প্রথম পরিচ্ছেদ
(১)
‘পার্থপ্রতিম সান্যাল বলে কাউকে মনে আছে তোর? বলছে, আমাদের সময় প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স পড়ত। আমাদেরই ইয়ার। তোদের চেনে বলল। আরও অনেককে চেনে।’ আদিত্য চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে বলল।
‘ঠিক মনে করতে পারছি না। আসলে সায়েন্সের ছেলেদের সঙ্গে ততটা মেলামেশা ছিল না তো।’ অমিতাভ একটু ভুরু কুঁচকে খবর কাগজটা নামিয়ে রাখল। তারপর মুচকি হেসে রত্নার দিকে চোরা চোখে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘রত্নার হয়ত মনে থাকতে পারে। কলেজে পড়ার সময় ওর তো প্রধান কাজ ছিল ছেলেদের মাথা খাওয়া।’
রত্না চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিতে দিতে অমিতাভর দিকে মুখ তুলে কটমট করে তাকাল। বলল, ‘যত বয়েস বাড়ছে তত তোমার পচা রসিকতা বাড়ছে।’ তারপর আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার অন্তত পার্থপ্রতিম সান্যাল বলে কাউকে মনে পড়ছে না। তোর চেনা?’
সপ্তমী পুজোর সকাল। নিচে ঢাক বাজছে। অমিতাভ-রত্নাদের হাউসিং সোসাইটিতে বেশ জাঁকজমক করেই পুজো হয়। তবে অমিতাভ-রত্নারা পুজো-টুজোর মধ্যে খুব একটা নেই। পুজোতে কলকাতায় থাকলে তারা সারাদিন বাড়িতেই অলসভাবে সময় কাটায়। যে আলসেমিটা বছরের অন্য সময় তাদের কপালে জোটে না। সোসাইটির পুজোতে একমাত্র টুবলুই ওদের ফ্ল্যাটের প্রতিনিধি। এই বাড়িতে তার অনেক বন্ধু। সকাল থেকে রাত্তির অব্দি সে বন্ধুদের সঙ্গে পুজো মণ্ডপে হইহই করছে, দৌড়দৌড়ি করছে, চোর-চোর খেলছে। ষষ্ঠী থেকে দশমী অব্দি তার পড়াশোনা নেই। খুব মজা। আরও মজা এই কারণে যে, এবার পুজোর চার দিন আদিত্য তাদের বাড়িতে থাকবে। তার মানে রোজ রাত্তিরে আদিত্যকাকুর কাছ থেকে ভূতের গল্প শোনা যাবে।
‘আমারও ঠিক মনে নেই। তবে ফিজিক্স যখন বলছে তখন নিশ্চয় একসঙ্গে কেমিস্ট্রির পাস ক্লাশ করতাম। ও যাদের কথা বলল তাদের কাউকে কাউকে অবশ্য আমার বেশ ভালই মনে আছে।’
‘এতদিন পরে হঠাৎ এই পার্থপ্রতিম সান্যালটাকে পেলি কোথায়?’ অমিতাভ একটা পুজোসংখ্যা হাতে তুলে নিয়ে আলগোছে প্রশ্ন করল। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল, ‘কী যে সব ছাইভষ্ম লেখা বেরোয়, একবার উল্টে দেখতেও ইচ্ছে করে না।’
‘উল্টে দেখতে ইচ্ছে করে না তো হাতে নাও কেন?’ রত্না খরখরে গলায় বলল। পুজোসংখ্যাগুলো সে-ই পড়বে বলে কিনেছে।
আবার একটা যুদ্ধের উপক্রম দেখে আদিত্য তাড়াতাড়ি বলল, ‘আচ্ছা, পার্থপ্রতিম সান্যালকে না হয় তোদের মনে নেই। কিন্তু চন্দ্রলেখা সেনকে কি মনে আছে? সে-ও আমাদের ইয়ারে ফিজিক্স পড়ত।’
‘সকাল থেকে একটার পর একটা কী সব নাম বলে যাচ্ছিস? পার্থপ্রতিম সান্যাল, চন্দ্রলেখা সেন। একজনকেও চিনি না। এরা কারা?’ অমিতাভ উঠে দাঁড়াল। মনে হয়, সিডি প্লেয়ারে কিছু একটা বাজানোর মতলব কষছে।
‘অ্যাই এখন গান-টান নয়, শুধু আড্ডা হবে।’ রত্না ফতোয়া দিল। তারপর আদিত্যর দিকে ফিরে বলল, ‘চন্দ্রলেখা সেনকে আমার বেশ ভালই মনে আছে। সবাই চন্দ্রা বলে ডাকত। আমার পাড়ার বন্ধু পারমিতা, ওর সঙ্গে চন্দ্রা লরেটো হাউসে পড়ত। বেশ ভাল ছিল লেখাপড়ায়। আই এস সি-তে মেলা নম্বর পেয়েছিল।’
আদিত্য বলল ‘চন্দ্রাকে আমি অনেকটাই চিনতাম। আলিপুরে ওদের বাড়ির কাছেই ছিল আমাদের বাড়ি। ফার্স্ট ইয়ারে চন্দ্রার সঙ্গে আমার বেশ ভালই বন্ধুত্ব ছিল। মাঝে মাঝে এক সঙ্গে বাড়ি ফিরতাম, কখনও চন্দ্রাদের গাড়িতে, কখনও আমাদের। নিশ্চয় তোদের মনে আছে, কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে সাহেবি ইস্কুল থেকে আসা ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা বোকা-বোকা বন্ডিং থাকত। সেই নিয়মে আমারও চন্দ্রার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। পরে অবশ্য আর ততটা যোগাযোগ ছিল না।’
‘কলেজে পার্থর সঙ্গে চন্দ্রার একটা সম্পর্ক হয়েছিল। বেশ গভীর সম্পর্ক।’ আদিত্য কেজো গলায় বলল।
‘চন্দ্রার সঙ্গে কলেজে একটা ছেলের সম্পর্ক হয়েছিল এটা একটু একটু মনে পড়ছে। তবে ছেলেটার নামটা মনে নেই। কফি হাউসে ওদের একসঙ্গে অনেকবার দেখেছি। দুজনে কফি হাউসের দোতলায় এক কোণে নেই হয়ে বসে থাকত আর মাঝে মাঝে খুব নিচু গলায় কথা বলত। যেমন প্রেমিক-প্রেমিকারা বলে। কিন্তু ব্যাপারটা কি বলত? হঠাৎ চন্দ্রা আর তার বয়ফ্রেন্ডকে মনে পড়ল কেন?’
ধমক খেয়ে অমিতাভ আবার বসে পড়েছে। নিরীহভাবে বলল, ‘রত্না আর আমিও কিন্তু মাঝে মাঝে কফি হাউসের দোতলায় বসতাম।’
‘বসতামই তো।’ রত্না জোর গলায় বলল। ‘তখনই চন্দ্রাকে ছেলেটির সঙ্গে দেখেছি। তোমাকেও অনেকবার দেখিয়েছিলাম। তোমার মনে নেই কেন?’ শেষ কথাগুলো অমিতাভকে লক্ষ করে।
‘আমি কী আর তোমাকে ছাড়া কখনও অন্য কারও দিকে তাকিয়েছি?’ অমিতাভ মুখটা করুণ করে বলল।
‘আ হা হা, মরে যাই মরে যাই।’ ঠাট্টা হলেও আদিত্যর মনে হল রত্না একটু লজ্জা পেয়েছে। বোধহয় খুশিও হয়েছে। বিয়ের এত বছর পরেও যে ওদের মধ্যে সেই কলেজ জীবনের ছেলেমানুষি প্রেমটা বজায় আছে এটা আদিত্য টের পায়। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আর এক রাউন্ড চা হবে নাকি?’
‘এবার কফি হোক। কফি পান করতে করতে আদিত্য আমাদের পার্থ-চন্দ্রার উপাখ্যান শোনাবে।’ অমিতাভ বলল।
‘উপাখ্যানই বটে। রত্না কফির জলটা বসিয়ে আসুক, আমি তারপর শুরু করছি। কিন্তু তার আগে বারান্দায় গিয়ে একটু বিষপান করে আসি।’ আদিত্য সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই নিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়াল।
একটু পরে যখন আদিত্য ফিরে এল তখন বসার ঘরের সেন্টার টেবিলে কফি এসে গেছে, সঙ্গে কিছু নানখাটাই বিস্কুট। আদিত্য জানে, আসল নানখাটাই আজকাল প্রায় পাওয়াই যায় না। পার্ক সার্কাসের এক বৃদ্ধ মুসলমানের বেকারি থেকে এ-বাড়িতে মাসে একবার কি দুবার সত্যিকারের নানখাটাই বিস্কুট আসে। সে একটা বিস্কুটে কামড় দিয়ে বলতে শুরু করল,
‘সপ্তাহ দুয়েক আগে একটু রাত্তিরের দিকে একটা ফোন পেলাম। মোবাইলে যে নম্বরটা ফুটে উঠল সেটা দেখে মনে হল ফোনটা বিদেশ থেকে আসছে। ভাবলাম, রং নাম্বার। ওপারের কণ্ঠস্বর অবশ্য আস্বস্ত করল ফোনটা আমারই। পুরুষের গলা, উচ্চারণটা একটু কৃত্রিম। অনেকদিন বিদেশে থাকলে কোনও কোনও বাঙালির যেমন হয়। ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, এটা কি আদিত্য মজুমদারের নম্বর? আমি হ্যাঁ বলাতে বাংলায় বলল, আমার নাম পার্থপ্রতিম সান্যাল। প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্স পড়তাম। আমাকে কি চেনা যাচ্ছে? কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করেও পার্থপ্রতিম সান্যালকে চিনতে পারলাম না। বললাম, ঠিক মনে পড়ছে না। সে বলল, আমার কিন্তু তোকে বেশ ভালই মনে আছে। আমি অনির্বাণ রায়, সাহানা সরকারদের ক্লাশে পড়তাম। অবশ্য ওদের মতো লেখাপড়ায় অতটা ভাল ছিলাম না। ওই দুটো নামই আমার চেনা। বললাম, সামনা-সামনি দেখলে নিশ্চয় মনে পড়ে যাবে। কেমন আছিস? সে বলল, একটু গণ্ডগোলের মধ্যে আছি রে। সেইজন্যেই তোকে ফোন করা। কিছুক্ষণ কথা বলার সময় হবে? আমি বললাম, নিশ্চয় হবে। পার্থ বলল, সে একটা বিচ্ছিরি সমস্যায় পড়েছে। বললাম, কী সমস্যা? ও বলল, চন্দ্রলেখা সেনকে মনে আছে? আমাদের সঙ্গেই পড়ত? আমরা যাকে চন্দ্রা বলতাম? আমি বললাম খুব মনে আছে। ও বলল, সমস্যাটা চন্দ্রাকে নিয়ে। পার্থকে কেউ বলেছে যে আমি এখন একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। দুএকটা কেস সলভ করে খানিকটা সুনামও আমার হয়েছে। তাই পার্থ আমার সাহায্য চায়। ফোনটা পার্থ অ্যামেরিকা থেকে করছিল। বলল, আগামী সপ্তাহে ও কলকাতায় আসছে। তখন ওর সমস্যাটার কথা আমাকে বলবে। একটা তারিখ এবং সময় ঠিক করা হল যেদিন আমাকে ওর হোটেলে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
আদিত্য একটু থেমে কফির কাপে চুমুক দিল। আর একটা বিস্কুট হাতে নিয়ে বলল, ‘এই বিস্কুটগুলো একেবারে ইরেজিস্টেবল। সামনে থাকলেই খেতে ইচ্ছে করে। রত্না, তুই বিস্কুটগুলো সামনে থেকে সরা। নাহলে একটার পর একটা খেয়ে যেতে হবে। দুপুরে তোর বাগদা চিংড়ির মালাইকারি খেতেই পারব না।’
রত্না বিস্কুটের প্লেটটা সাইড টেবিলে সরিয়ে রেখে বলল, ‘তোকে আর বিস্কুট খেতে হবে না। তুই গল্পটা বল।’
এক চুমুকে কফিটা শেষ করে আদিত্য আবার শুরু করল, ‘এয়ারপোর্টের কাছেই হোটেল। কথা মতো নির্দিষ্ট দিনে দুপুরবেলা পৌঁছে গেলাম। পার্থ বলেছিল সুইমিং পুলের ধারে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। বেজায় মুটিয়েছে। মাথায় চুল প্রায় নেই। ভারসাম্য রক্ষার জন্য থুতনি জুড়ে গোটি রেখেছে। পার্থর সঙ্গে লাঞ্চ খেলাম। পুরোনো বন্ধুদের কথা হল। পার্থ কুড়ি বছরেরও বেশি দেশে নেই। তাই কে কোথায় ছড়িয়ে গেছে কিছুই জানে না। তারপর সে আসল কথায় এল। সুইমিং পুলের ধারে বসে অনেকক্ষণ তার সঙ্গে কথা হল। টুকরো টুকরো কথা থেকে যে গল্পটা খাড়া করা গেল সেটা আসলে একটা প্রেমের গল্প। তবে মিলনান্ত না বিয়োগান্ত এখনই বোঝা যাচ্ছে না। অদরকারি জিনিসগুলো বাদ দিয়ে আমি মোদ্দা ব্যাপারটা বলছি। রত্না ঠিকই বলেছে, কলেজে পড়ার সময় পার্থর সঙ্গে চন্দ্রার গভীর প্রেম হয়েছিল। দুজনের ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু একেবারে আলাদা। চন্দ্রার বাবা-ঠাকুর্দা বিলেত ফেরত লইয়ার, আলিপুরে বিশাল বাড়ি, চন্দ্রা কলেজে যাওয়া-আসা করে বাড়ির গাড়িতে। বর্হিজগত সম্বন্ধে তার ধারণা খুবই সামান্য। উল্টোদিকে পার্থ মফস্বলের ছেলে, বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। তার বাবা বেসরকারি আপিসের কেরানি, দেশভাগের পর কপর্দকহীন অবস্থায় এপারে চলে এসেছিলেন। পার্থ যখন কলেজে পড়ছে তখন তার মাথার ওপর একজন অবিবাহিত দিদি, বাবার চাকরিও খুব বেশি বাকি নেই।’
কলিং বেল বাজল। টুবলু বাড়ি ফিরেছে। তার জল তেষ্টা পেয়েছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতল বার করে ঢকঢক করে খানিকটা খেয়ে বোতলটাকে টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে টুবলু ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল। রত্না কিছু বলারই সময় পেল না। অমিতাভ রত্নার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘চান করেছে?’
‘সকালে জোর করে ভাগ্যিস চানটা করিয়ে দিয়েছিলাম। যেভাবে ঠান্ডা জল খেল, আবার গলা ব্যথা শুরু হবে। আমি আর কী করব?’ খানিকক্ষণ থেমে রত্না আদিত্যর দিকে ফিরে বলল, ‘তারপর কী হল বল।’
‘ভাইবোনের মধ্যে পার্থই ছিল বেশি মেধাবী। জেলা ইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল। কলকাতায় যখন হিন্দু হস্টেলে থাকত তখন স্কলারশিপের ওপরেও তিন-চারটে টিউশন করে বাড়িতে টাকা পাঠাত। বলতে গেলে, পুরো পরিবারটাই তাকিয়ে থাকত পার্থর দিকে।’
‘এরকম অসম অবস্থায় প্রেম হল কী করে?’ এবার অমিতাভর প্রশ্ন।
‘সেটাই বলতে যাচ্ছি। চন্দ্রা যখন ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে তখন তার মা হঠাৎ মারা যান। হার্ট অ্যাটাক, একেবারে আনএক্সপেকটেড। চন্দ্রার মা মারা যাবার মাস ছয়েকের মধ্যে তার বাবা আবার একটা বিয়ে করেন। শোনা যায়, চন্দ্রার সৎমায়ের সঙ্গে চন্দ্রার বাবার বেশ কিছুদিন ধরেই লটরপটর চলছিল এবং সেটা কেন্দ্র করেই চন্দ্রার মায়ের অশান্তি, হৃদরোগ এবং অকালমৃত্যু। সে যাই হোক, মায়ের মৃত্যুর পর চন্দ্রার জীবনটা একেবারে বদলে গেল। সৎমায়ের সঙ্গে তার কোনদিনই বনেনি, বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পর বাবার সঙ্গেও সম্পর্কটা খুব দূরের হয়ে গেল। বাড়িতে চন্দ্রার নিজের বলতে আর কেউ রইল না। এই সময়েই পার্থ সান্যালের সঙ্গে তার সম্পর্কটা তৈরি হতে শুরু করে।’
আবার কলিং বেল। না, এবার টুবলু নয়। ফ্ল্যাটের দুজন কিশোরী, সপ্তমীর সকালে সখ করে দুজনেই শাড়ি পরেছে। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে অভ্যাস নেই। তাদের মধ্যে লম্বা মেয়েটি এক পা এগিয়ে এসে রত্নাকে লক্ষ্য করে বলল,’কাকিমা, আজ দুপুরে তোমরা কতজন নিচে খেতে নামছ ?’
মেয়েটির সঙ্গিনী খাতা ডট পেন বার করে ফেলেছে। রত্না বলল, ‘আমরা কেউ আজ নিচে খাব না রে। শুধু টুবলু হাউসিং-এর বন্ধুদের সঙ্গে খেতে নামবে।’
‘তার মানে একজন।’ সঙ্গিনী খাতায় লিখে নিয়ে বলল, ‘আসছি কাকিমা।’
‘এত ঘন ঘন বেল বাজলে গল্প শোনা যায়?’ রত্না দরজাটা বন্ধ করতে করতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তারপর কী হল বল।’
আদিত্যর সত্যি সত্যি খেই হারিয়ে গিয়েছিল। খানিকটা ভেবে নিয়ে সে আবার বলতে শুরু করল, ‘চন্দ্রা নিজের বাবাকে ঘৃণা করার সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় সমগ্র বড়লোক জাতটাকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। এর ফ্লিপ সাইডটা হল, এই সময় থেকেই গরিবদের প্রতি তার একটা আশ্চর্য সহানুভূতি জন্মায়। হয়ত সেই কারণেই সে প্রথম পার্থ সান্যালকে নজর করেছিল। অন্তত পার্থর তাই ধারণা। প্রথম প্রথম ক্লাশ নোট মেলানোর অছিলায় চন্দ্রা পার্থর সঙ্গে কথা বলত, ভাব একটু জমলে কফিহাউস, সিনেমা, গঙ্গার ঘাট, ইত্যাদি ইত্যাদি। পার্থ বলছে, ইনিশিয়েটিভটা চন্দ্রার দিক থেকেই ছিল। প্রথম প্রথম পার্থ বরং একটু সংকোচ বোধ করত, ভয় পেত। সে নিজে অতি সাধারণ ঘরের ছেলে, মাথার ওপর অনেক দায়িত্ব। তার মনে হতো বড়লোকের সুন্দরী মেয়েদের থেকে দূরে থাকাই ভাল। তাদের কখন কী খেয়াল হয় বোঝা মুস্কিল। তারপর একটু একটু করে তার সংকোচ কাটল। চন্দ্রা তার ব্যক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডির কথা পার্থকে জানাল। তাই নিয়ে পার্থর মনে চন্দ্রার প্রতি একটা সিমপ্যাথি তৈরি হল। মনে হল, মেয়েটাকে একটা মানসিক প্রোটেকশন দেওয়া দরকার। সিমপ্যাথি থেকে প্রোটেকশন, প্রোটেকশন থেকে নৈকট্য, নৈকট্য থেকে প্রেম। কিছুদিনের মধ্যেই পার্থ-চন্দ্রার প্রেম বেশ জমে গেল।’
জানলা দিয়ে হঠাৎ এক ঝলক জোলো হাওয়া ঢুকে পড়েছে। জানলার দিকে তাকিয়ে রত্না বলল, ‘এ কী রে, বৃষ্টি হবে নাকি?’
অমিতাভ বলল, ‘বৃষ্টি হলে আড্ডাটা জমবে ভাল। তবে বাচ্চাগুলোর আনন্দ একেবারে মাটি হয়ে যাবে।’
আদিত্য জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখল একটা কালো মেঘ আকাশের একদিকটা ঢেকে ফেলেছে। সূর্যটাও মনে হচ্ছে শিগগির ঢাকা পড়ে যাবে। বৃষ্টির সম্ভবনা দেখলে এই বুড়ো বয়সেও তার মনটা মেঘদূতের কামার্ত যক্ষের মতো উড়ু উড়ু করে। আর মনটা উড়ু উড়ু করলেই তার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে। এই ঘরে যেহেতু সেটা সম্ভব নয় তাই ইচ্ছেটাকে শাসন করে সে আবার বলতে লাগল, ‘আর একটা ব্যাপার পার্থ-চন্দ্রার প্রেমে ক্যাটালিস্টের কাজ করেছিল। সেটা হল অতি বাম মাওবাদী রাজনীতি। পার্থ তার বাবার কাছ থেকে কিছু বামপন্থী বিশ্বাস ইনহেরিট করেছিল। ফলে কলেজে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই সে বেশ সক্রিয়ভাবে অতি বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। চন্দ্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর সে তার বাম বিশ্বাসগুলোর কথা মাঝে মাঝেই চন্দ্রাকে বলত। খুব বেশি বলতে হয়নি, চন্দ্রাও কয়েকদিনের মধ্যে কলেজের মাওবাদীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল, রাজনীতির মধ্যেই এক ধরনের সোলেস, বলা যায়, বেঁচে থাকার একটা সার্থকতা, খুঁজে পেল যার ভেতর কাঁচা বয়েসের আবেগ তো ছিলই কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল নিজের বাবার প্রতি তার তীব্র ঘৃণা।’
রত্না একটু ব্যাঙ্গের সুরে বলল, ‘একটা দিনের কথা আমার বেশ মনে আছে। আমরা তখন বি এ পাশ করে গেছি। এম এ পড়ি। চন্দ্রারও এম এস সি পড়ার কথা। কী একটা কারণে কলেজে এসেছিলাম। ও মা! দেখি, চন্দ্রা দলবল নিয়ে প্রিন্সির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে। নেত্রী-নেত্রী ভাব। আমাকে দেখেও দেখল না।’
‘তোর ইম্প্রেশনটা পার্থর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এম এস সি পড়ার সময় চন্দ্রা রীতিমত নেত্রী হয়ে গেছে। কিন্তু তার আগে কী হয়েছিল বলি। থার্ড ইয়ারে পৌঁছে পার্থর মনে হল, রাজনীতিটা তার জন্য নয়। তার মাথার ওপর অনেক দায়িত্ব। বাবা, মা, দিদি সকলে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাছাড়া বিজ্ঞানচর্চা করতে তার বেশ ভালোই লাগে। অথচ দুএকটা বছর প্রেম এবং রাজনীতির চাপে লেখাপড়া কিছুই করা হয়নি। অতএব এবার তাকে উঠে পড়ে লাগতে হবে। সে একটু একটু করে রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করতে লাগল। মজার ব্যাপার হল, পার্থ যত রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে, চন্দ্রা ততই গভীরভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়। যেন রাজনীতিটাই তার জীবন, অন্য সব কিছু গৌণ। বিএসসিতে পার্থ বেশ ভালই রেজাল্ট করল, চন্দ্রা একেবারে কান ঘেঁষে একটা ফার্স্ট ক্লাশ। তোদের নিশ্চয় মনে আছে ফিজিক্সে প্রায় সকলেই ফার্স্ট ক্লাশ পেত, অন্তত আমাদের কলেজে, তাই চন্দ্রার রেজাল্টটা সাদামাটাই বলতে হবে। সে যাই হোক, পার্থ এমএসসি পড়তে কানপুর আই আই টি চলে গেল, চন্দ্রা রয়ে গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই থেকে পার্থ আর চন্দ্রার ছাড়াছাড়ির শুরু।’
(২)
একটু জিরিয়ে নেবার জন্য আদিত্য কিছুক্ষণ থামল। বাইরে বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। ঘরে ছাঁট আসছে। সঙ্গে জোলো হাওয়া। আদিত্য জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, বাইরের ছবিটা হঠাৎ বদলে গেছে। যেন ম্যাজিক। ‘সকালবেলার বাদল আঁধারে’ শরতের ঝলমলে রোদ্দুর উধাও। তার জায়গায় পরিপূর্ণ বৃষ্টির একটা দিন। শুধু খুব দূর থেকে মাইকের শব্দ ভেসে এসে মনে করিয়ে দিচ্ছিল আজ পুজো। না হলে সেটাও মনে থাকত না। আদিত্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। ‘সকালবেলার বাদল আঁধারে’ গানটা পুরোনো কার গলায় শুনেছিল? সম্ভবত কনক বিশ্বাস।
অমিতাভ উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘পুজোটা একেবারে মাটি করে দিল রে। কোনও মানে হয়?’
আদিত্য তখনও অন্যমনস্ক। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
রত্না অসহিষ্ণু গলায় বলল, এই রে, মরেছে। আকাশে মেঘ দেখে আদিত্যর মনে ভাব এসেছে।’ তারপর গলাটা একটু তুলে ধমকের সুরে বলল, ‘এই আদিত্য, তুই গল্পটা বলবি? নাকি আকাশের দিকে চেয়ে থাকবি?’
রত্নার তাড়া খেয়ে আদিত্য আবার বলতে শুরু করল, ‘পার্থ যখন কানপুরে, তখন চন্দ্রা একটা অ্যাকটিভ মাওবাদী দলের সঙ্গে ভালো মতোই জড়িয়ে পড়েছিল। আমরা কলেজে যেরকম মাওবাদী দেখতাম, এরা ঠিক সেরকম গণসঙ্গীত গাওয়া, কফি হাউসে তর্ক জমানো, বড় জোর প্রিন্সিকে ঘেরাও করা নিরীহ টাইপের মাওবাদী নয়। পার্থর ধারণা, এই দলটা বিপ্লবের ছুতোয় মানুষ-টানুষ মারত। পুরুলিয়া-ঝাড়খন্ড বর্ডারে অ্যাকশন করত। দলের অনেকে জঙ্গলে অ্যাবস্কন্ড করে থাকত। একেবারে পুরোদস্তুর উগ্রপন্থীদের একটা দল। কী করে এদের সঙ্গে চন্দ্রার যোগাযোগ হল সেটা অবশ্য পার্থ জানে না। এমএস সি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চন্দ্রা পুরুলিয়ায় সাঁওতালদের গ্রামে লেখাপড়া শেখাতে যেত, তাদের ছোটখাট অসুখ-বিসুখে ওষুধপত্র দিত, নানারকম পরামর্শ দিত, কখনও অল্পস্বল্প টাকা-পয়সা। হয়ত তখনই ওদের সঙ্গে চন্দ্রার যোগাযোগ হয়। কিংবা হয়ত যোগাযোগটা আগেই হয়েছিল, এবং যোগাযোগ হবার পর ওরাই চন্দ্রাকে পুরুলিয়ায় কাজ করতে পাঠিয়েছিল। দল চন্দ্রাকে দিয়ে আর কী কী করাতো সেসব ডিটেল পার্থ জানে না। তবে ওই দলটার সঙ্গে যে চন্দ্রার ভাল মতোই যোগাযোগ ছিল, সে-ব্যাপারে পার্থ নিশ্চিত। ছুটিছাটায় পার্থ যখন বাড়ি ফিরত তখন চন্দ্রার সঙ্গে দেখা করার জন্য কলকাতাতেও আসত। হাতে হাজার কাজ থাকলেও চন্দ্রা সব কাজ ফেলে পার্থর সঙ্গে দেখা করত। দেখা হওয়াটা অবশ্য ইনভেরিয়েবলি তর্কাতর্কি, কথা কাটাকাটি পর্যন্ত গড়াত। দুজনেই দুজনকে বোঝানোর চেষ্টা করত যে তার পথটাই ঠিক, অন্যজনেরটা ভুল। এইভাবে পার্থ আর চন্দ্রার মধ্যে একটা ড্রিফট তৈরি হচ্ছিল, একটু একটু করে তারা একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। আবার এটাও ঠিক যে ভেতরে ভেতরে তাদের পরস্পরের প্রতি খুব গভীর একটা টান তখনও রয়ে গিয়েছিল।
‘এম এস সি পাস করার পর পার্থ পি এইচ ডি করার জন্য অ্যামেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে একটা ভাল স্কলারশিপ পেল। সে চন্দ্রাকেও তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইল। স্কলারশিপের টাকায় দুজনের মোটামুটি চলে যাবে। তারপর সুযোগ বুঝে চন্দ্রাও নয় কোথাও একটা পি এইচ ডি প্রোগ্রামে ঢুকে পড়তে পারবে। চন্দ্রা রাজি হল না। সমাজ বদলে দেবার ভূত তখন পুরোপুরি তার মাথায় বাসা বেঁধে রয়েছে। অ্যামেরিকা যাওয়া মানে দেশের গরিব লোকগুলোকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া, অ্যামেরিকা যাওয়া মানে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়া, চন্দ্রা তখন বিশ্বাস করে অ্যামেরিকার ক্যাপিটালিস্টরা সারা পৃথিবীর মানুষকে শোষণ করছে। সে দেশে কি যাওয়া যায়? পার্থ অ্যামেরিকা চলে যাবার আগের দিন সে পার্থকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করল, যেটা তার একেবারে স্বভাববিরুদ্ধ, কিন্তু নিজের বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়ল না। পার্থর চোখও ভিজে। সে চন্দ্রাকে অঙ্গীকার করল পড়াশোনা শেষ হলেই দেশে ফিরে আসবে।’
‘জম্পেশ ফেঁদেচিস কিন্তু গল্পটা। তুই গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে পট বয়লার লিখলে পারতিস।’ অমিতাভ ফোড়ন কাটল।
‘খালি বাজে কথা। তুমি থামবে?’ রত্না তার স্বামীকে মুখ ঝামটা দিল। সে গল্পটাতে বেশ রস পেয়ে গেছে। বলল, ‘তারপর?’
‘তারপরের কুড়ি বছর ঠিক কী ঘটেছিল পার্থ জানে না। মানে, পার্থর জীবনে কী ঘটেছিল সেটা নয়, চন্দ্রার জীবনে কী ঘটেছিল সেটার কথা বলছি। পার্থ বিদেশ যাবার পর আস্তে আস্তে চন্দ্রার সঙ্গে তার যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। হবার কথাই ছিল। যখনকার কথা বলছি, তখন টেলিফোন এত সস্তা হয়নি। ইমেল অবশ্য এসে গেছে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই চন্দ্রা প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ায় যেখানে তার ইমেল অ্যাক্সেস থাকার প্রশ্নই ওঠে না। সব থেকে বড় কথা, দুজনের মানসিকতায়, ভাবনা-চিন্তায় দিন দিন যে তফাতটা তৈরি হচ্ছিল সেটা আর জোড়া দেওয়া সম্ভব ছিল না।
‘এদিকে পার্থর জীবন তখন অন্য খাতে বইছে। বছর দুয়েক ফিজিক্স পড়ে সে বুঝল ফিজিক্সের বাজারটা অত্যন্ত কম্পিটিটিভ। ওখানে টিকে থাকতে গেলে পি এইচ ডির পর অনেকদিন পোস্টডক করতে হবে, প্রচুর পেপার-টেপার ছাপাতে হবে, তারপর যদি একটা পাকাপাকি ফ্যাকাল্টি পোজিশন পাওয়া যায়। কিন্তু অতদিন তার পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। বাড়ির সবাই তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দিদির তখনও বিয়ে হয়নি। বাবা রিটায়ার করেছে। বাবা এক্সপেক্ট করে পার্থই সংসারের হাল ধরবে। কর্নেলে দুবছর ফিজিক্স পড়ার পর পার্থ একটা বড় ডিসিশন নিল। ক্যানাডার মনট্রিয়ল শহরের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে ফিন্যান্স-এ পিএইচ ডি করার জন্য একটা জলপানি জোগাড় করে বিষয়, ইউনিভার্সিটি এবং দেশ তিনটেই পাল্টে ফেলল। মোটামুটি বুদ্ধিশুদ্ধি থাকলে, খানিকটা অঙ্ক জানলে আর কিছুটা কম্পিউটারের কোড লিখতে পারলে ফিন্যান্সে চড়চড় করে উন্নতি করা যায়। পার্থর তিনটে গুণই ছিল, তাই খুব তাড়াতাড়ি সে উন্নতি করল। বছর চারেকের মধ্যে পি এইচ ডি শেষ, পি এইচ ডি শেষ করে আবার মার্কিন দেশ, এবার কর্পোরেট সেক্টর, বিস্তর মাইনে, বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাতেও অসুবিধে নেই। এর কিছুদিন পরে স্টেফানি ম্যাকার্ডি বলে এক মার্কিনি মহিলার সঙ্গে পার্থর সম্পর্ক হয়। এতদিন চন্দ্রলেখা সেন যদি বা তার মনের এক কোণে একটুখানি জায়গা জুড়েছিল, স্টেফানির সঙ্গে আলাপ হবার পর সেটুকু জায়গাও আর রইল না।’
‘এই বিচ্ছিরি গল্পটা বলার জন্য তুই এতক্ষণ সময় নষ্ট করলি? এর থেকে অমিতাভর খেয়াল গানের সিডিও ভাল ছিল।’ রত্না বেশ রেগে গেছে। বিয়োগান্ত গল্প তার একেবারে পছন্দ নয়।
‘আরে দাঁড়া না। গল্প এখনই শেষ হয়েছে নাকি?’ আদিত্য রত্নাকে আশ্বস্ত করল। ‘তবে অনেকক্ষণ বকবক করেছি। একটা সিগারেট এবার খেতেই হবে। আমি বারান্দা থেকে সিগারেটটা খেয়ে আসি। তুই বরং আরেক প্রস্থ চায়ের ব্যবস্থা কর।’
‘সেই ভাল। আর একবার চা হোক।’ অমিতাভ চায়ের প্রস্তাবকে পূর্ণ সমর্থন জানাল।
বারান্দায় এসে আদিত্য দেখল বৃষ্টি একেবারে থেমে গেছে। ঝলমলে রোদ্দুর উঠেছে আবার। শরৎকালের বৃষ্টি বেশিক্ষণ চলার কথাও নয়। তবে অল্প সময়ের জন্য হলেও বৃষ্টির বেগটা ছিল মারাত্মক। রাস্তার ওপর বৃষ্টি তার চিহ্ন রেখে গেছে। জায়গায় জায়গায় জমা বৃষ্টির জল। তার মধ্যেই ভীড় বাড়ছে রাস্তায়। এক ঝলক তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায় ভীড়ের বেশিরভাগ মফস্বলের মানুষ। ঠাকুর দেখতে কলকাতায় এসেছে। এরা বৃষ্টির সময় কোথায় ছিল কে জানে। হয়ত কোনও দোকানে বা গাড়িবারান্দার নিচে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছিল। সিগারেটে আরও দুটো-তিনটে সুখটান বাকি আছে, এমন সময় ঘর থেকে অমিতাভ ডাকল, ‘চলে আয়, চা এসে গেছে।’
চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে আদিত্য আবার শুরু করল, ‘কিছুদিন একসঙ্গে বসবাস করার পর পার্থ স্টেফানিকে বিয়ে করল। মেম বউ নিয়ে একবার দেশেও এসেছিল সে। তবে চন্দ্রার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। আসলে, চন্দ্রার সামনা-সামনি দাঁড়ানোর সাহস তো দূরের কথা, চন্দ্রা কোথায় থাকে, কী করে সেটুকু খোঁজ নেবার মতো নৈতিক জোরও তার ছিল না। বস্তুত, নিজের বিশ্বাসঘাতকতা ঢাকা দেবার জন্য সে চন্দ্রাকে একেবারে ভুলে যেতে চেয়েছিল। যাই হোক, মেমসাহেবের সঙ্গে পার্থর বিয়েটা বছর দশেক টিকেছিল। তারপর ডিভোর্স। ভাগ্যক্রমে ওই বিয়েতে পার্থর কোনও বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। বিয়ে ভেঙে যাবার কিছুদিন পর থেকে পার্থ আবার একা-একা বোধ করতে লাগল। আবার তার চন্দ্রার কথা মনে পড়তে লাগল। তার মতো দুর্বল চরিত্রের পুরুষদের যেমন হয়।
‘একা থাকতে থাকতে পার্থর মনে হতো চন্দ্রার সঙ্গে আবার দেখা হলে সে তার সব দোষ স্বীকার করে নেবে। সব দোষ স্বীকার করে নিয়ে সে চন্দ্রাকে বলবে তার আর যাবার কোনও জায়গা নেই। তাই সে চন্দ্রার কাছে ফিরে এসেছে। তখন চন্দ্রা কি তাকে ফিরিয়ে নেবে না? কিন্তু চন্দ্রার ঠিকানা বা ফোন নম্বর সে পাবে কোথায়?’
‘তুই যে এত সেন্টু দিয়ে গল্প বলতে পারিস আগে জানা ছিল না।’ অমিতাভ মুচকি হাসল।
‘আমি সেদিন পার্থর মুখে যা যা শুনেছি ঠিক সেটাই রিপিট করছি।’ আদিত্যকে রক্ষণাত্মক শোনাল।
‘তুমি আদিত্যর পেছনে লাগছ কেন? গল্পটা তো বেশ জমে উঠেছে। আদিত্য তুই বলে যা।’
‘বছর কয়েক এইভাবে কেটে যাবার পর, প্রায় অলৌকিকভাবে পার্থ চন্দ্রার টেলিফোন নম্বরটা পেয়ে গেল। কীভাবে পেল সেটা আরেকটা গল্প, আমাদের মূল গল্পের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। তাছাড়া সেই গল্পটা পার্থ আমাকে বলেওনি। তাই তার মধ্যে আর যাচ্ছি না। কেমন করে দুরুদুরু বুকে পার্থ একদিন চন্দ্রাকে ফোন করে ফেলল, অতদিন পরে পার্থর গলা শুনে চন্দ্রা কী বলল, আরও কতদিন সে অভিমান করে রইল, কেমন করে পার্থ তার অভিমান ভাঙাল এসবের ডিটেল বর্ণনা অবশ্য সেদিন পার্থ আমাকে দিয়েছিল। আমি সেসবের মধ্যেও যাচ্ছি না। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, পার্থর সঙ্গে চন্দ্রার আবার ভাব হয়ে গেল। পার্থ ঠিক করল দেশে ফিরে আসবে। ইতিমধ্যে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের একটা কন্সাল্টেন্সি ফার্ম শুরু করেছিল। তার অনেক ক্লায়েন্টই মাল্টিন্যাশানাল, তারা ভারতে ব্যবসা করে। পার্থ ঠিক করল তার হেড অফিসটা ব্যাঙ্গালোরে সরিয়ে আনবে। আস্তে আস্তে বিদেশের ব্যবসাটাও গুটিয়ে নিয়ে আসবে।’
‘এ তো পুরো হ্যাপি এন্ডিং। পার্থর সমস্যাটা তাহলে কী?’ রত্নার গলাটা বিভ্রান্ত শোনাল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। এবার সমস্যার কথাটা বলি।’ আদিত্য একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগল, ‘পার্থ যখন পি এইচ ডি করছে বা ফ্লরিডায় পড়াচ্ছে বা মেমসাহেব বউএর সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে ডিভোর্স করার মতলব আঁটছে, তখন চন্দ্রা কী করছিল, পার্থ অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারেনি। চন্দ্রার জীবনের দশ-পনের বছর তার কাছে অন্ধকারেই থেকে গেছে। শুধু এইটুকু জানতে পেরেছে যে, কোনও একটা সময় খুনোখুনির বামপন্থী রাজনীতিতে চন্দ্রা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। যাকে বলে কমপ্লিটলি ডিসইলিউশন্ড। এতটাই যে কিছুদিন আগে সে তার দলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে ইছামতীর ধারে একটা ছোট্ট গ্রামের ইস্কুলে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছে। আসলে মাওবাদীদের সংস্রব ত্যাগ করলেও কিছু কিছু বামপন্থী বিশ্বাস সম্ভবত তার ভেতরে রয়ে গিয়েছিল। ফলে, সে আর কলকাতায় তার বাড়িতে ফিরে আসেনি। তার বাবা আগেই গত হয়েছেন। আলিপুরের বাড়িতে শুধু তার সৎমা। বাবা তার জন্য ব্যাঙ্কে প্রচুর টাকা রেখে গেছেন। আলিপুরের বাড়িতেও তার অর্ধেক ভাগ। অতএব চাইলে সে অনায়াসেই কলকাতায় এসে আরামে দিন কাটাতে পারত। কিন্তু একে বাম-আদর্শ, তার ওপর সৎমার সঙ্গে তার মোটেই বনে না।’
‘মাওবাদীদের হাত থেকে চন্দ্রা অত সহজে মুক্তি পেল কী করে? শুনেছি উগ্রপন্থীদের দলে একবার নাম লেখালে আর বেরোনো যায় না।’ অমিতাভ জিজ্ঞেস করল।
‘আমিও এই প্রশ্নটা পার্থকে করেছিলাম। উত্তরটা পার্থর জানা নেই। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তার আগে বলা দরকার, এই ইস্কুলটাতে চন্দ্রা গত পাঁচ-ছ মাস পড়াচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই ইস্কুলটার প্রতি চন্দ্রার একটা গভীর মমত্ব তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে এই কারণে যে, ওখানে যারা পড়তে আসে তারা সকলেই হতদরিদ্র ঘর থেকে আসে। পার্থ কয়েকবার চন্দ্রার সঙ্গে ওখান থেকে ঘুরেও এসেছে।’
‘পার্থ এখন কী করতে চাইছে?’
‘পার্থ চন্দ্রাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বিদেশ যেতে চন্দ্রা কিছুতেই রাজি নয়। মূলত সেই কারণেই পার্থ পাকাপাকি ভাবে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দেশে ফিরে আসার পরেও যদি পার্থকে চন্দ্রার থেকে দূরে থাকতে হয়, তাহলে দেশে ফিরে এসে লাভ কী? অনেক বোঝানোর পর অবশেষে চন্দ্রা ইস্কুলের চাকরি ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। বিয়ের পর সে পার্থর সঙ্গে তার নতুন কর্মস্থলে চলে যাবে। ওখানে গরিব বাচ্চাদের জন্য একটা ইস্কুল করবে। আমাদের দেশে তো গরিবের অভাব নেই। এটা অবশ্য মাস দেড়েক আগেকার কথা।’
‘তাহলে আর সমস্যা কী? সবই তো মিলে গেল।’ রত্না এখনও বিভ্রান্ত।
‘সমস্যা আছে, সমস্যা আছে। সবই যখন ঠিকঠাক চলছিল তখন হঠাৎ কিছু দিন আগে বলা নেই কওয়া নেই চন্দ্রা তার বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে। কাউকে কিচ্ছু বলে যায়নি। পার্থকেও না। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারাও এখন পর্যন্ত কমপ্লিটলি ক্লু লেস। চন্দ্রাকে খুঁজে বার করার কাজটা পার্থ আমাকে দিয়েছে। তার ভয়, চন্দ্রা হয়ত আর বেঁচে নেই। হয়ত চন্দ্রার পুরোনো দলই তাকে শেষ করে দিয়েছে। হয়ত অমিতাভর ধারণাটাই ঠিক। একবার দলে নাম লেখালে উগ্রপন্থীদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না।’
আদিত্য থামল। ঘড়িতে দেড়টা। ঘরের আবহাওয়াটা হঠাৎ ভারী হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ সকলে নীরব। তারপর নীরবতা ভেঙে রত্না স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরা চান করতে যাও। আমি ততক্ষণ খাবার গরম করি। আচ্ছা তার আগে একবার নিচে গিয়ে দেখবে ছেলেটা খেতে বসল কিনা? আমাদের পুজো কমিটির যা ব্যাপার, হয়ত প্রথম ব্যাচটাই এখনও বসেনি।’
অমিতাভ উঠে দাঁড়াল। আদিত্যও উঠে দাঁড়িয়েছে। অমিতাভ আদিত্যকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কিছু ভেবেছিস কী করবি?’
‘এখনও জানি না কী করব। কালী পুজো নাগাদ পার্থ একবার দেশে আসবে বলেছে। তার মানে নভেম্বরের মাঝামাঝি। ওরা ভেবেছিল ডিসেম্বরের গোড়ায় একটা ছোটখাট অনুষ্ঠান করে বিয়েটা সেরে ফেলবে। কিন্তু চন্দ্রা বেঁচে আছে কিনা সেটাই তো কেউ জোর দিয়ে বলতে পারছে না। যদি বেঁচে থাকে, ডিসেম্বরের আগে চন্দ্রাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করব। হাতে খুব বেশি সময় নেই। তবে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে চন্দ্রা বেঁচে আছে। মাওবাদীরা যদি দল ছেড়ে দেবার জন্য চন্দ্রাকে মারবেই তাহলে তারা পাঁচ-ছয় মাস অপেক্ষা করবে কেন?’
(৩)
রত্না বলেছিল সন্ধেবেলা সেজেগুজে নিচে নামবে। সন্ধেটা পুজোমণ্ডপে কাটাবে। এই বাড়িতে রত্নার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব না হোক অন্তত চেনা পরিচিত আছে। একটা সন্ধে তাদের সঙ্গে বসে মেয়েলি গল্প করা রত্নার পক্ষে খুব শক্ত নয়। আসলে, হাউসিং সোসাইটির মহিলাদের সঙ্গে একটু আধটু না মিশলে সবাই নাক উঁচু মনে করে। তাই পুজোর সময় একদিন অন্তত নিচে নামা দরকার। কিন্তু হাউসিং সোসাইটিতে অমিতাভর এমন কেউ নেই যার সঙ্গে সে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারে। মুখচেনা দুচারজন আছে বটে, তবে তাদের সঙ্গে মিনিট দু-তিনের বেশি কথা বলা অমিতাভর পক্ষে অসম্ভব। তার ওপর এখন আদিত্য এসেছে। তাই অমিতাভ আগেই বলে দিয়েছিল সে আর আদিত্য সারাটা সন্ধে বাড়িতে বসে গান শুনবে। সারা সন্ধে শোনার মতো কয়েকটা গান বেছেও রেখেছিল। সম্প্রতি পুনে, বরোদা আর কলকাতা থেকে এগুলো সে বহুকষ্টে সংগ্রহ করেছে।
সরোদে একটা জয়জয়ন্তী চালিয়ে দিয়ে অমিতাভ বলল, ‘কলকাতা দিয়ে শুরু করি। এটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর মাঝ-বয়েসের বাজনা। কলকাতায় বাজানো। শুনে দ্যাখ কী অসাধারণ।’
বাজনা খানিকটা এগোনোর পরে অমিতাভ বলল, ‘জয়জয়ন্তী নিয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর গল্পটা মনে আছে তোর?’
‘খুব মনে আছে। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ভাল করে না শিখে রেডিয়োতে জয়জয়ন্তী বাজানোর পর রাধুবাবুর কাছে প্রচণ্ড ঝাড় খেয়েছিলেন। তারপর আসল জয়জয়ন্তী শেখা।’
আদিত্যর কথার মাঝখানেই সুর মধ্যম-গান্ধার হয়ে খুব সহজভাবে রেখাবে গিয়ে দাঁড়াল আর অমনি আদিত্যর মনে হল খুব দ্রুত একটা কাহিনি তৈরি হচ্ছে। যেন একটা ক্লান্ত মানুষের ঘরে ফিরে আসার কাহিনি। পথে কত নদী, কত পাহাড়, কত রাস্তা সে পেরিয়ে এসেছিল। কত দুঃখ, কত মনোরম বেদনা পেরিয়ে সে ঘরে ফিরে আসছে। এটা কি পার্থর গল্প? পার্থ কি ফিরে আসতে পারবে? সুর একবার মধ্যম-গান্ধার হয়ে রেখাবে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, আবার কখনও কোমল নিষাদ ধৈবত বেয়ে পঞ্চমে দাঁড়িয়ে দুদণ্ড বিশ্রাম নিচ্ছে। গান-বাজনা জানা পণ্ডিতেরা কীভাবে চিন্তা করে আদিত্য জানে না, কিন্তু তার মনে হয় জয়জয়ন্তী রাগে অবরোহণ অর্থাৎ ফিরে আসাটাই আসল। পঞ্চমে কিংবা রেখাবে ফিরে আসা। নিজের অজান্তেই আদিত্যর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘কী বাজাচ্ছে রে!’
ঘন্টাখানেক পরে, যখন জয়জয়ন্তী সদ্য শেষ হয়েছে, পাশের ঘর থেকে অমিতাভর মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠল। পাশের ঘরে গিয়ে অমিতাভ মোবাইলে কী কথা বলল আদিত্য খেয়াল করেনি, তার মাথায় তখনও জয়জয়ন্তী বাজছে। একটু পরে অমিতাভ ফিরে এসে বলল, ‘রত্না ফোন করেছিল। সর্বনাশ হয়েছে। ওর এক ইস্কুলের বন্ধু তার স্বামী এবং দুটি বাচ্চাকে নিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে আমাদের বাড়িতে আসছে। এপাড়ায় ঠাকুর দেখতে এসেছে। সিংঘি পার্ক, একডালিয়ার ঠাকুর দেখে আমাদের বাড়িতে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেবে। তারপর দেশপ্রিয় পার্কের দিকে ঠাকুর দেখতে যাবে। অর্থাৎ আমাদের গান শোনার দফা রফা। রত্না এখনই ওপরে আসছে। আমি একা তো আর ওদের সামলাতে পারব না।’
মিনিট পাঁচেক পরে রত্না নিপুণ হাতে প্লেটের ওপর কিছু মিষ্টি সাজাতে সাজাতে বলছিল, ‘গার্গী মানুষটা মোটেই খারাপ নয়। শুধু একটু বেশি কথা বলে। আর ওর স্বামীও মানুষ ভাল, তবে তোদের মতো আঁতেল নয়।’ তারপর নিজের স্বামীর দিকে ফিরে বলল, ‘তুমি কিন্তু ওদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবে।’
”আমি তোমার বন্ধুদের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেছি?’ অমিতাভ নিরীহ গলায় বলল, ‘যদিও তোমার বন্ধু এসে আমাদের গান শোনাটা একেবারে মাটি করে দিল।’
‘সারা পুজো ধরেই তো গান শুনবে। একটা সন্ধে না হয় না শুনলে। তাছাড়া গার্গী আর ওর স্বামীকে তো তুমি চেন।’ রত্নার কথা শেষ হতে না হতে দরজায় বেল।
গার্গী বিশ্বাস ও তার স্বামী মৈনাক বিশ্বাস, দুজনেই ব্যাঙ্কে চাকরি করে। গার্গী ফর্সা, মোটাসোটা, গিন্নিবান্নি, মুখশ্রী চমৎকার, তিরিশ দশক হলে অনায়াসে সুন্দরী বলা যেত, এখন অবশ্য সুন্দরের ধারণা পালটেছে। তার স্বামী কালো, রোগা, লম্বা, চুলে সামান্য পাক ধরেছে, যদিও মুখ দেখলেই বোঝা যায় বয়েস বেশি নয়। তাদের ছেলে দুটো পিঠোপিঠি, একজন ক্লাশ থ্রি, একজন ফাইভ। ওরা টুবলুর সঙ্গে নিচে সোসাইটির ঠাকুর দেখতে গেল। রত্নার আশঙ্কা ঠিক, গার্গী অনর্গল কথা বলছে।
গার্গী বলছিল, ‘রাস্তায় কী প্রচণ্ড ভিড় রে বাবা। সকালে বৃষ্টি হল বলে ভাবলাম ভিড়টা একটু কম হবে। কোথায় কম! হাঁটাই যায় না। খালি ভয় হচ্ছিল, ভিড়ের চাপে ছেলে দুটো বুঝি হাত ছেড়ে চলে যাবে। আমি তো ওদের বাবাকে বারবার বলছিলাম, ছেলেদের ওপর নজর রেখো। এমন জানলে বেরোতামই না।’
‘বেরোলি বলে তাও দেখা হল। তোর ছেলেদের সেই কবে দেখেছিলাম।’ রত্না আন্তরিকভাবে বলল।
‘আসলে আমার কর্তার খুব ঠাকুর দেখার শখ। সে-ই ছেলেদের তাতায়। আমি মোটা মানুষ অত হাঁটতে পারি নাকি?’
আদিত্য দেখল মৈনাক বিশ্বাস মিটিমিটি হাসছে। সে তার স্ত্রীর ঠিক উলটো, কথা প্রায় বলেই না। রত্না হঠাৎ খেয়াল করল তার অতিথিদের সঙ্গে আদিত্যর আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়নি।
গার্গী বলেই যাচ্ছিল, কাল আবার বাবা-ছেলেদের নর্থ ক্যালকাটায় ঠাকুর দেখার প্ল্যান। আমার ভাবতেই গায়ে জ্বর আসছে। আমি তো ভাবছি দাদার ওখানে…’
তাকে থামিয়ে দিয়ে রত্না বলল, তোদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়নি, ইনি আদিত্য মজুমদার, আমাদের কলেজের বন্ধু, পুজোর কটা দিন আমাদের বাড়িতে থাকছেন।’
আদিত্য হাত তুলে নমস্কার করল। গার্গী আদিত্যকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনিও রত্নাদের মতো কোথাও পড়ান নাকি?’
পেশা নিয়ে প্রশ্ন হলে আদিত্য এখনও খুব বিব্রত বোধ করে। সে যে একজন পেশাদার বেসরকারি গোয়েন্দা এটা অচেনা কাউকে বলতে তার ভীষণ সংকোচ হয়। তার অস্বস্তিটা আন্দাজ করতে পেরে রত্না তাড়াতাড়ি বলল, ‘আচ্ছা গার্গী, তুই স্কটিশে কেমিস্ট্রি পড়তিস না?’
‘পড়তামই তো।’
‘তারপর কলকাতায় এম এস সি পড়েছিলি?’
‘ভর্তি হয়েছিলাম। এক বছর ক্লাশও করেছিলাম। তারপর ব্যাঙ্কের চাকরিটা পেয়ে গেলাম। অতএব উচ্চশিক্ষায় ইতি।’
‘আচ্ছা, চন্দ্রা বলে একজন আমাদের সময় প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স পড়ত, কলকাতায় এম এস সি পড়েছিল। নকশাল করত। তুই চিনতিস?’
‘নকশাল চন্দ্রা? প্রেসিডেন্সিতে পড়ত?’ গার্গী বিশ্বাস কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর অনিশ্চিত গলায় বলল, ‘মনে হচ্ছে মনে করতে পারছি। তবে চেনার কথা নয়। চন্দ্রা তো ফিজিক্স পড়ত আর আমি কেমিস্ট্রি। তাও কলেজ আলাদা। আসলে কেয়া বলে আমার এক বন্ধু স্কটিশে ফিজিক্স পড়ত। পরে এমএসসি পড়তে গিয়ে কেয়ার সঙ্গে চন্দ্রার খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। কেয়াই চন্দ্রার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। দুএকবার কেয়ার সঙ্গেই চন্দ্রাকে দেখেছি। কিন্তু চন্দ্রার কথা হঠাৎ উঠল কেন?’ গার্গী খানিকটা অবাক।
‘কেন উঠল বলছি।’ রত্না উত্তর দিল। ‘তুই তো জানিস চন্দ্রা একসময় নকশাল করত। তারপর কী হল সব ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে ও একটা ইস্কুলে পড়াচ্ছিল। মাস খানেক হল চন্দ্রা নিখোঁজ হয়ে গেছে। পুলিশও তার হদিশ করতে পারছে না। তাই ভাবছিলাম, তুই চন্দ্রার কোনও হদিশ দিতে পারিস কিনা।’
‘আমি তো চন্দ্রাকে ভাল করে চিনতামই না। কী করে তার হদিশ দেব?’ গার্গীর অবাক ভাব এখনও কাটেনি।
‘আপনি কি এমন কারও হদিশ দিতে পারেন যে চন্দ্রার খবর জানে? ওই যে কেয়া না কার কথা বললেন?’ আদিত্য একটু উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘কেয়া, মানে কেয়া বাগচির ফোন নম্বর দিতে পারি। কিন্তু তার আগে আপনার পরিচয়টা জানতে পারলে ভাল হত।’ আদিত্যর দিকে তাকিয়ে খানিকটা উদ্ধতভাবেই বলল গার্গী বিশ্বাস।
‘আদিত্য আমাদের মতো মাস্টারি করে কিনা জিজ্ঞেস করছিলি না?’ রত্না আদিত্যর সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। ‘আদিত্য মাস্টারি করে না। আদিত্য একজন পেশাদার বেসরকারি গোয়েন্দা। চন্দ্রলেখা সেনকে খুঁজে বার করার কাজটা ও পেয়েছে।’
‘বেসরকারি গোয়েন্দা!’ এতক্ষণ পরে মৈনাক বিশ্বাসের গলা শোনা গেল। গলায় অকৃত্রিম বিস্ময়। স্বামী-স্ত্রী একজন বেসরকারি গোয়েন্দার অস্তিত্বটা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। তাদের ঘোর কাটতে কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল।
বিষ্ময়ের ঘোর কাটার পর গার্গী বলল, ‘চন্দ্রার সম্বন্ধে ভাল করে জানতে গেলে কেয়া বাগচির সঙ্গেই কথা বলতে হবে। কেয়া এখনও বিয়ে করেনি, বাগবাজারে একটা মেয়েদের হস্টেলে থাকে। ওর সঙ্গেই চন্দ্রার যোগাযোগ সব থেকে বেশি। আমি কেয়ার ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি।’