চতুর্থ পর্ব— যেইসব শেয়ালেরা

চতুর্থ পর্ব— যেইসব শেয়ালেরা

—এখন উপায়?

—গোপালচন্দ্র কিছু একটা আঁচ করে পালিয়েছে। তবে চিন্তা নেই। ওকে ঠিক ধরে নেব। তার আগে আর-একজনের সঙ্গে কথা বলতেই হবে।

—সে কে?

—বুড়ো জর্জ। তবে এখন দুপুর গড়িয়েছে। ও আর হোটেলে নেই। কোথায় আছে আমি জানি।

—কোথায়?

—চিনে পাড়ায়। চন্ডুখোরদের আস্তানায়।

চিনে পাড়ায় কদিনের মধ্যে আবার যেতে হবে, ভাবেনি প্রিয়নাথ। সেই রাস্তা, ঝুলছে লাল লাল বাতির সারি। তবে সেদিন রাতের দমবন্ধ পরিবেশ আজ উধাও। দোকান সব খোলা। চিনা মন্দিরের দরজাও বন্ধ নেই। যেন একইরকম দেখতে অন্য কোনও এক জায়গায় সে এসেছে। তবে এ পাড়া সাহেবের বেশ চেনা তা হাবেভাবেই বোঝা গেল। উনি কি তবে এখানে নিয়মিত আসেন? সরু গলি বেয়ে একটা ঘুপচি ঘরের সামনে দুজন এসে দাঁড়ালেন। দরজায় লাল পর্দা ঝুলছে। তাতে সোনালি রঙের ড্রাগনের ছবি আঁকা। তারা দুজন সামনে এসে দাঁড়াতেই কোথা থেকে এক হলুদমুখো চিনা এসে উপস্থিত। সরু চোখ। মুখে হাসি।

—কাম, কাম স্যার। কাম ইন স্যার।

সাইগারসন যেন নিজের বাড়িতেই ঢুকছেন, এমনভাবে ঢুকে গেলেন। চিনা মালিক প্রিয়নাথকেও বেশ খাতির করে ভিতরে নিয়ে গেল। দিনের বেলাতেও ভিতরে আলো-আঁধারি। জানলায় মোটা লাল পর্দা টানা। কিছু মিটমিটে আলো জ্বলছে। আর গোটা ঘরে অদ্ভুত গন্ধের একটা ধোঁয়া স্থির হয়ে রয়েছে। ভিতরে লম্বা সরু প্যাসেজের দুইদিকে প্রচুর লোক এলিয়ে পড়ে আছে। বেশিরভাগেরই পাশে রয়েছে অদ্ভুত দেখতে একটা পাইপ। পাইপের একটা দিক লম্বা আর অন্যদিক তিনটে প্যাঁচ খেয়ে সোজা দাঁড়িয়ে আছে। এই মুখটা একটা ছোটো কলকের মতো। পাশের বাটিতে জলে সাদা সাদা কীসব যেন ভাসছে। সাইগারসন বোঝালেন পাইপে চন্ডুর গুলি পুরে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে। যিনি গুলি খাবেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে টান মেরেই ঘুরে পড়বেন। তখন আড্ডার লোকেরা চিনির জলে ভেজানো শোলার টুকরো তাঁর মুখে গুঁজে দেবেন। একটু বেশি পয়সা দিলে তিনি পাবেন বাতাসা, আর সবচেয়ে বেশি পয়সার খদ্দেররা পাবেন রসমুন্ডি।

মালিক খাতির করে দুজনকে দুটো তুলোভরা তোশক আর মাথায় দেবার বালিশ দিল। দুটোই তেল চিটচিটে। সাইগারসন বললেন, “এবার চুপটি করে শুয়ে থাকুন। হাতে পাইপ নিয়ে। জর্জ এখানেই আসে।”

—আপনি কী করে জানলেন?

—জর্জকে এই আস্তানার সন্ধান আমিই দিয়েছি।

সাহেব চন্ডুর আস্তানার মালিককে জানালেন তাঁরা আজ গুলি নেবেন না। তবু বসে আছেন দেখে কিছু টাকা দিলেন। মালিক দুজনের জন্য দুটো বড়ো বড়ো রসমুন্ডি এনে দিল। চন্ডুর পরে এ জিনিস খেলে নাকি মৌতাত বাড়ে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। টলমল পায়ে পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল বুড়ো জর্জ। প্রিয়নাথের দেখেই মনে হল এ যেন আর বেশিদিন বাঁচবে না। সারা মুখ লাল, চোখ ফোলা ফোলা। অদ্ভুত একটা অস্থিরতা সারা দেহ জুড়ে। ঢুকেই এক কোণে একটা খালি জায়গা দেখে শুয়ে পড়ল। মালিক প্রায় দৌড়ে গিয়ে এগিয়ে দিল চন্ডুর পাইপ। কলকেতে চন্ডুর গুলি পুরে আগুন ধরিয়ে দিল নিজেই। জর্জ এক টান মেরেই ঘুরে শুয়ে পড়ল। মালিক তার মুখে গুঁজে দিল বাতাসা।

খানিক বাদে বুড়ো একটু শান্ত হলে সাইগারসন প্রিয়নাথকে চোখের ইশারা করলেন।

-চলুন। যাওয়া যাক।

দুজনে এসে বুড়োর পাশে বসলেন। জর্জের নেশা তখনও ভালোভাবে কাটেনি। ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। সাইগারসন বুড়োর কাঁধে হাত রাখলেন। যেন ডুবন্ত মানুষ কুটো ধরেছে, এইভাবে সেই হাত চেপে ধরে জর্জ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ধীরে ধীরে জর্জের হাতে হাত বোলাতে লাগলেন সাইগারসন। জর্জ কেঁদেই চলেছে। সাইগারসন খুব নরম গলায় এবার বললেন, “তোমার ছেলে মারা যাওয়াতে আমিও কম দুঃখিত নই জর্জ। সব খুলে বলো।”

জর্জ প্রায় ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। “কিন্তু তুমি! তুমি জানলে কীভাবে?”

“অনুমান। একেবারে প্রথম থেকে বলো জর্জ, শুরুটা না জানলে শেষটা কিছুতেই হাতে আসছে না।”

জর্জ এবার প্রিয়নাথের দিকে তাকাল।

“ইনি? ইনি আমার বন্ধু। খুব ভালো মানুষ। তোমার ছেলে কেন মারা গেল সেটা ইনিই খুঁজে বার করছেন।”

“খুঁজে আর কী হবে? আমি জানি। যবে থেকে ও গংসিদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছিল, আমি জানতাম একদিন ওর এই অবস্থা হবে। এই চিনেরা কারও বন্ধু হয় না সাইগার, কারও না। আমি পুলিশকে সব বলিনি। তোমাদের বলছি। না বললে শান্তিতে মরতেও পারব না”, বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল জর্জ।

খানিক বাদে নিজেই বলতে শুরু করল, “শার্লটকে আমি চিনি অনেক ছোটো থেকে। ওর মা ল্যাম্বেথ ওয়ার্ক হাউসে কাজ করত। বাবা ছিল না। ছোট্ট শার্লি মায়ের সঙ্গে যেত ওখানে। হপ্তায় আঠেরো সেন্ট রোজগার। তাতেই মা-মেয়ের চলত। আমার প্রতিবেশী ছিল ওরা। ব্র্যাডফোর্ড স্ট্রিটে আমাদের পাশেই দুই কামরার একটা ঘুপচি ঘরে ভাড়া থাকত দুজন। সেবার খুব ঠান্ডা পড়েছিল। শার্লির মা মারা গেল। ড্রপসিতে। সারা দেহ ফুলে গেছিল। তখন শার্লি মাত্র পনেরো। ফুটফুটে ফুলের মতো। আমার বউও ওকে খুব ভালবাসত। শার্লি খুব কাঁদল। মেরির দয়া হল। মেরি অমনই ছিল। কারও দুঃখ সইতে পারত না। আমাদেরও ছেলেমেয়ে ছিল না। শার্লি আমাদের সঙ্গেই থাকতে লাগল। মেয়ের মতো। বিশ্বাস করো, আমি ওকে তখনও অন্য নজরে দেখিনি। তারপর একবার লোহার বিম পড়ে আমার পা ভাঙল। আমি ঘরে বসা। মেরি ল্যাম্বেথে কাজে যেত। ঘরে আমি আর শার্লি একা। ও আমায় খুব ভালোবাসত। পাপা, পাপা বলে ডাকত। একদিন দুপুরে… তারপর রোজ চলতে থাকল। মেরি বেরিয়ে গেলেই আমরা শুরু করে দিতাম। মেরি কোনও দিন সন্দেহটুকু করেনি। তারপর একদিন শার্লির পেটে বাচ্চা এল। মেরি ওকে খুব মারল। তাও শার্লি পেটের বাচ্চার বাবার নাম বলেনি। কিন্তু আমি তো জানতাম। শার্লিকে তাড়িয়ে দিল মেরি। ও আবার আগের বাসাতেই ফিরে গেল। আমি লুকিয়ে কিছু সাহায্য করতাম, যাতে মেরি জানতে না পারে।

হ্যারির জন্মের পর শার্লি অনেক চেষ্টা করেও কাজ পেল না। ল্যাম্বেথে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওখানে তো মেরি আছে। বাধ্য হয়ে দেহব্যবসায় নামল। আমি একেবারে চাইনি। কিন্তু কী-ই বা করার ছিল। হ্যারি বড়ো হতে লাগল। বড়ো আর অবাধ্য। এদিকে ব্র্যাডফোর্ড স্ট্রিট চওড়া করার জন্য আমাদের বস্তি উঠিয়ে দিয়ে ঠাঁই দিল বেকার স্ট্রিটের পাশে। এখনও ওখানেই থাকি। বেকার স্ট্রিটে আসার কিছুদিনের মধ্যেই যক্ষ্মাতে মেরি মারা গেল। ল্যাম্বেথের হাড়ভাঙা খাটুনি আর পোষাচ্ছিল না ওর। ভাবলাম এবার শার্লিকে বিয়ে করে সম্পর্কটা পাকা করে নিই। কিন্তু কপালে নেই। শার্লি ততদিনে লিন্ডসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। লিন্ডসে ছিল পাকা খুনে আর চোর। একটাই কাজের কাজ করেছিল, হ্যারিকে নিজের পদবিটা ব্যবহার করতে দিয়েছিল। কিন্তু দুচোখে দেখতে পারত না ওকে। রোজ মদ খেয়ে এসেই পেটাত। ততদিনে শার্লি আবার ল্যাম্বেথে ফিরে গেছে। লিন্ডসের মার খেয়ে ছেলে ভয়ে আমার কাছে লুকিয়ে থাকত। ডাকত গ্র্যান্ডপা বলে। তারপরেই লিন্ডসের ওই শয়তান জারজ ছেলেটা এসে উপস্থিত।”

“লিন্ডসের ছেলে?”

“হ্যাঁ, হোয়াইট চ্যাপেলের এক বেশ্যার পেটে লিন্ডসের একটা ছেলে ছিল। মা-টা খুন হয়ে যায়। ছেলে এসে শার্লিদের সঙ্গেই থাকতে শুরু করে। ছেলে তো না, স্বয়ং শয়তানের মূর্তি। ও আসার পরে হ্যারি বদলে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। কিছুদিন পরে শার্লি আর লিন্ডসেরও একটা ছেলে হয়। উইগিন্স। হ্যারিকে লিন্ডসের সেই জারজ ছেলে বোঝায়, এবার আর হ্যারির কদর থাকবে না। তার কথাতেই দুজনে মিলে গংসিদের দলে নাম লেখাল।”

“এই গংসি কারা?” প্রিয়নাথ শুধাল।

“চিনাদের গোপন দল। চিন থেকে পালিয়ে যেসব অপরাধী উদ্বাস্তুরা ব্রিটেনে আশ্রয় নিত, তারা ছোটো ছোটো অনেকগুলো গোপন সমিতি গড়ে তুলেছিল। এই সমিতিদের বলা হত টং। আর ব্রিটেনে যত টং ছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক ছিল গংসি। এরা খাঁটি চিনে ছাড়াও ব্রিটিশ, মালয়, মেক্সিকানদেরও নিত। যোগ্যতা একটাই। যে-কোনওরকম ঘৃণ্য অপরাধ করতে পিছপা হলে চলবে না। আর এদের দলে একবার ঢুকলে না মরা অবধি নিস্তার নেই। এদের নিজস্ব সাংকেতিক ভাষা ছিল। নাম ই-চিং। কাউকে খুন করবার আগে অত্যাচার করে মারত। তাকে বলত লিং-চি। এতে সারা দেহে আঘাত করে করে কষ্ট দিয়ে শেষে বুকে ছুরি বিঁধিয়ে হত্যা করা হত। হত্যার ঠিক আগে কেটে নেওয়া হত অণ্ডকোশ। দেহে ধারালো অস্ত্র দিয়ে লেখা হত চিহ্ন। এইসব এদের কাছে প্রায় ধর্মের মতোই ছিল। যেদিন লিন্ডসেকে ওইভাবে পড়ে থাকতে দেখলাম, সেদিন আর কেউ বুঝুক না বুঝুক আমি বুঝেছিলাম কে এই কাজ করেছে। আর কে করিয়েছে।”

“কে করিয়েছে?”

“লিন্ডসের সেই জারজ ছেলে। বাবাকে সহ্য করতে পারত না। তার মাকে বিয়ে না করে লিন্ডসে শার্লিকে বিয়ে করেছিল। সেই রাগ তো ছিলই। ও এসেছিল বাবাকে খুন করতে। কিন্তু নিজে করার সাহস ছিল না। হ্যারিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করল। হ্যারি চিরকালের বোকা। ফাঁদে পা দিল। লাভের লাভ কী হল? হ্যারিকেই পালাতে হল। আর শার্লি পাগল হয়ে বেডলামে ভরতি হল।”

“লিন্ডসের সেই ছেলেকে আপনি আর দেখেছেন?”

“লিন্ডসে মারা যাবার পরে আর দেখিনি। শুধু জেনেছিলাম কোনও এক ডাক্তারের অ্যাপোথেকারিতে সহকারীর কাজ করে। দেখলাম অনেক বছর বাদে। ইন্ডিয়াতে আসার আগে। হ্যারি একদিন আমার কাছে ওকে নিয়ে এল। বলল, গ্র্যান্ডপা, ও আমাদের সঙ্গে ইন্ডিয়া যাবে। খুব জরুরি দরকার। আমি অনেক মানা করেছিলাম জানেন? হ্যারি বলল, না। ও যাবেই। বেডলামে ও মায়ের খেয়াল রাখে। মাকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসত হ্যারি। কী লাভ হল? দুজনই প্রাণ হারাল।”

প্রিয়নাথ দস্তুরমতো চমকে উঠল, “তার মানে!!”

“হ্যাঁ, মায়ের পদবি ব্যবহার করত রিচার্ড। বাবারটা করতে নাকি ঘেন্না হয়। ওর মায়ের পদবি ছিল হ্যালিডে, সেটাই লিখত।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *