চতুর্থ পর্ব— ধোঁয়া, রক্ত, অন্ধ আঁধার
(প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের জার্নাল)
১।
কিছু ঘটনার অভিঘাত মনুষ্যজীবনে এমন গভীরভাবে দাগ কাটিয়া যায়, যাহা আমৃত্যু ভোলা অসম্ভব। এই সম্পূর্ণ তদন্তকালে যদি একটি এবং কেবলমাত্র একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করিতে হয় যাহা আমার মর্মমূল অবধি আতঙ্কের শিহরণ জাগাইয়া দিয়াছিল, তবে তাহা অবশ্যই সেই দিনের ঘটনা যেই দিন তারিণীর আপিসে যাইব বলিয়া আমি অতি প্রত্যুষে লালবাজার হইতে রওনা হইয়াছিলাম। আমি সাহিত্যিক নই। হইলে হয়তো সে ভয়াবহ দৃশ্যের সঠিক বর্ণনা আমার লেখনী দ্বারা সম্ভব হইত। শুনিয়াছি মৃত্যুকে অতি নিকট হইতে প্রত্যক্ষ করিলে তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ স্মৃতিতে অক্ষয় হইয়া থাকে। ইহা যে কেবলই মিথ্যা নয়, তাহা আজ এত বৎসর বাদে সেই গ্রীষ্ম প্রভাতের স্মৃতি রোমন্থন করিতে বসিয়া বিলক্ষণ টের পাইতেছি। নারকীয় ঘটনা গতকল্যই ঘটিয়াছে এমন বোধ হইতেছে।
তারিণী পূর্বাহ্নে আমার নিকট আসিয়া শৈলর রচিত একখানি নাটক দিয়া গিয়াছিল। আপাতদৃষ্টিতে উহা নিতান্ত নির্দোষ এক পালার ন্যায় প্রতীয়মান হইলেও তাহাতে হিলির নাম সহ এমন কিছু গোপন সূত্র ছিল যাহা ইংরাজ সরকারের পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ ব্যতীত কাহারও উপায়ে? উপরন্তু তারিণী জানাইল সে দুই দিবস হইল নিরুদ্দেশ। তাহাকে সামান্য ভাবিয়া বড়ো জানিবার প্রশ্নই উঠে না। শৈল এক সাধারণ পালাকার। তাহার নিকট এই সম্বাদ পৌঁছাইল কী ভুল করিয়াছিলাম। যেনতেনপ্রকারেণ তাহাকে খুঁজিয়া বার করিতেই হইবে। আমার বিশ্বাস বহু রহস্যের চাবিকাঠি লইয়া সে সকলের অগোচরে পুকাইয়া রহিয়াছে। তবে তাহার পূর্বে তারিণীর সহিত দ্রুত মিলিত হইতে হইবে। সমস্ত রাত্রি লালবাজারে আমার নিজস্ব কামরাটিতে নিদ্রাহীন অতিবাহিত করিয়া পরদিন প্রাতেই তারিণীর আপিসের উদ্দেশে বহির্গত হইলাম।
বাহিরেই সংবাদপত্র বিক্রেতার নিকট হইতে সবেমাত্র একখানি পত্রিকা খরিদ করিয়াছি, আমার কানে অদ্ভুত বিজাতীয় এক আওয়াজ প্রবেশ করিল। ‘চড়াৎ চড়াৎ’ সেই শব্দ কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত আমার দুঃস্বপ্নে হানা দিত। সম্মুখে দৃষ্টিপাত করিতেই আওয়াজের কারণ স্পষ্ট প্রতীয়মান হইল। কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানি কয়েক বৎসর যাবদ কলকাতার সড়কের প্রায় সকল গ্যাসবাতিকে প্রতিস্থাপিত করিয়া বিজলীবাতির বন্দোবস্ত করিয়াছে। কাজ সম্পূর্ণ শেষ হয় নাই, তবু কলিকাতার বারো আনা সড়কে সেই সময় উজ্জ্বল বিজলীবাতি দেখিতে পাওয়া যাইত। লালবাজারের উলটাদিকের বিজলীবাতিস্তম্ভের বাতি দুই দিবস হইল তড়িৎহীন হইয়া আছে। দুই দিবস পূর্বের প্রবল বর্ষণে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়াছে। এদিন প্রভাতে কিলবার্ন কোম্পানির দুই নেটিভ কর্মচারী আসিয়া কীসব করিতেছিল। এক ব্যক্তি লম্বা মই বাহিয়া এক উচ্চস্তম্ভে চড়িয়া দুইখানি কালো মোটা ছিন্ন তারকে জোড়া লাগাইবার চেষ্টা চালাইতেছিল। সেই ভয়ানক শব্দ লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম একখানি তার হইতে বিদ্যুৎঝলকের ন্যায় তড়িৎস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতেছে। মইয়ের উপরের কর্মচারীর আতঙ্কে দিশাহারা হইয়া লাফাইয়া উঠিল। আমি স্পষ্ট দেখিলাম, তাহার সঙ্গী তাহার পদতলের মইখানিতে এক রামধাক্কা মারিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। নিমিত্ত লোকটি তারের অন্য প্রান্তটি চাপিয়া ধরিল। উহাই তাহার কাল হইল। দুইখানি বিদ্যুতের তারের মধ্যে সে এক জীবন্ত তড়িৎবাহক। বিদ্যুৎ ভীমবেগে তার মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল। চড়াৎ, চড়াৎ শব্দ বাড়িয়া উঠিতেছে। তাহার দুই হস্তে অদ্ভুত কমলা হলুদ বর্ণের অগ্নি। যেন পাতালের হুতাশন। মই নিম্নে পতিত। দুইখানি তার ধরিয়া ঝুলিয়া একজন মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হইতেছে। আমি এতটাই বিহবল হইয়া গিয়াছিলাম যে আমার কোনও বুদ্ধি সেই মুহূর্তে কাজ করিতেছিল না। পুতুলের ন্যায় দণ্ডায়মান হইয়া আমি শুধু ঊর্ধ্বপানে চাহিয়া দেখিতেছিলাম। আমার ন্যায় সেই রাজপথে আরও কিছু মনুষ্য, পালকি, ঘোড়ার গাড়ি, লাল পাগড়ি দেশীয় কনস্টেবল আপনাপন কর্মে যাইতেছিল। সবাই যেন সেই দৃশ্যে চিত্রার্পিত হইয়া স্তব্ধ হইয়া গেছে। কোনও এক নরকের শয়তান যেন তাহার জাদুদণ্ড সঞ্চালনে আমাদের সকলকে স্থির করিয়া দিয়াছে এক মুহূর্তে। শহরের কোলাহলও যেন কমিয়া প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে। অবাক বিস্ময়ে সকলে দেখিল ঝুলন্ত লোকটির মুখ খুলিয়া গেল। সেই হাঁ মুখ হইতে ঝলকে ঝলকে নির্গত হইতেছে লেলিহান নীল আগুনের শিখা। তাহার মোটা চটের পোষাক দাউদাউ করিয়া জ্বলিতেছে। তাহার মস্তক ঝুলিয়া পড়িয়াছে। দেহ বেতসপত্রের ন্যায় দোদুল্যমান। দুই হাত তবু তারের দুই প্রান্ত চাপিয়া ধরিয়া আছে। ভুল বলিলাম। তড়িৎ তাহাকে মুক্তি দিতেছে না। ঊর্ধ্বাকাশে ঝুলন্ত প্রভু যীশুর ন্যায় তাহার সেই মূর্তি আমি ভুলিব না। চারিদিকে চামড়া, আর মাংসপোড়া গন্ধ। তাহার পোষাক, চামড়ার পোড়া টুকরো যখন মাটিতে পড়িতে লাগিল তখনও সকলে চুপ। ইহার অব্যবহিত পরেই সেই ব্যক্তির শোণিতধারা তীব্রবেগে বাহির হইয়া নীচে দণ্ডায়মান এক শিশুকে আবিষ্ট করিল।
এইবার সমবেত জনগণ উন্মাদের ন্যায় চিৎকার আর পলায়ন আরম্ভ করিল। ল্যান্ডোর ঘোড়া লাফাইয়া এক পথচারীর ঘাড়ে উঠিল, পালকি বেহারারা। বেগতিক দেখিয়া ছুটিয়া পলাইতে গিয়া এক ছ্যাকরা গাড়ির সহিত সংঘর্ষ বাধিল। সকলেই পলাইতে চায়। কে কাহার পদতলে পিষ্ট তাহার পদতলের মইখানিতে এক রামধাক্কা মারিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। নিমিত্ত লোকটি তারের অন্য প্রান্তটি চাপিয়া ধরিল।
উহাই তাহার কাল হইল। দুইখানি বিদ্যুতের তারের মধ্যে সে এক জীবন্ত তড়িৎবাহক। বিদ্যুৎ ভীমবেগে তার মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল। চড়াৎ, চড়াৎ শব্দ বাড়িয়া উঠিতেছে। তাহার দুই হস্তে অদ্ভুত কমলা হলুদ বর্ণের অগ্নি। যেন পাতালের হুতাশন। মই নিম্নে পতিত দুইখানি তার ধরিয়া ঝুলিয়া একজন মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হইতেছে। আমি এতটাই বিহবল হইয়া গিয়াছিলাম যে আমার কোনও বুদ্ধি সেই মুহূর্তে কাজ করিতেছিল না। পুতুলের ন্যায় দণ্ডায়মান হইয়া আমি শুধু ঊর্ধ্বপানে চাহিয়া দেখিতেছিলাম। আমার ন্যায় সেই রাজপথে আরও কিছু মনুষ্য, পালকি, ঘোড়ার গাড়ি, লাল পাগড়ি দেশীয় কনস্টেবল আপনাপন কর্মে যাইতেছিল। সবাই যেন সেই দৃশ্যে চিত্রার্পিত হইয়া স্তব্ধ হইয়া গেছে। কোনও এক নরকের শয়তান যেন তাহার জাদুদণ্ড সঞ্চালনে আমাদের সকলকে স্থির করিয়া দিয়াছে এক মুহূর্তে। শহরের কোলাহলও যেন কমিয়া প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে। অবাক বিস্ময়ে সকলে দেখিল ঝুলন্ত লোকটির মুখ খুলিয়া গেল। সেই হাঁ মুখ হইতে ঝলকে ঝলকে নির্গত হইতেছে লেলিহান নীল আগুনের শিখা। তাহার মোটা চটের পোষাক দাউদাউ করিয়া জ্বলিতেছে। তাহার মস্তক ঝুলিয়া পড়িয়াছে। দেহ বেতসপত্রের ন্যায় দোদুল্যমান। দুই হাত তবু তারের দুই প্রান্ত চাপিয়া ধরিয়া আছে। ভুল বলিলাম। তড়িৎ তাহাকে মুক্তি দিতেছে না। ঊর্ধ্বাকাশে ঝুলন্ত প্রভু যীশুর ন্যায় তাহার সেই মূর্তি আমি ভুলিব না। চারিদিকে চামড়া, আর মাংসপোড়া গন্ধ। তাহার পোষাক, চামড়ার পোড়া টুকরো যখন মাটিতে পড়িতে লাগিল তখনও সকলে চুপ। ইহার অব্যবহিত পরেই সেই ব্যক্তির শোণিতধারা তীব্রবেগে বাহির হইয়া নীচে দণ্ডায়মান এক শিশুকে আবিষ্ট করিল।
এইবার সমবেত জনগণ উন্মাদের ন্যায় চিৎকার আর পলায়ন আরম্ভ করিল। ল্যান্ডোর ঘোড়া লাফাইয়া এক পথচারীর ঘাড়ে উঠিল, পালকি বেহারারা। বেগতিক দেখিয়া ছুটিয়া পলাইতে গিয়া এক ছ্যাকরা গাড়ির সহিত সংঘর্ষ বাধিল। সকলেই পলাইতে চায়। কে কাহার পদতলে পিষ্ট হইল কে তাহার খবর রাখে? কিন্তু এই সমস্ত কোলাহল ছাপাইয়া এক অদ্ভুত উন্মাদের ন্যায় হাস্য আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। কেহ যেন অদ্ভুত আমোদ পাইয়াছে, এমনভাবে হাসিতেছে। কে এই নরাধম? একবার হাসির আওয়াজের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেই বুঝিতে বাকি রহিল না। এ সেই কর্মচারীর সঙ্গীটি। দুই হস্ত কোমরে স্থাপন করিয়া প্রাণপণে হাসিতেছে। সে হাসির বিরাম নাই। হাসিতে হাসিতে সে পেট চাপিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল। আমি ততক্ষণে নিজজ্ঞানে ফিরিয়াছি। সামনেই এক বেহারী লাল পাগড়ি কনস্টেবল মোতায়েন ছিল। তাহাকে বলিলাম, “জলদি চলো।” সেই ব্যক্তির নিকটে গিয়া দেখি সে হাসিতে হাসিতে ভূমিতে লুটাইয়া পড়িয়াছে। চক্ষে অদ্ভুত এক দৃষ্টি, যেমনটি কয়েক বৎসর পূর্বে ডালান্ডা হাউসের কয়েদীদের দৃষ্টিতে দেখিয়াছিলাম। ভাবলেশহীন। নির্বাক। হাসিতে হাসিতে তাহার দম বাহির হইয়া যাইতেছে। মুখগহ্বর হইতে ফেন নির্গত হইতেছে। তবু সে হাসিতেছে। কনস্টেবল তাহাকে ধরিতে গেলে সে বাধাদানের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করিল না। ইতিমধ্যে আরও দুইজন কনস্টেবল আসিয়া উপস্থিত। আমি তাহাদের নির্দেশ দিলাম ইহাকে বন্দি করিয়া আপাতত ফাটকে রাখিতে। স্খলিতপদে এই ব্যক্তি যখন লালবাজারের উদ্দেশে যাইতেছে, তখনও তাহার হাসি থামে নাই।
বিদ্যুতের স্তম্ভের দিকে চাহিতেই আমার নিকট গোটা ঘটনা স্পষ্ট হইল। স্তম্ভের ঠিক নিম্নে একখানি বিদ্যুতের হাতল থাকে। যাহা নামাইয়া রাখিলে তার দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় না। স্তম্ভে উঠিবার পূর্বে হাতলটি নামাইয়া রাখাই ব্যক্তির দস্তুর। কিন্তু স্পষ্ট দেখিলাম হাতল নামানো নাই। নিশ্চিতভাবে মৃত সঙ্গীই এই দুষ্কর্মটি সাধন করিয়াছে। কিন্তু কেন? কিছুদিন পূর্বে হইলেও আমি পুরাতন রাগ, প্রতিহিংসা ইত্যাদি ভাবিতাম। খিদিরপুরের ঘটনাও আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি নাই। কিন্তু আজ ওই খুনির যে দশা দেখিলাম তাহা অভূতপূর্ব। একমাত্র কাহারও উপরে ভূতে ভর করিলেই সে এমন করে শুনিয়াছি। এদিকে শৈলর লিখিত নাটক আমাকে পরম বিস্মিত করিয়াছে। তবে কি হিলির ভূতের বাস্তব অস্তিত্ব রহিয়াছে? তাহা হইতেও বড়ো প্রশ্ন, সেই ভূত কি অবশেষে মুক্তি পাইয়াছে?
চারিদিকে ধোঁয়া, জ্বলন্ত শবের গন্ধ। ঝুলন্ত অবস্থায় সেই পোড়া কাঠের ন্যায় শব এখনও তড়িতের আবেশে মধ্যে মধ্যে নাচিয়া নাচিয়া উঠিতেছে। এ দৃশ্য সহ্য করা যায় না। আমি খানিক সভয়েই আগুয়ান হইয়া সেই বিদ্যুতের হাতল লইয়া ঠেলিয়া নামাইয়া দিলাম। ধপ করিয়া আওয়াজে আমার ঠিক সম্মুখেই কৃষ্ণবর্ণের সেই বস্তুটি পড়িল। ইহাকে মনুষ্যদেহ বলিয়া চিহ্নিত করা অসম্ভব। আমি আমার চাকুরীজীবনে বহু মৃত্যু, বহু হত্যা দেখিয়াছি। চিনাপাড়ায় সেই সাহেবের মৃতদেহ দেখিবার পর ভাবিয়াছিলাম আমার নূতন কিছু দেখিবার নাই। কিন্তু পরম করুণাময় ঈশ্বর আমার প্রতি বড়োই অকরুণ। উনি এমন মৃত্যু প্রত্যক্ষ করিতে বাধ্য করিলেন।
আমার তখনও হতভম্ব ভাব কাটে নাই। মেডিক্যাল কলেজের দিক হইতে একখানি দামী ল্যান্ডো আসিয়া ঠিক আমার সমুখেই দাঁড়াইল। দরজা খুলিয়া যিনি লাফাইয়া নামিলেন তাঁহাকে দিন দুই পূর্বেই চুঁচুড়ায় দেখিয়াছিলাম। উনি এই স্থলে কী করিতেছেন?
“আপনার সন্ধানেই আসিয়াছি। দ্রুত এই গাড়িতে উঠিয়া আসুন। মেডিক্যাল কলেজ যাইতে হইবে। তারিণী ওই হাসপাতালেই ভর্তি। গতকল্য উহাকে কেউ খুন করিবার প্রচেষ্টা করিয়াছে। অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। উহাকে বাঁচাইতেই হইবে। নহিলে অনর্থ।”
আমি কিছু বুঝিবার পূর্বেই সাইগারসন সাহেব প্রায় ঠেলিয়াই আমায় গাড়িতে প্রবৃষ্ট করাইলেন।
২।
“এ তো প্রায় মেরে এনেছে হে। আমি কী করব?”
মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। ইদানীং মেডিক্যাল কলেজে আসেন না বিশেষ। প্রিয়নাথকে বিশেষ স্নেহ করেন। তাঁর শিষ্য গোপালচন্দ্র দত্তের সঙ্গে বছর চারেক আগে পরিচয় হয়েছিল প্রিয়নাথের। এখন তিনিই সর্বেসর্বা। তিনিই প্রিয়নাথের কথা বলে মহেন্দ্রলালকে ডেকে এনেছেন।
তারিণীর মাথার ডানদিকে গভীর ক্ষত। কেউ লোহার ডান্ডা বা ওই জাতীয় দিয়ে সজোরে আঘাত করেছে। আর-একটু জোরে মারলেই মাথা ফেটে দুইভাগ হয়ে যেত। প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে। এখন ক্ষতস্থানে ভালো করে। আয়োডিন, ব্রোমাইড আর পারার ক্কাথ মলমের মতো লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। জ্ঞান নেই। ফিভার হাসপাতাল থেকে ডাক্তার গুডিস এসেছেন। তিনি বলেছেন দু ড্রাম অ্যামোনিয়া, দু ড্রাম ল্যাভেন্ডার আর কর্পূর মিশিয়ে পুলটিস দিতে। সঙ্গে দিনে তিনবার দু গ্রেন ক্যালোমেল। ক্রমাগত বিড়বিড় করে কী যেন বলছে তারিণী। সাইগারসন ইঙ্গিতে প্রিয়নাথকে দরজার বাইরে ডেকে নিলেন।
“ওঁকে এখানে কে ভরতি করল সাহেব?” প্রিয়নাথ জিজ্ঞেস করল।
“আমিই। কাল অনেক রাতে।”
“আপনি কাল কলকাতায় এসেছেন? কেন?”
“তারিণীর সঙ্গে দেখা করতে। কাল দুপুরে ট্রেনে চেপে চুঁচুড়া থেকে এসেছি। এসেই প্রথমে গেলাম তারিণীর আপিসে। দেখি তালাবন্ধ। সেখান থেকে হোটেল। হোটেলে ডিনার সেরে রাতে আবার তারিণীর আপিসে আসি। ও ফিরল কি না দেখতে। এসে দেখি দরজা খোলা। তারিণী দরজার পাশেই পড়ে ছিল। অজ্ঞান। আমিই একটা গাড়ি ডেকে ওকে মেডিক্যাল কলেজে ভরতি করিয়েছি। ডাক্তার দত্ত তো ছিলেনই। তখন প্রায় যমে মানুষে টানাটানি। আজ সকালে অবস্থা একটু ভালো হতেই আপনাকে ডেকে আনতে যাই।”
“কিন্তু আপনিই বা সাততাড়াতাড়ি তারিণীকে খুঁজতে এলেন কেন? কিছু আন্দাজ করেছিলেন?
“আপনার কাছে খবরটা আসেনি তাহলে।”
“কী খবর?”
“চুঁচুড়ায় তারিণীর বাড়ি আছে জানেন তো?”
“হ্যাঁ। ও বলেছিল বটে।”
“বাড়ির নাম জানেন?”
“জানি না।”
“CONCORDIA। এবার কিছু বুঝলেন?”
“না সাহেব।”
“কনকরডিয়া রোমের দেবী। ঐক্যের দেবী। যিনি সবাইকে এক নীতিতে, এক আইনে বেঁধে রাখেন। ফ্রিম্যাসনরা শুরু থেকেই এই দেবীকে খুব মানত। বিশ্বাস করত কেউ কনকরডিয়ার আইন ভাঙলে তার শাস্তি হয়। শাস্তি দেন জাবুলন নিজে। একেবারে প্রাচীনকালে ফ্রিম্যাসনদের অনুষ্ঠান শুরু হত এই দেবীর আরাধনা দিয়ে। তাতে একটাই বাদ্যযন্ত্র বাজত। কী বলুন তো?”
“জানি না।”
“অ্যাকর্ডিয়ন। এর দুটো কারণ। একে তো গোটা অ্যাকর্ডিয়ন একসঙ্গে বাজে। একসঙ্গে খোলে আর বন্ধ হয়। কনকরডিয়ার ঐক্যের মতো। তবে আসল কারণটা অন্য। সেটা আমি ভেবে বার করেছি।”
“কী সেটা?”
সাইগারসন পকেট থেকে ছোট্ট একটা নোটবই বার করে বড়ো বড়ো করে লিখলেন CONCORDIA। এবার অক্ষরগুলো একটু উলটেপালটে দিলেন-ACCORDION
“চুঁচুড়ার এই বাড়ি এককালে ফ্রিম্যাসনদের ঘাঁটি ছিল। ডাচ ফ্রিম্যাসনদের শুরু এখান থেকেই। ডাচ শাসক ভার্নেৎ নিজে ফ্রিম্যাসন ছিলেন। তিনিই চুঁচুড়ায় প্রথম ম্যাসনিক লজ স্থাপন করেন। এই সেই কনকরডিয়া। পরে ইংরেজরা চুঁচুড়ার দখল নিলে এই বাড়ির হাতবদল হয়। তখন তারিণীরা এই বাড়ি পেয়েছে। ও নিজেও ব্রাদারহুডের সদস্য। সেটা তো জানেনই।”
“তা তো জানি। কিন্তু এর সঙ্গে…”
“যেটা সেদিন আপনাদের বলেছিলাম। ব্রাদারহুড একেবারে শান্তিপ্রিয় হলেও জাবুলন তা না। ফ্রিম্যাসনদের মধ্যে যিশুর বাণী প্রবেশের পর তারা অহিংসায় বিশ্বাস করা শুরু করেছে। কিন্তু জাবুলনরা এখনও প্রাচীন রোমের কায়দায় শাস্তি দিতে পছন্দ করে।”
“সেটা কেমন?”
“ফ্রিম্যাসনদের এই চরমপন্থী দলের শুরু করেন অরিজেন নামের এক সাধু। নিজেকে ঈশ্বর ভাবতেন তিনি। নিজের পাপ স্খলন করতে নিজের হাতে নিজের অণ্ডকোশ কেটে ফেলেন। এখনও তাঁর উদাহরণ দেওয়া হয়। এই অরিজেন জাবুলনদের কাছে যিশুর সমান। কিংবা তাঁর চেয়েও বড়ো। কেউ বেইমানি করলে জাবুলনরা তাকে শাস্তি দেয়।”
“কীভাবে?”
“ঠিক যেভাবে অরিজেন নিজেকে শাস্তি দিয়েছিলেন। অণ্ডকোশ কেটে দেয়। হত্যা করে। তারপর সেই কাটা অণ্ডকোশ তার মুখে পুরে দেয়। তাদের বিশ্বাস এতে পরকালে গিয়েও সে কথা বলতে পারে না।”
“কিন্তু এত কিছু আপনি জানলেন কী করে?”
“গত পরশু চুঁচুড়ায় আমার কাছে এক আগন্তুক এসেছিল। তাকে দেখেনি। দারোয়ান তাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। কিন্তু সে বলে সে তারিণীর বন্ধু। আমি তাকে ঢুকতে দিয়েছিলাম। লোকটি আমাকে কিছু অদ্ভুত তথ্য দেয়। বলে সে রাজভক্ত আর ইংরাজ সরকারের ভয়ানক বিপদ আসতে চলেছে। আমি যদি তাকে সহায়তা করি সে ইংরাজ সরকারকে রক্ষা করতে পারবে।”
“তারপর?”
“আমি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম, ও আমার কাছে এল কেন? খোঁজই বা পেল কী করে? সে জানায় সে নাকি লুকিয়ে তারিণীর ডায়রি পড়ে আমার উল্লেখ পেয়েছে। চার বছর আগেকার যে ঘটনা কলকাতায় খুব বেশি লোকের জানার কথা না, তা সে জানে। জানে ইংরেজ সরকারে আমার প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। শুনলাম আপনি যখন তারিণীর আপিসে গিয়ে তারিণীকে চুঁচুড়ায় আমার ঠিকানা দেন, সেই সময় সেই ঘরে সে উপস্থিত ছিল। তারিণী ঠিকানা লেখা কাগজটা টেবিলে রেখেই বাইরে বেরিয়ে যায়। এই লোকটি বোঝে আমি চুঁচুড়ায় এসেছি। কিন্তু তারিণী আসার আগে ইচ্ছে করে আসেনি। তাতে তার কাজের ক্ষতি হত।”
“আপনি তার কথায় বিশ্বাস করলেন?”
“প্রথমে করিনি। তারপর সে বলল কারা এর পিছনে আছে সে জানে।”
“কারা?”
“জাবুলন।”
“বলেন কী? এই লোকটি নিজের নাম বলেছে? শৈলচরণ সান্যাল কি?”
“হ্যাঁ। তারপর সে আমায় জাবুলন নিয়ে কিছু গোপন কথা জানায়। সেগুলো তো আমি আপনাকে বললামই। কিন্তু এতটুকুই। আমি জাবুলনের সদস্যদের নাম জানতে চাই। বলেনি।”
“কেন?”
“শৈলচরণ বলে ওর কাছে সব প্রমাণ আছে। ও সব বলবে। কিন্তু তার আগে ওর প্রচুর টাকা চাই। প্রচুর।”
“প্রচুর মানে কত?”
“পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড।”
“বলেন কী?” চমকে উঠল প্রিয়নাথ।
“আমিও ওকে তাই বললাম। ও জানাল ওর কাছে খবর আছে সেই তুলনায় এই পরিমাণ নাকি কিছুই না। ইংরেজ সরকার যদি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চায় তবে এই টাকাটা ওকে দিতেই হবে।”
“আপনি রাজি হলেন?”
“আমি সময় চাইলাম। পনেরো দিন। আমাকেও তো টেলিগ্রাফে লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।”
“সে কী বলল?”
“বলল সময় বেশি নেই। বেশি দেরি করলে সে অন্য উপায় দেখে নেবে। তার সঙ্গে নাকি অনেকেই যোগাযোগ করেছে। আর সে ব্যবস্থাও নাকি আগেই সে করে এসেছে।”
“আর কিছু বলল?”
“আর বলল, সে যে এসেছিল, সেটা যেন তারিণী ঘুণাক্ষরে না জানতে পারে। তারিণীকে জানালে সে আর একটা কথাও বলবে না।”
“বুঝলাম। তাহলে আপনি কাল তারিণীর খোঁজে এসেছিলেন কেন?”
“আমার মনে হচ্ছিল তারিণীর এবার কোনও ভয়ংকর বিপদ হতে পারে। প্রাণসংশয় অবধি। আমায় ওকে জানাতেই হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
“কিন্তু কেন?”
সাইগারসন এতক্ষণ দরজা দিয়ে বেডে শুয়ে থাকা তারিণীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওহ। এতক্ষণে আসল কথাটাই বলা হয়নি। কলকাতায় খবরটা আসেনি এখনও। কাল খুব ভোরে তারিণীর বাড়ির সামনে কেউ সেই শৈলচরণকে খুন করে রেখে গেছে। পেট চিরে দুইফালা। অণ্ডকোশ কেটে মুখে পুরে দিয়েছে।”