চন্দ্রলেখা অন্তর্ধান রহস্য – ৬

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

(১)

ভারতীয় রেলওয়ের ওয়েবসাইট বলছে, কলকাতা থেকে পুরুলিয়া যাবার অনেক উপায়। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে বেশিরভাগ অপশানগুলোই ভাল নয়। যেমন রূপসী বাংলা ছাড়ে ভোর ছটা পঁচিশে। অত তাড়াতাড়ি আদিত্যর পক্ষে ঘুম থেকে উঠে, তৈরি হয়ে স্টেশনে পৌঁছনো অসম্ভব। লালমাটি ছাড়ে আর একটু পরে, বেলা সাড়ে আটটায়, কিন্তু সেটাও আদিত্যর পক্ষে বড্ড সকাল। কয়েকটা ট্রেন আবার হাওড়া থেকে ছাড়েই না, ছাড়ে সাঁতরাগাছি বা শালিমার থেকে। সেসব জায়গায় কী করে পৌঁছতে হয়, আদিত্যর কোনও ধারণাই নেই। তাছাড়া তার নান্দনিক চেতনা বলে কলকাতা থেকে ট্রেনে করে কোথাও যেতে হলে হাওড়া বা শেয়ালদা থেকে রওনা হওয়াই শ্রেয়। কলকাতা-রাঁচি ইন্টারসিটি বলে একটা ট্রেন পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু একটু খেয়াল করতে চোখে পড়ল ট্রেনটা পুরুলিয়া যায় না, পুরুলিয়ার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই ট্রেনে পুরুলিয়া যেতে গেলে আদ্রা জংশনে নেমে বাস বা অন্য কিছু ধরে পুরুলিয়া পৌঁছতে হবে। কে যাবে অত ঝামেলায়?

অনেক খোঁজাখুঁজি করে আদিত্যর মনে হল হাওড়া-পুরুলিয়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসটাই তার পক্ষে সব চেয়ে সুবিধেজনক গাড়ি। এটা হাওড়া থেকে ছাড়ে বিকেল চারটে পঞ্চাশে, পুরুলিয়া পৌঁছয় রাত্তির সাড়ে দশটা নাগাদ। একটা অজানা শহরে পৌঁছনোর পক্ষে রাত্তির সাড়ে দশটাটা অবশ্য মোটেই ভাল সময় নয়। বিশেষ করে ট্রেন যদি লেট থাকে। কিন্তু ভারতীয় রেল জানাচ্ছে, এই ট্রেনটা সাধারণত খুব একটা লেট করে না। তাছাড়া যে হোটেলটাতে আদিত্য নিজের থাকার ব্যবস্থা করেছে তাদের পিক-আপ, ড্রপ-ডাউন দুটো সারভিসই আছে। তারাই স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে আদিত্যকে তুলে নেবে। আবার ফেরার সময় স্টেশনে পৌঁছেও দেবে। তাই বেশি রাত্তিরে পৌঁছনো নিয়ে আদিত্য ততটা ভাবছে না।

ডেবিট কার্ড দিয়ে হোটেলের ঘর আগেই বুক করে রেখেছিল। এবার রেলের ওয়েবসাইট থেকে আদিত্য যাতায়াতের টিকিটও কেটে নিল। এসি চেয়ার। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা বসে বসে কাটাতে হবে। সঙ্গে কোনও ইন্টারেস্টিং বই নিলে হয়। তাহলে সময়টা তাড়াতাড়ি কাটবে। অনেক ভেবেচিন্তে ফেরার টিকিটটাও ওই একই ট্রেনে কাটল। শুক্রবার খুব ভোরে ফেরা। আশা করা যায়, হোটেলের গাড়ি স্টেশনে পৌঁছে দেবে। সত্যি কথাটা হল, যেহেতু কলকাতা ছেড়ে আদিত্যর খুব একটা বেরোনো হয় না, তাই কোথাও যেতে হলে তার ভীষণ নার্ভাস লাগে। ভ্রমণে যাদের বিন্দুমাত্র ভয় নেই আদিত্য তাদের শ্রদ্ধা করে।

আদিত্য ভেবে দেখল, মঙ্গলবার আর শুক্রবার যাতায়াতেই কেটে যাবে। তাহলে মাত্র দুটো দিন হাতে রইল। তার মধ্যে একদিন চন্দ্রার পুরোনো ইস্কুলে যেতে হবে। হয়ত সারাদিনটাই ওখানে কেটে যাবে। কী যেন নাম ইস্কুলটার? মনে পড়েছে। নীপবীথি। সমাদ্দার বলেছিল, যে এন জি ও ইস্কুলটা চালায় রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় তাদের আরও ইস্কুল আছে। চন্দ্রার বসিরহাটের ইস্কুলটার নাম বনবীথি। নাম শুনে মনে হয় ওই একই এন জি ও-র ইস্কুল। চন্দ্রা তাহলে এক ইস্কুল থেকে আর একটা ইস্কুলে বদলি নিয়েছিল।

আদিত্য মোবাইলে সমাদ্দারের নম্বরটা ডায়াল করল।

‘গুড মর্নিং স্যার।’ সমাদ্দারের গলায় একটা উষ্ণতা আদিত্য বরাবরই টের পেয়েছে।

‘আপনাকে আর একটা রিকোয়েস্ট করতে পারি?’

‘নিশ্চয় স্যার। বলুন, আপনার জন্য আর কী করতে পারি?’

‘আমি আগামী কাল পুরুলিয়া যাচ্ছি। দুদিন থেকে একটু ঘুরে ফিরে দেখব। যদি কিছু বার করতে পারি। ওই অঞ্চলে আপনার চেনা কোনও পুলিশ অফিসার আছেন যাঁর কাছে দরকার পড়লে যেতে পারব?’

সমাদ্দার কিছুক্ষণ ভাবল। ‘আপনি তো আগেই বলেছিলেন পুরুলিয়া গিয়ে আমাদের ইনফর্মারদের সঙ্গে কথা বলতে চান। একটা সমস্যা হল, পুরুলিয়া শহরে পুলিশের পুরোনো লোকেরা আর কেউ নেই স্যার। তবে আদ্রায় আছে। আদ্রা পুলিশ স্টেশনের ওসি আমার বিশেষ চেনা। ওই স্পেশাল অপরেশনের সময় আমাদের টিমে ছিল। আমি ওকে ফোন করে দেব। ওর নামও সঞ্জয়। আমি সঞ্জয় সমাদ্দার আর ও সঞ্জয় বারিক। খুব ভাল ছেলে। আমি ওকে ফোন করে দিচ্ছি। আর ওর ফোন নম্বরটাও আপনাকে মেসেজ করে দিচ্ছি। ওই আপনাকে সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবে।’

‘অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

‘ধন্যবাদ বলবেন না স্যার, এটা তো আমার ডিউটি।’

ফের কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে। আদিত্য কয়েক পা হেঁটে গিয়ে দরজাটা খুলল। নূপুর মণ্ডল।

‘তোমার মেসেজ পেয়ে ছুটে এলাম আদিত্যদা। বল কী বলবে। আমাকে আবার দেড়টার মধ্যে পার্ক সার্কাস ফিরতে হবে। চার নম্বর পুলের সামনে থেকে আমাকে অফিসের গাড়িটা দেড়টায় পিক আপ করে।’

‘বোসো, বোসো। হাঁপাচ্ছ দেখছি। এখন তো সবে সাড়ে এগারোটা। দেড়টা বাজতে দেরি আছে। একটু কফি খাও। তারপর সব বলছি।’

আদিত্য কফির জল বসাতে বসাতে একবার পেছন ফিরে নূপুরের দিকে তাকাল। এইভাবে আগে কখনও তাকায়নি। মেয়েটা কি একটু রোগা হয়ে গেছে? হতেও পারে। চাকরি নিয়ে টেনশনে আছে। একটা কালো টি শার্ট আর জিনস পরেছে নূপুর। বয় কাট চুল। বড় বড় চোখ। নাকটা ভোঁতাই বলতে হবে। চোখের নিচে সামান্য কালি জমেছে।

‘অমনভাবে কী দেখছ আদিত্যদা? কিছু হয়েছে নাকি?’ নূপুরের গলাটা উদ্বিগ্ন শোনাল।

‘দেখছি তোমাকে কতটা বিশ্বাস করা যায়।’

‘বিশ্বাস!’ নূপুর কি একটু চমকে উঠল? নাকি আদিত্যর মনের ভুল।

আদিত্য দুকাপ কফি নিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। বলল, ‘বিস্কুট খাবে?’

‘না, না। জাস্ট কফি। তুমি তাড়াতাড়ি বল। অফিসের গাড়িটা মিস করলে খুব মুস্কিলে পড়ে যাব।’

‘তোমার তো সামনের সপ্তাহ থেকে চাকরি নেই।’

‘তোমাকে তাই বলেছিলাম। তখন তাই জানতাম। এখন বস বলছে চাইলে এই মাসটা কাজ করতে পারি। আসলে বাইরে থেকে একটা কাজ এসে গেছে। আমি ছেড়ে দিলে কাজটা ডেলিভার করা যাবে না। তাই এত দয়া। আমি পারলে এক্ষুনি ছেড়ে দিতাম। কিন্তু হাতে আর কিছু তো নেই।’ নূপুর মাথা নিচু করে নিজের আঙুলগুলো নিয়ে খেলছে।

‘সেদিন তুমি আমার কাছে কাজ চেয়েছিলে। বলেছিলে, আমার ডিটেকটিভ এজেন্সিতে কাজ করতে চাও। এখনও কি সে রকম ইচ্ছে আছে?’ আদিত্য আস্তে আস্তে বলল।

‘তুমি কি সত্যিই আমায় কাজ দেবে?’ নূপুরের মুখটা হঠাৎ ঝলমল করছে।

‘একটা কাজ আমি তোমাকে দিতে পারি। তবে মাত্র একমাসের জন্য।’

‘আমি একমাসের কাজ পেলেও নিতে রাজি আছি। এই লোকটাকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। একমাসের মধ্যে অন্য কাজ দেখে নেব। এই অন্য কাজ দেখে নেবার ব্যাপারটা তো আমাকে ইন এনি কেস করতেই হবে। বদমায়েসটা তো আমাকে একমাসের বেশি রাখবে না। তাই তোমার কাজটা নিলে আমার তো বাড়তি কোনও ক্ষতি নেই।’

আদিত্য দেখল এই সঙ্কটের মুহূর্তেও নূপুরের মাথা পরিষ্কার কাজ করছে। মনে মনে সে নূপুরের তারিফ না করে পারল না। মুখে বলল, ‘এখন তুমি মাসে কত টাকা পাচ্ছ?’

‘পঁচিশ হাজার দিচ্ছে আদিত্যদা। তবে তুমি যদি দু-চার হাজার কম দাও তাও আমি তোমার চাকরি করতে রাজি আছি। ওই লোকটার কম্পানিতে কাজ করা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

‘আমি তোমাকে চল্লিশ হাজার দেব। কারণ আমার কাজটাতে ঝুঁকি আছে। টাকাটা অবশ্য আমি দিচ্ছি না, আমার ক্লায়েন্ট দিচ্ছে। সে ওই চল্লিশ হাজারই দেবে। তুমি ঝুঁকির কাজ করতে রাজি তো?’

‘কী রকম ঝুঁকি? আমাকে কী করতে হবে খুলে বললে ভাল হতো।’

‘একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে। হয়ত কেউ তাকে কিডন্যাপ করেছে। কিংবা হয়ত সে নিজেই লুকিয়ে রয়েছে। আমাদের ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করতে হবে। মেয়েটি বসিরহাটে একটা ইস্কুলে পড়াত। তোমাকে সেখানে যেতে হবে। অন্য কোনও আইডেন্টিটিতে। গিয়ে ওখানকার পরিবেশটা বুঝতে হবে। এবং আমাকে রিপোর্ট করতে হবে। তুমি একটা কাজ করতে পার। ওই ইস্কুলে গিয়ে বলতে পার, তুমি শুনেছ ওখানে একটা চাকরি খালি আছে। যদি জিজ্ঞেস করে কোথায় শুনেছ, বোলো, এটা তো সকলেই জানে এখানকার একজন দিদিমনি কাউকে না বলে চলে গেছে। আমি সেই দিদিমনির কাজটা চাইছি। যতদিন না ওই দিদিমনি ফিরে আসে, অন্তত ততদিন আমাকে কাজটা করতে দেওয়া হোক। আমার ধারণা কাজটা তুমি পেয়ে যাবে।’

‘এতে আর ঝুঁকি কী আছে?’

‘ঝুঁকি আছে। প্রাণের ঝুঁকি। যদি কেউ ওই দিদিমনিকে সরিয়ে দিয়ে থাকে সে তোমার আসল পরিচয় জানতে পারলে তোমাকেও রেয়াত করবে না। পুরো গল্পটা বললে তুমি আরও ভাল করে বুঝতে পারবে। কিন্তু পুরো গল্পটা শোনার আগে আমাকে বলতে হবে তুমি কাজটা করতে রাজি আছ কিনা।’

‘অবশ্যই রাজি আছি। কাজটা আমার বেশ এক্সাইটিং লাগছে। অন্তত বারো ঘন্টা বসে বসে কম্পিউটারে কাট-পেস্ট করার থেকে হাজার গুণে ভাল। তাছাড়া আমার টাকা-পয়সার এখন যা অবস্থা, চল্লিশ হাজার টাকা পেলে আমি রাস্তা ঝাঁট দিতেও রাজি। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে। তুমি নিজে না গিয়ে আমাকে পাঠাচ্ছ কেন?’

‘দুটো কারণে। এক, ওখানকার লোকে জানে আমি একজন গোয়েন্দা। আমি ওই দিদিমনির ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করছি। তাই ওখানে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। লোকে আমাকে চিনে ফেলবে। দুই, ওই হারিয়ে যাওয়া দিদিমনি, যার নাম চন্দ্রলেখা সেন, এর আগে পুরুলিয়ার একটা ইস্কুলে পড়াতেন। আমি এখন সেখানে যাচ্ছি। হয়ত সেখানেও কোনও লিড পেতে পারি। একসঙ্গে তো আর দুটো জায়গায় যাওয়া যায় না।’

‘বুঝেছি। আমি বসিরহাট যাব। তুমি আমাকে পুরো গল্পটা বল।’

‘বলছি। তার আগে বলি, তুমি যে আমার হয়ে কাজ করছ সেটা তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না, বুঝেছ? কেউ না মানে একেবারে কেউ না।’

‘বুঝেছি।’ নূপুর মণ্ডলের চোখ দুটো হাসছে।

(২)

শেষ কবে ট্রেনে চেপে কলকাতার বাইরে গিয়েছিল আদিত্যর মনেই পড়ে না। খুব ছোটবেলায় ছুটি পড়লেই বাবার সঙ্গে মধুপুর যাওয়া হতো। প্রত্যেক ছুটিতে একই জায়গা। মধুপুর। মধুপুরে একটা মস্ত বাড়ি ছিল তাদের। ট্রেনের গোটা একটা কামরা রিজার্ভ করে যাওয়া হতো। শুধু বাবা আর আদিত্য সেই রিজার্ভ কামরায়। বাকি লোকজন, ঠাকুর-চাকর-খানসামা, ট্রেনের অন্য কোথাও। বাংলার সীমানা পেরোলেই মাটি ঢেউএর মত ফুলে ফেঁপে উঠে ছোট ছোট পাহাড় হয়ে যেত। ট্রেনের জানলা দিয়ে সেসব পাহাড় দেখতে খুব ভাল লাগত আদিত্যর।

আরও ছোটবেলায় একবার পুরী যাওয়া হয়েছিল। মা তখন বেঁচে। পুরীর স্মৃতি আদিত্যর প্রায় নেই বললেই চলে। সমুদ্রটাও মনে নেই। শুধু মনে আছে, পুরীতে তারা যে বাড়িটায় থাকত তার সদর দরজাটা ছিল পেল্লায়, সবুজ রঙের। এইমাত্র কিছুদিন আগে একটা কাজে মুম্বই গিয়ে আদিত্য ভাল করে সমুদ্র দেখেছে।

মধুপুরের বাড়িটা যে বছর বিক্রি হয়ে গেল, সে বছর আদিত্য ক্লাশ ফোর-এ উঠেছে। সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথাও যাওয়া হল না। পাছে তার মন খারাপ হয় তাই বাবা তাকে চিড়িয়াখানা আর বোটানিকাল গার্ডেন বেড়াতে নিয়ে গেল। মাঝে মাঝেই ক্লাবে ডিনার খাওয়াল। কিন্তু সেই পাহাড়গুলোর কথা ভেবে আদিত্যর মন খারাপ আর কাটতেই চাইত না।

পুরুলিয়াগামী ট্রেনের জানলায় বসে আদিত্যর এইসব পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বাইরে কার্তিকের ধান কেটে নেওয়া মাঠ ধু ধু করছে। দ্রুত পড়ে আসছে হেমন্তের রোদ্দুর। এতদিন পরে ট্রেনে উঠেছে বলেই হোক কিংবা তার মাথার মধ্যে তখন জীবনানন্দ-সুধীন দত্তের কিছু লাইন টগবগ করে ফুটছিল বলেই হোক, আদিত্যর খুব ভাল লাগছিল, বলা যায়, ভীষণই ভাল লাগছিল। সেই ভাল লাগাটা রূপান্তরিত হচ্ছিল ধূমপানের ইচ্ছায়, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আজকাল ট্রেনে ধূমপান একেবারে নিষেধ, এমনকি এসি কোচ থেকে বেরিয়ে বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুচারটে সুখটানও চলবে না। অতএব দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে আদিত্য খড়গপুর আসার আগেই দুবার চা খেয়েছে, একবার কফি।

এক একটা রো-তে তিনটে করে সিট, তারপর প্যাসেজ, আবার তিনটে সিট। আদিত্য সিট পেয়েছে জানলার ধারে, তার পাশের দুটো সিট এতক্ষণ ফাঁকা যাচ্ছিল। বস্তুত, কামরার অনেক সিটই ফাঁকা যাচ্ছিল। খড়গপুর পৌঁছে কামরায় অনেক লোক উঠল, অনেক সিট ভর্তি হয়ে গেল। কিছু সিট ফাঁকাও রয়েছে, তার মধ্যে আদিত্যর পাশের দুটো সিটও ফাঁকা। আদিত্য ভাবছিল আহা, সিট দুটো যেন এমনই ফাঁকা থাকে।

ছিলও ফাঁকা পড়ে অনেকক্ষণ। তারপর ট্রেন যখন খড়গপুর স্টেশন ছাড়ব ছাড়ব করছে ঠিক তখন টিকিট চেকারের সঙ্গে একটি বছর তিরিশ-বত্রিশের যুবতী হাঁপাতে হাঁপাতে আদিত্যর পাশে প্যাসেজের দিকের ফাঁকা সিটটাতে এসে বসল। চেকার সাহেব তার হাতের লম্বা রিজারভেশন লিস্টটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, না। এটাতে নয়। আপনি মাঝের সিটটায় বসুন। ধারেরটায় মেদিনীপুর থেকে লোক উঠবে।’

চেকার সাহেব আদিত্যর টিকিটটা চেক করে তার হাতের কাগজে একটা টিক মেরে অন্য দিকে চলে গেলেন। যুবতী তার হাতের ব্যাগটা ওপরে মাল রাখার জায়গায় তুলে দেবার চেষ্টা করে কয়েক বার ব্যর্থ হল। আদিত্য তাকে লক্ষ করছিল, এবার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘আমাকে দিন, আমি তুলে দিচ্ছি।’

ব্যাগটা বেশ ভারি, সেটা ওপরে তুলতে গিয়ে আদিত্যকেও খানিকটা কসরত করতে হল। ব্যাগের ভেতরে থান ইঁট-টিট আছে নাকি? মেয়েটি আদিত্যর মনের ভাব বুঝতে পেরে খানিকটা কিন্তু কিন্তু গলায় বলল, ‘ব্যাগে পরীক্ষার খাতা আছে, তাই একটু ভারি।’

আদিত্য ভদ্রতা দেখিয়ে বলল, ‘না, না তেমন কিছু ভারি নয়। তবে একা আপনার পক্ষে হয়ত নামাতে অসুবিধে হবে। আমি তো সেই পুরুলিয়া অব্দি যাচ্ছি। নামাবার সময় আমাকে বলবেন।’

‘আমিও পুরুলিয়া অব্দি যাব। আপনি কি পুরুলিয়াতেই থাকেন?’

‘না, না। আমি কলকাতায় থাকি। পুরুলিয়ায় কাজে যাচ্ছি। দুতিন দিন থাকব। আপনি পুরুলিয়ায় থাকেন?’

ট্রেন চলতে শুরু করেছে। মেয়েটি উত্তর না দিয়ে জানলার বাইরে তাকাল। যেন কাউকে খুঁজছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে মধ্য তিরিশের একটি ছিপছিপে চেহারার চাপ দাড়িওলা যুবক হাত নাড়ছে। মেয়েটিও তাকে দেখে বিষন্নভাবে হাত নাড়ল। ট্রেন এখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আদিত্যর মনে পড়ে গেল খড়গপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নাকি পৃথিবীর দীর্ঘতম। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। জানলা দিয়ে অনেক দূরে জ্বলতে থাকা দুএকটা মিটিমিটি আলো ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। আদিত্য জানলা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে হাতের বইটাতে চোখ রাখল।

‘জিজ্ঞেস করছিলেন না আমি পুরুলিয়ায় থাকি কিনা।’ মেয়েটি আবার কথা বলতে শুরু করেছে। ‘ওই যে জানলা দিয়ে যাকে হাত নাড়লাম, ও আমার স্বামী। খড়গপুরে থাকে, আই আই টি-তে পড়ায়। আমার পাকাপাকি সংসার আই আই টি ক্যাম্পাসে। কিন্তু চাকরি সূত্রে পুরুলিয়ায় থাকতে হয়।’

‘আপনিও নিশ্চয় কোথাও পড়ান? সঙ্গে পরীক্ষার খাতা রয়েছে যখন।’ মেয়েটিকে আদিত্যর ইন্টারেস্টিং লাগছে।

‘হ্যাঁ, আমিও পড়াই। রঘুনাথপুর কলেজে অঙ্ক পড়াই। অর্ণব, মানে আমার স্বামী, আই আই টি-তে ওই অঙ্কই পড়ায়।’

আদিত্য ভাবল বলে সে-ও এক সময় অঙ্ক পড়ত। কিন্তু বলার মতো কোনও লেখাপড়া তো সে করেনি। তাই সে প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কি কলকাতার?’

‘আমরা দুজনেই কলকাতার। আমি বড় হয়েছি উত্তর কলকাতায়। সুকিয়া স্ট্রিটে আমাদের বাড়ি। আমার স্বামীদের বাড়ি যাদবপুর। আমরা দুজনেই প্রেসিডেন্সিতে অঙ্ক পড়তাম। তবে অর্ণব আমার থেকে দুবছরের সিনিয়ার ছিল।’

‘কলকাতা খুব মিস করেন?’

‘সত্যি বলতে কি আজকাল আর করি না। বরং কলকাতায় গেলে কদিনেই হাঁপিয়ে উঠি।’

আদিত্য হাতের বইটা বন্ধ করে রাখল। সামনে একটা বড় দল দুতিনটে রো জুড়ে বসে হুল্লোড় করছে। মশলামুড়িওলা তার বেসাতি নিয়ে হাঁকতে হাঁকতে কামরার এমাথা থেকে ওমাথা অব্দি চলে গেল। বোধহয় কেউ মশলামুড়ি কিনবে। আদিত্য টের পেল তার পেছনে দাঁড়িয়ে মুড়িওলা টিনের মধ্যে মশলামুড়ি মাখছে। মেয়েটি আবার কথা বলতে শুরু করেছে।

‘বলুন, এই বাজারে কি চাকরি ছাড়া যায়? তাই কষ্ট হলেও চাকরিটা চালিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া আমাদের প্রফেশনে এখনও বেশ ছুটি-ছাটা আছে।’

‘আপনি পুরুলিয়ায় থাকেন কিন্তু রঘুনাথপুরে পড়ান?’

‘হ্যাঁ। একটু ট্র্যাভেল করতে হয়। কী করব? রঘুনাথপুরে ভাল থাকার জায়গা পাওয়া শক্ত। তাছাড়া শহরের অন্যান্য ফেসিলিটিও তেমন নেই। সব থেকে বড় কথা, পুরুলিয়া থেকে যেমন খড়গপুর যাবার অনেক ট্রেন, বহির্জগতের সঙ্গে রঘুনাথপুরের কানেক্টিভিটি তেমনি খারাপ।’

‘আপনি কোন সালে প্রেসিডেন্সি থেকে পাশ করেছেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘আমি পাশ করেছি দুহাজার দশে। অর্ণব আরও দুবছর আগে। কেন জিজ্ঞেস করছেন বলুন তো?’

‘কৌতুহল বলতে পারেন। আসলে আমিও প্রেসিডেন্সি থেকে ওই অঙ্ক নিয়েই পাশ করেছিলাম। তবে আপনার ষোলো বছর আগে।

‘আপনিও প্রেসিডেন্সি এবং অঙ্ক! কী আশ্চর্য কোয়েন্সিডেন্স!’ মেয়েটির গলায় বিস্ময়।

‘আপনার সঙ্গে ফর্মাল আলাপটা এই ফাঁকে সেরে নিই।’ আদিত্য নরম গলায় বলল, ‘আমার নাম আদিত্য মজুমদার।’

‘আমি সুরঞ্জনা চক্রবর্তী। আগেই বলেছি, রঘুনাথপুর কলেজে পড়াই। আপনার প্রফেশনটা জানা হয়নি।’

‘বি এস সির পর নানা কারণে আমার আর লেখাপড়া করা হয়নি। এখন ছোটোখাটো একটা ব্যবসা করি।’ আদিত্য সাবধানে জানাল। তারপর একটু থেমে বলল, ‘আমাদের সময়ের তুলনায় আপনাদের সময় কলেজটা কিন্তু অনেক বদলে গিয়েছিল। আমি দুএকবার গিয়ে চিনতেই পারিনি।’ আদিত্যর গলায় একটু দুঃখ ছিল। বোধহয় বয়েস হয়ে যাবার দুঃখ।

‘তা হয়ত গেছিল, কিন্তু এখন যদি যান তাহলে মনে হবে অন্য কোথাও চলে এসেছেন। অবশ্য এখন ইচ্ছে করলেই কলেজে ঢুকতে পারবেন না। আই ডি লাগবে। অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে কেন ঢুকতে চাইছেন।’ সুরঞ্জনার গলায় বেশ বিরক্তির ছাপ।

আদিত্যর মনে পড়ে গেল তাকেও একটা কাজে খুব শিগগির প্রেসিডেন্সিতে যেতে হবে।

ট্রেনটা ভালই চলছে। মেদিনীপুর থেকে এক মধ্যবয়স্ক মারোয়াড়ি ভদ্রলোক উঠে সুরঞ্জনার পাশের সিটটার দখল নিয়েছেন। তারপর ট্রেন মেদিনীপুর ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই যে ঈষৎ নাসিকাগর্জন সহ ঘুমোতে শুরু করেছেন, এখনও ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। আদিত্যর সময়টা মোটামুটি কেটে যাচ্ছিল। কখনও সুরঞ্জনার সঙ্গে হালকা কথা বলে, কখনও কোনও স্টেশনে ট্রেন থামলে সেই স্টেশনের দৃশ্য দেখে। কত চেনা চেনা নাম। শালবনী, গড়বেতা, চন্দ্রকোনা রোড, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া। এসব নাম আদিত্য অনেক শুনেছে, তবে কখনও চাক্ষুস দেখতে পাবে, ভাবেনি। এর মধ্যে সুরঞ্জনার সঙ্গে একবার চা খেয়েছে, একবার কফি। আর সুরঞ্জনার কৌটো থেকে চমৎকার ভাজা মশলা।

ট্রেন ঝন্টিপাহাড়ি স্টেশন পেরিয়ে যখন আদ্রার দিকে চলেছে, সুরঞ্জনা বলল, ‘আজ ট্রেনটা দারুণ যাচ্ছে। বিফোর টাইম পৌঁছে যাবে মনে হয়। আপনি পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে কোনদিকে যাবেন?’

‘আমি হোটেল গগনে যাব। হোটেলই গাড়ি পাঠাবে বলেছে।’

‘তাহলে তো কোনও চিন্তাই নেই। হোটেল গগন পুরুলিয়ার বেস্ট হোটেল। খুব ডিপেন্ডেবল। আমার জন্য আমার বন্ধু গাড়ি নিয়ে আসবে। ওকে ফোনে পেলাম না। মেসেজ করে দিয়েছি। আশা করি পেয়েছে।’

‘পুরুলিয়ায় আপনি কি বাড়ি ভাড়া করে থাকেন?’

‘ও হো, সেটাই তো বলা হয়নি। আমরা তিন বন্ধু মিলে একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকি। তিনজনেই রঘুনাথপুর কলেজে পড়াই। ওদেরই একজন গাড়ি নিয়ে আসবে। অন্যজন কলকাতায় গেছে, কাল ফেরার কথা।’ একটু থেমে সুরঞ্জনা বলল, ‘আমরা তিনজন মিলে একটা গাড়ি কিনেছি। সেটাই আমাদের কলেজে নিয়ে যায়। কলেজ থেকে বাড়ি নিয়ে আসে।’

‘চমৎকার ব্যবস্থা।’ আদিত্য না বলে পারল না।

আদ্রা স্টেশন থেকে বেরিয়ে খানিক দূর যাবার পর ট্রেনটা হঠাৎ মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল। নিশ্চয় আগে এসে গেছে বলে সিগনাল পাচ্ছে না।

সুরঞ্জনা বলল, ‘আমার ব্যাগটা একটু নামিয়ে দেবেন প্লিজ।’

ব্যাগটা নামাতে নামাতে আদিত্য দেখল বেশির ভাগ যাত্রীই মালপত্তর গুছিয়ে যাত্রাশেষের তোড়জোড় করছে। সুরঞ্জনার ব্যাগটা নামিয়ে দিয়ে সে নিজের সুটকেসটাও নিচে নামিয়ে রাখল। কিন্তু তারপর পনের মিনিট কেটে গেল ট্রেন ছাড়ার নামগন্ধ নেই।

যাত্রীরা সকলেই উসখুস করছে। দেখতে দেখতে সাড়ে দশটা বেজে গেল, এগারোটা বেজে গেল, ট্রেন তখনও একইভাবে ঠায় মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। সোয়া এগারোটা নাগাদ চেকার সাহেব হঠাৎ কোথা থেকে আবির্ভূত হলেন। হয়ত পাশের কোনও কামরায় ছিলেন, ভেস্টিবিউল গাড়ি বলে চলে আসতে পেরেছেন।

চেকার সাহেব বললেন, ‘সামনে মালগাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। নতুন ইঞ্জিন এসে মালগাড়িটাকে না সরানো অব্দি এই গাড়ি যেতে পারবে না। আপনারা দয়া করে ধৈর্য ধরে বসুন।’

 যাত্রীদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল। ‘কতক্ষণ লাগবে?’ ‘কতক্ষণ বসে থাকতে হবে?’ যাত্রীদের এইসব হাজারো প্রশ্ন এড়িয়ে চেকার সাহেব দুটি কামরার সংযোগস্থল দিয়ে পাশের কামরায় চলে গেলেন। সম্ভবত সেখানে দুঃসংবাদটা জানানোর জন্য।

আদিত্য চুপচাপ বসে আছে। ভগবান তাকে আর কিছু না দিক প্রচুর ধৈর্য দিয়েছে। সুরঞ্জনা কিন্তু ক্রমশই অধৈর্য হয়ে উঠছিল। বারবার সে তার বন্ধুকে মোবাইলে ফোন করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু এই মাঠের মধ্যে টাওয়ার পাওয়া অসম্ভব। কামরার এসিটা অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথমে কিছুক্ষণ কামরাটা ঠাণ্ডাই ছিল। এখন বেশ গরম লাগতে শুরু করেছে। বিশেষ করে যেহেতু এসি কামরা বলে জানলাগুলো খোলাই যায় না, তাই কামরার ভেতরে ভ্যাপসা গরম। এইভাবে যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে ঘড়িতে যখন পৌনে বারোটা বেজেছে তখন ট্রেনটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল।

পুরুলিয়া এক্সপ্রেস যখন পুরুলিয়া স্টেশনে ঢুকল তখন রাত্তির বারোটা বেজে দশ মিনিট। জনমানবহীন স্টেশন। ট্রেন থেকে যে কজন নামল, মনে হচ্ছে ওই কটাই লোক স্টেশনে রয়েছে। আদিত্য সুরঞ্জনার সঙ্গেই নেমেছে। তার নিজের সুটকেসটা চাকা লাগানো, টানতে অসুবিধে হয় না। সুরঞ্জনার ব্যাগটা সে অন্য হাতে নিয়েছে। এই সঙ্কটের মুহূর্তে সুরঞ্জনাও আদিত্যর কাছ থেকে এই সাহায্যটুকু নীরবে মেনে নিচ্ছে।

স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখা গেল সুরঞ্জনার গাড়ি আসেনি। তবে আদিত্যর হোটেলের গাড়ি সামনেই অপেক্ষা করছে। এতক্ষণ পরে সুরঞ্জনা তার বন্ধুকে ফোনে ধরতে পারল। সে যা ভয় করছিল সেটাই হয়েছে। তার মেসেজ পৌঁছয়নি। ফলে বন্ধু জানেই না সে আসছে। ড্রাইভার ছুটি নিয়ে সন্ধেবেলা বাড়ি চলে গেছে। এখন তাকে ধরা অসম্ভব।

আদিত্য তার গাড়ির ড্রাইভারকে বলল, ‘ভাই, এই মেমসাহেবের বাড়ি থেকে গাড়ি আসেনি। এত রাত্তিরে উনি কী করে বাড়ি যাবেন? তুমি ওঁকে বাড়িতে নামিয়ে তারপর আমাকে হোটেলে নিয়ে যাবে। যা বাড়তি টাকা লাগবে আমি তোমাকে দিয়ে দেব। তাছাড়া আগামী তিনদিনও তো তোমার গাড়ি আমার লাগবে।’

এটা ভাড়ার গাড়ি। হোটেল আদিত্যর জন্য ভাড়া করে দিয়েছে। আরও তিনদিন ভাড়া পাওয়া যাবে জেনে ড্রাইভার খুশিই হল। আগামী তিনদিনের মালিককে সে চটাতে চায় না। তাই মেমসাহেবকে পৌঁছে দিতে সে রাজি হয়ে গেল।

রাত্তির একটার সময় একটা ছিমছাম দেখতে দোতলা বাড়ির সামনে সুরঞ্জনাকে নামিয়ে দিল আদিত্য। গাড়ির শব্দ পেয়ে সুরঞ্জনার বন্ধু নিচে নেমে এসেছে। ‘আমার বন্ধু জয়ন্তী ঘোষ।’ সুরঞ্জনা আলাপ করিয়ে দিল।

‘আপনি না থাকলে সুরঞ্জনার আজ কী যে হত! আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না।’ ভদ্রমহিলার গলায় কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছে।

‘না, না। ওইভাবে হবে না। আপনি তো শুক্রবার ভোরে চলে যাচ্ছেন। তার আগের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দুপুরে আপনি আমাদের বাড়িতে দুপুরে খাচ্ছেন। কোনও আপত্তি শুনব না। আমার নম্বরটা বলছি। একটা কল করুন। আপনার ফোন নম্বরটা আমি সেভ করে রাখব। আপনাকে বৃহস্পতিবারের ব্যাপারটা বুধবার রাত্তিরে আবার মনে করিয়ে দেব।’ সুরঞ্জনা কোনও আপত্তি শুনবে বলে মনে হল না।

আদিত্য যখন তার হোটেলে পৌঁছল তখন রাত্তির পৌনে দুটো।

(৩)

আদ্রা পুলিশ স্টেশনের অফিসার ইন চার্জ সঞ্জয় বারিক সহৃদয় মানুষ। অন্তত টেলিফোনে কথা বলে আদিত্যর সেরকমই মনে হল। হয়ত এই সহৃদয়তার পেছনে সমাদ্দারের বলে দেওয়াটাও কাজ করেছে। সে যাই হোক, তিনজনের সঙ্গে সঞ্জয় দেখা করতে বলেছে। তার মধ্যে একজনের নাম বিজয় মাহাতো। সে গ্রামের বড়লোক। কিছুদিন আগে তার দাদা শঙ্কর মাহাতোকে মাওবাদীরা কুপিয়ে মেরেছিল। এ ছাড়াও সঞ্জয় বারিক দুজনের সঙ্গে দেখা করতে বলছে। দুজনেই এক সময় মাওবাদীদের দলে ছিল। এখন চাষবাসের কাজ করে। এদের মধ্যে একজন, নাম লক্ষ্মণ হাঁসদা, বলেছে বেলা বারোটা নাগাদ আদিত্যর হোটেলে এসে দেখা করবে। অন্যজন, নাম তরুণ মির্ধা, আসবে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ। সেও আদিত্যর হোটেলেই আসবে। এদের সঙ্গে আদিত্যর সরাসরি কথা হয়নি, সঞ্জয় বারিকই এদের দুজনের সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সঞ্জয় বারিক এটাও বলেছে যে আদিত্যর সঙ্গে কথা বলার জন্য এরা একটা পারিশ্রমিক আশা করবে।

বিজয় মাহাতোকে অবশ্য টাকা-পয়সা দেবার কোনও ব্যাপার নেই। সে গ্রামের অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। তার সঙ্গে আদিত্যকেই সরাসরি যোগাযোগ করতে হবে। কাজটা আদিত্য পরের দিনের জন্য রেখে দিয়েছে। সঞ্জয় বারিক বলছে, খুব সকাল সকাল বেরিয়ে বিজয় মাহাতোর গ্রামে পৌঁছে যেতে পারলে তাকে বাড়িতেই পাওয়া যাবে। তবে সে আদিত্যর সঙ্গে কথা বলতে চাইবে কিনা সঞ্জয় বারিক জোর দিয়ে বলতে পারছে না।

আগের রাত্তিরে আদিত্যর ঘুম হয়নি বললেই চলে। বেলায় উঠে সঞ্জয় বারিককে ফোন করে সব বন্দোবস্ত করতে করতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। হোটেলের ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্টের সময় পেরিয়ে গেছে। এদিকে বেশ খিদে পেয়ে গেছে আদিত্যর। খিদের আর দোষ কী, কাল রাত্তিরে তো ডিনারই খাওয়া হয়নি। রুম সার্ভিসে কফি, টোস্ট, ডিমের পোচের সঙ্গে একটা আলুভাজার প্লেটও অর্ডার দিয়ে দিল আদিত্য। যা খিদে পেয়েছে, শুধু ডিম-পাঁউরুটিতে পেট ভরবে না। খাবারটা আসতে বেশ দেরি করল। ব্রেকফাস্ট খেয়ে চান-টান করে যখন সে একটু ধাতস্থ হয়েছে তখন বারোটা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই। বারোটা বেজে পাঁচ মিনিটে টোকা পড়ল দরজায়।

লক্ষ্মণ হাঁসদা বলল তাকে লখা বলে ডাকতে। পাকানো, ছোটখাট চেহারা, পুরোনো দিনের গ্রামাফোন রেকর্ডের মতো ঘন কালো গায়ের রঙ। কালো মুখে ঝকঝকে একসারি দাঁত। কথায় কথায় হাসে। হাসিটা মিষ্টি।

‘তোমার বাড়ি শহর থেকে কত দূর?’ আদিত্য কথাবার্তা শুরু করার জন্য জিজ্ঞেস করল।

‘খুব দূরে নয়। পুরুলিয়া শহর থেকে বেরিয়ে বত্রিশ নম্বর ন্যাশানাল হাইওয়ে ধরে ধানবাদের দিকে আধঘন্টা গেলে একটা ছোট রাস্তা ডানদিকে বেঁকে গেছে। ওই রাস্তাটা ধরে আরো পনের মিনিট হাঁটলে আমার গ্রাম।’ লখা হাঁসদা মিষ্টি করে হাসল।

‘এলে কী করে? বাস আছে?’

‘বাস আছে, তবে হাইওয়ে দিয়ে চলে না। বাসের জন্যে অনেকক্ষণ দাঁড়াতেও হয়। আমি টোটো করে এলাম। হাইওয়ের পাশ দিয়ে টোটো চলে। তারপর পুরুলিয়া পৌঁছে এইটুকু অটোতে।’

‘একটু চা-জলখাবার খাও। অনেক দূর থেকে এসেছ।’ লখা আপত্তি করল না।

আদিত্য ফোন করে পুরি-তরকারি, গুলাব জামুন আর চায়ের অর্ডার দিল। রুম সার্ভিসকে বলল একটু তাড়াতাড়ি খাবারটা দিতে। আগেরবারের মতো দেরি যেন না হয়।

‘আপনি খাবেন না?’ লখা আদিত্যর দিকে তাকিয়ে হাসল।

‘না গো। এই একটু আগে ডিম-পাঁউরুটি খেয়েছি। শুধু চা খাব।’ একটু থেমে আদিত্য বলল, ‘তোমার কথাবার্তা কিন্তু বেশ শহুরে। একটুও গ্রামের টান নেই।’

‘আমরা রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই ছোট বয়েসেই অনাথ হয়েছিলাম। ফাদারের কাছে মানুষ হয়েছি। ফাদার আমাদের খ্রীষ্টান করে নিয়েছিল। আমার পুরো নাম লক্ষ্মণ পিটার হাঁসদা, দাদার নাম রাম ডমিনিক হাঁসদা।’

‘ফাদারের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখ না?’

‘ফাদার আর নেই। অনেক বয়েস হয়েছিল। শেষ বয়েসে বেলজিয়াম ফিরে গিয়েছিল। শুনেছি ওখানেই মারা গেছে। রঘুনাথপুরের কাছে ফাদারের একটা ডিসপেনসারি ছিল। কিছু জমিজমাও ছিল। আমরা সেখানেই কাজ করতাম। ফাদার চলে যাবার পরে চার্চের লোক এসে সেসব বিক্রি করে দিল। ডিসপেনসারি ভেঙে ইটভাটা হল। আমরা দুই ভাই আবার অনাথ হয়ে গেলাম।’

‘মাওবাদীদের দলে নাম লেখালে কেন?’ আদিত্য হঠাৎ প্রশ্নটা করে ফেলল। বারিক বলেছিল, লক্ষ্মণ হাঁসদা দলে থেকে ভেতরের খবর দিত।

উত্তরটা এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। ‘চারদিকে এত অন্যায়। মানুষের পেটে ভাত নেই, তেষ্টার জল নেই, রোগ হলে বিনা চিকিৎসায় কুকুর-বেড়ালের মতো মরে যায়। আর এদিকে অল্প কিছু লোক, যাদের জমিজমা আছে, টাকার জোর আছে, গরিবের ওপর জুলুম চালায়। আর সরকারও তাদের মদত দেয়। খুব রাগ হতো। ভাবতাম সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেব।’

‘দুই ভাই একসঙ্গে ওদের দলে যোগ দিলে?’

‘একসঙ্গেই ওদের দলে নাম লেখালাম। দাদা আর আমি সব কাজ একসঙ্গে করতাম। আমাদের কেউ আলাদা করতে পারত না।’

‘দলের সঙ্গে গন্ডগোল হল কেন?’

লখা পিটার হাঁসদার চোয়ালটা শক্ত হল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘দল দাদাকে খুন করল। বাঘ মারার জন্যে যেমন ছাগলকে টোপ রাখা হয়, তেমনি দাদা আর বিজুকে টোপ হিসেবে রাখা হয়েছিল। ওদের বন্দুক নিয়ে এগিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, দুজন মিলিটারির জওয়ান ভুল করে জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে, ওদের খতম করে দিতে হবে। আসলে দুজন নয়, একটা পুরো ট্রাক ভর্তি মিলিটারি জঙ্গলে ঢুকে এসেছিল। দাদা আর বিজুকে দেখে ওরা গুলি চালাল। দাদারাও পালটা গুলি চালালো। কিন্তু অতগুলো জোয়ানের সঙ্গে ওরা মাত্র দুজন কী করে পারবে? মিলিটারিরা ওদের ঘিরে ফেলে গুলিতে গুলিতে শরীর ঝাঁঝরা করে দিল। তারপর যখন মিলিটারিগুলো একটু অসতর্ক হয়ে দাদা আর বিজুর বডি দুটো ট্রাকে তুলছে, ভাবছে কাছাকাছি আর কোনও জঙ্গী নেই, ঠিক তখন আমাদের আসল দলটা পেছন থেকে এসে মিলিটারিদের আক্রমণ করল। একটা মিলিটারিও সেদিন বেঁচে ফিরতে পারেনি। একত্রিশ জন জওয়ান খতম। ট্রাকটাও জ্বালিয়ে দেওয়া হল। দাদা আর বিজুর বডিগুলো পাওয়া যায়নি। কেউ পাবার চেষ্টাও করেনি। ট্রাকের সঙ্গেই জ্বলে গেছিল।’

লখা থামল। ঘরের আবহাওয়া বেশ ভারি হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই দরজায় টোকা। রুম সার্ভিস খাবার নিয়ে এসেছে। আবহাওয়াটা সহজ করার জন্য আদিত্য দুটো কাপে চা ঢালল। লখার জন্য চায়ে দুধ মেশাল সঙ্গে উপুড়-চুপুড় দুচামচ চিনি। তার নিজের জন্য দুধ-চিনি ছাড়া কালো চা।

‘খেয়ে নাও।’ আদিত্য খুব নরমভাবে বলল।

একটু পরে, যখন লখার খাওয়া শেষ হয়েছে, সে গেলাসের জল প্লেটে ঢেলে হাত ধুয়ে নিয়েছে, শব্দ করে চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়েছে, তখন আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘দলটা কে চালাত?’

‘দলের কমান্ডার ছিল অভিজিৎ সিং। সে-ই আমাদের অর্ডার দিত। অ্যাকশনের সময় সে দলের সঙ্গেই থাকত। তবে পেছন দিকে।’

‘অভিজিৎ সিং-এর ওপরে আর কেউ ছিল?’

‘বলতে পারব না। হয়ত ছত্তিসগড়ে আরও বড় যে মাওবাদী দলটা আছে তাদের কাছ থেকে কখনও কখনও নির্দেশ আসত। তবে আমি সঠিক বলতে পারব না।’

‘তোমার সঙ্গে অভিজিৎ সিং-এর কথা হতো?’

‘না। আমি তো নিচু র‍্যাঙ্কের সোলজার ছিলাম। আমার সঙ্গে কমান্ডার কেন কথা বলবে। তবে একদিন পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল। যেদিন ওরা দাদাকে খুন করল সেদিন। অপরেশনের সময় অভিজিৎ সিং পেছন দিকে ছিল। জওয়ানগুলো মরে যাবার পর একবার সামনে এসেছিল। সবাইকে সাবাসি দিচ্ছিল। আমাকেও দিল। পুরোটাই নাকি ছিল ওর প্ল্যান। এটা অবশ্য পরে শুনেছিলাম। তখন যদি জানতাম ও দাদাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে, ওকে গুলি করে মেরে ফেলতাম।’

‘অভিজিত সিং সম্বন্ধে আর কিছু বলতে পার?’

‘দেখতে খুব সুন্দর। সিনেমা আর্টিস্টের মতো। আর প্রচণ্ড মাগীবাজ। মেয়ে দেখলে নিজেকে সামলাতে পারত না। দলের মেয়েদের সঙ্গেও ফষ্টিনষ্টি করত। দলের ছেলেরা এটা ভাল চোখে দেখত না। তবে মেয়েরা ওকে দেখলেই পটে যেত। শুনেছি পুরুলিয়া, রাঁচি, পাটনা সব যায়গায় ওর আলাদা আলাদা মেয়েমানুষ ছিল।’

সাড়ে তিনটে বেজে গেল পুলিশের অন্য ইনফর্মার তরুণ মির্ধা এখনও এল না। চারটে বেজে গেল, সাড়ে চারটে বেজে গেল। আদিত্য প্রথমে ভাবছিল হয়ত অনেক দূর থেকে আসছে বলে দেরি হচ্ছে। কিন্তু ঘড়িতে যখন প্রায় পাঁচটা বাজতে চলেছে তখন আদিত্যর মনে হতে লাগল যে কোনও কারণেই হোক তরুণ মির্ধা আজ আর আসছে না। সে সঞ্জয় বারিককে ফোন করল। বারিক একটু পরে আদিত্যকে ফোন করে জানাল তরুণ মির্ধার ফোন সুইচট অফ আছে।

খুব দরকার ছিল তরুণ মির্ধার সঙ্গে কথা বলার। এই ব্যক্তিই পুলিশের কাছে মাওবাদীদের এক্স্যাক্ট লোকেশনগুলো জানাত। সেই ইনফর্মেশন অনুযায়ী পুলিশ অনেকগুলো এনকাউন্টার করেছে।

সাড়ে পাঁচটার সময় আদিত্য ঠিক করল আর সময় নষ্ট করার মানে হয় না। তরুণ মির্ধা আজ আসছে না। সে সঞ্জয় বারিকের নম্বরটা ডায়াল করল।

‘তরুণ মির্ধা তো মনে হচ্ছে আর আসবে না। তাহলে আপনার সঙ্গে কি আজ সন্ধেবেলা দেখা করা যেতে পারে?’

‘আমি আটটা সাড়ে আটটা অব্দি পুলিশ স্টেশনেই আছি। আপনি চলে আসুন।’ সঞ্জয় বারিক জানাল।

গাড়িটা সারাদিন হোটেলের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য গাড়ির কাছে গিয়ে দেখল ড্রাইভার সিটটা পেছন দিকে করে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। দোষ দেওয়া যায় না। কাল রাত্তিরে তো ওরও ঘুম হয়নি। পুরুলিয়া থেকে পাঁচ নম্বর স্টেট হাইওয়ে ধরে, হাতুয়ারা, গুড়গুড়িয়া, চাপারি হয়ে আদ্রা পুলিশ ফাঁড়িতে পৌঁছতে প্রায় এক ঘন্টা পনের মিনিট লেগে গেল।

সঞ্জয় বারিক আদিত্যর জন্যই অপেক্ষা করছিল। আদিত্যকে ঢুকতে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি আদিত্যবাবু তো। আসুন আসুন। আপনার জন্যেই বসে আছি।’ তারপর এক কনেস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চা নিয়ে এসো। আর কচুরি-জিলিপি। আমাদের এখানকার কচুরি একবার খেলে ভুলতে পারবেন না স্যার। এই সন্ধের মুখটাতে ভাজে।’ শেষের কথাগুলো বলাই বাহুল্য আদিত্যকে লক্ষ্য করে।

আদিত্য দুএকবার আপত্তি করে রাজি হয়ে গেল। লাঞ্চটা সে খুব হালকা খেয়েছে।

কচুরি-জিলিপি ভক্ষণ সমাধা হবার পর চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘বারিক সাহেব, আপনি তো ওই স্পেশাল টাস্ক ফোর্সটাতে ছিলেন যেটা মাওবাদীদের ফাইট করার জন্য তৈরি হয়েছিল?’

‘অবশ্যই ছিলাম। ইন ফ্যাক্ট টাস্ক ফোর্স তৈরি হবার ঢের আগে থেকেই আমি পুরুলিয়ায় পোস্টেড ছিলাম, তাই পুরো ব্যাপারটা আমি অনেকটাই জানি।’

‘তাহলে বলুন, চন্দ্রা সেনের গতিবিধির ওপরেও আপনারা নিশ্চয় ভাল করে নজর রাখতেন।’

‘অবশ্যই। চন্দ্রা সেনের প্রতিটি মুভমেন্ট ফলো করা হতো।’

‘চন্দ্রা সেন কি খুব বেশি ট্র্যাভেল করতেন? মানে, মাঝে মাঝে জঙ্গলে গিয়ে মাওবাদী দলটার সঙ্গে যোগাযোগ করা কি তার পক্ষে সম্ভব ছিল?’

‘দেখুন, চন্দ্রা সেন জয়চণ্ডী পাহাড় জংশন স্টেশনের কাছে নীপবীথি বলে একটা ইস্কুলে ইংরেজি আর অঙ্ক পড়াতেন। এটা গরিব মেয়েদের ইস্কুল। দুপুরে এক পেট খাওয়ার লোভে অনেক গরিব ঘরের মেয়ে এখানে পড়তে আসে। ইস্কুল ছুটি হয়ে গেলে চন্দ্রা সেন বেশির ভাগ দিনই সঙ্গে সঙ্গে পুরুলিয়া ফিরে যেতেন। শুধু সপ্তাহে একদিন ওই ইস্কুল চত্বরেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। খুব মাঝে মাঝে জঙ্গলে গিয়ে মাওবাদী দলটার ক্লাশ নিতেন। বোধহয় মার্কস, লেনিন এইসব পড়াতেন। এর বাইরে আর কিছু তাকে কখনও করতে দেখা যায়নি।’

‘অভিজিৎ সিং-এর সঙ্গে চন্দ্রার কেমন সম্পর্ক ছিল?’

‘অভিজিৎ সিং মাসে অন্তত একবার নীপবীথি ইস্কুলে এসে চন্দ্রা সেনের সঙ্গে দেখা করত। সাধারণত টিফিনের সময় এই মিটিংটা হতো। ইস্কুল থেকে কিছু দূরে একটা দিঘি আছে সেই অব্দি দুজনে হাঁটতে হাঁটতে যেত। দিঘির ধারে বেঞ্চিতে কিছুক্ষণ বসত। আমরা মনে করতাম দুজনের মধ্যে একটা রোমান্টিক সম্পর্ক আছে। একটা খটকা ছিল। ওরা নিয়ম করে মাসে মাত্র একদিন দেখা করে কেন? তাও একটা বিশেষ দিনে, মাসের প্রথম মঙ্গলবারে।’

‘আচ্ছা, আপনারা কি চন্দ্রা সেনকে চব্বিশ ঘন্টাই নজরে রাখতেন?’

‘না, আমাদের অত লোক কোথায়? তবে দুতিন দিনে অন্তত একবার আমরা চন্দ্রা সেনের খোঁজ নিতাম।’

‘তাহলে তো চন্দ্রা সেন কখনও কখনও পুলিশের চোখ এড়িয়ে দলের সঙ্গে, বিশেষ করে অভিজিৎ সিং-এর সঙ্গে গিয়ে দেখা করতেও পারত?’

‘হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে এটা একেবারে অসম্ভব ছিল না।’

পুরুলিয়া ফেরার পথে সুরঞ্জনার ফোন এল। ‘কাল দুপুরের কথা মনে আছে তো?’

‘অবশ্যই মনে আছে। আমিই এ-ব্যাপারে আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আচ্ছা, দুপুরের বদলে যদি রাত্তিরে যাই তাহলে কি আপনাদের খুব অসুবিধে হবে? আসলে দিনের বেলা আমার একটু কাজ পড়ে গেছে।’

‘রাত্তিরে হলে আমাদের তো সুবিধেই হয়। আপনার কথা ভেবেই দুপুরে করছিলাম। আপনাকে তো পরের দিন খুব ভোরে ট্রেন ধরতে হবে। সেটা পারবেন তো?’

‘সে আমি ঠিক পারব। আমার রাত জাগা অভ্যেস আছে। বাকি ঘুমটা ফেরার পথে ট্রেনে মেক-আপ করে নেব। তাহলে ওই কথাই রইল। আমি রাত্তিরেই যাচ্ছি।’

‘খুব রাত্তির করবেন না। সাতটার মধ্যে চলে আসুন। তাহলে খানিকটা কথাবার্তা বলা যাবে।’

‘ঠিক আছে। কাল দেখা হবে।’

(৪)

বিজয় মাহাতোর গ্রামটা এন এইচ থার্টি টু থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে। রাস্তাটাও ভাল নয়, মাঝে মাঝে বিরাট গর্ত। দুদিকে ধানক্ষেত। একটু অসতর্ক হলেই গাড়ি সোজা ধানক্ষেতে নেমে যাবে। আদিত্য খুব ভোরবেলা বেরিয়ে পড়েছিল। পথে সে আর তার ড্রাইভার বাপি চা-সিঙাড়া খেয়েছে। বিজয় মাহাতোর গ্রামের নাম বেলতোড়া। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা আটটা হয়ে গেল। মাহাতোরা গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ। সকলেই তাদের চেনে। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা চায়ের দোকান। কয়েকজন সেখানে বসে চা খাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করতেই একজন বলল, মাহাতোদের বাড়ি তো ওই সামনেই। কিন্তু বিজয় মাহাতো বউ ছেলে নিয়ে কাল রাত্তিরে কলকাতা চলে গেছে। বাড়িতে এখন কেউ নেই। কলকাতা থেকে তারা কবে ফিরবে সেটাও বলে যায়নি।

আদিত্যর প্রচণ্ড হতাশ লাগছিল। ভোরবেলা উঠে এত কষ্ট করে এখানে আসা। সব বৃথা গেল। সে চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে বাপি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখান থেকে জয়চণ্ডী পাহাড় জংশন যেতে কতক্ষণ লাগবে?’

‘খুব টেনে চালালেও ঘন্টা দুয়েক লেগে যাবে।’

‘খুব টেনে চালানোর দরকার নেই। আমার হাতে সময় আছে। জয়চণ্ডী পাহাড় স্টেশনের কাছে নীপবীথি বলে একটা মেয়েদের ইস্কুল আছে। তুমি চেন?’

‘নামটা চেনা চেনা লাগছে। বোধহয় দেখেছি।’

‘আমাকে সেখানেই যেতে হবে। নিয়ে যেতে পারবে তো?’

‘কেন পারব না? আপনি গাড়িতে উঠে বসুন আমি আসছি।’

আদিত্য গাড়িতে বসে সিগারেট ধরাল। বাপি মাঠের মধ্যে নেমে গেছে। নিশ্চয় প্রকৃতির ডাক। সামনে একটা দিঘি। পাড়ের দিকটা কচুরিপানায় ভর্তি। মাঝখানে টলটলে জল। কচুরিপানার ওপর ফুল ফুটেছে। একটা খুব ছোট্ট পাখি ফুলের ওপর বসে দোল খাচ্ছে। বোধহয় মধুও খাচ্ছে। পাখিটার মধু খাওয়ার কেরামতি দেখতে দেখতে হঠাৎ অজ পাড়াগাঁয়ের এই সকালটা আদিত্যর ভীষণ ভাল লেগে গেল। ভোরে ওঠা সার্থক হয়েছে।

‘গাড়ি ছাড়ব?’ বাপি ড্রাইভার গাড়িতে ফিরে এসেছে।

পরের দুঘন্টার মধ্যে দেড় ঘন্টা আদিত্যর ঘুমিয়েই কাটল। টানা ঘুম নয়, মাঝে মাঝে গাড়ির ঝাঁকানিতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। যতবারই ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল, আদিত্য চোখ চেয়ে দেখছিল দুদিকে সেই একই ছবি। ধান কেটে নেওয়া মাঠ, পুকুর, মরাই, কিছু একতলা বাড়ি, বাজার, মুদির দোকান, সাইকেলের দোকান। এসব দেখতে দেখতে আবার চোখ বুঝে ফেলছিল আদিত্য। ভোরে ওঠার এই এক সমস্যা, সারাদিন ঘুম পায়। তারপর একটা সময় বাপির গলার আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গেল, ‘আমরা এসে গেছি।’

সাদামাটা একটা বাড়ি, তার ঢোকার মুখে বড় বড় করে লেখা ‘নীপবীথি’। আদিত্য দরজা দিয়ে ঢুকে দেখল পুরোদমে ইস্কুল বসে গেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে চারটে বড় ঘর চোখে পড়ল। চারটেতেই ক্লাশ হচ্ছে। আর একটা ছোট ঘর আছে, তার দরজায় বাংলাতে লেখা ‘অফিস ঘর’। আদিত্য উঠোন পেরিয়ে সেই অফিস ঘরের দিকে রওনা দিয়েছিল, এমন সময় ধুতি-শার্ট পরা কালো রোগা মতো একটা লোক আদিত্যর পেছন থেকে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাবেন?’

এরকম একটা প্রশ্ন হবে আদিত্য জানত। উত্তরে কী বলবে সেটাও আদিত্য ভেবে রেখেছিল। সে বলল, ‘এখানে চন্দ্রলেখা সেন পড়ান? আমি তার সঙ্গে একটু দেখা করতে এসেছি।’

‘চন্দ্রা দিদিমনি তো অনেকদিন এখান থেকে চলে গেছেন। চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন।’

‘চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন?’ আদিত্য যতটা পারে অবাক হবার ভান করল। ‘কতদিন হল চলে গেছেন?’

‘তা চার-পাঁচ মাসের বেশি। বোধহয় ছ-মাস হবে।’

‘কোথায় গেছেন বলতে পারেন?’

‘তা তো আমি বলতে পারি না বাবু। আমি দুলাল ডোম, ইস্কুলের দরোয়ান। আমি অত খবর রাখি না। আপনি ওই আপিস ঘরে যান। দেখবেন হেড দিদিমনি বসে আছেন। ওনাকে জিজ্ঞেস করলে উনি বলতে পারবেন।’

দুলাল ডোম আদিত্যকে আপিস ঘর অব্দি পৌঁছে দিল। বাইরে থেকে ঘরটাকে যতটা ছোট মনে হয়েছিল, আদিত্য ভেতরে ঢুকে দেখল ঘরটা ততটা ছোট নয়। মাঝখানে একটা পার্টিশন। তার একদিকে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক একটা মান্ধাতার আমলের টাইপ রাইটারে দুই আঙুলে শামুকের গতিতে টাইপ করছেন। পার্টিশনের অন্যদিকে একটি চেয়ার-টেবিলে বসে ঈষৎ স্থূলকায়া এক মহিলা একটা মোটা খাতা খুলে কী যেন লিখছেন। আদিত্যর পায়ের আওয়াজে চোখ তুলে তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আদিত্য আন্দাজে বুঝে নিল ইনিই হেড দিদিমনি। সে বলল, ‘আমি চন্দ্রলেখা সেনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। এসে শুনলাম ও এখানকার চাকরি ছেড়ে চলে গেছে।’

‘চন্দ্রা তো মাস ছয়েক হলো চলে গেছে। আপনি ওর কে হন?’ ভদ্রমহিলাকে একটু সন্দিগ্ধ মনে হল।

আদিত্য এই প্রশ্নটার জন্যেও তৈরি হয়ে এসেছিল। বলল, ‘আমি ওর পুরোনো বন্ধু। একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। তবে বহুদিন দেখা হয়নি। শেষ দেখা হয়েছিল কলকাতায়, প্রায় পাঁচ-ছ বছর আগে। তখন চন্দ্রা বলেছিল, এই নীপবীথি ইস্কুলে ও পড়ায়। জায়গাটার একটা ডিরেকশনও দিয়েছিল। ডিরেকশনটা ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু কী করে জানি না আমার ইস্কুলের নামটা মনে থেকে গিয়েছিল। এদিকে কয়েকদিনের জন্য কাজে এসেছিলাম। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। তখন ভাবলাম, নীপবীথি ইস্কুলটার খোঁজ করা যাক। বেশি খোঁজ করতে হল না। আমার ড্রাইভারই বলল ইস্কুলটা চেনে। সে-ই নিয়ে এসেছে। কিন্তু তখন কি জানতাম চন্দ্রা এখান থেকে চলে গেছে। ভেবেছিলাম চন্দ্রাকে জোর একটা সারপ্রাইজ দেব।’ কথা শেষ করে আদিত্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ভদ্রমহিলার এবার খেয়াল হল আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘আপনি বসুন।’

আদিত্য একটু ইতস্তত করে ভদ্রমহিলার উল্টোদিকের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। বুকের ওপর দুহাত জড়ো করে বলল, ‘নমস্কার। আমার নাম আদিত্য মজুমদার।’

‘আমি মাধবী হালদার, এই স্কুলের হেড মিস্ট্রেস।’ ভদ্রমহিলাও দুহাত জড়ো করে নমস্কার করলেন।

‘চন্দ্রা আপনাদের এই ইস্কুলটার কথা খুব বলেছিল। বলেছিল, এখানে আপনারা গরীব মেয়েদের খুব যত্ন করে লেখাপড়া শেখান।’

‘ওই যত্ন করে কথাটা একদম সঠিক বলেছেন। আশেপাশে সরকারি স্কুলের তো অভাব নেই। সেখানে লেখাপড়াও শেখানো হয়। কিন্তু জোর গলায় বলতে পারি, আমাদের মতো এত যত্ন করে কেউ শেখায় না।’

‘এটা তাহলে সরকারি ইস্কুল নয়?’

‘না, এটা বেসরকারি। একটা এন জি ও ইস্কুলটা চালায়। তবে কিছু কিছু সরকারি সাহায্যও আমরা পেয়ে থাকি।’

‘চন্দ্রা এখন কোথায় আছে বলতে পারেন?’

‘হ্যাঁ, সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম। যে এন জি ও এই স্কুলটা চালায় সারা রাজ্যে তাদের এরকম আরও স্কুল আছে। সেই রকমই একটা স্কুলে চন্দ্রা চলে গেছে। স্কুলটা বসিরহাটে, নাম বনবীথি। এটা নীপবীথি, ওটা বনবীথি। এদের সবকটা স্কুলই ওই বীথি নিয়ে নাম। নীপবীথি, বনবীথি, কুঞ্জবীথি, কাননবীথি, এইসব। যে ভদ্রলোক এন জি ও-টা চালান, আমি যত দূর জানি, তার স্ত্রীর নাম ছিল বীথি।’

‘আমি এই অঞ্চলে একটা বড় ফার্ম করার কথা ভাবছি। গরু-মোষ-হাঁস-মুরগি থাকবে, কিছু চাষ-বাসও হবে, বিশেষ করে মাশরুমের চাষ। সেই জন্য জমি দেখতে এসেছিলাম। রঘুনাথপুর ছাড়িয়ে আরও উত্তরে একটা জমি দেখে এসেছি। তা ভাবছিলাম, এখানে এসেই যখন পড়লাম, আপনাদের ইস্কুলটা কি একটু ঘুরে দেখা যেতে পারে? আমার এই ধরনের প্রজেক্টে খুব উৎসাহ।’

‘নিশ্চয় দেখা যেতে পারে। অবশ্যই দেখা যেতে পারে।’

আদিত্যর মনে হলো সে ইস্কুলটা দেখতে চেয়েছে বলে হেড দিদিমনি খুব খুশি হয়েছেন। সে কিছু বলার আগেই মাধবী হালদার বললেন, ‘চলুন আমার সঙ্গে। আমি আপনাকে স্কুলটা ঘুরে দেখাই।’

দেখার অবশ্য খুব বেশি কিছু নেই। চারটে ঘরে ক্লাশ হয়, ওয়ান থেকে ফোর। আর একটা ঘরে ইস্কুলের আপিস আর হেড মিস্ট্রেসের বসার জায়গা। হেড মিস্ট্রেসের চেয়ারের পেছনে একটা বেতের সোফা আর কয়েকটা চেয়ার রয়েছে। ক্লাশের অবকাশে অন্য দিদিমনিরা সেখানে বসেন। হেড দিদিমনি ছাড়া আরও তিনজন দিদিমনি আছেন। তাঁরা সকলেই এখন ক্লাশ নিচ্ছেন। এছাড়া ইস্কুলের পেছন দিকে আর একটা ছোট ঘর আছে। সেখানে মিড ডে মিলের চাল ডাল আলু পেঁয়াজের বস্তা রাখা হয়। এক ঝুড়ি ডিমও রয়েছে একদিকে। হেড দিদিমনি জানালেন, সপ্তাহে একদিন মেয়েদের ডিম খাওয়ানো হয়। বাইরে থেকে মিড ডে মিলের রসদ আসে। যে এন জি ও-টা ইস্কুল চালায় সে-ই এসব পাঠায়, সে-ই এর খরচ বহন করে। তবে এই বাবদে সরকারের কাছ থেকে কিছু সাহায্যের জন্য খুব চেষ্টা করা হচ্ছে। ইস্কুলটা ঘুরে দেখতে দেখতে আদিত্য চারদিকের পরিষ্কৃতির তারিফ না করে পারল না।

‘এত সুন্দর একটা ইস্কুল, চন্দ্রা ছেড়ে চলে গেল কেন? আদিত্য আলগাভাবে জিজ্ঞেস করল।

মাধবী হালদার খানিকক্ষণ ইতস্তত করলেন। আদিত্যর মনে হল তার সহজাত রমণী সত্তা একটা কিছু রসাল গল্প বলতে চাইছে আর তার গম্ভীর হেড মিস্ট্রেস সত্তা তাকে বাধা দিচ্ছে। শেষে দ্বিতীয় সত্তার জয় হলো। তিনি বললেন ‘জানি না। চন্দ্রাকে এখানে তো বেশ সুখীই মনে হতো।’

‘চন্দ্রা কি এখানেই থাকত?’

‘না, না। চন্দ্রা থাকত পুরুলিয়ায়। আরও কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে। ওখান থেকে যাতায়াত করত।’

আদিত্য মাধবী হালদারের সঙ্গে আবার আপিস ঘরে ফিরে এসেছিল। মাধবী হালদার তাঁর চেয়ারে বসলেন, ইঙ্গিতে আদিত্যকেও বসতে বললেন। মুখে বললেন, ‘একটু চা খেয়ে যান। এত দূর থেকে আমাদের স্কুল দেখতে এলেন।’ তারপর গলার স্বর চড়িয়ে ডাকলেন, ‘দুলাল, দুলাল, একবার শুনে যাও।’

দুলাল ঘরে ঢোকার আগেই একটি রোগা কালো ছোটোখাট চেহারার মেয়ে ঈষৎ উত্তেজিতভাবে ঘরে এসে ঢুকল। হেড দিদিমণির দিকে তাকিয়ে বলল, কুসুম কিন্তু আজও ক্লাশে অসভ্যতা করেছে। সমানে পাশের মেয়েকে বিরক্ত করে গেছে। আমি কিন্তু এবার ওকে শাস্তি দেব। আপনি আপত্তি করতে পারবেন না।’ আদিত্যর মনে হল হেড দিদিমনি মেয়েদের শাস্তি দেবার বিরোধী। কাউকে শাস্তি দেবার আগে তার অনুমতি নিতে হয়।

হেড দিদিমনি বললেন, ‘সেসব পরে হবে। আগে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি, ইনি চন্দ্রার বন্ধু, চন্দ্রার খোঁজে এসেছেন। জানতেনই না চন্দ্রা এখান থেকে অনেক দিন হলো চলে গেছে।’ তারপর আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইনি ইলা নস্কর, আমাদের একজন টিচার।’

আদিত্য বুঝল তার নামটা হেড দিদিমনি ভুলে গেছেন। সে তাড়াতাড়ি ইলা নস্করের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলল, আমি আদিত্য মজুমদার। চন্দ্রার সঙ্গে কলেজে পড়তাম।’

‘আপনি চন্দ্রার বন্ধু? তাহলে তো আপনি আমাদের থেকে অনেক উঁচু ঘরের মানুষ। চন্দ্রার মতো আপনারও কি গরিবের উপকার করা বাতিক?’ ইলা নস্কর তার গলার তিক্ততা ঢেকে রাখার কোনও চেষ্টাই করল না।

আদিত্য অপ্রস্তুত। তার থেকেও বেশি অপ্রস্তুত মাধবী হালদার। তিনি অবস্থাটা সামলানোর জন্য আদিত্যর দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আসলে চন্দ্রার এই হঠাৎ চলে যাওয়া নিয়ে ইলার মনে খুব অভিমান জমে আছে।’

‘অভিমান-টভিমান নয়। যেটা জমে আছে সেটা বিরক্তি। দেখুন, আপনার কথা আমি জানি না। কিন্তু চন্দ্রার কথা ভালো করেই জানি। বিরাট বড়লোকের মেয়ে। সখ করে এখানকার গরিবদের উদ্ধার করতে এসেছিল। তারপর হঠাৎ একদিন সখ মিটে গেল। ব্যাস চলে গেল এখান থেকে। আমাদের ব্যাপারটা আলাদা। এখান থেকে যে কটা টাকা পাই তাই দিয়ে সংসার চালাতে হয়। চন্দ্রার সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? যাক গে, আপনাকে এসব কথা বলার কোনও মানেই হয় না। মাধবীদি আমি যাচ্ছি, ক্লাশ আছে।’ শেষের কথাগুলো, বলাই বাহুল্য, মাধবী হালদারকে লক্ষ্য করে।

ইলা নস্কর গটগট করে বেরিয়ে যাবার পরেও বেশ খানিকক্ষণ ঘরের হাওয়াটা ভারি হয়ে রইল। কেউই কোনও কথা বলতে পারছে না। শুধু পার্টিশনের ওপার থেকে মাঝে মাঝে কেরানিবাবুটির টাইপ রাইটারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটু আগে দুলাল চা দিয়ে গেছে। আদিত্য নীরবে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। শেষে নীরবতা ভেঙে মাধবী হালদার বললেন, ‘আসলে ইলা মেয়েটা বুঝলেন মোটেই খারাপ নয়। শুধু একটু বেশি ইমোশানাল। ওর সঙ্গে চন্দ্রার খুবই বন্ধুত্ব ছিল। চন্দ্রার হঠাৎ এইভাবে চলে যাওয়াটা ও মোটেই মেনে নিতে পারেনি।’

‘সত্যি, চন্দ্রা এইভাবে চলেই বা গেল কেন?’ আদিত্য এই নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করল।

‘একটা ব্যাপার ঘটেছিল। জানি না আপনাকে বলাটা ঠিক হবে কিনা। তবে ঘটনাটার কথা এখানকার সকলেই জানে। এখানে অভিজিৎ সিং বলে একজনের সঙ্গে চন্দ্রার একটা সম্পর্ক হয়েছিল। অভিজিৎ এই স্কুলেও মাঝে মাঝে চন্দ্রার সঙ্গে দেখা করতে আসত। আমরা সবাই তাকে দেখেছি। শুনেছিলাম অভিজিৎ একজন ইঞ্জিনিয়ার। তবে চাকরি-টাকরি কী করত জানি না। কেউ কেউ বলত অভিজিতের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগ আছে।’

‘কত ঘনঘন অভিজিৎ আসত এখানে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস না করে পারল না। তারপর নিজের কৌতুহলটাকে বৈধতা দেবার জন্য বলল, ‘আসলে চন্দ্রা আমাকেও একবার এই অভিজিৎ সিং-এর কথা বলেছিল। অবশ্য হালকাভাবেই বলেছিল।’

‘মাসে একবার করে অন্তত অভিজিৎ আসত। হয়ত তার বেশিই আসত। আমি ঠিক খেয়াল করতে পারছি না। আসলে অভিজিৎ যখন আসত তখন অনেক সময় আমি কাজে ব্যস্ত থাকতাম। অভিজিৎ আসত আমাদের টিফিনের সময় যাতে চন্দ্রার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে। ঠিক সেই সময় অনেকদিন আমাদের মিড ডে মিলের চাল-ডাল আসত। আমি সেসব নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়তাম।’

‘তারপর কী হল বলুন?’

‘কোনও কারণে অভিজিতের সঙ্গে চন্দ্রার আড়ি হয়ে গেল। কেন হল বলতে পারব না। ব্যাপারটা খুব হঠাৎই ঘটল। কী ঘটল জানি না কিন্তু এতে চন্দ্রা এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিল যে সে ঠিক করল রাতারাতি এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। তার আগে অবশ্য বসিরহাটের বনবীথি ইস্কুলে একটা চাকরি জোগাড় করে নিয়েছিল। একরকম বদলি নিয়েই চলে গেল বলতে পারেন। আসলে চন্দ্রার মতো কোয়ালিফাইড টিচার তো সত্যিই আমাদের ইস্কুলে আর নেই। তাই কর্তৃপক্ষ চন্দ্রাকে ছাড়তে চায়নি। সে বলা মাত্র তাকে অন্য জায়গায় চাকরি দিয়ে দিয়েছিল।’

‘চন্দ্রা চলে যেতে আপনাদের অসুবিধে হয়নি?’

‘হয়নি আবার? ভীষণ অসুবিধে হয়েছিল। আমরা সকলে মিলে চন্দ্রাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম। বিশেষ করে ইলা। চন্দ্রা আমাদের কারও কথা শুনল না। পুরুলিয়ায় থাকতে সে আর রাজি নয়। কিছুতেই নয়।’

একটু পরে হেড দিদিমনির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আদিত্য বাইরে এসে দেখল বাপি ড্রাইভার গাড়িতে নেই। তাকে ফোন করতে সে বলল খেতে এসেছে, মিনিট দশেকের মধ্যে গাড়ির কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এখন ইস্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। আদিত্য সিগারেট ধরাল। ইস্কুলের উল্টোদিকে পুকুর। পুকুরে কয়েকটা হাঁস চরছে। কয়েকটি গ্রামের বধূ বাসন মাজতে নেমেছে। আরও দূরে একটা টিলার আবছা রূপরেখা। আদিত্য দেখল ইস্কুলের সেই কেরানি ভদ্রলোক, যিনি পার্টিশানের আড়ালে বসে সশব্দে টাইপ করছিলেন, গেটের দিকে এগিয়ে আসছেন। হয়ত খেতে যাচ্ছেন। আদিত্যকে দেখে ভদ্রলোক হাসলেন। আদিত্যও হাসল। তারপর খানিকটা কৈফিয়ত দেবার মতো করে বলল, ‘ড্রাইভার খেতে গেছে, তাই দাঁড়িয়ে আছি।’

ভদ্রলোক আদিত্যর সামনে এসে দাঁড়ালেন। আদিত্য বলল, ‘এখানে আপনার খুব কাজের চাপ, না?’

‘না, না। কাজের তেমন চাপ নেই। শুধু ওই যেদিন মিড ডে মিলের চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ আসে তার পরদিনটা একটু কাজ থাকে। সব হিসেব করে মিলিয়ে রাখতে হয় তো?’

‘মাসে কবার আসে মিড ডে মিলের জিনিসপত্র?’

‘মাসে একবারই আসে। যেমন আজ এসেছে। ওই দেখুন ট্রাক থেকে চালের বস্তা নামছে।’

আদিত্য খেয়াল করল স্কুলের পাশে একটা ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। দুজন বস্তা পিঠে নিয়ে স্কুলের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।

‘আমি একটু এগোচ্ছি, হেড দিদিমনি ডেকে পাঠিয়েছেন।’

কেরানিবাবু চলে যাবার পর আদিত্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিড ডে মিলের বস্তার যাতায়াত দেখল। পুরোনো বস্তাগুলো ফেরত যাচ্ছে। নতুনগুলো আসছে। তারপর এক সময় আদিত্য লক্ষ করল ঢালু রাস্তা দিয়ে উঠে আসছে বাপি ড্রাইভার।

(৫)

তিন সখীর সংসার। পুরো সংসার না বলে একে অর্ধেক সংসার বলাই সমীচীন। সুরঞ্জনা চক্রবর্তী, জয়ন্তী ঘোষ, শ্রেয়সী তালুকদার এরা প্রত্যেকেই বিবাহিত। স্বামীর সঙ্গে এদের প্রত্যেকের একটা করে সংসার আছে। বলা যায়, সেগুলোই এদের আসল সংসার। এখানে তিনজনে মিলে যে সংসারটা পেতেছে সেটাকে অস্থায়ী বলা যাবে না, কারণ রঘুনাথপুর কলেজে তিনজনেরই পাকা চাকরি। আবার সম্পূর্ণ সংসারও বলা চলবে না, যেহেতু, ওপর ওপর তাদের যতই হাসিখুশি দেখাক না কেন, তিন সখীরই মন পড়ে থাকে তাদের স্বামীদের কাছে। তিনজনের মধ্যে সুরঞ্জনা অঙ্ক পড়ায়, জয়ন্তী পড়ায় পলিটিকাল সায়েন্স আর শ্রেয়সীর বিষয় ইতিহাস। বিষয়ের দিক থেকে অমিল থাকলেও একটা ব্যাপারে এদের মিল আছে। এদের কারোরই এখনও ছেলেপুলে হয়নি। কাজেই সেদিক থেকে এরা প্রত্যেকেই ঝাড়া হাত পা। তবে জয়ন্তীকে দেখে আদিত্যর মনে হল তার সন্তান উৎপাদনের বয়েস প্রায় পেরিয়ে গেছে। তিনজনের মধ্যে সে-ই সব থেকে বড়। অন্য দুজন অনেকটাই ছোট। দেখে মনে হয়, সুরঞ্জনার সদ্য তিরিশ পেরিয়েছে, শ্রেয়সীর তাও পেরোয়নি।

রাত্তিরের খাওয়াটা বাড়াবাড়ি রকমের বেশি হয়ে গেল। কুচো ট্যাংরা মাছের গা-মাখা চচ্চড়ি থেকে শুরু করে প্লেটে আঁটে না এমন সাইজের পাবদার ঝাল, স্থানীয় পুকুরের অতি সুস্বাদু কাতলা এবং সবার ওপরে রেওয়াজি খাসির কোর্মা। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আদিত্য ভাবছিল কী করে কাল ভোরে উঠে হাওড়াগামী পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ধরবে?

‘আমরা তো এতক্ষণ বকবক করে নিজেদের কথা বলে গেলাম, আপনি তো আপনার কথা কিছুই বললেন না।’ সুরঞ্জনা মশলার থালা এগিয়ে দিয়ে বলল।

প্রসঙ্গটা যে উঠবে আদিত্য জানত। সে আজ দুপুরে হোটেলে ফেরার সময় গাড়িতে বসে এটা নিয়ে ভেবেছে। সে কি এদের কাছে নিজের আসল পরিচয়টা দেবে? নাকি যে পরিচয় একটু আগে নীপবীথি ইস্কুলে দিয়ে এসেছে, সেটাই চালিয়ে যাবে? তার স্বাভাবিক বুদ্ধি বলছে দুজায়গায় দুরকম পরিচয় না দেওয়াই ভাল। ছোট জায়গা, জানাজানি হয়ে যেতেও পারে।

‘আমার কথা কী আর বলব। কিছুই প্রায় বলার নেই।’ আদিত্য নিচু গলায় বলল। ‘বি এস সির পরে আর পড়াশোনা হয়নি। বাবা মারা গেলেন, মা আমার ছোটবেলাতেই চলে গেছেন। আমার একটা ছোটখাট পৈতৃক ব্যাবসা আছে। অ্যাগ্রো ফার্ম। হুগলিতে কিছু জমি নিয়ে গরু-মোষ-হাঁস-মুরগি পালন করি, কিছু জমিতে চাষবাসও হয়। এখানে একটা জমি দেখতে এসেছিলাম। ব্যবসাটা একটু বাড়াবার ইচ্ছে আছে। রঘুনাথপুরের কাছে একটা জমি দেখেছি। পছন্দও হয়েছে। এখানে ফার্মটা হলে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগটাও থাকবে।’

‘সংসার করেননি?’ জয়ন্তী প্রশ্নটা করে হাসল। বোধহয় অনেকক্ষণ ধরেই সে প্রশ্নটা করবে ভাবছিল। এইসব ব্যাপারে মেয়েদের অসীম কৌতুহল।

‘হয়ে ওঠেনি। আসলে একা থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন আর সংসার করার তাগিদটাও অনুভব করি না।’ আদিত্য সত্যি কথাটাই বলল।

‘পুরুলিয়ার চারপাশটা একটু ঘুরে দেখার সময় পেলেন? এদিকে কিন্তু অনেক কিছু দেখার আছে।’ শ্রেয়সী প্রসঙ্গ বদলাল।

‘কোথায় আর পেলাম? তবে এদিকে যদি ব্যবসা করতে আসি, অনেক সময় পাব ঘুরে দেখার।’

‘জানেন তো এদিককার পলাশ ফুল খুব বিখ্যাত। অনেকে শুধু পলাশ দেখতেই পুরুলিয়ায় আসে। তবে এখন পলাশের সময় নয়।’ সুরঞ্জনা বলল।

‘পলাশের কথা আমিও শুনেছি। ভবিষ্যতে দেখার ইচ্ছে রইল। এবার জমি দেখতেই দুটো দিন কেটে গেল। আজ সকালে অবশ্য জমি দেখে ফেরার পথে এক পুরোনো বন্ধুর খোঁজে জয়চণ্ডী পাহাড়ের কাছে একটা ইস্কুলে গিয়েছিলাম। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল না, গিয়ে শুনলাম সে ইস্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।’

‘জয়চণ্ডী পাহাড়ের কাছে স্কুল? কোন স্কুল? আপনার বন্ধুর নাম কী?’ জয়ন্তীর গলায় তীব্র কৌতুহল।

‘খুব একটা নাম করা ইস্কুল নয়। গরিব মেয়েদের ক্লাশ ফোর অব্দি পড়ার ব্যবস্থা। ইস্কুলের নাম নীপবীথি। আপনাদের নামটা শোনার কোনও কারণ নেই।’

‘আপনার বন্ধুর নাম কী?’ জয়ন্তী আদিত্যর কথাটা উপেক্ষা করে আবার প্রশ্ন করল।

‘আমার বন্ধুর নাম চন্দ্রলেখা সেন। আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়ত।’

‘চন্দ্রলেখা সেন আপনার বন্ধু?’ জয়ন্তী যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

‘কেন আপনি চিনতেন নাকি চন্দ্রাকে?’ আদিত্যর গলায় অবিশ্বাস।

‘চিনতাম মানে? এই বাড়িতে চন্দ্রা আর আমি একসঙ্গে থাকতাম। এরা দুজন তখন আসেনি। চন্দ্রা চলে যাবার পর আমি নতুন রুমমেট খুঁজছিলাম। এরা সেই সময় কলেজে নতুন জয়েন করেছে। এদের বলতে এরা রাজি হয়ে গেল। সেই থেকে এদের সঙ্গে আছি। এরা অবশ্য চন্দ্রাকে দেখেনি।’ জয়ন্তী উত্তেজিত গলায় বলল।

আদিত্য ভাবছে এতটা সমাপতনও সম্ভব? চন্দ্রা যে বাড়িতে থাকত সেই বাড়িতেই সে ঘটনাচক্রে এসে পড়েছে! এরকম ঘটনা সিনেমাতেও ঘটে না। সে মুখে বলল, ‘চন্দ্রার সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। তবে এক সময় আমরা খুবই বন্ধু ছিলাম। আমি জানতাম এখানে এই ইস্কুলটাতে ও পড়ায়। ভেবেছিলাম হঠাৎ এসে ওকে একটা সারপ্রাইজ দেব। এসে শুনলাম ও হঠাৎ পুরুলিয়া ছেড়ে চলে গেছে। ওর সঙ্গে নাকি অভিজিৎ সিং বলে কোনও একজনের একটা রোমান্টিক সম্পর্ক হয়েছিল। সেই সম্পর্কটা কোনও কারণে ভেঙে যেতে ও আর পুরুলিয়ায় থাকতে চায়নি। নীপবীথি ইস্কুলের হেড মিস্ট্রেস এটাই বললেন।’

‘মোটামুটি ঠিকই বলেছেন, তবে পুরোটা বলতে পারেননি। বলতে পারার কথাও নয়। কারণ পুরো ঘটনাটা বোধহয় আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। ব্যাপারটা আমি এদেরও বলিনি। তবে এতদিন পরে হয়ত বলা যেতে পারে।’ জয়ন্তী ঘোষ একটু থেমে আবার শুরু করল।

‘চন্দ্রার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আমার স্বামী। আমার স্বামী ছিল পুরুলিয়ায় একটা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। ওই ব্যাঙ্কে আমার একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। সেই সূত্রে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমরা যখন ঠিক করলাম বিয়ে করব, তখন এই বাড়িটা ভাড়া করলাম। আমাদের দুজনের জন্যে একটু বড়, কিন্তু বাড়িটা এত পছন্দ হয়ে গেল যে ছাড়তে ইচ্ছে করল না। বিয়ের পর বছর দুয়েক আমরা এই বাড়িতে ছিলাম। তারপর ব্যাঙ্কের চাকরিতে যা হয়, আমার স্বামী শিলিগুড়িতে বদলি হয়ে গেল। স্বামী চলে গেলে একা এতবড় বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি রুমমেট খুঁজছিলাম অথবা নতুন একটা থাকার জায়গা। এই সময় একদিন, তখনও আমার স্বামী পুরুলিয়াতেই আছে, নতুন অফিসে জয়েন করেনি, ও আমাকে চন্দ্রার কথা বলল। চন্দ্রা ওদের ব্রাঞ্চের একজন বড় ক্লায়েন্ট। একটা স্কুলে পড়ায়, কিন্তু মনে হয় সেটা নিতান্তই সখের। ওর অ্যাকাউন্টে যা টাকা আছে তার সুদের তুলনায় ওর স্কুলের মাইনেটা অতি নগন্য।’

সুরঞ্জনা আর শ্রেয়সীও খুব মন দিয়ে গল্পটা শুনছিল। সুরঞ্জনা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ডেসার্টটা এবার সার্ভ করে দিই। খেতে খেতে গল্প শোনা যাক।’

আদিত্যর পেটে সত্যিই আর জায়গা ছিল না। কিন্তু সেকথা বলে নিস্তার নেই। তাছাড়া সে যখন দেখল ডেসার্টটা গুড়ের পায়েস, সে আর আপত্তি করল না। শুধু একটা প্রশ্ন মনে রয়ে গেল, এই অসময়ে গুড় আসে কোথা থেকে?

জয়ন্তী আবার বলতে শুরু করেছে। ‘আমার স্বামী বলল, চন্দ্রা একটা ভাল বাড়ি খুঁজছে। এখন যাদের সঙ্গে আছে তাদের সঙ্গে ওর বনছে না। ওর যা আর্থিক অবস্থা তাতে ও অনায়াসে একা একটা বাড়ি নিয়ে থাকতে পারত। কিন্তু ও একা থাকতে চায় না। শিলিগুড়ি চলে যাবার আগে আমার স্বামী একদিন চন্দ্রাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এল। চন্দ্রাকে আমার বেশ ভাল লেগে গেল। আমার মনে হয় আমাকেও চন্দ্রার মন্দ লাগল না। মোটমাট আমার স্বামী শিলিগুড়ি চলে যাবার পর চন্দ্রা আর আমি একসঙ্গে এই বাড়িটাতে থাকতে লাগলাম।’

পায়েসটা যাকে বলে ‘আউট অফ দিস ওয়ার্লড’। আদিত্য সেকথা সকলকে জানাতে শ্রেয়সী বলল, ‘আন্দাজ করুন তো পায়েসটা কে করেছে?’ আদিত্য দেখল জয়ন্তী, শ্রেয়সী আর সুরঞ্জনা তিনজনেই মিটিমিটি হাসছে।

আদিত্য তার গোয়েন্দাসুলভ ইন্ট্যুইশন খাটিয়ে বলল, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এটা জয়ন্তী করেছেন। এইরকম পায়েস করার জন্য অনেকদিনের অভিজ্ঞতা লাগে। সেটা এখানে একমাত্র জয়ন্তীরই আছে। কিন্তু সুরঞ্জনাই যখন উৎসাহ নিয়ে পায়েসটা সার্ভ করার কথা বললেন, তখন মনে হয় ওটা সুরঞ্জনাই করেছেন।’

‘বাঃ, একদম ঠিক বলেছেন।’ শ্রেয়সী হাততালি দিয়ে উঠল, ‘আপনি অনায়াসে একজন ভাল ডিটেকটিভ হতে পারতেন।’

‘চন্দ্রার গল্পের বাকিটা শোনা যাক।’ আদিত্য প্রসঙ্গ পালটে বলল।

 ‘চন্দ্রা আর আমি একসঙ্গে প্রায় তিন বছর ছিলাম।’ জয়ন্তী আবার বলতে শুরু করেছে। ‘আদিত্যবাবু আপনি কি জানেন চন্দ্রার কিছু নকশাল কানেকশন ছিল?’

‘জানতাম। কলেজ থেকেই জানতাম ও নকশালদের সঙ্গে আছে। ঠিক বিপ্লব-টিপ্লব করত না। তবে বস্তিতে গিয়ে গরিব বাচ্চাদের পড়াত। মাঝে মাঝে কলেজে মাওবাদী লেকচার দিত।’

‘এখানেও চন্দ্রা গরিব মেয়েদের পড়াত। একই সঙ্গে এখানকার মাওবাদী একটা দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। ওই অভিজিৎ সিং লোকটা ছিল মাওবাদীদের নেতা। আমি অনেকবার চন্দ্রাকে লোকটার ব্যাপারে সাবধান করেছিলাম। ও খুব একটা শুনত না। তবে লোক মারা ব্যাপারটা চন্দ্রা পছন্দ করত না, তা সে জোতদারই হোক, আর পুলিশ বা মিলিটারি হোক। কিন্তু চন্দ্রার যে একটা বামপন্থী আইডিয়াল ছিল তাতে সন্দেহ নেই এবং সেই কারণেই সে পুরুলিয়াতে এসেছিল। তারপর সেই ঘটনাটা ঘটল।’ জয়ন্তী একটু থামল।

‘কী ঘটনা?’ নিজের অজান্তেই আদিত্যর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল প্রশ্নটা।

‘মাওবাদীদের হাতে প্রায় পঁচিশ-তিরিশজন মিলিটারি জোয়ানের মৃত্যু হয়। তাদের ট্রাকটাও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ-নিয়ে এখানকার লোকাল মিডিয়ায় তোলপাড় হয়েছিল। ন্যাশানাল মিডিয়াও খবরটা বেশ বড় করে বার করেছিল। শোনা গেল অভিজিৎ সিং-এর দল এর পেছনে আছে।’

‘চন্দ্রা কি আপনাকে বলেছিল এর পেছনে অভিজিৎ আর তার দল আছে?’

‘খুব স্পষ্ট করে বলেনি। তবে তার কথা থেকে এটা বুঝেছিলাম যে এই ধরনের মাস কিলিং সে সমর্থন করে না। শুধু সমর্থন করে না বললে কম বলা হবে, রীতিমত ঘৃণা করে। আমার স্থির বিশ্বাস এই নিয়েই অভিজিৎ সিং-এর সঙ্গে চন্দ্রার তীব্র মতবিরোধ হয়, এবং সেই মতবিরোধের জেরে সে পুরুলিয়া থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। পুরুলিয়ায় থাকলে চন্দ্রা মাওবাদীদের সংস্রব এড়াতে পারত না।’

‘শুনলাম চন্দ্রা এখন বসিরহাটের একটা স্কুলে পড়ায়। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ আছে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল। ফোনে নিয়মিত কথা হতো। কিন্তু ইদানীং কেন জানি না কিছুতেই চন্দ্রাকে ফোনে ধরতে পারছি না। খালি বলছে ফোনটা সুইচট অফ আছে। চন্দ্রাও নিজে থেকে অনেকদিন ফোন করেনি। ওর জন্যে মাঝে মাঝে চিন্তা হয়।’

রাত্তিরে হোটেলে ফিরতে ফিরতে আদিত্য ভাবছিল, পুরুলিয়ায় এসে তার মোটামুটি লাভই হয়েছে।

পরের দিন আদিত্যর কলকাতা ফেরার ট্রেনটা যখন খড়গপুর ঢুকছে, বিমল ফোন করল।

‘স্যার, কমলিকা সেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। দরোয়ানকে বললাম, তোমাদের এখানে সিকিউরিটির কাজ-টাজ কিছু খালি আছে? সে বলল, না কিচ্ছু খালি নেই। আর খালি থাকলেও এখানে সরাসরি লোক নেওয়া হয় না। একটা সিকিউরিটি কম্পানিকে বরাত দেওয়া আছে। তারাই লোক দেয়। বুঝলাম সব জায়গায় একই ব্যবস্থা। তবু দরোয়ানের সঙ্গে ভাব জমালাম। তাকে বিড়ি খাওয়ালাম। তার কাছ থেকে জানলাম, মেম সাহেবের পুরোনো ড্রাইভার ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। একজন বদলি লোক গাড়ি চালাচ্ছে। বদলি ড্রাইভারের ঠিকানাটা জোগাড় করেছি। চেতলায় থাকে। ওর সঙ্গে দেখা করে ভাব জমাতে হবে। তাহলে মেমসাহেব কোথায় কোথায় যান জানা যাবে। আশা করছি, দুচার দিনের মধ্যে আপনাকে কিছু একটা জানাতে পারব। আজ তাহলে রাখি স্যার?’

মেসে ফিরে আদিত্য অনেকক্ষণ ধরে চান করল। তারপর খাবার ঘরে গিয়ে খুব তৃপ্তি করে মাছের ঝোল ভাত খেল। কদিন খুব গুরুপাক খাওয়ার পর ঝোল-ভাত অমৃত লাগছে। সব থেকে বড় কথা ভানু ঠাকুর ফিরে এসেছে। আর চিন্তা নেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *