চতুর্থ পর্ব- স্নান ধূপের শরীর
অধীশদার বাড়ি ব্রেকফাস্ট খেয়ে পেট ভরে গেছিল। তাই ফিরে, না খেয়েদেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন জাগলাম, তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে। গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। মানে উর্ণারা এখনও বাড়ি ফেরেনি। এই সময় একজনকে খুব মিস করছি। বাবাকে। যত দিন যাচ্ছে, বুঝতে পারছি, আমার বাবা সবকিছু জানতেন। শুধু জানতেনই না, আমি যাতে এইসব ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়ি, তার চেষ্টা করে গেছেন আজীবন। কিন্তু কী কপাল, হয়তো ভাবতেও পারেননি, তাঁর মৃত্যুর পর এমন এক জটিল রহস্যে জড়িয়ে যাব, যার সন্ধান তাঁর কাছে থাকলেও থাকতে পারত। উর্ণার বাবা সেদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, বাবা নাকি গোপনে ব্যান্ডেল চার্চে কিছু গচ্ছিত রেখে এসেছিলেন। যদি মিথ্যে কথা না বলেন, আর আমার ধারণা যদি খুব ভুল না হয়, তবে এটা তারিণীর সেই ডায়রি আর ছেঁড়া পাতাগুলো। কিন্তু সেগুলো কি এখনও চার্চেই আছে? ঘরে বসে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। একমাত্র উপায় নিজে সেখানে যাওয়া। প্রথমবার আলাপের সময়ই দেবাশিসদা কিছু আন্দাজ করেই আমায় ব্যান্ডেল চার্চের কথা বলেছিলেন। গা ঝাড়াদিয়ে উঠে পড়লাম। দিল্লি রোড ধরে গেলে বড়োজোর ঘন্টা দুই। বিকেল তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাব। বেরোবার আগে উর্ণাকে ফোন করলাম। বেজে গেল। আবার করলাম। কেটে দিল। ব্যস্ত? না রাগ করেছে?
মাঝরাস্তায় সামান্য কিছু খাবার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। তাই পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে তিনটে বাজল। বাঁকানো একটা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। আজ তেমন কোনও অনুষ্ঠান নেই। তাই ভিড় কম। পিছনে বিরাট ফাঁকা মাঠ, একদিকে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। এককালে এখান দিয়েই সব জাহাজ পাল তুলে রওনা দিত ফ্রান্স, ডেনমার্ক, পর্তুগালে। দুরে জুবিলি ব্রিজ। ১৮৮৭ সালে মহারানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের গোল্ডেন জুবিলি উপলক্ষ্যে এই ব্রিজ তৈরি হয়েছিল। আর ঠিক দশ বছর পরের ডায়মন্ড জুবিলি নিয়েই তো দেখছি যত সমস্যা।
ভাবতে ভাবতে মেটে লাল রঙের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে উঠে গেলাম উপরের দিকে। প্রবেশপথের দরজার উপরেই কোরক ফোটা এক পদ্মফুল। ফুলের উপরে দাঁড় টানা নৌকা। নৌকার বাঁদিকে ক্রুশ, ডানদিকে সামান্য বেঁকে থাকা দাঁড়। মাঝে মেরি মাতা, লেডি অফ দি হ্যাপি ভয়েজ। দেবশীষদার মুখে প্রথমবার এর নাম শোনা। এইরকম মেরির মূর্তি আমি আগে কোথাও দেখিনি। মেরির এক হাত উঠানো, যেন কিছু নির্দেশ করছেন। অন্য হাতে শিশু যিশুকে কোলে ধরা। এক পাশ করে। যিশুর দুই হাতের আঙুল সেই একইদিকে নির্দেশ করছে। ভিতরে ঢুকে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভিতরে এতগুলো গলি। কোথায় যাব, কিছুই বুঝতে পারছি না। চার্চের কর্মীদের দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তাঁরা আমায় বিশেষ গা করছেন না। একজনকে পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, আমি একটু প্রয়োজনে এসেছি। আর্চবিশপ আছেন?”
আর্চবিশপ অফ কলকাতা যে প্রায়ই এখানে আসেন সেটা খবর নিয়ে নিয়েছিলাম গুগলে। বাকিটা কপাল ঠুকে মেরে দিলাম। যদি ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে। প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল। “আর্চবিশপের সঙ্গে আপনার কী দরকার?”
মিথ্যে বললাম। “আমার বাবা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। তিনি চার্চে একটা বড়ো ডোনেশন করতে বলেছিলেন।”
“কিন্তু ডোনেশনের ব্যাপারে আপনি আমার সঙ্গেই কথা বলতে পারেন। আর্চবিশপকে কী দরকার?”
“সে জানি। কিন্তু উনি মারা যাবার আগে একটা চিঠি দিয়ে গেছেন। সেটা পারসোনালি ওঁকেই হাতে হাতে দেবার নির্দেশ আছে। বাবার শেষ ইচ্ছে…”
“আচ্ছা। আপনি এখানে একটু দাঁড়ান। আমি বিশপের সঙ্গে কথা বলে আসছি।”
বুঝলাম ওষুধে কাজ হয়েছে। কোনটা অবশ্য বলতে পারব না। ডোনেশন, নাকি বাবার ইচ্ছে?
“অবশ্যই। আর শুনুন, আমার বাবা খুব সম্ভবত বিশপের চেনা ছিলেন। নামটা বলবেন। বিরূপাক্ষ রায়। আমি তাঁর ছেলে তুর্বসু রায়।”
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে-টেড়ে চলে গেলেন।
প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল। ভদ্রলোক আর আসেনই না। আমিও অন্য কোথাও যেতেও পারছি না। এদিকে ভিড় বাড়ছে অল্প অল্প। ছেলেমেয়েরা আসছে জোড়ায় জোড়ায়। বাগানে ঘুরছে। যিশুর মূর্তির সামনে মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। এইসব ঝামেলা মিটুক, একদিন উর্ণাকে নিয়ে এখানে ঘুরতে আসতে হবে।
“এই যে, এইযে স্যার। এদিকে আসুন। আর্চবিশপ তাঁর কামরায় আপনাকে ডাকছেন”, দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন ভদ্রলোক।
বিরাট সেগুন কাঠের দরজা। ভাতে নানারকম নকশা আঁকা। এত চকচকে, দেখলেই বোঝা যায় রোজ পরিষ্কার করা হয়। পিতলের তবকে আর্চবিশপের নাম লেখা। টমাস ডি’সুজা। দরজার হাতল দেখলে মনে হয় যেন সোনা। ভদ্রলোক দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে একটা বাও মতো করে দাঁড়ালেন। আমিও দেখাদেখি তাই করলাম। দেখলাম সামনে বসে আছেন হাসিমুখ, সাদা চুলের এক ভদ্রলোক। বড়ো অমায়িক চেহারা। তিনি আমার সঙ্গীকে চলে যেতে নির্দেশ দিলেন। তারপর ভাঙা বাংলা ইংরাজি মিশিয়ে আমায় বললেন, “দাঁড়িয়ে কেন? বোসো।”
আমি সামনের চেয়ারে বসতে খুব খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন আমায়। মুখে কোনও কথা নেই। আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। খানিক বাদে উনিই প্রথম কথা বললেন, “আশ্চর্য! অবিকল সেই মুখ, সেই চোখ। তুমি যে বিরূপাক্ষর ছেলে তা আর বলে দিতে হয় না। দাও কী চিঠি দেবে বলছিলে?”
“আমার ক্ষমা করবেন। এই মিথ্যেটা না বললে আমাকে আপনার কাছে আসতে দিত না হয়তো। আপনার সঙ্গে আমার খুব প্রয়োজন।”
মৃদু হাসলেন বিশপ। “ঈশ্বরের বাড়িতে মিথ্যে বলা পাপ। যাই হোক, প্রয়োজনটা বলো।”
“আপনি আমার বাবাকে চিনতেন?”
“খুব ভালোভাবে। তোমার বাবাদের একটা এনজিও ছিল। নীবার নাম। এককালে খুব অ্যাক্টিভ ছিল। আমাদের চার্চের সঙ্গে কাজ করত। তারপর যেমন হয়, নীবারের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা বাধল। আমরাও দূরে সরে এলাম।”
“ঝামেলাটা ঠিক কী নিয়ে?”
“সঠিক তো জানি না। তবে যেমন হয় সব সংগঠনে, তেমনই কিছু একটা। পুরাতনপন্থী বনাম নব্যপন্থী। তোমার বাবা পুরাতনপন্থীদের দলে ছিলেন।”
“এদের কথা বিশেষ কেউ জানে না কেন?”
“বেশিরভাগ খ্রিস্টান পরোপকারী সমিতিরাই নিজেদের আড়ালে রাখতে চায়। তবে এদের অন্য কোনও কারণ ছিল। এরা নিজেরা কখনোই সামনে আসত না। পরে শুনেছি, এঁদের অনেকে ছিলেন ম্যাসনিক ব্রাদারহুডের সদস্য। ম্যাসনদের সঙ্গে আমাদের আদর্শের তফাত আছে। আমরা তাই নীবারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি।”
“নীবার কবেকার সংগঠন?
“বহু পুরাতন। ওরা তো বলে ওদের জন্ম একশো বছরেরও বেশি আগে। তবে হ্যাঁ, মূলত হুগলি জেলাতেই এদের বাড়বাড়ন্ত। অন্য কোথাও এদের শাখা আছে বলে জানি না।”
“এটা কি কোনও গুপ্ত সমিতি?”
“কাইন্ড অফ। কিন্তু এদের রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি আছে। এনজিও-দের মতো নানা কাজও করে। কিন্তু যাকে বলে মেম্বারশিপ ড্রাইভ, সেটা এদের হয় না।”
“নীবারের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও আমার বাবার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তো ছিল…”
“তা ছিল। তবে সেটা একেবারেই ব্যক্তিগত। আমি যখন বাগডোগরার বিশপ ছিলাম, তোমার বাবা নকশালবাড়িতে পোস্টিং ছিলেন। তখন থেকেই আমাদের ঘনিষ্ঠতা। আমৃত্যু সে ঘনিষ্ঠতা বজায় ছিল।”
“কয়েক বছর আগে বাবা একবার আপনার কাছে এসেছিলেন। কিছু একটা জমা রাখতে।”
এতক্ষণ আর্চবিশপ বেশ হাসি হাসি মুখেই কথা বলছিলেন। এবার যেন একটু গম্ভীর হলেন। “তুমি জানতে পেরেছ? কীভাবে?”
“বাবার উপরে আক্রমণ হয়েছিল। কীসের জন্য জানি না। তবে যারা হামলা করেছিল, তারা কিছু খুঁজছিল। তাদের হাত থেকে বাঁচতেই বাবা নিশীথ দত্তের বাড়িভাড়া নিয়ে থাকেন। উনি বাবার বন্ধু। নীবারের সদস্য। ওঁর থেকেই জানতে পেরেছি।”
“কিন্তু…” বিশপের মুখে এবার চিন্তার ছায়া, “আমাকে তো অন্য কিছু বলেছিলেন তিনি। সেই শেষবার আমার সঙ্গে দেখা। চার্চে একটা পুরোনো টেবিল ডোনেট করেছিলেন। তাঁর ঠাকুর্দার আমলের। সঙ্গে আমাকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বললেন, এই জিনিসের অধিকার শুধু আমার ছেলের। কিন্তু কোনও দিন যদি সে কিছু চাইতে আসে, তবে বুঝতে হবে সে ভয়ানক বিপদে পড়েছে। আমি যেন সাধ্যমতো তাকে সাহায্য করি। সত্যি কথা বলো মাই সন, সবকিছু ঠিক আছে তো?”
“ঠিক নেই ফাদার। কিন্তু আমি সত্যিই জানি না বিপদের ধরনটা কেমন। তবে কথা দিলাম, সাহায্যের দরকার হলে আমি অবশ্যই আপনার কাছে আসব।”
বিশপ খানিক শান্তভাবে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর একটা কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, “তোমায় আমি জোর করব না। সময় এলে প্ৰভু নিজেই তোমায় দিয়ে যা উচিত তা করিয়ে নেবেন। এই দ্যাখো না, আজ সকালেই আমার এখান থেকে ভ্যাটিক্যানে চলে যাবার কথা। এক মাসের জন্য। শেষ মুহূর্তে ফ্লাইট ক্যানসেল হয়েছে। তাই যাওয়াও দুইদিন পিছিয়ে গেল। সকাল থেকে এতক্ষণ ভাবছিলাম, কেন এমন হল? এখন বুঝেছি। হয়তো প্ৰভু যিশু চাইছিলেন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হোক। তুমি তোমার বাবার রক্ষিত সম্পদ নিয়ে যাও। তবে হ্যাঁ, তোমাকে কোনও সাহায্য করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।”
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের এক কোণের একটা সিন্দুক খুলে ব্ৰাউন পেপারে মোড়া একটা প্যাকেট বার করে দিলেন বিশপ। প্যাকেটে গালা দিয়ে সিল করা।
আমার হাত কাঁপছিল। “এটা খুলে দেখতে পারি?”
বিশপ মুখে কিছু না বলে ইংরাজিতে যাকে বলে শ্রাগ, তাই করলেন।
কাগজের প্যাকেট। ছিঁড়ে ফেলতে সময় লাগল না। ভিতরে কী আছে দেখতে যাব, শেষ সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন বিশপ, “ভিতরে যাই থাক, একে সাবধানে হ্যান্ডল কোরো। এর খোঁজে আগেও এখানে লোক এসেছিল।”
আমি মাঝপথে থেমে গেলাম। “কে এসেছিল?”
“জানি না। তবে আমার সহযোগীরা জানিয়েছে বিরূপাক্ষ এখানে কবে
এসেছিল, কেন এসেছিল, এইসব নিয়ে একাধিক লোক জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কেউ আমি অবধি পৌঁছাতে পারেনি। এক তুমিই পারলে। তাও বিরূপাক্ষের ছেলে বলে।”
আমি ততক্ষণে ভিতরের জিনিস বার করে ফেলেছি। কিন্তু এ তো কোনও ডায়রি বা ছেঁড়া পাতা না। কালো চামড়ায় মোড়া একটা বাইবেল। স্পাইনে সোনারজলে লেখা, হোলি বাইবেল। কে জে ভি। মানে, কিং জেমস ভার্সান। ১৬১১ সালে রাজা ষষ্ঠ জেমস সাধারণের পাঠ্য ইংরাজিতে এই বাইবেল অনুবাদ করিয়েছিলেন। কিন্তু এই বই দিয়ে আমি কী করব? সঙ্গে আর-একটা লাল চামড়া বাঁধানো চটি বই। ১৮৯০ সালে ছাপা, লংম্যান, গ্রিনঅ্যান্ড কোং থেকে। এর গল্পও আমার পড়া। বইয়ের নাম, The Strange Case of Dr. Jekyll and Mr. Hyde, রবার্ট লুই স্টিভেনসনের লেখা। কিন্তু যার জন্য আসা, সেটা কোথায়? তারিণীর ডায়রি?
আর্চবিশপ বোধহয় আমার হতভম্ব ভাবটা বুঝতে পেরেছিলেন। মৃদু হেসে বললেন, “আর যাই হোক, প্যাকেটে বাইবেল আশা করোনি, তাই তো? কিন্তু কী বলো তো, মন দিয়ে পড়ে দ্যাখো। বাইবেলেই জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে। তোমাকে শুধু খুঁজে নিতে হবে। তোমার বাবা এটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, আমার ছেলে যদি সত্যিই তারিণীচরণ রায়ের বংশধর হয়, তবে সে বুঝতে পারবে আমি কী বলতে চাইছি।”
বাইবেলের পাতা ওলটাতেই দেখি, শুরুতেই বাবার হাতের লেখা। গোটা গোটা অক্ষরে বাংলায় লিখেছেন, “লেডি অফ দ্য হ্যাপি ভয়েজকে অনুসরণ করো। উনিই পথ দেখাবেন।” মানে কী এর? মাথা তুলতেই মেরি আর যিশুর সেই ছবি চোখে পড়ল। নৌকায় দাঁড়ানো। দুটো আঙুল বাইরে দরজার দিকে নির্দেশ করছে। আমি ঘোর লাগা মানুষের মতো উঠে দাঁড়ালাম। আর্চবিশপকে কোনওমতে বাও করেই বেরিয়ে এলাম বাইরে। বাইরের দেওয়ালে আবার এক ছবি। এবার ফ্রেস্কো। কিন্তু আঙুল এবার নির্দেশ করছে ডাইনে। ডাইনে এক পাদ্রির মূর্তি। জোয়াও দ্য ক্রুজ। এর কথাও দেবাশিসদার মুখে শুনেছি। বাঁ হাতে এক শিশুকে কোলে নিয়ে আছেন তিনি। ডান হাত মেরি মাতার অন্য এক মূর্তির দিকে নির্দেশ করছে। এই প্রথমবার আমি খেয়াল করলাম মা মেরির হাতের দুটো আঙুল তোলা, শিশু যিশুর এক হাতের দুই আঙুল তোলা, অন্য হাতে তিন মাথা ক্রুশ। দুই যোগ দুই যোগ তিন। সাত। ডিভাইন নাম্বার। পরের বাঁকে আবার একটা মূর্তি, কাচে ঢাকা। যেন স্বয়ং মা মেরি আমাকে দিক দেখাতে দেখাতে নিয়ে চলছেন। একেবারে শেষে প্রার্থনা হলের সামনে এসে অন্যরকম একটা মূর্তি দেখলাম। আবার মেরি আর যিশু। কিন্তু এখানে দুজনেই নির্দেশ করছেন মাটির দিকে, মেঝের দিকে। মেঝেতে কিছু নেই। শুধু আছে একটা প্রণামী রাখার বাক্স। কিন্তু সেটা না। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম বাক্সটা যে টেবিলে রাখা, সেই টেবিলটার দিকে। টেবিলের কারুকার্য আমার খুব চেনা। আমি দেখেছি। কিন্তু কোনও টেবিলে না। চেয়ারে। আমার অফিসের চেয়ারে। চিপ্যানডেল ডিরেকটরে।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। ড্রিসকল সাহেবের সেই ইনভেনটরি অনুযায়ী শুধু চেয়ার না, দুটো টেবিলও পেয়েছিল তারিণী। অফিসে তো কেবল একটা আছে। সেটা সাধারণ। এটা নিশ্চিত ডিরেক্টরের জোড়াটা। এটার অস্তিত্বের কথা এতদিন জানতাম না পর্যন্ত!
চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। এদিকটায় ভিড় অপেক্ষাকৃত কম। ধীর পায়ে চলে গেলাম প্রণামীর বাক্সের সামনে। আমি নিশ্চিত, এই টেবিলটার কথাই আর্চবিশপ বলছিলেন। টেবিলের কাজ করা অংশ অবিকল আমার চেয়ারটার মতো। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করতে করতে ফুলটাকে দেখতে পেলাম। মাঝে ফুল। চারদিকে লতাপাতা। এই ফুল আমার চেনা। একটু নিচু হয়ে আলগোছে ফুলের ঠিক মাঝে চাপ দিতেই খট করে পান্না খুলে হাতে একটা প্ল্যাস্টিক জড়ানো প্যাকেট এসে পড়ল। দেখেই বুঝলাম পুরোনো কোনও কাগজপত্র আছে এতে। পরে খুলে দেখা যাবে। চট করে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে ডালাটা আটকে দিলাম।
এবার? হ্যাঁ, ওই ডাক্তার জেকিলের বইটা। ওটা কেন? এদিকে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। একদল খ্রিস্টান ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করছেন। তাদেরই একপাশে বসে আমি ডাক্তার জেকিলের চটি বইটা খুলে বসলাম। ছোটো নভেলা। সঙ্গে আরও দশ পাতার এক ভূমিকা। আগাগোড়া খুঁজে দেখলাম। বাইবেলের মতো কোথাও কোনও নির্দেশ নেই। কিন্তু এই বই যখন এত যত্নে এখানে গচ্ছিত রাখা হয়েছে, নিশ্চয়ই তার কোনও কারণ আছে। সেকেন্ড হ্যান্ড বই। গোটা বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় দাগ মারা। নীল পেনসিল দিয়ে। শুধু ভূমিকায় কয়েক লাইন লাল পেনসিলে দাগানো। সেখানে লেখা-
Eventually, the brew began to run out, and Jekyll was unable to fInd a key IngredIent to make more. HIs abIlIty to change back from Hyde Into Jekyll slowly vanIshed. Jekyll wrItes that even as he composes hIs letter, he knows that he wIll soon become Hyde permanently, and he wonders If Hyde wIll face executIon for hIs crImes or choose to kIll hImself. The potIon became the brew of Hyde’s ultImate transformatIon.
ঠিক তার পাশেই বাবার হাতের লেখা ছোট্ট একটা নোট। এত ছোটো যে প্রথমবার খেয়ালই করিনি। এবার আমি বুঝেছি কেন এই বই আমার জন্য রাখা হয়েছে।
“আপনি তুর্বসু রায় তো?”
কাঁধে হাত পড়তে চমকে ফিরে তাকালাম। দুজন মুশকো লোক আমার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে।
“বলুন?”
“আমরা লালবাজার ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে আসছি। দেবাশিস গুহের খুনের ব্যাপারে।” বলেই আইডি কার্ড বার করে দেখালেন। “আমাদের আইজি সুকল্যাণ মিত্র আপনাকে ডেকেছেন। জরুরি দরকার। আপনাকে এখুনি আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।”
স্বপ্নাদিষ্টের মতো হেঁটে হেঁটে পুলিশের জিপে উঠলাম। আমার বাইক আর একজন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে যাবে। গাড়িতে বসে আছি। পুলিশ দুজন চুপ। আমি ও কথা বলার অবস্থায় নেই। পিঠের ব্যাকপ্যাক পাশে রাখা। হাতে স্টিভেনসনের নভেলাটা, যার ভিতরে এখনও বাবার হাতের লেখায় জ্বলজ্বল করছে, “Brew of Hyde’s UltImate TransformatIon= B.H.U.T.”