কিনা। করলে, কাকে করেছে?’
‘আমি দুটো কাজ করে তোমাকে ফোন করব।’
‘ঠিক আছে। আজ শুয়ে পড়। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা। পার্থর পকেট থেকে একটা পেন পড়ে গেছে। দামী ম ব্লঁ পেন। কালো রঙের। তুমি একটু দেখো। অন্যদেরও দেখতে বোলো।’
‘কালো পেন? ইস্কুলের কোথাও পড়েছে?’
‘ইস্কুলে পড়তে পারে, অন্য কোথাও পড়তে পারে। পার্থর খেয়াল নেই।’
‘ঠিক আছে। দেখব। গুড নাইট আদিত্যদা।’
‘গুড নাইট।’