চন্দ্রলেখা অন্তর্ধান রহস্য – ১০

দশম পরিচ্ছেদ

(১)

চন্দ্রা ফিরে এসেছে। সেই উপলক্ষে সে সবাইকে তার আলিপুরের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে। সে কোথায় চলে গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, কী করছিল এতদিন, কেনই বা ফিরে এল সেসব গল্প চন্দ্রা নিশ্চয় সবাইকে বলবে। অন্তত সকলে তাই আশা করছে। তবে গল্প যাই হোক, চন্দ্রা যে ফিরে এসেছে এতে সকলেই ভীষণ খুশি। চন্দ্রাকে সকলেই খুব ভালবাসে। এমন ফুলের মতো মিষ্টি মেয়েটা, যে কখনও কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি, সে হঠাৎ হারিয়ে যাবে কেন? ওপরওলার এ কেমন বিচার? চন্দ্রা হারিয়ে যেতে সকলেরই মন খারাপ হয়েছিল। এখন সে যে ফিরে এসেছে তাতে সবাই তো খুশি হবেই। অন্তত ওপর ওপর সকলকেই খুশি দেখাচ্ছে। অবশ্য ভেতরে ভেতরে কার কী কাছে কে জানে? সবাইকে এক সঙ্গে করার প্ল্যানটা অবশ্য আদিত্যর। কিন্তু সেটা একমাত্র চন্দ্রাকেই সে বলেছে।

নিমন্ত্রিতের সংখ্যা কম নয়। পার্থ সান্যাল। সে তার যাওয়া আরও কয়েকদিন পিছিয়ে দিয়েছে। পার্থর দিদি বিপাশা লাহিড়ি চন্দ্রার নেমন্তন্ন ফেলতে পারেননি, তিনিও এসেছেন। তবে কোচিং আছে বলে তার ছেলে আসতে পারেনি। চন্দ্রা চলে আসার পর থেকে পুলিশ পার্থর দিদির বাড়ির ওপর দিনরাত্তির নজর রেখেছে। পার্থ আর তার দিদি এখানেও এসেছেন কড়া পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে। গৌরবাবুর ঘটনাটা ঘটার পর থেকে পুলিশ আর কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না।

এছাড়া এসেছেন চন্দ্রার বনবীথি ইস্কুলের কলিগরা—বড়দিদি, ছোড়দিদি, সোনাদিদি আর গৌরবাবু। চন্দ্রার অভিন্নহৃদয় বান্ধবী কেয়া বাগচি। চন্দ্রার পুরোনো বন্ধু রত্নাবলী মিত্র এবং তার স্বামী অমিতাভ মিত্র। সেনদের পুরোনো সলিসিটার সামারভিল অ্যান্ড চৌধুরির বর্তমান কর্ণধার অভীক চৌধুরি। আর বলাই বাহুল্য আদিত্য নিজে। সে নূপুর মণ্ডলকেও সঙ্গে এনেছে। আর এনেছে তার বন্ধু গৌতম দাশগুপ্তকে যিনি এখন কলকাতার একজন অ্যাডিশানাল পুলিশ কমিশানার। তার সঙ্গে দুজন সশস্ত্র দেহরক্ষী আছে। এছাড়া আছেন বাড়ির অন্য বাসিন্দা চন্দ্রার সৎমা কমলিকা সেন, তাঁর বিশেষ বন্ধু মন্টু রায় এবং চন্দ্রার অনুরোধে প্রমোটার নভীন সরাফ, যিনি আলিপুরের এই বাড়িটা প্রোমোটিং করবেন বলে বাজারে গুজব। দেহরক্ষীদের বাদ দিলে সব মিলিয়ে পনের জন, চন্দ্রাকে ধরলে ষোলো। বাড়ির বাইরে দুটো পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। তাতে আরও অন্তত দশজন সশস্ত্র পুলিশ অপেক্ষা করছে। মুখে যতই খুশির ভাব দেখাক না কেন সকলেই ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত। আজ একটা কিছু ঘটবে।

নেমন্তন্নটা দুপুরের ছিল। নাহলে বনবীথি ইস্কুলের কেউ ফিরতে পারতেন না। একটু আগে সেই রাজকীয় মধ্যাহ্নভোজন শেষ হয়েছে। এখন অতিথিরা বড় হলঘরে জমায়েত হয়ে বিশ্রাম করছেন। সোনাদিদি একাধারে নার্ভাস ও পুলকিত। এত বড় বাড়ি আর এরকম ভোজ সে আগে কখনও দেখেনি। বড়দিদি-ছোড়দিদিও তাই, কিন্তু তাদের মনের ভাব মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। গৌরবাবু এখনও পুরো সুস্থ হননি, তাঁর মাথার পেছন দিকে এখনও একটা স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো। চন্দ্রা নেমন্তন্ন করাতে তিনি না এসে পারেননি, তবে খুব বেশি খেতে পারলেন না। তিনি একপাশে চুপ করে বসে আছেন। অন্যরা বেশিরভাগই যে যার বন্ধু বেছে নিয়েছে। কেয়া বাগচি চন্দ্রা আর পার্থর সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, পার্থর ব্যাপারে তার যেসব সন্দেহ ছিল সেগুলো আর নেই। গৌতম দাশগুপ্ত তার পুরোনো বন্ধু অমিতাভ আর রত্নার সঙ্গে গল্প করছে। সলিসিটর সাহেবও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। কমলিকা সেন মূলত কথা বলছেন মন্টু রায় এবং নভীন সরাফের সঙ্গে। বনবীথির দিদিরা নিজেদের মধ্যে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলছেন, স্বাভাবিকভাবে কথা বললে পাছে লোকে ভাবে তাঁরা আদব-কায়দা জানেন না। নূপুর মণ্ডল কারো সঙ্গেই কথা বলছে না, আনমনে নিজেরই আঙুল নিয়ে খেলছিল, একটু আগে বিপাশা লাহিড়ির সঙ্গে তার বেশ ভাব জমে গেছে। আদিত্য একটু দূর থেকে সকলকে লক্ষ করছিল।

মিনিট পাঁচেক পরে চন্দ্রা উঠে গিয়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। গলার আওয়াজটা একটু উঠিয়ে বলল, ‘আপনারা সকলে আজ আমার নিমন্ত্রণে এখানে এসেছেন সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি কিছুদিন নিরুদ্দেশ ছিলাম। আমি নিরুদ্দেশ ছিলাম বলে আপনারা অনেকেই আমার জন্য উৎকণ্ঠিত ছিলেন। আমার জন্য এই উৎকন্ঠা আপনাদের ভোগ করতে হয়েছে বলে আমি ক্ষমা চাইছি। একই সঙ্গে আমার মনে হয় কেন আমি কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম সে ব্যাপারে আপনাদের কাছে আমার একটা কৈফিয়ত দেবার আছে। আমার নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার গল্পটা আজ আপনাদের বলব। তবে আমি নিজে বলব না, আমার পুরোনো বন্ধু আদিত্য মজুমদার আপনাদের গল্পটা বলবে। আপনারা হয়ত কেউ কেউ জানেন আদিত্য একজন চমৎকার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার, সে এর আগে কয়েকটা জটিল কেস সমাধান করেছে। আমার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কেসটার সঙ্গেও আদিত্য যুক্ত ছিল। আদিত্য উইল টেক ওভার ফ্রম হিয়ার।’

আদিত্য উঠে গিয়ে ঘরের মাঝখানে চন্দ্রার পাশে দাঁড়াল। তারপর নিচু গলায় চন্দ্রাকে বলল, ‘একটা চেয়ার এনে দিতে বলবি? মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ কথা বলতে হবে।’

চেয়ার আসার পর আদিত্য কিছুক্ষণ চেয়ারে চুপ করে বসে রইল। যেন কী বলবে মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে। তারপর একসময় ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, ‘পার্থ সান্যাল যখন আমাকে চন্দ্রলেখা অন্তর্ধান রহস্য সমাধান করার জন্য নিয়োগ করল তখন আমি ভেবে দেখলাম এখানে মূল প্রশ্ন দুটো। এক, কেন চন্দ্রার অন্তর্ধান ঘটল? দুই, চন্দ্রা এখন কোথায়? আমার মনে হলো দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর খোঁজা অপেক্ষাকৃত সহজ। তাই প্রথমে দ্বিতীয় প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। দুটো সম্ভাবনা ছিল। প্রথম সম্ভাবনা, চন্দ্রা আর বেঁচে নেই। তাকে কেউ খুন করে ফেলেছে। আত্মহত্যার সম্ভাবনাটা মনে হল বাদ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কেউ যদি চন্দ্রাকে খুন করত তা হলে এতদিনে নিশ্চয় তার লাশটা খুঁজে পাওয়া যেত। খুনি খুন করে লাশটা লুকিয়ে রেখেছে যাতে কেউ খুঁজে না পায় এমন মনে করার কোনও সঙ্গত কারণ দেখতে পেলাম না। খুন করার পর লাশটা লুকিয়ে রেখে খুনির লাভ কী? অতএব ধরে নিলাম চন্দ্রা বেঁচে আছে।’

আদিত্য একটু থামল। সকলেই চুপ করে আছে। এর পর আদিত্য কী বলবে শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আদিত্য আবার বলতে শুরু করল, ‘দ্বিতীয় সম্ভাবনা, মনে হল, চন্দ্রা নিজেই কোথাও লুকিয়ে আছে অথবা কেউ তাকে লুকিয়ে রেখেছে। যতই ভাবতে লাগলাম ততই মনে হতে লাগল এটাই ঘটেছে। আপাতদৃষ্টিতে, চন্দ্রাকে কেউ মারতে চেয়েছিল, নেহাত ভাগ্যের জোরে সে দু-দুবার বেঁচে গেছে। তাই চন্দ্রার লুকিয়ে থাকাটা স্বাভাবিক। মনে হল, সে নিজের প্রাণের ভয়েই লুকিয়ে আছে। কিন্তু কোথায় লুকিয়ে আছে? তার পক্ষে নিজে নিজে লুকিয়ে থাকাটা সহজ নয়। কেউ সাহায্য করলে তার লুকিয়ে থাকার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। কে তাকে সাহায্য করতে পারে? বস্তুত, তার বন্ধু বলতে দুজন—কেয়া বাগচি এবং পুরোনো প্রেমিক পার্থ সান্যাল যাকে সে খুব শিগগির বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু কেয়া বাগচি তাকে কোথায় লুকিয়ে রাখবে? তার হস্টেলে সকলেই চন্দ্রাকে চেনে। অতএব সেখানে চন্দ্রাকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। আর দেশের বাড়ির সঙ্গে কেয়ার বহুদিন যোগাযোগ নেই। তাই সেখানেও চন্দ্রাকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাহলে বাকি রইল পার্থ সান্যাল। তার দিদির বাড়ি পায়রাডাঙা। চন্দ্রাকে লুকিয়ে রাখার এমন আদর্শ জায়গা আর কী হতে পারে? আমার সন্দেহটা সত্যি প্রমাণিত হল যখন কেয়া বাগচি আমাকে জানালেন চন্দ্রার কাছ থেকে তিনি একটা এস এম এস পেয়েছেন। তাতে চন্দ্রা লিখেছে সে ভাল আছে, তাকে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। কেয়া ভীষণ চিন্তা করবে এই ভেবে চন্দ্রা মেসেজটা পাঠিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এস এম এস-টা রানাঘাটের দিক থেকে এসেছিল। ফোনের মালিক জনৈক রাজা মল্লিক। পরে জানতে পেরেছিলাম সে পায়রাডাঙায় রিক্সা চালায়। সব মিলিয়ে মনে হল মেসেজটা এসেছিল পার্থর দিদির বাড়ি থেকে।’

‘তাহলে পার্থ তোকে হায়ার করল কেন? পার্থ তো জানত চন্দ্রা কোথায় আছে।’ রত্না সরলভাবে জিজ্ঞেস করল।

‘খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। এর উত্তরটা আমি দিচ্ছি। পার্থ আমাকে হায়ার করেছিল সবাইকে এটাই বোঝানোর জন্যে যে সে জানে না চন্দ্রা কোথায় আছে। তাই সে একজন ডিটেকটিভ নিয়োগ করছে। অর্থাৎ চন্দ্রাকে যে সে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রাখেনি, অন্যদের মতো সেও চন্দ্রাকে খুঁজছে, এটাই বোঝানো উদ্দেশ্য ছিল পার্থর। যাতে খুনি পার্থর বাড়িতে হানা দিতে না পারে। লক্ষ করা যেতে পারে, পার্থ যে আমাকে হায়ার করেছে এটা সে সবাইকে বলে বেড়িয়েছিল। আমার পরিচয় সবার কাছে ফাঁস করে দেবার একটাই কারণ যাতে খুনির ধারণা হয় পার্থ সত্যি সত্যি জানে না চন্দ্রা কোথায় আছে। অর্থাৎ চন্দ্রা পার্থর দিদির বাড়িতে নেই। সব মিলিয়ে আমি এই ভেবে নিশ্চিন্ত বোধ করলাম যে চন্দ্রা পার্থর দিদির বাড়িতে দিদির কাছে নিরাপদেই আছে। আমি প্রথম প্রশ্নটার উত্তর খোঁজায় মন দিলাম—কেন চন্দ্রাকে লুকিয়ে পড়তে হল? কেন কেউ তাকে খুন করতে চাইছে?’

‘এক্সেলেন্ট ডিটেকশন। এক্সেলেন্ট রিজিনিং। এক্সেলেন্ট এক্সপ্লানেশন। তুই খুব ভাল মাস্টার হতে পারতিস।’ পার্থ মুগ্ধ গলায় বলল।

 ‘আদিত্য মাস্টারি করলে এইসব জটিল কেস কে সলভ করবে?’ গৌতম ফুট কাটল।

আদিত্য একটু মুচকি হেসে আবার শুরু করল, ‘আমার মনে হল, দুটো আলাদা আলাদা কারণে কেউ চন্দ্রাকে খুন করতে চাইতে পারে। প্রথমত, চন্দ্রা এক সময় নকশালদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। পরে তার মোহমুক্তি ঘটে। সে নকশালদের সংস্রব ত্যাগ করে পুরুলিয়া ছেড়ে বসিরহাটে চলে যায়। পার্থকে সে তাই বলেছিল। এমন হতেই পারে, নকশালদের কিছু গোপন তথ্য চন্দ্রা জানত। তাই তারা চন্দ্রাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায়। দ্বিতীয় কারণ, সম্পত্তি। আলিপুরের এই বাড়িটা বিক্রি করার ব্যাপারে চন্দ্রার ঘোর আপত্তি ছিল। হাজার চাপ সত্ত্বেও নিজের অংশটা সে কিছুতেই প্রোমোটারের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়নি। ফলে কমলিকা সেনের অংশটারও বাজার দর অনেকটা পড়ে গিয়েছিল। প্রোমোটার সরাফ সাহেবও বেশ খানিকটা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম, চন্দ্রা মারা গেলে পুরো বাড়িটাই কমলিকা সেনের হয়ে যায়। সেরকম কিছু ঘটলে শুধু কমলিকা সেন নন, নভীন সরাফেরও বিলক্ষণ লাভ।’

‘আপনি কী বলতে চান? প্রপার্টিটা পাবার জন্য আমরা চন্দ্রা সেনকে খুন করার চেষ্টা করেছি? আপনার কোনও প্রমাণ আছে? আমি আপনাকে সু করব। তাছাড়া সেদিন ফলস আইডেন্টিটিতে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ইউ আর এ ফ্রড। জানেন আপনাকে আমি পুলিশে দিতে পারি?’ নভীন সরাফ উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

‘কাম ডাউন মিস্টার সরাফ। হি ইজ জাস্ট সাজেস্টিং এ থিওরেটিকাল পসিবিলিটি। আই অ্যাম রেপ্রেসেন্টিং দ্য পোলিস ইন দিস রুম। আই অ্যাশিয়োর ইউ নো ল হ্যাজ বিন ব্রোকেন বাই হিম অ্যাজ ইয়েট। প্লিজ টেক ইয়োর সীট অ্যান্ড লেট হিম কনটিনিউ।’ গৌতম দাশগুপ্ত ঠাণ্ডা পুলিশি গলায় বলল।

অনিচ্ছাসত্ত্বে নভীন সরাফ আবার চেয়ারে বসলেন। আদিত্য লক্ষ করল কমলিকা সেন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছেন, খানিকটা ভূতে পাওয়া মানুষের মতো। কিন্তু তার বন্ধু মন্টু রায় যেন স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। চেয়ারে বসে ছটফট করছেন।

আদিত্য আবার বলতে শুরু করল, ‘সম্পত্তির ব্যাপারটা আরও ঘোরালো হয়ে উঠল যখন জানতে পারলাম মৃত্যুর কিছুদিন আগে কুমুদকিশোর সেন একটা নতুন উইল করেছিলেন যে উইলে তিনি এই আলিপুরের বাড়ি ও জমির পুরোটাই তাঁর একমাত্র মেয়ে চন্দ্রলেখা সেনকে দিয়ে যান। আর হাজারিবাগের বাড়ি ও জমির পুরোটাই দিয়ে যান তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী কমলিকা সেনকে। তবে কমলিকা সেন যতদিন চাইবেন ততদিন এই আলিপুরের বাড়িতে থাকতে পারবেন। এখান থেকে কেউ তাঁকে তাড়াতে পারবে না। তিনজন সাক্ষী এই দলিলে সই করেছিল ড্রাইভার মদন মান্না, আর্দালি রামসেবক পাসোয়ান, আর ক্লার্ক নিমাই সরকার। তিনজনেই কুমুদকিশোরের চাকরি করত। এদের মধ্যে প্রথম দুজনের সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করতে পেরেছে। পুলিশের জেরায় দুজনেই স্বীকার করেছে তারা ওই উইলে সই করেছিল। তারা এটাও স্বীকার করেছে যে তাদের মোটা টাকা দেওয়া হয়েছিল এই শর্তে যে কোর্টে যদি কখনও উইলটা চ্যালেঞ্জ করা হয় তাহলে তারা বলবে তারা সম্পূর্ণ না বুঝে উইলটা সই করেছিল। এখন তারা বলছে কোর্টে বিষয়টা উঠলে কবুল করবে সই নেবার আগে কুমুদকিশোর ভাল করে তাদের উইলের বক্তব্যটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। উইল গ্রাহ্য হবার জন্য দুটি সাক্ষীই যথেষ্ট। তাও পুলিশ তৃতীয় সাক্ষীটিকে খুঁজছে। অধিকে দোষ নেই। শুধু একটাই সমস্যা এবং সমস্যাটা বেশ গভীর।’

আদিত্য দম নেবার জন্য একটু থামল। টেবিলের ওপরে রাখা জলের জাগ থেকে এক গেলাস জল ঢেলে পুরোটাই খেয়ে নিল। ঘরে অখণ্ড নীরবতা। আরো খানিকটা জল গেলাসে ঢেলে ছোট একটা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করল আদিত্য। ‘সমস্যাটার কথায় পরে আসছি। তার আগে জানা দরকার, কে সাক্ষীদের ঘুষ দিয়েছিল? নভীন সরাফ ছাড়া আর কে হতে পারে?’

একথা শুনেই নভীন সরাফ আবার দাঁড়িয়ে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। তাকে থামিয়ে দিয়ে গৌতম বলল, ‘সরাফ সাহেব। এটা আপনার প্রথম কুকীর্তি তো নয়। তাই অনেকদিন থেকেই আপনার ওপর পুলিশের নজর আছে। আপনার সাকরেদ, যে আপনার হয়ে বাজে কাজগুলো করত, সে পুলিশের ফাঁদে পা দিয়েছে। আপাতত সে পুলিশ হেফাজতে। সে আপনার হয়ে তিন সাক্ষীকে ঘুষ দেবার কথা স্বীকার করেছে।’

 আদিত্য বলল, ‘নভীন সরাফ তার পার্টনার মন্টু রায়ের মাধ্যমে কমলিকা সেনের অংশটা জলের দরে কিনে নিচ্ছিলেন। কমলিকা সেনকে তার বন্ধু মন্টু রায় বুঝিয়েছিলেন প্রপার্টিটার জন্যে বিরাট দাম পাওয়া যাচ্ছে। কমলিকাও তার বন্ধুকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে এই ভেবে তৃপ্তিলাভ করছিলেন যে মন্টু রায় তাকে বিরাট জিতিয়ে দিচ্ছেন। কমলিকা, বলাই বাহুল্য, রিয়াল এস্টেট বাজারের কিছুই জানতেন না। বাজার সম্বন্ধে যদি তার বিন্দুমাত্র ধারণা থাকত তাহলে তিনি বুঝতে পারতেন নভীন-মন্টু জুটি তাঁকে কী সাংঘাতিক ঠকাচ্ছেন। জমিটা জলের দরে পাওয়া যাবে, মন্টুবাবুর কাছ থেকে এই আশ্বাস পেয়ে নভীন সরাফ পোটেনশিয়াল বায়ারদের থেকে ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য আগাম টাকা নিয়ে ফেললেন। কিন্তু টাকা নেবার পরে হঠাৎ একদিন তারা জানতে পারেন পুরো প্রপার্টিটাই আসলে চন্দ্রলেখা সেনের। আগাম নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়া অসম্ভব কারণ সেটা ইতিমধ্যেই সরাফ সাহেবের বালিগঞ্জের প্রজেক্টে ঢালা হয়ে গেছে। আবার টাকা ফেরত না দিতে পারলে সরাফ সাহেবের ব্যবসার ভবিষৎ অন্ধকার কারণ যাদের কাছ থেকে উনি টাকা নিয়েছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই সমাজের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তাই মন্টু রায় ও নভীন সরাফ সাক্ষীদের ঘুষ দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। কে কে সেনের নতুন উইলটা চুরি করার উদ্দেশ্যে দফায় দফায় কয়েকজন মহিলাকে কেয়া বাগচির বাড়িতে পাঠালেন। তাছাড়া এটা তো ঠিক যে পুরো বাড়িটাই আসলে চন্দ্রার এবং চন্দ্রা এই বাড়ি মোটেই বিক্রি করতে চায় না এটা জানার পরেও নভীন সরাফ আমার কাল্পনিক বসকে ফ্ল্যাট বেচতে রাজি হয়েছিলেন। ওর লোভের সত্যিই শেষ নেই।’

 ‘আমি আবার এসবের মধ্যে কীভাবে এলাম?’ মন্টু রায় যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘আপনারা কিন্তু এবার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকব না।’ মন্টু রায় সোফা থেকে উঠে প্রস্থানের ভঙ্গী করলেন।

‘আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান। পুরো গল্পটা না শুনে যাবেন কোথায়? তাছাড়া আপনারা যে চন্দ্রাকে খুনের চেষ্টা করেননি সেটাও তো এখনও প্রমাণ হয়নি।’ এবার আদিত্যর গলা।

মন্টু রায় বসে পড়লেন। আদিত্য বলল, ‘একটা জিনিস কিন্তু এক্ষুনি প্রমাণ করা যাবে। ম্যাকনীল-ম্যাকফারসন কম্পানিতে জিজ্ঞেস করলেই ওরা বলে দেবে আপনি ওখানে আর নেই। পাঁচ বছর আগে টাকা-পয়সা গণ্ডগোল করার অভিযোগে আপনাকে ওখান থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তাছাড়া বছর দুয়েক আগে নিনা আগরওয়াল নামে এক মাঝবয়সী ধনী মহিলা আপনার নামে প্রতারণা এবং টাকা চুরির চার্জ আনেন। আপনাকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছিল। সেই মামলা এখনও চলছে। আপাতত আপনি বেল-এ আছেন।’

বলতে বলতে আদিত্য কমলিকা সেনের দিকে তাকাল। তার মনে হল ভদ্রমহিলা ভেতরে ভেতরে অবর্ণনীয় কষ্ট পাচ্ছেন। সে কমলিকা সেনকে বলল, ‘ম্যাডাম আপনি আমাকে ভাল করে বাজিয়ে দেখার জন্যে ডিনারে নেমন্তন্ন করলেন। আমি যাতে ডিনারে থেকে যেতে রাজি হই তার জন্য আপনার কাকাকেও জীবনে প্রথম বার নেমন্তন্ন করলেন। আপনি জানতেন তারাপদ গাঙ্গুলির সঙ্গে কথা বলার লোভ আমি সামলাতে পারব না। আমার অনুমান, পুরো কাজটাই আপনি করেছিলে মন্টু রায়ের কথায়। মন্টু রায় জানতে চেয়েছিল চন্দ্রাকে খুঁজে বার করার ব্যাপারে আমি কতদূর এগিয়েছি। আপনি মন্টু রায়কে বিশ্বাস করে ঠকে গেছেন। আপনার একটাই সান্ত্বনা যে এই ব্যাপারে আপনি একা নন।’

বেয়ারা সরবত নিয়ে এসেছে। পাতিলেবুর সঙ্গে বিটনুন ও অন্যান্য মশলা দিয়ে বানানো সরবত। গুরুভোজনের পরে হজমে সাহায্য করে, স্বাদেও চমৎকার। সরবতের গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘এবার সমস্যাটার কথায় আসি। কুমুদকিশোরের শেষ উইলের দুজন সাক্ষীকে আমরা পেয়েছি বটে, কিন্তু উইলটা এখনও পাইনি। উইলটা পাওয়া না গেলে কিন্তু আগের উইলটাই বহাল থাকবে। কুমুদকিশোরের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হবে না।’

অভীক চৌধুরি বলে উঠলেন, ‘চন্দ্রলেখা সেন আমার কাছে একটা খাম গচ্ছিত রেখে বলেছিলেন তিনি না বললে যেন আমি খামটা না খুলি। খামের ভেতরে কী আছে আমি জানি না। আজ সকালে মিস সেন আমাকে খামটা সঙ্গে আনতে বলেছিলেন। আমি সেটা এনেছি। এখন উনি যদি বলেন, আমি খামটা খুলতে পারি।’

খামের ভেতর থেকে কে কে সেনের শেষ উইলটা বেরিয়ে পড়ল। মিনিট দশেক পরে, যখন চন্দ্রার সম্মতি অনুযায়ী নতুন উইলটা সবার সামনে অভীক চৌধুরির পড়া হয়ে গেছে, তখন নভীন সরাফ হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এই উইল আমরা মানি না। আমরা এই উইলের বিরুদ্ধে কোর্টে যাব।’

‘কে কোর্টে যাবে? আপনি একা? আমি এই উইলকে মেনে নিচ্ছি।’ কমলিকা সেন শান্ত গলায় কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন, ‘আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। আমাকে দয়া করে মার্জনা করবেন আমি আর এখানে থাকতে পারছি না।’

গৌতমের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আদিত্য কমলিকা সেনকে যেতে দিতে বলল। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর আদিত্য আবার শুরু করল, ‘একটা জিনিস কিন্তু আমার কাছে পরিষ্কার। নভীন শরাফ এবং মন্টু রায় চন্দ্রাকে খুন করতে চায়নি। সাধারণ বুদ্ধি বলে, একজন অপরাধী আগে দেখবে চুরি করে তার কার্যসিদ্ধি হচ্ছে কিনা। যদি তা না হয় তাহলেই সে খুন করার কথা ভাববে। কিন্তু এক্ষেত্রে চুরির চেষ্টার অনেক আগে খুনের চেষ্টা হয়েছিল। তাই মনে হয় খুনের চেষ্টার পেছনে সম্পূর্ণ অন্য কোনও কারণ ছিল। তাছাড়া নভীন শরাফ এবং মন্টু রায়কে চন্দ্রার খুনি হিসেবে ধরে নিলে বনবীথি অঞ্চলের অন্য খুনগুলো ব্যাখ্যা করা যায় না। অতৃপ্ত আত্মারা এসে মানুষের ঘাড় মটকে গেছে এই তত্ত্ব মেনে নেওয়া মুস্কিল। আর সব থেকে বড় কথা, চন্দ্রাকে কেউ খুন করার চেষ্টাই করেনি। শুধু ভয় দেখিয়ে বনবীথি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল। এই একই কারণে মাওবাদীরাও চন্দ্রাকে খুন করতে চাওয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে।’

কথাগুলো বলে আদিত্য গৌরবাবুর দিকে তাকাল। কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা গেল না তিনি কী ভাবছেন। একটু থেমে আদিত্য বলল, ‘সরাফ সাহেব, রায় সাহেব, আপনারা চাইলে এখন চলে যেতে পারেন। আপনাদের ব্যাপারে পুলিশ যদি কোনও স্টেপ নেয় পরে জানতে পারবেন। আমার মনে হয় না আপনাদের যেতে দেবার ব্যাপারে গৌতমের কোনও আপত্তি হবে।’

নভীন শরাফ এবং মন্টু রায়ের কিন্তু চলে যাবার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না।

 (২)

কার্তিকের বেলা দ্রুত পড়ে আসছে। আদিত্য জানলা দিয়ে দেখল কার্নিশে জনা পনের কাক মিটিং করছে। এটা ওদের বাসায় ফেরার প্রস্তুতি। ঘরের ভিতরে এখনও যথেষ্টই দিনের আলো আছে, তবু বেয়ারা বড় ঝাড়লন্ঠনটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। ‘একটু চা এলে বেশ হতো’ কে যেন বলল। বলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই যেহেতু চা এসে হাজির, তাই আদিত্য ধরে নিল বক্তার কথায় চা আসেনি। চা তৈরির প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।

আদিত্য বলল, ‘যেটা বলছিলাম। চন্দ্রাকে কেউ ভয় দেখিয়ে বনবীথি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রাণে মারতে চায়নি। কী করে এটা বুঝলাম? পার্থ বনবীথির সবার কাছে আমার পরিচয় ফাঁস করে দিয়েছিল, ফলে ওখানে গিয়ে গোয়েন্দাগিরি করা আমার পক্ষে শক্ত ছিল। আমি তাই নূপুর মণ্ডলকে আমার সহযোগী নিয়োগ করে তাকে নীপবীথিতে পাঠালাম। নূপুর ওখানে গিয়ে ইস্কুলে চাকরি নিল। আমাদের সৌভাগ্য সে চন্দ্রার চাকরিটা পেয়ে গেল। নূপুরকে নিয়োগ করার কথাটা আমি কাউকে বললাম না, পার্থকেও নয়, পাছে তার মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে যায়।

‘নূপুর আমাকে খুব দরকারি একটা খবর দিল। যে সাপটাকে চন্দ্রার বাথরুমে ঢোকানো হয়েছিল, সেটার বিষদাঁত ভাঙা ছিল। যে সাপুড়ে সাপটা বিক্রি করেছিল সে-ই নূপুরকে খবরটা দিয়েছিল। আরও পরে চন্দ্রার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, আরেকটা রাত্তিরে চন্দ্রার ঘরে সিলিং ফ্যানটা ভেঙে পড়ার কিছু আগে একটা অন্যরকম শব্দে চন্দ্রার ঘুম ভেঙে যায়। সে যখন উঠে দেখতে গেছে শব্দটা কোথা থেকে এল, ঠিক সেই সময় ফ্যানটা ভেঙে পড়ে। চন্দ্রার ঘুম ভাঙানোর জন্যে শব্দটা করা হয়েছিল। যিনি ফ্যানের জয়েন্টটা আলগা করে দিয়েছিলেন তিনি মোটেই চন্দ্রাকে মারতে চাননি। অর্থাৎ ফ্যান ভেঙে পড়ার যে গল্পটা বনবীথিতে চলছিল, পরে চন্দ্রার সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, তার সঙ্গে বাস্তবের কিছু অমিল ছিল। প্রশ্ন হল, চন্দ্রাকে কেন কেউ ভয় দেখিয়ে বনবীথি থেকে তাড়াতে চাইবে?’

ঘরে স্তব্ধতা বিরাজ করছে। আদিত্য ঘরের চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, ‘আসল সমস্যাটার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আমার বন্ধু গৌতম দাশগুপ্ত। সরাসরি না করলেও পরোক্ষভাবে। গৌতমের কথায় আমার মনে হয়েছিল সম্ভবত বনবীথি অঞ্চলে আর্মস ডিলারদের একটা চক্র সক্রিয় আছে। এরকম কিছু হলে ওই এলাকায় মাঝে মাঝে দুএকটা খুন-টুন হওয়া স্বাভাবিক। এইসব আর্মস ডিলারদের মধ্যে বখরা নিয়ে বা অন্যান্য কারণে গণ্ডগোল লেগেই থাকে। হয়ত তার জেরে খুন। ওখানকার ওসিও দেখলাম একেবারে নিষ্ক্রিয়। দেখে মনে হল টাকা-পয়সা খেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে।

আমার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে অস্ত্র বিক্রির নেটওয়ার্কটার কথা একটু বলি। অস্ত্রগুলো আসত বাংলাদেশের বর্ডার পেরিয়ে। এপারে এসে বর্ডারের কাছেই কোথাও একটা অস্ত্রগুলো জমা হতো। তারপর পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তারা বিক্রি হয়ে যেত। ক্রেতা মূলত মাওবাদীরা এবং কিছু কিছু ধর্মীয় উগ্রপন্থী দল। পুলিশ জানতে পেরেছে বীথি নামক এন জি ও অস্ত্র বিক্রির এই ব্যবসাটা চালাত। বর্ডারের ওপার থেকে অস্ত্র এসে জমা হতো এপারে বনবীথি স্কুলের একটা গোপন কুঠরিতে। মনে রাখতে হবে বনবীথির ইস্কুলবাড়িটা এক সময় নীলকুঠি ছিল। এখানে দুএকটা গোপন ঘর থাকাটা মোটেই আশ্চর্য নয়, যে-ঘর অস্ত্র লুকিয়ে রাখার আদর্শ জায়গা। তাছাড়া বনবীথি বর্ডারের কাছেই। এই দুই মিলিয়ে বনবীথিকেই অস্ত্রের গুদোমঘর হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। বনবীথি থেকে বীথির অন্য ইস্কুলগুলোতে অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হতো, সেসব জায়গা থেকে অস্ত্র চলে যেত ক্রেতার কাছে।

‘বনবীথি ইস্কুলের একটা ঘর সব সময় বন্ধ থাকত। জনশ্রুতি, সে ঘরে নীলকুঠির সাহেবদের অতৃপ্ত আত্মারা থাকে যাদের বহু বছর আগে নীল বিদ্রোহের সময় পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আসলে এই ঘরের মধ্যে দিয়েই বনবীথির গোপন কুঠরিতে যাবার লুকোনো দরজা, যে কুঠরি অস্ত্রের মজুতঘর। দরজাটা এমনিতে দেখা যায় না। কিন্তু কেউ বিশেষভাবে খুঁজলে কিংবা নেহাতই দৈবক্রমে দরজাটা বেরিয়ে পড়তে পারে। তাই পুরোনো জনশ্রুতিটা কাজে লাগিয়ে ঘরটা বন্ধ রাখা হয়েছিল। মেমদিদি অর্থাৎ চন্দ্রা এসে ঘরটা খোলানোর ব্যবস্থা করে। শুধু খোলানো নয়, চন্দ্রা সেখানে ছুটির পরে নিয়মিত মেয়েদের ইংরেজি আর অঙ্কের ক্লাশ নেওয়া শুরু করল। ফলে অস্ত্রের মজুতঘরটি আর নিরাপদ রইল না।

‘ঘরটি যাতে ফের বন্ধ করে দেওয়া হয় তার জন্য অস্ত্র কারবারিদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কয়েকজন কালিঝুলি মাখা রণপা পরা লোককে রাত্তিরে ইস্কুলের পাশে ছেড়ে দেওয়া হল। ইস্কুলের ছাত্রী ছন্দা বাগ, সেলাই দিদিমনি এবং চন্দ্রা নিজেও এদেরই রাত্তিরে ঘুরতে দেখেছিল। আরও অনেকেই এদের দেখেছিল। নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোলের ফলে যে খুনগুলো হচ্ছিল তার সঙ্গে মিশে গিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে রটে গেল ইস্কুলের চারদিকে অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গৌরবাবু, যিনি পুরোহিতের কাজও করেন, বিধান দিলেন ঘরটা বন্ধ করে দেওয়া হোক। অস্ত্র কারবারিদের দুর্ভাগ্য, এতসব সত্ত্বেও দিদিমনিরা ভূতের ব্যাপারে কনভিন্সড হলেন না। শুধু চন্দ্রা নয়, বড়দিদি এবং ছোড়দিদিরও ধারণা হল পাশের একটা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল তাদের ব্যবসার স্বার্থে এসব কাণ্ড ঘটাচ্ছে। আমরা অবশ্য খবর নিয়ে দেখেছি এসব ব্যাপারে ওই স্কুলের কোনও হাত নেই। অতএব দেখা যাচ্ছে চন্দ্রাকে বনবীথি থেকে সরিয়ে দেবার যথেষ্ট কারণ অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল চন্দ্রাকে বনবীথি থেকে সরিয়ে দিয়ে ঘরটা আবার বন্ধ করে রাখা। কিন্তু অস্ত্র ব্যবসায়ীরা চন্দ্রাকে মেরে ফেলল না কেন? চন্দ্রাকে বাঁচিয়ে রেখে তাদের কী সুবিধে হচ্ছিল? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক চন্দ্রা নিজে অস্ত্র ব্যবসার ব্যাপারটা কতটা সন্দেহ করতে পেরেছিল। বস্তুত, চন্দ্রা আন্দাজ করতে পেরেছিল বীথির ইস্কুলগুলোতে মিড ডে মিলের ট্রাকে চাল-ডালের সঙ্গে অস্ত্রও আসে। চন্দ্রা, এটা কি আমি ঠিক বলছি?’ আদিত্য চন্দ্রার দিকে তাকাল।

সকলে চন্দ্রার দিকে তাকাতে চন্দ্রা মাথা নাড়িয়ে ধীরে ধীরে সম্মতি জানাল। বলল, ‘আমি এইটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে মিড ডে মিলের গাড়ির সঙ্গে আর্মস সাপ্লাইয়ের একটা সম্বন্ধ আছে। মিড ডে মিলের গাড়ি না এলে অভিজিৎ খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ত। ইন ফ্যাক্ট আমি পরে বুঝতে পেরেছি, অভিজিৎ প্রত্যেক মাসে আমার সঙ্গে প্রেম করতে আসার ছুতোয় নীপবীথি ইস্কুলে অস্ত্র কিনতে আসত। তারপর বনবীথিতেও এসে দেখলাম সেই একই দুটো লোক মিড ডে মিলের গাড়ি নিয়ে আসছে। দেখে সন্দেহটা বাড়ল।’

চন্দ্রার সমর্থন পেয়ে আদিত্য আবার বলতে শুরু করল। ‘হোয়াটসঅ্যাপে কেয়া চন্দ্রার যে দুটো ছবি পাঠিয়েছিল, আমি সেগুলো আবার ভাল করে দেখলাম। মনে হল, একটা ছবিতে দর্শকদের মধ্যে দুজন দাঁড়িয়ে আছে যাদের আমি আগে দেখেছি। কোথায় দেখেছি তাও মনে পড়ে গেল। কিছুদিন আগে আমি যখন পুরুলিয়ায় নীপবীথি ইস্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন দেখেছিলাম এই দুজন লোক পিঠে বস্তা নিয়ে স্কুলের ভেতরে মিড ডে মিলের চাল-আলু পৌঁছে দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, ওরা বনবীথি ইস্কুলে কী করছে?

‘প্রশ্নটার কিন্তু খুব সহজ একটা উত্তর আছে। স্বাভাবিক উত্তর হলো, লোক দুটো যেমন নীপবীথি ইস্কুলে মিড ডে মিলের রসদ পোঁছে দিতে আসত, বনবীথিতেও তাই। এসে দেখেছে বনবীথি ইস্কুলে গান-বাজনা হচ্ছে। গান শোনার জন্য তারা দর্শকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। নীপবীথি এবং বনবীথি চালায় একই এন জি ও। একই জায়গা থেকে তাদের মিড ডে মিলের রসদ যোগান দেওয়া হয়। অতএব একই লোক দুটো ইস্কুলে রসদ পৌঁছে দেবে এতে আর আশ্চর্য কী আছে? আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় কিন্তু বলছিল কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। পরে চন্দ্রার স্কেচবইটা হাতে পেয়ে দেখলাম ওই দুই ব্যক্তির সঙ্গে আর একজনকে চন্দ্রা স্কেচ করেছে। আমার মনে পড়ল, কেয়া বাগচির পাঠানো ছবিতে ওই তৃতীয় জন দর্শকদের প্রথম সারিতে বসে ছিলেন। দেখে মনে হয় ইনি যেন বনবীথি ইস্কুলেরই কেউ। তাহলে প্রশ্ন ওঠে বনবীথি ইস্কুলের কেউ নীপবীথি ইস্কুলে কী করছিলেন? আমি মনে মনে একটা গল্প খাড়া করলাম।

‘বনবীথি ইস্কুলে পড়াতে এসে চন্দ্রা এমন একজনকে দেখেছিল যাকে দেখে তার মনে হয়েছিল আগে যেন কোথায় দেখেছে। সে প্রথম প্রথম মনে করতে পারেনি কোথায়। পরে তার হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল সে ওই ব্যক্তিকে নীপবীথি স্কুলে দেখেছে। অথচ সেই ব্যক্তির নীপবীথি স্কুলে যাবার কোনও কারণই ছিল না। চন্দ্রা যখন সরল মনে সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করল তিনি কখনও নীপবীথি ইস্কুলে গেছেন কিনা, আমার ধারণা, সেই ব্যক্তি চন্দ্রাকে বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, তিনি কখনও নীপবীথি ইস্কুলে যাননি। তার কথায় চন্দ্রার সন্দেহ হয়। কিন্তু তখন তখন তার সন্দেহের কথা চন্দ্রা কাকে বলবে? সে শুধু তার স্কেচবুকে ওই ব্যক্তির একটা ছবি এঁকে রেখেছিল। একা ওই ব্যক্তির ছবি নয়। যে দুজন মিড ডে মিলের বস্তায় অস্ত্র সাপ্লাই করত স্কেচে দেখা যাচ্ছে তাদের সঙ্গে ওই ব্যক্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়ত ওই অবস্থাতেই চন্দ্রা ওদের দেখেছিল। বলে রাখি, এসব নিয়ে চন্দ্রার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়নি, তবে যতদূর মনে হয় ব্যাপারটা এরকমই ঘটেছিল।’

‘তুই নীপবীথি ইস্কুলে কাকে দেখে ছবি এঁকেছিলি?’ রত্না ঈষৎ উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।

চন্দ্রা উত্তর দেবার আগেই আদিত্য বলে উঠল, ‘চন্দ্রা স্কেচবুকে যার ছবি এঁকেছিল সে এই ঘরের মধ্যেই আছে। কিন্তু তার কাছে আমরা পরে আসছি। তার আগে আর্মস ট্র্যাফিকিং-এর ব্যাপারটা গৌতমের কাছ থেকে আর একটু ভাল করে শোনা যাক।’

‘আজ খুব ভোরবেলা বীথির প্রত্যেকটা স্কুল রেড করে পুলিশ প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে। বীথির মালিক রণবীর রায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি এই আউটফিটটির আউটার ফেস। আসল মাথা একজন বাংলাদেশি। পুলিশের খাতায় তার নাম আসলাম খান, যদিও তার কোনও ছবি পুলিশের কাছে নেই। তার গতিবিধি সম্বন্ধে পুলিশের ধারণাও বেশ কম। আসলামের সঙ্গে মিলে রণবীর রায় এই ব্যবসাটা করতেন। আর্মস ডিলার আসলামের সঙ্গে রণবীর রায়ের যোগাযোগ বিদেশে। এই যোগাযোগের কথা জানতে পেরে সুইটজারল্যাণ্ডে তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেন। আমরা রণবীর রায়ের বহু কুকীর্তির হদিশ পেয়েছি।’ ঘরের একদিকের কোণ থেকে গৌতমের গলা শোনা গেল।

আদিত্য আবার বলতে লাগল, ‘অতৃপ্ত আত্মা তত্ত্বের সব থেকে বড় প্রচারক ছিলেন গৌরবাবু। তিনি সাধ্যের অতিরিক্ত খরচ করে শান্তি-স্বস্তয়ন করলেন। অন্যদেরও করালেন। কিন্তু চন্দ্রাকে ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করাতে পারলেন না। চন্দ্রা তাঁকে আগে থেকেই সন্দেহ করছিল। কারণ কয়েক বছর আগে সে এই গৌরবাবুকেই নীপবীথি ইস্কুলে দেখে ফেলেছিল। স্কেচবুকে গৌরবাবুরই ছবি সে এঁকেছিল।’

‘এসব আপনি কী বলছেন দাদাভাই। গরিব ব্রাহ্মণের নামে এ কী কলঙ্ক রটাচ্ছেন। আমি কোনওদিন নীপবীথি ইস্কুলে যাইনি। মনে রাখবেন মাথার ওপর ঈশ্বর আছেন। তিনি সব দেখছেন।’ গৌরবাবু দাঁড়িয়ে উঠেছেন, তার গলা কাঁদোকাঁদো।

‘আপনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে হাতটা বার করুন। দু-দুটি বন্দুক আপনার দিকে তাক করা আছে। ওকে হ্যান্ডকাফ লাগাও।’ গৌতম কড়া গলায় বলল।

‘গৌরবাবুই চন্দ্রার বাথরুমে সাপ ঢুকিয়ে তাকে ভয় পাওয়াতে চেয়েছিল। চন্দ্রার সিলিং ফ্যানের জয়েন্ট আলগা করে রেখেছিল।’ আদিত্য বলল।

ঘরে প্রায় ম্যাজিকের মতো আরও কয়েকজন পুলিশ ঢুকে পড়েছে। গৌরবাবুকে হাতকড়া পরানোর পর তার পকেট সার্চ করে একটি ছোট্ট, অতীব সুদৃশ্য রিভলভর পাওয়া গেছে। যন্ত্রটা মিউজিয়ামে রাখার মতো সুন্দর। গৌতমের নির্দেশে গৌরবাবুকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকজন পুলিশ লালবাজারের উদ্দেশে রওনা হল।

‘কয়েকটা কারণে গৌর বাঁড়ুজ্জের ওপর আমার সন্দেহ হয়।’ গৌরবাবুকে নিয়ে পুলিশরা চলে যাবার পর আদিত্য বলতে লাগল, ‘প্রথম যখন চন্দ্রার স্কেচটা দেখি তখনও অবশ্য গৌরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়নি। কিন্তু স্কেচের অন্য দুজনকে চেনা লাগল। একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেল এদের আমি কেয়া বাগচির পাঠানো ছবিতে দেখেছি। আমার মনে হল, ছবি এবং স্কেচ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর যখন গৌরবাবুকে দেখলাম তখন আমার সব সন্দেহ তার ওপর গিয়ে পড়ল। কিন্তু এটা ছাড়াও আরও দুটো ব্যাপারে তার ওপর আমার সন্দেহ হয়। এক, গৌরবাবুর অতীতটা ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট, আন-অ্যাকাউন্টেড ফর। তিনি বললেন, ইস্কুল পাশ করার পরে অনেকটা সময় তিনি সাধুদের সঙ্গে কাটিয়েছেন। তার দেশের বাড়িতেও এখন আর কেউ নেই। অর্থাৎ খতিয়ে দেখার কোনও উপায় নেই তিনি যেটা বলছেন সেটা সত্যি না মিথ্যে। একজন ইন্টারন্যাশানাল আর্মস ডিলারের পক্ষে এই ধরনের নন-ভেরিফায়েবল অতীত খুবই সুবিধেজনক। দুই, আমরা যেদিন বনবীথি ইস্কুলে গেলাম, গৌরবাবু আমাদের বললেন, স্কুলে জায়গার অভাব। তাই যদি আমাদের আপত্তি না থাকে ওঁর বাড়ি গিয়ে আলাপ করা যেতে পারে। কথাটা সঙ্গে সঙ্গে আমার কানে লাগল। গৌরবাবু বলছেন ওঁর বাড়ি বর্ধমানে। বর্ধমানের লোক কখনও ‘আলাপ করা যেতে পারে’ বলবে না। বলবে ‘কথা বলা যেতে পারে’। ‘কথা বলা’ অর্থে ‘আলাপ করা’ এক্সপ্রেশনের ব্যবহারটা ভীষণ বাংলাদেশি।’

(৩)

‘তাহলে কি আমাদের গৌরবাবুই ওই কুখ্যাত অস্ত্র-ব্যবসায়ী আসলাম খান?’ ঘরের একদিক থেকে বড়দিদি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল। ওরা তিন দিদিমনি প্রায় নেই হয়ে বসে আছে।

‘আমি তো সেই রকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু গৌরবাবুকে আসলাম খান হিসেবে কল্পনা করলে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি না। প্রশ্নগুলো আমাকে খুব ভাবাচ্ছে।’

আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর চিন্তিত গলায় বলল, ‘আগে প্রশ্নগুলো এক এক করে আপনাদের সামনে রাখছি। পরে না হয় উত্তর খোঁজা যাবে। প্রথম প্রশ্ন, চন্দ্রা কেন তার সন্দেহের কথা বলতে একবারের জন্যেও পুলিশের কাছে যায়নি, এমনকি তার সলিসিটার অভীক চৌধুরির পরামর্শও চায়নি? দ্বিতীয় প্রশ্ন, পার্থ সান্যাল আমার ফোন নম্বরটা পেল কোথায়? সে জানল কী করে আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার? আমি এমন কিছু বিখ্যাত নই যে একজন আমেরিকাবাসী পেশাদার, যার সঙ্গে কুড়ি-একুশ বছর দেশের কোনও সম্পর্ক নেই, আমার কথা জানবে। তৃতীয় প্রশ্ন…’

‘তোর প্রথম দুটো প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি।’ আদিত্যকে শেষ করতে না দিয়েই পার্থ বলল। ‘চন্দ্রাকে আমিই পুলিশের কাছে যেতে বারণ করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এদেশের পুলিশ এতটাই করাপ্ট যে তাদের কাছ থেকে চন্দ্রার হাইড-আউটটা লিক হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, তোর পুরোনো কোনও বন্ধু অ্যামেরিকায় তোর কথা বলেছিল। কে বলেছিল এখন মনে পড়ছে না। তোর ফোন নম্বরটাও তার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম।’

‘আমার তৃতীয় প্রশ্ন,’ পার্থকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আদিত্য বলতে লাগল, ‘পার্থ আমার সঙ্গে সঙ্গে বনবীথি গেল কেন? কেন সে আমাকে একা যেতে দিল না? চতুর্থ প্রশ্ন, খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় গৌরবাবুর ব্যাপারে তার সন্দেহের কথা চন্দ্রা পার্থকে বলেছিল। কিন্তু পার্থ সেকথা আমাকে জানায়নি কেন? পঞ্চম প্রশ্ন, ট্রেন লাইনের ওপর পড়ে গিয়ে গৌরবাবু যখন অজ্ঞান হয়ে গেলেন তখন তার পকেট থেকে একটা পায়রাডাঙা-শেয়ালদার টিকিট পাওয়া গিয়েছিল। গৌরবাবু পায়রাডাঙায় কেন গিয়েছিলেন? পার্থর সঙ্গে দেখা করতে? নাকি অন্য কোনও কাজে? আর ষষ্ঠ প্রশ্নটা তো আগেই করেছি। আর্মস ডিলাররা চন্দ্রাকে কেন বাঁচিয়ে রাখতে চাইছিল? এছাড়া আর একটা কথা আছে, যেটা ঠিক প্রশ্ন নয়। বলা যায়, এটা আমার একটা অনুভব, একটা গাট ফিলিং। অনুভবটা হল, গৌরবাবুকে দেখে আমার কখনই মনে হয়নি তিনি নেতৃত্ব দিয়ে একটা আন্তর্জাতিক দল চালাতে পারেন। বরং তাঁকে দেখে মনে হয়েছিল তিনি ভালমানুষের ছদ্মবেশে একজন সুনিপুণ ঘাতক, যিনি ঊর্ধ্বতন কারও হুকুম তামিল করতে অভ্যস্ত। গৌতমকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম কাদের মল্লিক বলে আসলাম খানের একজন ডানহাত আছে। তাকেও পুলিশ খুঁজছে। আমার মনে হল, আসলাম খান নয়, আসলামের ডানহাত কাদের মল্লিকের সঙ্গে বরং গৌরবাবুর অনেক বেশি মিল।’

পার্থ আবার কী একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। আদিত্য বলতে লাগল, ‘আমি আমার কল্পনা দিয়ে একটা কাহিনি তৈরি করেছি, সেটা আগে বলি। তারপর দেখা যাবে বাস্তবের সঙ্গে সেই কাহিনি কতটা মেলানো যাচ্ছে। এই কাহিনির নায়ক আসলাম খান, আন্তর্জাতিক অস্ত্র-কারবারি। আসলামের বাড়ি বাংলাদেশে, ব্যবসা পৃথিবী জুড়ে। দুর্ভাগ্যবশত, কোনও দেশের পুলিশের কাছেই তার কোনও ছবি নেই। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের পুলিশ আসলামের ওপর তাদের জাল প্রায় গুটিয়ে এনেছিল, শেষ মুহূর্তে সে জাল থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে থাকা তার পক্ষে অতিশয় ঝুঁকির হয়ে ওঠে। তাই আসলাম, অন্তত কিছুদিনের জন্য, নতুন একটা দেশ এবং নতুন একটা পরিচয়ের খোঁজ করছিল। পশ্চিমবঙ্গটাই তার থাকার জন্যে সব থেকে সুবিধেজনক ছিল। এর একটা কারণ অবশ্যই ভাষা, আর অন্য কারণ, পশ্চিমবঙ্গেই ছড়ানো ছিল তার অস্ত্র ব্যবসার নেটওয়ার্ক এবং মজুতঘর। অবশ্য এখানে এসে একটানা থেকে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ ব্যবসার কাজে তাকে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে হতো। তার উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা পরিচয় গ্রহণ করা যাতে সে মাঝে মাঝে পশ্চিমবঙ্গে আসতে পারবে এবং তার মজুতঘরের ওপর নজর রাখতে পারবে।

‘আর একটা কারণে আসলামের পক্ষে মাঝে মাঝে পশ্চিমবঙ্গে আসাটা দরকার হয়ে পড়েছিল। আগেই বলেছি, আসলামের অস্ত্রগুলো বাংলাদেশ বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকে বনবীথি ইস্কুলে মজুত হতো। এই মজুতঘর থেকে ইদানীং বেশ কিছু অস্ত্র চুরি হয়ে যাচ্ছিল। চোর নিঃসন্দেহে দলের কিছু লোক। কিন্তু গৌরবাবু-বেশি কাদের মল্লিক এই চোরদের হদিশ পাচ্ছিল না। তাই আসলাম খানের নিজের বনবীথিতে ঘন ঘন আসাটা দরকার হয়ে পড়েছিল। এখানে আসার জন্য সে একটা যুৎসই পরিচয় খুঁজছিল। প্রসঙ্গত, এই চোরদেরই কেউ কেউ পরে খুন হয় যে খুনগুলো ভূতের কীর্তি বলে চালানো হয়েছিল। এই খুনগুলো প্রায় সবই বনবীথির সিকিউরিটি গার্ড সফিকুলের কীর্তি। সফিকুল ওদের লোক। আজ বনবীথি রেড করার সময় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। অসম্ভব দৈহিক শক্তির অধিকারী সফিকুল কারাটের চপ মেরে শুধু হাতে মানুষের ঘাড় ভেঙে দিতে পারে।

‘আসলাম যখন ভারতে আসার জন্য একটা যুৎসই পরিচয় খুঁজছে তখন ঘটনাচক্রে অভিজিৎ সিং-এর সঙ্গে তার কথা হয়। আসলাম অভিজিৎকে তার খদ্দের হিসেবে চিনত, তার সঙ্গে মাঝে মাঝে চারপাশের হাল-হকিকত নিয়ে কথাও বলত। নিশ্চয় তাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়াও ছিল। ফলে আসলাম এবং অভিজিৎ মিলে আসলামের নতুন পরিচয়টা তৈরি করল। অভিজিৎ জানত কলেজ জীবনে চন্দ্রার একজন প্রেমিক ছিল যে বহুদিন অ্যামেরিকায়। ঠিক হল, আসলাম চন্দ্রার সেই পুরোনো প্রেমিকের পরিচয় নিয়ে ভারতে আসবে। ইতিমধ্যে যদি চন্দ্রাকে কোনওভাবে পুরুলিয়ার নীপবীথি থেকে বসিরহাটের বনবীথিতে নিয়ে আসা যায় তাহলে তাকে দেখতে আসার ছুতোয় আসলামও মাঝে মাঝেই বনবীথিতে আসতে পারবে। আমার ধারণা, এই প্ল্যানটা কার্যকরী করার জন্য আসলাম অভিজিৎকে অনেক টাকা দিয়েছিল।’

পার্থ সান্যালের মুখের অভিব্যক্তি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি যে কারও অভিব্যক্তি বদলে যেতে পারে, না দেখলে আদিত্যর বিশ্বাস হতো না। আপাতত চারজন বন্দুকধারী তার দিকে বন্দুক উঁচিয়ে আছে।

‘চন্দ্রাকে আপনার বাড়ি থেকে উদ্ধার করার দিন থেকেই জনা কুড়ি আর্মড পুলিশ আপনার ওপর নজর রাখছিল। আপনার কোথাও পালিয়ে যাবার উপায় ছিল না।’ আদিত্য বলল।

‘এই লোকটা যতক্ষণ ঘরে থাকবে ততক্ষণ আমরা শান্তিতে বসে আদিত্যর কথা শুনতে পারব না। অ্যারেস্ট হিম অ্যান্ড টেক হিম টু লালবাজার। আইল টক টু হিম লেটার।’ গৌতম নির্দেশ দিল।

‘লেট মি স্টে হিয়ার অ্যান্ড লিসন টু দিস রিগমারোল। আফটার অল, আমার সম্বন্ধে কী বলা হচ্ছে সেটা জানার অধিকার তো আমার আছে।’ পার্থ সান্যাল ঈষৎ ঠাট্টার সুরে বলল।

‘না আসলাম ভাই। সে সুযোগ এখানে আপনাকে দেওয়া হবে না। পরে কোর্টে গিয়ে যা জানার জানবেন।’ আদিত্য ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল।

গৌরবাবুকে যত সহজে গ্রেফতার করা গিয়েছিল, পার্থ সান্যালের বেলায় ব্যাপারটা ততটা সহজ হল না। পার্থ সান্যাল ওরফে আসলাম খান হাত-পা ছুঁড়ে, আঁচড়ে, কামড়ে যতভাবে সম্ভব গ্রেফতার আটকাবার চেষ্টা করলেন। শেষে যখন গোটা পাঁচেক বলবান পুলিশ তাকে চেপে ধরে হাতকড়া পরাল তখন যুযুধান সব পক্ষই রীতিমত হাঁপাচ্ছে। সৌভাগ্যের বিষয় আসলাম খানের কাছে কোনও অস্ত্রশস্ত্র ছিল না।

আসলাম খান ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর রত্না বলল, ‘বাব্বাঃ। আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন খোকা ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো।’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘আদিত্য তুই বাকি গল্পটা তাড়াতাড়ি বল। আমরা আর কৌতুহল চেপে রাখতে পারছি না।’

‘আসলাম-অভিজিতের প্ল্যানটা ঠিকঠাক রূপান্তরিত করার দুটো বাধা ছিল। দুটোই মস্ত বাধা।’ আদিত্য আবার বলতে শুরু করল, ‘এক নম্বর বাধা, চন্দ্রার পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে আসলামের চেহারার খুব একটা মিল নেই। অতএব যারা সেই প্রেমিককে অল্পস্বল্প চিনত তাদের চোখে ধুলো দেওয়া সম্ভব হলেও চন্দ্রার চোখে ধুলো দেওয়া সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয় বাধা, চন্দ্রার আসল পুরোনো প্রেমিক যদি কোনওভাবে জানতে পারে তার পরিচয়টা ব্যবহার করা হচ্ছে, কিংবা পুলিশ যদি আসল পুরোনো প্রেমিকের ছবিটা ইন্টারনেট থেকে পেয়ে যায় তাহলে সমস্ত প্ল্যানটাই বানচাল হয়ে যাবে। এছাড়াও একটা ছোট সমস্যা ছিল কীভাবে চন্দ্রাকে নীপবীথি থেকে বনবীথিতে চলে আসতে রাজি করানো যায়।

‘আমি পুরুলিয়ায় গিয়ে অভিজিৎ সিং সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলাম সে একজন অসাধারণ উওম্যানাইজার। যে কোনও মেয়েকে সে পটিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি চন্দ্রার মতো হাই ব্রাউ ইন্টেলেকচুয়ালও তার প্রেমের ফাঁদে হাবুডুবু খাচ্ছিল। কিন্তু কোনও মেয়ের প্রতি অভিজিতের নিজের কোনও টান ছিল না। মেয়েদের সে নিজের কাজে ব্যবহার করত। যেমন চন্দ্রার সঙ্গে সে সম্পর্ক রেখেছিল যাতে চন্দ্রার সঙ্গে দেখা করার ছুতোয় সে নিয়মিত নীপবীথিতে এসে অস্ত্র কিনতে পারে। কিন্তু চন্দ্রা যতই তার প্রেমে হাবুডুবু খাক, একজন কুখ্যাত আর্মস ডিলারকে নিজের পুরোনো প্রেমিকের পরিচয়ে আশ্রয় দিতে যে সে রাজি হবে না এটা অভিজিৎ সিং আঁচ করতে পেরেছিল। সে তখন অন্য একটা মতলব করল।

‘আসলাম-অভিজিতের এই মতলবটা আমি প্রথম প্রথম কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না। তারপর হঠাৎ একদিন ভাবতে ভাবতে আমি সত্যটা দেখতে পেলাম। সত্যটা হল, চন্দ্রার কাছে আসলামকে কিছুই প্রমাণ করতে হয়নি, কারণ চন্দ্রা গোড়া থেকেই জানত এই ব্যক্তি তার পুরোনো প্রেমিক নয়। যেটা সে জানত না, মানে তাকে জানানো হয়নি, সেটা হল এই নকল প্রেমিক আসলে কুখ্যাত অস্ত্র-ব্যবসায়ী আসলাম খান।’

‘তোর হেঁয়ালিটা কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’ রত্না আদিত্যকে সাবধান করার গলায় বলল।

‘হেঁয়ালি নয় রে, আসল ব্যাপারটা জলের মতো সহজ। সত্যিটা আমি খানিকটা কল্পনা করতে পেরেছিলাম, যেটুকু ফাঁক-ফোকর ছিল চন্দ্রার কাছ থেকে জেনে ভরাট করে নিয়েছি। আসল গল্পটা হল অভিজিৎ সিং-এর সঙ্গে চন্দ্রার কোনও দিনই ছাড়াছাড়ি হয়নি। আমি পুরুলিয়ায় গিয়ে জানতে পেরেছিলাম অভিজিতের সঙ্গে চন্দ্রার সম্পর্কটা একেবারে হঠাৎ কোনও কারণ ছাড়াই ভেঙে গিয়েছে। ব্যাপারটা বিশ্বাস করা শক্ত। নিজের রুমমেট জয়ন্তী ঘোষকে অবশ্য চন্দ্রা বলেছিল তিরিশ জন জওয়ানকে মাওবাদীরা মেরে ফেলেছিল বলে সে মাওবাদীদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাইছিল না। কিন্তু এটা নেহাতই বাজে যুক্তি। মাওবাদীরা ওই প্রথম মানুষ মারল এমন তো নয়।

‘যাই হোক, চন্দ্রা যখন পুরুলিয়ায় তখন একদিন অভিজিৎ সিং তাকে এসে বলল, ভাস্কর সেনগুপ্ত বলে একজন বিখ্যাত মাওবাদী তাত্ত্বিক আছেন, তিনি বোমা-বারুদ নিয়ে বিপ্লব করেন না, শুধু তার কথা দিয়ে বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করেন, তাঁকে পুলিশ পাগলের মতো খুঁজছে। এতদিন তিনি ছত্তিসগড়ে থাকতেন, কিন্তু তার পক্ষে সেখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। তিনি যদি চন্দ্রার আমেরিকাবাসী পুরনো প্রেমিকের পরিচয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন, চন্দ্রা কি তাঁকে সাহায্য করতে পারবে? অভিজিতের মনে হয়েছিল, ‘বিপ্লবের স্বার্থ’, ‘নিপীড়িত মানুষের স্বার্থ’ ইত্যাদি কিছু কড়া সেন্টিমেন্টাল কথা বললে চন্দ্রা রাজি হয়ে যেতে পারে। অভিজিৎ ঠিকই ভেবেছিল, চন্দ্রা রাজি হয়ে গেল।

‘আর একটা সমস্যার কথা অভিজিৎ সিং চন্দ্রাকে বলল। সমস্যাটা হচ্ছে, ভাস্কর সেনগুপ্তর পক্ষে ছত্তিসগড়ের মতো পুরুলিয়াও নিরাপদ নয়, যেহেতু মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা বলে পুরুলিয়াও পুলিশের নজরে আছে। তাই ভাস্কর সেনগুপ্তকে আশ্রয় দিতে হলে চন্দ্রাকে পুরুলিয়া ছাড়তে হবে। দুজনে মিলে ঠিক করল, মানে অভিজিৎ সিং-ই ঠিক করল, তারা ওপর ওপর দেখাবে যে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এবং এই ছাড়াছাড়ির ফলে চন্দ্রা এতটাই ভেঙে পড়েছে যে সে আর পুরুলিয়া থাকতে চায় না। আসলামের কথায় রণবীর রায় চন্দ্রাকে বনবীথিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। আসলাম ভাস্কর সেনগুপ্ত সেজে চন্দ্রার সঙ্গে দেখা করল। চন্দ্রাকে অনেকটা অভিনয় করতে হয়েছিল। পার্থকে বিয়ে করা নিয়ে কেয়া বাগচির সঙ্গে তার ঝগড়াটাও অভিনয়। পরে অবশ্য কেয়ার জন্যে তার খারাপ লাগে। সে অনেক কষ্ট করে এক রিক্সাওয়ালার মোবাইল থেকে কেয়াকে মেসেজ করে। তার নিজের মোবাইল তার কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, অত কষ্ট করে এই পুরোটা সময় সে ভাস্কর সেনগুপ্তকে নয়, আসলে আসলাম খানকে আশ্রয় দিচ্ছিল।

‘আর একটা সমস্যা ছিল বিপাশা লাহিড়িকে নিয়ে। তিনি কী করে নকল ভাইকে মেনে নিলেন? আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি বিপাশা লাহিড়ি মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত। চন্দ্রা যতটা যুক্ত তিনি সম্ভবত তার থেকে অনেকটাই বেশি। বস্তুত, তাঁর স্বামীর অকালমৃত্যুর পরে তিনিও অভিজিৎ সিং-এর প্রেমের ফাঁদে পা দেন। কাজেই অভিজিতের কথায় খুব সহজেই তিনি আসলামকে তার ভাই হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। আমার অনুমান, তিনি আসলামের আসল পরিচয়টাও জানতেন। অন্তত এটা নিয়ে সন্দেহ নেই যে, চন্দ্রা তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেবার পর তাকে পাহারা দেবার ভারটা বিপাশা লাহিড়ির ওপরেই পড়েছিল।’

বিপাশা লাহিড়ি কথা বলছেন না, শুধু তাঁর চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। যদি সেই আগুন দিয়ে ভস্ম করে দেওয়া যেত, আদিত্যকে তিনি তাই করতেন।

অমিতাভ বলল, ‘এটা কিন্তু খুব একটা সমাপতন হয়ে গেল। পার্থ সান্যালের দিদিও নকশাল, এবং শুধু তাই নয় মোস্ট কনভিনিয়ন্টলি তিনিও অভিজিৎ সিং-এর প্রেমে হাবুডুবু? আমার কিন্তু এতটা বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে।’

‘হবারই কথা।’ আদিত্য রহস্য করে বলল, ‘কিন্তু বাস্তবে কোনও সমাপতন ঘটেনি। কারণ, আসলে চন্দ্রার পুরোনো প্রেমিক আর বিপাশা লাহিড়ির ভাই সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তি। তাদের মধ্যে একমাত্র মিল হল তারা দুজনেই দীর্ঘদিন অ্যামেরিকা প্রবাসী।’

‘আমার কিন্তু এবার সত্যিই সব গুলিয়ে যাচ্ছে আদিত্যদা।’ নূপুর প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।

‘গুলিয়ে যাচ্ছে কারণ আসল ব্যাপারটাই তুমি ধরতে পারনি। আসল কথাটা হল, নাম থেকে শুরু করে পার্থ সান্যাল চরিত্রটার পুরোটাই সম্পূর্ণ কাল্পনিক। ওই নামে কস্মিনকালেও চন্দ্রার কোনও প্রেমিক ছিল না। কলেজে যার সঙ্গে চন্দ্রার সম্পর্ক ছিল তার নাম কৃশানু মুখার্জী। তাকে আমারও খুব আবছা মনে আছে, তবে চন্দ্রার প্রেমিক হিসেবে নয়, নেহাতই একজন সহপাঠী হিসেবে। কৃশানু বহুদিন অ্যামেরিকা প্রবাসী। অপরপক্ষে, বিপাশা লাহিড়ির অ্যামেরিকা প্রবাসী ভাই-এর নাম সুপ্রতিম সান্যাল। বিপাশা লাহিড়ির শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় সকলে জানত তার এক অ্যামেরিকা প্রবাসী ভাই আছে, কিন্তু তাকে কেউ দেখেনি। বিপাশা লাহিড়ি আলাদা করেই মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত এবং পুরোপুরি অভিজিৎ সিং-এর প্রভাবাধীন। তার সঙ্গে কৃশানু বা চন্দ্রার কোনও সম্পর্কই নেই।

‘আসলাম খান যদি কৃশানু মুখার্জীর পরিচয়ে চন্দ্রার সঙ্গে দেখা করতে আসত তাহলে আমি বা পুলিশ নিশ্চয় ইন্টারনেটে কৃশানুর খোঁজ খবর করতাম। ইন্টারনেটে খোঁজ করলে নিশ্চয় কৃশানুর একটা-দুটো ছবি বেরিয়ে পড়ত। তখন হয়ত আমরা আসল কৃশানুর সঙ্গে যোগাযোগও করতাম। আর তাহলেই আসলামদের মতলবটা ফাঁস হয়ে যেত। তাই আসলাম পার্থ সান্যাল বলে একজন সম্পূর্ণ কাল্পনিক ব্যক্তিকে তৈরি করল। সেই ব্যক্তির নামে একটা ওয়েবসাইট খুলল। তাকে একটা কাল্পনিক কন্সাল্টেন্সি ফার্ম-এর মালিক হিসেবে দেখানো হল। তার নামে নকল পাশপোর্ট তৈরি হল। তারপর আসলাম তার পরিচয় গ্রহণ করল। আমি ইন্টারনেটে পার্থ সান্যালকে খুঁজে দেখলাম সবই ঠিকঠাক আছে। নকল পার্থর আইডেন্টিটিটা এস্ট্যাবলিস করার জন্য কিছুদিন চন্দ্রাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার ছিল। যতক্ষণ চন্দ্রা পাশে রয়েছে ততক্ষণ হঠাৎ পুরোনো পরিচিত কেউ সামনে এসে গেলেও আসলাম ঘটনাটা সামলে দিতে পারত। যেন চন্দ্রা সমানে সাক্ষী দিচ্ছে এ-ই আসলে তার পুরোনো প্রেমিক। বলা যায় এটা একটা কন্সট্যান্ট অ্যাশিয়োরেন্স। অন্তত কিছুদিন এই অ্যাশিয়োরেন্সটা নকল পার্থর দরকার ছিল। তাছাড়া চন্দ্রা নকল পার্থকে তার আসল প্রেমিক সম্বন্ধে অনেক খুঁটিনাটি তথ্য জানিয়েছিল যেগুলো জানার ফলে নকল পার্থর কাজ চালিয়ে যেতে অনেক সুবিধে হয়েছিল। আর নকল পার্থর চরিত্রটা আরও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বিপাশা লাহিড়িও তাঁর ভূমিকা পালন করছিলেন। এটা একটা ফিনিসিং টাচ।

 ‘ইতিমধ্যে চন্দ্রা সেই নিষিদ্ধ ঘর খুলিয়ে সেখানে ক্লাশ নিতে শুরু করেছে। তাই চন্দ্রাকে বনবীথি থেকে সরানো দরকার হয়ে পড়ল। কিন্তু তাকে মারা যাবে না, কারণ তার প্রয়োজনীয়তা তখনও ফুরোয়নি। তাই তাকে ভয় দেখানো শুরু হল। দুটো ঘটনার পর চন্দ্রা বেশ ভয় পেয়ে গেল। পার্থ চন্দ্রাকে নিয়ে তার নকল দিদির বাড়িতে রেখে এল। চন্দ্রার ধারণা হল, সে একজন কমরেডের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে যিনি ভাস্কর সেনগুপ্ত-র ব্যাপারটা জানেন। বনবীথি ইস্কুলের সেই নিষিদ্ধ ঘরটা আবার তালাবন্ধ হয়ে গেল।’

‘পার্থবাবু কিন্তু মাঝে মাঝেই বনবীথি আসতেন। আপনি যেদিন বনবীথি এলেন তারপরেও পার্থবাবু দুদিন এসেছিলেন।’ এবার সোনাদিদির গলা শোনা গেল।

‘আমি যেদিন বনবীথি এলাম সেদিন নকল পার্থ আমাকে আগলে আগলে নিয়ে এল। পাছে আমি সেই গোপন দরজাটা আবিষ্কার করে ফেলি। নকল পার্থর নির্দেশে গৌরবাবু মানে কাদের মল্লিক অনেকটা সময় আমাদের আটকে রাখল তার বাড়িতে। আমি ইস্কুলটা ভাল করে দেখার সুযোগই পেলাম না। তবে আমি ছিলাম বলে আসলাম খানেরও কোনও কাজ হল না। ফলে তাকে আবার আসতে হল। কিন্তু কোন ছুতোয় আসবে? চন্দ্রাই তো আর নেই। সে ভান করল তার দামী কলমটা সে বনবীথি ইস্কুলে ফেলে এসেছে। তাই আমাকে কিছু না বলে সে আবার বনবীথিতে ফিরে এল। পেনটা বলাই বাহুল্য সে খুঁজে পেল না। কী করে পাবে? পেন তো তার পকেটেই রয়েছে। এবার সত্যি সত্যি বড়দিদির ঘরে সে তার পেনটা ফেলে এল এবং সেই ছুতোয় আরও একদিন সে বনবীথি ঘুরে গেল। আসলে সে খবর পেয়েছিল পুলিশ বনবীথির দিকে নজর দিয়েছে। যে কোনও দিন রেড হতে পারে। সে ভাবল, রেড হলে পুলিশ তাকে ধরতে পারবে না ঠিকই কিন্তু তার অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই সে একটু একটু করে সব মালপত্তর অন্য জায়গায় সরিয়ে দিচ্ছিল। ফলে মাঝে মাঝেই বনবীথিতে আসা তার প্রয়োজন হচ্ছিল।’

‘তুই নকল পার্থকে সন্দেহ করলি কবে থেকে?’ রত্না জিজ্ঞেস করল।

‘বলতে পারিস একেবারে প্রথম থেকে। পার্থ আমার নম্বর এবং পেশা কী করে জানল? আমার নম্বর এবং পেশার খবর রাখে মূলত কিছু ক্রিমিনাল। কেন জানি না আমার মনে হল এদেরই কারও কাছ থেকে পার্থ আমার নম্বরটা জেনেছে। তারপর একদিন অ্যাটলান্টা থেকে পার্থ আমাকে ফোন করল। আমি কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম ওদের ওখানে এখন কেমন ঠাণ্ডা? বিদেশ থেকে কেউ ফোন করলে এটা, কেন জানি না, লোকের একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্ন। পার্থ, বলাই বাহুল্য, অ্যাটলান্টা থেকে ফোন করছিল না। কিন্তু আমি এরকম একটা প্রশ্ন করতে পারি ভেবে সে নেটে ওখানকার তাপমাত্রাটা দেখে নিয়েছিল। কিন্তু সে একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছিল। সে আমাকে বলেছিল, হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা পড়ে গেছে রে, দশ ডিগ্রিতে নেমে গেছে। দশ ডিগ্রি মানে দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফ্যারেনহাইট হতে পারে না, কারণ অক্টোবরে অ্যাটলান্টায় অত ঠাণ্ডা পড়ে না। শুনেই আমার খটকা লাগল। অ্যামেরিকার বাসিন্দারা তো সেলসিয়াসে টেম্পারেচার মাপে না, ফ্যারেনহাইটে মাপে। পার্থর বলা উচিত ছিল হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা পড়ে গেছে রে, পঞ্চাশ ডিগ্রিতে নেমে গেছে। আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে এই সত্যটা আমার সামনে উদ্ঘাটিত হয়েছিল। সেদিন থেকে পার্থর ওপর আমার সন্দেহটা গাঢ় হল। তারপর আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে খোঁজ নিয়ে জানলাম চন্দ্রাদের সঙ্গে পার্থ সান্যাল বলে কেউ পড়তই না। এইটুকু রিস্ক আসলাম নিয়েছিল। সে ভেবেছিল ইন্টারনেটেই তার খোঁজ করা হবে। কলেজে গিয়ে কেউ তার খোঁজ করবে এই সম্ভবনাটা সে তার হিসেবের মধ্যে আনেনি। হয়ত ভেবেছিল, কলেজে গিয়ে কেউ তার খোঁজ করার আগেই সে কাজ শেষ করে চিরতরে গা ঢাকা দেবে। এসব কাজে একটু রিস্ক নিতেই হয়।’

 ‘একটা জিনিস কিন্তু বুঝলাম না। আসলাম খান তোকে হঠাৎ কন্ট্যাক্ট করল কেন? বেশ তো সে চুপি চুপি নিজের কাজ সেরে কেটে পড়তে পারত। বসিরহাটের পুলিশও তো তার হাতের মুঠোয় ছিল। সে তোকে এর মধ্যে জড়াতে গেল কেন?’ অমিতাভ জিজ্ঞেস করল।

‘আসলাম আমাকে কিছুতেই কন্ট্যাক্ট করত না। বসিরহাটের পুলিশ চন্দ্রার অন্তর্ধানের ব্যাপারটা লালাবাজারকে জানায়নি। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু চন্দ্রার বন্ধু কেয়া বাগচি তার চেনাশোনা কাজে লাগিয়ে একেবারে লালবাজারে গিয়ে ব্যাপারটা জানায়। যেহেতু চন্দ্রার ওপর আগে থেকেই পুলিশের নজর ছিল, তাই লালবাজার ব্যাপারটা ফেলে রাখেনি। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের একটা টিম বনবীথিতে ইন্সপেকশনে গেল। ফলে চন্দ্রার অন্তর্ধান নিয়ে একটা সত্যিকারের ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়ে যায়। এই অবস্থায় আসলামের মনে হয় সে যে নির্দোষ সেটা ভাল করে প্রমাণ করা দরকার। তাই সে আমার কাছে আসে। কেয়া লালবাজারে গিয়ে ব্যাপারটা নাড়াচাড়া না করলে আসলাম আমার কাছে আসত না।’

‘অভিজিৎ সিং এখন কোথায় আছে?’ অভীক চৌধুরি প্রশ্ন করলেন।

‘সম্ভবত ছত্তিসগড়ে। পুলিশ এখনও তাকে ধরতে পারেনি, তবে তার দলটা একেবারে ভেঙে গেছে।’ গৌতম উত্তর দিল।

‘এখানে আমার একটা অনুমান আছে।’ আদিত্য বলল। ‘আমার মনে হয় আসলাম খান চাইছিল অভিজিৎ সিং পুলিশ এনকাউন্টারে মারা যাক। তাহলে তার আসল পরিচয়টা আর কেউ জানতে পারবে না। এই উদ্দেশ্যে আসলামের লোক, হয়ত কাদের মল্লিক নিজে, বিজয় মাহাতো এবং তরুণ মির্ধাকে মোটা টাকা দিয়ে বলেছিল তারা যেন অভিজিতের গতিবিধির খবর পুলিশকে দেয় যাতে পুলিশ অভিজিৎ সমেত দলের সদস্যদের খতম করে দিতে পারে। এছাড়া ওই অঞ্চলে পুলিশের হঠাৎ সাফল্যের আর কোনও ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। এটাও মনে রাখতে হবে যে ওই দুজন ইনফর্মার পুরুলিয়ায় আমার সঙ্গে দেখা করেনি। হয়ত তাদের মনে পাপ ছিল বলেই তারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়নি।’

ঘরে কিছুক্ষণ স্তব্ধতা বিরাজ করছিল। সকলেই চিন্তায় ডুবে আছে। কিছু পরে নীরবতা ভেঙে চন্দ্রা বলল, ‘একটা প্রশ্নের কিন্তু উত্তর পেলাম না। গৌরবাবু কেন পায়রাডাঙা গিয়েছিলেন?’

 ‘এটাই এই রহস্যের শেষ ধাপ। এটা পেরতে পারলেই সমস্ত প্রহেলিকার সমাধান হয়ে যাবে। উত্তরটা প্রথমে ছোট করে দিয়ে দিই। গৌরবাবু বা কাদের মল্লিক নকল পার্থ বা আসলাম খানের নির্দেশে পায়রাডাঙা গিয়েছিলেন তোকে খুন করতে।’ আদিত্য বলল।

‘এই তো বললি চন্দ্রাকে ওরা খুন করতে চায়নি। আবার এখন বলছিস চন্দ্রাকে খুন করার জন্যে আসলাম কাদের মল্লিককে ডেকে পাঠিয়েছিল। আবার সব গুলিয়ে দিচ্ছিস।’ এবার রত্নার গলা।

‘আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি। তাহলেই বুঝতে পারবি। আমার অনুমান পায়রাডাঙায় থাকতে থাকতে চন্দ্রার মনে হতে লাগল এই লোকটা ভাস্কর সেনগুপ্ত হতেই পারে না। হয়ত নকল পার্থর সঙ্গে কথা বলে চন্দ্রার সন্দেহ হয়েছিল। চন্দ্রা, ভুল বললে আমায় শুধরে দিবি।’

‘না, না। তুই একেবারে ঠিক বলছিস। আমি ভাস্কর সেনগুপ্ত ভেবে যতবার লোকটার সঙ্গে বামপন্থা নিয়ে কোনও থিওরেটিকাল আলোচনা করতে গেছি, ততবার সে আমাকে এড়িয়ে গেছে। তাছাড়া, আমার প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি একটা জেলখানায় বন্দী রয়েছি। স্বাধীনভাবে কিছু করার কোনও অধিকার আমার নেই। পুলিশ, সলিসিটর, বন্ধু সকলের সঙ্গে কথা বলা বারণ। মোবাইলটাও সঙ্গে রাখতে দেয়নি। অতি কষ্টে এক রিক্সাওলার মোবাইল থেকে আমি কেয়াকে একটা মেসেজ করেছিলাম। আশা করছিলাম নম্বরটা থেকে পুলিশ আমার লোকেশানটা ট্রেস করতে পারবে। বলাই বাহুল্য, এটা নকল পার্থকে এবং দিদিকে লুকিয়ে করতে হয়েছিল।’

‘চন্দ্রার যে আস্তে আস্তে সন্দেহ বাড়ছে এটা নকল পার্থও বুঝতে পেরেছিল। সে ভেবে দেখল, তার ফেক আইডেন্টিটিটা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। এখন যদি বাইরের কোনও লোক এসে চন্দ্রাকে মেরে যায় তাহলে কোনও ক্ষতি নেই। পুলিশকে সে বলতে পারবে চন্দ্রার সেফটির জন্যই সে চন্দ্রাকে লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। এই ভেবে সে কাদের মল্লিককে বলল কালীপুজোর রাত্তিরে সে এসে যেন বাইরে থেকে চন্দ্রাকে গুলি করে। এটা তখনই করতে হবে যখন চন্দ্রা বাচ্চাটার সঙ্গে বাগানে বাজি পোড়াতে যাবে। বাগানের চারদিকে পাঁচিল আছে। কিন্তু বাইরে কোনও গাছের ওপর উঠলে বাগানের ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যায়।’

‘তারপর কী হল?’ চন্দ্রা রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল।

‘বাগান সংলগ্ন একটা নিমগাছে উঠে কাদের মল্লিক যখন বন্দুক বার করে তোদের জন্য অপেক্ষা করছে তখন জানি না কীভাবে পাড়ার কয়েকজন তাকে দেখতে পেয়ে যায়। ফলে কাদের মল্লিককে তাড়াহুড়ো করে পালাতে হয়। বন্দুকটা সে গাছের কোটরে রেখে আসে। ইচ্ছে ছিল পরের দিন গিয়ে তার অসমাপ্ত কাজ শেষ করবে। দুর্ভাগ্যবশত, ফেরার পথে তার অ্যাক্সিডেন্ট হল। ফলে তার আর ফেরা হয়নি। বন্দুকটা পুলিশ পরে উদ্ধার করেছে।

‘কী করে ফেরা হবে? মাথার ওপর ঠাকুর তো আছেন।’ এই প্রথম ছোড়দিদির গলার আওয়াজ শোনা গেল। সকলে ভুলেই গিয়েছিল তিনি ঘরের মধ্যে আছেন।

‘একটা ধাঁধার কিন্তু উত্তর পাওয়া গেল না। আমরা জানতে পারলাম না কে গৌরবাবুকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন লাইনে ফেলে দিয়েছিল।’ গৌতম বলল।

 ‘সব প্রশ্নের কী আর উত্তর পাওয়া যায়? কিছু রহস্য রহস্যই থেকে যায়।’ আদিত্য দার্শনিকের গলায় বলল।

আরও ঘন্টাখানেক পরে যখন সকলে বাড়ি ফিরছে, আদিত্য নূপুরকে বলল, ‘আমার আপিসে একবার দেখা কোরো।’

(৪)

পরদিন ভোর ছটা নাগাদ টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল আদিত্যর। ঘুমচোখে দেখল মোবাইলে কেয়া বাগচির নামটা ফুটে উঠেছে। আদিত্য ঠিক করল এখন ফোনটা ধরবে না। আর একটু ঘুমিয়ে নিয়ে পরে কেয়াকে ফোন করবে। ফোনটা বাজতে বাজতে এক সময় থেমে গেল। আদিত্য ফোনটাকে সাইলেন্ট মোডে দিয়ে পাশ ফিরতে ফিরতে টের পেল ফোনটা ভাইব্রেট করছে। সাড়ে আটটা নাগাদ চা-বিস্কুট খেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে আদিত্য দেখল কেয়া বাগচি পাঁচটা মিসড কল করেছে। সে কেয়া বাগচির নম্বরটা ক্লিক করল।

‘আপনাকে সকালে ফোন করেছিলাম। বোধহয় ফোনটা সাইলেন্ট মোডে ছিল। আপনার সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে?’ কেয়া বাগচির গলাটা একটু লাজুক শোনাল।

‘বিবাদী বাগের কাছে আমার একটা আপিস আছে। ওখানে কি আসতে পারবেন?’ আদিত্য সাবধানি গলায় বলল।

‘না, না, অফিসে নয়। কাল শনিবারে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবেন?’ কেয়ার গলাটা আগের থেকে সাহসী।

‘আপনার সঙ্গে লাঞ্চ? সে তো খুব ভাল প্রস্তাব। অবশ্যই যাব। কখন? কোথায়?’

‘আপনাকে কলেজ স্ট্রিট মহাত্মা গান্ধীর মোড় থেকে তুলে নেব। আমি বাগবাজারের দিক থেকে আসব। আপনি সাড়ে বারোটার মধ্যে পাতিরামের সামনে আসতে পারবেন? আমি একটা উবার নিয়ে চলে আসব।’

‘ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করব।’

ফোনটা রেখে দেবার পর আদিত্য কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে আলস্য করল। ভাবল, আজ আর বাড়ি থেকে বেরোবে না। অনেক কাজ করেছে। একটা দিন সে বিশ্রাম নিতেই পারে। এইসব ভেবে সে আবার একচোট ঘুমিয়ে নেবার ফন্দি করছে এমন সময় আবার ফোনটা বেজে উঠল। এবার নূপুর মণ্ডল।

‘আদিত্যদা, আজ কি তুমি অফিসে আসছ? এলে দেখা করতাম।’

‘সামনের সপ্তাহে হয় না? আজ ভাবছিলাম আর আপিস যাব না।’

‘আসলে আমি ব্যাঙ্গালোরে একটা চাকরি পেয়েছি। ওরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জয়েন করতে বলছে। ভাবছিলাম, সামনের সোম কি মঙ্গলবার চলে যাব। কিন্তু তোমার সঙ্গে দেখা না করে তো যেতে পারি না। তাই আজ যদি একটু সময় দাও খুব ভাল হয়।’

‘ঠিক আছে। তুমি বারোটা নাগাদ চলে এস।’

আদিত্য ফোন রেখে বাথরুমে ঢুকল। বিশ্রাম তার কপালে নেই।

নূপুরের আসতে আসতে প্রায় সোয়া বারোটা হয়ে গেল। আদিত্য বারোটার আগেই আপিসে পৌঁছে গেছে।

‘তুমি আমার কাছে কিছু টাকা পাবে।’ একটু পরে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল। সে একটা চেক এগিয়ে দিল নূপুরের দিকে। বলল, ‘দেখে নাও তোমার নামের বানানটা ঠিক লিখেছি কিনা।’

‘আচ্ছা আদিত্যদা, একটা কথা বলো। তোমার মক্কেলটাই তো ভুয়ো। তার টাকা কি আমার নেওয়া উচিত?’ নূপুর চেকটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘আমার মক্কেল তো তোমাকে নিয়োগ করেনি। তোমাকে নিয়োগ করেছিলাম আমি। আমার কাছ থেকে টাকা নিতে তোমার অসুবিধে কোথায়?’

‘আদিত্যদা, টাকাটা তুমি দিচ্ছ কোথা থেকে?’ টাকাটা নিতে নূপুর এখনও ইতস্তত করছে।

‘শোনো। টাকাটা নিতে তোমার কোনো নৈতিক সমস্যা থাকার কারণ নেই। যে টাকাটা তোমাকে দিচ্ছি সেটা আমার টাকা। আসলাম খানের কাছ থেকে আমি যে টাকাটা পেয়েছিলাম সেটা ফেরত দিয়ে দেব। কীভাবে ফেরত দেব সেটা অবশ্য জানতে হবে।’

‘তাহলে এটা তো তোমার পকেট থেকে গেল। এটা আমি নেব না।’ নূপুর চেকটা আদিত্যর দিকে বাড়িয়ে দিল।

‘নূপুর, তুমি কিন্তু ভীষণ পাকামি করছ। চেকটা এক্ষুনি ব্যাগে পুরে নাও। নাহলে তোমার আসল গল্পটা পুলিশকে বলে দেব। জানতে পারলে পুলিশ কিন্তু তোমাকে ছাড়বে না।’ আদিত্য মিটিমিটি হাসছে।

বাধ্য মেয়ের মতো নূপুর মণ্ডল চেকটা ব্যাগে পুরে নিল। তার মুখের অভিব্যক্তিটা একেবারে পালটে গেছে। সে বলল, ‘তুমি জান আসল গল্পটা? কী করে জানলে?’

 ‘এইটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি যে কালীপুজোর রাত্তিরে তোমার জন্যেই কাদের মল্লিক চন্দ্রাকে গুলি করতে পারেনি। আর ফেরার পথে তুমিই কাদের মল্লিককে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন লাইনের ওপর ফেলে দিয়েছিলে। এর বেশি জানি না। ডিটেলটা তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই। আমি ঠিক বলছি তো?’

নূপুর উত্তর দিল না। সে মাথা নিচু করে নিজের আঙুল নিয়ে খেলছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে বলল, ‘আমিও তোমাকে গল্পটা বলতে চাই। কেন আমি লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম সেটাও বলব। তোমার কথা মতো গৌরবাবুকে আমি চোখে চোখে রাখছিলাম। তখন অবশ্য জানতাম না তার নাম কাদের মল্লিক। যাই হোক আমি ধরে নিয়েছিলাম গৌরবাবুর ওপর খারাপ লোকেদের নজর আছে। তাই তাকে আগলে আগলে রাখতে হবে। কিন্তু কিছুদিন পরে বুঝলাম গৌরবাবু লোকটাই গোলমেলে। রাত্তিরবেলা নানারকমের সন্দেহজনক লোকেদের সঙ্গে সে নদীর ধারে দেখা করত। বুঝলাম, তাকে চোখে চোখে রাখতে হবে যাতে সে কোনও দুষ্কর্ম না করে। রাত্তিরে ইস্কুলের পেছন দিকে লরি এসে দাঁড়াত। লরিতে বস্তায় করে মাল তোলা হত। গৌরবাবু আর সফিকুলদা তার তদারকি করত। কালীপুজোর দিন কলকাতায় গিয়ে আমি এগুলো সব তোমাকে বলব ভেবেছিলাম কিন্তু সেটা হয়ে উঠল না। কালীপুজোর দিন দুপুরে গৌরবাবু বনবীথি থেকে বেরলেন। বেরিয়ে স্টেশনে যাবার অটো ধরলেন। আমি আর একটা অটোতে ওর পিছু নিলাম। উনি আমাকে চিনতে পারছিলেন না কারণ আমি বোরখা পরে ছিলাম। এটাও অবশ্য তোমার কাছ থেকেই শেখা। টিকিট কাউন্টারে ওর পেছনে দাঁড়ালাম। শুনলাম উনি পায়রাডাঙার টিকিট চাইছেন। আমিও পায়রাডাঙার একটা টিকিট কাটলাম। শেয়ালদা স্টেশনে নেমে আমি তোমাকে ফোন করলাম। গৌরবাবু সম্বন্ধে আমার সন্দেহের কথা জানালাম। তাকে ফলো করে যে শেয়ালদা অব্দি এসেছি সেটাও বললাম। গৌরবাবু পায়রাডাঙার টিকিট কেটেছেন শুনে তুমি আমাকেও পায়রাডাঙা যেতে বললে। তুমি বললে তোমার মনে হয় উনি লাহিড়িদের বাড়ি যাবেন। তাই আমাকে সোজা লাহিড়িদের বাড়ি গিয়ে তার আশেপাশে লুকিয়ে থাকতে বললে। এই অব্দি গল্পটা তোমার জানা। আমি এর পর কী হল বলছি।’

‘সেটাই তো শুনতে চাই।’

‘আমার ভাগ্য ভাল গৌরবাবু পায়রাডাঙা স্টেশনে নেমে রিক্সায় না উঠে টোটোর লাইনে দাঁড়ালেন। মনে হল পাছে রিক্সাওলা ওঁর চেহারাটা পরে আইডেন্টিফাই করে ফেলে সেই ভয়ে উনি ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকতে চাইছেন। আমার এতে খুব সুবিধে হল। আমি রিক্সা ধরে অনেক আগেই লাহিড়িদের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। তখন অন্ধকার নেমে আসছে। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা ঢিপির ওপর ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। খানিক বাদে দেখি গৌরবাবু খুব সাবধানে লাহিড়িদের বাড়ির দিকে আসছেন। বাড়ির কাছে এসে উনি একটা নিমগাছে চড়লেন। দু-পা দুদিকে দিয়ে একটা মোটা ডালের ওপর বসলেন, যেভাবে লোকে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়। অন্ধকার নেমে আসার জন্য আমি আমার লুকোনো জায়গা থেকে লাহিড়িদের বাড়ির ভেতরটা ভাল দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু রাস্তায় আলো জ্বলছিল বলে গাছের ওপর বসা গৌরবাবুকে মোটামুটি দেখতে পাচ্ছিলাম। একটু পরে গৌরবাবু রিভলভর বার করলেন। মনে হল ওটা ওঁর কোমরে গোঁজা ছিল। রিভলভর হাতে নিয়ে গৌরবাবু অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমাকে ভীষণ পিঁপড়ে কামড়াচ্ছিল। মনে হল আমি পিঁপড়ের ঢিপির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। পিঁপড়ের কামড় সহ্য করে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা সময়ে লাহিড়িদের বাড়ির ভেতর বাজি পোড়ানো শুরু হল। বাজির আলোয় এবার বাড়ির ভেতরটা ভালোই দেখা যাচ্ছে। একটি মেয়ে একজন বাচ্চাকে নিয়ে বাজি পোড়াচ্ছে। বাচ্চাটা একবার বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম গৌরবাবু মেয়েটির দিকে তাক করে বন্দুক তুলেছেন। আমি ‘চোর চোর’ বলে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলাম। আমার চিৎকারে পাশের বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে এল। লাহিড়িদের বাড়িতে যে মেয়েটি বাচ্চার সঙ্গে বাজি পোড়াচ্ছিল সে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। বেগতিক দেখে গৌরবাবু গাছ থেকে নেমে উল্টোদিকের একটা গলিতে গা ঢাকা দিলেন। ততক্ষণে আশেপাশের বাড়ি থেকে অনেক লোক বেরিয়ে এসেছে। দেখলাম গৌরবাবু সেই ভিড়ের সুযোগ নিয়ে আস্তে আস্তে পালিয়ে গেলেন। আমিও ধীরে ধীরে স্টেশনের পথ ধরলাম।’

‘এই অব্দি তো ভালই বোঝা গেল। প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি শেয়ালদা স্টেশনে গৌরবাবুকে দেখে তাকে ধাক্কা মারলে কেন?’

নূপুর খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর যখন কথা বলতে শুরু করল তখন তার গলার স্বর একেবারে পালটে গেছে। সে ঘোলাটে গলায় বলল, আদিত্যদা, তুমি যখন এতই জান, তখন এটাও নিশ্চয় খবর নিয়ে জেনেছ যে আমার ছোটবেলায় আমার বাবা আমার মাকে খুন করেছিল। সেই থেকে আমার একটা অসুখ হয়েছে। যদি কোথাও দেখি কোনও পুরুষ কোনও মহিলার গায়ে হাত তুলছে, আমার মাথায় খুন চেপে যায়। তোমার কাছে স্বীকার করছি, ওই লোকটাকে আমি মেরেই ফেলতে চেয়েছিলাম। নেহাত কপালজোরে ও বেঁচে গেছে।’ নূপুর মণ্ডলের সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল।

(৫)

‘আপনার কাছে আমার অনেক অনেক ঋণ। আপনি চন্দ্রাকে বাঁচিয়েছেন। আপনি না থাকলে মেয়েটা মরেই যেত।’ কেয়া বাগচি কফির কাপে চুমুক দিল।

একটু আগে পার্ক স্ট্রিটের একটা বনেদি চিনে রেস্তোঁরায় মধ্যাহ্নভোজন সমাপ্ত করে তারা এখন যেখানে কফি খেতে এসেছে সেখানকার কেক-পেস্ট্রি বিখ্যাত। রোববারের সকালে ব্রেকফাস্ট খাবার জন্য এখানে লম্বা লাইন পড়ে। এই শনিবারের দুপুরে অবশ্য রেস্তোঁরা প্রায় ফাঁকা। মিষ্টি ছাড়া কেয়া বাগচি ভোজন সমাপ্তির কথা ভাবতেই পারে না। তাই এখানে আসা। ব্ল্যাক ফরেস্টের পর কফি। আদিত্য অবশ্য দার্জিলিং চা খাচ্ছিল।

‘বললে বিশ্বাস করবেন না, এখন চন্দ্রাই আমার একমাত্র বন্ধু।’ কেয়া বাগচি আবার কফির কাপে চুমুক দিল।

‘সে কী? ফেসবুকে আপনার বন্ধুর সংখ্যা তো দেখলাম গিনিস বুকে ওঠার মতো।’ আদিত্য অকৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করল।

‘না, না। তারা কেউ বন্ধু নয়, পরিচিত মাত্র। আগে অনেকে বন্ধু ছিল। এখন সংসারে জড়িয়ে পড়েছে। যোগাযোগই রাখে না। আমি তাদের দোষ দিই না।’

‘সেদিক থেকে দেখলে অবশ্য চন্দ্রার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বের কারণটা বোঝা যায়। আপনাদের দুজনের কেউই সংসার করেননি।’

‘আমরা কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাপারেই আলাদা। আমি বেশি কথা বলি, চন্দ্রা চুপচাপ। আমি সিনেমা পত্রিকা আর ফিজিক্সের পাঠ্যবই ছাড়া কিচ্ছু পড়ি না, চন্দ্রা নানা কিছু পড়ে—ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, পপুলার সায়েন্স। আমি সাজগোজ করতে ভালবাসি, চন্দ্রা একটা হালকা লিপস্টিক পর্যন্ত লাগায় না।’

‘সেটাই আমার আশ্চর্য লাগে। চন্দ্রা না হয় ছোট বয়েস থেকেই ইন্টেলেকচুয়াল। কিন্তু আপনাকে দেখে তো একেবারে স্বাভাবিক মনে হয়। আপনি সংসার করেননি কেন?’

‘ইন্টেলেকচুয়ালরা বুঝি স্বাভাবিক হয় না?’ আদিত্যর মনে হল কেয়া বাগচি তার প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। আদিত্য আর ওই প্রসঙ্গে না গিয়ে চুপ করে রইল।

একটু পরে কেয়া বাগচি নিজে থেকেই বলল, ‘সংসার শুরু করার একটা সময় থাকে। কোনও কারণে সেই সময়টা পেরিয়ে গেলে আর ওটা হয়ে ওঠে না। তখন কোনও কমিটমেন্টে যেতে ভয় করে। আপনার তো ব্যাপারটা জানা উচিত। আপনিও তো সংসার করেননি।’

আদিত্য মনে হল কথাটা মিথ্যে নয়। সে মুখে বলল, ‘আমার কথা ছেড়ে দিন। আমার চাল নেই চুলো নেই। আয়ের স্থিরতা নেই।’

‘তাহলে গার্গীকে আপনার বন্ধু রত্না কেন বলেছিল আপনি পাগলের মতো আমার প্রেমে পড়ে গেছেন?’ কেয়া বাগচি সরাসরি আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বুলেটের মতো প্রশ্ন করল। সে মিটিমিটি হাসছে।

আদিত্য বিপাকে পড়েছে। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘আসলে ওরকম কিছু না বললে রত্না তাড়াতাড়ি আপনার খবরটা এনে দিত না। অথচ আপনি কেন বিয়ে করেননি এটা জানা তদন্তের স্বার্থে আমার একান্তই দরকার ছিল। আমি ভাবছিলাম, হয়ত আপনার কোনও বন্ধু আছেন যিনি সামনে আসেন না। আর যদি তাই হয়, কেন সামনে আসেন না? তিনি মাওবাদী দলটার সঙ্গে যুক্ত নন তো? চন্দ্রার অন্তর্ধানের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই তো? সত্যি বলতে কি, কোনও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আপনি যুক্ত আছেন এটা ভাবতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাই গার্গী যখন জানাল সে আপনার বন্ধুকে অনেকবার দেখেছে, আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।’

‘তাহলে কি ধরে নেব শুধু তদন্তের স্বার্থে নয় অন্য কোনও কারণেও আপনি আমার অতীতটা জানতে চেয়েছিলেন?’ কেয়া বাগচি প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

আদিত্য কেয়ার দিকে তাকাল। কেয়া আজ খুব সেজেছে। লাল শাড়ি। কপালে বড় লাল টিপ। কিন্তু পারফিউমটা বদলাল কেন? আদিত্যর মনে হল, বড় দেরি হয়ে গেছে। সে মুখে বলল, ‘আপনি তো প্রথম দিনই বলেছিলেন আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম। বন্ধুর জন্যে বন্ধুর কষ্ট হবে না?’

মাস তিনেক পরের কথা। আদিত্যকে দুপুরে খাবার নেমন্তন্ন করেছিল চন্দ্রা। খাওয়ার পরে সে আর আদিত্য চন্দ্রাদের দোতলার মস্ত বারান্দায় বসে গল্প করছিল। এখন আলিপুরের বাড়িতে চন্দ্রা একাই থাকে। তার সৎমা কমলিকা সেন পাকাপাকিভাবে হাজারিবাগ চলে গেছেন। চন্দ্রা তাঁকে অনেকবার থাকতে বলেছিল। বলেছিল, আইনত এই বাড়িতে সারা জীবন থাকার অধিকার তাঁর আছে। তিনি রাজি হননি। আলিপুরের বাড়ির একতলায় চন্দ্রা গরিব মেয়েদের জন্য একটা ইস্কুল খুলেছে। তাদের সে ইংরেজি আর অঙ্ক শেখায়। চেতলা এবং মোমিনপুরের বস্তি থেকে অনেক ছোট ছোট মেয়ে চন্দ্রার ইস্কুলে পড়তে আসে।

আদিত্য বলছিল, ‘তুই রাজসাক্ষী হতে রাজি থাকলে পুলিশ তোর বিরুদ্ধে কোনও কেস আনবে বলে মনে হচ্ছে না। গৌতম অন্তত আমাকে তাই বলল। তোর মাথা থেকে অভিজিৎ সিং-এর ভূত নেমেছে? বিপ্লবের ভূত?’

চন্দ্রা মাথা নিচু করে রইল, উত্তর দিল না। চন্দ্রার অস্বস্তি দেখে আদিত্য প্রসঙ্গ পালটাল। জিজ্ঞেস করল, ‘এতদিন পরে কলকাতায় সেটল করে তোর কেমন লাগছে?’

‘প্রথম একমাস তো নস্টালজিয়ার সমুদ্রে ডুবে ছিলাম।’ চন্দ্রা এতক্ষণে কথা বলল। ‘টেরই পেলাম না কোথা দিয়ে একমাস কেটে গেছে। এখন একটু একটু করে ধাতস্থ হচ্ছি। আর যত ধাতস্থ হচ্ছি তত মনে হচ্ছে একটা ভালগার আরামে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছি। তাই নিয়ে মনে পাপবোধের শেষ নেই। এসব নিয়ে বেশি না ভাবার চেষ্টা করছি।’

‘করছিস কী এখন? সময় কাটাস কী করে?’

‘কী করছি? অ্যানারকিস্টদের লেখা পড়ছি। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি সমাজ পড়ছি। গান্ধী পড়ছি। থারো পড়ছি। প্রপোটকিন পড়ছি। নিজের মতো করে একটা রাস্তা হাতড়ে হাতড়ে বার করার চেষ্টা করছি। ভায়োলেন্স-এ বিশ্বাস চলে গেছে। এখন সমাজতন্ত্রেও আর তেমন বিশ্বাস নেই। ব্যক্তিমানুষকে বাদ দিয়ে যে কিছু হয় না, এই বিশ্বাসটা ক্রমশ মনের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছে।’

‘চন্দ্রা, তুই আর বদলালি না। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে যেমন আঁতেল ছিলি তেমনই রয়ে গেলি। জানিস তো আঁতেল মেয়েদের বিয়ে হয় না।’ আদিত্য আবহাওয়াটা লঘু করে দিতে চাইল।

‘বিয়ে আর আমার হল কই? আরে, বিয়ের কথায় মনে পড়ল। আসল কথাটাই তো বলতে ভুলে গেছি। অ্যামেরিকা থেকে কৃশানু মুখার্জী, মানে আসল কৃশানু মুখার্জী, বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। বলল, তোর সঙ্গে কথা হয়েছে।’

‘এটা আসল কী করে বুঝলি? আগেরটার মতো নকলও তো হতে পারে।’

‘আরে না, না। এটা একেবারে আসল কৃশানু। আমি কথা শুনেই বুঝতে পেরেছি। ঠিক আগের মতোই ম্যাদামারা আছে। মুখে গদগদ প্রেম। তোমাকে ছাড়া কী করে এতদিন কাটালাম ঈশ্বরই জানেন। এবার আমাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না। এইসব ন্যাকা ন্যাকা কথা। জানিস তো ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে। কিন্তু যেই বললাম দেশে ফিরে এস, অমনি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, এতদিন এখানে আছি, অ্যামেরিকা ছেড়ে কোথায় যাব? এত দুর্বল লোককে বিয়ে করা যায়?’

চন্দ্রা বড়বড় চোখে আদিত্যর দিকে তাকাল। আদিত্যর চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে হঠাৎ বলল, ‘সেইজন্যেই তো অভিজিতের মতো শক্তপোক্ত লোকের সঙ্গে ঝুলে পড়তে চেয়েছিলাম।’

চন্দ্রা মিটিমিটি হাসছে। চন্দ্রাকে এত প্রগলভ আদিত্য আগে কখনও দেখেনি। আদিত্যও মুচকি হেসে বলল, ‘ইন্টেলেকচুয়াল মেয়েরা একটু রাগেড পুরুষদের পছন্দ করে। দেখা যাচ্ছে, তুইও এক্সেপশান নোস।’

‘অভিজিতের কোন খবর পাওয়া গেল?’

‘এখন অব্দি পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। তবে আমি যতদূর জানি, পুরোদমে চেষ্টা চলছে।’

হঠাৎ চন্দ্রার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। যেন দরকারি কিছু মনে পড়েছে এমন মুখ করে সে বলল, ‘বাজে লোকের কথা ছাড়। একটা বিশেষ কারণে তোকে খেতে ডেকেছিলাম। তোকে একটা জিনিস দেবার আছে। তুই কিন্তু না বলতে পারবি না।’

চন্দ্রা ঘরের ভেতর উঠে গিয়ে টেবিলে বসল। একটু পরে ফিরে এল একটা চেক নিয়ে। আদিত্যর হাতে চেকটা দিয়ে বলল, ‘এটা তোর প্রফেশানাল ফি। তুই আমার জন্যে যা করেছিস তাতে এর থেকে অনেক বেশিই বোধহয় আমার দেওয়া উচিত ছিল।’

আদিত্য দেখল টাকার অঙ্কটা বিশাল। তদন্তের খরচ-টরচ বাদ দিয়েও এই টাকায় তার বছর খানেক চলে যাবে। সে গম্ভীর মুখে বলল, ‘থ্যাঙ্কস চন্দ্রা। থ্যাঙ্কস আ লট। টাকা নিতে না বলব কেন? না বলার বিলাসিতাটা কি আমি অ্যাফোর্ড করতে পারি? তাছাড়া এটা তো সত্যি যে আমি তোকে ঘোর বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করেছি।’ আদিত্য খানিকক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘টাকাটা পেয়ে আমার খুব উপকার হল রে।’

পরে চেকটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে সে স্বগতোক্তি করল, ‘গোয়েন্দা ব্যবসার যা অবস্থা চলছিল তাতে ভাবছিলাম গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে আলুর ব্যবসা করব। এখন মনে হচ্ছে আলুর ব্যবসার আইডিয়াটা কিছুদিন স্থগিত রাখা যায়।’

সন্ধেবেলা চন্দ্রার বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিনিবাস ধরার জন্যে আদিত্য যখন স্টেট ব্যাঙ্ক মোড়ের দিকে এগোচ্ছে তখন তার মনটা খুব ফুরফুরে লাগছিল। হাতে অনেক কাজ রয়েছে। কাল ব্যাঙ্কে গিয়ে চেকটা জমা দিতে হবে, বিমলকে আরও কিছু টাকা দিতে হবে, বলরামের ছেলের জন্যে পাঁচটা ইংরেজি এসে আর গোটা পঞ্চাশ ইংরেজি বাক্য রচনা লিখে দিতে হবে। এক ঝলক উত্তরের হাওয়া এসে আদিত্যর মুখে লাগছে। চলে যাবার আগে শীত আদর করছে তাকে। আদিত্য টের পেল, সে বেশ আছে।

সমাপ্ত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *