চন্দ্রলেখা অন্তর্ধান রহস্য – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

(১)

পরের দিন সকালে আদিত্য আপিস যাওয়ার জন্য সবে রাস্তায় পা দিয়েছে এমন সময় তার মোবাইলটা বেজে উঠল। কেয়া বাগচির নম্বর। আদিত্য সাড়া দিতেই ওদিক থেকে কেয়া বাগচির ঈষৎ উত্তেজিত গলা শোনা গেল, ‘আপনার সঙ্গে একবার দেখা করা খুব দরকার। আজ আমার ইস্কুল ছুটির পর দেখা করতে পারবেন?’

‘কখন দেখা করতে চাইছেন?’

‘ধরুন পাঁচটা নাগাদ। আমার ইস্কুলের কাছে, বিডন স্ট্রীট আর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-এর মোড়ের উত্তর পশ্চিম কোণে একটা নতুন কফিশপ হয়েছে। নাম দিয়েছে ক্যাফে অ্যান্ড শুগার। ওখানে বসে কথা বলা যেতে পারে। আমি ইস্কুল ছুটি হলে ওখানে চলে যাব। আসতে পারবেন?’

‘হঠাৎ কিছু ঘটেছে?’

‘টেলিফোনে বলছি না। দেখা হলে বলব। প্লিজ একবার আসুন।’

‘চলে আসব। তবে ঘন্টাখানেকের বেশি থাকতে পারব না। সন্ধেবেলা একটা জায়গায় যেতে হবে।’

‘আধঘন্টার বেশি আপনাকে আটকাব না। আসছেন তো? খুব দরকার।’ কেয়া বাগচির গলাটা প্রায় কাতর শোনাল।

‘অবশ্যই আসব। রাখছি তাহলে। পাঁচটায় দেখা হচ্ছে।’ আদিত্য ফোনটা কেটে দিয়ে পকেটে রাখল।

আদিত্য কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে দেখল ট্রামে-বাসে তখনও বেশ ভীড়। এত ভীড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। তার থেকে এইটুকু পথ হেঁটে যাওয়াই ভাল। আপিসে তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর কোনও তাড়া নেই। এমন নয় যে শয়ে শয়ে মক্কেল তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে। আদিত্য কফি হাউসের নিচ থেকে দু-প্যাকেট সিগারেট কিনল। আশা করা যায় এতে আজ সারাদিন চলে যাবে। কোনও কোনও দিন অবশ্য তার কুড়িটা সিগারেটে দিন চলে না, রাত্তিরের দিকে আরেক প্যাকেট কিনতে হয়।

পথে অনেক লোক, ছাত্র, হকার, ঠেলাগাড়িতে স্তূপাকার বইপত্র চাপিয়ে ঠেলাওলা বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রিটে ঢুকেছে। ফলে গাড়িগুলো সব ঠেলার পেছনে আটকে গেছে। আদিত্য একটা সিগারেট ধরাল। কিন্তু সে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট খেতে পারে না। একবার ভাবল, কফি হাউসে উঠে এক কাপ কফি খেয়ে যাবে। কিন্তু হাতে অনেক কাজ, কফি খেতে গেলে নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে। বরং সংস্কৃত কলেজের গায়ে যে চায়ের দোকানটা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে এক ভাঁড় চা খাওয়া যেতে পারে। তাতে সিগারেটেরও সদ্ব্যবহার হবে।

সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে আদিত্য ভাবছিল। পুরুলিয়া এবং বসিরহাট দুটো জায়গাতেই খুব শিগগির যাওয়া দরকার। আগে পুরুলিয়া যেতে হবে। ওখানেই চন্দ্রার অতীতটা লুকিয়ে আছে। ওখানে কাজ সারতে অন্তত তিন চার দিন লেগে যাবে। কিন্তু তারপরে বসিরহাট গেলে দেরি হয়ে যাবে। একটা-দুটো ট্রেল যদি বা পাওয়া যেত সেগুলোও হারিয়ে যাবে। তার চেয়ে একটা কাজ করলে কেমন হয়? সে নিজে পুরুলিয়ায় গিয়ে যদি নূপুর মণ্ডলকে বসিরহাটে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে হয়ত ও কিছু দরকারি খবর যোগাড় করে আনতে পারে। নূপুর তো কাজ খুঁজছে। মেয়েটাকে চালাক-চতুর মনে হয়। কত তাড়াতাড়ি আদিত্যর কাজে যোগ দিতে পারবে? জিজ্ঞেস করতে হবে। নূপুরকে বসিরহাট পাঠানোর আর একটা সুবিধে আছে। পার্থ বসিরহাটে সকলকে আদিত্যর পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে। এতে কাজের অসুবিধে হতে পারে। কিন্তু নূপুর যদি অন্য কোনও পরিচয়ে বসিরহাট যায় তাহলে তার পক্ষে খবর জোগাড় করাটা সহজ হবে। অবশ্য একটা খরচের দিকও আছে। পার্থ যথেষ্ট টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে, তাই দিয়ে অনায়াসে নূপুরকে কাজ দেওয়া যাবে। আদিত্যর মনে হল এখনই কথাটা পার্থকে বলার দরকার নেই। হয়ত ও কাউকে বলে ফেলতে পারে। যেমন আদিত্যর পরিচয়টা বলে ফেলেছে। তাহলে নূপুরকে বসিরহাট পাঠানোর উদ্দেশ্যটাই মাটি হয়ে যাবে।

আপিস যাবার পথে আদিত্য একবার ব্যাঙ্কে থামল। টাকা তুলতে হবে। পাশবইটাও আপডেট করা দরকার। টাকা তোলার লাইনে অপেক্ষা করতে করতে মোবাইল থেকে পার্থকে সে একটা ইমেল করল। লিখল, পার্থ যেন তাকে একটা ফোন করে। কিন্তু সে নূপুরকে নিয়োগ করার কথা কিছু লিখল না। এখান থেকে হোয়াটঅ্যাপে সব সময় পার্থর নম্বরটা পাওয়া যায় না। ব্যাঙ্কের কাজ সেরে আদিত্য যখন বউবাজারে তার আপিসে পৌঁছল তখন সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।

পাঁচটার একটু আগেই বিডন স্ট্রিট চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-এর মোড়ে পৌঁছে গেল আদিত্য। ক্যাফে অ্যান্ড সুগার নামক কফিশপটা খুঁজে নিতে অসুবিধে হল না। এক ঝলক দেখেই বোঝা যায় নতুন হয়েছে। ভেতরটা প্রায়ান্ধকার। ভীড় একেবারে নেই। শুধু এক কোণে একটি যুগল খুব ঘন হয়ে বসে ফিসফিস করে কথা বলছে। দোকানের বাইরের চাতালেও চাঁদোয়া টাঙিয়ে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। আদিত্য সেখানেই বসল। রাস্তা দেখতে দেখতে কফি খাওয়া যাবে। তাছাড়া দোকানের ভেতরে বসা ওই যুগলকেও খানিকটা প্রাইভেসি দেওয়া দরকার। কেয়া বাগচি কখন আসবে কে জানে? আদিত্য একটা বড় কফি আমেরিকানো অর্থাৎ কালো কফি অর্ডার করল।

কাছাকাছি কোথাও কোনও মেয়েদের ইস্কুল ছুটি হয়েছে। সাদার ওপর নীল খোপকাটা ইউনিফর্ম পরা দলে দলে মেয়ে বাড়ি ফিরছে। কেউ একা, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে, কেউ মায়ের হাত ধরে। এই ইস্কুলেই হয়ত কেয়া পড়ায়। যদি তাই হয় তাহলে কেয়াও এক্ষুনি এসে যাবে। আদিত্য মগ্ন হয়ে দুই মায়ের কথোপকথন শুনছিল।

একজন আরেকজনকে বলছে, ‘তোদের ক্লাশে আজ কী কী বাক্য রচনা দিল রে?’

‘আমাদের ক্লাশে পঞ্চাশটার একটা লিস্ট দিয়েছে। বাড়ি থেকে তৈরি করে আনতে বলেছে। তোদের ক্লাশে?’

‘আমাদেরও অনেকগুলো দিয়েছে। কটা দিয়েছে আমার মেয়ে বলতে পারল না। তবে অনেকগুলো।’

‘তাহলে রাফ বুকগুলো মিলিয়ে নেব। দুটো মেলালে হয়ত সত্তর আশিটা হয়ে যাবে।’

‘ঠিক আছে।’

আদিত্য ভাবছিল, এরা এদের মেয়েদের ক্লাশকে নিজেদের ক্লাশ বলছে, মেয়েদের রাফ বুককে নিজেদের রাফ বুক। মেয়েকে পড়িয়ে বিদ্যেধরী বানানো ছাড়া এদের জীবনে আর কোনও লক্ষ্য নেই। এই সব ভাবতে ভাবতে আদিত্য টের পায়নি কখন কোন দিক থেকে কেয়া বাগচি এসে তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছে।

‘বাইরে বসলেন? ভেতরে বসলে ভাল হতো না? ভেতরে এসি রয়েছে তো। বাইরেটা যা গরম।’ কেয়ার কপালে সত্যিই বিন্দু বিন্দু ঘাম।

‘বেশ তো। চলুন না ভেতরেই বসি।’ আদিত্য নিরীহভাবে বলল।

‘তাছাড়া কোনও ছাত্রী আমাকে আপনার সঙ্গে এখানে বসে থাকতে দেখলে স্কুলে রটিয়ে দেবে কেয়া মিস এই বুড়ো বয়সে প্রেম করছে।’ কেয়া বাগচি হাসতে হাসতে বলল।

আদিত্যও হাসল। কিন্তু মনে মনে ভেবে দেখল হালকা ভাবে বললেও কেয়া কথাটা একেবারে ভুল বলেনি। সে কেয়ার পেছন পেছন ক্যাফের ভেতরে ঢুকল। একটা কোণের দিকের টেবিল বেছে নিয়ে তারা ধীরে সুস্থে বসল। যেদিকের কোণে ঘনিষ্ঠ যুগলটি বসেছিল তার উল্টোদিকের কোণে।

টেবিলের ওপর পড়ে থাকা মেনুটা কেয়ার হাতে তুলে দিয়ে আদিত্য বলল, কী খাবেন বলুন। আমি কিন্তু নিজের জন্য একটা কালো কফি বলে দিয়েছি।’

‘আমার খুব খিদে পেয়েছে। সারাদিন অনেকগুলো ক্লাশ নিয়েছি। আমি একপ্লেট চিকেন স্যান্ডউইচ খাব। আপনি কি খাবেন বলুন।’

‘আমি একটু আগেই লাঞ্চ খেয়েছি। শুধু কফি খাব।’

বেয়ারা আদিত্যর কফিটা নিয়ে এসেছে। তাকে একপ্লেট চিকেন স্যান্ডউইচ এবং একটা কাপুচিনো অর্ডার দিল কেয়া। বেয়ারা একটু দূরে যেতেই আদিত্য বলল, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? এত জরুরি তলব কেন?’

কেয়ার মুখের অভিব্যক্তিটা চকিতে বদলে গেল। যেন হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল একটা সঙ্কটের মধ্যে সে রয়েছে। সে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘কাল আপনি চলে যাবার পর দুটো ঘটনা ঘটেছে যেগুলো আমার মনে হয় আপনার এক্ষুনি জানা দরকার। তাই আপনাকে আসতে বললাম।’ তারপর খানিকটা থেমে কেয়া বলল, ‘একটু জল খেতে পারলে ভাল হতো। ইস্কুল ছুটি হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছি। গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।’

আদিত্য ইশারায় বেয়ারাকে ডেকে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল দিতে বলল। বেয়ারা জলের বোতল আর দুটো ফাঁকা গ্লাস এনে টেবিলে রেখে দুটো গেলাসে জল ভরে দিয়ে চলে যেতেই প্রায় এক ঢোঁকে আধ গেলাস জল খেয়ে ফেলল কেয়া। তারপর আবার বলতে শুরু করল, গতকাল আপনি মনে হয় আটটা নাগাদ আমাদের হস্টেল থেকে বেরোলেন। আপনি চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই আমার খোঁজে একজন ভদ্রমহিলা এসে উপস্থিত।’

‘কতক্ষণ পরে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘আমার ধারণা আপনি চলে যাবার মিনিট দশেকের মধ্যে। ডেফিনিটলি সাড়ে আটটার আগে।’

‘কী করে এতটা নিশ্চিতভাবে বলছেন ভদ্রমহিলা সাড়ে আটটার আগে এসেছিলেন?’

‘সাড়ে আটটা থেকে আমাদের ডিনার শুরু হয়। ভদ্রমহিলা যখন এসেছিলেন তখনও ডিনার শুরু হয়নি।’

‘বুঝেছি। তারপর?’ আদিত্যর একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ক্যাফের ভেতরে বড় বড় করে নো স্মোকিং লেখা আছে। বাইরে বসলে হয়ত সিগারেট খাওয়া যেত। সেটা যখন আর হচ্ছে না, তখন মনে মনে ‘যাক গে যাক’ বলে সে স্থির হয়ে বসল।

‘ভদ্রমহিলা এসে বললেন, উনি চন্দ্রার ইস্কুল, অর্থাৎ বনবীথি থেকে এসেছেন। উনি চন্দ্রার কলিগ। নাম অনিমা সামন্ত।’ কেয়া একটু থেমে আর এক ঢোঁক জল খেল। আর ঠিক তখনই বেয়ারা এসে কেয়ার স্যান্ডউইচ আর কাপুচিনো টেবিলের ওপর রেখেছে।

আদিত্য বলল, ‘আপনি আগে খেয়ে নিন।’

কেয়া আপত্তি করল না। মনে হয় তার সত্যিই খিদে পেয়েছে। প্লেটে দুটি পেল্লায় স্যান্ডউইচ। তার একটাতে কামড় দিয়ে কেয়া কাপুচিনোতে একটা চুমুক দিল। তারপর আবার বলতে শুরু করল।

‘অনিমা সামন্ত নামটার সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম। চন্দ্রা এঁর কথা মাঝে মাঝেই বলত। উনি বনবীথি ইস্কুলের হেড মিস্ট্রেস, সকলে ওঁকে বড়দিদি বলে। আমি বললাম, আপনার কথা চন্দ্রার মুখে অনেক শুনেছি। ভদ্রমহিলা একটু মলিন হাসলেন। বললেন, চন্দ্রার কোনও খোঁজখবর পেলেন? আমি মাথা নাড়লাম। উনি বললেন, চন্দ্রার এইভাবে হারিয়ে যাওয়াটা যে আমাদের ইস্কুলের কী অপূরণীয় ক্ষতি বলে বোঝাতে পারব না। ওর কাছে অঙ্ক আর ইংরিজি শিখবে বলে দূর দূর থেকে মেয়েরা আসত। ওর মতো লেখাপড়া তো আমাদের কারও নেই। আমরা কী করে ওর জায়গা নেব? তাছাড়া ও মানুষটা এত ভাল, ওকে সকলে এত ভালবাসত, ওর অভাবটা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। বলতে বলতে ভদ্রমহিলার চোখে জল এসে গেল। তাই দেখে আমারও চোখে জল। এই চোখের জল ব্যাপারটা খুব ছোঁয়াচে। সে যাই হোক, এইসব কথা শেষ হবার পর ভদ্রমহিলা আসল কথায় এলেন। বললেন, বনবীথি ইস্কুলটা অনেক দিন ধরেই সরকারি স্বীকৃতি পাবার চেষ্টা করছে। এ-নিয়ে সরকারের প্রাইমারি স্কুল দপ্তরকে বিস্তর চিঠিপত্র লিখতে হয়েছে। চিঠি লেখার কাজটা চন্দ্রাই করত। মাঝে মাঝে কলকাতায় এসে প্রাইমারি স্কুল দপ্তরকে তাগাদা লাগাবার দায়িত্বটাও ছিল তার। ফলে এই সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র চন্দ্রার কাছে থাকত। কোথায় যে সে এই কাগজপত্র রাখত আমরা কেউ জানতাম না, জানার দরকারও মনে করিনি কখনও। এখন চন্দ্রা নেই, ফলে সেই কাগজপত্রগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে আগামী মাসে প্রাইমারি স্কুল ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাদের ইস্কুলে ইন্সপেকশান হবার কথা। চন্দ্রা অন্তত সেইরকমই বলেছিল। ইন্সপেকশানের সময় যদি দরকারি কাগজপত্রগুলো হাতের কাছে না থাকে তাহলে খুবই অসুবিধে হবে। আমি বললাম, এ-ব্যাপারে আমি কী করতে পারি? ভদ্রমহিলা বললেন, চন্দ্রা তার পার্মানেন্ট ঠিকানা হিসেবে আপনার ঠিকানাটাই দিয়েছিল। আমরা জানি, কলকাতায় এলে সে আপনার এখানেই থাকত। চন্দ্রার কোনও কাগজপত্র কি এখানে আছে? একটু ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ে গেল চন্দ্রার একটা সুটকেস আমার খাটের তলায় রয়ে গেছে।

ভদ্রমহিলাকে অপেক্ষা করতে বলে সুটকেসটা ঘর থেকে নিয়ে এলাম। তারপর আমরা দুজনে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। দুর্ভাগ্যবশত পুরোনো জামাকাপড় আর কিছু ব্যক্তিগত কাগজপত্র ছাড়া আর কিছুই সুটকেসে পাওয়া গেল না। ভদ্রমহিলাকে বেশ হতাশ দেখাল। তিনি বিরস মুখে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলেন।’

‘শুনে তো মনে হচ্ছে এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এটা নিয়ে আপনি এত উতলা হচ্ছেন কেন?’ আদিত্য একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল।

‘এর পরের ঘটনাটা শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন কেন উতলা হচ্ছি।’ বলতে বলতে কেয়া দ্বিতীয় স্যান্ডউইচটাকে আক্রমণ করল। কাপুচিনোর অবশিষ্টাংশ সহ সেটার সদ্ব্যবহার করে এক গেলাস জল খেল। তারপর বলতে শুরু করল আবার।

‘ভদ্রমহিলা সব মিলিয়ে মিনিট দশেক আমাদের হস্টেলে ছিলেন। তিনি চলে যাবার পর ঘরে গিয়ে সুটকেসটা আবার খাটের তলায় রেখে দিলাম। তারপর নিচে খেতে নামবো ভাবছি এমন সময় নিচ থেকে আমাদের কাজের মাসির গলা শুনে বুঝলাম আবার কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। নেমে দেখি যিনি এসেছেন তিনি বনবীথি ইস্কুলের আর একজন দিদিমনি। নাম বললেন, সোনালী সাঁতরা। একে আমি চিনি। ইনি ইস্কুলে সেলাই, উলবোনা, হাতের কাজ এইসব শেখান। সবাই ওঁকে সোনাদিদি বলে। ইনি চন্দ্রার সঙ্গে একবার আমাদের হস্টেলে এসেছিলেন। চন্দ্রার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক দুঃখ-টুঃখ করে শেষে সোনাদিদি বললেন, চন্দ্রার বাড়িওলা বলেছিল চন্দ্রার ঘরটা খালি করে দিতে হবে। তাই সোনাদিদি চন্দ্রার জিনিসপত্রগুলো একটা সুটকেসে করে নিয়ে এসেছিল। আর একটা সুটকেস ইস্কুলের ক্লার্ক গৌরবাবুর বাড়িতে রাখা আছে। ইস্কুলে সুটকেস রাখার সুবিধে নেই। তাই সোনাদিদি সুটকেস এখানে রেখে যেতে এসেছে। সোনাদিদি ঠিক করেছিল, এর পর যেদিন কলকাতা আসবে সেদিন নিজেই সুটকেসটা পৌঁছে দেবে। তা এতদিনে কলকাতা আসার সুযোগ হল।’

এই পর্যন্ত শুনে আদিত্য বলল, ‘আমি আর একটা কফি খাচ্ছি। আপনি খাবেন?’

‘পরে একটা কফি খাব। কিন্তু তার আগে ক্যাফে অ্যান্ড সুগার-এর সুগারের অংশটা টেস্ট করা দরকার। এরা চমৎকার স্ট্রবেরি শর্টকেক বানায়। আপনি যদি খান তাহলে আমিও একটা খেতে পারি।’

আদিত্য বুঝল কেয়ার স্ট্রবেরি শর্টকেক খাওয়াটা সম্পূর্ণভাবে আদিত্যর নিজের স্ট্রবেরি শর্টকেক খাওয়ার ওপর নির্ভর করছে। যদি আদিত্য না খায়, কেয়াও চক্ষুলজ্জার খাতিরে খেতে পারবে না। সে স্ট্রবেরি শর্টকেক খেতে রাজি হয়ে গেল।

কেয়া ভুল বলেনি। ক্যাফে অ্যান্ড সুগার-এর স্ট্রবেরি শর্টকেক সত্যিই চমৎকার। কিছুক্ষণ দুদিকেই নীরবে খাওয়া-দাওয়া চলল। তারপর আবার কফির অর্ডার দিয়ে কেয়া তার গল্পে ফিরে গেল।

‘সুটকেসটা নিয়ে আমি সোনাদিদিকে বললাম, আপনাদের বড়দিদি তো এই একটু আগে এখানে এসেছিলেন। শুনে সোনাদিদি এত অবাক হয়ে গেল যে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। আমি তখন বড়দিদির আসার কারণটা বিশদে বললাম। তাই শুনে সোনাদিদি আস্বস্ত হওয়া দূরের কথা আরও অবাক হয়ে গেল। তারপর হড়বড় করে যা বলে গেল তার সারমর্ম হল, বড়দিদি এখানে আসতেই পারে না। কারণ এই বাড়িতে ঢোকার একটু আগে সে ফোনে বড়দিদির সঙ্গে কথা বলেছে। বড়দিদি বসিরহাটেই আছে। তাছাড়া ইন্সপেকশন হবে বলে সরকারি স্বীকৃতি পাবার সব কাগজপত্র তো সে নিজে আজ সকালে সল্ট লেকের বিকাশ ভবনে প্রাইমারি ইস্কুলের দপ্তরে জমা দিয়ে এসেছে। বস্তুত কাগজপত্র জমা দিতেই তো সে কলকাতায় এসেছে। আর কাগজপত্র কিছুই হারায়নি। সব দরকারি কাগজপত্রই চন্দ্রা দিদিমনির টেবিলের ওপর ছিল।’

‘ইনটারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং।’ আদিত্য না বলে পারল না।

তারপর সে কেয়াকে বলল, ‘মনে হয়, কেউ বড়দিদি সেজে চন্দ্রার কাগজপত্রের খোঁজে আপনার কাছে গিয়েছিল। হয়ত সে চন্দ্রার অনুমানের কথা জানত। হয়ত সে ভেবেছিল চন্দ্রা তার অনুমানের কথা কোথাও লিখে রেখেছে। কিংবা তার কাগজপত্রের মধ্যে তার অনুমানের সমর্থনে কিছু প্রমাণ আছে। আমাকে একবার কাগজপত্রগুলো দেখতে হবে। আমি পুরুলিয়া যাচ্ছি। ফিরে এসে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। আপনি খুব সাবধানে থাকবেন। এরা কিন্তু আবার আসতে পারে। এই সুটকেসটার খোঁজেই আবার আসতে পারে।’

বিল মেটানোর সময় একপ্রস্থ ধস্তাধস্তি হল। কেয়া কিছুতেই আদিত্যকে বিল মেটাতে দেবে না। তার একটাই কথা, ‘আমিই তো জোর করে খেলাম। আপনি কেন পয়সা দেবেন? আমি দেব।’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য আদিত্যই জিতল। কেয়াকে একটা উবার ধরিয়ে দিয়ে আদিত্য মেট্রো স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগাল। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছিল, যদি কেয়া জানত ক্যাফে অ্যান্ড সুগারের এই বিলটা আদিত্য এক্সপেন্স দেখিয়ে পার্থর কাছ থেকে আদায় করে নেবে, অর্থাৎ বিলের টাকাটা পার্থর পকেট থেকেই যাবে, তাহলে হয়ত সে আদৌ আদিত্যকে বিল মেটাতে দিত না।

(২)

সুনন্দ মিত্রর ক্লাবটা আদিত্যর খুব চেনা। বাবা বেঁচে থাকতে সে বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝেই এখানে আসত। পরেও কয়েকবার সুনন্দর সঙ্গে আড্ডা দিতে এখানে এসেছে। ক্লাবের ভেতরটা এতগুলো বছরেও তেমন বদলায়নি। শুধু, আদিত্য লক্ষ করেছে, ক্লাব মেম্বারদের গড় বয়েসটা যেন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এর একটাই মানে হতে পারে। আজকালকার কম বয়সী ছেলেমেয়েরা এই ধরনের সনাতন ক্লাবে আসার ব্যাপারে তেমন উৎসাহ পায় না। দুপুরে সুনন্দ ফোন করে মনে করিয়ে দিয়েছিল, সন্ধেবেলা ক্লাবে ঢুকতে গেলে কলারবিহীন টি-শার্ট, পেছনে স্ট্র্যাপবিহীন জুতো এবং জিনস পরা চলবে না। মনে করানোর অবশ্য দরকার ছিল না, কারণ এক, এগুলো আদিত্য জানত এবং দুই, এর কোনওটাই আদিত্য পরে না। তবে এটা ভেবে আদিত্যর হাসি পেয়ে যায় যে এখনও এই একবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার পুরোনো ক্লাবগুলোতে এই ধরনের কলোনিয়াল মনোভাব সগর্বে জারিয়ে রাখা হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্ম এই সেকেলে মনোভাব পরিত্যাগ করতে বাধ্য।

বারের এক কোণে সুনন্দ একা একা বসে হুইস্কি খাচ্ছিল। আদিত্যকে ঢুকতে দেখে হাত নাড়ল।

‘তোকে একটু রান ডাউন দেখাচ্ছে। ব্যাপার কি? খুব কাজের চাপ?’ আদিত্য চেয়ার টেনে বসার পর সুনন্দ প্রশ্ন করল।

‘দূর! আমার আবার কাজের চাপ! তবে ইদানীং একটা কাজ নিয়ে একটু দৌড়োদৌড়ি করতে হচ্ছে। সে কাজটার জন্যই তোর হেল্প চাইছি।’

‘কাজের কথা পরে হবে। আগে বল কী খাবি। আমি ব্ল্যাক লেবেল খাচ্ছি। তুই ব্ল্যাক লেবেল খাবি?’

‘আমি একটা জিন অ্যান্ড টনিক খাব।’ আদিত্য খানিক ভেবেচিন্তে বলল।

‘ভেরি ব্রিটিশ চয়েস।’ সুনন্দর গলায় সম্মতির সুর। ‘তুই যতই নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করিস না কেন আদিত্য, তোর ক্লাশটা কিন্তু মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়ে।’

ক্লাশের কথা উঠলে আদিত্য রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এটা ঠিক যে একসময় তারা কলকাতার একেবারে প্রথম সারির বনেদি বাড়িগুলোর একটা ছিল। সেই অবস্থা আর নেই। অনেকদিনই নেই। বিশেষ করে বাবা মারা যাবার পর তাদের সব সম্পত্তি দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেছে। এখন তার এমনই অবস্থা যে গোয়েন্দাগিরির মতো উঞ্ছবৃত্তি করে তাকে পেট চালাতে হয়। তাই পুরোনো আভিজাত্যের কথা কেউ বললে আদিত্যর ভাল লাগে না। সে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, ‘তোর কথা বল। কেমন আছিস? নতুন খবর কিছু আছে?’

‘ভালই আছি। আর নতুন খবর বলতে আমার বড় ছেলেটা এবছর স্কুল পাশ করে ব্যাঙ্গালোরে ন্যাশানাল ল স্কুলে পড়তে ঢুকেছে। পাঁচ বছরের ইণ্টিগ্রেটেড কোর্স। পাঁচ বছর পরে পাশ করে বেরোলে আমার জুনিয়ার করে ঢুকিয়ে দেব। আর তখন যদি একবার বিলেত যেতে চায়, না হয় ঘুরে আসবে। ওর ব্যাপারে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত। ছোটটার অবশ্য সবে ক্লাশ এইট।’

‘কাবেরী কেমন আছে?’

‘কাবেরীর শরীরটা একটু খারাপ হয়েছিল। হাই শুগার। ওর বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। শুগার এতটাই বেড়েছে যে ইনসুলিন নিতে হয়। তবে আজকাল ইনসুলিনের কোয়ালিটি অনেক ইমপ্রুভ করেছে। মাঝখানে শরীরের জন্য কিছুদিন ছুটি নিয়েছিল। এখন আবার কোর্টে যাচ্ছে। আমাদের জাজ এত কম, বেশিদিন ছুটিও নেওয়া যায় না। গত সপ্তাহে কাবেরী লামার্টিনিয়ার ফর গার্লস-এ প্রাইজ দিতে গেছিল। শি ওয়াজ ভেরি এক্সাইটেড টু গো ব্যাক টু হার আলমা মটর অ্যাজ চিফ গেস্ট। সব মিলিয়ে এখন কাবেরী ভালোই আছে।’

কথা বলতে বলতে সুনন্দ হঠাৎ থেমে গেল। দূরে কাউকে দেখে হাত নাড়ল। তারপর আদিত্যকে বলল, ‘ওই তো অভীকদা এসে গেছে।’

অভীক চৌধুরির বয়েস আদিত্য বা সুনন্দর থেকে খানিকটা বেশি, মনে হয় পঞ্চাশ পেরিয়েছে। সাহেব সাহেব চেহারা, হাবেভাবেও সাহেবি, তবে গোমড়ামুখো সাহেব নয়। সুনন্দ আলাপ করিয়ে দিল, ‘অভীকদা এ আমার স্কুলের বন্ধু আদিত্য মজুমদার। আর আদিত্য, ইনি সামারভিল অ্যান্ড চৌধুরির অভীক চৌধুরি। অভীকদা আর আমি অনেকদিন একসঙ্গে লন্ডনে ছিলাম। কিংস কলেজে একসঙ্গে ল পড়েছি।’

আদিত্য হাত তুলে নমস্কার করতে যাচ্ছিল, অভীক চৌধুরি করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। সুনন্দ বলল, অভীকদাকে আমি বলেছি তুই কুমুদকাকার সম্পত্তিটার সম্বন্ধে জানতে চাস। তোর প্রফেশনটা কী সেটাও অভীকদাকে বলেছি।’

‘আমরা অনেকদিন ধরেই কে কে সেন-এর সলিসিটর। আই ক্যান টেল ইউ হোয়াট ইজ পাবলিকলি নোন। বাট কানট ডাইভালজ এনিথিং কনফিডেনশিয়াল। সেটা আমার প্রফেশনাল এথিক্স-এর বিরুদ্ধে যাবে।’ অভীক চৌধুরি একটু থেমে থেমে কথা বলেন।

‘না, না। সেরকম কিছু আমি জানতে চাইব না।’ আদিত্য তাড়াতাড়ি বলল। ‘আমি খুব ব্রডলি কে কে সেন-এর সম্পত্তির ওয়ারিশ কারা এটা জানতে চাইছি। কেন চাইছি, সেটা আগে বলি।’ আদিত্যর জিন অ্যান্ড টনিক এসে গেছে। অভীক চৌধুরি কী পান করেন বেয়ারা নিশ্চয় জানত। সে জিন অ্যান্ড টনিকের সঙ্গে একটা রেড ওয়াইনের বোতলও নিয়ে এসেছিল। আদিত্য খেয়াল করল, ওয়াইনটা খাঁটি ফরাসি।

গেলাসে পানীয় ঢেলে দিয়ে বেয়ারা চলে যাবার পর আদিত্য সুনন্দকে জিজ্ঞেস করল, ‘সুনন্দ, তুই কি কুমুদকিশোর সেনের মেয়ে চন্দ্রলেখা সেনকে চিনতিস?’

‘একসময় খুব ভালই চিনতাম। তবে ওর ভাল নামটা মনে ছিল না। ওর ডাকনাম বুড়ি। আমরা ওই নামেই ওকে চিনতাম। আমারই ক্লাশে পড়ত। একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বুড়ি ওর বাবা-মার সঙ্গে আমাদের কালিংপং-এর বাড়িতে প্রায় একমাস কাটিয়েছিল। আমরা দুজনেই তখন ক্লাশ ফোরে পড়ি। ওই সময় বুড়ির সঙ্গে আমার একটু প্রেম প্রেম ভাব হয়েছিল।’ সুনন্দ হাসল।

‘কাফস লাভ।’ অভীক চৌধুরি ফোড়ন কাটলেন।

‘তা হঠাৎ বুড়ির কথা উঠল কেন?’ সুনন্দ জিজ্ঞেস করল।

‘কেন উঠল বলছি। তার আগে বলি, তুই যাকে বুড়ি বলে চিনতিস আমি তাকে চন্দ্রা বলে চিনতাম। চন্দ্রা কলেজে আমাদের ইয়ারে ফিজিক্স পড়ত। আমার বেশ বন্ধুই ছিল। তবে প্রেমের সম্পর্ক কখনও হয়নি।’ আদিত্য হাসল। ‘এবার আসল কথায় আসি। প্রায় একমাস হতে চলল চন্দ্রাকে পাওয়া যাচ্ছে না। চন্দ্রার এখনকার বয় ফ্রেন্ড চন্দ্রাকে খুঁজে বার করার জন্য আমাকে এমপ্লয় করেছে।’

‘চন্দ্রলেখা সেনকে পাওয়া যাচ্ছে না? অ্যান্ড উই আর নট ইভন ইনফরমড? দিস ইজ ভেরি স্ট্রেঞ্জ।’ অভীক চৌধুরি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন। ‘হার স্টেপমাদার শুড হ্যাভ ইনফরমড আস।’

‘দেখুন, সৎমায়ের সঙ্গে চন্দ্রার খুব একটা যোগাযোগ নেই। চন্দ্রা বসিরহাটে একটা স্কুলে পড়াত। কলকাতায় কমই আসত। এলেও চন্দ্রা ওদের আলিপুরের বাড়িতে উঠত না। মিসেস সেনের পক্ষে চন্দ্রার খবরটা না জানাটা অস্বাভাবিক নয়।’ আদিত্য ঠাণ্ডা গলায় বলল।

‘আপনি কি জানেন এটা নিয়ে কোনও এফ আই আর হয়েছে কিনা?’ অভীক চৌধুরির গলা থেকে এখনও উৎকন্ঠা যায়নি।

‘বসিরহাট জেলার সোলাডাঙায় একটা পুলিশ স্টেশন আছে। আমি যতদূর জানি সেখানে একটা এফ আই আর হয়েছে। তাছাড়া লালবাজারও এখন কেসটা টেক আপ করেছে। আপনি পুলিশ ইন্সপেকটর সঞ্জয় সমাদ্দারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন কতদূর এগিয়েছে জানতে পারবেন। উনি লালবাজারেই বসেন। আমি ওর নম্বরটা আপনাকে টেক্সট করে দিচ্ছি। আমার রেফারেন্স দিতে পারেন। আপনার নম্বরটা একটু বলবেন?’ আদিত্য অভীক চৌধুরির দিকে তাকিয়ে বলল।

নম্বর আদানপ্রদানের পর আদিত্য বলল, ‘এবার কি বোঝা যাচ্ছে কেন জানতে চাইছিলাম কে কে সেন-এর সম্পত্তি কতটা আর তার ওয়ারিশই বা কারা?’

‘কে কে সেনের সম্পত্তির পরিমাণ খুব কম নয়।’ অভীক চৌধুরি চিন্তিত গলায় বললেন। ‘আলিপুরে বাড়ি আর লন মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ কাঠা জমি। ওরকম প্রাইম লোকেশনে চল্লিশ কাঠা জমির কত দাম হতে পারে আমি অফহ্যান্ড বলতে পারব না। তবে অনেকটাই হবে। তাছাড়া হাজারিবাগে সেনেদের একটা বড় বাগানবাড়ি আছে। স্থাবর সম্পত্তি ছাড়াও বেশ কিছু টাকা কে কে সেন রেখে গেছেন। এই টাকাটা তিনি তিন ভাগে ভাগ করে গেছেন। একভাগের সুদ দিয়ে আলিপুর আর হাজারিবাগের বাড়ি দুটোর মেনটেনেন্স হয়। মেনটেনেন্স-এর দায়িত্ব আমাদের। দ্বিতীয় ভাগটা পেয়েছেন কে কে সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী মিসেস কমলিকা সেন। তিনি টাকাটা দিয়ে কী করেছেন আমি বলতে পারব না। তৃতীয় ভাগটা কে কে সেনের প্রথম পক্ষের সন্তান চন্দ্রলেখা সেনের। তিনি টাকাটা আমাদের কাছেই গচ্ছিত রেখেছেন। একটা সামান্য অংশ মান্থলি ইনকাম স্কিমে রাখা আছে। যে সুদটা হয় সেটা মাসে মাসে চন্দ্রলেখা সেনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে যায়। বাকীটা, অর্থাৎ বেশির ভাগটা, আমরাই বেস্ট পসিবল ইনটারেস্ট-এ ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখি, ম্যাচিওর করলে আবার রিনিউ করাই। টাকাটা বাড়তে বাড়তে এখন একটা ফ্যাবুলাস অ্যামাউন্ট রিচ করেছে।’

‘আলিপুর আর হাজারিবাগের বাড়ির মালিক কারা?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘কমলিকা সেন আর চন্দ্রলেখা সেনের সমান ভাগ। সম্পত্তিটা এমনভাবে ভাগ করা আছে যে দুজনেই তার অংশ আলাদা আলাদা ভাবে বিক্রি করতে পারেন। বাড়িটা পুব-পশ্চিম জুড়ে। সামনে লন। পুব দিকটা কমলিকা সেনের আর পশ্চিমের অংশটা চন্দ্রা সেনের। লনটার মালিকানাও দুভাগ করা। কিন্তু চন্দ্রা সেন তার অংশটা বিক্রি না করলে বাকি অংশটা লম্বাটে হয়ে যাবে। ফলে তার দামটাও অনেক কমে যাবে। যতদিন না সম্পত্তি বিক্রি হচ্ছে ততদিন আমাদের ওগুলো মেনটেন করে যেতে হবে। সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেলে মেনটেনেন্স-এর টাকাটা সমান দুভাগে ভাগ হয়ে কমলিকা সেন আর চন্দ্রলেখা সেনের কাছে চলে যাবে।’

‘আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে। চন্দ্রলেখা সেনের অবর্তমানে তার সম্পত্তির ওয়ারিশ কে?’

অভীক চৌধুরি মনে হয় এই প্রশ্নটারই অপেক্ষা করছিলেন। খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, ‘দেখুন, চন্দ্রলেখার কিছু ঘটে গেলে তার নেক্সট অফ কিন-এর কাছে সম্পত্তি যাবার কথা। সেরকম কেউ আছে বলে আমাদের জানা নেই। চন্দ্রলেখা নিজেই যদি কোনও উইল করে তার সম্পত্তি কাউকে দিয়ে যায় তাহলে তো ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। তবে চন্দ্রলেখা কোনও উইল করে গেছে কিনা তাও আমাদের জানা নেই।’

‘চন্দ্রলেখার অবর্তমানে কমলিকা সেন কি তার সম্পত্তির মালিক হতে পারেন?’

‘যদি চন্দ্রলেখার স্বামী অথবা রক্তের সম্পর্কের কেউ না থাকে আর সে যদি কোনও উইলও না করে যায়, তাহলে অ্যাকর্ডিং টু সেকশন ফিফটিন অফ দি হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট, নাইন্টিন ফিফটি সিক্স, তার সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে তার বাবার জীবিত উত্তরাধিকারী অর্থাৎ তার সৎমা কমলিকা সেন।’

‘থ্যাঙ্কস আ লট, মিস্টার চৌধুরি। আমি এইটুকুই জানতে চাইছিলাম।’ আদিত্যর গলায় অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা।

ঘটনার আকস্মিকতায় সুনন্দ মিত্র বেশ দমে গিয়েছিল। এতক্ষণে তার গলা শোনা গেল, ‘আদিত্য, তুই কি তাহলে বলতে চাইছিস সম্পত্তির লোভে বুড়িকে তার সৎমা লোপাট করে দিয়েছে?’

‘না, না। আমি মোটেই সেরকম কিছু বলতে চাইছি না।’ আদিত্য আত্মরক্ষার ভঙ্গীতে বলল। ‘কিন্তু ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করতে গেলে আমাকে তো সব সম্ভাবনাগুলোই মাথায় রাখতে হবে।’

‘আর কী কী সম্ভাবনার কথা আপনি ভাবছেন?’ এবার অভীক চৌধুরির গলা।

‘চন্দ্রার সঙ্গে একটা এক্সট্রিম লেফট টেররিস্ট গ্রুপের বেশ ক্লোজ কানেকশন ছিল। এরা পুরুলিয়ার দিকে ঝাড়খণ্ডের বর্ডার বরাবর অপরেট করত। দল এখন ভেঙে গেছে। কিন্তু হতেই পারে চন্দ্রা ওদের কিছু সিক্রেট জানত বলে ওরা চন্দ্রাকে সরিয়ে দিয়েছে। আবার এমনও হতে পারে নতুন করে আবার দল তৈরি করবে বলে চন্দ্রাই নিজে থেকে অ্যাবস্কন্ড করে আছে। আরও অনেক পসিবিলিটি আছে। সবটা আমি এখনও ভেবে উঠতে পারিনি। কয়েকদিনের মধ্যে পুরুলিয়া যাচ্ছি। হয়ত ওখানে গেলে ব্যাপারটা খানিকটা বুঝতে পারব।’

বেয়ারা আরেক প্রস্থ পানীয় দিয়ে গেছে। সকলেই চুপচাপ। সকলেই চিন্তামগ্ন। একটু পরে নীরবতা ভেঙে আদিত্য বলল, ‘আচ্ছা, কমলিকা সেন সম্বন্ধে কিছু জানা যায়? উনি কী করেন, কীভাবে সময় কাটান, কাদের সঙ্গে মেশেন?’

‘আমি কমলিকা সেনকে প্রায় চিনিই না। একবার দুবার দেখেছি। কুমুদকাকা দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরে আমার বাবা-মা ওদের বাড়িতে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিল। আসলে, বুড়ির মাকে আমার বাবা-মা খুব ভালবাসত। তাই কুমুদকাকার দ্বিতীয় বিয়েটা মোটেই মেনে নিতে পারেনি।’ সুনন্দ জানাল।

‘আমাকে অবশ্য নিয়মিত কমলিকা সেনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। আমি যতদূর জানি, ভদ্রমহিলা একজন সোশালাইট। কলকাতার উঁচু মহলে বিচরণ করেন। ওঁর একটা প্যাশন আছে। হিন্দুস্তানি ক্লাসিকাল মিউজিক। উনি ওঁর বাড়িতে মাঝে মাঝেই হিন্দুস্তানি ক্লাসিকাল মিউজিকের প্রোগ্রাম অর্গানাইজ করেন। এক সময় উনি নিজেও ভাল নাচতেন। আমাকে অনেকবার ইনভাইট করেছেন। কিন্তু আমি ও রসে বঞ্চিত। তাই কখনও যাওয়া হয়নি।’

অভীক চৌধুরি আরও অনেক কিছু বলছিল, কিন্তু আদিত্য শুনছিল না। সে ভাবছিল, কমলিকা সেন যদি তার বাড়িতে নিয়মিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মজলিস অর্গানাইজ করে থাকেন তাহলে সম্ভবত অমিতাভ তাকে চিনবে। সেক্ষেত্রে অমিতাভই আদিত্যকে কমলিকা সেন অব্দি পৌঁছে দিতে পারবে।

(৩)

‘আমার কফিতে একটু বেশি করে দুধ-চিনি দেবেন স্যার। কফি জিনিসটা কাঁচা-কাঁচা খেতে পারি না।’ একটা মারি বিস্কুট হাতে তুলে নিয়ে বিমল বলল।

কাঁচা-কাঁচা কফি কথাটা আদিত্যর কানে লাগছিল। কাঁচা মাংস, কাঁচা মাছ, কাঁচা ফল, কাঁচা সবজি অব্দি সে মেনে নিতে পারে। কিন্তু তাই বলে কাঁচা কফি? তারপর মনে হল, কালো কফিকে তো অনেকে র কফি বলে। বিমল কি তারই বঙ্গানুবাদ করেছে? বোধহয় না। অত ভেবেচিন্তে কথা বলার লোক বিমল নয়। সে মুখে বিমলকে জিজ্ঞেস করল, ‘কচামচ চিনি দেব?’

পুজোর সময় অকালবর্ষণ ঘটিয়ে কালো মেঘগুলো আকাশ থেকে আপাতত বিদায় নিয়েছে। বৃষ্টি থেমে যাবার ঠিক পরে কয়েকদিন একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পড়েছিল। আদিত্যর মনে হয়েছিল শীতটাও বুঝি এবার তাড়াতাড়ি পড়ে যাবে। আদতে সেরকম কিছু ঘটল না। দুএকটা দিন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা থাকার পর সেই যে গুমোট শুরু হল, সেটা এখনও চলছে। এই নভেম্বর মাসেও এতটাই গুমোট যে বেশিক্ষণ হাঁটলে সারা গা ঘামে ভিজে যায়। জামা-টামা ঘামে ভিজে গেলে আবার কাচার ঝামেলা। শুকোতে দেবার ঝামেলা। আদিত্য খেয়াল করেনি কখন চেয়ার থেকে উঠে বিমল তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘যদি কিছু মনে না করেন চিনিটা আমি মিশিয়ে নেব স্যার?’

‘নিয়ে নাও যতটা ইচ্ছে। আমি ততক্ষণ তোমার কফির জন্য দুধটা গুলে ফেলি। তবে দুধটা বেশ পুরোনো হয়ে গেছে, কেটে যেতে পারে। আমি তো কফিতে দুধ চিনি খাই না। দুধটা পড়েই রয়েছে।’

ভাগ্যক্রমে দুধটা দুধই রইল, ছানায় রূপান্তরিত হল না। তবে তাই দিয়ে যে পানীয়টা তৈরি হল সেটা এতটাই ফরসা যে তাকে কফি বলতে আদিত্য অন্তত রাজি নয়।

‘তোমার বাড়ির কী অবস্থা?’

‘সেই একই রকম স্যার। বউ বিছানাতেই শুয়ে। ভারী অপারেশন তো। ডাক্তার এখনও কাজ করার পারমিশান দেয়নি। মেয়ে আর আমি সংসার সামলাচ্ছি। তবে মেয়েটা এখনও বেশ দুর্বল। বেশিক্ষণ কাজ করতে পারে না। একটু কাজ করেই হাঁপিয়ে ওঠে। গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আমিই রান্নাবান্না করছি। ডাক্তার বলেছে মেয়ে বেশি পরিশ্রম করলে আবার ঘুরে অসুখে পড়তে পারে। ওই রিল্যাপ না কী একটা যেন বলল।’

‘বুঝেছি, রিল্যাপ্স। টাইফয়েড সেরে যাবার পরে ঠিকমতো বিশ্রাম আর পথ্য না হলে অসুখটা রিল্যাপ্স করতে পারে। মানে, ঘুরে আবার হতে পারে। তুমি মেয়েকে একটু সাবধানে রেখো।’

‘চেষ্টা করি স্যার। আমার যতটুকু ক্ষমতা আছে তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করি। কিন্তু আমার কতটুকুই বা ক্ষমতা?’

‘তুমি কাজে বেরোও কখন? ফেরো কটায়?’

‘আমার কাজটা স্যার রাত্তির আটটা থেকে সকাল আটটা। বাড়ি থেকে সন্ধে সাতটা নাগাদ বেরোলেই হয়ে যায়। সেদিক থেকে সুবিধে। সকাল নটা সাড়ে নটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাই। ফিরে রান্নাবান্না করি। সকালটা মেয়েকেই সামলাতে হয়। মেয়ে দশটা নাগাদ ইস্কুল চলে যায়। আমি সারাদিন বউএর সঙ্গে থাকি। ছেলেটা তো বললাম স্যার একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। খাবার সময় ছাড়া বাড়িতে তাকে দেখতেই পাই না।’

‘তোমার চাকরিটা ঠিকঠাক চলছে তো?’

‘চাকরিটা মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট। কিন্তু মাইনেটা বড় কম। হাউসিং সোসাইটি আমার কাজ বাবদ সিকিউরিটি কম্পানিকে দেয় সাত হাজার। তার থেকে এক হাজার কেটে নিয়ে কম্পানি আমাকে দেয় ছ’হাজার। আপনিই বলুন স্যার, এই বাজারে ছ’হাজার টাকায় মাস চলে?’

আদিত্য কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘তোমাকে যদি একটা কাজ দিই, সেটা তো তোমাকে দিনের বেলায় করতে হবে। তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে তোমার বউকে দেখবে কে?’

‘সেটা কোনও সমস্যা হবে না স্যার। আমি এখন বাড়ি থাকি বলে বউএর কাছে থাকি। কিন্তু ওর কাছে কাউকে থাকতেই হবে এরকম অবস্থা ওর নয়। এমনিতে উঠে হেঁটে বেড়াতে পারে। ডাক্তার ওকে হাঁটাচলা করতেই বলেছে। শুধু ভারী কোনও কাজ, যেমন জল তোলা বা ঘর ঝাঁট দেওয়া, ঘর মোছা বা এমনকি রান্না করা, সেসব এখন বারণ। আমি বেরোনোর আগে ওইসব কাজগুলো সেরে বেরোতেই পারি। আর আমাদের বস্তির বউ-ঝিরাও খুব ভাল। বলে রাখলে মাঝে মাঝেই এসে আমার বউএর খবর নিয়ে যাবে।’

নিজের কফিতে একটা ছোট চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘তাহলে শোনো তোমাকে কী করতে হবে। আলিপুরে বর্ধমান রোড আছে, সেখানে গিয়ে ব্যারিস্টার কে কে সেন-এর বাড়িটা খুঁজে বের করতে হবে। ঠিকানাটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। ভদ্রলোকের পুরো নাম কুমুদকিশোর সেন। বেশ কয়েক বছর হল মারা গেছেন। তবে বাড়িটা এখনও রয়েছে। মস্ত বড় বাড়িটাতে কুমুদকিশোরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কমলিকা সেন একাই থাকেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রী ব্যারিস্টার সাহেব মারা যাবার বহুদিন আগেই গত হয়েছিলেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা যাবার কিছুদিন পরে ব্যারিস্টার সাহেব দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। দ্বিতীয় পক্ষে কোনও ছেলেমেয়ে নেই।’

আদিত্য একটু থেমে কফিতে একটা চুমুক দিল। তারপর আবার শুরু করল। ‘দ্বিতীয় পক্ষে ছেলেমেয়ে না থাকলেও ব্যারিস্টার সাহেবের প্রথম পক্ষে একটি মেয়ে ছিল। নাম চন্দ্রলেখা, চন্দ্রলেখা সেন। এই চন্দ্রলেখা সেনকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার কাজ তাকে খুঁজে বার করা। চন্দ্রলেখা অবশ্য আলিপুরের বাড়িতে থাকত না। কিন্তু ওই বাড়ি এবং সংলগ্ন জমির অর্ধেক মালিকানা তার। বাড়ি আর লন মিলিয়ে, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, প্রায় চল্লিশ কাঠা জমি। বর্ধমান রোডের ওপরে চল্লিশ কাঠা জমির দাম কত হবে বুঝতে পারছ? তাছাড়া কুমুদ সেন ব্যাঙ্কেও বিপুল টাকা রেখে গেছে। সেটাতেও তার মেয়ে এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর সমান ভাগ।’

‘ঠাকুরের একচোখোমিটা দেখুন স্যার,’ বিমল আর না বলে পারল না, ‘এই আমি, টাকার অভাবে বউ-মেয়েকে ওষুধ-পথ্য দিতে পারছি না, আর কিছু লোকের এত টাকা যে টাকা নিয়ে কী করবে ভেবে পায় না।’

দৈবী অবিচার নিয়ে আদিত্যও অনেক ভেবেছে, তবে খুব পরিষ্কার কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। সে একটু দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল, ‘কিন্তু একবার ভেবে দেখ, এইসব বড়লোকেরা কি সব সময় সুখে থাকে? হয়ত দেখবে তোমার বাড়িতে যে সুখটা আছে এদের বাড়িতে সেটা নেই।’

‘সে আপনি যাই বলুন স্যার। মাঝে মাঝে ভগবানের ওপর খুব রাগ হয়। আমাদের টানাটানির সংসারেই কি যত রোগ-বালাই দিতে হবে? এই নড়বড়ে খাঁচায় আমরা আর কত নিতে পারি?’

এসব কঠিন প্রশ্নের উত্তর আদিত্যর জানা নেই। সে খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘ছাড়ো ওসব কথা। কাজের কথাটা শোনো। তোমাকে কমলিকা সেন সম্বন্ধে খবর জোগাড় করতে হবে। ভদ্রমহিলা কোথায় যান, কী করেন, কাদের সঙ্গে মেশেন, আমার সবটা জানা দরকার। আর শোনো, তুমি এই হাজার দশেক টাকা রাখো। তোমাকে কাজ বাবদ অগ্রিম দিলাম। বউ আর মেয়ের জন্যে একটু ফল-টল কিনো। ওষুধ কিনো। আর পারলে ওদের একটু মুরগির স্টু খাইও। মুরগির স্টুতে শরীরে বল হয়। শালার কাছে কত ধার করেছ?’

‘সে অনেক টাকা স্যার। একসঙ্গে শোধ দিতে পারব না। একটু একটু করে শোধ দিতে হবে। তবে এই দশ হাজার আমার খুব কাজে লাগবে স্যার। একটু আগে যে ঠাকুরের একচোখোমির কথা বলছিলাম, সেটা ফিরিয়ে নিচ্ছি। মাথার ওপর ঠাকুর আছেন। নিশ্চয় আছেন। নাহলে আপনি আজ আমাকে ডাকবেন কেন? টাকাই বা দেবেন কেন?’

 বিমলের চোখদুটো কৃতজ্ঞতায় চিকচিক করছে। আদিত্য বুঝতে পারল না কৃতজ্ঞতাটা তার প্রতি না ঠাকুরের প্রতি।

বিমল চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যর মোবাইলটা বেজে উঠল। পার্থ অ্যামেরিকা থেকে ফোন করেছে। তাকে এখন অব্দি কী ঘটেছে সেটা ডিটেলে বলতে গিয়ে প্রায় মিনিট পনের লেগে গেল আদিত্যর।

(৪)

ইলিশ মাছ রান্না নিয়ে রত্নার সঙ্গে অমিতাভর চিরন্তন মতবিরোধ। এটা আসলে বাঙাল-ঘটির ঝগড়া। রত্নাদের দেশ ফরিদপুরে আর অমিতাভরা ঘোর দোখনো, অর্থাৎ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লোক। রত্না মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা ও হলুদ দিয়ে কাঁচা ইলিশের যে লম্বা ঝোল হয়, যাতে কখনও-সখনও এক-আধ চিলতে বেগুন বা কাঁচা কুমড়োও চলতে পারে, সেটাই ইলিশের শ্রেষ্ঠ রান্না। এই রান্নায় মশলার আধিক্য নেই বলে এতে ইলিশের নিজের স্বাদটা বজায় থাকে। এটাই ফরাসী রান্নার দর্শন। ফরাসীরা বলবে, যে জিনিসটা রান্না করছ, দেখো, মশলা এবং অন্যান্য উপকরণ দিয়ে যেন তার নিজস্ব স্বাদটা ঢাকা পড়ে না যায়। রত্নারও তাই মত। রত্নার সঙ্গে রান্নার কম্পিটিশনে নামা, অমিতাভর পক্ষে কুমিরের সঙ্গে সাঁতারের প্রতিযোগিতায় নামার মতো। কুমির শুধু যে তাড়াতাড়ি সাঁতার কাটতে পারে তাই নয়, প্রতিপক্ষকে তেড়েও যেতে পারে। তেমনি রত্না ভাল রাঁধুনি তো বটেই, তার ওপর অমিতাভকে সে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখলে তেড়ে আসবে না, এমন গ্যারেন্টি নেই। অমিতাভ নিজে যে একেবারে রান্না করতে পারে না তা নয়, বস্তুত বিদেশে ছাত্র থাকার সময় সে নিজের রসনার তাগিদেই অনেক ধরনের রান্না শিখে ফেলেছিল। কিন্তু রত্না তার সেই কষ্টার্জিত জ্ঞানকে কোনওরকম গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। তাই অমিতাভর সর্বাধিক পছন্দ যে দই ও সর্ষেবাটা দিয়ে গা মাখা ইলিশ মাছের ঝাল, যেটা রান্না হবে ভাপে, তাকে রত্না মোটেই পাত্তা দিতে চায় না। তবে একটা ব্যাপারে দুজনেই একমত। দুজনেই মনে করে, ইলিশ মাছ ভাজা ও তার থেকে বেরনো তেল অতিশয় উপাদেয় এবং বাড়িতে ইলিশ এলে এটাই হওয়া উচিত স্টার্টার।

আজকাল বর্ষা ঋতুর আগমন যেমন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিন মাসে পুজোর সময় নাগাড়ে ধারাবর্ষণ হচ্ছে, তেমনি ইলিশেরও আবির্ভাব ঘটছে দেরিতে। এবছর পুজো অব্দি জাত ইলিশের দেখা মেলেনি। ছ-সাত ইঞ্চির খোকা ইলিশকেই নিরুপায় বাঙালি অহেতুক দাম দিয়ে ঘরে নিয়ে গেছে। অথচ কী আশ্চর্য, এখন, এই পুজো কেটে যাবার এক সপ্তাহ পরে, বাজারে হঠাৎ দেড় কেজি দুকেজির টাটকা ইলিশ দেখা যাচ্ছে। দাম একটু বেশি হলেও মধ্যবিত্তর ধরাছোঁয়ার একেবারে বাইরে নয়।

বাঙাল রক্ত নিয়ে যাঁদের জাত্যভিমান আছে তাঁরা অবশ্য বিজয়া দশমী থেকে সরস্বতী পুজো অব্দি ইলিশ খান না। কারণ এই সময়টা ইলিশের প্রজননের সময়। প্রজননে ব্যাঘাত ঘটলে পরের বছর ইলিশের যোগানে টান পড়বে এই অভিজ্ঞান হেতু ইলিশভক্ষণে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা বাঙাল দেশে বহুদিনের। তাছাড়া এই সময় ইলিশের স্বাদও নাকি তেমন ভাল হয় না। সেসব পুরোনো অভিজ্ঞান অবশ্য ক্লাইমেট চেঞ্জের ধাক্কায় ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। এখন বৃষ্টি হয়, ইলিশ ওঠে সবই বেটাইমে, তার পেছনে এল নিনো বা অন্য গূঢ়তর কোনও প্রাকৃতিক চক্রান্ত থাকতেও পারে, কিন্তু সেসব না ভেবে অমিতাভ গড়িয়াহাট বাজার থেকে দুকেজি সাইজের দুটি ইলিশ কিনে এনেছে। অমিতাভর একটা সুবিধে, বাঙাল রক্ত নিয়ে তার জাত্যভিমানের ঝামেলা নেই। কিন্তু আসল ভরসার কথা হল, অসময়ের ইলিশ দেখে রত্না ভুরু কোঁচকায়নি, বরং খুশিই হয়েছে।

এসব শুক্রবারের কথা। আজ রবিবার। অমিতাভ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে টাটকা ইলিশ অনেক দিন ধরে ফ্রিজে রেখে বাসি করে খাওয়া আর দেবস্থানে মলমূত্র ত্যাগ করা একই মাত্রার পাপ। তাই সে আজ মধ্যাহ্নভোজনে দুতিনজন নিকট বন্ধুবান্ধবকে ইলিশের নেমন্তন্ন করেছে। উদ্দেশ্য, সকলে মিলে ঈশ্বরের এই দান উপভোগ করবে। রত্নার সঙ্গে তার একটা রফা হয়েছে। ঠিক হয়েছে, রত্না যেমন কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়ে ইলিশের লম্বা ঝোল রাঁধবে, তেমনি অমিতাভও ভাপা ইলিশ রান্না করার সুযোগ পাবে। এছাড়াও রান্নার মাসি রত্নার ত্তত্বাবধানে রত্নার সিগনেচার আইটেম খাসির মাংসের দোপেঁয়াজা রাঁধছে।

এসব দরকারি কথা আদিত্য কিছুটা আগেই জানত এবং কিছুটা অমিতাভ ফোন করে জানিয়েছে। তার সঙ্গে বলেছে, ‘একটায় লাঞ্চ, কিন্তু এগারোটার মধ্যে চলে আয়। নানারকম বিলাওল শুনব বলে বেছে রেখেছি। আলাইয়া, দেবগিরি, ইমনি, ককুভ।’

সাড়ে এগারোটায় রত্নাদের বাড়ি পৌঁছে আদিত্য দেখল সে-ই প্রথম, অন্য অতিথিদের কেউই তখনও আসেনি। কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। সারা বাড়ি ইলিশের গন্ধে ম ম করছে। রান্নাঘরে ঢুকে আদিত্য দেখল রত্না খুব মন দিয়ে রান্নার মাসিকে কী যেন বোঝাচ্ছে। আদিত্যকে দেখে রত্না বলল, ‘অমিতাভ স্নান করতে গেছে। যতক্ষণ না বেরোচ্ছে ততক্ষণ তুই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের মরাল সাপোর্ট দিতে পারিস, কিংবা বসার ঘরে গিয়ে ঠাণ্ডায় বসতে পারিস।’

‘আমি বসার ঘরে গিয়েই বসছি। টুবলু কোথায় রে?’

‘টুবলু তো অঙ্ক কোচিং-এ গেছে। শেষ পর্যন্ত একটা কোচিং-এ দিতেই হল। অঙ্কটা আমাদের দুজনের কেউই পারি না। একেবারেই পারি না। নাহলে এই ক্লাশ ফাইভে কোচিং-এ দিতে হয়? যাক গে। তুই গিয়ে বোস, অমিতাভ এক্ষুনি বাথরুম থেকে বেরিয়ে পড়বে।’

দুমিনিটও হয়নি আদিত্য বসার ঘরে গিয়ে বসেছে রত্না হাতে একটা রুম ফ্রেশনার নিয়ে হাজির। বলল, ‘বাড়িময় বিচ্ছিরি মেছো গন্ধ হয়ে গেছে। ইলিশ মাছ রান্না করার এই সমস্যা।’

রত্না সিলিং-এর দিকে তাক করে খানিক রুম ফ্রেশনার স্প্রে করে দিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল। সম্ভবত সেসব ঘরেও সুগন্ধ ছড়ানো হবে। বিন্দু বিন্দু সুগন্ধ বৃষ্টির ধারার মতো ওপর থেকে ঝরে পড়ছে। সেই রাশি রাশি সুগন্ধের মধ্যে বসে আদিত্য টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা ইতিহাসের জার্নাল তুলে নিয়ে আনাড়ির মতো পাতা ওল্টাচ্ছে এমন সময় অমিতাভর গলা শোনা গেল, ‘কী রে কখন এলি?’

‘আমাকে এগারোটায় আসতে বলে কোন আক্কেলে নিজে চান করতে ঢুকে গেলি?’

‘আরে এগারোটায় আসতে বললে তুই বারোটায় আসবি এটা ধরে নিয়ে চানে ঢুকেছিলাম। দ্যাখ, বারোটা বাজতে এখনও দেরি আছে। আমি কী করে জানব তুই এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবি?’

‘এ-ব্যাপারে আমার দোষ নেই।’ আদিত্য স্বীকারোক্তির ভঙ্গীতে বলল। ‘আমিই বা কী করব যদি আজ মেট্রোতে কেউ আত্মহত্যা না করে? মেট্রোর দরজাগুলো সব ঠিকঠাক বন্ধ হয়? আমি যে গাড়িটাতে আসছি সেটার আগের গাড়িটা খারাপ হয়ে সামনের কোনও স্টেশনে দাঁড়িয়ে না থাকে?’

‘যাক গে, দুঃখ করিস না। এরকম অঘটন মাঝে মাঝে ঘটে যায়। তোর তো কোনও দোষ নেই। তুই বরং বসে বসে নিভৃতিবুয়ার এই ককুভ বিলাওলটা শোন। আমি ততক্ষণে চুলটা আঁচড়ে আসি।’

অমিতাভ ওর ল্যাপটপে গানটা চালিয়ে দিতেই বসার ঘরের দুটো বড় স্পিকারে গমগম করে উঠল নিভৃতিবুয়ার গলা। ওয়াই ফাই-এর কী মহিমা!

সাড়ে বারোটার মধ্যে অন্য অতিথিরাও এসে গেল। অবশ্য সংখ্যায় তারা খুব বেশি নয়। মাত্র তিনজন। একটি দম্পতি, শৌভিক রায় আর চিত্রা গুহ, দুজনেই আদিত্যর চেনা, কলেজে আদিত্যদের তিন ক্লাশ নিচে পড়ত। দুজনেই এখন নামকরা ঐতিহাসিক। অমিতাভর মতে চমৎকার রিসার্চ করছে। আর একজন প্রবাসী বাঙালি, নাম শেখর সেনগুপ্ত, তিনিও ঐতিহাসিক, দিল্লিতে পড়ান, অমিতাভর বিদেশের বন্ধু, কয়েক সপ্তাহের জন্য অমিতাভদের ইন্সটিটিউট ভিজিট করতে এসেছেন, তবে সস্ত্রীক আসেননি। অমিতাভ আদিত্যকে আগেই জানিয়েছিল যে ধ্রুপদী সঙ্গীতের ব্যাপারে এদের সকলেরই প্রবল উৎসাহ আছে। তাই কথাবার্তা চালিয়ে যেতে অসুবিধে হবে না। তবু এত পণ্ডিতদের ভীড়ে আদিত্য একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। ভাগ্যিস অমিতাভর ল্যাপটপে তখন বুধাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের আলাইয়া বিলায়ল বাজছিল, নাহলে আদিত্যকে স্রেফ চুপচাপ বসে পণ্ডিতদের পণ্ডিতি শুনতে হত। আদিত্যর ভাগ্য ভালো, অচিরেই আলোচনাটা বাঙালির মিউজিকাল ট্যালেন্টের দিকে ঘুরে গেল।

বুধাদিত্যর বাজনা শুনতে শুনতে শেখর বলল, ‘যাই বল অমিতাভ, আজকাল গান-বাজনায় কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের দেখতেই পাই না। এই বুধাদিত্য মুখার্জীও তো ভিলাইতে বড় হয়েছেন।’

‘আসলে ধ্রুপদী সঙ্গীতের জন্য পেট্রন দরকার। আগে রাজা-রাজড়া-জমিদাররা ছিল। এখন তাদের জায়গায় কর্পোরেটরা এসেছে। কলকাতায় কর্পোরেট কম, তাই স্পনসর, পেট্রন সবই কম।’ অমিতাভ তার মতামত জানাল।

‘আমি কিন্তু পেট্রন নয়, ট্যালেন্টের কথা বলছি। পরিশ্রমী মিউজিশিয়ানদের কথা বলছি। এখানে কোথায় তারা?’

‘আছে, ট্যালেন্ট আছে। কিন্তু উপযুক্ত পেট্রনেজের অভাবে তারা হারিয়ে যাচ্ছে।’ অমিতাভ তার জায়গা থেকে নড়বে না।

‘অমিতাভদার পেট্রনেজে কিন্তু একজন বাঙালি গায়ক বেশ দাঁড়িয়ে গেছে। নন্দন চক্রবর্তীর গান শুনেছেন?’ এবার চিত্রার গলা।

‘অবশ্যই শুনেছি। সিমপ্লি সুপার্ব। কিন্তু সেও তো তালিম পেয়েছে দিল্লিতে।’ শেখরও ছাড়ার লোক নয়।

যুদ্ধ অবসানের কোনও সম্ভাবনা নেই দেখে আদিত্য বলে উঠল, ‘আচ্ছা, শুনেছি আজকাল আলিপুরে কমলিকা সেনের বাড়িতে অনেক ইয়াং ট্যালেন্ট পারফর্ম করছে। অনেকেই বলছে, শি ইজ ডুয়িং আ গুড জব অফ প্রোমোটিং ইয়াং ট্যালেন্টস।’

‘আমি ওঁর বাড়িতে কয়েকটা প্রোগ্রাম শুনেছি। মন্দ নয়। তবে আমার মনে হয়েছে ইয়াংদের প্রোমোট করার থেকেও শি ইজ মোর ইনটারেস্টেড ইন প্রোমোটিং হারসেলফ। ওই এক-একজনের লাইমলাইটে আসার একটা অ্যামবিশন থাকে না?’ কমলিকা সেনকে বেশি নম্বর দিতে অমিতাভ রাজি নয়।

‘এরকম কেন বলছ অমিতাভদা?’ শৌভিক বলল, ‘চিত্রা আর আমি অনেকদিন ধরে ওঁকে চিনি। গান-বাজনার ব্যাপারে ওঁর ডেডিকেশনটা কিন্তু জেনুইন। তাই না চিত্রা?’

‘আমার তো তাই মনে হয়।’ চিত্রা বলল।

‘আমি দিল্লি সার্কেলেও কমলিকা সেনের নাম শুনেছি। সবাই বলে ভাল অরগানাইজার।’ এবার শেখরের গলা।

‘হয়ত আমারই ভুল হয়েছে। তোমরা সবাই একসঙ্গে নিশ্চয় ভুল বলবে না। সামনের সপ্তাহে কমলিকা সেনের বাড়িতে একটা প্রোগ্রাম আছে। উনি ফোন করেছিলেন। যাব তাহলে। তোরা যাচ্ছিস?’ অমিতাভর শেষের প্রশ্নটা শৌভিক-চিত্রাকে।

‘আমরা তো অবশ্যই যেতাম। সাধারণত আমরা ওঁর বাড়ির প্রোগ্রাম খুব একটা মিস করি না। কিন্তু ওই সময় আমরা কলকাতায় থাকছি না।’ চিত্রা জানাল।

‘লাঞ্চ রেডি। খেতে চল সকলে।’ রত্না কখন ঘরে ঢুকেছে কেউ টের পায়নি।

গুরুভোজন হল। হওয়ারই কথা ছিল। রত্নার কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়ে ইলিশের লম্বা ঝোল আর অমিতাভর ভাপে ইলিশ দুটোই লেটার নম্বর পেয়ে পাশ করে গেছে। বলা যায় খেলা ড্র। খাবার পর টানা পাঁচটা অব্দি আড্ডা চলল। পণ্ডিতি নয়, স্রেফ আড্ডা। গান-বাজনা থেকে পলিটিক্স, দেশের ভবিষ্যৎ, শিক্ষার ভবিষ্যৎ, ইলিশের ভবিষ্যৎ, চেনা দুএকজনের সম্বন্ধে হাল্কা কেচ্ছা, সাহিত্য, আবার গান-বাজনা।

পাঁচটার সময় শেখর বলল, ‘আমাকে এবার উঠতে হবে। কাছেই একডালিয়া রোডে আমার কাকা-কাকিমা থাকেন। এতদূর যখন এলাম একবার দেখা করে যাব।’

‘আমরাও উঠব অমিতাভদা। আর এন টেগোরে এক বন্ধুকে দেখতে যাব। বন্ধুর বাইপাস সার্জারি হয়েছে। ভাবো, চল্লিশ বছর বয়েস, এর মধ্যেই আর্টারি ব্লক। খুব সিগারেট খেত অবশ্য।’

আদিত্যর কেমন যেন মনে হল শৌভিক শেষ কথাগুলো তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে। এই মজলিসে সে-ই একমাত্র সিগারেটখোর। রত্নার বকাবকি সত্ত্বেও সে কয়েকবার বারান্দায় গিয়ে ধূমপান করে এসেছে।

অন্য অতিথিরা চলে যাবার পর আদিত্য অমিতাভকে বলল, শোন, সামনের সপ্তাহে কমলিকা সেনের বাড়িতে তুই যদি গান শুনতে যাস আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবি?’

‘নিশ্চয় পারব। কিন্তু হঠাৎ ইয়াং ট্যালেন্টদের ব্যাপারে তোর এত উৎসাহ হল কেন? আগে তো কখনও এরকম উৎসাহ দেখিনি।’

‘ইয়াং ট্যালেন্টদের ব্যাপারে আমার কোনও উৎসাহ নেই। আগেও ছিল না, এখনও নেই। আমার উৎসাহ কমলিকা সেনের ব্যাপারে। কারণটা বললেই বুঝতে পারবি। কমলিকা সেন চন্দ্রলেখা সেনের সৎমা, যে চন্দ্রলেখা সেনকে খুঁজে বার করার জন্য আমাকে অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছে। কমলিকা সেনকে দেখতে চাই, তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। পরশু আমি দুতিন দিনের জন্য পুরুলিয়া যাচ্ছি। প্রোগ্রামটা কবে?’

‘আজ তো একটা রবিবার, প্রোগ্রামটা আগামী শনিবার সন্ধেবেলা।’

‘আমি শুক্রবারের মধ্যে ফিরে আসছি। ফিরে এসে তোর সঙ্গে যোগাযোগ করব।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *