চন্দ্রলেখা অন্তর্ধান রহস্য – ২

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

(১)

আজকাল শহরের রাস্তায় রাস্তায় দৈত্যাকার সব মুদিখানা হয়েছে। এদের এক সময় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স বলা হত, এখন মার্কিনি কায়দায় বলা হয় সুপার মার্কেট। সাবান-পাউডার থেকে বেডকভার, কেক-বিস্কুট থেকে কাটোয়ার ডাঁটা, লম্বা হাতলওলা আধুনিক ন্যাতা ও সম্মার্জনী থেকে শুরু করে ককটেল সসেজ—জগতের হেন জিনিস নেই সেখানে পাওয়া যায় না। পাড়ার পুরোনো মুদিখানাগুলো ভয়ে ভয়ে আছে, এই বুঝি তাদের ঝাঁপ একেবারে বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু এখন অব্দি তারা টিকেই রয়েছে, সম্ভবত এই কারণে যে, আদিত্যর মতো কোনও কোনও খদ্দের এখনও মহাবিপনীর আন্তর্জাতিক পরিবেশে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। আদিত্যর মেসবাড়ির কাছে পাড়ার মুদিখানা বলতে একটাই, দুই ভাই উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সেটিকে চালু রেখেছে। বড় ভাই গোপাল গম্ভীর স্বভাবের, কথা বলে কম। ছোট নেপাল হড়বড় করে কথা বলে, তার অর্ধেক কথা বোঝাই যায় না। এরই মধ্যে, মাস ছয়েক হল, বড় রাস্তার ওপরে তিনটে তলা জুড়ে মাথা তুলেছে নতুন একটা সুপার মার্কেট। ছোট ভাই নেপাল আজকাল প্রায়শই উৎকণ্ঠিত হয়ে আদিত্যকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা দাদা, আপনারা তো অনেক লেখাপড়া করেছেন, পাঁচটা জায়গায় যান, পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেন। আপনার কি মনে হয়, আমরা আর ব্যবসা-পত্তর চালাতে পারব?’ আদিত্য তাকে এই বলে আস্বস্ত করে যে, এই গরিব দেশে যতই সুপার মার্কেট গজিয়ে উঠুক, পাড়ার মুদিখানা অত সহজে বন্ধ হবার নয়।

এসব নিয়ে অবশ্য আজকাল খবর কাগজে পোস্ট-এডিট ছাপা হচ্ছে, টেলিভিশনের টক-শোতে পণ্ডিতেরা এসে তুমুল তর্কাতর্কি করছে। আদিত্য টিভি তেমন একটা দেখে না, খবর কাগজের পোস্ট-এডিটগুলোও মন দিয়ে পড়ে না। তাছাড়া অর্থনীতির সূক্ষ্ম যুক্তি-টুক্তিতেও তার তেমন উৎসাহ নেই। সে শুধু লক্ষ করেছে, এই আশ্চর্য দেশে দুটো-তিনটে শতাব্দী কেমন অনায়াসে পাশাপাশি সহাবস্থান করছে। বস্তির পাশে বিরাজ করছে হাইরাইজ, সরু গলির মধ্যে হাতে-টানা রিক্সার পেছন পেছন গজেন্দ্রগমনে চলেছে মার্সিডিস বেনজ। তাহলে সুপার মার্কেটের পাশাপাশি সনাতন মুদিখানাই বা চলবে না কেন? আদিত্যর একটা সামন্ত্রতান্ত্রিক সত্তা আছে যার ফলে ধোপা-নাপিত-মুদির ক্ষেত্রে একটু ব্যক্তিগত ছোঁয়া না থাকলে তার ভাল লাগে না। এই ব্যক্তিগত ছোঁয়ার লোভে সে নেহাত অপ্রয়োজনেই গোপাল-নেপালের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুদণ্ড কথা বলে। তাদের খোঁজখবর নেয়। আর পারতপক্ষে বড়রাস্তা পেরিয়ে সুপার মার্কেটে জিনিসপত্র কিনতে যায় না।

একটাই সমস্যা। রবিবার সন্ধেবেলা গোপাল-নেপালের দোকানটা বন্ধ থাকে। সপ্তাহের মধ্যে ওই একটা বেলা দুভাই বাড়ি বসে বিশ্রাম নেয়। তখন হঠাৎ কিছুর দরকার পড়লে সুপার মার্কেট ছাড়া গতি নেই। অমিতাভ-রত্নার বাড়ি থেকে পুজোর ছুটি কাটিয়ে আদিত্য যেদিন মেসে ফিরে এল সেদিন একে রবিবার, তায় লক্ষ্মী পুজো। ঘড়িতে সন্ধে সাতটা বেজে গেছে। রাস্তাঘাট খাঁ খাঁ করছে। দোকানপাট সব বন্ধ। সাধারণ রবিবারে মহাত্মা গান্ধী রোডের ওপর তবু দুএকটা সবজিওলা বসে, ঠেলাগাড়ি দাঁড় করিয়ে দুএকজন পকৌড়া বিক্রি করে। আজ তারাও কেউ নেই। মেসে ফিরে আদিত্য দেখল টুথপেস্ট ফুরিয়ে গেছে, সাবানের অবস্থাও তথৈবচ। তাছাড়া কিছু বিস্কুট আর এক কৌটো কফি কিনে রাখলেও ভাল হয়। কিছুদিন হল সে দুটো ইলেকট্রিক কেটলি কিনেছে, একটা বাড়ির জন্য, একটা আপিসের জন্য। চা-কফি নিজেই বানিয়ে নিচ্ছে।

রাস্তার ওপারে সুপার মার্কেট। আদিত্য রাস্তায় বেরিয়ে দেখল সেটা তখনও খোলা রয়েছে। বিপনীতে ঢোকার মুখে নীল ইউনিফর্ম পরা একটি নিপাট ভালমানুষ চেহারার যুবক তার হাতের যান্ত্রিক ডাণ্ডাটা আদিত্যর আপাদমস্তক বোলাতেই যন্ত্রটা থেকে নানারকম ধাতব শব্দ বের হতে লাগল। তাতে যুবকটি কী বুঝল সেই জানে। আদিত্য ধরে নিল, যুবকটি বুঝে গেছে, আদিত্যর কাছে বোমা-ছুরি-পিস্তল ইত্যাদি ভয়ঙ্কর কিছু নেই। কারণ সে একগাল হেসে বলল, ‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার।’ আদিত্যর মনে পড়ে গেল তার এক বন্ধুর গল্প। বন্ধুটি প্রথম মার্কিন দেশে পৌঁছনোর কয়েকদিন পর ইউনিভার্সিটির বাসে উঠে টাল সামলাতে না পেরে এক মেমসাহেবের পা মাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’।

সুপার মার্কেটটি একটি নাম করা চেন। জিনিসপত্রে ঠাসা, তবে এই লক্ষ্মী পুজোর রাত্তিরে প্রায় খদ্দেরহীন। আদিত্য দেখল, এক কোণে একটি পরিবার, অর্থাৎ স্বামী, স্ত্রী এবং বাজার করার ঠেলাগাড়ির ওপর উপবিষ্ট তাদের বছর তিনেকের মেয়ে, শাক-সব্জীর বাজার করছে। আর একটু দূরে মাঝবয়সী এক মহিলা পসরা উপচে পড়া ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলেছেন। মনে হয় তাঁর আরও কিছু সওদা করার মতলব আছে। নিজের জিনিসগুলো খুঁজে নিতে আদিত্যর খুব বেশি সময় লাগল না। জিনিসগুলো একটা বাস্কেটে ভরে সে কাউন্টারের দিকে এগোতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে একটি মেয়ের গলা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ইন্সট্যান্ট নুডলস কোনদিকে আছে, জানেন?’

আদিত্য পেছন ফিরে দেখল বছর পঁচিশের একটি ছোটখাট শ্যামবর্ণ মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটির বয়কাট চুল, ছোট নাক, চোখের দৃষ্টিতে সারল্য, দুষ্টুমি এবং অকৃত্রিম বিষ্ময়ের চমৎকার মিশেল ঘটেছে। প্রচলিত অর্থে সুন্দরী হয়ত নয়, তবে নিঃসন্দেহে অ্যাট্র্যাক্টিভ। মেয়েটির প্রশ্নের উত্তরটা আদিত্যর জানার কথা ছিল না, কারণ এই বিপনীতে মাত্র দু-একবারই সে এসেছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে কয়েক মিনিট আগে স্ট্যাক থেকে বিস্কুট তুলতে গিয়ে সে খেয়াল করেছিল বিস্কুটের ঠিক উল্টোদিকে নুডল, ম্যাকারনি, স্প্যাগেটি ইত্যাদি রয়েছে। তাই বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সে বলল, ‘সামনের দুটো আইল ছেড়ে তৃতীয়টার বাঁদিকে।’

একটাই কাউন্টার খোলা। সেখানে পৌঁছে আদিত্য দেখল সেই মাঝবয়সী মহিলা তার সামনে দাঁড়িয়ে উপুড়-চুপুড় ঠেলাগাড়ি থেকে একটা একটা করে জিনিস কাউন্টারে নামিয়ে রাখছেন। তার মানে ঝাড়া পাঁচ মিনিটের ধাক্কা। আদিত্য ভদ্রমহিলার পেছনে লাইন দিল, তারপর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পর তার মনে পড়ল কিছুদিন হল শ্যাম্পুটা ফুরিয়েছে, অবিলম্বে একটা নতুন বোতল কেনা দরকার। সে খেয়াল করেনি ইতিমধ্যে সেই শ্যামলা মেয়েটি তার পেছনে এসে লাইন দিয়েছে। সে মেয়েটিকে ‘আপনি এগিয়ে যান’ বলে শ্যাম্পুর খোঁজে লাইন থেকে বেরিয়ে এল। কিছুক্ষণ পরে সে যখন শ্যাম্পুর বোতল এবং নেহাতই অদরকারি এক প্যাকেট পট্যাটো চিপস নিয়ে ফিরে এল, তখন শ্যামলা মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে ক্রেডিট কার্ড বার করে দাম মেটাচ্ছে।

কেনা জিনিসগুলো ব্যাগে নিয়ে আদিত্য বাইরে এসে দেখল এক কাণ্ড ঘটেছে। সেই শ্যামলা মেয়েটি বিপনীর মূল ফাটকের সামনে পড়ে গেছে। তার প্লাস্টিক ব্যাগের জিনিসপত্র ব্যাগ থেকে বেরিয়ে বৃষ্টিভেজা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আদিত্য এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে তাকে উঠতে সাহায্য করল। তারপর সে আর মেয়েটি মিলে মাটিতে ছড়ানো জিনিসগুলো এক এক করে আবার ব্যাগে তুলে ফেলল। সুবিধের ব্যাপার প্লাস্টিকের ব্যাগ বৃষ্টিতে ভিজলেও ছিঁড়ে যায় না।

‘আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব।’ মেয়েটি একটু ধাতস্থ হয়ে বলল। ‘বৃষ্টির জলে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।’ নিজের দুর্গতিতে মেয়েটি নিজেই হাসল।

‘সাবধানে থাকবেন। বাড়িতে আর্নিকা থাকলে কয়েকটা খেয়ে নিতে পারেন। নাহলে হয়ত দেখবেন কাল সকালে গায়ের ব্যথায় উঠতে পারছেন না।’ আদিত্য মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল।

‘বাড়িতে এক শিশি আর্নিকা আছে বোধহয়।’ মেয়েটি অনিশ্চিত গলায় বলল।

বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। সঙ্গে ছাতা নেই, এখন ফিরতে গেলে একেবারে ভিজে যেতে হবে। সারা পুজো জুড়ে বৃষ্টিটা জ্বালিয়েছে, লক্ষ্মী পুজোতেও রেহাই দিচ্ছে না। দোকানের বাইরে শেডে আদিত্যর পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি অপেক্ষা করছে।

‘কী বিচ্ছিরি বৃষ্টি বলুন তো, সেই ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু হয়েছে।’ মেয়েটি বলল।

মুখ দিয়ে একটা সম্মতিসূচক শব্দ করল আদিত্য।

‘আপনি কি এই পাড়াতেই থাকেন?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করল।

‘রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটা গলি ঢুকে গেছে দেখতে পাচ্ছেন। ওই গলিটা দিয়ে দুপা গেলেই শংকর হোটেল। তার তিনতলায় আমি থাকি।’

‘হোটেলে থাকেন?’ মেয়েটি বেশ অবাক হয়েছে।

‘ওটা পুরোপুরি হোটেল নয়। তিনতলার গোটাটাই মেস। ওই মেসে একটা ঘর নিয়ে আমি থাকি।’ মেয়েটির গায়ে-পড়া ভাবে আদিত্যর একটু অস্বস্তি হচ্ছিল।

মেয়েটি যেন আদিত্যর মনের ভাব বুঝতে পারল। মুখে বলল, ‘নিশ্চয় ভাবছেন এত প্রশ্ন কেন করছি। আসলে মাত্র কয়েক সপ্তাহ হল কলকাতায় এসেছি। সেক্টর ফাইভে নতুন চাকরি। কলকাতা বলতে গেলে চিনিই না। আমার বাড়ি রায়গঞ্জে। তাও ঠিক রায়গঞ্জ শহরে নয়, শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে, মালদা আর রায়গঞ্জের মাঝামাঝি একটা জায়গায়। আমি অবশ্য রায়গঞ্জ শহরে পড়াশোনা করেছি। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি থেকে অঙ্ক অনার্স, তারপর ওখান থেকেই কম্পিউটার সায়েন্স-এ মাস্টার্স। ওই যে দূরে হাইরাইজ বাড়িটা দেখছেন? ওটার পাঁচতলায় আমার কাকার একটা ফ্ল্যাট আছে। কাকা-কাকিমা দিল্লিতে থাকে। ফ্ল্যাটটা ফাঁকাই পড়েছিল, তাই আমাকে থাকতে দিয়েছে। আমারও সুবিধে হল আর কাকাও ফ্ল্যাট দেখাশোনা করার জন্য একটা লোক পেয়ে গেল।’ মেয়েটি থামল। বৃষ্টিটা এক নাগাড়ে হয়েই চলেছে।

‘ওই দেখুন আমার নামটাই বলা হয়নি। আমার নাম নূপুর, নূপুর মণ্ডল। কলকাতায় প্রায় কাউকেই চিনি না। একটা দুটো চেনা ভাল লোক কাছে-পিঠে না থাকলে আমার খুব ভয় করে। তাই আপনার সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ জমালাম।’

‘ভাল করেছেন। কিন্তু আমি ভাল লোক বুঝলেন কী করে?’

‘আমি পড়ে যেতে আপনি যেভাবে সাহায্য করলেন! আপনাকে দেখেই বোঝা যায় আপনি ভদ্রলোক। খুব বনেদি বাড়ির লোক। আমি মানুষ চিনতে কখখনো ভুল করি না।’

‘আপনি বুঝি অনেক মানুষ দেখেছেন?’ আদিত্য মজা করার গলায় বলল।

‘খুব বেশি দেখিনি অবশ্য, তবে বুঝতে পারি।’ মেয়েটি হাসল।

আদিত্য খেয়াল করল মেয়েটি হাসলে তার চোখ দুটোও হাসে। সে বুকের কাছে দুই হাত জড়ো করে নমস্কারের ভঙ্গীতে বলল, আমার নাম আদিত্য মজুমদার। কোথায় থাকি সেটা তো আগেই বলেছি।’

বৃষ্টির বেগ একটু কমেছে। একেবারে যে থামেনি সেটা রাস্তার আলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়। এর থেকে কম বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে গেলে অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হবে। আদিত্য বলল, ‘বৃষ্টিটা ধরেছে মনে হচ্ছে। এগোবেন নাকি?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলুন, চলুন। এর থেকে আর কমবে না।’ মেয়েটি মাটিতে নামিয়ে রাখা বাজারের ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। তারপর সেটা আবার নামিয়ে রেখে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ, আমাকে আপনি বলবেন না। নাম ধরে ডাকবেন। আমি তো আপনার থেকে কত ছোট! আপনার ছোট বোনের মতো।’

ছোট বোন! আদিত্য একটু অপ্রস্তুত। সে বলল, ‘অনুমতি দিলে তাই ডাকব।’ এর থেকে উপযুক্ত কোনও উত্তর তার মাথায় এল না।

হ্যারিসন রোড একেবারে ফাঁকা। দুজনে সহজেই বড় রাস্তা পেরিয়ে গেল। মেসের গলির মুখে পৌঁছে আদিত্য বলল, ‘আমার মোবাইল নম্বরটা বলছি। ওই নম্বরে একটা ফোন করলে আমিও আপনার, মানে, তোমার নম্বরটা সেভ করে নিতে পারব। আজ এগোচ্ছি। কোনও দরকার হলে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ফোন কোরো। আর আর্নিকাটা অবশ্যই খেয়ে নিও।’

নিজের ঘরে ফিরে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে আদিত্য ভাবছিল, গ্রামের মেয়েরা এত সহজে দাদা-বোন পাতিয়ে ফেলে নাকি? ঠিক যেন পঞ্চাশ দশকের বাংলা সিনেমা। তাছাড়া মেয়েটাকে খুব গ্রাম্য বলে তো মনে হল না। গ্রামের মেয়েদের কি বয়কাট চুল হয়? তারা কি ইন্সট্যান্ট নুডল খায়? মেয়েটা দিব্যি তো ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বাজার করছিল। হয়ত শহরের অভ্যেসগুলো আজকাল গ্রামেও পৌঁছে গেছে। নাকি এর মধ্যে অন্য কিছু আছে?

(২)

আদিত্যর পুলিশ বন্ধু গৌতম দাশগুপ্ত, আই পি এস, বছর খানেক হল ডেপুটেশনে দিল্লি গেছে। এর ফলে আদিত্যর বেশ অসুবিধে হচ্ছে। তার কাজে পুলিশের কাছ থেকে সহযোগিতার বিশেষ প্রয়োজন। প্রায়শই এটা-ওটা জানবার দরকার হয়ে পড়ে। গৌতমের কাছ থেকে যেসব গোপন তথ্য সে সহজেই পেয়ে যেত, এখন সেগুলো পেতে গেলে কিছুটা চেষ্টা করতে হয়, সব সময় যে পাওয়া যায় তাও নয়। অবশ্য গৌতম যাবার আগে লালবাজারে দুএকজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে গেছে। খুব অসুবিধে না হলে, তারা আদিত্যকে সাহায্যই করে। তাছাড়া কয়েকটা জটিল রহস্যের সামাধান করে পুলিশ মহলে তার মোটামুটি নামও হয়েছে। কিন্তু গৌতম লালবাজারে থাকার সুবিধেটা ছিল অন্যরকম।

আদিত্য তার আপিসে বসে ভাবছিল। চন্দ্রা সম্বন্ধে পুলিশের খাতায় কী তথ্য আছে সেটা জানা দরকার। নকশাল করলে পুলিশের খাতায় নাম থাকাটা সম্ভব। তবে পুলিশের খাতায় নাম থাকতে গেলে মাওবাদী ইনভলভমেন্ট কিছুটা গভীর হতে হবে। চন্দ্রার কতটা ইনভলভমেন্ট ছিল, জানা নেই। জানতে হবে। কার সঙ্গে কথা বলবে? গৌতম যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে? নাকি প্রথমে গৌতমের সঙ্গে কথা বলে নেবে?

সাত-পাঁচ ভেবে গৌতমের নম্বরটাই ডায়াল করল আদিত্য। রিং টোন খানিকক্ষণ কিশোরকুমারের গলায় ‘জীবন সে ভরি তেরি আঁখে’ শোনানোর পর নিজে থেকেই থেমে গেল, অর্থাৎ গৌতম ফোনটা ধরল না। হয়ত ফোনটা সাইলেন্ট করে মিটিং করছে। আদিত্য মোবাইলটা টেবিলে নামিয়ে রেখে একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটের প্যাকেটে আজকাল ধূমপায়ীদের সম্বন্ধে ভয়ঙ্কর সব বার্তা দেওয়া থাকে। কর্কটাক্রান্ত ফুসফুসের কিছু সিনিস্টার ছবিও থাকে। আদিত্য যত ভাবে প্যাকেটের দিকে তাকাবে না, তবু বারবার চোখ পড়ে যায়। সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে সে প্যাকেটটাকে টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখল যাতে আর সেটাকে দেখতে না হয়। তারপর মোবাইলটা তুলে নিয়ে আর একবার গৌতমের নম্বরটা লাগাল। এবারেও কিশোরকুমার খানিকক্ষণ ‘জীবন সে ভরি’ শোনালেন, কিন্তু গৌতম ফোনটা ধরল না। গৌতম নিশ্চয় ব্যস্ত আছে, নাহলে ফোনটা অবশ্যই ধরত। গৌতমকে একটা মেসেজ করতে করতে আদিত্যর খেয়াল হল, ‘জীবন সে ভরি’ গানটা রাগেশ্রীর ওপর। গানটা সে বহুবার শুনেছে, কিন্তু আগে কখনও খেয়াল করেনি। চমৎকার সুর, সুরটা সে গুনগুন করছে এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। গৌতম ফোন করছে।

‘একটা মিটিং চলছে। তোকে ঘন্টাখানেক বাদে ফোন করছি।’ গৌতম ফিসফিস করে বলল।

‘নো প্রবলেম। তাড়া নেই। সময় পেলে একটা ফোন করিস।’ ফোনটা নামিয়ে রাখল আদিত্য।

গৌতম ফোন করল প্রায় দুঘন্টা বাদে, ঘড়িতে তখন দেড়টা বেজে গেছে। ‘একটা ম্যারাথন মিটিং চলছে রে। এতক্ষণে লাঞ্চ-ব্রেক হল। আড়াইটেতে আবার শুরু হবে। ভাবলাম, খেতে যাবার আগে তোর সঙ্গে কথাটা সেরেনি। বল কী বলছিলি।’

‘খুব তাড়াতাড়ি বলছি যাতে তুই লাঞ্চটা মিস না করিস। তোর কি মনে আছে চন্দ্রা বলে একটি মেয়ে আমাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স পড়ত, নকশাল করত?’

‘ঠিক মনে পড়ছে না।’ গৌতম খানিকটা ভেবে বলল। ‘আসলে সায়েন্সের মেয়েদের আমি ততটা চিনতাম না।’

‘চন্দ্রা পুরুলিয়ার গ্রামে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করত। গরিব মেয়েদের পড়াত। সেই কাজ ছেড়ে সে কিছুদিন আগে বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে একটা ইস্কুলে চলে গিয়েছিল। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার ওপর ভার পড়েছে তাকে খুঁজে বার করার। আমি জানতে চাই নকশাল হিসেবে পুলিশের খাতায় চন্দ্রার নাম আছে কিনা। এটা তোর সাহায্য ছাড়া জানা অসম্ভব। তুই কি লালবাজারে কাউকে বলে দিতে পারিস, যে আমাকে এই ব্যাপারে একটু হেল্প করতে পারে?’

গৌতম আবার খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘তুই আকাশ শ্রীবাস্তব বলে একজনের সঙ্গে কথা বল। আমি ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। ওকে ফোন করে বলেও দিচ্ছি। আকাশ বেশ কিছুদিন পুরুলিয়ার এস পি ছিল। সম্প্রতি লালবাজারে বদলি হয়ে এসেছে। পুরুলিয়া-ঝাড়খন্ড বর্ডারের মাওবাদীদের বিষয়ে ওর থেকে ভাল আর কেউ জানে না। আমি ওর নম্বরটা তোকে এস এম এস করে দিচ্ছি। তুই সন্ধে ছ’টার পর ওকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিস। আমি ওকে সেই রকমই বলে রাখব।’

‘তুই কি আর এর মধ্যে কলকাতায় আসছিস?’

‘নভেম্বরের শেষে আসার প্ল্যান আছে। আমার এক ভাইজির বিয়ে।’

‘তখন তো দেখা হবেই। কিন্ত তার আগেই তোকে ফোন করে চন্দ্রার উপাখ্যানটা ডিটেলে জানিয়ে দেব। মনে হয়, তোর ইন্টারেস্ট হবে। এখন রাখছি। টা টা।’

‘ওকে। টা টা।’

(৩)

আকাশ শ্রীবাস্তব সেই ধরনের আই পি এস অফিসার যাঁরা নিজেদের পদমর্যাদা নিয়ে সদা সচেতন। অর্থাৎ গৌতমের ঠিক উল্টো। উত্তরপ্রদেশের লোক, ওয়েস্ট বেঙ্গল কাডার বলে বাংলাটা কিছুটা বলতে পারে, তবে টান আছে। গৌতম বলে না দিলে আকাশ শ্রীবাস্তব আদিত্যর সঙ্গে কথা বলত বলে মনে হয় না। সেটা টেলিফোনে কথোপকথনের সময় রাখঢাক না করে আদিত্যকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল সে। বলল, প্রাইভেট জাসুসদের সঙ্গে সে কথা বলে না। কিন্তু গৌতম দাশগুপ্ত তার থেকে বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র অফিসার, পদমর্যাদাতেও চার ধাপ উঁচুতে। তিনি অনুরোধ করেছেন বলে সে আদিত্যকে সময় দিচ্ছে। বড়জোর মিনিট দশেক সময় দিতে সে রাজি আছে, তার বেশি নয়। দুপুর সাড়ে তিনটেতে লালবাজার আসতে হবে। গেটে আদিত্যর নাম বলা থাকবে। দেরি যেন একদম না হয়।

শ্রীবাস্তবের কথা বলার ভঙ্গীতে আদিত্য রীতিমত অপমানিত বোধ করছিল। একটা পরীক্ষা পাশ করে আই পি এস হয়ে এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। কিন্তু ভিখিরিদের তো আর অত বাছবিচার করলে চলে না। তাকে এখানে ভিখিরিই বলতে হবে, তথ্যের ভিখিরি। সাড়ে তিনটের মিনিট দশেক আগেই লালবাজারে পৌঁছে গেল আদিত্য। তারপর প্রায় দেড় ঘন্টা বসে থাকতে হল। বোঝা গেল, সময় রক্ষার দায়টা তার একার, যেহেতু দরকারটাও তারই। শ্রীবাস্তব নিজের ইচ্ছে মতো দেরি করতেই পারে। অপেক্ষা করতে করতে যখন আদিত্য ভাবতে শুরু করেছে আজ আর শ্রীবাস্তবের দেখা পাওয়া যাবে না, তখন এক প্লেন ড্রেসের পুলিশ এসে তার নাম ধরে ডাকল।

আকাশ শ্রীবাস্তবের চেহারাটা লম্বা চওড়া, তার ওপর নাকের নিচে এক জোড়া জাঁদরেল মিলিটারি গোঁফ। গলার বাজখাঁই আওয়াজটাও চেহারার সঙ্গে মানানসই। আদিত্য ঘরে ঢুকে দেখল শ্রীবাস্তব ফাইল ক্যাবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্যকে একবারও বসতে বলল না, এতক্ষণ যে আদিত্যকে অপেক্ষা করিয়েছে তার জন্যেও ক্ষমা চাইল না। শুধু কেজো গলায় বলল, ‘উই হ্যাভ সাম ইনফরমেশন অন দি মাওইস্ট গার্ল ইউ ওয়ান্টেড টু নো অ্যাবাউট। হিয়ার ইজ দ্য ফাইল। বাট আই ডোন্ট হ্যাভ দ্য টাইম টু টক টু ইউ নাউ। আমার একজন অফিসার আপনার সোঙ্গে কোথা বোলে লিবেন।’

বলতে বলতে উর্দি পরা ছিপছিপে চেহারার একজন পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকলেন। এরও গোঁফ আছে, তবে শ্রীবাস্তবের মতো অত প্রবল নয়। বয়েস, আদিত্য আন্দাজ করল, বছর তিরিশ।

‘ইনি ইন্সপেক্টার সমাদ্দার হচ্ছেন’ শ্রীবাস্তব বলল, ‘হি উইল টেল ইউ এভরিথিং।’ তারপর সমাদ্দারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দিস ইজ আদিত্য মজুমদার, দ্য পার্সন হু ওয়ান্টস টু নো অ্যাবাউট দ্য মাওইস্ট গার্ল। হি ইজ দাশগুপ্তা সাহাব’স খাস দোস্ত। সো প্লিজ হেল্প হিম অ্যাজ মাচ অ্যাজ ইউ ক্যান। আউর ইয়ে ফাইল আপ সাথ মে লে কে যাইয়ে। দিস ইজ চন্দ্রা সেন’স ফাইল।’

আদিত্যর মনে হল এর থেকে বেশি ভদ্র ব্যবহার আকাশ শ্রীবাস্তবের পক্ষে করা সম্ভব নয়। ‘আসুন স্যার।’ ফাইল নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে সমাদ্দার বলল।

সমাদ্দারের বসার জায়গাটা ইংরেজি করে বললে কিউবিকল, কিন্তু আসলে একটা খুপরি। খুপরির মধ্যে একটা টেবিল, তার ওপর অগোছালোভাবে কিছু ফাইল, কিছু ফাইল মেঝেতেও নামানো রয়েছে। সমাদ্দার তার হাতের ফাইলটা টেবিলে নামিয়ে রাখল। টেবিলের একদিকে একটা চেয়ার রয়েছে সমাদ্দারের বসার জন্য, উল্টোদিকে একটাও চেয়ার নেই। ভিজিটারদের জন্য অন্তত একখানা চেয়ার থাকা উচিত ছিল।

‘কে যে চেয়ারগুলো নিয়ে চলে যায়!’ সমাদ্দার বিরক্ত গলায় বলল। তারপর পাশের কিউবিকল থেকে একটা চেয়ার টানতে টানতে নিয়ে এসে আদিত্যর সামনে রেখে বলল, ‘বসুন স্যার।’

আদিত্য সমাদ্দারের দিকে তাকিয়েছিল। সমাদ্দারকে বেশ চেনা চেনা লাগছিল তার। সে বলল, ‘আপনি কি গৌতম দাশগুপ্তর টিমে ছিলেন?’

‘অবশ্যই ছিলাম স্যার। আপনি কি আমাকে মনে করতে পারছেন? আপনাকে কিন্তু আমি খুব ভাল করে চিনি স্যার। অবশ্য আপনাকে লালবাজারে এখন অনেকেই চেনে। অনেকেই জানে আপনিই চৌধুরি বাড়ির কেসটা সলভ করেছিলেন। তার আগে সেই ভূতুড়ে টেলিফোনের ব্যাপারটাও। আসলে, শ্রীবাস্তব সাহেব লালবাজারে নতুন তো, তাই আপনার কথা জানেন না। ভেবে খারাপ লাগছে, আপনাকে আজ অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল। আমি ওঁর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি স্যার।’

আদিত্য স্বস্তি পাচ্ছিল। বিদেশ-বিভুঁইএ চেনা লোক দেখলে মানুষ যেমন স্বস্তি পায়। কিম্বা তার থেকেও বেশি। তার ভাবতে ভাল লাগছিল তাকে লালবাজারে অনেকে চেনে। কথাটা সত্যি কিনা কে জানে? হয়ত সত্যি নয়, আবার সত্যি হতেও তো পারে! আদিত্যর মধ্যে একটা ছেলেমানুষ আছে যে প্রশংসা শুনলে এখনও খুব খুশি হয়। বিশেষ করে আকাশ শ্রীবাস্তবের নাক-উঁচু ব্যবহারের পর প্রশংসাটা শুনতে বেশ ভাল লাগছে। অপেক্ষা করতে করতে সে বেশ দমে গিয়েছিল, প্রশংসাটা খানিকটা টনিকের কাজ করল। সে মুখে অবশ্য বলল, ‘আমাদের মতো বেসরকারি গোয়েন্দাদের অত মান-অপমানের কথা ভাবলে চলে না। দরকার পড়লে তো বসে থাকতেই হবে।’ তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘যে কাজটার জন্য এসেছি সেটা বলি।’

‘জানি স্যার। আপনি চন্দ্রা বলে একটি মহিলার খোঁজ করছেন। এক সময় মাওবাদীদের সঙ্গে মহিলার যোগাযোগ ছিল। গত কয়েক বছর ধরে তিনি পুরুলিয়ায় একটা স্কুলে পড়াচ্ছিলেন। কিছুদিন আগে সেই চাকরিটা ছেড়ে তিনি বসিরহাটের কাছে আর একটা স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে যান। মাস খানেক হল তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি আমাদের কাছে ঠিক কী জানতে চান?’

‘প্রথমত জানতে চাই, মাওবাদী হিসেবে পুলিশের খাতায় চন্দ্রার নাম আছে কিনা। থাকলে, পুলিশের ধারণা অনুযায়ী, সে মাওবাদীদের সঙ্গে কতটা ইনভলভড ছিল।’

‘আর কী জানতে চান?’

‘দ্বিতীয়ত জানতে চাই, চন্দ্রা নিখোঁজ হয়ে যাবার পরে পুলিশ যে তদন্ত করেছিল বা এখনও হয়ত করছে, সেটা থেকে কী জানা গেছে?’

‘আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা যতটা ভাল দিতে পারব, দ্বিতীয়টা ততটা পারব না। আমি প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে শুরু করছি। তার আগে বলি, দাশগুপ্ত সাহেব দিল্লি চলে যাবার পর কিছুদিন আমি পুরুলিয়ায় ছিলাম। এটা ঠিক রেগুলার বদলি নয়, কলকাতা পুলিশ থেকে জেলায় সাধারণত বদলি হয় না, আমি ছিলাম একটা স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের অংশ যাদের কাজ ছিল পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ড বর্ডারে মাওবাদীদের বশে আনা। আমরা ঝাড়খণ্ড পুলিশ এবং সেন্ট্রাল ফোর্সের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছিলাম। ওই সময় আমি ওই অঞ্চলের মাওবাদীদের সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা করতে পেরেছিলাম।’

‘কিন্তু আপনি যখন পুরুলিয়া গেলেন তখন চন্দ্রা তো পুরুলিয়াতেই ছিল।’

‘হ্যাঁ, তখনও ছিল। কিছুদিন পরে চলে গেল। কিন্তু দলটা তখনও রয়ে গিয়েছিল। তাদের সম্বন্ধে ভাল করে না জানলে চন্দ্রার পুরো গল্পটা জানা যাবে না।’

‘আপনি প্রথম থেকে বলুন।’

‘তাই বলছি। তার আগে একটু চা বলি।’

মিনিট পাঁচেক পরে চায়ে একটা চুমুক দিয়ে সমাদ্দার চন্দ্রার ফাইলটা খানিকক্ষণ পড়ে দেখল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘পুলিশ ফাইলে একটা মাওবাদী দলের কথা আছে যারা পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ডের বর্ডারে অপরেট করত। বেশ পুরোনো দল। নব্বই দশকের সেকেন্ড হাফ থেকে এদের নানারকম সাবভারসিভ অ্যাক্টিভিটির কথা পুলিশ রেকর্ডে রয়েছে। অ্যাক্টিভিটি বলতে, মূলত গ্রামের অবস্থাপন্নদের থেকে এক্সটরশান, ডাকাতি, দরকার হলে দু-একটা খুন, এছাড়া জঙ্গলের মধ্যে কিংবা হাইওয়েতে, যেখান দিয়ে পুলিশের গাড়ি যাবার কথা সেখানে, মাইন পেতে রাখা। দলটা অসম্ভব ধূর্ত। পুরুলিয়ায় অপকর্ম করে ঝাড়খণ্ডে পালায় আবার ঝাড়খণ্ডে গণ্ডগোল পাকিয়ে পুরুলিয়া ফিরে আসে। তখনও অবশ্য বিহার-ঝাড়খণ্ড ভাগাভাগি হয়নি, পরে হল। এই রাজ্যের পুলিশ আর তখনকার বিহার পুলিশ একত্র হয়েও দলটাকে ধরতে পারছিল না।’

কথা বলতে গিয়ে সমাদ্দারের চা-টা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সেটাকে এক চুমুকে গিলে নিয়ে সমাদ্দার একটা মুখবিকৃতি করল। ‘এই চা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে একদম খাওয়া যায় না স্যার।’ সমাদ্দার তার মুখবিকৃতির কারণ দর্শাল, যদিও তার কোনও দরকার ছিল না। আদিত্য আগেই তার চা-টা খেয়ে নিয়েছে। সে তার নোট বইটা বার করে মনোযোগী ছাত্রের মতো নোট নিচ্ছিল।

সমাদ্দার আবার বলতে শুরু করল, ‘দলটাকে ধরতে না পারার প্রধান কারণ, গ্রামের গরিব মানুষ দলের লোকদের খুব প্রোটেকশন দিত। দরকার পড়লে মাওবাদীরা গ্রামের মানুষদের সঙ্গে এমন করে মিশে যেত যে পুলিশ তাদের আলাদা করতে পারত না। এইভাবে বহু পুলিশ রেড ফেল করেছে। উল্টোদিকে মাওবাদীরা গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াত, ছোটখাট অসুখ-বিসুখে তাদের ওষুধ দিত, বড় কিছু হলে তাদের সঙ্গে নিয়ে সদর হাসপাতালে যেত, কখনো-সখনও টাকা-পয়সা দিয়েও সাহায্য করত। ওখানকার গ্রামের লোক খুব গরিব স্যার। মানুষ যে এতটা গরিব হতে পারে সেটা ওখানকার গ্রামের লোকদের নিজের চোখে না দেখলে আমার বিশ্বাসই হতো না। সেই গরিব মানুষরা একটু-আধটু সাহায্য পেলেই কেনা গোলাম হয়ে থাকে।’

সমাদ্দার থামল। এদিক ওদিক তাকাল। আদিত্য অনুমান করল সমাদ্দারের চা-পিপাসু মন আবার চায়ের সন্ধান করছে। যে ছেলেটি তাদের চা এনে দিয়েছিল তাকে যখন ধারে কাছে কোথাও দেখা গেল না তখন সমাদ্দার তার টেবিলের গায়ে লুকোনো একটা বোতাম টিপল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যিনি আবির্ভূত হলেন তিনি যে একজন বেয়ারা সেটা বোঝার জন্য খুব একটা কল্পনাশক্তি লাগে না। সমাদ্দার তাকে বলল, ‘জনার্দনকে দেখতে পেলে এখানে দুটো চা দিতে বোলো তো। আর বোলো, একটু আগে সে যে চা-টা দিয়েছিল সেটা একেবারে জুড়িয়ে গেছিল।’ ‘জুড়িয়ে গেছিল’ কথাটা আদিত্যর কানে লাগল। আজকাল বেশিরভাগ লোকই বোধহয় বলবে ‘ঠান্ডা হয়ে গেছিল’। ‘জুড়িয়ে গেছিল’ খুব একটা কেউ আর বলে না। আদিত্যর বাবা বলত।

সমাদ্দার আবার বলতে শুরু করেছে, ‘ক্রমশ পুলিশ জানতে পারল দলটির অপরেশানাল মাথা অভিজিৎ সিং বলে এক ব্যক্তি। অভিজিতের বাবা-মা অরিজিনালি বিহারের হলেও অভিজিৎ বড় হয়েছে পুরুলিয়ায়। তাই হিন্দির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাটাও মাতৃভাষার মতো বলে। ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজিও বলতে পারে। একটা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ার। তাই এক্সপ্লোসিভের ব্যাপারটা খুব ভাল বোঝে। এই অভিজিৎ সিং-এর সঙ্গে চন্দ্রলেখা সেনের একটা সম্পর্ক ছিল। অবশ্য চন্দ্রা সেন কোনও সাবভারসিভ অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত আছে এমন কোনও এভিডেন্স পুলিশ কখনও পায়নি। সে স্থানীয় একটা ইস্কুলে গরিব মেয়েদের পড়াত, গ্রামে গ্রামে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বিলি করত, প্রয়োজনে গ্রামের গরিব মানুষদের অর্থসাহায্য করত আর কখনও কখনও অভিজিৎ সিং-এর দলের ছেলেমেয়েদের থিওরেটিকাল ক্লাশ নিত।’

সমাদ্দার আবার থামল কারণ জনার্দন আবার চা এনেছে। ‘ঠান্ডা নয় তো?’ সমাদ্দার তাকে শাসানোর ভঙ্গীতে বলল।

‘এবার আর ঠাণ্ডা হবে না। এইমাত্র করে এনেছি।’ চা টেবিলে রেখে জনার্দন ফাঁকা কাপদুটো নিয়ে চলে গেল।

সত্যিই চা এবার ঠাণ্ডা নয়। চুমুক দিয়ে সমাদ্দার একটা তৃপ্তির অতি প্রলম্বিত ‘আঃ’ ধ্বনি উচ্চারণ করল। তারপর বলল, ‘মাওবাদী এই দলটা একটা গোটা আর্মি ট্রাক উড়িয়ে দিয়েছিল। তিরিশ-চল্লিশজন জওয়ান মারা গিয়েছিল। এরপর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তৈরি হয়।’

‘তারপর?’

‘আমি সেই টাস্ক ফোর্সের পার্ট হিসেবে পুরুলিয়া গেলাম। কয়েকজন খুব ভাল ইনফর্মার পেয়ে গেলাম আমরা। তাদের দেওয়া খবরের ওপর ভিত্তি করে জঙ্গলে জঙ্গলে চিরুনি তল্লাসি চলল। দলটার সঙ্গে বেশ কয়েকটা এনকাউন্টার হল। অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে, বাঘমুন্ডির জঙ্গলে, সুবর্ণরেখার ধারে, কংসাবতীর ধারে, হাজারিবাগের জঙ্গলে। দুপক্ষেরই ক্যাসুয়্যালটি বাড়তে লাগল। দিল্লি, কলকাতা আর রাঁচি থেকে আমাদের রিএনফোর্সমেন্ট এল। আস্তে আস্তে দলটাকে আমরা কব্জা করে ফেললাম। তাদের কিছু মারা পড়ল, বেশ কিছু ধরা পড়ল আর কয়েকজন পালিয়ে গেল। অভিজিৎকে আমরা ধরতে পারলাম না। তবে আমাদের স্থির বিশ্বাস এনকাউন্টারের সময় সে দলের সঙ্গেই ছিল এবং সে এখনও বেঁচে আছে।’

‘এইসব সময়ে চন্দ্রা কি পুরুলিয়ায়?’

‘দাঁড়ান, এটা একটু ভেবে বলতে হবে। যখন এনকাউন্টারগুলো হচ্ছে মোটামুটি তখনই চন্দ্রা সেন পুরুলিয়া ছেড়ে চলে যায়। এটা খানিকটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি কারণ চন্দ্রার ওপর পুলিশের কন্সট্যান্ট নজর ছিল।’

‘চন্দ্রলেখা সেন যে ইস্কুলে পড়াত তার নাম ঠিকানা কি আপনাদের ফাইলে নোট করা আছে?’

‘আছে স্যার। ইস্কুলটার নাম নীপবীথি, গরিব মেয়েদের ইস্কুল। আদ্রা থেকে রঘুনাথপুর যেতে জয়চণ্ডী পাহাড় পড়ে, ইস্কুলটা তার খুব কাছে। ওখানে একটা রেল স্টেশনও আছে। আমরা এইটুকুই জানি যে একটা এন জি ও ওই ইস্কুলটা চালায়।’

‘এন জি ও-টার সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি?’

‘আপত্তিকর কিছু জানা যায়নি। তারা পশ্চিমবঙ্গে গরিব মেয়েদের জন্য এরকম আরও ইস্কুল চালায়।’

‘আচ্ছা, চন্দ্রার সঙ্গে অভিজিতের কোনও যোগাযোগ এসট্যাবলিস করা যায়নি?’

‘গিয়েছিল। অভিজিৎ নিয়মিত চন্দ্রার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। একটা সময় পুলিশের মনে হত দুজনের মধ্যে সম্ভবত একটা রোমান্টিক সম্পর্ক আছে। কিন্তু অভিজিতের বিরুদ্ধেও অনেক দিন অব্দি তেমন কোনও ইনক্রিমিনেটিং এভিডেন্স পুলিশ যোগাড় করে উঠতে পারেনি। যখন জোগাড় করতে পারল ততদিনে অভিজিৎ উধাও হয়ে গেছে। তারও আগে একদিন কোনও কারণে অভিজিতের সঙ্গে চন্দ্রার ঝগড়া হয়ে গেল। চন্দ্রা পুরুলিয়া ছেড়ে বসিরহাটে চলে গেল।’

‘চন্দ্রা বসিরহাট চলে যাবার পরেও কি পুলিশ তার ওপরে নজর রাখছিল?’

‘না স্যার। চন্দ্রা পুরুলিয়া ছেড়ে চলে যাবার পরে পুলিশের নজরদারি অনেক শিথিল হয়ে গিয়েছিল।’

সমাদ্দার ফাইলটা বন্ধ করল। আদিত্য বলল, ‘চন্দ্রার নিখোঁজ হয়ে যাবার ব্যাপারে পুলিশ কতটুকু জানতে পেরেছে?’

‘ও হ্যাঁ, এটাই তো আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল। চন্দ্রার হঠাৎ উধাও হয়ে যাবার ব্যাপারে পুলিশ এখন পর্যন্ত প্রায় কিছুই জানতে পারেনি। সত্যিটা হল, বেশ কিছুদিন লালবাজার জানতেই পারেনি যে চন্দ্রা সেনকে পাওয়া যাচ্ছে না। বসিরহাটে একটা এফ আই আর অবশ্য করা হয়েছিল এবং তার ওপর ভিত্তি করে বসিরহাট পুলিশ স্টেশনের একজন এস আই, লালবাজারকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, ব্যাপারটা অত্যন্ত ধীর গতিতে ইনভেস্টিগেট করছিলেন। তারপর কিছুদিন আগে, চন্দ্রা সেনের এক বান্ধবী ব্যাপারটা আমাদের নজরে আনেন। ব্যাপারটা জানার পর আমরা কেসটা এক্সপিডাইট করার জন্যে বসিরহাট পুলিশকে চাপ দেয়েছি। আমাদের এখান থেকে একটা টিম বসিরহাটে গিয়েছিল। হয়ত আবার যাবে। তবে একেবারে লেটেস্ট সিচুয়েশনটা বসিরহাটের লোকাল পুলিশই বলতে পারবে।’

‘চন্দ্রা সেনের বান্ধবীর নাম কী? যিনি খবরটা দিয়েছিলেন?’

‘দাঁড়ান, ফাইলটা দেখে নিয়ে বলছি।’ সমাদ্দার আবার ফাইলটা খুললেন, ‘বান্ধবীর নাম কেয়া বাগচি। পুলিশের ওপর মহলে ভদ্রমহিলার জানাশোনা ছিল। তাই তিনি লালবাজারে সরাসরি এন্ট্রি পেয়েছিলেন। আমার সঙ্গেই তাঁর কথা হয়েছিল।’

‘একটা শেষ প্রশ্ন। ঠিক প্রশ্ন নয়, অনুরোধ। কয়েক দিন বাদে আমি পুরুলিয়া যাব ভাবছি। ওখানে গেলে আপনাদের ইনফর্মারদের সঙ্গে কি একটু যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবেন?’

‘নিশ্চয় পারব স্যার। আপনি শুধু যাবার আগে আমাকে একটু জানাবেন।’

‘অনেক ধন্যবাদ।’ আদিত্য নোটখাতা বন্ধ করল।

‘ধন্যবাদ দেবেন না স্যার, আপনার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলাটাই আমার সৌভাগ্য। গৌতম দাশগুপ্ত শুধু আমার সুপিরিয়ারই ছিলেন না, নিজের হাতে আমাকে তৈরি করেছিলেন। আর আমি জানি, দাশগুপ্ত সাহেব আপনাকে কী চোখে দেখেন। ভাল থাকবেন। আর দরকার হলেই আমাকে ফোন করবেন। আমার ফোন নম্বরটা সেভ করে নেবেন? আমার পুরো নাম সঞ্জয় সমাদ্দার।’ সমাদ্দার পকেট থেকে মোবাইল বার করল।

লালবাজারে ঢোকার মুখে মোবাইল জমা রাখতে হয়। মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে রাখা ছিল। বেরোবার সময় আদিত্য মোবাইল ফেরত নিয়ে দেখল দুজন ফোন করেছিল। শেষ ফোনটা একটা অচেনা নম্বর থেকে এসেছে। এটা নিশ্চয় সমাদ্দারের নম্বর। তার আগে একই ফোন থেকে দুবার ফোন এসেছিল, ফোন করেছিল নূপুর মণ্ডল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *