চন্দ্রলেখা অন্তর্ধান রহস্য – ৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

(১)

আদিত্য খাটে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল। ঘন্টা খানেক হল সে মেসে ফিরে এসেছে। তার হাতে এখন অনেকগুলো কাজ। বসিরহাটে চন্দ্রা যে ইস্কুলে পড়াত সেখানে যেতে হবে। একবার পুরুলিয়াতেও যাওয়া দরকার। কিন্তু সবার আগে পার্থ সান্যালের সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে। পার্থ বলেছিল, কলকাতায় চন্দ্রার দুএকজন বন্ধু আছে যাদের সঙ্গে সে যোগাযোগ রাখত। তাদের নাম ঠিকানাগুলো হয়ত পার্থ দিতে পারবে। চন্দ্রাদের আলিপুরের বাড়িটাতে এখন কে থাকে? ওখানেও একবার গেলে ভাল হয়। তাছাড়া নূপুর মণ্ডলকে একবার কল ব্যাক করা উচিত। নূপুর কেন ফোন করেছিল কে জানে? নূপুর মণ্ডল চরিত্রটা এখনও তার কাছে ধোঁয়া-ধোঁয়া। তার সম্বন্ধে আর একটু খবর নিতে হবে। হয়ত সমাদ্দার হেল্প করতে পারে। হাতে আরও কিছু কাজ আছে, এখনই মনে পড়ছে না। নিশ্চয় পরে মনে পড়বে। যে কাজগুলোর কথা মনে হল সেগুলো খাতায় লিখে রাখার জন্য আদিত্য উঠে বসল। খাটের ওপর বসে টেবিলের ওপর থেকে নোটখাতাটা খুঁজে বার করল। অনেক কাজ। অথচ হাতে সময় খুবই কম। এসব কাজ বিমলকে দিয়ে হবে না। নিজেকেই করতে হবে। এইসব সময়ে আদিত্যর মনে হয় তার একটা নির্ভরযোগ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকলে খুব সুবিধে হতো।

আদিত্য চেয়ার-টেবিলে না বসলে লিখতে পারে না। ছোটবেলার এই একটা সাহেবি অভ্যেস তার রয়ে গেছে। চেয়ারের ওপর যে দুটো আধময়লা প্যান্ট রাখা ছিল, সেগুলোকে সরিয়ে ঘরের একদিকে টাঙানো নাইলনের দড়িতে সে ঝুলিয়ে রাখল। আদিত্যর ঘরে কোনও আলমারি বা ওয়ার্ডরোব নেই। রাখার জায়গাও নেই। শুধু একটা দুইতাকওলা বেঁটে মতন হোয়াট-নট আছে যেটা এতই বেঁটে যে সেখানে জামা-প্যান্ট ঝুলিয়ে রাখা অসম্ভব। হোয়াট-নটের নিচের তাকে আদিত্যর বই ও কাগজপত্র থাকে, ওপরের তাকে গেঞ্জি-আন্ডারওয়্যার- রুমাল-পাজামা ছাড়াও সেইসব জামা-প্যান্টগুলো থাকে যেগুলো ধোপার বাড়ি থেকে সদ্য কেচে এসেছে। সৌভাগ্যবশত, এসব জিনিস আদিত্যর খুব বেশি নেই। থাকলে হোয়াট-নটে ধরানো যেত না। একবার-পরা জামা প্যান্ট তাই সে দড়িতেই ঝুলিয়ে রাখে। তবে আলস্যের কারণে বাড়ি ফিরেই ছাড়া জামা-প্যান্ট দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়ে ওঠে না। সাময়িকভাবে তাদের জায়গা হয় চেয়ারের ওপর।

আদিত্য চেয়ারে বসতে না বসতে তার মোবাইলটা বেজে উঠল। নূপুর মণ্ডল আবার ফোন করেছে। সে ফোন তুলে ‘হ্যালো’ বলতে না বলতে ওপার থেকে নূপুরের রিনরিনে গলা ভেসে এল, ‘আদিত্যদা চিনতে পারছ? আমি নূপুর। সেদিন সুপার মার্কেটে আলাপ হয়েছিল, মনে আছে?’

আদিত্য খেয়াল করল তাকে তুমি বলার লিবার্টিটা নূপুর নিজে নিজেই নিয়ে নিয়েছে। সে একটু ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘অবশ্যই মনে আছে। তারপর? কেমন চলছে? কলকাতা ধাতস্থ হল?’

‘কলকাতা তেমন একটা চেনা হয়নি। খুব বেশি জায়গায় তো যেতে হয় না। বেশিরভাগ দিনই বাড়ি থেকে আপিস আর আপিস থেকে বাড়ি।’

‘চিনে যাবে, আস্তে আস্তে চিনে যাবে।’ আদিত্য অলসভাবে বলল।

‘আদিত্যদা, একটা বিপদে পড়ে তোমাকে ফোন করছি। এই শহরে আর বিশেষ কাউকে চিনি না তো।’ আদিত্যর মনে হল নূপুরের গলার উৎকণ্ঠাটা বানানো নয়।

‘বিপদ? কী হল আবার?’ আদিত্য আন্তরিকভাবেই বলল।

‘ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। সামনা-সামনি কথা হলে ভাল হয়। কাল সকালের দিকে আমাকে একটু সময় দিতে পারবে? বেশি নয়, এই ধরো মিনিট পনেরো। আমার ডিউটি বেলা দুটো থেকে শুরু হয়। চলে রাত্তির দুটো অব্দি। আউটসোর্সিং-এর কাজ তো। কম্পানির গাড়িই বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। রাত্তিরে একদম সময় পাই না। সকাল এগারোটা, সাড়ে এগারোটা নাগাদ তোমার একটু সময় হবে?’

আদিত্য খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। কাল সকাল এগারোটা। আমি কি তোমার বাড়িতে চলে যাব?’

‘না, না। আমার বাড়িতে একটু অসুবিধে আছে। আমার বিপদের কথাটা বললেই সব বুঝতে পারবে। আমিই তোমার কাছে চলে আসছি। কোথায় আসব? তোমার মেসবাড়িতে?’

‘আরে না, না। এটা পুরুষদের মেস। সম্পূর্ণ নারী বিবর্জিত। তুমি এখানে ঢুকলে ঢি ঢি পড়ে যাবে।’ আদিত্য শঙ্কিত গলায় বলল।

‘তাহলে কোথায় যাব?’ নূপুরকে কিছুটা বিভ্রান্ত শোনাল।

‘তুমি আমার আপিসে চলে এস। তোমার বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়।’

‘কীভাবে যাব?’

‘বলছি কীভাবে আসবে। ওই অফিস টাইম-এ ট্যাক্সি পাওয়া শক্ত হবে। তুমি বরং ট্রামে এস। তুমি কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে এসপ্লানেডগামী ট্রামে উঠে বৌবাজারের মোড়ে নামবে। বৌবাজারের এখন নাম হয়েছে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট। ট্রাম থেকে নেমে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরে বিবাদী বাগের দিকে তোমাকে খানিকটা হাঁটতে হবে। কিছুটা হাঁটলে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ পড়বে। সেটা খুব বড় একটা রাস্তা। সেটা পেরিয়ে ওই বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরেই আরও মিনিট তিনেক হাঁটলে তোমার ডানদিকে পড়বে বিনানি ম্যানসন। পাঁচতলা বাড়ি। দোতলায় আমার আপিস। ঢোকার মুখে দেখবে একজন সিকিউরিটি বসে আছে। ওর নাম শ্যামল। আমার নাম বললে ও তোমাকে আমার আপিসটা দেখিয়ে দেবে। আমি বলে রাখব। আমার পুরো নামটা মনে আছে তো? আদিত্য মজুমদার।’

‘তোমার পুরো নাম আমার খুব ভালই মনে আছে। কিন্তু তুমি যেদিকটা যেতে বলছ আমি ওদিকটা একেবারেই চিনি না। তুমি আর একবার থেমে থেমে ডিরেকশনটা বলবে প্লিজ? আমি তাহলে লিখে নেব। দাঁড়াও আগে একটা কাগজ আর পেন নিয়ে আসি।’

নূপুর কাগজ-কলম নিয়ে আসার পর আদিত্যকে আবার খুব থেমে থেমে ডিরেকশনটা বলতে হল। ডিরেকশনটা দিয়ে সে বলল, কখনও যদি মনে হয় রাস্তা হারিয়ে ফেলেছ, আমাকে ফোন করবে। আমার মোবাইল তো খোলাই থাকবে।’

‘ঠিক আছে আদিত্যদা, তাহলে কাল এগারোটায় দেখা হচ্ছে।’ নূপুর ফোন কেটে দিল।

(২)

মাত্র মাস দেড়েক হল আদিত্য একটা স্মার্ট ফোন কিনেছে। তার আগে যে মোবাইলটা সে ব্যবহার করত সেটা সাদা-কালো, আজকের যুগের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় অ্যান্টিক। কিন্তু একে তো ফোনটার ওপর আদিত্যর খুব মায়া পড়ে গিয়েছিল, তার ওপর ফোনটারও নিশ্চয় আদিত্যর ওপর কিছুটা মায়া পড়েছিল। কারণ সেটা, আদিত্যকে ছেড়ে যাবার ভয়েই বোধহয়, কিছুতেই খারাপ হচ্ছিল না। আর খারাপ না হলে আদিত্য তাকে বাতিল করে কী করে?

শেষে একদিন রত্না আদিত্যর ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আমি এই ফোনটা আমাদের রান্নার মাসিকে দিয়ে দিচ্ছি। তুই তো নিজে থেকে নতুন ফোন কিনবি না। আমিই না হয় তোকে একটা নতুন স্মার্ট ফোন কিনে দেব।’

এরপর আর নতুন ফোন না কিনে উপায় আছে? তবে আদিত্য এখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে একটা স্মার্ট ফোন থাকার অনেক সুবিধে। এখন সে মোবাইলেই ই-মেল চেক করতে পারে। আগে ই-মেল দেখার জন্য ল্যাপটপটা খুলতে হত, কিন্তু খুললেই যে ই-মেল দেখা যেত তা নয়। আদিত্যর ব্রডব্যান্ড কানেকশন নেই, একটা ডঙ্গল দিয়ে কাজ চালাতে হয়। আর সেই ডঙ্গলটা অসম্ভব স্লো। তাই অনেক সময় ধরে কম্পিউটারটা বাফার করে যায়, ফলে ল্যাপটপে ই-মেল বা ইন্টারনেট দেখার ধৈর্য থাকে না। এখন যে শুধু মোবাইলে চট করে ই-মেলটা চেক করে নিতে পারে তাই নয়, নেট সার্ফ করারও বেশ সুবিধে হয়েছে। সব থেকে বড় সুবিধে, সে এখন হোয়াটস অ্যাপ দিয়ে নিখরচায় পৃথিবীর যে কোনও যায়গায় ফোন করতে পারে। যেমন এখন সে পার্থ সান্যালকে একটা ফোন করবে ভাবছে।

আদিত্য মেসবাড়ির খাবার ঘরে রাত্তিরের খাবার খেতে যায়। তাদের মেসে সপ্তাহে দুদিন মাছ, দুদিন ডিম, দুদিন নিরামিষ আর একদিন চিকেন খাওয়ানো হয়। এটা রাত্তিরের মেনু। দুপুরে দুদিন বাদ দিয়ে রোজই নিরামিষ। তবে অনেকেই কাজের দিনে দুপুরটা বাইরে খায়। আদিত্যও বছর দেড়েক তাই করছে। আজ রাত্তিরে নিরামিষ ছিল। দুরকমের বিস্বাদ তরকারি, ডাল আর তিনটে রুটি দিয়ে নিরানন্দ নৈশাহার সেরে একটু আগে আদিত্য তার ঘরে ফিরে এসেছে। মেসের মূল পাচক ভানু ঠাকুর কিছুদিনের জন্য দেশে গেছে। তার পরিবর্তে এখন যে রান্না করছে তার মতো খারাপ রাঁধুনি আদিত্য জীবনে দেখেনি। ভানু ঠাকুর না ফেরা অব্দি আদিত্যর মনে সুখ নেই।

মার্কিন দেশে চারটে টাইম জোন। পার্থ আছে পূর্ব উপকূলে, জর্জিয়ার অ্যাটলান্টাতে। তার সঙ্গে ভারতীয় সময়ের তফাৎ সব থেকে কম। কিন্তু এক ফ্যাকড়া, ওসব দেশে শীতকালে সময় এক ঘন্টা পিছিয়ে যায়, গ্রীষ্মে এগিয়ে আসে। আদিত্য ইন্টারনেটে দেখে নিয়েছে এই বছর নভেম্বরের প্রথম রবিবার মার্কিন দেশে শীতকালীন সময় শুরু হবে। তার মানে শীতকালীন সময় এখনও শুরু হয়নি। অর্থাৎ কলকাতার সঙ্গে অ্যাটলান্টার সময়ের পার্থক্য এখন সাড়ে ন-ঘন্টা। আদিত্য দেখল তার হাত ঘড়িতে রাত্তির পৌনে দশটা বেজেছে। তার মানে, আদিত্য হিসেব করে দেখল, পার্থদের ওখানে এখন বেলা সোয়া বারোটা। হয়ত পার্থ লাঞ্চ খেতে বেরিয়েছে। এখন তাকে ফোন করা যেতেই পারে।

আদিত্যর ভাগ্য ভাল ফোনটা একবারেই লেগে গেল। ওদিক থেকে পার্থ বলল, ‘বল। নতুন কোনও খবর আছে?’

‘নতুন খবর নেই। তবে কাজ শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু কাজ এগোতে গেলে আরও দুএকটা জিনিস জানা দরকার। তুই কি এখন সেগুলো জানাতে পারবি?’

‘আমি দুজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে বাইরে এসেছি। অফিসে ফিরে এক ঘন্টার মধ্যে তোকে ফোন করছি। তুই জেগে আছিস তো?’

‘আমি এখনও ঘন্টা তিনেক জেগে আছি। তুই ধীরেসুস্থে অফিসে ফিরে আমাকে একটা ফোন করিস।’ আদিত্য ফোন রেখে দিল। সে সমাদ্দারের কাছ থেকে যে তথ্যগুলো জানতে পেরেছে, ইচ্ছে করেই পার্থকে কিছু জানাল না। ওগুলো পুলিশের গোপন তথ্য, স্ট্রিক্টলি কনফিডেনশিয়াল। নিজের ক্লায়েন্টকেও সেই তথ্য জানানোর অধিকার আদিত্যর নেই।

পার্থর ফোনের আশায় এখন বিরহিনী রাধার মতো অপেক্ষা করতে হবে। হাতে কাজ অবশ্য অনেক আছে। টুকিটাকি অন্য কাজ, যার সঙ্গে চন্দ্রার উধাও হয়ে যাবার কোনও সম্পর্ক নেই। একটা ফিনান্সিয়াল কম্পানির হয়ে সে একটা জালিয়াতির তদন্ত করেছিল, তার রিপোর্টটা লেখা একটু বাকি আছে। কিছু মেলেরও উত্তর দিতে হবে।

আর একটা খুব দরকারি কাজ আছে। মেসের চাকর বলরাম তার ছেলের জন্য কয়েকটা ইংরেজি এসে এবং বাক্য রচনা লিখে দিতে বলেছে। এই কাজটা আদিত্যকে করতেই হবে। মাঝে মাঝেই করতে হয়। মেসবাড়িতে তার আপনজন বলতে বলরাম ছাড়া আর কেউ নেই। তাই বলরামের কথা সে ফেলতে পারে না। বলরামের ছেলে-বউ থাকে দেশের বাড়িতে, সে ছুটি-ছাটায় বাড়ি যায়। আদিত্যর হাজার বারণ সত্ত্বেও অনেক টাকা খরচ করে ছেলেকে প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে ভর্তি করেছে বলরাম, বাংলা ইস্কুলে নাকি লেখাপড়াই হয় না। কিন্তু বলরামের বাড়িতে ইংরেজি জানা কেউ নেই। কে তার ছেলেকে ইংরেজি পড়াবে? অতএব আদিত্যই একমাত্র ভরসা। আদিত্য ইংরেজিতে এসে, বাক্য রচনা বা প্রশ্নের উত্তর লিখে দেয়। সেটা হোয়াটস অ্যাপ করে তার বউকে পাঠিয়ে দেয় বলরাম। তারপর সেগুলো কী হয় আদিত্য জানে না। টেকনোলজির কী বিচিত্র ব্যবহার! আদিত্যকে বলরামের ছেলের ইংরেজি পাঠ্যবই এক কপি কিনতে হয়েছে।

সাড়ে এগারোটার একটু আগে পার্থ ফোন করল। বলল, ‘রাত হয়ে গেল নাকি?’

‘আরে না, না। এখনও সাড়ে এগারোটাই বাজেনি। কাগজে দেখছিলাম এবার আমেরিকায় তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। তোদের ওখানে কেমন ঠাণ্ডা এখন?’

‘এমনিতে তো অ্যাটলান্টাতে এই সময় ততটা ঠাণ্ডা পড়ে না। তবে এবছর একটু পড়েছে। কাল রাত্তিরে হঠাৎ দশ ডিগ্রিতে নেমে গিয়েছিল। দুপুরেও বাইরে বেরোতে গেলে একটা গরম জামা লাগছে। অক্টোবর মাসে এটা ভাবাই যায় না।’

‘শোন, আগে কাজের কথাগুলো সেরে নিই।’ এত রাত্তিরে আদিত্য ঠিক আড্ডা মারার মুডে নেই। ‘আমার কয়েকটা জিনিস জানার আছে। এক এক করে জিজ্ঞেস করছি। প্রথমত, তুই বলেছিলি কলকাতায় চন্দ্রার দুএকজন বন্ধু আছে যাদের সঙ্গে ওর নিয়মিত কথা হয়। তারা কারা? কোথায় থাকে?’

‘আমি খুব ভাল জানি না। তবে একজনের কথা চন্দ্রা খুব বলে। ওদের সঙ্গে কলকাতায় এম এস সি পড়ত। নাম কেয়া বাগচি। কেয়া নিয়মিত চন্দ্রার খোঁজ খবর নেয়। কিন্তু সে কোথায় থাকে বলতে পারব না। আরও দুএকজনের কথাও চন্দ্রা বলত। নামগুলো ঠিক মনে পড়ছে না। সরি টু বি অফ সো লিটল হেল্প।’

‘নো প্রবলেম। আমি কেয়া বাগচির কাছ থেকে নামগুলো জোগাড় করে নেব। কেয়া বাগচির ঠিকানাটাও জোগাড় করে ফেলতে পারব মনে হচ্ছে। আচ্ছা, চন্দ্রা কি ফেসবুকে আছে?’

‘আছে। তবে খুব অ্যাক্টিভ নয়। এটা কিন্তু ভাল বলেছিস। ফেসবুক থেকে ওর কিছু বন্ধুদের হদিশ পাওয়া যেতেই পারে।’

‘আমার পরের প্রশ্ন, চন্দ্রাদের আলিপুরের বাড়িতে এখন কে থাকে? ওখানে গেলে কার সঙ্গে কথা বলা যাবে?’

‘আমি যত দূর জানি, আলিপুরের বাড়িতে চন্দ্রার সৎমা একাই থাকেন। তাছাড়া নিচের তলায় সার্ভেন্টস কোয়াটারে এক নেপালি দরোয়ান তার পরিবার নিয়ে থাকে। সে ওদের বহুদিনের পুরোনো লোক। সে-ই বাড়িটা দেখাশোনা করে। আর বাড়ির বাগানে একটা আউটহাউস মতো আছে। সেখানে বুড়ো ম্যানেজারবাবু থাকেন, তার তিনকুলে কেউ নেই। তিনিও বহুদিনেরলোক, চন্দ্রাকে জন্মাতে দেখেছেন। চন্দ্রার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ব্যাঙ্কে যাওয়া, টাকা তোলা, ফিক্সড ডিপোজিট ম্যাচিওর করলে রিনিউ করা, বাড়ির ট্যাক্স জমা দেওয়া এইসব কাজ তিনি করেন। চন্দ্রা ম্যানেজারবাবুকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে। আমার ধারণা চন্দ্রার সৎমাও ম্যানেজারবাবুকে মোটের ওপর বিশ্বাস করেন। আলিপুরের বাড়িতে গেলে এদের সকলের সঙ্গেই কথা বলা যাবে। তাছাড়া ওদের আরও কাজের লোক আছে, বড়মানুষদের যেমন থাকে। তুই বাড়িটা চিনিস তো?’

‘অনেকদিন আগে গেছি। স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে। তবে মনে হয় যেতে পারব।’

‘আর কিছু জানতে চাস?’

‘হ্যাঁ। আমাকে খোঁজখবর করার জন্য চন্দ্রার ইস্কুলে যেতে হবে। তুই কি সেখানে কখনও গেছিস?’

‘আমি বেশ কয়েকবার গেছি। কয়েকবার তো চন্দ্রার সঙ্গেই গিয়েছিলাম। আর শেষ গেলাম এই কিছুদিন আগে, তোর সঙ্গে কথা বলার পর। তোর কথা আমি ওদের বলে এসেছি। ওখানে গেলে তোর কোনও অসুবিধেই হবে না।’

‘তার মানে আমি ওখানে একজন বেসরকারি গোয়েন্দা হিসেবেই যাচ্ছি, আমার নিজের পরিচয়ে, তাই তো?’

‘সেভাবে যাওয়াই তো ভাল, না কি?’

‘ভাল মন্দ পরের কথা, তুই যখন আমার কথা বলেই রেখেছিস তখন অন্য কোনও আইডেন্টিটিতে যাবার আর অপশানও তো নেই। যাই হোক, জায়গাটা ঠিক কোথায় বলত?’

‘জায়গাটা বসিরহাটের সাউথ-ইস্টে, ইছামতি নদীর ধারে, একেবারে বাংলাদেশের বর্ডারে। সোলাডাঙা বলে একটা জায়গা আছে তার কাছে। ইস্কুলটা খুব পুরোনো নয়, সরকারি সাহায্যও পায় না। একটা এন জি ও ইস্কুলটা চালায়। গরিব মেয়েদের এখানে প্রাইমারি ক্লাশ অব্দি পড়ানো হয়। ইস্কুলের নাম বনবীথি। চন্দ্রাকে নিয়ে সবসুদ্ধু চারজন দিদিমনি আছেন। আর আছেন একজন ক্লার্ক। তিনি পুরুষ মানুষ। তাঁকে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করতে হয়। সকলেরই নামমাত্র মাইনে। চন্দ্রার না হয় পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে মোটা ইনকাম আছে। অন্যদের যে কী করে চলে, মা ভবানীই জানেন।’

‘এখান থেকে সেখানে যাবার উপায় কী?’

‘শুনেছি শেয়ালদা থেকে ট্রেনে যাওয়া যায়। আমি অবশ্য প্রত্যেকবার একটা গাড়ি ভাড়া করে নিই। তুইও তাই নিবি। এটা তো তোর এক্সপেন্স অ্যাকাউন্টে যাবে। আর একটা কথা। তোর ব্যাঙ্ক ডিটেলটা আমাকে মেল করে দিস। ইনিশিয়াল খরচের জন্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দেব। তোর চেকের একটা স্ক্যানড কপি পাঠালেই হবে। আমার জি-মেল অ্যাকাউন্টে ব্যাঙ্ক ডিটেলটা পাঠাস। অফিসের ই-মেলটা আজকাল মাঝে মাঝে ওভার ফ্লো করে। তবে অফিসের মেলে পাঠালেও ওটা অটোম্যাটিকালি আমার জি-মেলে চলে আসবে।’

বনবীথি নামটা আদিত্যর চেনা চেনা লাগছে। আগে কোথায় যেন শুনেছে। সে বলল, ‘এই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে ইস্কুলের সন্ধান চন্দ্রা পেল কী করে?’

‘এটার উত্তর আমার জানা নেই। তবে ওখানে পড়িয়ে চন্দ্রা খুব খুশি ছিল। ওর মনে হতো গরিব মেয়েদের জন্যে ও একটা কিছু করছে।’

‘আমাকে একবার পুরুলিয়াতেও যেতে হবে। ওখানেও চন্দ্রা একটা ইস্কুলে পড়াত না?’

‘পড়াত বলেই তো জানি। তবে তার বেশি আর কিছু জানি না। পুরুলিয়ার কথা চন্দ্রা একদম বলতে চায় না। আমি দুএকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, পুরুলিয়ার কথা থাক।’

‘ঠিক আছে রে। আজ এই অব্দি থাকুক। আমি দরকার হলে আবার তোকে ফোন করব।’

‘ওক্কে। নতুন কিছু জানতে পারলে জানাস। গুড নাইট।’

আদিত্য মোবাইলটা বন্ধ করে দেখল প্রায় বারোটা বাজে। এখনও ঠিক ঘুম পায়নি। সে একটা সিগারেট ধরিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে বসল। ফেসবুকে গিয়ে চন্দ্রলেখা সেন-এর হোমপেজটা খুলে দেখল তার বন্ধুর সংখ্যা খুব বেশি নয়। তার মধ্যে তিন চারজন চন্দ্রার পোস্টগুলোতে নিয়মিত লাইক দেয়, কমেন্ট করে। এদের মধ্যে কেয়া বাগচি ছাড়াও রয়েছে মধুমিতা দাশগুপ্ত, মৌ সরকার এবং বর্ণালি দত্ত। বর্ণালি দত্ত আবার আদিত্যরও ফেসবুক ফ্রেন্ড, সে আদিত্যদের সঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স পড়ত। ভালই হল। একজন কমন ফ্রেণ্ড থাকার ফলে আদিত্য চন্দ্রার অন্য ফ্রেন্ডদের হোম পেজে যেতে পারল। এদের হোম পেজে গিয়ে আদিত্য জানতে পারল, মৌ সরকার অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, গ্রিন্ডলেস ব্যাঙ্কে চাকরি করে, মধুমিতা দাশগুপ্ত থাকে নয়ডায়, হোমমেকার। এরা দুজনেই লরেটো হাউসে পড়েছে, মনে হয় চন্দ্রার ইস্কুলের বন্ধু। বর্ণালি দত্ত তো আদিত্যরও ফ্রেন্ড, সে এখন থাকে শিকাগোতে, সেখানে ফার্মি ল্যাবে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো।

কেয়া বাগচি। এই নামটাই তো গার্গী বিশ্বাস বলেছিল। ফোন নম্বরটাও দিয়ে দিয়েছে। কেয়া বাগচি কলকাতাতেই থাকে। সে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি এস সি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি করেছে। একটা স্কুলে পড়ায়। আদিত্য লক্ষ করল, ফেসবুকে কেয়ার বন্ধুর সংখ্যা গিনিস বুকে ওঠার মতো। সে ফেসবুকে রীতিমত অ্যাক্টিভও বটে।

আদিত্য একটা হাই তুলে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিল। ঘুম পাচ্ছে।

(৩)

নূপুর বলেছিল এগারোটায় আসবে। এগারোটা বাজতে পাঁচে আদিত্য আপিসে পৌঁছে দেখল নূপুর তার আপিসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

‘অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ?’ আদিত্য দরজা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল।

‘বেশিক্ষণ না, এই মিনিট দশেক। কিন্তু তোমার কোনও দোষ নেই, আদিত্যদা। তুমি তো ঠিক সময়েই এসেছ। আমিই আগে আগে পৌঁছে গেছি। আসলে বাড়ি থেকে বেরিয়েই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। সেটা আগে আগে পৌঁছে দিল। আমার মা বলতেন, দেরিতে পৌঁছনোর থেকে আগে আগে পৌঁছে যাওয়া ঢের ভাল।’ তারপর গলা নামিয়ে প্রায় ষড়যন্ত্র করার স্বরে নূপুর বলল, ‘আদিত্যদা, তুমি তো বলোনি তুমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ?’

আদিত্য এই প্রশ্নটার জন্য তৈরি ছিল। নূপুর এই আপিসে এলে দরজায় লাগানো নেমপ্লেটটা তার চোখে পড়বে না এটা হতেই পারে না। আর বলাই বাহুল্য, নেমপ্লেট দেখলেই সে আদিত্যর পেশাটা জানতে পারবে। সে সহজ গলায় বলল, ‘ভেতরে এসে বোসো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ।’

কিছুক্ষণ পরে কেটলিতে জল গরম করতে দিয়ে আদিত্য বলল, ‘আমি কি তোমাকে একবারও বলেছি আমি গোয়েন্দা নই, অন্য কিছু? তুমি কি কখনও জিজ্ঞেস করেছ আমি কী কাজ করি, যে বলব?’

আদিত্য লক্ষ করল সেদিনের তুলনায় নূপুরকে একটু রোগা দেখাচ্ছে। মুখেও একটা চিন্তার ছাপ রয়েছে। সে নূপুরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার এখানে কিন্তু দুধ-চিনি ছাড়া কফি। তোমার চলবে তো?’

‘আমিও চা বা কফিতে দুধ-চিনি খাই না। কিন্তু তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন? কফি পরে খেলেও চলত।’

‘কফিটা আসলে আমার নিজের দরকার। সকালে আপিসে এসে একটা কফি না খেলে কাজ শুরু করতে পারি না। যাই হোক তোমার বিপদটা কী বল।’ আদিত্য গুঁড়ো কফির ওপর গরম জল ঢালতে ঢালতে বলল।

‘আমার বিপদটা নেহাতই সাদামাটা। গোয়েন্দার কাছে আসার মতো মোটেই নয়। কিন্তু তাই বলে ভেবো না বিপদের মাত্রাটা কিছু কম।’ নূপুর চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে আদিত্যর হাত থেকে কফির কাপটা নিল। তারপর জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, বিপদ একটা নয়, দুটো।’

দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। আদিত্য ‘খোলা আছে’ বলতেই শ্যামল দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। দুটো চিঠি আদিত্যর টেবিলে রেখে বলল, ‘লাঞ্চ আনতে হবে?’

আদিত্য নূপুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘লাঞ্চ খাবে?’

‘না, না। আমাকে দুটোর মধ্যে অফিস পৌঁছতে হবে। এক্ষুনি চলে যাব। লাঞ্চ খাবার প্রশ্নই ওঠে না।’

‘তাহলে আমার একার জন্যই নিয়ে এস। আমি যেটা খাই, সেটা। একটা সাদা ধোসা, একটা দইবড়া আর একটা শসা।’ আদিত্য শ্যামলের দিকে একটা একশ’ টাকার নোট এগিয়ে দিল।

শ্যামল দরজা বন্ধ করে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নূপুর বলল, ‘আমার প্রথম বিপদ, এই শহরে আমার থাকার কোনও জায়গা নেই। আমার মতো একা মেয়ের পক্ষে নিরাপদ কোনও জায়গা তোমার সন্ধানে আছে? খুব বেশি ভাড়া কিন্তু দিতে পারব না। কারও বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকতে পারলে সব থেকে ভাল হয়।’

‘কেন? তোমার কাকার বাড়ি কী হল?’

‘কাকা আমাকে বলেছিল বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে আছে। আমি যতদিন খুশি থাকতে পারি। কিন্তু কাকিমার ব্যাপারটা ভাল লাগেনি। এমনই কপাল, কাকিমার এক ভাই এখন বদলি হয়ে কলকাতায় এসেছে। কাকিমা সুযোগ পেয়ে গেছে। তাকে বলেছে ওই বাড়িতে থাকতে। কাকা কাকিমার ওপর কথা বলতে পারে না। তিনদিন আগে মালপত্তর নিয়ে সেই ভাই এসে হাজির। সঙ্গে তার স্ত্রী আর দুটো বাচ্চা। বলল, এই বাড়িতেই তার থাকার কথা। আমি ঘাবড়ে গিয়ে দিল্লিতে কাকাকে ফোন করলাম। কাকা সব শুনে আমতা আমতা করতে লাগল। কাকিমা কাকার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল, শোনো নূপুর, ওই বাড়িতে আমার ভাই তার পরিবার নিয়ে থাকবে। তুমি এক সপ্তাহের মধ্যে অন্য একটা থাকার জায়গা দেখে নাও। আমি তো আর কাকিমার সঙ্গে ঝগড়া করতে পারি না। আর করে লাভও নেই। আমার কলিগদের বলেছি, যদি কেউ কোনও বাড়ির সন্ধান দিতে পারে। এখন অব্দি কেউ কিচ্ছু দিতে পারেনি। সবাই বলছে, ডিসেম্বরে অনেক বাড়ি খালি হবে। ডিসেম্বরে খালি হলে আমার কী লাভ? এই কটা দিন আমি থাকব কোথায়? তারপর হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়ল। মনে হল, তোমার সন্ধানে হয়ত কিছু থাকতে পারে।’

আদিত্য দেখল নপূরের চোখদুটো ছলছল করছে। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করে নূপুরের অবস্থাটা প্রায় সেরকম। সে বলল, ‘দ্যাখো নূপুর, তোমাকে সাহায্য করতে পারলে খুব খুশি হতাম। কিন্তু আমি একজন অবিবাহিত পুরুষ মানুষ। আমার কাছে বড়জোর দুএকটা পুরুষদের মেসবাড়ির খবর থাকতে পারে। কিন্তু মেয়েদের জন্য পিজি, হস্টেল বা নিরাপদ বাড়ির সন্ধান আমি কোথা থেকে দেব?’ বলতে বলতে আদিত্যর কী যেন মনে পড়ে গেল। সে বলল, ‘দাঁড়াও, একটা জায়গায় জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।’

সে মোবাইলটা তুলে নিয়ে রত্নার নম্বরটা ডায়াল করল।

‘কি রে? সেই যে লক্ষ্মী পুজোর দিন উধাও হলি, আর সাড়াশব্দ নেই। ব্যাপারটা কী?’ ওদিক থেকে রত্নার গলা শোনা গেল।

‘ওই নতুন কাজটা ধরেছি। তোদের বললাম তো সেদিন। কটা দিন তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তুই কি এখন কলেজে?’

‘না, না। বাড়িতে আছি। কলেজ তো সেই ভাইফোঁটার পর খুলবে। আমাকে অবশ্য ছুটির মধ্যেও সপ্তাহে দুতিনদিন যেতে হয়। তবে আজ কলেজ যাইনি।’

আদিত্যর মনে পড়ে গেল, বছর খানেক হল রত্না প্রিন্সিপাল হয়েছে। তার মানে কাজও নিশ্চয় বেড়েছে।

 তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রত্না ওপার থেকে বলল, ‘তোর কী খবর বল। চন্দ্রাকে খুঁজে পাওয়া গেল?’

‘এত সহজে খুঁজে পাওয়া গেলে তো সমস্যাই ছিল না। এখনও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।’ আদিত্যর গলাটা বিষণ্ণ শোনালো। তারপর গলার সুর পালটে সে বলল, ‘আমি কিন্তু তোকে সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে ফোন করেছিলাম। পুজোর সময় যখন তোদের বাড়িতে থাকছিলাম তখন একদিন ওভারহিয়ার করলাম তুই তোদের হস্টেল সুপারের সঙ্গে কথা বলছিস। মনে হল তুই সুপারকে বলছিলি তোদের পোস্টগ্র্যাজুয়েট ক্লাশের কয়েকটি মেয়ে, হস্টেলে জায়গা না পেয়ে, কজন মিলে পার্ক সার্কাসের কাছে একটা বাড়ি ভাড়া করেছে। বাড়িটা ভাল কিন্তু ওদের আন্দাজে একটু বড়। তাই ওরা আরও একজনকে খুঁজছে যে ওদের সঙ্গে বাড়িটা শেয়ার করতে পারে। আমি ঠিক বলছি তো?’

‘একদম ঠিক বলছিস। ওরা এখনও কাউকে পায়নি। কালই ওদের একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তোর চেনা কেউ আছে নাকি? স্টুডেন্ট হলে সব থেকে ভাল হয়। ওরা ইন ফ্যাক্ট স্টুডেন্টই খুঁজছে।’

‘আমার চেনা একজন আছে কিন্তু সে স্টুডেন্ট নয়। সেক্টর ফাইভে কাজ করে। খুব ডেসপারেটলি তার একটা মাথা গোঁজার জায়গা দরকার। ওরা কি ওয়ার্কিং গার্ল নেবে?’

‘সেক্টর ফাইভের একটা প্রবলেম হল এদের বাড়ি ফিরতে গভীর রাত্তির হয়ে যায়। তাতে এই মেয়েগুলো আনসেফ বোধ করতে পারে। যাইহোক তুই ওই মেয়েটাকে বলতে পারিস আমার ছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু মেয়েটা কে?’

‘মেয়েটা আমাদের পাড়ার। বাজার করতে গিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ। রায়গঞ্জের মেয়ে। কলকাতায় চাকরি করতে এসেছে। কাউকে চেনে না। কাকার বাড়িতে থাকত, এখন আর সেখানে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।’

‘তুই আবার ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস না তো?’

‘ডুবে ভেসে কোনওভাবেই জল খাচ্ছি না। মেয়েটি আমার সঙ্গে দাদা-বোনের সম্পর্ক পাতিয়েছে। তুই আমায় ভাবিস কী?’ বলতে বলতে আদিত্য একবার আড়চোখে নূপুরের দিকে দেখে নিল। নূপুরের চোখদুটো হাসছে।

‘ঠিক আছে, তোকে বিশ্বাস করলাম। আমার কাছে ওখানকার একটি মেয়ের ফোন নাম্বার আছে। ও-ই দিয়ে রেখেছে, যদি আমি কাউকে জোগাড় করে দিতে পারি, এই আশায়। আমি নাম্বারটা টেক্সট করে দিচ্ছি। তোর বোনকে তাড়াতাড়ি ফোন করতে বলিস। নইলে কিন্তু বাড়ি হাতছাড়া হয়ে যাবে।’

‘আমি আজকেই ফোন করতে বলছি। আর এই উইকএন্ডেই হয়ত তোদের বাড়িতে যাব। তোকে বলে রাখলাম। অমিতাভকেও বলিস। এখন রাখছি।’

আদিত্য ফোন রাখতে না রাখতেই টুং করে মেসেজ এল। রত্না ফোন নম্বরটা পাঠিয়ে দিয়েছে।

নূপুর চলে যাবার আধঘন্টা পরে আদিত্যর দুপুরের খাওয়া নিয়ে এল শ্যামল। খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ জানলার দিকে তাকিয়ে আদিত্য সিগারেট ধরাল। তারপর উঠে গিয়ে জানলার পাশে দাঁড়াল সে। নিচে রাস্তায় বউবাজারের জনস্রোত। অক্টোবর যত শেষ হয়ে আসছে তত নরম হচ্ছে রোদ্দুর। সামনে দেয়ালি। ঘড়ির দোকানে মেগা সেল চলছে। ঘন্টা বাজাতে বাজাতে একটা ফাঁকা ট্রাম কলেজ স্ট্রিটের দিকে চলে গেল। কলেজ স্ট্রিট হয়ে বেলঘরিয়া যাবে। আজকাল ট্রামে বোধহয় বিশেষ কেউ চড়ে না।

চন্দ্রার নিখোঁজ হয়ে যাবার রহস্যটা আরও জটিল হয়ে উঠছে। পার্থর সঙ্গে কথা বলেও কয়েকটা খটকা লাগছে। পার্থর যতটা উদ্বিগ্ন হবার কথা, তাকে ততটা উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে কি? নূপুরের চালচলনও একটু অদ্ভূত। তার যে একটা বাড়ি দরকার সে কথাটা অনায়াসে টেলিফোনে বলা যেত। তার জন্যে ঠেঙিয়ে আদিত্যর আপিস অব্দি আসতে হল কেন? সেটা কি শুধু তার তীব্র অসহায়তাটা বোঝানোর জন্য? নূপুর এখনও তার দ্বিতীয় বিপদের কথা বলেনি। শুধু বলে গেছে, প্রথম বিপদটা সামলে উঠলে, দ্বিতীয়টার কথা বলবে।

আদিত্য সিগারেট শেষ করে চেয়ারে এসে বসল। মোবাইলে সঞ্জয় সমাদ্দারের নম্বরটা লাগাল।

‘বলুন স্যার’ সমাদ্দারের গলায় আন্তরিকতা স্পষ্ট।

‘একটা রিকোয়েস্ট ছিল সমাদ্দার সাহেব।’

‘নিশ্চয়, বলুন।’

‘একটি মেয়ে সম্বন্ধে ইনফর্মেশান দরকার। যতটা ইনফর্মেশান পাওয়া যায়। মেয়েটির নাম নূপুর মন্ডল। আপনি একটা কাগজে নোট করে নেবেন?’

‘নিচ্ছি স্যার। এক মিনিট দাঁড়ান, একটা কাগজ নিয়ে আসি।’

কিছুক্ষণ পরে আবার সমাদ্দারের গলা শোনা গেল, ‘বলুন স্যার।’

‘হ্যাঁ। মেয়েটির নাম নূপুর মন্ডল। বয়েস তেইশ-চব্বিশ। বড়জোর পঁচিশ। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি থেকে অঙ্ক অনার্স নিয়ে বি এস সি করেছে, তারপর ওখান থেকেই কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স। বাড়ি রায়গঞ্জ শহর থেকে খানিকটা দূরে। আপনাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এই মেয়েটির সম্বন্ধে যতটা জানা যায় জেনে দেবেন? বিশেষ করে জানতে হবে পুলিশের খাতায় মেয়েটির নাম আছে কিনা।’

‘কোনও প্রবলেম হবে না স্যার। কয়েকদিনের মধ্যে জেনে নিয়ে আপনাকে জানিয়ে দেব। আর কিছু?’

‘আপাতত এইটুকুই। পরে হয়ত আবার আপনাকে বিরক্ত করতে পারি।’

‘বিরক্ত বলবেন না স্যার। আপনার জন্যে কিছু করা মানে দাশগুপ্ত সাহেবের জন্যে করা। ভাল থাকবেন স্যার। আমি খবর পেলেই আপনাকে জানাব।’

বাকি দিনটা আদিত্যর এটা-ওটা ভাবতে ভাবতে কেটে গেল। রাত্তিরে মেসে ফিরে আবার সেই নিরানন্দ ডিনার। তরকারির সঙ্গে আজ একটা ডিমও ছিল। কিন্তু এত ঝাল দিয়েছে, ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে যায়। কবে যে ভানু ঠাকুর ফিরে আসবে!

দশটা নাগাদ নূপুরের ফোন। গলায় খুশি ঝরে পড়ছে।

‘আদিত্যদা, থাকার জায়গা পেয়ে গেছি। কী বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দেব!’

‘কী হল খুলে বল।’

‘আমি প্রথমে ওই নম্বরে ফোন করলাম। বললাম রত্নাবলী মিত্রর কাছ থেকে নম্বরটা পেয়েছি। তুমি যেমন বলতে বলেছিলে। বললাম আমি চাকরি করি, থাকার জায়গা খুঁজছি, শুনেছি তোমাদের ওখানে একটা জায়গা খালি আছে। তবে সেক্টর ফাইভে চাকরি করি প্রথমে বলিনি। ওরা ওদের ওখানে যেতে বলল। আমি সন্ধে সাতটা নাগাদ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িটা পার্ক সার্কাস কানেক্টারের ধারে। আমার অফিস থেকে যাওয়া খুব সুবিধে।’

নূপুর একটু থামল। আদিত্য বলল, ‘তারপর?’

‘মেয়েগুলো খুব ভাল। আমার থেকে দুএক বছরের ছোট। সকলেই পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ছাত্রী। তবে আমি সেক্টর ফাইভে কাজ করি শুনে বেশ গাঁইগুঁই করছিল। বলল, অত রাত্তিরে বাড়ি ফিরলে ওদের ঘুম ভেঙে যাবে। পরদিন সকালে উঠে ক্লাশ করবে কী করে? অনেক কথাবার্তার পর ঠিক হল, বাড়িতে যে খুব ছোট একটা ঘর আছে, যেটাকে এখন ওরা স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার করছে, সেখানে একটা খাট ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। আমি সেখানে একা থাকব। তাহলে রাত্তিরে আমি ফেরার সময় কেউ বিরক্ত হবে না। ঘরটাতে জানলা নেই, পাখাও নেই। কিন্তু ওটুকু আমি সহ্য করে নেব। এখন তো শীত আসছে। পাখার অতটা দরকার হবে না। আর নেহাত দরকার পড়লে না হয় একটা টেবিল ফ্যান কিনে নেওয়া যাবে। সব মিলিয়ে আমি খুব খুশি। কাল শনিবার আমার ছুটি। সকালেই মালপত্তর নিয়ে শিফট করে যাচ্ছি। তোমার জন্যই একটা মাথা গোঁজার জায়গা পেলাম। কী উপকার যে হল। বলেছিলাম না আমি লোক দেখে ঠিক বুঝতে পারি সে কেমন। তোমাকে দেখেই ভালো লোক মনে হয়েছিল।’

নূপুর মন্ডলের উচ্ছ্বাস আর থামে না!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *