সপ্তম পরিচ্ছেদ
(১)
বাড়ির নাম সেনবাটী। সেকেলে নাম। শুধু সেকেলে নয়, বাড়ির স্থান-মাহাত্ম্য, আয়তন বা স্থাপত্য আন্দাজে নামটা নেহাতই সাদামাটা। আদিত্য ভাবছিল, বাড়ির নামের সঙ্গে একটা প্যালেস বা ম্যানসন জাতীয় জমকালো কিছু জোড়া থাকলে আরও লাগসই হতো, কারণ সেনবাটীকে বাড়ি না বলে অনায়াসে প্রাসাদ বলা চলে।
গানের অনুষ্ঠান সন্ধে ছটায়। অমিতাভ আর রত্নার সঙ্গে পাঁচটা দশে সেনবাটী পৌঁছে গেল আদিত্য। পাঁচটা থেকে চায়ের নেমন্তন্ন। শুধু চায়ের নেমন্তন্ন নয়, উদীয়মান দুই শিল্পী, যাঁরা সেই সন্ধেবেলা গান-বাজনা শোনাবেন, তাদের সঙ্গে পরিচিত হবার আমন্ত্রণও ছিল।
বাড়ির মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বেশ বড় একটা লন। লনের চারদিক দিয়ে রাস্তা। লনে কোথাও আগাছা নেই, বেমানানভাবে বেড়ে ওঠা ঘাস নেই। বাড়ির পেছন দিকে গাড়ি রাখার জায়গা। দরোয়ান একটা লম্বা সেলাম ঠুকে দেখিয়ে দিল গাড়ি থেকে কোথায় নামতে হবে আর তারপর ড্রাইভার কোথায় গাড়ি রাখবে। পুরোনো আমলের গাড়ি বারান্দার নিচে গাড়ি থেকে নামতে নামতে রত্না বলল, ‘আমার এইসব জায়গায় আসতে একেবারে ইচ্ছে করে না। আমি তো গান-টান কিচ্ছু বুঝি না। দুতিন ঘন্টা বোকার মতো চুপচাপ বসে থাকতে হবে। কিন্তু কমলিকা সেন এত করে বললেন, না এলে খুব অভদ্রতা হতো।’
‘এসে ভালই করলে। এরকম দুচারটে অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে দেখবে ক্লাসিকাল গান ভালো লাগতে শুরু করেছে।’ অমিতাভ মৃদু হেসে বলল।
উত্তরে রত্না একটা মুখভঙ্গী করল যার নানারকম মানে হতে পারে। তারা তিনজন এখন মূল বাড়ির সদর দরজা দিয়ে একটা হলঘরে ঢুকেছে। সামনেই গৃহকর্তী দাঁড়িয়ে, তাদের হাত তুলে নমস্কার করলেন। মুখে বললেন, ‘আসুন, আসুন, অমিতাভ।’ তারপর রত্নার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি আসতে পেরেছেন, তাই খুব ভাল লাগছে। জানতাম, আমার কথা আপনি ফেলতে পারবেন না। পাশের ঘরে সামান্য চায়ের ব্যবস্থা করেছি। শিল্পীরাও ওখানে। ওদের সঙ্গে একটু কথা বললে ওদের খুব ভাল লাগবে।’ কথাটা বলে তিনি আদিত্যর দিকে তাকালেন।
অমিতাভ বলল, ‘ইনি আমার বন্ধু আদিত্য মজুমদার। এঁর কথাই আপনাকে বলেছিলাম। আদিত্য একজন অত্যন্ত সমঝদার শ্রোতা।’
আদিত্য মৃদু প্রতিবাদের ভঙ্গী করল। কমলিকা সেন বললেন, ‘আপনি এসেছেন বলে খুব ভাল লাগছে। আমি কিন্তু আপনার আসল পরিচয়টা আপনার বন্ধুর কাছ থেকে আগেই জানতে পেরেছি।’
আদিত্য শঙ্কিত হয়ে উঠল। সে যে গোয়েন্দাগিরি করে সেটা অমিতাভ এঁকে গল্প করতে গেল কেন?’
তার শঙ্কা দূর করে কমলিকা সেন বললেন, ‘অমিতাভ আমাকে বলেছে, আপনি অসিতবর্ণ মজুমদারের ছেলে। আমরা যারা গানবাজনার সঙ্গে অল্পস্বল্প যুক্ত, আমরা তো জানি, অসিতবাবুর মতো বোদ্ধা, সঙ্গীতরসিক কলকাতায় খুব বেশি জন্মাননি। পুরোনো লোকেরা ওঁর বাড়ির বৈঠকগুলোর কথা এখনও বলেন। অসিতবাবুর ছেলে আমার বাড়িতে গান শুনতে এসেছেন বলে আমি ধন্য বোধ করছি।’
আদিত্যর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। একই সঙ্গে ভেতরে ভেতরে সে হঠাৎ খুব আবেগী হয়ে পড়ল। আসলে কেউ তার বাবার কথা বললে সে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে সে বলল, ‘আপনারা আমার বাবাকে মনে রেখেছেন এটা আমার কাছে যে কত বড় ব্যাপার বলে বোঝাতে পারব না।’
আরও অনেক অতিথি সদর দরজা দিয়ে ঢুকছেন। সে দিকে তাকিয়ে কমলিকা সেন বললেন, ‘আপনারা পাশের ঘরে গিয়ে চা-টা খান, আমি একটু ওদিকটা সামলাই।’ বলতে বলতে কমলিকা সেন দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
হলঘরেই গানবাজনার ব্যবস্থা। জাজিমের ওপর সাদা চাদর পাতা রয়েছে। একেবারে সামনে পুরু গদি দিয়ে মঞ্চ। ঘরটা বেশ বড়, জনা পঞ্চাশ অনায়াসে বসতে পারে। পাশের ঘরে যাবার জন্য আগেকার দিনের মস্ত দরজা। যাবার রাস্তাটা পাতা চাদরের পাশ দিয়ে। সেখানে দাবার বোর্ডের মতো সাদা-কালো মার্বেলের মেঝের কিছুটা উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে।
‘তোর পিতৃপরিচয়টা কিন্তু ভদ্রমহিলা আগেই জানতেন। আমাকে কিছু বলতে হয়নি। আমি ফোন করতে উনি নিজে থেকেই বললেন, শুনেছি অসিত মজুমদারের ছেলে আপনার খুব বন্ধু। ওঁকে যদি নিয়ে আসেন, খুব ভাল লাগবে। কোথা থেকে জেনেছে কে জানে। যাই হোক, এখানে তুই বেশ খাতির পাবি। ফলে তোর কাজেরও সুবিধে হবে।’ অমিতাভ পাশের ঘরে যেতে যেতে বলল।
পাশের ঘরে কিছুটা ভিড়। জনা কুড়ি-পঁচিশ নারী পুরুষ নিচু গলায় কথাবার্তা বলছে, চা-স্যান্ডউইচ-কাবাব-সন্দেশ খাচ্ছে। আদিত্য এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, সকলেই তার অচেনা। সে ভেবেছিল, অন্তত দুএকজন চেনা বেরিয়ে পড়বে। হিন্দুস্তানি মার্গসঙ্গীত যারা নিয়মিত শোনে তারা অনেকেই আদিত্যর মুখচেনা, কারও কারও সঙ্গে পরিচয়ও আছে। এদের কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে বেশির ভাগই কর্পোরেট জগতের লোক। কিংবা নাম করা উকিল বা ডাক্তার। ইংরেজি করে এক কথায় বললে সোশালাইট, সমাজের উঁচুতলার মানুষ। কোনও অভিজাত ক্লাবের জলসায় এই ধরনের মানুষদের খুব দেখা যায়। এরা গান-টান খুব একটা বোঝে বলে মনে হয় না। তবে বোঝার ভান করে।
প্লেটে স্যান্ডউইচ তুলতে তুলতে আদিত্য রত্নাকে বলল, ‘তুই এখানে কাউকে চিনিস নাকি?’
‘নাঃ। শুধু ওই কোণে যে লাল শাড়ি পরা সাদা চুলের মহিলাকে দেখছিস, উনি কিছুদিন আগে মাঝে মাঝেই আমার কলেজে চলে আসতেন। আবদার, ওঁর নাতনিকে ভর্তি করতে হবে, যদিও নাতনির রেজাল্ট পাতে দেবার মতো নয়। এখন মনে হয় ভদ্রমহিলা আমাকে দেখেও চিনবেন না। কারণ ওঁর নাতনিকে আমরা নিতে পারিনি।’
অমিতাভ দু-একজনের সঙ্গে কথা বলছে। নিশ্চয় চেনা। আদিত্য লক্ষ করল, কমলিকা সেন ঘরে ঢুকেছেন। সঙ্গে একজন আধময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ। এই জমায়েতে নিতান্তই বেমানান। বৃদ্ধর চেহারাটা আদিত্যর ভীষণ পরিচিত লাগছে। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছে না কোথায় দেখেছে। কমলিকা সেন আদিত্যর কাছে এগিয়ে এলেন। আদিত্যকে দেখিয়ে বৃদ্ধকে বললেন, ‘চিনতে পারছ?’
বৃদ্ধ চিনতে পারুন না পারুন আদিত্য বৃদ্ধকে চিনতে পেরেছে। তারাপদ গাঙ্গুলি। গান পাগল মানুষ। বাবার বন্ধু, তবে বাবার থেকে অনেকটা ছোট। আদিত্য দুপা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘তারাপদকাকা আমি আদিত্য, অসিত মজুমদারের ছেলে।’
কমলিকা সেন অমিতাভ-রত্নার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইনি আমার ছোটকাকা, তারাপদ গঙ্গোপাধ্যায়, আদিত্যবাবুর বাবার বন্ধু।’
গান হল নেহাতই সাদামাটা। একটি বছর পঁচিশের মেয়ে শুদ্ধ কল্যাণ গাইল, তারপর একটা ঠুংরি। এমনিতে শুদ্ধ কল্যাণ আদিত্যর ভীষণ প্রিয় রাগ, কিন্তু এই মেয়েটা এখনও সুরের গভীরে ঢুকতেই শেখেনি। গানের পর সেতার, বাগেশ্রী। এবার বছর তিরিশের এক যুবক। সুরের বিস্তার বিশেষ করল না, সাত-তাড়াতাড়ি গতে পৌঁছে কালোয়াতি দেখাতে লাগল। কত তাড়াতাড়ি সে তান করতে পারে দেখাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার বেসুরো হয়ে পড়ল। তার সঙ্গে তবলাটাও কান ফাটিয়ে বাজছিল। আদিত্যর শুনতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছিল।
আসর ভাঙল সাড়ে আটটায়। কমলিকা সেন আদিত্যদের কাছে এসে বললেন, ‘আপনারা একটু দাঁড়াবেন? কথা ছিল।’
একটু পরে অতিথিদের বিদায় করে দিয়ে কমলিকা তার কাকাকে সঙ্গে করে ফিরে এলেন। বললেন, ছোটকাকা আমার বাড়িতে আজ রাত্রে খেতে রাজি হয়েছেন। আপনারাও যদি আজ রাত্তিরে এখানে সামান্য ডিনার করে যান আমার খুব ভাল লাগবে। ছোটকাকাকে আমি আদিত্যবাবুর কথা বলেছিলাম। ছোটকাকার খুব ইচ্ছে আদিত্যবাবুর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর।’
‘আসলে, আমাদের আর একটা জায়গায় ডিনারের নেমন্তন্ন আছে।’ রত্না বিনীতভাবে বলল।
আদিত্য বুঝল রত্না গুল মারছে। কমলিকা সেনও সেটা বুঝলেন কিনা কে জানে, হয়ত বুঝলেন। মুখে বললেন, ‘তাহলে তো আপনাদের আমি আটকাতে পারি না, কিন্তু আদিত্যবাবুরও কি নেমন্তন্ন আছে?’
রত্না তাড়াতাড়ি বলল, না, না আদিত্যর নেমন্তন্ন নেই, ও থেকে যেতেই পারে। তবে থেকে গেলে ওকে একা একা বাড়ি ফিরতে হবে।’
‘সেটা কোনও সমস্যা হবে না। আমার গাড়ি তো ছোটকাকাকে বাগবাজারে নামাতেই যাবে। পথে কোথাও আদিত্যবাবুকে নামিয়ে দেবেখ’ন। আদিত্যবাবু আপনার বাড়ি কোথায়?’
‘আমহার্স্ট স্ট্রিট।’ আদিত্য কুণ্ঠিতভাবে বলল।
‘তাহলে তো আপনার বাড়ি বাগবাজার যাবার পথেই পড়বে।’
নৈশভোজনের মান গানের আসরের মতো খেলো নয়। বস্তুত, প্রতিটি আইটেমে বনেদি বাড়ির খানসামা-বাবুর্চির ছোঁয়াটা আদিত্য পরিষ্কার টের পাচ্ছিল। ভোজনের শেষে একটি পান মুখে দিয়ে তারাপদ গাঙ্গুলি বললেন, ‘খাওয়াটা তো জব্বর হল, কিন্তু গান শুনে মন ভরল না। এরা তো এখনও গান বাজনা শিখেই উঠতে পারেনি। কোন সাহসে আসরে বসে এতগুলো লোকের সময় নষ্ট করে?’
‘আসলে ম্যাকনীল-ম্যাকফারসনের মন্টু রায় এদের কথা বললেন। উনি অবশ্য আজ আসতে পারেননি। মেয়েটি ওঁর ভাইজি হয়। ছেলেটি আবার মেয়েটির বন্ধু।’ কমলিকা সেন খানিকটা কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গীতে বললেন।
‘মন্টু রায় কে আমি জানি না। জানতে চাইও না। আর তার ভাইজি বা তার বন্ধুর সম্বন্ধে তো যত কম জানা যায় ততই ভাল। আমি তো মাঝে মাঝে বুঝতেই পারছিলাম না মেয়েটা শুদ্ধ কল্যাণ গাইছে না ভূপালি গাইছে। যাই হোক, একটা কথা বলতে পারি। আমাদের অসিতদা হলে মাঝপথে উঠে যেতেন। সঙ্গীত নিয়ে কোনও ছ্যাবলামি তিনি সহ্য করতে পারতেন না।’
এরপর আড্ডাটা বেশ কিছুক্ষণের জন্য অসিত মজুমদারের দিকে ঘুরে গেল। কোন কোন ওস্তাদ কবে কবে অসিত মজুমদারের আলিপুরের বাড়িতে গান গেয়েছিলেন তার পুরো ইতিহাস তারাপদ গাঙ্গুলির কণ্ঠস্থ। সেসব ওস্তাদদের বিচিত্র স্বভাব, খেয়াল, চরিত্র নিয়েও অনেকক্ষণ কথাবার্তা চলল। আদিত্যরও অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ বাদে সে খেয়াল করল, একটু একটু করে সে-ও আলোচনায় ঢুকে পড়েছে।
তারাপদ গাঙ্গুলি বাথরুমে যাবার জন্য উঠলেন। আদিত্য কমলিকা সেনকে বলল, ‘আমি কিন্তু এই বাড়িতে আগে কয়েকবার এসেছি। চন্দ্রা কলেজে আমার সহপাঠী ছিল। আমরা কাছাকাছি থাকতাম বলে একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম।’
‘চন্দ্রা আপনার বন্ধু ছিল?’ কমলিকা সেনের মুখে বিরাট বিস্ময়। ‘আপনি আগে বলেননি তো?’
‘বলার সুযোগ পাইনি। আপনি কি জানেন চন্দ্রাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?’
‘আগে জানতাম না। সদ্য জেনেছি। আমার লইয়ার আমাকে জানিয়েছেন। চন্দ্রা এ-বাড়ির সঙ্গে তো কোনও সম্পর্কই রাখত না। জানব কী করে?’ কমলিকা সেনের গলাটা বেশ কঠিন শোনাল। ‘আপনি জানেন নাকি সে কোথায় আছে?’
‘জানি না, তবে জানবার চেষ্টা করছি। চন্দ্রা যাকে বিয়ে করবে ঠিক করেছে সে-ও আমাদের ক্লাশমেট। সে-ই আমাকে চন্দ্রার খোঁজ নিতে বলেছে।’
‘চন্দ্রা বিয়ে করবে? কাকে বিয়ে করবে?’ কমলিকা সেন যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তারপর একটু সামলে নিয়ে বললেন, ‘সে-ই ছেলেটি নয়ত যে চন্দ্রাকে এখানে রেখে অ্যামেরিকা চলে গিয়েছিল?’
‘সেই ছেলেটিই। সে পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসছে। চন্দ্রা ঠিক করেছে তাকেই বিয়ে করবে।’
‘চন্দ্রা কোথায় থাকতে পারে? আপনি খোঁজ-খবর নিয়ে কতটা জানতে পারলেন?’
‘এখনও খুব বেশি জানতে পারিনি। কিছু জানতে পারলে নিশ্চয় আপনাকে জানাব।’
তারাপদ গাঙ্গুলি বাথরুম থেকে ফিরে এসেছেন। এসে বোধহয় টের পেয়েছেন কোনও কারণে ঘরের আবহাওয়াটা ভারি হয়ে উঠেছে।
‘কী হল? কী ব্যাপার?’ তারাপদ গাঙ্গুলির গলাটা খানিকটা উদ্বিগ্ন শোনাল।
তাঁকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কমলিকা সেন আদিত্যকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চন্দ্রা কবে বিয়ে করবে ঠিক করেছে আপনি জানেন?’
‘আপনাকে কিছু বলেনি?’ আদিত্য উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে বলল।
‘না, আমাকে কিছু বলেনি। চন্দ্রার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল তিন-চার মাস আগে। তখন অন্তত কিছু বলেনি।’
‘কী নিয়ে তাহলে তখন আপনাদের কথা হয়েছিল?’
‘দেখুন এটা সকলেই জানে যে চন্দ্রার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনদিনই ভাল ছিল না। শেষ দেখা হয়েছিল এই বাড়িতেই। আমি একটা আলোচনার জন্য চন্দ্রাকে আসতে বলেছিলাম।’
‘কী নিয়ে আলোচনা বলা যাবে কী? যদি না অবশ্য খুব গোপনীয় কিছু হয়।’
‘আলোচনা এই বাড়িটা বিক্রি করা নিয়ে। চন্দ্রার সঙ্গে আমার সেদিন তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। আমাদের কাজের লোক, রান্নার লোক সকলেই সেটা শুনেছিল। তাছাড়া নভীন সরাফ বলে একজন রিয়াল এস্টেট প্রোমোটারও সেদিন এখানে উপস্থিত ছিলেন। কাজেই ব্যাপারটা মোটেই আর গোপনীয় নেই।’
‘কী নিয়ে আপনাদের ঝগড়া হয়েছিল?’
‘চন্দ্রা এই প্রপার্টিটা প্রোমোটিং-এ দিতে চায় না, আমি চাই। এই নিয়েই আমাদের মতবিরোধ। আমাদের দুজনের অংশ অবশ্য ভাগ করা আছে। আমার ভাগে পুব দিকটা পড়েছে, পশ্চিম দিকটা চন্দ্রার ভাগে। আমি চাইলে আমার অংশটা বিক্রি করে দিতে পারি। কিন্তু পুরো প্রপার্টিটা একসঙ্গে বিক্রি করতে পারলে অনেক বেশি দাম পাওয়া যাবে। প্রোমোটার তাই বলছে। কিন্তু চন্দ্রা কিছুতেই তার অংশটা বিক্রি করতে রাজি নয়।’
‘বেশ রাত হয়ে গেছে। আমাকে ফিরতে হবে।’ তারাপদ গাঙ্গুলি একটু বিরক্ত গলায় বললেন। ‘তুই আমাকে একটা গাড়ি করে পৌঁছে দিবি বলেছিলি না?’ শেষ প্রশ্নটা কমলিকাকে।
‘হ্যাঁ, বেশ রাত হয়েছে। আমি ড্রাইভারকে ডাকছি। আদিত্যবাবু তোমার সঙ্গে ফিরবেন।’
‘আদিত্য আমার সঙ্গে ফিরবে? সে তো অতি উত্তম কথা।’ তারাপদ গাঙ্গুলির মুখটা উজ্জ্বল দেখাল।
বেরনোর সময় কমলিকা সেন বললেন, ‘যদি চন্দ্রা কোথায় আছে জানতে পারেন, আমাকে প্লিজ একটু জানাবেন।’
‘অবশ্যই জানাব।’
ফেরার পথে তারাপদ গাঙ্গুলির সঙ্গে আরও অনেক কথা হল আদিত্যর। তার মধ্যে একটা কথায় আদিত্যর খটকা লাগছে।
তারাপদ গাঙ্গুলি বললেন, ‘আমার ভাইজি আমাকে আগে কখনও তার বাড়িতে ডাকেনি। এত খারাপ গান শোনানোর জন্যে আজ হঠাৎ কেন ডাকল, বুঝতে পারছি না।’
(২)
দুপুরে আদিত্য তার আপিসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল, এমন সময় দরজায় টোকা। খুলে দেখে নূপুর মণ্ডল। সঙ্গে একটা চাকা লাগানো সুটকেস।
‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে ফোন করিনি। কাল রাত্তিরে কলকাতায় এসেছি। বাড়িভাড়া দেবার ছিল। টুকিটাকি আরও দুএকটা কাজ। আজ সন্ধের ট্রেনে আবার বসিরহাট ফিরে যাব। তোমাকে কিছু কিছু জিনিস রিপোর্ট করার আছে।’ নূপুর চেয়ারে বসে সুটকেসটা পায়ের কাছে রাখল।
‘সব শুনব। আগে স্থির হয়ে বোসো। কফি খাবে তো?’ আদিত্য কফি বানানোর জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘কিছু খাওয়াবে আদিত্যদা? সকাল থেকেই কিছু খাওয়া হয়নি।’
‘আরে, আগে বলবে তো? দাঁড়াও দেখি কী আনানো যায়। আগে খেয়ে নাও তারপর কফি বানাব।’
আধঘন্টা পরে, খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে, কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে নূপুর বলতে শুরু করল।
‘স্কুলের নাম বনবীথি, জায়গাটা ইছামতি নদীর খুব কাছে। এখানেই চন্দ্রলেখা সেন পড়াত, থাকতও। স্কুলটাতে আশেপাশের গ্রাম থেকে গরিব মেয়েরা পড়তে আসে। ক্লাশ ফোর অব্দি পড়ানো হয়। চন্দ্রলেখা সেনকে এখানকার ছাত্রীরা মেমদিদি বলে, তার ফরসা রঙের জন্যে নিশ্চয়।’
‘তুমি ইস্কুলে কোন পরিচয়ে ঢুকলে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমি বড়দিদি, মানে হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করে বললাম, শুনেছি এখানকার একজন দিদিমনি বেশ কিছুদিন ধরে আসছেন না। আমি কি তার জায়গায় চাকরি পেতে পারি? বড়দিদি একটু ইতস্তত করে কাকে যেন ফোন করলেন। পরে শুনলাম, উনি রণবীর রায়কে ফোন করেছিলেন। যে এন জি ও ইস্কুলটা চালায় রণবীর রায় তার মালিক। তারপর ফোন রেখে আমাকে বললেন উনি আমাকে টেম্পোরারি কাজ দিতে রাজি আছেন তবে চন্দ্রা সেন ফিরে এলে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে। ওখানে আমার এক সপ্তাহ চাকরি করা হয়ে গেল।’
‘থাকছ কোথায়?’
‘থাকার জায়গা নিয়ে প্রথম দিকে খুব অসুবিধে হয়েছিল। প্রথম দুটো দিন বসিরহাটের একটা হোটেল থেকে যাতায়াত করলাম। তারপর গৌরবাবু স্কুলের সামনেই একটা থাকার জায়গা জোগাড় করে দিলেন। একটাই ঘর, কিন্তু সঙ্গে একটা নিজস্ব বাথরুম আছে আর এক চিলতে বারান্দা। রান্নাবান্না ওই বারান্দায়। একটা স্টোভ কিনেছি।’
‘গৌরবাবু কে?’
‘ও হো। সেটাই তো বলতে ভুলে গেছি। গৌরবাবু, মানে গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায়, স্কুলের ক্লার্ক। নিপাট ভালোমানুষ। খুব হেল্পফুল। ওঁর কথায় পরে ভাল করে আসছি।’
‘চন্দ্রার ওখানে কোনও শত্রু-টত্রু ছিল?’
‘একেবারেই নয়। ছাত্রীরা তো বটেই, দিদিমনিরাও সকলে চন্দ্রা সেনকে ভালবাসে। ও হঠাৎ এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ায় সবাই অবাক এবং চিন্তিত। তবে উধাও হয়ে যাবার আগে দু-দুবার চন্দ্রার ভয়ঙ্কর অ্যাক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিল। কপাল জোরে বেঁচে গেছে।’
‘ভয়ঙ্কর অ্যাক্সিডেন্ট? খুলে বলবে?’
‘অ্যাক্সিডেন্ট না বলে ঘটনাই বলা উচিত বোধহয়। প্রথম ঘটনাটা ঘটে পুজোর মাস খানেক আগে। এক্স্যাক্ট তারিখটা কারও মনে নেই। তবে ঘটনাটা সকলের মনে আছে। চন্দ্রা সেন যে বাড়িটায় থাকত সেটা বেশ বড় আর পুরোনো একটা বাড়ি। এক সময় ওই অঞ্চলের এক অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাড়ি ছিল ওটা। বাড়িটা করেছিলেন বর্তমান মালিকের ঠাকুর্দা। মালিক তার পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকেন। মালিকের বাবা-মা বাড়িটায় থাকতেন, তাঁরা দুজনেই মারা গেছেন। বাড়িটা তেমন যত্ন পায় না। ভাড়াটের অভাবে বেশ কিছুদিন ফাঁকাই পড়েছিল, ওই পাড়াগাঁয় কে আর অত বড় বাড়ি ভাড়া করবে? সে যাই হোক, চন্দ্রা সেন পুরো বাড়িটাই ভাড়া করেছিল। তবে কয়েকটা ঘর বন্ধই পড়ে থাকত। দোতলার একটা বড় ঘর শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো আর একতলায় একটা ঘর বসার ঘর হিসেবে। তাছাড়া বাড়ির পেছন দিকে ছিল রান্নাঘর, কাজের মাসির থাকার ঘর। আমি, ভাড়া করতে পারি এই অজুহাতে, বাড়িটা ঘুরে দেখে নিয়েছি। পাশের বাড়িতে এই বাড়িটার একটা চাবি ছিল, বাড়ির মালিকই রেখে গেছে, আমি গিয়ে চাইতে বাড়িটা ঘুরে দেখিয়ে দিল।’
নূপুর মণ্ডল একটু থেমে কফির কাপে একটা চুমুক দিল। আদিত্য উঠে গিয়ে জানলাটা খুলে দিয়েছে। মতলব, একটা সিগারেট খাবে। কালীপুজো এসে গেল বলে, বউবাজারের ঘড়ির দোকানগুলোতে দেওয়ালির সেল-এর বড় বড় বিজ্ঞাপন ঝুলছে। আদিত্য সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণ জানলার বাইরে ধোঁয়া ছাড়ল। তারপর টেবিলে ফিরে এসে জ্বলন্ত আধখানা সিগারেট অ্যাসট্রেতে গুঁজে বলল, ‘তারপর?’
‘ঘটনাটা ঘটে রাত্তিরবেলায়। রাত্তির তখন আড়াইটে-তিনটে হবে। চন্দ্রা সেন বাথরুমে যাবার জন্য উঠেছিলেন। দোতলায় তার শোবার ঘরের পাশেই বাথরুম। বাথরুমের আলো জ্বেলে কয়েক পা এগোতেই হঠাৎ চোখে পড়ল ফুট তিনেক লম্বা একটা সাপ দেয়াল থেকে মেঝেতে নেমে আসছে। একেবারে জাত সাপ, মিশকালো কেউটে। কামড়ালে অবধারিত মৃত্যু। সেই রাত্তিরে নেহাত কপাল জোরে বেঁচে গিয়েছিলেন চন্দ্রা সেন। ঘুম চোখে আর একটু হলেই সাপটাকে মাড়িয়ে দিচ্ছিলেন।’
‘তারপর কী হল?’
‘চন্দ্রা সেনের নার্ভের জোর আছে। অন্য কেউ হলে হয়ত ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেত। চন্দ্রা সেন ঠাণ্ডা মাথায় এক পা এক পা করে পিছু হটে বাথরুমের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন। তারপর উল্টোদিকের বাড়ির একতলায়, যেখানে গৌরবাবু থাকেন, সেখানে গিয়ে কড়া নাড়লেন। গৌরবাবু উঠে স্কুলের দরোয়ান সফিকুলকে জাগাল। সে স্কুলের মেন গেটের ধারে একটা ঘরে রাত্তিরে ঘুমোয়। সফিকুল আরও কয়েকজনকে নিয়ে লাঠিসোটা হাতে চন্দ্রা সেনের বাথরুমে ঢুকে দ্যাখে সাপটা তখনও সেখানেই রয়েছে। সবাই মিলে সাপটাকে পিটিয়ে মারল।’
‘ওসব অঞ্চলে কি সাপের খুব উপদ্রব?’
‘এটাই আশ্চর্য ব্যাপার যে ওই অঞ্চলে ওই রকম কালো কেউটে সাপ আগে কেউ দ্যাখেনি। সবাই বলল, নদীর ধারে কিছু সাপ আছে। কিন্তু তারা জলের সাপ, তেমন বিষাক্ত নয়। কেউ কেউ বলল, এটা বাস্তুসাপ, এই বাড়িতেই থাকত। বাস্তুসাপ কখনও কারও ক্ষতি করে না। একে মারাটা অন্যায় হয়েছে। বন বিভাগের লোকেরাও নাকি এসেছিল। তারা বলছে, ঠিক সময় খবর পেলে তারা এসে সাপটাকে জ্যান্ত ধরে নিয়ে যেত। আবার কেউ বলছে, এই সাপটার নাকি একটা জোড়া থাকবে। সে এবার এসে বদলা নিতে পারে। অনেকে চন্দ্রা সেনকে ওই বাড়িটা ছেড়ে দিতে বলেছিল। কিন্তু চন্দ্রা সেনের ভীষণ জেদ। সে ওই বাড়িতেই থেকে গেল।’
আদিত্য উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘দ্বিতীয় ঘটনা আরম্ভ হবার আগে আর একবার কফি হোক।’
‘চা হলে আর একটু ভাল হতো।’ নূপুর একটু কুণ্ঠিতভাবে বলল।
‘বেশ তো, চা-ই হোক।’ আদিত্য ইলেকট্রিক কেটলিতে জল বসিয়ে আবার জানলার ধারে গিয়ে রাস্তা দেখছে এমন সময় তার মোবাইলটা বেজে উঠল। পার্থ সান্যালের ফোন, অ্যামেরিকা থেকে করছে।
‘বল, কেমন আছিস?’ ফোন ধরে আদিত্য বলল।
‘আমি তো একরকম আছি। ওদিকে তোর কাজ কিছু এগোল?’ ওপার থেকে পার্থর গলায় কিছু উৎকণ্ঠা রয়েছে।
‘এগোচ্ছে। আস্তে আস্তে জাল গুটিয়ে আনছি। আশা করছি আর কয়েকদিনের মধ্যে চন্দ্রাকে খুঁজে বার করে ফেলব।’
‘তার মানে তুই মনে করছিস চন্দ্রা এখনও জীবিত আছে?’ পার্থ খানিকটা আকুল হয়ে বলল।
‘আমার স্থির বিশ্বাস চন্দ্রা বেঁচে আছে। কোনও কারণে লুকিয়ে রয়েছে। সময় হলেই আত্মপ্রকাশ করবে।’
‘তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। শোন, যে-কারণে তোকে ফোন করছি। আমার জাপানে একটা কাজ আছে। কলকাতা হয়ে যাব। পরশু দুপুরে কলকাতা পৌঁছচ্ছি। রাত্তিরটা থাকছি। ওই আগের হোটেলটা, যেখানে তুই একবার আমার সঙ্গে দেখা করেছিলি, এবার সেখানে থাকছি না। এবারের এই হোটেলটার ডিরেকশন পাঠিয়ে দিচ্ছি। এটাও বলছে এয়ারপোর্টের কাছে। তুই পরশু রবিবার সন্ধে ছটা নাগাদ একবার আসতে পারবি? এলে ভাল করে কথাবার্তা হবে।’
‘অবশ্যই পারব।’
‘তাহলে পরশু দেখা হচ্ছে। আজ রাখছি। কিছু গোছগাছ বাকি আছে।’
আদিত্য মোবাইলটা টেবিলে রাখতে রাখতে দেখল নূপুর ইতিমধ্যে দুকাপ চা করে ফেলেছে। আদিত্যর ফোনে কথা বলা শেষ হতেই নূপুর আবার বলতে শুরু করল।
‘দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটেছিল প্রথম ঘটনা ঘটার সপ্তাহ দুয়েক পরে। এক্ষেত্রেও সঠিক তারিখটা কেউ বলতে পারল না। তবে ঘটনাটা যে পুজোর ঠিক আগে ঘটেছিল এটা অনেকেই বলেছে। তোমার নিশ্চয় মনে আছে এবার সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পুজোর ঠিক আগে একটা অসহ্য গুমোট গরম পড়েছিল। যার ফলে পুজোর সময় অত বৃষ্টি হল। এই গুমোট গরমটাই দ্বিতীয়বার চন্দ্রা সেনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কেমন করে সেটা বলি।’
নূপুর তার চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল। আদিত্য আবার সিগারেট ধরিয়েছে। এবার নিজের চেয়ারে বসে।
‘চন্দ্রা সেনের শোবার ঘরের পাখাটা কিছুদিন ধরেই একটু গণ্ডগোল করছিল। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আস্তে হয়ে যায়। একটা ঝুলঝাড়ু দিয়ে ধাক্কা দিলে আবার ঠিকমতো চলতে শুরু করে। চন্দ্রা রোজই ভাবে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডেকে সারিয়ে নেবে, কিন্তু গ্রামে একজনই ইলেকট্রিকের কাজ জানে। সে কিছুদিনের জন্যে গ্রামের বাইরে কোথাও গেছে। তুমি ভাবছ আমি এত কথা জানলাম কী করে? চন্দ্রা এইসব কথা গৌরবাবুকে গল্প করেছিল। আমি গৌরবাবুর কাছ থেকে জেনেছি।’
‘তারপর?’ গল্পটা আদিত্যর রীতিমত ইন্টারেস্টিং লাগছিল।
‘তারপর একদিন মাঝরাত্তিরে পাখাটা ভেঙে পড়ল। ভেঙে পড়ার ঠিক আগে পাখাটা দুএক মিনিটের জন্য থেমে গিয়েছিল। প্রচণ্ড গুমোট ছিল বলে পাখা বন্ধ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রা সেনের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে দ্যাখে পাখাটা থেমে গেছে। আর তার পর মুহূর্তেই চন্দ্রা সেন দেখল পাখাটা খুলে নিচের দিকে নেমে আসছে। চন্দ্রা সেনের রিফ্লেক্স মনে হয় চমৎকার। সে এক নিমেষে বিছানা থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ করে খাটের ওপর ভেঙে পড়ল পাখাটা। পুরোনো দিনের ভারি সিলিং ফ্যান। চন্দ্রা সেন ঠিক সময়ে সরে না আসতে পারলে পাখাটা তার মাথার ওপর এসে পড়ত, এবং কোনও সন্দেহই নেই যে সে মারা যেত। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে চন্দ্রা সেন নিখোঁজ হয়ে যায়।’
আদিত্য গভীরভাবে ভাবছিল। সন্দেহ নেই, কেউ বা কেউ কেউ চন্দ্রাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। দুবার চন্দ্রা নেহাত ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে। তৃতীয়বার কি তাহলে এরা সফল হল? যদি তাই হয়, চন্দ্রার বডিটা গেল কোথায়? ইছামতি নদীর কথা প্রথমেই মনে হয়। কিন্তু বডি ইছামতিতে ভাসিয়ে দিলে এতদিনে ভেসে উঠত। অবশ্য যদি পাথর-টাথর বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে অন্য কথা। নাকি চন্দ্রা তার আততায়ীদের ভয়ে নিজেই কোথাও লুকিয়ে আছে? আদিত্যর মন বলছে চন্দ্রা বেঁচে আছে।
আদিত্য একটু অন্যমনস্কভাবে নূপুরকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওখানকার লোকগুলোকে কেমন দেখলে?’
‘খুব বেশি দিন তো দেখার সুযোগ পাইনি। ওপর ওপর দেখে মনে হল স্বাভাবিক মানুষ যেমন হয়, এরাও তেমন। হেড মিস্ট্রেস বয়স্ক গম্ভীর মানুষ, বহুদিন এই ইস্কুলে আছেন। ইস্কুলকে ভালবাসেন। একজন সেলাই দিদিমনি আছেন, দুস্থ মহিলা, কারও সাতে পাঁচে থাকেন না, ভিতু প্রকৃতির, সকলের মতে মত দিয়ে চলেন। আর একজন দিদিমনি আছেন যাকে সবাই ছোড়দিদি বলেন। বেশ মুখরা। একমাত্র হেড মিস্ট্রেসকে একটু মান্য করেন। এছাড়া আছে সিকিউরিটি গার্ড সফিকুলদা, দেখে মনে হয় তার বয়েস চৌষট্টি-পঁয়ষট্টির কম হবে না। কিন্তু এখনও শরীরে বেশ শক্তি ধরে। আর গৌরবাবু, স্কুলের ক্লার্ক, যার কথা আগেই বলেছি, কিন্তু আর একটু ভাল করে বলা দরকার।’
নূপুর একটু থামল। পায়ের কাছে রাখা সুটকেসের ফ্ল্যাপ থেকে বোতল বার করে কয়েক ঢোঁক জল খেল। তারপর আবার বলতে লাগল।
‘গৌরবাবু ভীষণ সুদিং একটি চরিত্র। মৃদুভাষী। গলা তুলে কথা বলতেই পারে না। তাছাড়া খুব হেল্পফুল। এক কথায় চমৎকার একজন মানুষ। ইস্কুলের সামনেই থাকেন। বাচ্চাদের সঙ্গে তার বেজায় ভাব। ইস্কুল ছুটির পর অনেক বাচ্চাই ওর কাছে গল্প শুনতে যায়। উনি তাদের মুড়ি-বাতাসা খাওয়ান। ওঁর আর্থিক অবস্থা যে খুব ভাল তা নয়। তবু তার মধ্যেই ভাল রেজাল্ট করলে নিজের পয়সায় বাচ্চাদের প্রাইজ দেন। ক্লাশ থ্রিতে একটা, ক্লাশ ফোরে একটা। ওঁর চরিত্রের একটা অদ্ভূত দিকও আছে। উনি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন। শুধু তাই নয়, উনি প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন বনবীথি ইস্কুলে ভূত আছে। উনি নাকি তাদের নিজের চোখে দেখেছেন। মিশকালো, তালগাছের মতো লম্বা। রাত্তিরে বাথরুমের জন্যে উঠতে হলে উনি নাকি তাদের দেখা পান। উনি বিশ্বাস করেন চন্দ্রা সেনের অ্যাক্সিডেন্টগুলো তেনাদেরই ঘটানো। অবশ্য শুধু উনি নন ইস্কুলের বেশির ভাগ মেয়েই বিশ্বাস করে এখানে ভূত আছে। যা শুনলাম, চন্দ্রা সেনের সঙ্গে গৌরবাবুর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। এক তো দুজনে কাছাকাছি বাড়িতে থাকতেন। তাছাড়া চন্দ্রা সেন, মনে হয়, গৌরবাবুর সারল্যটা পছন্দ করতেন। চন্দ্রা সেনের অ্যাক্সিডেন্টের গল্পগুলো গৌরবাবুর কাছেই জানলাম। সব মিলিয়ে আমি বলব, গৌরবাবু সরল, সাদাসিধে একজন গ্রাম্য মানুষ।’
নূপুর থামল। টেবিলের ওপরে রাখা জলের বোতলটা থেকে আবার জল খেল। বলল, ‘আমি এবার উঠব আদিত্যদা। ট্রেন ধরার আগে দুএকটা কেনাকাটা আছে।’
আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘শোনো নূপুর। তুমি আজ বনবীথি ফিরে যাচ্ছ, যাও। আমি খুব শিগগির ওখানে যাচ্ছি। যাবার আগে তোমাকে ফোন করে জানিয়ে দেব। আর কোনও ইন্সট্রাকশন থাকলে সেটাও জানিয়ে দেব। এসো তাহলে।’
নূপুর বেরিয়ে যাবার কয়েক মিনিটের মধ্যে আদিত্যর ফোনটা আবার বেজে উঠেছে। কেয়া বাগচি।
‘খুব দরকার। একদিন দেখা করা যাবে?’
‘কবে দেখা করতে চান?’
‘সামনের সোমবার কলেজ স্ট্রিট যেতে হবে স্কুলের বই কেনার জন্যে। সেদিন দেখা করা যাবে?’
‘কটায় বলুন?’
‘আমার সাড়ে চারটের মধ্যে বই কেনা হয়ে যাবে। তাহলে সাড়ে চারটেতে আপনার জন্যে কফি হাউসে অপেক্ষা করব।’
‘চলবে। তবে কফি হাউসের দোতলায় আসবেন। একতলায় খুব ভিড় থাকে। ঠিক মতো কথা বলা যাবে না।’
‘ঠিক আছে। তাহলে সে কথাই রইল।’
(৩)
রবিবার দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আদিত্য একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, দরজায় খটখট শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। দরজা খুলে দ্যাখে বিমল দাঁড়িয়ে আছে। চেয়ারে রাখা প্যান্ট-শার্টগুলো সরিয়ে নিয়ে বিমলকে সেখানে বসতে বলল আদিত্য। ঘড়িতে দেখল পৌনে চারটে। তাহলে এখন চা খাওয়া যেতেই পারে। সে বারান্দায় বেরিয়ে চেঁচিয়ে বলরামকে ডাকল। বলরামের সাড়াশব্দ নেই। আরও দুএকবার ডাকাডাকির পর হাল ছেড়ে দিয়ে আদিত্য ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে এমন সময় দ্যাখে সিঁড়ি দিয়ে বলরাম উঠে আসছে।
‘চা আনতে হবে তো? পয়সা দাও।’
‘তুই কেটলি করে তিন কাপ চা আনবি আর দুটো ভাঁড় দিতে বলবি। আর আর’ আদিত্য একটু ভেবে বলল, ‘চারটে প্রজাপতি বিস্কুট।’
আদিত্য জানে বিমল প্রজাপতি বিস্কুট খেতে খুব ভালবাসে। সে ঘরে ঢুকে পেরেকে ঝোলানো হ্যাঙারের শার্টের পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বলরামকে দিয়ে বলল, ‘খুচরো নেই রে। ভাঙিয়ে আনতে হবে।’
মিনিট পনের পরে চায়ের ভাঁড়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, এবার বল বিমলবাবু কী জানতে পারলে?’
‘কিছু খবর পেয়েছি স্যার। তবে সেটা কাজের না বাজে আপনি বিচার করবেন।’
‘বল কী খবর পেয়েছ।’
‘আপনাকে বলেছিলাম না মেমসাহেবের পুরোনো ড্রাইভার ছুটি নিয়ে দেশে গেছে, একজন বদলি লোক গাড়ি চালাচ্ছে, তা আমি সেই বদলির বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে ভাব জমালাম। বদলির নাম বিল্টু, চেতলায় একটা বস্তিতে থাকে। তাকে বললাম, আমি গাড়ি চালাই। শুনেছি, সেনেদের ড্রাইভার দেশে চলে গেছে, একটা চাকরি খালি হতে পারে। তারপর শুনলাম তুমি বদলির কাজ করছ। তা তুমি কতদিন এই কাজটা করবে? যদি বেশিদিন না কর তাহলে আমি করতে পারি। সে বলল, যতদিন পারি করে যাব, আমার হাতে আর কোনও কাজ নেই। আরও বলল, পুরোনো ড্রাইভার কবে ফিরবে সে জানে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কাজে কি খুব চাপ? সে বলল, না, না। কাজ খুব হালকা। মেমসাহেব মাঝে মধ্যে ক্লাবে যান, কখনও উকিল বাড়ি যান, কখনও বিউটি পারলারে যান, ব্যাস। তবে গাড়ি চলুক না চলুক আমাকে বারো ঘন্টা থাকতে হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর কোথথাও যান না? বিল্টু অনেক ভেবেচিন্তে বলল, হ্যাঁ, কখনও কখনও এক প্রোমোটারের আপিসেও যান। বাড়িটা বিক্রির ব্যাপারে বোধহয় ওই প্রোমোটারের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। টেলিফোনে ম্যাডামের কথা শুনে তাই মনে হয়। বিল্টুর সঙ্গে আরও বন্ধুত্ব পাতানোর জন্যে ওকে বিরিয়ানি খাওয়ালাম।’
‘বিরিয়ানি খাওয়ালে? কোথায় বিরিয়ানি খাওয়ালে?’
‘ফুটপাথের দোকানে স্যার। এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি পঁয়ত্রিশ টাকা।’
‘পঁয়ত্রিশ টাকায় চিকেন বিরিয়ানি!’ আদিত্য বিষ্মিত।
‘বোধহয় কাকের মাংসের বিরিয়ানি স্যার। নইলে এত সস্তায় দিতে পারে? বিল্টু অবশ্য সেটাই আহ্লাদ করে খেয়ে নিল। খাবার পর এমন এক-একটা ঢেঁকুর তুলছিল মনে হচ্ছিল যেন দাঁড়কাক ডাকছে।’
‘খাবার পর কী বলল?’
‘বিরিয়ানি খাওয়াবার পর পান-সিগারেট খাওয়ালাম। বললাম, তোমার জানা আর কোথাও কাজ-টাজ খালি আছে? বিল্টু প্রথমে কিছুতেই কিছু বলবে না। শেষে বলল, সে যতদূর জানে পুরোনো ড্রাইভার মদনবাবু আর ফিরবে না। মদনবাবু বিল্টুর কাকার বন্ধু, সে সেই সূত্রেই চাকরিটা পেয়েছে। মদনবাবু বিল্টুর কাকাকে বলেছে, মেমসাহেব মদনবাবুকে একটা মোটা টাকা দিয়ে রিটায়ার করিয়ে দিয়েছেন। মদনবাবু পাকাপাকিভাবে দেশে চলে গেছে। তবে বিল্টু হয়ত সামনের মাস থেকে উবার চালাবে। ওতে টাকা অনেক বেশি। তখন আমি ওই কাজটা করতে পারি। বিল্টু আমাকে তার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে খোঁজ রাখতে বলেছে। আর একটা কথা। বিল্টু শুনেছে, মদনবাবু নাকি কী একটা কাগজে সই করেছিল। তাই ভয় পেয়ে দেশে চলে গেছে। তবে বিল্টু ব্যাপারটা ভাল জানে না।’
‘মদনবাবুর দেশ কোথায় জিজ্ঞেস করেছিলে?’
‘এটা তো স্যার জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে কায়দা করে জেনে নিতে পারি।’
‘ওটা জানা খুব দরকার। যত তাড়াতাড়ি পার জেনে দিও।’
পার্থ সান্যালের এবারের হোটেলটা নামে এয়ারপোর্টের কাছে হলেও আসলে নিউ টাউনের এক প্রান্তে। ওসব জায়গায় এখনও তেমন বাস চলে না। অতএব গাড়ি বা ট্যাক্সি ছাড়া যাবার উপায় নেই। তবে হোটেলে যারা থাকে কিংবা কাজে কর্মে আসা-যাওয়া করে তাদের সকলেরই গাড়ি আছে। উপায় নেই বলে আদিত্য একটা উবার নিয়েছিল। শুনেছিল, উবার চালকরা জিপিএস ম্যাপ থেকে সব জায়গার হদিশ বার করে নিতে পারে। আদিত্য তাই খানিকটা নিশ্চিন্তই ছিল। কিন্তু নিউ টাউনে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ চক্রাকারে ঘুরপাক খাবার পর ট্যাক্সিওলা যখন আত্মসমর্থনের ভঙ্গীতে বলল যে সে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে তখন আদিত্য বুঝল তার চালক রাজারহাট অঞ্চলটা তার থেকেও কম চেনে। মনে হল, ছেলেটা বিহার বা ঝাড়খণ্ড থেকে সদ্য কলকাতায় এসে গাড়ি চালাচ্ছে। শেষে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে যখন আদিত্য তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছল তখন সোয়া ছটা বেজে গেছে।
রিসেপশন-এ পার্থর নাম বলতে সাদা-কালো স্কার্ট-ব্লাউজ এবং মুখমণ্ডলে উগ্র মেক-আপ পরিহিতা মেয়েটি আদিত্যর নাম জিজ্ঞেস করল। নাম জানার পর সে বলল মিস্টার সান্যাল আদিত্যর জন্য কফি শপে অপেক্ষা করছেন। কফি শপে লোকজন প্রায় নেই। পার্থ এক কোণে এক কাপ কফি নিয়ে বসে আছে। আদিত্যকে দেখে হাত নাড়ল।
মিনিট দশেক পরে এক কাপ দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘আমার কাজ এগোচ্ছে। কয়েকটা পরিষ্কার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। তবে এখনই কিছু বলব না। একেবারে নিশ্চিত হয়ে বলব।’
‘তুই শুধু একটা কথা বল। চন্দ্রা বেঁচে আছে তো?’ পার্থর গলাটা খুব উৎকণ্ঠিত শোনাল।
‘আমার বিশ্বাস চন্দ্রা বেঁচে আছে।’ আদিত্য সংক্ষিপ্তভাবে বলল।
‘তোর বিশ্বাসের কি কোনও কারণ আছে? নাকি এমনি এমনি বলছিস?’
‘কারণ আছে। অবশ্যই কারণ আছে। ধরা যাক, চন্দ্রাকে কেউ খুন করেছে। কিন্তু খুন করে সে লাশটা লুকিয়ে রাখবে কেন? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, লাশ ইছামতির জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাহলেও এতদিনে সেটা কোথাও না কোথাও ভেসে উঠত। একটা সম্ভাবনা, গলায় ভারি কিছু বেঁধে লাশ ইছামতিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেটা ডুবতে ডুবতে একেবারে নদীর তলায় গিয়ে পড়ে রয়েছে। কিন্তু তাহলে প্রশ্ন, এতটা কষ্ট খুনি করবে কেন? খুন করে লাশ ফেলে রাখলেই তো হতো। তাকে যত্ন করে লুকিয়ে রাখার কী দরকার ছিল?’
বলতে বলতে আদিত্যর মনে হল তার কথাগুলো নিশ্চয় পার্থর খুব নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। সে বলল, ‘আই অ্যাম রিয়ালি সরি। আমার এভাবে কথাগুলো বলা ঠিক হয়নি।’
‘না না ঠিক আছে। তুই তো একটা হাইপথেটিকাল সিচুয়েশন আলোচনা করছিস। তুই তো বলছিস না এটা রিয়ালিটি।’
‘এক্স্যাক্টলি। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি চন্দ্রা বেঁচে আছে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।’
পার্থ অনেকক্ষণ চুপ করে রয়েছে। আদিত্য তাকে খানিকটা ধাতস্থ হবার সময় দিল। তারপর বলল, ‘তবে চন্দ্রাকে যে কেউ মারতে চাইছিল সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই।’
‘সেটা তুই কী করে বুঝলি?’ পার্থ তীক্ষ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘তোকে কেউ বলেনি নিখোঁজ হয়ে যাবার আগে চন্দ্রা দু দুবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল? এটা নিছক সমাপতন হতে পারে না।’
‘আমাকে তো এসব কেউ বলেনি!’
‘তোকে কেউ বলেনি যে একটা রাত্তিরে কেউ একজন চন্দ্রার বাথরুমে একটা জাত কেউটে সাপ ঢুকিয়ে দিয়েছিল? বরাত জোরে চন্দ্রা বেঁচে গেছে। এর কয়েক সপ্তাহ পরে রাত্তিরে চন্দ্রার শোবার ঘরে সিলিং ফ্যানটা হঠাৎ ভেঙে পড়ে। ফ্যানটা ভেঙে পড়ছে টের পেয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে চন্দ্রা সরে যেতে পেরেছিল। তোকে কেউ বলেনি এসব কথা?’
পার্থকে বিহ্বল দেখাচ্ছিল। যেন সে কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়েছে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে বলল, ‘আমি তো এসব কিছুই জানি না।’
আদিত্য বলল, ‘এই ঘটনাগুলোকে কোয়েনসিডেন্স মনে করার কোনও কারণ নেই। আমার মনে হয়, চন্দ্রা বুঝতে পেরেছিল কেউ তাকে খুন করার চেষ্টা করছে। তাই সে গা ঢাকা দিয়ে আছে। সময় হলেই আত্মপ্রকাশ করবে।’
‘তোর কথা শুনে খানিকটা আস্বস্ত হচ্ছি।’
‘পুরোপুরি আশ্বস্ত হবার সময় কিন্তু আসেনি।’ আদিত্য সাবধানি গলায় বলল। ‘চন্দ্রা যেখানে লুকিয়ে আছে সেটা যদি খুনি খুঁজে বার করে ফেলতে পারে তাহলে চন্দ্রার ঘোর বিপদ।’
পার্থকে আবার খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। সে থেমে থেমে বলল, ‘কিন্তু, চন্দ্রাকে কেউ খুন করতে চাইবে কেন?’
‘নানারকম কারণ থাকতে পারে। আমি এখনও আসল কারণটা বুঝতে পারিনি। আর একটু ইনভেস্টিগেট করতে হবে।’ আদিত্য অকপটভাবে বলল।
পার্থকে এখনও বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। সে ভাবছে। একটু পরে পার্থ বলল, আমি কাল জাপান যাচ্ছি, সামনের সোমবার ফিরব। ফিরে একবার বসিরহাটে চন্দ্রার স্কুলে যেতে হবে। ওখানে এক ভদ্রলোক আছেন। নামটা মনে পড়ছে না। ওই বনবীথি স্কুলের ক্লার্ক। চন্দ্রার প্রতিবেশি ছিলেন। আগেরবার যখন গিয়েছিলাম, বলেছিলেন চন্দ্রার কিছু জিনিসপত্র চন্দ্রার বাড়িতে পড়ে ছিল, উনি বাড়িওলাকে বলে যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। সেগুলো আমার হাতে তুলে দিতে চান। আমি তখন জিনিসগুলো নিতে পারিনি। ভাবছি এবার গিয়ে নিয়ে আসব। এনে আমার দিদির বাড়িতে রেখে দেব।
‘দেশে এখন তোর কে আছে?’
‘বাবা মা দুজনেই চলে গেছে। রানাঘাটে আমাদের পুরোনো বাড়িটাও আর নেই। আমার আত্মীয় বলতে শুধু দিদি আর দিদির ছেলে। দিদির স্বামী মারা গেছে। অল্প বয়সে ক্যান্সার হয়েছিল। ভেরি স্যাড। দিদির শ্বশুর-শাশুড়িও আর নেই। আমার জামাইবাবু এক সন্তান। শ্বশুরবাড়িতে দিদি একা একা ছেলে নিয়ে থাকে। স্কুলে পড়ায়। দিদির শ্বশুর যে স্কুলে পড়াত সেই স্কুলের প্রাইমারি সেকশনে। আমি দিদির সঙ্গে গিয়ে মাঝে মাঝে থাকি।’
‘দিদির শ্বশুরবাড়িটা কোথায়?’
‘রানাঘাটের কাছেই দিদির বিয়ে হয়েছিল। ঠিক রানাঘাটে নয়। রানাঘাটের আগে পায়রাডাঙা বলে একটা স্টেশন আছে। ওখানে নেমে রিক্সায় মিনিট পনেরো। গ্রামের নাম হেতমপুর। আমাদের মতই দিদির শ্বশুরবাড়িটাও উদ্বাস্তু পরিবার। দেশভাগের পর ওরা হেতমপুরে চলে আসেন। ওখানকার স্কুলে দিদির শ্বশুর অঙ্ক পড়াতেন।’
একটু থেমে পার্থ বলল, ‘শোন, তুইও আমার সঙ্গে বসিরহাট চল। আমরা দুজনে মিলে ইস্কুলটা ঘুরে দেখব। যদি কিছু আবিষ্কার করতে পারি।’
আদিত্য ভাবল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। তাই হোক। আমি তো একবার বসিরহাট যাবই ভাবছিলাম। তোর সঙ্গেই না হয় যাব। তুই কবে যাবি ভাবছিস?’
‘আমি সোমবার ফিরছি। মঙ্গলবার গেলে কেমন হয়? এই মঙ্গলবারের পরের মঙ্গলবার? তোর কোনও অসুবিধে নেই তো?’
‘না না কোনও অসুবিধে নেই।’
আদিত্য উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এবার যেতে হবে রে। যাবার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। খুব ভাল করে ভেবে দ্যাখ। চন্দ্রা কি কখনও তোকে কোনও হিন্ট দিয়েছিল সে কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে?’
পার্থ অনেকক্ষণ ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘নাঃ, সেরকম কিছুই মনে পড়ছে না।’
(৪)
কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসটা আজকাল বদলে গেছে। বদলে গেছে মানে আদিত্যর ছাত্রজীবনে যেমন ছিল তেমনটা আর নেই। আগে বেয়ারাদের ডাকলেও আসতে চাইত না। এখন নিজের থেকে এসে জিজ্ঞেস করে কী খাবেন। আগে লোকে ঘন্টার পর ঘন্টা কিছু না খেয়ে বসে থাকত। এখন অনেকেই চট করে একটা কফি খেয়ে উঠে যায়। আগে কফি হাউসে চাউমিন চিলি চিকেন বিক্রি হবার কথা ভাবাই যেত না। এখন অনেকে ওসব খেতেই কফি হাউসে আসে। আবার অনেক কিছু বদলায়নি। ইনফিউশন নামধারী কালো কফি, পকৌড়া, চিকেন কিংবা এগ স্যান্ডউইচ, মটন আফগানী যা আসলে মটন কাটলেটের গরগরে ঝোল, যা লম্বা করে কাটা দুটুকরো সেঁকা পাঁউরুটি সহযোগে খেতে হয় এবং যা খেলে পেটের গণ্ডগোল অবধারিত, এ সবই এখনও আছে।
আদিত্য সাড়ে চারটের বেশ আগেই কফি হাউসে পৌঁছে গিয়েছিল। একটা কফির অর্ডার দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল চেনা কেউ চোখে পড়ে কিনা। কোথাও কেউ চেনা নেই। আদিত্যর মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগে পড়া সেই লাইনগুলো : ”যৌবন যায়। যৌবন বেদনা যে/ যায় না। সহসা ব্যাকুল বিকেলে বাজে/ স্নায়ুতে স্নায়ুতে সাত সাগরের দোলানি/ চেনা মুখ আর দেখায় না কফিখানা/নতুন শহর, পথঘাট নয় জানা/ বন্ধুরা মৃত, অপরিতৃপ্ত, গোঙানি।”। সত্যি এই কফিখানায় কোথাও কোনও চেনা মুখ আর নেই। অথচ এমন সময়ও ছিল যখন প্রায় প্রত্যেক টেবিলেই চেনা বেরিয়ে পড়ত। এক টেবিলের আড্ডা শেষ করে বহুবার আদিত্য আরেক টেবিলে গিয়ে বসেছে।
সোয়া চারটে নাগাদ কেয়া বাগচি দোতলার দরজা দিয়ে ঢুকল। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে, সবুজ পাড়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের মাঝে সবুজ টিপ। কেয়া নিজেই আদিত্যকে দেখতে পেয়ে তার টেবিলে এসে বসল।
‘বই কোথায়? বই কিনলেন না?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘অনেক বই কেনা হয়েছে। আমার সঙ্গে স্কুলের দুজন দরোয়ান এসেছিল। তাদের হাত দিয়ে বইগুলো স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি এখন ঝাড়া হাত-পা।’
আদিত্যর মনে হল কেয়াকে কিছুটা শীর্ণ দেখাচ্ছে। সে মুখে বলল, ‘স্যান্ডউইচ খাবেন?’
‘খাব। এগ স্যান্ডউইচ। এখানকার চিকেনের থেকে এগ স্যান্ডউইচটাই বেশি ভাল লাগে। আর একটা কোল্ড কফি খাব। কোল্ড কফি উইথ ক্রিম। গরমটা যাচ্ছে না। আপনি খাবেন না?’
‘আমিও তাহলে এক প্লেট এগ স্যান্ডউইচই খাই। আর একটা কালো কফি।’
বেয়ারাকে অবশ্য দোতলায় বেশি দেখা যায় না। যখন আসবে তখন অর্ডার দিতে হবে।
‘আপনাকে বেশ রান ডাউন দেখাচ্ছে। বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে।’ আদিত্য আস্তে আস্তে বলল।
কেয়ার শরীর থেকে পারফিউম আর ঘাম মেশানো একটা গন্ধ আসছে। গন্ধটাতে মাদকতা আছে। আদিত্য বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল।
‘রান ডাউন লাগার কারণ আছে। জ্বরে পড়েছিলাম। তিনদিন স্কুলে যেতে পারিনি। গত সোমবার থেকে আবার স্কুলে যাচ্ছি। ভীষণ উইক করে দিয়েছে। যে কারণে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলাম সেটা অবশ্য একেবারে অন্য একটা ব্যাপার। তার জন্যেও খানিকটা চিন্তায় আছি। একটু জিরিয়ে নিয়ে ব্যাপারটা বলছি।’ কেয়া তার শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল।
‘জ্বরের ওপর কোল্ড কফি খাবেন? আবার ঠাণ্ডা লাগবে না তো?’ আদিত্য ঈষৎ মৃদুভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘কিচ্ছু হবে না। একে তো জ্বর সেরে গেছে। তার ওপর আমার তো ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়নি। ভাইরাল ফিবার হয়েছিল। এই ভাইরালটা শহরে খুব হচ্ছে। তবে একবার সেরে গেলে আর ফিরে আসে না। শুধু খুব দুর্বল করে দেয়। তাছাড়া এই গরমে হট কফি খাওয়া অসম্ভব।’
তারপর একটু থেমে কেয়া বলল, ‘আপনার সঙ্গে তো অনেকদিন দেখা হয়নি। তদন্ত কেমন এগোচ্ছে? চন্দ্রার কোনও খোঁজ পেলেন?’
‘এখনও পাইনি, তবে খুব শিগগির পেয়ে যাব। কয়েকটা জিনিস এখনও জট পাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে ছাড়াতে হবে।’
বেয়ারা অর্ডার নিতে এসেছে। আদিত্য বলল, ‘আর কিছু খাবেন না? ইস্কুল থেকে আসছেন, নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে?’
‘না না আর কিছু খাব না। জ্বরের পর খিদেটা একেবারে চলে গেছে।’ কেয়া ব্যাগ খুলে একটা ছোট জলের বোতল বার করল। কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে বলল, ‘বসিরহাট গিয়েছিলেন? চন্দ্রার স্কুলে?’
‘এখনও যাওয়া হয়নি। তবে পুরুলিয়ায় গিয়েছিলাম। চন্দ্রা যে ইস্কুলে পড়াত সেখানে গেলাম। চন্দ্রা যে বাড়িটাতে থাকত সেখানেও গেছি। দরকারি কিছু তথ্য জানতে পেরেছি।’
‘যে প্রশ্নটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে সেটা হল, চন্দ্রা বেঁচে আছে তো?’ কেয়ার গলাটা খুব বিষণ্ণ শোনাল।
‘দেখুন, আমি যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে এটা পরিষ্কার যে চন্দ্রাকে কেউ খুন করার চেষ্টা করছিল। আমার মনে হয়, খুনিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য চন্দ্রা কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ সে বেঁচে আছে।’
‘কিন্তু, চন্দ্রাকে কেউ খুন করার চেষ্টা করবে কেন?’ কেয়া উদ্বিগ্ন গলায় বলল।
‘সেটাই তো বার করার চেষ্টা করছি।’
বেয়ারা কফি-স্যাণ্ডউইচ নিয়ে এসেছে। কফি হাউসের সার্ভিসের বেশ উন্নতি হয়েছে আজকাল। খাবার অর্ডার দিয়ে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। কেয়া কোল্ড কফির স্ট্রতে ঠোঁট ছোঁয়াল। আদিত্য কেয়াকে দেখছে। মুখে বয়েসের একটা হালকা ছাপ পড়লেও এখনও বেশ অ্যাট্র্যাক্টিভ বলা যায়। কেয়া কেন বিয়ে করেনি কে জানে? আদিত্য এই প্রশ্নটা আগেও নিজেকে করেছে।
‘আমি তাহলে আমার সমস্যাটার কথা বলতে শুরু করি।’ কেয়া প্রায় এক নিশ্বাসে কফিটা শেষ করে বলল।
‘বলুন।’ আদিত্য ঘাড় নাড়ল।
‘আগেই বলেছি, আমার একটা ভাইরাল ফিভার হয়েছিল। একটা বুধবার জ্বরটা এল, ধুম জ্বর। দুদিন ভোগার পর শুক্রবার সকালে দেখলাম জ্বর নেই। ভাবলাম, জ্বর যখন নেই তখন আর মিছিমিছি স্কুল কামাই করি কেন? দুদিন স্কুল কামাই হয়ে বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে। সাড়ে দশটা নাগাদ খাবার ঘরে গিয়ে অল্প ভাত খেয়ে নিলাম, যদিও খাবার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। সাড়ে এগারোটায় স্কুল। ঘরে ফিরে স্কুল যাবার জন্য শাড়িটা বদলাতে যাচ্ছি হঠাৎ শরীরটা ভীষণ দুর্বল মনে হল। বুঝলাম, এই শরীরে স্কুল যাওয়া অসম্ভব। কোনও রকমে স্কুলে একটা ফোন করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শুয়েই ঘুম।’
আদিত্য খুব মন দিয়ে শুনছে। একটু জিরিয়ে নিয়ে কেয়া আবার বলতে লাগল, ‘আমার পরিষ্কার মনে আছে, শাড়ি বদলাবার জন্যে ঘরে এসে আমি দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমার দরজাটার কথা একটু বলি। দরজায় একটা গোদরেজের ইয়েল লক লাগানো আছে। বাইরে থেকে টেনে দিলেই বন্ধ হয়ে যায়, আবার ভেতর থেকে টেনে দিলেও বন্ধ হয়ে যায়। বাইরে থেকে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলা যায়। আর ভেতর থেকে নব ঘুরিয়ে দরজা খুলতে হয়।
‘ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। কেউ বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজা খুলে আমার ঘরে ঢুকেছে। ঘরে আধো অন্ধকার। দিনের বেলা দরজা-জানলা বন্ধ থাকলে যেমন হয়। সেই আধো অন্ধকারে চিনতে পারলাম যে ঘরে ঢুকেছে সে আমাদের নতুন কাজের লোক চম্পা। ঘর ঝাঁট দেয়, ঘর মোছে, বাসন মাজে। এই কাজগুলো আমাদের এক রাতদিনের মাসিই করত। সে কিছুদিনের জন্য দেশে গেছে বলে চম্পাকে দিয়ে গেছে। চম্পা আমাদের হস্টেলে থাকে না। কাজ করে বাড়ি চলে যায়। আমার মনে হয় আলো থেকে হঠাৎ অন্ধকারে এসে চম্পা ঠিক বুঝতে পারেনি আমি ঘরে রয়েছি। আমি চম্পাকে দেখে ‘কে কে’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে সে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আমতা আমতা করে বলল সে জানত আমি স্কুলে গেছি। তারপর ওপরে এসে আমার ঘরের দরজা খোলা দেখে ভেবেছিল আমি বোধহয় ভুল করে দরজা খোলা রেখে চলে গেছি। তাই ভেতরে ঢুকে দেখছিল। চম্পার কৈফিয়তটা মোটেই যুতসই হল না। কিন্তু আমি সে সময়ে এতটাই দুর্বল বোধ করছিলাম যে বেশি কথা না বলে চম্পাকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে যেতে বললাম। কিন্তু পরে খুব ভাল করে ভেবে দেখেছি যে দরজাটা আমি অবশ্যই বন্ধ করেছিলাম। আমাদের হস্টেলের সব থেকে সিনিয়ার মেম্বার রানুদি, আমাদের সকলের অভিভাবকের মতো, তাকে কথাটা বললাম। রানুদি আমার আশঙ্কাটা হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল, তোর কথা সত্যি হলে ধরে নিতে হবে ওই মেয়েটা আমাদের সকলের ঘরের চাবি ডুপ্লিকেট করে রেখেছে আর নয়ত ও দেখেছে তোর ঘরে কোনও সাত রাজার ধন মানিক রয়েছে যা আমাদের ঘরে নেই। তাই হয়ত কষ্ট করে তোর ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা শুধু করে রেখেছে। এবার তুই ভেবে দ্যাখ তোর ঘরে সেরকম কিছু আছে কিনা। আমি চুপ করে গেলাম।’
কেয়া একটু থামল। এখনও ওর দুর্বলতা কাটেনি তাই একটানা বেশিক্ষণ কথা বলতে পারছে না। ওরা জানলার ধারে একটা টেবিল পেয়েছিল। আদিত্য জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। নিচে বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রিট দিয়ে জনস্রোত চলেছে। রিক্সাভ্যানে চড়ে উপুড়-চুপুড় বই দোকানে যাচ্ছে। একটু দূরে, কলেজ স্ট্রিটের দিকটায় কয়েকটি ছেলেমেয়ে বক্তৃতা আরম্ভের তোড়জোড় করছে, যদিও তাদের সামনে এখনও তেমন কোনও শ্রোতা নেই।
‘আমার গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছে। কিন্তু মনে হয় কফি হাউসের জলটা না খাওয়াই ভাল। আর একটা কোল্ড কফি খেলে খুব রাগ করবেন?’
‘মোটেই না, মোটেই না। আমিও একটা কোল্ড কফি খাব।’
ভাগ্যক্রমে বেয়ারা ধারে কাছেই ঘুরছিল, তাকে দুটো কোল্ড কফি উইথ ক্রিম আনতে বলে আদিত্য কেয়াকে বলল, ‘তারপর?’
‘শনি, রবি দুদিন রেস্ট নেবার পর শরীরে একটু জোর পেলাম। সোমবার স্কুলে জয়েন করলাম আর তার পরেই আসল ঘটনাটা ঘটল। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ঘর খুলে দেখি ঘরের লণ্ডভণ্ড অবস্থা। কেউ আমার ঘরে ঢুকেছিল। ঘরে ঢুকে কিছু একটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। কী খুঁজেছে আমি জানি না, তবে আমার আলমারি, ড্রয়ার, সুটকেস সব হাট করে খোলা। এমনকি খাটের নিচে চন্দ্রার দুটো সুটকেস ছিল, একটা আগে থেকেই ছিল আর একটা সেদিন সোনামাসি রেখে গিয়েছিল, দুটোই খোলা, আর তাদের ভেতরের জিনিসপত্রগুলো মেঝেতে ছড়ানো। শুধু তাই নয়, দুটো সুটকেসেরই লাইনিং ব্লেড দিয়ে কেটে ভেতরটা দেখা হয়েছে। আমার সুটকেস দুটো অবশ্য অক্ষতই ছিল। বলাই বাহুল্য, চম্পা বলে মেয়েটাকে আর আমাদের হস্টেলে দেখা গেল না। রানুদি পুলিশে খবর দিতে বলেছিল, আমি দিতে দিইনি। কী হবে পুলিশে খবর দিয়ে? তাছাড়া আমার কিছু খোয়া গেছে বলেও তো মনে হল না।’
আদিত্য কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘চন্দ্রার নতুন সুটকেসটাতে কী ছিল মনে আছে?’
‘বলার মতো কিছু নয়। কিছু পুরোনো জামাকাপড়, বাতিল সোয়েটার, পুরোনো কাগজপত্র।’
‘কী ধরনের কাগজপত্র?’
‘আমার ঠিক মনে নেই। কিছু পুরোনো ফিজিক্সের খাতা, বোধহয় কলেজ-ইউনিভার্সিটির নোট, যেগুলোর সঙ্গে চন্দ্রার আর খুব একটা সম্পর্ক নেই, কিছু পুরোনো চিঠি, স্কেচবুক। জানেন তো, চন্দ্রা ছবি আঁকত?’
‘একসময় জানতাম। তবে ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, এখন যদি আপনার সঙ্গে আপনার হস্টেলে যাই, চন্দ্রার এই দ্বিতীয় সুটকেসের জিনিসপত্রগুলো একবার দেখা যাবে?’
‘অবশ্যই যাবে। চলুন আমার সঙ্গে। আপনার কী সন্দেহ হচ্ছে চন্দ্রার ওই সুটকেসটার জন্যে চোর আমার ঘরে ঢুকেছিল?’ কেয়ার গলায় সংশয়।
‘সন্দেহ নয়। আমি নিশ্চিত।’
কোল্ড কফি শেষ করে আদিত্য আর কেয়া বাগচি যখন মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড় থেকে ট্যাক্সি ধরছে তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। রাস্তায় বেশ ভিড়, দেয়ালির কেনাকাটা চলছে। কলেজ স্ট্রিট মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড় থেকে বাগবাজারে কেয়ার হোস্টেলে পৌঁছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল। ট্যাক্সিতে কেয়ার পাশে বসে আবার কেয়ার শরীরের সেই গন্ধ! আদিত্যর অস্বস্তিটা ফিরে এসেছিল।
হস্টেলে পৌঁছে কেয়া আদিত্যকে একতলায় বসার ঘরে বসাল। বলল, ‘চা খাবেন তো? এই সময় আমাদের চা হয়।’
‘চা খেতে আমার কখনই আপত্তি নেই।’
‘চন্দ্রার সুটকেসের জিনিসগুলো আমি সুটকেসেই তুলে রেখেছি। সুটকেসটা নিয়ে আসি?’ কেয়া একটু ইতস্তত করে বলল। তারপর একটু থেমে বলল, ‘আসলে দোতলায় পুরুষ ভিজিটারদের নিয়ে যাওয়া বারণ। নাহলে আপনাকে ওপরেই নিয়ে যেতাম।’
‘না না আমার ওপরে যাবার দরকার নেই। আপনি সুটকেসটা আনলেই হবে।’ আদিত্য কিছুটা কুণ্ঠিতভাবে বলল।
মিনিট পাঁচেক পরে কেয়া যখন সুটকেসটা নিয়ে ফিরে এল, আদিত্য লক্ষ করল সে ইতিমধ্যে বাইরে পরার শাড়িটা বদলে একটা সাধারণ শাড়ি পরে নিয়েছে। কপালের টিপটাও আর নেই। হয়ত চোখে-মুখে জলও দিয়ে এসেছে। কারণ কেয়াকে অনেকটা আটপৌরে দেখাচ্ছিল।
আদিত্য সুটকেস খুলে তার ভেতরের জিনিসগুলো বার করে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল। পুরোনো শাড়ি, চুড়িদার, বাতিল অন্তর্বাস, কাগজপত্রের একটা বান্ডিল, কিছু অঙ্ক-কষা খাতা, একটা স্কেচবুক।
আদিত্য স্কেচবুকটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। ঘোড়ার স্কেচ, কুকুরের স্কেচ, টিয়া পাখির স্কেচ, সবই পেনসিলে। কিছু স্কেচপেনে আঁকা দৃশ্যাবলী, পাহাড়ের ছবি, পুকুরের ছবি, পুরুলিয়া রেল স্টেশনের ছবি, পুরুলিয়া শহরের টুকরো টুকরো ছবি। কয়েকটা চন্দ্রাদের আলিপুরের বাড়ির পেনসিল স্কেচ। বনবীথি ইস্কুলের স্কেচ। ইছামতির ছবি। প্রত্যেকটা ছবির নিচে ক্যাপশান দেওয়া আছে। পাতা ওলটাতে ওলটাতে একটা জায়গায় আদিত্যর চোখ আটকে গেল। আবার নীপবীথি ইস্কুল বাড়ির স্কেচ। একটা নয়, বেশ কয়েকটা। বিভিন্ন দিক থেকে। একটা ছবিতে একটা ট্রাক দেখা যাচ্ছে। ট্রাকটা নীপবীথি ইস্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দুটো লোক পিঠে করে ট্রাক থেকে বস্তা নামাচ্ছে। আর একজন ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না ইস্কুলের সামনে মিড ডে মিলের চাল-ডাল নামছে। ছবিটা আদিত্য খুব মন দিয়ে দেখছিল। ছবিটাতে কিছু একটা আছে যেটা সে আগে কোথাও দেখেছে। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না জিনিসটা কী বা কোথায় সেটা দেখেছে। এই ছবিটার পরে স্কেচবুকে আর কোনও ছবি নেই।
আদিত্য কেয়াকে বলল, ‘আমি কি এই স্কেচবুকটা কয়েকদিনের জন্যে নিতে পারি?’
‘ওই স্কেচবুকের মধ্যে চন্দ্রার অন্তর্ধান রহস্য লুকিয়ে আছে বলছেন?’ কেয়া হাসছে।
‘না, না। তা বলছি না। তবে মনে হচ্ছে এর মধ্যে একটা কিছু আছে যা আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। স্কেচবুকটা নিয়ে যেতে পারলে খুব ভাল হত। একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করতাম। যদি অবশ্য আপনার আপত্তি না থাকে।’
‘নিয়ে যান, নিয়ে যান। নিয়ে গিয়ে যতদিন খুশি রেখে দিন। আমার কোনও আপত্তি নেই। প্রাণ ভরে ওই ছবিগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করুন। আমি আবার আর্ট জিনিসটা একেবারে বুঝি না।’
চা এসেছে। সঙ্গে বিস্কুট। বিস্কুটটা বেশ নতুন ধরনের।
‘আপনি চা-টা খেয়ে নিন। আমি ততক্ষণ সুটকেসটা ওপরে রেখে আসি। তারপর আপনাকে না হয় গলির মোড় অব্দি এগিয়ে দেব।’
একটু পরে আদিত্য যখন নিবেদিতা লেন ধরে কেয়া বাগচির পাশাপাশি হাঁটছিল, আর কেয়ার শরীরের সেই ঘাম মেশানো পারফিউমের গন্ধটা আদিত্যকে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিল, তখন আদিত্যর মনে সেই প্রশ্নটাই ঘুরছিল, কেয়া বিয়ে করেনি কেন? সন্দেহ নেই, কেয়া বাগচির সঙ্গে হাঁটতে তার বেজায় ভাল লাগছিল।
(৫)
বিমল খবর এনেছিল মদন ড্রাইভারের বাড়ি বারুইপুর স্টেশন থেকে ভ্যানরিক্সায় মিনিট পনের। বিমল নিজে একবার সেখানে ঘুরে এসেছে। মদনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে সে সেনবাড়িতে আর কাজ করবে কিনা। মদন বলেছে তার বয়েস হয়েছে বলে মেমসাহেব তাকে রিটায়ার করিয়ে দিয়েছেন। কিছু টাকাপয়সাও দিয়েছেন। আপাতত সে আর কাজ করবে না। বাড়ি বসে কিছুদিন আরাম করবে। এখন বিল্টু বলে একটা ছেলে তার কাজটা করছে। বিল্টু কতদিন কাজ করবে মদন জানে না। বিল্টু যদি কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে তার কাজটা বিমল অবশ্যই করতে পারে।
বিমলের অবশ্য মদনকে খুব বুড়ো মনে হয়নি। তাই বুড়ো বলে তাকে রিটায়ার করিয়ে দেওয়ার গল্পটা বিমলের অবিশ্বাস্য লেগেছে। অনেক চেষ্টা করেও কিন্তু সে মদনের মুখ থেকে আর কোনও কথা বার করতে পারেনি। মদনকে একটু বেশি প্রশ্ন করাতে সে রেগে মারমুখি হয়ে উঠেছিল। বিমল আর তাকে ঘাঁটাতে সাহস পায়নি।
বিমলকে দিয়ে কাজ হল না বলে আদিত্য ঠিক করেছিল নিজেই একবার মদন ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা করে আসবে। কিন্তু বিমল যখন কার্যোদ্ধার করতে পারেনি, সেও একা গিয়ে কিছু করে উঠতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাই আদিত্য অন্য রাস্তা ভেবেছে। সমাদ্দারের সঙ্গে কথা বলে স্থানীয় পুলিশের সাহায্য চেয়েছে। বারুইপুর থানার ওসির সঙ্গে আদিত্যর কথা বলিয়ে দিয়েছে সঞ্জয় সমাদ্দার। ঠিক হয়েছে থানার ছোটবাবু মনসুর আলমকে নিয়ে আদিত্য মদন ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। পুলিশ ধমক দিয়ে যদি মদনের পেট থেকে কথা বার করতে পারে।
বেলা দশটা নাগাদ আদিত্য শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে দেখে সাউথ স্টেশনে লোক থইথই করছে। সবই আপিসযাত্রী, ট্রেন থেকে নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে আপিসের পথে ধাবমান। তবে আদিত্যর সৌভাগ্য, ভীড়টা একমুখী। যে ট্রেনগুলো শেয়ালদা ঢুকছে, সেগুলোতে অমানুষিক ভীড়। আর যে ট্রেনগুলো শেয়ালদা ছেড়ে যাচ্ছে সেগুলো একেবারে ফাঁকা। আদিত্য বারুইপুর লোকাল ধরে একেবারে বারুইপুরে গিয়ে নামবে। তাতে দুটো সুবিধে। এক, ভীড়ের বিপরীতে যাচ্ছে বলে মনে হয় ট্রেনটা ফাঁকাই থাকবে। দুই, অরিজিনেটিং স্টেশনে উঠে একেবারে টারমিনাল স্টেশনে গিয়ে নামবে বলে ওঠা এবং নামা দুটোই শান্তিপূর্ণ হবে বলে আশা করা যায়।
বারুইপুর লোকাল বারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। ছাড়তে মিনিট পনের বাকি। ধূমপান করে এই পনের মিনিটের সদ্ব্যবহার করা যেত। কিন্তু আজকাল ট্রেনের কামরায় তো বটেই, এমনকি প্ল্যাটফর্মেও সিগারেট খেতে দেয় না। অগত্যা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো করে আদিত্য পরপর দুকাপ চা খেল, কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে প্ল্যাটফর্মে হাঁটাহাঁটি করল, তারপর একটা ইংরেজি খবর কাগজ কিনে সামনে যে কামরাটা পেল তাতে উঠে বসল।
ট্রেন ছাড়ল পাঁচ মিনিট দেরি করে, বারুইপুর পৌঁছল কুড়ি মিনিট লেটে। স্টেশনে নেমে একটা রিক্সা ধরে আদিত্য যখন থানায় পৌঁছল তখন বারোটা বেজে গেছে। পথে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু ঘটেনি, শুধু মল্লিকপুরের কাছে এসে এক অন্ধ গায়ক ‘কী দ্বন্দ্ব করলে জারি/ও গোঁসাই, কোন রঙ্গে বেঁধেছো ঘরখানি’, এই গানটা গেয়ে আদিত্যর মনটাকে রীতিমত নরম করে দিয়েছিল।
ছোটবাবু মনসুর আলম একজন অত্যন্ত সুপুরুষ, স্বল্পবাক, ব্যক্তিত্বশালী পুলিশ অফিসার। বয়েস চল্লিশের কমই হবে। আদিত্য তাকে অল্প কথায় চন্দ্রলেখা সেনের উধাও হয়ে যাবার কাহিনি শোনাল। এটাও বলল যে এই মদন ড্রাইভার সম্ভবত কোনও একটা ডকুমেন্টে সই করেছিল যার সঙ্গে চন্দ্রলেখার উধাও হয়ে যাবার একটা যোগ থাকতে পারে। মদনকে চাপ দিয়ে জানতে হবে সে কোন ডকুমেন্টে সই করেছিল কিংবা আদৌ কোনও ডকুমেন্টে সই করেছিল কিনা। আদিত্যর মনে হল মনসুর আলম সমস্যাটা বুঝেছে।
বড় রাস্তা থেকে নেমে ছোট রাস্তা, তারপর খানিকটা এবড়ো খেবড়ো মাটির পথ। একে ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে যখন পুলিশের জিপ মদন ড্রাইভারের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তখন সে মধ্যাহ্নভোজন সেরে কুয়োতলায় মুখ ধুচ্ছে। মনে হল, পুলিশের জিপ দেখে মদন এতটাই ঘাবড়ে গেছে যে তার হাত-পা চলছে না। তার ওপর মনসুর আলমের পুলিশি ধমক। মদনের বুকে যেটুকু সাহস ছিল সেটাও উধাও হয়ে গেছে।
আদিত্য, মনসুর আলম ও একটি কনস্টেবল সামনের ঘরে ঢুকেছে। ঘরে একটা তক্তাপোষ, গোটা দুই চেয়ার, একপাশে একটা মান্ধাতার আমলের রেফ্রিজারেটার ঘড়ঘড় শব্দ করে চলছে। একটু আগে মাটিতে বসে কেউ ভাত খেয়েছিল, হয়ত মদন নিজেই, এঁটো থালাটা এখনও পড়ে আছে। একগলা ঘোমটা দিয়ে একজন মহিলা জায়গাটা মুছে এঁটো থালাটা তুলে নিয়ে চলে গেল। আদিত্য ও মনসুর আলম তক্তাপোষে বসল, কনস্টেবল দাঁড়িয়ে রইল। মদন বাড়ির ভেতরে গেছে।
একটু পরে মদন ঘরে ঢুকতে মনসুর আলম জলদগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল, ‘তোমার নাম মদন মান্না?’
মদন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। কিন্তু আমি কী দোষ করেছি স্যার? আমার বাড়িতে পুলিশ কেন?’
‘চোপ! একদম বাড়তি কথা নয়। যা জিজ্ঞেস করব শুধু তার ঠিক ঠিক জবাব দেবে। নাহলে ঘাড় ধরে লক-আপে নিয়ে যাব।’ মনসুর আলম গর্জে উঠল। মদন তার উদ্গত কান্নাটা গিলে চুপ করে গেল।
‘তুমি কলকাতায় কমলিকা সেনের গাড়ি চালাতে?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘কতদিন ওখানে গাড়ি চালিয়েছ?’
‘স্যার, আগে আমি সাহেবের গাড়ি চালাতাম। সাহেব গত হবার পর থেকে মেমসাহেবের গাড়ি চালাচ্ছি। সব মিলিয়ে প্রায় পঁচিশ বছর ওই বাড়িতে গাড়ি চালিয়েছি।’
‘তাহলে চাকরি ছাড়লে কেন? তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আরও দশ বছর চাকরি করতে পারতে।’
‘পারতাম স্যার। নিশ্চয় পারতাম। কিন্তু মেমসাহেব আমাকে রিটায়ার করিয়ে দিলেন।’
‘মেমসাহেব আপনাকে কেন রিটায়ার করিয়ে দিলেন?’ এবার আদিত্য প্রশ্ন করল।
‘মেমসাহেব বললেন অনেক দিন চাকরি করেছ। তোমার বয়েস হয়েছে। এবার রিটায়ার করে আরাম করো।’
‘মেমসাহেব কেন একথা বললেন? আপনার কি গাড়ি চালাতে অসুবিধে হচ্ছিল?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘না স্যার, কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। গাড়ি আমি এখনও আগের মতই চালাতে পারি।’
‘তাহলে কেন মেমসাহেব আপনাকে রিটায়ার করিয়ে দিলেন?’ আদিত্য গলা না তুলে সেই একই প্রশ্ন করল।
‘বোধহয়, মেমসাহেবের মনে হয়েছিল আমি অনেকদিন চাকরি করেছি, এবার রেস্ট নেওয়া দরকার। কিছু টাকাও দিলেন। মেমসাহেবের দয়ার শরীর।’
‘তুই ঢপ মারার জায়গা পাস না?’ এবার মনসুর আলমের হুঙ্কার শোনা গেল। ‘এই শ্যামা, এই শুয়োরের বাচ্চাটাকে জিপে তোল। থানায় নিয়ে গিয়ে দুচারটে কোঁৎকা না দিলে সত্যিটা বেরোবে না।’ শেষের কথাগুলো দণ্ডায়মান কনস্টেবল-এর উদ্দেশে।
মিতবাক, সুদর্শন মনসুর আলমের মুখ থেকে হঠাৎ এরকম ভাষা বেরোতে পারে আদিত্য কল্পনাও করতে পারেনি।
‘আমি সত্যি বলছি স্যার।’ মদন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল।
‘তুই সত্যি বলছিস না মিথ্যে বলছিস থানায় গেলেই বোঝা যাবে। এই শ্যামা, শালাকে জিপে তোল।’
কনস্টেবল শ্যামাচরণ এবার এগিয়ে এসে মদনের হাত ধরল। চাপা গলায় বলল, ‘চল গাড়িতে।’
মদন ভয় পেয়েছে। হয়ত সে নিজের থেকেই কিছু একটা বলত, হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে একটি রোগা মাঝবয়সী মহিলা তীরবেগে বেরিয়ে এসে বলল, ‘বলে দাও না কী হয়েছিল। এই বয়েসে থানায় গিয়ে হাত-পা ভাঙবে নাকি?’
আদিত্য আন্দাজ করল এই মহিলা মদনের স্ত্রী। এ-ই একটু আগে ঘোমটা মাথায় এঁটো বাসন নিয়ে যেতে এসেছিল।
মহিলার দিকে তাকিয়ে মদন তীক্ষ্ন গলায় বলল, ‘বলছি, আমি সব বলছি। তুমি আগে ভেতরে যাও।’
মহিলার নড়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। সে গলা তুলে বলল, ‘আমি কোথথাও যাবনি। এইখানেই দেঁইড়ে থেকে শুনতে চাই আমাকে তুমি যা যা বলেছ ঠিক সেটাই পুলিশকে বলছ। পুলিশের কাছে কথা নুকুলে আমরা সবাই কিন্তু বিপদে পড়ব। মনে রেখো তোমার ছোট মেয়ের এখনও বিয়ে হয়নি। পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে গেলে আর মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেনি।’
যেটুকু প্রতিরোধ মদন মান্নার বাকি ছিল, মহিলার কথায় সেটাও ভেসে গেল। সে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘মারা যাবার কিছুদিন আগে সাহেব আমাকে তার চেম্বারে ডেকে পাঠান। তখন সন্ধে আটটা সাড়ে আটটা হবে। ওই সময় সাহেবের ঘরে আর ওয়েটিং রুমে মক্কেল উপচে পড়ে। সেদিন কিন্তু কেউ কোথাও ছিল না। শুধু সাহেবের খাস আর্দালি রামসেবক সাহেবের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সাহেব তাকে দিয়েই আমাকে ডেকে এনেছিলেন।’
‘ব্যাপারটা আপনার অদ্ভূত মনে হয়নি?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘বেশ অদ্ভূত মনে হয়েছিল স্যার। কিন্তু একটু পরেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।’
‘বলে যাও তারপর কী হল।’ এবার মনসুর আলমের গলা।
‘সাহেব আমাকে বললেন একটা কাগজে সাক্ষী হিসেবে সই করতে হবে। এই বলে তিনি ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা কাগজ বার করলেন। আমি দেখলাম কাগজে ইংরেজিতে কীসব লেখা আছে। আমি ইংরেজি পড়তে পারি না। তাই সাহেবকে বললাম, সাহেব এতে কী লেখা আছে বলবেন না? সাহেব বললেন, নিশ্চয় বলব। কিছু না জানিয়ে একটা কাগজে তোমাকে দিয়ে সই করাব কেন? এতে লেখা আছে আমার আলিপুরের বাড়ি এবং তার সঙ্গে যে জমি আছে তার পুরোটাই আমি আমার মেয়ে চন্দ্রলেখাকে দিয়ে যাচ্ছি। আমার মৃত্যুর পরে সেই হবে এই পুরো বাড়ি এবং জমির মালিক। আর আমার হাজারিবাগের বাড়ির পুরো মালিক হবে আমার স্ত্রী কমলিকা সেন। আর আমার টাকা-পয়সা যা থাকবে তা আমার স্ত্রী এবং মেয়ের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হবে। তবে আমার স্ত্রী তার যতদিন ইচ্ছে আলিপুরের বাড়িটায় থাকতে পারবেন, তাঁকে এখান থেকে কেউ তাড়াতে পারবে না। এটাই আমার উইল। এতে রামসেবক আর সরকারবাবু সাক্ষী হিসেবে সই দিয়েছে। আর একটা সই দরকার। তাই তোমাকে বলছি। একটা কথা। এই উইলের কথা কেউ যেন এখন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। তবে পরে কখনও যদি এসব নিয়ে কোর্ট-কাছারি হয় তখন সাক্ষী দিতে হবে।’
‘সরকারবাবু কে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘সরকারবাবু সাহেবের ফাইলপত্র গুছিয়ে রাখেন। অনেক দিনের বিশ্বাসী লোক।’
‘বুঝেছি। তারপর কী হল?’
‘তারপর কিছুদিন ব্যাপারটা ভুলেই গেছিলুম। এর মধ্যে সাহেবের শরীর খারাপ হল, কয়েকদিন ভোগার পর সাহেব চলেও গেলেন। সাহেব চলে যাবার পর আলিপুরের বাড়িটা মেমসাহেবেরই হয়ে গেল। ছোট মেমসাহেব তো এমনিতেই বাড়িতে কম আসতেন, সাহেব চলে যাবার পর আলিপুরের বাড়িতে আসা বন্ধই করে দিলেন। অথচ সবই তো তার। আর কেউ না জানুক আমি তো জানি। আমি মেমসাহেবের গাড়ি চালাতাম। রামসেবক আর সরকারবাবু অন্য জায়গায় কাজ নিয়ে চলে গেল। তাদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।’
‘তারপর একদিন কি মেমসাহেব তোমাকে ছাড়িয়ে দিলেন?’ মনসুর আলম জিজ্ঞেস করল।
‘না স্যার। আমি মিথ্যে বলেছিলাম। মেমসাহেব আমাকে কখনও ছাড়াননি। আসল ব্যাপারটা কী হল বলছি। একদিন একটা লোক আমার ঘরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করল। আলিপুরের বাড়িরই বারমহলে ছিল কাজের লোকেদের থাকার ব্যবস্থা। আমি সেখানে একটা ঘর নিয়ে থাকতাম। পরিবার থাকত এখানে। তা সেই লোকটা এসে আমাকে বলল আমি যদি কাজ ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে যাই আর ওই সই করার কথা কাউকে না বলি তাহলে আমাকে অনেক টাকা দেবে।’
‘কত টাকা?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘বলেছিল এক লক্ষ টাকা দেবে। পঞ্চাশ হাজার প্রথমে, দেশে ফিরে গেলে আরও পঞ্চাশ হাজার। আর ওই উইলটা নিয়ে যদি কখনও মামলা হয় তখন কোর্টে বলতে হবে কেউ জোর করে ওই কাগজটাতে আমাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছিল। সেরকম কিছু হলে আরও দুলাখ টাকা পাওয়া যাবে।’
‘তুমি কী করলে?’
‘স্যার, তখন আমার বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। টাকার খুব দরকার। আমি রাজি হয়ে গেলাম। ভেবে দেখলাম, এক্ষুনি তো আর মিথ্যে সাক্ষী দিতে হচ্ছে না, শুধু চাকরিটা ছাড়তে হচ্ছে। সেটা তো আর বেআইনি কিছু নয়। আমি মেমসাহেবকে গিয়ে বললাম আমার শরীরটা ভাল নেই। চাকরি ছেড়ে দেব। চাকরি ছেড়ে কিছুদিন বাড়িতে রেস্ট নিতে চাই।’
‘মেমসাহেব কী বললেন?’
‘মেমসাহেব প্রথমে একটু অবাকই হয়ে গেলেন। তারপর অনেকবার আমাকে ভেবে দেখতে বললেন। বললেন, এই বাজারে একবার চাকরি ছাড়লে এরকম চাকরি আর চট করে পাওয়া যাবে না। আসলে মেমসাহেব আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন, তাই চট করে আমাকে ছাড়তে চাইছিলেন না। তারপর যখন দেখলেন আমি কিছুতেই আর কাজ করতে রাজি নই তখন মেমসাহেব বেশ রেগে গেলেন। বললেন, চাকরি ছাড়ার আগে একটা লোক দিয়ে যাবে। আমি তখন বিল্টুকে কাজে ঢুকিয়ে দিলাম।’
‘দুটো প্রশ্ন করব।’ আদিত্য বলল। ‘যে লোকটি আপনাকে চাকরি ছাড়ার জন্য টাকা দিয়েছিল তাকে কি আপনি আগে কখনও দেখেছিলেন?’
‘না স্যার। তাকে আগেও কখনও দেখিনি। আর টাকা নেবার পরেও কখনও দেখিনি। তবে লোকটা বাঙালি নয়। হিন্দি আর ভাঙা ভাঙা বাংলা মিশিয়ে কথা বলছিল।’
‘দুনম্বর প্রশ্ন। যে কাগজটায় আপনি সই করলেন, অর্থাৎ সেই উইলটার কী হল কিছু জানেন?’
‘না স্যার। এব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। হয়ত সাহেব ওটা ছোট মেমসাহেবকে দিয়ে গেছিলেন। হয়ত ওটা সাহেবের কাছেই ছিল। না স্যার। ওটা কোথায় গেল আমি কিছুই জানি না।’
‘আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই।’ আদিত্য মনসুর আলমকে বলল।