চন্দ্রলেখা অন্তর্ধান রহস্য – ৪

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

(১)

শ্যামবাজার-বাগবাজার অঞ্চলটা আদিত্যর পছন্দ। বাগবাজারে ছিল আদিত্যর মামার বাড়ি, শ্যামবাজারে মাসির বাড়ি। খুব ছোটবেলায়, যখন আদিত্যর মা বেঁচে, তখন প্রায় প্রত্যেক বৃহস্পতিবার মার সঙ্গে সে মামার বাড়ি যেত। আর মামার বাড়ি গেলে একবার মাসির বাড়ি যাওয়া হতোই। বৃহস্পতিবার করে মামার বাড়ি যাওয়া হতো, কারণ ওই দিনটাই আদিত্যদের মিশনারি ইস্কুলে ছুটি থাকত। মামার বাড়িতে আদিত্যর দুই দিদি তার থেকে অনেকটাই বড়। কাজেই সেখানে তার বিরাট খাতির। আর মাসির ছেলেমেয়েই ছিল না। তাই মাসির বাড়ি গিয়ে যা খুশি দৌরাত্ম্য করার অধিকার ছিল তার। বলরাম ঘোষ স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আদিত্যর এইসব পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।

 আদিত্যকে যেতে হবে বাগবাজারের নিবেদিতা লেনে। রত্নার বন্ধু গার্গী বিশ্বাসের কাছ থেকে কেয়া বাগচির ফোন নম্বর পেয়ে আদিত্য তাকে ফোন করেছিল। কেয়া বাগচি সন্ধে ছটায় সময় দিয়েছে। সে থাকে নিবেদিতা লেনে একটা মেয়েদের মেসবাড়িতে। কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে বাস ধরে আদিত্য ফড়েপুকুরের মোড়ে বেশ আগে আগেই নেমে পড়েছিল। ইচ্ছে, ছেলেবেলার ওই পুরোনো রাস্তাগুলো দিয়ে একটু হাঁটবে। ইচ্ছে হলে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চা খাবে, রাস্তা দেখবে।

পুরোনো দোকানগুলো কিছু আছে, বেশিরভাগই নেই। মাসির বাড়ি গেলে বিকেলবেলা মালঞ্চ রেস্টোরেন্ট থেকে কাটলেট আসত। সেই মালঞ্চ কবে উঠে গেছে। মালঞ্চর উল্টো ফুটপাথে ছিল জোনাকি রেস্টোরেন্ট, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে হতো, সেটাও আর নেই। অরফানের চায়ের দোকানটা অবশ্য এখনও রয়েছে, কিন্তু তার পাশে দত্ত বেকারি উধাও। বলরাম ঘোষ স্ট্রিট ধরে আদিত্য হাঁটছিল। আদিত্যর মাসি-মেসোর বনেদি বাড়িটা শরিকি মামলায় জর্জরিত হয়ে পোড়ো বাড়ির মতো পড়ে আছে, মাসি-মেসো বহুদিন গত হয়েছেন। শ্যামপুকুর থানা পেরিয়ে, ডাফ ইস্কুলের সামনে দিয়ে, সরস্বতী ইস্কুলের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভূপেন্দ্র বসু এভিনিউতে পড়ল আদিত্য। ডাফ ইস্কুলের সামনে দিয়ে যাবার সময় বাবার কাছে শোনা সেই পুরোনো গল্পটা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন আগে যারা ডাফ সাহেবের ইস্কুলে পড়ত তারা একটু বেশি শিখত, জানত, কথাও বলত একটু বেশি। তাদের বলা হতো ডেফো। এই ‘ডেফো’ থেকেই ‘ডেঁপো’ শব্দটার উৎপত্তি।

ভূপেন বোস এভিনিউ যেখানে চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে মিশেছে সেখানে ডাইনে বেঁকে আরও খানিকটা হাঁটলেই রাস্তার মাঝখানে গিরীশ ঘোষের বাড়ি। বাড়ির দুপাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। গিরীশ ঘোষের বাড়ির পশ্চিম দিক থেকে শুরু হয়ে নিবেদিতা লেন চিৎপুরের দিকে চলে গেছে। সরু গলি। ভেতরে ঢুকলে মনে হবে গত একশ-দেড়শ বছরে কলকাতার কোনও পরিবর্তনই হয়নি। গলি ধরে একটু এগোলে নিবেদিতা ইস্কুল, তাকে বাঁয়ে রেখে আরও কিছুটা হাঁটলে, যেখানে রাস্তাটা চিৎপুর রোডে গিয়ে পড়েছে প্রায় সেখানে, কেয়া বাগচির মেস।

চাকুরে মেয়েদের মেসবাড়ি। দুটো সিঁড়ি ভেঙে সদর দরজা, সিঁড়ির দুপাশে রোয়াক। একজন জাঁদরেল চেহারার কাজের মাসি রোয়াকের ওপর পা ছড়িয়ে বসে চুল বাঁধছিল। আদিত্য তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কেয়া বাগচি থাকেন?’

সে উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলে হাঁক পাড়ল, ‘অপু দিদিমণির সঙ্গে দেখা করতে লোক এয়েচে গো।’ তারপর গলাটা একটু নামিয়ে আদিত্যকে বলল, ‘আপুনি বাইরের ঘরে বোসো, অপু দিদিমণি নিচে নামছে।’

আদিত্য ধরে নিল কেয়া বাগচির ডাক নাম অপু।

মাসির পেছন পেছন আদিত্য সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখল বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা উঠোন, তার এককোণে একটা চৌবাচ্চা, গায়ে টুলু পাম্প লাগানো। উঠোনের বাকি অংশ জুড়ে সারি সারি ফুলগাছের টব। একটা বেগুনি রঙের ডালিয়া বেশ বড় হয়েছে। আর একটা টবে লাল-সাদা বোগেনভেলিয়া। আদিত্যর মনে পড়ল, এর পোষাকি নাম মারি পামার, আদিত্যদের আলিপুরের বাড়িতে খুব হত। দেখে মনে হয়, উঠোনের গাছগুলো বেশ যত্ন পায়।

উঠোন ঘিরে গোটা চারেক ঘর, তার একটাতে মাসি আদিত্যকে নিয়ে গিয়ে বসাল। আদিত্য আন্দাজ করল এটা ভিজিটার্স রুম, বিশেষ করে পুরুষ ভিজিটার এলে এখানে বসানো হয়, যেহেতু দোতলায় মেয়েদের ঘরে তাদের প্রবেশাধিকার নেই। ঘরে কয়েকটা পুরোনো যুগের হাতলওলা চেয়ার, একদিকে একটা তক্তোপোশ, তার ওপর কয়েকটা ছোট ছোট তাকিয়া, মাঝখানে একটা সেন্টার টেবিলের ওপর কয়েকটা বাংলা ম্যাগাজিন। আদিত্য লক্ষ করল দেয়ালে তিনটে ছবি টাঙানো রয়েছে, বিসর্জন নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ, বুকের ওপর দুই হাত মুড়ে বিবেকানন্দ, আর ঈষৎ অপটু হাতে আঁকা একটা সিনারি, নদীর ধারে সূর্য উঠছে। শেষোক্ত ছবিটা মনে হয় মেসবাসিনীদের কারও শিল্পকীর্তি।

কেয়া বাগচি ঘরে ঢুকল মিনিট কয়েক পরে, আদিত্য তখন একটা পুরোনো ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে।

‘আপনি আদিত্য মজুমদার? আপনি আমাকে ফোন করেছিলেন?’ কেয়া বাগচি একটু জোরে কথা বলে।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল।

আদিত্য লক্ষ করল, কেয়া বাগচির রঙ ফরসা, ছিপছিপে গড়ন, বাঙালি মেয়েদের আন্দাজে লম্বাই বলতে হবে। নাক-মুখ-চোখের আদলও খারাপ নয়। এমন মেয়ে বিয়ে করেনি কেন?

‘বসুন, বসুন।’ আদিত্যকে বসতে বলে কেয়া বাগচিও একটা চেয়ারে বসল। ‘গার্গীও আমাকে ফোন করেছিল। বলল, আপনি একজন ডিটেকটিভ, চন্দ্রাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন। চন্দ্রাকে নিয়ে আমাদের ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। বলা নেই, কওয়া নেই, জ্বলজ্যান্ত মেয়েটা কোথায় যে উধাও হয়ে গেল! ওর স্বভাবটা কিন্তু মোটেই এরকম নয়।’ কেয়া বাগচি শুধু যে জোরে কথা বলে তাই নয়, খুব তাড়াতাড়ি কথা বলে।

‘আপনি ঠিকই শুনেছেন, আমি একজন পেশাদার ডিটেকটিভ। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। শুধুমাত্র একজন পেশাদার গোয়েন্দা হিসেবে চন্দ্রাকে খুঁজছি না, চন্দ্রার সঙ্গে আমি একসঙ্গে কলেজে পড়েছি। এক সময় আমরা বেশ বন্ধু ছিলাম। চন্দ্রার জন্য আমারও একটা বিশেষ উৎকন্ঠা রয়েছে।’

‘আপনি চন্দ্রার বন্ধু হলে আমারও বন্ধু। আমি আর চন্দ্রা একসঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। আপনিও কি ফিজিক্স?’

‘না, না। আমি প্রেসিডেন্সিতে অঙ্ক পড়তাম। চন্দ্রার সঙ্গে পাশ ক্লাশ করতাম। তাছাড়া চন্দ্রাদের পাড়াতেই আমাদের বাড়ি ছিল। অনেক সময় একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম।’

‘দাঁড়ান একটু চা বলে আসি।’ কেয়া উঠে দাঁড়াল।

‘ব্যস্ত হবেন না। আমি একটু আগেই চা খেয়েছি।’

‘আর একবার খান। আমার ব্যস্ত হবার কিছু নেই, এই সময় আমাদের এখানে এমনিতেই চা হয়।’ কেয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে কাউকে কিছু একটা বলল। তার কথাগুলো আদিত্য ঠিক ধরতে পারল না, তবে আন্দাজ করে নিল, কেয়া চা দেবার কথা বলছে।

‘আপনাদের এখানে কতজন থাকেন?’ কেয়া ফিরে আসার পর আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘একতলায় কেউ থাকে না। দোতলায় চারটে ঘর, দুটো বড়, দুটো ছোট। বড় ঘরগুলোতে দুজন করে থাকে, ছোট ঘরগুলোতে একজন করে। তিনতলাতেও ঠিক একই রকম, ছ’জনের থাকার ব্যবস্থা। এই মুহূর্তে সব সিট ভর্তি, অর্থাৎ বারোজন থাকেন এই বাড়িতে।’

‘আর একতলায়?’

‘একতলার চারটে ঘরের মধ্যে একটা খাবার ঘর, একটা রান্নাঘর, এই ঘরটা, এটাতে ভিজিটারদের বসানো হয়, আর একটা ঘর আছে যেটাতে আমাদের তিনজন রাতদিনের মাসি থাকে, তাদের মধ্যে দুজন কাজের মাসি আর একজন রান্নার মাসি।’

‘চমৎকার ব্যবস্থা। আপনার এখানে কতদিন থাকা হল?’

‘সে অনেকদিন। আমার বাড়ি বহরমপুর। ইস্কুল পাশ করার পর থেকে বাড়ি ছাড়া। হস্টেলে হস্টেলে মানুষ। কলেজে পড়ার সময় স্কটিশের হস্টেলে থাকতাম, তারপর এম এস সি পড়ার সময় ইউনিভার্সিটির হস্টেলে। এম এস সি পাশ করেই স্কুলের এই চাকরিটা পেয়ে গেলাম। চাকরি পাবার পর প্রথম পাঁচ-ছ’ মাস গ্রে স্ত্রিটের কাছে একটা বাড়িতে পেয়িং গেস্ট ছিলাম, তারপর থেকে এখানে। কুড়ি বছর হতে চলল। এখন এখানকার আমি সেকেন্ড সিনিয়রমোস্ট মেম্বার। দেশের বাড়িতে আর কেউ নেই, তাই যাওয়াই হয় না। এটাই এখন আমার বাড়ি।’ কেয়া বাগচি হাসল। তার হাসিটা খুব খোলামেলা। মহিলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আদিত্যর আবার মনে হল এই মহিলা বিয়ে করেননি কেন?

সেই কাজের মাসি, যে রোয়াকে বসে চুল বাঁধছিল, যে আদিত্যকে এই ঘরে এনে বসিয়েছে, ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। সঙ্গে কিছু থিন অ্যারারুট বিস্কুট। চায়ের কাপগুলোকে প্রায় সৌখিন বলা চলে। বিস্কুটের প্লেটটাও বেশ নতুন ধরনের। সব মিলিয়ে মেসবাড়ি হলেও একটা লক্ষ্মীশ্রী আছে। আদিত্য ভাবছিল এই লক্ষ্মীশ্রীটা মেয়েলি স্পর্শ ছাড়া সম্ভব নয়, এটা কোনও পুরুষদের মেসবাড়িতে কখনও পাওয়া যাবে না। সে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘চন্দ্রা কখনও এখানে এসেছে?’

‘অনেকবার এসেছে। আপনি তো জানেন আলিপুরে ওদের বিশাল বাড়ি। কিন্তু ওই বাড়িতে থাকতে চন্দ্রার ভাল লাগত না। তবু যতদিন ওর বাবা বেঁচে ছিলেন ততদিন কলকাতায় এলে ও আলিপুরের বাড়িতেই থাকত। বাবা মারা যাবার পর কিন্তু কলকাতায় যতবার এসেছে, আমার ঘরে রাত্তিরে থেকে গেছে। সৎমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা একেবারেই ভাল ছিল না। আসলে চন্দ্রার বন্ধু বলতে বোধহয় একমাত্র আমিই ছিলাম।’

‘তাহলে আপনি নিশ্চয় জানেন চন্দ্রা ওর পুরোনো বন্ধু এবং সহপাঠী পার্থ সান্যালকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল? ইন ফ্যাক্ট, এই ডিসেম্বরেই ওদের বিয়ে হবার কথা, এটাও নিশ্চয় জানেন?’

প্রশ্নটা শুনে কেয়া বাগচি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর থেমে থেমে বলল, ‘আমি সবই জানি। আসলে এই ব্যাপারটা নিয়ে চন্দ্রার সঙ্গে আমার বিরাট কথা কাটাকাটি হয়ে গিয়েছিল। কথা কাটাকাটির পর রাত্তিরে চন্দ্রা আমার সঙ্গে আর একটাও কথা বলল না। তারপর ভোরে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেল। চা-টুকু খেল না। তারপর আর চন্দ্রার সঙ্গে দেখা হয়নি। কদিন পরেই শুনলাম চন্দ্রাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’ বলতে বলতে কেয়ার গলা ধরে এল।

‘ঠিক কী নিয়ে আপনাদের মনোমালিন্য হয়েছিল বলতে অসুবিধে আছে কি?’ আদিত্য একটু সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল।

‘এমনিতে বলতাম না। কিন্তু যখন চন্দ্রাকে পাওয়া যাচ্ছে না তখন তো সব কথা বলতেই হবে।’ কেয়া একটু থামল। আদিত্য তাকে তৈরি হবার সময় দেবার জন্য নিজে চুপ করে রইল। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল। একটা বিস্কুটে কামড় বসাল।

একটু পরে কেয়া নিজে থেকেই শুরু করল, ‘এটা মাস খানেক আগেকার ঘটনা হবে। আমার তারিখ একদম মনে থাকে না, তাই আন্দাজে এক মাস বললাম। এটুকু মনে আছে ঘটনাটা মহালয়ার আগের। চন্দ্রা ফোন করে বলেছিল কলকাতায় আসবে। কলকাতায় এলে ইদানীং আমার সঙ্গেই চন্দ্রা থাকত, তাই আমাদের রান্নার মাসিকে বলে দিলাম আমার বন্ধু রাত্তিরে এখানে খাবে। আমার ঘরটা তিনতলায়। ওয়ান-সিটার হিসেবে বেশ বড়, দুজনের থাকতে কোনও অসুবিধে হয় না। চন্দ্রার পৌঁছতে পৌঁছতে সাধারণত রাত্তির সাড়ে আটটা-নটা বেজে যায়। সেদিন চন্দ্রার পৌঁছতে আরও দেরি হয়ে গেছিল। আমি বারবার ফোন করছিলাম, কিন্তু চন্দ্রার মোবাইলে কানেক্ট করতে পারছিলাম না। চন্দ্রা এল প্রায় সাড়ে নটায়। তখন খাবার ঘরে ডিনার শুরু হয়ে গেছে। চন্দ্রাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বলল, ট্রেন লেট ছিল, তাই দেরি। আমি বললাম, তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর খুব খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে যা। খেতে খেতে চন্দ্রা প্রায় কোনও কথাই বলল না। আমিই একতরফা বকবক করে গেলাম। মনে হল, কিছু একটা নিয়ে চন্দ্রা খুব ডিসটার্বড আছে।

‘খাবার পরে আমরা আমার ঘরে গেলাম। আমি শোবার জন্য বিছানা করতে যাচ্ছি, চন্দ্রা বলল, একটু পরে বিছানা করিস। আগে তোর সঙ্গে একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাই। ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস। চন্দ্রার গলার স্বরে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হল, ও একটা গভীর সমস্যার মধ্যে আছে। আমাকে একটু অবাক করে দিয়ে ও বলল, আমি বিয়ে করছি। ওখানে আর থাকা যাচ্ছে না। থাকাটা নিরাপদ নয়। বিয়ে করে অনেক দূরে চলে যাব। যা ভেবে শুরু করেছিলাম সেটা হল না। জীবনটা আর নষ্ট করতে চাই না। আমি বললাম, আমি তোর কথার একবর্ণও বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বলবি? চন্দ্রা বলল, শোন, আমি বুঝিয়ে বলছি। আমি ঠিক করেছি বিয়ে করব। এই ডিসেম্বরেই বিয়ে। আমি বললাম, কাকে বিয়ে করবি? চন্দ্রা বলল, আমার পুরোনো বন্ধুকে। সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, পুরোনো বন্ধু মানে কোন পুরোনো বন্ধু? চন্দ্রা জানাল, এ সেই ছেলেটি যে ওকে ছেড়ে বিশ বছর আগে অ্যামেরিকায় চলে গিয়েছিল। তার নাম শুনলাম পার্থ সান্যাল। হয়ত আগেও চন্দ্রা নামটা বলেছিল, আমার মনে ছিল না।

(২)

কাজের মাসি এঁটো চায়ের কাপ-ডিশ, বিস্কুটের প্লেট তুলে নিয়ে গেল। আশেপাশে কোনও বাড়িতে কোনও মেয়ে বেসুরো গলায় গান গাইছে। প্রতিবেশিদের বিড়ম্বনা। কান পেতে শুনলে বোঝা যায় ইমন গাওয়ার চেষ্টা করছে। পুরোনো গান। শিক্ষার্থীরা প্রথমেই শেখে। পিয়াকে নজরিয়া যাদু ভরি। এত খারাপ করেও গানটা গাওয়া যায়!

কেয়া আবার বলতে শুরু করেছে। ‘আমি জানতাম অভিজিৎ সিং বলে একটি নকশাল ছেলের সঙ্গে চন্দ্রার অনেকদিনের সম্পর্ক। সেসব ছেড়ে এখন সে পার্থ সান্যালকে বিয়ে করতে চায় শুনে আমার মাথায় আগুন জ্বলে গেল। পার্থ সান্যালকে আমি কখনও দেখিনি, কিন্তু চন্দ্রার মুখে তার কীর্তিকলাপের কথা অনেক শুনেছি। আমি বললাম, তোর লজ্জা করে না, যে পার্থ সান্যাল তোকে ডাম্প করে অ্যামেরিকা চলে গেল, যে পার্থ সান্যাল তোকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে মেমসাহেব বিয়ে করল, তাকে তুই বিয়ে করবি? কেন তার মেমসাহেব বউ-এর কী হল? চন্দ্রা বলল, পার্থর ডিভোর্স হয়ে গেছে। সে এখন আমার কাছে ফিরে আসতে চায়। পার্থ আমাকে বিয়ে করার জন্য দেশে ফিরে আসছে। আমি বললাম, চন্দ্রা, তুই কি নিজেকে এতটুকু সম্মান করিস না? একটা ছেলে তোকে এতটা অপমান করল, এতদিন ধরে অবহেলা করল, এখন সে হঠাৎ তোকে বিয়ে করতে চাইছে বলে তুই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাবি? কী গ্যারেন্টি আছে সে তোকে আবার ডাম্প করে বিদেশে চলে যাবে না? চন্দ্রা বলল, পার্থ তো আমাকে কুড়ি বছর আগে অ্যামেরিকায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমিই তখন রাজি হইনি। আমি বললাম, আর অভিজিৎ সিং-এর সঙ্গে তোর এতদিনের সম্পর্ক, যে সম্পর্কের কথা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি। তাকে কী করে ভুলে যেতে পারলি? চন্দ্রা বলল, আমি অনেক ভেবে দেখেছি অভিজিতের সঙ্গে আমার সম্পর্কটার কোনও পরিণতি নেই। ওই সম্পর্কটার কথা ভুলে যাওয়াই ভাল। আমাদের কথা কাটাকাটি অনেক রাত্তির অব্দি চলল। শেষে ব্যাপারটা কুৎসিত ব্যাক্তিগত আক্রমণের পর্যায় চলে গেল। চন্দ্রা বলল, তোর বিয়ে হয়নি বলে তুই চাস না অন্য কারও বিয়ে হোক। আমি বললাম, তোর শরীরের খিদেটা তুই আর সামলাতে পারছিস না। তোর আসলে একটা যাহোক তাহোক পুরুষ মানুষ দরকার। এর পরে আমাদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। আমি ঘুমিয়েও পড়লাম। সকালে উঠে দেখি চন্দ্রা ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে যাবার জন্য রেডি। আমি বললাম, চন্দ্রা ব্রেকফাস্ট খেয়ে যা। চন্দ্রা আমার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে দরজা খুলে চলে গেল। অথচ বিশ্বাস করুন, আমি কিন্তু চন্দ্রাকে খুব আপন ভেবেই কথাগুলো বলেছিলাম। অন্য কেউ হলে আমি তার বিয়ে নিয়ে মাথাই ঘামাতাম না।’

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আদিত্য বলল, ‘আসলে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা চন্দ্রা বোধহয় নিয়েই ফেলেছিল। আপনার কাছে শুধু একটা সমর্থন আশা করছিল। একটা অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি বললেন না, চন্দ্রা যেখানে ছিল সেখানে সে নিরাপদ বোধ করছিল না। কেন নিরাপদ বোধ করছিল না, সেটা কি চন্দ্রা বলেছিল?’

‘এটাই তো আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। বিয়ে নিয়ে এমন ঝগড়া হল যে ওই আসল কথাটাই চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি।’

‘আমি আর একবার ভেরিফাই করে নিচ্ছি, চন্দ্রা বলেছিল সে আর ওখানে থাকতে পারছে না। ওখানে থাকাটা তার পক্ষে নিরাপদ নয়। তাই সে বিয়ে করে অনেক দূরে পালিয়ে যেতে চায়। তাই তো?’

‘হ্যাঁ, মোটামুটি এইরকমই একটা কিছু চন্দ্রা বলেছিল।’

‘আর কিছু বলেছিল? খুব ভাল করে ভেবে দেখুন।’

‘হয়ত বলেছিল, আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’

‘কোনও ব্যক্তির কথা কি চন্দ্রা বলেছিল যার জন্যে সে নিজেকে আনসেফ মনে করছে? সে ব্যক্তি মেয়েও হতে পারে বা পুরুষও হতে পারে।’

‘নাঃ, সেরকম কারও কথা বলেনি। বললে আমার নিশ্চয় মনে থাকত।’

‘আপনি কি চন্দ্রার ব্যাপারটা পুলিশকে জানিয়েছিলেন?’

‘অবশ্যই জানিয়েছিলাম। আমার এক কলিগের স্বামী হোম ডিপার্টমেন্ট-এ বড় চাকরি করে। তাকে ধরে লালবাজারে গিয়েছিলাম। গিয়ে মনে হল ব্যাপারটা ওরা কিছুই জানে না। আমি ঝাঁকানি দেওয়াতে এখন নড়েচড়ে বসেছে।’

‘আমি দু-একদিনের মধ্যে বসিরহাটে চন্দ্রার ইস্কুলে যাচ্ছি। যদি নতুন কিছু জানতে পারি আপনাকে জানাব। আর আপনারও যদি এর মধ্যে কিছু মনে পড়ে যায় আমাকে অবশ্যই জানাবেন। আমার ফোন নম্বরটা আপনার কাছে আছে তো?’

‘থাকার তো কথা। দেখি সেভ করে রেখেছি কিনা।’ কেয়া টেবিলের ওপরে রাখা তার মোবাইলটা তুলে কন্ট্যাক্টস-এ গিয়ে দেখল আদিত্যর নামটা নেই। বলল, ‘সেভ করতে ভুলে গেছি। প্লিজ, আর একবার নম্বরটা বলবেন আমি সেভ করে নেব?’ নম্বরটা সেভ করার পরেও চন্দ্রা তার মোবাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। যেন কিছু খুঁজছে। যেটা খুঁজছিল সেটা পেয়ে গিয়ে মোবাইলটা আদিত্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখুন চন্দ্রার ছবি। ওদের স্কুলে পুজোর আগে শারদোৎসব হয়েছিল, তখন কেউ তুলেছিল।

আদিত্য দেখল, দুটো ছবি। একটাতে চন্দ্রা হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান গাইছে। দুপাশে কয়েক জন ছাত্রী। তারাও গাইছে। মনে হয় কোরাস। আর একটা দর্শকদের ছবি। একদম প্রথম সারিতে চন্দ্রা বসে আছে, তার পাশে অজানা কয়েকজন নারী ও পুরুষ। পেছনের সারিতে আরও কিছু দর্শক। একদম পেছনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদিত্যর মনে হল চন্দ্রার চেহারাটা খুব একটা বদলায়নি, যৌবনের চটকটা চন্দ্রা প্রায় ধরেই রেখেছে। মনে মনে আদিত্য এর তারিফ না করে পারল না। তার পাশাপাশি পার্থর চুল উঠে যাওয়া, ভুঁড়িওলা এখনকার চেহারাটা রীতিমত বেমানান।

মোবাইলটা কেয়ার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে আদিত্য বলল, ‘ছোটবেলার চেহারাটা চমৎকার ধরে রেখেছে চন্দ্রা। আমাকে এই ছবিদুটো হোয়াটসঅ্যাপ করে দেবেন প্লিজ? আমার খুব কাজে লাগবে। চন্দ্রার আরও ছবি যদি থাকে সেগুলোও।’

‘চন্দ্রার আর কোনও ছবি আমার কাছে নেই। ছবি-টবি তোলা চন্দ্রার খুব একটা পছন্দ ছিল না। ভেবেছিলাম ফেসবুকে ছবি দুটো দেব। চন্দ্রা ভীষণ আপত্তি করেছিল। ফেসবুকে নিজের ছবি দেওয়াকে চন্দ্রা এক্সিবিশনিসম মনে করত। আমিও তাই আর দিইনি।’

আদিত্য উঠে দাঁড়াল। বেশি রাত্তির অব্দি বোধহয় মেয়েদের মেসবাড়িতে কোনও পুরুষের থাকাটা ঠিক নয়। মুখে বলল, ‘আজ উঠি। আপনি আমাকে অনেকটা সময় দিলেন, তার জন্য ধন্যবাদ।’

‘ধন্যবাদ দেবেন না। প্লিজ ধন্যবাদ দেবেন না। চন্দ্রাকে খুঁজে বার করার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। আপনি জানেন না চন্দ্রা আমার কতটা ক্লোজ বন্ধু ছিল।’ কেয়া বাগচি হঠাৎ ভীষণ ইমোশানাল হয়ে গেল।

‘কিছু জানাবার হলে আমাকে ফোন করবেন।’ আদিত্য বেরোতে বেরোতে বলল। ‘হয়ত আবার আমাকে আসতে হবে।’

‘কিছু জানাবার থাকলে নিশ্চয় ফোন করব। আর দরকার হলে অবশ্যই আসবেন। শুধু আগে একটা ফোন করে দেবেন।’ তারপর একটু থেমে কেয়া বাগচি বলল, ‘আজ থেকে তো আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।’

কেয়া বাগচির মেস থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হাঁটার পরেই পকেটের ভেতর একটা টুং শব্দ শুনে আদিত্য পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে দেখল হোয়াটস অ্যাপে চন্দ্রার ছবিদুটো এসে গেছে।

(৩)

আদিত্য ভেবেছিল শ্যামবাজারের মোড় থেকে ট্রাম ধরবে। ট্রাম জিনিসটা আদিত্যর ভারি পছন্দ। ট্রামের ধীরস্থির হাবভাবের সঙ্গে আদিত্যর নিজস্ব হাবভাবের খুব মিল আছে। তাছাড়া একবার জানলার ধারে একটা সিট পেয়ে গেলে তো কথাই নেই। নিজেকে রাজা-রাজা মনে হয়। তখন ট্রামের ভেতরে বসে চারদিকের শহর, ভীড়, রাস্তাঘাট, দোকান দেখতে দেখতে যাওয়াকে আদিত্য রয়াল ট্রিটমেন্ট মনে করে। সব কিছুই যেন বাইরের, দূরের, অথচ কত কাছে। কিন্তু আদিত্যর দুর্ভাগ্য, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও ট্রাম এল না। আর বাসগুলোর যা চেহারা, উঠতে ইচ্ছে করে না। সে ঠিক করল হেঁটেই ফিরে যাবে। শ্যামবাজারের মোড় থেকে তার মেস হেঁটে মিনিট চল্লিশের বেশি লাগবার কথা নয়। পথে, হেঁদুয়ার মোড় পেরোলে, একটা পাইস হোটেল পড়ে। ওখানেই রাত্তিরের খাবারটা সেরে নেওয়া যাবে। মেসের রান্না আর মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে, ভানু ঠাকুর পরশু দিন ফিরে আসবে। আদিত্য ফিঙ্গার ক্রশ করে রেখেছে। পাইস হোটেল পেরিয়ে আরও কিছুটা হাঁটলে গলির মধ্যে সন্তোষের দোকান। ওরকম দই কলকাতায় খুব বেশি লোক করতে পারে না। কপাল ভাল থাকলে দোকানটা খোলা পাওয়া যেতেও পারে। মাছের ঝোল ভাতের পর এক ভাঁড় ভালো দই! এরপর আর কী বা চাওয়ার থাকতে পারে বিধাতার কাছে।

খুব বেশি ভিড় নেই হোটেলটায়। কাউন্টারের লোকটা বলল, ভাত এখনও নামেনি। নামতে নামতে মিনিট দশেক সময় লেগে যাবে। বসে থাকার পক্ষে হোটেলের ভেতরটা খুব সুবিধের নয়। আদিত্য বাইরে এসে সিগারেট ধরাল। কী করে সময় কাটানো যায় ভাবতে ভাবতে আদিত্যর মনে হল বিমলকে একবার ফোন করা দরকার। বিমলের ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বেজে যাচ্ছে, কেউ ধরছে না। এরকম তো কখনও হয় না। বিমল তো সব সময় ফোন ধরে। ছেলেটা কোনও ঝামেলায় পড়ল নাকি? আদিত্য আর একবার নম্বরটা লাগাল। এবার দু-তিন বার বাজার পর ফোনটা ধরল বিমল। লাইনে খুব ডিস্টার্বেনস। বিমল কোনও রকমে বলল, ‘বাসে রয়েছি স্যার, নেমে ফোন করছি।’

বিমল যখন ফোন করল ততক্ষণে আদিত্যর ডাল ভাজা এসে গেছে। ভাতের ওপর ডাল ঢালতে ঢালতে আদিত্য বলল, ‘একটা কাজ আছে, কিছুদিনের মধ্যে তোমাকে দরকার হবে, তুমি এখন কলকাতায় আছ তো?’

‘যাব আর কোথায় স্যার? এখানেই আছি। টালিগঞ্জে ওই নাইট গার্ডের কাজটাই করছি। কবে আমাকে লাগবে স্যার?’

‘সেটা কাল-পরশুর মধ্যে জানিয়ে দেব।’

‘ঠিক আছে স্যার। টাকার খুব টানাটানি যাচ্ছে স্যার। একটা উপরি কাজ পেলে খুব উপকার হয়।’

‘টানাটানি কেন? হঠাৎ কী হল?’

‘মেয়েটা অসুখে পড়ল স্যার। টাইফয়েড। প্রথমে তো ধরাই যাচ্ছিল না। তারপর মেয়েটা সেরে উঠতে না উঠতে বউ অসুখে পড়ল। কীসব মেয়েলি রোগ। ডাক্তার বলল, এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে। নীলরতনে ভর্তি করে দিলাম। অপারেশন হল। এই সবে বাড়ি এসেছে। এখন ভাল আছে। তবে তিন মাস ভারি কাজ করা বারণ। মেয়ে আর আমি কোনও রকমে সামলে নিচ্ছি। ছেলেটা তো আল্লার ষাঁড়, কোনও কাজে লাগে না। শুধু দুবেলা খাবার সময় তাকে বাড়িতে দেখা যায়।’

‘তোমার এত বিপদ গেল আমাকে জানাওনি কেন?’

‘আপনাকে আর কত বিরক্ত করব স্যার? একেবারে উপায় না দেখলে আপনার কাছে আসতেই হত। আমার এক শালা কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। তাই দিয়েই হয়ে গেল। তবে টাকাটা তাকে ফেরত দিতে হবে। তাই বলছিলাম, একটা উপরি কাজ পেলে খুব উপকার হত স্যার।’

‘কাজ একটা আছে। আমি তোমাকে দুএকদিনের মধ্যে জানাচ্ছি। আজ রাখছি। সাবধানে থেক।’

‘আপনিও সাবধানে থাকবেন স্যার। আজ তাহলে রাখছি?’

‘রাখো। আমি পরে ফোন করব।’ আদিত্য ফোন কেটে দিল।

খাওয়া-দাওয়া সেরে আদিত্য যখন পাইস হোটেল থেকে বেরোল তখন প্রায় নটা বেজেছে। বিধান সরণী তখনও বেশ জমজমাট। আদিত্য সিগারেট ধরাল। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট খাওয়া আদিত্যর পছন্দ নয়। তাছাড়া ভর পেটে হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না। সামনেই যে বাস স্টপটা চোখে পড়ল সেখানে গিয়ে দাঁড়াল আদিত্য। বাস ট্রাম যা আসে উঠে পড়বে। দইটা আর খাওয়া হল না। যাক গে, আরেক দিন হবে।

কেয়া বাগচির কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চন্দ্রা বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিয়ে করার ব্যাপারে তার কোথাও একটা সংকোচ ছিল। তাই সে কেয়ার সমর্থন চেয়েছিল। কেয়ার সমর্থন মানে সমাজের সমর্থন। চন্দ্রা তার স্বেচ্ছা-নির্বাসন থেকে সমাজে ফিরতে চেয়েছিল। তাই সমাজের সমর্থনটা তার দরকার ছিল। কিন্তু কেয়াই বা কেন চন্দ্রার বিয়েতে আপত্তি করল? চন্দ্রার ভালোর জন্যে? নাকি অন্য কোনও কারণে? অন্য প্রশ্ন, চন্দ্রা কি নিজে থেকে গা ঢাকা দিয়েছে নাকি তাকে অপহরণ করা হয়েছে? যেটাই হোক, আদিত্যর কিন্তু স্থির বিশ্বাস চন্দ্রা বেঁচে আছে।

হেঁদোর দিক থেকে হেলতে দুলতে একটা ট্রাম এগিয়ে আসছে। আদিত্যর ভাগ্য ভাল ট্রামটা বেশ ফাঁকা। উঠেই আদিত্য একটা বসার জায়গা পেয়ে গেল। জানলার ধারে নয়, তবে সামনের জানলা দিয়ে রাস্তাটা খানিকটা দেখা যায়। আদিত্যর বোধহয় তুঙ্গে বৃহস্পতি যাচ্ছে। একটু পরেই তার পাশের লোকটা উঠে পড়ল। আদিত্যর এখন জানলার সিট। জানলার ধারে সিট পেয়ে আদিত্য দই না খাওয়ার দুঃখ ভুলে গেছে। অবশ্য কতটুকুই বা পথ।

রাস্তার ভীড় পাতলা হয়ে এসেছে। দোকানদার শাটার নামিয়ে দিয়ে দোকানের সামনে কাগজ পোড়াচ্ছে। দোকান বন্ধ করার আগে কাগজ পোড়ানোর রীতি আদিত্য অনেকদিন ধরে দেখছে, কিন্তু এর মানেটা সে ভাল জানে না। রাত্তিরে যখন দোকানদার দোকানে থাকবে না, তখন কি অগ্নিদেবকে দোকান পাহারা দিতে বলা হচ্ছে? নাকি অগ্নিদেবকে বলা হচ্ছে দোকানির অনুপস্থিতিতে তিনি যেন দোকানে না ঢোকেন অর্থাৎ দোকানে যেন আগুন না লাগে? ফুটপাথে বসা হকার তার বেসাতি পুঁটলিতে পুরে বোঁচকা বাঁধছে। ফুটপাথবাসী বধূ উনুনে রান্না চাপিয়েছে।

আর একটু এগিয়ে ট্রাম ট্র্যাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে গেল। আদিত্য লক্ষ করল, এই অবেলায় উল্টোদিকের ফুটপাথে তিনটি কিশোরী প্রবল বেগে ফুচকা খেয়ে চলেছে। যতক্ষণ ট্রামটা দাঁড়িয়ে রইল আদিত্য সকৌতুকে ওদের ফুচকা খাওয়া দেখছিল। তিনটি মেয়ের মধ্যে একজন আবার বাঁ-হাতি। সে ডান হাত দিয়ে শালপাতা ধরে বাঁ-হাত দিয়ে ফুচকা তুলে মুখে পুরছে। এখন এত ফুচকা খেলে রাত্তিরে ভাত খাবে কী করে? ফুচকাওলার মালমশলা ফুরিয়ে গেছে। সে আবার নতুন করে মাখছে।

সিগনাল সবুজ হয়ে গেল, ট্রাম আবার চলতে শুরু করেছে। ফুচকা বিলাসী তিনটি মেয়ের ছবিটা এখনও আদিত্যর মাথায় ঘুরছে। শেষ কবে ফুচকা খেয়েছিল আদিত্যর মনেই পড়ে না। তখন বোধহয় দুটাকায় পাঁচটা ফুচকা পাওয়া যেত। এখন কত দাম হয়েছে কে জানে?

আদিত্য যখন মেসে ফিরে ঘরের দরজা খুলছে তখন দশটা বেজে গেছে।

(৪)

ঘরে ফিরে আদিত্য কিছুক্ষণ ইউ টিউবে ইরশাদ খানের হামীর শুনল। ইমরত খানের ছেলে ইরশাদ। চমৎকার বাজাচ্ছে আজকাল। কখনও কখনও পুরোনো বিলায়েতের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। বাজনা শেষ হবার আগেই টেলিফোন। আদিত্য বাজনা বন্ধ করে ফোন ধরল। গৌতমের গলা, টেলিপ্যাথিই বলতে হবে। সে গৌতমকেই ফোন করবে ভাবছিল।

‘কী রে, ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি?’

‘আরে না না। এখন তো সবে সন্ধে। গান শুনছিলাম।’

‘তোদের সেই অ্যা অ্যা গান? পারিসও বটে। রাত দুপুরে অ্যা অ্যা গান।’ গৌতমের গলায় বিরক্তি।

‘একটু ধর, একটা সিগারেট ধরিয়ে নিই।’

আদিত্য মোবাইল রেখে টেবিলের ওপর থেকে সিগারেট-দেশলাই নিয়ে সিগারেট ধরাল। একটা লম্বা সুখটান দিয়ে মোবাইল তুলে বলল, ‘এবার বল।’

‘আমার সমস্যাটা একটু খুলে বলি।’ গৌতম বলতে শুরু করল, ‘একটা স্পেশাল টিমে কাজ করার জন্য আমাকে দিল্লি পাঠানো হয়েছিল। এই টিমটা বেসিক্যালি একটা অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড। তবে আমার কাজটা ছিল আর একটু স্পেসিফিক। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন টেররিস্ট গ্রুপগুলোর কাছে যে অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছচ্ছে তার সাপ্লাই চেনটা ট্র্যাক করা এবং যারা এই সাপ্লাইটা দিচ্ছে তাদের আইডেন্টিফাই করাটাই ছিল আমার কাজ। নানারকম এভিডেন্স থেকে বোঝা গিয়েছিল, আর্মস-এর একটা বড় সাপ্লাই আসছে বাংলাদেশ বর্ডার পেরিয়ে, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে। তাই বেঙ্গল কাডারের একজন অফিসারের দরকার ছিল, যে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সঙ্গে কোঅর্ডিনেট করে কাজ করতে পারবে। আমাকে দিল্লিতে ডাকার মূল কারণ এটাই।’

‘তুই গত এক বছরে কী জানতে পারলি?’

‘হ্যাঁ, সেটাই বলছি। প্রচুর পরিশ্রম করে এটা জানতে পারলাম যে এই সাপ্লাই চেনের মূল পাণ্ডা আসলাম খান বলে এক বাংলাদেশী। আসলামের জন্ম কুমিল্লায়, ইস্কুল কলেজ ঢাকায়। ঢাকায় থাকতে থাকতেই সে এই ব্যবসা শুরু করে। এখন তার ব্যবসা বেশ বড় হয়েছে। সারা পৃথিবী থেকে অস্ত্র কিনে সে মূলত ভারতেই অস্ত্র বিক্রি করে। তবে কাশ্মীরে নয়। কাশ্মীরের সাপ্লাই আসে পাকিস্তানের দিক থেকে, সেটা একটা আলাদা সোর্স। বিভিন্ন টেররিস্ট আউটফিট আসলামের খদ্দের। এদের মধ্যে যেমন মাওবাদীরা আছে, তেমনি আছে ব্যাঙ্গালোর-হায়দ্রাবাদ-গুজরাত-মহারাষ্ট্রতে সক্রিয় নানা ইসলামিক মিলিটেন্ট গ্রুপ। এদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বলার জন্য আসলামকে মাঝে মাঝে ভারতে আসতে হয়। আমাদের কাছে খবর আছে যে বেশ কিছুদিন হল সে ভারতেই থাকছে। বাংলাদেশ হ্যাজ বিকাম টূ হট ফর হিম। সম্ভবত সে পশ্চিমবঙ্গেই আছে, কারণ তার কনসাইনমেণ্টগুলো বাংলাদেশ দিয়ে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গেই আসে।’

‘পুলিশের কাছে আসলাম খানের কোনও ছবি আছে?’

‘আনফরচুনেটলি নো। আমরা শুধু এইটুকু শুনেছি যে আসলাম ঢাকার ইস্কুল-কলেজে পড়েছে। কোন ইস্কুল, কোন কলেজ, কবে পড়েছে এসব কিচ্ছু জানি না। জানলে আরও খানিকটা ইনফরমেশন পাওয়া যেত।’ গৌতমের গলায় স্পষ্ট হতাশা।

‘আমাকে কী করতে বলছিস?’

‘দ্যাখ অতীতে একাধিকবার তুই আমাকে ভীষণ সাহায্য করেছিস। তোর বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর আমার বিপুল ভরসা। তোর ফোন পাবার পর আমি চন্দ্রা সেনের ব্যাপারটা খোঁজ নিলাম। নকশাল বলে চন্দ্রার নাম পুলিশের খাতায় আছে। তুই বললি চন্দ্রা সেনের কেসটা তুই ইনভেসটিগেট করছিস। আমার মনে হল সাপ্লাই চেনের ব্যাপারটা আসলাম বা তার এজেন্টের দিক থেকে না দেখে যারা আসলামের কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে তাদের দিক থেকে দেখলে কেমন হয়? আমাদের কাছে এই ইনফরমেশনও আছে যে পুরুলিয়ার ওই মাওবাদী দলটা আসলামের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেনে। দলের অবস্থা এখন ভাল নয়। চন্দ্রা সেনও হয়ত সেই কারণে অ্যাবস্কন্ড করে আছে। হয়ত লুকিয়ে থেকে নতুন করে দলটাকে গড়ে তোলায় সাহায্য করছে। তাই যদি হয় তাহলে ওদের আবার অস্ত্রশস্ত্রের দরকার পড়বে। সেক্ষেত্রে আসলাম বা তার এজেন্টের সঙ্গেও চন্দ্রা বা তার দল একটা যোগাযোগ রেখে চলবে। তার মানে, চন্দ্রাকে ট্রেস করা গেলে হয়ত আসলাম খানের একটা হদিশ পাওয়া যেতে পারে। তুই এই ব্যাপারে নিশ্চয় আমাদের সাহায্য করতে পারবি।’

‘বুঝলাম।’ আদিত্যর গলাটা খানিকটা চিন্তিত শোনালো। ‘কিন্তু তোরা কি নিশ্চিত যে চন্দ্রা সেনের সঙ্গে দলটার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল?’

‘যোগাযোগ তো অবশ্যই ছিল। তবে সে দলটা চালাত না, দল চালাত অভিজিৎ সিং। অভিজিতের মতো চন্দ্রা অ্যাকশানে থাকত না, কিন্তু আমাদের সন্দেহ সে দলকে নানা রকম পরামর্শ দিত। অর্থাৎ সে ছিল দলের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। ইস্কুলে পড়ানোটা তার কামুফ্লাজ।’

‘হতে পারে। আমি যেটুকু জানতে পারব, পুলিশকে অবশ্যই জানাব। তোরাও আমাকে দরকার মতো সাহায্য করিস।’

‘পুলিশের সাহায্যের ব্যাপারে তুই নিশ্চিন্ত থাক। আর একটা জিনিস। চন্দ্রা পুরুলিয়া ছেড়ে বাংলাদেশ বর্ডারের দিকে চলে গেল কেন?’

‘ব্যাপারটা আমিও খেয়াল করেছি। এটা কাকতালীয় হতে পারে আবার এর পেছনে অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে। আমি পুরুলিয়া, বসিরহাট দুটো জায়গাতেই যাচ্ছি। প্রথমে পুরুলিয়া যাব, তারপর বসিরহাট। আশা করছি, এসব জায়গায় গেলে ব্যাপারটা খানিকটা আন্দাজ করতে পারব। যখন যেটুকু জানতে পারছি তোকে জানাব।’

‘ওক্কে, গুড নাইট।’ গৌতম কথা বলতে বলতে হাই তুলল।

‘গুড নাইট।’

(৫)

আদিত্য ফোনটা নামিয়ে রাখতে না রাখতেই আবার ফোন। এবার সঞ্জয় সমাদ্দার।

‘খুব কি দেরি হয়ে গেল স্যার? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’

‘না, না। আপনি বলুন।’

‘আসলে কাল খুব ভোরে একটা ইনভেসটিগেশনে বেরিয়ে যেতে হবে। কখন ফিরব ঠিক নেই। তাই ভাবলাম রাত্তিরেই আপনার সঙ্গে কথা বলে নিই।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলুন।’

‘আপনি নূপুর মণ্ডল বলে যে মেয়েটার কথা জানতে চেয়েছিলেন তার সম্বন্ধে খবর নিয়েছে স্যার। নূপুরের একটা পাস্ট আছে। মেয়েটার বাবা মেয়েটার মাকে খুন করে জেলে যায়। জেলেই তার মৃত্যু হয়। নূপুর মণ্ডল তখন ছোট কিন্তু বোঝার বয়েস হয়েছে। ওই ঘটনার পর থেকে নূপুর মাসির কাছে মানুষ।’

‘তাই নাকি?’ এরকম হতে পারে আদিত্য একেবারেই ভাবেনি। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘নূপুরের নিজের কি কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে?’

‘না, না। একেবারেই নেই। অভাগা মেয়ে স্যার। খুব স্ট্রাগল করতে হয়েছে। ওই চত্বরে নূপুর মণ্ডলকে সকলেই ভালবাসে।’

‘নূপুরের বাবা নূপুরের মাকে খুন করেছিল কেন?’

‘পুলিশ রেকর্ড বলছে, লোকটার সন্দেহ-বাতিক ছিল। সন্দেহের বশে সে বউকে খুন করে। নূপুরের মার কোনও দোষ ছিল না। লোকটার যাবজ্জীবন হয়েছিল। জেলে ঢোকার বছর খানেকের মধ্যেই লোকটা মারা যায়।’

‘নূপুর কি কখনও রাজনীতি-টিতি করত? এই ধরুন, অতি বাম রাজনীতি?’

‘তেমন কোনও রেকর্ড পুলিশের কাছে নেই স্যার।’

‘কলেজ ছাড়ার পর নূপুর কী কী করেছে?’

‘এটারও কোনও রেকর্ড পুলিশের কাছে নেই স্যার। আসলে নূপুরকে ট্র্যাক করাটা তো পুলিশের উদ্দেশ্য ছিল না। তবে আপনি যদি বলেন আমরা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি।’

‘এক্ষুনি মনে হচ্ছে না তার দরকার হবে। পরে দরকার হলে বলব।’

‘নিশ্চয় বলবেন স্যার।’

‘আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার খুব উপকার হল। ভাল থাকবেন। আজ রাখছি।’

‘আপনিও ভাল থাকবেন স্যার।’

আদিত্য ভাবছিল। নূপুরের একটা ভয়ঙ্কর ছেলেবেলা আছে। সম্ভবত এটা দিয়েই ওর অস্বাভাবিক, অতি সক্রিয় হাবভাবটা ব্যাখ্যা করা যায়।

আর একটা ফোন করতে হবে। রাত্তির হয়ে গেছে। কিন্তু যাকে ফোন করবে তাকে একটু রাত্তির ছাড়া ধরা যায় না। আদিত্য নম্বরটা ডায়াল করল। একটু পরে ওপার থেকে উৎফুল্ল গলার শব্দ শোনা গেল, ‘আরে, আদিত্য যে। তোর ব্যাপারটা কী? ফোন-টোন করা ছেড়েই দিয়েছিস।’

‘তোর মক্কেলরা গেছে? কিছুক্ষণ কথা বলতে পারবি?’

‘আজকের মতো গেছে। নাউ আই অ্যাম অল ইয়োরস। বল কেমন আছিস?’

সুনন্দ মিত্র আদিত্যর ইস্কুলের বন্ধু। কলকাতার একেবারে প্রথম সারির ক্রিমিনাল লইয়ার। রাত্তির অব্দি তার চেম্বারে মক্কেল বসে থাকে। সুনন্দর পরামর্শেই একসময় আদিত্য গোয়েন্দাগিরিতে এসেছিল।

‘সুনন্দ, আমার একটা ইনফরমেশন দরকার। তুই কি কে কে সেন-এর কথা জানিস? পুরোনো যুগের ব্যারিস্টার। মারা গেছেন তাও বেশ কিছুদিন হল। আলিপুরে থাকতেন।’

‘কুমুদকিশোর সেন? বাবা কমলকিশোর সেন? ঠাকুরদা কৃষ্ণকিশোর সেন? সকলেই কে কে সেন। সকলেই ব্যারিস্টার। আইনের জগতে এদের কে না চেনে? তাছাড়া তিন পুরুষ ধরে আমাদের পরিবারের সঙ্গে এদের পরিবারের গভীর যোগাযোগ। তুই এদের সম্বন্ধে ঠিক কী জানতে চাস?’

আদিত্যর মনে পড়ে গেল সুনন্দরাও তিন পুরুষের ব্যারিস্টার। সে বলল, আপাতত জানতে চাই কে কে সেন-এর সম্পত্তির ওয়ারিস কারা? সম্পত্তির পরিমাণই বা কত? এটা কি জানা সম্ভব? কেন জানতে চাই পরে বলছি।’

‘এটা জানা খুব শক্ত নয়। কুমুদকাকার সম্পত্তি দেখাশোনা করে সামারভিল অ্যান্ড চৌধুরি বলে খুব পুরোনো একটা সলিসিটার ফার্ম। এদের বর্তমান কর্তা অভীক চৌধুরি আমার খুবই বন্ধু। ওর সঙ্গে তোকে কথা বলিয়ে দেব। একটা কাজ কর। কাল শুক্রবার, উইকএন্ড, আমার চেম্বার নেই। তুই সন্ধেবেলা আমার ক্লাবে চলে আয়। ওখানে অভীকদাকেও পেয়ে যাবি। আমি আলাপ করিয়ে দেব।’

‘কটা নাগাদ যাব?’

‘আমি সাড়ে সাতটা থেকে দোতলায় বারে থাকব। তুই তোর সুবিধে মতো চলে আয়। রাত্তিরে ডিনার খেয়ে যাবি। আমি ডাইনিং হলে জায়গা রিজার্ভ করে রাখছি।’

‘ঠিক আছে। আমি সাড়ে সাতটাতেই পৌঁছে যাব। কেন কে কে সেন সম্বন্ধে জানতে চাইছি সেটা লম্বা গল্প। এখন বলতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। কাল দেখা হলে বলব।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সেটাই ভাল। আমার এখনও রাত্তিরের খাওয়া হয়নি। কাল তোর গল্প শুনব। টা টা।’

আদিত্য আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল, আবার ফোন। আলো জ্বালিয়ে টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে আদিত্য দেখল নূপুর মণ্ডলের ফোন। কী আশ্চর্য! একটু আগেই তো নূপুরকে নিয়ে সঞ্জয় সমাদ্দারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল!

সাড়া দিতেই নূপুরের গলা। ‘হ্যালো, আদিত্যদা। অনেক রাত্তিরে ফোন করছি। প্লিজ কিছু মনে কোরো না। কী করব? রোজ আপিস থেকে বেরতে বেরতে রাত্তির বারোটা বেজে যাচ্ছে। আজও একটু আগে আপিস থেকে বেরোলাম। তুমি বলেছিলে না অনেক রাত্তির অব্দি জেগে থাক? তাই সাহস করে ফোন করলাম। রাগ করনি তো?’

আদিত্য বলতে যাচ্ছিল সে রাগ করেনি, কিন্তু কোনও প্রশ্ন করে তার উত্তরের অপেক্ষা করা নূপুরের ধাতে নেই। সে অনর্গল বলে যাচ্ছে, ‘খুব দরকার না হলে সত্যিই তোমাকে ফোন করতাম না। কিন্তু কী করব বল, খুব বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি। সেদিন বলেছিলাম না, আমার একটা নয়, দুটো বিপদ। একটা বিপদ তো তুমি সামলে দিলে। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা হয়েছে। তুমি সাহায্য না করলে সেটা হতো না। দ্বিতীয় বিপদটা ভেবেছিলাম এক্ষুনি আসবে না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। বিপদটা একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে।’

বলতে বলতে নূপুরের খেয়াল হল আদিত্য শুনছে তো? সে গলাটা একটু তুলে বলল,’আদিত্যদা শুনতে পাচ্ছ?’

এতক্ষণে আদিত্য কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগ বিশেষ কাজে না লাগিয়ে সে ছোট্ট করে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছি, তুমি বলে যাও।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলছি। আমার দ্বিতীয় বিপদটা হল, আগামী সপ্তাহ থেকে আমার চাকরিটা আর থাকছে না। এখানে জয়েন করার পর থেকেই শুনতে পাচ্ছি কম্পানির অবস্থা ভাল নয়। যে কোনও দিন নতুনরা ছাঁটাই হয়ে যেতে পারে। তবে সেটা এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে ভাবিনি। গতকাল নোটিস ধরিয়ে দিয়েছে। সামনের সপ্তাহ থেকে আর চাকরি নেই। এক মাসের নোটিসও দিল না। ছোট প্রাইভেট কম্পানি, মগের মুল্লুক, নিয়ম টিয়মের ধার ধারে না। চাকরি না থাকলে এই শহরে চলবে কী করে? খাব কি? রায়গঞ্জে ফিরে গিয়েও লাভ নেই। ওখানে চাকরি পাওয়া অসম্ভব। কার কাছে যাই, কী করি ভাবতে ভাবতে তোমার কথা মনে পড়ল।’

নূপুর কিছুক্ষণ থামল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আদিত্যদা তোমার ডিটেকটিভ এজেন্সিতে আমাকে একটা কাজ দেবে? কিছুদিনের জন্যে হলেও হবে। আমি তার মধ্যে পারমানেন্ট একটা কিছু নিশ্চয় পেয়ে যাব। আমি কথা দিচ্ছি, খুব মন দিয়ে কাজ করব। একটুও ফাঁকি দেব না। আমার সত্যিই খুব বিপদ আদিত্যদা। এই শহরে আমার থাকাটা খুব দরকার। না থাকলে চাকরি খুঁজব কী করে? দেবে একটা টেম্পোরারি কাজ?’

আদিত্য হতভম্ভ হয়ে গেছে। নূপুর যে এই রকম একটা অনুরোধ করতে পারে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে নিচু গলায় বলল, ‘নূপুর, আজ অনেক রাত্তির হয়ে গেছে। শুয়ে পড়ো। কাল বা পরশু আমি তোমার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলব।’

শুয়ে পড়ার আগে আদিত্য মোবাইলটা সুইচ অফ করে চার্জে দিল। আজ রাত্তিরে আর সে ফোন ধরতে চায় না। আজ অনেক ফোন হয়েছে। আলো নিবিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ শুয়ে রইল আদিত্য। ঘুম আসছে না। কিছুতেই ঘুম আসছে না। মাথার মধ্যে কয়েকটা মুখ ভেসে উঠছে, কয়েকটা ছবি। কেয়া বাগচি, গৌতম, সঞ্জয় সমাদ্দার, নূপুর মণ্ডল। শ্যামবাজার, হেঁদো, ঠনঠনিয়া। ফুটপাথবাসী বউ রান্না চাপিয়েছে। তিনটে মেয়ে ফুচকা খাচ্ছে। খেয়েই যাচ্ছে। তাদের একজন ডান হাতে শালপাতা ধরে বাঁ হাতে ফুচকা মুখে তুলছে। তুলেই যাচ্ছে। সে গত কয়েকদিনে যা দেখেছে বা শুনেছে তার মধ্যে কোথাও একটা গভীর অসংগতি আছে। কী অসংগতি? কী অসংগতি? ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে আদিত্যর অবচেতন মন তাকে সচেতন করে দিচ্ছে সে যা দেখেছে বা শুনেছে তার মধ্যে একটা গভীর অসংগতি আছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *